জয়দীপ চক্রবর্তীর আগের লেখাঃ নিবারণ চক্কোত্তির হাতঘড়ি, গোলমেলে গন্ধ, আলোর কাছে ফেরা, পরিদাদুর সঙ্গে বহরমপুরে, সোনার চেয়েও দামি
সুছন্দা প্রথমটা আপত্তিই করেছিলেন। পরিদাদু প্রস্তাবটা দিতেই নাক সিঁটকে বলে উঠেছিলেন, “এতদিন ঘরবন্দি থাকার পর বেড়াতেই যদি বেরোই, অমন ঘরের মধ্যে আটকে থাকতে যাব কেন? তার চেয়ে বরং গ্যাংটক চলো, সঙ্গে পেলিং টেলিং-ও ঘুরে আসা যাবে। তা না হলে সিমলা টিমলা…”
অরুণাংশু বিরক্ত হয়ে বললেন, “কেন হলং-এ সমস্যাটা কোথায় তোমার?”
“ওই যে পরিকাকু বলল শুনলে না, জায়গাটা একেবারে নিরিবিলি। জলদাপাড়ার জঙ্গলের বলতে গেলে একেবারে মাঝ মধ্যিখানেই। কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়েই হাতি-টাতি দেখা যেতে পারে কপাল ভালো থাকলে…”
“সেটাই তো ভালো। অমন জায়গাতেই তো মানুষ বেড়াতে যায় পয়সা খরচা করে। প্রকৃতির কোলে থাকা। নাগরিক আওয়াজ টাওয়াজ কানেই আসবে না দু’তিনটে দিন। রাতের অন্ধকার চিরে ঘরের মধ্যে শুয়ে শুয়েই হাতির ডাক শুনব। ভোরবেলা ময়ূরের ডাকে ঘুম ভাঙবে…”
“ময়ূরের ডাককে কী বলে, জানিস শানু?” অরুণাংশুর কথার মাঝখানেই জিজ্ঞেস করলেন পরিদাদু।
“হুঁ জানি,” শাওন হাসল, “কেকা।”
“ভেরি গুড,” পরিদাদুর গলায় তারিফ ফুটল, “আর হাতির ডাক?”
“বৃংহন–”
“বাঃ।”
“মুখে মুখে বাংলা শব্দছক শুরু করলে নাকি পরিকাকু?” টি টেবলের ওপরে চায়ের ট্রে-টা নামিয়ে রাখতে রাখতে সুছন্দা বিরক্ত হয়ে বললেন, “একটু লোকজন দোকান-পাট না থাকলে বেড়াতে যেতে ভালো লাগে? ফিরে এলেই চেনা জানা বন্ধু প্রতিবেশীরা জিজ্ঞেস করবে বেড়াতে গিয়ে কী কিনে আনলুম। তখন কী জবাব দেব তাদের?”
“ঠিকই তো,” পরিদাদু গম্ভীর গলায় মাথা নেড়ে নেড়ে বলতে লাগলেন, “খুকুর এই সমস্যাটার কথা তো আমার মাথায় আসেনি আগে। এ সত্যিই ভারী গভীর সমস্যা হে অরুণ…”
কথাটা শেষ করে এমন মুখ করে তাঁর দিকে চাইলেন পরিদাদু যে অরুণাংশু হো হো করে হেসে উঠলেন।
সুছন্দা রেগে গেলেন। মুখ ভার করে বললেন, “খালি আমাকে নিয়ে মজা করো তোমরা পরিকাকু। একদম ভাল্লাগে না আমার…”
পরিদাদু এবারে সত্যি সত্যিই গম্ভীর মুখে তাকালেন সুছন্দার দিকে, “আমি বলছি। তুই দেখে নিস খুকু, জায়গাটা ভালো লাগবে তোর। শোন, দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি কাটাতেই তো প্রকৃতির কাছে আশ্রয় চাই আমরা। সেই নির্মল আশ্রয়ে নিজের কাছে ফেরার খানিক অবকাশ পায় মানুষ। বাইরের দশ রকম কৃত্রিম আওয়াজে সেই নিভৃতি যে ছিঁড়ে যায়…”
“ডুয়ার্সে তুমি তো আগেও গেছ। ভালো লাগেনি বলো?” অরুণাংশুও পরিদাদুর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বললেন সুছন্দার দিকে চেয়ে।
“তা লেগেছে। তবে আমার বাপু নিরিবিলি জায়গার থেকে একটু জমজমাট জায়গাই বেশি ভালো লাগে,” সুছন্দা হাসলেন, “এছাড়াও আর একটা কারণও ভাবছি।”
“কী কারণ?” পরিদাদু চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন।
“তোমার সঙ্গে যেখানেই গেছি সুখে শান্তিতে বেড়ানো তো কপালে জোটেনি কখনও। একটা না একটা ঝঞ্ঝাট ঠিক এসে জুটেছে। চারপাশে লোকলস্কর থাকলে তবু বিপদের সময় খানিক সাহায্যের আশা থাকে। কিন্তু ওই বনে বাদাড়ে…”
পরিদাদু এত জোরে হো হো করে হেসে উঠলেন যে সুছন্দার বাকি কথা চাপা পড়ে গেল।
অরুণাংশু এবারে কিন্তু সুছন্দার কথাতেই সায় দিলেন, “তোমার এ কথাটা সত্যিই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না খুকু। পরি যেখানেই যায় কোনো না কোনো একটা রহস্যকে নেমন্তন্ন করে সঙ্গে নিয়ে যায়।”
“সে রহস্য সমাধানের পরে মনে মনে একটা রোমাঞ্চ আসে কিনা সে কথাটাও বলো।” পরিদাদু মুচকি মুচকি হাসছেন এখনও।
“রোমাঞ্চ না ছাই,” সুছন্দা মুখটাকে বেঁকিয়ে বলেন, “একবার করে তোমার সঙ্গে বাইরে বেরোই আর টেনশনে ভুগে ভুগে দু-পাঁচ বছর করে আয়ু খুইয়ে ফিরে আসি।”
“তাহলে আমার সঙ্গে তোদের আর না বেরনোই বোধহয় ভালো,” পরিদাদুর হাসিটা মুখ থেকে দপ করে নিভে গেল।
শাওন দেখল, এ তো মহা বিপদ হল। মায়ের এমন বেফাঁস মন্তব্যে ট্যুরটাই না বাতিল হয়ে যায়। তাছাড়া সত্যিই যদি পরিদাদুর সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষেরই মতো ঘুরে বেড়িয়ে ফিরে আসে তাহলে তো তার আর মনই ভরবে না। পরিদাদুর সঙ্গে নানান অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে সে ইতোমধ্যেই বন্ধু এবং শিক্ষক মহলে একটা আলাদা পরিচিতি এবং সম্ভ্রম পাচ্ছে আজকাল। পরিদাদু মায়ের কথায় সত্যি সত্যিই যদি তাকে ছাড়াই অভিযানে বেরোতে শুরু করেন, তাহলে তার এই বাড়তি সম্মান যে ধুলোয় মিশে যাবে আর কদিন পর। ট্যুরটা যাতে বাতিল না হয়ে যায় সেইজন্য সে তড়িঘড়ি জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা পরিদাদু, এই হলং জায়গাটা ঠিক কোনখানে বলো তো?”
“যে বাংলোতে থাকার প্ল্যান করছি সেটা নিউ জলপাইগুড়ি রেল স্টেশন থেকে খুব বেশি হলে একশ কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটার। জঙ্গলের অন্তত আট দশ কিলোমিটার ভেতরে অনেকখানি জায়গা জুড়ে কতকগুলো ছড়ানো ছিটনো কটেজ বানিয়ে চমৎকার ব্যবসা করছেন মিস্টার ঘোষ। আমাকে হোয়াটস অ্যাপে কটেজগুলোর ছবি পাঠিয়েছিলেন ভদ্রলোক। বাঁশের কাজ করা দেওয়াল, সিলিং… খোলামেলা লন, ব্যাডমিন্টন কোর্ট, বার বি কিউ-এর বন্দোবস্ত, সব মিলিয়ে বিউটিফুল অ্যামবিয়েন্স। ভদ্রলোক বললেন, সম্প্রতি তিনি নাকি একটা ওয়াচ টাওয়ার বানিয়েছেন। সেখান থেকে হরিণ, ময়ূর, গাউর টাউর তো দেখা যায়ই, এমনকি মাঝেমধ্যেই হাতির দল এবং জলদাপাড়ার বিখ্যাত একশৃঙ্গ গন্ডারও এসে দেখা দিয়ে যায় সামনের জঙ্গল থেকে কটেজের সামনে উঁকি ঝুঁকি মেরে…”
“দারুন ব্যাপার তো,” উত্তেজনায় হাততালি দিয়ে উঠে বলল শাওন।
“দারুন বলে খুব তো লাফিয়ে উঠছিস,” শাওনের দিকে চেয়ে চোখ পাকিয়ে বললেন সুছন্দা, “আর যদি ওগুলো বাংলোর মধ্যে ঢুকে পড়ে?”
“তা অবিশ্যি পড়ে মাঝেমধ্যে,” চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে নিয়ে বললেন পরিদাদু, “তার জন্যেই সন্ধে থেকে সারা রাত্তির পাহারাদারির ব্যবস্থা রয়েছে ওখানে। আর রাতে কটেজের সামনের যে লন, তার ওপাশের জঙ্গলের পথে পা বাড়ানো স্ট্রিক্টলি প্রহিবিটেড।”
পরিদাদুর কথা শুনে গা ছমছম করে উঠল শাওনের। আবার আনন্দও হল খুব। সত্যিই যদি হলং-এর কটেজের বারান্দায় বসে সামনের জঙ্গলে হাতির পাল বা গন্ডার দেখা যায়, তাহলে ফিরে এসে স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের কাছে জমিয়ে গল্প করা যাবে।
এতক্ষণে বোধহয় সুছন্দাও মনে মনে খানিক উৎসাহ পেয়েছেন। হাতের কাজ তাড়াতাড়ি সেরে নিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে পরিদাদুর পাশে এসে বসলেন তিনি। তারপর আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস্ব করলেন, “এই যে একটু আগে মিস্টার ঘোষ না কার কথা বললে যেন পরিকাকু, তা এই ভদ্রলোককে পেলে কোথা থেকে?”
“ফেসবুক,” পরিদাদু হাসলেন, “অনেকেই এইসব আধুনিক গ্যাজেটগুলোকে তুড়ে গাল পাড়ে শুনতে পাই। আমি কিন্তু বাপু বলি, বিজ্ঞান আমাদের যে সুযোগগুলো দিচ্ছে সেগুলোকে চুটিয়ে ব্যবহার করে নেওয়াই ভালো। তবে হ্যাঁ, দেখতে হবে সেই ব্যবহার যেন সুব্যবহার হয়। বিজ্ঞানের অপব্যবহার বড় ভয়ংকর, বড় আত্মঘাতি…”
“ঠিক,” মাথা নেড়ে সায় দিলেন অরুণাংশু।
এতসব কথা শোনার আগ্রহ ছিল না শাওনের। সে জিজ্ঞেস করল, “যাওয়াটা তাহলে হচ্ছে তো মা?”
“হচ্ছে, আলবাত হচ্ছে,” পরিদাদু তার পিঠে আলতো চাপড় মেরে বললেন। তারপর সুছন্দার দিকে তাকিয়ে বললেন কী বলিস খুকু, যাওয়া হচ্ছে তো?”
“চলো, ঘুরেই আসা যাক,” বলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন সুছন্দা, “তবে একটা শর্ত আছে আমার।”
“এর মধ্যে আবার শর্তের কথা আসছে কেন?” অরুণাংশু বিরক্ত হয়ে বললেন।
“কারণ আছে,” বলে হাসলেন সুছন্দা।
“কী শর্ত?” পরিদাদু জিজ্ঞেস করলেন।
“আমরা কিন্তু নিছক বেড়াতেই যাব পরিকাকু।”
“আমারও তাই ইচ্ছে,” পরিকাকু নিজেও হাসলেন, “কিন্তু পরিস্থিতির ওপরে তো আর সবসময় আমার নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকে না—”
শাওনের তর সইছিল না। অরুণাংশুর দিকে চেয়ে সে বলল, “এত কম সময়ের মধ্যে টিকিট পাওয়া যাবে বাবা?”
“দেখছি,” বলেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে তার স্ক্রিনের ওপরে চোখ রাখলেন অরুণাংশু।
২
“হলং পান্থ নিবাস” মূল রাস্তা থেকে অনেকই ভিতরে। কিন্তু এখান থেকে জাঙ্গল সাফারি করার ক্ষেত্রে সুবিধে একটু বেশি। যেখান থেকে সরকারিভাবে এলিফ্যান্ট সাফারি হয়, সে জায়গাটা এখান থেকে দূরে নয়। এখন অবশ্য জঙ্গল সাফারি বন্ধ। সেপ্টেম্বর মাসের পনের তারিখের পর আবার সাফারি চালু হবে। ভারতবর্ষের সমস্ত জঙ্গলেই এই নিয়ম। বর্ষার শুরু থেকে এই তিন মাস জঙ্গলের পশু পাখিদের নিজেদের মতন থাকতে দেওয়া হয়। মানুষ তাদের এলাকায় ঢুকে পড়ে অহেতুক বিরক্ত করতে পারে না।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের বাইরেই গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল। আলুয়াবাড়ি পেরোতেই পরিদাদু ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছিলেন ফোনে। পরিদাদুর বন্ধু ঘোষ আঙ্কল হোয়াটস অ্যাপ করে ড্রাইভারের নাম, ছবি, ফোন নম্বরের সঙ্গে গাড়ির নম্বরও দিয়ে দিয়েছিলেন। ড্রাইভারের বয়েস খুব বেশি নয়। দেখে মনে হল পঁচিশ ছাব্বিশ। ঝকঝকে মুখ, স্মার্ট। ট্রেন থেকে নেমে মস্ত ব্রিজটা পেরিয়ে নিচে নামতেই ছেলেটাকে দেখতে পাওয়া গেল। জিন্সের ওপরে মেরুন রঙের টি শার্ট পরে দাঁড়িয়েছিল। মাথায় জিন্সের ক্যাপ। দূর থেকে শাওনদের দেখতে পেয়েই ছেলেটা হাত নাড়তে লাগল হাসি মুখে।
পরিদাদু তাকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন, “যাক চিন্তা নেই। সঞ্জীব একদম ঠিক সময়ে এসে গেছে।”
সঞ্জীব ছেলেটি বেশ চটপটে। দ্রুত শাওনদের লাগেজগুলো গাড়ির মাথায় তুলে দিয়ে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল। তারপর পরিদাদুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “ট্রেন থেকে কি সকালের চা খেয়ে নেমেছেন, নাকি দাঁড়াব? এক রাউন্ড চা খেয়ে নিয়েই তাহলে রওয়ানা দিই আমরা?”
