গল্প-রঙিন হুমকি-সায়নী ঘোষ -বর্ষা ২০২২

golpronginhumki

চুলের সামনের ভাগ উঠে আছে, সেটি আবার কালো নয় লালচে রঙের, মুখ চোয়াড়ে মার্কা—এইটুকুই মনে আছে ভবতোষবাবুর। একটা অদ্ভুত হুমকি তেনার—রঙিন চুল করাতে হবে এই বছর ষাটের বৃদ্ধকে। কী এটা! পাগল-ছাগল সব। এটা কিছুতেই মানা যায় না। ধবধবে সাদা চুল ওঁর। প্রাক্তন সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের অফিসার ভবতোষ মুখার্জি, তিনি কিনা রঙ করে কিম্ভূত সাজবেন!

“কী রে যাবি আমার সঙ্গে? পুলিশে কমপ্লেন করতে যাব।” ঘরে পাক খেতে খেতে মেধাকে বললেন।

মেধা আর ভবতোশবাবু ছাড়া বালিগঞ্জ প্লেসের এই বাড়িতে আর কেউ থাকে না। মেধা তার একমাত্র ভাগনি, তিনিই ওকে ছোটবেলা থেকে মানুষ করেছেন। তাঁর ছেলে আমেরিকায় চাকরি করেন।

“কী হবে কমপ্লেন করে, মামু? এসব আবার কেউ পুলিশে বলে?” মেধা বলল।

সেটা ভবতোষবাবুও বিলক্ষণ জানতেন। এ-ব্যাপারে পুলিশকে বিরক্ত করা উচিত হবে না। কিন্তু দু-দিন আগের প্রাতর্ভ্রমণের সময় পাওয়া হুমকি তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। প্রথমে তেমন পাত্তা দেননি। রাতে আবার ঢিল মোড়া কাগজে একই হুমকি ভবতোশবাবুর ঘরের জানালার কাচ ভেদ করে ঢুকে আসতে চিন্তায় পড়েছেন তিনি।

“তাহলে আমি বাজার গেলাম। এসে দেখব কী করা যায়।” মুখ নীচু করে হতাশ গলায় বলে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

ইলিশের দর কষাকষি করছেন, ঠিক এমন সময় পাশে দেখেন ওই এক মুখ, পাশে দাড়িয়ে মিটমিটি হাসছে, টাইট গেঞ্জি ছেঁড়া জিন্স—একেবারে ছ্যাঁচড়া ছেলের মতো দেখতে। এমনিতে মিতভাষী ভবতোষবাবু এবার খানিক ক্ষিপ্র হয়ে উঠলেন।—“কী ছোকরা, কেন পড়েছ আমার পেছনে? আমি কিন্তু পুলিশে যাব!” আঙুল উঁচিয়ে ওই ছোকরাকে লক্ষ্য করে বললেন তিনি।

“সে আপনি যেখানে খুশি যান ,আগে সেলুনে যান। আমার বলা আছে, বারগেন্ডিটা লাগিয়ে দেবে। আর যদি আপনার অন্য কিছু পছন্দ হয়…”

ছোকরা পুরোটা শেষ করার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভবতোষবাবু।—“কেন করব আমি রঙ? দাদাগিরি নাকি?” বলে ফেললেন ভবতোষবাবু। কানটা লাল হয়ে গেছে ওঁর।

“আহা, চটছেন কেন? ব্রো, বি কুল!”

ছোকরার সহাস্য কথাটি চাবুকের মতো লাগল ভবতোষবাবুর। “ব্রো, ব্রো মানে?” চোখ কপালে উঠিয়ে বললেন উনি।

“ব্রো মানে ভাই, ব্রাদার।” অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল ছোকরা।

মাথা নাড়াতে নাড়াতে এগোলেন উনি। ভাবলেন, এর সঙ্গে তর্ক করলে উনি পাগল হয়ে যাবেন।

পিছু নিয়েছে ওই বিটকেল ছোকরা। মিতালি সুইটসে ঢুকে ঘণ্টা খানেক কাটালেন, আট-দশটা মিষ্টিও খেতে হল; যতক্ষণ ওই বিটকেল ছোঁড়া চলে না গেল ততক্ষণ। তবে সেটা মন্দ লাগেনি বলাই বাহুল্য। তবে এরকম পালিয়ে বেড়ানো মোটেই ভালো লাগছিল না ওঁর। কাউকে বলতেও পারছিলেন না এমন হাস্যকর ব্যাপার। ওঁর ইমেজ বলে একটা ব্যাপার তো আছে নাকি!

