(এই গল্পের প্রতিটা ঘটনা সত্যি, কিন্তু সময়টা পরিবর্তিত। প্রতিটি লোক, প্রতিটি বই সম্বন্ধে তথ্য সত্যি। জীবিত বা মৃত—কোনও ব্যক্তির সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া অসম্ভব নয়।)
১
সকালবেলা আনন্দবাজারটা খুলেই কৌশিক চমকে উঠল। কয়েক মিনিট আগেই মেসের গোপাল চা দিয়ে গেছে। ‘কলেজ স্ট্রিটে চুরি’। সাংবাদিক আরও লিখেছেন, ৩১১ নম্বর দোকানে চুরি। টাকাপয়সা খুব বেশি খোয়া যায়নি, কিন্তু সমস্ত বই রাস্তায় ছড়ানো। পরের খবরটা আরও সাংঘাতিক। দোকান থেকে একটু দূরে মহাত্মা গান্ধী রোডে এক চিনে ভদ্রলোকের খুন। খুন বোঝাই যাচ্ছে, কারণ ভদ্রলোকের দেহে দুটি ধারালো অস্ত্রের আঘাত। সামনে ফুটপাথে চাপ চাপ রক্ত। পুলিশ দেহটি ময়না তদন্তে পাঠিয়েছে। সাংবাদিক নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন যে যখন কলুটোলা বা প্রেসিডেন্সির পিছনে এত লোক এই শীতকালেও শুয়ে থাকে ফুটপাথে, তখন খুন আর চুরি হলই-বা কেমন করে? আসলে সবই প্রশাসনের গাফিলতি ইত্যাদি।
খুন-চুরি এসব তো আজকাল কাগজ খুললেই পাওয়া যায়। কিন্তু কাগজটা এক হাতে আর চায়ের কাপটা অন্য হাতে নিয়ে কৌশিক দৌড়ল উপরতলায়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তারদের ছোট্ট হস্টেল এটা। দোতলা পুরোনো বাড়ি, দু-দিকে দুটো ঘোরানো লোহার সিঁড়ি। মেস চালান তরুণদা। সাকুল্যে তিরিশ-বত্রিশ জন থাকে। সবাই ডাক্তারি পাশ করে হয় হাউস স্টাফশিপ করছে কিংবা এম.ডি, এম.এস পড়ছে আবার কেউ কেউ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। উপরতলার বাঁদিকের প্রথম ঘরটা অরিন্দমদা আর সমীরদার। অরিন্দমদা আর কৌশিক একসঙ্গে প্ল্যাব পরীক্ষা দিয়েছিল ইংল্যান্ডে এম.আর.সি.পি করতে যাবে বলে। অরিন্দমদা বিলেতে চলে গেছে কয়েক মাস আগে। এবার কৌশিক যাবে, অরিন্দমদার কাছে থেকে পরীক্ষা দেবে আর তারপর চাকরি খুঁজবে। এই ট্র্যাডিশন মেডিক্যাল কলেজে বহুদিনের।
সমীরদার ঘরটা খোলাই ছিল। “খবরটা দেখেছ বস?” কৌশিক জিজ্ঞাসা করে।
“কী খবর রে?” সমীরদার প্রশ্ন? “ইন্ডিয়া অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছে ফলো অন করার পর?”
“আরে না না, সেটা নয়। এই কলেজ স্ট্রিটের খবরটা? চুরি আর খুন?”
“দেখেছি তো, ও তো রোজই হচ্ছে এখানে ওখানে। এ আর নতুন কী, বল।”
“জানি, কিন্তু এটা একটু অন্যরকম। কালই আমি ওই দোকানটাতে গিয়েছিলাম আর দুটো বইও কিনলাম।” একটু থেমে কৌশিক বলে, “আর একটা চিনে লোককেও দেখেছি ওখানে।”
“বোকা বোকা কথা বলিস না কৌশিক।” মৃদু বকুনিই দেয় সমীরদা, “কত কত চিনে লোক আছে কলকাতায়। লোকটাকে দেখলে চিনতে পারবি?”
মাথা নাড়ে কৌশিক। না, তা পারবে না সে। আসলে যাদের আমরা সবসময় দেখি না, তাদের সকলকেই আমাদের একরকম মনে হয়। সব সাদা মানুষই ইংরেজ বা সব কালো মানুষই নাইজেরিয়ান—এইরকম আর কি।
“তুমি তো জানো সমীরদা, প্রতিদিন আমার একবার কলেজ স্ট্রিটে না ঘুরলে ভাত হজম হয় না। আমার হাতখরচের পুরো টাকাটাই যায় বই কিনে। কালও গেছিলাম শঙ্করদার দোকানে। খুব অমায়িক লোক শঙ্করদা। কথা হল, দুটো বইও কিনলাম। কত ক্ষতি হয়ে গেল বলো তো!”
সমীরদা হেসে বলে, “চিন্তা করিস না। তোর মতো আরও অনেক পাগল আছে। তারাই বই কিনে কিনে ওঁর দোকান আবার ঠিক করে দেবে।”
সমীরদা ওর কথায় বিশেষ আমল দিল না দেখে চা-টা শেষ করে নিজের ঘরে ফিরে এল কৌশিক। আবার পড়তে বসল। প্ল্যাব একটি অত্যন্ত ব্যায়বহুল পরীক্ষা। প্রচুর টাকা ধার করে সে যাচ্ছে ইংল্যান্ডে, সুতরাং পড়াটা খুবই জরুরি। কিন্তু আজ আর তার মন বসল না। সেদিন সে আর ভাত খাওয়ার পর কলেজ স্ট্রিট গেল না। এমনিতে কৌশিক বিশেষ খরুচে নয়। বই কেনা ছাড়া তার আর কোনও নেশা নেই। বাইরে খাওয়ার অভ্যেসও তেমন নেই। তরুণবাবুর মেসে খেতে তার দিব্যি ভালো লাগে, যদিও মাঝে-মাঝেই তরুণবাবুকে মনে করাতে হয় যে এবার মাছের পিসটা মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হবে কিংবা এর চেয়ে ছোটো করে মাংস কাটতে গেলে হয়তো আঙুলই কেটে যাবে।
স্যুটকেস গোছানো হয়ে গেছে তার আগেই। পাউন্ডও তুলেছে সে স্টেট ব্যাঙ্কের প্রধান শাখা থেকে। এক থোক টাকার বদলে মাত্র কয়েকটা পাউন্ডের নোট দেখে সে আশ্চর্য আর বিপর্যস্ত, দুইই হয়ে পড়ল। আর মাত্র তিনদিন পরেই যাওয়া তার। কলকাতা থেকে লন্ডন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্লেনে। ওখানে পরীক্ষা দিয়ে স্কটল্যান্ডে অরিন্দমদার বাড়ি। প্ল্যান পাকা হয়ে আছে অনেকদিন। এমনকি সে স্বপ্নও দেখে ফেলেছে লন্ডনের, এডিনবরার অথচ প্লেনেই চাপেনি সে কোনোদিন।
পরের দিন আর থাকতে পারল না কৌশিক। আবার কলেজ স্ট্রিট। আজ কিন্তু বইয়ের খোঁজে নয়। শঙ্করদার দোকানটা দেখতেই যাবে সে। দোকান খুলেছে শঙ্করদা। মনমরা হয়ে বসে আছে টুলের উপর। এমনিতেই রোগা শঙ্করদা যেন আরও রোগা হয়ে গেছে। কাঁধটা ঝুঁকে পড়েছে। কৌশিককে দেখে শঙ্করদা একটু নড়েচড়ে বসে।
“কী খবর শঙ্করদা? কাগজে কাল দেখলাম।”
“আর বোলো না ভাই। আমার দোকান ভাঙল আর পুলিশ আমাকেই ঝামেলায় ফেলছে।”
“তোমাকে? কেন?”
“ওরা এই চুরি আর খুনটা একই লোকের কাজ ভাবছে। আমি লোকটাকে চিনি কি না, আমি কিছু লুকিয়ে রেখেছিলাম কি না দোকানে—এই সবই আর কি।”
“চুরি? কী চুরি গেল?”
“কিচ্ছু না। ক্যাশ বাক্সটা বাইরে পড়ে ছিল। খুচরো কিছু টাকা পড়ে ছিল। পাঁচ-দশ টাকার নোট। সব হাপিস।”
“শঙ্করদা, সেদিন আমি বই কিনতে এসেছিলাম, তুমি বলেছিলে যে তখনই একটা চিনে লোক একশো টাকা দিতে চেয়েছিল, তুমি দাওনি। এই লোকটাই কি সেই লোক?” প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল কৌশিক।
“কী যা তা বলছ?” শঙ্করদা একটু ঝাঁঝিয়ে বলে। “আমি আবার কখন তোমাকে বললাম? আমি কোন চিনে লোককে দেখিনি জীবনে। সারাদিন কত লোক আসছে দোকানে, কতজনকে মনে রাখব? ফালতু কথা বোলো না তো, একেই পুলিশের এত ঝামেলা!”