অরুণাংশু বললেন, “এখানে চা খাওয়ার জন্যে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে পড়ি বরং। পথে একটা ভালো জায়গা দেখেই দাঁড়ানো যাবে। চা টিফিন একসঙ্গেই করে নেব আমরা।”
দু হাত নেড়ে একেবারে হাঁ হাঁ করে কুঠল সঞ্জীব, “রথীনকাকু আমাকে খুন করে ফেলবেন। গাড়ি নিয়ে বেরনোর সময় বার বার করে বলে দিয়েছেন রাস্তায় যেন একদম দেরি না করি। আপনাদের জন্যে ব্রেকফাস্ট রেডি করে অপেক্ষা করবেন উনি।”
“রথীনকাকু?” সুছন্দা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“মিস্টার ঘোষ,” পরিদাদু বললেন, “ওঁর পুরো নাম রথীনকুমার ঘোষ। একসময় কলকাতাতেই থাকতেন। সক্রিয় রাজনীতিও করতেন আট নয়ের দশকে। এখন সব ছেড়েছুড়ে বনবাসী হয়েছেন।”
পরিদাদুর কথা শুনে সঞ্জীব হেসে উঠল, “ভালোই বলেছেন। বনবাসীই বটে। বছর সাতেক হবে কাকু এখানে জায়গা কিনে এই হোটেল টোটেল বানিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যেই আশেপাশের আদিবাসি গ্রামগুলোতে তুমুল জনপ্রিয়তা তৈরি করে নিয়েছেন। এখানকার গরীবগুর্বো মানুষ রথীনকাকুকে দেবতার চোখে দেখে।”
“কেন?” পরিদাদু জিজ্ঞেস করলেন, “খুব দান ধ্যান করেন নাকি ভদ্রলোক, নাকি রাজনীতির জীবন ভুলতে না পেরে এখানেও গরীব কল্যাণের উদ্দেশ্যে ট্রেড ইউনিয়ন টিয়ন…”
“না না সেসব কিছু না,” সঞ্জীব পাশের দোকান থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে বলে, “রাজনীতি থেকে কাকু এখন শত যোজন দূরের মানুষ। তিনি কোনো রাজনৈতিক রঙ ছাড়া একজন মানুষ হিসেবেই এখানকার গাঁ গঞ্জের আদিবাসী মানুষের জন্যে কী না করেন! ওষুধ বিষুধ, বাচ্চাদের জামাকাপড়, খাবার এসব তো আছেই, এদের মধ্যে কত লোককে যে কাজ দিয়েছেন কাকু তার হিসেব নেই কোনো…”
“কী কাজ?” চা ভর্তি কাগজের কাপে সাবধানে চুমুক দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন পরিদাদু।
“যার যেমন যোগ্যতা,” বলে একটু থামল সঞ্জীব। তারপর বলল, “যেমন আমাকে তিনি এই ড্রাইভারের কাজটা দিয়েছেন। বিশ্বাস করে আমার হাতেই এ গাড়িটা ছেড়ে রেখেছেন দিন রাত…”
“আর কাকে কী ধরনের কাজ দিয়েছেন? হোটেলেরই কাজ, নাকি অন্য কিছুও। মানে আমি বলতে চাইছি…”
“ওই, আবার শুরু হয়ে গেল,” পরিদাদুকে কথার মাঝখানেই থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন সুছন্দা, “বাংলায় একটা প্রবাদ আছে না, স্বভাব যায় না ম”লে… তোমার হয়েছে তাই। অমনি গোয়েন্দাদের মতো জেরা শুরু করে দিলে ছেলেটাকে।
“না না জেরা টেরা নয়,” পরিদাদু অপ্রস্তুত গলায় বলেন, “এমনিই কৌতূহল।”
“তোমার সব বিষয়ে এত কৌতূহল কেন বলো দেখি পরিকাকু? ছেলেটা কী ভাববে তোমায়?”
“না না, এতে ভাবার কী আছে মাসিমা?” সঞ্জীব হেসে বলল।
“তা রথীনবাবুর কলকাতার বাড়িটা কি নেই আর, বিক্রি করে দিয়েছেন?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন পরিদাদুর দিকে চেয়ে।
“না, না, বাড়িটা আছে। ওঁর ছেলে বৌমা থাকেন কলকাতার বাড়িতে। ছেলে কলকাতা থেকে এই রিসর্টের অনলাইন বুকিং টুকিংগুলো সামলায়। রথীনবাবু নিজে ডাকসাইটে মানুষ হলে কী হবে তেমন একটা টেকশ্যাভি নন…”
“আচ্ছা,” অরুণাংশু মাথা নাড়লেন।
“ভদ্রলোক কি একাই থাকেন এখানে?” সুছন্দা জিজ্ঞেস করলেন।
“ওঁর স্ত্রী থাকেন,” পরিদাদু হাসলেন, “দুজনেই বেজায় প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষ। শহরের ভিড় থেকে দূরে এখানে জমি কিনে রিসর্ট বানিয়েছেন। ব্যবসাও হচ্ছে, নিজেদের থাকার জন্যেও সম্প্রতি দিব্বি সুন্দর একটা দোতলা বাড়ি বানিয়েছেন নিয়েছেন ভদ্রলোক। তোফা আছেন। কলকাতা যাবার নামও মুখে আনতে চান না চট করে…”
“সত্যিই তাই,” সঞ্জীব মাথা নেড়ে সায় দেয়, “দৈবাৎ যদি যানও কলকাতায়, সে ওই দু তিন দিনের জন্যে। কাকু বলেন, শহরের হাওয়ায় ওঁর দম আটকে আসে। নিশ্বাস নিতে পারেন না। কাকিমাও তাই। দুজন দুজনের একেবারে যোগ্য পার্টনার বলতে পারেন।”
গাড়িটা বেশ কিছুক্ষণ আগেই পাকা রাস্তা ছেড়ে লালচে কাঁকর বিছনো রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করেছে। দু দিকেই গাছপালা ক্রমশ ঘন হচ্ছে। গাছের ডালে দারুন সুন্দর কয়েকটা পাখি বসে থাকতে দেখল শাওন। একবার একটা গাঢ় নীল আর বাদামি মেশানো ছোট্ট পাখি দেখে মাকে ডেকে শাওন বলল, “মা দেখ পাখিটা কী সুন্দর।”
সঞ্জীব মাথা না ঘুরিয়েই গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, “পুরো ডুয়ার্স জুড়ে কত যে পাখি আছে তার ইয়ত্তা নেই। ইদানিং মোবাইল টাওয়ার ফাওয়ার বসিয়ে পাখি খানিক কমেছে ঠিকই, তবু যা আছে তা দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যায়।”
“ঠিক,” সায় দেন পরিদাদু, “আমার কয়েকজন বন্ধু আছে বার্ড ওয়াচার। ওরা তো সুযোগ পেলেই গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে এদিকে চলে আসে।”
বাঁ দিকে বেঁকে বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে সঞ্জীব গাড়িটাকে ডান দিকের খানিক নীচু পথটায় নামিয়ে দিতেই রিসর্টের বড় গেটটা চোখে পড়ল। রথীনবাবু এবং তাঁর স্ত্রী দুজনেই দাঁড়িয়েছিলেন গেটের কাছে। গাড়ি গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে দাঁড়াতেই এগিয়ে এলেন তাঁরা। শাওনরা গাড়ি থেকে নামতেই রথীনবাবু এগিয়ে এসে দু হাত বাড়িয়ে পরিদাদুর হাতদুটো চেপে ধরলেন। আন্তরিক গলায় বললেন, “পথে কষ্ট হয়নি তো?”
“এক্কেবারেই না,” পরিদাদু হাসলেন, “আপনার ব্যবস্থাপনার তারিফ করতেই হয়।”
“ব্যবসার স্বার্থে এটুকু তো করতেই হয়,” দরাজ গলায় হেসে উঠলেন ভদ্রলোক অরুণাংশু, সুছন্দাদের দিকে চেয়ে, “পরিমলবাবু বিখ্যাত মানুষ। তিনি ফিরে গিয়ে আমার রিসর্ট সম্পর্কে পাঁচজনের কাছে যদি গুড রিভিউ দেন, সে তো আমারই লাভ…”
অরুণাংশু হেসে উঠলেন তাঁর কথা বলার ভঙ্গিতে। সুছন্দারও মানুষটাকে ভালো লাগছিল। এই জায়গাটাও। ভারি সুন্দর সাজানো গুছনো রিসর্ট। গেট দিয়ে ঢুকেই ডান দিকে কিচেন কাম ডাইনিং। আর একটু এগিয়ে বাঁ দিকে ঘুরেই সারি দিয়ে কটেজগুলো। সিঙ্গলরুম এবং ডাবল রুম দু ধরনের কটেজেরই বন্দোবস্ত রয়েছে। শাওনদের জন্যে ডাবল রুম কটেজ বুক করা আছে। রথীন ঘোষ হেঁকে বললেন, “এই সঞ্জু, চ্যাটার্জীবাবুদের লাগেজ তিন নম্বরের বারান্দায় পৌঁছে দাও। দুটো রুমের যে ঘরে যাঁরা থাকবেন, তাঁদের লাগেজ বারান্দা থেকে নিয়ে নেবেন ঘরে।”
শাওনরা কটেজের দিকে এগোতেই আর একবার দাঁড় করালেন রথীন ঘোষ, “একটা কথা। ডোন্ট টেক ইট আদার ওয়াইজ… বাইরের জুতো বারান্দায় খুলে ঘরে ঢুকবেন, প্লিজ… আর দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে চলে আসবেন। ব্রেকফাস্ট রেডি।”
ব্রেকফাস্টে গরম গরম লুচি, সবজি, ডিমের ওমলেট আর মিষ্টি। রথীন আঙ্কলের স্ত্রী মঞ্জুকাকিমা এগিয়ে এসে শাওনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “রান্না পছন্দ হয়েছে তো শানুবাবু?”
“খুউব,” শানু মাথা নাড়ল।
কাকিমা মানুষটিকে ভারী ভালো লেগে গেছে শাওনের। মায়ের সঙ্গেও এর মধ্যেই খুব ভাব হয়ে গেছে তাঁর। সুছন্দাকে চোখ পাকিয়ে বলে দিয়েছেন তিনি, “আমাদের একদম আপনি আজ্ঞে করা যাবে না। আমি নিজে ফর্মালিটি করতে পারি না। কেউ অযথা অতিরিক্ত ফর্মাল হলে সহ্যও করতে পারি না। তুমি বাপু বয়েসে আমার চেয়ে ঢের ছোট। আমি তাই তোমাকে নাম ধরে ডাকব আর তুমি আমাকে মঞ্জুদি এবং তুমি বলবে।”
“বেশ। তাই হবে,” সুছন্দা হেসে একদিকে ঘাড় কাত করেন, “পরিকাকু আর উনি আমাকে খুকু বলে ডাকেন। তুমিও তাই বলে ডেকো।”
পরিদাদু খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করলেন, “ডাইনিং রুমে তো শুধু আমরাই। আপনার পান্থশালায় আর কোনো অথিথি নেই বুঝি?”
“আছেন একজন,” রথীন বললেন, “আপনাদের ঠিক পাশের সিঙ্গল কটেজে। খুব ইন্টারেস্টিং লোক মশাই।”
“কেন?”
“তিনি তান্ত্রিক। পিশাচসিদ্ধ। ভূত প্রেত তাঁর কথায় ওঠে বসে একেবারে।”
“অ্যাঁ—” চমকে উঠে বলেন সুছন্দা।
“হ্যাঁ,” মঞ্জু মাথা নাড়লেন, “মাঝে মাঝে আসেন এখানে। দু চার দিন থেকে যান। এবারে এসেছেন আজ দু দিন হল। পেল্লায় চেহারা। লাল লাল চোখ, পরনে কালো জোব্বা। গোঁফ দাড়িতে ঢাকা মুখ। দেখলেই ভয় করে। কোন্নগরে আশ্রম। তবে সেখানে থাকেন তিনি খুব কম সময়েই। সারা ভারতের সমস্ত জঙ্গল আর পাহাড় পর্বত পরিক্রমা করে বেড়ান। এখন এখানে এসেছেন আসাম থেকে। বললেন, এই জঙ্গলের ধারে যে প্রাচীন শ্মশান আছে, সেখানে নাকি কীসব গুহ্য ক্রিয়া আছে তাঁর। কাল রাতে সঞ্জুকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন। বলেছিলেন আজও বেরোবেন। গাড়ির জন্যে বাড়তি পে করে দেবেন আমায়।”
“ইন্টারেস্টিং,” পরিদাদুর ভ্রু কুঁচকে গেছে, “কাল রাতে কোথায় গিয়েছিলেন সঞ্জীব কিছু বলেছে?”
“উঁহু,” দু দিকে মাথা নাড়লেন রথীন, “বেশ কিছুটা পথ গিয়ে সঞ্জুকে দাঁড় করিয়ে রেখে একা অন্ধকারে ঢুকে গিয়েছিলেন জঙ্গলের পথে। সঞ্জুকে বার বার সাবধান করে দিয়েছিলেন, সে যাতে আর না এগোয়।”
“কেন?” কৌতূহলী হয়ে বলে শাওন।
“ওঁদের সাধনপথটা তো খুব সুবিধের নয়,” চোখে মুখে সম্ভ্রম ফুটিয়ে তুলে বললেন রথীন ঘোষ, “মারণ, উচাটন, বশীকরণ কত সব ভয়ংকর কাজ করেন ওঁরা মন্ত্র তন্ত্র দিয়ে…”
“মারণ, উচাটন আবার কী জিনিস?” শাওন অবাক হয়ে বলে।
“ওসব বড় গোলমেলে জিনিস,” মঞ্জু ভয় পাওয়া গলায় বললেন, “মানুষের ক্ষয় ক্ষতিও হয় ওসব বিদ্যের সাহায্যে। আমি বাপু ভদ্রলোককে এক্কেবারে ঘাঁটাই না। যখন আসেন নিজের মতো থাকেন। যা খেতে চান, ব্যবস্থা করে দিই। রাতের খাবার বরাবর উনি নিজের ঘরে নেন। আমি কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিই…”
“উনি তার মানে এখানে নতুন নন?” পরিদাদু চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন।
“উঁহু,” মাথা নেড়ে বলেন রথীন, “আগে বার তিনেক এসেছেন। হুট করেই আসেন। দিন তিন চার থাকেন। আবার চলে যান।”
“এই যে তিন চার বার এসেছেন, সেটা কত দিনের মধ্যে?”
“কেন বলুন তো?”
“না এমনিই, কৌতূহল।”
“তা ধরুন গত দু আড়াই বছরের মধ্যে।”
“পিক সিজনে অমন হুট করে এলে ঘর খালি পাওয়া তো মুশকিল এখানে।”
“খুব পিক সিজনে উনি আসেন না। বলেন, সংসার ছাড়ার পর মানুষের থিকথিকে ভিড়ে নাকি নিতে পারেন না আর। তাছাড়া যেহেতু সিঙ্গল কটেজ নেন ভদ্রলোক, সাধারণত অসুবিধা হয় না। এখানে সাধারণত টুরিস্টরা আসে হয় ফ্যামিলি নিয়ে তা নাহলে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে। কাজেই ডাবল রুম ফ্যামিলি কটেজের চাহিদাই বেশি থাকে। যেমন কটেজ আপনাদের দেওয়া হয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে দু হাতে দুটো ঘরের দরজা। দুটো ঘরই অ্যাটাচড বাথ, ডাবল বেড… সিঙ্গল কটেজগুলো ছোট। স্পেশালি যেটায় উনি থাকেন, সেটা খানিকটা ইউনিকই বলা যেতে পারে…” বলে ভদ্রলোক থেমে গেলেন। মাথা নীচু করলেন। তাঁর মুখে যেন খানিক ছায়া ঘনালো।
মঞ্জু নরম গলায় বললেন, “আসলে এই প্রজেক্টটা শুরু করেছিলেন আমার কত্তা আর তাঁর বাল্যবন্ধু মানস মিত্র, এই দুজনে মিলে। মানসদা বিয়ে থা করেননি, ব্যাচেলর। এই সিঙ্গল বেডেড কটেজটা বানানো হয়েছিল তাঁর নিজের থাকার জন্য।”
“তিনি কোথায়? তাঁকে তো দেখলাম না?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন। ব্রেকফাস্ট শেষ হয়েছে। রথীন ঘোষ কিচেনের দিকে চেয়ে হাঁক মারলেন, “এই চা রেডি কর।” তারপর পরিদাদুর দিকে ফিরে বললেন, “দুধ, চিনি সব থাকবে তো চায়ে?”
“থাকবে,” পরিদাদু হাসলেন।
“হ্যাঁ, মানসবাবুর কথা বলছিলাম আমরা,” অরুণাংশু আবার বললেন, “তাঁর সঙ্গে তো আলাপ হল না আমাদের…”
“সেই সুযোগ আর সে দিল কই?” রথীন ঘোষ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “বরাবরই মানস ছিল ডাকাবুকো আর বেপরোয়া। শেষ পর্যন্ত ওর ওই ডোন্ট কেয়ার ভাবই কাল হল…”
“কেন?” সুছন্দা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে উঠলেন।
“জঙ্গলে থাকতে থাকতেই বুঝেছি প্রকৃতির সঙ্গে কক্ষনও চ্যালেঞ্জ করতে নেই। আর তুমি যতই সাহসি হও না কেন, জঙ্গলে থাকলে তোমাকে জঙ্গলের নিয়ম মেনে চলতেই হবে। অযথা বাহাদুরি দেখাতে গেলে বিপদ আসবেই। কতবার বারণ করেছি। কিন্তু মানস কোনোদিন আমার কথা কানেই তোলেনি। নিজের জীবন দিয়ে সে থামল অবশেষে…” রথীনবাবুর গলা বুজে এল।
“কী হয়েছিল?” পরিদাদু জিজ্ঞেস করলেন।
“এই কটেজগুলো পেরিয়ে পিছনের জঙ্গলের দিকে একটা ছোট্ট গেট আছে। আপনারা এখনও দেখেননি। দেখবেন ঘুরে টুরে। ওদিকটা ভারী সুন্দর। সামনেই ঘন জঙ্গল। ওয়াইল্ড নেচার যাকে বলে। ওই বেড়ার গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটু হেঁটে গিয়ে আমাদের জঙ্গলমহল, মানে নিজেদের থাকার বন্দোবস্ত,” মঞ্জু বলতে শুরু করলেন, “আগে ওদিকটা ফাঁকাই ছিল। আমরা মানসদার পাশের ডাবল রুমঅলা কটেজে থাকতাম তখন। মানসদা চলে যাবার পর আর ওখানে থাকতে ইচ্ছে করল না। বছর খানেক হল এই বাড়িটা বানিয়ে উঠে এসেছি আমরা। একতলাটা ফাঁকাই থাকে। দুজনে দোতলায় থাকি। বারান্দায় বসে জন্তু জানোয়ার দেখি, তাদের ডাক শুনি। আমাদের এখন আর কলকাতা যেতে ইচ্ছে করে না। যাইও না বড় একটা…”
“মানসবাবুর কী হয়েছিল?” প্রসঙ্গ অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে দেখে পরিদাদু তাঁকে কথার খেই ধরিয়ে দিলেন।
“এখন আমাদের বাড়ি যেদিকটায়, ওখান থেকে আরও এগিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আধঘন্টাটাক হেঁটে গেলে একটা নালা আছে। বর্ষার সময় ভালোই জল থাকে ওটায়, কিন্তু অন্য সময় প্রায় শুকনোই থাকে নালাটা। ওই নালায় জল খাবার জন্যেই বোধহয় ওয়াইল্ড অ্যানিমালের আসা যাওয়া আছে খুব। ওখানে বনদপ্তরের একটা পরিত্যক্ত ওয়াচ টাওয়ার আছে…”
“পরিত্যক্ত কেন?” পরিদাদু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“সে কথার উত্তর তো জানা নেই আমার পরিমলবাবু,” রথীন দু দিকে মাথা নাড়ালেন, “ওটা বনদপ্তরের লোকেরাই বলতে পারবেন।”
“হ্যাঁ, ওয়াচ টাওয়ারটা নিয়ে কী যেন একটা বলতে চাইছিলেন আপনি,” অরুণাংশু রথীনকে আবার মূল বিষয়ে ফেরাতে চাইলেন।
“মানস মাঝেমধ্যেই সরু নালার কাছের ওই ওয়াচ টাওয়ারটার দিকে যাতায়াত করত…”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু কেন?”
