একটা ব্যক্তিগত কাজ সেরে বাসে করে বারাসাত থেকে নৈহাটি ফিরছিলাম। ফেব্রুয়ারি মাস। সূর্যাস্তের পরও যেমন সূর্যের আলো পৃথিবী মেখে থাকে, তেমনই শীতও যেন যাই যাই করেও এই মফস্সল শহরের গায়ে পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে। কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের এই রুট আমার বড়ো পছন্দের। দু-দিকে সুন্দর সবুজ গাছের সমারোহ, বাস চলতে চলতে হঠাৎ যখন দাঁড়িয়ে পড়ে দেখি সামনে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে, বাস স্ট্যান্ড বলে বেশিরভাগ জায়গাতেই কিছুই নেই, আর এই রুটের যাত্রীরাও আধা গ্রাম্য পরিবেশের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে গ্রাম্য ছাপের মানুষ।
“ম্যাডাম একটু সরে বসবেন?”
হালকা ঠান্ডায় আমার একটু ঝিমুনি লেগে গিয়েছিল। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি একজন ভদ্রলোক, বয়স পঁচিশও হতে পারে আবার পঁয়ত্রিশও হতে পারে, কালো জামা পরা, এই বিকেলেও চোখে কালো রঙের সানগ্লাস, আমার পাশের সিটে বসে আমাকে আরও একটু জানালার দিকে সরতে বলছেন। আমিও একটু সরে বসলাম।
বাস চলতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে ওই ভদ্রলোকের মোবাইল বেজে উঠল। উনি নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠলেন, “রক্ত দালালটাকে নিয়ে আর পারা গেল না।”
আমি ‘রক্ত দালাল’ এই কথাটা শুনে ওর দিকে তাকালাম। কালো সানগ্লাসে চোখ ঢাকা, কোনদিকে তাকিয়ে আছেন বোঝা দায়। তবে আমাকে দেখে মুচকি হাসলেন যখন, তখন বুঝলাম দৃষ্টি আমার দিকেই। ওদিকে মোবাইল বেজেই চলেছে। ভদ্রলোক পকেট থেকে ফোনটা বার করে কানে দিলেন। আমি ওদিকের কিছু আর শুনতে পাচ্ছিলাম না। তবে ওঁর কথাগুলো সবই আমার কানে আসছিল। আমি বাইরের দিকে উদাসীনভাবে তাকিয়ে থাকার ভান করতে করতে সব শুনছিলাম, আর তাজ্জব হয়ে যাচ্ছিলাম।
ভদ্রলোক একটু উত্তেজিত হয়ে বলছিলেন, “দাদা, আপনাকে তো আগেও বলেছি, সরকারি হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের রক্তের টেস্ট মানে ইয়ে কাজ ভালো হয় না, আপনি একটু ডোনার খুঁজে দিন।”
…
“না না, টাকাপয়সা নিয়ে কোনও চিন্তা করবেন না, কাজটা নির্বিঘ্নে হয়ে যাওয়া নিয়ে কথা।”
তারপর একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, “কী বললেন? বয়স? হ্যাঁ, তা চল্লিশের মধ্যে হলেই ভালো।”
এইসব কথা শুনতে শুনতে আমার ঘুম ছুটে গেল। ইতিমধ্যেই উনি কথা বলা শেষ করে ফোনটা পকেটে রাখলেন। খেয়াল করলাম, ওঁর হাত দুটো ভীষণ শুকনো। চামড়া শুকনো পাতার মতো বিবর্ণ হলুদ। হঠাৎ দেখলে মনে হবে জন্ডিস হয়েছে। হাতের নখগুলো বিচ্ছিরি রকমের কালচে আর লম্বা। আমি অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকাতেই উনি আদন্ত বিকশিত হাসি হাসলেন। আর ঠিক তখনই খেয়াল করলাম, ওঁর দাঁতগুলো পুরো হলুদ আর শ্বদন্ত দুটো যেন বেমানান ধরনের বড়ো।
আমি এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে ওঁর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, “ভয় পাবেন না, আমি আপনাদের থেকে একটু আলাদা।”
আমি বিস্মিত হয়ে নিজের অজান্তেই জিজ্ঞাসা করে ফেললাম, “মানে?”
