প্রথমে নৃশংস উত্তরে খুব ভয় পেল সেইবেই। কিন্তু তার সঙ্গীর যুক্তিজালে সহজেই ভুলে গেল সে। ফলে যতক্ষণ না সেইবেই ইয়োসিওয়ারার খাদের ধারে কোনো অথর্ব ভিখারি দেখতে পেল ততক্ষণ তারা চলতে লাগল। তাদের পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ভিখারির। সে জেগে যেই দেখল যে এক সামুরাই আর তার পেয়াদা তার দিকে আঙুল তুলে কীসব বলাবলি করছে, অমনি তার মনে হল যে যা কিছু ঘটছে এবং ঘটতে চলেছে তাতে তার ভালো কিছুই হবে না । তাই সে ভান করল যেন সে ঘুমিয়ে আছে, যদিও সে তীক্ষ্ণ নজরে লক্ষ করতে লাগল সারাক্ষণ। আর যেই না সেইবেই ছোরাখানা বাগিয়ে তার কাছে পৌঁছোল, অমনি ভিখারি ছোরার কোপ এড়িয়ে পাকড়ে ধরল সেইবেই-এর বাহু, তারপর সেটা মুচকে ধরে সেইবেইকে ঠেলে ফেলে দিল খাদের নিচে।
সঙ্গীর ধরাশায়ী দশা দেখে গোমপাচি খাপ খুলে তরোয়াল বার করে আক্রমণ করল ভিক্ষুককে। যদিও ভিক্ষুক তার পা দুটো নাড়তে অক্ষম, তবুও সে এমন ক্ষিপ্র গতিতে লড়াই করতে লাগল যে গোমপাচি কিছুতেই তাকে কাবু করতে পারল না। এমন সময় খাদের থেকে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এল সেইবেই আর সাহায্য করার চেষ্টা করল গোমপাচিকে, কিন্তু ভিক্ষুক বুদ্ধি করে এমনভাবে তার দিকে ধেয়ে আসা আঘাতগুলোকে কাটাল যে সেইবেই-এর কপাল আর হাত কেটে গেল।
এদিকে গোমপাচি চিন্তা করল যে ভিখারির সাথে তার কোনো শত্রুতাই নেই, বরং এখন এই উদ্দেশ্যবিহীন লড়াই চালানোর থেকে বেশি জরুরি সেইবেই-এর শুশ্রূষা শুরু করা। তাই সে সেইবেইকে টেনে নিয়ে ভিখারিকে ছেড়ে চলে গেল। ভিখারিও তাদের পিছু নেওয়ার পক্ষে বেশ দুর্বল।
তারপর গোমপাচি যখন সেইবেই-এর ক্ষত পরীক্ষা করে দেখল, তখন বুঝল তাদের রাতের ফুর্তির পরিকল্পনা মুলতুবি রেখে বাসায় ফিরে যাওয়াই ভালো। তাই তারা চোবেই-এর আশ্রয়ে ফিরে এল। এদিকে মাথার ঘায়ের কথা জানাজানি হওয়ার ভয়ে অসুখের ভান করে সেইবেই শুয়ে পড়ল। পরদিন সকালে চোবেই তাঁর নিজের কাজে লাগানোর জন্য ডেকে পাঠালেন সেইবেইকে এবং জানতে পারলেন যে সে অসুস্থ। তাই সেইবেই যে ঘরে শুয়েছিল বিছানায় সেই ঘরে গেলেন চোবেই। আর দেখে ফেললেন সেইবেই-এর কপালের তরোয়ালের আঘাত।