কৌশিক অবাক হয়। তার স্পষ্ট মনে আছে শঙ্করদা তাকে বলেছিল যে একটু আগেই একটা চিনে লোক বই দুটো কিনতে চাইছিল। একশো টাকায়। বলেছিল, ‘তোমার জন্য রেখে দিয়েছি। আড়াইশো টাকা দাম।’ আজ হয়তো পুলিশের ভয়ে অস্বীকার করছে। কৌশিক আর বেশিক্ষণ দাঁড়াল না।
“শঙ্করদা, পরশু যাচ্ছি লন্ডন, আগামী বছর খানেক ফিরব না। ফিরে দেখা করব।”
মন তার বাস্তবিকই খারাপ। শঙ্করদা শুনে বিশেষ প্রতিক্রিয়াহীন। শুকনো গলায় বলে, “ঠিক আছে, সাবধানে থেকো। ফিরে দেখা কোরো।”
এই শঙ্করদার সঙ্গে তার অনেকদিনের চেনাজানা। কত বই কিনেছে তার কাছ থেকে। পরশুই তো কিনল দুটো বই আড়াইশো টাকায়। একটা উমবের্তো একোর ‘আইল্যান্ড অফ দ্য ডে বিফোর’। প্রায় নতুন উমবের্তো একোর এই বইটা। একো বিখ্যাত হয়েছিলেন ‘নেম অফ দ্য রোজ’ লিখে। মধ্যযুগীয় এই ডিটেকটিভ গল্প পড়ে কৌশিক একোর প্রায় ফ্যান হয়ে গেছে। তার দৃঢ় ধারণা, ‘নেম অফ দ্য রোজ’ না পড়লে জীবনের অন্তত অর্ধেকটা বৃথা। অন্যটা একটা বহু পুরোনো কবিতার বই, নাম ‘টেমার লেন’, মানে তৈমুর লঙ। লেখকের নাম নেই, শুধু লেখা ‘এ বোস্টনিয়ান’ অর্থাৎ আমেরিকা বা ব্রিটেনের বোস্টনের কোনও লোকের লেখা। হলুদ হয়ে যাওয়া এই বোস্টনিয়ানের বইটায় কী কবিতা আছে কৌশিকের কোনও ধারণাই নেই, কিন্তু সে তাও কিনে ফেলল বই দুটো। বই দুটো কিনে মেডিক্যাল কলেজের দিকে ঘুরেই সে চিনে লোকটাকে দেখতে পেল। চিনে লোকটা একটু দূর থেকে দোকানটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কৌশিক বিশেষ পাত্তা না দিলেও একটু কেমন তার অস্বস্তি হল। টাকা দিয়ে মেডিক্যাল কলেজের দিকে আসতে-আসতেই চূড়ান্ত উত্তেজনায় কৌশিক খুলে ফেলল একোর বইটা। এক্কেবারে নতুন, কোথা থেকে কলেজ স্ট্রিটে উদয় হল কে জানে। বইয়ের তৃতীয় পাতাটা খুলে সে স্তম্ভিত। যেখানে বইয়ের নাম আর লেখকের নাম লেখা, তার ঠিক তলায় উমবের্তো একোর সই! অটোগ্রাফ করা বই কলেজ স্ট্রিট থেকে পেয়েছে সে! এ বই তো অমূল্য। দাম সম্বন্ধে বিশেষ ধারণা না থাকলেও এ যে প্রচণ্ড বিরল আর দুর্মূল্য, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। প্রচণ্ড উচ্ছ্বাসে কৌশিক কী করবে ঠিক করতে পারল না। শঙ্করদা নিশ্চয়ই না দেখেই তাকে দিয়েছে। বোস্টনিয়ানের টেমার লেনকে সে একোর অক্টাভো সাইজের বইয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে সজোরে হাঁটা দিল হস্টেলের দিকে।
প্রায় দৌড়ে হস্টেলে এসে কৌশিক বইটা খুলে আবার দেখে। এই বইয়ের পাতায় একোর মতো লেখক হাত দিয়েছেন। চটপট হাত-ব্যাগে বই দুটো ঢুকিয়ে নিল। টেমার লেনকে উমবের্তো একোর ভিতরে। প্লেনে যদি বোর হয়, পড়তে পড়তে যাবে সে। বই পাওয়ার আনন্দ আর বিদেশ যাওয়ার উত্তেজনার মাঝে একটু মনখারাপও হতে লাগল। আবার কতদিন বাদে বাড়ি ফিরবে সে। আবার কতদিন বাদে কলেজ স্ট্রিটে ঘুরবে সে, আবার কতদিন বইমেলা ঘুরবে না, অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখবে না।
দেখতে পাবে না কলকাতা কেমন করে একটু একটু করে পালটে যাচ্ছে, আরও সুন্দর হয়ে উঠছে। আরও কতদিন সে নকুড়ের সন্দেশ, কে.সি. দাশের রসগোল্লা, ট্যাংরার চাইনিজ খাবে না। এ সবই যে তার কাছে ভীষণ ইম্পরট্যান্ট।
বাড়ি যাবার সময় তার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল, যেন কেউ নজর রাখছে তার উপর। একটা অদ্ভুত অস্বস্তি তার ইন্দ্রিয়গুলোকে সজাগ করে দিল। ফেলুদা, ব্যোমকেশ থেকে শুরু করে কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি তার পড়া। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সে, কাউকেই দেখতে পেল না সন্দেহজনক। কিন্তু মনটা খচখচ করতেই লাগল। কে শঙ্করদার দোকান ভাঙল? তার চেয়েও বড়ো কথা, কেন ভাঙল? কে চিনে ভদ্রলোককে খুন করল? কে তার উপর নজর রাখবে আর কেনই-বা রাখবে? যাক গে, কাল ভোরেই রওনা দিচ্ছে সে।
পরদিন সকাল চারটে নাগাদ ট্যাক্সিতে চড়ে বসল কৌশিক। জানুয়ারির সেই কুয়াশামাখা সকালে লোকজন বেশ কম। এক-দুটো চায়ের দোকান খুলেছে মাত্র। ট্যাক্সি শহরের মধ্যে দিয়েই উল্টোডাঙ্গা হয়ে ভি.আই.পি রোড নিল। এয়ারপোর্টে এসে তার একটু ভয়ই করতে লাগল। প্লেনের আদবকায়দা সে কিছুই জানে না। শুধু সিট-বেল্ট বাঁধতে জানে, আর জানে যে এরা প্রচুর খাবার দেয় আর সেসব খাবার ফ্রি। এই ফ্রি ব্যাপারটা তার কাছে খুব জরুরি, কারণ পকেটে পয়সাকড়ি বেশ কম।
ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্লেনটা নড়েচড়ে রানওয়ের দিকে চলতে শুরু করল। ভিউইং গ্যালারিতে বাবা-মা। মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে প্লেনটা গাড়ির মতো চলতে লাগল। প্রথমে অটোর গতিতে, তারপর গাড়ি আর সবশেষে যেন টিভিতে দেখা ফর্মুলা ওয়ানের গাড়ি। স্পষ্ট বুঝতে পারল কৌশিক যে প্লেনটা মাটি ছেড়ে উঠে পড়ল। জানালা দিয়ে দেখতে পেল সে বাড়িগুলো কেমন ছোটো ছোটো হয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে গেল জটায়ুর কথা। প্লেন ওড়ার সময় কেমন জটায়ুর মুখটা বেঁকেচুরে গেছিল—মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব আরকি! জোর খিদে পেয়েছে তার। সকালে শুধু চা-বিস্কুট খেয়ে বেরিয়েছে সে। একটু পরে যখন প্লেনটা সোজা হল, তখন ট্রলি নিয়ে ব্রেকফাস্ট হাজির। পেস্ট্রি, কফি নিয়ে একজন বিমানসেবিকা মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করল, “ব্রেকফাস্ট?”
শব্দটা শেষ হওয়ার আগেই কৌশিকের ‘ইয়েস প্লিজ’ বেরিয়ে এল। ভদ্রমহিলার মৃদু হাসিতে কৌশিকের লজ্জায় কান অবধি লাল হয়ে গেল। তাকে কি হ্যাংলা ভাবছে?