“খেয়াল,” রথীনবাবু মাথা নাড়ালেন অসহায় ভঙ্গীতে, “ওই খেয়ালই কাল হল ছেলেটার। কতবার বারণ করেছি, আমি মঞ্জু দুজনেই। কিন্তু কথা শুনলে তবে তো! নির্জনতার মধ্যে সে এই অরণ্যকে তার মতো করে নাকি আবিষ্কার করতে চাইতো। ওয়াচ টাওয়ারটার টুকটাক মেরামতিও করিয়েছিল সে। ইচ্ছে হলেই একলা গিয়ে ওটার ওপরে বসে থাকতো চুপটি করে। কখনও কখনও সারা রাত। অবিশ্যি রাতেও যে সে ওখানে যেত তা আমরা জেনেছি অনেক পরে। মানে যখন সবকিছু শেষ হয়ে গেল…”
“ওয়াচ টাওয়ারটা এখনও আছে নিশ্চয়ই?”
“আছে হয়ত। তবে সেটার কন্ডিশন এতদিনে নড়বড়ে হয়ে গেছে নিশ্চিত। ওদিকে মানুষের চলাচল এমনিতেই নেই। আগে গ্রামের দু একজন যদিও বা দিনের বেলা শুকনো পাতা বা কাঠকুটো কুড়োতে যেত এখন সেটাও বন্ধ।”
“কেন?”
“মানসের মৃত্যুটা এমন ভয়ংকর ছিল…” বলে একটু থমকালেন রথীন। তারপর নীচু গলায় বললেন, “আপনারা মানেন কিনা জানি না, ইন ফ্যাক্ট আমি নিজেও মানতাম না আগে, কিন্তু মানস চলে যাবার পর আমি নিজেও অনেকখানিই বদলে গেছি। গ্রামের লোকেদের কথা সত্যি হোক বা মিথ্যে, আর কখনও ওদিকে যাইনি। মানে যাবার ইচ্ছেই করেনি কোনোদিন। ওখানে যাওয়ার কথা ভাবলেই বিচ্ছিরি একটা অস্বস্তি কাজ করে মনের মধ্যে। ভয় করে…”
“ভয়?” সুছন্দা বললেন, “কীসের ভয়?”
“ভূতের,” লাজুক মুখে বললেন রথীন, “আপনারা মনে মনে নিশ্চিত আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবেন জানি। তবু আপনাদের সঙ্গে আমার রিলেশনটা অন্যরকম বলেই বলছি, মারা যাওয়ার পরেও মানস ওই ওয়াচ টাওয়ারের মায়া কাটাতে পারেনি। সন্ধের পরে বা নির্জন দুপুরে সে এখনও ওই ওয়াচ টাওয়ারে এসে বসে। গ্রামের এক আধজন দেখেছে তাকে। আর সেই থেকেই জঙ্গলের ওদিকটা আমাদের কাছে বলতে গেলে এক প্রকার নিষিদ্ধই হয়ে গেছে ইদানিং…”
“কিন্তু ওই ওয়াচ টাওয়ার তো আপনার পান্থশালার অন্যতম আকর্ষণ হতে পারত। ঠিকমতো জায়গাটাকে প্রোমোট করতে পারলে শুধু ওখানে যাওয়ার জন্যেই টুরিস্টরা আপনার পান্থশালায় আসার জন্যে ভিড় জমাতো।”
“তাতে আমার বিপদ বাড়ত।”
“কেন?”
“এই জঙ্গল খুব নিরাপদ নয় পরিমলবাবু। আর সেইজন্যেই তো মানস অমন বিচ্ছিরিভাবে…” রথীন থেমে গেলেন। বিষাদের ছাপ পড়ল তাঁর চোখে মুখে।
“মানসবাবু যখন ছিলেন, তখনও পান্থশালার টুরিস্টদের আপনারা অ্যালাও করতেন না ওয়াচ টাওয়ারে?”
“আমি অন্তত এ ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখাতাম না,” রথীন দু’ দিকে মাথা নাড়লেন, “অতি উৎসাহী কেউ মানসের কাছে ওয়াচ টাওয়ারের কথা শুনে জোর করলে সকালের দিকে নিয়ে যেতাম হয়ত। তবে তা কদাচিৎ। আমি সত্যি বলতে কী, ডিসকারেজই করতাম বোর্ডারদের। আর সেটা করতাম তাদের সেফটির জন্যেই। জঙ্গলের ওদিকটা হাতির নিত্যি আনাগোনা। তাছাড়া পাইথনের উৎপাতও আছে। বেড়াতে এসে আমার অতিথিদের মধ্যে একজনও যদি বিপদে পড়েন, সে রিস্ক কে নেবে বলুন? আমাদের টুরিস্ট বাংলোরই বদনাম হতো তেমন কিছু হলে। ব্যবসারও দফা রফা হতো…”
“হুঁ,” মাথা নাড়লেন পরিদাদু, “তাহলে ওই ওয়াচ টাওয়ারে মানসবাবু একাই যেতেন?”
“হ্যাঁ। এবং যেটা ওর দোষ ছিল, ওখানে যাওয়ার সময় কক্ষনও আমাদের ও কিছু জানাতো না।”
“কেন বলুন দেখি?”
“আমরা যদি বারণ করি সেই ভয়েই হয়ত। আর এটা ঠিক, কানিয়ে যেতে গেলে বারণ আমরা নিশ্চিত করতাম…”
“যেদিন ঘটনাটা ঘটেছিল, সেদিনও তার মানে আপনারা জানতেনই না যে কখন তিনি পান্থনিবাস থেকে বেরিয়ে গেছেন?”
“না। একজন সুস্থ মানুষ রাতে একা ওই বিপজ্জনক জঙ্গলে যে ঢুকতে পারে, সে কথা ভাবতেই পারিনি আগে।”
“উনি রাতে ওখানে যে যেতেন, সে খবর আপনারা শেষ পর্যন্ত জানতে পারলেন কী করে?”
“ওই ঘটনার পরে,” মঞ্জু বললেন, “সেদিনও মানসদা রাতে জঙ্গলে চলে গিয়েছিলেন। একা। শুধু হাতে একটা টর্চ আর একটা লাঠি নিয়ে। জঙ্গলে হাতির দলের সামনে পড়ে যান। পরদিন যখন বডি পাওয়া গেল, তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল একেবারে…”
“ইশ…” সুছন্দা বলে উঠলেন।
“বডি কে দেখতে পেয়েছিল প্রথম?”
“গ্রামের লোক। এই যে আমাদের পান্থনিবাস দেখছেন, এর আশে পাশে জঙ্গলের গায়ে গায়ে কিছু গ্রাম আছে। বলছিলাম না, ওরা দিনের বেলা জঙ্গলে ঢুকে শুকনো কাঠ, পাতা সংগ্রহ করে জ্বালানির জন্যে। ওদেরই চোখে পড়েছিল প্রথম। তারপর তো ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকজনও এল, তাদের নিয়ম কানুন মোতাবেক কাজকর্ম করল…” বলতে বলতে চুপ করে গেলেন রথীন। মঞ্জুও। পরিদাদুও আর কথা বাড়ালেন না।
গেট দিয়ে একটা গাড়ি ভেতরে ঢুকে এসে দাঁড়ালো। গাড়ির দরজা খুলে একজন ঝকঝকে যুবক এবং এক তরুণী নেমে এলেন। সঙ্গে চেন দিয়ে বাঁধা একটা পেল্লায় কুকুর।
রথীন তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়লেন, “আপনারা দেখছি আমার জন্যে খুবই লাকি অতিথি পরিমলবাবু। এখন সিজন নয়, আগে থেকে বুকিং-ও নেই, তবু আপনারা আসার পর থেকেই দেখছি নতুন বোর্ডার ঢুকছে আমার পান্থনিবাসে।”
পরিদাদু লাজুক মুখে হাসলেন। এ কথার কোনো উত্তর দিলেন না।
মঞ্জুও উঠে দাঁড়ালেন, “আসি। আমার বাড়িতে চলে আসুন বিকেলবেলা। দোতলার বারান্দা অথবা ছাদে বসবেন। জঙ্গলের ভালো ভিউ পাবেন। কপাল ভালো থাকলে বন্যপ্রাণীও চোখে পড়ে যেতে পারে…”
“কী দেখা যাবে?” শাওন উৎসাহ পেয়ে জিজ্ঞেস করল।
“ময়ূর আর হরিণ তো দেখা যাবেই। চাই কি হাতি, বাইসনের সঙ্গেও দেখা হয়ে যেতে পারে।”
“তাই নাকি?” চোখ গোল গোল করে বলেন সুছন্দা, “বাড়ির এত কাছে হাতি চলে আসে বলছেন। আপনাদের ভয় করে না?”
“নাহ,” মঞ্জু হাসলেন, “ওদের নিয়েই তো আছি। ওরা আমাদের প্রতিবেশীই বলতে পারেন।”
“ওরা তো বাড়ির চৌহদ্দিতেও ঢুকে পড়তে পারে?”
“পড়তে পারে কী, পড়েই তো,” মঞ্জু স্বাভাবিক মুখে বললেন, “বাড়ির সামনে আমার কত্তা টুকটাক শাক সবজি ফলান। সে সবের ওপরে প্রায়ই নজর পড়ে ওদের। কদিন আগেই তো হাতি ঢুকে নিচের কল টল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে।”
“সর্বনাশ,” সুছন্দার চোখে মুখে আতঙ্ক ফুটল।
“তবে কি জানেন তো, মানুষের মতো ভয়ঙ্কর এ পৃথিবীর কোনো জানোয়ারই হতে পারেনি আজ পর্যন্ত।”
“এ কথাটা কিন্তু এক্কেবারে ঠিক বলেছেন মিসেস ঘোষ,” পরিদাদু গম্ভীর মুখে বললেন, “আমরা নিজেদের সভ্য বলে বড়াই করি বটে, কিন্তু নিজেদের কীর্তি-কলাপের জন্যে মানুষের সত্যিই লজ্জা পাওয়া উচিৎ। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের চেয়ে পশুরা ঢের বেশি ডিসিপ্লিনড্।”
“মিসেস ঘোষ নয়, আমাকে মঞ্জু বলে ডাকবেন দাদা।”
“বেশ,” পরিদাদু হাসলেন।
মঞ্জু দ্রুত পা চালিয়ে ডাইনিং হলের বাইরে চলে গেলেন নতুন বোর্ডারদের আপ্যায়ন করার জন্যে।
পরিদাদু বললেন, “চলো যাওয়া যাক। আবহাওয়াটা ভারী সুন্দর। বনবাংলোর আশপাশের অঞ্চলটা খানিক ঘুরে দেখে আসি খানিক।”
“আমি যাব?” শাওন জিজ্ঞেস করল।
“চল।” পরিদাদু তার পিঠে চাপড় মেরে বললেন, “তবে চপ্পল ছেড়ে পা ঢাকা জুতোটা পরে আয় চট করে। জঙ্গলে ঢুকতে গেলে পা ঢাকা জুতো কিন্তু মাস্ট।”
“তোমরা জঙ্গলে ঢুকবে মানে?” সুছন্দা ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন, “এতক্ষণ কী শুনলে তাহলে?”
“কী?” পরিদাদু চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন হাসতে হাসতে।
“জঙ্গলটা মোটেও ভালো নয়। যে কোনো সময় হাতির পাল অ্যাটাক করতে পারে। মানসবাবুর কথা তো নিজে কানেই শুনলে…”
“সে কথাটা মনে রাখলি আর আসল কথাটা ভুলে গেলি?”
“কোন কথা?”
“পশুরা মানুষের মতো ভয়ানক নয়…”
“ফাজলামি কোরো না পরিকাকু। মনে রেখ, শানু তোমার সঙ্গে যাচ্ছে…”
“শানু তোর মতো অমন ভীতু নয়,” সুছন্দাকে আরও রাগিয়ে দেবার জন্যে বললেন পরিদাদু।
“পরিদাদু সঙ্গে থাকলে আমার কোন বিপদ হতেই পারে না,” শানু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠল বুক চিতিয়ে।
“মুশকিলে ফেললি রে শানু,” পরিদাদু তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, “আমি তো আজকাল উলটো কথাটাই বিশ্বাস করি।”
“কী রকম?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে শাওন।
“আমি এখন বিশ্বাস করি, তুই সঙ্গে থাকলে আমার কোনো বিপদ হতেই পারে না।”
“যাঃ।”
“সত্যিই,” পরিদাদু হাসলেন, “তুই কি আর আগের মতো ছোট্টটি আছিস? এখন বড় হচ্ছিস। তোর ওপরে নির্ভর তো করতেই হবে আমাকে।”
শাওনের খুব ভালো লাগছিল মনে মনে। সে ভাবছিল, একদিন সে নিজেই কত বিপদসংকুল জায়গায় যাবে একা একা। এ পৃথিবীতে আজও পর্যন্ত সমাধান না হওয়া কত যে রহস্য! পরিদাদুর মতো সেও বুদ্ধি দিয়ে, সাহস দিয়ে সেই সব রহস্যের জট খোলার চেষ্টা করবে একদিন একা একা, কারও সাহায্য না নিয়েই।
পরিদাদু তার পিঠে আলতো চাপড় মারলেন, “আর দেরি নয়, চল। লাঞ্চের আগে ফিরে আসতে হবে। হাতে বেশি সময় নেই আমাদের।”
৩
হলং পান্থনিবাসের চৌহদ্দি পেরিয়ে একটু এগোতেই চারদিক একেবারে থমথমে হয়ে গেল। বড় বড় গাছ সোজা আকাশের দিকে উঁচু হয়ে উঠে গেছে। মূলত এখানে শাল আর সেগুন গাছই বেশি। আর এক ধরণের গাছও ডালপালা ছড়িয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। তাদের তেমন পাতা নেই। ডালগুলোকে দেখলে মনে হয় যেন অসহায়ের মতো দু হাত ছড়িয়ে রেখেছে তারা প্রার্থনার ভঙ্গীতে। তেমনই একটা গাছের ডালে একটা পেল্লায় ময়ূর পেখম ঝুলিয়ে বসেছিল। পরিদাদু শাওনকে বললেন, “এই জঙ্গলে প্রচুর ময়ূর আছে। অনেক গাছেই বাসা তাদের। গাছগুলোর দিকে নজর রাখিস। মাঝে মধ্যেই ওদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।”
শাওন অবশ্য মাথার ওপরে নজর রেখে হাঁটতে পারছিল না তেমন। জঙ্গল এখানে বেশ ঘন। সরু সরু জংলি গাছের ঝোপ সরিয়ে এগোতে হচ্ছে তাদের।
পরিদাদু মাথা ঘুরিয়ে একবার দেখলেন তাকে। হেসে জিগ্যেস করলেন, “কী রে চলতে অসুবিধা হচ্ছে খুব?”
