উপন্যাস-মূর্তি উধাও রহস্য-ছন্দা বিশ্বাস- শীত ২০২০

চয়নের কথার ভিতরে একটা চমক ছিল, যেটা ফোনের এ-পাশে থেকে উপলব্ধি করল তমস।

রামনবমীর দিনেই উধাও হয়ে গেল জানকী মূর্তি! কালো কষ্টিপাথরের তৈরি মূর্তিটা বহুবছরের পুরোনো ছিল। দেড় ফুট উঁচু জানকী মূর্তিটার গলায় ছিল তিন ভরি ওজনের সোনার হার। ব্যাঙকান্দি গায়ের মানুষের কাছে খুবই জাগ্রত ছিলেন এই সীতা মা। সকলে তাকে লক্ষ্মী জ্ঞানে পুজো করত।

সে কতকাল আগের কথা। তখন ব্যাঙকান্দি গাঁয়ের জমিদার ছিলেন হরপ্রসাদ রায় রায়ান। বিশাল প্রতিপত্তি ছিল তাঁর। একদিন রাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন, তাঁর বাড়ির উঠানে স্বয়ং সীতাদেবী দাঁড়িয়ে প্রজাদের অন্নদান করছেন।

ভোরবেলা স্বপ্নটা দেখে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। ভোরের স্বপ্ন নাকি মিথ্যে হয় না। ঘুম থেকে উঠে জমিদার তাঁর গিন্নিকে জানালেন স্বপ্নের কথা। বেলা বাড়লে ডাকা হল তাঁদের কুলপুরোহিতকে, জানানো হল তাঁদের পুরোনো নায়েবমশায়কে।

সেই সময়ে জমিদারমশায় গ্রামের মানুষের জন্যে একটা দিঘি খনন করছিলেন। সেই দিনেই খনন করতে গিয়ে শ্রমিকেরা মাটির ভিতরে একটা মূর্তি দেখতে পেল। কালো পাথরের তৈরি মূর্তিটার গায়ে কাদামাটির প্রলেপ ছিল। জল দিয়ে ধুয়ে দেখা গেল সেটি সীতাদেবীর মূর্তি।

খবরটা দ্রুত জমিদারের কাছে পৌঁছে গেল। ঘটনাটা কাকতালীয় হলেও সত্যি। কুলপুরোহিতের পরামর্শমতো মাটি খোঁড়া বন্ধ রেখে সেখানেই মন্দির প্রতিষ্ঠা হল। যেখানে মূর্তিটা পাওয়া গেল সেখানেই প্রতিষ্ঠা করা হল দেবীকে। মন্দিরের পাশেই শুরু হল পুকুর খোঁড়ার কাজ। এই মন্দিরের গর্ভগৃহটি তাই পাতালে। পনেরোটি সিঁড়ি ধরে নীচেয় নেমে তবে দেবীদর্শন করতে হয়।

জানকীদেবীর এই মন্দির জমিদার হরপ্রসাদ রায়ের তৈরি। মন্দিরের ভিত তৈরির সময়ে তিনি নিজের হাতে ইট গাঁথেন। পোড়া ইটের তৈরি চতুষ্কোণ মন্দিরের চূড়াটি পিরামিডের মতো সূচালো। প্রায় একশো ফুট লম্বা ছিল চূড়াটি। বেনারস থেকে কারিগর আনিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এই মন্দিরটি। জমিদার হরপ্রসাদ রায়ের ইচ্ছা ছিল যাতে বহুদূর থেকে লোকে এই মন্দির দেখতে পায়।

গতকাল রাতেই খবরটা তমস ওর বন্ধু চয়নের কাছ থেকে জেনেছিল। চয়নের পোস্টিং এখন দার্জিলিং-এ হলেও উত্তরবঙ্গের আটটি জেলার দায়িত্ব তার। চয়নের তাই নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। আজ কুচবিহার-আলিপুরদুয়ার তো কাল বালুরঘাট-রায়গঞ্জ, পরশু শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি ইন্সপেকশনে যাচ্ছে তো তরশু ছুটছে মালদা-কালিয়াগঞ্জ। তার চাকরিটাও তো বেশ ঝামেলার। সারাটা দিন চোর, গুন্ডা-বদমায়েশ, চোরা চালানকারী, মাফিয়াদের নিয়ে কারবার।

তমস বুঝতে পারে চয়নের জ্বালাটা। গঙ্গার ওপাড়ে উত্তরবঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থানটা অবশ্য এর জন্যে দায়ী। একদিকে নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং অন্যদিকে সিকিম, বিহার, আসাম, অরুণাচল প্রদেশ হল পার্শ্ববর্তী রাজ্য। সীমান্ত শহরগুলিতে তাই নানান ধরনের অসামাজিক কাজ কর্ম চলে। আর শিলিগুড়ি হল উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার। তাই দেশীয় এবং অন্তঃদেশীয় ব্যাবসাবাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে অবাধে চলছে চোরা কারবার। গোয়েন্দা পুলিশ এবং শুল্ক বিভাগের অফিসারদের একেবারে নাজেহাল অবস্থা।

তমসের হাতে এই মুহূর্তে তেমন কোনো কাজ ছিল না। ওদিকে চয়নের তখন ভীষণ কাজের চাপ। তাই চয়নের মুখে খবরটা শোনামাত্র ওর মনের ভিতরে গোয়েন্দা ফিঙে পাখিটা ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে লেজ নাড়তে লাগল। নিজে ডিসিশন নেবার পরে দীপ্তেনকে একবার ফোন করল—“কী রে, যাবি নাকি?”

“কোথায়?”

“নর্থ বেঙ্গল।”

“নর্থ বেঙ্গলের কোথায়?”

“ব্যাঙকান্দি গ্রাম।”

নামটা শুনে দীপ্তেন খানিক হেসে নিয়ে বলল, “এত জায়গা থাকতে ব্যাঙকান্দি গ্রাম? কেন, সেখানে কি খালি ব্যাঙ কান্নাকাটি করে?”

“ব্যাঙ কাঁদে কি না জানি না, কিন্তু মানুষ বড়ো কাঁদছে।”

“সেটা আবার কোন মুলুকে?”

“আগে তো বাগডোগরা এয়ারপোর্টে নামি, তারপর দেখা যাবে।”

এরপর সংক্ষেপে তমস চয়নের কথাগুলো রিপিট করে দীপ্তেনের কৌতূহলকে সাময়িকভাবে স্তিমিত করল।

এক

তমসের কথামতো রাতেই গুছিয়ে নিয়েছিল দীপ্তেন। তাই সকালের ফ্লাইট ধরতে ওদের কোনোরকম অসুবিধাই হল না। এবারে আর তনয়কে পাওয়া গেল না। অগত্যা দীপ্তেনকে সঙ্গী করেই রওনা দিল।

একজন সুন্দরী তরুণী পাইলট অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে প্লেনটাকে মাত্র চল্লিশ মিনিটে বাগডোগরার রানওয়ে স্পর্শ করাল।

ফ্লাইট থেকে বাইরে এসে তমস দেখল ঘন কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে আছে। মনে হচ্ছে খানিক বাদেই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামবে। চারদিক থম থম করছে।

টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে তমস চয়নকে একটা ফোন করল। চয়ন জানাল, সে ড্রাইভারের নাম এবং ফোন নাম্বার অলরেডি তমসের হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ করে দিয়েছে।

খুব বেশি বেগ পেতে হল না। পার্কিং-এ আসার পথেই একজন আটাশ-ত্রিশ বছর বয়সের নেপালি ড্রাইভার তমসের দিকে এগিয়ে এসে হাতজোড় করে বলল, “নমস্তে স্যার, আমি সুরজ তামাং, আমার গাড়ি এই তো সামনে। আপনেরা এই জায়গায় একটু ওয়েট করেন, আমি নিয়া আসছি।”

তমস ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল দশটা বাজে। কিন্তু পরিবেশ বলছে এখন সন্ধ্যা সমাগত। ঘন কালো মেঘে চতুর্দিক ছেয়ে গেছে। দিনের শেষ আলোকবিন্দুটুকু শুষে নিয়েছে কালবৈশাখী মেঘ। পাখিরা ভয়ার্ত স্বরে ডাকাডাকি করছে।

এই পরিস্থিতিতে তমস বুঝতে পারছে না কী করা উচিত—তারা গাড়িতে উঠবে, নাকি এয়ারপোর্টে আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করে পরিবেশ শান্ত হলে তারপর পথে নামবে।

সুরজই ওদের সমস্যার সমাধান করে দিল। বলল, “স্যার, আগে বাতাসবাড়ি চলেন যাই। সেখানে গিয়ে নাহয় ফ্রেশ হয়ে চা-কফি, ব্রেকফাস্ট খেয়ে ধীরে সুস্থে বেরোনো যাবে।”

তমস ঘাড় নাড়ে। কথাটা সুরজ মন্দ বলেনি। এখানে সময় নষ্ট না করে বাতাসবাড়িতে চলে গেলে ভালো হবে। তাছাড়া সকালে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। দমদম এয়ারপোর্টে এসে একটা স্যান্ডউইচ আর কফি কিনে খেয়েছিল। সে তো কখন হজম হয়ে গেছে।

“বাতাস বাড়ি এখান থেকে কতদূর?” দীপ্তেন জানতে চায়।

“খুব বেশি দূর নয়, বড়োজোর আধা ঘণ্টা সময় লাগবে। রাস্তা এক্কেবারে সেইই। একবার উঠলেই চোখের নিমেষে পৌঁছে যাবেন।”

“আমরা কি একত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে যাব?”

“ঠিক ধরেছেন স্যার, কিছুদিন হল কাজ কমপ্লিট হয়েছে। এক্কেবারে ঝকঝকে তকতকে রাস্তা। রাস্তাতে মনে হচ্ছে ভাত ঢেলে খাওয়া যাবে।”

সুরজের কথা শুনে তমস দীপ্তেনের হাতে একটু চাপ দেয়। দীপ্তেন তমসদার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে হেসে ফেলে।

সুরজ গাড়ি চালাতে চালাতে বলে, “হাসির কথা না বাবু, দেখলেই বুঝতে পারবা।”

তমস সুরজকে বলে, “তুমি তো দেখছি খুব ভালো বাংলা বলতে পারো।”

“আমার জন্ম তো এখানেই স্যার।”

“এখানে বলতে?”

“শিলিগুড়িতে। আমি তো এখানকার হিন্দি স্কুলেই পড়াশুনা শেষ করছি। আমার বাবার বাবা নেপাল থেকে কাজের ধান্দায় এখানে চলে আসে। সেই থেকে আমরা এখানকার বাসিন্দা হইছি।”

বাগডোগরা-নকশাল বাড়ি হাইওয়ে ধরে বেশ কিছুটা যাওয়ার পরে একটা বেশ বড়ো চা বাগিচা পড়ল। কালো মেঘের নীচে সবুজ গালিচা বিছানো বাগিচাটা দেখতে বেশ লাগছিল। দীপ্তেন তাকিয়ে দেখে নিল রাস্তার পাশে সাইন বোর্ডে লেখা আছে ‘ডেরেক টি এস্টেট’। কয়েক হাজার একর জমি নিয়ে এই বাগিচা। সেই বাগিচার ভিতর দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। তমস দীপ্তেনকে দেখাল বাগানের একপাশে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছে চায়ের কারখানা।

দীপ্তেনের খুব ইচ্ছা হচ্ছিল কীভাবে চা তৈরি হয় দেখার। কিন্তু এখন যেহেতু ওরা একটা কাজে বেরিয়েছে সেইজন্যে এই মুহূর্তে সময় নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই ওদের। তাছাড়া আকাশের অবস্থা ভালো নয়। যে-কোনো সময় ঝড় উঠতে পারে। তাই সবার আগে একটা ভালো জায়গায় শেল্টার নিতে হবে।

প্রায় একশো কিমি বেগে ছুটছে স্করপিও। ডেরেক টি এস্টেট ছাড়িয়ে আরো মাইল খানেক পথ চলার পরে বাঁদিকে একটা রাস্তা চলে গেছে ঘুমবাড়ির দিকে।

দীপ্তেন রাস্তার পাশে একটা যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে নামটা পড়ে তমসকে বলল, “দেখো তমসদা, এটা ঘুমবাড়ি যাওয়ার পথ। তুমি আবার ঘুমিয়ে পড়ো না যেন।”

তমসদাকে কথাটা বললেও দীপ্তেনের নিজেরই সত্যি ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। সেটা এই ছায়াঘেরা জায়গার জন্যে কিছুটা হলেও আসল কারণ হল ওর কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি। কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে ওর কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। তাই এই ছায়াচ্ছন্ন পরিবেশ, মিষ্টিমধুর হাওয়া অনুঘটকের কাজ করল। ঘুমবাড়ির হাট ছাড়ানোর পরে আস্তে আস্তে জঙ্গল শুরু হল। শাল, সেগুন, মেহগনি, গামারগাছের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে বাতাসবাড়ির দিকে।

তমস দীপ্তেনকে বলল, “বাতাসবাড়ি নামটা কেমন সুন্দর না?”

সুরজ বলল, “হ্যাঁ স্যার, ওখানে গরমে সকলে যায় হাওয়া খেতে। একটা পাহাড়ি নদী আছে, ঝোরা থেকে বেরিয়েছে। সেই নদীর পাড়ে শীতে মানুষজন আসে পিকনিক করতে। বাতাসবাড়িটা সেই নদীর পাড়ে।”

সুরজ  বলে, “দেখেন স্যার, এতটুকুন বাড়িয়ে বলছি না, এখনই দেখছেন কেমন সুন্দর ঠান্ডা বাতাস ছাড়ছে?”

তমসের সঙ্গে সঙ্গে দীপ্তেনও ঘাড় নাড়ে, “তা যা বলেছ।”

পরক্ষণেই তমস বলে, “মনে হচ্ছে এটা কালবৈশাখীর ঝোড়ো বাতাস শুরু হয়েছে?”

সত্যিই জঙ্গলের ভিতরে গাছের ডালপালাগুলো প্রচণ্ডরকম আন্দোলিত হতে শুরু করেছে। গাছে গাছে যেভাবে ঝাপটা লাগছে, তাকে ঝড় বলা চলে। সেই সঙ্গে একটা শো শো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রাস্তার পাশের বিশাল বিশাল উঁচু গাছগুলো দেখলে ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বুঝি হুড়মুড়িয়ে গায়ের উপরে ভেঙে পড়বে।

দুই পাশে ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। এপথে চল্লিশের বেশি স্পিড তোলার কথা নয়। কিন্তু সুরজের এখন নব্বই থেকে একশোতে চলছে। একবার কালবৈশাখী শুরু হলে ঝড়ে অনেক সময় বড়ো বড়ো গাছ কিংবা মোটা ডাল ভেঙে গিয়ে রাস্তা আটকে যেতে পারে।

তমস জানতে চাইল, “আর কতদূর?”

সুরজ কোনো উত্তর দিল না। ওর চোখ এখন সামনের দিকে। এখন তার একটাই টার্গেট, ঝড়ের আগেই তাদের বাতাসবাড়িতে পৌঁছতে হবে। নইলে কালবৈশাখীর কবলে পড়লে তাদের কপালে কী দুর্ভোগ আছে কে জানে।

দুই

ব্যাঙকান্দি গ্রামে ঢোকার আগেই পাকা সড়ক থেকে দেখা যাচ্ছিল মন্দিরের চূড়া। চয়ন এই চূড়াটার কথা বলে দিয়েছিল, তাই তমসদের চিনতে কোনোরকম অসুবিধাই হয়নি।

প্রায় পাঁচ একর জমির উপরে নির্মিত হয়েছে মন্দির এবং উদ্যান। মন্দিরের পিছনে রয়েছে বেশ বড়ো সড়ো একটা পুকুর। স্থানীয় লোকেরা বলে দুধপুকুর। এই দুধপুকুরের জল দিয়ে প্রতিদিন সীতা মাকে স্নান করানো হত। পুকুরের চারধারে নারকেল এবং সুপারিগাছের সারি। ঘাট বাঁধানো সিঁড়ির ধাপগুলো একেবারে নীচের দিকে নেমে গেছে যাতে শীতের সময়ে জল কমে গেলেও পুকুর থেকে জল তোলা যায়।

পুকুরঘাটের পাশেই আছে বিশাল এক কৃষ্ণচূড়া এবং তার পাশেই একটা রাধাচূড়ার গাছ। কত পাখি উড়ে এসে বসেছে তার ডালে। তারা মনের সুখে গান গাইছে, শিস দিচ্ছে, এ ডাল থেকে আরেক ডালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাঠবেড়ালি কুটুর কুটুর করে দানা চিবাচ্ছে। দোয়েল মনের সুখে শিস দিচ্ছে, কাঠঠোকরা শুকনো মরা ডালে ঠোক্কর দিচ্ছে ঠকঠক শব্দে। একদল বেজি ঘুরে বেড়াচ্ছে উদ্যানের ঘাসের ভিতরে। বাগানে নানা জাতের ফুল ফুটে আছে।

তমস আর দীপ্তেন ঘুরে ঘুরে মন্দিরের চারপাশটা দেখে নিল। তারপর মন্দিরের ভিতরে ঢুকল। কয়েকজন সেবায়েত মন্দির সংলগ্ন চাতালে ব্যাজার মুখ করে বসে ছিল। তমসদের দেখে একটু নড়েচড়ে বসল। কাঁধের গামছাটা দিয়ে চোখমুখ মুছে নিল। তমস এগিয়ে গেল মূল মন্দিরের দিকে। লোহার গেট। গেট খোলাই ছিল, তবে একপাশে তালা ঝুলছিল।

তমস বলল, “আমি কলকাতা থেকে আসছি। শুনলাম এখানকার মূর্তিটা নাকি চুরি হয়ে গেছে?”

লোকগুলো সেইরকম ব্যাজার মুখেই মাথা নাড়াল। তারা ধরে নিল, মনে হয় কোনো সংবাদসংস্থার লোক। এই ক’দিন তো একের পর এক তারা আসছে। বিগ্রহহীন মন্দিরের  ফটো তুলে নিয়ে যাচ্ছে, আর প্রশ্নে প্রশ্নে তাদের নাজেহাল করে ছাড়ছে।

তমস আর দীপ্তেন নীচের গর্ভগৃহ থেকে ঘুরে এসে বলল, “আর কিছু কি খোয়া গেছে?”