খাওয়াদাওয়া সেরে সে বইটা বার করল ব্যাগ থেকে। একদম ঝাঁ-চকচকে, ওপরে আবার স্বচ্ছ কাগজে মলাট লাগানো। আবার পাতা উলটে সে তৃতীয় পাতায় এল। উমবের্তো একোর সইয়ের উপর হাত বোলাল আরেকবার। এই বই একোর মতো লেখক হাত দিয়ে ধরেছেন, সে এখনও ভাবতে পারছে না। ভাগ্যিস একশো টাকায় শঙ্করদা দিয়ে দেয়নি। শেষদিকে এসে সে টেমার লেনটা পেয়ে গেল। টেমার লেন, অর্থাৎ তৈমুর লঙ। বোস্টনিয়ান নিশ্চয়ই লেখকের ছদ্মনাম। এত পুরোনো বই। বেচারা লেখক। হয়তো ধরেই নিয়েছিলেন যে বইটা বিক্রি হবে না।
কবিতাটা শুরু করে সে একেবারে অবাক হয়ে গেল। রীতিমতো পাকা হাতের লেখা।
‘I have sent for thee, holy friar;
But ’twas not with drunken hope,
Which is but agony of desire,
To shun the fate, with which to cope
Is more than crime may dare to dream…’
প্রথম পাতায় পেন্সিল দিয়ে দাম লেখা। বহুবার কাটা, বহুবার নতুন করে লেখা। দশ সেন্ট, কেটে কুড়ি সেন্ট আবার কেটে পঞ্চাশ সেন্ট, শেষে সত্তর সেন্ট। কৌশিক বুঝল, এই বইই লেখকের প্রথম এবং শেষ বই, কোনও প্রকাশক এর পরে আর এই লেখকের বই প্রকাশ করবে? বোস্টনের কোনও হ্রদেই লেখকের লেখনীর সলিলসমাধি ঘটেছে হয়তো। কৌশিকের কিন্তু বইটা বেশ ভালো লেগে গেল।
বেশ একটা গা ছমছমে ব্যাপার আছে এই বহু পুরোনো বইটার মধ্যে। ১৮২৭ সালে ক্যালভিন টমাসের ছাপা। এত পুরোনো বই বেশ যত্নে রাখতে হবে। বইটাকে একোর বইয়ের মধ্যে রেখে আবার কৌশিক পড়তে শুরু করল ‘দ্য আইল্যান্ড অফ দ্য ডে বিফোর’। এরই মধ্যে দফায় দফায় খাবার আসছে। ভীষণ টক অরেঞ্জ জুস, চা, কফি, লাঞ্চ—মুখ চলতেই থাকছে। যেসব পড়াশোনার নোটস কৌশিক প্লেনে পড়বে বলে এনেছিল তা আর খোলাই হল না। উমবের্তো একোর দেলা গ্রিভার জাহাজডুবির গল্পে সে এমনই মগ্ন, খেয়াল করেনি যে নয় নম্বর সিট বদল করে একত্রিশ নম্বরে যে মাঝবয়সি ছিপছিপে লম্বা ব্রিটিশ লোকটি এসে বসেছে শুধু কৌশিককে চোখের আড়ালে হতে দেবে না বলে, সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে কৌশিকের হাতের বইটার দিকে।
২
দশ ঘণ্টা পরে যখন হিথরো এয়ারপোর্টের রানওয়ে ছুঁলো প্লেনটা, কৌশিকের ভয় আবার জাঁকিয়ে বসল। ইমিগ্রেশন, কাস্টমস আর ইংরাজি উচ্চারণ—তিনটেতেই তার টেনশন। তার উপর অরিন্দমদা ফোনে বলে দিয়েছে যে ইমিগ্রেশনের লোকেরা বিশেষ হাসে না। অরিন্দমদা আরও উপদেশ দিয়ে দিয়েছে, ‘নার্ভাস হবি না, কিন্তু যা জিজ্ঞেস করবে তার বাইরে একটা কথাও বলবি না।’
প্লেন পুরোপুরি থামতে সিট-বেল্ট সাইনটা নিভে গেল। সবাইকে উঠে দাঁড়াতে দেখে কৌশিকও উঠে দাঁড়াল। উপর থেকে ব্যাগটা পেড়ে কাঁধে নিল। বেশ জটলা। অনেক ছোটো ছোটো বাচ্চা বেশ বিরক্ত এতক্ষণের প্লেন জার্নির পর। দুয়েকটা একেবারে খুদে শিশু কান্নাকাটিও জুড়ে দিয়েছে। হঠাৎই কৌশিকের মনে হল ব্যাগে একটা হালকা টান। পিছনে ঘুরে অবশ্য সে কাউকে দেখতে পেল না। একজন ছিপছিপে লম্বা সুদর্শন ব্রিটিশ লোক দাঁড়িয়ে। তার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন, “সরি।”
কৌশিক তাড়াতাড়ি বলল, “ইটস ওকে।”
ব্যাগটাকে সে সামনের দিকে এনে রাখল। এত ছোটো বাচ্চাকাচ্চা আছে, কার কখন লেগে যায়। ব্যাগে তিনটে বিশাল বিশাল মোটা মেডিক্যাল বই আছে তো।
প্লেন থেকে অবশেষে নামল সবাই। কৌশিক নেমে দেখল ভারি মজা—একটাই রাস্তা। পথ হারাবার কোনও সম্ভাবনাই নেই। একটু পরে পরেই লেখা আছে ‘ইমিগ্রেশন’ এবং ‘ব্যাগেজ রিক্লেম’। লাগেজ তো তাকে নিতেই হবে। সেখানেই তো তার সর্বস্ব। জামাকাপড় তো আছেই, আর আছে তার পছন্দের কয়েকটা বই—রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, দুটো দেবব্রত বিশ্বাসের সি.ডি। আর আছে একটা বড়ো প্যাকেট আমসত্ত্ব। এসব ছাড়া তার জীবন বৃথা একেবারে।
প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট পা চালানোর পর সে থামতে বাধ্য হল। সবাই থেমে গেছে। ইমিগ্রেশন। ব্রিটিশ আর ইউরোপিয়ানদের একটা লাইন, আর বাকি সবার আরেকটা। এক অত্যন্ত গম্ভীর মহিলা কেটে কেটে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন সে কেন এসেছে, কোথায় যাবে এবং কতদিন থাকবে ইত্যাদি। এরপর পাসপোর্টে একটা স্ট্যাম্প মেরে মুচকি হেসে বললেন, “Welcome to United Kingdom, Sir.”
শুনেই কৌশিকের মনটা একটা ভালোলাগায় ভরে গেল। কে বলে ইমিগ্রেশনের লোকেরা কড়া হয়? তাকে এমন করে স্বাগত জানালেন মহিলা, আবার স্যার সম্বোধন করে! এ তো ভাবাই যায় না। প্রায় দৌড়তে দৌড়তে ব্যাগেজের কাছে এসে গেল সে। স্যুটকেস নিয়ে সোজা ট্রেন স্টেশনের দিকে রওনা দিল সে। যাবে বারকিং। বারকিংয়ে এক গুজরাটি ভদ্রলোকের বাড়িতে সে পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকবে। অরিন্দমদা আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছে। পরীক্ষার আগে তাকে আবার একটা কোর্স করতে হবে, সেটা হবে ইস্টহ্যাম বলে আরেকটা জায়গায়। বারকিংয়ের পাশেই। হেঁটেই যাতায়াত করে সব ছাত্ররা। একটা ছোটো মাঠের পাশ দিয়ে একটা সরু বেশ নির্জন রাস্তা দিয়ে শর্টকাট নেওয়া যায়। এসব তার আগে থেকেই জানা, অরিন্দমদাও তাই করেছে।
সাড়ে পাঁচ পাউন্ডের টিকিট কেটে ট্রেনে চাপল কৌশিক। ট্রেন যখন বারকিং স্টেশনে পৌঁছল তখন ঘড়িতে প্রায় পাঁচটা। ছোটো স্টেশন। হিথরো থেকে অনেকটা দূরে বলে ট্রেন তখন প্রায় খালি। আর দু-একজন নামল। হঠাৎ কৌশিক সেই লম্বা ব্রিটিশ লোকটিকে দেখতে পেল, ট্রেন থেকে নামছে। কী আশ্চর্য! সেই কলকাতা থেকে এত দূর একসঙ্গে আসা। সেই অপরিচিত লোকটিই তখন এই বিদেশ-বিভূঁইয়ে কৌশিকের একমাত্র চেনা লোক। কেউ উঠল না ট্রেনে সেই ছোট্ট স্টেশন থেকে। বাইরে বেরিয়ে কৌশিক চমকে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার, স্ট্রিট লাইট জ্বলছে। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে আর ভয়ংকর ঠান্ডা। সামনে একটা দোকানের উপরে সাইনবোর্ডে লেখা মাইনাস দুই ডিগ্রি। মাইনাস দুই ডিগ্রি! কৌশিক বিশ্বাসই করতে পারছে না। কিন্তু বরফের মতো ঠান্ডা হাওয়া তাকে বিশ্বাস করতে প্রায় বাধ্য করল। স্টেশনের সামনেটা সে ভালো করে দেখল। প্যাটেলের টিকিও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এল সে। না, ভারতীয় কাউকেই দেখা যাচ্ছে না স্টেশনের আশেপাশে। প্যাটেলের আসার কথা স্টেশনে। একটা লোক শুধু ট্র্যাক-স্যুট আর জ্যাকেট পরে বার্গার খাচ্ছে। কৌশিকের নার্ভাসনেস বেড়েই চলে। দ্রুত চিন্তা করে কৌশিক। দুটো চয়েস তার কাছে, আরও অপেক্ষা করা বা ফোন করা। অরিন্দমদা নাম্বার দিয়ে দিয়েছিল। সামনে ব্রিটেনের সেই বিখ্যাত টেলিফোন বুথ। কাচের দরজা, উপরে লাল মাথায় সোনালি রঙে রানির মুকুট খোদাই করা। পড়ে সে দেখেছে, অনেক জাপানি ট্যুরিস্ট ফোন বুথের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে স্মৃতির জন্যে।
মিনিট দশেক দাঁড়াল কৌশিক। তারপর ফোন বুথের দিকে এগোল। ছোটো জায়গা, স্যুটকেস নিয়ে ঢোকা যাবে না। প্যাটেলের নাম্বারটা রেখেছিল সে বইটার মধ্যে, তাই স্যুটকেস আর ব্যাগটা বাইরে রেখে ফোন বুথে ঢুকল। একটা পঞ্চাশ পেন্সের পয়সা ফেলে নাম্বারটা ডায়াল করল সে। ফোনটা কিন্তু বেজেই গেল। প্যাটেল বাড়িতে নেই।
ঠিক সেই সময় সে দেখতে পেল লোকটাকে—ফর্সা, বয়স্ক ভারতীয়—সঙ্গে প্রায় তার বয়সি একটা ছেলে। হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছে স্টেশনে। এই কি প্যাটেল? কৌশিক তাড়াতাড়ি কুড়ি পেন্সটা নিয়ে এগিয়ে গেল ওদের পিছন পিছন। স্টেশনে ঢুকে দেখল যে ওরা টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কৌশিক আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, “মিস্টার প্যাটেল?”