“উঁহু।” শাওনও হাসল।
“ভয় পাচ্ছিস না তো?” আবার জিগ্যেস করলেন পরিদাদু।
“কীসের ভয়?”
“এই জঙ্গলে, এখন আমরা যেখানে আছি, তার আশেপাশে হাতি কিন্তু প্রায়ই আসে,” পরিদাদু থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, “রথীনবাবু মিথ্যে বলেননি, “তাঁর পান্থশালায় হাতি ঢুকে পড়া খুব অসম্ভব কিছু নয় রে শাওন।”
শাওনও পরিদাদুর পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। পরিদাদুর নজর অনুসরণ করে দেখল একটু দূরেই হাতির দলের ঝোপ জঙ্গল ভেঙ্গেচুরে এগিয়ে যাওয়ার স্পষ্ট চিহ্ন। এখানে ওখানে হাতির বিষ্ঠাও পড়ে রয়েছে। পরিদাদু বললেন, “খুব বেশিক্ষণ নয়। দেখে মনে হচ্ছে, ঘন্টা খানেক, ঘন্টা দুয়েক আগেই ওরা এই পথ দিয়ে চলে গেছে।”
“আমাদের কি এখন ওই পথে এগনো উচিৎ হবে পরিদাদু?” শাওন নীচু গলায় জিগ্যেস করল।
“হ্যাঁ, এখনই বরং এগনোটা ঠিক হবে,” পরিদাদু আবার হাঁটা শুরু করলেন, “এক্ষুনি ওরা আর এই পথে ফিরবে না। এই সুযোগে চল, মানসবাবুর তৈরি করা ওয়াচ টাওয়ারটা দেখে আসি।”
শাওন চমকে উঠল। পরিদাদুর দিকে চেয়ে উত্তেজিত গলায় সে বলে উঠল, “আমরা এখন সেই ওয়াচ টাওয়ারটা দেখতে যাচ্ছি?”
“হ্যাঁ,” পরিদাদু না থেমে হাঁটতে হাঁটতেই উত্তর দিলেন।
“তুমি কি মানসবাবুর মৃত্যুর ব্যাপারে অস্বাভাবিক কিছু সন্দেহ করছ?”
“আমি কিছুই সন্দেহ করছি না এক্ষুনি। স্রেফ কৌতূহল মেটাতে জায়গাটা দেখে আসতে চাইছি।”
“আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না পরিদাদু।”
“কেন?”
“নিছক কৌতূহল মেটানোর জন্যে যদি এখানে আসতে, তাহলে রথীনআঙ্কলের পান্থশালার লোকজন কাউকে নিয়েই তো আসতে পারতে তুমি। এমনকি সরাসরি রথীনআঙ্কলকেও বলতে পারতে, জায়গাটা তুমি দেখতে চাও। এমনকি এখানে আসার সময়ও তুমি কিন্তু কাউকে জানতে দাওনি আমরা এই ওয়াচ টাওয়ারটা দেখতে আসছি। আমার বাবা মা পর্যন্ত জানে না…”
“সাবাশ,” পরিদাদু শাওনের পিঠে আলতো চাপড় মারলেন, “আর কিছুদিন পরে আমিই তোর অ্যাসিসট্যান্ট হয়ে যাব।”
“ধ্যাত, কী যে বলো তুমি!” লজ্জা পেয়ে গিয়ে বলে শাওন।
পরিদাদু গম্ভীর মুখ করে বললেন, “তাহলে বুঝতেই যখন পারছিস সব, আপাতত ফিরে গিয়েও কাউকে বলা যাবে না, আমরা এদিকে এসেছিলাম…”
“আচ্ছা,” মাথা নেড়ে সায় দিল শাওন।
আর কয়েক পা এগোতেই ওয়াচ টাওয়ারটা চোখে পড়ল। ওয়াচ টাওয়ারের চারপাশে অনেকখানি জায়গাই বেশ ফাঁকা। গাছপালা নেই। জঙ্গলের মধ্যে গোল, ফাঁকা, পিকনিক করার জায়গার মতো। পরিদাদু শাওনকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। মোটা মোটা শালখুঁটির ওপরে গোলাকার ওয়াচ টাওয়ার। মাথায় টিনের আচ্ছাদন। একটা লোহার সিঁড়ি ছিল, কিন্তু সেটা জং ধরে ভেঙে গেছে নিচের দিকে। তবে ওপরের দিকে সিঁড়ির ধাপগুলো এখনও ব্যবহারযোগ্য। জংলি লতা পাতা সিঁড়ির লোহার রেলিং জড়িয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে। পরিদাদু ওয়াচ টাওয়ারের ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে রইলেন একটুক্ষণ। তারপর গম্ভীরভাবে চুপচাপ ঘুরতে লাগলেন তার চারপাশে।
“কিছু খুঁজছ?” শাওন জিজ্ঞেস করল।
“তুইও খুঁজতে থাক,” পরিদাদু হাসলেন।
“কী?”
“আপাতত টাওয়ারের ওপরে তাকিয়ে দেখ মানসবাবুর ভূতকে দেখতে পাস কিনা। ভদ্রলোক সত্যিই যদি ভূত হয়ে এখানে এসে বসে থাকতেন, বড় উপকার হতো। অনেক প্রশ্নের উত্তর সরাসরি তাঁর থেকেই জেনে নেওয়া যেত…”
শাওন হেসে ফেলল।
“হাসছিস যে বড়?” পরিদাদুও গা দুলিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, “ওরা যে ভূতের গপ্প টপ্প বলে এত ভয় পাওয়াতে চাইল আমাদের, সেটা গ্রাহ্যই করছিস না যে বড়?”
শাওন জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা পরিদাদু, ওরা আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে কেন বলো তো?”
“তার নির্দিষ্ট কারণ তো জানা নেই। তবে অন্তত এটুকু নিশ্চিত, ওরা চাইছে না আমরা এই ওয়াচ টাওয়ারের ধারে কাছে আসি।”
“কেন?”
“হয়ত আমাদের নিরাপত্তার কারণেই,” বলতে বলতেই টাওয়ারের ভাঙা রেলিংদুটো ধরেই খানিকটা দোল খেয়ে সিঁড়ির কিছুটা ওপরে উঠে গেলেন পরিদাদু। তারপর আর একটু কসরত করে তিনি পৌঁছে গেলেন সিঁড়ির না ভাঙা ধাপের ওপরে। শাওন অবাক হয়ে বলল, “তুমি কি এটার ওপরে উঠবে নাকি?”
“না হলে এত দূরে এসে তো কোনো লাভই হবে না শানুবাবু।”
পরিদাদু তরতর করে উঠে গেলেন টাওয়ারের মাথার ওপরে। নিচে একা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেই কেমন যেন অস্বস্তি শুরু হল শাওনের মনে। স্পষ্ট মনে হল, একটু দূরের একটা ঘন ঝোপ হঠাৎ নড়ে উঠেই থেমে গেল আবার। গা শিউরে উঠল শাওনের। কেউ কি আড়াল থেকে লক্ষ রাখছে তাদের দিকে? যে লক্ষ রাখছে, সে তো ভালো লোক না হতেও পারে। লোকটা যদি এক্ষুনি আক্রমণ করে তাকে? পরিদাদুকে কি সে ডাকবে চিৎকার করে? পরক্ষণেই নিজেই নিজেকে শাসন করল শাওন। এমন ভীতু হলে তো চলবে না। পরিদাদুর সঙ্গে আগেও কতবার কত রকম বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। সামান্য কারণে ভয় পেলে পরিদাদু তাকে এরপরে তো আর সঙ্গেই নেবেন না। শাওন ঠিক করল, ভয় না পেয়ে মাথাটাকে এখন ঠান্ডা রাখা দরকার।
ঝোপটার দিকে নজর রেখেই একটু ঘুরে পিছন দিকে চলে গেল শাওন। একটা গাছের আড়ালে এমনভাবে দাঁড়ালো, যাতে ঝোপ থেকে তাকে কিছুতেই আর দেখা না যায়। তারপর একটুখানি সময় অপেক্ষা করে নীচু হয়ে একটা মাটির ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে সে সেটা হঠাৎই ছুঁড়ে দিল ঝোপটার দিকে। ঢিলটা ঠিক জায়গাতেই গিয়ে পড়েছে। ঝোপটার এক্কেবারে মাঝামাঝি। ঠিক তখনই একটা হরিণ ঝোপ থেকে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে তীর বেগে দৌড় দিল জঙ্গলের অন্য দিকে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল শাওন। গাছের আড়াল ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল সে।
পরিদাদুও টাওয়ারের ওপর থেকে নিচে নেমে এলেন। পরিদাদুর মুখ গম্ভীর। শাওন জিজ্ঞেস করল, “কী দেখলে পরিদাদু?”
“যা দেখলাম তা বড়ই গোলমেলে শানুবাবু,” পরিদাদুর ভ্রু কুঁচকে উঠল, “কিছু একটা ব্যাপার মানুষের চোখের আড়ালে এখানে ঘটছেই। আর যা ঘটছে, তা খুব ভালো ব্যাপার স্যাপার মোটেই নয়…”
“কী করে বুঝলে?”
“রথীনবাবু টাওয়ারটাকে যতই পরিত্যক্ত বলে দেগে দিতে চান না কেন, এখানে মানুষের নিত্য আনাগোনা আছে।”
“তেমন চিহ্ন কিছু পেলে বুঝি ওপরে?”
“পেলাম।”
“তুমি কি কাউকে সন্দেহ করছ?”
“আমি তো এখন সকলকেই সন্দেহ করছি।”
“সকলকে মানে? রথীন ঘোষকেও?”
“রথীন ঘোষ, তাঁর স্ত্রী মঞ্জু, ওই তান্ত্রিক, তারপর মনে কর কুকুর নিয়ে যাঁরা গাড়ি থেকে নামলেন। এমনকি সঞ্জীবকেও।”
“সঞ্জুদাকেও সন্দেহ করছ?”
“হুঁ।”
“আমার সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে পরিদাদু।”
“আমারও,” বলেই পরিদাদু শাওনের দিকে ফিরলেন, “চল ফেরা যাক এইবার। নইলে দেরি হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, ওখানে পৌঁছনোর পর কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কোন দিকে গিয়েছিলি, বলবি জানকি রিসর্টের দিকে।”
“সেটা আবার কোন দিকে?”
“আমাদের রাস্তার একদম উল্টোদিকে। আমরা জঙ্গলের পথে এখন সেদিকেই গিয়ে উঠব। টাওয়ারের ওপর থেকে এই এলাকার বেশ স্পষ্ট একটা ম্যাপ তৈরি করে ফেলেছি মনে মনে। বলেই শাওনের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলেন পরিদাদু। বিশ পঁচিশ পা এগোতেই জঙ্গলের মধ্যে দিব্বি একটা পথ চোখে পড়ল। সে পথে গাড়ি চলাচলের চিহ্ন স্পষ্ট। পরিদাদু সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলেন।
৪
পরদিন সকাল থেকেই পরিদাদুকে একটু অস্থির লাগছিল। শাওন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“কিছু না,” বলে এড়িয়ে গেলেন পরিদাদু। যথারীতি ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন তিনি। শাওন তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। সে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করতে করতে বাংলোর সামনের লন পেরিয়ে রথীনআঙ্কল যেদিকে থাকেন সেদিকে চলে গিয়েছিল একা একা। রথীন আংকলের বাড়ির পিছন দিকে জঙ্গল বেশ ঘন। তবে ভেতরে ঢোকা যেতেই পারে। লোক চলাচলের পায়ে হাঁটা হাল্কা পথের চিহ্নও চোখে পড়ল শাওনের। তার ইচ্ছে ইচ্ছে করছিল ভেতরে ঢোকার। কিন্তু ওদিকে কয়েক পা এগোতেই একটা লোক কোথা থেকে যেন হাঁ হাঁ করে ছুটে এল। পিছন দিক থেকে শাওনের হাত টেনে ধরে বলে উঠল, “ওদিকে যেও না। বোর্ডাদের ওদিকে যাওয়া মানা।”
“কেন?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল শাওন।
“কিছুদিন আগে ওখানে মস্ত একটা অজগর দেখতে পাওয়া গিয়েছিল,” চোখ গোল গোল করে বলল লোকটা, “আমাদের একটা ছাগলকে গিলে নিয়েছিল সাপটা।”
শাওন শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ফিরে আসার সময় সে দেখল সঞ্জীবদার সঙ্গে রথীন আঙ্কলের খুব ঝগড়া হচ্ছে কিছু একটা বিষয় নিয়ে। রথীন আঙ্কল খুব চিৎকার করছিলেন। একটা কথাই শুধু কানে এল শাওনের। তিনি বার বার সঞ্জীবদাকে বলছিলেন, “শিবুর এত সাহস কী করে হয়? আমার পারমিশন ছাড়া কী করে সে গাড়ি নিয়ে যায় বাংলো থেকে? আর তোর জন্যে কী করিনি আমি? সেই তুইও শেষে শিবুর সঙ্গে হাত মেলালি? অনেক দিন ধরেই তোর মতিগতি ভালো লাগছে না আমার। সাবধানও করেছি কয়েকবার। তুই এবারে সত্যিই যদি বিপদে পড়িস, আমার কিন্তু দায় থাকবে না বলে দিলুম। সোজা পথে থাক সঞ্জীব, আবারও বলছি…”
মর্নিং ওয়াক সেরে পরিদাদু ফিরে আসার পর এই কথাগুলো বলতেই তাঁর সেই অস্থির অস্থির ভাবটা যেন আরো বেড়ে গেল। উত্তেজিত গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, রথীনের বাড়ির পিছনের জঙ্গলে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছিল তোর?”
“জঙ্গলের বেশি ভেতরে তো ঢুকতেই পারলাম না।”
“তবু যেটুকু ঢুকতে পেরেছিলি, তার মধ্যে?”
“তেমন কিছু নয়।”
“আর একটু ভেবে দেখ…”
একটুক্ষণ চুপ করে থাকল শাওন। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “একটাই অদ্ভুত ব্যাপার, বুঝলে…”
“কী?”
“ওই জঙ্গলে অনেক বাঁশ কেটে রাখা আছে, কিন্তু আশেপাশে বাঁশগাছ চোখে পড়ল না।”
“হুঁ,” পরিদাদু বললেন, “অন্য জায়গা থেকে কিনে এনেও রাখতে পারে। এই বাংলোর ইন্টেরিয়ার ডেকরেশনের প্রায় পুরোটারই প্রধান উপাদান যখন বাঁশ, তাহলে…”
“কিন্তু এই বাংলোয় আন্ডার কন্সট্রাকশন কিছু তো চোখে পড়ল না পরিদাদু?” কথার মাঝখানেই বলে উঠল শাওন।
“সব ঘরের ভেতরে তো আর ঢুকে দেখিনি আমরা। কোথাও রিপেয়ারিং-এর কাজ থাকতেই পারে।”
“তা অবশ্য পারে,” শাওন একটু মন খারাপ নিয়েই বলল। সে ভেবেছিল তার এই পর্যবেক্ষণ নিয়ে হয়ত পরিদাদু খানিক প্রশংসা টশংসা করবেন।
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে ঘরে এসে পরিদাদু যেন একেবারে গুম মেরে গেলেন। মুখ বুজিয়ে চুপ করে বসে রইলেন ঘরের দেওয়ালের দিকে টি টেবলের সামনে রাখা চেয়ারের ওপরে। শাওন বিছানায় শুয়েছিল কিন্তু ঘুম আসছিল না। আড়চোখে পরিদাদুর দিকে মাঝেমাঝেই তাকিয়ে দেখছিল সে। পরিদাদু একই ভঙ্গিতে বসে আছেন চুপ করে। মাঝেমধ্যে ডান হাতের আঙুলগুলো দিয়ে মাথার চুলের মধ্যে বিলি কাটছেন আপনমনে। খুব গভীরভাবে কিছু চিন্তা করলে পরিদাদু এমনই করেন, শাওন আগেও দেখেছে। কিছু একটা রহস্য যে দানা পাকিয়ে উঠেছে হলং বাংলোকে কেন্দ্র করে, স্পষ্ট বুঝতে পারছিল শাওন। কিন্তু পরিদাদুকে এ বিষয়ে এক্ষুনি কিছু জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। সে জানে, পরিদাদুর কাছ থেকে এখন কোনো সদুত্তর পাওয়ার আশা নেই। কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে উঠে বসল শাওন। বিছানা থেকে নেমে পরিদাদুর সামনের চেয়ারটায় গিয়ে বসল। পরিদাদু মুখ তুলে তাকালেন তার দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল, উঠে এলি? ঘুম আসছে না?”