উনি বললেন, “মানে ওই আর কী, সিনেমা দেখেন?”
আমি উত্তরে শুধু ঘাড় নাড়লাম। উনি বললেন, “ভূতের বা ভ্যাম্পায়ারের সিনেমা দেখেছেন?”
আমার মুখ থেকে অস্ফুটে একটা শব্দ হল, “ড্রাকুলা।”
ভদ্রলোক (যদিও ওঁকে ভদ্রলোক বলা যায় কি না তা নিয়ে আমার মনে সংশয় আছে) ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “এই আপনারা ভুল করেন। ভ্যাম্পায়ার আলাদা আর ড্রাকুলা আলাদা।”
আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, “তাতে কী? কাজ তো একই করে, মানে মানুষের রক্ত চোষে।”
উনি তখন দু-দিকে ঘন ঘন মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “না না, সব ভ্যাম্পায়ারকে একই পর্যায়ে ফেলবেন না। আমরা সকলে কিন্তু ওরকম নই।”
চলন্ত বাসে বাজ পড়লেও বুঝি আমি এত অবাক হতাম না। আমি আতঙ্কিত ও মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তার মানে আপনি…”
আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই নির্লিপ্ত মুখে বললেন, “হ্যাঁ, তা বলতে পারেন।”
বাসের মধ্যে লোকজন বেশ কম। যাও-বা আছে একটু দূরে দূরে বসা। আমি এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে চিৎকার করতেও ভুলে গিয়েছিলাম। আমার বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে উনি তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, “ম্যাডাম, চিন্তা করবেন না। আপনি যেমন ভাবছেন তেমন কোনও কিছুই হবে না।”
আমার তখন মরিয়া অবস্থা। আমি কিঞ্চিৎ রেগে গিয়ে বললাম, “কী হবে না? দিনেদুপুরে ইয়ার্কি করার জায়গা পান না? হয় আপনি পাগল, আর তা না হলে মিথ্যাবাদী।”
ভ্যাম্পায়ার ভদ্রলোক আমাকে অনুনয়ের সুরে বললেন, “আমাদের কথা শোনার মতো কেউ নেই। প্লিজ আমাকে একটু বোঝবার চেষ্টা করুন।”
আমি কিঞ্চিৎ রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনাদের মানে? আপনাদের দলে ক’জন আছে?”
“আমি মিথ্যাবাদী নই। এখন সংখ্যায় খুব কমই আছি আমরা। আপনি যেমন ভাবছেন আমরা কিন্তু তেমন নই। মানে মানুষের ঘাড়ে চেপে রক্ত শুষে খাই না। আমি আমার ব্যাপারটাই বলি, কিন্তু আপনি ভয় পাবেন না। একা একা থাকি, মনের কথা কাউকেই বলতে পারি না। সবাই আমাদের ভয় পায়।”
“সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?”
“আসলে আমি তো একজন দালাল ঠিক করে রেখেছি, সে আমাকে রক্ত সাপ্লাই দেয়। বছর চল্লিশের মধ্যের বয়সের মানুষের রক্ত পেলে বেশ টেস্ট লাগে। তার চেয়ে বেশি বয়সের মানুষের রক্ত যে পান করি না তা নয়, কিন্তু মানুষকে ভয় দেখিয়ে তার ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে রক্ত পান করাটা অমানবিক ও গর্হিত অন্যায় কাজ।”
আমি ওঁর দিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে। কোনও কালে কেউ এসব শুনেছে? আমার চোখে তখন ভেসে উঠছে টিমুর বেকম্যামবেটভ-এর ‘অ্যাব্রাহাম লিঙ্কন ভ্যাম্পায়ার হান্টার’ সিনেমাটির একটা দৃশ্য—নখ-দাঁত বার করে বীভৎস চেহারায় ভ্যাম্পায়ারটি ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে। আমি কল্পনাও করতে পারছিলাম না যে আমি ড্রাকুলা-ভ্যাম্পায়ার মাত্রই এত ভয় পাই, সেই আমি একটি ভ্যাম্পায়ারের পাশে বসে!