“ইউ মাস্ট বি কৌশিক। কখন এলে?”
“প্রায় সাড়ে পাঁচটায়। আপনাকে ফোন করছিলাম, কেউ ধরল না।”
“সে কি? তোমার বন্ধু ফোন করে বলল পাঁচটা চল্লিশের ট্রেনে আসছ।”
“আমার বন্ধু? অরিন্দমদা? ও কী করে জানবে যে আমি কোন ট্রেনে আসছি?”
“না, অন্য এক বন্ধু। নাম বলেনি অবশ্য, বলল তোমার বন্ধু হয়। যাক গে, চলো। লাগেজ কোথায়?”
“এই তো ফোন বুথের কাছে, বাইরে।”
“লাগেজ ছেড়ে এসেছ? এটা লন্ডন ভাই। এখানে কিন্তু চুরি যাবার যথেষ্ট ভয়।”
চুরি? কৌশিকের চোখ কপালে। যেখানে ফোন বুথ থেকে কুড়ি পেন্সও ফেরত পাওয়া যায়, সেখানে চুরি? তাও সে দৌড়ে গেল। এই তো স্যুটকেস। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে। কিন্তু এ কী? ব্যাগটা কোথায়? কৌশিক স্যুটকেসের আশেপাশে দেখল। ব্যাগটা কোথাও নেই।
ততক্ষণে প্যাটেল চলে এসেছে,“কী হল?” প্যাটেল জিজ্ঞাসা করে।
“ব্যাগটা নেই।” কৌশিকের চোখ ফেটে প্রায় জল আসে।
“ব্যাগ নেই? কী ছিল ওতে? টাকাপয়সা?”
“না।” কৌশিক মাথা নাড়ে,“আমার বইপত্র। টাকা আমার জ্যাকেটে। আমার পাসপোর্ট আর প্লেনের রিটার্ন টিকিট।”
“পাসপোর্ট?” প্রায় চিৎকার করে ওঠে প্যাটেল,“এ তো ভাই বড়ো ঝামেলা। এ-দেশে তোমার পদে পদে পাসপোর্ট লাগবে।”
কৌশিকের আর তখন মাথা কাজ করছিল না। একে বিদেশ, তারপর পাসপোর্ট নেই। পরীক্ষাটা কি সে আদৌ দিতে পারবে? এই আজব দেশে অরিন্দমদাকে ছাড়া সে বিশেষ কাউকে চেনে না। বিকেল পাঁচটায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাড়কাপানো ঠান্ডা, রাস্তায় জনমানব নেই। এইরকম নির্জন ঠান্ডা দেশে সে থাকবে কী করে?
প্যাটেলের পরামর্শে সে গাড়িতে উঠে পড়ে। পুলিশের কাছে যেতে হবে। থানা কাছেই। থানার মতো মোটেও দেখতে না, বরং অফিস-বাড়ির মতো দেখতে। সামনের ডেস্কে একজন ভীষণ স্মার্ট মহিলা কালো পুলিশের ড্রেসে বসে আছেন। মন দিয়ে ওর কথা শুনলেন আর একটা মোটা খাতায় লিখে নিলেন। কয়েকটা মামুলি প্রশ্নও করলেন। কী রঙের ব্যাগ, কত বড়ো, কীভাবে চেনা যাবে, কী কী আছে তাতে, এই আর কি। তারপর একটা ছোটো কাগজ ধরিয়ে বললেন, “ওকে। ইউ গো হোম। দেখি আমরা কী করতে পারি। পাসপোর্ট চুরি অত্যন্ত সিরিয়াস। এখানে অনেক ক্রিমিন্যাল গ্যাংই এইভাবে বেআইনি রাস্তায় লোক ঢোকাচ্ছে এ-দেশে। তাই সরকারও অত্যন্ত সজাগ। এই কাগজটা রাখো। ইমারজেন্সিতে কাজে লাগবে। আর কাল মেডিক্যাল কাউন্সিলের অফিসে জানিয়ে দিও।”
এতক্ষণে কৌশিকের মাথায় ঢুকল ব্যাপারটা। এ সাধারণ চুরি নয়। এইভাবে তার নাম করে আরেকজন তার মতোই, মানে কাছাকাছি রকম দেখতে হলেও চলবে, এসে ঢুকবে ব্রিটেনে। এইরকম বেআইনি কাজকারবারে পরোক্ষে সেও ভাগীদার হয়ে গেল ভেবে তার বেশ খারাপই লাগল। তার আরও অনেক সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।
প্যাটেল তার হাতে মৃদু টান দিল,“লেটস গো।”
সম্বিৎ ফিরে পেল কৌশিক। হঠাৎই একরাশ ক্লান্তি তাকে পেয়ে বসল। কোনোরকমে প্রায় কচ্ছপের গতিতে সে গাড়িতে ফিরে এল। প্যাটেলের সঙ্গের ছেলেটি তখনও গাড়িতে বসে। ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে কৌশিক এতক্ষণে ছেলেটিকে ভালো করে খেয়াল করল। ভালো চেহারা। পাঁচ ফুট দশ-এগারো ইঞ্চি লম্বা। মেদহীন শরীর। সে প্রায় যন্ত্রের মতো হাতটা বাড়িয়ে দিল,“কৌশিক।”
ছেলেটি মৃদু হ্যান্ডশেক করল,“রোহিত, ফ্রম মুম্বই।”
৩
সকালবেলা সাড়ে সাতটায় অ্যালার্ম দেওয়া ছিল। ঘুম থেকে উঠে কৌশিক জানালার পর্দাটা সরিয়ে একেবারে অবাক হয়ে গেল। চারদিক সাদা বরফে ঢাকা। ঘুটঘুটে অন্ধকার, স্ট্রিট লাইট জ্বলছে। এ এক আজব দেশ—সকাল সাড়ে সাতটায় এত অন্ধকার! তাড়াতাড়ি চারটে টোস্ট আর একটা অমলেট কফি সহযোগে খেয়ে বেরিয়ে গেল কৌশিক। রোহিতও সঙ্গে এল। কাল থেকে পড়াশোনা শুরু। কিন্তু আজ তার কোনও মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার সময় নেই। সে অবশ্য বার বার বলেছিল রোহিতকে না আসতে, সময় নষ্ট না করতে। কিন্তু রোহিতই জোর করে এল। রোহিত একটু গম্ভীর প্রকৃতির, বেশি কথা বলে না। কাল গাড়িতে দু-একটা কথা বলে কৌশিক বুঝেছে যে রোহিত সকালে দৌড়াতে যায়, পড়াশোনায় ভালো, গল্পের বই পড়ে না আর ক্রিকেট দেখে এবং ক্রিকেটের খুঁটিনাটি তথ্য মনে রাখে। প্রথমবার দেখেই ওকে ভালো লেগে গেল কৌশিকের। মেট্রো স্টেশন অবধি তারা হেঁটেই এল। রোহিত স্টেশনের দেওয়ালে ম্যাপ দেখে দুটো ডে টিকিট কিনল। প্রথম গন্তব্য বেকার স্ট্রিট।
“আমরা এখন যাচ্ছি গ্রেট পোর্টল্যান্ড স্ট্রিট, কিন্তু বেকার স্ট্রিটে নেমে হেঁটে যাব। কয়েকটা জায়গা তুমি দেখতে পাবে। তোমরা বাঙালিরা আবার সবাই বই-টই পড়ো…”
শেষের কথাটা শ্লেষ কি না কৌশিক ঠিক ধরতে পারল না।
বেকার স্ট্রিট স্টেশন থেকে বেরিয়েই ভদ্রলোককে দেখতে পেল কৌশিক। ঠিক ভদ্রলোক সশরীরে নন, তাঁর মূর্তি। টিকলো নাক, মুখে বাঁকানো পাইপ আর গায়ে ওভারকোট। পৃথিবীর সব ডিটেকটিভের সেরা ডিটেকটিভ। শার্লক হোমস! ঠিক ঠিক, কৌশিকের তো খেয়ালই ছিল না যে ২২১-বি বেকার স্ট্রিটেই তো তাঁর বাড়ি। কৌশিকের সেই আপ্লুত ভ্যাবাচ্যাকা চেহারা দেখে একটু হেসে রোহিত বলল, “আজ সময় নেই, নয়তো মিউজিয়ামেও নিয়ে যেতাম। মিউজিয়ামটা যদিও দুশো ঊনচল্লিশ নম্বর বাড়ি, কিন্তু দরজায় লেখা ২২১-বি। পরে কোনোদিন…”
একটু এগিয়েই একটা গোল সবুজ গম্বুজ দেওয়া বাড়ি। অত সকালেও একটু একটু ভিড়। প্রায় সবাই ট্যুরিস্ট। উপরে তাকিয়ে কৌশিক হতবাক। বড়ো বড়ো করে লেখা, মাদাম তুসো। মোমের পুতুলের সে এক বিশাল কর্মশালা। কে নেই সেখানে—মহাত্মা গান্ধি, ইন্দিরা গান্ধি। শোনা যাচ্ছে নাকি এবারে অমিতাভ বচ্চন, কিন্তু আজ এসব ভাবার সময় নেই। কাউন্সিলের অফিসে যেতেই হবে। পরীক্ষার হলে পাসপোর্ট দেখাতে হবে আর সেটাই তার খোয়া গেছে।