“উঁহু।”
“ভালোই হয়েছে” পরিদাদু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন, “আমি একটু বেরোচ্ছি। তুই দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দে।”
“কোথায় যাবে এখন?” শাওন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“দূরে কোথাও না,” পরিদাদু বললেন, “বাংলোটাকেই আর একটু ভালো করে দেখে নিতে চাইছি।”
“দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে আমরা ঘরে ঢুকে পড়ারও কতক্ষণ পরে তুমি ঘরে ঢুকলে। তখনও কি বাংলোর বিশেষ কিছু জায়গা পর্যবেক্ষণ করছিলে?”
“উঁহু।”
“তাহলে?”
“বাংলোর অন্য বোর্ডারদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করছিলাম।”
“মানে ওই যাদের সঙ্গে কুকুর? ওরা তো আমাদের ঠিক আগেই লাঞ্চ করে গেল ডাইনিং হল থেকে। আমি যখন হলে ঢুকছি তখন কুকুরটাকে সঙ্গে নিয়ে ভদ্রলোক বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন।”
“হ্যাঁ, ওঁরা এক এক করে লাঞ্চ করেছেন,” পরিদাদু বললেন, “মিসেস মিত্র যখন খাচ্ছিলেন, সুনন্দ মিত্রকে দেখলাম কুকুরটাকে সঙ্গে নিয়ে ওদিকের জঙ্গলের দিক থেকে বাংলোর লনের দিকে আসছেন। আমাকে দেখে খানিক অপ্রস্তুত লাগল ভদ্রলোককে।”
“কেন?”
“কারণ জানি না। তবে আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সুনন্দ বললেন, ডিঙ্গোকে টয়লেট করাতে জঙ্গলে নিয়ে গিয়েছিলেন।”
“কুকুরটার নাম ডিঙ্গো?”
“হ্যাঁ। তাই তো শুনলাম তাঁর মুখে,” পরিদাদু হাসলেন, “পরে অবিশ্যি ওঁদের সঙ্গে অনেক গল্পই হল। আমাদের লাঞ্চ হয়ে যাওয়ার পরে। তখন লনের শেষ প্রান্তে যে দোলনাটা ওটার ওপরে বসে ছিলেন দুজনে…”
“আর তান্ত্রিক? তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়নি?”
“হুঁ, তাঁর সঙ্গেও আলাপ পরিচয় সেরে রাখতে হল বৈকি। তবে তার জন্যে যেচে তাঁর ঘরে যেতে হল। খারাপই লাগল খানিক বুঝলি শানু। ভদ্রলোক বোধহয় দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে যোগনিদ্রায় ছিলেন…”
“বললেন তাই?”
“তা অবিশ্যি বলেননি। বরং বললেন, শাস্ত্রে দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা নিষিদ্ধ। তিনি দুপুরে কক্ষনও শোন না…”
“তাহলে বুঝলে কী করে যে তিনি ঘুমোচ্ছিলেন?”
“অনুমান। বেল বাজানোর পরে দরজা খুলতে তা না হলে অত দেরি হল কেন?”
“তাঁর সঙ্গে কী কথা হল পরিদাদু?”
“সে কথা পরে বলব’খন,” পরিদাদু তাড়াহুড়ো করে দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন, “এখন একটু ঘুরে আসি বুঝলি। মা বাবাকে এক্ষুনি কিছু বলার দরকার নেই। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে অরুণ যদি কিছু জিজ্ঞেস করে বলবি আমি তক্ষুনিই বেরিয়েছি। আশেপাশেই আছি কোথাও…”
“আচ্ছা,” ঘাড় নেড়ে সায় দিল শাওন।
“দরজাটা বন্ধ করে দে,” বলে পরিদাদু বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
সন্ধেবেলা রুম সার্ভিসে যখন চা পকৌড়া দিয়ে গেল, তখনও পরিদাদুর দেখা নেই। অরুণাংশু বিরক্ত হয়ে বললেন, “পরিকে নিয়ে এই এক জ্বালা। কী যে করে আর কোথায় যায় কে জানে! কস্মিনকালেই আমাদের কিছু জানিয়ে কাজ করা ওর ধাতে নেই।”
সুছন্দা শাওনের দিকে চেয়ে কড়া গলায় বললেন, “সত্যি করে বল তো শানু, ব্যাপারটা ঠিক কী?”
“কী ব্যাপার?” শাওন উদাসীন থাকার চেষ্টা করে। পরিদাদু বলে গেছেন এক্ষুনি মা বাবাকে কিছু না জানাতে।
“একদম ন্যাকামি করবি না,” সুছন্দা ধমকে উঠলেন, “যেমন গুরু তেমনই চ্যালা। পরিকাকু নিশ্চিত আবার কিছু একটা গোলমাল পাকাচ্ছে। পরিকাকুর সঙ্গে যেখানেই যাই, শান্তিতে বেড়ানো যেন আমাদের কুষ্ঠিতে লেখা থাকতে নেই…”
শাওন বলল, “ওইজন্যেই তো আমার কেবল পরিদাদুর সঙ্গেই বেড়াতে ইচ্ছে করে।”
“তা তো করবেই,” সুছন্দা মুখ বিকৃত করেন, “তুমি যে মস্ত বীরপুরুষ হয়েছ…”
অরুণাংশু কিছু একটা বলতে গিয়েও দরজার কড়া নাড়ার শব্দে থেমে গেলেন। সুছন্দা উঠে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কে?”
“ভেতরে আসতে পারি?” বাইরে থেকে রথীন ঘোষের গলার আওয়াজ শোনা গেল।
“আসুন, আসুন,” সুছন্দা দরজা খুলে দিয়ে আপ্যায়ন করে চেয়ারে বসালেন তাঁকে। রথীনবাবু হাসলেন, “বসব না। জিজ্ঞেস করতে এলাম, পকৌড়া খেতে ভালো হয়েছে তো?”
“খুব সুন্দর,” অরুণাংশু বললেন।
“আর এক প্লেট দিয়ে যেতে বলব?” রথীন হাসলেন, “কমপ্লিমেন্টারি ডিশ। আমার তরফে…”
“না না লাগবে না,” সুছন্দা বললেন, “এমনিতেই যা পাঠিয়ে দিয়েছেন তাই খেয়ে শেষ করতে পারছি না…”
“পরিমলবাবুকে দেখছি না, কোথায় গেলেন?” রথীনবাবু ঘরের মধ্যে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“একটু আগে বেরলো। বলল, চারপাশটা ঘুরে দেখে আসি একবার,” অরুণাংশু বললেন, “পরিমল ওই রকমই। স্থির হয়ে বেশিক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকতে পারে না। কত বকাবকি করি আমরা এই নিয়ে। বয়েস তো বাড়ছে ক্রমশ। এখনও কি পঁচিশ তিরিশ বছরের যুবক আছে সে, বলুন? কিন্তু কে শোনে কার কথা…”
“সে ঠিক আছে,” রথীন মাথা দুলিয়ে বললেন, “মন থেকে আমিও বুড়ো না হয়ে পড়ার পক্ষপাতি। নিজেকে বুড়ো ভেবে ফেললে যে শক্তিটুকু শরীরে অবশিষ্ট আছে এখনও, তার ওপর থেকেও ভরসা চলে যায়। চিন্তা আসলে একটাই। আমার বাংলোটা তো বলতে গেলে জঙ্গলের একেবারে মাঝমধ্যিখানেই। পরিমলবাবু যদি একা একা জঙ্গলে ঢুকে পড়েন তাহলেই মুশকিল। জঙ্গলে যে কত রকমের বিপদ! বাইরের লোকেরা কল্পনাই করতে পারবে না। বিশেষ করে সন্ধের অন্ধকার নেমে যাওয়ার পরে তো জঙ্গল আরও আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে যায়…”
“জঙ্গলে ঢুকবে না,” ইচ্ছে করেই বলল শাওন, “আজ সকালেই তো আমাকে বলছিল পরিদাদু, জঙ্গলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই যেন গা ছম ছম করে ওঠে। মনে হয়, আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু জঙ্গলের পশু পাখিরা যেন লুকিয়ে নজর রেখেছে আমার ওপরে…”
রথীন মনে হল যেন একটু অবাকই হলেন। কেমন যেন একটু সন্দেহের সুরে বলে উঠলেন, “তাই নাকি? পরিমলবাবুকে দেখে তো অমন ভীতু টাইপ মনে হয় না?”
“ভীতু একেবারেই নয়,” সুছন্দা বলে উঠলেন, “বরং বলতে পারেন একটু বেশিই সাহসী। আর বাইরে বেরোলে সেইটেই সবসময় আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে এসেছে বরাবর। এখানে এসব বলেছে হয়ত নাতিকে কিছুটা বাগে রাখার জন্যে। নইলে শানু নিজেই ফাঁক পড়লে জঙ্গলে ঢুকে পড়বে, এই ভয় পেয়েছে হয়ত। নাতিকে নিজের মতোই বাউন্ডুলে তৈরি করছে কিনা…”
“তা হতে পারে,” রথীন ঘোষ শাওনের দিকে চেয়ে হাসলেন, “শাওনবাবুও কি দাদুর মতো রহস্য টহস্যের পিছনে দৌড়ে বেড়ানো শুরু করে দেবে নাকি আর একটু বড় হলেই?”
“দেবে কী বলছেন দাদা, অলরেডি শুরু তো করেই দিয়েছে,” সুছন্দা বললেন বিরক্তির সুরে, “সেইটেই তো অশান্তি আমার। কবে যে কোন বিপদ ডেকে আনে বেশি পাকামি মারতে গিয়ে…”
“কী ব্যাপার, আমার নাতির নামে রথীনবাবুর কাছে কী বদনাম করছিস রে খুকু?” বলতে বলতে ঠিক এই সময়েই পরিদাদু ঘরে ঢুকলেন। তাঁকে দেখে বেশ খুশি খুশি মনে হল শাওনের। পরিদাদু ঘরে ঢুকে বিছানার ওপরে বসে পড়লেন। সুছন্দার দিকে চেয়ে বললেন, “চা ঢাল খুকু।”
“সে ঢালছি,” সুছন্দা পরিদাদুর জন্যে উপুড় করে রাখা চায়ের কাপটা সোজা করে ডিশের ওপরে রেখে বললেন, “কিন্তু আর একটু আগে এলে পকোড়াগুলো আর একটু গরম পেতে…”
“গরম গরম এক প্লেট পাঠিয়ে দিতে বলি না হয়,” রথীন ঘোষ উঠে দাঁড়ালেন।
“আরে না, না, লাগবে না আপনি বসুন,” পরিদাদু সামনে রাখা প্লেট থেকে একটা পকোড়া হাতে তুলে নিয়ে বললেন, “আচ্ছা রথীনবাবু, মানসবাবু মারা গেছেন কতদিন হল?”
“বছর দুই হবে,” বলে পরিদাদুর মুখের দিকে চাইলেন তিনি, “কেন বলুন তো?”
“তাঁর শেষ কাজ এখানেই হয়েছিল?”
“হ্যাঁ। এখান থেকে মিনিট কুড়ি গাড়িতে গেলে একটা প্রাচীন শ্মশান আছে…” বলে একটু থামলেন রথীন। তারপর বললেন, “কাল আমরা ওই শ্মশানে যাব একবার। রাত্রিবেলা। আপনি আমাদের সঙ্গে যাবেন পরিমলবাবু?”
“রাত্রিবেলা শ্মশানে, কেন?” আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলেন সুছন্দা।
“মানসের মৃত্যুর পর থেকে এই এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ধারণাটা বদ্ধমূল হয়ে আছে, সেটার অবসান চাইছি এবার পরিমলবাবু…” রথীন ঘোষ নীচু গলায় বললেন।
“মানে?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন।
“এখানকার অনেকেই মনে করে, মৃত্যুর পরেও মানস এখানেই আছে। অনেকেই এখানে তার প্রবল উপস্থিতি অনুভব করতে পারে প্রায়ই। কেউ কেউ তো পরিত্যক্ত ওয়াচ টাওয়ারে তাকে বসে থাকতেও দেখেছে। সে কথা তো আপনাকে আগেই বলেছি…”
“আপনি তাঁকে অনুভব করতে পারেন?” পরিদাদু জিজ্ঞেস করলেন আগ্রহের সঙ্গে।
“পারি।”
“লাস্ট কবে এমন অনুভূতি হয়েছে আপনার?”
“গতকাল রাতে।”
“তাই নাকি? কখন?”
“তখন গভীর রাত। দুটো তিনটে হবে বোধহয়। চারদিক নিস্তব্ধ। মঞ্জু অঘোরে ঘুমোচ্ছে। টয়লেট করার জন্যে বিছানা ছেড়ে উঠতেই একটা খুব হাল্কা শব্দ পেলাম আমি বাইরে থেকে। অনেক সময় রাতের দিকে জঙ্গলের জানোয়ার বাড়ির হাতার মধ্যে চলে আসে। প্রথমটা তেমনই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে মনে হল, খুব চাপা গলায় কারা যেন নিচে বাধানো বড় ছাতা টাঙানো বসার জায়গাটা থেকে কথা বলছে। আমি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। আর তখনই পেলাম সেই গন্ধটা…”
“কোন গন্ধ?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন কৌতূহলী কণ্ঠে।
“একটা নির্দিষ্ট বডি স্প্রে। যেটা এখানে কেবল মানসই ব্যবহার করত…”
“আশ্চর্য!” পরিদাদু বললেন।
মানসবাবুর এই আনক্যানি প্রেজেন্সটা বন্ধ করার জন্যে কী একটা ব্যবস্থা নেবার কথা বলছিলেন যেন একটু আগে?” সুছন্দা পুরনো কথাটার খেই ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন রথীনবাবুকে।
“হ্যাঁ,” রথীন মাথা নাড়লেন, “কাল যোগানন্দজিকে দিয়ে শ্মশানে একটা ক্রিয়া করাতে চাইছি।”
“কীসের ক্রিয়া?” পরিদাদুর ভ্রু কুঁচকে উঠেছে আবার।
“মানসের আত্মার শান্তি কামনায়। যোগানন্দজি বলেছেন, মানসের আত্মাকে তিনি মুক্তি দেবেন এইবার।”
সুছন্দার চোখে মুখে যোগানন্দ সম্পর্কে বেশ একটা সম্ভ্রমের রেখা ফুটে উঠল। রথীন ঘোষের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, “এই ভদ্রলোকের অনেক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা, তাই না দাদা?”
“আমি ঠিক জানি না। তবে উনি নিজে যেটুকু বলেন তাইতে মনে হয় মন্ত্র তন্ত্রের বিষয়ে অন্তত চর্চায় থাকেন ভদ্রলোক। হাজার হোক এই নিয়েই পড়ে আছেন যখন, কিছু সিদ্ধি তো নিশ্চিত করায়ত্ত হয়েছে এতদিনে…”
“সে তো বটেই,” সুছন্দা তাঁর কথায় সায় দিলেন, “একবার শাওনকে সঙ্গে নিয়ে ওঁর কাছে যাব আলাপ করতে। আমার ছেলেটার ভবিষ্যৎ নিয়ে যদি দু’ কথা বলেন…”
শাওন একটু বিরক্ত হল। চোখ কুঁচকে তাকালো মায়ের দিকে। কিন্তু পরিদাদু তাকে চোখের ইশারায় কিছু না বলতে বললেন। চুপ করে গেল শাওন।
৫
দুপুরে লাঞ্চের পর ঘরে ঢুকে সটান বিছানায় শুয়ে পড়লেন পরিদাদু। শাওন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”
“শরীরটা খুব একটা ভালো বলছে না শানুবাবু,” পরিদাদু ম্লান হাসলেন, “যতই জোয়ান থাকার চেষ্টা করি না কেন, বয়েস আমাকেও ছেড়ে কথা কইছে না রে…”
“অসুবিধাটা কী হচ্ছে?”
“মাথাব্যথা,” বলে একটু থামলেন পরিদাদু। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “মাথার আর দোষ কী বল। এখানে এসে থেকে যে পরিমান ঘামাতে হল মাথাটাকে…”
শাওনের চোখ চক চক করে উঠল। পরিদাদু তার মানে কিছু একটা রহস্যের সমাধান খুঁজছিলেন মনে মনে আর এখন নিশ্চিত সে রহস্যের কিনারা করে ফেলেছেন। বিছানায় উঠে এসে পরিদাদুর পাশে বসে খুব নীচু গলায় জিজ্ঞেস করল শাওন, “ওয়াচ টাওয়ারটায় কারা যায় পরিদাদু? অযথা ভয় দেখিয়ে আমাদের সেখানে যেতে বার বার বাধাই বা দিতে চাইছিলেন কেন রথীন আঙ্কল?”
“সে প্রশ্নের জবাব খুব সম্ভবত আজ রাতেই পাওয়া যাবে।”
“কী করে বুঝলে?”
