সত্যজিত দাশগুপ্তর আগের গল্প মোতিবিবি, ক্লাইম্যাক্স, বোলতার চাক, বিশ্বনাথের চিত্রনাট্য, ফ্ল্যাট নম্বর ২০১, সেই মেয়েটা
(১)
এবারের গরমের ছুটিটা আমাদের কাটল শিলংয়ে। আর কাটল বেশ ভালোই। মে-জুনে কলকাতার অবস্থা কেমন হয় তা নিশ্চয়ই আলাদা করে বলতে হবে না। রোজ গাড়ির সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বাড়ছে দূষণ। বাধ্য হয়ে মানুষ এগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে। সঙ্গে অসহ্য গরম তো আছেই। সাংঘাতিক রোদের তাপ চাঁদি ফাটিয়ে দিচ্ছে। মনে হয় ঠান্ডা হাওয়াগুলোরও বিশাল বিশাল বিল্ডিংগুলোর মাঝে চেপে গিয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা!
সেখানে শিলং! সত্যি, ভাবা যায়! মে মাসের শেষেও শোবার সময় গায়ে পাতলা চাদর দিতে হচ্ছে! আর দৃশ্যগুলো? মনে গেঁথে রয়েছে। বিশেষ করে সেদিন বিকেলের সেই দৃশ্যটা। ঝিরঝিরে একটা বৃষ্টি হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। এবার রোদ উঠতে আবিষ্কার করলাম রামধনুটা। সাধারণত এতদিন রামধনু দেখে এসেছি মাথা তুলে আকাশের গায়ে। কিন্তু এটা ছিল একেবারে চোখ বরাবর। সামনের পাহাড়টা থেকে শুরু হয়ে পরের পাহাড়ে মিলিয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল একটা ঝুলন্ত সেতু। গঙ্গার পারে দাঁড়িয়ে হাওড়া ব্রিজ দেখছিলাম যেন!
ফেরার দিন খুব স্বাভাবিকভাবেই মনখারাপ। শিলং থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে সোজা এলাম গুয়াহাটি। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ধরে প্রায় ঘণ্টা খানেকের পথ কলকাতার দিকে চলে এসেছি, চোখের সামনে তখনো ভাসছে শিলং।
আমার প্রথম পছন্দ ছিল প্লেন। কিন্তু অনিদা বলে, ট্রেনে যে একটা যাচ্ছি যাচ্ছি ব্যাপার থাকে সেটা আকাশে উড়ে পাওয়া যায় না। আর ফেরার সময় স্মৃতি ঘাঁটতে ঘাঁটতে ফেরা—সেটার মজাই আলাদা। ভেবে দেখেছি, কথাটা একদম ঠিক। তাই শেষপর্যন্ত ট্রেনে চাপতে রাজি হয়ে গেলাম। তবে দেরিতে টিকিট কাটার জন্য এসির টিকিট পাইনি। স্লিপার ক্লাসের দুটো লোয়ার বার্থে সিট পেয়েছিলাম আমরা। আমাদের কুপের সাইড লোয়ারে বসেছিলেন এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক। সঙ্গে ফুটফুটে একটা বাচ্চা ছেলে। গুটি গুটি পায়ে বাচ্চাটা এদিক সেদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছিল, আর ওর বাবা ওকে ধমকে জায়গায় ফেরাচ্ছিলেন। থেকে থেকে বাচ্চাটা খালি জিজ্ঞাসা করছিল যে কলেজ স্ট্রিট পৌঁছতে আর কতক্ষণ। তাতে ওর বাবা ওকে বলছিলেন যে আর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওরা কলেজ স্ট্রিট পৌঁছে যাবে। বাচ্চা আর তার বাবার এই টম অ্যান্ড জেরি শো দেখতে দেখতে সময়টা খারাপ কাটছিল না আমার।
অনিদা তখন ব্যস্ত একটা ইংরিজি ম্যাগাজিন নিয়ে। আমার সঙ্গে ফেলুদার বই আছে বটে, কিন্তু ভাবছিলাম একটু পরে পড়া শুরু করব।
এবার আসল মজা শুরু হল চেকার আসার পর। টিটি ওই লোকটার কাছে টিকিট চাইলে পর উনি টিকিট দেখাতে চেকারের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া বাঁধল ওঁর। আশপাশ থেকে ততক্ষণে লোকজনের উঁকিঝুঁকি মারা শুরু হয়ে গেছে। আমি অবশ্য তখনো পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারিনি যে ঝামেলাটা ঠিক কী নিয়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি অনিদাও ম্যাগাজিনের পাতার ফাঁকে আঙুল গুঁজে ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে জিনিসটা বোঝার চেষ্টা করছে।
আসল ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল মিনিট দুয়েক পর। ভদ্রলোক থাকেন কলেজ স্ট্রিটে। স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গুয়াহাটি গিয়েছিলেন। পুরো পরিবারের যাতায়াতের দু-দিকেরই টিকিট কাটা ছিল। কিন্তু ওঁর স্ত্রীর ফেরার প্ল্যান দু-দিন পিছোতে উনি টিকিট ক্যান্সেল করতে দেন ওঁর শালাকে। কিন্তু ওঁর শালা ওঁর স্ত্রীর টিকিট ক্যান্সেল না করে ওঁরই টিকিট ক্যান্সেল করে দেন! এদিকে উনিও টিকিট না দেখেই ট্রেনে উঠে পড়েন! আর সেখানেই হয় কেলেঙ্কারি!
টিকিটে বাচ্চার সঙ্গে মহিলার নাম দেখে চেকার জিজ্ঞাসা করলেন, “শাঁওলি মজুমদার কে?”
তাতে ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, “আমার স্ত্রী।”
“তাহলে আপনার নাম কী?” জিজ্ঞাসা করলেন চেকার।
“অরিজিৎ মজুমদার।” বললেন ভদ্রলোক।
“কে অরিজিৎ মজুমদার?”
“আমি।”
“তাহলে শাঁওলি মজুমদার কে?”
“বললাম তো আমার স্ত্রী।” উত্তেজিত হয়ে বললেন ভদ্রলোক।
“তাহলে আপনি কে?” এবার রেগে গেলেন চেকার।
তাতে আরো ক্ষেপে গিয়ে ভদ্রলোক বললেন, “আরে মশাই, বললাম তো যে আমি অরিজিৎ মজুমদার।”
“তাহলে এখানে শাঁওলি মজুমদার লেখা কেন?”
“কোথায়?”
“কোথায় আবার? টিকিটে।”
“টিকিটে!” কথাটা শুনে এবার ভদ্রলোক তড়াক করে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ঠক করে ওপরের বার্থে একটা টাক খেলেন। চেকারের সঙ্গে ওঁর কথা কাটাকাটি আরো বেশ কিছুক্ষণ চলল। আসল ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে প্রথমে টিটি ওঁকে পরের স্টেশনে নেমে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু শেষে টাকা নিয়ে ওঁকে সিটটা ছেড়ে দিলেন। যদিও ব্যাপারটা বেআইনি। তবু বাধ্য হয়ে ওঁকে চেকারের কথায় রাজি হতে হল। কারণ, বুঝতে পারছিলাম ছোট্ট একটা ভুলের জন্য ভদ্রলোকের কী করুণ অবস্থা হয়েছে। প্রায় সারারাত জেগেই কাটিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। আর তার সঙ্গে থেকে থেকে নিজের শালার উদ্দেশ্যে যেসব বিশেষণ ব্যবহার করছিলেন, সেগুলো আর লেখা যাবে না।
পরদিন রাত ন’টা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম শিয়ালদা স্টেশনে। নামার জন্য গেটের সামনে গিয়ে দেখি স্টেশনে একটা বড়োসড় জটলা। এবার ট্রেন থেকে নেমে জটলাটার দিকে দু-পা এগোতে বুঝলাম সেটার কারণটা কী।
এখনকার বাংলা সিনেমার সঙ্গীত জগতে একটা জনপ্রিয় নাম হল বাসব নন্দী। কোনো একটা কারণে গুয়াহাটি গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। ফেরার সময় ফ্লাইট মিস করেন। তাই ট্রেনে ফিরেছেন। আমরা যে ট্রেনে ফিরলাম, সে ট্রেনেই। এত বড়ো একজন মানুষ যে ট্রেনে ফিরেছেন, আমরাও সেই একই ট্রেনে ফিরেছি! জিনিসটা আমার কাছে বেশ লোমহর্ষক বলে মনে হচ্ছিল। ভিড় দেখে বুঝলাম ভক্তের দল।
অনিদাও যে ওঁর ভক্তের একজন তা আমি জানি। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা এগিয়ে গিয়েও বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিলাম বাসব নন্দীকে। মনে মনে ভাবছিলাম যে, গুণ তো বটেই, রূপের জন্যও এমন মানুষের ভক্ত হওয়া যায়! যেমন ছিপছিপে চেহারা তেমন গায়ের রং! লম্বায় অনেকটা অনিদার মতোই হবেন। মানে পাঁচ দশ। ব্যাক ব্রাশ করা চুল। চোখে আধুনিক ডিজাইনের মোটা ফ্রেমের চশমা। এককথায় নায়কোচিত চেহারা।
কিছুদিনের মধ্যেই ভদ্রলোক বাংলা গানকে অনেক উঁচুতে তুলে নিয়ে গেছেন। শুনে তো মনে হয় যেন বাংলা গানের সেই সোনার সময় ফিরে এসেছে! সেদিন কাগজে পড়ছিলাম যে ওঁর বয়স খুব একটা বেশি নয়। মাত্র চল্লিশ। আর এর মধ্যেই ওঁর ঝুলিতে চারটে সেরা সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার! এত হ্যাপা সামলাতে হয় এইসব জনপ্রিয় মানুষদের, যে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। মানুষ যেন পিঁপড়ের মতো ছেকে ধরেছে ওঁকে। কেউ হাত মেলাতে চায়, তো কারো আবদার সেলফির।
লোকে তো ওঁকে চেপেই মেরে ফেলবে! কথাটা অনিদাকে বলতে অনিদা শুধু একবার মুচকি হাসল। আমি তখন বললাম, “জানো অনিদা, আমাদের ক্লাসের সৈকত সেদিন বলছিল যে মিডিয়াই নাকি এদের এত ওপরে তুলে দিয়েছে।”
তাতে অনিদা মাথা নেড়ে বলল, “মিডিয়ার একটা হিড়িক আছে, সেটা সত্যি। কিন্তু যাকে তাকে নিয়ে তো মিডিয়া লাফায় না। আর মানুষও যাকে তাকে নিয়ে অযথা পাগলামো করে না। তাই সেই জায়গায় পৌঁছতে গেলে মানুষকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতেই হয়। রক্ত জল করে খাটলে তবেই সাফল্য পাওয়া যায়। তা সে খেলোয়াড়ই হোক বা সঙ্গীতশিল্পী। ব্যবসায়ী হোক, কি কলেজের প্রফেসর।
কলিং ক্যাবে উঠতে উঠতে অনিদা বলল, “দেখ জয়, এই সমস্ত ঘটনাগুলোর মধ্যে কেমন যেন একটা মিল রয়েছে।”
“কীরকম?” অনিদার কথার রহস্যটা বুঝতে পারলাম না।
ও বলল, “দেরি করে টিকিট কাটাতে আমরা এসির টিকিট মিস করলাম। বাসব নন্দী ফ্লাইট মিস করলেন। আর সেই লোকটা নিজের শালার বোকামিতে নিজেরই সিট মিস করলেন। সব কেমন যেন মিস করার খেলা চলছে!”
আমি ওর কথার উত্তর দিতে যাব, এমন সময় ওর মোবাইলটা দু-বার শব্দ করে থেমে গেল। আমি চমকে উঠে বললাম, “মিসড কল!”
ফোনটা ওর মায়ের ছিল। কোনো কারণে কেটে গেছে। তাই ও এবার রিং ব্যাক করে মাসিকে জানিয়ে দিল যে আমরা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যাব। খুব খিদে পেয়ে গেছিল। তাই অনিদা ওর মাকে খাবার তৈরি করে রাখতে বলল।
আজ ইন্ডিয়া-অস্ট্রেলিয়ার চার নম্বর ওয়ান ডে ম্যাচ। মোবাইলে খেলার শব্দ আসছিল। নিশ্চয়ই অনিদার আর আমার বাবা খেলা দেখছে। অনিদার মা বললেন, এইমাত্র আমাদের উইকেট কিপার একটা লোপ্পা ক্যাচ মিস করল।
আবার একটা মিস! আমার মুখ দিয়ে আচমকা কথাটা বেরোতে দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলাম। তবে তাতে আমাদের পাঞ্জাবি ড্রাইভারটা কেন হেসে উঠল কে জানে। মনে হয় আমাদের হাসতে দেখেই। চলন্ত ট্যাক্সি থেকে উঁকি মেরে বাইরেটা দেখতে দেখতে অনিদা এবার বলল, “এই ক’দিন কলকাতাকে খুব মিস করছিলাম রে জয়!”
(২)
অনিদা ওর জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে এক ফোঁটা জ্ঞান আমার দিকে ছিটিয়ে দিয়ে বলল, “জানিস জয়, একজন মানুষ সারাদিন এক জায়গায় বসে থেকেও প্রায় আশি কিলোমিটার হাঁটার মতো পরিশ্রম করে।”
“সেটা কেমন করে?” প্রশ্নটা করেই হিসেব কষতে শুরু করলাম যে গতকাল আমার অতটা পরিশ্রম হল কীভাবে। কারণ কাল সারাদিন আমার ট্রেনেই কেটেছে। সেই রাত ন’টা নাগাদ শিয়ালদা স্টেশনে নেমে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত শরীরে যা একটু নড়াচড়া হয়েছিল।
তাতে ও বলল, “সারাদিন আমাদের সবাইকে যতবার চোখ খোলা আর বন্ধ করতে হয় তাতে আশি কিলোমিটার হাঁটার মতো পরিশ্রম হয়।”
“ইন্টারেস্টিং!” ভুরুজোড়া ওপর দিকে তুলে মাথাটা বাঁ পাশে হেলালাম।
অনিদা তখন আমার দিকে এক গ্লাস কোল্ড ড্রিঙ্ক এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমরা এই পড়ার বইয়ের বাইরে আর কিছুই জানি না। কারণ, আমরা সবাই পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার কম্পিটিশনে ছুটে চলেছি।”
তারপর প্রায় এক ঢোঁকে ওর গ্লাসের অর্ধেকটা শেষ করে দিল।
আমি অনিদার কথায় মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আমার গ্লাসে চুমুক মারলাম। ও তখন বলল, “তার মানেটা কী দাঁড়াল?”
“কী দাঁড়াল?”
“এই যে এত সব বইপত্র, এর সবই বেকার!” বলে আমাকে বুড়ো আঙুল দেখাল।
আমি তখন আমতা আমতা করে বললাম, “হবে হয়তো!”
অবশ্য যদিও বুঝতে পারছিলাম যে অনিদা আবার একটা হেঁয়ালি করছে। আর সেটা এবার সত্যি বলে প্রমাণ হল, যখন ও মাথাটা একবার করে ডানদিকে, বাঁদিকে, আর আবার ডানদিকে হেলিয়ে বলল, “ভুল।”
আমি তখন আবার স্বাভাবিক হয়ে বললাম, “তাহলে?”
ও তখন মুখ দিয়ে চুক করে একটা শব্দ করে বলল, “বাজে কথা।”
এবার ‘প্রত্যেকটা বইয়ের’ কথাটা জোর দিয়ে বলে বলল, “প্রথম থেকে শেষ পাতার প্রতিটা লাইনই গুরুত্বপূর্ণ। সে ভূমিকাই হোক বা উপসংহার।”
আমি চুপ করে ওর কথা শুনতে লাগলাম। ও বলতে থাকল।
“এটা আমি শিখেছিলাম আমার স্কুলের একটা বন্ধু রাজীব সাহার থেকে। সেদিন জিনিসটার গুরুত্ব বুঝতে পারিনি। আজ বুঝি। জীবনে যত বই পড়বি, চেষ্টা করবি সেগুলোর প্রতিটা পাতা থেকে কিছু না কিছু শিখতে।”
আমি কিছু বললাম না। মনে মনে ভাবলাম, একথা শুধুমাত্র ওর মতো বই পাগল মানুষের পক্ষেই বলা সম্ভব।
আমাদের আড্ডা জমে উঠেছিল। এমন সময় অনিদার মোবাইলটা বেজে উঠল। ওটা তখন আমার দেড় হাতের মধ্যে সেন্টার টেবিলটার ওপর। অনিদা এবার মাথাটা ডানদিকে হেলিয়ে ভুরুজোড়া ওপর দিকে তুলে আমাকে ইশারায় বলে দিল ফোনটা ধরতে। অচেনা নম্বর দেখে প্রথমে আমতা আমতা করাতে ও আবার আমাকে ইশারা করে কপাল কোঁচকাল। মানে আদেশের জোর বাড়ল। অগত্যা এবার বাধ্য হয়েই ফোনটা হাতে নিলাম।
আমি ‘হ্যালো’ বলতে ওপাশ থেকে মসৃণ যে গলাটা ভেসে এল, সেটা শুনে মনে হল গলার মালিক আবৃত্তি বা গানের জগতের কেউ হবেন।
“হ্যালো, গুড মর্নিং!”
“গুড মর্নিং! বলুন।”
ওপাশ থেকে এবার প্রশ্ন এল, “আমি কি অনিরুদ্ধ সেনের সঙ্গে কথা বলছি?”
আমি সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে ফোন নামিয়ে তাতে হাতচাপা দিয়ে অনিদার দিকে ফিরে চাপা গলায় বললাম, “তোমাকে চাইছে।”
অনিদাও তখন গলা নামিয়ে বলল, “জিজ্ঞাসা কর না, কে, কী দরকার।”
অনিদার কথামতো আমি আবার বললাম, “আপনি আমাকে বলতে পারেন যদি কিছু বলার থাকে।”
“আপনি?” গলা শুনে মনে হল এবার যেন বিরক্ত হলেন ভদ্রলোক।
“আমি ওঁর ভাই।” বললাম আমি।
“ভাই? তা কীরকম ভাই?”
“মাসতুতো।”
“ও। তা কী করা হয়?”
যেন পুলিশের জেরার সামনে পড়েছি! তবে বিরক্ত হয়েছি সেটা ওঁকে বুঝতে না দিয়ে বললাম, “আমি ওঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট।”
“ও, তুমি জয়? কমবয়সী গলা শুনেই আমার তোমাকে চেনা উচিত ছিল।”
আমার বয়স কম বলে আমাকে ভদ্রলোক এভাবে হেসে উড়িয়ে দিলেন! বিরক্তিটা আমার এবার রাগে পরিণত হল। অবশ্য অচেনা একটা লোক আমাকে চেনে দেখে ভালোও লাগছিল খুব।
আমি কোনো উত্তর না দেওয়াতে উনি আবার বললেন, “ওঁকে বলো, যা বলার আমি ওঁকেই বলব। ব্যাপারটা জরুরি।”
মাথা ঘুরিয়ে দেখি অনিদা তখন ফ্রিজ থেকে আপেল বের করছে। আবার ফোনে হাত চেপে বললাম, “অনিদা, তোমাকে চাইছেন।”
ফ্রিজটা বন্ধ করতে করতে অনিদা বলল, “নামটা জিজ্ঞাসা কর।”
এবার আমি আবার ফোনটা কানে লাগাতে ভদ্রলোক বললেন, “বলো আমার নাম বাসব নন্দী।”
বুঝলাম উনি এবারে অনিদার কথা শুনে ফেলেছেন। এদিকে বাসব নন্দী নামটা শুনে উত্তেজনার চোটে ফোনটা আর একটু হলেই আমার হাত থেকে পড়েই যাচ্ছিল। কোনোরকমে সামলে নিতে উনি আবার বললেন, “মিউজিক ডিরেক্টর বাসব নন্দীর নাম শুনেছ?”
