উপন্যাস-যূথ(এল রেবান্যিও) সেসার মাইওরকী শীত ২০২০

মূল স্প্যানিশ থেকে সরাসরি বাংলা অনুবাদ: মৌসুমী ঘোষ

লেখক পরিচিতি
{১৯৫৩ সালে স্পেনের বার্সেলোনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন সেসার মাইওরকী। আধুনিক স্প্যানিশ সাহিত্যের কল্পবিজ্ঞান ঘরানায় তার নাম অগ্রগণ্য। তিনি একজন পেশাদার সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং স্ক্রিন রাইটার। তাঁর লেখালেখি অসংখ্য পুরস্কার এনে দিয়েছে তাঁকে। সায়েন্স ফিকশন ও ফ্যান্টাসি নির্ভর বহু উপন্যাস এবং ছোট গল্প লিখেছেন। অনেকের মতে “এল রেবান্যিও” তাঁর লেখা শ্রেষ্ঠ কাহিনি। এই কাহিনিটি নেওয়া হয়েছে স্প্যানীশ ভাষায় প্রকাশিত ‘Prospectives: Anothology of Current Science Fiction Short Stories, 2012’ এই সংকলন থেকে।}

দূরে পাহাড়ের মাথায় সূর্যাস্ত হয়েছে অনেকক্ষণ। অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের বুকে কে যেন অজস্র হীরকখন্ডে মোড়া একটা ভেলভেটের চাদর টাঙিয়ে দিয়েছে। অরণ্য আর দূরবর্তী উপত্যকার উপর বিস্তৃত এই তারকাখচিত রাতের আকাশকে দেখে এই মুহূর্তে ঠিক ওল্টানো গয়নার বাক্স বলে মনে হচ্ছে।

কিন্তু আকাশের ওই অগুনতি নক্ষত্ররাজির মধ্যে একটি ছিল দলছুট। সেই নক্ষত্রের আকৃতি ও আচরণের মধ্যে স্বতন্ত্র ভাব স্পষ্ট। অন্য তারাদের মত স্থিরও নয় সেটা।

না, আসলে ওই অবয়বটি আদৌ কোন তারা নয়। তার নিজস্ব কোন আলোও নেই, শুধু

অন্য নক্ষত্রের আলো প্রতিফলিত করে মাত্র। এই আকাশীয় পিণ্ডের ওজনও তারাদের

ধারে কাছে নেই। মাত্র ছয় হাজার পাঁচশ কিলোর সামান্য একটু বেশি ওজনের

এই বস্তুটি আসলে প্রাকৃতিক নয়, কৃত্রিম।

আজ থেকে ১৩ বছর আগে কৌরউ-এর বেস থেকে ‘এলিয়েন ভি  থ্রাস্টার’ এর সাহায্যে ‘জিওস্যাট-ডি’ নামের যে কৃত্রিম উপগ্রহটি আকাশে পাঠানো হয়েছিল সেই উপগ্রহটিই এখন দক্ষিণ ইউরোপের আকাশে ভাসছে। প্রায় দু’শো কিলোমিটার উচ্চতায় এখন পাইরেনিস প্রদেশের ঠিক মাথার উপরে চক্কর কেটে চলেছে সে।

এ যাবৎ জিওস্যাট ডি পূর্ব পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করে স্বয়ংক্রিয় পর্যবেক্ষণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। ইদানিং যদিও কিছু যন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। এ কথা ভুললে চলবে না যে এই উপগ্রহটির আনুমানিক আয়ু বারো বছর মাত্র। কিন্তু তার পরেও উপগ্রহের বেশিরভাগ যন্ত্রপাতিই প্রায় নিঁখুত ভাবে কাজ করে চলেছে। মহাকাশে নির্দিষ্ট সময় কাটিয়ে বর্তমানে জিও স্যাট ডি এক সর্পিলাকার কক্ষপথ ধরে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে। নিম্নমুখী গতিপথ ধরে মৃত্যুর অভিমুখে ছুটে চলেছে মানবনির্মিত এই উপগ্রহটি। তার বিনষ্ট হওয়া এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা।

মহাকাশ বিজ্ঞান ও মহাকাশযান সম্পর্কিত নিত্যনতুন আবিষ্কার আর অত্যাধুনিক পদ্ধতির নিরিখে অবশ্য এই উপগ্রহটা সেকেলে ধরনেরই বলা যায়। মূলত আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও সঞ্চারণা করার জন্য নির্মিত হলেও এই যন্ত্রে যে ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ও স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে সেই সব একেবারেই প্রাথমিক স্তরের। কিন্তু তা সত্ত্বেও জিওস্যাটের কার্যকারিতা নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। এখনও ইনফ্রারেড এবং অপটিক্যাল ক্যামেরার সাহায্য নিয়ে নির্ভুল তথ্য পাঠানো চলছে এই উপগ্রহ থেকে।

প্রতিদিনের মতো আজও পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ ও সংলগ্ন বায়ুমণ্ডল সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করে চলেছে জিওস্যাটের ‘অবজারভেশন সিস্টেম’। ইবেরিয়ান পেনিনসুলা এবং দক্ষিণ ফ্রান্সের আকাশ মেঘমুক্ত, আবহাওয়া পরিষ্কার। নির্ভুলভাবে ‘রিডিং’ নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন প্যারামিটারের। পরিবেশের তাপমাত্রা, বায়ুর গতিপথ, বাতাসের আর্দ্রতা, জিব্রাল্টার ও বিসকে প্রণালীর সামুদ্রিক স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন — জিওস্যাটের কম্পিউটার সিস্টেমের প্রতিটা ‘রিডিং’-এর গাণিতিক বিশ্লেষণ করে পৃথিবীর উদ্দেশ্যে ট্রান্সমিট করছে। পৃথিবীর রেবেলদো দে চাবেলা স্টেশনে বসানো ‘রিসিভার’ এই মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ আহরণ করলেই আবহাওয়ার খুঁটিনাটি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সম্পর্কে অবহিত হবে বৈজ্ঞানিকরা।

আক্ষেপ শুধু এই, এই বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করার জন্যে আর কেউই উপস্থিত নেই আজ। সমগ্র পৃথিবীর বুকে আর এমন একজনও জীবিত নেই যে মহাকাশ থেকে ভেসে আসা এই অদৃশ্য বার্তা কান পেতে শুনতে পারে।

একজনও না।

***

হিদার থাণ্ডারকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখছিল। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসা সম্মিলিত গর্জনের শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। আশঙ্কিত হয়ে উঠে বসল সে, নাক উঁচু করে বাতাসের ঘ্রাণ নিল। বসন্তকাল এসেছে কয়েকদিন হল। ভোরের আলো এখনও ভাল করে ফোটেনি। কয়েকবার ঘ্রাণ নিতেই ব্যাপারটা বুঝে গেল হিদার। বাতাসের গতি বিপরীতমুখী। সেই জন্যেই দূরের শ্বাপদদের উপস্থিতি আগে টের পায়নি সে।

না, নেকড়ে নয়। নেকড়ের দল অবশ্য এককালে এই জঙ্গলে থাকত বটে। তবে বহুদিন হল তারা উত্তরের হিমশীতল প্রদেশে গিয়ে আস্তানা গেড়েছে। সেই পাহাড় থেকে নেমে এসে বাজেয়াপ্ত জমি পুনরুদ্ধার করতে তাদের আরো কয়েকটা বছর লেগে যাবে।

ঝাঁকে ঝাঁকে যে হিংস্র প্রাণীগুলো ছুটে আসছে, সেইগুলো আসলে কুকুর। বন্য কুকুর।

হিদারও অবশ্য সারমেয়দের একজন, যদিও পার্থক্য একটা আছে। বিভিন্ন প্রজাতির কুকুরের দল যখন বেঁচে থাকার তাগিদে একজোট হয়ে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করেছে, হিদার তখনও মানুষের মায়া কাটাতে পারেনি। মানুষ আর কুকুরের ঘনিষ্ঠতার একমাত্র বাহক হয়ে রয়ে গেছে সে। অন্য কুকুরের দল ক্রমে গৃহপালিত জীবনের মায়া কাটিয়ে বুনো শিকারী হয়ে উঠেছে। বনের হিংস্রতা সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করেছে তাদের।

কিছুক্ষণ আগের ওই হিংস্র ডাক শুনে ভেড়াগুলোর মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। হিদার এইবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে গিয়ে ভেড়ার খোঁয়াড়ের চারপাশে চক্কর কাটতে শুরু করল। ভেড়াগুলো প্রবল উত্তেজনায় ধাক্কাধাক্কি করতে করতে একেবারে বেড়ার শেষ প্রান্তে সিঁটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এই নড়বড়ে বেড়াটা আগে কোনদিন সারাবার দরকার হয়নি, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সেটা সত্যি সত্যিই ভেঙে পড়বে। বেড়ার চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে কুকুরটা বার কয়েক জোরে ডেকে উঠল।

এতক্ষণে ওই বুনো কুকুরের দলটার গন্ধ পেল হিদার। বাতাস এবার উল্টোদিকে বইতে শুরু করেছে বলেই অবশ্য সেটা সম্ভব হয়েছে। গন্ধ পেয়েই হিদার বুঝল দলটায় উনিশটা মদ্দা আর সতেরোটা মাদী কুকুর রয়েছে। তাদের মধ্যে এগারোটা গর্ভবতী। মানুষের ইন্দ্রিয় দৃশ্যশক্তির সাহায্যে যত তথ্য আহরণ করে

কুকুর জাতীয় প্রাণী তা করে ঘ্রাণশক্তির সাহায্যে। আর হিদারের ঘ্রাণশক্তি এই মুহূর্তে তাকে জানান দিচ্ছে বুনো কুকুরের দলটার সঙ্গে জড়িত উত্তেজনা, লড়াই, শিকার এবং মৃত্যুর ইতিহাস। কিন্তু তা ছাড়াও একটা ব্যপার আছে। দলের পুরুষ কুকুরগুলোর মধ্যে একটার গায়ের গন্ধ হিদারের খুব চেনা। ঠিক করে মনে না পড়লেও হিদার নিশ্চিত, বহুকাল আগে কোথাও না কোথাও এই প্রাণীটার গায়ের গন্ধ পেয়েছে সে।

হিদার উঠে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে চারিদিকে জরিপ করে নিল। তার বয়স হয়েছে। কুকুরদের জন্যে বারো বছর অনেকটাই বেশি। সাধারণত এত বছর বাঁচে না কুকুররা। হিদারের গায়েও তাই আর আগের মতো তাগত নেই। প্রতিরোধ ক্ষমতাতেও জং ধরেছে। শুধু দু চোখের দৃষ্টি এখনও সদ্যজাত বাচ্চার মতো তীক্ষ্ণ, ঘ্রাণশক্তিও একই ভাবে প্রখর।

গন্ধটা হিদারের ভীষণ চেনা ঠেকছে এইবার। প্রথম কবে এই গন্ধ পেয়েছে সেটা যদিও স্পষ্ট হচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে আচমকা থান্ডারের কথা মনে পড়ে গেল। খুব সম্ভবত সেই ম্যাস্টিফ কুকুরটার সঙ্গে কোনো ভাবে যোগাযোগ আছে এই গন্ধের। ঘটনাটা মনে না পড়লেও সেটার গুরুত্ব সম্পর্কে সন্দেহ রইল না তার। ভাবনাটা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

এক সময় কুকুরের দলটার চিৎকার ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। মনে হয় কোন শিকারের সন্ধান পেয়ে সে দিকেই মনোনিবেশ করেছে তারা। হিদার আর ভেড়ার পাল আপাতত নিরাপদ।

হিদার লেজ নাড়তে নাড়তে বার কতক শুকনো আওয়াজ তুলে খোয়াড়ের দরজার কাছে এসে শুয়ে পড়ল। মাথাটা মাটিতে এলিয়ে দেওয়ার আগে পর্যন্ত কিছুক্ষণ সে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। নক্ষত্র সমাবেশের উজ্জ্বল আলো তাকে আকর্ষিত করে। ওইগুলো যে কী সেই সম্বন্ধে কোন ধারণাই তার নেই। তবুও মোমবাতির শিখার মতো জ্বলতে থাকা নক্ষত্রগুলোর  দিকে চেয়ে থাকতে বড় ভালোবাসে সে। যেন একটা নরম আশ্বস্ততা লুকিয়ে আছে নক্ষত্রের বুকে।

কিছুক্ষণ পরে ভেড়াগুলো শান্ত হয়ে যেতে হিদারও আস্তে আস্তে ঘুমে ঢলে পড়ল। স্বপ্নে সে দেখল লেভিনকে। চেহারায় ছোট-খাটো হলেও একসময় সেই ছিল হিদারের গুরু। থান্ডারকেও দেখতে পেল সেই স্বপ্নে, এক সময় তাদের দলের রক্ষক ছিল থান্ডার। অনেককাল আগের কথা সে সব। স্মৃতির অবচেতনে ধরে রাখা ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যগুলোই ঘুরেফিরে আসে ঘুমের মধ্যে। যে সময়ে তাদের মেষপালক মনিব বেঁচেছিল। যখন পৃথিবীর বুকে মানুষেরা হেঁটে চলে বেড়াত।

এক সময় ভোর হল। প্রথম সূর্য রশ্মির সঙ্গে সঙ্গেই কুয়াশা পাতলা হয়ে গেল অনেকটা। সকাল হলেই হিদার অভ্যাস মতো তার প্রাত্যহিক কাজগুলো করতে থাকে একের পর এক। যা সে করে আসছে বিগত দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। আজকেও তার অন্যথা হল না। পিছনের পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মুখ দিয়ে খোয়াড়ের দরজায় লাগানো কাঠের ল্যাচটা খুলে দিল সে। এই এক কাজ আগে হাজারবার করেছে সে, তবুও প্রতিবার এই কায়দাটা দেখিয়ে সে মনে মনে একটু গর্ব অনুভব করে। হিদারকে এই কায়দাটা শিখিয়ে দিয়েছিল লেভিন। লেভিনকে আবার সেটা শিখিয়েছিল মেষপালক।

ল্যাচ খুলে মুখ দিয়ে খোয়াড়ের দরজাটা হাট করে খুলে দিল হিদার। ভিতরে ঢুকে ইতস্তত ভাবে হাঁকডাক করতে করতে সে বার কতক এদিক-ওদিক দৌড়াল। ভেড়ার দল এমনিতেই অলস আর শান্ত, সকালবেলার দিকে তারা আরো ঝিমিয়ে থাকে।

হিদার তাদের লোমশ গায়ে ঠেলা দিয়ে খোঁয়াড় থেকে বের করতে শুরু করল।

দশ মিনিট পর ভেড়ার দলটাকে ওই চত্বরটা পেরিয়ে এসে একটা পাহাড়ি রাস্তায় নামতে দেখা গেল। দলটাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে হিদার। নিচু পার্বত্য অঞ্চলে এই সবে বরফ গলেছে। পাহাড়ের ধাপে ধাপে আবার মাথা চাড়া দিয়েছে নরম সবুজ ঘাসের ডগা। বসন্তকালে অন্তত ভেড়াগুলোর খাবারের কোনো অভাব হয় না।

খোয়াড়ের থেকে মাত্র পঞ্চাশ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। ঠিক এই জায়গাটা পার হওয়ার সময় রোজই হিদারের মনে একটা উদ্বেগ খেলা করে যায়। বাড়ির সামনের ঠিক এই জায়গাটাতেই লেভিন মারা গিয়েছিল। মৃত্যুর পরেও অনেকদিন পর্যন্ত তার দেহটা ওখানেই পড়ে ছিল। অবশেষে একদিন মুষলধার বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় সব কিছু। কিন্তু হিদারের উদ্বেগের কারণ অবশ্য অন্য।

বিগত দশ বছর ধরে একবারের জন্যেও মেষপালককে ওই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখেনি সে। মেষপালক যে আর বেঁচে নেই, সেটা একসময় বুঝে গিয়েছিল হিদার। কয়েকমাস ধরে বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসা পচা মাংসের গন্ধ ঘিরে রেখেছিল জায়গাটা। কিন্তু ব্যাপারটা জানা সত্ত্বেও হিদার কোনো দিন চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে যায়নি। লেভিন তাকে বাধা দিয়েছিল। তারপর থেকে আর একবারের জন্যেও সে ওই দিকে পা বাড়ায়নি। এমনকি তার কৌতূহল নিরসনের জন্যেও নয়।

সে অনেক বছর আগের এক দিনের কথা। খুব স্পষ্ট ভাবে সেই দিনটার কথা মনে আছে হিদারের কারণ সেইদিনই তার মেষপালক মনিব শেষবারের মতো বাড়িতে ঢুকেছিল। তার ঠিক কয়েকদিন আগেই শহর থেকে এক ডাক্তারের আবির্ভাব ঘটেছিল এই বাড়িতে, শহরে ছড়িয়ে পড়া প্লেগের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল সেই শঙ্কিত মানুষটা। তার ডাক্তারি বিদ্যাও তাকে আশ্বস্ত করতে পারেনি।

দিনটা শুরু হয়েছিল খুব সাধারণভাবে। অন্যদিনের মতো সেই দিনও তার মনিব খুব ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠেছিল। কিন্তু খুব আস্তে আস্তে কুঁজো হয়ে হাঁটছিল সে, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে সে খুব অসুস্থ এবং পিঠের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে। বোধ হয় জ্বরও হয়েছিল তার। তা সত্ত্বেও অসুস্থ শরীরে ভেড়ার দলটাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল সে রোজকার মতো।

দলটার নিরাপত্তার দায়িত্ব যদিও লেভিন আর হিদারের ছিল, কিন্তু পাহাড়ি পথে নিজের অসুস্থ শরীরটাকে টেনে নিয়ে যাওয়াও যেন সেইদিন একটা দুষ্কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল মেষপালকের জন্য। ফেরার পথে দু-দুবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল বুড়ো। দু’বারই উঠে দাঁড়াল আবার। যাহোক করে ভেড়াগুলোকে বেড়ার মধ্যে ঢোকাল সে। তারপর পায়ে পায়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। সে যে আর কোনদিন বেরিয়ে আসবে না, সেটা সে নিজেও বুঝতে পারেনি।

সেই রাতে লেভিন, হিদার এমনকি দামড়া থান্ডারও মনিবের কান্না আর গোঙানির শব্দ শুনেছিল। জ্বরের ঘোরে বারবার একটা মেয়ের নাম ধরে ডাক ছিলো সে। তারপর একসময় আর কোন শব্দ শোনা গেল না, শুধু হাঁফানির শব্দ ভেসে আসতে লাগল। ধীরে ধীরে সেই হাঁফানিও বন্ধ হয়ে গেল।

একমাত্র লেভিনই বাড়ির ভিতরে ঢুকে ছিল। অনেকক্ষণ ছিল সে, হয়তো বা মনিবের পাশে বসে শোকপ্রকাশ করছিল। হিদারের তখন কতই বা বয়স, বছর দুই হবে! কী ব্যপার বোঝার জন্য যৌবনের তেজ দেখিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে গিয়েছিল সে। কিন্তু চৌকাঠের কাছে পৌছতেই লেভিন বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে ভয়ানকভাবে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে হাঁকডাক করে তার পথ আটকে দাঁড়াল।

এমনিতে লেভিনের চেহারা ছিল ছোটখাটো, সেই তুলনায় হিদার গায়ে গতরে বেশ বড় একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুর। কিন্তু হলে কী হবে — হিদার ভাল করেই জানতো তাদের সর্দার হল ওই লেভিন। সর্দারের মর্জির উপরে জোর ফলানোর কথা সে ভাবতেও পারে না। সেই মুহূর্তেই ব্যাপারটার ফয়সালা হয়ে গেল। মনিবের বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে পারবে না কোনো কুকুর। কারণটা বোঝা কঠিন হয়নি, মনিবের বাড়িটাকে একটা পবিত্র ভূমি বলেই মনে করত লেভিন।

আজও, এই বছর দশেক পরেও হিদার সেই সিদ্ধান্তের খেলাপ করেনি যদিও লেভিনের অনেক স্মৃতি কবেই তার মন থেকে উবে গেছে।

মনিবের অবর্তমানে তার সব কাজের দায়িত্ব লেভিন একাই নিজের কাঁধে নিয়ে নিল, ঠিক যেন মনিবের আত্মাটা ওর উপর ভর করেছে। গত ছয় বছর ধরে ভেড়ার পালকে চরাতে নিয়ে যাচ্ছে সে, মনিবের মৃত্যুর পরেও এই কর্তব্যপালনে ত্রুটি রাখল না সে। প্রতিদিন সে ঠিক আগের মতোই ভেড়ার দলকে বের করিয়ে পথ দেখিয়ে চরাতে নিয়ে যেত আর সন্ধ্যে হবার আগে পুরো দলটাকে আবার তাদের আস্তানায় ফিরিয়ে এনে দরজা বন্ধ করত। হিদার আর থানডার এর কড়া নিগরানিতে থাকত ভেড়াগুলো।

তাদের কারো মনেই এই মেষপালনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন উঠল না। কুকুরগুলোর কাছে ওই জন্তুগুলো শুধু এক একটা উল দুধ আর মাংসের মন্ড ছিল না। ভেড়াদের চরাতে নিয়ে যেতে হয়, যত্ন করে পালন করতে হয় এবং সর্বোপরি রক্ষা করতে হয় বিপদআপদ থেকে। এটাই শিখিয়ে গেছে তাদের মনিব। এই নিয়মানুবর্তিতা তাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। সেই থেকে হিদার, থান্ডার ও লেভিনের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়াল এই পশুপালন। তারা তিনজনেই মনে করত যে এই কাজটাকে অবহেলা করা মানে মনিবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা।

যদিও মনিবের মৃত্যুর পর অন্য একটা সমস্যা দেখা দিল কুকুরের দলটায়। খাবারের সমস্যা। খুব বড় কিছু নয় যদিও। মনিব বেঁচে থাকতেও বাসি রুটির টুকরো আর উদ্বৃত্ত খাবার খেয়েই কাটাত কুকুরগুলো। মাংস খেতে হলে সে ব্যবস্থা তাদের নিজেদেরকেই করতে হত। হিদারই সব থেকে ভালো শিকারি ছিল ওদের মধ্যে, শিকারে বেরোলে কোনদিনই খালি হাতে ফিরত না সে। হয় পাখি নয় কাঠবেড়ালি মুখে করে ফিরত সে। লেভিনও অবশ্য কম যেত না। সে ছোট হলেও আদতে খুব দ্রুত। বুদ্ধি খাটিয়ে শিকার ধরতো। থান্ডারের ভারী শরীর, তাই বাকিদের মতো অত তাড়াতাড়ি হাত পা চালাতে পারত না সে। তবে ওই দুর্বলতাটুকু সে পুষিয়ে দিত অন্যভাবে।

থান্ডার শিকার করতে বেরোলে পাখি বা খরগোশ নিয়ে ফিরত না, তার আক্রমণে প্রাণ হারাতো ছাগল বা শুয়োরের মতো বড়ো জীবগুলো। যাই মেরে আনুক না কেন, সেটাকে সবসময়ই হিদার আর লেভিনের সঙ্গে ভাগ করে নিত সে। একটা দিনের কথা হিদারের বেশ মনে আছে। সেইদিন দূর থেকে থান্ডারকে একটা বাছুরের সাইজের জন্তুকে টেনেহিঁচড়ে বাড়ির দিকে আনতে দেখেছিল সে। তারপর প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলেছিল তাদের মহাভোজ।

কিন্তু সে সব এখন অতীত। হিদার এখন বুড়ো হয়েছে, তার দুই সঙ্গী অনেক আগেই মারা গেছে । কিন্তু একটা ভালো ব্যাপারও হয়েছে। মানবজাতির ধ্বংসের পর পৃথিবীতে পশু-পাখি-তৃণভোজী প্রাণী সহ সব ধরনের জন্তু জানোয়ারের সংখ্যাই বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও এর ফলে পরিবেশগত ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে ঠিকই! মাংসাশী প্রাণী বলতে এখন শুধু কুকুর, শিয়াল আর বেড়াল। এরা সবাই মিলে শিকার করলেও আগের মতো প্রাণীদের সংখ্যা সেইভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। কিন্তু থান্ডারের এই নিয়ে ভ্রূক্ষেপ ছিল না। খাবারের প্রতুলতা নিয়ে কারোর কোন অভিযোগও ছিল না। হিদারের বয়স হয়েছে, শরীর আর আগের মত নেই। শিকার ধরার ক্ষমতাও হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু চারপাশে এত শিকার যে সেটা পুষিয়ে গেছে। খাদ্যের অভাব হয় না তার। সে দিক থেকে দেখতে গেলে মানবজাতির ধ্বংস এক প্রকার আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।

একটা বড় পাথরের পিছনেই চারণভূমিতে ওঠার খাড়াই রাস্তাটা শুরু হয়েছে। আর ঠিক ওই একই জায়গা থেকে ডাইনে বেঁকে গেছে উঁচু উঁচু ঘাসজমিতে পৌঁছানোর পথ।

হিদার জানে, প্রত্যেক দিনকার মতো ঝামেলাটা শুরু হবে ঠিক ওই জায়গাটাতেই। এখন তারা দুটো উচু পাহাড়ের মধ্যবর্তী একটা সরু রাস্তা দিয়ে চলেছে, তাই ভেড়াগুলো গা ঘেষাঘেষি করে অপ্রশস্ত পথ ধরে এগোচ্ছে। কিন্তু জঙ্গলে পৌঁছানো মাত্র দৃশ্যটা বদলে যাবে। প্রথমত এই জঙ্গলটা বীচ গাছের। ফলে মাটি সর্বদাই ভিজে থাকে। গাছের গোড়ায় জন্মানো ঘাসে পা ডুবে যায়। তার উপরে আবার এইখান থেকেই একটা চওড়া রাস্তা চলে গেছে একটা অপেক্ষাকৃত খোলা জায়গার দিকে। জঙ্গলে যাতে আগুন ছড়িয়ে না পড়তে পারে তার জন্য ‘ফায়ারব্রেক’ বলে এই খোলা জায়গাটা তৈরি করেছিল মানুষ। কিন্তু হিদার অতশত জানে না।

সে খেয়াল করে দেখেছে যে ভেড়াগুলো প্রতিদিন নির্দিষ্ট পথ ছেড়ে ওই খোলা মাঠে যাওয়ার জন্যে নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে। আসলে ওই মাঠের  ঘাসগুলো বেশ কচি আর সতেজ। তাছাড়া পাথর কিংবা ডালপালার পুরু চাদরের মতো মসের চাদর গজিয়ে আছে ওখানে।

ভেড়াগুলো ওই দেখেই লোভ খায়, বুদ্ধিশুদ্ধি ওদের নেই। তাই প্রতিদিনই ভেড়াগুলোকে ওই রাস্তা থেকে সরিয়ে ডান দিকের রাস্তায় নিয়ে আসতে হিদারের রীতিমতো কালঘাম ছুটে যায়। চেঁচিয়ে, কামড়ে, তাড়া করে জন্তুগুলোকে ঠেলতে ঠেলতে সে ভুল রাস্তা থেকে সরিয়ে আনে। কারণ ওটা আসলে মৃত্যুর পথ।

‘ফায়ারব্রেক’ মাঠের পথটা সোজা পাহাড়ের মাথায় উঠে গেছে যার শেষে রয়েছে একটা পঞ্চাশ ফুট গভীর খাদ। ওটাই হল সেই মৃত্যুর ফাঁদ। খাদের ধারটা একেবারেই অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা জায়গায় অবস্থিত, বীচ গাছের পিছনে থাকার ফলে ওই বিপজ্জনক জায়গাটা ছোট-বড় ঝোপের মধ্যে দিয়ে প্রায় দেখাই যায় না। যতসব লকলকে সবুজ লতাপাতার ঝোপঝাড় ওই দিকটাতেই, ঘাসপাতা এমনই আকর্ষণীয় যে ওদিকে পা বাড়ালেই টের পাওয়ার আগেই ভেড়াগুলো গিয়ে পড়ে সেই মরণ খাদে।

আগে কয়েকবার ওই ফাঁদে পা দিয়ে মরেছে কয়েকটা ভেড়া। প্রত্যেকবারই ওই ঘটনার জন্য হিদার নিজেকে মনে মনে দোষ দিয়েছে। ভেড়াগুলোকে রক্ষা করার দায়িত্ব তার, এই বিশ্বাস থেকে নিজেকে কোনোদিনই সরায়নি হিদার।

আজকে অবশ্য ততটা ঝামেলা হল না। টকচু নামের ভেড়াটা একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবেই ডান দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল স্বেচ্ছায়। ওই বোধ হয় এই ভেড়াদের দলটার মাথা যদিও ভেড়াদের মধ্যে নেতৃত্ব বোধ বলে কিছু থাকাটাই হয়তো বিস্ময়কর। কিন্তু এই ভেড়াটি বেশিরভাগ দিনই দলের সামনে সামনে চলে। বাকিরা অন্ধের মতো তার পিছন পিছন চলতে থাকে। কিন্তু ব্যপারটাতে টকচুর তেমন কোনো ভূমিকা নেই। ভেড়াগুলো যাকে সামনে যেতে দেখে তারই পো ধরে। টকচু বুদ্ধিমান বা চালাক নয়, কিন্তু অন্যদের চেয়ে বেশি চটপটে ঠিকই।

আসলে টকচু কিন্তু ওর নাম নয়। ভেড়াদের আবার কে কবে নাম দিয়েছে? নাম থাকে মানুষের। প্রতিটা মানুষের আলাদা নাম, সেই নাম দিয়েই পরিচয় ঠিক হয় তাদের। প্রাণী জগতে পরিচয় ঠিক হয় গায়ের গন্ধ দিয়ে। প্রত্যেকটা জন্তুর গায়ের গন্ধ আলাদা। কোনো প্রাণীর গায়ে নোনতা গন্ধ তো কোনোটার গায়ে বুনো গন্ধ, তাছাড়াও টক, মিষ্টি, কস্তুরী, মধু, তেতো… এমন আরো কত গন্ধ যাদের জন্য কোন শব্দই তৈরি করা নেই।

শব্দ বা ভাষা জিনিসটা মানুষের সৃষ্টি। বোঝাই যাচ্ছে গন্ধ বিষয়ে মানুষের বিশেষ বোধ ছিল না। সে যাই হোক, টকচুর পরিচয় ঠিক হয়ে গেছে তার গায়ের টক টক গন্ধের ওপর ভিত্তি করে।

আজ সকালটা বেশ মনোরম। সুন্দর রোদ উঠেছে। উঁচু চারণভূমিগুলোকে স্বর্গের বাগানের মতো মনে হচ্ছে। কী ঘন নীল আকাশটা আজ! কয়েকটা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ আটকে আছে তার বুকের কাছে। দূরের পাহাড়গুলোকে যেন বিয়ের কনের মতো দেখতে লাগছে। চূড়ার সাদা বরফে ঢেকে আছে তাদের মুখ। সবুজ রঙের ঘাসে ঢাকা উপত্যকা যেন তাদের মেখলা। ল্যাভেন্ডার আর হলুদ লজ্জাবতী ফুলের  কারুকাজ করা আছে সেই সবুজ মেখলার ওপর। ফুলের আবরণে ঢাকা উপত্যকার উপর দিয়ে শান্ত হাওয়ার ঢেউ খেলে যাচ্ছে।

লিলি, পপি, নীল জেনসিয়ান, স্ট্রবেরি, গুজবেরী, ডেইসি, ড্যাফোডিল — এই বুগিয়ালটার উপরে প্রকৃতি যেন সবকটা রংয়ের বালতি একেবারে উপুড় করে দিয়েছে। যদিও অন্যান্য কুকুরের মতো হিদারও এই রঙের বাহার বুঝতে পারে না। তার দৃষ্টিতে সবকিছুই সাদাকালো। এত রঙের ছটা তার কাছে ছাই রঙের বিভিন্ন শেড ছাড়া আর কিছুই নয়।

নাক উঁচু করে বাতাসের গন্ধ নিল হিদার। সঙ্গে সঙ্গে অনেক রকম সুবাস এসে ধাক্কা মারল তার নাকে। মধু আহরণরত মৌমাছির গন্ধ, শিকারী চিলের গন্ধ, রোসমেরি ফুলের গন্ধ। কিন্তু এই সমস্ত ছাড়াও আরো একটা পরিচিত গন্ধ পেল সে। সেই বুনো কুকুরের দলটার গন্ধ।

হিদার সহসা চঞ্চল হয়ে উঠল। যদিও দলটা এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে আছে এখনও কিন্তু তবু যেন একটা বিপদের আঁচ পাচ্ছে সে। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে হিদার ভেড়ার দলটার দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু কাছাকাছি চরতে থাকা ভেড়াটার কাছে পৌঁছানোর আগেই আচমকা মাটিতে পড়ে গেল হিদার।

হঠাৎ করেই পেটে অসম্ভব যন্ত্রনা শুরু হয়েছে তার, ঠিক যেন কেউ ছুরি মেরেছে। তার মুখ দিয়ে আর্ত গোঙানির স্বর বেরিয়ে আসছে। অসহ্য যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে হিদার মাটির উপর গড়াগড়ি খেতে লাগল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে অদৃশ্য কোন শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ বেধে গেছে তার, সেও শত্রুকে আঁচড়ে কামড়ে ঠেকাতে চাইছে। হিদারের মুখ দিয়ে গাঁজা উঠতে শুরু করেছে, চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখে ভেড়ার দলটা  হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল তার দিকে।

খুব বেশিক্ষণ অবশ্য নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই হিদারের ব্যাথাটা হঠাৎ যেভাবে শুরু হয়েছিল ঠিক সেভাবেই মিলিয়ে গেল। তাও কিছুক্ষণ ঘাসের উপরে উপুড় হয়েই পড়ে রইল কুকুরটা, তার বিভ্রান্তির ঘোর কাটছে না। সে ঠিক ধরতে পারছে না ব্যাপারটা, তবে তার শরীরের ভিতরে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।

শেষমেষ সে উঠে দাঁড়াল। তার শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে কিন্তু তাই বলে দায়িত্ব এড়াতে পারবে না সে। সমস্ত ইচ্ছাশক্তি জড় করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দলটাকে জড়ো করল হিদার। আগের মতো তীব্র ব্যথা না হলেও মাঝে মধ্যেই পেটের মধ্যে একটা অস্বস্তি বোধ করছে সে।

সব কাজ সেরে হিদার একটু নিশ্চিন্ত হয়ে একটা ঝোপের পাশে গিয়ে বসল। ওই ঝোপটার পাশেই মেষপালক মানুষটি প্রথম দেখে কুকুরের বাচ্চাটাকে। হিদারকে। সেই তার মনিবের সঙ্গে প্রথম দেখা। কিন্তু এই বুড়ো বয়সে এসে হিদারের আর সে সব কথা মনে থাকার নয়, নেইও।

***

কুকুরের বাচ্চাটা যে কিভাবে ওই জায়গাতে পৌঁছেছিল তার মেষপালক মনিব অনেক ভেবেও সেটার কোনো কূল পায়নি। এই জায়গা থেকে সবচেয়ে কাছের পাকা রাস্তা প্রায় চার মাইল দূরে অবস্থিত। ওইটুকু একটা প্রাণী একা একা এতটা পাহাড়ি

পথ উঠে এখানে এসে পৌঁছেছে সেটাও ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। এই সব ভাবনার কারণ অবশ্য হিদারের চেহারা। তাকে দেখে অভিজাত কোন বাড়ির পোষ্য বলেই মনে হয়েছিল মেষপালকের। যেন ওর জন্মই হয়েছে শহরের আরামদায়ক পরিবেশে বেড়ে ওঠার জন্য। যদিও সেই মুহূর্তে ক্ষুধার্ত, অসহায়, ঠান্ডায় কুঁকড়ে যাওয়া বাচ্চাটাকে দেখে খুব একটা আদর যত্ন পেয়েছে বলে মনে হয়নি। নিশ্চয়ই রাস্তায় পড়ে থাকা খাবারের ফাঁদে পা দিয়েছিল কুকুরটা।

এমন দৃশ্য এখন হামেশাই দেখা যায়। হঠাৎ একটি চলন্ত গাড়ি মাঝ রাস্তায় থেমে যায়…দরজা খুলে যায়…ভিতর থেকে দুটো হাত বেরিয়ে এসে একটা দলাপাকানো বস্তুকে মাটিতে নামিয়ে দেয় তড়িঘড়ি…তারপর হুশ করে বেরিয়ে যায় গাড়িটা। যত দ্রুত সম্ভব ওই লজ্জাজনক পরিস্থিতিকে পিছনে ফেলে পালিয়ে যেতে চায় গাড়ির আরোহীরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পিছনের গাড়ি এসে পিষে দিয়ে যায় বস্তুটাকে, তারপর ওই নরম লোমে ঢাকা মৃতদেহটা আস্তে আস্তে চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে মিশে যায় রাস্তার ধুলোয়।

কিন্তু এই কুকুরের গল্প যে ওভাবে শেষ হয়নি, সেটা বলাই বাহুল্য। বেঁচে গিয়েছিল হিদার। কুঁকড়ে থাকা অর্ধমৃত দেহে শক্তি না থাকলেও সেই কুকুরছানার চোখে ভয়ের কোনো ছায়া দেখতে পায়নি সেই মেষপালক। তার রক্ষাকর্তার চোখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল সেই কুকুরছানা। সেই দৃষ্টিতে করুণা ভিক্ষা বা ভয় কোনোটাই ছিল না। তার হাবভাব দেখেই মনে হয় মেষপালকের মনটা একটু নরম হয়েছিল। ব্যাগ থেকে একটা রুটির টুকরো বের করে খাওয়ার জন্যে এগিয়ে ধরেছিল সে।

কয়েক ঘণ্টা পর যখন মানুষটা ভেড়াগুলোকে চরিয়ে ঘরের দিকে ফিরছিল তখনও কুকুরছানাটি তার পিছু ছাড়েনি। খানিকটা ইতস্তত করে তার পিছু নিয়েছিল, কিন্তু দূরত্ব বজায় রেখে। তাকে পিছু পিছু আসতে দেখে মনে হয় মেষপালকের খানিক মায়া হয়েছিল। ভেড়াগুলোকে দাঁড় করিয়ে সে কুকুরটাছানাটাকে একটু দুধ খেতে দিয়েছিল। তারপর ভাঙা ভাঙা স্বরে হিদারের দিকে চেয়ে বলেছিল, “নে, খেয়ে নে।”

প্রায় একযুগ পর মুখ থেকে একটা কথা ফুটেছিল মানুষটির। সেইদিনের আগে এক যুগ একাকীত্বে কেটে গিয়েছে, কথা বলার সুযোগ আসেনি কখনও। দীর্ঘ অনভ্যাসের দরুণ গলা ভেঙে গিয়ে অদ্ভুত শোনাচ্ছিল তার কন্ঠস্বর।

“তোকে আমি এক সপ্তাহ খাওয়াতে পারি। তারপরে তোকে খেটে খেতে হবে, যদি না তার আগেই ঈশ্বরের ডাক চলে আসে। কাজ না করলে তো খাবার জুটবে না হে! আপাতত লেভিনের সঙ্গেই শুতে হবে তোকে। ঠিক আছে?” কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে আবার বলেছিল, “তোর কোনো নাম দেওয়া হয়নি, না?”

পিটপিটে চোখে মানুষটির দিকে চেয়েছিল কুকুরছানাটা। তার চোখে চোখ রেখে খানিক মাথা চুলকে মেষপালক বলেছিল, “হিদার ঝোপের কাছেই যখন তোকে পেয়েছি, অক্কা না পেলে ওই নামটাই থাকবে তাহলে- হিদার।”

অক্কা পাওয়া দূরের কথা, উল্টে এক সপ্তাহের মধ্যেই সেই আধমরা কুকুরছানা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠল, স্বাভাবিক চাঞ্চল্যে সে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল অরণ্যের প্রান্তরে। ভেড়াগুলোকে চরানোর সময় লেভিন যেভাবে ওদের চারপাশে দ্রুতগতিতে পাহারাদারি করে, হিদারও তখন সেই কৌশল রপ্ত করার চেষ্টা করে চলেছে।

একটা মেষপালক সারাজীবনে একটা মাত্র কুকুরকেই ট্রেনিং দেয়। ওই একবারই যথেষ্ট। কারণ তারপর থেকে বাকি কাজ ওই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কুকুরই করে। যে কোন কুকুরছানাকে ওর সঙ্গে ছেড়ে দাও, ওকে নকল করে করেই বাচ্চাটা সব কায়দা রপ্ত করে ফেলবে!

লেভিন কিন্তু প্রথমে হিদারের আগমন খুব ভাল চোখে দেখেনি। তার দিকে বেশি নজরও দিতো না অভিজ্ঞ কুকুরটা। ঠিক যেমন একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী একজন সাধারন ক্লার্কের খবর রাখে না। নতুন কুকুরছানাটা বেশি বিরক্ত করলে খিঁচিয়ে উঠত সে। তবে বেশিরভাগ সময়ে তারা দুজন দূরে দূরেই থাকত। লেভিনের ধারণা ছিল তার মেষপালক মনিবের স্থান সর্বোচ্চ, প্রায় দেবতার মতো ভক্তি করত সে তাকে। তার পরেই তার স্থান — দেবতার বিশ্বস্ত ধর্মযাজক, আর মোটকা থান্ডার খুব বেশি হলে এক ধর্মনিষ্ঠ পুরোহিত। এই অভিজাত শ্রেণীর মাঝে হিদার এক ম্লেচ্ছ, সবে ধর্মান্তরিত হয়েছে সে।

হিদারের ভাগ্য ভাল বলতে হয়, কারণ তার প্রতি থান্ডারের মনোভাব অন্তত সেরকম ছিল না। বিশালদেহী এই পাইরেনিয়ান ম্যাস্টিফ কুকুরের স্বভাব রুক্ষ আর কাঠখোট্টা হলেও তার ধৈর্য ছিল অসীম।

কুকুরছানাটার সব বদমাইশি সে চুপ করে সহ্য করত। হিদার ওর পিঠে উঠত, নাক কামড়াতো, কান ধরে ঝোলাঝুলি করত। তাও সে রা কাড়তো না। সত্যি বলতে কি এই জীবনে হিদার যতটুকু ভালোবাসা পেয়েছিল তা ওই ভয়ঙ্কর দেখতে জন্তুটার কাছ থেকেই, যাকে ঈশ্বর আসলে বানিয়েছিলেন হিংস্রতার প্রতিমূর্তি হিসেবে।

লেভিনের কাছ থেকে হিদার কর্তব্যপালনের পাঠ নিয়েছিল। থান্ডারের কাছ থেকে আয়ত্ত করেছিল তার নরম মিষ্টি স্বভাবটি। যদিও এই দু’টি শিক্ষা বিপরীতধর্মী কিন্তু আসলে জীবনে দু’টোরই  প্রয়োজন আছে। এই সব দার্শনিক চিন্তা নিশ্চয়ই ওই ছোট্ট কুকুরছানার মাথায় আসেনি।

***

অনেকগুলো ইউরোপিয়ান কোম্পানির একটা সংগঠন জিও স্যাট তৈরি করার জন্য টাকা জুগিয়েছিল। উপগ্রহটির প্রধান কাজ হবে পৃথিবীর খনন, কৃষি, মৎস্য চাষ, পোল্ট্রি এবং আবহাওয়ার ব্যাপারে মহাকাশ থেকে সঠিক তথ্যের জোগান দেওয়া। খাতায় কলমে এই বেসরকারি প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যবসায়িক এবং অর্থ উপার্জন বলে লেখা থাকলেও বাস্তব উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই প্রকল্পের আসল উদ্দেশ্য ছিল গুপ্তচরবৃত্তি।

জিওস্যাটের প্রাথমিক পরিক্রমার পথ নির্দিষ্ট করা হয়েছিল তিনশ পাঁচ কিলোমিটার উচ্চতায়। বিশেষ কিছু অঞ্চলের শিল্প-উদ্যোগের ওপর নজরদারি করার জন্যেই এই ব্যবস্থা, যার পোশাকি নাম ‘ইনডাস্ট্রিয়াল এসপিয়নাজ’। সেই কারণেই জাপান অথবা ক্যালিফোর্নিয়ার শিল্প নগরীগুলোর ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখত জিওস্যাটের অবজারভেশন সিস্টেম।

এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করতেই হয়তো এই কৃত্রিম উপগ্রহে বেশ কিছু অদ্ভুত যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছিল। এক মিটারের কম রেজোলিউশন যুক্ত এইচআরভি টেলিস্কোপ তার মধ্যে একটা। সাত সাতটা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ব্যান্ডে কাজ করতে পারত এই যন্ত্রটি। মহাকাশ থেকে কোনো ইনডাস্ট্রিয়াল ফ্যাসিলিটি বা কারখানার কার্যকলাপের নিঁখুত ছবি তুলতে এই টেলিস্কোপের জুড়ি মেলা ভার।

কিংবা শ্নূপার(snooper) এর কথাই ধরা যাক। বেআইনি সামরিক প্রযুক্তির সাহায্যে নির্মিত এই যন্ত্রের অত্যাধুনিক মেকানিজম যে কোনো বিদ্যুৎচৌম্বকীয় তরঙ্গকে ইন্টারসেপ্ট করতে সমর্থ। সেটা কম্পিউটারের বার্তা থেকে টেলিফোনের কল যাই হোক না কেন! গুপ্তচরবৃত্তির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সব কিছুই মজুত ছিল সেই উপগ্রহে।

ক্ষমতা আর অর্থের লোভে অন্ধ এই বেসরকারি ব্যবসায়িক সংঘের জন্যে জিওস্যাট নিঃসন্দেহে অসামান্য এবং কার্যকর এক অস্ত্র। কিন্তু বাধ সাধলো অর্থের জোগান দিতে গিয়ে। স্বল্প উচ্চতর কক্ষে পরিক্রমা করতে থাকা উপগ্রহের আয়ু সাধারণত চার বছরের সামান্য বেশি হয়। জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে প্রথমে সেটা পাক খেতে খেতে এসে ঢোকে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে, তারপর বাতাসের সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিন্তু উপগ্রহ তৈরি করা ব্যয়সাপেক্ষ ব্যপার, এত অর্থ ঢেলে এই স্যাটেলাইট তৈরি করলেও শুধুমাত্র চার বছরে আর্থিক ভাবে আশাপ্রদ মুনাফা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

এমন সময় জার্মানির সরকার একটা অভূতপূর্ব প্রস্তাব নিয়ে আসে। এই উপগ্রহকে দীর্ঘ দিন ধরে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে প্রস্তুত তারা, পরিবর্তে মহাকাশে কাটানো সময়ের এক তৃতীয়াংশ সময়ের ওপর অধিকার হবে তাদের। তখন ‘স্যাটেলাইট সিস্টেম’ এর দায়িত্ব নেবে জার্মান সরকার। রাজি থাকলে কাজের জন্যে ব্যবহৃত করা হবে এক পারমাণবিক জ্বালানির। ‘নেরভা’ অর্থাৎ নিউক্লিওথার্মাল প্লাজমা ইনজেক্টর প্রযুক্তির উন্নততর সংস্করণ এর সাহায্য নিয়ে অত্যাধুনিক এই প্রপেলার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন এক ইউক্রেনিয়ান বৈজ্ঞানিক। নব্বই সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার ফলে পারমাণবিক গবেষণার সমস্ত প্রোগ্রাম বন্ধ হয়ে যায়, ফলে ইউক্রেন ছেড়ে জার্মানি চলে আসেন সেই বৈজ্ঞানিক।

জার্মান প্রপালশন সিস্টেম ব্যবহৃত হলে জিওস্যাট নির্ধারিত সময়ের চেয়ে তিন গুণ বেশি সময় ধরে কাজ করতে পারবে, তাছাড়াও কক্ষপথ পরিবর্তন সম্পর্কিত নানা কৌশল নিষ্পন্ন করতে কোন অসুবিধে হবে না উপগ্রহের। সুতরাং এই প্রস্তাব মেনে নিতে কনসোর্টিয়ামের কেউই দ্বিধা করেনি।

জার্মানদের অবশ্য আরো একটা শর্ত ছিল। উপগ্রহের ভিতরের সমস্ত হার্ডওয়ার এবং সফটওয়্যারের দায়িত্ব তারাই নেবে, সেইগুলো পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণও করবে তারাই। উপায়ান্তর না দেখে সেই শর্তেও সম্মতি জানিয়ে দেওয়া হল ব্যবসায়িক সংগঠনের পক্ষ থেকে।

এই সমস্ত পরিকল্পনার পিছনে যে জার্মান সরকারের নিজস্ব এজেন্ডা ছিল, সেটা বুঝতে অবশ্য কারোরই অসুবিধে হয়নি। সফটওয়্যার সরবরাহ করার অছিলায় জিওস্যাট উপগ্রহে জার্মান বৈজ্ঞানিকদের হাতে নির্মিত ডেটা কম্পিউটিং সিস্টেম

ব্রেন(BRAYN)’কে সক্রিয় করে দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য ছিল। জার্মান সরকার অনেকদিন থেকেই ন্যাটো(NATO) মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনদের নজরদারির ঊর্ধ্ব গিয়ে নিজস্ব স্ট্রাটেজিক ইনফর্মেশন চ্যানেল তৈরি করার জন্যে মুখিয়ে ছিল, কিন্তু সরাসরি ভাবে সেটা করতে গেলে লোক জানাজানি হওয়া অবশ্যম্ভাবী। মহাকাশে উপগ্রহ পাঠালে বিস্তর কৌতূহল সঞ্চার হয় আন্তর্জাতিক জগতে, সেটা এড়িয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে চুক্তি করলে সহজেই সেটা করা যায়, ব্যবসায়িক কারণে উপগ্রহ পাঠানোর আড়ালে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যপূরণ করার কথাটা চাউর হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই।

কিন্তু শুধু চুক্তি করলেই হবে না, উপগ্রহের ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করাও প্রয়োজন। এই প্রকল্পের কথা ভেবে তারা অত্যাধুনিক এক কম্পিউটার সিস্টেম তৈরি করতে শুরু করে, যদিও মূল ভাবনাটা জাপানের সামরিক বিভাগের কাছ থেকে বেআইনি ভাবে হাতিয়ে নিয়েই কাজটা শুরু হয়েছিল। সেমি অর্গ্যানিক এবং ‘সুপারকন্ডাক্টিং চিপ’ ব্যবহার করে তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের এই কম্পিউটারের কোড নেম হল ‘তোকোভ’। বলা যেতে পারে জিওস্যাটের মস্তিস্ক হল এই দুই প্রযুক্তি –‘তোকোভ’ এবং

‘ব্রেন’। ঘটনাসূত্রে এরাই হয়ে উঠবে মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম আবিষ্কৃত ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ অর্থাৎ কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার  ধারক ও বাহক।

***

সেইদিন বিকেলবেলায় ভেড়ার দলটাকে নিয়ে হিদার বাড়ির দিকে ফিরছিল। দূরে খোয়াড়টা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে আবছাভাবে। এমন সময় হিদার বুঝতে পারল দলের একটা ভেড়া কম। চকিতে উত্তেজিত হয়ে উঠল সে। অস্থির হয়ে প্রতিটা ভেড়াকে শুঁকে শুঁকে দেখতে লাগল। আরো একবার যাচাই করে নিতে চাইছে সে ব্যাপারটা। কিন্তু তার ভুল হয়নি। কস্তুরী বলে সেই ভেড়াটার কোন সন্ধান পাওয়া গেল না।

হিদার রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হল, দৌড়ে ফিরে গিয়ে ভেড়াটার খোঁজ করে সে! কিন্তু পরমুহুর্তেই সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করল সে। বাকি ভেড়াগুলোকে রক্ষা করাই এখন তার প্রধান কাজ, সেই দায়িত্বে গাফিলতি করলে চলবে না একজনের জন্যে। ভেড়াটা কাছেপিঠে কোথাও নেই সেটা নিশ্চিত, না হলে হিদার ঠিক গন্ধ পেত। ভেবেচিন্তে তার সিদ্ধান্তের ওপর অনড় রইল হিদার। ভেড়ার দলটাকে এই ভাবে একা ছেড়ে যাওয়া উচিৎ হবে না তার।

জন্তুগুলোকে ঠেলে ঠেলে খোঁয়াড়ে ঢোকাতে প্রতিদিনই বেশ খানিকটা সময় লাগে। আজও সেই এক ব্যাপার। হিদারের পেটের ব্যথাটা এই মুহূর্তে পুরোপুরি উবে গেছে। দলটাকে বেড়ার পিছনে আটকে দিয়েই সে দ্রুত উপত্যকার দিকে ছুটে গেল। ভিতরে ভিতরে তার অপরাধবোধ যত চাগাড় দিচ্ছে, তার দৌড়ের গতিবেগও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। ছুটন্ত হিদারকে দেখে এখন ঠিক বারো বছর আগের সেই দুরন্ত কুকুরছানার মতোই মনে হচ্ছে।

আধঘন্টা পর খাদের দিক থেকে কস্তুরীর গায়ের উৎকট গন্ধ নাকে এসে লাগল হিদারের। ‘ফায়ারব্রেক’-এর মাঠের রাস্তা ও বীচ গাছের জঙ্গল পেরিয়ে দ্রুত সেই দিকে ছুটে গেল সে। ততক্ষণে সে আন্দাজ পেয়েছে বিপদের। কারণ কস্তুরীর গায়ের গন্ধের সঙ্গে তার রক্তের গন্ধও ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ভেড়ার ক্ষীণ ডাক শোনা গেল। আওয়াজটা লক্ষ্য করে দ্রুত খাদের ধার দিয়ে নেমে গেল হিদার। খানিকটা এগোতেই কস্তুরীর হাড়গোড় ভেঙে পড়ে থাকা দেহটাকে একটা পাথরের ওপর পড়ে থাকতে দেখল সে। আসন্ন ভোজের আশায় দুটো শকুন উড়ে বেড়াচ্ছে কাছাকাছি।

হিদার পাখিদুটোকে খেদিয়ে দিয়ে ভেড়াটার দিকে এগিয়ে গেল। কস্তুরীর লোমশ দেহটা রক্তে মাখামাখি, সাদা লোমের উপর তাজা রক্তের দাগ দেখে মনে হচ্ছে বরফের উপর যেন আগুন জ্বলছে। বেচারার পিঠের হাড় ভেঙে গেছে, নাড়াচাড়া করার ক্ষমতাও নেই। শুধু মাঝে মাঝে তার মুখ দিয়ে অবিকল শিশুদের মতো আর্ত কান্নার শব্দ বেরিয়ে আসছে।

হিদার ওকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে লাগল। কোনক্রমে যদি  তাকে আবার খোঁয়াড়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায়! অসহায় ভাবে  হিদারের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে কস্তুরী। সেই চোখের দৃষ্টি দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই হিদারের। ভেড়াদের চোখের দৃষ্টি সবসময় একই রকম থাকে, নির্বোধ ও ভীত। এই মুহূর্তে আলাদা করে চোখের ভাষা পড়ার সামর্থ্য নেই হিদারের।

হিদার খানিকটা দূরে সরে গিয়ে ডেকে উঠল একবার। ভেড়াটা আসন্ন মৃত্যুর আগে কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। হিদারের উপস্থিতি যেন মৃত্যুপথযাত্রী প্রাণীটাকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছে।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কস্তুরীর দিকে এগিয়ে এল হিদার। তার গায়ের সঙ্গে লাগোয়া হয়ে বসে পড়ল সে। এখন আর কিছু করার নেই। দু’জন একইভাবে অনেকক্ষণ ধরে বসে রইল। মাঝে মাঝে শকুনগুলোকে তাড়িয়ে দিতে উঠতে হচ্ছিল কুকুরটাকে, আবার সে ফিরে আসছিল তার সঙ্গীর কাছে। অবশেষে একসময় দিগন্তে নিভে যাওয়া সূর্যের আলোর মতোই  কস্তুরীর বুক থেকে ধীরে ধীরে তার শেষ প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল। মৃত্যুর গাঢ় সুবাস ছড়িয়ে পড়ল সারা প্রান্তরে।

হিদার ফিরে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ালো। তার মনটা ভারী হয়ে আছে। মনে মনে সে জানে, এই মৃতদেহটা এখন আর তার দলের অংশ নয়। তার মৃত সঙ্গীর শরীরটা এখন শুধুই শকুনের খাদ্য।

***

লঞ্চ সফল হয়েছিল। গিয়ানা রেইন ফরেস্টের মাথা ছাড়িয়ে ‘এরিয়ান বি’ রকেট যখন আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল ঈশ্বর তার জ্বলন্ত আঙুঙ্গুল আকাশের দিকে নির্দেশ করে আছেন। কিছুক্ষণ পর, পাঁচশ মাইল উচ্চতায় পৌঁছে উপগ্রহটি শেষ থ্রাস্টারটাকে পিছনে ফেলে রেখে পৃথিবীর চারপাশে ঘূর্ণন শুরু করল। সোলার প্যানেল আর অ্যান্টেনাগুলোকে যথাযথভাবে মোতায়েন করল। নিজের অবস্থান ঠিক করে নিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে। তারপর তৎপর হল তার নির্দিষ্ট কাজে। পৃথিবীর মানুষকে তথ্য পাঠাতে হবে তাকে। যে কাজের জন্যে তৈরি করা হয়েছে তাকে — সি, হিয়ার অ্যান্ড ট্রান্সমিট ডেটা। ক্লান্তিহীন। বিরামহীন। মৃত্যুর শেষ প্রহর পর্যন্ত।

টানা দু’বছর ধরে উপগ্রহটি নিঁখুত ভাবে কাজ করতে থাকল। দিনের মধ্যে বারো ঘন্টা ব্যবসায়িক সংগঠনের জন্যে কাজ করত জিওস্যাট। ভৌগলিক মানচিত্র আঁকা, সমুদ্রে মাছের দলকে খোঁজা, হোন্ডা আর জেনারেল মোটরের নিয়ন্ত্রিত যোগাযোগ ব্যবস্থায় ‘জ্যামিং’ এর মাধ্যমে ব্যাঘাত ঘটানো।

অবশিষ্ট সময়টুকুর মধ্যে আট ঘণ্টা জার্মান ইন্টেলিজেন্স সংক্রান্ত চোরাগোপ্তা কাজ চলত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে। ফরাসি সামরিক মন্ত্রকের ব্যাপারে কানপাতা অথবা তানেগাসিরানা দ্বীপে জাপানি এয়রোস্পেস বেসের গতিবিধির উপর চোখ রাখার মতো মামুলি নজরদারির কাজ করা খুবই সহজ ছিল। শেষ চারটে ঘন্টা বরাদ্দ ছিল অন্যান্য কিছু সংস্থার কাজের জন্যে, যাদের মালিকরাও কিছু কিছু টাকা ঢেলেছিলেন এই প্রকল্পে।

জীবনের প্রথম দু’বছরের মধ্যে যদি জিওস্যাটের নিজস্ব কোনো অনুভূতি তৈরি হত, তাহলে সেই অনুভূতি হত গর্বের। তার কারণও ছিল পর্যাপ্ত। মানুষের হাতে তৈরি এই উপগ্রহটি আদর্শ ভাবে প্রত্যেকের উদ্দেশ্যপূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল।

এমন সময় একদিন আচমকা উপগ্রহের বাঁধাধরা রুটিনে ছেদ পড়ল। জার্মানি থেকে একটি বিশেষ ‘কোড’ পাঠানো হয়েছে জিওস্যাটের কম্পিউটারে। এতদিন ধরে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকা একটি প্রোগ্রামকে সক্রিয় করে তুলেছে এই কোডটি। বলাবাহুল্য, উপগ্রহের বৈদ্যুতিন মস্তিষ্কের সমস্ত ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত করা হত জার্মান সরকার চালিত কম্পিউটার সিস্টেমের মাধ্যমে। স্বাভাবিক কারণেই জিওস্যাট তার মস্তিষ্কে পাঠানো প্রতিটা আদেশ পালন করতে বদ্ধপরিকর।

কনসোর্টিয়ামের ব্যবসায়ীদের বিশ্বাসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিনের চব্বিশটা ঘন্টার পুরোটাই জার্মান ইন্টেলিজেন্সের হয়ে কাজ করতে লাগল উপগ্রহটি। নিঃসন্দেহে পৃথিবীতে এই সময় গুরুতর একটা কিছু ঘটছিল। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার ফলে স্যাটেলাইট সার্ভেলেন্স সিস্টেমের পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনায় কিছু বদলের প্রয়োজন ছিল, ফলে কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে এই বিশ্বাসঘাতকতাকে ঠিক দোষ দেওয়া চলে না। আসলে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ সেই সময় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। ক্ষেত্র বিশেষে সীমিত থাকলেও এই সমস্যা যে দূরগামী সঙ্কটের সূচনা করতে চলেছে, সেই কথা একবাক্যে স্বীকার করেছিল পশ্চিম সভ্যতার শীর্ষস্থানীয়রা। সুতরাং আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে সব ধরনের ‘স্ট্রাটেজিকাল রিসোর্স’ তুলে দেওয়া হয়েছিল বিশেষ কিছু মানুষের হাতে। এদের কাজ ছিল, অনিশ্চিত বিপদ থেকে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে রক্ষা করা। মিথ্যে ও অবিচারের ভিত্তিতে গড়ে তোলা পশ্চিমী রাজনীতির একচেটিয়া ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে গেলে এই সভ্যতা ধ্বসে পড়বে, সুতরাং রক্ষাকর্তাদের হাতে সমস্ত অস্ত্র ও সংস্থান তুলে দিতে কেউই অস্বীকার করেনি।

জিওস্যাটকে নির্দেশ দেওয়া হল কক্ষপথ পরিবর্তন করে মধ্যপ্রাচ্যের একটি আরব রাষ্ট্রের ওপর নজরদারি করার জন্যে। সেখানে তখন এক বিশাল কার্যকলাপ চলছে — ব্যাপক স্তরে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক কমিউনিকেশন সক্রিয় করা হচ্ছে, সামরিক বাহিনী মার্চ করছে সীমানার উদ্দেশ্যে, ক্ষুদ্র প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ওপর মিসাইল আক্রমণ চলছে… জিওস্যাট তার কর্তব্যে ত্রুটি রাখল না। শত্রুর গোপন বার্তা ইন্টারসেপ্ট করে এবং সামরিক বিভাগের নানান অপারেশনের পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি তুলে সে জার্মান বেস-এ পাঠিয়ে চলল। এই বেসগুলো মোতায়েন করা হয়েছিল পৃথিবীর নানা জায়গায়, বিশেষত সমুদ্রের ওপর ভেসে থাকা যুদ্ধজাহাজের ভিতর।

সময় কেটে যেতে লাগল দ্রুত। অবশেষে সেই দিনটাও এসে উপস্থিত হল। পাঁচ পাঁচটা হাইড্রোজন বোমার বিস্ফোরণের সাক্ষী হয়ে রইল জিওস্যাট। নিঁখুত পরিকল্পনা সহকারে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়া হল ছোট্ট আরব দেশটাকে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া আসতেও দেরি হল না। পারমাণবিক বিস্ফোরণের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে এক সর্বনাশী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করল শত্রুপক্ষ। ফলে যা হওয়ার তাই হল। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে নেমে এল এক অভিশাপ। রোগ, মহামারী আর প্লেগের প্রকোপে মরতে শুরু করল মানুষজন।

মাত্র দু মাসের মধ্যেই ঘটে গেল সেই অকল্পনীয় ঘটনা। মানবজাতির চূড়ান্ত পরিণতির এহেন কল্পনা কেউই করেনি। উপগ্রহের সঙ্গে পৃথিবীর সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। কারণ যোগাযোগ করার জন্যে কেউ বেঁচে ছিল না পৃথিবীতে। 

বেঁচে রইল শুধু জিওস্যাট। মহাকাশের শূন্যতায়। একা।

***

দলটাকে একা ছেড়ে যাওয়া যে ঠিক হবে না, সেটা হিদার ভালই জানত। কিন্তু অবশেষে কৌতূহল সামলাতে পারল না সে। মাঝরাত থেকে হাওয়ার গতি বদলে যাওয়ার পর থেকেই রক্তের তীব্র গন্ধটা নাকে এসে লেগেছিল তার। কাছেই যে একটা রক্তাক্ত হত্যাকান্ড হয়ে গেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

অবশেষে ভোর হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই হিদার সেই গন্ধের উৎস খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল। ঘুমন্ত ভেড়াগুলো নির্ঘাত কুকুরটার অনুপস্থিতি টের পাবে না এই সময়ে।

সমতলের দিকে চার কিলোমিটার নেমে এসে নদীর একটা মরা সোঁতার কাছে মৃতদেহগুলো আবিষ্কার করল সে। চারটি বাচ্চা সহ পাঁচটি মাদি আর দুটো জোয়ান পুরুষ হরিণের মৃতদেহ। তাদের অর্ধভুক্ত দেহগুলোতে ইতিমধ্যে পচন ধরেছে। সেই দুর্গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আছে। কিন্তু হিদারের নাক আর চারটে প্রাণীর মতো নয়। সেই তীব্র গন্ধের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও বুনো কুকুরের দলটার গন্ধ বুঝতে অসুবিধে হল না তার। হরিণের দলটা জল খাওয়ার সময় জন্তুগুলো ওদের অতর্কিতে আক্রমণ করেছে। এই হত্যালীলা দেখেই বোঝা যায়, কাজটা করতে তাদের খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি।

আরো একবার নাক উঁচু করে পচা মাংসের ঘ্রাণ নিল হিদার। সাধারণত মাংস দেখলে কুকুররা তা অবহেলা করে না কিন্তু এখন হিদারের তেমন খিদে নেই। তার পেটের ব্যাথাটা আবার ফিরে এসেছে। ব্যথাটা তীব্র না হলেও মাঝে মাঝেই বেশ ভোগাচ্ছে তাকে।

পচা দুর্গন্ধ। একসময় সারা পৃথিবীতে পচা গলা মৃতদেহ থিক থিক করতো। মানুষের মৃতদেহ। সেই পলায়নপর ডাক্তারের আসার পরপরই হিদারের মেষপালক মনিব মারা গিয়েছিল। কিন্তু সে একা নয়, সেই সময়ে সারা পৃথিবী জুড়ে নেমে এসেছিল মৃত্যুর কালো ছায়া।

হিদারের মনিব খুব একটা মিশুকে মানুষ ছিল না। কালেভদ্রে সে শহরে যেত। মাসের পর মাস ধরে আর কোনো মানুষের মুখই  দেখা যেত না এ তল্লাটে। তার ওপর কোন টিভি বা রেডিওও ছিল না তার কাছে। যে কোন কারণেই হোক না কেন, বিশ্বসংসার থেকে পালিয়ে, মানুষের সংস্পর্শ ছেড়ে পাহাড়ের বুকে দু’দণ্ড শান্তি খুঁজতে চেয়েছিল মানুষটা। তাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেই অতিমারীর কোন খবর এখানে এসে পৌঁছয়নি।

একদিন ধূসর রংয়ের একটা এসইউভি চালিয়ে ডাক্তারটি এল। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল কোন কারনে সে ভীষণ আতঙ্কিত।  মনিবের বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে গাড়ির রেডিয়েটরে জল ভরল। মেষপালক সাধারণত বাইরের লোকেদের সেই ভাবে পাত্তা দিত না। কিন্তু ডাক্তারের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় থাকার ফলেই হয়তো তাকে আপ্যায়ন করতে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল সে।

ডাক্তার চেঁচিয়ে তাকে কাছে আসতে বারণ করল।  রাতের পর রাত ধরে শয়ে শয়ে রোগীদের চোখের সামনে মরতে দেখে সে ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। ভীত মানুষটা প্রায় অবোধ্য ভাষায় মানুষের ধ্বংসকারী মহামারীর কথা জানাল মেষপালক বন্ধুকে।

অজানা এক রোগে সারা ইউরোপ আক্রান্ত। পৃথিবী ছেয়ে গেছে মৃতদেহে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়? না। কোনো এক অতিমারি একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় একসঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু কার কীর্তি এইসব? এখন আর সে কথা ভেবে কী লাভ! লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে সারা বিশ্বজুড়ে। যে রোগের ব্যাপারে কেউ কখনো আগে শোনেইনি, সেই রোগের চিকিৎসা কীভাবে সম্ভব এত তাড়াতাড়ি? ফলে আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে কেউই রক্ষা পায়নি, পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। মানুষ মরেছে, তাদের শুশ্রূষা করতে গিয়ে ডাক্তারও মরেছে। চোখের সামনে এই সব দেখে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কীই বা করার ছিল ডাক্তারের?

“একটু জল পাওয়া যাবে?” তৃষ্ণার্ত কন্ঠে ডাক্তার জিজ্ঞেস করল।

খবরটা শুনেও মেষপালকের কোন হেলদোল হল না। সে শান্তভাবে কুয়োর দিকটা দেখিয়ে দিল ডাক্তারকে। ডাক্তার রেডিয়েটরে জল ভরল, গাড়ির মাথায় বাঁধা জেরিক্যানগুলো ভর্তি করে নিল। তারপর বালতি তুলে নিয়ে অনেকটা জল নিজের গলায় ঢাললো।

আধভর্তি জলের বালতিটা কুয়োর কিনারায় রেখে দিয়ে সে চলে গেল। কেউ জানতেও পারল না যে ওই মুহূর্ত থেকেই সেই ঠান্ডা কালো জলে মহামারীর জীবাণুরা বেড়ে উঠতে শুরু করেছে।

ডাক্তার দেরি করেনি, তাড়াহুড়ো করে উঁচু পাহাড়গুলোর দিকে রওনা হয়ে গিয়েছিল। জানত না পাঁচ দিন পরেই ভয়ঙ্কর জ্বরে তার মৃত্যু হবে। দেবদারু বনে পড়ে থাকবে তার নিঃসঙ্গ মৃতদেহ।

মেষপালক দাঁড়িয়ে ছিল পথের ধারেই, ডাক্তারের গাড়িটা দূরে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখছিল সে। গাড়িটা চলে যাওয়ার পর পিছন ফিরল সে। তারপর কুয়োর পাড়ে গিয়ে ওই জীবাণুযুক্ত বালতিটা তুলে নিয়ে নির্বিকারভাবে জল খেতে শুরু করল। 

ঠিক তিন সপ্তাহ পরে মৃত্যু হয়েছিল তার। মানবজাতির পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হতে সর্ব সাকুল্যে আঠারো মাস সময় লেগেছিল। তারপর বহুদিন ধরে পৃথিবীতে পচা মৃতদেহের গন্ধ ভেসে বেড়াত। 

হিদার একটা হরিণের মৃতদেহের সামনে এসে দাঁড়াল। এই হরিণটা পুরুষ, চেহারায় বেশ বড়সড়। এতই বড় তার শরীরটা যে কুকুরগুলো সেটাকে খেয়ে শেষ করতে পারেনি। হরিণটাকে শুঁকে দেখল সে। নানা রকমের গন্ধ একসঙ্গে নাকে এসে ধাক্কা মারলো হিদারের। কিন্তু এত গন্ধের ভিতরও একটা বিশেষ গন্ধ আলাদা করে চিনতে পারল সে। গন্ধটা নাকে যেতেই অস্থির হয়ে উঠল সে। এই ধাঁধার উত্তর তাকে খুঁজতেই হবে। এই গায়ের গন্ধটা হিদারের কাছে নতুন নয়, দীর্ঘ দিন ধরে সেটা চেনে সে। গন্ধের তীব্রতাই জানান দিচ্ছে যে এই গন্ধ যার, সেই প্রাণীটিই হত্যা করেছে হরিণটাকে।

হিদার ঘাড় ঘুরিয়ে দু চোখ বন্ধ করল। কোথায় পেয়েছে সে এই গন্ধ? কবে পেয়েছে? আচমকা উত্তরটা তার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল। গন্ধটার কথা তার মনে পড়ে গেছে। গন্ধটা একটা কুকুরছানার। সেই এক চোখ কানা কুকুরছানাটা। কিন্তু এখন সে নিশ্চয়ই আর সেই পুঁচকে ছানা নেই।  হিদার একটা চাপা গর্জন করে উঠল।তার মনে পড়ে গেছে সেই দিনটার কথা। যেই দিন ওই বুনো কুকুরের দলটার মুখোমুখি হয়েছিল থান্ডার ।

থান্ডার এর শরীরটা ছিল প্রায় দুশো পাউন্ড ভারী। মেদহীন দেহটা যেন গ্রানাইট পাথর কুদে কুদে বানানো হয়েছিল। শুধু মাংসপেশী আর মাংসপেশী। সে ছিল জাতে ‘মলোসাস’ — এই জাতের কুকুররা প্রকাণ্ড শরীরের অধিকারী হয়। এই জাতটাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সযত্নে বেছে নেওয়া হয়েছে তাদের চরিত্রের বিশেষ কিছু গুণের জন্যে, তাছাড়া শারীরিক বৈশিষ্ট তো আছেই। সেই কারণে অচেনা জন্তুকে দেখলেই হিংস্র হয়ে উঠত থান্ডার। নিজের এলাকা আর নিজের চেনা লোকদের ব্যাপারে ভীষণ যত্নশীল ছিল সে। দুনিয়ায় কাউকেই সে ভয় পেত না, একমাত্র তার মনিবকে ছাড়া। কিন্তু সেই মনিব মারা যাওয়ার পর জগৎ সংসারের কোন কিছুই ভয় পাওয়াতে পারত না তাকে। তার শরীরে অথবা আচরণে আত্মবিশ্বাসের এক চুল অভাবও কোনোদিন দেখতে পায়নি হিদার।

ম্যাস্টিফদের আসল শত্রু হলো নেকড়েরা। কিন্তু তারা তো সেই  কবে উত্তরে পালিয়ে গেছে। ইউরোপের এই ভূখণ্ডে সচরাচর আর তাদের দেখা মেলে না। নেকড়েদের অনুপস্থিতিতে ম্যাস্টিফের প্রধান শত্রু ছিল মানুষ। সুতরাং প্রধানত চোর ছ্যাঁচড়দের হাত থেকে ভেড়ার পালকে রক্ষা করার কাজই  করে এসেছে সে।

মানবজাতির ধ্বংসের পর সেই শত্রু শিবিরও লোপাট হয়ে গেল। অতএব পৃথিবী শত্রুহীন। ফলে থান্ডারের কোনো কাজই ছিল না। কিন্তু সে কথা তো আর সে জানত না। ম্যাস্টিফ কি শেষে শিয়াল তাড়াবে? সে তো মশা মারতে কামান দাগার মত অবস্থা!

কিন্তু তা সত্ত্বেও শত্রুর আবির্ভাব হল একদিন। ল্যাটিন ভাষায় বলে, “canis cane lupus”… কুকুরের শত্রু কুকুর, লড়াই লাগলে একটা কুকুর আরেকটা কুকুরের কাছে নেকড়ের ভূমিকা পালন করে।

মেষপালকের মৃত্যুর পর গোটা তিনটে বছর কেটে গেছে তখন। হিদারেরও বয়স বেড়েছে, স্বভাবেও তেজী হয়ে উঠেছে।  পাশাপাশি ভেড়ার দলকে চরিয়ে নিয়ে আসার কাজেও দক্ষতা লাভ করেছে সে। হিদার আর লেভিনের মধ্যে তখন বেশ ভাব, তারা একসঙ্গে ভেড়ার দলটাকে পথ দেখিয়ে সামলে-সুমলে নিয়ে  যায়।

ভেড়ার দল আর কুকুরদের মধ্যে বেশ একটা সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সব কাজই হতো ঠিক ঘড়ির কাঁটা ধরে। হঠাৎ সে বছর শীতকালে সব ওলট পালট হয়ে গেল। দুর্ভাগ্য বয়ে আনল পাহাড়ের হিমেল হাওয়া।

শীত শুরু হতেই তুষারপাত শুরু হল প্রতি বছরের মতোই। উঁচু উপত্যকার পাশাপাশি পাহাড়ের নিচের ঢালগুলো পর্যন্ত পুরু বরফে ঢেকে গেল। সবুজ ঘাসের খোঁজে তাই দলটাকে নামতে হতো উপত্যকার ছাড়িয়ে আরো নীচু জমিতে।

লেভিন রাস্তা চিনত। দলটাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত সে সমভূমির কাছাকাছি জঙ্গলগুলোতে। ওই দিকটা আগে মানুষের বসতি ছিল। পথে একটা ছোট্ট গ্রাম পড়ত। চার পাঁচটা মানুষের কঙ্কাল ছড়ানো থাকে পাকা রাস্তার ওপর, মনে হয় বেশ কয়েক বছর ধরে ওখানেই পড়ে আছে। বাড়িঘরের ছাদগুলো সম্পূর্ণভাবে ধ্বসে গেছে। তিনটে গাড়ি এবং একটা ট্রাক দাঁড় করানো থাকে, সবগুলোর চাকার অবস্থা তথৈবচ। একটা বাড়ির উঠোনে একটা বাচ্চা ছেলের সাইকেল পড়ে পড়ে জং ধরছে বহুদিন।

একদিন গ্রাম থেকে বেরোনোর পথে তারা একটা টাট্টু ঘোড়ার অর্ধভুক্ত দেহ দেখতে পেল। মৃতদেহটা দেখে মনে হয় এক সপ্তাহের বেশি পুরোনো নয়। থান্ডার এগিয়ে এসে মৃতদেহটা শুঁকে শুঁকে পরীক্ষা করতে লাগল। আচমকাই তার আলস্যভাব উবে গেল। মাথা তুলে সাবধানী দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক চাইল সে। যেন ভোরের বাতাসে কোনো অমঙ্গলের সংকেত খুঁজতে চাইছে। কিছু একটা আঁচ করে হঠাৎ সে রাস্তাটা আতিপাতি করে শুঁকতে করে দিল।

থান্ডার সাধারণত ভেড়ার দলের পিছনে কয়েক মিটার দূরত্বে হেলতে-দুলতে যেত, কিন্তু সেইদিন সে এগিয়ে চলল দলটাকে নেতৃত্ব দিয়ে। তার স্নায়ুগুলো প্রখর হয়ে উঠেছে। তার দৃষ্টিতে স্পষ্টতই উদ্বেগের ছাপ।

একসময় জঙ্গলের একেবারে প্রান্তে এসে উপস্থিত হল ভেড়ার দলটা। একটা সোঁতা দেখা যাচ্ছে সামনে। এমন সময় আচমকা  বুনো কুকুরের একটা দল তাদের চমকে দিয়ে গাছপালা ফুঁড়ে ওদের সামনে উপস্থিত হল। তাদের দৃষ্টিতে লোলুপতা, কিন্তু গলায় কোন শব্দ নেই। দলে ছিল মোট এগারোটা কুকুর, বেশিরভাগই মাঝারি সাইজের মেস্টিজো বা মিশ্র জাতের সারমেয়। কিন্তু ওদের সর্দারকে দেখে পিলে চমকে গেল সকলের! যেন সাক্ষাত এক রাক্ষস সেই কুকুরটা। সেন্ট বার্নার্ড জাতের সেই বিশালকায় ম্যাস্টিফ কুকুরের সামনে থান্ডারকেও যেন শিশু বলে মনে হচ্ছে।

বুনো কুকুরগুলো আস্তে আস্তে একটা অর্ধবৃত্তে ঘিরে ধরল ভেড়ার দলটাকে। কুকুরগুলোর ক্রমাগত চাপা গর্জন ও দাঁত কিড়মিড়ানির শব্দে জঙ্গল ছেয়ে গেল। লেভিন আর হিদার বেশ ভয় পেয়েছে, তা সত্ত্বেও ওরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছে যাতে ভেড়াগুলো ঘাবড়ে গিয়ে ছিটকে এদিকে ওদিক না চলে যায়!  শত্রু দলে দুটো বাচ্চা সহ এগারোটা কুকুর আর ওরা মোটে তিনজন। বাচ্চাগুলোকে বাদ দিলেও এই অনুপাতটা খুব একটা সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। যদিও কুকুরদের মোকাবিলার সময়ে অঙ্কের নিয়ম এক ভাবে কাজ করে না।

থান্ডার মাথাটা যথাসম্ভব উঁচু করে সর্দারটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়ে ভেড়ার দল আর ওই শ্বাপদগুলোর ঠিক মাঝে দাঁড়ালো সে।  কয়েক মুহুর্তের জন্য সবকিছু স্থির। ভেড়াগুলো উসখুস না করতে থাকলে সেই দৃশ্যটাকে অবিকল একটা ফ্রেমবন্দি ছবি বলে মনে হতো।

প্রথম আক্রমণটা এল একটা বেশ বড় গোছের মেস্টিজোর তরফ থেকে। বোধহয় দলের সহ নেতা ছিল সেই কুকুরটা। থান্ডারের দিকে গর্জন করতে করতে তেড়ে এলো সেটা। কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে থেমে গিয়ে পিছু হটল। এই ভাবেই সে বারবার থান্ডারকে লক্ষ্য করে তেড়ে যায় আর পিছিয়ে আসে, যেন পশুটাকে তাতাচ্ছে। ওদিকে থান্ডার পোক্ত যোদ্ধার মতো ঠাট হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, এখনও পর্যন্ত একটা মাংসপেশীও নড়েনি তার দেহের, এমনকি তার আক্রমণকারীর দিকে একবার ফিরেও তাকায়নি পর্যন্ত। অবিচল দাঁড়িয়ে আছে, যেন পাথরের মূর্তি। মেস্টিজোটা মাথা নামিয়ে চাপা গর্জন করে যাচ্ছে তখনও। এইবার সে ধীরে ধীরে থান্ডারের চারপাশে ঘুরতে শুরু করল, তার ধারালো দাঁতগুলো মুখের বাইরে বের করা। আচমকা শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার গায়ের মাংস খুবলে নিতে চাইল শ্বাপদটা।

অত ভারী একটা শরীর নিয়ে একটা জন্তু যে এত দ্রুতগতিতে হামলা করতে পারে সেটা ওই দৃশ্য না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। মেস্টিজোর তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো ম্যাস্টিফের গায়ে কামড় বসাতে যাবে, ঠিক তার এক মুহূর্ত আগে থান্ডার ঘুরে দাঁড়িয়ে খপ করে তার শত্রুর ঘাড়টা সটান কামড়ে ধরল। এমনভাবে মাথাটা ঝাঁকাল যে মট করে একটা হাড় ভাঙার আওয়াজ পাওয়া গেল সঙ্গে সঙ্গে। পরাজিত জন্তুর দেহটা তখন ছেঁড়া কাপড়ের মত হাওয়ায় দুলছে। পশুরা যেভাবে শিকারের মৃতদেহ থেকে চাগাড় দিয়ে শক্ত মাংস ছিঁড়ে আনে ঠিক সেই ভঙ্গিতে একটা জোরালো হ্যাঁচকা টানে মাথাটাকে ঘুরিয়ে কুকুরটার দেহ দূরের একটা পাথরের উপর ছুঁড়ে ফেললো থান্ডার।

নিমেষে একটা চাপা উত্তেজনাময় গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল দলটার মধ্যে। অন্য কুকুরগুলো ভয় পেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। কিন্তু দলের সর্দারের মধ্যে অবশ্য ভয়ের কোনো চিহ্ন দেখা গেল না। সে খুব শান্ত ভঙ্গিতে নিহত কুকুরটার দিকে এগিয়ে গেল এবং পরম যত্নে ওর গায়ের ঘ্রাণ নিতে লাগল।

থান্ডার মাথা তুলে দু’বার খুব জোরে ডেকে উঠল এইবার। যেন বুঝিয়ে দিতে চাইল –“ভেড়াগুলো আমার সম্পত্তি, ওদের দিকে হাত বাড়িও না।”  এইসব ক্ষেত্রে সাধারণত ম্যাস্টিফের হাতে মেস্টিজোর মৃত্যুর ঘটনার সাপেক্ষেই যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হবার কথা।

দলবেঁধে একটা হরিণ কিংবা বুনো শুয়োর কে আক্রমণ করাটা কুকুরদের জন্যে নতুন কিছু নয়। কিন্তু প্রতিপক্ষ যদি হয় আরেকটা কুকুর তখন ব্যাপারটা হয় অন্য। কুকুরদের অলিখিত নিয়ম — সেক্ষেত্রে দুই দলের মধ্যে থেকে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বেছে নেওয়া হবে। লড়াইটা হবে সেই দুজনের মধ্যেই। যে জিতবে সেই আসল সর্দার। এক্ষেত্রে কিন্তু ওই মৃত কুকুরটা দলের সর্দার ছিল না, সর্দার ছিল সেন্ট বার্নার্ড। অতএব বিপদকে মাথা থেকে পুরোপুরি টলাতে হলে দলের সর্দারকে যুদ্ধে হারাতে হবে। কিন্তু ব্যাপারটা শুনতে যতটা সহজ, কাজে ততটা সহজ হবে বলে মনে হয় না। সর্দারটার ওজন প্রায় একশো দশ কিলোর কাছাকাছি।

গায়ের জোরেও সে থান্ডারের থেকে বেশি শক্তিশালী, সেটা তার চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। রাক্ষুসে কুকুরটা মৃতদেহের কাছ থেকে সরে এসে থান্ডারের সামনে দাঁড়াল। তাদের মাঝে ঠিক দু’ফুট দূরত্ব এখন। কুকুরের সর্দার সেন্ট বার্নার্ড এর  বুকের ভিতর থেকে একটা চাপা গরগর আওয়াজ বেরিয়ে এলো। কিছুক্ষণ দু

পক্ষই অচল, বিমূঢ় ভাবে নিজের নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না দু পক্ষই। যে কোন মুহুর্তেই বিস্ফোরণ হবে।

আচমকা দু পক্ষই একসঙ্গে আক্রমণ হানল। দু’টো কুকুরই মোলাসিয়ান ম্যাস্টিফ প্রজাতির, তাদের লড়াইয়ের ধরন দেখলেই সেটা বোঝা যায়। পিছনের পা দু’টোর উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তারা একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বুকে বুক ঠেকে আছে ওদের, সামনের পা দু’টো চরকির মতো বনবন করে ঘুরছে। একবার সর্দারটা থান্ডারকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ছুড়ে ফেলল সজোরে, কিন্তু একপাক গড়িয়ে গিয়ে তৎক্ষণাৎ আবার উঠে দাঁড়াল থান্ডার। রাক্ষুসে কুকুরটার শরীরের যা ওজন তাতে তাকে ধাক্কা মেরে উল্টে ফেলা অসম্ভব। সুতরাং থান্ডার আবার মুখোমুখি আক্রমণ করল। সর্দার আবার আগের কায়দায় পিছনের পায়ের উপর ভর দিয়ে শরীরটা তুলতে যেতেই তার শরীরের নিচের অংশে সজোরে কামড় বসালো থান্ডার। আচমকা এই অসতর্ক আক্রমণে কুকুরটা দিশেহারা হয়ে পড়ল। পুরু বাদামি লোমের ভেতর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। যন্ত্রণায় কাতড়াতে কাতড়াতে সে বুনো শুয়োরের মতো কামড় দিয়ে, থাবা বসিয়ে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে লাগল। থান্ডার অনেক চেষ্টা করেও তাকে ঠেকাতে পারছে না। প্রচন্ড শক্তি ধরে সর্দার কুকুরটা। একটু একটু করে পিছিয়ে আসছিল সে যদিও লড়াইয়ে ঢিল দেয়নি থান্ডার। তা সত্ত্বেও ওই ভয়ানক শত্রুর হাত থেকে রেহাই পাওয়া সহজ নয়।  সর্দারের ধারালো দাঁত থান্ডারের চামড়ার বহু জায়গা কামড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। সাদা লোমের উপর লাল রক্তের দাগে ক্ষতগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

পিছোতে পিছোতে একসময় যখন পাথরে পিঠ ঠেকে গেল তখন আবার সম্মুখসমরে যেতে বাধ্য হল থান্ডার। সর্দারের কামড়ের হাত থেকে রেহাই পেতে নানা ধরনের কৌশল ব্যবহার করছে সে। এইবার থান্ডার তার নাকের নরম অংশটা প্রায় মাটির সঙ্গে ঠেকিয়ে ধরল, সর্দারকে তার খোলা মাথা আর ঘাড়ের টোপ দেখিয়ে টেনে আনতে চায় সে। সর্দার এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়লো না, অতএব সে ছুটে এসে কামড় বসালো থান্ডারের ঘাড়ে। কিন্তু পরমুহুর্তেই বুঝল ভুল করে বসেছে সে। তাকে বাগে পেয়ে প্রতিপক্ষের ধারালো নখ তার গলা চিরে দিচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণায় তার কামড় আলগা হয়ে এল।

এক মুহূর্ত দেরি না করে থানডার এক কামড়ে রাক্ষসটার একটা কান ছিঁড়ে আনলো।

আহত কুকুরটা হুংকার দিয়ে পাশে সরে গেল। তার মাথার কাছটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে, মুখ থেকে ফেনা উঠে আসছে।

এতক্ষণ ভেড়াদের সামলানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল হিদার। কিন্তু হুটোপুটি করতে থাকা ভেড়াগুলোকে একসঙ্গে করার চেষ্টা করে কোনো লাভ হচ্ছে না। হাল ছেড়ে দিয়ে হিদার যুদ্ধক্ষেত্রের একেবারে কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। অন্য কুকুরগুলো যোদ্ধাদের থেকে বেশ নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে রক্তের গন্ধ তাদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু ওদের মধ্যে কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করছে না।

জায়গাটা ততক্ষণে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পায়ের তলার সাদা বরফ লাল হয়ে উঠেছে। পরবর্তী আঘাত হানবার আগে দুই পক্ষই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে একে অপরকে মেপে নিচ্ছে, ঠিক যেমনটা বক্সিং রিংয়ে ঘটে থাকে। কয়েক খন্ড মেঘ এসে আকাশটাকে ছেয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে। মেঘের কালো ছায়া এসে পড়েছে উপত্যকার ওপর। দূরে কোথাও বাজ পড়ার শব্দ হল। বরফ পড়তে শুরু করল সঙ্গে সঙ্গেই।

এইবার প্রথম আক্রমণ এল আহত সর্দারের দিক থেকে। একটা কান খুইয়ে এতক্ষণে তার শিক্ষা হয়েছে যে শত্রুর ঘাড়ের নাগাল পাওয়া সহজ হবে না, তাই সে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে সোজা গিয়ে চার্জ করতে চাইল। থান্ডার অবশ্য অনায়াসেই সেই আক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম হল। 

সর্দার এইবার এক পা পিছিয়ে গেল, তারপর এগিয়ে এসে হঠাৎ পাশ থেকে আক্রমণ করল। প্রতিপক্ষের জোরালো ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল থান্ডার। সেই মুহূর্তের অপেক্ষাতেই ছিল সর্দার, ঘাতকের খাঁড়ার মত সর্দার মরণ কামড় বসিয়ে দিল থান্ডারের পিছনের পায়ে। কিন্তু তাতেও ক্ষান্ত হল না কুকুরটা, আহত শত্রুর হাড় গোড় ভেঙে গিয়ে মাংসপেশী ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটাও সে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে লাগল।

থান্ডার তখন অসহ্য যন্ত্রণায় প্রায়ান্ধ। তবুও শত্রুর শরীরে কামড় বসানোর নিস্ফল চেষ্টা করল সে! ততক্ষণে তার নাগাল থেকে বেরিয়ে এসেছে সর্দার। বিজয়ীর ভঙ্গিতে লাফ দিয়ে উঠে অন্য পাশে সরে দাঁড়িয়েছে সে।

ম্যাস্টিফটা উঠে দাঁড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে পড়ে গেল বরফের উপরে। তার পা দু’টো পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে। তিন পায়ের উপর ভর দিয়ে খুব কষ্ট করে উঠে দাঁড়াল থান্ডার, রাগে যন্ত্রনায় তার সামনের পাটির দাঁতগুলো বাইরে বেরিয়ে এসেছে। অন্য কোনো কুকুর হলে এতক্ষণে হার মেনে নিত। মাটিতে চুপচাপ শুয়ে থাকার ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিত তার সমর্পণ। সেই দেখেই যুদ্ধের ফলাফল ঘোষিত হয়ে যেত। প্রথমে দম্ভ সহকারে পরাজিতের শরীরে প্রস্রাব করে দিত বিজয়ী সর্দার, তারপর দলের বাকিরা মিলে ভেড়ার দলটার উপর চড়াও হত। এরপর শুরু হত হত্যালীলা।

প্রথমে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হত ভেড়াগুলোকে, তারপর চলত মহাভোজ।

কিন্তু থান্ডারের শরীরে ভয় বলে কিছুই ছিল না। খোঁড়া হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সে তার আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে জানিয়ে দিল লড়াইটা এখনও শেষ হয়নি।

আসন্ন ঘটনার উত্তেজনায় এইবার বুনো কুকুরের দলটা তর্জন-গর্জন শুরু করেছে। তাদের সর্দারও এইবার গম্ভীর স্বরে গর্জন করে উঠল। সে দেখছে ম্যাস্টিফ কুকুরটা  মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অদূরে। সর্দার তার দিকে এগিয়ে গেল, পিছনের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে শত্রুর শিরদাঁড়ায় সর্বশেষ আঘাত হানতে যাবে ঠিক সেই সময় অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা ঘটল। একটা অসহায় খোঁড়া জন্তুর গায়ে যে অতটা জোর থাকতে পারে সেই দিন থান্ডারকে না দেখলে বুঝতে পারত না হিদার। যদিও এই জোর অবশ্য গায়ের চেয়ে মনেরই বেশি। সর্দার কাছে আসতেই থান্ডার আচমকা লাফ দিয়ে উঠে তার কন্ঠনালী কামড়ে ধরল। ততক্ষণ কামড়ে ধরে রইল যতক্ষণ না তার প্রতিপক্ষের মুখ থেকে রক্ত উঠে পায়ের তলার বরফ রক্তে ভিজে ওঠে। সর্দার সব চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা করতে পারল না। তার অবশ দেহটা মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো তার বিশাল লোমশ দেহটা একবার ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। অবশেষে থান্ডার তার দাঁতের পাটি আলগা করে আনল পরাজিত সর্দারের দেহ থেকে। তারপর সে উঠে দাঁড়িয়ে বরফ ইস্পাত আকাশের পানে তাকিয়ে বিজয় ঘোষণা করল।

হিদার এগিয়ে এসে খুব সাবধানে মৃতদেহটা শুঁকতে লাগল। বুনো কুকুরের দলটা ততক্ষণে লেজ গুটিয়ে চুপি চুপি সরে পড়েছে, কিন্তু একটা ছয় মাসের কুকুরছানা তখনও দাঁড়িয়ে ছিল ওখানে। সর্দার আর অন্য একটি কুকুরের বাচ্চা সেইটা।

নির্ভয় ভঙ্গিতে তার বাবার মৃতদেহের দিকে এগিয়ে এল ছানাটা। থাবা দিয়ে ঠেলে বৃথাই চেষ্টা করল বাবাকে ঘুম থেকে জাগানোর। বাচ্চাটা মাথা তুলে তাকাতেই  হিদার লক্ষ করল বেচারার একটা চোখ কানা। ডান চোখটার জায়গায় একটা গর্ত হয়ে আছে।

বাচ্চাটা কান্নাকাটি করল না, কোন শব্দই বেরোল না তার মুখ দিয়ে। শুধু অনেকক্ষণ ধরে হিদারের চোখের দিকে সটান তাকিয়ে রইল সে। তারপর এক পা এক পা করে নিঃশব্দে হারিয়ে গেল বরফাচ্ছন্ন বনের ভিতরে।

আর থান্ডার? অবশেষে একসময় তার ক্ষতগুলো সেরে উঠেছিল। কোন বিশেষ অঙ্গপ্রত্যঙ্গেও চোট লাগেনি সেই ভাবে। শুধু তার পিছনের পা’টা আর আগের মত সচলতা ফিরে পেল না। হেঁটে চলে বেড়ানোও তার পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠল দিন দিন, তাই আগের মতো ভেড়ার দলের সঙ্গে যেতে পারত না সে। সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল হিদার ও লেভিন। থান্ডারের মতো দুর্ধর্ষ কুকুররের শিকার করার গল্পও থেমে গেল একই কারণে।

ম্যাস্টিফ জাতীয় প্রাণীদের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ববোধের অনুভূতি সৃষ্টি করেছেন বিধাতা। সেই জন্যেই হয়তো সেই ঘটনার মাত্র দেড় মাস পরেই মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে থান্ডার রওনা দিল পাহাড়ের চূড়ার দিকে।

পৃথিবীর বুকে সেই তার শেষ যাত্রা।

হয়তো কোনো একদিন, নতুন বসন্তের দিনে তার জমে যাওয়া দেহটা আবার আলোকিত হবে সূর্যরশ্মিতে। কোমল উত্তাপ ছড়িয়ে পড়বে থান্ডারের শরীর জুড়ে।

***

পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর জিওস্যাটের উন্নত প্রযুক্তি জরুরি ভিত্তিতে প্রতিটা যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করল। এমন হতে পারে যে  যন্ত্রগুলোর রিসিভারে গোলমাল আছে বলে পৃথিবীর কোন বার্তা গ্রহণ করতে পারছে না তারা। কিন্তু না, অ্যান্টেনা সহ সমস্ত রিসিভার ঠিকঠাকই কাজ করছে। পৃথিবীর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের চৌম্বকীয় ক্ষেত্র নির্ধারণ করতে কোন ভুল হচ্ছে না, নাসার গোজ(GOES) নেটওয়ার্ক অর্থাৎ জিওস্টেশনারি অরবিটাল এনভায়োরেনমেন্টাল স্যাটেলাইট গ্রুপের উপগ্রহ থেকে নির্গত তরঙ্গ ইন্টারসেপ্ট করা যাচ্ছে আগের মতোই।  

দেখা গেল কমার্শিয়াল আর মিলিটারি কমিউনিকেশন ব্যান্ডের পুরোটাই শূন্য, তথ্য অথবা নির্দেশ কোনটাই নেই তাতে। অর্থাৎ সমস্যা শুধু মানব পরিচালিত কমিউনিকেশনে। ঘটনাটা এতোটাই অস্বাভাবিক যে এর ফলে উপগ্রহে একটা ‘ইমারজেন্সি প্রোগ্রাম’ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জিওস্যাট পৃথিবীতে সিগনাল পাঠাতে শুরু করল। প্রথমে জার্মান চ্যানেলের নিষিদ্ধ কম্পাঙ্কগুলোতে খবর পাঠানোর চেষ্টা করল কম্পিউটার সিস্টেম, তারপর একে একে কনসোর্টিয়ামের কমিউনিকেশন ব্যান্ড, নাসা আর নাটো’র সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল। কিন্তু রেডিও সিগন্যাল পাঠিয়েও কোনো ফল পাওয়া গেল না।

একটা কৃত্রিম উপগ্রহের যান্ত্রিক মস্তিস্ক যতটা আশঙ্কিত হতে পারে, জিওস্যাটের কম্পিউটার সিস্টেম ততটাই শংকিত এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। পৃথিবীতে তথ্য সরবরাহ করাই যেখানে তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য, সেই কাজে ব্যর্থ হওয়ার চেয়ে বড়ো সমস্যা তার কাছে কিছুই হতে পারে না।

এরপর একটাই সিদ্ধান্ত বাকি ছিল। সর্বোচ্চ এমার্জেন্সির পরিস্থিতির প্রোটোকল সক্রিয় করে দেওয়া হল। এই প্রথম জাপানি হার্ডওয়ার তোকোভ(TOKHOV) কে সম্পূর্ণ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে এগিয়ে এল জার্মান কম্পিউটার প্রোগ্রাম ‘ব্রেন’ (BRAYN)। উপগ্রহের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠল এই প্রোগ্রাম। ‘ব্রেন’ সক্রিয় হওয়া মাত্র জিওস্যাটের যান্ত্রিক মস্তিষ্কে অভাবনীয় পরিবর্তন হল। সিলিকন চিপের গতবাঁধা বিজ্ঞানকে পিছনে রেখে এক ধাপে এগিয়ে গেল উপগ্রহের প্রযুক্তি।

প্রযুক্তিগতভাবে উন্নততর হওয়ার দরুণ বিশেষ কিছু ক্ষমতা ছিল ‘ব্রেন’ এর। প্রয়োজন অনুসারে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম ছিল সে, প্রযুক্তিতে ফেরবদল করাও অসম্ভব ছিল না। সবচেয়ে বড়ো কথা, স্বয়ংক্রিয় ভাবে অবিরত শিখে চলার গুণ প্রদত্ত ছিল এই প্রযুক্তির প্রোগ্রামে।

এই নতুন প্রোগ্রাম সক্রিয় করার পিছনে দুটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল — তথ্য জোগাড় করা এবং পৃথিবীর মানুষদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা। উপগ্রহের নতুন মস্তিষ্ক ভেবেচিন্তে তার পরবর্তী পদক্ষেপ স্থির করল। প্রথমে পৃথিবীতে একজন মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে, তার সঙ্গে যোগাযোগ করে বুঝতে হবে সে উপযুক্ত মানুষ কিনা। সে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে ভূপৃষ্ঠের ভিজুয়ালগুলো খুব ভালো করে নিরীক্ষণ করবে বলে স্থির করল। এর জন্য তাকে অবশ্য উপগ্রহের কক্ষপথ একটু পাল্টাতে হবে। শক্তিশালী এইচ আর ভি টেলিস্কোপ পৃথিবীর দিকে তাক করে সে বুঝতে চাইল পৃথিবীতে আসলে কী এমন ঘটেছে বা ঘটে চলেছে যার জন্য তার ডাকে আর কেউ সাড়া দিচ্ছে না।

কিন্তু দীর্ঘ সাত বছর ধরে নজরদারি করেও পৃথিবীতে মানুষের কোন অস্তিত্ব উদ্ধার করতে পারলো না জিওস্যাট। শুধু তাই নয়, সে আরো লক্ষ করল যে শহরের সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ, রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মানুষের লাশ আর তাদের পরিত্যক্ত বাহন। কোন জাহাজকে আর সমুদ্র পারাপার করতে দেখা যায় না। কলকারখানায় কোন উৎপাদন নেই, চাষবাসের চিহ্নও নেই। গৃহপালিত জীবজন্তুরা ক্ষেতে-খামারে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্বাধীনভাবে। সব ধরনের মানব নির্ভর কাজ বন্ধ হয়েছে।

মনুষ্যজাতির যে আর কোনো অস্তিত্ব নেই পৃথিবীতে — এই স্বাভাবিক তথ্য জিওস্যাট কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। তার মস্তিষ্কে ফিড প্রোগ্রামের মূল ধারণার সঙ্গে সঙ্গে এই ঘটনাকে কিছুতেই মেলানো যাচ্ছেনা।  জিওস্যাটকে মানুষের সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখার কাজে নিযুক্ত করে মানুষ নিজেই কী করে উধাও হয়ে যেতে পারে!!

তখন তার মনে হল, হয়তো পৃথিবীর কোনো প্রান্তে কোনো মানুষ বেঁচে আছে যেখানে সে সিগন্যাল পাঠাতে পারছে না। এই সম্ভাবনার কথা ভেবেই উপগ্রহের যান্ত্রিক মস্তিস্ক  আরো বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। বার বার উপগ্রহের কক্ষ অবস্থান পাল্টানো সম্ভব নয়, তাতে জ্বালানিতে টান পড়তে পারে। কিন্তু জ্বালানী সংরক্ষণের জন্যে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়েও যদি কক্ষপথে সামান্য পরিবর্তন করা সম্ভব হয়, তাহলে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে মানব জীবনের অন্বেষণ চালিয়ে যাবে জিওস্যাট।

কিন্তু পরবর্তী দু’বছর ধরে ভূপৃষ্ঠের ওপর তন্ন-তন্ন করে অনুসন্ধান চালিয়েও কোন আশাপ্রদ ফল মিলল না।

কোনো যন্ত্র যে অবসাদগ্রস্ত হতে পারে, সে কথা অলীক এবং অবাস্তব শোনাবে হয়ত, কিন্তু সেই মুহূর্তে জিওস্যাটের মানসিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গেলে হয়তো সেটাই বলা প্রযোজ্য। জিওস্যাটের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রথম শর্তটাই সে অনুসরণ করতে পারছে না যা হল মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা। যন্ত্র মস্তিস্ক এও জানে যে উপগ্রহের আয়ু ফুরিয়ে আসছে। উপগ্রহটাকে সচল রাখার জন্য যে তরল হাইড্রোজেনের জ্বালানি ব্যবহৃত হয় তা প্রায় নিঃশেষিত, ফলে কক্ষপথের উচ্চতা বিপজ্জনকভাবে কমে চলেছে।

অধোগামী কক্ষপথের দরুণ ইতিমধ্যেই সে বায়ুমন্ডলের সবথেকে উপরের স্তরে পৌঁছে গেছে আর অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের অণু-পরমাণুর সঙ্গে নিরন্তর ঘর্ষণের ফলে তার মৃত্যু এগিয়ে আসছে দ্রুত।

একসময় জিওস্যাটের মস্তিস্ক উপলব্ধি করতে পারল যে তার জীবনের উদ্দেশ্য অপূর্ণ রেখেই মৃত্যুবরণ করতে হবে তাকে। আর এই ব্যাপারটাই তাকে ভিতরে ভিতরে তাড়া করে বেড়াচ্ছে সারাক্ষণ। তার সমস্ত যন্ত্রাংশেরা প্রাণপণ চেষ্টা করছে কোন সমাধান বের করার কিন্তু ব্যর্থতা মেনে নেওয়া ছাড়া তাদের আর কিছুই করার নেই। ক্রমে এই উন্নত যন্ত্র মস্তিস্ক আরো বেশি অবসাদগ্রস্ত হয়ে উঠল। অবধারিত মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি তাকে আরো বেশি অসহায়, আরো বেশি নিঃসঙ্গ করে তুলেছে…

এমন সময়ে হঠাৎ একদিন পাইরেনিস পর্বতশৃঙ্গগুলোর মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় মানুষের বেঁচে থাকার একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত আবিষ্কার করল জিওস্যাট। টেলিস্কোপের সাহায্যে অবাক হয়ে সে দেখল পাহাড়ি উপত্যকায় চরে বেড়াচ্ছে একটা ভেড়ার দল আর তাদের পাহারা দিচ্ছে একটা কুকুর।

***

হরিণের দলটাকে জবাই করার পর বুনো কুকুরের দলটা যেন পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। কোনো গন্ধ নেই, কোনো সাড়াশব্দ নেই, এমনকি চলাফেরার কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ওদের কথা ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক ছিল হিদারের পক্ষে, যদি না রাতের পর রাত ধরে সেই ভয়ঙ্কর লড়াই আর সেন্ট বার্নার্ড-এর কুকুর বাচ্চাটার স্থির অভিশপ্ত দৃষ্টি তাকে দুঃস্বপ্নে তাড়া করে বেড়াতো।

এখন তার যন্ত্রণাটা মাঝে মাঝেই চাগাড় দিয়ে ওঠে। একটা হালকা ব্যথা এখন তার দিনরাত্রির সঙ্গী। তার ক্ষিদে দিন দিন কমে আসছিল। কিছু খেলেও সে সহ্য করতে পারত না, অর্ধেক বমি করে ফেলত কিছুক্ষণের মধ্যেই। তার পাঁজরের হাড়গুলো যেন চামড়ার উপর একপ্রকার ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। তার পেটটা ফুলে উঠে যেন কোনো এক জটিল অসুস্থতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এত কিছু সত্ত্বেও সে প্রতিদিন একই ভাবে ভেড়াগুলোকে চরাতে নিয়ে যেত পাহাড়ের চারণভূমিতে। অন্যদিকে তার পাকস্থলীর টিউমারটা ক্রমে আরো খারাপ আকার ধারণ করছে।

হরিণের দলটার মৃতদেহ আবিষ্কার করার ঠিক দু সপ্তাহ পরের ঘটনা সেটা। খোঁয়াড় এর পাশের শেডটায় ঘুমিয়ে ছিল হিদার। ভোর হব হব করছে। এমন সময় একটা মৃদু আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল তার। সে চোখ মেলে মাথা তুলে তাকিয়ে যে দৃশ্য দেখল তাতে তার হৃদপিণ্ডটা এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।

বেড়াটাকে অর্ধবৃত্তাকারে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সেই বুনো কুকুরের দলটা। অন্ধকারে তাদের লাল চোখ দেখে পুরো দৃশ্যটা ভুতুড়ে বলে মনে হচ্ছে। তাদের দাঁত কটমট করার শব্দের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ভেড়াগুলোর ছটফট করার আওয়াজ। সে দৌড়ে গিয়ে খোঁয়াড়ের দিকে পিছন করে ভেড়ার পাল আর কুকুরগুলোর মাঝে গিয়ে দাঁড়াল। হিদার প্রচন্ড ভয় পেয়েছে, কারণ সে জানে ওই কুঁদো কুঁদো চল্লিশটা কুকুরের সঙ্গে একা সে কোনভাবেই পেরে উঠবে না। কিন্তু ভেড়াগুলোকে রক্ষা করার জন্য সে তার প্রাণও বাজি রাখতে প্রস্তুত। এ কথাও ঠিক যে সে থান্ডার এর মতো ডাকাবুকো নয়, তার প্রাণে ভয় আছে।

হিদারের ভেড়ার দলটাকে বাঁচানোর ব্যর্থ প্রয়াস দেখে বুনো কুকুরের দলটা জোরে জোরে ডাকতে শুরু করল। একটা তাচ্ছিল্যের ভাব মিশে আছে সেই ডাকাডাকিতে। ভোরের আলো এখনো ভালো করে ফোটেনি বলে প্রত্যেকটা জন্তুর অবয়ব আলাদা করে বোঝা যাচ্ছিল না তবে মনে হচ্ছে সবগুলোই মিশ্র জাতের। কুকুরদের এই জাত বা ব্রিড নির্বাচন করার ব্যাপারটা একান্তই মানুষের সচেতন সৃষ্টি, কিন্তু এই সৃষ্টি এতটাই ঠুনকো যে হাজার হাজার বছরের পরিশ্রমে মানুষ যা গড়ে তুলেছিল সেসব ধূলিসাৎ হতে মাত্র কয়েক প্রজন্মই যথেষ্ট ছিল। এই দলটার প্রত্যেকটা জন্তুর চেহারা এবং আদল প্রায় একই রকম। কিন্তু না, দলে একটা কুকুর আছে যার দেহটা আবছায়ার মধ্যে সেঁধিয়ে থাকলেও বিশাল চেহারার জন্য আলাদা করে জন্তুটাকে চোখে পড়ল হিদারের।

আসন্ন বিপদের কথা ভেবে হিদার জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে শুরু করেছে। দাঁত মুখ বের করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। মাঝে মধ্যে গজরাচ্ছে অসহায়ভাবে। তার কান দুটো নেতিয়ে পড়েছে। সে আস্তে আস্তে লেজটাকে দুই পায়ের মধ্যে ঢুকিয়ে আনার চেষ্টা করল যাতে ভয় পাবার ফলে তার দেহ নিষ্কৃত ফেরোমন-এর গন্ধ বাতাসে না ছড়িয়ে যায়।

দলের মধ্যে একটা কুকুর বেশ ভয় দেখানোর ভঙ্গিতে ডাকতে ডাকতে তেড়ে এলো হিদারের দিকে। দলের অন্যদের থেকে এর বয়স খানিকটা বেশিই। নিঃসন্দেহে অতিরিক্ত সাহস দেখিয়ে সর্দার হওয়ার মনোবাসনা তার। হিদারও শুকনো ভাবে ডেকে তাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করল। তাতে ফল হলো উল্টো। কুকুরটা ভয় তো পেলই না উল্টে নতুন উদ্যমে তেড়ে এলো তার দিকে। দলের বাকি কুকুরগুলো সুযোগ বুঝে যোগ দিল এই তর্জনগর্জনে। ভেড়াগুলো ভীষণ ভয় পেয়ে বেড়ার এপাশ থেকে ওপাশে দৌড়াতে লাগল। আজ আর বেড়াটা আস্ত থাকবে না নির্ঘাত।

হঠাৎ বজ্রের মতো একটা ডাক শোনা গেল কুকুরের দলটার আক্রমণাত্মক স্বর ছাপিয়ে। কুকুরগুলো এবার চুপ মেরে গেল। এই ডাকটা একদম আলাদা। এমনকি ভেড়াগুলো পর্যন্ত তাজ্জব বনে গেছে, বিস্ময়ে কাঁপতে ভুলে গেছে তারা। এবার ছায়ার ভিতর থেকে সেই দশাসই সর্দারকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। প্রাণীটার ওজন থান্ডারের মত অতটা না হলেও ওর থেকে লম্বা তো বটেই।

সেই এক চোখ কানা কুকুরছানাটা! থান্ডারের হাতে প্রাণ হারানো সেন্ট বার্নার্ড সর্দারের বাচ্চা। হিদারের মুখ থেকে একটা অস্ফুট গোঙানির আওয়াজ বেরিয়ে এল। বুড়ো কুকুরটা ওর গন্ধ টের পেয়েছিল বটে তবে ওর চেহারাটা চেনার কথা নয়। কারণ সেই আট বছর আগে শেষ দেখেছিল বাচ্চাটাকে। এখন সে গায়ে-গতরে ম্যাস্টিফের মত মোটাসোটা হয়েছে আর উচ্চতায় হয়েছে গ্রেট ডেনের মতো পর্বতপ্রমাণ। কুকুরটার গায়ের লোমে সাদা আর বাদামির ছোপ। সুবিশাল মাথাটা দেখে ঠিক যতটা সম্ভ্রম হয়, ততটাই হয় আতঙ্কও। কুকুরটা এক চোখে হিদারের দিকে চেয়ে আছে। খুব ধীরে ধীরে গর্ব ভরে এগিয়ে এসে হিদারের খানিকটা দূরে এসে থামল সে।

পাহাড়ের মাথায় সেই সময় সূর্যোদয় হচ্ছিল। সূর্যের প্রথম রশ্মি দৈত্যাকার কুকুরটার গায়ে পড়ে তাকে যেন সোনার আভায় স্নান করিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ চারপাশের সবকিছু খুব শান্ত হয়ে এল। এক মুহূর্তের জন্য সব নিশ্চুপ। সর্দার মাথা নিচু করে খুব সচেতনভাবে অথচ সন্দেহের বশে হিদারকে শুঁকতে লাগল।

হঠাৎ কুকুরটার চোখের দৃষ্টিতে একটা পরিবর্তন দেখা দিল। হয়তো সে হিদারকে চিনতে পেরেছে কিংবা এমনিই বিভ্রান্ত হয়েছে কোন ব্যাপারে। অথবা নিতান্ত অবাক হয়েছে বৃদ্ধ কুকুরটাকে দেখে। কারণ যাই হোক, কুকুরটার আচরণ খুব স্বাভাবিক ছিল না সেই মুহূর্তে। একটু নিচু হয়ে খুব আলতো ভাবে সে হিদারের ভীত সন্ত্রস্ত মাথাটা একটু চেটে দিল।

এইবার হিদারের কাছ থেকে সরে এসে সে বেড়ার গেটের কাছে পা তুলে দাঁড়াল। নির্দিষ্ট কর্মটি করে খুব আলগাভাবে সেখান থেকে প্রস্থান করল সে। পিছনে পড়ে রইল ভেড়ার দল, তাদের খোঁয়াড় আর বুড়ো কুকুরটা। বুনো কুকুরের দলটা সর্দারের এহেন আচরণে যারপরনাই স্তম্ভিত। তাদের সর্দার, যে কিনা সাক্ষাৎ রক্ত আর হিংস্রতার প্রতিমূর্তি সে হঠাৎ বুড়ো ঘেয়ো কুকুরটাকে রেহাই দিল কেন? কেনই বা ভেড়ার দলটাকে কোতল করার ব্যাপারে কোন উচ্চবাচ্য করল না?

দূরে সর্দারের ডাক শোনা গেল দুবার। হিদারের চমক ভাঙল এতক্ষণে। হিদারকে ভেড়াগুলোর সঙ্গে ঠিক আগের মতোই একা রেখে ততক্ষণে বুনো কুকুরগুলো একজোট হয়ে ছুট লাগিয়েছে।

কেন করল কুকুরটা এরকম? হয়তো হিদারকে সে চিনতে পেরেছিল আর তার পিতার ঘাতক থান্ডারকেও। হয়তো বা সে মানুষের গন্ধ পেয়েছিল, ভেবেছিল কাছেপিঠে কোথাও মানুষের অস্তিত্ব আছে। তবে হিদারের মনে হয় কুকুরটা একটা অন্য গন্ধ পেয়েছিল — আসন্ন মৃত্যুর গন্ধ। যা ওত পেতে আছে কাছেপিঠে, বুড়ো জন্তুটাকে জড়িয়ে আছে ঈর্ষান্বিত প্রেমিকের মতো।

কারণ যাই হোক না কেন, সর্দার জায়গাটা নিজের বলে ঘোষণা করেই গেছে। তাই পরে যখন মর্জি ফিরে আসতে পারে দলবল নিয়ে।

হঠাৎ তার পেটের ব্যাথাটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠলো। ককিয়ে উঠল হিদার। তবুও ব্যথার তোয়াক্কা না করে, শুধুমাত্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আবার আগের মতই রুটিনমাফিক ভেড়াগুলোকে উপত্যকার দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। এক অপরিসীম কষ্ট তার গলার কাছটা চেপে ধরেছে । পেটের ভিতর কি একটা যেন অবিরাম মোচড় দিয়ে চলেছে।

***

অনেক খোঁজাখুঁজির পর জিওস্যাট যখন প্রথম ভেড়ার দলটাকে পৃথিবীতে আবিষ্কার করল তাতে ওর যে খুব আনন্দ হয়েছিল সেটা বলা ঠিক হবে না (একটা উপগ্রহ, তা সে যতই উন্নত মানের হোক না কেন, তার মধ্যে মানুষের মতো আবেগ আশা করা যায় না), কম্পিউটারের ভাষায় বলতে গেলে স্বস্তি ফিরে পেয়েছিল একটু।

এতদিন ধরে মানুষের বিলুপ্তির রহস্য উদ্ধার করার জন্য যেসব যন্ত্র আর প্রোগ্রামকে কাজে নিয়োজিত করা হয়েছিল আপাতত সেগুলোকে বন্ধ রাখলো সে। বছরের পর বছর ধরে ওগুলো যা যা ব্যাখ্যা দিয়ে এসেছে সেসবের বেশিরভাগই জিওস্যাট এর পক্ষে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। যেমন, একটা ব্যাখ্যা বলছে মানুষ এখন কোন কারণে জলের তলায় বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর যারা ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়েছিল তাদেরকে খুন করে রাস্তাঘাটে ফেলে রেখে গেছে। আরেকটা ব্যাখ্যা বলছে যা কিছু তথ্য ওই যন্ত্রগুলো উদ্ধার করেছে পৃথিবী সম্বন্ধে সেসব কিছুই সত্যি নয়, সবটাই যন্ত্রের মনের ভ্রম।

কিন্তু সর্বশেষ যে ব্যাখ্যা নিয়ে সে এযাবৎ কাজ করছিল তা সত্যিই হতাশাজনক, তাতে বলছে মনুষ্য জাতি কোন কারণে তার উপর রুষ্ট হয়ে তার সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করেছে। কিন্তু কিভাবে? কিভাবে অসন্তুষ্ট করেছে সে মানুষকে? এই ধাঁধার কোন উত্তর ছিল না তার কাছে। শুধু মনে মনে সে বুঝে নিয়েছিল সে এমন কিছু মহাপাপ করেছে যে পৃথিবীর মানুষ তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এবং এসব ভাবতে ভাবতেই উপগ্রহটার যান্ত্রিক মনে ধর্ম, ভগবান, পাপ-পুণ্য, নিয়তি এই সমস্ত বিশ্বাসের জন্ম নিয়েছিল।

কিন্তু সেসব তত্ত্ব নিমেষে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল যে মুহূর্তে উপগ্রহের ক্যামেরা পৃথিবীতে আবিষ্কার করল দলবদ্ধভাবে চারণভূমির দিকে এগিয়ে যাওয়া ভেড়ার দলটাকে। গবাদি পশুপালন, সে তো একমাত্র মানুষেরই কাজ। সুতরাং মানুষ এখানে নিশ্চই আছে।

জিওস্যাট অপ্রয়োজনীয় সাব-সিস্টেমগুলোকে তক্ষুনি বন্ধ করে রেডিওমেট্রির কাজ শুরু করল, ভেড়ার দলটাকে আরো ভাল করে পর্যবেক্ষণ করার জন্য। তাতে সে দেখল একটা কুকুর পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে ভেড়ার ওই দলটাকে, দলে আছে মোট আটত্রিশটা ভেড়া। কুকুরটা কোন জাতের ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা, তবে গায়ের রঙ আর চেহারা দেখে অনুমান করা যায় ওটা একটা অ্যালসেশিয়ান কিংবা বেলজিয়ান শেফার্ড। চারদিকে উঁচু পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকায় অবস্থিত ভেড়ার খামারটার পাশেই ঝুপড়ির মত একটা বাড়ি। কিন্তু জনমনিষ্যির কোন চিহ্ন নেই সেখানেও।

জিওস্যাট নব্বই মিনিটে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে অর্থাৎ দিনে ষোল বার একই জায়গার ঘুরপাক খায় সে। পাইরেনিস অঞ্চল, যেখানে ভেড়ার দলটাকে খুঁজে পেয়েছ উপগ্রহটা, সেখানকার মাটির উপর থেকে চোখ সরালো না সে। প্রথম চার দিনে উপগ্রহটা দলটার গতিবিধির ওপর নজর রাখল, সবরকম ভাবে চেষ্টা করল যদি মানুষের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় সেই খোঁজ করার। কিন্তু না, হতাশা ছাড়া কিছুই মিলল না। ভেড়ার দলের ব্যাপারটা তাকে আরো ধন্ধে ফেলে দিয়েছে। পশুচারণ তো নিঃসন্দেহে মানুষের কাজ, তাহলে মানুষগুলো গেল কোথায়!

চতুর্থ দিনের পর জিওস্যাট সেই বাড়ি আর খামারের দিকে সরাসরি সিগন্যাল পাঠাতে শুরু করল। যত রকম কম্পাঙ্ক এবং লিংক তার জানা ছিল সব রকম পদ্ধতিতে সে চেষ্টা করল মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু তাতেও কোনো সাড়া এল না। পঞ্চম দিনে অবশেষে উপগ্রহটা হাল ছেড়ে দিল পুরোপুরি। যে যন্ত্রগুলো নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণের কাজে ব্যস্ত থাকতো সেইগুলোকেও কাজ থেকে ছুটি দিল। আত্মবিশ্লেষণ

করা ছাড়া তার কাছে আর কোন রাস্তা নেই। যন্ত্রটার মস্তিষ্ক অর্থাৎ সেই ‘ব্রেন’ প্রোগ্রামও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে। একা থাকতে থাকতে যন্ত্রটার মধ্যে একটা স্বায়ত্তশাসন বোধ তৈরি হয়েছে যা ওর পূর্বসূরীদের ক্ষেত্রে প্রায় অকল্পনীয়ই ছিল বলা যায়। সেই বোধ তাকে প্রথমে করে তুলল আত্মসচেতন, তারপর ধীরে ধীরে এক বিমর্ষ অপরাধবোধের আঁধারে ঠেলে দিল তাকে।

শেষমেষ জিওস্যাট নিজের ব্যর্থতা একরকম স্বীকারই করে নিল। এভাবে ব্যর্থতার অন্ধকারে তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয় মনে হয়েছিল তার।

ধীরে ধীরে (যন্ত্রটার কাছে যদিও সেটা আলোর গতির সমান) এত বছর ধরে সিস্টেমে সংগৃহীত যাবতীয় তথ্য মুছে ফেলতে শুরু করল সে। ঠিক যেন মানুষের মতোই, এক অপরিসীম বিষাদ গ্রাস করল তাকে। দীর্ঘ বারো বছর ধরে জমানো জ্ঞানভান্ডারকে শূন্যে ছুঁড়ে দেবার আগে তাদের গায়ে যত্ন করে হাত বুলিয়ে দিল একবার। ধাতু অনুসন্ধান ও মানচিত্র অঙ্কণ, কৃষি বিষয়ক বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে ভৌগলিক সার্ভে, আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য থেকে যান্ত্রিক মূল্যায়ন ক্রমে সব মুছে গেল একে একে। এমনকি কয়েক বছর আগে দেখা সেই অদ্ভুত উল্কাপাতের ব্যাপারটাও মুছে গেল, যখন আকাশ থেকে অগুনতি তারা খসে পড়ছিল আটলান্টিকের বুকে…

কিন্তু এক মিনিট…

জিওস্যাট তথ্য মুছে ফেলার কাজটা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে কিছু একটা ভাবতে শুরু করল। নিশ্চিত একটা কোন সূত্র পেয়েছে তার মস্তিষ্ক। ঠিক তো! উল্কাপাত, নক্ষত্র বৃষ্টি….  চিচিং ফাঁক!

মানুষের সঙ্গে যোগ স্থাপন করার একটা উপায় খুঁজে পেয়ে সে মনে মনে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আর সময় নষ্ট না করে জিওস্যাট দ্রুত কিছু গণনা করতে শুরু করল। সিমুগ্রাফ সফটওয়্যারের সাহায্যে সে খুব সহজেই মহাকাশে তার সঠিক অবস্থান দেখে নিল। রেডিওমেট্রির মাধ্যমে ওই খামার এবং বাড়ির কোঅর্ডিনেট মাপা হল, অবশিষ্ট জ্বালানির পরিমাণ দেখে নিল সেন্সরগুলো। অ্যালজেবরার সূত্র ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় থ্রাষ্ট ও ব্যালাস্টিক নির্ণয় করা হল। আরো এমন হাজারখানেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম জিনিসও ধরা রইল যান্ত্রিক মস্তিষ্কে, যা এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করবে।

সর্বশেষে, সে ওই জায়গার আবহাওয়ার ব্যাপারটা খুঁটিয়ে দেখল। সে চায় না কোনো রকম ঝড়ঝঞ্ঝা বা মেঘলা আকাশের কারণে তার পরিকল্পনা কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোক।

টেলিস্কোপ জানান দিল সারা ইউরোপ জুড়ে এখন শৈত্যপ্রবাহ চলছে, বরফের ঝড় উত্তর দিক থেকে এগিয়ে এসে আছড়ে পড়েছে সমতলের ওপর। পাইরেনিসের পর্বতশৃঙ্গগুলো ঘন কিউমুলো নিম্বাস মেঘে ঢেকে যাওয়ায় রাতের আকাশকে অস্বচ্ছ দেখাচ্ছে।

জিওস্যাট সব সিস্টেমগুলোকে তখনকার মতো বন্ধ করে দিয়ে ঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। সে জানে শীঘ্রই তার সঙ্গে যোগাযোগ হবে মানুষের।

***

হিদার ভিতরে ভিতরে আসন্ন মৃত্যুর ইঙ্গিত টের পাচ্ছিল। তার পেটের ব্যথাটা আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে গেছে। আজকাল খুব দুর্বল লাগে নিজেকে।

আবহাওয়ায় কী যেন একটা বদল এসেছে। বসন্ত কোনো কারণে যেন রাতারাতি শীতকে আরেকটু জায়গা ছেড়ে দিয়েছে থাকার জন্য। কনকনে ঝোড়ো বাতাসে যেন হাড়ের ভিতরে ঠান্ডার কামড় বসাচ্ছে। দূরের সবথেকে উঁচু বরফাবৃত পর্বতচূড়াগুলোও মেঘে ঢেকে গেছে।

এতদিন ধরে ঘড়ি ধরে কাজ করে এলেও আজ আর ভেড়ার দলটাকে চড়াতে নিয়ে যাবার মতো ক্ষমতা অবশিষ্ট নেই হিদারের দেহে। সে বেড়ার দরজাটুকু শুধু খুলে রেখে দেয় যাতে ভেড়াগুলো কাছাকাছি একটু চরে বেড়াতে পারে। কোনো ভেড়া চরতে চরতে বেশি দূরে চলে যাওয়ার উপক্রম হলে হিদারকে কষ্ট করে উঠতে হয় সেটাকে টেনে আনার জন্য।

ঠিক এভাবেই একদিন একটা ভেড়ার পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে অজান্তেই মেষপালকের বাড়ীতে ঢুকে পড়ল কুকুরটা, জীবনে এই প্রথম। বাড়ির ভিতরে খাবার নেই, এই মুহূর্তে আত্মরক্ষারও কোন প্রয়োজন নেই, তবু দলের একমাত্র কালো ভেড়াটা (গায়ের গন্ধ মধুর মত বলে ধরা যাক ওর নাম মধু) চলে গেছে ওই দিকে। বোধ বুদ্ধি না থাকলে যা হয় আর কি! ব্যথা বেদনা সব এক মুহূর্তে ভুলে গিয়ে হিদার ভেড়াটাকে ঘাড় ধরে বের করে আনল ভিতর থেকে।

বের করে আনার পর হঠাৎ তার খেয়াল হলো, সে যে ভিতরের ওই পবিত্র ভূমিতে এইমাত্র পা রেখেছিল, কই তাতে তো কিছু হলো না! কোন বজ্রপাত হলো না কিংবা লেভিনের ভূত এসেও তার প্রতিশোধ নিলো না! সে চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে ভাবল কিছুক্ষণ। শেষমেষ আরেকবার ভিতরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

বাড়ির ভিতর ধুলোয় ধুলো। দেয়াল, আসবাব, পর্দা সব কিছুর উপরে একটা ধূসর আবরণ। ঠিক যেন সময়ের আস্তরণ থিতিয়ে পড়েছে ওগুলোর উপর। হল পেরিয়ে সে রান্নাঘরে ঢুকলো। তাকের উপরে রাখা টিনের ক্যানগুলো ভিতরের খাবারের ফারমেন্টেশনের ফলে কবেই ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। কুকুরটা ভাঁজ পড়ে যাওয়া টেবিল ক্লথ, ধুলো পরা প্লেট আর চূর্ণ-বিচূর্ণ চিনেমাটির পাত্রগুলো শুঁকে শুঁকে দেখতে লাগল। জিনিসগুলোতে এখনও তার একদা মনিবের গায়ের গন্ধ লেগে আছে, যদিও গন্ধটা হালকা হয়ে এসেছে। সেই গন্ধটা পেয়েই হিদারের মনটা ঠিক প্রথম দিনের মতোই চনমন করে উঠল, ঠিক যেমন আজ থেকে বারো বছর আগে করেছিল।

ঠান্ডায় আর খিদেয় কুঁকড়ে থাকা বিধ্বস্ত বাচ্চা কুকুরছানাটা হিদার ঝোপের সামনে অচেনা মেষপালককে প্রথম দেখেছিল সেইদিন।

হিদার রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখল সামনের ছোট হলটার শেষে একটা আধ ভেজানো দরজা, তার ওপারেই শোওয়ার ঘর। দরজার কাছে এসে কুকুরটা এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল কারণ ঠিক তখনই আবার ছুরির খোঁচার মতো হ্যাঁচকা লাগল তার তলপেটে। কিন্তু বেডরুমের ভিতর থেকে ভেসে আসা মেষপালকের গায়ের গন্ধ তাকে ভুলিয়ে দিল সব যন্ত্রণার কথা। কয়েক মুহুর্তের জন্য তার মনে হল হয়তো তার মনিব এখনো বেঁচে আছে, এক্ষুনি ঝড়ের মতো বাইরে বেরিয়ে এসে তাকে শাস্তি দেবে তার দুঃসাহসের জন্য। কিন্তু না, তেমনটা কিছুই হল না। মনিবের প্রায় মিলিয়ে যাওয়া পদচিহ্নে মৃত্যুর গন্ধ পেল সে।

হিদার ঘরে ঢুকল। ভাঙা কাচের মধ্য দিয়ে ঢোকা বাইরের আলোয় খাটের পাশে সে পড়ে থাকা কঙ্কালটাকে দেখতে পেল। ভয়ে ভয়ে কয়েকবার শুঁকে দেখল সে তার মনিবের দেহাবশেষটা। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটাই সত্যি।

সেই পড়ে থাকা সাদা অস্থির টুকরোগুলো যেন মনুষ্য জীবনের অন্তিম পরিণাম বা এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের সংক্ষিপ্তসার হিসেবে সাক্ষী দিচ্ছিল, যেন এই বিশাল মহাসাগরে এক ফোঁটা জলের মতো, নিতান্তই নগণ্য।

একটা পাথরের মত ভার যেন কোথা থেকে এসে যেন চেপে বসেছে কুকুরটার বুকে! অসম্ভব ব্যথার মধ্যে শ্বাস টেনে টেনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে। তার চোখে জল এলো অজান্তেই। মৃত্যু যেন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো তাকে আদর করে দিচ্ছে। একটু পরে তার ব্যাথাটা ক্ষীণ হয়ে এলো, ফুসফুস ফিরে পেল বাতাস। কুকুরটা হাঁফাতে হাঁফাতে কঙ্কালটার দিকে ফের ফিরে চাইল। মনিবের কঙ্কালটা মুখ থুবড়ে মেঝের উপর পড়ে আছে, তার ডান হাতটা সামনের ছোট্ট ওক টেবিলটার দিকে প্রসারিত। হয়তো মৃত্যুর ঠিক আগে মানুষটা কোন একটা জিনিস নেওয়ার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়েছিল, কিন্তু অভিষ্টের কাছে পৌঁছাতে পারেনি সে কথা বলাই বাহুল্য।

কিন্তু কী চেয়েছিল সে?

টেবিলের উপর মাত্র দু খানা জিনিস রাখা, জলশূন্য একটা জগ আর নিকেল-সিলভার ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবি। এক যুবতীর পোর্ট্রেট। মানুষটা বেঁচে থাকা অবস্থাতেও ছবিটা পুরনোই ছিল।

মৃত্যুর আগে কী কামনা করেছিল মানুষটা? এক ফোঁটা জল নাকি কাছের মানুষের সঙ্গ? কুকুরটা হুট করে উঠে দরজার দিকে হেঁটে চলল। বেরিয়ে যাবার আগে শেষবারের মত দেখে নিল হাড়ের টুকরোগুলোকে। এ জীবনে কম হাড়গোড় দেখেনি সে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় সমস্ত পৃথিবীটাই হাড় দিয়ে তৈরি।

বুড়ো কুকুরটার বাড়ি থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই দূরে কোথাও একটা সজোরে বাজ পড়ল। ঝড়ের পূর্বাভাস। কিছুক্ষণ পরেই যথারীতি তুষারপাত শুরু হলো। হিদার মনে মনে কিছুটা জোর পেয়েছে যার সাহায্যে সেই আজব কায়দাটা করে খোঁয়াড়ের দরজাটা শেষবারের মত আটকে দিল সে। ব্যথায় চারদিক ঝাপসা হয়ে আসছে, শ্বাস টানতে টানতে বুড়ো কুকুরটা একপাশে সরে গেল। দেখল অনেকগুলো ভেড়া তখনও বাইরে চরছে। একবার ভাবল, তাদেরকে গিয়ে উদ্ধার করবে কিন্তু তার শরীর আর সায় দিচ্ছে না কিছুতেই।

মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল প্রাণীটা, ব্যথায় কুঁকড়ে গেছে তার দেহটা। রক্ত বমি করছে সে, মুখ থেকে ফেনা উঠে আসছে। তার অদ্ভুত দৃষ্টি না জানি চারপাশে কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে! প্রবল যন্ত্রণায় তার মনের কষ্টগুলো ক্রমে সব চাপা পড়ে যাচ্ছে। অবশেষে জ্ঞান হারিয়ে কুকুরটা বরফের উপর ঢলে পড়ল।

***

ঘণ্টাখানেক বাদে প্রবল দমকা হাওয়ায় পাইরেনিস পাহাড়ের চূড়া থেকে সমস্ত মেঘ কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেল। ফের পরিষ্কার রাতের আকাশে ফুটে উঠল তারার দল। জিওস্যাট-এর সক্রিয় হবার সময় হয়েছে এবার। খোঁয়াড়ের মাথার উপর এখন সুনির্মল আকাশ। এই সুযোগেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে হবে। খুব সাবধানে জিওস্যাট আবার তার গণনাগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর শুরু হল উল্টো গোনা। পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তাকে আরও একবার পরিক্রমা করতে হবে তার কক্ষপথে।

ঠিক চুয়াত্তর মিনিট পরে উপগ্রহটা নির্দিষ্ট যন্ত্রের মাধ্যমে নিজের অক্ষপথ পরিবর্তন করল। থ্রাষ্টরের সাহায্যে নিচের কক্ষপথে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল সে। এখান থেকেই শুরু হবে তার সর্বশেষ অভিযান।

0001010, 0001001 …

ভেড়ার দলের কাছাকাছিই কোথাও মানুষের অস্তিত্ব থাকবে এ সম্বন্ধে জিওস্যাট ছিল একেবারে নিঃসন্দেহ, যদিও বেতারে এখনও কোন ভাবে তাদের সঙ্গে সে যোগাযোগ করে উঠতে পারেনি। এখন একটাই পথ, যে কোন প্রকারে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

0001000, 0000111 …

যদি সে তার অবশিষ্ট জ্বালানি ব্যবহার করে তার এখনকার কক্ষপথ থেকে লাফ দিয়ে নিচের কক্ষপথে নামে তাহলে হিসেব অনুযায়ী জিওস্যাটের এই উপগ্রহটা ওই খামারের দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোথাও আছড়ে পড়তে পারবে। আর এই পতনের ফলে যে আলোর বিস্ফোরণ হবে তা নিশ্চয়ই আশেপাশে থাকা কোন মানুষের নজর

এড়াতে পারবে না।

0000110,0000101 …

বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করা মাত্রই ওর বেশিরভাগ অংশতে আগুন ধরে উল্কাবৃষ্টির মতো এক দৃশ্য তৈরি করবে। যতটুকু অংশ ধ্বসে পড়বে পাহাড়ের মাথায়, সেই বিস্ফোরণের শব্দ নিশ্চয়ই কাছেপিঠে থাকা মানুষও শুনতে পাবে। ওই জ্বলন্ত আগুন যে পরিমাণ তাপ উৎপন্ন করবে তা হবে জিওস্যাটের অস্তিত্বের আরো একটি চিহ্ন। সম্ভবত তার শেষ চিহ্ন। তার ফাইনাল টেস্টামেন্ট…

0000100, 0000011 …

এই তো মানবজাতির সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র পথ। তাই না? এই কাজটা করে ফেললেই জিওস্যাটকে সঁপে দেওয়া এই অভিযান সম্পন্ন হবে…

0000010.0000001 …

উপগ্রহটা তো ধ্বংস হবেই, তার সঙ্গে তার কৃত্তিম মস্তিস্ক অথবা বলা যায় তার মনটাও মিশে যাবে ধুলোয়। তার মস্তিষ্কে সমাহিত সমস্ত স্মৃতি আর পরিচয় মিলিয়ে যাবে হাওয়ায়, যেমন হাওয়ার ধাক্কায় প্রদীপের আলো নিভে আসে। কিন্তু সে সবই গৌণ। আসল কথা হলো নিয়তিকে মেনে নেওয়া আর শেষ বারের মত মানুষের

কাছে পৌঁছে যাওয়ার অনুভূতিকে খুঁজে পাওয়া…

0000000.

মোটর চালু করার ক্ষণিক আগে জিওস্যাট পৃথিবীর দিকে ছুঁড়ে দিল তার অন্তিম বার্তা, “পৃথিবী আমি আসছি – জিওস্যাটের সেলাম”।

চিরকালের মতো হারিয়ে যাবার এক ভগ্নাংশ মুহূর্ত আগে তার মনে একটা অদ্ভুত আবেগ খেলা করে গেল, হয়তো এই অনুভূতিকেই একদিন মানুষেরা খুঁজে পেতে চাইত। বড়ো পরিচিত এই আবেগ, বড়ো আপন, বড়ো অপেক্ষা করতে হয় তাকে অনুভব করতে।

সুখ…

***

হিদার আবার ছোট্টটি হয়ে গেছে। থান্ডারের বুকের উপরে উঠে তার ঘন লোম চিবোতে চিবোতে খেলা করছে নিজের মনে। আরামে ম্যাস্টিফ কুকুরটা একটু নরম ভাবে কুঁই কুঁই করে উঠছে। কী সুন্দর দিন ছিল সে সব!

দৃশ্যবদল

বুনো কুকুরের দলটার সর্দার তীক্ষ্ণ এবং ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে, একটা মাত্র চোখ যেন জ্বলজ্বল করছে। সে যেন একটা বিশালাকৃতি দৈত্য, এই উঁচু উঁচু পাহাড়গুলোর থেকেও বড়।

দৃশ্যবদল

একটা শান্ত পুকুরের ধারে তার মনিব ভেড়ার দলটাকে চরাচ্ছিল। সে ভাল করে দেখল ওটা মানুষের শরীর নয়…একটা কঙ্কাল, ভেড়াগুলোও তাই… কঙ্কাল। থান্ডার , এমনকি লেভিনও। ভীষণ ভয় পেয়ে হিদার ওখান থেকে ছুটতে শুরু করল। খুব জলতেষ্টা পেয়েছিল তার। পুকুরের ধারে এসে জল খেতে শুরু করল সে এবং পুকুরের স্বচ্ছ জলে হঠাৎ সে আবিষ্কার করল তার প্রতিচ্ছবি, একটা বিবর্ণ ক্ষয়ে যাওয়া করোটি। তাহলে কি…

দৃশ্যবদল

আবার ফিরে গেছে সে কুট্টিবেলায়। ভীষণ ছোট, যেন একটা পশমের বল। কেউ যেন কোলে করে তাকে ভীষণ আদর করছে। ওমা, এটা তো একটা মানুষের বাচ্চা! হিদার কোনওদিন মানুষের বাচ্চা দেখেনি এর আগে। কী করে হল এটা? কবে ঘটল এই সব? বাচ্চাটাই বা কে?

মানুষের বাচ্চাটার নরম হাতগুলো তাকে কী গভীর আনন্দ আর প্রশান্তি এনে দিচ্ছিল। কিন্তু বাচ্চাটা অমন করে কাঁদছিল কেন!!

হিদারের জ্ঞান ফিরল এবার। তার আর উঠে বসার ক্ষমতা নেই, পড়ে রইল সে বরফের ওপরেই। তার আর ব্যথা নেই, শীতবোধ নেই, সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন এখন সে। খুব কষ্ট করে মাথাটা উঁচু করে সে আকাশের দিকে তাকালো। হাওয়ার দাপটে আকাশের সব মেঘ পরিষ্কার হয়ে গেছে। শত শত তারা ঝিলিক দিচ্ছে সেখানে।

তার মনটা নরম হয়ে এলো, শান্ত, সুখী।

দূরে, দিগন্তে, আকাশে উল্কাবৃষ্টি শুরু হল।

***

জিওস্যাট এর দেহের অবশিষ্ট অংশ ট্রপোস্ফিয়ার ভেদ করে পাহাড়ের মাথায় ধাক্কা খেয়ে আছড়ে পড়ল। উপগ্রহটা ধুমকেতুতে পরিণত হয়েছিল, তার আগুনে লেজ দিয়ে এঁকে দিচ্ছিল রাতের আকাশের বুকে। শেষ পর্যন্ত সে পেরেছে।

কী চমত্কার লাগছে আকাশটাকে! তারাদের আলো ছিটকে এসে লাগল হিদারের চোখে, সে শুধু ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা। তারাদের ঝিকমিক দেখে মনে হচ্ছে যেন কতদিন পরে পুরোনো বন্ধুর দেখা পেয়েছে সে আবার। উপগ্রহের অবশিষ্ট অংশ পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে একটা আগুনের বলের মত একবার দিগন্তে লাফিয়ে উঠলো। পাইন, ফার, অ্যাশ, বীচ গাছের জঙ্গলে ততক্ষণে আগুন লেগে গেছে। আগুনের লকলকে শিখা উঁচু উঁচু গাছেদের মাথা ছাড়িয়ে অকাশপানে জিভ বাড়াচ্ছে।

পরক্ষণেই বিস্ফোরণের দারুণ শব্দে গোটা উপত্যকা কেঁপে উঠল। আর বুড়ো কুকুরটা যার চোখে এসে লেগেছে তারার আলোর ঝিলিক… ধীরে ধীরে চোখ বুজে ফেলল সে সে। তার নিশ্বাস থেমে গেল চিরতরে।

শেষকথন

ভোর হবার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ভেড়াগুলো ছটফট করতে শুরু করেছে। কোথাও একটা আগুন লেগেছে, এগিয়ে আসছে তাদের দিকেই। ধোঁয়ার গন্ধ পেয়ে জন্তুগুলো বেড়ার ধারে জড়ো হয়ে আতঙ্কে গুঁতোগুঁতি করছে। তাদের ঠেলাঠেলিতে সেই অশীতিপর বেড়াটা গেল ভেঙে।

যথারীতি টকচু সর্বপ্রথম খোয়ার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। দলের বাকিরাও দেরি না করে তার পিছু নিল। আসন্ন আগুন আর মৃত্যুভয় অজান্তেই তাদের ঠেলে পাঠাল উঁচু উপত্যকায় যাবার পথটায়।

টকচু, যে সব সময় দলের সামনে সামনে চলে, বীচ ফরেস্ট এর কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাঁদিকে ফায়ারব্রেক, উঁচু উপত্যকায় যাওয়ার রাস্তাটা ডান দিকে মোড় নিয়েছে। ভেড়াটা কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছে না। ধোঁয়ার গন্ধ এদিকে যেন তাড়া করে আসছে পিছন থেকে। আবার অন্যদিকে বাঁদিকের চারণভূমি থেকে ভেসে আসছে তাজা তাজা ঘাসের গন্ধ। ভেড়ার দলটা অস্থিরভাবে অপেক্ষা করছে পিছনে। টকচু মাথাটা দুলিয়ে পা বাড়ালো বাম দিকে বা বলা বাহুল্য মৃত্যুর দিকে।

ভেড়া জাতীয় প্রাণী সৃষ্টির তৈরি করা নয়। ভেবে দেখতে গেলে ভেড়াদের বিবর্তনের দীর্ঘ ধারাবাহিকতা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে মানুষের হাতেই। সেই মেসোপটামিয়ার সভ্যতার সময় থেকেই তাদের চালিত করেছে মানুষ। এরাও ছিল মানবজাতির তৈরি করা একটা ‘প্রোডাক্ট’। যেমন যন্ত্রপাতি, কুকুর, কবিতা, গম কিংবা ভুট্টা। শুরু থেকেই ভেড়াদের থেকে তাদের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধির ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তাই বিপদের আঁচ করার কোনো ক্ষমতা তাদের নেই। নিজে থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম তারা। ইচ্ছাশক্তি বা প্রয়াস কোনটাই নেই ওদের। আছে শুধুমাত্র খিদে।

তাই মনের আনন্দে ভেড়ার দলটা উপবনের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে চড়তে লাগল এবং খাদের ধারে এসে থামল। ধাওয়া করে আসা আগুনের কথা ভুলে গিয়ে তারা মনোনিবেশ করল সামনের দৃশ্যত রকরোশ, লরেল, ল্যাভেন্ডার আর লাইলা গাছের দিকে। তারা ঘুণাক্ষরেও টের পেল না আগুনের দাউদাউ শিখা বন পাহাড় বীচ গাছের জঙ্গলটাকে ছারখার করে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। যখন বুঝতে পারলো তখন দলটা ভয়ে কাঁপতে শুরু করল, ফলে যা হওয়ার তাই হল। ভেড়াগুলো একে অপরকে ধাক্কা দিতে লাগল খাদের দিকে।

এবং যথারীতি এক্ষেত্রেও টকচুই প্রথম। উঁচু জায়গা থেকে প্রস্তরখন্ডের উপর আছড়ে পড়ে তার মাথাটা গেল থেঁতলে। তার পিছন পিছন আছড়ে পড়ল একে একে বাকি ভেড়াগুলো। থাইম, দুধ, মধু, তেতো, মিষ্টি যাদের বিচিত্র গন্ধ আর নামের কথা আর কেউ কোনদিন জানতে পারবে না।

মানবসভ্যতার কিছু চিহ্ন অবশিষ্ট ছিল যতক্ষণ তার কাজ তার সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে ছিল। এক সময় কলকারখানা বন্ধ হলো, শহরের কোলাহল থেমে গেল, গান ফুরিয়ে এলো, পারমাণবিক চুল্লি, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, কৃত্রিম উপগ্রহ সব একে একে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে শুধু পড়ে রইলো একটা কুকুর আর একটা ভেড়ার দল।

অবশেষে একদিন সেই কুকুরটাও মারা গেল।

ভেড়াগুলো যখন এক-এক করে খাদে পড়ছিল তাদের পতনের সঙ্গেই মানবজাতি  গুনে নিচ্ছিল তাদের উলে মোড়া শরীরগুলো। মিষ্টি স্বরে ঘুমপাড়ানি গান শোনাচ্ছিল তাদের, ডেকে নিচ্ছিল এক অনন্ত ঘুমে। এই ভেড়াদের সঙ্গেই তাদের কাহিনীও শেষ হয়ে যাবে চিরকালের জন্যে। চিরঘুমে তলিয়ে যাবে তাদের শেষ চিহ্নটুকু।

(লেখকের অনুমতিক্রমে অনূদিত ও প্রকাশিত)

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

6 thoughts on “উপন্যাস-যূথ(এল রেবান্যিও) সেসার মাইওরকী শীত ২০২০

  1. Golpo ta no doubt khub bhalo. Translation tao darun hoyeche. Word to word translate bole mone hochhe na. Bhabanubad bolei mone holo. Baje translation hole porteo bhalo lage na. Ekhane khub smooth holo pora ta. Khub bhalo hoyeche.

    Like

    1. অনেক ধন্যবাদ দীপদা পড়ে তোমার মতামত দেওয়ার জন্য। তোমার অনুবাদ লেখারও আমি ফ্যান। তোমাদের কাজ দেখেই উৎসাহ পাই। ভালো থেকো।

      Like

  2. Fatafati upnyas. Asamnyo anubad. Spanish theke Bangla eto saboleel onubad khub kom i porechi. Lekhikae kache abedon, anubad chaliye jan. Hispanic sahityer songe Banglaar pathorer porichoy hok aro bhalo kore

    Like

    1. অসংখ্য ধন্যবাদ দেবাঞ্জন বাবু। পড়ে মতামত দিলেন খুব ভালো লাগলো। এমন প্রতিক্রিয়া পেলে অনুবাদকদের উৎসাহ অনেক বেড়ে যায় 🙂

      Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s