মিনিট কুড়ি হেঁটে তারা পৌঁছে গেল গ্রেট পোর্টল্যান্ড স্ট্রিটের স্টেশনের সামনে। সেখানেই মেডিক্যাল কাউন্সিলের অফিস।
কাউন্সিলের অফিসে রিসেপশনিস্ট তাদের বসতে বলে একটা নাম্বার ডায়াল করে খুব নীচু স্বরে কাউকে কিছু বললেন। তারপর তাদের দিকে তাকিয়ে মহিলা বললেন, “সামনের বারান্দায় বাঁদিকের দ্বিতীয় ঘরটা। মিস্টার টমসন তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন।”
বারান্দা দিয়ে দ্বিতীয় ঘরের সামনে লেখা, ‘অ্যান্ড্রু টমসন’। দরজায় মৃদু টোকা দিতেই এক ভদ্রলোক এসে দরজাটা খুলে দিলেন। রোগা, বয়স চল্লিশের ঘরে, মাথায় টাক আর মুখে এক সপ্রতিভ হাসি,“হ্যালো ডিয়ার, আমি অ্যান্ড্রু। বলো, কীভাবে তোমাদের হেল্প করতে পারি।”
ভদ্রলোকের গলায় এমন একটা আন্তরিকতা আছে যে কৌশিকের প্রায় চোখে জল চলে এল। সে তার নিজের কলকাতার ইংরাজিতে যতটা সম্ভব গুছিয়ে বলল কী হয়েছে। মিস্টার টমসন সে-প্রসঙ্গে আসার আগেই জিজ্ঞাসা করলেন, “সকাল থেকে আমি এক কাপ কফিও খাইনি, তোমরা কি কফি নেবে?”
কৌশিক বা রোহিত কিছু বলার আগেই ফোনটা তুলে বললেন, “লেসলি, প্লিজ ডু মি আ ফেভার। তিনটে কফি পাঠিয়ে দাও আর কৌশিকের ফাইলটা একটু পাঠিয়ে দাও। … কী বললে? … ফ্যাক্স? ইয়েস, ওটাও।” তারপর চেয়ারে একটু শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বললেন, “এত স্ট্রেসের কিছু নেই। দেখি কী করতে পারি। কবে পরীক্ষা তোমাদের?”
কৌশিক খুব আস্তে আস্তে বলল, “আর দশদিন।”
“দশদিন তো অনেক সময় হে, অত নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই। ইন্ডিয়ান হাই কমিশন সাতদিনের মধ্যেই ভিসা করে দেবে। আর তোমার কাছে নিশ্চয়ই ফটোকপি আছে?”
কৌশিক ঘাড় নাড়ল। নেই। ব্যাগে ছিল, এখন আর নেই। শুনে টমসনের উদার হাসি,“নাউ, দ্যাট ইজ স্টুপিড। ব্যাগেই পাসপোর্ট আর ব্যাগেই ফটো কপি!”
এর মধ্যে লেসলি বলে মেয়েটি কফি আর ফাইল দিয়ে গেল,“ফ্যাক্সটা উপরেই আছে অ্যান্ড্রু।”
ফাইলটা খুলেই মিস্টার টমসন চমকে উঠলেন,“এ কি! এ তো তোমার পাসপোর্টের ফ্যাক্স!”
কৌশিক আর রোহিত স্তম্ভিত। চোরে পাসপোর্ট ফ্যাক্স করে পাঠিয়েছে নিজের পয়সা খরচ করে! নিশ্চয়ই বাড়ি থেকে পাঠায়নি ধরা পড়ার ভয়ে। মিস্টার টমসন কৌশিকের দিকে তাকালেন। মুখে একটা প্রচ্ছন্ন জাত্যাভিমান। প্রায় বলতে চাইলেন যে দেখো, আমার দেশের চোরেরাও কত সৎ!
“আমার মনে হয় না এরপর তোমার কোনও অসুবিধা হবে পরীক্ষা দিতে। নতুন পাসপোর্ট পেলে ভালো, না পেলেও কোনও ক্ষতি নেই। শুধু পাসপোর্ট হয়ে গেলে আমাদের জানিয়ে দিও নাম্বারটা।”
কৌশিক আর রোহিত বেরিয়ে এল কাউন্সিলের অফিস থেকে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে। দুজনেই নতুন এ-দেশে। তাই প্রতি মুহূর্তেই চমকে যাচ্ছে। লোকজনের ভদ্রভাবে কথা বলা ও শোনা, পরস্পরকে সাহায্য করতে চাওয়া—এ তাদের কাছে একটু নতুন লাগছে।
বাইরে বেরিয়ে এল যখন ওরা দুজন তখন প্রায় একটা বেজে গেছে। দুজনেরই প্রবল খিদে পেয়েছে। সামনে একটা ম্যাকডোনাল্ড পেয়ে দুজনে ঢুকে পড়ল। গরম বার্গার আর চিপস খেয়ে নরম সোফাতে গা এলিয়ে দিয়ে পেপসিতে চুমুক দিতে দিতে রোহিত বলল, “কিছু বুঝতে পারছি না কে তোমার ব্যাগ চুরি করল আবার পাসপোর্টও ফ্যাক্স করল। এরকম আগে কখনও শুনিনি।”
কৌশিক ভাবছিল। সেও বুঝতে পারছে না এত সহৃদয় চোর কী করে থাকা সম্ভব। কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। কোথাও একটা অঙ্ক মিলছে না। কিন্তু কোথায় সেটা সে বুঝতে পারছে না, শুধু একটা কোথাও খটকা থেকে যাচ্ছে। অথচ সে নিশ্চিত জানে যে এইসবের মধ্যেও তাকে পরীক্ষাটা পাশ করতে হবে। নইলে সমূহ বিপদ।
পেপসিটা শেষ করে দুজনে উঠে পড়ল। এবারে গন্তব্য ভিসা অফিস, ক্রয়ডন বলে একটা জায়গায়। যদিও সে পাসপোর্টের আর ভিসার পাতাটা অ্যান্ড্রুর কাছ থেকে ফটো কপি করে নিয়েছে, তাও ভিসা অফিসে জানিয়ে দেওয়াটা তার দরকার বলেই তার মনে হয়েছে। যতই হোক, বিদেশে রয়েছে সে আর তার পাসপোর্ট নেই কাছে। কথাটা মনে হলেই কেমন একটা শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের স্রোত বোয়ে যাচ্ছে।
কোনোরকমে নিজের ইংরাজিতে তার সমস্যাটা মহিলাকে বোঝাতে পারল কৌশিক। মহিলা কম্পিউটারে দু-এক লাইন লিখে হেসে বললেন, “ওকে। নোট করে নিয়েছি। নতুন পাসপোর্ট হলে এসো, স্ট্যাম্প মেরে দেব।”
থ্যাঙ্ক ইউ বলে কৌশিক যখন বেরিয়ে এল তখন প্রায় চারটে বাজে। চারদিক অন্ধকার নেমে আসছে আর প্রচণ্ড ঠান্ডা। মেট্রো নিয়ে বারকিং স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় পাঁচটা বেজে গেল। বাইরে দেখে মনে হচ্ছে রাত ন’টা। চারদিকে প্রচণ্ড অন্ধকার। প্রায় ফেরার পথে একটা দোকান থেকে সস্তা একটা ব্যাগ কিনে ফেলল। পাউন্ড খুব দেখেশুনে খরচ করতে হবে। আজ সারাদিনে অনেক খরচ হয়ে গেছে। আর আরও খারাপ লাগছে এই জন্য যে এই খরচটা হিসেবের এক্কেবারে বাইরে ছিল। তার একটা বোকামির জন্য এত হয়রানি, পড়াশোনার বারোটা বাজল আর ফালতু এত পয়সা নষ্ট হল। কেন যে সে ব্যাগ-স্যুটকেস ফেলে দৌড়ল প্যাটেলকে দেখতে পেয়ে! বাড়ি ঢোকার আগে সামনের ফোন বুথটা থেকে সে অরিন্দমদাকে একটা ফোন করল। অরিন্দমদা তখন সবে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে।
“কী রে, সব ঠিক আছে?”
