সপ্তাহে অন্তত একদিন ব্যারাকপুর চিড়িয়া মোড়ের নিউসান রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ করতে আসেন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল বিনোদ গুপ্তা।
বিশ্বজনিক শহর ব্যারাকপুরে স্কুল ও রেস্তোরাঁর অভাব নেই। নানা ভাষাভাষীর, নানা পেশার হাজারো লোকের বাস এ শহরে। শহরের অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে পুলিশ ট্রেনিং স্কুল ও সামরিক বাহিনীর ছাউনি। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। এই শহরের সিপাহী ছাউনিতেই মঙ্গল পাণ্ডে নামে ব্রিটিশ সরকারের এক সিপাহী প্রথম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। এই শহরেই এশিয়ার প্রথম চিড়িয়াখানা স্থাপন করেছিলেন লর্ড ওয়েলেসলি।
সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নেবার পর কর্নেল বিনোদ গুপ্তা ফিরে যাননি তাঁর পিতৃপুরুষের ভিটে লখনউতে। শহরের প্রান্তে একটি বাগানবাড়ি কিনে পাকাপাকিভাবে থেকে গিয়েছেন শেষ পোস্টিং ব্যারাকপুরেই। ছোটো একটা লাইব্রেরি করেছেন বাড়িতে। সারাদিন পড়াশুনা আর বাগানচর্চা নিয়েই থাকেন। অধিকাংশ বইপত্র নেট থেকে কিনলেও সপ্তাহে একদিন শহরের বইয়ের দোকানগুলোতে ঢুঁ মারেন নতুন বইয়ের খোঁজে। বই কিনে সোজা চলে আসেন চিড়িয়া মোড়ের তিনতলার এই রেস্তোরাঁয়। সাধারণত সপ্তাহের মাঝে আসেন বলে দুপুরের দিকটাতে প্রায় ফাঁকা পান রেস্তোরাঁটা। এক কাপ কফি নিয়ে সদ্য কেনা বই খুলে বসে পড়েন মোটা গদিওয়ালা রাস্তার দিকের কাচ-ঢাকা জানালার পাশে ছয় আসনের টেবিলের কোনায়। কফির কাপ শেষ হলে কোনোদিন আরো একটা কফির অর্ডার দিয়ে ডুবে যান বইয়ের পাতায়। এভাবে কেটে যায় ঘণ্টা দেড়-দুয়েক। তারপর অর্ডার দেন ওঁর প্রিয় খাবার চিকেন বিরিয়ানি ও স্যালাডের।
আজ সদ্য কেনা ‘পুখতুনিস্তান – দ্য ল্যান্ড অফ পুখতুনস’ বইটা কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পরই ঠিক করলেন এই বইটা শেষ না করে আজ এখান থেকে উঠবেন না। একবারে ডিনার খেয়ে বাড়ি ফিরবেন। ব্রিটিশ সরকারের সামরিক বাহিনীর এক বাঙালি ইঞ্জিনিয়ারের আফগানিস্থানের পুখতুনদের নিয়ে লেখা এই বইটা হঠাৎ করেই চোখে পড়ে গেছিল দোকানের এককোণে। পুরু ধুলো জমে ছিল বইটার ওপরে।
তিন কাপ কফি খাবার পর রেস্তোরাঁর ম্যানেজার এসে বললেন, “লাঞ্চ করবেন না? তিনটে বেজে গেছে!”
“ও হ্যাঁ, দিন। ইয়ে, রাতের খাবার খেয়ে ফিরব। আশা করি এখানে বসে থাকলে আপনাদের অসুবিধা নেই!”
“না স্যার, কোনো অসুবিধা নেই। বিরিয়ানি আর স্যালাডই দেব তো?”