“গ্যাছে তো, প্রায় তিন কেজি সোনার গহনা, পনেরো-ষোলো কেজি রূপার গহনা, দেড় মনেরও বেশি পিতল-কাঁসার বাসন ছিল, সব গ্যাছে।” একজন বয়স্ক সেবায়েত উঠে এসে জানাল।

“কত রাত পর্যন্ত খোলা থাকে এই মন্দির?”

“সাধারণত সন্ধের সময়ে পূজা এবং আরতির পরেই গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। শীতকালে সাতটা আর গরমকালে রাত আটটার ভিতরেই মূল মন্দিরে তালা পড়ে যায়। তবে এই কয়দিন রামনবমী উপলক্ষ্যে নানান অনুষ্ঠান হয়েছিল। বাইরে থেকে প্রচুর ভক্তেরা এসেছিলেন। তাই রাত নয়টা পর্যন্ত সকলকে দেবী দর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।”

“মন্দির বন্ধ হয়েছিল ক’টার সময়?”

“সব কাজ সারতে সারতে রাত দশটা বেজে যায়। দেবীর পোশাক পালটানো, দেবীর অঙ্গরাগ লেপন, রাতপোশাক পরানো, বিছানা করে মশারি টাঙিয়ে দেবীকে শয়ন করানো ইত্যাদি নিয়ম পালন করে রাত দশটার দিকে আমরা চলে যাই।”

“কোথায় চলে যান?”

“সেদিন পাশের মাঠে বেশ বড়ো একটা যাত্রাপালা হয়েছিল। কলকাতা থেকে যাত্রাদল এসেছিল। সেটা দেখার জন্যে যাই। অবশ্য মন্দিরের দ্বাররক্ষী ছিল।”

“আপনারা সকলেই মানে প্রধান পুরোহিত, তাঁর সহকারী, সেবায়েতরা সকলেই?”

“হ্যাঁ। এটা নতুন কিছু নয়। এর আগেও আমরা এদিক সেদিক গেছি দারোয়ানের উপরে ভরসা করেই।”

“তাহলে চুরিটা হল কী করে?”

লোকটা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “আমরা বারোটার দিকে ফিরে এসে দেখি দারোয়ান মাটিতে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। আর মন্দিরের প্রধান দরজার তালা ভাঙা। ভিতরে গিয়ে দেখি গর্ভগৃহেরও তালা ভাঙা আর সীতা মা উধাও। প্রণামী বাক্সের তালা ভেঙে তার ভিতর থেকে টাকাপয়সা সব নিয়ে গেছে। তারপর পাশের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখি সেই ঘরটারও তালা ভাঙা। ওই ঘরে মায়ের গয়নাগাটি এবং পুজোর জিনিসপত্র থাকত। ঢুকে দেখি লোহার ট্রাঙ্কের তালা ভেঙে তার ভিতর থেকে দেবীর গয়নাগাটি এবং বাসনপত্র নেই।”

“প্রণামী বাক্সে আনুমানিক কত টাকা ছিল?”

“তা ধরুন হাজার পঞ্চাশ তো হবেই। তার বেশি ছাড়া কম না। রামনবমীর দিনেই তো কুড়ি হাজারেরও বেশি দর্শনার্থীর সমাগম হয়েছিল।”

“টাকাগুলো তো সেদিন গোনা হয়নি, তাহলে এই হিসাব কীভাবে পেলে?”

“আমাদের ভোগের জন্যে টোকেন দিতে হয় না, মাথাপিছু কুড়ি টাকা? তা থেকেই আমরা দর্শনার্থী অনুমান করতে পারি।”

“আর প্রণামী?”

“সেটা আলাদা। যে যা খুশি হয়ে দেয়। এই আর কী।”

“তাহলে তো কোনো হিসাব থাকে না।”

“তবু প্রতিবারের হিসাব থেকে অনুমান করে বললাম। যারা বেশি অঙ্কের টাকা ডোনেশন দেন তাঁরা সরাসরি মন্দিরের ফান্ডেই দান করেন।”

“সেই টাকা কোথায় থাকে?”

“তার জন্যে ব্যাঙ্কে আলাদা অ্যাকাউন্ট আছে। এই যে বার্ষিক উৎসব হয়, তখন সেখান থেকেই খরচ করা হয়। তাছাড়া অনেক ব্যবসায়ী লোকাল পঞ্চায়েত মন্দিরে দান করেন।”

তমস কথার ভিতরে লক্ষ করল, একজন কিছুটা দূর থেকে ওদের লক্ষ করছে। কী কথাবার্তা হচ্ছে সেটা বোঝার চেষ্টা করছে।

তমস সবকিছু শোনার পরে মাথা নেড়ে বলল, “এছাড়া আর কিছু চুরি হয়েছে কি?”

“হ্যাঁ, সেদিন রাতে বুঝতে পারিনি, পরেরদিন সকালে মন্দিরে যখন পুলিশ এল তখন দেখি পাশের নাটমন্দিরেরও তালা ভাঙা।”

“সেখানে দামি কিছু ছিল?”

“হ্যাঁ, গোবিন্দের মাথার রূপার মুকুট আর তাঁর হাতের রূপার বাঁশিটাও দেখি চোরেরা নিয়ে গেছে।”

দীপ্তেন চুপচাপ সবকিছু শুনতে লাগল।

তমস বলল, “দেবীর জিনিসপত্রগুলো যে এই ভিতরের পাতালঘরেই থাকত সেকথা তো  মন্দিরের ভিতরের লোক ছাড়া আর কারো জানার কথা নয়। সেক্ষেত্রে কাউকে তোমার সন্দেহ হয়?”

“কাকে আর সন্দেহ করি বলেন? আমরা তো এখানে বহুকাল ধরে আছি। একেবারে বংশপরম্পরা ধরে দেবীর সেবা করে আসছি।”

“দারোয়ানের বাড়ি কোথায় বলতে পারবে?”

“ও বিহারের লোক। আগে ওর বাপ-ঠাকুর্দারা এখানে পাহারা দিত, তারপর ও আর একজন এখানে দিনে রাতে ডিউটি করছে। ওরা খুব বিশ্বাসী। একাজ ওরা কক্ষনো করতে পারে না।”

“এখানে বাইরের কোনো লোক আসে?”

“সে তো আসেই। জানকী মাকে দর্শন করতে বহু দূর দূর থেকে সবাই আসে। মানত করে যায়। আবার তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হলে পূজা দিয়ে যায়। বিশেষ করে রামনবমীতে এইখানে বেশ বড়ো মেলা বসে। হাজার হাজার লোক আসে। নেপাল, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা, বাংলাদশ থেকেও লোক আসে সেই সময়ে। আশেপাশের বাড়িগুলিতে হোম-স্টের ব্যবস্থা করা হয়। এবারেও তো বসেছিল এই পাশের মাঠে। কিছু অস্থায়ী ছাউনি করা হয়েছিল দর্শনার্থীদের থাকার জন্যে। একটা বিশাল বড়ো অতিথিশালা বানানোর জন্যে কাজ শুরু হয়েছিল, কিন্তু কীসব জমি সংক্রান্ত আইনি জটিলতার জন্যে কাজকর্ম আটকে আছে।”

তমস লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মন্দিরের ভিতরটা ঘুরে বাইরে বেরিয়ে এল।

প্রধান পুরোহিত মন্দিরের একপাশে মাথা নীচু করে বসে ছিলেন। তমস আর দীপ্তেনের দিকে একনজর তাকিয়ে আবার আগের অবস্থায় বসে রইলেন।

তমস বুঝতে পারল লোকটার কথা বলার মতো কোনো ইচ্ছাই নেই। আবার এমনও হতে পারে, অনেকের কাছে জবাবদিহি করতে করতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তমসকে তার চেনার কথা নয়। আর তমস নিজের পরিচয় দিতে চাইছে না এই মুহূর্তে। সে আর দীপ্তেন একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে এখানে এসেছে। যেমন অন্যেরা এসেছে এর আগে। তমস প্রধান পুরোহিতকে না ঘাঁটিয়ে এগিয়ে গেল নাটমন্দিরের দিকে।

একজন গেরুয়া বসনধারীকে দেখা গেল রাধাগোবিন্দ মন্দিরে। গলায় পৈতে, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত অবস্থায় বেশ ভক্তিভরে কৃষ্ণ ঠাকুরের গলা থেকে পুরোনো বাসি মালা সরিয়ে নতুন মালা পরাচ্ছে। তমসের চোখ বলল এ-ই সেই সময়ে তাদের লক্ষ করছিল।

তমস লোকটার কাছ থেকে খুঁচিয়ে কিছু কথা জেনে নিল। তার নাম কেশব, সে এখানকার সহকারী পুরোহিত। বাড়ি পাশের লতাপাতা গ্রামে। এই মন্দিরের পিছনের ঘরগুলোতে থাকে প্রধান পুরোহিত এবং তিনজন সেবায়েত। আর তার পাশেই রয়েছে টিনের ছাউনি দেওয়া একচালা পাচক বামুনের ঘর। কেশব সারাদিন পূজা-আর্চা করে নিজের গ্রামে ফিরে যায়। তবে এখানে তারও একটা ঘর আছে। দিনের বেলায় বিশ্রাম নেয় সেখানে।

তমস আর দীপ্তেন এরপর নাটমন্দির থেকে বেরিয়ে মন্দিরের পিছনের দিকে চলে আসে।

মন্দিরের পিছনে কিছু মাটির তৈরি বিভিন্ন দেবদেবীর ভাঙা মূর্তি পড়ে আছে। কারো হাত ভাঙা, কারো হাতের আঙুল নেই, মাথার দিকটা ভাঙা। মনে হচ্ছে পুরাণে বর্ণিত নানান দেবদেবীর মূর্তি। তার ভিতরে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহাদেব এবং হনুমান ঠাকুরের মূর্তিও আছে। আছে রামসীতার যুগলমূর্তি। মহামুনি দুর্বাসার এবং বিশ্বামিত্রের মূর্তি। মনে হচ্ছে বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানের সময়ে এই মূর্তিগুলোর প্রয়োজন হয়।

এখানে এসে একটি ছেলের সঙ্গে দেখা হল। তার কাছ থেকে কয়েকটা তথ্য পেল। এই যেমন প্রধান পুরোহিতের নাম সাধন পণ্ডিত। বাড়ি বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলায়। কেশব স্থানীয়। বছর খানেক হল সে এই মন্দিরে সহকারী পুরোহিতের দায়িত্ব নিয়েছে। বয়স্ক সেবায়েত বিল্ব ঠাকুর, বাড়ি জলপাইগুড়ি হলেও এই মন্দিরেই থাকেন। এখন যার সঙ্গে কথা হচ্ছে সেই রাম ভগতের বাড়ি মুঙ্গের জেলায়। পাঁচ বছর হল সে এই মন্দিরে এসেছে। দারোয়ানের কাজ করে।  অপর সেবায়েত হল কিষাণ ভগত।

রাতের দারোয়ান তখনো পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে। তার নাসিকা গর্জন বলে দিচ্ছে তাকে এই সময়ে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।

তমস রাতের দ্বাররক্ষী বিনোদ প্রসাদের কাছে গেল। দিনের বেলা যেহেতু সবসময়ে পুরোহিত, সেবায়েতরা মন্দিরে থাকেন তাই দারোয়ান একটু কাজে শৈথিল্য দেখায়। আসলে মন্দির থেকে যে এইভাবে মূর্তি এবং জিনিসপত্র সব চুরি হয়ে যেতে পারে, এই চিন্তাটা তাদের মাথাতেই আসেনি। এত জাগ্রত মন্দিরে হাত দেবার সাহস কার? এই বিশ্বাস্টা তাদের মনে বরাবর কাজ করত।

দারোয়ান বিনোদ প্রসাদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে এগিয়ে গেলে রাম ভগত এগিয়ে এসে জানায়, কিছুদিন আগে থানা থেকে একটা ইনফর্মেশন দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন মন্দির, দেবদেবতার থান থেকে যেভাবে পুরোনো সব মূর্তি দুষ্কৃতিরা চুরি করছে সেইজন্যে এখানেও নজরদারীর ব্যবস্থাটা রাখতে হবে। আগে শুধুমাত্র রাতেই পাহারাদার ছিল, কিছুদিন হল দিনের বেলাতেও পাহারাদার রাখা শুরু হল সেই কথা ভেবে। তাতেও শেষরক্ষা হল না।

দীপ্তেন লক্ষ করল, রাম বেশ গুছিয়ে কথা বলায় পারদর্শী। তমস রামকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি বরাবর দিনেই ডিউটি করো, নাকি রাতেও করতে হয়?”

“আজ্ঞে না, আমি এখানে দিনেই ডিউটি করি, আর রাতে অন্য এক জায়গায় ডিউটি করি।”

“কোথায়?”

“ওই শহরের একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে রাত পাহারার কাজ করি।”

“রাতে ডিউটি করে এখানে আবার সারাটা দিন ডিউটি করো, তাহলে ঘুমাও কখন?”

তমসের কথা শুনে রাম ভগত মাথার চুলগুলো একটু ঘেঁটে নিয়ে বলে, “ওখানে কাজ তেমন কিছুই না। ওই বারোটা পর্যন্ত একটু ঘোরাফেরা করি টর্চ জ্বেলে, বাঁশি বাজাই, বিল্ডিংয়ের সব ঘরে তো তালা লাগানোই থাকে, তারপর প্রিন্সিপালের রুম এবং কম্পিউটার রুমের সামনে বিছানা পেতে শুয়ে পড়ি। ওখানে বেশ কিছু কম্পিউটার এবং আলমারিতে দামি জিনিসপত্র আছে, তার জন্যেই পাহারা দিতে হয়।”

তমস কয়েক পা এগিয়ে যেতেই রাম ভগত জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা, আপনেরা কি কাগজের লোক?”

তমস একটু গম্ভীর  হয়ে জানায়, “সেরকমই বলতে পারো। কিন্তু কেন বলো তো?”

“নাহ্‌, তেমন কিছু না, ওই একটু জানতে ইচ্ছা করল তাই। অনেকেই তো আসছে।”

তমস রাম ভগতের কাছ থেকে ও যে স্কুলে ডিউটি করে সেই স্কুলের নামটা জেনে নিল—রামতনু কনভেন্ট, মাটিগাড়া।

তমসের আর এখানে তেমন কোনো কাজ ছিল না, তাই ওরা মন্দিরের চারপাশটা একটু এদিক সেদিক ঘুরে দেখে নিয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে পড়ল।

তিন

মাটিগাড়াতে এসে অনেকের কাছে রামতনু কনভেন্টের কথা জিজ্ঞাসা করল তমস, কিন্তু মাটিগাড়াতে রামতনু কনভেন্ট বলে কিছু আছে কি না কেউই বলতে পারল না। তমস বুঝতে পারল না রাম ভগত কেন তাদের মিথ্যা কথা বলেছে। তবে ও রাতে যে কোনো কাজ করে সেটা সত্যি। কিন্তু রাম ওদের কাছে মিথ্যা বলতে গেল কেন?

দীপ্তেনকে নিয়ে তমস এখন চয়নের কোয়ার্টারে এসেছে। কেয়ারটেকারের কাছে চাবি রাখা ছিল, আর তমসদের কথা আগেই বলা ছিল—‘কলকাতা থেকে একজন অফিসার আসছেন, সুতারাং তাদের ঠিকঠাক দেখভালো কোরো।’

চয়নের কোয়ার্টারটা ব্যাঙডুবিতে। এখান থেকে ব্যাঙকান্দি গ্রাম খুব বেশি দূর নয়। ফেরার সময়ে সুরজ একটা শর্টকাট রাস্তা দিয়ে নিয়ে এল। তাই সময়টা আরো একটু কম লাগল।

তমস দীপ্তেনের কাছে জানতে চাইল, “কী যেন নাম গ্রামটার?”

“কোন গ্রামের নাম জানতে চাইছ?”

“ওই তো একটু আগেই যে গ্রামের ভিতর দিয়ে আমরা এলাম। দুই ধারে পুকুর, বেশ ছায়াচ্ছন্ন।”

“লতাপাতা গ্রামের কথা বলছ কি?”

“ঠিক বলেছিস। আমার মাথায় ‘পাতাবাহার’ নামটাই ঘুরে ফিরে আসছে। এই গ্রামেই তো শুনলাম কেশবের বাড়ি, তাই না?”

“হুম, তাই তো শুনলাম।”

“একটা জিনিস লক্ষ করেছিস? গ্রামটাতে কিন্তু বেশীরভাগ হতদরিদ্র পরিবারের বাস। তার ভিতরে একমাত্র কেশবের বাড়িটা চোখে পড়ার মতো, তাই না?”