আমার এবার দাঁতে দাঁত লেগে যাবার জোগাড়। বার দুয়েক ডান কানটা ঝাঁকিয়ে নিলাম। হাতে ধরা কোল্ড ড্রিঙ্কের গ্লাসটা গরম লাগছিল। বার তিনেক ঢোঁক গিলে অনেক কষ্টে মুখ দিয়ে ‘হ্যাঁ’ বেরোল।
আমার হতভম্ব অবস্থা বুঝে উনি ওঁর তাচ্ছিল্য ভাবটা বাড়িয়ে নিয়ে বললেন, “এবার নিশ্চয়ই বোঝা গেল আমি কে? ফোনটা মি. সেনকে দাও।”
আমি যে একেবারে নাস্তানাবুদ, অনিদা ততক্ষণে আঁচ করে ফেলেছে। এবার আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ও সেটার স্পিকার অন করে সোফায় বসে বলল, “গুড মর্নিং! আমি অনিরুদ্ধ সেন বলছি।”
“গুড মর্নিং!” গলা শুনেই বুঝলাম অনেক কষ্টে অভদ্রতা এড়ালেন বাসব নন্দী। উনি যে অনিদার ওপর বেশ বিরক্ত সেটা ওঁর কথাতেই ধরা পড়ল। “দেখুন, একটা বিশেষ দরকারে আমি আপনাকে ফোনটা করেছি। আর আপনি আমার অযথা সময় নষ্ট করছেন।”
এমন পরিস্থিতি অনিদা অবশ্য খুব সহজেই সামলায়। এবার গলা নরম করে বলল, “এর জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তবে জয় সব কেসেই আমার সঙ্গে থাকে। তাই ওকে নিয়ে চিন্তা করবেন না।”
“ইটস ওকে।” একটু দম নিয়ে বাসব নন্দী বললেন, “আসলে আমি একটা সমস্যায় পড়েছি। লালবাজারের অফিসার রাজা মুখার্জির কাছ থেকে আমি আপনার নম্বরটা পেয়েছি। কয়েকদিন ধরেই একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভের খোঁজে ছিলাম। আপনার নাম শুনেছি। রাজার কাছে আপনার কথা বলতে ও আপনার নম্বরটা দিল।”
অনিদার মুখ দেখে বুঝতে পারলাম নতুন মামলা হাতে আসার একটা সম্ভবনা তৈরি হওয়াতে ও বেজায় খুশি। তবে সেটাকে চেপে রেখেই বলল, “বলুন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি।”
অনিদার জন্য আমার খুব গর্ব হচ্ছিল। এমন একজন জনপ্রিয় মানুষ অনিদার কাছে সাহায্য চেয়ে ফোন করেছেন, এ কম বড়ো ব্যাপার নয়।
বাসব নন্দী বললেন, “দেখুন, আমরা যে জগতের মানুষ, সেখানে কোনো কথা পাঁচকান হলে আমাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই বলছিলাম…”
“ব্যাপারটা গোপন রাখতে চাইছেন? ফোনে না বলে সামনাসামনি হলে সুবিধে হত?”
অনিদার কথা শুনে ভদ্রলোকের মান অভিমান তখন একেবারেই উধাও। বেশ গদগদ হয়ে বললেন, “একদম ঠিক। তাই একবার যদি আমার বাড়িতে আসেন।”
“ওকে।” কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে অনিদা বলল, “আপনার বাড়ি যেতে আমার কোনো অসুবিধে নেই।”
“থ্যাঙ্ক ইউ!”
“আপনার অ্যাড্রেসটা?”
অনিদা ইশারা করার আগেই আমি তৈরি ছিলাম। বাসব নন্দী ঠিকানাটা বলতেই আমি ঝট করে টুকে নিয়ে অনিদাকে হোয়াটস অ্যাপ করে দিলাম। এতে সেটা আর হারাবার ভয় থাকল না।
“আপনি কবে নাগাদ আসতে পারবেন?” জিজ্ঞাসা করলেন বাসব নন্দী।
“আপনার কবে গেলে সুবিধে হয়?” জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
“আমার তাড়াতাড়ি দরকার।”
“কাল?”
“গুড! তবে সন্ধের আগে হবে না। কাল একটা রেকর্ডিং আছে। তাই ছ’টার পর হলে ভালো হয়।”
“ওকে, তাহলে কাল সন্ধে সাতটা নাগাদ দেখা হচ্ছে।”
“আমি ওয়েট করব। গুড ডে।”
“বাই, গুড ডে।”
অনিদা ফোন কাটতেই আমি লাফিয়ে উঠলাম। “তোমার টেনশন হচ্ছে না!”
“কীসের জন্য?” খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
“এত বড়ো একটা লোক তোমাকে সাহায্যর জন্য ডাকলেন!”
“এখানে লোকটা কত বড়ো সেটা আসল কথা নয়।” হেসে বলল অনিদা।
“তবে?”
“কেসটা কত বড়ো, সেটাই আসল কথা।”
“কারণ?”
“কারণ, এইসব ভি.আই.পিরা চাইলেই পুলিশের হেল্প পেয়ে যাবেন। তাহলে প্রশ্ন হল, আমার মতো প্রাইভেট ডিটেকটিভকে ওঁর হঠাৎ করে কেন দরকার পড়ল?”
অনিদার কথায় ওজন ছিল। আবার কোন জালে আমরা জড়িয়ে পড়তে চলেছি কে জানে! কথাটা ভেবে বুকটা ঢিপঢিপ করতে শুরু করল আমার। বললাম, “সেটা তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু ওঁর বাড়ি না গেলে জানব কী করে, উনি আমাদের কেন ডেকেছেন।”
“হুম।” মাথাটা বার দুয়েক সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে অনিদা বলল, “সেটাও ঠিক কথা।”
“আমাদের তাহলে কাল সাড়ে ছ’টা নাগাদ বেরোলেই হবে।” বলে একবার মোবাইলে পাঠানো হোয়াটস অ্যাপে বাসব নন্দীর ঠিকানাটা দেখে নিয়ে বললাম, “বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড। হাজরা থেকে বেশিক্ষণ লাগবে না, তাই না?”
অনিদা তখন আমাকে চমকে দিয়ে বলল, “আমাদের মানে?”
অনিদার কথা শুনে আমি ততক্ষণে হকচকিয়ে গেছি। ও বলল, “তোকে তো যেতে বলেননি উনি।”
মিথ্যে বলব না, একথা শুনে আমার সব উত্তেজনা তখন যেন এক ফুঁয়ে নিভে গেছে। অনিদার কোনো মামলায় আমি ওর সঙ্গে নেই, কল্পনাও করতে পারি না। তাই মনমরা হয়ে বললাম, “আমি যাব না?”
অনিদা কপাল কুঁচকে বলল, “তুই কেন যাবি?”
আমি একেবারেই দমে গেছিলাম। কিছু মাথায় আসছিল না। হতবাকের মতো আমাকে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়তে দেখে অনিদা এবার হো হো করে হেসে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার বুক থেকে পাথর নেমে গেল। এবার নিশ্চিন্ত হয়ে এক চুমুকে কোল্ড ড্রিঙ্কের গ্লাসটা শেষ করলাম।
(৩)
কলকাতার বহু বিখ্যাত উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর বাস এই বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। প্রতিটা বাড়ির দামই আকাশছোঁয়া। ডাইনে বাঁয়ে একতলা দোতলা বাড়িগুলো দেখতে দেখতে এগোচ্ছি। তেমন একটা আলো নেই রাস্তাটাতে। আর যতটুকু আছে, সেগুলো আবার দু-ধারের বড়ো বড়ো গাছগুলোর আড়ালে চলে যাওয়াতে রাস্তাটা অন্ধকার হয়ে রয়েছে। বেশি দূরে পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না। নম্বর ধরে খুঁজতে খুঁজতে এবার একটা বাড়ির নেম-প্লেটে পেয়ে গেলাম বাসব নন্দীর নাম। তার ঠিক নীচেই বাড়ির নম্বর। বেশ ছিমছাম দোতলা একটা বাড়ি। নিয়মিত যত্নের জন্য মরচে পড়েনি বটে, তবে গড়ন দেখে বোঝা যায় তার বয়স কম নয়।
আমাদের সন্ধে সাতটায় পৌঁছোনোর কথা ছিল। এখন ছ’টা পঞ্চাশ। দশ মিনিট আগেই পৌঁছে গেছি। এটা আমরা সবসময় করি। কোথাও যাওয়ার থাকলে কিছুক্ষণ আগেই পৌঁছে যাই। অনিদা বলে, যার সময়ের দাম নেই, সে মানুষ ফেলনা হয়।
আমরা বাসব নন্দীর বাড়িতে ঢুকব ঢুকব করছি, ঠিক তখন একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল যা এই পরিবেশের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। মেইন গেটের ডানদিকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে একটা লোককে দেখলাম ঝালমুড়ি বিক্রি করতে। তাও আবার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে! কৌটো নেড়ে নেড়ে লোকটা কার জন্য মুড়ি মাখছে কে জানে। কারণ, ধারে কাছে তখন ওর কোনো খদ্দের নেই। কয়েক হাত দূরে একটা মোটর বাইক দাঁড়িয়ে। এভাবে পড়ে থাকার জন্য একবার মনে হল কেউ যেন সেটা চুরি করে এখানে রেখে গেছে। অন্ধকারে থাকায় লোকটার মুখ বোঝা যাচ্ছিল না। জানি না কেন, জিনিসটা খুব একটা সুবিধার ঠেকল না আমার কাছে। তাই চাপা গলায় অনিদাকে বললাম, “এই সময় এভাবে লোকটা এখানে ঝালমুড়ি বিক্রি করছে!”
“আমিও ঠিক তাই ভাবছি। আশেপাশে তো কেউ নেই!” চারদিকে একবার দেখে নিয়ে একইভাবে গলা চেপে বলল অনিদা।
এমনিতেই এটা একটা রেসিডেন্সিয়াল এলাকা। একটাও দোকানপাট নেই এই গলিতে। তাই এই সময় লোকটাকে দেখে একটু অবাকই হয়েছিলাম। পরে ভাবলাম হয়তো বেশি চিন্তা করছি। তাই আবার এগোনোর জন্য পা বাড়ালাম। কিন্তু এবার লোকটা এমন একটা কাণ্ড করল যা বলে দিল যে বিপদ আমাদের ঘরের দোরগোড়ায় চলে এসেছে!
আমরা বাসব নন্দীর বাড়িতে ঢোকার জন্য পা বাড়িয়েছি, এমন সময় লোকটা হঠাৎ পকেট থেকে মোবাইল বের করে খচ খচ করে আমাদের বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিল! প্রথমটায় জিনিসটাতে হকচকিয়ে গেছিলাম। এবার ধাতস্থ হয়ে লোকটার দিকে দৌড়ে যেতেই ও মুড়ি-টুরি ফেলে দৌড়ে গিয়ে সামনে রাখা বাইকটা নিয়ে রাস্তার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। তখন হতাশ হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আমি ফিরে এলাম।
লোকটা যেদিকে পালাল সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল অনিদা। বাইকটা অন্ধকারে থাকার জন্য অনিদাও নম্বরটা দেখতে পায়নি। আমি ওর সামনে যেতে ও বলল, “মনে হয় টস হওয়ার আগেই খেলা শুরু হয়ে গেল রে জয়।”
ঘটনাটা একরকম জোর করেই মন থেকে উড়িয়ে দিতে হল। আওয়াজ শুনে বাড়ির দারোয়ান ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে। আমাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেভাবে দেখল, তাতে বুঝলাম আমাদের পরিচয় জানতে চায়। অনিদা ওকে বাসব নন্দীর কথা জিজ্ঞাসা করাতে ও বলল, “আপনার পরিচয়? উনি যার তার সঙ্গে দেখা করেন না।”
দারোয়ান সহজে ছাড়বে না বুঝে অনিদা ওর পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে ওর হাতে দিয়ে বলল, “উনি আমাকে আসতে বলেছিলেন। আমি চাইলে ওঁকে এখুনি ফোন করে নিতে পারতাম। তাও এই কার্ডটা ওঁকে দিন, তাহলেই হয়ে যাবে।”
দারোয়ান অনিদার কথা শুনে কী ভাবল কে জানে। কার্ডটাতে একবার চোখ বুলিয়ে ‘জীবনদা’ বলে কাউকে একটা গলা তুলে ডাকল। বার তিনেক ডাকার পর প্রায় বছর পঞ্চাশের একটা লোক সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হল। বুঝলাম এই হল জীবনদা। রোগা ছিপছিপে চেহারা। পরনে পাজামা আর ফতুয়া। লম্বাটে মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। কোঁচকানো কপাল আর নাক দেখে মনে হল সারা পৃথিবীর সমস্ত দুশ্চিন্তা যেন ওঁরই কাঁধে চেপে বসেছে। জীবনদা এবার দারোয়ানের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কিছু একটা আলোচনা করল। তারপর তার থেকে অনিদার কার্ডটা নিয়ে আমাদের দুজনকে একবার করে দেখে জিজ্ঞাসা করল, “অনিরুদ্ধ সেন কে?”
“আমি।” বলল অনিদা।
“আর ও?” আমার দিকে আঙুল দেখাল লোকটা।
“ও রণজয়। রণজয় বোস। আমার ভাই।”
“সেনের ভাই বোস!” অবাক হওয়ার হাসি হেসে জীবনদা বলল, “সে কেমন করে হয়?”
এত জেরা আমার সহ্য হচ্ছিল না। অনিদা কিন্তু শান্ত মেজাজেই বলল, “ও আমার মাসতুতো ভাই।”
এবার ‘ও’ বলে সে অনিদার কার্ডটা সঙ্গে করে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। আমরা ততক্ষণে নজর উঁচিয়ে বাড়ির ভেতরটা সম্পর্কে সামান্য ওয়াকিফ হাল হবার চেষ্টা করছি। মনের মধ্যে দুশ্চিন্তার ঘূর্ণিঝড় বয়ে চলেছে। কী জটিল সমস্যা আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে কে জানে!
এর মধ্যে মিনিট পাঁচেক কেটেছে। এবার একটা শব্দ কানে আসতে মুখ তুলে দেখলাম ফর্সা সুন্দর হাসি হাসি মুখের একজন মানুষ বাড়ির ভেতর থেকে কোলাপসিবল গেট ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসছেন। তারপর অনিদাকে দেখে হাতজোড় করে এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। পেছন পেছন হেঁটে আসছিল জীবনদা বলে লোকটা।
বাসব নন্দীকে এভাবে এত কাছ থেকে দেখতে পাব ভাবিনি। অনিদাকে দেখে ‘গুড ইভিনিং’ বলে হাত বাড়িয়ে দিতে অনিদাও ‘গুড ইভিনিং’ বলে হাত বাড়িয়ে দিল।
“সরি! একটু কষ্ট সহ্য করতে হল। আসলে কত লোকই তো আসে, তাই…”
“না না, ইটস ওকে। বুঝতে পেরেছি।” বাইকওয়ালাটা যেদিক দিয়ে পালিয়েছিল সেদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল অনিদা। তবে ও কী ভাবছিল সেটা বলতে পারব না।
বাসব নন্দী এবারে আমাদের ভেতরে যাবার জন্য অনুরোধ করাতে আমরা পা বাড়ালাম। সেই সময় একবার দারোয়ানের সঙ্গে চোখাচোখি হতে ও সঙ্গে সঙ্গে পা-জোড়া এক করে ডান হাতটা কপালে ঠুকে আমাদের সেলাম করল। প্রথমটা ওর ওপর রাগ হয়েছিল বটে, তবে ও-বেচারারই বা কী করার আছে। ওর ডিউটি ও করেছে।
যাই হোক, আমরা বাসব নন্দীর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভেতর দিকে এগিয়ে চললাম। জীবনদাও চলল আমাদের পেছন পেছন। বাসব নন্দী এবার আমার দিকে চেয়ে বললেন, “তুমিই জয়? মি. সেনের ভাই?”
“হ্যাঁ।” হেসে বললাম আমি। ওঁকে দেখার পর থেকেই আমি খেই হারিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছিলাম।
“তোমার বোধ হয় আরেকটা নাম আছে, তাই না?” হেসে বললেন মি. নন্দী।
“না না,” আমি মাথা নেড়ে বললাম, “আমার নাম রণজয় বোস। সবাই আমাকে জয় বলে ডাকে।”
“বাহ্, তোমার নামটা বেশ সুন্দর।”
ওঁর প্রশংসাটা আমি হেসে ‘থ্যাঙ্কস’ বলে নিলাম।
উনি তখন বললেন, “কিন্তু সেনের ভাই বোস কী করে?”
“ও আমার মাসতুতো ভাই।” পাশ থেকে এবার আমাকে গার্ড করল অনিদা।
আসলে আমি অনিদার সত্যিকারের মাসতুতো ভাই নই। আমাদের মায়েরা ছেলেবেলাকার বান্ধবী। কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের মেঘমালা অ্যাপার্টমেন্টের দোতলার দুটো পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকি আমরা আর অনিদারা। তবে বাইরের লোকের কাছে অনিদা আমাকে মাসতুতো ভাই বলেই পরিচয় দেয়।
“তুমি তোমার দাদার অ্যাসিস্ট্যান্ট?”
আমি আবার হেসে মাথা নাড়লাম।
“সব কেসগুলো গল্পের আকারে তুমিই তো লেখো?”