“না অরিন্দমদা, বেজায় সমস্যা, পাসপোর্ট চুরি হয়ে গেছে।”
“বলিস কী! এ-দেশে ঢুকতে না ঢুকতে?”
“আর বোলো না, সে এক কাণ্ড।” কৌশিক সমস্ত ঘটনাটা বলল। অরিন্দমদা প্রায় হতবাক।
“যাক গে, মনখারাপ করিস না। সব জায়গাতেই তো মোটামুটি বলে দিয়েছিস। সাবধানে থাকিস। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর পয়সাকড়ি লাগলে বলিস, পাঠিয়ে দেব।”
ফোন রেখে কৌশিক বেরিয়ে এল। এই বিদেশে অরিন্দমদা বিরাট ভরসা। তারা একসঙ্গে মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলে ছিল বহুবছর। একসঙ্গে পড়েছে, সিনেমা দেখেছে; ক্যারম, ফুটবল, টেবিল টেনিস খেলেছে। অরিন্দমদা না এলে সে এদেশে আসার কথা ভাবতেই পারত না।
প্যাটেল বসে ছিল ডাইনিং হলে। ওদের দেখেই বলল “এই যে, কফি হয়ে গেছে। খেয়ে তারপর ঘরে যাও।”
কফি খেতে খেতে কৌশিক পুরো গল্পটা বলল। প্যাটেলকে বেশ আশ্বস্ত দেখাল,“ওরা তো খুশি, তুম বেটা স্টাডি মে ধ্যান দো।”
কৌশিক মনে মনে বলল, ‘আর কী করব বলো, যা বিপদে পড়লাম তোমার এই পচা দেশে এসে।’
ঘরে এসে চেঞ্জ করবে বলে স্যুটকেস খুলতে যাবে কৌশিক, হঠাৎ মনে হল তার জিনিসে কেউ হাত দিয়েছে। স্যুটকেস তো নাম্বার লক, তাই খুলতে পারেনি হয়তো, কিন্তু স্যুটকেসের উপর দুটো মেডিক্যাল বই রাখা ছিল, সেগুলো একটু অবিন্যস্ত। কিন্তু কে আর হাত দেবে তার জিনিসে? কৌশিক কিছুতেই বুঝতে পারল না। হয়তো মনের ভুল। প্যাটেলকে জিজ্ঞেস করতে হবে। সে বই নিয়ে পড়তে বসল। কাল থেকে তার কোর্স।
ডিনারের সময় সে জিজ্ঞেস করল প্যাটেলকে, “আঙ্কল, কোই মেরে ঘর মে আয়া থা ক্যায়া?”
থতমত খেয়ে গেল প্যাটেল,“তুমহারে কমরে মে? নহি তো। কুছ খো গয়া হ্যায় ক্যায়া?”
“না, কিছু না।”
“মে বি দ্য লেডি হু কামস টু ক্লিন দ্য হাউস। ম্যায় বোল দুঙ্গা উসে।”
রাতে খেয়ে শুয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি। ক্লান্ত শরীর, জেট ল্যাগ কাটেনি এখনও। কিন্তু ঘুম আসছে না তার। নতুন বিছানায় এই সমস্যাটা তার চিরকালের। নিজের বালিশ ছাড়া ঘুম আসে না কিছুতেই।
ফোনের ঘণ্টিটা বেজে উঠতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। প্যাটেলের গলা শুনতে পেল সে। উপরতলায়। কাঠের বাড়ি বলে অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে কথা। নীচু গলায় প্যাটেল কথা বলছে, দু-একটা শব্দ সে শুনতে পেল—‘নাম্বার লক’, ‘হি হ্যাজ আস্কড মি’, ‘ওকে, আই উইল ডু সামথিং’। ঘড়ি দেখল কৌশিক, রাত সাড়ে এগারোটা। ডু সামথিং? কী?
৪
সকালে উঠে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল কৌশিক। কোর্সে যেতে হবে, ন’টায় ক্লাস আরম্ভ। যাওয়ার আগে কিন্তু সমস্ত জিনিস স্যুটকেসে ঢুকিয়ে নাম্বার লক করতে ভুলল না। একবার কোর্সে গিয়ে কিন্তু সে এই এত ঝামেলার কথা ভুলে গেল। পড়াতে মন দিতে হচ্ছে প্রবলভাবে। ডাক্তারি সে কলকাতাতেই শিখেছে, কিন্তু এখানে শিখতে হচ্ছে কীভাবে রোগীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। রোগীকে কোনোরকম ভুল তথ্য দেওয়া যাবে না। এই আচার-আচরণ কোনোদিন সে ভেবেই দেখেনি কলকাতায়। লাঞ্চও দিল কোর্স থেকে, স্যান্ডউইচ আর জুস। সেই শুকনো স্যান্ডউইচ খেতে খেতে কৌশিকের তরুণবাবুর মেসের কথা মনে পড়ে গেল। মাছের পিসটা ছোটো থাকত ঠিকই, কিন্তু পটল বা পোস্ত? হায় হায়, আবার সে কবে পটল বা পোস্ত খেতে পাবে? এই ঠান্ডা অন্ধকার দেশে কি আর পোস্ত পাওয়া যাবে?
কোর্সে তাদের গ্রুপে পড়েছে একটা বিদেশি মেয়ে। সুন্দর দেখতে, সোনালি চুল যাকে বলে ব্লন্ড, নীল চোখ। কৌশিক কিছুতেই বুঝতে পারছিল না যে সে কী করছে এই কোর্সে। লাঞ্চে জানতে পারল। লাঞ্চের সময় কৌশিক একাই কয়েকটা স্যান্ডউইচ নিয়ে খাচ্ছিল। রোহিতদের লাঞ্চ হবে তাদের শেষ হলে। ডাইনিং হলে অতজনের খাওয়ার জায়গা নেই আর রোহিতরা এখন যে কম্পিউটারে আছে সেগুলো লাঞ্চের পর কৌশিকরা পাবে পড়ার জন্য।
“হাই!” মেয়েটা হাত বাড়িয়ে দিল,“আমার নাম এমা, এমা ডানকান।”
“হাই, আমি কৌশিক, ফ্রম ইন্ডিয়া।”
“আমি সাউথ আফ্রিকা থেকে।”
তাই বল। কৌশিক ভাবল। একে তো দেখে বা উচ্চারণ শুনে তো ব্রিটিশ বলেই ভেবেছিল সে। সাউথ আফ্রিকার লোকেদেরও পরীক্ষা দিতে হয়? এত ভালো ইংরাজি জানা সত্ত্বেও! এ বড়ো অদ্ভুত নিয়ম!
“কোথায় আছ তুমি?” এমা জিজ্ঞেস করে।
“পেয়িং গেস্ট হয়ে। তুমি?”
“আমার আঙ্কলের বাড়ি, কেন্সিংটনে।”
“কেন্সিংটন? মাই গড! সে তো দারুণ পশ জায়গা!”
“ও ইয়া। মাই আঙ্কল ইজ আ বিজনেসম্যান। আ প্রপার ডায়মন্ড মার্চেন্ট।”
“বলো কী? ডায়মন্ড? এ তো একেবারে সিনেমার মতো! আমি কোনোদিন সামনাসামনি ডায়মন্ড মার্চেন্ট দেখিইনি।”
“যদি দেখা করতে চাও তো আমি নিয়ে যেতে পারি। মে বি কোর্সের লাস্ট দিন। বাট ইউ উইল বি ডিস্যাপয়েন্টেড। আমার আঙ্কল অত্যন্ত সহজ সাধাসিধে লোক, বড়োলোক বলে মনেই হয় না। আর ওর বাড়িতে শুধু থাকার মধ্যে বই, আর কিছু নেই।”
“বই?” উত্তেজিত হয়ে ওঠে কৌশিক—“তোমার আঙ্কল বই পড়েন?”
“ইয়েস, আমার অবশ্য কোনও ইন্টারেস্ট নেই। কিন্তু হাজার পাঁচেক বই আছে বাড়িতে।”
“তাহলে তো যেতেই হচ্ছে, যদি উনি কিছু মনে না করেন।”
“না, না। নিয়ে যাব একদিন। কেন, তোমারও বইয়ের শখ নাকি?”