“গোবরে পদ্ম ফুটে আছে মনে হল।”

ভাঙাচোরা ঘরবাড়ির ভিতরে চোখে পড়ার মতো তিনতলা বাড়িটা কেশবের। একজন গ্রামবাসীকে জিজ্ঞেস করাতে সে হাত তুলে দেখিয়ে দিল।

দীপ্তেনের কথা শুনে তমস হেসে ওঠে, “এক্কেবারে ঠিক বলেছিস। মাঝে মাঝে তুই দুই একটা যা কমেন্ট করিস না, একেবারে বাঁধিয়ে রাখার মতো।”

তমস ভাবছে জানকী মন্দিরের কথা। মন্দিরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছাড়াও প্রতিদিন অনেক লোক আসে প্রতিমা দর্শন করতে। পুজো দিতে আসে। তারা প্রণামী বাবদ টাকাপয়সা দিয়ে যায়। সেই টাকা থেকে এতগুলো লোকের দিন গুজরান হয়, মন্দিরের যাবতীয় খরচাপাতি চলে। এতক্ষণ যাদের সঙ্গে দেখা হল তাদের বয়স বেশি নয়। এক সাধন পণ্ডিত ছাড়া সবাই বিবাহিত। প্রত্যেকের বাড়িতে বউ-বাচ্চা আছে। এই মন্দিরের নিশ্চয়ই ভালো এমন আয় আছে যে সেই টাকা দিয়ে তাদের জীবিকানির্বাহ হয়। এক প্রণামী বাক্সে একদিনেই প্রায় পঞ্চাশ হাজার জমা পড়েছে শুধু দর্শনার্থীদের টাকা। বাকি দানের টাকা আলাদা।

কথা বলতে চয়নের কোয়ার্টারে সামনে ওরা চলে এল। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে। সারাটা দিন বেশ ধকল গেছে। আজ রাতটা চয়নের কোয়ার্টারেই ওরা কাটিয়ে দিল।

 

পরের দিন সকালে ঠিক সময়ে সুরজ এসে হাজির হয়েছে।

তমস আর দীপ্তেন আশেপাশে একটু ঘুরে এল। নকশালবাড়ি হয়ে যে রাস্তাটা ভারত-নেপাল বর্ডার ধূলাবাড়ির দিকে চলে গেছে, সেইদিকে গেল। পানি-ট্যাঙ্কিতে আসার পরেই ধূলাবাড়ি চেক পোস্ট। সামনেই মেচি নদী। নদীর ওপারে চেক পোস্ট।

নদীর ওপরে ব্রিজ। ব্রিজ পার হয়ে সুরজ চেক পোস্টে কাগজপত্র দেখিয়ে ধূলাবাড়িতে ঢুকে গেল। মেচি নদীতে তেমন জল ছিল না। সুরজ জানাল, বর্ষায় এই নদী ভয়ংকর হয়ে ওঠে।

ধূলাবাড়িতে তেমন কিছুই দেখার নেই। তবে মার্কেট আছে, সেখানে অনেক কিছু পাওয়া যায়। দীপ্তেন আর তমস সেই মার্কেটে ঢুকে ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র দেখল। সুরজ সঙ্গেই ছিল। দীপ্তেনকে বলল, “এর চাইতে শিলিগুড়ির হংকং মার্কেটে ঢের ভালো জিনিস পাওয়া যায়। আর দামেও বেশ সস্তা। একটু বুঝেসুঝে বার্গেনিং করতে হয় এই যা।”

দীপ্তেন একটা ছোটো এল.ই.ডি চার্জেবল টু-ইন-ওয়ান টর্চ কিনল ধূলাবাড়ি মার্কেট থেকে। টর্চ, কিন্তু টেবিল ল্যাম্প হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। ফুল চার্জ দেওয়া থাকলে লোডশেডিং-এর সময়ে ঘণ্টা খানেক তাতে বই পড়া যাবে।

দীপ্তেন সুরজের সঙ্গে এটা সেটা দেখতে লাগল আর সেই সময়ে তমস সেই সময়ে কাঠমান্ডুগামী বাস স্ট্যান্ড থেকে সিগারেট কিনে চারপাশটা একটু দেখতে লাগল।

এদিকে দোকানদার থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটে যাদের দেখছে, অধিকাংশই নেপালি। জিনিসপত্রের দামও বেশ চড়া।

তমস হঠাৎ একটি দোকানে জানকী মন্দিরের সহকারী পুরোহিত কেশবকে দেখতে পেল। ‘কেশব এখানে কী করছে?’ নিজের মনেই বলল তমস। ভালো করে লক্ষ করে দেখল, কেশব একজন বাস কন্ডাক্টরের সঙ্গে কথা বলছে। বাস কন্ডাক্টর ছেলেটার চেহারা ভারি অদ্ভুত। অদ্ভুত তার চুলগুলো। টি আকৃতির জুলপি। বেশ মন দিয়ে কেশবের কথা শুনছে। হতে পারে কিছু দরকার আছে, ভাবল তমস।

ধূলাবাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে গেল। সুরজকে ছেড়ে দিয়ে তমস আর দীপ্তেন একটু বিশ্রাম করে নিল।

সুরজকে আবার বিকেলের দিকে আসতে বলে দিল। ওর বাড়ি আপার বাগডোগরায়। এখান থেকে মিনিট পনেরো লাগে গাড়িতে। কিন্তু জ্যাম থাকলে আধঘণ্টা-চল্লিশ মিনিটও লেগে যায়। সেটাও বলে গেল সুরজ।

তমস আর দীপ্তেন দুপুরে সবে একটু রেস্ট নিচ্ছে, সেই সময় ঘরের দেওয়ালের গায়ে ধুপ ধুপ আওয়াজ হতে লাগল। দীপ্তেন গেট খুলে বাইরে এল। একটি দশ-এগারো বছরের ছেলের সঙ্গে আলাপ হল দীপ্তেনের। বেশ সপ্রতিভ ছেলেটা। হাতে একটা ক্রিকেট ব্যাট আর বল নিয়ে চয়নের পাঁচিলে একা একাই খেলছিল। আর জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিল।

তমস তখন একটা ল্যাপটপ খুলে দরকারি কাজ করছিল। দীপ্তেন দুপুরের রোদ্দুর কখন ঝিমিয়ে পড়বে সেই অপেক্ষাতেই ছিল। দুপুরে ঘুমাতে চায় না দীপ্তেন। বেশ কিছুটা সময় বই পড়ে কাটাল।

ছেলেটি দীপ্তেনকে দেখে বলল, “তোমরা কি চয়ন আঙ্কেলের গেস্ট?”

“হুম।”

“আমার সঙ্গে খেলবে?”

দীপ্তেন বলল, “খেলতে পারি, তবে অল্প সময়ের জন্যে।”

“কেন?”

“একটু পরেই আমাদের একটা জায়গায় যেতে হবে।”

“কোথায় যাবে তোমরা?”

“একটু হংকং মার্কেটে যাব।”

“তোমার সঙ্গে যিনি আছেন উনি কি একজন গোয়েন্দা?”

ছেলেটার কথা শুনে দীপ্তেন হঠাৎ সতর্ক হলে গেল। ও সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে বলল, “উনি আমার দাদা হন। আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি। কিন্তু তোমাকে এসব কথা কে বলেছে?”

“আমার মা বলেছে। চয়ন আঙ্কেলের রিলেটিভ না তোমরা?”

“তুমি চয়নদাকে চেনো?”

“ওমা, চিনব না কেন? চয়ন আঙ্কেল তো আমার বাবার বেস্ট ফ্রেন্ড।”

“ও, তাই বুঝি?”

“ওই যে ওদিকে আমাদের কোয়ার্টার।” ছেলেটা ডানদিকের চারতলা বাড়িগুলো দেখাল। একেবারে ফ্ল্যাটবাড়ির মতো দেখতে কোয়ার্টারগুলো।

কথা বলতে বলতেই সুরজ গাড়ি নিয়ে ঢুকে গেলে দীপ্তেন ছেলেটাকে বলল, “আর খেলতে পারব না, এবারে আমাদের বেরোতে হবে।”

ছেলেটা বিমর্ষ মুখে মাথা নাড়ল।

দীপ্তেন লক্ষ করল, ও আর তমস যখন সুরজের গাড়িতে উঠছে ছেলেটা একভাবে তমসের দিকে তাকিয়ে ছিল।

গাড়িতে বসে দীপ্তেন আস্তে আস্তে ছেলেটার সঙ্গে কী কী কথা হল তমসদাকে বলে দিল। তমস হাসতে হাসতে বলল, “তাই? ছেলেটাকে একটু দেখাতে পারতিস।”

“ওই তো আমাদের গেটের সামনে যে ছেলেটা বল খেলছিল।”

চার

সুরজ গাড়িটাকে হিলকার্ট রোডে পার্ক করলে তমস দীপ্তেনকে নিয়ে হংকং মার্কেটে ঢুকল।

দীপ্তেন একটা বাইনোকুলার নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। তমস ঘুরে ঘুরে সব জিনিসপত্র দেখতে লাগল। কত যে বিচিত্র জিনিসের সম্ভার এখানে। হংকং মার্কেটের ভিতরে কত যে দোকান আর সেখানে কী না বিক্রি হচ্ছে! বেশিরভাগই চাইনিজ প্রডাক্ট। প্রত্যেকটা দোকানে পর্যটকদের ভিড় উপচে পড়েছে। এখানকার জিনিসের দামের কোনো মাথামুণ্ডু নেই। দোকানদার যার কাছ থেকে যা পারছে নিচ্ছে। একই জিনিস এক দোকানে তিনশো টাকা তো অন্য দোকানে সেটাই সাতশো-আটশো টাকাতে বিক্রি হচ্ছে। পঞ্চাশ টাকার জিনিস হামেশাই পাঁচশো টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছে পর্যটকেরা।

তমস দীপ্তেনকে বললে, “সবকিছুই দেখ, পছন্দ কর, দরদাম আমিই করব।”

ঘুরতে ঘুরতে তমসের চোখে একটা টেলিস্কোপ পড়ল। তমস টেলিস্কোপটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল। দোকানদার দাম বলল পাঁচ হাজার। তমস তার কোনো উত্তর না দিয়ে জিনিসটা দেখতে লাগল। হঠাৎ ওর পাশের কয়েকটা দোকানের পরের দোকানে চোখ চলে গেল। একজন যুবক এসে দোকানদারের সঙ্গে ইশারায় কিছু কথা বলে যাবার পরপরেই একটি ছেলে এল। তার হাতে একটা বাক্স। দোকানদারকে সে বাক্সটা ধরিয়ে দিয়ে চটপট বেরিয়ে গেল। দোকানদার বাক্সটা আবার দ্রুত একটা ছোট্ট লোহার সিঁড়ি বেয়ে ছাদের উপরে একটা কাউন্টার আছে, সেখানে ঢুকিয়ে দিল।

তমস টেলিস্কোপটা রেখে সেই ছেলেটাকে অনুসরণ করতে লাগল। কিন্তু এই ভিড়ের ভিতরে ঠিকমতো পাওয়াও মুশকিল। তবু তমসের মন বলছে, ছেলেটা এদিকেই গেছে।

তমস চারদিক নজর করতে করতে এ গলি সে গলি ঘুরে শেঠ শ্রীলাল মার্কেটে গিয়ে দেখা পেল ছেলেটার। তমস একটু তফাতে হাঁটতে লাগল ছেলেটাকে অনুসরণ করে। ছেলেটা যেন এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে। কিছু সময় পরে একটু ফাঁকা জায়গা দেখে পকেট থেকে মোবাইল বের করে কারো সঙ্গে কথা বলল। ছেলেটা কাউকে দেখতে না পেয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল। তমস ওর পিছু ছাড়ল না। এবারে একটু দূর থেকে নজরে রাখল। ছেলেটা সবজি মার্কেটের ভিতর দিয়ে একটা গহনার দোকানে ঢুকে গেল।

কিছু সময় পরে অন্য একটি যুবক যাকে একটু আগে হংকং-এর দোকানদারেরে সঙ্গে ইশারায় কথা বলতে দেখেছিল, কিছুটা দূর থেকে সোনার দোকানে ঢুকে যাওয়া ছেলেটাকে সে ফলো করতে লাগল। যুবক ভিড়ের ভিতরে থেকে ছেলেটিকে লক্ষ করছিল। সেটা তমসের দৃষ্টি এড়াল না।

তমস একটু দূর থেকে ছেলেটাকে এবং যুবকটিকে লক্ষ করতে লাগল। জিনস আর টি-শার্ট পরা যুবকটিকে ভিড়ের ভিতরে হলেও মুখটা কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল তমসের। এর আগে কোথাও দেখেছে মনে হল।

সামনেই একটা পোশাকের দোকানে ঢুকে এটা সেটা দেখতে লাগল। সবই মেয়েদের পোশাক। শো-ডলকে পরানো পোশাক কী কারণে যে এতটা মগ্ন হয়ে দেখছে সেটাই তমসকে ভাবাচ্ছে। একেবারে অত্যাধুনিক পোশাক পরানো আছে শো-ডলগুলোকে।

যুবকটি দোকানদারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভিতরে ঢুকে গেল।

তমস সোনার দোকানে ঢুকে যাওয়া ছেলেটাকে এবং মেয়েদের গার্মেন্টসের দোকানে ঢুকে যাওয়া যুবক দুজনকে একই সঙ্গে নজর রাখার জন্যে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে পড়ল। পকেট থেকে একটা ক্লাসিক সিগারেটের বাক্স বের করে তার থেকে একটা সিগারেট নিয়ে বাক্সটা পকেটে রেখে দিল। তারপর ধীরে ধীরে দেশলাই কাঠি দিয়ে সিগারেট ধরাল। এই কাজগুলি করল খুব আস্তে আস্তে। সময় কাটানোটাই ওর উদ্দেশ্য এখন।

একটু দূর থেকে তমস লক্ষ করল, সোনার দোকানদার একটা টাকার বান্ডিল ধরিয়ে দিল ছেলেটার হাতে। তারপর খুব আস্তে আস্তে কী যেন বলল। ছেলেটা টাকার বান্ডিল একটা ব্যাগের ভিতরে ভরে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এল।

তমস কথাগুলো না শুনলেও এটা বুঝতে পারল দোকানদারের সঙ্গে তার কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে। ছেলেটা আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। দোকান থেকে বেরিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগল। এবারে গার্মেন্টসের দোকানের ছেলেটাও তার পিছু নিল।

তমস একটু দূর থেকে ভিড়ের ভিতরে নিজেকে মিশিয়ে ‘রাম’ বলে ডাক দিতেই গার্মেন্টসের ছেলেটা পিছন ঘুরল। তমস নিশ্চিত হল, এত জানকী মন্দিরের সেই দারোয়ান ছেলেটা। তখন ধুতি আর কপালে তিলক কাটা ছিল, তার পরিবর্তে এখন জিনস, টি-শার্ট পরাতে হঠাৎ করে চিনতে পারেনি। আর চুলটাও মনে হচ্ছে একটু অন্যভাবে কেটেছে।

রাম একটু পিছিয়ে পড়েছিল। একটু জোর পায়ে হেঁটে আগের ছেলেটাকে ধরে ফেলল। তারপর দুই একটা কথা বলে ছেলেটা টাকার বান্ডিলের ব্যাগটা রামের হাতে গুঁজে দিল। রাম এক সেকেন্ড সময় নষ্ট না করে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে ওপার থেকে বাগডোগরাগামী একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়ল।

রামকে অনুসরণ করতে গিয়ে সেই সময়ে ভিড়ের ভিতরে ছেলেটা যে কোথায় গেল তমস গুলিয়ে ফেলল। রাস্তার পাশে একটা অটো দাঁড়িয়ে ছিল। তমস অটো-চালককে বলল, “আমাকে কি একটু বাগডোগরার দিকে নিয়ে যেতে পারো? খুব বেশি জোরে চালানোর দরকার নেই, ওই বাসটার পিছন পিছন গেলেই হবে।”

বাগডোগরা পর্যন্ত যাওয়ার দরকার পড়ল না। তার আগেই তমস নেমে পড়ল। অটো-চালককে বলল, “এক মিনিট তুমি এখানে ওয়েট করো, আমাকে আবার শিলিগুড়িতেই ফিরতে হবে।”

কথাটা বলে তমস দ্রুত রাস্তা পার হল। দেখল, রাম বাস থেকে নেমে রাস্তার উলটোদিকে একটা অফিস-বাড়িতে ঢুকে পড়ল। তমস দূর থেকে রামকে অনুসরণ করতে লাগল। অফিসের দরজাটা কাচের তৈরি। বাইরে থেকে সব দেখা গেলেও কারো কথা শোনা গেল না। তবে রামকে দেখা গেল উলটোদিকের চেয়ারে বসা লোকটার হাতে বেশ কিছু টাকা দিতে। তমস বাইরে থেকে একটা ফটো তুলে নিল।

তমস খুব বেশি সময় এখানে দাঁড়াল না। দীপ্তেনকে কিছু বলে আসেনি। এদিকের মোবাইল সাইলেন্ট করা আছে। তমস পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখে নিল, না দীপ্তেন এখনো ওর খোঁজ করেনি।

তমস সেই অটোতে চেপে হংকং মার্কেটের সেই দোকানটায় ফিরে এল যেখানে ছেলেটা দোকানির হাতে একটা কার্টন বাক্স ধরিয়ে দিল একটু আগেই। তমস দোকানের সামনে দাঁড়াতেই লোকটা বলল, “কী লাগবে বলেন?”

তমস দোকানের জিনিসগুলোর দিকে কয়েকবার তাকিয়ে বলল, “আমি না একটা জিনিস খুঁজছি, কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না।”

“কী জিনিস বলেন তো, দেখি আমার কাছে আছে কি না।”

“ওই একটা কষ্টিপাথরের রাধাগোবিন্দের মূর্তি। এখানে বেড়াতে আসার সময়ে আমার ঠাকুরমা পইপই করে বলে দিয়েছেন, কোথায় যে পাওয়া যায় তাই বুঝতে পারছি না।”

“আপনার কি রাধাগোবিন্দের মূর্তিই চাই? নাকি অন্য কোনো মূর্তি হলে চলবে?”

“আর কীসের মূর্তি আছে আপনার কাছে?”

“আমার কাছে এই মুহূর্তে নেই, তবে আপনি যদি সত্যি সত্যি কেনেন তাহলে আমি আনিয়ে দিতে পারি। তবে তার জন্যে কিন্তু বেশ দাম দিতে হবে, পারবেন তো?”

তমস ঘাড় নেড়ে জানাল, “দেখুন, আমি কলকাতার একজন শিল্পপতি না হলেও বেশ বড়ো ব্যবসায়ী বলতে পারেন। বড়-বাজারে আমাদের কাপড়ের দোকান। আমার কাছে ঠাকুরমা একটা  জিনিস চেয়েছেন যখন তখন কি আমি সেটা না দিয়ে পারি, তা সে যত দামি হোক না কেন? তা বলুন আমি কবে আসব? আমার তো হাতে আর বেশি সময় নেই।”

লোকটা এক মিনিট ভেবে নিয়ে বলল, “আপনি কাল রাতের দিকে একবার আসেন।”

“রাতের দিকে? ক’টার সময় বলে দিলে ভালো হয়।”

“ন’টার পরে। আপনি উঠেছেন কোথায়? সেরকম হলে আমরাই আপনার ওখানে দিয়ে আসতে পারি।”

তমস হোটেলের নামটা জানাল এবং বলল, “আসতে পারেন।”

“হোটেল স্যাংগ্রিলা।” তমস আবার নামটা বলে দিল।

“হোটেল স্যাংগ্রিলা? কোথায় বলেন তো? এই নামে কোনো হোটেলের নাম তো মনে আসছে না।”

“এটা মূল শহর থেকে একটু দূরে। খাপরাইল থেকে যে রাস্তাটা শুকনা হয়ে কার্শিয়াং- মিরিকের দিকে চলে গেছে সেই রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা গেলে পড়বে। একেবারে নতুন হোটেল, কিছুদিন হল ওপেন হয়েছে। তবে ভিতরে এখনো কাজকর্ম চলছে।”

লোকটা মাথা নেড়ে জানাল, “ঠিক আছে, সময়মতো মাল আপনার হাতে পৌঁছে যাবে।” তারপর তমসের ফোন নাম্বারটা চেয়ে নিল।

তমস বলল, “আপনি একবার রিং করুন তো।”

লোকটা মোবাইল থেকে দুইবার রিং করে কেটে দিল। তমস লোকটার নাম্বারটা সেভ করে নিল। সঙ্গে সঙ্গে নামটাও বলে দিল, বাবলু বাগচী।

কথার ভিতরে দীপ্তেনের ফোন এল। তমস দোকানদারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেই জায়গা ছেড়ে বেশ কিছুটা যাওয়ার পরে দীপ্তেনের ফোন ধরে জানাল, আসছে।

দীপ্তেন একটা বাইনোকুলার পছন্দ করেছে। দীপ্তেনকে একটা বাইনোকুলার কিনে দিয়ে তমস আর দীপ্তেন সবজি মার্কেটের ভিতরে সেই জুয়েলারির দোকানে এল। একটু আগে এই দোকান থেকেই ছেলেটা টাকার বান্ডিল নিল।

তমস আর দীপ্তেন দোকানে ঢুকলে দোকানদার জিজ্ঞাসা করলেন কী দেখাবেন? ছোটোখাটো একটা দোকান। শো-কেসে সেরকম চোখে পড়ার মতো কিছু নেই। যা আছে হালকা-পলকা কিছু সোনার কানের দুল, আংটি, কিছু পেন্ডেন্ট আর শাঁখা-পলা বাঁধানো। বাকি সব রুপোর জিনিসপত্র।

তমস বলল, “আমি একটা জিনিস খুঁজছি, সেটা আপনার দোকানে আছে কি না বুঝতে পারছি না।”

“কী জিনিস বলেন? না থাকলে আমরা বানিয়ে দেব অথবা অন্য কারো কাছ থেকে এনে দিতে পারি। বলেন কী জনিস চাই আপনার?”

“আমি একটা কৃষ্ণ ঠাকুরের মাথার মুকুটের খোঁজ করছিলাম, নিদেনপক্ষে একটা বাঁশি হলেই চলবে। আসলে এখানে বেড়াতে আসছি শুনে আমার বুড়ি ঠাম্মা আমার কাছে বায়না করেছে।”

লোকটা একবার দীপ্তেন আর একবার তমসের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনারা কলকাতা থেকে আসছেন?”

“হুম।”

“সে আমরা লোক দেখলেই বুঝতে পারি। কলকাতার লোকের কথাবার্তা, রুচিই আলাদা।”

দীপ্তেন তমসদার কথা শুনে অবাক হলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করল না। তমসদা এসব আবার খোঁজ করছে কেন? তাছাড়া তমসদার ঠাম্মা এখন কোথায়? তিনি তো বহুদিন হল অনন্তলোকে যাত্রা করেছেন।

লোকটা এক মিনিট এটা সেটা নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, “আপনার কোনটা লাগবে?”

তমস জানাল, “আপনি আগে কৃষ্ণের মাথার মুকুটটাই দেখান।”

লোকটা লোহার সিন্দুক খুলে একটা রুপোর মাথার মুকুট নিয়ে এল। তমস হাতে নিয়ে দেখল, রুপোর উপরে মিনে করা অপূর্ব সুন্দর জিনিসটা। তমস বলল, “এটার কত দাম হবে?”

“তা ধরুন পঞ্চাশ হাজার মতো পড়বে।”

“পঞ্চাশ হাজার?”

“হ্যাঁ, এখন রূপার ভরি কত করে যাচ্ছে জানেন? এতে কতখানি রূপা আছে। তার উপরে সুন্দর মিনে করা। আমি তো আপনাকে মেকিং চার্জ কিছুটা বাদ দিয়েই দামটা বললাম। আপনার কথা শুনে আমার ভালো লেগে গেল তাই। আপনি চাইছেন তাই বের করলাম। সত্যি বলতে কী, এটা আমার একটা অর্ডারি মাল ছিল। একজন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী অর্ডার দিয়েছেন। আপনার পছন্দ হলে কিনে নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে আমি আরেকটা বানিয়ে দেব তাঁকে।”

“আপনার কারখানা কোথায়? মানে বলছিলাম যে এগুলো কোথায় তৈরি হয়? এখানে তো কারিগরদের দেখছি না।”

লোকটা হঠাৎ কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। চোখেমুখে একটা অস্বস্তি প্রকাশ পেল। পরক্ষণেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলল, “এসব জিনিস আমাদের এখানে তৈরি হয় না।  আমাদের বাইরে থেকেই কিনতে হয়। আপনার কি এটা পছন্দ হয়েছে?”

তমস মকুটটা নাড়তে নাড়তে বলল, “পছন্দ যার তিনি তো বাড়িতে, যদি তাঁকে একবার দেখাতে পারতাম…”

কথাটা বলা মাত্র দীপ্তেন ওর পকেট থেকে মোবাইল বের করে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে মুকুটের একটা ফটো তুলে নিল। লোকটাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফটোটা কয়েক জায়গায় সেন্ড করে দিল।

তমস বলল, “এক মিনিট, আমি একটু বাড়িতে ফোন করে দেখছি। এত দামি জিনিস তো, আমাদের মূর্তিটার মাথাতে আবার ঠিকঠাক বসবে কি না…”

তমস খুব সংক্ষেপে মুকুটটার কথা জানিয়ে দিল আর একটা ফটো পাঠিয়ে দিল হোয়াটস অ্যাপে। তারপর লোকটাকে বলল, “আপনি মুকুটটা প্যাক করুন, আর রুপোর বাঁশি আছে  বলছিলেন?”

“হ্যাঁ, বাঁশিও আছে। আপনার লাগবে? কিন্তু আমার না একটা কথা আছে, আপনি ক্যাশে দেবেন নাকি কার্ডে দেবেন?”

“দেখেন, আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি। আজকাল এত টাকাপয়সা নিয়ে কি কেউ ঘোরে?”

“না, শোনেন, টাকাটা আপনাকে ক্যাশে দিতে হবে। এই তো পাশেই এটিএম আছে, আপনি তুলে আনুন না।”

“সে দেখছি। আপনি আমায় বাঁশিটা দেখান।”

লোকটা সিন্দুক খুলে একটা এক ফুট লম্বা রুপোর বাঁশি বের করে আনল। বাঁশিটার গায়ে সুন্দর অলঙ্করণ করা। তমস ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। তলার দিকে কোন দোকানে তৈরি তার লোগো আছে। রিনি হাউজ, কলকাতার বৌবাজার থেকে তৈরি। আর মুকুটটা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে, ঢাকায়, আগরওয়াল অ্যান্ড সন্স।

দীপ্তেনকে দোকানে রেখে তমস এটিএমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।

দীপ্তেন শায়েরের কথা ভাবছিল। এতক্ষণে শায়ের হয়তো খেলে বাড়িতে ফিরে এসেছে।

পাঁচ

সেদিন বিকেলে পার্কে খেলতে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল শায়ের। গত সপ্তাহে ওদের এই খেলার জায়গাটাতে যে অস্পষ্ট পায়ের ছাপ দেখে শায়ের এবং ওর বন্ধুদের মনে কেমন সন্দেহ জেগেছিল, আজ বেশ কয়েকটা জায়গায় স্পষ্ট পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে একটু আগেই বুঝি কোনো জন্তু এ পথ দিয়ে হেঁটে গেছে। শুকনো ধুলোর উপরে দ্বিতীয় কোনো আস্তরণ পড়েনি।

শায়ের দুই পা পিছিয়ে এসে ডানে বাঁয়ে মাথাটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। পায়ের ছাপগুলো অনুসরণ করে এগিয়ে গেল। দেখল, ছাপগুলো ক্রমশ চা-বাগানের ভিতরে ফেলে রাখা বড়ো বড়ো জলের পাইপের দিকে গিয়ে মিলিয়ে গেছে। শায়ের ছাড়া আজ এখনো পর্যন্ত আর কেউ খেলতে আসেনি। ও চারদিকটা একবার দেখে নিল। বেলা পড়ে এসেছে। কমলা-হলুদ রোদ্দুর ঝিমিয়ে পড়েছে বাগানে। ছায়াগাছের মাথার উপরে বেশ কিছু পাখি ওড়াউড়ি করছে। বিচিত্র সুরে ডাকছে পাখিগুলো।

অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু আগেই বেরিয়েছে শায়ের। মা শপিং মলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলে শায়েরও ব্যাট আর লাল রঙয়ের বলটা নিয়ে সাইকেল চেপে বেরিয়ে পড়ল। বৈশাখের এই বিকেলগুলো কেমন যেন সন্দেহজনক। এই রোদ তো পরক্ষণেই কমলারঙা রোদ্দুরগুলো কেমন যেন ঝুপ্পুস করে মিলিয়ে যায়। ঘন কালো মেঘে যেন সন্ধ্যা ঘনায়। মুহূর্তের ভিতরে শুরু হয়ে যায় কালবৈশাখী। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সেদিন আর তাই খেলার সময় থাকে না এতটুকু।

পারমিতা বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে পইপই করে বলে গেল, “একটু বাদেই কিন্তু ড্রয়িং টিচার আসবেন, ড্রয়িংগুলো কমপ্লিট করে রাখিস। আর শোন, স্যারের কাছ থেকে শুনে নিবি এস.বি.আই থেকে যে আর্ট কম্পিটিশন হওয়ার কথা আছে সেটা কত তারিখে এবং কোথায় হবে, বুঝতে পারলি?”

শায়ের বাধ্য ছেলের মতো মায়ের সব কথাতেই ঘাড় নাড়ে। আর বারে বারে জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছে। আর কত দেরি করবে মা? এই তো বেলা প্রায় শেষ হয়ে এল। মার যেন কিছুতেই গোছানো শেষ হচ্ছে না।

আজ যে ড্রয়িং টিচার আসবেন না সেটা শায়ের গোপন রেখেছে। গেল শনিবার উনি বলে গেছেন কী একটা ব্যাপারে যেন আসতে পারবেন না। মাকে বললে আজ হয়তো ওর খেলতেই যাওয়া হত না। জোর করে মা ওকে টানতে টানতে মলে নিয়ে যেত।

সামনের মাসেই পুজো। হাতে আর মাত্র গোনা কয়েকটা দিন। মা এখন কেনাকাটা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। প্রায় দিন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনগুলো দেখছে আর মিমি-আন্টিকে ফোন করছে, “দেখেছ, ফ্যাশান বিগ বাজারে কত পারসেন্ট ডিসকাউন্ট দিচ্ছে? প্যান্টালুনসের খবর জানো?”

গত সপ্তাহেই মা মলে গিয়ে ঢাউস ব্যাগভর্তি সব কেনাকাটা করে এসেছে। এবার নাকি প্রত্যেক সপ্তাহেই ঢুঁ দেবে। শায়ের অবশ্য খেলা ছাড়া কিছুই বোঝে না। মায়ের কাছে বাড়ির একটা চাবি থাকে। শায়ের অন্য চাবি দিয়ে গেটে তালা লাগিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। শায়েরদের বাড়ি থেকে সাইকেলে মিনিট দশ-বারো সময় লাগে এই খেলার মাঠটাতে পৌঁছতে। মাঠটা জনবহুল অঞ্চল থেকে একটু দূরে। ওদের বাড়ির ধারেকাছে সেরকম ক্রিকেট খেলার মতো মাঠ নেই। ওদের ক্লাশের উদ্দীপন-স্মার্তরা বেশ কিছুদিন ওকে এই মাঠটার কথা বলেছে। সেই থেকে ওরা এই মাঠেই ক্রিকেট খেলে। শায়ের আজ আসার পথে তিতাস, রাহুল আর উদ্দীপনদের ডেকে এল। গুলমোহর জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে দিল, “তুই যা, আমি আসছি।”

মাঠটার একদিকে রাস্তা আর অন্যদিকে ঘন চা-বাগান। মাঠটার চারদিকে নানান আগাছায় ভরা। পার্থেনিয়ামের জঙ্গলের ভিতরে কিছু ঘাপটি মেরে বসে আছে কি না কে জানে? চা-গাছগুলো বেশ বড়সড় হয়েছে। বাগানের ভিতরে যদি কোনো জন্তুজানোয়ার লুকিয়ে থাকে এখান থেকে বোঝার উপায় নেই। রাস্তার ওপাশে বেশ কিছু প্রজেক্টের কাজ চলতে চলতে থেমে গেছে। কীসব আইনি জটিলতায় বাধা পড়া উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটগুলোর দিকে তাকালে গা-টা ছমছম করে। মনে হয় কোনো হানাবাড়ি, ভূতেদের আস্তানা। সন্ধ্যার পরে বাদুড়েরা কালো ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়, দুদ্দাড় করে বাতাস ছুটে যায় কঙ্কালের করোটির অক্ষিগোলকের মতো কপাট বিহীন জানালাগুলো দিয়ে। হি হি করে দাপিয়ে বেড়ায় ভৌতিক বাতাস। কালো কালো ছায়ামূর্তিদের দেখা যায় রাত বাড়লে। অনেকেই নাকি দেখেছে তাদের। হা হা করে গিলতে আসে বাড়িগুলো।

এদিকে তেমন কোনো জনবসতি নেই। সন্ধ্যার আগেই বাগিচায় পাতা-তোলা মেয়েরা যে যার গন্তব্যস্থলে ফিরে যায়। সন্ধ্যার পরে পাহাড় থেকে নেমে আসা গাড়ির সংখ্যা আস্তে আস্তে কমে আসে। আশেপাশে কয়েকটা কাঠচেরাই কল, গাড়ি সারাইয়ের দোকান, দুটো হিন্দি আর ইংরাজি মাধ্যমের স্কুল, কয়েকটা ছড়ানো ছিটানো খাবারের আর চায়ের দোকান, টিনের চালা আর দরমার বেড়া দেওয়া ভাঙা একটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকান ছাড়া আর তেমন কিছুই চোখে পড়ে না।

সেদিন স্কুলে তিতাসের মুখে শুনল, চা-বাগানে নাকি একজন শ্রমিকের বাচ্চা ছেলেকে চিতাবাঘে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। সকলে চিৎকার করে ছুটে যাওয়াতে চিতাটা ছেলেটাকে ফেলে পালিয়ে যায়। কাছে গিয়ে সকলে দেখল বাচ্চাটার চোখমুখ খুবলে নিয়েছে চিতাটা। একটা আতঙ্ক চেপে বসেছে সকলের মধ্যে। সন্ধ্যার আগে আগেই সকলেই তাই ঘরমুখো হচ্ছে। জায়গাটা এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এই মুহূর্তে তিতাসের কথাটা মনে পড়ায় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তিতাসের বাবা ওখানকার বিট অফিসার। এখান থেকে মিনিট পনেরো গেলেই ঘন জঙ্গল শুরু হয়েছে। চিতা ছাড়াও বুনো শুয়োর, হায়না, বাইসন, হাতির দল জঙ্গল দাপিয়ে বেড়ায়। সময়ে সময়ে লোকালয়েও ঢুকে পড়ে।

শায়েরের মনে হয়েছে এই দাগগুলো চিতাবাঘের নয়তো? ও তিতাসের অপেক্ষাতে আছে। তিতাস এই ব্যাপারে অনেকটাই অভিজ্ঞ। কথাটা ভাবতে ভাবতেই স্মার্তরা খেলার মাঠে ঢুকল। ঢুকেই সকলে হল্লা জুড়ে দিল। কিন্তু শায়েরের থমথমে মুখ দেখে অন্যেরা এর ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটে গেছে এর ভিতরে।

শায়ের ওদের হাতের ইশারায় দেখাল পায়ের ছাপগুলো। সেদিন অবশ্য গুলমোহর অস্পষ্ট ছাপ দেখে কুকুরের পায়ের ছাপ বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। তিতাসের সেদিন ক্যারাটে ক্লাশ ছিল। তাই গুলমোহরের ‘নিশ্চয়ই কোনো বড়ো জাতের কুকুর এসেছিল’ যুক্তিটাকে ও অগ্রাহ্য করতে পারেনি।

এত বড়ো একটা মাঠ পেয়ে সত্যি ওরা খুব খুশি হয়েছিল। এখানে চার-ছয় মারলে কারো বাড়ির জানালার কাচ ভাঙবে না, কারো বাড়ির পাঁচিল টপকে বল কুড়াতে গিয়ে বকা খাওয়ার সম্ভবনা নেই। তবে তিতাস ওদের সাবধান করে দিয়েছিল সন্ধের আগে আগেই এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে। পাশেই অভয়ারণ্য। সন্ধে নামলেই অরণ্যের সন্তানেরা কখন রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে অতর্কিতে হামলা চালাতে পারে।

ইতিমধ্যে তিতাস-শায়েরদের এখানে খেলতে দেখে শ্রমিক বস্তির কিছু ছেলেও খেলতে আসে। তবে ওরা মাঠের অন্য একটা কোণে খেলে। ছেলেগুলো প্লাস্টিকের ভিতরে কিছু ভরে সেটাকে বল বানিয়ে খেলে। শায়েরের খুব খারাপ লাগে। ও ছেলেগুলোকে বলে, “কী রে, তোদের বল কী হল?”

ওদের দলের একটি ছোটো ছেলে ফিক করে হেসে বলে, “ফাইট্টা গেছে।”

“ঠিক আছে, সামনের দিন তোদের জন্যে একটা ফুটবল নিয়ে আসব।” শায়ের কথা দেয়। বাচ্চাগুলোকে খুব ভালো লাগে শায়েরের। কী ভীষণ পরিশ্রমী এবং বেশ সরল আর বিনয়ী ওরা।

এটা বেশ কয়েকদিন আগের ঘটনা।

ছয়

শায়ের আজ মাঠে এসে বেশ হতাশ হল। আজ ছেলেগুলোর জন্যে একটা ফুটবল এনেছে। সেবার বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর আগে ওদের এল.ই.ডি টিভিটা কেনার সময়ে কোম্পানি থেকে এই বলটা গিফট করেছিল। শায়েরের আরো একটা জন্মদিনের উপহার হিসাবে পাওয়া ফুটবল আছে। বাবার অফিস কলিগেরা দিয়েছিলেন। সুতরাং এই বলটা দিতে বাড়ির কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। তাই মা চলে যেতেই ও বলটাকে একটা ব্যাগে করে সাইকেলে ঝুলিয়ে নিয়ে এসেছে।

শায়ের লক্ষ করল আজ ও ছাড়া আর কেউই আসেনি খেলতে। স্মার্তদের কী হল কে জানে। গুলমোহর তো বলল, ‘যা, আসছি।’ এতটা সময় হয়ে গেল কারুরই তো পাত্তা নেই। অথচ স্কুলে থাকতে সকলে বলল, আজ খেলতে আসবে।

দ্রুত বেলা পড়ে আসছিল। ও দেখল কয়েকজন শ্রমিক এইদিকে আসছে। ওকে একাকী এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওদের ভিতরে একজন শায়েরকে ডেকে বলল, “এখানে কী করছ? এখানে কয়েকদিন হল একটা চিতা বেরিয়েছে।”

“চিতাবাঘ?”

“হুম, তা আর বলছি কী? ওই যে বাগানের ভিতরে জলের পাইপ রাখা আছে, ওইখানে লুকিয়ে থাকে। তারপর শিকার দেখলে তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চিতার ভয়ে এদিকপানে আর কেউই আসে না।”

“আপনারা কেউ কি তাকে দেখেছেন?”

“দেকিনি, তবে তার ডাক শুনিচি। এই আশপাশ থেকে সে ডাক দিয়ে যায়। সন্ধ্যা নামার পরপরেই সে আসে। এখানে একলাটি থেকোনি বাপ, বড়ো খতরনাক জন্তু, বুঝলে?”

শায়ের এক মিনিট কী একটু ভেবে নিল। লোকগুলো চলে গেলেও শায়ের দাঁড়িয়ে ভাবল, কেউই কি চিতাটাকে ওই পাইপের ভিতরে ঢুকতে কিংবা বের হতে দেখেছে?

চিন্তা করতে করতে তিতাস মাঠে ঢুকল। আসার পথে একটা মারুতি ভ্যানের সঙ্গে ওর সাইকেলের ধাক্কা লাগে। সাইকেলটাকে ঠিক করতে দিয়ে তবে এল। তাই এত দেরি হল। গুলমোহরের নাকি কম্পিঊটার টিচার এসেছেন তাই ও আসতে পারল না, সেটাও তিতাস জানয়ে দিল। ফেরার পথে সাইকেলটা নিয়ে তবে তিতাসকে ফিরতে হবে, তাই আজ আর খেলা হবে না। তাছাড়া দুজনে মিলে কী আর খেলবে?

শায়ের ওকে পায়ের ছাপগুলো দেখালে তিতাস বলল, “শোন, বলে দিচ্ছি ওগুলো কিন্তু সত্যি চিতাবাঘের পায়ের ছাপ। লোকগুলো তোকে কিন্তু ঠিক কথাই বলে গেল। এখানে  কিছুতেই একলা থাকিস না। ওরা যেমন ক্ষিপ্র তেমনি হিংস্র। আর দুর্দান্ত গাছে চড়তে পারে। এমনও হতে পারে হয়তো কোনো গাছের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে আছে। কখন যে লাফ দিয়ে মুণ্ডুটা কামড়ে নিয়ে পালাবে কিচ্ছু বিশ্বাস নেই। বাবার মুখে শুনেছি ওরা নাকি মাটি থেকে আট-দশ ফুট পর্যন্ত লাফাতে পারে।” যাওয়ার সময়ে শায়েরকে পইপই করে বলে গেল কথাগুলো।

তিতাস চলে যাওয়ার পরেও শায়ের আকাশপাতাল কতকিছু ভাবতে লাগল। রাস্তার ওপারের করাতকলের শব্দ থেমে গেছে। তবু বাতাসে কাঠের গন্ধ ভেসে আসছে। জায়গাটা আস্তে আস্তে নির্জন, নিঝুম হয়ে এল। দিনের শেষ আলোকবিন্দুটুকু শুষে নিল রাতের আকাশ। একপাল বক তাদের ডানায় ধুসর আলো মেখে দূরে, বহুদূরে উড়ে গেল।

রাস্তার ওপারের অসমাপ্ত, পরিত্যক্ত ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর দিকে চোখ চলে গেল শায়েরের। দেখল কারা যেন বেশ কৌতূহলী হয়ে ওকে দেখছে উঁকিঝুঁকি মেরে। ছেলেগুলোকে মোটেও সুবিধের বলে মনে হল না শায়েরের। ওদের ভিতরে একজন কিছু যেন বলতে যাচ্ছিল। অন্যেরা তাকে বাধা দিল।

শায়ের দ্রুত রাস্তায় উঠল। হঠাৎ বাতাস কাঁপিয়ে সেই ডাকটা ও শুনতে পেল, ‘উ-আওওও! উ-আওওও!’

চা-গাছ, ছায়াগাছ, বাতাসে ঢেউ তুলে ছড়িয়ে গেল সেই হাড় হিম করা তীক্ষ্ণ শব্দ। এ তো চিতাবাঘের ডাক! শায়েরের এক পা মাটিতে আরেক পা সাইকেলে। তবু কে যেন বলে গেল চুপিচুপি, এক্ষুনি সতর্ক হও। অনধিকার প্রবেশ ঘটেছে তোমার। অতএব সাবধান!

তিতাস ঠিকই বলেছিল, এই গোধূলি বেলাটা হল পাখিদের আর সন্ধের পরের সময়টা জঙ্গলের প্রাণীদের। এরপর রাত যখন গভীর হবে তখন এসব অঞ্চল ভূতপ্রেতের দখলে চলে যাবে।

এখানে আর এক মুহূর্ত থাকাটা নিরাপদ মনে করল না শায়ের। চিতাবাঘ না থাকলেও ছেলেগুলোকেও খুব একটা সুবিধের বলে মনে হল না। ওর বাবা একজন কাস্টমস অফিসার। এটা অনেকেই জানে। এই শহরে ওদের বেশ কয়েকটা ফ্ল্যাট আছে। তাছাড়া মায়ের নামে একটা রেস্তোরাঁও আছে, একটা বুটিক এবং পার্লার আছে। কেউ যদি ওকে অপহরণ করে মুক্তিপণ বাবদ কয়েক লক্ষ টাকা চায়, হতেও তো পারে! এসব ঘটনা তো হামেশাই ঘটছে।

কিছু সময়ের জন্যে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল শায়ের। সাইকেলে সবে প্যাডেল ঘোরাতে যাবে ঠিক সেই সময়ে কী একটা যেন ওর ঘাড়ের পাশ দিয়ে শা করে তীব্র গতিতে বেরিয়ে গিয়ে পাশের চা-বাগানে একটা ডালবর্জিয়া গাছের গুঁড়িতে গিয়ে ধাক্কা খেল। শায়েরের মনে হল কেউ বুঝি ওকে লক্ষ্য করে কিছু ছুড়ে মারতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের লক্ষ্য বিফলে গেল। কিন্তু কেন? আর কারাই বা টার্গেট করেছে? অনেকগুলো প্রশ্নচিহ্ন উঁকি মারছে শায়েরের মনের আকাশে।

সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বেশ বড়সড় একটা চাঁদ উঠে গেছে। মনে হচ্ছে আজ অথবা কাল পূর্ণিমা। তাই অনেক কিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। শায়ের রাস্তার একপাশে সাইকেলটাকে রেখে এগিয়ে গেল সেই গাছটার দিকে। আশপাশটা ভালো করে লক্ষ করতেই দেখে একটা তক্তা পড়ে আছে গাছের নীচে। শায়ের এক ফুট বাই হাফ ফুট আয়তাকার তক্তাটাকে হাতে নিয়ে পরখ করে দেখল তার গায়ে সিমেন্টের আস্তরণ শুকিয়ে লেগে আছে। শায়ের নিশ্চিন্ত হল, তক্তাটা ওই পরিত্যক্ত ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে তাকে টার্গেট করে ছোড়া হয়েছে। ওর কয়েকদিন আগের একটা কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন স্মার্ত একাই মাঠে এসেছিল। সেদিন বিকেল গড়িয়ে গেলে একজন হুমদোমার্কা ছেলে করাতকল থেকে বেরিয়ে এসে তাকে বলল, “তোদের বড্ড পাখনা গজিয়েছে, না? আর কোনো খেলার জায়গা পেলি না, না? কী করে তোদের ডানাগুলো ছাঁটতে হয় তার ব্যবস্থা করছি।”

লোকটার মুখ থেকে তীব্র মদের গন্ধ বার হচ্ছিল। স্মার্ত সেদিন মাঠ থেকে একপ্রকার পালিয়ে এসেছিল।

কথাগুলো পরেরদিন স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের বলায় বন্ধুরা ওকে বলল, “ছাড় তো, মদ খেলে শুনেছি মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। কী বলেছে ঘোরের ভিতরে, ওসব নিয়ে কিচ্ছু ভাবিস না।”

আজ কিন্তু কথাগুলো আবার নতুন করে শায়েরকে ভাবাচ্ছে।

শুনশান চারদিক। কেবল বাগানের ভিতর থেকে একটানা ঘণ্টা পোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। কয়েকটা কুকুর তড়িৎ গতিতে ছুটে গেল চা-বাগানের ভিতরের রাস্তা দিয়ে। দূরে ধামসা মাদলের ধ্বনি কানে এল। মনে হয় সাঁওতাল বস্তিতে আজ কোনো পরব আছে।

সাত

সোনার দোকানদার বেশ আনন্দ সহকারে নিজের হাতে একটা কার্টন বাক্সের ভিতরে কিছু কাগজের কুচির কুশন বানিয়ে তার ভিতরে সযত্নে মুকুটটাকে রাখল। তারপর অন্য একটা বাক্সের ভিতরে সেটাকে বসিয়ে দিল। দীপ্তেন জানাল, ওরা ফ্লাইটে যাবে তাই একটু বাড়তি যত্ন। বাঁশিটাকে একটা মোড়কে মুড়ে দিল।

কাজটা করে সবে দোকানদার তার জায়গায় ফিরেছে, এমন সময় দেখতে পেলে তার দোকানে বেশ কয়েকজন পুলিশ ঢুকেছে। দোকানদারের কপালে ভাঁজ পড়ল। আবার পুলিশ কেন?

একজন পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে বাক্সটা হাতে নিতেই দোকানদার জানাল, “এটা বিক্রি হয়ে গেছে স্যার।”

“এতে কী আছে?”

লোকটা তো তো করে জানাল, “একটা মুকুট আছে স্যার, ওটা তো বিক্রি হয়ে গেছে স্যার, আপনাদের কিছু লাগবে?”

“হুম, আমরা মুকুটটা একটু দেখতে চাই।”

লোকটা কাঁপা কাঁপা হাতে বাক্সের ভিতর থেকে মুকুটটা বের করে পুলিশ অফিসারের হাতে দিল। বাইরে তখন পুলিশ ঘিরে ফেলেছে তার দোকানটাকে। শুধু তাইই নয়, আশেপাশের অনেক লোক জমে গেছে পুলিশ দেখে। তারা কৌতূহলী হয়ে ব্যাপারটা কী বোঝার চেষ্টা করছে। দোকানদার তখন তোতলাতে শুরু করেছে, “আমি আবার কী করলাম স্যার? আমি একজন ছাপোষা মানুষ, ছোটোখাটো একটা ব্যাবসা চালাই, কারো সাতে-পাঁচে সাতে থাকি না।”

পুলিশ অফিসার তাঁর সহকারী একজন পুলিশকে বললেন, “এঁকে গাড়িতে তোলো। আর দোকানে তালা লাগিয়ে দাও।” কথাটা বলে অফিসার সেই মুকুট আর বাঁশিটাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন।

দোকানদারকে পুলিশ ভ্যানে তোলা হল। তারপর ওঁর দোকানটাকে পুলিশ সিল করে দিল।

এদিকে খবরটা পাওয়ামাত্র পুলিশ দারুণ তৎপরতায় ফোর্স নিয়ে ছুটে গেল ব্যাঙকান্দি গ্রামে। তমস সঙ্গে গেল। জানকী মন্দিরে তখন বিগ্রহহীন গর্ভগৃহে সন্ধ্যারতি করছিলেন প্রধান পুরোহিত সাধন পণ্ডিত। ঘট পূজা সম্পন্ন হলে তিনি চলে এলেন নাটমন্দিরে। নাটমন্দিরে তখন ফুল-মালা দিয়ে গোবিন্দের মূর্তিকে সাজাচ্ছিল কেশব।

পুলিশ এসে দাঁড়াল মন্দির প্রাঙ্গণে। প্রধান পুরোহিতকে ডাকা হল। সাধন পণ্ডিত ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। পুলিশের ভিতর থেকে একজন বললেন, “আপনার এই সহকারীকে এখন একটু থানায় যেতে হবে।”

“সে কি? কেন? আজ রাতে তো আমাদের এখানে অষ্টপ্রহর কীর্তন শুরু হবে। পূর্ণিমা লাগছে রাত দশটাতে, তখনই তিথি মেনে নাম সংকীর্তন শুরু হবে।”

“আপনাদের আরো একজন সেবায়েত আছে না, রামভগত?”

“সে তো গতকাল কাজ আছে বলে সেই যে বেরিয়েছে এখনো পর্যন্ত তার কোনো পাত্তাই নেই। কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।”

কেশব ভয়ার্ত চোখে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল। অপরাধীর মতো চাহনি তার। সাধন পণ্ডিত কেশবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী কেশব, তুমি কিছু বলো।”

কেশব নীরব রইল।

পুলিশ বললেন, “ওঁকে এখন একটু থানায় যেতে হবে, কিছু জিজ্ঞাসাবাদ আছে। সঙ্গে আপনিও যেতে পারেন। আপনি গেলে আরো ভালো হয়।”

“কেন বলেন ত? হঠাৎ করে আমাদেরকে থানায় ডেকে পাঠালেন কেন অফিসার?”

“আমরা একটি ঠাকুরের মাথার মুকুট আর একটা কৃষ্ণের বাঁশি উদ্ধার করেছি, আপনারা দেখলে বুঝতে পারবেন সেটা আপনাদের জিনিস কি না।”

কেশবের মুখটা সহসা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মনে হচ্ছে তার মুখমণ্ডলে রক্তের ছিটেফোঁটাও নেই। সাধন পণ্ডিত আর কেশবকে নিয়ে কয়েকজন এগিয়ে গেলেন।

তমস এবারে প্রত্যেকের ঘর খুব ভালো করে সার্চ করল। পুরোহিত, সেবায়েত, দারোয়ান—প্রত্যেকের ঘর সার্চ করে বেশ কিছু জিনিস পেল যা ওর তদন্তে সাহায্য করবে। একজন পুলিশ মন্দিরের দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন। আরেকজন মন্দিরের পাহারায় থাকলেন। অন্যান্য সেবায়েতরা পুলিশের এই ভূমিকা দেখে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। যখন চুরি হল তখন তেমন কারো ভিতরে এত উদ্যোগ লক্ষ করা গেল না, এখন আর পাহারা বসিয়ে কী হবে? তারা আড়ালে এই জাতীয় মন্তব্য করতে লাগল।

পুলিশ অফিসারের উলটোদিকের চেয়ারে বসে আছেন সাধন পণ্ডিত। অফিসার তাঁর অধস্তন একজনকে ডাক দিলেন। সে এসে আলমারি থেকে একটা বাক্স বের করে টেবিলের উপরে রাখল। সাধন পণ্ডিত অবাক হয়ে সেইদিকে তাকিয়ে রইলেন।

সেকেন্ড অফিসার বাক্সটা খুলে তার ভিতর থেকে গোবিন্দের মাথার মুকুটটাকে বের করে টেবিলের উপরে রাখলেন। সাধন পণ্ডিত বললেন, “হ্যাঁ স্যার, এই মুকুটটাই আমার গোবিন্দের মাথায় পরানো ছিল।”

“এটাই যে সেই মুকুট তার কোনো প্রমাণ দিতে পারবেন? এই যেমন কোনো ফোটো তোলা আছে নিশ্চয়ই?”

“সে তো আছেই স্যার। প্রত্যেক বছর দোল পূর্ণিমায়, মাঘী পূর্ণিমায়, হোলিতে—এছাড়াও বছরের ভিন্ন সময়ে অনেক ফোটো তোলা হয়ে থাকে। সব বাঁধানো আছে, মন্দিরের ভিতরেও বেশ কিছু ফোটো বাঁধিয়ে রাখা আছে। তাছাড়া এই মন্দিরের বর্তমান উত্তরাধিকারী যাঁরা আছেন তাঁদের কাছেও আছে। আমি আপনাকে দেখাতে পারব। তখন বুঝতে পারবেন আমি মিথ্যা কিছু বলছি না।”

“না না, আমি সেকথা আপনাকে বলিনি। প্রমাণ না পেলে তো আমরা কিছু করতে পারি না, শুধুমাত্র মুখের কথায় তো জিনিসটা কার সেটা বলে দেওয়া যায় না। ও ব্যাপারে আপনি চিন্তা করবেন না, আমরাও বুঝতে পারছি এটাই সেই মুকুট।”

সেকেন্ড অফিসার এরপর একটা লম্বা মোড়ক এনে টেবিলে রাখলে অফিসার ঘনশ্যাম বললেন, “এই যে সেইসঙ্গে একটা বাঁশিও পাওয়া গেছে।”

সাধন পণ্ডিতের মুখটা সহসা উজ্জ্বল হয়ে গেল। তিনি বাঁশিটা হাতে নিয়ে বললেন, “জানেন, এই বাঁশিটা একজন কলকাতার ব্যবসায়ী গোবিন্দকে দিয়ে গেছেন। আর হ্যাঁ, মনে পড়েছে, মুকুটাটা দান করেছিলেন যিনি তিনি বাংলাদেশের খুব বড়ো একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী। দেখবেন আমাদের মন্দিরে শ্বেতপাথরে তাঁর নাম লেখা আছে, মণিলাল আগরওয়াল।”

সেকেন্ড অফিসার বাঁশিটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী যেন দেখলেন, তারপর ঘনশ্যামের হাতে দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ স্যার, উনি ঠিকই বলেছেন। এই দেখুন বাঁশির গায়ে ‘রিনি হাউজ’ কথাটা লেখা আছে।”

কেশবকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে থানায় রেখে সাধন পণ্ডিতকে ছেড়ে দেওয়া হল। একটু বাদে থানার লক-আপে রামভগতকে দেখে কেশব চমকে উঠল।

রামভগতকে এবারে জেরা করা হল। কিন্তু ও জানাল, মূর্তি কে চুরি করেছে সেটা ও জানে না। রামকে অনেকরকম ভয় দেখানো হল, শারীরিকভাবে নিপীড়ন করা হল কথা বের করার জন্যে, কিন্তু ও প্রতিবার একই কথা বলে যাচ্ছে, ও মূর্তি চুরির ব্যাপারে কিছুই জানে না।

তবে সাধন পণ্ডিতকে জেরা করার সময়ে উনি একটা কথা জানালেন, রাম নবমীর রাতে পাড়ার যাত্রা দেখতে ওঁকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিল কেশব, কিছু সময় পরে কেশব যায় যাত্রা দেখতে।

কেশবের কাছে জিজ্ঞাসা করলে কেশব জানায়, “মন্দিরে তখন কিছু কাজ পড়ে ছিল। তাই আমিই ঠাকুরকে বলি, আপনি এগিয়ে যান, আমি কাজগুলো সেরে আসছি। তারপর কী হয়েছে আমি আর জানি না। তখন পাহারাতে দীনু ছিল।”

রাতে দীপ্তেনকে সঙ্গে করে তমস মাটিগাড়ার কাছাকাছি এক জায়গায় এল। বড়ো রাস্তা থেকে ডানদিকে একটা গলি রাস্তা নেমে গেছে। সেই রাস্তা ধরে কয়েক মিটার গেলেই চোখে পড়বে ‘সুকৃত’ প্রজেক্টের অফিস। কাচের দরজা। বাইরে থেকে পরিষ্কার দেখা যায়।

তমস আর দীপ্তেন সুইং ডোর ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেল। একটা রিভলভিং চেয়ারে বসে ছিলেন প্রজেক্ট ম্যানেজার। তমসের দিকে একনজর তাকিয়ে বসতে বললেন।

“বলুন?”

তমস বলল, “রামভগত নামে একজন এখানে একটা ফ্ল্যাট বুক করেছে, সে-ই আমাকে আপনার ঠিকানাটা দিল। আমি এখানে একটা ফ্ল্যাট বুক করার কথা ভাবছি।”

“কত রিকোয়ারমেন্ট? আমার এই মুহূর্তে সামনের সব বুকিং কমপ্লিট। টপ ফ্লোরের পিছনের দিকে টু বি.এইচ.কে এবং থ্রি বি.এইচ.কে দুটি ফাঁকা আছে। একটি আটশো এবং অপরটি সাড়ে এগারোশো স্কয়ার ফিট।”

“রামভগত কোন ফ্লোরে নিয়েছে?”

ভদ্রলোক খাতা খুলে বললেন, “ওরটাও টপ ফ্লোরেই আছে।”

তমস বলল, “টপ ফ্লোর আমি কার্যত অ্যাভয়েড করতে চাইছি। প্রথম কথা প্রচণ্ড গরম, দ্বিতীয়ত, এখনকার বালি মোটেই ভালো নয়। কিছুদিন বাদেই ছাদ ড্যাম্প হয়ে জল চুইয়ে পড়ে শুনেছি।”

“না না, সে ব্যাপারে আপনার চিন্তার কিচ্ছু নেই। এখন আমরা অন্যভাবে ছাদের ট্রিটমেন্ট করছি। আর এসি লাগিয়ে নিয়ে গরম লাগার প্রশ্নই ওঠে না। অনেকেই আবার নিরিবলি থাকার জন্যে টপ পছন্দ করেন। আচ্ছা, সেরকম হলে আমি নাহয় কিছু কম করে দেব। এমনিতে সাড়ে তিন করে যাচ্ছে টপে, আমি নাহয় ওটা তিনের ভিতরেই রাখব।”

“ঠিক আছে, ধন্যবাদ, একটু ভেবে দেখি।” বলে তমস আর দীপ্তেন উঠে পড়ল।

রাস্তায় পা দিয়েই দীপ্তেন বলল, “তুমি আবার এখানে ফ্ল্যাট বুক করার ভাবছ নাকি?”

“হ্যাঁ, এখানে একটা ফ্ল্যাট থাকলে ক্ষতি কী? আমরা তো প্রত্যেক বছর একবার না একবার আসিই। আর কলকাতায় যা গরম তাতে গরমের কয়েকদিন এখানে কাটিয়ে গেলে মন্দ কী?”

দীপ্তেন বলল, “রামভগত এখানে যে ফ্ল্যাট বুক করেছে সেটা তোমাকে কে বলল?”

“তার আগে বল, একজন মন্দিরের সেবায়েত কত উপার্জন করে যে তার পক্ষে এইরকম জায়গায় ফ্ল্যাট বুক করা সম্ভব?”

দীপ্তেন ঘাড় নাড়ে, “তাই তো। এত টাকা ও কোথায় পাচ্ছে?”

তমস আজকে হংকং মার্কেটে যা যা ঘটেছিল সেসব বলতে লাগল। রামভগতকে অনুসরণ করতে করতে ও এই পর্যন্ত এসেছিল। রাস্তার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখেছিল ম্যানেজারকে টাকা দিতে।

আট

কথা বলতে বলতে ওরা রাস্তার একটু নির্জন দিকে চলে আসে। এখন এদিকে সেভাবে লোক চলাচল করছে না। শুধু গাড়িগুলো হুশ হুশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে।

তমস হঠাৎ লক্ষ করল কেউ যেন ওদেরকে ফলো করছে। একজন নয়, দুইজন নয়, বেশ কয়েকজন। কাছাকাছি আসতে বুঝতে পারল বাবলু বাগচী। তাকিয়ে দেখে বাবলু বাগচী একা আসেনি। বেশ কিছু হোমড়াচোমড়া লোকদের সঙ্গে করে এনেছে। তমস অবশ্য মনের দিক থেকে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। দীপ্তেনকে বলল, “তুই রেডি থাকিস। ওরা কিন্তু আমাদের টার্গেট করেছে। তুই ওই বিল্ডিংটার পিছনে লুকিয়ে পড়।”

“আর তুমি? তোমাকে একা রেখে…”

“যা বলছি কর, এখন আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা যাচ্ছে না।”

রাস্তার পাশেই একটা নীল রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। তমস ধরে নিল বাবলুরা সম্ভবত ওই গাড়িতেই এসেছে।

হঠাৎ রাস্তার দুইদিক থেকে প্রায় দশ-বারোজন ষণ্ডামার্কা যুবক ওকে ঘিরে ধরল। সকলের হাতেই অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। বাবলু এগিয়ে এসে বলল, “আপনি বুঝতে পারেননি কাদের খপ্পরে পড়েছেন। কলকাতা থেকে এখানে এসেছেন গোয়েন্দাগিরি করতে?”

“কিন্তু আপনি? আপনি এদের এখানে কেন এনেছেন? আমার মূর্তিটা কোথায়? ওটা তো আমাকে হোটেলে দেওয়ার কথা ছিল।”

“আপনি কী ভেবেছেন, এখনো আমরা আপনার উদ্দেশ্য ধরতে পারিনি? আপনি হয়তো জানেন না এখানে দিনে রাতে আমাদের লোক কত নির্ভয়ে তাদের ব্যাবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আরে বাবা, এ জগতে দেখছেন না সকলেই লুটেপুটে খাচ্ছে! আর আমরা তো ব্যাবসা করে খাচ্ছি। রীতিমতো মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করছি।”

“কিন্তু আপনারা যেটা করছেন সেটা অন্যায়। আমাদের দেশের ঐতিহ্য, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছেন। হাজার হাজার বছরের প্রাচীন এই মূর্তিগুলো তো আমাদের অ্যাসেট। এর নৃতাত্ত্বিক গুরুত্ব, ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। দাম দিয়ে এর বিচার করা যায় না। নিজের দেশের এই সম্পদ কেবলমাত্র টাকার বিনিময়ে পাচার করাটা অনৈতিক, বে-আইনি।”

তমসের কথা শুনে বাবলু হা হা হা হা করে ব্যঙ্গের হাসি হাসতে লাগল। তার দেখাদেখি অন্যেরাও। তারপর তমসের মাথায় একটা নাইন-এমএম পিস্তল ঠেকিয়ে ওকে সেই নীল গাড়িতে তুলল। সঙ্গের ছেলেগুলো এদিক ওদিক তাকিয়ে দীপ্তেনকে খুঁজতে লাগল।

দীপ্তেন একটা জাইলো গাড়ির পিছনে সিটে লুকিয়ে ছিল। ওদিকে আলোর প্রতুলতা বেশ কম ছিল। তাছাড়া বেশ কিছু গাড়ি পরপর দাঁড়িয়ে ছিল।

তমসের পাশে বসল বাবলু, আর সামনে ড্রাইভারের পাশে বসল একজন। তার হাতে রিভলভার ধরাই ছিল। গাড়ির কাচ বন্ধ করে ছুটে চলল হাইওয়ে ধরে।

তমস বুঝতে পারল শুকনার ভিতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। বলল, “আমাকে এইভাবে ধরে নিয়ে যাওয়ার মানেটা কী?”

“সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। আর আপনার সঙ্গে ওই বাচ্চা চেলাটা কে? সেটাকে তো দেখলাম না?”

তমস নীরব রইল।

বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পরে রাস্তাটা দুইদিকে ভাগ হয়ে গেছে। উপরের দিকের রাস্তাটা চলে গেছে মিরিকের দিকে, আর ডানদিকের রাস্তাটা ঘন জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে গেছে। এ পথে তমস এর আগে কখনো আসেনি। তাছাড়া এদিকের পথঘাট সেইভাবে ওর চেনা নেই।

দুইপাশে ঘন জঙ্গল। ডানদিকে খাদ। গাড়িটা বেশ জোরে ছুটছে। তমসের মনে হচ্ছে খুব সংকটপূর্ণ পথ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। মনের ভিতরে একটা আশঙ্কা জেগে উঠল, এখান থেকে যদি ওকে ঠেলে ফেলে দেয় কেউ জানতেও পারবে না। বেশ বড়সড় চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্নায় মোটামুটি সব দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে নীচ দিয়ে কোনো নদী বয়ে চলেছে।

তমস নিজেকে প্রস্তুত করল। এটা বুঝতে পারছে, ওদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে। হয় ওকে মেরে ফেলতে পারে, নতুবা গুম করে ওদের প্রাপ্য আদায় করতে পারে। পুলিশ ওদের দলের কয়েকজনাকে ইতিমধ্যে ধরে ফেলেছে। পাচারকারী দলের চাঁইকে এবার ধরার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে যে করেই হোক ওকে এই জায়গা থেকে বের হতে হবে। কিন্তু কী উপায়ে?

এ পথে অসংখ্য বাঁক। কোথাও কোথাও প্রায় তিনশো ডিগ্রি ঘুরে ঘুরে উপরের দিকে উঠে গেছে পথ। কিছুটা উপরের দিকে উঠে আবার নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে। তমসের মনে হল পিছনদিক থেকে একটা গাড়ি আসছে। ধরে নিল এদিকে তাহলে জনবসতি আছে। গাড়ি যাচ্ছে যখন তখন নিশ্চয়ই গন্তব্যস্থল আছে।

বাবলুর ভিতরে হঠাৎ বেশ চাঞ্চল্য দেখা গেল। ও ড্রাইভারের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “জোরসে চালা না!”

ড্রাইভার একটু ক্ষুব্ধ হয়ে জানাল, “জলদিবাজি মত কিজিয়ে ইয়ার, রাস্তা বহুৎ খারাব আছে। ঠিকঠাক দেখে না চালালে গাড়ি খাদের দিকে নেমে যাবে।”

বাবলু যখন সিট থেকে কিছুটা উঠে সামনের লোকটার কানের কাছে মুখ লাগিয়ে কথা বলায় ব্যস্ত, ঠিক সেই সময়ে তমস মোক্ষম চালটা দিল। ও দ্রুত পকেটের ভিতর থেকে ওর রিভলভারটা বের করল। প্রথমেই বাবলু এবং ওর সাগরেদদের মাথাদুটো জোরসে ঠুকে দিল। বাবলুর মাথাটা বনবন করতে লাগল। চোখে আঁধার ঘনিয়ে এল।

অবশ্য কিছুটা সময়ের ভিতরেই বাবলু ধাতস্থ হয়ে ঘুরে তমসের দিকে হাত বাড়াতেই তমস ওর হাতটা এমনভাবে মুচড়ে দিলে যে বাবলু ব্যথায় ‘উউউউউ’ করে কঁকিয়ে উঠল। এরপর সামনের লোকটিকে গাড়ির জানালাতে প্রচণ্ড জোরে মাথা ঠুকে দিল। সে বেচারি সিটের উপরেই লুটিয়ে পড়ল। বাবলু সেই সময়টুকুর ভিতরে পকেটে হাত ঢোকাতেই তমস অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ওর পিস্তলের বাঁট দিয়ে সজোরে আঘাত করল বাবলুর মাথায়। তারপর পকেট থেকে একটা নাইলনের দড়ি বের করে দ্রুত বাবলুর হাত বেঁধে ফেলল। বাবুলু সিটের উপরে এখন এলিয়ে পড়ে আছে।

ড্রাইভার ছেলেটা ভয়ার্ত চোখে এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। তারপর বিপদ বুঝে রাস্তার ধারে হঠাৎ গাড়িটাকে থামানোর চেষ্টা করছে দেখতে পেয়ে তমস ড্রাইভারের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, “গাড়ি ঘোরাও। নইলে এক্ষুনি তোমার মাথার খুলি উড়ে যাবে।”

ড্রাইভার ছেলেটা গোল গোল চোখে ‘জি স্যার’ বলে গাড়িটাকে আস্তে আস্তে ব্যাক গিয়ার করে কিছুটা এগিয়ে পিছিয়ে নিয়ে ঘোরানোর চেষ্টা করছে। তমস ওর মাথায় পিস্তলটা ঠেকিয়ে রেখে দিল। এরপর বাঁহাত পকেটে ঢুকিয়ে মোবাইলটা বের করে তমস দ্রুত চয়নকে একটা ফোন করল।

মাত্র একবার রিং হতেই চয়ন বলল, “আমি তোর পিছনেই আছি। তুই হয়তো খেয়াল করিসনি।”

তমস দেখল ওদের গাড়িটা ঘুরছে দেখে পিছনের গাড়িটা হঠাৎ একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। আসলে এতটাই সরু পথ, একজন জায়গা করে না দিলে অন্যজন কিছুতেই সেই জায়গা দিয়ে যেতে পারবে না। তার উপরে রাত, গভীর জঙ্গল, পাশেই গভীর খাদ! নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা বালাসন নদী। আকশে চাঁদ উঠলেও পাতার ভিতর দিয়ে সামান্যই আলো এসে পড়েছে পথে। গাড়ির আলোই ভরসা।

গাড়ি দাঁড় করিয়ে তমসকে চয়নদের গাড়িতে তোলা হল এবং দুইজন পুলিশ সেখানে চলে গেল। বাবলু এবং তার শাগরেদের হাতে হাতকড়া পরানো হল।

তমস বলল, “আমার একসময়ে মনে হচ্ছিল গাড়িটা আমাদের গাড়িকে অনুসরণ করেই হয়তো আসছে। কেন জানি তোর কথাই বারে বারে মনে আসছিল। দীপ্তেন তো জানে সবটা। ও নিশ্চয়ই কিছু একটা করছে। তোকে যে ফোন করব সেই ফুরসতটুকু পাইনি।”

একেবারে থানায় এসে থামল দুটো গাড়ি। বাবলু, ওর শাগরেদ আর ড্রাইভারকে লক-আপে চালান করে দিল পুলিশ।

চয়ন বলল, “দীপ্তেনই আমাকে জানিয়েছে তোকে যখন ওরা গাড়িতে তুলল। তুই ওদের চিনিস না ওরা কতটা খতরনাক। ওদের ডালপালা যে কতদূর ছড়ানো তার হদিস পেতেই আমরা সব নাস্তানাবুদ হচ্ছি। ওসব কথা থাক। শোন, এখনই আমাদের একটা অপারেশনে বের হতে হবে। তুই আর দীপ্তেন সাবধানে থাকিস, বুঝলি?”

“মূর্তিটার কোনো খবর পাওয়া গেল?”

“নাহ্‌, তার চাইতে বড়ো ব্যাপার। আজ রাতে আমাদের মাদারিহাটের দিকে যেতে হচ্ছে। ওখানকার একটা গ্রামে কয়েকটা বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে বেশ কিছু চন্দন কাঠের লগ ধরা পড়েছে। পুলিশের সঙ্গে পাচারকারীদের সংঘর্ষ হয়েছে। পাচারকারীদের কয়েকজন আহত হয়েছে এবং একজন নিহত হয়েছে। বেশ উত্তাল অবস্থা বুঝতেই পারছিস। তোকে আমার কোয়ার্টারে নামিয়ে দিয়ে তবে আমি যাব। দীপ্তেন নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছে, ওকে একটা ফোন করে দে।”

সত্যি, এতক্ষণ দীপ্তেনের কথা মাথাতেই আসেনি। তমস মোবাইল বের করে দীপ্তেনের কাছে ফোন করল।

মাত্র একবার রিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দীপ্তেন বলল, “তুমি কোথায় আছ তমসদা? আমার না, ভীষণ টেনশন হচ্ছিল। তোমাকে ওরা কিছু করেনি তো?”

“না রে, চিন্তা করিস না। এই তো আমি আসছি।”

“চয়নদার সঙ্গে দেখা হয়েছে?”

“হুম, চয়নই আমাকে নিয়ে এল। আমি এসে বলছি। তুই কী করছিস?”

“আমরা গোয়েন্দা গোয়েন্দা খেলছি।”

“কার সঙ্গে?”

“শায়েরের সঙ্গে।”

“শায়ের? সে আবার কে?”

চয়ন পাশ থেকে বলল, “আমার বন্ধুর ছেলে। খুব ইন্টেলিজেন্ট। ও আমারও বন্ধু। সব চাইতে বড়ো কথা গোয়েন্দা টর্পেডো ওর আদর্শ। ও নাকি বড়ো হয়ে গোয়েন্দা টর্পেডোর মতো হতে চায়। কয়েকদিন আগে আমার মুখে যখন শুনল গোয়েন্দা টর্পেডো আমার এখানে আসছে তখন থেকে আমায় ফোন পাগল করে দিচ্ছে আমি কখন তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। সেই থেকে আমার কোয়ার্টারের পাশে ঘুরঘুর করছে।”

কথা বলতে বলতে চয়নের কোয়ার্টার চলে এল। চয়ন তমসকে কোয়ার্টারে নামিয়ে দিয়ে মাদারিহাটের দিকে ছুটল।

নয়

তমস ঘরে ঢুকে বলল, “কী রে, তোরা নাকি গোয়েন্দা গোয়েন্দা খেলছিস? আমাকে দেখা তো কেমন সেই খেলা।”

তমসকে দেখে শায়ের চুপ করে গেল। একটু আগেই তমস শুনতে পাচ্ছিল ওর গলা। দীপ্তেন শায়েরকে বলল, “তোকে বলেছিলাম না, ইনি হলেন মিঃ টিপিডি মানে তপদ্যুতি দত্ত, ওরফে ‘গোয়েন্দা টর্পেডো’, আমার তমসদা, বুঝলি?”

শায়ের অবাক হয়ে দেখতে লাগল তমসকে। তার চোখদুটো বিস্ফারিত, মুখটা হাঁ হয়ে গেছে। ইনিই তাহলে গোয়েন্দা টর্পেডো? এঁর সম্বন্ধে চয়ন-আঙ্কেলের মুখে কত গল্প শুনেছে। দুষ্টু লোকেরা নাকি গোয়েন্দা টর্পেডোর নাম শুনলে আঁতকে ওঠে, সেই তিনি এখন ওর সামনে দাঁড়িয়ে?

তমস বলল, “কী ব্যাপার? দেখি তোমাদের খেলাটা কীরকম।”

শায়ের একটু ধাতস্থ হয়ে সংক্ষেপে ওদের চা-বাগানের পাশের মাঠে ক্রিকেট খেলার কথা এবং সেখানে চিতাবাঘের পায়ের ছাপের কথা বলল।

“চিতার পায়ের ছাপ! সত্যি? তারপর?”

তমসের এই জাতীয় প্রশ্নের পরে শায়ের জানাল, গতদিন সন্ধ্যার সময়ে ও একাই গিয়েছিল। বন্ধুরা সেদিন কেউ খেলতে আসেনি। মাঠের ভিতরে একা দেখে ওকেই লক্ষ করে কারা যেন তক্তা ছুড়েছে সেটাও বলে দিল। তক্তার গায়ে সিমেন্ট লাগানো ছিল। মনে হয় সামনে যে বিন্ডিংটা তৈরি হচ্ছে, সেই রাজমিস্ত্রিদের ব্যবহার করা কাঠের তক্তা।

তমস খানিকটা সময় চুপ করে রইল। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল শায়েরের দিকে। শায়েরের ভারি অস্বস্তি হতে লাগল। ও মাথাটা নামিয়ে নিল। এরপর চা-বাগানের শ্রমিকেরা যে চিতাবাঘের ডাক শুনতে পায় সেটাও জানাল। চিতাবাঘের ভয়ে শ্রমিকেরা আর চা-পাতা তুলতে আসছে না বেশ কিছুদিন হল।

“তুমি সেই ডাক শুনেছ?”

“হুম, শুনেছি। সন্ধ্যার পরপরেই।”

শায়ের সেই পোড়ো অসমাপ্ত ফ্ল্যাটবাড়িটার কথা বলল। কিছু দুষ্টু লোক ওখানে থাকে—মদ-গাঁজা খায়, আড্ডা মারে। লোকগুলো ওকে কিছুদিন ধরে টার্গেট করেছিল সেই কথাটাও বলে দিল।

দীপ্তেন নিজের মনেই বলল, “একদিকে চিতাবাঘ, অন্যদিকে দুষ্টু লোক, ভাবো কীভাবে খেলবে ওরা।”

তমস বলল, “আজ তো রাত হয়ে গেছে, আগামীকাল আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারো?”

“সে তো যাওয়াই যায়।” শায়ের জানাল।

“তবে একটা কাজ করা যায়। কাল সকালের দিকে একসময়ে আমাকে মাঠটা দেখাতে হবে। আর বিকেলের দিকে যেমন তুমি খেলতে যাও তেমনি যাবে।”

“আমরা তো শুধু রবিবার দিন আর ছুটির দিনগুলোতে বিকেলে ক্রিকেট খেলতে যাই।”

“নাহ্‌, কাল তুমি যাবে, একাই যাবে। দীপ্তেন অবশ্য তোমার সঙ্গে যাবে, তবে মাঠের আগেই ও নেমে যাবে। তুমি এমন ভাব করবে যে তোমার বন্ধুদের জন্যে অপেক্ষা করছ, যেমন অন্যদিন করো। আরেকটা কথা, দীপ্তেন বা আমার সম্বন্ধে কোনো কথাই বন্ধুদের বলার দরকার নেই। বাড়িতেও এ ব্যাপারে কিছু বলবে না। গোপনীয়তা গোয়েন্দাদের প্রধান অবলম্বন, সেটা জানো তো?”

শায়ের ঘাড় কাত করে বলে, “তাহলে আপনি কখন যাবেন?”

“ওই যে বললাম, কাল সকালে তোমাকে নিয়ে একটু বেরোব, গাড়িতে বসেই তুমি আমাকে মাঠটা দেখিয়ে দেবে।”

“কাল কখন আসব?”

“সকাল সাতটার দিকে রেডি হয়ে থাকবে। আমি তোমাকে ডেকে নেব।”

রাত বাড়ছিল। শায়ের বাড়ি চলে গেলে দীপ্তেন তমসের কাছ থেকে আজকের রোমহর্ষক ঘটনার কথা শুনল। বুঝতে পারল, তমসদা সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। যদিও চয়ন ওর টিম নিয়ে ওদের গাড়িটাকে অনুসরণ করছিল। বাবলু বোধ হয় বুঝতে পেরে ড্রাইভারকে জলদি চালানোর কথা বলে। তারপর সামনের সিটে বসা শাগরেদটাকে কানে কানে কিছু বলতে যায়। আর ঠিক সেই মুহূর্তটাকে তমস কাজে লাগায়।

দীপ্তেন ভেবে অবাক হয়, এর পরেও তমসদা কী সুন্দর শায়েরের সঙ্গে শান্ত মাথায় কথা বলে গেল। ও এর আগেও দেখেছে, বিপদের সময় তমসদার মাথা খুব শান্ত থাকে। একেবারে ‘কুল ব্রেন’ যাকে বলে।

রাত হয়েছে দেখে তমস দীপ্তেনকে ডিনার সেরে নিতে বলে। চয়নের রান্নার মাসি অনেক কিছুই রেঁধে রেখে গেছে। তমস সেসব কিছুই খেল না। তমস একটু ঘরে পাতা দই আর শশা খেল, সঙ্গে কিছু আমন্ড আর গোটা দুই-তিন আখরোট খেল।

খেতে খেতে দীপ্তেন বলল, “তাহলে এটা বোঝা যাচ্ছে এই মূর্তি পাচারচক্রের সঙ্গে রামভগত, বাবলু বাগচী সকলেই জড়িত আছে।”

“হুম।”

“রামভগতের কাছ থেকে কোনো কথা উদ্ধর করা গেল না?”

“দেখছি, কাল একবার থানায় যাবার কথা আছে।”

“ঘনশ্যামবাবু ফোন করেছিলেন।”

“কখন?”

“এই তো, তখন তুমি চয়নদার গাড়িতে। উনি তো সব শুনে বললেন, আমাদের কাছে না শুনে কেন যে তপদ্যুতিবাবু অত বড়ো একটা রিস্ক নিতে গেলেন। এখানকার হালচাল তো উনি কিছুই জানেন না।”

তমস অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়তে লাগল। দীপ্তেন বুঝতে পারল, তমসদা আরো গভীর কিছু চিন্তা করছে।

খাওয়া হয়ে গেলে তমস ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল। আজকের ঘটনাগুলো ভাবাচ্ছে তাকে। সোনার দোকানদার ধরা পড়ে যাওয়ায় গোটা মার্কেটে একটা চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। সেইসঙ্গে অন্য সকলে অ্যালার্ট হয়ে যায়। বাবলুও বুঝতে পারে তার কাছ থেকে জিনিস কেনাটাও একটা ছক। সেইমতো সেও তার লোকজন নিয়ে তমসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। শাগরেদদের বলে, “খুব বড়ো বড়ো ডানা গজিয়েছে কলকাতার গোয়েন্দাবাবুর। দেখব কেমন ডানা মেলে ওড়ে এবার। কলকাতা থেকে এখানে এসেছে গোয়েন্দাগিরি করতে?”

তমস চয়নকে আগেই বলে রেখেছিল। চয়ন বলেছিল ও ঠিকমতো পৌঁছে যাবে। তারপর একবারে হাতেনাতে ধরবে। কিন্তু শেষমুহূর্তে ডি.আই.জির সঙ্গে জরুরি একটা মিটিং থাকায় সময়মতো আসতে পারেনি। কিন্তু যে মুহূর্তে দীপ্তেনের ফোন পেল, তমসের কথা ভেবে আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে বাবলুদের পিছু ধাওয়া করল। দীপ্তেন বুদ্ধি করে আড়াল থেকে গাড়িটার রঙ আর তার নাম্বার বলে দিল। চয়নের অসুবিধা হত না। তমসের জামার বোতামের সঙ্গে যে চিপস লাগানো আছে সেটা ও এই মুহূর্তে কোথায় আছে সেই লোকেশনটা বলে দেয়। চয়ন সেই সূত্র ধরেই গাড়িটাকে অনুসরণ করে। নইলে শুকনা থেকে একটা রাস্তা রোহিণীর দিকে, একটা শুকনা মোড় হয়ে দার্জিলিংয়ের দিকে, অন্যটা ডানদিকে বেকে শিলিগুড়ির দিকে চলে গেছে। আবার দুধিয়ার পরেও গুলিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, ওরা মিরিকের রাস্তা ধরল নাকি বুংকুলুঙ্গের রাস্তায় গেল?

তমস দেখল, দীপ্তেন সানডে সাসপেন্স শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর আইপ্যাড চলছে। গল্প বলে চলেছেন মীর। তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প। সত্যি রোমহর্ষক। আবহ সঙ্গীতের জন্যে আরো আকর্ষণীয় হয়েছে। সব মিলিয়ে চমৎকার পরিবেশন করেছেন মীর।

এরপর থানার বড়োবাবু ঘনশ্যামবাবুর সঙ্গে কথা বলল তমস।

দশ

শায়েরের সঙ্গে চা-বাগান আর মাঠটা দেখার পরে শায়েরকে ওদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে তমস বেরিয়ে গেল জানকী মন্দিরের দিকে।

পাঁচটার কিছু আগেই শায়ের সাইকেলে ব্যাট, প্যাড চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ওকে গোছাতে দেখে শায়েরের মা বলল, “কী রে, আজ আবার কোথায় খেলা?”

“আজ ম্যাচ আছে আমাদের। তোমাকে তো বলা হয়নি, টি-টুয়েন্টি ম্যাচ, খুব বেশি সময় লাগবে না।”

“তাড়াতাড়ি ফিরিস কিন্তু। বাবা তোকে বার বার ওখানে খেলতে যেতে বারণ করেছে, তাও তুই শুনিস না। কোনদিন দেখবি কেউ তোকে ধরে নিয়ে যাবে।”

মা বকবক করতে করতেই শায়ের বাগডোগরা-নকশালবাড়ি হাইওয়ে ধরে বেশ দ্রুত গতিতে প্যাডেল করতে থাকে। সকালেই গোয়েন্দা টর্পেডো ওকে জানিয়ে দিয়েছেন কোথায় দীপ্তেনদা ওর জন্যে ওয়েট করবে। শায়েরের খুব রোমাঞ্চ হচ্ছে মনে গোয়েন্দা টর্পেডোর সঙ্গে ও আজ বের হচ্ছে। কীভাবে উনি রহস্য সমাধান করেন সেটা ও ভাবছে। গোয়েন্দা টর্পেডোকে বেশ মনে ধরেছে শায়েরের। কী সুন্দর ওর সঙ্গে কথা বলছিলেন। মনে হচ্ছিল যেন কতদিনের চেনা। এই জায়গার কথা, ওর বন্ধুদের কথা, বন্ধুর বাবারা কে কী কাজ করেন সব শুনলেন ওর কাছে। কলকাতায় ফিরে যাবার আগেই এর ভিতরে একদিন সকলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলবেন কথা দিলেন।

কাঠের দোকান, করাতকল, হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকান ছাড়িয়ে কিছুটা এগোতেই দীপ্তেন শায়েরকে ডাক দিল। শায়ের সাইকেল থামাতে দীপ্তেন বলল, “আমি চা-বাগানের ভিতরে ওয়েট করব, খুব জোরে ঘণ্টা পোকার আওয়াজ হলেই বুঝতে পারবি আমি চলে এসেছি।”

বেলা প্রায় শেষের দিকে। কিছুটা হলদেরঙা রোদ্দুর গাছের মাথায় তখনো আলতো ছুঁয়ে ছিল। দীপ্তেন চা-বাগানের ভিতরে ঢুকে গিয়ে একটা নালার ধারে বসে পড়ল। এখান থেকে হাজার চেষ্টা করেও কেউ ওকে দেখতে পাবে না। দীপ্তেন লক্ষ করল, এখান থেকে বেশ পরিষ্কার শায়েরকে দেখা যাচ্ছে। বাইরে থেকে কেউ ওকে দেখতে পারবে না এমন জায়গায় বসে আছে ও। চাগাছগুলো প্রায় ওর বুক সমান উঁচু। কয়েকটা ডালবর্জিয়া আর শিশুগাছ ওকে আড়াল করে রেখেছে।

দীপ্তেন শায়েরকে বোঝানো জন্যে ঘণ্টা পোকার আওয়াজ করল। এই বাঁশিটা ও হংকং মার্কেট থেকে কিনেছে। আরেকটা জিনিস কিনেছে যেটা শুনলে সকলে চমকে উঠবে।

দীপ্তেন লক্ষ করল, ঘণ্টা পোকার আওয়াজ শুনে শায়ের মাথা নাড়ল। হাত উঁচু করে বোঝাল সে বুঝতে পেরেছে। দীপ্তেন দেখল ওর থেকে কয়েক মিটার দূরে বেশ কয়েকটা পাইপ পড়ে আছে। আর সেই পাইপের সামনে বেশ কিছু পায়ের ছাপ। শায়ের মিথ্যে বলেনি। একেবার টাটকা পায়ের ছাপ। মনে হচ্ছে একটু আগেই জন্তুটা এখান দিয়ে চলাফেরা করেছে।

দীপ্তেন ভাবল, শুধু শায়ের কেন, যে কেউ এই পায়ের ছাপ দেখলে আতঙ্কিত হবে। চিতার মতো হিংস্র আর খতরনাক জন্তু একটিও নেই। কখন অতর্কিতে যে তোমার গায়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে তুমি বুঝতেও পারবে না।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। শায়ের একা একাই বল নিয়ে ব্যাটে বলে ঠোকাঠুকি করছে। এমন সময় বাতাস কাপিয়ে সেই হুঙ্কার শোনা গেল। মনে হল ধারেকাছেই সে আছে। একবার, দুইবার, তিনবার। হাড় হিম করা সেই আওয়াজ!

গোয়েন্দা টর্পেডো বলেছেন, ‘তুমি বিন্দুমাত্র ভয় পাবে না। তুমি তো সাহসী ছেলে, বড়ো হয়ে গোয়েন্দা হতে চাও, ভালো গোয়েন্দা হতে গেলে সবার আগে যেটা দরকার সেটা হল অপরিসীম সাহস। আজ দেখব তুমি কেমন সাহসের পরিচয় দাও। ভয় পেয়ে পিছিয়ে এলে বা জঙ্গল ছেড়ে পালালে বুঝব তুমি গোয়েন্দা হতে পারবে না।”

শায়েরের বুকের ভিতরটা মুহূর্তের ভিতরে কেঁপে উঠলেও যে মুহূর্তে তপদ্যুতি দত্ত ওরফে গোয়েন্দা টর্পেডোর কথা মনে পড়ে গেল তখনই ও মনকে প্রবোধ দিল, বি স্টেডি, আমাকে গোয়েন্দা টর্পেডোর মতোই সাহসী হতে হবে। তাছাড়া আমি তো আর এই জঙ্গলে একা নই, দীপ্তেনদাদাও আছে। ওর যদি ভয় না করে আমার কেন ভয় করবে?