আমি আবার হেসে ‘হ্যাঁ’ বলতে উনি বললেন, “আমি গ্যাংটকের ঘটনাটা একটু পড়েছি। যদিও পুরোটা পড়া হয়নি, তোমার লেখার হাতটা কিন্তু বেশ। চালিয়ে যাও।”
কথাগুলো শুনে আমি তখন উড়ছি। এত বড়ো একটা মানুষ আমার লেখার প্রশংসা করছেন, আমি ভাবতেই পারছিলাম না। অনিদাও মনে হয় এতে খুব খুশি হয়েছে। মুচকি হেসে ও একবার আমার দিকে তাকাল।
বাসব নন্দীর বাড়ির পরিবেশটা দারুণ। ফটক থেকে একটা বাঁধানো রাস্তা বেঁকে গিয়ে বাড়ির সদর দরজায় মিশেছে। তার মধ্যেই আরো একটা রাস্তা ওই রাস্তাটা থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ির পেছনদিকে চলে গেছে। এই রাস্তাটার ডানদিকে বাহারি গাছের বাগান আর বাঁদিকে একটা ঘাস বিছানো উঠোন। ঘাসের সমান আকার দেখেই বোঝা যায় সেগুলোর নিয়মিত যত্ন নেওয়া হয়। বাড়ির পুরো চত্বরটা দু-মানুষ উঁচু পাঁচিলে ঢাকা। ভেতর দিকে বাউন্ডারি ঘেঁষে বিশাল বিশাল গাছগুলো বাড়িটাকে বাইরে থেকে আড়াল করছে। যেন বিশাল একটা পর্দা টাঙানো।
উঠোনের মাঝে একটা দোলনা চোখে পড়ল। তার সামনে মাটিতে পোঁতা বিশাল একটা রঙিন ছাতা। সেটার নীচে পাতা রয়েছে একটা গোল টেবিল আর সেটাকে ঘিরে গোটা চারেক চেয়ার। সিনেমায় দেখেছি, বড়ো বড়ো লোকেরা সকালের খাবার আর কাগজ পড়া এইরকম চেয়ারে বসে সারেন। মেইন ফটক থেকে হেঁটে আসতে আসতে চারধারে এমন মনকাড়া পরিবেশ দেখে ভেতরে ভেতরে খুব ঝরঝরে লাগছিল।
আমরা এবার সদর দরজা পেরিয়ে যে ঘরটাতে এলাম সেটা ‘তেরোর গেরো’ গল্পের ষষ্ঠী মুখার্জির বাড়ির কথা মনে করিয়ে দেয়। আকারের হিসেবে এটাকে হল-ঘর বলা যেতে পারে। সারা ঘর জুড়ে শুধু বই আর বই। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান—কোনো বিষয় যেন বাদ নেই! এককোণে একটা গদি পাতা। তাতে সাদা ধপধবে চাদর পাতা। বই ছাড়াও যে জিনিসগুলো আমার নজর কাড়ল সেগুলো হল নানারকমের বাদ্যযন্ত্র। গদির সামনেই রাখা ছিল একটা হারমোনিয়াম। তার পাশেই রয়েছে তবলা আর সেতার। তাছাড়াও রয়েছে গিটার, কী-বোর্ড এইসব।
বই আর বাজনা ছাড়াও ঘর জুড়ে রয়েছে অসংখ্য প্রাইজ। আর তার সঙ্গে দেওয়াল জুড়ে ফ্রেম করা প্রচুর সার্টিফিকেট আর ছবি। প্রতিটা ছবিই এক-একটা বিশেষ মুহূর্তের। কোনোটা পুরস্কার পাওয়ার, তো কোনোটা অনুষ্ঠানের। এর বেশ কয়েকটাতে ওঁর সঙ্গে রয়েছেন তাবড় তাবড় সব শিল্পীরাও।
এ ঘরে বসার কোনো চেয়ার ছিল না। জীবনদা দুটো চেয়ার এনে দিল। আমাদের বসতে দিয়ে বাসব নন্দী সামনের গদিটাতে বসলেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের জন্য কফি আর খাবার এল।
অনিদা এবার খাবার মুখে পুরে সারা ঘরে নজর বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞাসা করল, “এই ঘরে বসেই বুঝি অবিস্মরণীয় সুরগুলো তৈরি হয়?”
মি. নন্দী তখন হেসে বললেন, “এই ঘরেই হয় তা ঠিক, কিন্তু সেগুলো অবিস্মরণীয় কি না তা জানি না।”
“আপনার গান আমার খুব ভালো লাগে।” বললাম আমি।
“ধন্যবাদ!” আমার প্রশংসা শুনে মাথাটা সামনের দিকে একবার ঝুঁকিয়ে উনি বললেন, “মানুষের যতদিন ভালো লাগে ততদিনই আমরা আছি।”
অনিদা এবার সরাসরি প্রসঙ্গে গেল। বলল, “বলুন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি।”
মি. নন্দী এবার পাশে রাখা ল্যাপটপটা অন করতে করতে বললেন, “দেখুন, গত কয়েকদিন ধরে আমি খুব মানসিক চাপে আছি। এর কারণটা যদিও আমাদের লাইনে নতুন নয়। আসলে আমরা ছবির জগতের প্রায় প্রতিটা মানুষই এর শিকার।”
অনিদা তখন ওঁকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনাকে কি কেউ হুমকি দিচ্ছে?”
“কারেক্ট!” ডানহাতের তর্জনী শূন্যে ছুড়ে মি. নন্দী চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, “একদম ঠিক ধরেছেন।” কিন্তু তারপরই আবার মুখ কালো করে হতাশ হয়ে বললেন, “আমি খুব ডাউন হয়ে পড়েছি মি. সেন।”
অনিদা এবার কফির কাপে একটা চুমুক মেরে বলল, “কিন্তু পুলিশ থাকতে আপনি আমায় ডাকলেন কেন? আপনি চাইলেই তো, মানে ওদের ওপর কি ভরসা…”
“না না,” সঙ্গে সঙ্গে অনিদাকে থামিয়ে মি. নন্দী বললেন, “তা নয়। তবে ওদের কাছে গেলে লোক জানাজানির একটা চান্স থাকে তো। তাতে আমার আবার, মানে মিডিয়ার যা উৎপাত আজকাল!”
“হুম।” কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে অনিদা বলল, “কী ধরনের হুমকি আসছে আপনার কাছে?”
“প্রথমে তো ইমেইলে আসছিল।”
“ইমেইলে!” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
এর কারণ আমি জানি। কারণ ইমেইল ট্র্যাক করে সেটা কে পাঠাচ্ছে জেনে নেওয়া যায়। তাহলে যে সেগুলো পাঠাচ্ছে, সে কি ইমেইলের ব্যাপারটা জানে না? তার মানে সে আনাড়ি কোনো মানুষ?
“হ্যাঁ, প্রায় পনেরো-কুড়িটা ইমেইল পাঠানো হয়েছে আমাকে।”
“নাম নেই নিশ্চয়ই?”
“না।”
“তার বক্তব্য কী?”
“বক্তব্য নয়, আদেশ।”
“সেটা কেমন?”
অনিদা মি. নন্দীর চোখে চোখ রেখে কথা বলছিল। আমি ঝুঁকে পড়ে বসে ওদের কথা গিলছিলাম। খুব সময় নিয়ে ফেলছিলাম চোখের পাতাগুলো। আসলে কোনো বিষয়ে বেশি ঢুকে গেলে আমার এমনটা হয়।
“প্রেরক বলছে আমাকে বেশি কাজ না নিতে। না হলে সে আমাকে দেখে নেবে।”
মি. নন্দীর কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে কপাল কুঁচকে গেল অনিদার। ও বলল, “এ তো প্রফেশনাল রাইভালরি বলে মনে হচ্ছে।”
তাতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মি. নন্দী বললেন, “জানি না মি. সেন।”
অনিদা আবার জিজ্ঞাসা করল, “কারণ কী?”
“সেটা বলেনি।” বলে মাথা নাড়লেন মি. নন্দী।
“শুধু ইমেইল?”
“না, ফোনও করেছিল বার দুয়েক।”
“বার দুয়েক!” অনিদা সোজা হয়ে বসল।
একটা আশার আলো আমার মনেও জেগেছিল। কিন্তু সেটা ঝপ করে নিভে গেল অনিদা যখন ওঁকে ফোন নম্বরগুলো দিতে বলায় উনি জানালেন গত পরশু ফরম্যাট করার জন্য ওঁর সমস্ত ফোন হিস্ট্রি ডিলিট হয়ে গেছে। আর ফোন নম্বর উনি কোথাও টুকে রাখেননি।
“আপনি রিং ব্যাক করেননি?” জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
“করেছিলাম। সুইচড অফ বলছে।”
“সেটাই স্বাভাবিক।” মাথাটা সামনের দিকে দু-বার ঝুঁকিয়ে বলল অনিদা।
“যে ফোন করেছিল তার গলা চিনতে পেরেছিলেন?”
“না। তবে মাঝবয়সী কেউ হবে বলেই মনে হয়।”
“হুম।” কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার কিছু চিন্তা করল অনিদা। আমি জানি মনের মধ্যে ও সবকিছু সাজিয়ে নিচ্ছে। এবার জিজ্ঞাসা করল, “কাউকে সন্দেহ হয় আপনার?”
“এভাবে কিছু বলতে পারব না মি. সেন। দেখতে গেলে আমাদের লাইনে সবাই কম্পিটিটর। আমাকে আটকাতে পারলে অনেকেরই সুবিধে।”
“হু, সেটা ঠিক কথা।” ওঁর কথায় সায় দিয়ে অনিদা আবার জিজ্ঞাসা করল, “ইমেইলগুলো আশা করি আছে আপনার কাছে?”
“হ্যাঁ, কিন্তু সবগুলো নেই।”
“সে কি!” অনিদা চোখ কপালে তুলে বলল, “বাকিগুলো কোথায় গেল?”
“দেখুন, ওগুলো চোখে পড়লে আমার মানসিক চাপ হয়। তাই রাখিনি আর ওগুলো।”
ব্যাপারটা আমাদের জন্য যথেষ্ট হতাশাজনক। তবু কিছু করার নেই। মি. নন্দী আমাদের মেরেকেটে তিনটে ইমেইল দেখাতে পারলেন। যেগুলোর বক্তব্যগুলো অনেকটা এইরকম—
১) যত তাড়াতাড়ি পারো কলকাতা থেকে বিদেয় হও।
২) এখানে তোমার কাজ করা আর নিরাপদ নয়।
৩) এত বেশি কাজ হাতে নিও না।
প্রতিটা ইমেইলই ছোটো ছোটো কথায় লেখা। অনিদা প্রথমেই যা করল সেটা হল, স্ক্রিনের ডানদিকের হেডার থেকে আই.পি অ্যাড্রেসটা নিয়ে নিল। আই.পি অ্যাড্রেসের মানে হল ইন্টারনেট প্রটোকল অ্যাড্রেস। প্রতিটা কম্পিউটারের আলাদা আলাদা আই.পি অ্যাড্রেস থাকে। আর এটা হাতে থাকলে ওই মেইলগুলো কোথা থেকে পাঠানো হয়েছিল সেটা জানা যায়।
বাসব নন্দী এবার অনিদাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাকে কেন এগুলো পাঠাচ্ছে বলুন তো! আমি তো কারো কোনো ক্ষতি করিনি!”
অনিদা ওঁর কথার কোনো উত্তর করল না। এবার ইমেইলগুলো বার বার দেখতে দেখতে বলল, “দেখুন, এই ধরনের হুমকি অনেক সময় ভুয়ো হয়। এখানেও হয়তো…”
“মে বি!” উত্তেজিত হয়ে তখন মি. নন্দী বললেন, “কিন্তু এগুলো বন্ধ হওয়া দরকার। এগুলো আমার কাজে অ্যাফেক্ট করছে।”
অনিদা এবার ওর কফির কাপে শেষ চুমুকটা মেরে বলল, “দেখি আমি কী করতে পারি।” তারপর ইমেইলগুলো নিজের মেইল আইডিতে পাঠিয়ে দিল।
তখন পাশে রাখা কুশনের ওপর একটা ঘুসি মেরে মি. নন্দী বললেন, “ওসব পারি-টারি বললে হবে না মি. সেন। আমি আপনার রেপুটেশনের কথা সব জানি। আপনাকে পারতেই হবে।”
তাতে হেসে অনিদা বলল, “আপনি অতটা উত্তেজিত হবেন না।” তারপর মুখ গম্ভীর করে বলল, “হ্যাঁ, একটা কথা…”
“বলুন।”
“আপনার বাড়িতে কে কে থাকেন?”
“আমরা মাত্র তিনজন। আর তাদের প্রত্যেককেই আপনি দেখেছেন।”
“একজন তো জীবনদা?”
“আমার জন্মের আগে থেকেই আমাদের বাড়িতে আছে। বলতে গেলে আমার বড়ো দাদার মতো।”
“সে তো তাঁর দাদাগিরি দেখেই বুঝেছি।” হেসে বলল অনিদা।
“সে একটু আছে, ঠিক কথা।” অনেকটা জোর করে হেসে অনিদার কথায় সায় দিলেন মি. নন্দী।
“আর দ্বিতীয়জন নিশ্চয়ই আপনার দারোয়ান?”
“হ্যাঁ। বাবুয়া।”
“এই দুজনকে কেমন মানুষ বলে মনে হয় আপনার?”
“জীবনদা সম্পর্কে আর কী বলব? সে আছে বলেই আমার সব টিকে আছে। ঘরবাড়ি অক্ষত আছে। আমাকে আগলে রেখেছে বলতে পারেন। বেচারার তিনকুলে আর কেউ নেই।”
“আর বাবুয়া?”
“খুবই ভালো ছেলে। সৎ ছেলে। প্রায় সাত বছর আছে আমার কাছে। দোষ বলতে রোজ রাতে একটু নেশা করে, এই যা। তবে আমার মনে হয় না এতে ওদের কোনো হাত আছে।”
“তা ঠিক।” মাথা নেড়ে অনিদা বলল, “আমারও তাই মনে হয়। কারণ, হুমকিগুলো তাহলে ইমেইলে আসত না।” তারপর আবার জিজ্ঞাসা করল, “আর আপনার বাবা-মা?”
অনিদার এই প্রশ্নটা শুনে মুখটা কালো হয়ে গেল মি. নন্দীর। বললেন, “দুজনকেই হারিয়েছি অল্প বয়সে।”
“বিয়ে করেননি?”
“গানবাজনা করতে গিয়ে তার আর সময় পাইনি।” শুকনো হাসি হেসে বললেন মি. নন্দী।
“আপনার বন্ধু জাতীয় মানে ঘনিষ্ঠ আর কেউ?”
“সেরকম কেউ নেই। শুধু অজয় ছাড়া।”
“অজয়?” তালিকায় নতুন নাম জুড়তে উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করল অনিদা। আমিও সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে বসলাম।
মি. নন্দী তখন বললেন, “ও আমার কাছে নিজেই কাজ চেয়ে এসেছিল।”
“কী কাজ? গান করেন উনি?” জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
“না না। আসলে সেই সময় আমার কাজের চাপ বাড়ছে। একজন সেক্রেটারি গোছের কাউকে দরকার ছিল। ঠিক তখনই ও আসে। লোকটাকে দেখেই আমার ভালো লেগে গেছিল। তাই কাজে রেখে দিলাম। ভালোই কাজ করছিল। দেখতে দেখতে ও আমার ফ্রেন্ড কাম ফিলোজফার হয়ে উঠল।”
“এই কাজে ওঁর কোনো হাত থাকতে পারে না?”
“ছি ছি, এ কী বলছেন মি. সেন?” চোখ গোল গোল করে মি. নন্দী বললেন, “এটা আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।”
অনিদা এবার ওর লম্বা প্রশ্নমালার ইতি টানল। আমরা আর এখানে সময় খরচ করলাম না। বেরোব বলে আমরা বাসব নন্দীর গেটের সামনে পৌঁছেছি, এমন সময় একটা কী যেন উড়ে এসে পড়ল বাসব নন্দীর মাথার ওপর! হাতে নিয়ে দেখি ওটা একটা দলা পাকানো কাগজ। ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে ডাইনে বাঁইয়ে তাকালাম। কিন্তু কাউকেই পেলাম না। উত্তেজনার বশে বেশ কিছুটা দৌড়ে গেছিলাম বটে, কিন্তু রাস্তায় একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়ল না। হাঁপাচ্ছিলাম আর তার সঙ্গে সঙ্গে বুক ঢিপঢিপ করছিল ভীষণভাবে।
কাগজটা তখন অনিদার হাতে। সেটা খুলতে চোখে পড়ল আঁকাবাঁকা হাতের লেখায় কিছু কথা—‘তোর হাতে কিন্তু আর বেশি সময় নেই।’
হুমকিটা বাসব নন্দীকে দেওয়া তাতে কোনো সন্দেহ নেই। লেখাটা পড়ে মি. নন্দীর মুখটা অসম্ভব গম্ভীর হয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে উনি বললেন, “পঞ্চাশ হাজার, এক লাখ, যা লাগে আমি দেব মি. সেন। আপনি শুধু ক্রিমিনালটাকে ধরুন।”
ঘড়িতে এখন ন’টা। বালিগঞ্জ থেকে আমাদের গাড়ি হাজরার দিকে এগিয়ে চলেছে। গাড়ির ড্রাইভারের সিটে অনিদা। পাশে বসে আমি শরীরটা এবার এলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “সামান্য একটা ঘটনার জন্য ভদ্রলোক তোমাকে এতগুলো টাকা অফার করলেন!”
“হুম।” আমার দিকে একবার আড়চোখে চেয়ে নিয়ে অনিদা বলল, “জিনিসটা আমাকেও অবাক করেছে রে জয়। কারণ, এইরকম জিনিস এঁদের মতো মানুষের জীবনে আকছারই হয়ে থাকে।”
“আজকাল তো শুনেছি বাজারে নাম কেনার জন্য…”
“না না।” আমার কথা কেটে অনিদা বলল, “তাহলে এত গোপনীয়তা উনি বজায় রাখতেন না। প্রেস ডেকে রাষ্ট্র করে খবরটা নিজে আগে ছড়াতেন। আর প্রাইভেট ডিটেকটিভ তো… নাহ্, অসম্ভব।”
ভেবে দেখলাম অনিদার কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। তাই এবার জিজ্ঞাসা করলাম, “তাহলে এর পেছনের রহস্যটা কী?”
“সেটা বুঝতে একটু সময় লাগবে।”
“আর যে লোকটা ছবি তুলল?”
“সে আর যেই হোক, আমাদের বন্ধু নিশ্চয়ই নয়।” হেসে বলল অনিদা। বুঝলাম, ব্যাপারটাকে ও এখনই বেশি পাত্তা দিচ্ছে না। তাই ও নিয়ে আর কথা বাড়ালাম না।
“আর ইমেইলগুলো?”
“দুটো পয়েন্ট।”
“কী?” আমি চনমনিয়ে উঠলাম।
“এক, লেখায় যে ফন্ট ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা একেবারেই আনকমন।”
“আর দু-নম্বরটা?”
“প্রতিটা শব্দই শুরু হয়েছে ক্যাপিটাল লেটার দিয়ে। যেমন কেউ যদি তোকে মেইল করে, হাউ আর ইউ? তাহলে সে শুধু হাউ-এর এইচটাই ক্যাপিটালে লিখবে। আর বাকি সব হবে স্মল লেটারে। কিন্তু এখানে হাউ-এর এইচ, আর-এর এ আর ইউ-এর ওয়াই, সবই লেখা হয়েছে ক্যাপিটাল লেটারে মানে বড়ো হাতের অক্ষরে।”
“বাহ্!” আমি অনিদাকে থাম্বস আপ দেখিয়ে বললাম, “দারুণ নোটিস করেছ তো!”
অনিদা কিছু না বলে মুচকি হেসে গাড়িটা হাজরা মোড় থেকে ডানদিকে ঘুরিয়ে নিল। বুঝলাম, আশুতোষের পাশের গলিটা নেবে।
(৪)
কেস হাতে নিয়ে তাতে মন না দিতে অনিদাকে আমি আগে দেখিনি। মনে হচ্ছে সামনে পরীক্ষা, আর ছাত্র গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছে! কারণ, গতকাল বাসব নন্দীর বাড়ি থেকে ফেরার পর একবারের জন্যও ওকে কেসটা নিয়ে কোনো কথা বলতে শুনলাম না। অন্য সময় হলে মক্কেলের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলো হাজার বার দেখা হয়ে যেত। কিন্তু এবারে ও একবারের জন্যও সেই ইমেইলগুলো নিয়ে একটা কথা পর্যন্ত বলল না। সকাল এগারোটা বাজতে চলল। ও বঙ্কিমের আনন্দমঠ নিয়ে বসে আছে! এবার কী মনে হতে ল্যাপটপ খুলে মেইলগুলো পড়ে দেখল। তারপর আই.পি অ্যাড্রেসগুলো ইন্টারনেটে কোন সার্ভার থেকে পাঠানো হয়েছে সেটা দেখল। জায়গা খুঁজে দেখা গেল প্রথমটা হাজরা, দ্বিতীয়টা পার্ক সার্কাস আর তিন নম্বরটা কলেজ স্ট্রিট থেকে পাঠানো হয়েছে। এবার দরকার সেই কম্পিউটারগুলো যেখান থেকে এই মেইলগুলো পাঠানো হয়েছিল। অনিদা কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে সব তথ্য দিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সব ঠিকানা পেয়ে গেলাম।
“প্রত্যেকটা ইমেইল ক্যাফেটেরিয়া থেকে পাঠানো হয়েছিল। গোপনীয়তা রক্ষা করার এটাই সেরা উপায়।” বলল অনিদা।
আমরা এবার ক্যাফেটেরিয়াগুলোতে একবার করে ঢুঁ মারলাম। যে যে ক্যাফেটেরিয়ার কম্পিউটার ব্যবহার করে তার নাম-ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে রাখা একটা নিয়ম। কোথাও কোথাও তো সি.সি টিভিও লাগানো থাকে। এই ক্যাফেটেরিয়াগুলোতে যদিও সে ব্যবস্থা নেই। অবশ্য প্রতিটা কাস্টমারের নাম-ঠিকানা লিখে রেখেছে। তাছাড়া সময়ও ঘড়ি ধরে লেখা রয়েছে। তবে ইমেইলে যদিও সময় পাওয়া যেতই।
আমাদের বাড়ির কাছেই হাজরা। তাই সেখানেই গেলাম প্রথমে। ইমেইল থেকে সময় বের করে সে সময় কে কে এই ক্যাফে থেকে কম্পিউটার ব্যবহার করেছে তার লিস্টটা হাতে নিতে পেলাম মাত্র দুজনের নাম। প্রথম নামটা একটা বাচ্চা মেয়ের। কিন্তু এবার দু-নম্বর নাম আর নীচে লেখা ঠিকানাটা দেখে প্রথমে চোখ কপালে উঠল আর তারপর নিজের অজান্তেই হেসে ফেললাম।
নাম – বাসব নন্দী
ঠিকানা – বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড
ফোন নম্বর – (সেটাও বাসব নন্দীর)
আমাদের সন্দেহজনকভাবে নাম খুঁজতে দেখে ক্যাফের মালিক জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ব্যাপার ভাই? কোনো ঝামেলার কেস নাকি?”
আসলে দোকানের মালিক আমাদের চেনা। উনিও এই অঞ্চলের। আর অনিদার পেশাটাও উনি জানেন।
অনিদা অবশ্য ওঁর উত্তেজনা দমিয়ে দিয়ে বলল যে তেমন কিছু নয়, সামান্য একটা চুরির মামলায় আমরা কাজ করছি।
তাতে ‘ও’ বলে হেসে উনি বললেন, “এই বাসব নন্দী লোকটা কে?”
তাতে অনিদা হেসে বলল, “জানি না দাদা। অচেনা বলেই খুঁজছি।”
“আচ্ছা আচ্ছা,” আবার হেসে উনি বললেন, “আমি তো প্রথমে ভাবলাম ওই মিউজিক ডাইরেক্টর কি না।”
অনিদা তখন একটা একপেশে হাসি হেসে বলল, “উনি অত বড়ো লোক, এভাবে ক্যাফেটেরিয়াতে এসে ইমেইল করবেন!”
“তা অবশ্য ঠিকই।” বলে আবার কাজে মন দিলেন ক্যাফের মালিক।
বাকি জায়গাগুলোতেও একই অবস্থা। নাম থেকে ঠিকানা, সবই বাসব নন্দীর নাম ব্যবহার করা হয়েছে!
“আমার কিন্তু মনে হচ্ছে যে কেউ ওঁর সঙ্গে মজা করার জন্য মেইলগুলো পাঠাচ্ছে।” বললাম আমি।
বেশ কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল অনিদা। তারপর বলল, “সবই ঠিক আছে। শুধু মি. নন্দীর নামটা কেন ব্যবহার করা হল সেটাই রহস্য।”
“কেন?”
“যে লোক মেইলটা পাঠিয়েছে সে নিজের পরিচয় লুকোবার জন্যই বাসব নন্দীর নাম ব্যবহার করেছে। একটা সাধারণ মজা করার দরকার হলে নাম লুকোনোটা মানা যায়, কিন্তু যাকে মেইল করছি, তারই নাম ব্যবহার করছি, এটা কেমন যেন না?”
কথাটা আমাকে চিন্তায় ফেলল। আমরা ততক্ষণে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে এসেছি।
অনিদা গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, “তবে সত্যি সত্যিই যদি কেউ ওঁর সঙ্গে মজা করে থাকে তবে তো চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু আমাদের মনে হয় আর একটু সময় লাগবে।”
আমরা বাড়ি ফিরেছি প্রায় ঘণ্টা খানেক হয়ে গেল। অনিদার ঘরে বসে কথা হচ্ছিল। অনিদা এবার এমন একটা কথা বলল যেটা আমাকে ভাবাল।
“একটা জিনিস লক্ষ করেছিস?”
“কী, অনিদা?”
“প্রতিটা ক্যাফের মালিকই বয়স্ক।”
আমি ভেবে ওই লোকগুলোর মুখ মনে করে করে বললাম, “হ্যাঁ, সেটা ঠিক। কিন্তু তাতে কী?”
“না, আসলে ভাবছিলাম, যে মেইলগুলো পাঠিয়েছে, সে বেছে বেছে ওই ক্যাফেগুলো থেকেই পাঠিয়েছে যাতে মালিকের পক্ষে তাদের মুখ মনে রাখা সম্ভব না হয়। আর…”
বুঝলাম এর পেছনে নিশ্চয়ই অনিদার কিছু একটা যুক্তি আছে। তাই উৎসুক হয়ে ওর শেষ বলা কথাটাকেই প্রশ্ন করে নিয়ে বললাম, “আর?”
“এর একটা ক্যাফেতেও সি.সি টিভি ক্যামেরা নেই!”
অনিদা এগুলোর মধ্যে কী রহস্য পেল কে জানে! তাই জিজ্ঞাসা করলাম, “এর মধ্যে তুমি কি কিছু রহস্য খুঁজে পেলে?”
তাতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও বলল, “না, ঠিক সন্দেহ নয়। তবু মনটা ঠিক মানছে না রে জয়, যদি না কেউ ওঁর সঙ্গে প্র্যাক্টিক্যাল জোক করে থাকেন।”
এর ঠিক দু-দিন পরের কথা। আমরা অনিদার ঘরে বসে আড্ডা মারছি। কথা হচ্ছিল শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক কাহিনিগুলো নিয়ে। এমন সময় অনিদার মোবাইলটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে বাসব নন্দীর নামটা দেখে নিয়ে দু-সেকেন্ড কী যেন ভেবে নিয়ে ফোনটা ধরল অনিদা।
“গুড আফটারনুন মি. নন্দী!” বলে স্পিকার অন করল অনিদা।
“আফটারনুন ঠিক, তবে সেটা গুড নয়।” তিরিক্ষে গলা শুনেই বুঝলাম ভদ্রলোকের মেজাজ খাপ্পা।
“কেন? কী হল?” কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে বুঝতে পেরে সোফায় হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসল অনিদা।
“এমন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করলে কার মাথা ঠিক থাকে বলুন তো?” ভদ্রলোক ফোনে তখন রীতিমতো চেঁচাচ্ছেন।
সঙ্গে সঙ্গে ভুরু কুঁচকে গেল অনিদার। একবার আমার দিকে চেয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কে আপনাকে গালিগালাজ করল, মি. নন্দী?”
“কে আবার, সেই লোক! আবার ফোন করেছিল।” চেঁচিয়ে উঠলেন মি. নন্দী।
আমি তখন হাঁ করে চেয়ে রয়েছি অনিদার দিকে। কান অবশ্য ফোনের স্পিকারে। অনিদা তখন জিজ্ঞাসা করল, “কেন, কী বলছে এবার?”
“কী আর বলবে? সেই এক কথা। আমি যে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি সেটাও জেনে গেছে। বলছে মুখ খুলতে মানা করেছিল, আমি শুনিনি। তাতে ওর নাকি অপমান হয়েছে। পেছনে টিকটিকি লাগিয়ে নাকি আমি নিজেই আমার বিপদ ডেকে এনেছি। এমন করতে থাকলে এবারে আমার মুখ যাতে চিরদিনের জন্যই বন্ধ হয়ে যায়, সেই ব্যবস্থাই সে করবে।”
“হুম।” কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে অনিদা বলল, “নজর যে রেখেছে সে তো আগেই বুঝেছি। আপনি গলাটা চিনতে পেরেছেন?”
“না মি. সেন।” বললেন মি. নন্দী।
“আর কিছু বলল?”
“আর বলার কিছু বাকি রাখেনি মি. সেন। আমাকে কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে বলে, তারপর এমন নোংরা ভাষায় গালিগালাজ আরম্ভ করল যা মুখে আনা যায় না।”
অনিদা সে কথা শুনে বলল, “দেখুন, যে-ই এগুলো করে থাকুক না কেন, আমার মনে হচ্ছে সে আপনার একজন কম্পিটিটর। তাই আপনার কাজ না নেওয়াতে তার বা তাদের সবসময়ই লাভ।”
“দেখুন, লাইনে এক নম্বরে থাকা লোকটাকে সরিয়ে দিতে পারলে দুই থেকে দশ, সবারই লাভ।”
এই প্রথম বাসব নন্দীর গলায় এমন আত্মবিশ্বাস আর ঔদ্ধত্য দেখতে পেলাম।
অনিদা এবার ওঁর কাছে যে ফোনটা থেকে কল এসেছিল সেটার নম্বরটা নিল। তারপর মি. নন্দী ফোন রাখতে ওই নম্বরটাতে একটা ফোন করল। আর সঙ্গে সঙ্গে ওধার থেকে জানিয়ে দিল যে এই নম্বর আর কেউ ব্যবহার করে না। অর্থাৎ ‘দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড, ডাস নট এক্সিস্ট’!
অনিদা ফোনটা কাটতে কাটতে বলল, “অস্বাভাবিক কিছু নয়।”
যে কোম্পানির মোবাইল নম্বর থেকে ফোনটা এসেছিল, সেখানে অনিদার এক বন্ধু কাজ করে। তাকে ফোন করে অনিদা ওই নম্বরটা দিয়ে সেটার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে বলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই বন্ধু অনিদাকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে সেই নম্বরের মালিক থাকে চেতলা। নাম বিমান রায়।
সামান্য আশা নিয়ে আমরা চেতলা পৌঁছে তার থেকেও বেশি হতাশ হলাম যখন বিমান রায়ের বাড়ির লোক জানালেন যে মাস আটেক আগেই উনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। আর ওই নম্বরটা ওঁর বাড়ির লোক মাস খানেক হল সারেন্ডার করে দিয়েছেন।
কেস যে কোনদিকে গড়াচ্ছে, কিছুই আন্দাজ করা যাচ্ছিল না। আসলে সত্যি কথা বলতে কী, কেসটার গুরুত্ব কতটা, সেটা নিয়েই আমরা দোটানায় ছিলাম। অনিদা যদিও তেমন কিছু এখনো মন্তব্য করেনি, তবে আমার কিন্তু মনে হচ্ছিল এই কেসে তেমন ওজন নেই।
ঘড়িতে এখন রাত আটটা। আমরা সবেমাত্র ঘরে ফিরেছি, এমন সময় আবার বাসব নন্দীর কাছ থেকে ফোন এল।
“মি. সেন! মি. সেন!” প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছিলেন উনি। তাতে একটা বিপদের আশঙ্কা করে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেল আমার। অনিদার গলা অবশ্য বরাবরের মতোই শান্ত। মি. নন্দীকে বলল, “আপনি শান্ত হোন মি. নন্দী। কী হয়েছে বলুন!”
“বিপদ! বিপদ!” বলে একটা ঢোঁক গিলে একইভাবে হাঁপাতে লাগলেন মি. নন্দী। বুঝতে পারছিলাম কোনো একটা কারণে বেজায় ভয় পেয়েছেন ভদ্রলোক।
অনিদা তখন চোখ সরু করে একদৃষ্টে মাটির দিকে চেয়ে রয়েছে। এবার বাসব নন্দী যা বললেন তাতে আধা-খ্যাচড়া অবস্থা থেকে কেসটা পুরো আকার নিল। মনে হচ্ছিল সোজাসাপটা একটা জিনিস আচমকা জটিল হয়ে গেল।
আজ বিকেলে আমাদের সঙ্গে কথা হওয়ার পর উনি ওঁর পি.এ মি. অজয় রায়কে সঙ্গে করে টালিগঞ্জের একটা রেকর্ডিং স্টুডিওতে গেছিলেন। আধঘণ্টার একটা ছোট্ট মিটিং সেরে উনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। রোজের মতোই ড্রাইভার বেশ মাঝারি গতিতেই গাড়ি চালাচ্ছিল। অজয় রায় বসে ছিলেন ড্রাইভারের পাশের সিটে। ওঁর বাড়ি দেশপ্রিয় পার্কের কাছে। মি. নন্দী ভেবেছিলেন ওঁকে নামিয়ে দিয়েই বাড়ি ফিরবেন। সেইমতো রাসবিহারী মোড়ে এসে একটা শর্টকাট রাস্তা ধরেছিল ড্রাইভার। ওই রাস্তাটা সাধারণত পেরোতে লাগে দশ মিনিট। ওঁরা যখন প্রায় মাঝামাঝি চলে এসেছেন, এমন সময় আচমকা কোথা থেকে মুখোশ পরা চারটে লোক মোটর বাইকে করে এসে ওঁদের পথ আটকে দাঁড়ায়। বাইক থেকে এবার একজন নেমে এসে একটা লোহার রড দিয়ে সোজা মারে গাড়ির পেছনের কাচে। ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়ে কাচটা। এবার বাইক থেকে নেমে আসে আরেকজন। পকেট থেকে পিস্তল বের করে গাড়ির পেছনের সিটে বসে থাকা বাসব নন্দীকে ইশারা করে দরজা খোলার। উনি দরজা খুলতে সে এবার পিস্তলটা সরাসরি ওঁর কপালে ঠেকিয়ে বলে সাতদিনের মধ্যে কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে। না-হলে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এবার অজয় রায় কিছু বলতে গেলে তৃতীয়জন বাইক থেলে নেমে এসে সজোরে এক থাপ্পড় কষায় ওঁর গালে। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়তে থাকে বেচারার গাল বেয়ে। এরপর বাইক-বাহিনী সেখান থেকে চলে যায়। ঘটনাতে মি. নন্দী এতটাই ঘাবড়ে গেছিলেন যে শেষপর্যন্ত অজয় রায়ই উলটে ওঁকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যান!
ঘটনাটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে অনিদা এবার একটু অন্যভাবে ভাবা শুরু করল। প্রথমেই ও লালবাজারের ওর ও.সি বন্ধু রাজাদাকে ফোন করে সব কথা জানিয়ে বলল বাসব নন্দীর বাড়ির সামনে সাদা পোশাকে পুলিশ পাহারা বসাতে। এর সঙ্গে রাজাদাকে এটাও বলে দিল যে ব্যাপারটা যেন আপাতত পাঁচকান না হয়। আমি জানি, কেসটার সঙ্গে যেহেতু বাসব নন্দীর মতো হেভি ওয়েট একজন জড়িয়ে, তাই অনিদা লোকাল থানার হেল্প না নিয়ে সোজা লালবাজারে যোগাযোগ করল।
পরদিন সন্ধেবেলা অনিদা, আমি আর রাজাদা তিনজনে মিলে গেলাম বাসব নন্দীর বাড়ি। কেস হাতে আসার পর থেকে এই প্রথম আমাদের মুখোমুখি হলেন বাসব নন্দীর পি.এ অজয় রায়। বলতে গেলে আমাদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হল ওঁর। আর প্রথম দেখাতেই ওঁকে ভালো লেগে গেল আমার। কথাবার্তার মধ্যে একটা কাব্যিক ভাব রয়েছে মানুষটার। ভদ্রলোককে যত দেখছিলাম, তত আশ্চর্য হচ্ছিলাম। বাসব নন্দী ওঁকে শুধুমাত্র ওঁর সহকারী বলেই পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে জানতে পারলাম যে হেন কোনো যন্ত্র নেই যা উনি বাজাতে পারেন না। আস্তে আস্তে খোলসা হল যে বাসব নন্দীর গ্রুপের আসল স্তম্ভ উনিই।
গতকালের আচমকা হামলার কথাটা জিজ্ঞাসা করাতে মুখ চুন হয়ে গেল ওঁর। এখনো বেচারার ডান ঠোঁটের কাছটায় আঘাতের দাগটা যায়নি। বাইকে যারা ছিল, তাদের কাউকেই ওঁরা চিনতে পারেননি। কারণ, আগেই বলেছি ওরা সবাই ছিল মুখোশ পরা।
এর মধ্যে বাসব নন্দী জানালেন যে উনি ঠিক করে ফেলেছেন আগামী ছ’মাস মুম্বইতে থেকে কাজ করবেন। কলকাতা ওঁর জন্য আর নিরাপদ নয়। অজয় রায় অবশ্য ওঁকে সাহস জুগিয়ে চলেছেন। বার বার ঢোঁক গিলতে দেখে রাজাদা ওঁকে এবার জানাল যে ওঁর বাড়ির সামনে সাদা পোশাকে পুলিশ সবসময় ঘুরঘুর করছে। তাই চিন্তার কোনো কারণ নেই। অবশ্য এতে উনি কতটা নিশ্চিন্ত হলেন সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। কারণ, মাথা নাড়তে নাড়তে উনি বললেন, “কাল যেভাবে অ্যাটাক করল, তাতে আমার কনফিডেন্সটাই চলে গেছে মি. সেন!”
আমরা এবার বাড়ি ফেরার জন্য উঠলাম। মি. নন্দী অসুস্থ বোধ করাতে উনি আর নীচে নামলেন না। আমরা ঘর থেকে বেরোতে উনি লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন।
এবার সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে ওপরদিকে তাকাতে আমার চোখ পড়ল বাসব নন্দীর ঘরের কাচের জানালাটায়। জিনিসটা অজয় রায় বা রাজাদা নজর না করলেও আমার আর অনিদার চোখ এড়াল না। ওপরদিকে তাকাতে যেন একটা ছায়ামূর্তি ঝট করে সরে গেল জানালার সামনে থেকে।
অন্যদের থেকে একটু তফাতে আসতে অনিদাকে আমি ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “মি. নন্দী না?”
“চেপে যা।” সঙ্গে সঙ্গে চোখ টিপে আমায় থামিয়ে দিল অনিদা।
বাসব নন্দীর বাড়ি থেকে তিনটে রাস্তা তিনদিকে ছড়িয়ে গেছে। অজয় রায় চলে গেলেন দেশপ্রিয় পার্কের দিকে। রাজাদা বাইকে এসেছিল। ও বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ির দিকে। আমরা ধরলাম হাজরার রাস্তা।
“ছায়ামূর্তিটা বাসব নন্দী ছিলেন না?” গাড়িতে বসে অনিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“তাতে কোনো সন্দেহ নেই।” গাড়ি চালাতে চালাতে বলল অনিদা।
“ভদ্রলোক না অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন?”
“শুধু অসুস্থ!” মুখ দিয়ে চুক করে একটা আওয়াজ করে অনিদা বলল, “আমরা আসার সময় তো শুয়েই পড়লেন!”
“তাহলে?” আমার ব্যাপারটা কেন জানি ভালো ঠেকল না।
অনিদা বলল, “তাহলে আর কী? গণ্ডগোল।”
“লোকটা নিজেই কি সন্দেহজনক?”
আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর করল না অনিদা।
ইমেইল থেকে শুরু করে ফোন কল, বাসব নন্দীর সঙ্গে যে-সমস্ত জিনিসের সম্পর্ক রয়েছে, তাদের কথা চিন্তা করে সব ঘটনাগুলোকে সাজিয়ে কিছু একটা খাড়া করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিশেষ কিছু সুবিধে করতে পারলাম না।
বেশ কিছুক্ষণ পর অনিদা বলল, “জটটা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু সুতোর মুখটা খুঁজে পাচ্ছি না রে জয়!”
জটটা এবার একেবারে দলা পাকিয়ে গেল পরেরদিন রাতের বেলা। আচমকা যে খবরটা কানে এল তার জন্য আমরা বিন্দুমাত্র তৈরি ছিলাম না।
সেদিন রাত আটটা নাগাদ মুষলধারে বৃষ্টি নামে। মুহূর্তের মধ্যে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। এদিন টালিগঞ্জ থেকে ফেরার সময় আবার বাসব নন্দীর গাড়িতে হামলা হয়। ড্রাইভারের পাশের সিটে। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই পরপর ছ’টা গুলি! একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে লুটিয়ে পড়েন বাসব নন্দীর পি.এ মি. অজয় রায়! ভাগ্যবশত হোক কী দুর্ভাগ্যবশত, সেদিন গাড়িতেই ছিলেন না বাসব নন্দী।
(৫)
বাসব নন্দীর ড্রাইভারকে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেলেও মানসিকভাবে সে তখন বিধ্বস্ত। থানায় এককোণে গুটিসুটি মেরে বসে ছিল বেচারা। ফ্যাকাসে মুখ। উসকোখুসকো চুল। কথা বলেই বুঝলাম ওর মনের মধ্যে চলা ঘূর্ণি ঝড়টা এখনো থামেনি। অবশ্য চোখের সামনে এমন কিছু ঘটলে এটাই স্বাভাবিক।
অনিদা ওকে নাম জিজ্ঞাসা করলে পর ও কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “মণি।”
এবার কালকের ঘটনার কথা জিজ্ঞাসা করতে ও যা জানাল তা হল এই—
কাল অজয় রায়ও বাসব নন্দীর সঙ্গে রেকর্ডিং স্টুডিওতে ছিলেন। কাজ শেষ হতে তখনো আরো ঘণ্টা খানেক সময় বাকি। এদিকে অজয় রায়ের তখন বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল। তাই বাসব নন্দী ওঁকে বলেন ওঁর গাড়িটা নিয়ে ফিরতে। ঠিক হল, মণি প্রথমে মি. রায়কে পৌঁছে দিয়ে এসে তারপর মি. নন্দীকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে।
ওরা আজও সেই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিল যে রাস্তায় বাসব নন্দীর ওপর আগের দিন হামলা হয়েছিল। এদিনও গাড়ি যেই রাস্তার মাঝামাঝি এসেছে, ঠিক আবার আগের দিনের মতোই মুখোশধারী চারটে লোক বাইক নিয়ে এসে ওদের পথ আটকে দাঁড়াল। বাধ্য হয়েই গাড়ি থামাতে হল মণিকে। সঙ্গে সঙ্গে বাইক থেকে নেমে এসে একজন গাড়ির সামনের বাঁদিকের কাচটা হাতের লোহার ডান্ডাটা দিয়ে দমাদ্দম বাড়ি মেরে ভেঙে চুর চুর করে দিল। এর মধ্যে বাইক থেকে নেমে এসেছে আরো একটা লোক। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে এবার পকেট থেকে রিভলবার বের করে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে লাগল অজয় রায়ের ওপর। পর পর ছ’টা গুলি খেয়ে মি. রায় তখন সিটের মধ্যেই লুটিয়ে পড়েছেন।
“তোমাকে কিছু বলেনি, বা করার চেষ্টা করেনি ওরা?” জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
“না স্যার।” মাথা নাড়ল মণি। পুরো ঘটনাটা আবার করে বলতে গিয়ে থরথর করে কাঁপছিল বেচারা।
লোকগুলো সবাই মুখোশ পরে ছিল। তাই চেনার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। সুতরাং অনিদা সেই প্রসঙ্গে গেল না। জিজ্ঞাসা করল, “বাইকের নম্বরগুলো দেখেছিলে?”
“এ-জিনিস আগে কোনোদিন দেখিনি স্যার। তাই ওসব কথা মাথাতেই ছিল না। আর রাস্তাটা অন্ধকার ছিল।” বার দুয়েক ঢোঁক গিলে বলল মণি।
আমি মনে মনে মণির কথার সমর্থন করলাম। মনে হল, সবাই তো আর অনিদার মতো মাথা ঠান্ডা রেখে চলতে পারে না। তাও চোখের সামনে একটা নৃশংস খুন দেখার পর।
অনিদা তখন আবার প্রশ্ন করল, “ওরা গাড়ি থেকে নেমে এসেই এলোপাথাড়ি গুলি করতে শুরু করল?”
“না না। প্রথমে লোকটা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করল। তারপর চেঁচিয়ে চেঁচিযে ধমক মেরে বলল, ‘তোকে বলেছিলাম না যে কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে? শুনলি না, তাই না? এবার তোকে এর ফল ভুগতে হবে।’ বলেই দমাদ্দম গুলি চালাতে শুরু করল।”
“কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে!” ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল অনিদা।
লক্ষ করলাম, ওর কপালে তখন গোটা চারেক ভাঁজ। মুখটা অসম্ভব থমথমে। জিনিসটা আমার কাছেও আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছিল। শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত পড়ছিল আমার।
অনিদা তখন ফিসফিসিয়ে বলে উঠল, “সর্বনাশ!” এবার আমার দিকে চেয়ে বলল, “বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা?”
চমকের পর চমকে সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল আমার। তবে এতটুকু বুঝতে পারলাম যে আততায়ীরা আসলে বাসব নন্দী ভেবে অজয় রায়ের ওপর গুলি চালিয়েছে! তবে জিনিসটা নিয়ে অন্য কারো কাছে আর মুখ খুললাম না। বাসব নন্দীর কাছে তো নয়ই। ওঁর ড্রাইভারকেও অনিদা বুঝিয়ে বলে দিল যে এ বিষয়ে আপাতত আর কারো কাছে মুখ না খুলতে।
মি. নন্দী তখন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। বাইরে সেই সময় লোক জমে গেছে। কয়েকজন রিপোর্টারকেও দেখলাম কোথা থেকে চলে এসেছে। তবে টুকরো-টাকরা যে-ক’টা কথা কথা কানে এল, তাতে বুঝলাম আসল ঘটনা এখনো ওদের কানে যায়নি। তাই পুলিশের পক্ষে জিনিসটা চেপে রাখা কিছুটা হলেও সুবিধেজনক। তবে বলতেই হবে, পুলিশ ব্যাপারটা ম্যানেজ করল বেশ।
অনিদা এবার মণিকে আরো কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করল। “আচ্ছা, তোমার সাহেব কি কখনো সামনে আর কখনো পেছনে বসতেন?”
“না,” মাথা নেড়ে মণি বলল, “উনি সবসময় পেছনেই বসেন।”
“আর অজয় রায় গাড়িতে উঠলে কোথায় বসতেন?”
“ওঁর কিছু ঠিক থাকত না। সাহেবের সঙ্গে কখনো কখনো পেছনেও বসতেন। যেমন কখনো কিছু দরকারি কথা থাকলে। আবার কখনো উনি সামনেও বসতেন। আমার পাশে।”
“হুম।” অনিদা এবার কয়েক মুহূর্ত কিছু একটা চিন্তা করে বলল, “তার মানে আততায়ী জানত যে পেছনের সিটটা কালকে ফাঁকা থাকবে।” তারপর বেশ কিছুক্ষণ মাটির দিকে চেয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল, “কিন্তু কী করে?”
“ওঁদের ওরা কাল ফলো করছিল হয়তো।” বললাম আমি।
“হতে পারে।” মাথাটা একবার সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে বলল অনিদা। তারপর বলল, “আবার এও হতে পারে যে কেউ তাদের খবর দিয়ে দিয়েছিল।”
“সে কি!” অনিদার কথাটা শুনে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। বললাম, “কে খবর দেবে?”
অনিদা তখন একটা শুকনো হাসি হেসে বলল, “সেটা জানলে তো হয়েই যাবে রে!” তারপর আবার মণিকে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, তুমি তো তোমার সাহেবের সঙ্গে সব জায়গায় যাও?”
“হ্যাঁ, স্যার।” মাথাটা সামনের দিকে ঝোঁকাল মণি।
“সন্দেহজনক কাউকে তেমন কোনোদিন চোখে পড়েছে? মানে, যেমন ধরো তোমার সাহেবের সঙ্গে কারো কোনোদিন ঝগড়া-টগরা বা অন্য কোনো শত্রুতা…”
“সেইরকম তো…” একটু ভেবে মণি বলল, “না স্যার, তেমন কিছু কোনোদিন দেখিনি। তবে…”
শেষ কথাটায় রহস্য ছিল। তাই অনিদা সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে প্রশ্ন বানিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তবে?”
“একজন লোক আছে। কী যেন নাম!” একটু ভেবে নিয়ে মণি বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। হোমি উল্লা।”
“হোমি উল্লা!” আমার দিকে চেয়ে অনিদা বলল, “সেই বিখ্যাত প্রডিউসার!” তারপর আবার উৎসুক হয়ে মণির দিকে তাকিয়ে বলল, “কী ব্যাপার?”
মণি তখন বলল, “ওই লোকটার সঙ্গে সাহেবের ঝামেলা আছে।”
“কী ঝামেলা?” বলে অনিদা ভুরু কুঁচকে একবার আমার দিকে তাকাল। যার মানে আমি জানি। মি. নন্দী একবারও এই লোকটার ব্যাপারে অনিদাকে জানায়নি। আর সেটা জানতে পেরে অনিদা যে বেশ বিরক্ত তা ওর মুখ দেখেই বুঝলাম।
মণি বলল, “এই তো কয়েকদিন আগেই লোকটার সঙ্গে সাহেবের কী একটা জিনিস নিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল।”
“কী নিয়ে?”
“তা বলতে পারব না স্যার। তবে লোকটা সাহেবকে কিছু একটা বলছিল যাতে সাহেব কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না।”
“তোমার সামনেই কথা হচ্ছিল?”
“হ্যাঁ, আমার সামনেই তো। মানে ওঁরা পেছনের সিটে বসে কথা বলছিলেন।”
“আর মি. রায় সেই সময় সামনে ছিলেন?”
“হ্যাঁ। রায় সাহেবও তখন গাড়িতে ছিলেন। সামনের সিটে বসে ছিলেন।”
“কী ব্যাপারে কথা হচ্ছিল ওঁদের মধ্যে?”
“সেটা জানি না। তবে লোকটা সাহেবকে কিছু একটা ব্যাপারে রাজি করানোর চেষ্টা করছিল। সাহেব রাজি হচ্ছিলেন না। শেষে কথা কাটাকাটি বেশি হওয়াতে সাহেব লোকটাকে গাড়ি থেকে নেমে যেতে বললেন।”
“তারপর?”
“লোকটা নেমে যাওয়ার আগে সাহেবকে ধমক দিয়েছিল যে সাহেব ইন্ডাস্ট্রিতে কী করে কাজ করেন তা ও দেখে নেবে।”
“হুম।” আবার কী যেন ভাবল অনিদা। ও কী ভাবছিল সেটা জানার খুব ইচ্ছে করছিল।
“এরপর ওঁর সঙ্গে আর তোমার সাহেবকে কোনোদিন কথা বলতে দেখেছ?” আবার মণিকে জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
“সামনাসামনি না হলেও ফোনে কথা বলতে শুনেছি।” বলল মণি।
“কী নিয়ে কথা বলছিলেন ওঁরা?”
“মনে হয় ওই একই ব্যাপারে কথা বলছিলেন। আমার শুধু মনে আছে সাহেবের ওই কথাটা। কী একটা বলতে সাহেব হঠাৎ রেগে উঠে বললেন, ‘অজয় আমার হয়েই কাজ করবে মি. হোমি উল্লা। অন্য কারো হয়ে নয়।’”
অজয়! তথ্যে আবার চমক! চোখ প্রায় কপালে তুলে অনিদা জিজ্ঞাসা করল, “উনি মি. রায়কে নিয়ে কথা বলছিলেন?”
“একদিন তো রায় সাহেবকেও ফোন করেছিল লোকটা। আমার সাহেব তখন গাড়িতে ছিলেন না।”
“তাই? কী বলছিল?”
“লোকটা মনে হয় রায় সাহেবকে অনেক টাকা দিতে চাইছিল।”
“মি. রায় তোমাকে বলেছিলেন সে কথা?”
“না না। ফোনে উনি যা বলছিলেন সেটা শুনেই মনে হচ্ছিল।”
“কী বলছিলেন উনি?”
এবারে একটু ভেবে মণি বলল, “উনি যা বলছিলেন তা অনেকটা এইরকম, ‘টাকার অ্যামাউন্ট অনেক হলেও আমার হাত বাঁধা, মি. হোমি উল্লা।’”
“হুম।” আবার গভীর চিন্তায় ডুবে গেল অনিদা। এবার ডান হাতটা দু-গালে ঘষে নিয়ে বলল, “আর কিছু মনে আছে তোমার?”
“না স্যার।” মাথা নেড়ে মণি বলল, “তবে যেদিন রায় সাহেবের কাছে ফোনটা এসেছিল, সেদিন উনি মনে হয় খুব চাপে ছিলেন। কেমন যেন টেনশন-টেনশন মুখ করে বসে ছিলেন।”
অনিদা এবার প্রসঙ্গ বদল করল। কথা বলে জানতে পারলাম মণি আজ প্রায় চার বছর মি. নন্দীর ড্রাইভারি করছে। ওর বাড়ি বালিগঞ্জ বন্ডেল গেটের কাছে। বাড়িতে মা আর ছোটো ভাই। ভাই পড়াশুনা করে। সংসারের দায়িত্ব ওরই ওপর।
“এই চাকরিতে চলে তোমার?” অনিদা জিজ্ঞাসা করল ওকে।
“আরামসে স্যার। তার ওপর সাহেব আমাকে অন্যদিক দিয়েও প্রচুর হেল্প করেন।”
অনিদা মণিকে এবার ছুটি দিল। কোনো সন্দেহ নেই, ওর থেকে পাওয়া তথ্যগুলো আমাদের অনেক কাজে লাগবে।
আমরা এবার মি. নন্দীর কাছে গেলাম। উনি তখনো একইভাবে বসে। অনিদা ওঁকে সরাসরি হোমি উল্লার কথা জিজ্ঞাসা করল। “আপনি লোকটার কথা চেপে গেলেন কেন?”
অনিদার কথা শুনে উনি একবার ঝট করে ওর দিকে তাকালেন। তারপর তিরিক্ষে মেজাজে বললেন, “আপনি ওর কথা জানলেন কী করে?”
“যেভাবেই জানি।” কড়া গলায় করে অনিদা বলল, “একথা কি সত্যি যে ওঁর সঙ্গে আপনার রিসেন্টলি ঝামেলা হয়েছিল?”
বেশ কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে রেখে এবার ধীরে ধীরে মাথা তুলে চোয়াল শক্ত করে সামনের দিকে দু-বার মাথা ঝোঁকালেন মি. নন্দী।
“কী নিয়ে?”
মি. নন্দী চুপ করে আছেন দেখে অনিদা আবার বলল, “দেখুন, সত্যিই যদি কিছু থেকে থাকে তো খুলে বলুন। মনে রাখবেন, একজনের প্রাণ গেছে।”
“একজন!” অনিদার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে মি. নন্দী বললেন, “অজয় আমার কাছে শুধুমাত্র একজন ছিল না মি. সেন।”
“তাই তো বলছি মি. নন্দী,” গলা নরম করে অনিদা বলল, “সব খুলে বলুন।”
সামান্য ইতস্তত করে মি. নন্দী বললেন, “আপনি ঠিকই শুনেছেন মি. সেন। হোমি উল্লার সঙ্গে আমার ঝামেলা চলছে। ও যে প্রডিউসার তা নিশ্চয়ই জানেন? ওর একটা সিনেমাতে সাইন করা নিয়ে ঝামেলা।”
“আপনাকে কাজ করতে বলছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“আপনি রাজি হননি?”
“না।”
“কেন? উনি তো বড়ো মাপের প্রডিউসার।”
“নামেই বড়ো, কাজে নয়।” বলে মি. নন্দী যেভাবে মুখ ঘুরিয়া নিলেন, মনে হল ঘেন্নায়। তারপর বললেন, “কাজ তো করিয়ে নেয়। কিন্তু তারপর পেমেন্টের কথা উঠলেই তার টিকিটি খুঁজে পাওয়া যায় না।”
“এর আগে ওঁর সঙ্গে কাজ করেছেন?”
“করেছি তো। ওই যেটায় আমি দ্বিতীয়বারের জন্য সেরা সুরকারের পুরস্কারটা পেলাম, সেটাতে। কিন্তু পুরস্কারে কি পেট ভরে? কন্ট্রাক্টের টাকা এখনো পাইনি। পাঁচ বছর হয়ে গেছে। জানি লোকটা সেটা মেরে দিয়েছে। এরপরেও আবার ওর সঙ্গে কাজ করব, ও ভাবল কী করে?”
“উনি মি. রায়কেও ফোন করেছিলেন?”
“কেন করেছিলেন বুঝলেন না?” উত্তেজিত হয়ে মি. নন্দী বললেন, “শয়তানটা জানে রায় রাজি হলেই নন্দীকে পাওয়া যাবে। কিন্তু অজয়ও রাজি হয়নি। দেখুন মি. সেন, কাজ জানা লোকের কাজের অভাব হয় না। তাই আমার প্রডিউসারেরও অভাব হবে না।”
আমি ভেবেছিলাম হোমি উল্লার মি. রায়কে টাকা অফারের ব্যাপারটা অনিদা মি. নন্দীকে জিজ্ঞাসা করবে। কিন্তু কেন জানি না ও ওটা চেপে গেল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “আপনার কী মনে হয়, মি. রায়ের খুনের পেছনে হোমি উল্লার হাত আছে?”
অনিদার প্রশ্নে তেতে উঠলেন মি. নন্দী। বললেন, “কার হাত থাকতে পারে তা আমি কী করে বলব বলুন তো? প্রথমেই বলেছিলাম জিনিসটাকে সিরিয়াসলি নিতে। কিন্তু আপনারা তো খেলা ভেবেই উড়িয়ে দিলেন।” শেষের কথাটা বেশ কড়া শোনাল মি. নন্দীর।
রাজাদা সামনে ছিল। ও অনিদার হয়ে বলল, “দেখুন, এতটা হবে সেটা কি আপনিও ভেবেছিলেন?”
“কী করে ভাবব?”
“তবে? আপনি তো জানেন যে এইধরনের ঘটনা শহরে আকছার ঘটে চলেছে। তবে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। যে এটা ঘটিয়েছে, তাকে আমরা ধরবই।”
“যা খুশি করুন আপনারা। অজয়কে তো ফিরে পাবো না, তাই না?” বলে দু-হাতে মুখ ঢাকলেন মি. নন্দী।
একেবারে পুলিশি ঘেরাটোপের মধ্য দিয়ে বাসব নন্দীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসা হল। থানা থেকে বেরোতেই রিপোর্টার থেকে ফটোগ্রাফাররা ছেঁকে ধরল আমাদের। কোনোরকমে নিজেদের বাঁচিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। সেলিব্রিটিদের যে কী কী সামলাতে হয় তা ভালোই টের পাচ্ছিলাম আজকে।
টিভি চ্যানেলের হাজার হাজার প্রশ্নবাণ তখন রাজাদার দিকেই উড়ে আসছে। কারণ, আমাদের আসল পরিচয় তখনো পর্যন্ত গোপনই রাখা হয়েছে।
এবার ভিড়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে আমরা যখন গাড়িতে উঠছি, তখন প্যান্টের ডান পকেটে হাত দিয়ে পেলাম একটা কাগজের দলা। বুঝতে পারলাম কেউ কায়দা করে লুকিয়ে সেটা আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে! কাগজটা পকেট থেকে বের করতে করতে ঘাড় ঘুরিয়ে ডাইনে বাঁয়ে তাকালাম। কিন্তু সন্দেহজনক কাউকেই চোখে পড়ল না। এবার অনিদাকে সেটা বলতে ও আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে তার পাকানো ভাঁজটা খুলল। দেখি, তাতে লেখা রয়েছে একটা হুমকি—‘ওকে বলে দে, খুব অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। এবার আর ভুল হবে না। যত তাড়াতাড়ি হয় কলকাতা থেকে ভাগতে বল।’
লেখাটা পড়ে অনিদা সবেমাত্র কাগজটা পকেটে রেখেছে, ঠিক এমন সময় আচমকা একটা বাইক প্রচণ্ড শব্দ করে কোথা থেকে ঝড়ের বেগে আমাদের দিকে ধেয়ে এল। আর একটু হলে আমাদের প্রায় গায়ে উঠে পড়ছিল! ভাগ্যিস সময়মতো দেখে ফেলেছিলাম। তাই এক ঝটকায় দুজনে মিলে উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়লাম রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর।
আমরা গা ঝেড়ে উঠতে উঠতে বাইক ততক্ষণে হাওয়া। অনিদা তখনো চেয়ে রয়েছে সেদিকে। এবার হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, “যুদ্ধের দামামা বেজে গেছে রে জয়। অপোনেন্ট যে ধারে কাছেই ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেটা অন্তত বোঝা গেল।”
(৬)
পুলিশ এর মধ্যে অঙ্কের ব্যাক ক্যালকুলেশন শুরু করে দিয়েছে। একে তো সেলিব্রিটি, তার ওপর আবার খুনের মামলা। পুলিশ যাকে পারছে তাকেই জেরা করছে। হুমকি দেওয়া পর্যন্ত তাও ঠিক ছিল। কিন্তু এবার এর সঙ্গে খুনখারাপি জুড়ে যেতে পুরো বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। আবার তার সঙ্গে মিডিয়ার অত্যাচার তো রয়েইছে। টিভি ক্যামেরা থেকে শুরু করে খবরের কাগজ, সবাই যেন গিলে খেতে আসছে। রাজাদা আর দেশপ্রিয় পার্ক থানার ও.সি কী করে যে এসব সামলাচ্ছে, তা কে জানে।
অনিদা এবারে ওর কাজে আরো বেশি করে মন দিল। প্রথমেই আমরা টার্গেট করলাম হোমি উল্লাকে। অনিদা ওঁর নম্বর মি. নন্দীর থেকে নিয়ে নিয়েছিল। আজ সকালেই ওঁকে ফোন করল। বাসব নন্দীর নাম শুনে প্রথমে তো উনি কোনো কথাই শুনতে চাইছিলেন না। পরে অবশ্য বললেন, অজয় রায়ের মৃত্যুতে উনি দুঃখিত। কারণ, মি. রায়কে নিয়ে ওঁর অনেক প্ল্যান ছিল। এই ঘটনাতে ওঁর নাকি অনেক লস হয়ে গেছে। অনিদা ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চায় শুনে উনি ফোনই কেটে দিচ্ছিলেন। শেষে অনেক জোরাজুরির পর উনি আমাদের জন্য কিছুটা সময় খরচ করতে রাজি হলেন।
কথামতো পরদিন সকাল সাড়ে এগারোটার সময় আমরা হোমি উল্লার রাসবিহারীর অফিসে রওনা দিলাম।
“অজয় রায়কে নিয়ে পরিকল্পনার ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। কী ব্যাপারে কথা বলছিলেন উনি?” যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করলাম অনিদাকে।
তা শুনে অনিদা ঠোঁট উলটে বলল, “সেটাই আশ্চর্য লাগছে। অবশ্য পুরো বিষয়টা ওঁর সঙ্গে কথা বলে তবেই পরিষ্কার হবে। তবে একটা কথা আমার কিন্তু মনে হচ্ছে।”
অনিদার কথা শুনে আমি উৎসুক হয়ে বললাম, “কী কথা?”
“মনে হয় না অজয় রায়ের খুনের সঙ্গে হোমি উল্লার কোনো হাত আছে।”
“প্ল্যানের কথাটার জন্য বলছ?”
“হ্যাঁ। যাকে নিয়ে প্ল্যান করবে, তাকেই খুন করবে? আবার মি. রায়ের মৃত্যুতে ক্ষতিও তো হয়ে গেছে বলছে ওঁর!”
“সে তো উনি আমাদের মিথ্যেও বলতে পারেন। কারণ, ড্রাইভারের কথা শুনেই তো বোঝা গেছে আততায়ীরা বাসব নন্দীকেই খুন করতে এসেছিল।”
“কিন্তু একটা জিনিস তুই লক্ষ করেছিস, যে প্রথম হামলাটা পেছনের সিটে করা হয়েছিল? কারণ, আততায়ী জানত যে মি. নন্দী পেছনের সিটে বসে আছেন। অথচ তার পরের বারটা করা হল সামনের সিটে। কিছু না ভেবে, না দেখে! তার মানে তারা জানত যে এবারে পেছনের সিটে কেউ নেই!”
অনিদার কথা শুনে আমি ঢোঁক গিলে বললাম, “মানে?”
“মানে এটাই যে সামনের সিটে মি. নন্দী বসে আছেন সেটা ভাবা হয়েছিল, নাকি ভাবানো হয়েছিল!”
কথাটা শুনে আমার মুখ হাঁ হয়ে গেল। অনিদাকে পরের প্রশ্নটা করতে যাব, এমন সময় হঠাৎ গাড়ির সামনের লুকিং গ্লাসে এক বাইকওয়ালাকে দেখে আমার সন্দেহ হল। সারা শরীর কালো পোশাকে ঢাকা। মাথায় হেলমেট থাকায় মুখ দেখা যাচ্ছিল না। আমাদের গাড়ির বেশ কিছুটা পেছনে পেছনে আসছিল বাইকটা। লোকটাকে দেখেই যে জিনিসটা আমার অবাক লাগল, সেটা হল এই গরমের মধ্যেও এত কিছু সে গায়ে চাপিয়ে রয়েছে কী করে! মনে হল নিজেকে যেন লুকোনোর চেষ্টা করছে লোকটা। বেশ কিছুক্ষণ পর মনে হল ও আমাদের পিছু নিয়েছে! কারণ আমরা যে রাস্তাতেই যাচ্ছি, সেও আমাদের পেছন পেছন সেই রাস্তাতেই যাচ্ছে। আর গতিও আমাদের গাড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়েই রেখে চলেছে সে। সন্দেহটা এবার বিশ্বাসে ঘুরল যখন অনিদা আমাদের গাড়িটা ভুল করে একটা গলিতে ঢুকিয়ে ফেলেছিল। সঙ্গে সঙ্গে লোকটাও আমাদের পেছন পেছন ওই গলিতে ঢুকে পড়ল। এবার অনিদা গাড়ি বের করে নেবে বলে পেছনদিকে নিয়ে যেতেই সেই লোকটাও বাইক পেছোতে লাগল।
লোকটার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না বলে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল আমার। এবার থাকতে না পেরে অনিদাকে ব্যাপারটা বলতে ও আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “তাই তো গাড়িটা অন্য একটা গলিতে ঢুকিয়ে দিয়ে লোকটার সঙ্গে একটু মজা করলাম।”
“তার মানে তুমি বুঝতে পেরেছিলে?” আমি মুচকি হাসির সঙ্গে চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করলাম অনিদাকে।
ও তখন আমাকে আবার অবাক করে দিয়ে বলল, “লোকটাকে আমি সকাল থেকেই লক্ষ করছি।”
“সকাল থেকে!”
“আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে গলিটার কাছে ঘুরঘুর করছিল। দূরে থাকায় মুখটা আগেও ভালো করে দেখতে পারিনি। আর এখন তো হেলমেট পরে। গাড়ির পেছনে দেখেই বুঝতে পেরেছি।”
এর মধ্যে একটা ক্রসিং এল। আমাদের গাড়ি সেখানে দাঁড়াতে বেশ কিছুটা তফাতে এসে দাঁড়াল বাইকটা। এই সময় একটা কাণ্ড করল অনিদা। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে ঝট করে গাড়ির দরজা খুলে ছুটে গেল বাইকওয়ালাটার দিকে। কিন্তু ওর পাঁচ হাতের মধ্যে পৌঁছোতে না পৌঁছোতে সট করে ঘুরে গিয়ে ডানদিকের গলি দিয়ে পালিয়ে গেল বাইকটা।
বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে সেদিকে চেয়ে থেকে আবার গাড়িতে এসে বসল অনিদা। এবার ডান হাতে একটা তুড়ি মেরে বলল, “এই লোকটাই কাল আমাদের বাইকে চাপা দিতে চেয়েছিল।”
“কী করে বুঝলে?” কালকের ঘটনাটা চিন্তা করে কিছু না ধরতে পেরে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
ও আবার আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “লোমানি।”
“লোমানি?” অনিদার কথায় মানে বুঝতে পারলাম না। বললাম, “সে তো একটা পারফিউমের নাম!”
“ঠিক তাই।” মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে অনিদা বলল, “এইমাত্র যেটার গন্ধ আমি পেয়েছি। এই লোকটাই সেটা ব্যবহার করেছে।”
“কিন্তু সে তো হতেই পারে। তাতে কী?” অনিদার কথা আমার কাছে হেঁয়ালির মতো শোনাল।
তখন অনিদা আমাকে চমকে দিয়ে বলল, “কাল যখন আমরা থানা থেকে বেরিয়ে ভিড় ঠেলে গাড়ির দিকে এগোচ্ছিলাম, তখনো এই গন্ধটা আমার নাকে এসেছিল।”
“তার মানে তুমি বলতে চাইছ যে কালকে আমাদের ওপর যে হামলা করেছিল সেই লোকই আজ আমাদের ফলো করছে? কিন্তু এক ব্র্যান্ডের পারফিউম তো অনেকেই মাখতে পারে। তাই শুধুমাত্র গন্ধের ওপর ভরসা করে…”
“ঠিক বলেছিস।” অনিদা এবার মাথা হেলিয়ে বলল, “তবে শুধুমাত্র গন্ধের ওপর বেস করে আমি একথা বলছি না। আরো একটা জিনিস আছে।”
“কী?” অনিদার কথা শুনে নড়েচড়ে উঠলাম আমি।
অনিদা তখন বলল, “কাওয়াসাকি বাজাজ, আর তার নম্বর। শেষে চার। আর সেটাই হল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।”
অনিদার কথাটা শুনে আমার পিঠ দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল।
“তার মানে সত্যিই আমাদের পেছনে লোক লাগানো হয়েছে!” বললাম আমি।
“কোনো সন্দেহ নেই।” মাথাটা বার দুয়েক ডাইনে বাঁয়ে নেড়ে বলল অনিদা।
আমার কেমন যেন একটু ভয় ভয় করছিল। তাই জিজ্ঞাসা করলাম, “কে লোক লাগাল?”
“যে এই ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে।”
“হোমি উল্লা?”
“তার চান্স খুব কম।”
অনিদা যার সঙ্গে কথাই বলেনি, তাকে কী করে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছে সেটা মাথায় ঢুকছিল না। কথাটা ওকে জিজ্ঞাসা করতে ও বলল, “একটু বুদ্ধি খরচ কর।”
বুঝতে পারলাম, কিছু একটা মিস করছি। তাই কিছু না বলে ফ্যাল ফ্যাল করে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। ও বলল, “একটা প্রশ্নের উত্তর দে। কাউকে কারো পেছনে কেন লাগানো হয়?”
“তার গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্য।”
“ঠিক তাই। আর আমরা এখন কোথায় চলেছি?”
“হোমি উল্লার অফিসে।”
“হুম। হোমি উল্লা সে-কথা জানেন?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই। কারণ, আগে থেকে আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।”
“তাহলে উনি যদি জানেনই যে আমরা ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, তাহলে এখন শুধু শুধু উনি আমাদের পেছনে লোক লাগাবেন কেন?”
“এটা তো ভেবে দেখিনি!” ফস করে জিভ কাটলাম আমি।
তাতে অনিদা হেসে বলল, “শুধু তোপসেকে নকল করলেই হবে? ওর মতো বুদ্ধিটাও তো ধরতে হবে!”
আমি হেসে লজ্জা ঢাকলাম।
তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। আমি ওর দিকে তাকাতে ও বলল, “হোমি উল্লা যদি লোক না লাগিয়ে থাকেন তবে বলাই যায় যে উনি অপরাধী নন।”
কথাটা শুনে আমি যে খুব খুশি হলাম তা মোটেই নয়। কারণ, আমি ধরে নিয়েছিলাম যে হোমি উল্লাই আসল দোষী। তাই আশা করেছিলাম অপরাধীর মুখোশ হয়তো আমরা আজই খুলে দিতে পারব। কিন্তু এবারে মনে হল আমাদের এখনো অনেক সিঁড়ি চড়া বাকি আছে। এর মধ্যে অনিদাকে দেখলাম রাজাদাকে ফোন করছে। ও বাইকের নম্বরটা তখনো মনে রেখেছে। রাজাদাকে সেটা দেবার সময় শুনতে পেলাম।
আর মাত্র মিনিট দুয়েকের মধ্যেই আমরা পৌঁছলাম হোমি উল্লার অফিসে।
সাধারণ চেহারার একজন অসাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল আমাদের। চেহারায় মনে রাখার মতো কিছু নেই, শুধু সুরমা লাগানো কটা চোখদুটো ছাড়া। ফোনে যখন কথা বলছিলেন, তখন বেশ তিরিক্ষে লাগছিল ওঁকে। এখানে সামনাসামনি দেখা হতে কিন্তু খুব খাতির করেই ভেতরে ডেকে নিয়ে বসালেন আমাদের। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই আমাদের জন্য চলে এল চিকেন প্যাটিস আর কাজু বরফি দেওয়া শরবত। এবার অজয় রায়ের কথা উঠতে উনি বললেন যে এমন লোক নাকি ইন্ডাস্ট্রিতে দুটো ছিল না। ওঁর দীর্ঘশ্বাস ফেলাই বুঝিয়ে দিল, ঘটনাটাতে উনি কতটা ধাক্কা খেয়েছেন। তবে তার কারণ জানি না।
“জানেন, আমার পরের প্রজেক্টে অজয় বাবুর কাজ করার কথা ছিল।” বললেন হোমি উল্লা।
“বাহ্, আপনি তো বেশ বাংলা বলেন!” বলল অনিদা।
উত্তরে যেন অনেকটা জোর করেই হাসলেন ভদ্রলোক।
অনিদা এবার ওঁকে জিজ্ঞাসা করল, “কিন্তু আপনার প্রজেক্টে মি. রায়ের কাজ করার কথা ছিল মানে, ব্যাপারটা বুঝলাম না।”
তাতে আবার হেসে উনি বললেন, “বোঝার কথাও নয়।”
অনিদা তখন বলল, “অমন একজন হিট সুরকারকে ফেলে আপনি ওঁর সহকারীকে নিয়ে কাজ করতে চাইছিলেন!”
গলা শুনেই বুঝলাম ওঁর কথায় অনিদা কতটা অবাক হয়েছে।
“কে হিট?” এবার যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন হোমি উল্লা। ওই অকাট মূর্খটা হিট? ও গানের কিছু বোঝে? আমি ওর সঙ্গে কাজ করেছি মি. সেন, আমি জানি আসল গল্পটা কী!”
অনিদার কপালে তখন গোটা তিনেক ভাঁজ। আমিও হাতড়াচ্ছি ওঁর কথার মানে বের করার জন্য।
এবার একবার আমার দিকে চেয়ে নিয়ে অনিদা বলল, “আপনার কথাটা কিন্তু ঠিক বুঝলাম না।”
“এখনো বুঝলেন না?” বলে একটা একপেশে হাসি হাসলেন ভদ্রলোক। বললেন, “দেখুন, নাম বাসব নন্দীর হলেও ওর হয়ে আসল কাজটা করতেন অজয় রায়। উনি কতটা ট্যালেন্টেড ছিলেন তা আমি জানি। তাই জেনেশুনে কেন আমি ওই স্কাউন্ড্রেলটাকে নিয়ে কাজ করতে যাব, যেখানে অজয়বাবুকে দিয়ে কম টাকায় ভালো প্রোডাক্ট পেয়ে যাব? দেখুন মি. সেন, আমি টাকা ঢালি, ছবি বানাই। খরচ কম, বেশি ইনকাম। এটাই আমার টার্গেট। কম খরচে ভালো জিনিস পাব, এর থেকে একজন বিজনেসম্যানের কাছে আর কী বেশি হতে পারে? আর এখানেই নন্দী বেঁকে বসেছিল।”
“কিন্তু উনি তো বলছিলেন আগের ছবিতে কাজ করে উনি আপনার থেকে পুরো টাকা পাননি?”
“বলেছে?” প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন হোমি উল্লা। বললেন, “বলেছে ও এই কথা?”
“তাই তো বললেন উনি।” মাথাটা বার দুয়েক ওপর-নীচ করে বলল অনিদা।
বেশ কিছুক্ষণ চোখের পাতা না ফেলে অনিদার দিকে চেয়ে রইলেন হোমি উল্লা। তারপর বললেন, “হ্যাঁ, দিইনি। ওকে দিইনি। বাকি টাকাটা আমি দিয়েছিলাম অজয়বাবুকে।”
“অজয়বাবুকে!” হোমি উল্লার কথায় আবার চমক। অনিদার কপালের ভাঁজ তখন প্রচণ্ড কড়া। এবার ও বলল, “কিন্তু কেন?”
“কারণ, উনিই ওটা পাওয়ার যোগ্য লোক ছিলেন। তা সেটা পারিশ্রমিকই বলুন, কী উপহার। অবশ্য,” এবার একটা একপেশে হাসি হেসে হোমি উল্লা বললেন, “সে টাকা কতদিন ওঁর কাছে ঠিকঠাক ছিল আমি জানি না।”
“আপনি কি বলতে চান মি. নন্দী ওঁর থেকে টাকাটা নিয়ে নেন?”
“আপনার কী মনে হয়, ওর মতো টাকার পিশাচ অতগুলো টাকা না নিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে?” পালটা প্রশ্নে অনিদাকে তেড়েফুঁড়ে উঠলেন হোমি উল্লা।
এখানে আসা থেকে শুরু করে আমার ভূমিকাটা অনেকটা নীরব দর্শকের মতো। একবার করে অনিদার দিকে তাকাচ্ছি আর একবার করে হোমি উল্লার দিকে।
অনিদা বলল, “আপনি তো ওঁর সঙ্গে কাজের কন্ট্রাক্ট করেছিলেন, তাই টাকাটা তো ওঁরই পাওনা, তাই না?”
“হুম।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হোমি উল্লা বললেন, “তাই তো এবার আমি মি. রায়কেই ডাইরেক্ট প্রপোজ করি। কিন্তু তখন কি বুঝতে পেরেছিলাম যে এর পেছনে এত বড়ো খেলা রয়েছে!”
“খেলা! কীরকম?” অনিদার গলায় অবাক হওয়া ধরা পড়ল।
এ যেন ডিটেকটিভ সিনেমা দেখছি। একটার পর একটা চমক। এবার আরো একটা চমক আমাদের সামনে এল যখন হোমি উল্লা বললেন, “বাসব নন্দী অজয় রায়কে বন্ড সই করিয়ে নিয়েছিলেন যে আগামী দশ বছর উনি আর অন্য কোথাও কাজ করতে পারবেন না।”
“বন্ড!” অস্ফুটে বেরিয়ে এল আমার মুখ থেকে।
“বাসব নন্দী মি. রায়কে দিয়ে বন্ড সই করিয়ে নিয়েছিলেন!” অবাক হয়ে অনিদা বলল, “কিন্তু কেন?”
“তার কারণটা ঠিক জানি না। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম যে একটা প্রতিভা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই আমার তরফ থেকে একবার চেষ্টাও করেছিলাম।”
“কীভাবে?” জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
“নন্দীকে একটা অফিসিয়াল চিঠি লিখেছিলাম। যাতে ও মি. রায়ের সঙ্গে কন্ট্রাক্টটা ক্যান্সেল করে দেয়। কিন্তু শয়তানটা শুনল না। আসলে আমি চেয়েছিলাম মি. রায় যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন। আমি তার জন্য কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবেও দিতে চেয়েছিলাম।”
“তাতে আপনার কী লাভ হত?”
“উনি সুর দিলে ডেফিনিটলি সে গান হিট হত। আমি জানতাম, যে-টাকা আমি ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতাম তার তিনগুণ টাকা উঠে আসত। আমি মেইল করেছিলাম। কিন্তু নন্দী রাজি হল না। এই দেখুন না ও আমাকে মেইলের উত্তরও দিয়েছে।”
হোমি উল্লা আমাদের মেইলটা দেখালেন। দেখলাম বাসব নন্দী সেখানে পরিষ্কারভাবে লিখেছেন—‘বিফোর কপ্লিশন অফ দ্য কন্ট্রাক্ট হি উইল নট বি অ্যালাউড টু ওয়ার্ক উইথ এনি আদার।’ যার মানেটা হল, কন্ট্রাক্ট শেষ না হওয়া পর্যন্ত উনি আর কারো সঙ্গে কাজ করতে পারবেন না।
ইমেইলটা দেখতে দেখতে চোখগুলো চকচক করে উঠল অনিদার। সেটার লেখাটা পড়তে পড়তে চাপা গলায় আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “কিছু বুঝতে পারছিস?”
অনিদা কী বলতে চাইছে সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। বুকের ভেতরে ততক্ষণে ঢিপ ঢিপ শুরু হয়ে গেছে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় আমি বললাম, “সেই একই ফন্ট অনিদা। যে ফন্টে বাসব নন্দীর কাছে হুমকি চিঠি এসেছিল।”
“আর কিছু?” ভীষণ গম্ভীর শোনাল অনিদার গলা।
“হ্যাঁ, আরেকটা জিনিস।”
“কী?”
“সেই লেখাগুলোর মতো এই লেখাতেও প্রতিটা শব্দের প্রথম লেটার ক্যাপিটালে লেখা!”
“কারেক্ট!” বলে অনিদা আমার কাঁধে একটা চাপড় মেরে দিল। এবার ল্যাপটপের ওপর চোখ রেখেই হোমি উল্লাকে জিজ্ঞাসা করল, “অজয় রায়কে কে খুন করল বলে আপনার মনে হয়?”
“সে আমি কী করে বলব? খুনিকে ধরা তো আপনার কাজ, মি. সেন।” বললেন হোমি উল্লা।
আমরা হোমি উল্লার অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। বন্ড আর ইমেইল, ঘটনাকে অন্যদিকে মোড় দিয়ে দিল! অনিদা মনে করছে বন্ড সইয়ের ব্যাপারটা যতটা না গোলমেলে, তার থেকেও বেশি গোলমেলে ইমেইলটা।
“আমাদের এই কেসের পুরো ব্যাপারাটাই কি সাজানো?”
প্রথমে আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর করল না অনিদা। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ও বলল, “ঘটনা সাজানোর মানে কী? এই খুনের সঙ্গে কি এর কোনো সম্পর্ক রয়েছে?” তারপর বিড়বিড় করে বলল, “কিন্তু তাহলে বাসব নন্দীকে খুন করার জন্য লোক পাঠানো হবে কেন? কে পাঠাবে?”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “অজয় রায়?”
“তা কী করে হয়?”
“কেন? হতেই পারে যে ওঁর হাত থেকে মুক্তি পেতেই মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন মি. রায়।”
মাথা নেড়ে অনিদা বলল, “তাহলে লোকগুলো ওঁকেই কেন মেরে দিল? না না। কোথাও একটা গণ্ডগোল!” তারপর মুখ দিয় চুক করে একটা শব্দ করে বলল, “মনে হচ্ছে কেসটা সলভ হতে আরো সময় নেবে।”
কেসটায় আসল অপরাধী কে সেটাই আন্দাজ করতে পারছিলাম না। আমাদের ক্লায়েন্ট নিজেই ফেঁসে আছেন। অজয় রায় খুন হয়ে গেছেন। অনিদা প্রমাণ করেছে যে হোমি উল্লার খুনে কোনো হাত নেই। আর ওর মতে দোষী নয় জীবনদা বা বাবুয়া। তাহলে কালপ্রিট কে? পর্দার আড়ালে কি তবে অন্য কেউ রয়েছে? জানি না।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মাথা গুলিয়ে গেছিল। এবার ঘোর কাটল হাজরা মোড়ে একটা ওষুধের দোকানের সামনে এসে থামতে। ওষুধ কিনে বেরোনোর সময় এবার ডানদিক থেকে একজন অচেনা ভদ্রলোক অনিদার নাম করে ডেকে উঠলেন, “নমস্কার, মি. অনিরুদ্ধ সেন।”
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একজন মাঝবয়সী রোগা লম্বা লোক আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ হবে। গায়ে একটা হাফ হাতা জামা আর জিন্সের প্যান্ট। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
“নমস্কার।” অনিদা লোকটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বলল, “আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।”
লোকটা তখন আমাদের কাছে এগিয়ে এসেছেন। এবার একবার আমার দিকে চেয়ে নিয়ে অনিদাকে বললেন, “আপনি আমাকে চিনবেন না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। আমি জানি অজয়দার কেসটা আপনিই হ্যান্ডেল করছেন।”
ঘটনাতে আমি অবাক হলেও বরাবরের মতোই একেবারে নির্বিকার দেখাল অনিদার মুখ। অচেনা একটা লোক আমাদের এইভাবে রাস্তায় ডেকে কথা বলছেন দেখে এমনিতেই আমি অবাক। আর অবাক হওয়ার পরিমাণটা বাড়ল যখন উনি অনিদাকে বললেন, “আমি আপনাকে এমন কিছু জিনিস জানাতে চাই যা আপনাকে এই কেসে হেল্প করতে পারে।”
লোকটার মুখে আচমকা এ-কথা শুনে আমার মুখ হাঁ। অনিদা কিন্তু শান্ত গলাতেই বলল, “আপনার পরিচয়টা?”
অবশ্য আমি জানি ভেতরে ভেতরে লোকটা কী বলে সেটা শোনার জন্য ও ছটফট করছে।
“আমার নাম শুভেন্দু বোস। বাসব নন্দীর মিউজিক ট্রুপে তবলা বাজাই।” বলে চারদিকে একবার দেখে নিলেন ভদ্রলোক। মনে হল ওঁর অনিদার সঙ্গে কথা বলাটা কেউ দেখে ফেলে সেটা উনি চান না।
অনিদা তখন বলল, “বলুন, কী বলতে চান।”
ভদ্রলোক আবার চারদিকটা দেখে নিয়ে বললেন, “এ জায়গাটা সেফ নয়। বরং অন্য কোথাও চলুন।”
আমরা হাজরা মোড়ে যতীন দাস পার্কে গিয়ে বসলাম। এবার এই ভদ্রলোকের থেকে এমন কিছু তথ্য পাওয়া গেল যা আমাদের থ করে দিল। উনি যা বললেন, তা অনেকটা এই—
“বছর পনেরো আগেকার কথা। সঙ্গীতকার হবার স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে এসেছিলেন অজয় রায়। প্রযোজকদের দরজায় দরজায় ঘুরে বেচারা তখন প্রায় ভেঙে পড়েছেন। শহরে আর কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন না। ঠিক এমন সময় ওঁর সঙ্গে পরিচয় হল বাসব নন্দীর। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রচুর টাকার মালিক হওয়াতে উনি তখন ইন্ডাস্ট্রিকে বলতে গেলে কিনে রেখেছেন। ওদিকে তখন টাকার দরকার অজয়দার। মায়ের অপারেশান করাতে হবে। অনেকগুলো টাকা। কে দেবে? ঠিক এই সময় নোংরা খেলেটা খেললেন বাসব নন্দী। নিজেই এগিয়ে এলেন টাকা দিয়ে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু তার বদলে শর্ত রাখলেন যে অজয় রায়কে কাজ করতে হবে শুধু ওঁর জন্য। আগামী দশ বছর আর উনি কারো হয়ে কাজ করতে পারবেন না। আর এটা ওঁকে মেনে নিতে হবে বন্ড সই করে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বাধ্য হয়ে অজয় রায় মেনে নিলেন বাসব নন্দীর শর্ত। ট্যালেন্টেড ছিলেন। কিন্তু দশ বছর এভাবে এক্সপ্লয়েট হবার পর ট্যালেন্টের যে আর কিছু বেঁচে থাকবে না সে-কথা বাসববাবু যেমন জানতেন, তেমন জানতেন অজয়দাও। চোখের সামনে এমন একটা প্রতিভা শেষ হয়ে যেতে দেখলাম। ওঁর কাজ শ্রোতাদের কান অবধি তো পৌঁছল, কিন্তু উনি চিরটা কালই থেকে গেলেন বাসব নন্দীর আড়ালে। কেউ জানতেও পারল না আসল সত্যিটা!”
এতটা বলে থামলেন মি. বোস। আমি এতক্ষণ হাঁ হয়ে ওঁর কথা শুনছিলাম। অনিদা ওঁকে জিজ্ঞাসা করল, “মি. রায় তো মি. নন্দীর সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। উনি কি গানও গাইতেন?”
“না না, উনি গান গাইতেন না।”
“তাহলে?”
“এত যে এতসব দারুণ দারুণ সুর, এত মেলোডি, চার-চারটে সেরা সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার—এত ট্যালেন্ট বাসব নন্দীর আছে?”
“তাহলে?” বলেই কপাল কুঁচকে গেল অনিদার। আমার মনেও একটা সন্দেহ মনে উঁকি মারছিল। তার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনাও অনুভব করছিলাম।
আমার সন্দেহটা যে সত্যি সেটা এবার প্রমাণ হল মি. বোসের কথা শুনে।
“দিনের পর দিন চোখের জল ফেলতে ফেলতে যে সুরগুলো তৈরি করেছিলেন অজয়দা, যেগুলো নিয়ে উনি গ্রাম থেকে শহরে এসেছিলেন, সেগুলো উনি বাসব নন্দীকে দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।”
“সুর চুরি!” একসঙ্গে অস্ফুটে বলে উঠলাম আমি আর অনিদা।
“চুরি নয়, চুরি নয়,” বার বার মাথা নাড়তে নাড়তে মি. বোস বললেন, “বলুন ডাকাতি।”
“উনি কোনোদিন প্রতিবাদ করেননি?”
“কীসের জোরে প্রতিবাদ করবেন বলুন? প্রথমেই তো বন্ড সাইন করে পা বেঁধে দিয়েছিলেন। তার ওপর এমন প্রভাবশালী লোক। মুখ খুললেই অজয়দার পরিবারকে শেষ করে দেবেন বলে হুমকি দিয়ে ওঁর হাতদুটোও অকেজো করে দিয়েছিলেন বাসববাবু।”
এতদিন যেটাকে ‘ছয়’ বলে মনে হচ্ছিল সেটা যে আসলে ‘নয়’, তা এবার বুঝতে পারলাম। অনিদাও মেনে নিল যে আমাদের এতদিন ইচ্ছে করে উলটোদিকে হাঁটানো হচ্ছিল। এই ভদ্রলোকও বললেন যে এ ব্যাপারে মি. রায়ের সঙ্গে ওঁর কোনোদিন কোনো কথা হয়নি। উনি অজয় রায়ের খুনের ব্যাপারে কিছু জানেন কি না জিজ্ঞাসা করাতে উনি গলা নামিয়ে বললেন যে গত বুধবার নাকি দুজনের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হয়েছিল।
“বুধবার?” বলে কপাল কোঁচকাল অনিদা।
তাতে আমি বললাম, “সেদিনই তো বাসব নন্দীর ওপর প্রথম হামলাটা হয়েছিল!”
“কারেক্ট!” আমার দিকে চেয়ে বলল অনিদা।
মি. বোস এবার জানালেন যে সেদিন মি. রায় নাকি মি. নন্দীকে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। কথাটা শুনে তাজ্জব বনে গেলাম আমরা। অবশ্য মি. বোসের মতে কথাটা নিতান্ত রাগের মাথায় বলেছিলেন অজয়দা।
“আপনি তখন সামনে ছিলেন?” ওঁকে জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
“না না।”
“তাহলে?”
এবার অপরাধীর মতো মুখ নামিয়ে নিয়ে উনি বললেন, “আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে ওঁদের কথা শুনে ফেলেছিলাম।”
এবার বেশ কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল অনিদা। তারপর একদৃষ্টে ওঁর দিকে চেয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল, “এই যে এতগুলো কথা বললেন, তা আপনি প্রমাণ করতে পারবেন?”
“প্রমাণ?” করুণ চোখে তাকালেন ভদ্রলোক।
অনিদা তাতে বলল, “হ্যাঁ। প্রমাণ ছাড়া আমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়।”
“কিন্তু তেমন কিছু তো আমার কাছে নেই!” বলে হতাশ হয়ে মাথা নীচু করলেন ভদ্রলোক। আবার ঝট করে মাথা তুলে ডানহাত দিয়ে বাঁহাতের তালুতে একটা ঘুসি মেরে বললেন, “খাতা!”
“খাতা!” বলে অনিদা একবার আমার দিকে তাকাল।
“হ্যাঁ, খাতা।” চোখদুটো চকচক করে উঠল ওঁর।
“কীসের খাতা?” নড়েচড়ে বসলাম আমরা।
“অজয়দার খাতা। ওটাতেই উনি ওঁর তৈরি করা সুরগুলো লিখে রাখতেন। সেটা আপনাদের হাতে এলেই তো আপনারা প্রমাণ করতে পারবেন যে ওই দুর্দান্ত সুরগুলো আসলে অজয়দার।”
“কিন্তু কোথায় পাব সেটা?” জিজ্ঞাসা করল অনিদা। ওর মুখে চোখে তখন উত্তেজনা ধরা পড়ছে।
মি. বোস তখন বললেন, “আমার মনে হয় অজয়দার বাড়িতে গেলেই ওটা আপনারা পেয়ে যাবেন।”
“ধন্যবাদ!” বলে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল অনিদা। বুঝলাম, আমাদের এবারের গন্তব্যস্থল দেশপ্রিয় পার্ক। সেখানে গিয়ে মি. রায়ের বাড়িটা একটু খুঁজতে হবে, এই যা। কারণ, আমরা তখন আন্দাজ করে ফেলেছি যে প্রতিবাদী হওয়ার মাশুল গুনতে হয়েছিল অজয় রায়কে।
(৭)
একজন তাঁর জোয়ান ছেলে হারিয়েছেন আর অন্যজন দাদা। মা আর মেয়ের কান্না দেখে মন এমনিতেই ভার হয়ে গেছিল আমাদের। আমরা বাসব নন্দীর বিরুদ্ধে অনেক কিছুই শুনব বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু উলটে ওঁদের মুখে মি. নন্দীর গুণগানই শোনা গেল। বুঝতে পারলাম, প্রফেশনাল লাইফে যা-ই হোক, তা পরিবারের কাছে গোপনই রেখেছিলেন মি. রায়।
আমরা অজয় রায়ের বসার ঘরে বসে। এমন সময় জানালায় নজর পড়তে দেখি একটা মাথা সট করে সরে গেল। বুঝতে পারলাম এখানেও আমরা স্ক্যানিং-এ রয়েছি। আমি সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি একটা বাচ্চা ছেলে। আমাকে দেখেই ছুট লাগাল ছেলেটা। আমিও সঙ্গে সঙ্গে ওর পেছনে পেছনে ছুটতে শুরু করলাম। বেশ কিছুটা রাস্তা তেড়েমেড়ে দৌড়লেও আমার সঙ্গে বেশিক্ষণ পারল না বাচ্চাটা। অল্পতেই কাবু করে ফেললাম ওকে।
ছেলেটা লোকাল। ওর পেট থেকে কথা বের করতে বেশি বেগ পেতে হল না আমাদের। বলল, আমাদের এখানে আসার পর একটা লোক সাদা গাড়িতে করে এসে ওকে দুটো দুশো টাকার নোট দিয়ে বলে যে আমাদের ওপর নজর রাখতে। আমরা কী কথা বলি, কী কী করি—সব তাকে জানাতে। এবার অনিদা ওকে সেই লোকটার চেহারা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে ও যেমনটা বলল, সেটা অনেকটা বাসব নন্দীর সঙ্গে মেলে!
অনিদার চোখদুটো তখন অজয় রায়ের বাড়িতে ক্যামেরার মতো ঘুরে চলেছে। দোতলার উত্তরদিকের ঘরটাতেই সময় কাটাতেন অজয় রায়। ওঁর বোনকে অনুরোধ করতে উনি ঘরটা খুলে দিলেন।
ঘরে ঢুকে অনিদা ডাইনে বাঁয়ে দেখে বলল, “এটাই তাহলে মি. রায়ের স্টাডি কাম মিউজিক রুম?”
ঘরটা একেবারে ঝকঝকে না হলেও বইপত্র যা আছে তা মনে হয় না বাসব নন্দীর থেকে কম। এঁর ঘরেও নানান বাদ্যযন্ত্র রয়েছে। তাছাড়াও এদিক সেদিক ছড়িয়ে বহু কাগজপত্র। সেগুলোর প্রায় প্রতিটাতেই স্বরলিপি লেখা। মি. রায়ের বোন সেগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, “এগুলো দিয়ে আর কী হবে! মানুষটাই তো…” কথা শেষ করতে পারলেন না উনি।
জিনিসপত্রগুলো দেখতে দেখতে এবার আমাদের চোখ আটকে গেল ঘরের ডান কোণে। একটা হারমোনিয়াম আর তবলা। আর ওই হারমোনিয়ামের ওপরেই রাখা রয়েছে মোটা একটা খাতা! সেটা হাতে নিতেই বুঝতে পারলাম, যার জন্য আমরা এখানে এসেছি সে-জিনিস পেয়ে গেছি। এবার খাতাটার দুয়েকটা পাতায় চোখ বোলাতেই সব কিছু জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। বোঝা গেল এই খাতাটার কথাই মি. বোস বলছিলেন। প্রচুর গানের স্বরলিপি লেখা রয়েছে এতে। যার অনেকগুলো গান হয়ে বাজারে রীতিমতো জনপ্রিয়তা লাভ করে লোকের মুখে মুখে ঘুরেছে।
এবার অনিদা তার মধ্যে দুটো পাতা আলাদা আলাদা করে আমাকে দেখাল। ওগুলোতে যে গানগুলো ছিল, সেগুলোর জন্য বাসব নন্দী দু-বার সেরা মিউজিক ডাইরেক্টরের পুরস্কার পেয়েছেন! আর তার মধ্যে দু-নম্বরটা হোমি উল্লার ছবির জন্য করা। এমন প্রতিভার এই পরিণতি! সত্যিই খারাপ লাগছিল আমার।
এবার রাজাদার ফোন এল। বলল, আমাদের পিছু নেওয়া সেই বাইক আরোহী ধরা পড়েছে। সে স্বীকার করেছে যে সে আর তার দলবলই অজয় রায়কে খুন করেছে। আর তার জন্য ওরা বাসব নন্দীর থেকে প্রচুর টাকা পেয়েছে।
আমরা অজয় রায়ের বাড়িতে আর সময় খরচ করলাম না। পরিকল্পনামাফিক রাজাদাকে ফোন করে অজয় রায়ের বাড়ি থেকে আমরা সোজা পৌঁছলাম বাসব নন্দীর বাড়ি।
প্রথমটায় জীবনদা আমাদের বাসব নন্দীর সঙ্গে দেখা করতে দিতে রাজি হচ্ছিল না। কারণ, অজয় রায়ের মৃত্যুর পর থেকেই নাকি মি. নন্দী বিছানা নিয়েছেন। তাই বাসব নন্দীর শোবার ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে আমাদের জোর খাটাতে হল।
চোখে মুখে অসুস্থতার ছাপ। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথার চুলও উসকোখুসকো। বুক অবধি চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে ছিলেন মি. নন্দী। আমাদের দেখে অতিকষ্টে বললেন, “আসুন, আসুন, মি. সেন।”
আমার মনে হল যে আমরা যে ওঁর মুখোশের তলায় থাকা আসল চেহারাটা দেখে ফেলেছি সেটা উনি জানেন। কিন্তু তবু অভিনয় করছেন।
“বসতে তো আমরা আসিনি মি. নন্দী।” খুব কড়া গলায় বলল অনিদার।
তখন অতিকষ্টে উঠে বিছানায় বসে উনি বললেন, “তাহলে বলুন, কী বলবেন।”
“আমি আর কী বলব? বলবেন তো আপনি।” খুব হালকা একটা একপেশে কঠিন হাসি হেসে বলল অনিদা। ততক্ষণে জীবনদা এ ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে।
“দেখুন, আমি এখন বেশি কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।” খুব ধীরে ধীরে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কথাগুলো বললেন মি. নন্দী। ওঁর কথায় সায় দিতে গেল জীবনদা। বলল, “দেখুন, ওঁর শরীরটা…”
“আপনি চুপ করুন!” অনিদার ধমকে চুপ মেরে গেলে জীবনদা। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে মি. নন্দীকে বলল, “যে কাজের জন্য আমাকে অতগুলো টাকা দিতে রাজি হয়েছিলেন, জানতে ইচ্ছে করছে না সেই কাজটায় কতদূর এগোলাম?”
“আপনি কি অজয়ের খুনিকে ধরে ফেলেছেন?” একইভাবে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বললেন মি. নন্দী।
অনিদা কোনো কথা না বলে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ওঁর দিকে। উনি এবার চেঁচিয়ে উঠলেন। “কে? কে খুন করেছে অজয়কে?”
আমি মনে মনে ভাবছি, বেশ অভিনয় পারেন বটে মানুষটা।
এবার আমার মনের কথাটাই বলে ফেলল অনিদা। “আপনি যে মিউজিক ডাইরেক্টর, সে-কথা এতদিন জানতাম। কিন্তু এত ভালো অভিনয় করেন সেটা তো জানা ছিল না!”
“অভিনয়!” উত্তেজিত হয়ে বললেন মি. নন্দী। “কী বলতে চাইছেন আপনি, মি. সেন?”
অনিদা সেটাকে পাত্তা না দিয়ে বলল, “খুনির নামটা আগে শুনবেন, নাকি তার কীর্তিগুলোর কথা আগে বলব?”
কিছু না বলে চুপ করে এবার অনিদার দিকে চেয়ে রইলেন মি. নন্দী। অনিদা তখন বলল, “আচ্ছা, শুনুন তবে।
“ঘটনার সূত্রপাত হয় সুর তৈরি করা থেকে। একেকটা সুর তৈরি করে গেছেন অজয় রায় আর সেগুলোকে নিজের নামে চালিয়ে গেছেন আপনি, মি. বাসব নন্দী।”
“আমি!”
“হ্যাঁ মি. নন্দী, আপনি।”
“কী যা তা বলছেন? অজয় আবার কবে থেকে সুর তৈরি করা শুরু করল? ও নানারকমের বাজনা বাজাতে জানত সেটা ঠিক, কিন্তু…”
“সেটা তো আপনিই ভালো করে জানেন, তাই না? আর ওঁকে চুপ করে থাকতেও বাধ্য করেন আপনি। বন্ড সই করিয়ে আর মুখ খুললেই তার পরিবারকে খুন করে দেবার ভয় দেখিয়ে।”
“বন্ড!” যেন আকাশ থেকে পড়লেন মি. নন্দী।
“কেন? দশ বছরের কন্ট্রাক্ট ভুলে গেছেন? আপনারই তো বানানো। আমি উকিল বীরেশ্বর ভদ্রর সঙ্গে কথা বলেছি। যথেষ্ট প্রমাণ আমার হাতে আছে মি. নন্দী।” বলে স্টাম্প পেপারের একটা কপি তুলে দিল মি. নন্দীর হাতে।
এবার চুপ করে থেকে মি. নন্দী বললেন, “হ্যাঁ, ছোট্ট একটা কন্ট্রাক্ট করতে হয়েছিল সেটা ঠিক। কিন্তু নেহাতই কাজের খাতিরে।”
“হ্যাঁ, তা হবে হয়তো। সেটা আপনার আর ওঁর ব্যাপার। আইনত সে ব্যাপারে বাইরের কেউ কিছু বলতে পারে না। কিন্তু বন্দুকের নল দেখিয়ে একের পর এক গান চুরি করে নেওয়া? সেটাও কি দরকার ছিল, মি. নন্দী?”
এবার তেতে উঠলেন মি. নন্দী। বললেন, “এবার কিন্তু আপনি আমাকে অপমান করছেন মি. সেন। আমার প্রতিভারও অপমান করছেন আপনি।”
তাতে হুহ্ করে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে অনিদা বলল, “অপমান? তাও আবার প্রতিভার? যেটা কোনো কালেই আপনার ছিল না! আর সেটা যার ছিল সে সেটা দাবি করে বসাতে আপনি বুঝতে পারলেন যে আপনার সিংহাসন টলে যেতে বসেছে। মানসম্মান সব এবার ধুলোয় লুটিয়ে যাবার জোগাড়! তাই ছকে ফেললেন একটা চিত্রনাট্য। হুমকি পাওয়ার নাটক করে সহানুভূতি কুড়োলেন। জিনিসটাকে আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তুললেন নিজের ওপর হামলা করিয়ে।”
হামলা করানোর কথাটা শুনে ফোঁস করে উঠলেন মি. নন্দী। বললেন, “আমি আর একটু হলে সেদিন মারাই যাচ্ছিলাম, আর আপনি বলছেন সেটা আমি নিজে করিয়েছি!”
“তা না হলে পরের দিন মি. রায়কে খুনটা করা যেত না যে! সেদিন প্ল্যান করে মি. রায়কে তাড়াতাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। আর সুযোগ পেয়ে আপনার লোকেরা ওঁকে মাঝ-রাস্তায় খুন করল। আপনার শেখানো বুলিগুলোও আপনার পোষা চারপেয়েগুলো বেশ গুছিয়েই বলল যাতে সেই কথাগুলো আপনার ড্রাইভারের মারফত পুলিসের কানে পৌঁছায়। উদ্দেশ্য, পুলিশকে বিশ্বাস করানো যে আসলে ওরা বাসব নন্দীকেই খুন করতে এসেছিল। কিন্তু মিস হিট টাইপের কিছু একটা হয়ে গেছে। আর হলও তাই। পুলিশ আপনার সাজানো চিত্রনাট্যই সত্যি বলে মনে করল। ব্যস, পথের কাঁটাও সরে গেল আর পুলিশের ফুল প্রোটেকশনও পাওয়া গেল।”
“আপনি এমন অযোগ্য জানলে আমি আর যাই হোক এ-কাজে আপনাকে অন্তত অ্যাপয়েন্ট করতাম না মি. সেন।” একদৃষ্টে অনিদার দিকে চেয়ে থেকে বললেন মি. নন্দী।
তাতে হেসে অনিদা বলল, “ঠিকই বলেছেন। ভাড়াটে গুন্ডাগুলোর মতোই ভাড়াটে গোয়েন্দা জোগাড় করা উচিত ছিল আপনার, যে আপনার কথায় উঠত আর বসত। আপনি যে আমায় এ-কাজ দিয়ে ভুল করেছেন সেটা বুঝতে পেরেছিলেন পুলিশ স্টেশনে আমার সঙ্গে আপনার ড্রাইভারের কথা শুনে। আমি এবার আসল অপরাধীর নাগাল পেয়ে যাব বুঝে গেছিলেন আপনি। তাই আমাকে ভুল পথে চালানোর জন্য জয়ের পকেটে কাগজ পাকিয়ে ঢুকিয়ে দিল আপনারই লোক। আর তার পরদিন থেকেই আমার পেছনে দিলেন লোক লাগিয়ে। আমার মনে কিন্তু তার মধ্যেই সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে। এবার সেটা আরো পোক্ত হল হোমি উল্লার সঙ্গে কথা বলে আর ওঁকে পাঠানো আপনার ইমেইলের লেখাটা দেখে। লেখার ফন্ট আর তার ধরন দেখে বুঝতে পারলাম এই নাটকের পেছনে রয়েছে আপনারই হাত। আর শেষে আমার বিশ্বাস আরো জোরালো হল অজয় রায়ের গানের খাতাটা দেখে।”
“এই ঘটনাটা আপনি প্রমাণ করতে পারবেন?” আচমকা লক্ষ করলাম বাসব নন্দীর গলা কঠোর হয়ে উঠেছে। শরীরে আর অসুস্থতার চিহ্নমাত্র নেই।
তাতে হো হো করে হেসে উঠে অনিদা বলল, “ইমেইলগুলো আমার কাছে আছে মি. নন্দী। আর তাছাড়া আপনি জানলে খুশি হবেন যে আপনার ওই চারপেয়ে পোষ্যগুলো এখন পুলিশের হেফাজতে।”
মি. নন্দী তখন কটমটিয়ে চেয়ে রয়েছেন অনিদার দিকে। অনিদা এবার ওঁকে অবাক করে দিয়ে বলল, “আরো আছে মি. নন্দী। সারপ্রাইজ প্যাকেজ। মি. বোস।”
“বোস!” রাগে বাসব নন্দীর চোখের মণিগুলো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল।
তাতে হেসে অনিদা বলল, “কেন? ভুলে যাচ্ছেন নাকি ওঁকে? আপনার, থুড়ি, অজয় রায়ের তৈরি সুরগুলোতে তবলার যে বোলগুলো ব্যবহার হয়েছিল, সেগুলো তো ওঁরই আঙুল থেকে বেরিয়েছিল, তাই না?”
অনিদার কথা শেষ হতে না হতেই এবার ঘরের মধ্যে একটা ছোটোখাটো নাটক হয়ে গেল। বিছানায় বসে থাকা অবস্থা থেকে আচমকা ঝট করে উঠে দাড়ালেন মি. নন্দী। সঙ্গে সঙ্গে ডানহাতে আমাকে বেড় দিয়ে ধরে ঘরের কোণে রাখা আলমারিটার পাশে উড়ে গিয়ে পড়ল অনিদা। আর ঠিক তখনই কান ফাটানো শব্দ করে গুলি বেরিয়ে এল বাসব নন্দীর পিস্তল থেকে। মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় মাথা তুলতে চোখে পড়ল পিস্তল ধরা বাসব নন্দীর ডানহাতটা। এবার এলোপাথাড়ি গুলি-বৃষ্টি শুরু হল আমাদের লক্ষ্য করে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের লুকিয়ে নিলাম পাশের ঘরে। বাঁচার জন্য তখন মরিয়া হয়ে উঠেছেন মি. নন্দী। শেষে গুলি ফুরিয়ে যাওয়াতে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেন উনি। আমরাও দৌড়লাম ওঁর পেছনে।
দরজা দিয়ে বেরোতেই আবিষ্কার করলাম একটা সিঁড়ি। কিন্তু প্রচণ্ড গতিতে থাকার জন্য টাল না সামলাতে পেরে পা হড়কে গেল আমাদের দুজনেরই। চিত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে গিয়ে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে নেমে এলাম নীচে। জায়গাটাতে কোনো আলো নেই। এবার ঘাড় ঘুরিয়ে ওপরদিকে তাকাতেই দেখলাম ধড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল ওপরের দরজাটা! সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারে ডুবে গেলাম আমরা। এক হাতের মধ্যে থাকা অনিদাকেও দেখতে পাচ্ছিলাম না। এবার মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে নিজেদের আবিষ্কার করলাম মেরেকেটে একটা চার ফুট বাই সাত ফুটের ঘরে। এটার উচ্চতাও ফুট আটেকের বেশি নয়। বইতে পড়েছি, এইধরনের ঘরকে বলে চোরকুঠুরি। এ-বাড়িতে বাসব নন্দীর চোরকুঠুরির কী দরকার পড়ে জানি না।
আলোটা এদিক সেদিক ঘোরাতে এবার একটা দরজা চোখে পড়ল। একটা আশার আলো দেখতে পেলাম বটে, কিন্তু সেটা সঙ্গে সঙ্গেই নিভল। কারণ, দরজাটা এমনভাবে ঠেসে আটকে ছিল যে আমি বা অনিদা সেটাকে একচুলও নাড়াতে পারলাম না। আসলে ওটা এতটাই পুরু যে দেখে মনে হল আমাদের মতো কুড়ি জনও ওটাকে এই অবস্থায় একবিন্দু নাড়াতে পারবে না।
“এটা দিয়েই লোকটা পালিয়েছে।” দরজাটা দেখতে দেখতে বলল অনিদা।
আমি তখন জিজ্ঞাসা করলাম, “কিন্তু এবার এখান থেকে বেরোব কী করে?”
আমার এবার বুক ঢিপঢিপ করতে শুরু করল।
“আমরা এখানে কতক্ষণ এভাবে আটকে থাকব অনিদা?” আবার জিজ্ঞাসা করলাম অনিদাকে।
তাতে অনিদা বলল, “অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই রে জয়। মোবাইল নেটওয়ার্কও একেবারেই ডাউন।”
আমি এবার মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, “হ্যালো! কেউ আছেন?”
কিন্তু আমার গলা আমার কাছেই ফিরে এল।
একে তো এই ছোটো ঘর, দুজনে গায়ে গা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় মোবাইলের টর্চটাও গেল নিভে। সেটা আর অনও হচ্ছিল না। বুঝলাম ব্যাটারি শেষ! অনিদার মোবাইল আগেই চুপ মেরে গেছে। একেই বলে দুঃসময়। একসঙ্গে দুটো মোবাইলই গেল! গরমে ঘামছি কুল কুল করে। তার ওপর এই অন্ধকার। মনে হচ্ছে শ্বাসটাও আটকে যাবে এবার।
অনিদা এবার আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “ভয় পাস না। অপেক্ষা কর।”
আমি তখন মনে জোর এনে বললাম, “না না, ঠিক আছে।”
বুক ঢিপঢিপ করছে। নিজেদের নিঃশ্বাস নিজেরাই শুনতে পাচ্ছি। জায়গাটাতে একেবারে পিন পড়া নিস্তব্ধতা। ঘুটঘুটে এই অন্ধকারে এভাবে কাটল আরো বেশ কিছুক্ষণ। এবার কানে এল হড়াৎ করে একটা আওয়াজ। আর সঙ্গে সঙ্গে তীব্র বেগে একটা আলো এসে পড়ল আমাদের মুখের ওপর। এবার রাজাদার গলা পেয়ে বুঝলাম আমরা ছাড়া পেয়ে গেছি। জানতে পারলাম, পালাবার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন বাসব নন্দী।
এরপর কেটে গেছে বেশ কয়েকমাস। আমাদের এই মামলাটা নিয়ে কাগজেও বেশ লেখালেখি হয়েছে। টিভি চ্যানেলগুলোও বিভিন্নভাবে প্রচার করেছে। এই কেসের সবথেকে বড়ো পাওনা হল যে তারপর থেকে আমাদের মুখগুলোও মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এরপর এক সন্ধ্যাবেলা আমি আর অনিদা ওদের ব্যালকনিতে বসে আছি। এমন সময় এফ.এমে একটা বাংলা গান শুরুর আগে মিউজিক ডাইরেক্টর হিসেবে নাম ঘোষণা করা হল অজয় রায়ের। গানটা শুনতে শুনতে অনিদা বলল, “নিজের তৈরি সুরের জালে নিজেই যে এভাবে জড়িয়ে পড়বেন তা মনে হয় অজয় রায় কোনোদিনই কল্পনা করতে পারেননি।”
আমি তখন অনিদাকে একটা প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা অনিদা, মি. নন্দীর উদ্দেশ্য তো ছিল মি. রায়কে রাস্তা থেকে সরানো। তাহলে উনি তো সেটা এমনিতেই করতে পারতেন। তোমাকে কেন এই কেসের ভার দিলেন?”
তাতে হেসে অনিদা বলল, “বুঝিসনি? আসলে আমরা হলাম আইনের লোক। তাই এমন একজনকে হাতের সামনে রেখে ওঁর ওপর হামলার ব্যাপারটা যদি প্রমাণ করা যায় তাহলেই তো কেল্লাফতে। কারণ, উনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন খুনি আসলে ওঁকেই খুন করতে চেয়েছিল, কিন্তু ভুল করে মি. রায়কে খুন করে ফেলেছে। এই করে ধড়িবাজটা পুলিশ প্রোটেকশনও পেয়ে গেল আর পথের কাঁটাও দূর হয়ে গেল। কিন্তু কথায় বলে না, ক্রাইম নেভার পে’জ!”
অলঙ্করণ-শিমূল সরকার
KHUB BHALO GOLPO TA…
LikeLike