“ইয়েস। আমার নিজেরও একটা ছোটো লাইব্রেরি আছে।”
“দারুণ তো! আমার আঙ্কলের সঙ্গে কথা বোলো, দারুণ লাগবে।”
বাড়িতে ফিরে রোহিতকে বলতেই রোহিত হাতজোড় করে বলল, “প্লিজ কৌশিক, আমাকে তোমার সঙ্গে যেতে বোলো না। এই পৃথিবীতে বই জিনিসটা আমাকে সবচেয়ে বেশি বোর করে। আমি বুঝতেই পারি না লোকে কেন বই পড়ে। জিম আছে, ক্রিকেট আছে, ফুটবল-রাগবি আছে—তাহলে আর বই পড়ে কী হবে? দেখেছ কাল আর্সেনাল কীরকম জিতল! কত এক্সাইটিং। তোমরা বসে বসে কাগজে সে-লেখা পড়বে, কিন্তু খেলাটা দেখবে না।”
কৌশিক বুঝল রোহিতকে সে বোঝাতে পারবে না শত চেষ্টা করলেও। কী করে সে বোঝাবে যে খেলা দেখতে তার ভালোই লাগে, খেলতে আরও ভালো লাগে; কিন্তু খেলার পর সুব্রত বা পি.কে যখন বড়ো বড়ো ক্লাবের ভুলভ্রান্তিগুলো ধরিয়ে দেন তখন সে সেগুলোও দারুণ উপভোগ করে। আসলে পরিবেশ মানুষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। বই পড়া, বইমেলা যাওয়া, লেখকদের সই জোগাড় করা, জন্মদিনে বই পাওয়া আর বই দেওয়া—এ সবই তার রক্তে মিশে আছে।
পরের তিনদিন খুব তাড়াতাড়ি কেটে গেল। আর দু-দিন বাকি কোর্স শেষ হতে। পরের দিন পড়াশোনা শেষ হতে একটু দেরিই হয়েছে। তখন প্রায় ছ’টা বাজে, যে-ভদ্রলোক কোর্সে পড়াচ্ছেন, তিনি বলে দিয়েছেন যে পরের দিন পরীক্ষা। ফেরার সময় সেই নির্জন শর্টকাটের মাঝামাঝি যখন এসেছে, কৌশিক দেখল দুটো লোক, দুজনেই সাদা, ইউরোপিয়ান, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা অত মাথা ঘামায়নি। রাস্তা তো আর কৌশিক কিনে রাখেনি। যে-কেউ দাঁড়াতেই পারে। খেয়াল করল যখন লোক দুটো ওদের দিকে এগিয়ে এল,“লাইটার আছে?” একজন জিজ্ঞেস করল।
“না, সরি।” রোহিত বেশি কথার ছেলে নয়।
“দেখো না ব্যাগে যদি থাকে।”
“বললাম তো সিগারেট খাই না।”
আচমকা একটা লোক এগিয়ে কৌশিকের ব্যাগটা ধরল আর তক্ষুনি কৌশিক দূরের স্ট্রিট লাইটের আবছা আলোয় তার মুখটা দেখতে পেল। কোথায় দেখেছে যেন এই লোকটাকে সে। কিছুতেই মনে করতে পারছে না। লোকটা কিন্তু তার ব্যাগটা ধরে টানছে। হঠাৎ রোহিত প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুসি মারল লোকটার চোয়ালে। লোকটা এর জন্যে বোধ হয় প্রস্তুত ছিল না, চোয়াল চেপে বসে পড়ল। ওর সঙ্গীও কেমন তখন হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। একটা সাদামাটা ইন্ডিয়ান ছেলে যে তাদের এইরকম জোরে ঘুসি মারবে এ তারা কল্পনাও করেনি। চাপা গলায় রোহিত বলল, “কৌশিক, ভাগো!”
কৌশিক সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দৌড়াতে শুরু করল। ফুটবল খেলার সুফল সে আজকে পেল। পার্ক পেরিয়ে রাস্তায় নেমে আবার রোহিত আস্তে আস্তে হাঁটা আরম্ভ করল। রোহিত চাপা গলায় বলল, “আর ভয় নেই, সামনে পুলিশ আছে, দৌড়াতে দেখলে হয়তো আমাদেরই সন্দেহ করবে।”
বাড়ি গিয়ে কফি খেল দুজনে, ভীষণ টায়ার্ড। রোহিত একটাও কথা বলল না। ভুরু কুঁচকে যেন গভীর চিন্তায় মগ্ন। কফি খেয়ে যখন নিজের ঘরে যাচ্ছে কৌশিক, তখন রোহিত এগিয়ে এল তার দিকে,“তোমার একটু সময় হবে? কথা বলব।”
“অফ কোর্স। কী ব্যাপার?”
“আজ কী হল বলো তো ব্যাপারটা?”
“রোহিত, আমি জানি না, সামথিং ইজ নট রাইট।”
“কী ব্যাপার বলো তো কৌশিক। এটা কাকতালীয় হতে পারে, কিন্তু তোমার ব্যাগ হারাল লন্ডনে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার আজ ব্যাগ ধরে টানাটানি। একটু খটকা লাগছে।”
“জানি না রোহিত। আমার এই অবস্থা চলছে কলকাতা থেকে।” ও পুরো ঘটনাটা বলল রোহিতকে।
“ভেরি স্ট্রেঞ্জ।” তারপর শুধু জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি কোনোরকম ইনভলভমেন্ট আছে কোনও বেআইনি কাজে? এয়ারপোর্টে কেউ কিছু এ-দেশে আনতে দেয়নি তো?”
কৌশিক মাথা নাড়ল। রোহিত ড্রাগসের কথা বলছে। অনেকেই এইভাবে অপরিচিত লোকেদের দিয়ে ড্রাগ পাচার করে তারপর বিদেশে এসে আবার যেভাবে পারে সেটা হাতিয়ে নেয়। যদি এয়ারপোর্টে ধরা পড়ে তাহলে তাদের কোনও সমস্যা নেই। একজন নিরপরাধ লোক জেল খাটবে বহুবছর আর পৃথিবীর কোনও কোনও দেশে তো শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
“তাহলে কি প্যাটেল কিছু জানে?”
“জানি না কৌশিক, বাট আই নো দিস মাচ যে আমাদের পরীক্ষাটা পাশ করতেই হবে। আর এটা আমার মুম্বই বা তোমার কলকাতা নয়, ঝামেলা এড়িয়ে চলাই ভালো। সাবধানে থাকো, তবে আমার মনে হয় এই ঘটনাগুলো কাকতালীয় হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর তাছাড়া তিনটে তো মোটে দিন বাকি, তারপর তুমি চলে যাচ্ছ স্কটল্যান্ড আর আমি যাচ্ছি লিডস। ওখানে আমার দাদার কাছে থাকব কয়েকদিন। কাল কোর্স শেষ হয়ে যাবার পর একটু লন্ডন ঘুরে নিও। আমার একবার ঘোরা হয়েছে, ডোন্ট মাইন্ড যদি আবার ঘুরতে হয়।”
আর দু-দিন বাদে তো পরীক্ষা। যাই হোক, শুয়ে পড়া যাক। কাল দেখা যাবে।
কৌশিকও নিজের ঘরে এসে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। ঘণ্টা খানেক পড়াশোনা করে যখন সে শুতে গেছে তখন প্রায় এগারোটা।
রাত তখন কত কৌশিক জানে না। হঠাৎই তার ঘুমটা ভেঙে গেল। যেন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠেছে। ঘরে আরেকজন কেউ। একটা ছায়ার মতো বিছানার পাশে টেবিলের কাছে। কৌশিকের তখন প্রচণ্ড ভয়—ঘরে চোর, যদি ছুরি বা বন্দুক থাকে। তাও সে গলাটা ভারী করে জিজ্ঞেস করল, “হু ইজ দেয়ার?”
ছায়ামূর্তিটা যেন চমকে উঠল,“বেটা, মাথা ধরেছে, ভাবলাম তোমাকে জিজ্ঞেস করব কোনও ওষুধ আছে কি না।”
“না আঙ্কল, আমার কাছে কোনও ওষুধ নেই।”
“সরি, ডিস্টার্ব করলাম।”
কৌশিকের চোখ ফেটে জল এল। কী চায় এই প্যাটেল? এই-ই কি আমার ব্যাগ চুরি করেছে? কিন্তু কৌশিক তো তার সঙ্গে ছিল যখন ব্যাগ চুরি হয়। কিন্তু এত টেনশন আর সে নিতে পারছে না। প্যাটেল তো আর শঙ্করদার দোকান ভাঙেনি, আর চিনা লোকটাকে খুনও করেনি। তাহলে প্যাটেলের কী স্বার্থ তার উপর নজর রেখে?
৫
সকালে কোর্সে যাওয়ার সময় রোহিতকে সে বলল রাতের ঘটনা। রোহিত কিন্তু অতটা বিচলিত হল না। হয়তো সত্যি গেছিল ওষুধের খোঁজে। কোর্স শেষ হল। শেষ দু-ঘণ্টা শুধু কীভাবে পরীক্ষা পাশ করতে হবে তাই নিয়ে আলোচনা। কৌশিকের একটু ভয়ই হচ্ছিল শেষের দিকে। যখন কথা হচ্ছিল যে পাশ না করতে পারলে অঢেল টাকা নষ্ট, বেশিরভাগ সময় আর ভিসা থাকে না, ফলে দেশে ফিরে যেতে হয়।
ক্লাস শেষের পর এমা আবার কৌশিকের কাছে ছুটে এল,“কী ব্যাপার, যাবে তো আমার কাকার বাড়ি?”
