গল্প -অ্যালি-অনন্যা দাশ-শরৎ ২০২২

 অনন্যা দাশ -এর সমস্ত লেখা একত্রে

golpoally

হাল্কা কমলা রঙের ছোট পাখিটাকে আমরা যখন বাড়ি এনেছিলাম তখন মার্কিন জিমনাস্ট অ্যালি রাইসম্যান অলিম্পিকে মেয়েদের জিমনাস্টিকে সবে দুটো স্বর্ণ পদক পেয়েছে।  হাল্কা কমলা রঙের মেয়ে ক্যানারি পাখিটা তার বড়োসড়ো খাঁচাটাতে যে ভাবে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল তাই দেখে অ্যালি রাইসম্যানের কথাই মনে হয়েছিল আমাদের, সেই জন্যেই তার নাম আমরা রেখেছিলাম ‘অ্যালি’।

খুব খুশি সে নিজের খাঁচাতে। সঙ্গী পাখি হাল্কা হলুদ রঙের পাখি আকাশের সঙ্গে দিব্যি খেলে বেড়ায়, কুটুর কুটুর করে দানা খায়, দোলনায় দোলে, ভোর হলে মিষ্টি সুরে গান গায়। এখানে বলে রাখা ভালো যে মার্কিন দেশে পোষার জন্যে যে সব পাখি বিক্রি হয় সেগুলো আদৌ এদেশের পাখি নয়। তাদের জন্মও পরাধীন পরিবেশে। কেউ ভালোমানুষি দেখিয়ে তাদের খাঁচা খুলে উড়িয়ে দিলে তারা দুদিনও বাঁচতে পারবে না কারণ তারা শিকার করতে বা খাবার খুঁজে নিতে শেখেনি মোটেই। শেখেনি অন্য বড় পাখি বা জন্তুদের থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার কায়দাও। আর সব চেয়ে বড়ো কথা হল এরা বেশির ভাগই ট্রপিকাল জায়গার পাখি, এখানকার বাইরের ভয়ানক ঠান্ডা তারা কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। ঘরের আবহাওয়াতেই এরা ভালো থাকে।     

এবার ফেরা যাক অ্যালির কথায়। এখানে, মানে মার্কিন দেশে, যারা পাখি বিক্রি করে তারা জন্মের পরই পাখিদের পায়ে একটা ছোটো ধাতুর রিং মতন পরিয়ে দেয়। তাতে জন্ম সাল আর চেনার জন্যে কিছু নম্বর ইত্যাদি খোদাই করা থাকে। সেই রিংটাই অ্যালির জন্যে মারাত্মক হয়ে উঠল। ধাতুর রিং পায়ে বসে গিয়ে পায়ের নিচের অংশটা শুকিয়ে যেতে লাগল। আমাদের কলেজের পশুর ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এসে দেখাতে তিনি বললেন, “ওর পাটা কেটে বাদ দিতে হবে রিং সমেত, তবে যদি বাঁচে।“     

শুরু হল সার্জারি। সার্জেন বললেন এত ছোট পাখিকে আনেস্থিসিয়া দিলে সে আর বেঁচে ফিরবে না। কাজেই আনেস্থিসিয়া ছাড়াই করতে হবে যা করার। দুটো হাতের ওমের মধ্যে জড়িয়ে ধরে রাখা হল অ্যালিকে আর আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকা হল। অন্য দিকে তখন ধারালো কাঁচি দিয়ে অস্ত্রপচার চলছে। অ্যালির একটা পা কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হল ওই ধাতুর রিংটা শুদ্ধু। কাটা জায়গায় রক্ত বন্ধ করার ওষুধ লাগিয়ে দিয়ে আলতো করে খাঁচায় ফিরিয়ে দেওয়া হল তাকে। ঢাকা দিয়ে দেওয়া হল খাঁচাটাকে যাতে ও আর আকাশ ঘুমিয়ে পড়ে।     

পরদিন সকালে আমরা ভয়ে ভয়ে খাঁচার ঢাকা খুলে তাকিয়ে দেখলাম। অ্যালি বেঁচে আছে তো? সে কি পারবে এক পায়ে ভর দেওয়া জীবনকে মেনে নিতে? কুচকুচে কালো চোখ দিয়ে আমাদের তাকিয়ে দেখল অ্যালি। যেন বলছে আমি ঠিকই আছি। সব কিছু আগের মতনই আছে। 

এরপর ক্রমে আমরা দেখলাম আর উপলব্ধি করলাম যে অ্যালি সত্যিই চ্যাম্পিয়ান পাখি। কী অদম্য ইচ্ছে তার জীবনের সব কিছু উপভোগ করার! পা কাটা যাওয়ার আগে সে যা যা করত সব কিছু ধীরে ধীরে রপ্ত করে ফেলল এক পায়ে। ওর কারবার দেখে বোঝাই যেত না যে ওর একটা পা নেই।  আমরা মানুষেরা কত তুচ্ছ জিনিস নিয়ে আক্ষেপ করি, চিৎকার চেঁচামেচি করি কিন্তু ওই একরত্তি ছোট্ট পাখি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিল বেঁচে থাকা কাকে বলে! কোন ক্ষোভ নয়, কোন আক্ষেপ নয়। 

আরো অনেকদিন বেঁচে ছিল অ্যালি। জীবনের সব কিছু উপভোগ করেছিল ওই একটা পা নিয়েই। ও রামধনুর রাজ্যে চলে গেলেও আমাদের হৃদয়ের কোণের একটা  জায়গায় ওই ছোট্ট হাল্কা কমলা রঙের পাখিটার নাম লেখা থাকবে সব সময়। না রে অ্যালি, তোর কথা লিখতে গিয়ে কাঁদছি না আমি।    

অলঙ্করণ- মৌসুমী রায়

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s