“কী আর করব ম্যাডাম, একা একাই থাকি, আমার বয়স তো আর কম হল না। তা প্রায় নয়শো বছর। এতদিন ধরে বেঁচে থাকাটাই তো যন্ত্রণার। এই চোখে কত কী না দেখলাম। আমার পরিবার ছেড়ে কবেই চলে এসেছি। নিঃসঙ্গ একা জীবনযাপন করতে বড়ো কষ্ট হয়।আজ মনটা সকাল থেকেই বড়ো খারাপ। শপিং মলে নিজের মনেই ড্রেস পছন্দ করছিলাম, আমাদের চেহারার প্রতিফলন আয়নায় পড়ে না, তো একজন সেলস গার্ল আয়নায় শুধু পোশাকগুলো অদৃশ্যে ভাসতে দেখে ভয়ে চিৎকার শুরু করে দিল। আমিও কৌশলে ওখান থেকে পালালাম। পাবলিকের হাতে পড়লে আর দেখতে হত না, পিটিয়ে পাটিসাপটা বানিয়ে দিত।”
আমি রেগে গিয়ে বললাম, “কেন ইয়ার্কি করছেন? এত বছর কোনও প্রাণী বাঁচতে পারে? আর আপনি যদি ভ্যাম্পায়ারই হবেন তবে শপিং মল থেকে বাদুড় হয়ে উড়ে পালিয়ে গেলেই হত! হুহ্, আজ পয়লা এপ্রিল নয়।”
এ-কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আমি ব্যাগ থেকে মোবাইল বার করে ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করলাম। ক্যামেরা ধরে ওর দিকে তাক করলাম। অবাক কাণ্ড, সত্যিই তো আমার পাশে বসা ভদ্রলোককে ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে না, পাশের সিট বিলকুল খালি!
ফেব্রুয়ারি মাসের বিকালে আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল। হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ এত জোরে হচ্ছিল, মনে হল এ আওয়াজ বাস চলার শব্দ ছাপিয়ে ড্রাইভার ও কন্ডাক্টরের কানে গিয়ে পৌঁছাবে। কিন্তু এগুলোর কোনোটাই হল না, উলটে দেখলাম আমার পাশে বসা ভ্যাম্পায়ার ভদ্রলোকটি অপরাধী মুখে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি কিছু বলবার আগেই মাথা ঝুঁকিয়ে নীচু স্বরে বললেন, “সরি ম্যাডাম, আমার জন্য আপনি ভয় পেলেন, আমি খুবই দুঃখিত ও লজ্জিত।”
ভ্যাম্পায়ারটি তখনও বলেই চলেছেন, “আমি চেষ্টা করি কম রক্ত পান করতে। শরীরে হিমোগ্লোবিন বাড়ায় এরকম খাবার বেশি খাই। তবুও শারীরবৃত্তীয় কারণে মানুষের রক্ত একটু খেতেই হয়, তার জন্য আমি খুবই অপরাধবোধে ভুগি।”
আমি মনে মনে নিজেকে তখন বোঝাচ্ছিলাম, যা হওয়ার হবে, আমার তো এমনিও কিছু করার নেই। উনি আমার ঘাড়ে দাঁত বসালেই সব শেষ। কিন্তু উনি নিজের সম্বন্ধে যা বলছিলেন, তাতে আমার ভীষণ কৌতূহল তৈরি হল। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা তো নোংরা, অন্ধকার, পরিত্যক্ত জায়গায় থাকতে পছন্দ করেন।”
উনি ঘন ঘন দু-দিকে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “না না, আমি নোংরা কিছুতেই সহ্য করতে পারি না। ভারত সরকারের স্বচ্ছ ভারত অভিযানের ভীষণরকম পক্ষে আমি।”
আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ভ্যাম্পায়ার সম্বন্ধে আমার প্রচলিত ধ্যান-ধারণা দ্রুত বদলে যাচ্ছিল।
“আপনারা তো রসুন খুব ভয় পান। আমি ব্রাম স্টোকারের বইতে পড়েছি।”
খুব মজা পেয়ে হাসতে হাসতে উনি বললেন, “আরে না, ওসব বানানো কথা। আমি তো পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া খেতেই পারি না। আমিনিয়ার চিকেন চাপ আমার ভীষণ পছন্দের।”
আমি আরও একবার হোঁচট খেলাম। সত্যি বলতে কী, আমার তেমন একটা ভয় করছিল না, বরং ওর সান্নিধ্য আমি বেশ উপভোগ করছিলাম। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আর কী কী করেন?”