প্রথমে তো সেইবেই কিছুতেই বলতে চায় না যে কিভাবে কপালে তরোয়ালের কোপ পড়ল, কিন্তু চোবেই-এর চাপাচাপিতে সেইবেই শেষে বলে ফেলল আগের রাতের সব ঘটনা। সব শুনে চোবেই-এর ধারণা হলো যে বীর ভিখারি নিশ্চয়ই কোনো ছদ্মবেশী সামুরাই, হয়তো অপরাধের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায় আছেন। এমন এক বীরপুরুষের উপকার করার ইচ্ছেতে সন্ধ্যাবেলা চোবেই চললেন ইয়োশিওয়ারার বাইরের বাঁধ বরাবর ভিখারিকে খুঁজতে, সঙ্গে নিলেন তাঁর দুই বিশ্বস্ত অনুচর, টোকেন গোম্বেই আর সিরোবেই, “তরুণ তুর্কি” -কে। ভিখারিও আগের রাতের অভিযানে তিলমাত্র ভয় পাননি বলে শুয়েছিলেন একই জায়গায়, বাঁধের ওপর। চোবেই যখন তাঁর কাছে পৌঁছোলেন, আর বললেন, “মশায়, আমি চোবেই, ওটোকাডেটের সর্দার, উপস্থিত আপনার সেবায়। আমি গভীর অনুতপ্ত কারণ আমার দলের দুজন গতরাতে আপনাকে আক্রমণ করে আপনার অপমান করেছে। যাই হোক, গোমপাচি, যত ওস্তাদ তরোয়ালবাজই হোক না কেন আপনার তুলনায় কিছুই না, তাই তাকে পিছু হটতে হয়েছে। আর তাতেই আমি বুঝলাম যে আপিনি নিশ্চয়ই এক মহান সামুরাই যিনি কোনো দূর্ভাগ্যজনক কারণে ভিখারী ও প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছেন। দয়া করে আপনি আমাকে আপনার সব কথা খুলে বলুন। আমি সামান্য পেয়াদা, কিন্তু হয়তো আপনার কাজে লাগতে পারি, যদি আপনি আমাকে অনুমতি করেন তো।”
প্রতিবন্ধীটি প্রথমে চোবেই-এর প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পরে চোবেই-এর বক্তব্যের সততা ও দয়ায় অভিভুত হয়ে বললেন, “মশায়, আমার নাম তাকাগি উমানোসুকে। আমি ইয়ামাটোর বাসিন্দা।” তারপর তিনি বললেন কিভাবে দুরাত্মা বানজায়েমনের পাপাচারে তিনি দুর্ভাগ্যের পাকে পাকে জড়িয়ে পড়তে পড়তে বর্তমান দশায় পৌঁছেছেন।
“এই সবই ভারি অদ্ভুত কথা্” রাগে ছটফট করতে করতে বললেন চোবেই, “এই বানজায়েমনের কুচক্রী মনের কথা আমি টের পাবার আগে, সে আমার আশ্রয়েই ছিল। সে সানজাকে খুন করার পর এখানে থাকা তারপক্ষে মুশকিল ছিল। আমার এই দুই সাগরেদ তাকে তাড়া করেছিল এবং সেই থেকে সে আমার আশ্রয়ে ফেরেও নি আর।”
তারপর তিনি তাঁর শাগরেদদের সঙ্গে উমানোসুকের আলাপ করিয়ে দিলেন। আর একটা রেশমের পোশাক বার করলেন যা একটা পূর্ণবয়স্ক পুরুষের গায়ে ঠিকঠাক পরানো যাবে। ভিক্ষুকের বেশধারী যুবকটিকে স্নান করিয়ে তার চুলের পরিচর্যা করে, তাঁকে পরিয়ে দিলেন পোশাকটা। তারপর টোকেন গোম্বেইকে ডেকে উমানোসুকের দায়িত্ব ন্যস্ত করলেন। তারপর ডেকে পাঠালেন এক নামী চিকিৎসককে যাতে উমানোসুকের উরুর ক্ষতটা সারানো যায়। পরের দুমাসের চিকিৎসায় আর যত্নে, বিশ্রামে উমানোসুকের যন্ত্রণার উপশম হলো এবং তিনি সহজেই স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়াতে পারলেন। তারপরের মাসে উমানোসুকে যখন অল্প অল্প হাঁটতে শুরু করলেন তখন চোবেই তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন আর স্ত্রীর সামনে, শাগরেদদের সামনে ভান করতে লাগলেন যেন উমানোসুকে তাঁর কোনো আত্মীয় যিনি চোবেই-এর সাথে দেখা করতে এসেছেন। আরও কিছু সময় পরে, উমানোসুকে যখন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন, সে একটা দারুণ বিখ্যাত মন্দিরে পুজো দিতে গেলেন তিনি। ফেরার পথে রাতের অন্ধকারে তিনি একচোট বৃষ্টিতে ভিজে গেলেন। তখন একটা বাড়ির চালের নিচে আশ্রয় নিলেন তিনি।
বাড়িটা ছিল ইয়ানাজিওয়ারা শহরের এক প্রান্তে। আর অপেক্ষা করতে লাগলেন আকাশ পরিষ্কার হওয়ার। এদিকে সেই রাতটাই ছিল গোমপাচির রক্তাক্ত অভিযানের রাতগুলির একটি, যার মূলে সে নিজে, তার দারিদ্র্য এবং কোমুরাসাকির প্রতি তার ভালোবাসা। সে যখন দেখল যে একজন সামুরাই বেশ দুরবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, সে অমনি ঝাঁপিয়ে পড়ল, একবারও খেয়াল করল না যে সেই সামুরাই আর কেউ নয় তার মালিক চোবেই-এর বন্ধু উমানোসুকে। উমানোসুকে তরোয়াল বাড়িয়ে নিজেকে রক্ষা তো করলেনই, গোমাবাচির কপালটা চিড়েও দিলেন। আর তাতেই নিজের দূর্বলতার আঁচ পেয়ে গোম্পাচি পালিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে। সদ্য সেরে ওঠা চোটে আবার আঘাত লাগার আশঙ্কায়, উমানোসুকে তাড়া করলেন না গোম্পাচিকে। বরং চটপট ফিরে গেলেন চোবেই-এর বাড়িতে। গোম্পাচি ডেরায় ফিরে বানিয়ে বানিয়ে একটা গল্প বলল চোবেই-কে তার কপালের ক্ষতটার ব্যাখ্যা হিসেবে। তাহলেও, উমানোসুকে যখন গোম্পাচিকে তার অপকর্মের জন্য দুয়েক কথা শোনাচ্ছিলেন, সেসব চোবেই শুনে ফেললেন আর বুঝলেন সত্যি সত্যি কী হয়েছে। একটা খুনে ডাকাতকে তিনি তাঁর চৌহদ্দিতে রাখতে চাইলেন না আর। গোম্পাচিকে ডেকে কিছু টাকাপয়সা উপহার হিসেবে দিয়ে তাকে বলে দিলেন যে সে যেন আর কখনও চোবেই-এর বাড়িমুখো না হয়।
এই সময় চোবেই বুঝলেন যে উমানোসুকে শরীরের বল ফিরে পেয়েছেন। তিনি তাঁর শাগরেদদের নানান দল বানালেন। একেক দলকে একেক দিকে পাঠালেন বানজায়েমনের খোঁজে, যাতে উমানোসুকে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে পারেন। শিগিগিরই খবর এলো চোবেইএর কাছে যে বানজায়েমন আসাকুসার ঠগের দলে ভিড়ে, নানা হাতসাফাইয়ের খেলা দেখিয়ে রোজগার করছেন। খবরটা চোবেই উমানোসুকেকে দিলেন। উমানোসুকেও উপযুক্ত প্রস্তুতি নিলেন।। পরদিন ভোরে দুজনে রওয়ানা হয়ে গেলেন আসাকুসার দিকে, যেখানে গাঁইয়া ভুতেদের তরোয়ালের অবাক কারসাজি দেখিয়ে দিন কাটাচ্ছিল বানজায়েমন।