রাতে স্বপ্নে একটি এমন দৃশ্য দেখলেন যে হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লেন। একজন লোক পরনে তার মতোই পাজামা-পাঞ্জাবি, চুলটা লালচে। তারপর তিনি আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে এলেন। তার সঙ্গে আর একজন রয়েছে। এগিয়ে আসতে দেখলেন, এ কি! পাঞ্জাবি পরা লোকটার মুখটা তো বড়োই চেনা চেনা লাগছে। এ কি, এটা তো তিনি নিজেই আর তার কাঁধে হাত দিয়ে এগিয়ে আসছে ওই বিটকেল ছোঁড়া! দুজনে হাসছেন। ঘুম ছুটে গেল। হুড়মুড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে পড়লেন। বাকি রাতটা জেগেই কাটালেন।

সকালে প্রাতর্ভ্রমণে গিয়ে তাকে দেখতে না পেয়ে শান্তি পেলেন। কিন্তু না, পার্ক থেকে যেই বেরিয়েছেন, ঠিক সেই সময় তেনার আবির্ভাব।

“আসুন আমার সঙ্গে দাদু!” ছোকরাটি বলল।

“দাদু! আগের দিন যে ভাই বললে!” ভুরু কুঁচকে বললেন ভবতোষবাবু।

“তাও তো আপনার পছন্দ ছিল না। তাই না?”

“মাঝামাঝি কিছু হয় না বুঝি—কাকু, জেঠু গোছের কিছু?”

চারপাশে তাঁর পার্কের বন্ধুবান্ধব থাকায় কথা বাড়ালেন না ভবতোষবাবু। একটি বেঞ্চে বসলেন, পাশে ওই বিরক্তিকর ছোঁড়াটিও বসল।

“কেন বিরক্ত করছ ভাই! ওহ্‌, না না, ব্রো ভাই।” বিনম্র মুখে বললেন।

“এই দেখুন।” বলে তার ইয়া বড়ো মোবাইলখানা ভবতোষবাবুর সামনে ধরল।

এ কি! দেখে তো ওঁর চোখ কপালে উঠে গেল। তারই ছবি! পুজোর সময় দেশের বাড়িতে ঠাকুর ভাসানের পর সিদ্ধি খেয়ে নাচানাচি করেছিলেন। অনেক বছর আগে। চোখ গোল গোল, অদ্ভুত ছবি। আত্মীয়দের মধ্যে কেউ একটা টুক করে তুলে নিয়েছিল। বাবা বাছা করে তার থেকে বাগিয়ে নিয়েছিলেন উনি। এই ছবিটা সবার থেকে, এমনকি মেধার থেকেও লুকিয়ে রাখতেন। এটা এই মহামানবের কাছে কীভাবে! উনি আর কথা বলতে পারলেন না।

“কী, দাদু? ছাড়ব নাকি ফেসবুকে?” ছোকরা হাসতে হাসতে বলল।

“কী অদ্ভুত! ব্রো ভাই, এমন কেন করছ বলো তো? তোমার মোটিভটা কী? নেহাত আমি পুলিশে যাচ্ছি না…”

“সেলুনে যান, সেলুনে।” বলে প্রস্থান করল ওই ছোকরা।

ফেরার পথে প্রচুর ভাবলেন। ওই ছবি যদি প্রতিবেশী সুজিতদার চোখে পড়ে তো! তো ওঁর পা টেনে টেনে লম্বা করে দেবেন।