উনি উত্তর দিলেন, “আমরা আপনাদের পড়া গল্পের মতো বাদুড় হয়ে উড়তে পারি না। উলটে বাদুড় দেখলে আমার গা ঘিনঘিন করে, শুধু সূর্যের আলোয় আমাদের একটু সমস্যা হয়, দিনের বেলা বেরোতে হলে চোখে সানগ্লাস পরি।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার নাম?”
উনি ওঁর সানগ্লাসটিকে ডানহাত দিয়ে নাকের ওপরে তুলে দিয়ে বললেন, “উঁহু, সেটা বলা যাবে না। তাহলে আবার আপনি ফেসবুকে আমাকে খুঁজবেন। আর এখন আমার ভ্যাম্পায়ারের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে কেলেঙ্কারির একশেষ হবে।”
আমি তবুও নাছোড় হয়ে বললাম, “আহা, বলুন না, আমি কাউকে বলব না।”
“ম্যাডাম, সবই কি জানা যায়? কিছু রহস্য রাখাও ভালো, কী বলেন ম্যাডাম?”
“ও ম্যাডাম! ম্যাডাম!”
মনে হচ্ছিল আমি যেন কোনও অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। ম্যাডাম শব্দটা আমার কানে বেঁকেচুরে আসছিল। কুয়োয় মধ্যে চেঁচিয়ে কথা বললে যেমন গমগম আওয়াজ হয়, তেমনভাবেই ম্যাডাম শব্দটা আমি শুনছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না হঠাৎ করে কী হল। আচমকাই মুখে জলের ঝাপটা পেয়ে ধড়মড় করে উঠে দেখি কোথায় কী! বাস পুরো ফাঁকা। আমার সামনে বাস ড্রাইভার ও কন্ডাক্টর একটা জলের বোতল হাতে নিয়ে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে।
আমি সোজা হয়ে উঠে বসতেই ওঁরা বললেন, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অনেক ডাকার পরও কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে ওঁরা আমার মুখে জলের ছিটে দিয়েছেন।
বাইরে তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। দূরের আকাশের ঘন কালো মেঘের আড়াল থেকে অজানা কোনও রহস্য বুঝি উঁকি দিচ্ছে। আমি হতভম্ব হয়ে পুরো ব্যাপারটা ভাবতে চেষ্টা করছিলাম। পেট গরম হয়ে গিয়েছিল, তাই উলটোপালটা স্বপ্ন দেখেছি, না-হলে ভ্যাম্পায়ার নিয়ে এরকম ঘটনা অসম্ভব ব্যাপার।
খুব লজ্জিত মুখে ড্রাইভার ও কন্ডাক্টরকে সরি বলে তাড়াতাড়ি সিট ছেড়ে উঠতে যাব, দেখি আমার পাশের সিটে ভ্যাম্পায়ার ভদ্রলোকের চোখের কালো চশমাটি রাখা রয়েছে।
ব্যাপারটা বুঝতে আমার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। তারপরই আমি আতঙ্কিত হয়ে প্রায় দৌড়ে বাস থেকে নেমে হনহন করে হাঁটা দিলাম। একবারও পেছনে ফিরে দেখিনি। রাস্তার দু-দিকে সন্ধ্যার আলো চিরে সদ্য জ্বলে ওঠা লাইট-পোস্টের আলোর চারপাশে জমাট বেঁধে ওঠা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছিলাম, সত্যিই, ‘বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকু জানি’।
ওই রুটের বাস তদাবধি ভয়ে আর চাপিনি। তোমরা কেউ চাপলে জানিও তোমাদেরও কি এরকম কোনও অভিজ্ঞতা হয়েছিল?
ছবি অংশুমান