সেখানে মঞ্চ ঘিরে চাষাভুসো লোকেদের ভিড়। তারা হাঁ করে বানজায়েমনের কেরামতি দেখতে মশগুল। উমানোসুকে সেই ভিড় ঠেলে গিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “ওরে ঠগ, খুনে কাপুরুষ, আমাকে চিনতে পারছিস? আমি উমানোসুকে, উমানোজোর পুত্র। তোর ছলের শিকার তিনজন নির্দোষ মানু্ষ। তাদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এসেছি আমি। যদি তুই পুরুষ হোস তো নিজেকে রক্ষা কর, কারণ আজই তোর আত্মা নরক দর্শন করবে।”
কথাগুলো শেষ হতে না হতেই সে প্রবল ক্ষোভে ঝাঁপিয়ে পড়ল বানজায়েমনের ওপর। পালানো অসম্ভব দেখে, বানজায়েমন প্রতিরোধের চেষ্টা করল। কিন্তু তার কাপুরুষ হৃদয় কেঁপে উঠল বারবার তার বিনাশকর্তার বিক্রমে, আর সে অচিরেই লুটিয়ের পড়ল তার বিনাশকের পদতলে, রক্তাক্ত কলেবরে।
বলাই বাহুল্য যে উমানোসুকে চোবেইকে তাঁর সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে কৃতজ্ঞতায় পঞ্চমুখ হলো, এমনকি তারপরেও, তার নিজের দেশে ফিরে গিয়েও, তার মনের মণিকোঠায় রেখেছিল চোবেইএর প্রতি তার কৃতজ্ঞতা। আর চোবেইকে সে দ্বিতীয় পিতার সম্মান করত।
এভাবেই চোবেই তাঁর ক্ষমতা ব্যববহার করতেন দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালনে। আর নিজের অগাধ সম্পত্তি বিলিয়েছিলেন দরিদ্রদের মধ্যে, দূর্ভাগাদের সহায় হয়েছিলেন যাতে কাছে, দূরে তাঁর নাম মর্যাদা পায়। তাঁর দূর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর কথাও বিধৃত আছে।
আমরা তো জেনেইছি যে কিভাবে আমাদের প্রভু মিদজুনো জিউরোজায়েমন, যিনি দলবদ্ধ সম্ভ্রান্তজনদের নেতা ছিলেন, চোবেইকে লজ্জায় ফেলার ষড়যন্ত্র করে ধরা পড়েছিলেন আর কিভাবে ওটোকাডেটের পিতা চোবেই তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দিয়ে বারবার অহঙ্কারী সম্ভ্রান্তজনদের অস্ত্র থেকে নিজেকে রক্ষা করেছিলেন। চোবেইকে আহত করার সমস্ত চেষ্টার ব্যর্থতা বড়ো তীব্র হয়ে বেজেছিল জিউরোজায়েমনের বুকে। তিনি চোবেইকে খুবই ঘৃণা করতেন। সারাক্ষণ ফিকির খুঁজতেন যে কিভাবে চোবেইকে পর্যুদস্ত করা যায়।
একদিন তিনি তাঁর এক শাগরেদকে পাঠিয়েছিলেন চোবেইএর বাড়িতে এই খবর দিয়ে যে পরদিন সকালে জিউরোজায়েমন চোবেইএর সাথে তাঁর বাড়িতে দেখা করতে চান আর এক পাত্র সুরা দিয়ে চোবেইএর সেবা করতে চান, চোবেই ঠাণ্ডা ম্যাকারোনি দিয়ে প্রভু জিউরোজায়েমনের যে সেবা করেছিলেন, তার প্রতিদানে।