বাড়ির সামনে সুজিতদা আর রবিকে দেখলেন। তাঁরা কিছু একটা নিয়ে প্রচণ্ড হাসাহাসি করছেন। হঠাৎ ছোকরার কথাটা খেয়াল হল। ব্যাটা এর মধ্যে ছেড়েও দিল নাকি! ভবতোষবাবুকে ওঁরা খেয়ালই করছেন না। পিছন থেকে দেখলেন উনি, না, এটা অন্য কিছু। স্বস্তি পেলেন।

না, বাড়ি ফিরলেন না। বাজারের সেই সেলুনটির সামনে দেখা গেল তাকে। তবে অনেকক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর আস্তে আস্তে ঢুকেও গেলেন।

“চুলে রঙ করো ভাই?” আমতা আমতা করে বললেন ভবতোষবাবু।

“হ্যাঁ, করি। কী করাবেন?” তার কিছু পরেই মাথা চুলকে সেলুনের লোকটি বলল, “ওহ্‌, আপনি রাজদার সেই দাদু নাকি? আপনার জন্য তো বারগেন্ডি।”

মুখ নীচু করে হ্যাঁ সূচক ঘাড় হেলালেন। রঙ করা হয়ে গেল।

আয়নায় দেখে নিজেকে চিনতে পারলেন না। তবে খুব একটা মন্দ লাগছে না।

বাড়ি ফিরে দেখেন মেধা গোল গোল চোখ করে দেখছে।

“খুব খারাপ লাগছে নাকি রে?” ভবতোষবাবু বললেন।

“তুমি ওর কথা মেনে নিলে?”

“না, ওর কথা মানব কেন? আমি নিজেই আর কি ভাবলাম…” প্রথমটা ঝাঁজালো শোনালেও পরের কথাটা কেমন যেন মিয়ানো লাগল।

দুপুরে খাওয়ার তোড়জোড় চলছে। কলিং-বেলের শব্দে মেধা কথোপকথন ছেড়ে দরজার দিকে গেল। ভবতোষবাবু দেখেন, এ কি! এ তো সেই বিটকেল মূর্তিমান! ঠিকানা পেল কীভাবে?

“এই দেখো, আমি কিন্তু রঙ করিয়ে নিয়েছি ব্রো ভাই। এবার তুমি ছবিখানা ডিলিট করো।” ছোকরাটিকে লক্ষ্য করে বললেন।

মেধা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। ভবতোষবাবু বুঝতে পারছেন না কী হচ্ছে।

আসলে ক’দিন ধরে ভবতোষবাবু প্রচণ্ড মনমরা ছিলেন। না ঠিক করে খাওয়াদাওয়া করছিলেন, না ঘুমোচ্ছিলেন। ওঁর ছেলে ফোন করছিলেন না। আর ফোন করলে বেজে যেত। ওঁর ছেলে ড. পরিমল মুখার্জি। বিদেশে থাকেন। নিজের জন্মদিনের দিন অনেক আশা করেছিলেন সেদিন অন্তত একটা ফোন আসবে। কিন্তু আসেনি। তাই মেধা প্ল্যান করে এসব করেছে। ওর কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেটিকে পাকড়াও করে এসব করিয়েছে। দু-দিন ওসব দুঃখ-টুঃখ ভুলে ছিলেন। সব খুলে বলল মেধা।

“তবে আমি বলেই মানিয়েছে কিন্তু। ওই সুজিতদা হলে মানাত? কী বলো ব্রো ভাই?” বলে মেধাকে জড়িয়ে ধরলেন ভবতোষবাবু।

সেদিন ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখা গেল। সেখানে সহাস্য ভবতোষবাবু আর মেধা। সঙ্গে ওঁর কাঁধে হাত দিয়ে ওই বিটকেল ছোকরা। না না, ব্রো। ঠিক স্বপ্নের মতো। কী জানি, ড. পরিমল মুখার্জি দেখেছেন হয়তো। তবুও তাতে এখন আর কিছু যায় আসে না ভবতোষবাবুর।

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s