“চোখ কান খোলা রাখলে বোঝা যায়,” পরিদাদু চিত হয়ে শুয়ে চোখ বুজিয়ে বললেন, “আজ রাতেই যদি যোগানন্দজির কৃপায় মানসবাবুর ভূত ওয়াচ টাওয়ার থেকে মুক্ত হয়ে যায় তাহলে তো আর ওদিকটাকে অমন নিষিদ্ধ অঞ্চল বলে দেগে রাখার মানে থাকবে না। তখন টুরিস্টদের আনাগোনা শুরু হবে ওয়াচ টাওয়ারে। তাহলে যারা ওখানে নিরিবিলিতে জড়ো হয় কিছু বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে, তাদের নিজেদের জরুরি কাজকর্ম আজ রাতের মধ্যেই তো সেরে ফেলতে হয় আপাতত। আর আজ রাতটা বড় সুবিধেরও…”
“কেন?”
“এটা না বোঝার কী আছে?” পরিদাদু চোখ খুলে বিরক্ত মুখে চাইলেন শাওনের দিকে, “আজকে এখানকার লোকজনের অ্যাটেনশন থাকবে শ্মশান এবং যোগানন্দের দিকে…”
“যোগানন্দ লোকটাকে তোমার কেমন মনে হয়ে পরিদাদু?”
“খুবই গোলমেলে।”
“কেন?”
“অনেকগুলো কারণ।”
“যেমন?”
“এক, লোকটা যদি রাবারের স্ট্র্যাপ দেওয়া খড়ম পরতেই অভস্ত হয় তাহলে তাহলে তার পায়ে স্ট্র্যাপের মাপ অনুযায়ী সাদা দাগ থাকার কথা। কিন্তু লোকটার পা এক্কেবারে পরিষ্কার। বুট পরে অভস্ত মানুষের মতো। দুই, ওর মাথার বড় বড় যে চুলগুলো দেখছিস সেগুলো নকল। সম্ভবত দাড়িটাও…”
“বলো কী গো?”
“হ্যাঁ। আর সেইজন্যেই আমি যেদিন আলাপ করার জন্যে ওর ঘরে গিয়েছিলাম, মেক আপ করার জন্যেই ওর দরজা খুলতে দেরি হয়েছিল…”
“লোকটা ভন্ড তার মানে?”
“ভন্ড কী না জানি না, তবে লোকটা ছদ্মবেশে রয়েছে যে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।”
“লোকটা তো আগেও এখানে এসেছে, অন্তত রথীনআঙ্কলের কথা থেকে তাই তো মনে হয়েছে। আগেও তার মানে সে ছদ্মবেশেই এসেছে।”
“অন্তত যোগানন্দ সেজে যে তিন চার বার সে এসেছে তা রথীনবাবু তো স্বীকার করেইছেন…,” পরিদাদু হাসলেন।
শাওন ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলল, “তার মানে লোকটা আসল চেহারাতেও অন্য নামে এই বাংলোয় আসে বলছ?”
“হুঁ।”
“কিন্তু পরিদাদু, বাংলোয় থাকার জন্যে তো আমাদের কাছ থেকে ফোটো আইডেন্টিটি কার্ড চেয়ে নিল। এটাই যদি নিয়ম হয় তাহলে ওই যোগানন্দ নামের ভন্ড সাধুটা কোন আই কার্ড দেখাল?”
“এটা একটা ভালো পয়েন্ট,” পরিদাদু মাথা নাড়লেন, “কথাটা আমার মাথাতেও আসেনি তা নয়। কিন্তু ফোটোশপে আজকাল তো অনেক কিছুই করা যায়। এসব হোটেল বাংলোয় যেসব কাগজ আমরা জমা দিই সেগুলোকে কি আর ভেরিফাই করে কেউ? গোলমাল কিছু না হলে ওসব নিয়ে কে আর মাথা ঘামায় বল…”
“এ লোকটা তাহলে জাল আই কার্ড দিয়ে থাকে এখানে?”
“হতেই পারে,” পরিদাদু হাসলেন, “আবার এমনও হতে পারে, লোকতার আসল পরিচয় রথীনের জানা। সব জেনেশুনেই এ লোকটাকে অমন ছদ্মবেশে অ্যালাও করছে সে…”
“লোকটা তো তাহলে বেশ বিপজ্জনক।”
“বিপজ্জনক কিনা বলতে পারব না, তবে সন্দেহজনক।”
“আজকে যে উদ্দেশ্য নিয়ে শ্মশানে যাচ্ছেন রথীনআঙ্কল, সেটা তো তাহলে পূর্ণ হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই…”
“রথীনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তুই কি নিঃসন্দেহ নাকি?”
“মানে?” চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞেস করে শাওন।
“এমনও তো হতে পারে রথীন ঘোষ যোগানন্দের আসল পরিচয় জানেন। জেনে বুঝেই লোকটাকে সঙ্গে করে শ্মশানে নিয়ে যাবার নাম করে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আজ রাতে বাংলো থেকে। এবং আমার সম্পর্কে যেহেতু খানিক ধারণা তাঁর আছে, তাই আমাকেও কৌশলে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন। চোখে চোখে রাখতে চাইছেন আমাকে আজ রাতের খানিকটা সময়…”
“ওই সময় এমন কোন ঘটনা ঘটতে চলেছে পরিদাদু যার থেকে তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছেন তিনি?”
“সেটা খানিক অনুমান করতে পারছি। তবে সে বিষয়ে এক্ষুনি কিছু বলার সময় আসেনি। শুধু এটুকু বলতে পারি, কাল সকালে রথীনের বাড়ির পিছনের বাঁশগুলোর কথা বলে তুই বড় উপকার করেছিস আমার।”
পরিদাদু উঠে পড়লেন। ঘরের দেওয়ালের ওপরে মাঝখান থেকে চিরে নেওয়া ফাঁপা বাঁশের আস্তরনের ওপরে হাত বুলোতে লাগলেন সন্তর্পণে।
শাওন হাসল, “তোমার শরীর মোটেই খারাপ নয়। তুমি আপাতত অসুস্থতার ভান করছ।”
“বুদ্ধি খুলছে দেখছি।” পরিদাদু হাসলেন।
“রাত্তিরে যাতে শ্মশানে না যেতে হয় তার ফিল্ড তৈরি করতে চাইছ তুমি এখন থেকে।” শাওনও হাসল।
“এই চাতুরিটুকু না করে যে উপায় ছিল না শানুবাবু। আজ তো আমার শ্মশানে গেলে চলবে না। আজ যে আমার ডিউটি অন্য জায়গায়।”
“ওয়াচ টাওয়ার?”
“হুঁ।”
“আমিও কিন্তু তোমার সঙ্গে যাচ্ছি।”
“নো স্যার।”
“এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না পরিদাদু’, আহত গলায় বলল শাওন, “তোমার সঙ্গে কত বিপদের জায়গাতেই তো আমি থেকেছি। আজ আমাকে বারণ করলে আমি কিন্তু কিছুতেই শুনব না। হাজার হোক আমি তোমার অ্যাসিসট্যান্ট…”
“এটা ছেলেখেলার সময় নয় শানু। আজ রাতে কী হতে চলেছে আমি নিজেও জানি না ভালো করে। যা ভাবছি তা যদি সত্যি হয় তাহলে আজকের রাতের অভিজ্ঞতা ভয়ঙ্কর হতে পারে। ওই বিপদের মধ্যে আমি তোকে কিছুতেই নিয়ে যেতে পারি না…”
“এর আগে কি আমরা বিপদে পড়িনি পরিদাদু?”
“কিন্তু তখন বিপদে পড়েছি না বুঝে। ঘটনাচক্রে বিপদের মধ্যে আমরা জড়িয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এই কেসটা আলাদা। বিপদ সামনে অপেক্ষা করে আছে আমি জানি।”
“কী ধরণের বিপদ?”
“যদি শিবশংকর গুছাইতের কথা ছেড়েও দিই, রাতের জঙ্গলটাও তো নিরাপদ নয়…”
“শিবশংকর গুছাইত আবার কে? সে এর মধ্যে ঢুকে পড়ল কোথা থেকে?” উত্তেজিত গলায় বলে শাওন।
“তুইই তো তার কথা বললি আমায়,” পরিদাদু শাওনের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিলেন, “এবারে সত্যিকারের হিরো তো আসলে তুই। ঠিক সময়ে সঠিক দিকে আমার নজর ঘুরিয়ে দিয়েছিস একাধিক বার। তা নাহলে ব্যাপারটা এত সহজে আমি কিছুতেই ছকে নিতে পারতাম না…”
“তোমার কথা তো কিছুই বুঝতে পারছি না পরিদাদু’, অবাক হয়ে বলে শাওন।
“রথীনের সঙ্গে সঞ্জীবের বাকবিতন্ডার সময় শিবু নামটা এসেছিল। তুই-ই আমাকে বলেছিলি, মনে করে দেখ।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ,” মাথা নারে শাওন, “মনে পড়েছে।”
“তোর কাছ থেকে নামটা পেয়ে শিবু সম্পর্কে খানিক খোঁজ তল্লাশ তো করতেই হল,” পরিদাদু চেয়ারে বসে বললেন, “খবর যা পেলাম তাতে দেখলাম, সে তো বলতে গেলে মহাপুরুষ একেবারে…”
“কেন?”
“লোকটা কাঠের ব্যবসায়ী,” পরিদাদু বললেন, “জঙ্গলে তাই তার অবাধ যাতায়াত। আইনি এবং বেআইনি কাঠের ব্যবসায় দু ভাবেই দেদার টাকা কামিয়েছে লোকটা। পুলিশ প্রশাসনেও জমাটি প্রভাব লোকটার…”
“কী করে জানলে?”
“এমনি এমনিই কি আর ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি রে?” পরিদাদু সামনের টি টেবলের ওপরে আঙুলের টোকা দিতে দিতে আপন মনে বললেন, “কিন্তু কাঠের ব্যবসার আড়ালে তার আর একটা ব্যবসা আছে। সেটার খবর সকলে রাখে না। সে ব্যবসাটি গোপন এবং লাভজনক…”
“কী ব্যবসা?”
“মাদকের।”
“অ্যাঁ?”
“হ্যাঁ,” পরিদাদু বললেন, “এবং সেইসব মালপত্তর সে লোদ করত ওই ওয়াচ টাওয়ারের কাছে। তারপর তার গাড়ি ওই টাওয়ারের পাশের রাস্তা দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে যেত…”
“চেকিং থাকে তো। ধরা…”
“ধুস,” পরিদাদু হেসে উঠলেন, “কে ধরবে? ভূত তো সর্ষের মধ্যেও রয়েছে। তাছাড়া তার মাল পাচারের পদ্ধটিটাও ভারী অভিনব…”
“কী রকম?”
“বাঁশের মধ্যে করে মাদক পাচার করে লোকটা। মাঝখান থেকে চ্যালা করে মাল ঢুকিয়ে আবার আটকে দেয় বাঁশগুলো। অন্য বাঁশ আর কাঠের মধ্যে ওগুলোও পাচার হয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যায় নিরাপদে…”
“উরিব্বাস।”
“সেদিন টাওয়ারের ওপরে উঠে আমি তাদের প্রস্তুতির খানিক নমুনা সেখানে পড়ে থাকতে দেখেছি। তারা তো ভাবেনি পরিমল চাটুজ্জে দুম করে হলং পান্থ নিবাসে এসে হাজির হবে এবং অমন ভয়ংকর সব গল্প শোনার পরেও সটান গিয়ে হাজির হবে জঙ্গলের মধ্যে ওয়াচ টাওয়ারের কাছে। তারপর সুড়সুড় করে সিঁড়ি ভেঙে রাখা সত্বেও গোঁয়ারের মতো টাওয়ারের মাথায় চড়ে যাবে এই বুড়ো বয়েসেও…,” পরিদাদু হাসলেন, “আমার অনুমান সঠিক হলে আজ রাতেই ওখান থেকে মালগুলো সরানোর চেষ্টা করবে শিবু আর তার সাকরেদরা…”
“এই রকম একটা দুর্ধর্ষ সময়ে তুমি আমাকে নিয়ে যাবে না বলছ, এটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না পরিদাদু’, শাওন মরিয়া হয়ে বলে।
“অযথা জেদ করিস না শানু,” পরিদাদু ধমক লাগান তাকে।
শাওন চুপ করে গেল। আর কোনো কথা বলল না পরিদাদুর মুখের ওপরে।
রাতে ডাইনিং হলে গেলেন না পরিদাদু। রথীন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “পরিমলবাবু এলেন না?”
পরিদাদুর শরীরটা ঠিক নেই। শুয়ে আছে,” শাওন বলল।
“সে কী! কী হয়েছে?” রথীনবাবু ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, “জ্বর টর এসেছে নাকি?”
সুছন্দা, অরুণাংশুও ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। অরুণাংশু চিন্তিত গলায় বললেন, “কই আমাদের কিছু বলিসনি তো এতক্ষণ? দুপুরে তো একসঙ্গেই খাওয়া দাওয়া করলাম। সন্ধেবেলা একসঙ্গে চা-ও তো খেল। তখনই অবিশ্যি দেখেছি বেশি কথা বলছে না। গুম মেরে আছে কেমন। তবে অমন তো অনেক সময়েই থাকে। ভাবলাম আবার কিছু একটা নিয়ে মনে মনে মেতেছে হয়ত। কিন্তু শরীর খারাপ তা তো বুঝতে পারিনি…”
“না না তেমন কিছু নয়,” শাওন বলল, “খুব মাথা ধরেছে। বলল প্যারাসিটামল খেয়েছি। একটু রেস্ট নিতে দে, ঠিক হয়ে যাব।”
“আমার সঙ্গে তার মানে রাতে আর উনি বেরোতে পারবেন না আজকে?” রথীন ঘোষ বললেন।
“আজ রাতে পরিদাদুর কোথাও বেরনোর মতো ক্ষমতা নেই দেখলাম শরীরে,” শাওন যতটা সম্ভব সিরিয়াস মুখ করে বলল, “আমি খেতে আসার সময় উঠে দরজা বন্ধ করতেও এল না। বলল, তুই দরজা বাইরে থেকে লক করে দিয়ে যা…”
“ইশ,” সুছন্দা বললেন অরুণাংশুর দিকে তাকিয়ে, “তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। পরিকাকুর জন্যে চিন্তা হচ্ছে। চলো দেখি কেমন আছে। অন্য কোনো ওষুধ টসুধ যদি লাগে…”
রথীন ঘোষকে চিন্তান্বিত দেখাচ্ছিল। ডাইনিং হলের মধ্যে পায়চারি করতে করতে তিনি বললেন, “পরিমলবাবু সঙ্গে থাকলে খানিক নিশ্চিন্ত হতে পারতাম…”
শাওন আড়চোখে তাঁর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়েই খাওয়ায় মন দিল। পরিদাদুর জন্যে খারাপ লাগছিল। আজ রাতের খাবারে দারুণ মেনু। গরম রুটি, সুস্বাদু তরকারি, চিকেন। সঙ্গে দু’ রকমের দুর্দান্ত মিষ্টি। বেচারা পরিদাদু। বলেছে, রাতে চুপি চুপি ছাতু ভিজিয়ে খেয়ে নেবে…
৬
পরিদাদু বলল, “আওয়াজ না করে পাশের ঘরের দরজায় কান পেতে দেখে আয় তো শাওন মা বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা।”
“ঠিক আছে, দেখছি,” শাওন দরজার দিকে এগোয়।”
“আশেপাশেও খেয়াল রাখিস।”
“আচ্ছা।”
একটু আগেই যোগানন্দকে সঙ্গে নিয়ে রথীন ঘোষ বেরিয়ে গেছেন সঞ্জীবদার গাড়িতে। সঙ্গে বাংলোর আরো দু এক জনও ছিল। শ্মশানে ক্রিয়া করার সময় যে জিনিসপত্তরগুলো লাগবে, সেগুলো গুছিয়ে দিয়ে আসার জন্যে। বেরনোর সময় রথীন অরুণাংশুকেও জিজ্ঞেস করেছিলেন একবার, “আপনার আগ্রহ টাগ্রহ আছে নাকি এসব বিষয়ে? গেলে যেতে পারেন কিন্তু আমাদের সঙ্গে। পরিমলবাবু তো যেতে পারলেন না…”
অরুণাংশু দোনামোনা করছিলেন। বোধহয় ব্যাপারটা দেখে আসার ইচ্ছে তাঁর ছিল। কিন্তু সুছন্দা এক ধমক দিলেন তাঁকে, “খবর্দার নয়। ওসব ভূত পিশাচের ব্যাপারে একদম মাথা গলাবে না তুমি। তাছাড়া কাল বিকেলেই আমাদের ফেরা। সে কথাটাও মাথায় রাখা দরকার। মনে রেখ, তুমি আর এখন ছেলেমানুষ নেই। সারা রাত শ্মশানে নেচেকুঁদে এসে কাল যদি শরীর খারাপ করে তাহলেই হয়ে গেল। একজন তো ইতিমধ্যেই উলটে পড়েছে। এবার কি নিজে শুয়ে না পড়লে চলছে না তোমার?”