চোবেই সন্দেহ করলেন যে এই বন্ধুত্বপূর্ণ নিমন্ত্রণের পিছনে ধূর্ত প্রভুর কোনো চক্রান্ত আছে, তিনি হাসি দিয়ে তরোয়াল ঢাকছেন। যদিও চোবেই জানতেন যে যদি ভয় পেয়ে তিনি এই নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে তাঁর গায়ে বসবে কাপুরুষের তকমা, তিনি নির্বোধদের মধ্যেও হাস্যকর হয়ে উঠবেন। তাই তাঁকে লজ্জিত করার চেষ্টায় জিউরোজায়েমনের সাফল্যের সম্ভাবনাকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে, তিনি তাঁর প্রিয় শাগরেদ টোকেন গোম্বেইকে ডেকে পাঠালেন, আর তাকে বললেন, “আমাকে মিদজুনো জিউরোজায়েমন এক পানাসরে নেমন্তন্ন করেছেন। খুব ভালো করে জেনে রাখো যে এটা একটা ছল, আমি যে তাঁকে বোকা বানিয়েছিলাম তার শোধ তোলার জন্য। হয়ত আমাকে হত্যা না করলে তাঁর ঘৃণা তৃপ্ত হবে না। তাহলেও আমি যাব, আর সুযোগ নেব। যদি কোনো ষড়যন্ত্রের আভাস পাই তাহলে দুনিয়াকে এক স্বেচ্ছাচারির কবল থেকে মুক্ত করার জন্য নিশ্চয়ই চেষ্টা করব। সেই স্বেচ্ছাচারী যার দিন কাটে অসহায় চাষা আর পেয়াদাদের উৎপীড়ন করে। যদিও আমি সফল হই জিউরোজায়েমনকে তাঁর নিজ গৃহে হত্যা করতে, তবুও আমার জীবন বিসর্জন দিতে হবে সেই কৃতকর্মের জন্য। তুমি কাল রাতে জিউরোজায়েমনের বাড়িতে একটা কবর দেওয়ার গামলা নিয়ে হাজির হয়ো, আমার মৃতদেহ তাতে করে ভরে নেওয়ার জন্য।”
“পিতা”-কে এইসব বলতে শুনে টোকেন গোম্বেই খুব ভয় পেল। সে চোবেইকে বোঝাতে চাইল যে তিনি যেন এই নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু চোবেই মনস্থির করে ফেলেছিলেন। টোকেন গোম্বেই-এর নিষেধে কর্ণপাত না করে তিনি নির্দেশ দিতে লাগলেন কিভাবে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সমস্ত সম্পত্তির বন্টন হবে। আরও উদ্যোগী হলেন তাঁর ঐহিক কর্তব্যগুলোকে মিটিয়ে ফেলতে।
পরের দিনে দুপুরের দিকে তিনি তৈরি হলেন জিউরোজায়েমনের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। রওয়ানা হওয়ার আগে তাঁর এক চ্যালাকে আদেশ দিলেন যে প্রীতি উপহার নিয়ে তাঁর আগে আগে যাওয়ার জন্য। জিউরোজায়েমন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন চোবেই-এর আগমনের। তিনি যেই শুনলেন যে চোবেই পৌঁছেছেন তাঁর বাসায়, অমনি তাঁর শাগরেদদের বললেন যে কালবিলম্ব না করে চোবেইকে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে। চোবেইও তাঁর শাগরেদদের আদেশ দিলেন যে রাতে তাঁকে যেন শাগরেদরা অবশ্যই নিয়ে যেতে আসে। তারপর প্রবেশ করলেন জিউরোজায়েমনের আবাসে।