“ওহ্, ইয়েস।”
সবে বিরিয়ানির আলুর একটা টুকরো কেটে মুখে পুরেছেন, তখনই রেস্তোরাঁর পুরু কাচের দরজা ঠেলে একদল মহিলা ঢুকলেন। এতক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে থাকা রেস্তোরাঁ মুহূর্তে জেগে উঠল যেন। প্রায় সবক’টা টেবিল ভরে গেল নিমেষে। চারজন মহিলা কর্নেলের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে লাগলেন। কারণ, ওঁর টেবিলে পাঁচটি আসন ফাঁকা রয়েছে। ইতস্ততর কারণ টেবিলের ওপর রাখা একটি কার্ড—‘রিসার্ভড’।
কখন যে রেস্তোরাঁর ম্যানেজার ‘রিসার্ভড’ কার্ডটা ওঁর টেবিলে রেখে গেছেন খেয়াল করেননি কর্নেল। আড়চোখে দেখলেন, দূরে দরজার পাশে কয়েকটা টেবিল খালি আছে। কিন্তু উনি যে টেবিলে বসে আছেন সেরকম আকর্ষণীয় অবস্থান নয় ওই টেবিলগুলোর। ওঁর টেবিল থেকে বসে যেমনি শহরের অনেকটা দেখা যায়, অন্য টেবিলে বসে রেস্তোরাঁর দেওয়ালে সাঁটানো সুদৃশ্য ওয়ালপেপার ছাড়া আর কিছু নজরে পড়ে না।
কর্নেল গুপ্তা বাংলা ভালো লিখতে পড়তে জানলেও বলাতে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। কিন্তু টেবিলের সামনে চারজন মহিলাকে তাঁর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চুপ করে থাকতে পারলেন না।
“ওয়ান্ট টু আস্ক মি সামথিং?”
রিসার্ভড বোর্ড দেখিয়ে একজন মহিলা বলে উঠলেন, “না মানে, এত বড়ো টেবিলে তো আপনি একা আছেন, আরো কেউ আসবে বোধ হয়?”
বই পড়ার দফারফা হয়ে গেল। দুষ্টুমি চেপে বসল কর্নেলের মাথায়। “নট শিওর। মে কাম, মে নট।”
“কেউ না এলে আমরা কি এই টেবিলে বসতে পারি?”
“ইউ ক্যান, বাট দে মে ফিল ডিস্টার্বড।”
“আপনি কাদের কথা বলছেন? মানে আপনার যাঁরা আসবেন?”
“না, এই টেবিলে এখন যাঁরা আছেন।”
“কিন্তু টেবিলে আপনি ছাড়া তো আর কেউ নেই!”
“আছে, দে আর ভেরি মাচ হিয়ার।”
কর্নেলের ভারী গলার স্বর কানে যেতে রেস্তোরাঁ ভর্তি মহিলাদের কলকলানি হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার সহ বেশ কয়েকজন ওয়েটারও এসে দাঁড়িয়েছে কর্নেলের টেবিলের সামনে। সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করে দিয়েছে। রিসার্ভড টেবিলে মাত্র একজন বসে আছেন, অথচ উনি বলছেন টেবিলে উপস্থিত অন্যদের অসুবিধা হতে পারে? রাশভারী চেহারার কর্নেলের গলার স্বরে এমন কিছু আছে যাকে উপেক্ষা করা সহজ নয়।
“স্যার, আপনার জন্য কি একটা আলাদা টেবিলের ব্যবস্থা করে দেব?” বলে উঠলেন ম্যানেজার।
“নো নো, আই অ্যাম ফাইন, দে মে সিট হিয়ার। আই ওনলি টোল্ড দিস লেডিস দ্যাট ইফ দে সিট হিয়ার, আদার অকুপেন্টেস অফ দিস টেবিল মে ফিল ডিস্টার্বড।”
“বাট স্যার, দেয়ার ইস নো ওয়ান এক্সসেপ্ট ইউ ইন দিস টেবিল!” প্রায় চিৎকার বেরিয়ে এল রেস্তোরাঁর ম্যানেজারের গলা থেকে।
“ইয়েস, আই রিপিট, দে আর হিয়ার ভেরি মাচ!”
“কিন্তু স্যার,” এক মহিলার গলা থেকে আর্তনাদ বেরিয়ে এল প্রায় “কেউ তো নেই এখানে!”
“আছে আছে, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না। আমি মিলিটারিতে ছিলাম, আমাদের সেন্স অনেক বেশি কাজ করে। ভুলে যাবেন না আমরা যে শহরে বসে আছি সেই শহরেই সিপাহী মিউটিন শুরু হয়েছিল। অনেক শহিদের রক্ত রাঙানো এই শহর।”
“আ-আ-আপনি কি ভূ-ভূ-ভূতের কথা বলছেন?” এক মহিলা তুতলে উঠলেন।
“আমি কিছু বলিনি, ওনলি আই টোল্ড দ্যাট দে আর হিয়ার অ্যান্ড ইফ ইউ সিট হিয়ার, দে উইল বি ডিস্টার্বড।”
“স্যার, কী বলছেন? আমাদের রেস্তোরাঁ নতুন হতে পারে, কিন্তু এখানে কেউ অস্বাভাবিক কিছু দেখিনি। স্যার, আপনি তো রেগুলার আসেন। কোনোদিন কিছু বলেননি। আপনি বই পড়ছিলেন বলে আমিই খানিক আগে ‘রিসার্ভড’ বোর্ডটা আপনার টেবিলে রেখে গেছিলাম যাতে আপনাকে কেউ ডিস্টার্ব না করে। কারণ, এ সময় রেস্তোরাঁ প্রায় ফাঁকা থাকে।”
“নো নো ম্যানেজার, ডোন্ট ওয়ারি, আই উইল টেক কেয়ার অফ দেম।”
“স্যার নতুন রেস্তোরাঁ, কোনো বদনাম রটে গেলে ফিনিশ হয়ে যাব। কেউ আসবে না। প্রায় কোটি টাকা খরচ হয়েছে এই রেস্তোরাঁ বানাতে।”
“আই টোল্ড ইউ, আই উইল টেক কেয়ার অফ দেম।”
“রেশমি, অন্য কোনো রেস্তোরাঁয় চল, ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না। লোকটা কে জানি না। কিন্তু যেভাবে বলছে…” দলের এক বয়স্ক মহিলা পেছন থেকে বলে উঠলেন।
“দূর, ভূত বলে কিছু আছে নাকি? তুমিও না বনিদি…”
“তাহলে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে কেন লোকটা? মতলব ভালো নয়। পুলিশে খবর দে।”
“স্যার, প্লিস এক্সপ্লেন হোয়াট অ্যাবাউট আর ইউ টকিং। স্যার, উই উইল বি ফিনিশড ইফ এনি রিউমার…”
“রিলাক্স ম্যানেজার, নাথিং উইল হ্যাপেনড। বাট ইউ হ্যাভ টু বি মোর কেয়ারফুল সো দ্যাট দে ডোন্ট গেট চান্স টু স্টে হিয়ার।”
“স্যার, প্লিস বলুন কাদের কথা বলছেন, আমরা আপনার টেবিলে অন্য কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।”
“আগেই বলেছি, আমি মিলিটারির লোক। সাধারণ লোকের নজরে যা আসে না, আমরা তা দেখতে পাই।”
“ও ভাই, আপনি তখন থেকে বলে যাচ্ছেন এখানে আরো কেউ আছে। ধুর, কেউ নেই, তখন থেকে শুধু ভয় দেখিয়ে চলেছেন কেন? এই আপনার সোফার পাশে বসছি। দেখি তো কে আছে।” বয়স্ক মহিলাটি এগিয়ে এলেন।
এক চামচ বিরিয়ানি মুখে তুলে বলে উঠলেন কর্নেল, “যাহ্, খাবারটা ঠান্ডা হয়ে গেছে।”
“স্যার, আপনাকে ওটা খেতে হবে না, আমরা নতুন করে খাবার দিচ্ছি। শুধু বলুন কীসের কথা বলছেন আপনি।” এক ওয়েটার ভিড়ের মধ্যে থেকে বলে উঠল।
“না না, নতুন করে খাবার দিতে হবে না। শুধু আরেকবার গরম করে দিলেই হবে।”
“স্যার…”
“আমরা মিলিটারির লোকেরা ঝুট বলি না। আই রিপিট, আই টোল্ড ইউ দ্যাট দে মে ফিল ডিস্টার্বড। নাউ সি।”
টেবিলের ওপর উলটো করে কাচের গ্লাসটা সোজা করতেই দুটো মাছি উড়ে গেল খাবারের প্লেটের ওপর দিয়ে।
অলঙ্করণ:রাহুল মজুমদার