সুছন্দার ওই মূর্তি দেখে রথীন আর দ্বিতীয়বার অনুরোধ করেননি অরুণাংশুকে। অরুণাংশু নিজেও তাঁর সঙ্গে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাতে সাহস করেননি। চুপচাপ ঢুকে গেছেন ঘরের মধ্যে।
রথীন যখন পান্থনিবাস থেকে থেকে বেরিয়ে পড়লেন, সুনন্দ মিত্র ডিঙ্গোকে সঙ্গে নিয়ে লনে হাঁটছিলেন। শাওনকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, “তোমার দাদু, আই মিন পরিমলবাবুকে দেখছি না তো?”
“ওঁর শরীরটা বিশেষ ভালো নেই,” শাওন হাসল।
“শুনেছিলাম উনি নাকি এই বোগাস ব্যাপারটা দেখতে যাবেন বলেছিলেন?”
“পরিদাদু যাবে বলেনি, রথীন আঙ্কলই যাবার জন্যে অনুরোধ করেছিল ওঁকে…”
“আচ্ছা,” সুনন্দ হাসলেন, “উনি ওইসব ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করেন নাকি রথীনবাবুর মতো?”
“আপনি তো করেন না, তাই না?” শাওন ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল ভদ্রলোককে।
“উঁহু,” সুনন্দ হাসলেন, “সুপারস্টিশনকে আমি এক্কেবারেই এনকারেজ করি না। তুমি তো এখনও ছোট, তাই বলছি, তুমিও কোরো না। ছোট থেকেই যুক্তি ও বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে বড় হওয়ার চেষ্টা করাই উচিৎ আমাদের…” বলেই কনুই থেকে বাঁ হাত ভাঁজ করে ঘড়ি দেখলেন তিনি। তারপর হেসে বললেন, “আসি। রাত হচ্ছে। আমি আবার আর্লি টু বেড এন্ড আর্লি টু রাইজ-এর দলে…”
শাওনও ঢুকে পড়েছিল ঘরের মধ্যে।
এখন বাইরে বেরিয়ে পুরো পান্থনিবাসটাকেই যেন বড় বেশি শান্ত আর নির্জন মনে হচ্ছিল শাওনের। কোথাও এতটুকু শব্দ নেই। কী এক অজানা আশংকায় চারদিক যেন থম মেরে আছে। মা বাবার ঘরের সামনের দরজায় গিয়ে কান পাতল সে। নাঃ, চুপচাপ। ঘুমিয়ে পড়েছে দুজনেই। বাবার নাক ডাকার আওয়াজ আসছে বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে। বারান্দা থেকে লনে নামল শাওন। এগিয়ে দেখল যোগানন্দের ঘরে তালা ঝুলছে। কিন্তু সুনন্দ মিত্রের ঘর বন্ধ। জানলা দিয়ে ভিতর থেকে আলো আসছে না কোনো। নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছেন ওঁরাও।
ঘরে ফিরে এসে শাওন বলল, “পরিদাদু অল ক্লিয়ার। এবার আমরা বেরোতে পারি।”
“আমরা নয়, আমি,” স্থির ঠান্ডা গলায় বললেন পরিদাদু, এবারেও।
থতমত খেয়ে চুপ করে গেল শাওন।
দ্রুত তৈরি হয়ে নিয়ে শাওনের দিকে একটা সরু টর্চ এগিয়ে দিলেন পরিদাদু, “কাছে রেখে দিস। ঘরে একা থাকবি। বাই চান্স পাওয়ার কাট হয়ে গেলে কাজে লাগবে। আর হ্যাঁ, সাবধানে থাকিস।”
শাওন উত্তর দিল না। পরিদাদু তার অভিমান ভাঙানোর চেষ্টাই করলেন না। বরং দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েও আবার থমকালেন। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “সুনন্দ মিত্রের ঘরের সামনে গিয়ে দেখে এসেছিস?”
“বারান্দার ওপরে উঠিনি। লন থেকে দেখেছি, দরজা বন্ধ।”
“কাছে গিয়ে একবার দেখা উচিৎ ছিল,” দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে বললেন পরিদাদু, “ওদের ঘর থেকে কোনো শব্দ শুনিসনি? কুকুরের ডাক?”
“না তো।”
“আচ্ছা,” বলে সন্তর্পণে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলেন পরিদাদু। শাওন দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করল। কিন্তু বিছানার দিকে আদৌ এগলো না সে। বরং দ্রুত ট্রাক শুট এবং জুতো মোজা পরে নিয়ে পরিদাদুর দেওয়া টর্চটাকে ট্রাক শ্যুটের পকেটে রাখল সে। তারপর চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। এক্ষুনি নয়, পরিদাদু জঙ্গলের পথে আরো কিছুটা এগিয়ে যাক, তারপর…
পরিদাদু বেরনোর মিনিট কুড়ি পরে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল শাওন। দরজা বন্ধ করে তালা লাগালো ধীরেসুস্থে। তারপর চাবিটাকে পকেটে পুরে বারান্দা থেকে লনে নামল। চারদিকে সাবধানে নজর বুলিয়ে নিল খানিক। তারপর জঙ্গলের পথ ধরল। পথ অন্ধকার। আকাশে চাঁদ থাকলেও বড় বড় গাছের ফাঁক ফোকর গলে সে আলোর খুব উজ্জ্বল হয়ে জঙ্গলের পথ পর্যন্ত পৌঁছনো অসম্ভব। খানিকটা আন্দাজেই আগের দিনের রাস্তা ধরল সে ওয়াচ টাওয়ারের দিকে যাওয়ার জন্য।
কিছুটা পথ হাঁটার পরে অন্ধকার চোখে সয়ে এল। জঙ্গল এখানে খুব ঘনও নয়। ছোট ছোট ঝোপ আর ফাঁক ফাঁক কিছু বড় গাছ। আবছা আলোয় কিছু কেটে ফেলা গাছকে শুয়ে থাকতে দেখতে পেল শাওন। আগের দিন এগুলো দেখেনি তারা। তার মানে গাছগুলো দু একদিনের মধ্যেই কাটা হয়েছে। হয়ত আজই। মন খারাপ হয়ে গেল শাওনের। এই ভাবেই মানুষের লোভের সামনে এই পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর সব শেষ হয়ে যাবে ধীরে ধীরে। পকেট থেকে টর্চ বের করে দু একবার জ্বালিয়ে দিক ঠিক করে করে নেবার চেষ্টা করেছিল সে একটু আগে। তারপর নিজেরই মনে হয়েছে কাজটা ঠিক হচ্ছে না। অন্ধকার জঙ্গলের টর্চ জ্বালানো মানে অন্যের চোখে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে দেওয়া। এখন সে অন্ধকারের মধ্যেই হাঁটছিল। আর এভাবে হাঁটতে হাঁটতেই এক সময় জঙ্গলের মধ্যে দিক ভুল হয়ে গেল শাওনের। গাছ কেটে সাফ করে ফেলা একটা গোল ফাঁকা জায়গায় এসে সে থেমে গেল। মাথার ওপরে হঠাৎ করেই আকাশটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। গোল খোলা আকাশ থেকে চাঁদের আলো ঠিকরে এসে পড়েছে মাটির ওপরে। এমন কোনো জায়গায় তো পরিদাদুর সঙ্গে সেদিন আসেনি সে! গা ছমছম করে উঠল শাওনের। এই মস্ত জঙ্গলে ভুল করে অন্য পথে চলে গেলে চরম বিপদের মুখে পড়তে হতে পারে তাকে। বাড়ি ফিরতে তো পারবেই না, বন্য জন্তুদের কবলে পড়লেও রক্ষা নেই আর। এই প্রথম শাওনের মনে হল, ঘর থেকে পরিদাদুর কথা না শুনে একা একা বেরিয়ে আসাটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি।
চুপ করে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে করতে আপন মনেই বলে উঠল শাওন, “কোন দিকে যাই এখন? ওয়াচ টাওয়ারটা কোন দিকে গেলে পাব?”
“ডানদিকে। সোজা ডানদিকে ফিরে নাক বরাবর হাঁটতে থাকো। আর কোনোদিকে ঘুরবে না। অন্যমনস্কও হবে না। জঙ্গলে হাজার বিপদ লুকিয়ে থাকে। বিশেষত রাত্রিবেলা। চোখ কান খোলা রাখতে হয় তাই সবসময়। খুব বোকামি করে ফেলেছ শাওন। এইভাবে কাউকে কিছু না বলে একা ঘর থেকে বেরিয়ে দাদুকে ধাওয়া করা একেবারেই উচিৎ হয়নি তোমার…”
অন্ধকারের মধ্যে থেকে কণ্ঠস্বরটা কানে আসতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল শাওনের। সে তাহলে অনেক্ষণ আগেই ধরা পড়ে গেছে। কেউ তাকে এতক্ষণ ধরে ফলও করছিল জঙ্গলের পথে অথচ সে বুঝতেই পারেনি একটুও। নিজের ওপরে খুব রাগ হয়ে গেল শাওনের। নাঃ, কিছুতেই পরিদাদুর মতো হয়ে ওঠা সম্ভব হবে না তার পক্ষে।
নিজের ভয় পেয়ে যাওয়া ভাবটা লুকিয়ে রেখে বেশ তেড়িয়া হয়েই বলে উঠল শাওন, “কে আপনি?”
“এখনই সেটা জানার দরকার নেই শাওন,” কণ্ঠস্বর আড়াল থেকেই বলে উঠল, “নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। তোমার বোকামি এবং অতি অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তার জন্যে এমনিতেই আমরা অনেকখানি সময় নষ্ট করে ফেলেছি। মিস্টার চ্যাটার্জি আদৌ এতক্ষণ পর্যন্ত অক্ষত আছেন কিনা কে জানে! আমার অর্ডার ছাড়া এন্টায়ার অ্যাকশনটাই থমকে থাকবে…”
লোকটাকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিল না শাওন। চুপ করে দাঁড়িয়েই ছিল সে। অন্ধকার ঝোপের মধ্যে থেকে লোকটা এবার গর্জে উঠল, “কী হল? মুভ, কুইক। অ্যাজ ফাস্ট অ্যাজ ইউ ক্যান…”
তার গলায় এমন কিছু ছিল, শাওন সে আদেশ অমান্য করতে পারল না। দ্রুত ডান দিকে ঘুরেই সোজা হাঁটা লাগালো সে। অচেনা মানুষটা তার সঙ্গে সঙ্গে চলল কিনা, সে বিষয়ে কৌতূহল নিরসনের আর কোনো চেষ্টাই করল না শাওন। একবার অন্ধকারে পথ ঠাওর করতে না পেরে পকেট থেকে টর্চটা বের করতে যেতেই সেই গম্ভীর গলা যেন একেবারে তার পাশ থেকেই চাপা গলায় বলে উঠল, “একদম নয়। আলো জ্বালাতে যেও না। আমরা ধরা পড়ে যাব তাহলে। ভয় নেই, আমি সঙ্গে আছি তোমার। ওয়াচ টাওয়ারের কাছে প্রায় এসেই গেছি আমরা। ভালো করে লক্ষ করো। দেখ গাছপালার ফাঁকে মৃদু আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। ওই আলোই আমাদের গন্তব্য।”
৭
পরিদাদু সাবধানে এগোচ্ছিলেন। জঙ্গলের পথ। তাও আবার রাত। নির্দিষ্ট লক্ষ্যে দিক ঠিক করে এগিয়ে চলা সহজ ছিল না। কিন্তু জীবনের প্রথম দিকে পনের বছর সেনাবাহিনীতে কাটানোয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বিস্তর কঠিন মনে হওয়া অনেক কাজই তাঁর কাছে এখনও নেহাত জলভাত। আজও ওয়াচ টাওয়ারের দিকে বেশ সাবলীল ভাবেই তিনি এগোচ্ছিলেন। রাতের জঙ্গলে চলাফেরায় বাড়তি সতর্কতার সঙ্গে কানদুটোকেও সজাগ রাখতে হয়। সামান্য নড়াচড়ার শব্দ, শুকনো পাতার খসখস, গাছের ডালে পাখিদের ডানা নাড়া, সবই খেয়াল রাখতে হয় সাবধানতার সঙ্গে।
ওয়াচ টাওয়ারের কাছাকাছি পৌঁছে নিরাপদ দূরত্বে একটা ঝোপের আড়ালে বসে পড়লেন তিনি। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে জায়গাটা। শিবু গুছাইতের লোকজনের তৎপরতা চোখে পড়ছে এখান থেকেই। ওরা পরিদাদুকে দেখে ফেলবে এমন সম্ভাবনা কম। যেহেতু নিজেদের কাজের জায়গায় কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে ওরা, বাকি জঙ্গলটা ওদের চোখে এখন আরও বেশি অন্ধকার।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন পরিদাদু। এখনও পর্যন্ত সবকিছু পরিকল্পনামাফিকই চলছে। মিত্রর লোকজনের এতক্ষণে এখানে এসে পজিশন নিয়ে নেবার কথা। নিশ্চয়ই সুবিধামতন জায়গায় অন্ধকারে মিশে সুনন্দ মিত্রের আদেশের জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা। শিবু গুছাইতের লোকজনের মতো তিনিও তাদের অস্তিত্ব টের পাচ্ছেন না এতটুকুও। দ্রুত কাজ করছে এখন লোকগুলো। আবছা আলো অন্ধকারে ওদের ব্যস্ত ছুটোছুটি দেখে বোঝা যাচ্ছে খুব বেশি সময় ওরা এখানে থাকতে চাইছে না আর। তবে কি ওরাও সন্দেহ করেছে কিছু? এখানে ওদের ধরার জন্যে যে ফাঁদ পাতা হবে আজ তার আগাম আঁচ পেয়ে গেল কি লোকগুলো?
গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে টাওয়ারের ঠিক পিছনেই, রাস্তার ওপরে। বাঁশের গোছা বয়ে নিয়ে গিয়ে তোলা হচ্ছে গাড়িতে। সঙ্গে কিছু কাঠের গুঁড়িও। এদের মধ্যে থেকে মাদক ভরা বাঁশ আলাদা করে সনাক্ত করা সত্যিই কঠিন। তার চেয়েও বড় কথা এমন ভাবে কাজটা চালিয়ে যাচ্ছে এরা, হঠাৎ করে সন্দহই হবে না কারো। গাড়িতে করে যে কাঠ জঙ্গল থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে, নিশ্চিত তার অনুমতিপত্রে টত্রে কোথাও ফাঁক ফোকর রাখেনি এরা। অন্তত বনদপ্তর যে পথের কাঁটা হবে সে আশঙ্কা আপাতত নেই এদের সামনে। মনে মনে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা টের পাচ্ছিলেন পরিদাদু। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। গাড়ি লোডিং-এ আর খুব একটা বেশি সময় লাগার কথা নয় এদের। তারপরেই এখান থেকে রওনা দেবে লোকগুলো। তখন আর প্রমান সমেত এদের ধরে ফেলার রাস্তা থাকবে না হাতের মুঠোর মধ্যে। কিন্তু সংকেত দিতে এত দেরি করছে কেন সুনন্দ? তবে কি…
বুকের মধ্যে ছাঁৎ করে উঠল পরিদাদুর। শাওনকে একা রেখে এসেছেন বলে দুশ্চিন্তা কাজ করছে সর্বক্ষণ। শানুকে বিলক্ষণ চেনেন তিনি। তাঁর সঙ্গে এই অপারেশনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে ষোলো আনারও বেশি ইচ্ছে ছিল তার। তিনি একা বেরিয়ে আসার সময় শানুর নির্বিবাদে চুপ করে মেনে নেওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঠেকেনি। সঙ্গে আসার বায়না সে করেছিল ঠিকজই, কিন্তু তিনি বারণ করার পর খুব বেশি জোরও সে করেনি। সুনন্দকে তাই বলে রেখেছিলেন, শানুর ওপরে নজর রাখতে। সে ঘুমিয়েছে এটা নিশ্চিত হবার পরেই যেন সে আসে। তবে কি শানু কোনো গোলমাল পাকালো? যদি তা সত্যি হয় তাহলে কী ধরনের গোলমাল? শানু কোনো বিপদে পড়েনি তো? না হলে সুনন্দ এত দেরি করবে কেন?