যেই তিনি জিউরোজায়েমন যে ঘরে বসেছিলেন সেই ঘরের পাশের ঘরে গেলেন অমনি টের পেলন যে জিউরোজাইয়েমনের চক্রান্ত নিয়ে তাঁর আশঙ্কা মিথ্যে নয়। কারণ দুজন মানুষ খোলা তলোয়ার হাতে তাঁর দিকে ধেয়ে এলো আর তাঁকে কেটে ফেলার চেষ্টা করল। কৌশলের সঙ্গে তিনি তাদের আঘাত এড়িয়ে গেলেন, একজনকে মাটিতে আছড়ে ফেললেন আর অপরজনের পাঁজরে লাথি কষালেন, যার জেরে সে দেওয়ালের দিকে গড়িয়ে গেল। তারপর যেন কিছুই হয় নি এমন ভান করে উপস্থিত হলেন জিউরোজায়েমনের সামনে। এদিকে জিউরোজায়েমন দু ঘরের মধ্যেকার দরজার ঠেলা পাল্লা ফাঁক করে সবই দেখেছিলেন। জিউরোজায়েমন বললেন, “স্বাগতম, স্বাগতম, স্বাগতম! চোবেই মশাই। আমি তো সারাক্ষণই শুনি আপনার সাহসিকতার কথা। তাই আমার সাংঘাতিক কৌতুহল যে আপনি কোন ধাতুতে গড়া! তাই আমি আমার শাগরেদদের লাগিয়ে পরখ করে দেখলাম আর কি যে আপনি ঠিক কেমন সাহসী। আপনি তো ওস্তাদের মার মারলেন! যা হোক, আপনাকে কিন্তু এই উদ্ধত অভ্যর্থনা মাপ করতে হবে। আসুন আমার পাশে বসুন এখন।”
“সে কথা নাই বা বললেন, প্রভু” বললেন চোবেই বেশ ব্যঙ্গাত্মক স্বরেই, “আমি জানি আমার সামান্য ক্ষমতা কোনো মহান সামুরাই-এর তুলনায় কিছুই নয়। আর যদি এই দুই মহোদয় ভয়ানক কোনো চোট পেয়ে থাকেন এইমাত্র তো তাও নেহাত ভাগ্যের ব্যাপার – এই আরকি।”
সুতরাং, যথারীতি প্রীতি সম্ভাষণ আদানপ্রদানের পর চোবেই বসলেন জিউরোজায়েমনের পাশে। পরিচারকরা সুরা ও মুখোরোচক এনে উপস্থিত করল। পান শুরু করার আগেই জিউরোজায়েমন বললেন, “চোবেই মশাই, আপনি নিশ্চয়ই এই গরমে এতটা পথ হেঁটে এসে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। আমার মনে হলো স্নান করলে আপনার আরাম হবে। তাই আমি আমার লোকেদের বলে দিয়েছি যে আপনার জন্য যেন স্নানের ব্যবস্থা করে। আপনি কি স্নান করবেন না?”
চোবেই সন্দেহ করলেন এটা তাঁকে বিবস্ত্র করার একটা ছল। তাহলে তাঁকে অতর্কিতে আক্রমণ করা যাবে স্নানের সময়, যখন তাঁর তরোয়াল খুলে রাখা থাকবে পাশে। যদিও তিনি বেশ সানন্দেই জবাব দিলেন, “প্রভু, আপনি ভারি ভালো। আমি তো খুবই আনন্দ পাব আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করে। শুধু আমাকে কয়েক মূহুর্তের জন্য মাপ করতে হবে।
তাই তিনি স্নানাগারে গেলেন, নিজের কাপড়-চোপড় বাইরেই ছেড়ে রাখলেন, আর তিনি স্নানে গেলেন মনে স্থির বিশ্বাস নিয়েই যে এই তাঁর মৃত্যুক্ষেত্র। তবুও তিনি অটল, অকম্প রইলেন, যদি তাঁকে মরতেই হয়, কেউ যেন বলতে না পারে যে তিনি কাপুরুষের মৃত্যু বরণ করেছেন। তারপর জিউরোজায়েমন তাঁর পরিচারকদের ডেকে বললেন যে, “জলদি কর!, স্নানঘরটা বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে দে। আমরা এখন ওকে ঝপ করে বন্দি করব। যদি ও বেরিয়ে আসতে পারে, তো তার দাম চোকাতে একাধিক প্রাণ যাবে। সৎযুদ্ধে ও একাই তোদের ছজনের সমান। দরজায় তালা দে। আর স্নানঘরের নিচের আগুনটা জ্বালিয়ে দে। আর আমরা ওকে জলে ফুটিয়ে মারব। আর ওর হাত থেকে ছুটকারা পাব। জলদি কর রে সব, জলদি কর।”
তাই তারা দরজায় তালা দিয়ে দিল। আগুনে ততক্ষণ ইন্ধন দিয়ে গেল যতক্ষণ না জল সোঁ-সোঁ করে ফুটতে শুরু করল আর তাতে বুদবুদ উঠতে লাগল। যন্ত্রণায় কাতর চোবেই, দরজা ভেঙে বেরোনোর চেষ্টা করল। কিন্তু জিউরোজায়েমন তাঁর লোকেদের আদেশ দিলেন যে দেওয়াল ফুঁড়ে তাদের বর্শা গুঁজে দিতে আর চোবেইকে মেরে ফেলতে। দুটো বর্শা মুঠোয় ধরে সেগুলোকে ভেঙে টুকরো করে দিলেন চোবেই। কিন্তু শেষে তাঁর পাঁজরে গেঁথে গেল প্রাণঘাতি আঘাত। আর এক বীর মারা পড়লেন একদল কাপুরুষের হাতে।
সন্ধেবেলা চোবেই-এর স্ত্রীকে চমকে দিয়ে টোকেন গোম্বেই একটা কবর দেওয়ার পাত্র নিয়ে এলেন। তাঁর সঙ্গে এলেন সাতজন শিক্ষানবিশ। চললেন জিউরোজায়েমনের বাসা থেকে ওটোকাডেটের পিতাকে আনতে। তাদের দেখে জিউরোজায়েমনের শাগরেদরা টিটকিরি দিল, “কী ব্যাপার, তোদের মাতাল প্রভুকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা ময়লা ফেলার পাত্র এনেছিস?”
“না”, উত্তর দিলেন গোম্বেই, “বরং আমরা তাঁর মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা কফিন এনেছি, যেমন তিনি আমাদের আদেশ করেছিলেন।”
এ কথা শুনে চোবেই-এর সাহসের আন্দাজ পেয়ে চমকে উঠল শাগরেদরা। তারা অবাক হলো যে, নিজের পরিণতি জেনেবুঝে চোবেই হাসিমুখে তাঁর পরিণতিকে বরণ করেছেন। চোবেই-এর মৃতদেহ কফিনে ভরে তাঁর শিক্ষানবিশদের দিয়ে দেওয়া হল, যাঁরা প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন চোবেই-এর হত্যার প্রতিশোধ নেবেন বলে। দূরদূরান্তের দুঃস্থ আর নির্বান্ধব মানুষ, তাঁর মৃত্যুতে শোক যাপন করল। তাঁর পুত্র চোমাতসু তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেলেন, তাঁর স্ত্রী সদাচারী বৈধব্য পালন করলেন আমৃত্যু, এই প্রার্থনায় যে তিনি যেন স্বর্গে চোবেই-এর সাথে একই পদ্মের বুকে বসতে পান।
বহুবার চোবেই-এর শিষ্যরা একত্র হলেন তাঁর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু জিউরোজায়েমন তাদের কেবল ফাঁকি দিয়ে পালাতে লাগল যতদিন না সরকার তাকে বন্দি করে রাখল উয়েনোর কানিয়েজি মন্দিরে, যেমন বলা আছে “কাজুমার প্রতিশোধ” গল্পে, আর নিস্তার পেল যাবতীয় প্রতিশোধ স্পৃহার নাগাল থেকে।
এইভাবেই বেঁচে ছিলেন এবং মৃত্যু বরণ করেছিলেন ইয়েডোর ওটোকাডেটের পিতা, বান্ডজুইনের চোবেই।