তবে শায়ের একটা গাছ দেখে রেখেছে। কিন্তু চিতাবাঘ যে ভালো গাছে চড়তে জানে সেটাও ও জানে। আত্মরক্ষার জন্যে ওর কাছে তেমন কিছুই নেই। শায়ের একটা গাছের ডালে আত্মগোপন করল।

দিনের শেষ আলোকবিন্দু মুছে গেছে। চারদিকে ঝিঁঝিঁর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ দীপ্তেন লক্ষ করল, দুইজন লোক জঙ্গলের দিকেই হেঁটে আসছে। দীপ্তেন সতর্ক হল। সরীসৃপের মতো মাটিতে শুয়ে পড়ল। দেখল, লোক দুইজন আস্তে আস্তে সেই পাইপগুলোর দিকেই এগিয়ে আসছে। ওদিক ওদিক তাকিয়ে একজন গুঁড়ি মেরে সেই পাইপের ভিতরে ঢুকে গেল। দীপ্তেন নিশ্চুপ হয়ে দেখতে লাগল।

লোকটা তারপর পাইপের ভিতর থেকে একটা বাক্সমতো বের করে অন্যজনের হাতে দিল। ঠিক সেই সময়ে বাতাস কাঁপিয়ে গুড়ুম! গুড়ুম! গুড়ুম! তিনবার গুলির শব্দ হল।

শায়েরের শরীর বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। হাত-পা কাঁপছে। ও তবু শক্ত করে গাছের ডাল আঁকড়ে বসে রইল।

লোকটার হাত থেকে সহসা বাক্সটা পড়ে গেল। পাশের সঙ্গী হঠাৎ পকেট থেকে পিস্তল বের করে সামনে উঁচিয়ে ধরল। তারপর শূন্যে এক রাউন্ড গুলি ছুড়ল। বোঝাল সেও নিরস্ত্র নয়।

শায়ের দেখল, কালো পোশাকে সর্বাঙ্গ ঢাকা তৃতীয় আগন্তুক তাদের দিকে পিস্তল উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে। শায়ের ধরে নিল অন্য পার্টি হবে, দুইদলের ভিতরে হয়তো গোলমাল বেধেছে। এক্ষুনি হয়তো গুলির লড়াই চলবে।

কালো পোশাক পরা লোকটি তাদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, “একদম চালাকি করবার চেষ্টা করবে না। যেখানে আছ সেইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকো। মাথার উপরে হাত তোলো, তোলো বলছি! নইলে এক্ষুনি গুলি ছুড়তে বাধ্য হব।”

লোকদুটোর ভিতরে একজন কালো বেশধারীর দিকে দ্রুত এগিয়ে এসে তাকে লাথি মারার চেষ্টা করতেই তমস চকিতে পেল্লাই সাইজের একটা ঘুসি মারল তার মুখে।

‘আ-আ-আ-আ’ করতে করতে বেচারা মাটিতে পড়ে কোঁকাতে লাগল। মনে হচ্ছে চোয়ালের হাড় বুঝি ভেঙেই গেছে। সেই সুযোগে অপরজন চা-বাগানের ভিতর দিয়ে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে বাগানের ভিতর থেকে একজন ছুটে এসে পলায়নরত লোকটাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিল মাটিতে। লোকটা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যেতেই ছেলেটা তার হাতদুটো পিছনদিকে ধরে তাকে টানতে টানতে মাঠের দিকে নিয়ে এল।

কালো পোশাক পরা লোকটা ছেলেটাকে বলল, “দীপ্তেন, ওর হাতদুটো বেঁধে ফেল, ওকে কিছুতেই পালাতে দিবি না।”

আরে, এ তো তো গোয়েন্দা টর্পেডোর গলা! শায়েরের বুকের ভিতরে সহসা একটা ডুগডুগি বেজে উঠল ডুডুক ডুডুক ডুডুক সুরে। গাছ থেকে নেমে এল শায়ের। একছুটে চলে এল দীপ্তেনদার কাছে।

মাটিতে পড়ে থাকা লোকটার হাতদুটোও বেঁধে ফেলল তমস। তারপর একটা ফোন করল থানায়।

একটা জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে সবেমাত্র চেয়ারে এসে বসেছেন ঘনশ্যমবাবু। তখনই তমসের ফোন এল। তমসের ফোন পাওয়ামাত্র তিনি সেই মুহূর্তে তড়িঘড়ি ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। খুব বেশি দূর তো নয়। তার থানা থেকে বড়োজোর কুড়ি মিনিট লাগল লোকেশনে পৌঁছতে।

ঘনশ্যামবাবু বললেন, “ওহ্‌, তোরা? আবার এইসব কুকাজ করেছিস?” তারপর তমসের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই নিয়ে কতবার যে এরা জেল খাটল। ঢোকে, বের হয়, আবার একটা কুকাজ করে আবার ঢোকে। আমি বলি কী, এদের বাইরে বের করাই যাবে না। জেলে পচে মরুক।”

পাশ থেকে একজন বলে, “জেলে পচবে কী, জেলে তো এরা ভালোই থাকে। পেট পুরে খাচ্ছে-দাচ্ছে।”

তমস আলোতে একজনকে চিনতে পারল। মুখে কালি মেখে এলেও তমসের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। তমস ছেলেটার কাছে গিয়ে বলল, “জানকী মন্দিরের দারোয়ান রামভগত না? তুমি রাতে এইসব করো তাহলে? আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি ‘রামতনু কনভেন্ট’ বলে আদৌ কিছু নেই এখানে।”

রাম মাথা নীচু করল।

এরপর চলল জেরা। তমসের জেরার চোটে সব সত্যি কথা বলতে বাধ্য হল রামভগত। শুধু জানকী মূর্তিই নয়, এর আগে সে আরো অনেক প্রাচীন মূর্তি চুরি করে সেগুলো পাচার দিয়েছে। এই কাজে তার সঙ্গে ছিল কেশব। কেশব মূর্তিগুলো নেপালে পাচার করে দিত। রামভগত লিঙ্ক-ম্যান হিসেবে কাজ করত। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত আছে। ওদের দলে বিনোদকেও যুক্ত করেছিল।

তবে এবারে বিনোদকে অন্ধকারে রেখেই কেশব আর রাম দুইজনে যুক্তি করে জানকী মূর্তি এবং মন্দিরের টাকাপয়সা, গয়নাগাটি সব চুরি করে। বিনোদকে সেদিন কেশবই ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিল।

কথাটা বলে তমস ওর প্যান্টের পকেট থেকে একটা হোমিওপ্যাথির ওষুধের শিশি বের করে টেবিলে রাখে। তার গায়ে বাংলায় লেখা আছে ‘প্রেশারের ওষুধ’। আদতে এগুলো হল স্লিপিং পিল। এর দুটি ট্যাবলেট জলে গুলে খাওয়ালেই পাঁচ মিনিটের ভিতরে সে ঘুমে বেহুঁশ হয়ে যাবে।

থানার অন্যান্য অফিসারেরা তমসের মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনতে লাগলেন।

তমস এরপর কেশবকে জিজ্ঞাসা করে, “তোমাদের দলের চাঁই কে?”

রাম চুপ করে আছে। কেশবের মুখে কোনো কথা নেই। একেবারে চুপ করে আছে। কিছুতেই মুখ খুলছে না।

সেকেন্ড অফিসার তখন রামের কলার চেপে ধরে। তারপর পিঠে এবং পায়ের তলায় খানকতক রুলের বাড়ি মেরে কথা উদ্ধার করে।

রাম বলতে বাধ্য হয়। বলে, এই পাচারকারীর মূল যে পান্ডা তাকে এরা কোনোদিন চোখেই দেখেনি। তাদের কাজ হল নির্দিষ্ট একজনের হাতে মালগুলো তুলে দেওয়া এবং তার কাছ থেকে টাকা নেওয়া। তবে সে মূল চক্রীর নাম শুনেছে।

“কী নাম তার?”

“কে.পি।”

“কে.পি! মানে কোটি পতঙ্গ?”

কেশব নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ে।

দীপ্তেন চমকে ওঠে। কোটি পতঙ্গ তো একজন ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলার! সারা পৃথিবী জুড়ে তার ব্যাবসা। তমসদার কাছে এই তো সেদিন সে নামটা শুনল।

সেকেন্ড অফিসার একেবারে হাতকড়া পরিয়ে লক-আপে চালান করে দিল দুইজনকে।

এগারো

ইতিমধ্যে চয়ন সেখানে এসে পৌঁছেছে।

ঘনশ্যামবাবু নিজের হাতে বাক্সটা খুললেন। খুলতেই সকলে চমকে উঠল। বাক্সের ভিতরে রাখা আছে একটা মূর্তি। উচ্চতায় দেড় ফুটমতো হবে।

তমস হাতে নিয়ে দেখল মূর্তিটা। চয়ন বলল, “এটাই তো সেই জানকী মূর্তিটা। কীভাবে হদিশ পেলে এর?”

তমস বলল, “এর জন্যে অবশ্য ধন্যবাদ দিতে হবে আমাদের হবু গোয়েন্দাকে।”

“হবু গোয়েন্দা? সে আবার কে?”

দীপ্তেন মিটিমিটি হাসছিল। তমস বলল, “ওই যে আপনাদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। কী রে, সামনে আয়, সকলে তোকে দেখতে চাইছে।”

শায়ের সকলের সামনে এসে দাঁড়াল। তমস বলল, “ওর কিছু কথা আমার ইনভেস্টিগেশনে দারুণ কাজে দিল। ওরা ওই চা-বাগানের পাশের মাঠটাতে কিছুদিন হল খেলতে যাচ্ছিল। কয়েকদিন বাদে লক্ষ করল মাঠের ভিতরে এবং বাগানে পড়ে থাকা কিছু জলের পাইপের ধারে টাটকা চিতাবাঘের পায়ের ছাপ। চিতার পায়ের ছাপ দেখে এবং বাঘের ডাক শুনে ভয়ে শ্রমিকেরা বেশ কিছুদিন ওই বাগানে আর চা-পাতা তুলতে আসছে না। কুলি লাইনের আদিবাসী ছেলেগুলোও আর ভয়ে এদিকের ছায়া মাড়াচ্ছে না। এইটুকুতে আমার মনে কোনোরকম ধন্দ লাগেনি। কিন্তু যখন শুনলাম, দুই-তিনদিন আগে শায়েরকে লক্ষ করে কারা যেন একটা তক্তা ছুড়ে ওকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। এরপরে ওকে ভয় দেখায়, এখানে যেন না ওরা খেলাধূলা করে। একজন তো ইতিমধ্যে ওকে ভালোমতো শাসিয়েও গেছে।

“এসব কিছু মিলিয়ে আমার মনে হল কেউ বা কারা ঠিক চায় না বাচ্চারা এই মাঠে খেলুক। কিন্তু কেন? তারা খেললে অন্যদের কীসের আপত্তি? শায়েরের কথাগুলো আমাকে বেশ ভাবাচ্ছিল। গতকাল আমি জায়গাটা দেখে আসি। তারপর পরে একাই যাই সেখানে। পাইপের ধারে চাগাছের আশপাশ ঘুরতে ঘুরতে ঝোপের ভিতরে একটা লোহার জিনিস চোখে পড়ে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঝোপের ভিতর থেকে সেই লোহার দণ্ডটা নিয়ে আসি। আর সেই জিনিসটা দেখার পরেই আমার কাছে বিষয়টা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়।”

জিনিসটা দেখার জন্যে সকলে ব্যগ্র হয়ে আছে। কী সেই জিনিস যা এত বড়ো একটা রহস্যের জাল ছিন্ন করে দিল?

ঘাড় ঘুরিয়ে তমস দীপ্তেনকে বলে, “যা, গাড়ি থেকে জিনিসটা নিয়ে আয়।”

দীপ্তেন চাবিটা নিয়ে একদৌড়ে গাড়ির ডিকি থেকে জিনিসটা নিয়ে এল। সকলে দেখল, প্রায় একহাত লম্বা একটা লোহার দণ্ড।

তমস লোহার দণ্ডটাকে হাতে নিয়ে দেখাল। দণ্ডের মাথাটাকে চিতাবাঘের পায়ের আদলে বানিয়ে নিয়েছে। সেইরকম তীক্ষ্ণ নখরযুক্ত। সেটাই যখন নরম মাটির উপর বসাচ্ছে তখন হুবহু চিতার পায়ের ছাপ বলেই মনে হচ্ছে।

শায়েরও দেখল চিতাবাঘের পায়ের মতোই বাঁকানো আর ধারালো লোহার আঙুলগুলো। সত্যি পাচারকারীদের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।

সকলে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল জিনিসটা।

ঘনশ্যামবাবু কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে কী একটা ভেবে নিলেন। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “সে নাহয় পায়ের ছাপের রহস্য ভেদ হল, কিন্তু বাঘের ডাক?”

কথাটা মুখ থেকে বার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ ঘনশ্যামবাবুর পিছনের দিকের জানালায় হুঙ্কার দিয়ে উঠল একটা চিতা, ‘হুম্মম! হুম্মম!’

সকলে চমকে উঠল।

ঘনশ্যামবাবু ‘বাপ রে, বাঘ বাঘ’ বলে চিৎকার করে দ্রুত চেয়ার থেকে সরে আসতে গিয়ে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন মেঝের উপরে। চয়ন ঘনশ্যামবাবুকে হাত ধরে টেনে তুলল। চিতাটা আবার ডেকে উঠল হুমম হুমম শব্দে। উপস্থিত সকলে এর ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন।

তমসের মুখের অভিব্যক্তি দেখে চয়ন হাসছে। সেদিন হংকং মার্কেট থেকে কেনা হয়েছে এই মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্টটা। বিভিন্ন জন্তুজানোয়ারের আওয়াজ শোনা যায়। দীপ্তেন আরেকবার বাজিয়ে শোনাল সকলকে।

তমস বলল, “দুষ্কৃতিরা জানকী মূর্তি চুরি করার পর বুঝতে পারে চারদিকে বিশেষ করে সীমান্তে জোর তল্লাশি চলছে। বিশেষ করে নেপাল, ভুটান বা সিকিমের দিকে কড়া নজরদারি চলছে। এই সময় কিছুতেই সেটা বাইরে আনা যাবে না। তাই সচরচার যেটা কারো মাথায় না আসে তেমন জায়গায় এটা রেখে দিল। মূর্তিটাকে বাইরে পাচার না করা পর্যন্ত চিতার পায়ের ছাপ আর বাগানে যাতে কেউ ভয়ে ঢুকতে না পারে তার জন্যে চিতাবাঘের ডাক শোনাত মাঝে মাঝেই। চা-বাগানটাকে বেছে নিয়েছিল এই কারণে যেহেতু রাস্তার উলটোদিকের ওই পরিত্যক্ত বাড়িটা ছিল ওদের আস্তানা। ওখান থেকেই তারা নজরদারি চালাত। চিতার ভয়ে চা-বাগানের শ্রমিকেরাও কাজ বন্ধ করে দিল। আর সেটাই ওরা চাইছিল। কিন্তু বাদ সাধল শায়েরের ক্রিকেট টিম। ছেলেগুলো প্রচণ্ড বিচ্ছু আর অদম্য সাহস ওদের। সেটা ওরা ভালোই বুঝতে পেরেছিল।

“ছেলেদের খেলতে আসাটাকে কিছুতেই ওরা মেনে নিতে পারছিল না। শায়ের ছিল দলের লিডার। তাই সেদিন ওরা শায়েরকে টার্গেট করে তক্তা ছুড়েছিল। যাতে ভয়ে ও কিংবা ওর বন্ধুরা এই জায়গার ছায়া না মাড়ায়।

“আমি সেদিন সকালে শায়েরকে নিয়ে জায়গাটা দেখে আসার পরে সন্ধের দিকে একবার আমি আসি এখানে। চায়ের দোকানে বেশ কিছুটা সময় কাটাই। তারপর পাগলের বেশে ওদের ঠেকে যাই। পাগলের ছদ্মবেশ থাকায় ওরা আমায় চিনতে পারেনি। উপরন্তু আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় কোত্থেকে কোন পাগল এসেছে, এই তাড়া এটাকে বলে। সেখানে কেশবের দেখা পাই। আমার অনুমান যে সঠিক সেটা মিলিয়ে নেই।

“ওরা আমায় চিনতে পারেনি। আমি অদূরে চায়ের দোকানে বসে সবকিছু লক্ষ রাখছিলাম। দলটা বেরিয়ে গেলে আমি সেখানে যাই এবং ভালো করে পর্যবেক্ষণ করি। দেখি ওই জায়গা থেকে চা-বাগানে যেখানে পাইপের ভিতরে মূর্তির বাক্সটা রাখা আছে সেটা বেশ ভালোভাবেই লক্ষ করা যায়।

“জেরায় অবশ্য স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে কেশব, যে ওই সেদিন রাতের দারোয়ান বিনোদকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বেহুঁশ করে তারপর মূর্তিটা পাচার করেছিল। অনেকদিন তক্কে তক্কে ছিল। তাই রাম নবমীর দিনটাকেই ও বেছে নিল। কারণ সেদিন গ্রামের সকলে মেলা, যাত্রাপালা ইত্যাদি নিয়ে মশগুল থাকবে। এই সুযোগে তারা মূর্তিটাকে সরিয়ে ফেলবে। এই কাজে তাকে সাহায্য করে রামভগত।

“রামভগত এই মূর্তি পাচার করে একটা ফ্ল্যাট বুক করেছে মাটিগাড়াতে, সেটাও সকলে জানল। মাটিগাড়ার সেই প্রমোটারও এখানে উপস্থিত আছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, তিনি সত্যি জানতেন না লোকটয়া এরকম একটা দুই নম্বরি কাজের সঙ্গে যুক্ত আছে।”

সকলে তমসের বুদ্ধির তারিফ করতে থাকেন, “এই না হলে গোয়েন্দা টর্পেডো!”

এই গ্যাংটা বেশ কিছুদিন ধরে তাঁদের নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছিল। একের পর এক মূর্তি পাচার করে যাচ্ছিল। কিন্তু হাতেনাতে তাদেরকে কিছুতেই ধরতে পারছিলেন না।

শায়েরের বেশ রোমাঞ্চ লাগছে ব্যাপারটা ভাবতে। স্কুলে গিয়ে যতক্ষণ বন্ধুদের সঙ্গে গল্প না করতে পারছে ততক্ষণে ঠিকঠাক মজা পাচ্ছে না।

জানকী মূর্তিটা মন্দিরে রাখা হবে নাকি নৃতত্ত্ব বিভাগে রাখা হবে সেই ব্যাপারে জোর আলোচনা চলছে উচ্চ পর্যায়ে। কারণ মূর্তিটার দাম নাকি প্রায় চল্লিশ কোটি টাকা। সংবাদপত্র মারফত সকলেই সেটা জেনে গেছে। পাচারকারীরা সত্যিই জানত না মূর্তিটা যে কতখানি দূর্মূল্য। প্রকাশ্যে আসায় তারা বুঝতে পারল কী অমূল্য সম্পদ তারা পাচার করতে যাচ্ছিল। কত সামান্য দাম তারা পাচ্ছিল বিনিময়ে।

সরকার থেকে এবারে মূর্তিটাকে তাই সংরক্ষণ করার কথা ভাবা হচ্ছে।

শায়েরের বন্ধুরা সবাই এসেছিল আজ। তমস প্রত্যেককে ক্যাডবেরি আর চকলেট উপহার দিল। আর বলল, “তোমরা সকলে চোখ-কান খোলা রাখবে, কোথাও সন্দেহজনক কিছু দেখলে, গোলমেলে ব্যাপার মনে হলে চয়নকে জানাবে।” তারপর শায়েরের হাতে সেই মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টটা দিয়ে বলল, “এটা তোমার উপহার।”

“থ্যাঙ্ক ইউ আঙ্কেল।” বলে জিনিসটা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল শায়ের।

শায়েরের খুব ভালো লাগল উপহারটা পেয়ে এবং সেইসঙ্গে মনটা ভারী হয়ে এল দীপ্তেনদাদার জন্যে। চোখের কোণ বেয়ে দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

দীপ্তেন ওর হাত ধরে বলল, “আবার আসব। রহস্যের আভাস পেলে তুই যখন ডাকবি চলে আসব, কেমন?”

চয়নের স্করপিও ছুটে চলল হাইওয়ে ধরে বাগডোগরা এয়ারপোর্টের দিকে। চয়ন নিজেই এসেছে তমস আর দীপ্তেনদের সি অফ করতে। বিকেলের কোমল আলোতে দূরের পাহাড়টাকে জলরঙে আঁকা ছবির মতোই মনে হচ্ছে। দীপ্তেন আনমনা হয়ে দেখতে লাগল রহস্যে ভরা এই শহরের মোহময় রূপ।

অলঙ্করণ: শিমূল সরকার

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s