লোকগুলোর কাজ প্রায় শেষ। এবার এ জায়গা থেকে সরে যাবে ওরা। গাড়ির দিকে এগোচ্ছে লোকগুলো। সুনন্দর লোকেরা তো আছেই। প্রয়োজনে তাঁর সাহায্যে নিশ্চিত এগিয়ে আসবে ওরা। পরিদাদু ঝোপের অন্ধকার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সোজা এগিয়ে গেলেন ওদের দিকে। এই মুহূর্তে যে করেই হোক কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ওদের আটকে রাখা দরকার এইখানে।
জঙ্গল ফুঁড়ে পরিদাদুকে হঠাৎ সামনে এগিয়ে আসতে দেখে প্রথমটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও পরক্ষণেই নিজেদের সামলে নিল লোকগুলো। ওদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে সটান পরিদাদুর জামার কলারটা খামচে ধরল শক্ত হাতে। তাঁর চোখের ওপরে চোখ রেখে হিংস্র গলায় বলে উঠল, “কে আপনি, কী চান এখানে?”
পরিদাদু খুব অবাক হয়ে যাবার ভান করে বললেন, “তবে যে শুনেছিলাম এ জায়গায় কেউ আসে না। এই টাওয়ারটা ভূতুড়ে। রাতে এখানে ভূত দেখতে পাওয়া যায়!”
“কে বলেছে?”
“রথীন ঘোষ,” পরিদাদু বোকা বোকা মুখ করে বললেন, “আমি ওঁরই পান্থনিবাসে উঠেছি কিনা। ওঁর মুখে এ কথা শুনে আর লোভ সামলাতে পারলাম না। ভূত দেখব বলে…”
“মাঝরাত্তিরে অন্ধকার জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন?” পরিদাদুকে কথা শেষ করতে না দিয়েই চিৎকার করে উঠল লোকটা, “আসল মতলবটা কী বলুন দেখি? সঙ্গে আর কজনকে নিয়ে এসেছেন?”
“সঙ্গে তো কেউ নেই,” পরিদাদু একই রকম বোকা বোকা ভঙ্গীতে বলে চললেন, “ভূত দেখার শখ আমার বহুদিনের বুঝলেন মশাই। ভূত দেখার জন্যে কোথায় না ঘুরেছি। শ্মশান, গোরস্থান…”
“আপনি পাগল নাকি?”
“না, সত্যিই,” পরিদাদু হাসলেন, “আপনাকে আর দোষ দিই কী করে। আমার নিকট আত্মীয়রাও অনেকেই আমাকে পাগল বলে…”
“ঠিকই বলে,” লোকটা বিরক্ত হয়ে বলে। ততক্ষণে ওদের দলের আরও দু একজনও এগিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে একটা লোককে চেনা ঠেকল পরিদাদুর। এ লোকটিকে হলং বাংলোয় দেখেছেন তিনি। নাম সম্ভবত অনন্ত। কিচেনের দায়িত্বে আছে লোকটা। তার দিকে চেয়ে পরিদাদু হাসলেন, “আপনাকে তো পান্থনিবাসে দেখেছি। আপনিও এখানে ভূত দেখতে এসেছেন বুঝি?”
লোকটা কটমট করে তাকালো পরিদাদুর দিকে। তারপর গম্ভীর গলায় বলে উঠল, “এই মানকে, লোকটাকে দড়ি দিয়ে বাঁধ তো শক্ত করে। লোকটা বাংলোয় আসা থেকেই সন্দেহ হয়েছিল আমার। বড্ড কৌতূহল এর। প্রথম দিন থেকে একেবারে চরকি পাক খাচ্ছে চারদিকে। এ ব্যাটা নিশ্চিত পুলিশের খোঁচর। যতই ন্যাকা সাজুক এখন, এর মতলব একেবারেই সুবিধের নয়…”
“তালে বেঁধে কী হবে, একেবারে শেষ করেই দিই না,” পাশ থেকে একজন বলল।
“এখন আমরা এমনিতেই একটা লাফড়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। তারমধ্যে বাড়তি হুজ্জোতি কাঁধে নিয়ে লাভ নেই। গুলি গোলা চালালে আওয়াজ হবে। তাতে বিপদ আমাদেরই বাড়বে। লোকটাকে এখানে বেঁধে রেখে আমাদের মাল নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়া দরকার এখন এখান থেকে। বস অপেক্ষায় আছে কিন্তু মালটার জন্যে…”
“কিন্তু এ লোকটা কোনোভাবে যদি বেঁচে ফিরে যায়?”
অনন্ত হেসে ওঠে হা হা করে, “এই অন্ধকার জঙ্গলে গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় থাকবে সারা রাত। সাপের কামড়, হাতির আক্রমণ, বাঘের ক্ষিদে এড়িয়ে লোকটা যদি বেঁচে ফেরে তাহলে একে মহাপুরুষ বলতে হবে তো। তাছাড়া ওর হাত পা-র বাঁধন খুলতে কে আসবে এখানে?”
দুটো লোক টেনে হিঁচড়ে পরিদাদুকে নিয়ে চলল টাওয়ার থেকে খানিক দূরের একটা মোটা সেগুন গাছের দিকে। আর ঠিক তখনই অন্ধকার জঙ্গল ফুঁড়ে একটা তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ ঠিকরে উঠল সকলকে মারাত্মক চমকে দিয়ে।
৮
দূরে লালচে অস্পষ্ট আলোর রেখা দেখে থমকে দাঁড়াল শাওন। সেই কণ্ঠস্বর বলল, “এখানে নয়। আর একটু এগিয়ে বাঁ দিকের ঝোপটার আড়ালে বসে পড়ো। আমি কাছেই থাকব। যা কিছুই ঘটুক, ভয় পেও না।”
“আপনি কে?”
“তুমি তো রহস্য ভালোবাসো। ঝোপের আড়ালে বসে আপাতত মন দিয়ে আমার পরিচয়টা ভেবে বের করার চেষ্টা করতে থাকো,” চাপা হাসির শব্দ শুনল শাওন, “যদি বুঝতে না পারো, আর একটু পরে নিজের পরিচয় দিয়ে দেব আমি।”
“পরিদাদু কি আপনাকে চেনেন?”
“তাঁর কাছে নিজেকে আড়াল করে রাখা যে কঠিন তা তো তুমি জানোই শাওন,” বলে তিনি থামলেন। শাওন ঝোপটার কাছে পৌঁছে গেছে ততক্ষণে। ঠিক তার পাশের ঝোপের আড়াল থেকে সেই কণ্ঠস্বর বলে উঠল, “কোনো কথা নয়।”
কথা বলার পরিস্থিতে তখন ছিলও না শাওন। একটা লোক পরিদাদুর কলার চেপে ধরেছে গায়ের জোরে। শাওন উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়তে যাচ্ছিল। অচেনা কণ্ঠস্বর চাপা ধমক দিল, “এখনও সময় হয়নি। অপেক্ষা করো।”
ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিল শাওন। কী কথা হচ্ছে ওদের পরিদাদুর সঙ্গে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না এখান থেকে। লোকগুলো এবার পরিদাদুকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। লোকগুলো একেবারেই ভালো নয়। জঙ্গলের মধ্যে বনকর্মী এবং পুলিশকে এড়িয়ে যারা মাদকের ব্যবসা করতে পারে, তাদের ক্ষমতা যথেষ্টই। ওদের পথে বাধা তৈরি করলে ওরা যে ছেড়ে কথা কইবে না সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশই নেই কোনো। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল শাওনের। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল তার। ওরা পরিদাদুকে কি মেরে ফেলবে নাকি? আর এভাবে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকার মানেই হয় না কোনো। কারও কোনো বারণই সে শুনবে আর। যে করেই হোক পরিদাদুকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে তাকে। জঙ্গল সরিয়ে সামনে এগোতে গেল শাওন। আর ঠিক তখনই তার পাশের ঝোপ থেকে একটা তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ বেজে উঠল।
মুহূর্তের মধ্যে আশেপাশের সমস্ত জঙ্গল যেন জেগে উঠল। কয়েকটা ঝোপ যেন চলতে শুরু করল সামনের দিকে। যে লোকগুলো পরিদাদুকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, তারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে ততক্ষণে। গাড়ির কাছে ছিল যারা, তাদের একজন হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে নিতেই অন্ধকার থেকে একটা গম্ভীর গলা গর্জে উঠল, “পুরো এলাকাটাই সশস্ত্র বাহিনী ঘিরে রয়েছে এখন। হাতের অস্ত্র মাটিতে না নামিয়ে রাখলে তোমআদের সক্কলকেই ঝাঁজরা করে দেব আমরা।”
লড়াইটা খুব একটা জমল না। প্রায় বিনা যুদ্ধেই আত্মসমর্পণ করল লোকগুলো। আসলে লড়াইয়ের প্রস্তুতিও তেমন ছিল না এদের। ওরা ভাবতেও পারেনি আজ সুনন্দ মিত্র এবং পরিদাদু মিলে এমন ফাঁদ পেতে রেখেছেন তাদের জন্যে।
পরিদাদু সুনন্দ মিত্রের দিকে চেয়ে হাসলেন, “এদিকে তো মিটল। ওদিকের কী খবর?”
“ঠিকঠাক,” সুনন্দ হাসলেন, “আত্রেয়ীকে দেখলে বোঝা যায় না, কিন্তু এই ধরনের অপারেশনে আমার থেকেও বহুগুণ শার্প ও।”
শাওন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। পরিদাদুই বললেন, “যিনি মিসেস মিত্র সেজে সুনন্দর সঙ্গে বাংলোয় ছিলেন তিনিও নার্কোটিক ডিপার্টমেন্টের ঝানু গোয়েন্দা আত্রেয়ী শর্মা। ডিঙ্গোকে সঙ্গে নিয়ে যোগেশ আনন্দকে ধরার দায়িত্ব আজ তাঁরই ছিল। আর হ্যাঁ, সঞ্জীবকেও অ্যারেস্ট করা হয়েছে। এই অঞ্চলে আনন্দ-এর ডান হাত হিসেবে কাজ করছিল সে-ই।”
“যোগেশ আনন্দ কে পরিদাদু?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল শাওন।
“স্বামী যোগানন্দ নামে যিনি অধিষ্ঠান করছিলেন রথীন ঘোষের পান্থনিবাসে। তিনিই তো এই র্যাকেটটার মূল পান্ডা।”
বাংলোয় ফিরে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে সুনন্দ আর পরিদাদু বলছিলেন, “পুরো ঘটনাটার আসল নায়ক কিন্তু রথীনবাবুই।”
“আমি আর কীই বা করলাম,” লাজুক ভঙ্গীতে বললেন রথীন।
“আপনি সাহস করে পুরো ব্যাপারটা অ্যারেঞ্জ না করলে ওরা কিছুতেই ধরা পড়ত না।”
সুছন্দা এবং অরুণাংশুও এখন অবাক হয়ে শুনছিলেন পুরো ঘটনাটা। দুজনেই অবাক। এত কিছু ঘটে যাচ্ছে এখানে কদিন ধরে, অথচ তাঁরা কিছুই জানতে পারেননি…
মঞ্জু বলছিলেন, “মানসদার মৃত্যুটা উনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তখনই আমাকে বলেছিলেন, এই মৃত্যু দুর্ঘটনা হতেই পারে না। এর পিছনে অন্য ষড়যন্ত্র আছে…”
“আর তখন থেকেই আপাত ঔদাসীন্যের আড়ালে তিনি খোঁজ তল্লাশি শুরু করে দিয়েছিলেন। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে তাদের আস্থা অর্জন করেছেন, তথ্য সংগ্রহ করেছেন দিনের পর দিন। এসের গতিবিধির ওপরেও নজর রেখে গেছেন সন্তর্পণে…” পরিদাদু বললেন।
“ঠিকই,” রথীন লাজুক হাসলেন, “শুধু যোগানন্দকেই ঠিকমতো চিনতে পারিনি। ভাবতেই পারিনি সাধুর ছদ্মবেশে এই লোকটাই আসল শয়তান…”
“আর সঞ্জীব?” আত্রেয়ী হাসলেন।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রথীন, “ওর জন্যে কী না করেছি। আর মানস? সে তো ওকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতো। অথচ সে যখন ওদের কাজ কারবারটা নিজের চোখে দেখে ফেলল তাকে পথ থেকে সরাতেও হাত কাঁপল না সঞ্জীবের…”
“মানসআঙ্কলকে খুন করা হয়েছিল? তিনি দুর্ঘটনায় মারা যাননি?”
“না,” সুনন্দ বললেন, “এরা তাঁকে মেরে হাতিদের চলাচলের রাস্তার ওপরে ফেলে রেখে এসেছিল রাত্রিবেলা।”
“কেন?”
“ওই যে ওই টাওয়ার থেকে এদের কাজ কারবার, মুভমেন্ট দেখে ফেলেছিলেন…”
“ছিঃ,” সুছন্দা বলে উঠলেন।
“কিন্তু তোমরা হঠাৎ একসঙ্গে এখানে এসে জুটলে কী করে? এ কি কাকতালীয় ঘটনা?” অরুণাংশু সুনন্দ এবং আত্রেয়ীর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে পরিদাদুকে জিজ্ঞেস করলেন।
“উঁহু,” পরিদাদু হাসলেন, “পুরোটাই রথীনবাবুর পরিকল্পনা। ওইজন্যেই তো বলছিলাম, উনিই এই কান্ডের আসল নায়ক।”
“মানে?” অরুণাংশু বোকার মতো মুখ করে জিজ্ঞেস করলেন।
“প্ল্যানটা মাথায় আসে রথীনবাবুর। নার্কোটিক ডিপার্টমেন্টে তিনিই খবর দেন। আমাকেও ঠিক এই সময়েই এখানে আসার আমন্ত্রণ জানান ফেসবুক মেসেঞ্জার মারফত। ভেবেছিলেন, একটা মাদকচক্রটাকে ধরিয়ে দেবার পাশাপাশি মানসবাবুর মৃত্যুর পিছনে থাকা অজানা সত্যিটাও সামনে আসুক। আর বাকিটা নিয়তি,” পরিদাদু হাসলেন, “আমরা আসার ঠিক আগে আগেই যোগানন্দজিও এসে পড়লেন হলং বাংলোয়। হঠাৎ করেই।”
“তার মানে তুমি সবটাই আগে থেকে জানতে?”
“উঁহু,” পরিদাদু গা দুলিয়ে হেসে উঠলেন, “আমাকে উনি শুধু বলেছিলেন এই সময়ে যদি আসতে পারি, আমার জন্যে দারুণ রোমাঞ্চকর একটা অভিজ্ঞতা অ্যাসিওর করছেন উনি…”
“সে অভিজ্ঞতাটা কী তা নিয়ে কোনো আভাস দেননি আগে?” মঞ্জু জিজ্ঞেস করলেন অবাক হয়।
“না,” পরিদাদু কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা টি টেবলের ওপরে নামিয়ে রেখে বললেন, “জানলে এই বিপদের মধ্যে এদের নিয়ে আসতাম নাকি! আমি একাই আসতাম এ বিষয়ে আগে থাকতে ওয়াকিবহাল থাকলে…”
“খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছ তুমি পরিদাদু, ভয়ানক স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছ দিন কে দিন,” শাওন বলে উঠল অভিমানী গলায়।
সক্কলে হেসে উঠল হো হো করে।
রথীন বললেন, “আমার শেষে একটা কথা ছিল। অনুরোধই বলতে পারেন…”
“বলুন।” সুনন্দ বললেন।
“আপনারা সকলেই তো কাল ফিরছেন,”
“হ্যাঁ, সে রকমই তো কথা,” পরিদাদু বললেন।
“কাল আমাদের হলং পান্থনিবাসের ডাইনিং হলে একটা গ্র্যান্ড লাঞ্চ অরগানাইজ করতে চাইছি আমি। কমপ্লিমেন্টারি। সেখানে আপনাদের সকলকে একসঙ্গে উপস্থিত থাকতে হবে কাল। আর মেনু আমি ঠিক করব…”
“কিন্তু ডিঙ্গোকে নিয়ে…” আত্রেয়ী ইতস্তত ভঙ্গীতে বললেন।
“সে চিন্তা আমার,” রথীন বললেন, “ডিঙ্গোকে বাদ দিয়ে এই আয়োজন হতেই পারে না। সেও আমার গেস্ট। কাল আমার প্রাণ বাঁচাতে তার তৎপরতাও তো কম ছিল না। ডিঙ্গো না থাকলে যোগেশ কাল আমাকে বেঁচে ফিরতে দিত না কিছুতেই…”
ডিঙ্গো বসে ছিল খানিক তফাতেই। কী বুঝল কে জানে, রথীনবাবুর কথা শেষ হতেই লেজ-ফেজ নাড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে আদুরে গম্ভীর স্বরে ভৌউউউ করে ডেকে উঠল সে।
অলঙ্করণ সুলতা মিস্ত্রী
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস