গল্প-জাপানি বিভীষিকা- ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী-শরৎ ২০২২

golpoজাপানী-বিভীষিকা

গত একবছর ধরে লাইফটা পুরো ঝালাপালা হয়ে গেছে। অ্যাডভেঞ্চারের লোভে পড়ে হ্যাঁ বলেছিলাম, এখন এত শারীরিক কসরত করতে হচ্ছে আর এতরকম জিনিস শিখতে হচ্ছে যে আমার অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ অর্ধেক হয়ে গেছে। আরও ভালো না লাগার কারণ হল খাওয়াদাওয়ায় খুব রেস্ট্রিকশন, কতকাল কিচ্ছু ভালো খাই না। আর তাছাড়া নীল আমাকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে না। সব অভিযানে ও একাই যাচ্ছে। আর আমি যেতে চাইলেই বলছে, তুই এখনও রেডি হোসনি।

ব্যাপারটা তাহলে খুলেই বলি। খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে। মানে আমি দিব্যি সুখে ছিলাম। হায়দ্রাবাদে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকছিলাম। এই করোনাকালের লকডাউনে বাড়ি থেকে বেরোতেও হচ্ছিল না। বাড়িতে বসে কাজ—গুচ্ছের কফি খাচ্ছি, ফাঁকা টাইমে নেটফ্লিক্স বা আমাজন প্রাইম দেখছি—দারুণ ছিলাম। তারপর একদিন উপরতলার ফ্ল্যাটের একটা বাচ্চা মেয়ের অদ্ভুত ব্যবহারের সঙ্গে মিল পেলাম আমাদের স্কুল-ট্রিপের একটা ঘটনার সঙ্গে। তারপর আমার স্কুলের বন্ধু নীলোৎপলা এল। এরপরে অনেকগুলো ঘটনা পরপর ঘটল। ফাইনালি বুঝলাম যে আমি হলাম লালকমলের পুনর্জন্ম। সেই লালকমল, ঠাকুমার ঝুলিতে যার কথা পড়েছি। আর আমার বন্ধু বা দাদা নীলকমল হল নীলোৎপলা। ও রাক্ষসী রানির ছেলে। ওর মৃত্যু নেই। ও যে-কোনো মানুষের রূপ ধরতে পারে, আর তাই বার বার বিভিন্ন রূপ ধরে ও আমাকে বাঁচায়। সেই মেয়েটা আসলে একটা খোক্কস ছিল। আমিও বললাম আমি এবার থেকে নীলের সঙ্গে সঙ্গে অভিযানে যাব। সেই অভিযানে গিয়ে যাতে মারা না পড়ি সেই জন্যেই এত কঠিন ট্রেনিংয়ের মধ্যে দিয়ে আমাকে যেতে হয়।

হায়দ্রাবাদে একটা বিরাট স্পোর্টস ট্রেনিং ইন্সটিটিউট আছে। সেখানে রাতের বেলা আমার অস্ত্রশস্ত্রের ট্রেনিং চলে—সে পুরোদস্তুর কম্যান্ডো ট্রেনিং। অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও আমি শিখেছি জুডো, ক্যারাটে আর তাইকোন্ডু। আর দিনের বেলা আমাকে শিখতে হয় বিভিন্ন ভাষা আর কঠিন কঠিন মিথোলজির বই, মন্ত্রের বই। গত এক হাজার বছর ধরে যে-সমস্ত অভিজ্ঞতা নীল সংগ্রহ করেছে, সেগুলোও আমাকে পড়তে হয়। বিকেল চারটে থেকে রাত বারোটা অবধি টানা আট ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিই আমি। খাওয়ার ব্যাপারেও খুব কড়াকড়ি। সেটাই আমাকে খুব দুঃখ দেয় আর কি। একটু খেতে ভালোবাসি, এটুকুই তো আমার অপরাধ।

এই সপ্তাহের পুরোটাই আমার পরীক্ষা ছিল। সোমবারে উত্তর দিতে হয়েছিল কিছু বিকট বিকট প্রশ্নের। বুধবার ছিল আমার জুডো, তাইকোন্ডু আর ক্যারাটের পরীক্ষা। আর আজ, শুক্রবার। আজকেও আমার পরীক্ষা ছিল, অস্ত্রশিক্ষার। তরোয়াল চালানোটায় আমি খুব ভালো হতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু আমার নিশানা খুব ভালো। তাই আমি বন্দুক-পিস্তলেই বেশি আনন্দ পাই। প্রথমে তরোয়াল আর তারপর লক্ষ্যভেদের পরীক্ষায় ভালোই করেছি মনে হয়। শেষ পরীক্ষাটাই সবথেকে কঠিন ছিল। একটা পুরোদস্তুর কমব্যাট বানানো হয়েছিল আমার জন্য। একটা অন্ধকার বাড়িতে, শুধুমাত্র নিজের ইন্সটিংক্টের উপর ভরসা করে আমাকে একটা ঘর থেকে একজন মানুষকে উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু সেই ঘর অবধি পৌঁছনোর মধ্যে থাকবে বেশ কিছু মানুষ আর কিছু মনস্টারের ছদ্মবেশে মানুষ। তাদের চিহ্নিত করে ঠিক ঠিক জীবকে আহত করতে হবে আমাকে। আমার হাতে একটা বড়োসড়ো পেন্টবল গান। এই ক’দিনের ট্রেনিংয়ে আর কিছু না হোক, মানুষ আর মনস্টারদের মধ্যে পার্থক্য করতে আমি বেশ শিখে গেছি। কাজেই পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পরে যখন আমি জানলাম যে আমি সবক’টা ঠিকঠাক লক্ষ্যভেদ করতে পেরেছি, একটাও মানুষ আমার হাতে আহত হয়নি; তখন খুব বেশি অবাক হইনি। যদিও একটা জিনিস অবাক লাগে, আমার কোনও ট্রেনার আমার সঙ্গে প্রয়োজনের বাইরে একটা কথাও বলে না। বহুবার কথা বলতে চেয়েছি। কেউ কিছু জানেও না মনে হয় আর আমার সঙ্গে আড্ডা মারা মনে হয় বারণ। প্রত্যেকেই একটা নির্দিষ্ট টি-শার্ট আর জিনস বা অন্য কোনও প্যান্ট পরে। টি-শার্টের রঙ ধূসর আর পকেটের উপরে একটা নীল রঙের পদ্মের ছাপ দেওয়া। বুঝতেই পারি এরা নীলের দলের লোক। কিন্তু নীলের দলটার কোনোরকম পরিচয়ই আমি পাইনি। যদি কিছু একটা সংগঠন থেকেও থাকে, তাহলেও আমাকে তাদের কারও সঙ্গেই আলাপ করানো হয়নি। নীলও কিছু বলে না। শুধু একবার অনেক পীড়াপীড়ি করার পরে বলেছে আমি পরে তোকে সব খুলে বলব, ট্রেনিং শেষ হোক।

পরীক্ষার রেজাল্ট মনোমতো হয়েছে বলে আমি দু-দিন ছুটি পেয়েছি। যদিও এই দু-দিনে করার মতো কিছু নেই আমার, তাই ফ্ল্যাটে থাকব আর একটু বইপত্র ঘাঁটব, কয়েকটা ওয়েব সিরিজ দেখব—এটুকুই ভেবেছি। এই নতুন ফ্ল্যাটটায় আমার কোনও বন্ধুও নেই। এই বেশ বড়োসড়ো থ্রি-বি.এইচ.কে ফ্ল্যাটটা জোগাড় করেছে নীল। কেউ কোনও প্রশ্নও করে না, কথাও বলে না। মাঝে মাঝে আমি রুদ্রার মাকে বেশ মিস করি আজকাল। অন্তত কেউ ছিল কথা বলার জন্য, গায়ে পড়া হলেও। আজকের পরপর তিনটে পরীক্ষাই বেশ ভালো হয়েছে, ফলে একটা বড়ো মাথাব্যথা কমে গেছে।

সম্ভবত পরের সপ্তাহে নতুন কিছু শুরু হবে। আমি অনেকদিনই পরে কী হবে ভাবা ছেড়ে দিয়েছি। আজকে একটু রেস্ট নিয়ে কফি খেতে খেতে সিরিজ দেখব ভাবছিলাম, কিন্তু তার আগেই বেল বাজল।

যদিও জানি যে নীল ছাড়া কেউ আসবে না, তবু একবার ভালো করে চেক করে নিয়ে দরজা খুললাম। সামনে দাঁড়িয়ে নীলোৎপলা-ম্যাডাম। সারা সপ্তাহ সে কোথায় ছিল কে জানে। অবশ্য ওর এরকম না থাকায় আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ফ্ল্যাটে ঢুকে নিজের ঘরে চলে গেল; আমি গেলাম কফি বানাতে। সে ফ্রেশ হয়ে এসে বলল, “শোন, কফিটা বানিয়ে কাজের ঘরে আয়, কথা আছে।”

কাজের ঘর মানে তিন নম্বর ঘরটা। যেখানে আছে একগাদা বই, রাজ্যের ম্যাপ আর দুটো বড়ো স্ক্রিন। যেগুলোর সঙ্গে ল্যাপটপ কানেক্ট করে আমি বা নীলা নেট সার্চ বা পড়াশোনা করি। আমি ঢোকামাত্র কোনও ভূমিকা না করেই নীল বলল, “শোন, তোর রেজাল্ট দেখলাম। ভালো করেছিস।” বলে একটুকরো হাসল। আমিও হাসলাম। তারপর বলল, “আমার মনে হয় তোর সহজাত একটা ক্ষমতা আছে, তাই তুই এত তাড়াতাড়ি এত ভালো শিখতে পারছিস।”

কিছু বলার নেই আমার, এত খাটলেও যদি বলে চট করে শিখে গেছি। কিন্তু ততক্ষণে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেছে। বলল, “শোন, তোর পাসপোর্টটা আমাকে দে তো। জাপান যেতে হবে।”

“মানে? জাপান! কেন? আবার খোদ জাপান থেকে আমাকে নিনজা টেকনিক শিখতে হবে নাকি?” বলেই ফেললাম।

নীলা হো হো করে হেসে উঠে বলল, “না রে। আমরা যাব জাপানের একটা ছোটো শহরে। তার নাম হোকে বা হাউকে।”

“সেখানে কী আছে?”

“সেখানে তেমন কিছু নেই, ছোটো মফস্‌সল মতো। হোটেল মাত্র একটা। একটা বেশ প্রাচীন লাইব্রেরি আছে, আর সেখানেই আমাদের যেতে হবে।”

“কেন রে?”

“সেই লাইব্রেরিতে মাঝে-মাঝেই কিছু অশরীরী কাণ্ডকারখানা হচ্ছে খবর এসেছে। এই লাইব্রেরিতে বেশ পুরোনো কিছু জাপানি পুথিপত্র রয়েছে। যেগুলোর কথা সাধারণ লোক তেমন জানে না। পুথিগুলো বেশ লুকোনো আছে। কিন্তু বারবারই সেখানে রাতের দিকে যখন লাইব্রেরি বন্ধ তখন অ্যালার্ম বেজে উঠছে বা সকালে যখন লাইব্রেরি খোলা হচ্ছে তখন দেখা যাচ্ছে ঘরের মধ্যে যেন ঝড় বয়ে গেছে। তোর ট্রেনিং তো শেষ। এবার তোর অন-জব ট্রেনিং শুরু করতে হবে মনে হচ্ছে।” বলে একটু হাসল।

“আমি একা সামলাতে পারব নাকি? কখনও করিনি তো তোর মতো।”

“আরে ধুর! আমি আছি তো, চিন্তা করছিস কেন? হয়তো তোকে কিছুই করতে হবে না। তুই রাজি কি না বল। আসলে তোর মধ্যেও কিন্তু একটা ক্ষমতা আছে। মনস্টাররা তোর দিকে বেশ আকৃষ্ট হয়। কেউ যদি লুকিয়ে থাকে, তোর উপস্থিতিতে বেরিয়ে আসবে।”

“তাই বল। আমাকে একটা পাঁঠা বানিয়ে তুই বাঘ শিকারে যাবি।”

“আরে না রে, আমার কিউট বোন। তোকে নিয়ে যাচ্ছি যাতে তোর একটা অভিজ্ঞতা হয়, আর আমারও সাহস বাড়বে তুই থাকলে—ডিস্টিংশন পেয়ে পাস করেছিস। এতদিন ধরে যা হ্যাজাচ্ছিলি, ফাইনালি সেদিন এসে গেছে। তুই যাবি কি না বল।”

“না না, যাব তো বটেই।” তড়িঘড়ি বলে উঠলাম। আর তার ঠিক চারদিন পরে আমরা জাপানের রাজধানী টোকিওতে ফ্লাইট থেকে নামলাম। আমার সঙ্গে চেক-ইন লাগেজ থাকলেও নীলের পিঠে ওর সেই ব্যাকপ্যাক। আমার বন্দুক দুটোর জন্য একটা বাক্স দিয়েছে নীল। সেখানে বন্দুক দুটো রাখা থাকলে ফ্লাইটে কিছুতেই সেটা স্ক্যানারে ধরা পড়ে না। কিছু একটা ম্যাজিক করা আছে। কিন্তু সেটাকে সঙ্গে নিয়ে ট্র্যাভেল করা যায় না। অবশ্য দরকারও নেই। নীলের সঙ্গে আছে তো ওর বেঁটে লাঠি, দরকারে যেটা তরোয়ালে পরিণত হয়।

টোকিওর একটা হোটেলে থাকার পর, পরের দিন আমরা আরেকটা ফ্লাইট নিয়ে গেলাম তোত্তোরি শহরে। এই শহরটা হল যেখানে আমরা যাব, সেই হোকে শহরের সবথেকে কাছের বড়ো শহর। এখান থেকে গাড়ি করে ওই হোকে শহরে যেতে হবে। গাড়ি ভাড়া করা ছিল, সেখান থেকে আমরা অপূর্ব সুন্দর একটা রাস্তা ধরে প্রায় দু-ঘণ্টা ড্রাইভ করে হোকে শহরে পৌঁছলাম।

শহরটা ছিমছাম। ছোট্ট। দেখার তেমন কিছুই নেই। শুধুমাত্র চারদিকের সৌন্দর্য আর কাছেই একটা পাহাড়ের উপরে সবুজ রঙের একটা বিরাট দৈত্যমূর্তি। দৈত্যটা যেন নীচের দিকে তাকিয়ে আছে, শহরের দিকে নজর রাখছে। এই দৈত্যটার নাম ওনি। জাপানি মিথোলজির খুব বিখ্যাত একজন দৈত্য।

“ওনির নাম শুনেছিস তো?” নীল আমাকে জিজ্ঞাসা করল।

“হ্যাঁ, অবশ্যই শুনেছি। এই সবুজ রঙ ছাড়াও ওনি লাল-নীল এমনকি হলুদ বা কালো রঙের হতে পারে। ওর মাথায় থাকে দুটো শিং। তাছাড়া দরকারমতো তার গায়ে আরও শিং বার হতে পারে। হাতে নাকি বিরাট এক মুগুর থাকে। তা আমরা কি এই দৈত্যটার মোকাবিলা করতেই এসেছে নাকি?” জিজ্ঞাসা করলাম ফিসফিস করে।

নীল বলল, “জানি না রে। দেখা যাক।”

গাড়ির মধ্যেই নীল চেহারা পরিবর্তন করে একজন জাপানির রূপ ধারণ করেছে। আমরা দেখাতে চাইছি আমি হলাম এক ভারতীয় মহিলা যে বৌদ্ধ শাস্ত্রের উপরে রিসার্চ করছি আর নীল হল আমার দোভাষী। আমি নীলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “তুই জাপানি ভাষা জানিস?”

সে বলল, “আরে এত বছর ধরে পৃথিবীতে চরে বেড়াচ্ছি, জাপানি ভাষা শিখে নিতে হয়েছে। আর জানিস তো, যে রূপ আমি ধরি, তাদের ভাষাও আমি মোটামুটি আয়ত্ত করে নিই, কাজেই অসুবিধা হবে না। তুই আমাকে বল, তুই কি জানিস এই চিনে বৌদ্ধ দানব ওনির সঙ্গে ভারতে কাকে তুলনা করা হয়?”

মাথা নাড়লাম। বললাম, “দেখ, আমি এদের অরিজিন স্টোরিটা জানি। যদি খুব খারাপ কেউ মরে গিয়ে বহুকাল ধরে বিভিন্ন বৌদ্ধ নরকে ভাজা ভাজা হয় এবং তাতেও না শুধরোয়, তাহলে সে ওনি হয়ে ফেরত আসে। আবার অনেক সময় খুব খারাপ কেউ তার জীবনকালেও অভিশাপ পেয়ে ওনি হতে পারে। কিন্তু এর সঙ্গে ভারতীয় মিথের কোনও মিল তো পাইনি।”

“হুম, অরিজিন স্টোরিটা খুবই দরকার। এর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে একে কীভাবে ধ্বংস করা যায়, তার সূত্র। তবে আমরা জানি না, ওনির পাল্লাতেই আমরা পড়ছি কি না। ওনির শিং আছে বলে ভারতীয় পুরাণের যক্ষ বা রাক্ষসের সঙ্গেও তুলনা করা হয়। তবে সবথেকে বেশি তুলনা করা হয় যমের সঙ্গে। যেহেতু নরকের সঙ্গে এর ভালোমতো যোগাযোগ আছে। তবে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। হোটেলে এসে গেছি, চল ঢুকে পড়ি, আজ অনেক জার্নি হল। কাল আমরা যাব প্রথমে ইনফরমেশন সেন্টারে, তারপর লাইব্রেরিতে।”

হোটেলে চেক-ইনও হয়ে গেল দিব্যি। এ বিষয়গুলোতে কখনও অসুবিধা হতে দেখিনি। নীলের কাছে যেন সমস্তরকম যোগাযোগ খুব সহজলভ্য।

ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে তারপর নীচেই একটা রেস্তোরাঁয় ডিনার সারার পর নীল বলল, “তুই একটু ঘরে যা, আমি একপাক ঘুরে আসি।”

আমাকে নিয়ে যাচ্ছে না বলে একবার হেবি অভিমান হল। তারপরে বুঝলাম, ও জাপানি রূপ ধরেছে বলে অনায়াসেই মিশে যাবে; আমার দিকে সবার নজর থাকবে। কাজেই বিনা বাক্যব্যয়ে উপরে উঠে গেলাম। ঘুম পাচ্ছে। দু-দিন ধরে ক্রমাগত ফ্লাইটের ক্লান্তি তো আছেই। চোখটা বন্ধ করতেই কেন জানি না মনে হল ঘরে আর আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না ভালো করে। বুকের উপর একটা ভারমতো লাগছে, ঘরের হাওয়াটা ভারী হয়ে এসেছে। চোখটা না খুলেই হাত বাড়িয়ে বালিশের নীচ থেকে আমার বন্দুকটা নিলাম, তারপর জোর করে উঠে বসে চোখটা খুললাম। ঘরটা যেন একটা ধূসর ধোঁয়ায় ভরে গেছে, আস্তে আস্তে সেই ধোঁয়াটা একটা জায়গায় জমাট বাঁধছে যেন একটা চেহারা তৈরি হবে। এ-জিনিস আমি আগে পড়েছি, নিশ্চয়ই একটা কোনও অশরীরী, কিন্তু দেহটা স্পষ্ট না হলে আমার বিশেষ বন্দুকটাও কোনও কাজ করবে না। তবে সেটা আর ব্যবহারের দরকার পড়ল না। হঠাৎ চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে এল নীল। আর এক মুহূর্তের মধ্যে ধোঁয়া পুরোপুরি গায়েব হয়ে গেল।

“কী ব্যাপার রে? বন্দুক তাক করে বসে আছিস কেন?”

এত তাড়াতাড়ি ধোঁয়াটা গায়েব হয়ে গেল, যে আমার মনে হতে লাগল যে আমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছি, এটা সত্যি নয়। বললাম, “না রে, মনে হয় স্বপ্ন দেখেছি। একতাল ধোঁয়া…”

নীল বিশেষ পাত্তা দিল না মনে হল। আমিও চাই না এসব ছোটোখাটো কারণে ও চিন্তা করে আমাকে বাদ দিয়ে দেবে। আগামীকাল তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। এখানে আবার ভারতের থেকে সময় এগিয়ে। ঘুমিয়ে পড়লাম। আর কোনও সমস্যা হয়নি।

সকালে উঠে সবার আগে ইনফরমেশন সেন্টারে গেলাম। ইনফরমেশন সেন্টার ছাড়াও সেখানে কিছু দোকানপাট আছে, টেনিস কোর্ট, রেস্তোরাঁও আছে। এই শহর সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সেখানে পাওয়া যায়। ওখানে আমাদের কিছু একটা পরিচয়পত্র বানানো হল, যেটা লাইব্রেরিতে দেখানো হবে।

তারপর গেলাম সেই লাইব্রেরি। লাইব্রেরিটা বেশ বড়োসড়ো, কিন্তু সেখানে মাত্র একটা ঘরে প্রবেশের অনুমতি রয়েছে। লাইব্রেরিয়ানের নাম জোবেন দাইসুকে। ছোটোখাটো জাপানি মানুষটি, তবে বেশ সন্দেহপ্রবণ। বার বার আমাদের পরিচয়পত্র খুঁটিয়ে দেখলেন। আমরা ওই ঘরটি দেখলাম, তাতে কিছু পপুলার বইপত্র ছাড়া আর কিছুই নেই। বেশিরভাগই জাপানি বই, এককোণে একটা আলমারিতে কিছু ইংরেজি বইও আছে।

নীলের ইশারায় আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আমি যতদূর জানি এই লাইব্রেরিতে বেশ কিছু জাপানি প্রাচীন পুথিপত্র আছে। দেখা যায়?”

নীল জাপানিতে অনুবাদ করে একই কথা বলল সম্ভবত। তার উত্তরে মনে হয় একটু রেগেই উঠলেন দাইসুকে। একগাদা কীসব বললেন। নীলা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “রাজি হচ্ছেন না। পুলিশের বারণ আছে, তাছাড়া বিশেষ পরিচয়পত্র ছাড়া ওগুলো অ্যালাও করে না।”

“এবার কী হবে?” বেকুব বনে জিজ্ঞাসা করলাম।

“ব্যবস্থা করছি। তার আগে চল লাঞ্চ করে নিই। এখানে আর কিছু লাভ আছে বলে মনে হয় না।”

বেরিয়ে এলাম। ইনফরমেশন সেন্টারের রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ করছি, এখানে কিছু আমেরিকান খাদ্যও পাওয়া যায় দেখছি। আসলে মাছ-টাছ খেতে পছন্দ করি না, সুশি তো নয়ই। তাই পছন্দমতো বার্গার জাতীয় জিনিস পেয়ে আমার ভারি আনন্দ হয়েছে। অনেকদিন পরে খাচ্ছি।  এমন সময় দেখি একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল। সেখান থেকে একজন অফিসার বেরিয়ে এসে ইনফরমেশন সেন্টারের মহিলার সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলে রেস্তোরাঁর দিকে এগিয়ে এলেন। আমার চেহারাটা ভারতীয় বলেই অথবা ছোটো শহরে সবাই সবাইকে চেনে বলেই হয়তো একবিন্দু সময় নষ্ট না করে আমার টেবিলের দিকে চলে এলেন। ওকে দেখেই নীল ফিসফিস করে বলল, “উপায় হয়েছে। তুই চুপ থাক, আমি কথা বলছি।”

জাপানিতে দুজনে কী যে বকবক করল, একবিন্দু বুঝলাম না। আমি শুধু একবার নীলকে বললাম, “শোন, আমরা যদি মূল লাইব্রেরিতে ঢুকতে না পারি তাহলে রহস্যভেদ করা অসম্ভব। ওটা ম্যানেজ কর।”

নীল মাথা নাড়ল। তারপরে আবার কীসব বলে পকেট থেকে ফোন বার করল। করে কাউকে একটা ডায়াল করে কিছু কথাবার্তা বলে পুলিশের হাতে ফোন দিল। ভারতের পুলিশের মতো এখানেও যোগাযোগ ইত্যাদি দেখাতে হবে ভাবিনি। ফোন কানে দিয়েই ঝুঁকে ঝুঁকে বহুবার অভিবাদন জানাল কাকে একটা, তারপর কীসব কথাবার্তা বলে, (তার মধ্যে বেশিরভাগই সম্ভবত হ্যাঁ বাচক, মাথা নাড়ার ঘটা দেখে মনে হল) ফোন রাখল। তারপর নীলকে আবার কিছু বলে, আমার দিকে তাকিয়ে সম্ভ্রমসূচক একটা অভিবাদন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

নীলকে বললাম, “কী ম্যাজিক করলি রে?”

সে বলল, “লাঞ্চের পরে আমাদের পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে। জাপানের রাজপরিবারের একজনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়েছি। এবার একটা স্পেশাল পরিচয়পত্র পাব। সেটা ব্যবহার করলে আর কোনও চাপ থাকবে না। তবে এই জানাজানির ব্যাপারটা করতে চাইছিলাম না, তবুও করতে হল।”

খাওয়াদাওয়া সেরে পুলিশ স্টেশন থেকে নতুন পরিচয়পত্র নিয়ে আবার লাইব্রেরিতে হাজির হলাম। এবারে পরিচয়পত্র দেখার পরে জোবেন দাইসুকের ব্যবহারেও পরিবর্তন দেখতে পেলাম। বিরক্ত যে সে খুবই, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, তবে কখনোই তার কথায় বা ব্যবহারে প্রকাশ পায়নি। তারপরে আমরা এই ঘর পেরিয়ে হাজির হলাম মূল লাইব্রেরি ঘরে। কালো রঙ করা জানালাগুলো বন্ধ। ঘরে একটা কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে, আর থরে থরে সাজানো বই। বইগুলো বেশ পুরোনো, দেখে বোঝা যাচ্ছে।

নীলকে বললাম, “তুই তো পুথির কথা বলেছিলি, এখানে তো পুথির মতো কিছু দেখা যাচ্ছে না, সবই বই। পুরোনো, কিন্তু বই-ই, পুথি নয়।”

নীল বলল, “দাঁড়া, জিজ্ঞাসা করি।”

নীল প্রশ্ন করতেই প্রথমে দাইসুকে যেন একটু চমকে উঠল। তারপর আরও কীসব বলল। নীল আমার দিকে ফিরে বলল, “বলছে এখানে যা পুথি ছিল সেগুলো সবই টোকিওর রাজপ্রাসাদের লাইব্রেরিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখানে আর তেমন কিছু নেই। কিছু পুরোনো বই আছে। তবে মনে হচ্ছে কিছু একটা রয়েছে এখানে, নইলে হঠাৎ সব তছনছ হচ্ছে কেন? যাক গে, তুই কয়েকটা বই-টই দেখে নে। কিছু তেমন বুঝবি না হয়তো, তবুও। আমি আছি, দাইসুকেকে পাঠিয়ে দিই।”

দাইসুকে একটু অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিদায় নিল। তারপরে আমি আর নীল চারদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনও গোপন কুঠুরি বা দেওয়ালের কোনও আভাস পেলাম না। অবশেষে সন্ধ্যায়, লাইব্রেরি বন্ধ হওয়ার সময় বিদায় নিলাম। হোটেলের রেস্তোরাঁয় ডিনার সেরে একটু তাড়াতাড়িই শুতে চলে এলাম। উপরে এসে নীলকে বললাম, “শোন, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। কাল কোনোভাবে যদি এই দাইসুকেটাকে সরানো যায়, তাহলে তুই দাইসুকে সেজে লাইব্রেরি চলে যা। আমি পড়তে যাব। তারপর লাইব্রেরি বন্ধ হওয়ার পরেও থেকে যাব। কিছু না কিছু নিশ্চয়ই হবে। আমার মন বলছে।”

নীল একটু ভেবে বলল, “এই আইডিয়াটা মন্দ বলিসনি। দাইসুকেকে সরানোর ব্যবস্থা করছি, দাঁড়া।” বলে ফোন নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

আমি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঘুমোনোর আগে মুখে ক্রিম ঘষছি। স্পষ্ট দেখলাম পিছন দিকে আবার একটা ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে। আমার নিশ্বাস খানিক বন্ধ হয়ে গেল। আমার বন্দুকটাও হাতের কাছে নেই। ধোঁয়াটা ধূসর থেকে একটা নীল আকৃতি নিচ্ছে, বিরাট দুই শিং, মূর্তিটা আমার দিকে ঝুঁকে আসছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, আমি এবার শেষ। লালকমল, ইয়ে নলিনী, একবছর ধরে ট্রেনিং করে প্রথম অভিযানে বেরিয়েই তুমি শেষ… পরের জন্মে আর নীলের কাছে মুখ দেখাতে পারবে? এইসব ভেবে এইসা রাগ হল, ধুর। আমি একবার মারপিট করে তবেই মরব। এই ভেবে যেই পিছনে ঘুরে তাকালাম, অমনি ওনি ভ্যানিশ। বাতাসে শুধু ওর প্রথম কথাটা ভেসে বেড়াচ্ছে যেন, রাজকুমারী… আর পরক্ষণেই ঘরে ঢুকল নীল।

“কী রে, ওরকম ভেবলি হয়ে তাকিয়ে আছিস কেন?” জিজ্ঞাসা করল নীল।

কেন জানি না, মনে হল ব্যাপারটা আমার চোখের ভুল। এ নিয়ে নীলকে কিছু না বলাই উচিত। তাই বললাম, “না রে, মনে মনে ভাবছিলাম, যদি সত্যিই অশরীরী কিছু থাকে লাইব্রেরিতে।”

“তার জন্য চিন্তা করতে হবে না। তোত্তোরি থেকে দরকারি ফোন নিশ্চয়ই এসে গেছে এতক্ষণে জোবেন দাইসুকের কাছে। কাল ভোরেই বেরিয়ে যাবে সে। সারাদিনের জন্য নিশ্চিন্ত। তুই ঘুমিয়ে পড়। কাল অনেক কাজ।”

পরদিন সকালে জোবেন দাইসুকের চেহারা নিয়ে চুপচাপ লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব পালন করতে চলে গেল নীল। আর আমি সারাদিন ঘুরে বেড়ালাম ইনফরমেশন সেন্টারে, রেস্তোরাঁয়। দুপুরে লাঞ্চ করে হাজির হলাম লাইব্রেরিতে। প্রথমে গিয়ে বসলাম মূল ঘরে। তারপর যখন লোকজন একদমই নেই তখন হাজির হলাম রেস্ট্রিকটেড সেকশনে।

আবার খোঁজ শুরু করলাম। তবে কিছুই পাচ্ছি না। একটা বেশ ভালো খুপরিমতো জায়গা আবিষ্কার করলাম, যেখানে রাতে লুকিয়ে থাকা যাবে। একা থাকার সময়টা একটু গা ছমছম যে করছিল না তা নয়। এই জায়গাটাতেই নাকি ধস্তাধস্তির চিহ্ন পাওয়া গেছে, আর আমি একা থাকলেই যে-কোনো একটা জীব আমার ধারেকাছে আসছে, সেটা মনে পড়তে লাগল। তার সঙ্গে এটাও মনে পড়ল যে আমাকে নীল বলেছিল কোনও কারণে আমার প্রতি একটা আকর্ষণ বোধ করে এই অশরীরীরা। তবে তেমন কিছুই ঘটল না।

বিকেল পাঁচটায় লাইব্রেরি বন্ধ করে নীলও হাজির হল এই ঘরে। এখন আর কিছু কাজ নেই, শুধু অপেক্ষা। রাত বারোটার একটু পরে, যখন ডায়রিটা লিখছিলাম, তখন হঠাৎ মনে হল, ঘরের বাতাসটা ভারী হয়ে উঠেছে। ঠিক আগের দিনে হোটেলের ঘরে আমার যে অনুভূতি হচ্ছিল। ধীরে ধীরে একতাল ধোঁয়া রূপ ধারণ করছে। তার মানে, তার মানে… আমি ভুল দেখিনি বা স্বপ্ন দেখিনি। কিন্তু এ কী? এই ধোঁয়াটার রঙ লাল! লালচে মেরুন বলা যায়। অল্প সময়ের মধ্যেই ধোঁয়াটা ঘন হয়ে যে-রূপটা ধরল, সেটা চিনতে আমার কোনও অসুবিধা হল না। এর বিষয়ে আমরা পড়েছি। ওনি। ঘরটার মাথা প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে এতটাই লম্বা এবং চওড়া। তবে যেমন পড়েছিলাম, হাতে কিন্তু কোনও মুগুর নেই। হাত খালি। তার মুখ এতটাই ভয়ানক আর মাথায় অন্তত আটটা শিং। তবে আমার দিকে ওর দৃষ্টি নেই। আমি যে খুপরিতে লুকিয়ে ছিলাম, সেই খুপরির মাথার কাছে একটা বুদ্ধমূর্তি রাখা। সেই মূর্তির দিকে তার নজর। ওর দিকে নজরটা এক রেখেই বন্দুকটা বার করলাম। কিন্তু ফায়ার করার আগেই ওনি একটা বিরাট ঘুসি মারল দেওয়ালে। ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠল জায়গাটা। দেয়ালটা ভেঙে পড়ার আগেই কোনোমতে ওই খুপরি থেকে পালিয়ে গেলাম আমি। পুরো ব্যাপারটাই ঘটল চোখের পলক পড়ার গতিতে। আর তখনই ওনি আমাকে দেখতে পেয়ে গেল। নজর ঘুরে গেল আমার দিকে। আমার বন্দুকটা ওই ধ্বংসস্তূপেই থেকে গেছে। নীলকে দেখতে পাচ্ছি না কোথাও। এবার আমি শেষ…

কিন্তু না। তার আগেই আমার পিছন দিকে কালো কাচে ঢাকা জানালার কাচ ভেঙে ঘরে ঢুকে এল আরেকটা ধোঁয়া। এই ধোঁয়া আমার পরিচিত। আমার হোটেলের ঘরেই দু-বার দেখেছি। ধূসর ধোঁয়া মূহূর্তের মধ্যে পরিণত হল এক নীল-সবুজ রঙের ওনিতে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল লাল ওনির উপরে। এ কী দেখছি! দুই দৈত্যে ধস্তাধস্তি শুরু হল। তাদের মারপিটে পরপর বইয়ের তাক পড়ে যেতে শুরু করল।

এমন সময় ঘরের অন্যদিক থেকে এসে পড়ল নীল। তার হাতের বেঁটে লাঠিটা পরিণত হয়েছে একটা কাটানা তলোয়ারে। কাটানা হল একটা বিশেষ জাপানি তরোয়াল, একদম সোজা। তরোয়ালটা দেখেই হয়তো লাল ওনি আবার ধোঁয়ায় পরিণত হল, আর একটুও সময় নষ্ট না করে নীল ওর পকেট থেকে একটা ছোট্ট বাক্স বার করে, সেটা মাটিতে রেখে, ঢাকনা খুলে একটা বিজাতীয় মন্ত্র পড়া শুরু করল। ভাষা শুনে মনে হল পুরোনো দিনের জাপানি ভাষা। একটা ছোটো টর্নেডো বেরিয়ে যেন ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মতো লাল ধোঁয়াটাকে শুষে নিল। তারপর নিজেই বন্ধ হয়ে গেল।

সবজেটে নীল ওনি যেন আমার মতোই হতভম্ব হয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে ছিল। নীল তার দিকে তাকাতেই সে মাথা নীচু করে অভিবাদন জানিয়ে পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল, “হে ভারতীয় রাজপুত্র-রাজকন্যা, আমার অভিনন্দন গ্রহণ করুন। হোকে শহরকে লাল ওনির অত্যাচার থেকে মুক্ত করার জন্য আপনাদের অভিবাদন জানাই।”

আমি তো শুনে হাঁ। জাপানি দৈত্য ইংরেজি বলছে! সে আমার দিকে ফিরে বলল, “হে রাজকুমারী, আপনারা দুজনেই বুঝবেন এমন ভাষায় কথা বলছি। আপনার কি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে?”

মাথা নাড়লাম সঙ্গে সঙ্গে, একদমই না। তবে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার আশা করিনি তো বটেই। যাক গে।

নীল বলল, “কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ?”

নীলচে সবুজ ওনি বলল, “ওই হোকে পাহাড়ের উপরে যে ওনির মূর্তি রয়েছে, ওটা আমারই মূর্তি। আমি ওখানে বাস করি আর এই শহরের দিকে নজর রাখি।”

“কেন? এই শহরে তো কিছুই দরকারি নেই। যা পুরোনো পুথিপত্র আছে, সবই তো রাজপরিবারের লাইব্রেরিতে স্থান পেয়েছে।” জিজ্ঞাসা করল নীল।

“আপনারা হয়তো জানবেন, ওনির হাতে একটি লোহার মুগুর থাকে। যাকে বলা হয় কেনাবো। কেনাবো নামের মুগুরটা হাতে পেলে একজন ওনি হয়ে উঠতে পারে ওনি-নি-কেনাবো। মানে হল যাকে জয় করা অসম্ভব। এই অস্ত্রটি পেলে একজন ওনিকে আর হারানো যায় না।

“আজ থেকে বহু বহু আগে, একজন লাল ওনি ছিল। সে তার কেনাবোর সাহায্যে এই অঞ্চলে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। আমি মানুষের পক্ষ নিয়ে তার সঙ্গে প্রায় দুশো বছর লড়াই করি এবং একসময়ে তাকে হারাই। এই কাজে আমাকে সাহায্য করেছিলেন দুজন বৌদ্ধ ভিক্ষু বৈজ্ঞানিক। তাঁরা এমন এক রসায়ন আবিষ্কার করেছেন যা দিয়ে ওই কেনাবোকে গুঁড়োয় পরিণত করা হয়। এর পরে ওই কেনাবোর গুঁড়োটাকে একটা সুরক্ষিত পাত্রে নিয়ে একজায়গায় লুকিয়ে রাখা হয় এবং সেই পাত্রের সঙ্গে একটি বিশেষ পদ্ধতির পুথিও রয়েছে যাতে লেখা আছে কীভাবে ওই কেনাবোর গুঁড়োকে আবার একটা মুগুরে পরিণত করা হবে। ওই সুরক্ষিত জায়গায় কীভাবে পৌঁছানো যাবে সে সম্পর্কিত একটা পুথি এখানে গোপনে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এবং আমার মূর্তিও স্থাপন করা হয়েছে যাতে আমি ওই পুথিটাকে রক্ষা করতে পারি। লুকিয়ে রাখার জন্যেই কখনোই ওই পুথি রাজপরিবারের কারও হস্তগত হয়নি, ওটা এখানেই আছে। আর এই লাল ওনি, ওই পুথির সন্ধানেই বার বার হানা দিচ্ছিল আর প্রতিবারই আমি ওকে তাড়াচ্ছিলাম।”

“নীল বলল, “লাল ওনিকে আমি বন্দি করেছি, ও আর ফিরে আসতে পারবে না।”

ওনি বলল, “আমি আপনাকে চিনি রাজপুত্র। আপনার আর আপনার বোনের কথা সারা বিশ্বে প্রচলিত। আর কোনও সমস্যা হবে বলে মনে হয় না, আপনারা নিশ্চিন্তে ফিরে যেতে পারেন। আমি আর কোনও ক্ষতি হতে দেব না।”

নীল বলল, “বেশ।” অবশেষে তার হাতের তরোয়াল আবার লাঠিতে পরিণত হল।

তেমন বিশেষ কিছু করতে পারিনি বলে আমার একটু খারাপ লাগছিল, তবে দৈত্যদের মারপিটে আমি কিছু করতে পারব বলেও মনে হল না। এক মুহূর্তের মধ্যেই সবজেটে নীল ওনি ঘর থেকে চলে গেল, আমরা দুজনেই রইলাম শুধু। নীল বলল, “তুই একটু দাঁড়া, আমি ওই ধ্বংসস্তূপ থেকে তোর বন্দুকটা উদ্ধার করতে পারি কি না দেখি। একা আজকে অনেকটা করেছিস, আমি ঘরের অন্য কোণে ছিলাম বলে চট করে চলে আসতে পারিনি।”

তারপর ও গিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বন্দুকটা নিয়ে ফিরে এল। আমরা হোটেলে ফিরে এলাম।

এই উত্তেজনাটার ফলে কতদূর ক্লান্ত ছিলাম সেটা বুঝতে পারলাম যখন বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কাল এখান থেকে আমরা চলে যাব।

এত ক্লান্তিতেও ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখলাম। সবজেটে নীল রঙের ওনি আমার কাছে এসে বলছে, ‘রাজকুমারী লালকমল। আপনি সাবধানে থাকুন, চোখকান খোলা রাখুন…’ আমার ঘুম ভেঙে গেল। উঠে বসে দেখি দিনের আলো ফুটে গেছে, পাশে নীল নেই। অবশ্য একটুক্ষণ পরেই সে ফিরে এল। বললাম, “কী রে, কোথায় গেছিলি?”

সে বলল, “কাল অত কাণ্ড হল লাইব্রেরিতে আর আজ কিছুই হবে না? জোবেন দাইসুকে ফিরে এসে লাইব্রেরি খুলে যা অবস্থা দেখেছে, পুলিশকে সঙ্গে সঙ্গে খবর দিয়েছে। পুলিশকে সে বলেছে কাল সে শহরে ছিল না, তার বৌও সাক্ষী দিয়েছে, কিন্তু আবার লাইব্রেরির কয়েকজন বলেছে কাল তারা জোবেন দাইসুকেকে দেখেছে।” এই বলে মুচকি হাসল। “শোন, কাল তোকেও লাইব্রেরিতে দেখা গেছে। চল তাড়াতাড়ি ব্যাগ গোছা, পুলিশ আসার আগেই আমরা বেরিয়ে পড়ি।”

একবার ভাবলাম স্বপ্নের কথাটা বলি। তারপর ভাবলাম, কী দরকার? এমন কিছু বলেনি যা নীলকে বলতে হবে। তাছাড়া হয়তো ওটা নিছক স্বপ্নই। দশ মিনিটের মধ্যে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। এবার সোজা তোত্তোরি এয়ারপোর্ট।

গল্পের আর কিছু বাকি নেই তেমন। শুধু একবার নীলের ব্যাকপ্যাকটা খুলতে হয়েছিল চেকিংয়ের সময়। কেন জানি না মনে হল ওখানে একটা ফাঁপা চোঙামতো দেখলাম যার ভেতরে রোল করা কিছু পুরোনো কাগজপত্র।

অলঙ্করণ দেবসত্তম পাল

জয়ঢাকের গল্পঘর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s