কৌশিকের বিশেষ ইচ্ছা ছিল না। কাল রাতের ঘটনার পর আর আজ কোর্সে পাশ না করার ভয় পাওয়ার পর, কিন্তু এমন আন্তরিকভাবে এমা বলল যে ও না বলতে পারল না। আর যারা বই কেনে আর পড়তে ভালোবাসে, তারা বই দেখতেও ভালোবাসে।
রোহিতকে বলে সে আর এমা বেরিয়ে এল। কৌশিক বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এমাই থামাল তাকে,“নট দ্যাট ওয়ে, কাম উইথ মি।” বলে সোজা এগিয়ে গেল।
কৌশিক তখনও ভাবছে যে মেয়েটা যাচ্ছে কোথায়। একটা কার পার্কের মধ্যে ঢুকল এমা। এ গাড়িও চালায়! কৌশিক অত্যন্ত অবাক হয়ে ভাবল। সে জানে যারা নতুন এসেছে এ-দেশে, তাদেরই পরীক্ষা দিতে হবে আর পরীক্ষা না দিলে চাকরি পাওয়া অসম্ভব। তার মানে মেয়েটা চাকরি করে না। আর চাকরি না করলে গাড়ি কিনে চালাচ্ছে, নিশ্চয় কাকার গাড়ি হবে। লাল টুকটুকে ছোটো গাড়ি, টয়োটা।
এমা বলল, “সরি, গাড়িটা একটু নোংরা, অনেকদিন ধোয়া হয়নি।”
কৌশিক জিজ্ঞেস করল, “তুমি গাড়ি চালাও এখানে?”
এমা খুব সপ্রতিভভাবে জবাব দিল, “অবশ্যই। নইলে কত সময় নষ্ট বলো তো। পড়ব কখন?”
সত্যিই তো। এটা কৌশিকের খেয়ালই হয়নি। পড়ার সময় বাঁচানোর জন্য গাড়ি চালানো তো অবশ্য কর্তব্য। যদিও সে শুনেছে যে লন্ডনে মেট্রো করে যাওয়া-আসা করলেই সবচেয়ে সময় বাঁচানো যায়, রাস্তায় এত ট্রাফিক জ্যাম হয় বলে। তার হঠাৎ শরৎচন্দ্রের মেজদার কথা মনে পড়ে গেল। মেজদারও কিন্তু পড়ায় ঠিক এরকমই আগ্রহ ছিল! আর সেজন্যেই সে বছর বছর ফেল করত।
গাড়িতে এমা অনেক কথা বলল। সে এসেছে ডারবান থেকে—সেই ডারবান যেখানে ইন্ডিয়ার গান্ধির স্ট্যাচু আছে, যেখানে চমৎকার ক্রিকেট খেলার মাঠ আছে। দু-বছর আগে সে খেলা দেখেছে ইন্ডিয়া আর সাউথ আফ্রিকার। তিনটে ইয়াং ইন্ডিয়ান প্লেয়ারের সে প্রায় ফ্যান হয়ে গেছে। তিনজনই ব্যাট করে। তার ইন্ডিয়া যাওয়ার খুব ইচ্ছে, কিন্তু কেরালায়। সেখানে একটা হাসপাতালে কিছুদিন কাজ করতে চায় সে। এমা কথা বলে খুব সুন্দরভাবে আর যদিও অনেক কথা হল, কিন্তু বকবক করে না। আর সব কথাতেই সে খুব অবাক হয়। মাঝে-মাঝেই বলে ওঠে, “তাই নাকি! কী আশ্চর্য!”
কেন্সিংটন পৌঁছতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেল। একটা বেশ বড়ো বাড়ির সামনে এমা গাড়িটা দাঁড় করাল। তারপর বলল, “এসো।”
বাড়ির দরজা খোলাই ছিল। ঢুকতেই নরম লাল কার্পেটে কৌশিকের পা ডুবে গেল। হিটার চলছে, একটা দারুণ আরামদায়ক উষ্ণতা ঘরের ভিতরে। এমা তাকে নিয়ে গেল বাড়ির ভিতরে,“চলো লাইব্রেরিতে যাই।”
ঘরটা বেশ বড়ো। মাঝখানে ছোটো টেবিল, তিনটে সোফা আর চারদিকে দেওয়াল আলমারিতে শুধু বই। সমস্ত বই প্রায় নতুন, ঝকঝক করছে। এমা বলল, “এই নিয়ে থাকে আমার আঙ্কল। আমার আন্ট অনেকদিন আগে মারা গেছেন, এখন আঙ্কলের লাইফ শুধু বই। ওঁর ছেলে ব্যাবসা দেখে আর উনি শুধু বড়ো বড়ো বিজনেস মিটিংগুলোতে যান। ওঁর একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট গ্রাহাম, সে-ই ওঁর মোটামুটি দেখাশুনো করে।”
কৌশিকের কানে এসব কথা ঢুকছিল কি? সে শুধু বই দেখছিল। সমস্ত বই লেখকের নাম ধরে ধরে সাজানো। কিছু বই আছে বহু পুরোনো, কিন্তু বেশিরভাগই নতুন। গত পঁচিশ বছরে যেসব লেখকরা নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকের পুরো সেট। কে নেই সেখানে? গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস, আলবেয়ার কামু, কুন্দেরা, সলমান রুশদি থেকে অমিতাভ ঘোষ, জন আপডাইক। এই নামগুলো তো তার চেনা। এছাড়া বহু লোকের নাম সে শোনেইনি। বিখ্যাত পর্তুগিজ লেখক হোসে সারামাগোর সমস্ত বই পরপর সাজানো আছে। কোনও পেপারব্যাক সে দেখতে পেল না সেই আলমারিতে। কৌশিক অবাক হয়ে দেখছিল বইয়ের আলমারিগুলো। মেহগনি কাঠের আলমারি দেওয়ালের গায়ে গায়ে, প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট উঁচু যাতে উপরের তাক অবধি হাত পাওয়া যায়। কোথাও এক বিন্দু ধুলো নেই। দুটো পিতলের ল্যাম্প সোফার পাশে, কিন্তু বড়ো কোনও আলো নেই। দু-দিকে দুটো দরজা আর দুটো জানালা। ভারী পর্দা দিয়ে জানালা ঢাকা।
‘হ্যালো’ শুনে সে পিছন ফিরে তাকাল। এক সুদর্শন ভদ্রলোক একটা চমৎকার স্যুট পরে তার সামনে দাঁড়িয়ে। এমাকে হ্যালো বলতে শুনে সম্বিৎ ফিরে পেল কৌশিক। লজ্জা পেয়ে বলল, “হ্যালো! আমার নাম কৌশিক।”
নরম হাতে ভদ্রলোক তার হাতে একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “নাইস টু মিট ইউ, কৌশিক। আমি ডেভিড গিবসন।”
কৌশিক হ্যান্ডশেক করে বলল, “ভেরি নাইস টু মিট ইউ মিস্টার গিবসন। আপনার বইগুলো দেখছিলাম।”
“অফ কোর্স! আমার অনেকদিনের কালেকশন। তবে যদি ছুঁয়ে দেখতে চাও প্লিজ হাতটা ধুয়ে এসো।”
কৌশিক পুরো অবাক। এ কি পাগল নাকি যে বই দেখতে হলে হাত ধুতে হবে? কিন্তু পাগলামির কোনও লক্ষণই তার চোখে পড়ল না। তাও ভদ্রতা করে সে হাতটা ধুয়ে এল পাশের বাথরুম থেকে। ঘরে ঢুকতেই দেখল মিস্টার গিবসন দুটো গ্লাভস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সাদা সুতির গ্লাভস,“এগুলো পরে নাও প্লিজ, যাতে বইয়ে আঙুলের দাগ না লাগে।”
কৌশিক পরে নিল গ্লাভস দুটো। এই বইয়ের রাশি ছুঁয়ে দেখার জন্য সে সবকিছু করতে প্রস্তুত। এমন সময় এমা বলল, “আমি এবার আসি মিস্টার গিবসন।”
“ওহ্ শিওর। তোমার টাকাটা তোমার অ্যাকাউন্টে চলে যাবে।”
“থ্যাঙ্কস। বাই কৌশিক, নাইস মিটিং ইউ।”
এমা চলে যেতে কৌশিক আবার বইয়ে মন দিল। মিস্টার গিবসন বলে চলেছেন, “এই সমস্ত বই সব ভীষণ দামি। কিন্তু আমার আসল লাইব্রেরিটা অবশ্য আমেরিকায়। সেখানেই আমার সবচেয়ে দামি বইগুলো আছে।”
“দামি মানে রেয়ার?”
“অফ কোর্স। এখানকার বেশিরভাগ বই-ই হাজার দুয়েক পাউন্ডের কম আর আমেরিকার সব বই-ই দু-হাজার পাউন্ডের বেশি।”
কৌশিক একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। দু-হাজার পাউন্ডের বেশি দাম, মানে দু-লাখ টাকা! কী এমন বই, এ তো তার জ্ঞানবুদ্ধির বাইরে!—“সব বহু পুরোনো অ্যান্টিক বই বুঝি?”
ডেভিড গিবসন একটু হাসলেন,“পুরোনো বই মানেই কিন্তু দামি নয়। আর নতুন বই মানেই কিন্তু কম দামি নয়। বহু নতুন বইয়ের প্রথম সংস্করণ অষ্টাদশ শতকের বাইবেলের চেয়ে ঢের বেশি দামি। তোমার প্রিয় লেখক কে?”
কিছু না ভেবেই কৌশিক বলে, “রবীন্দ্রনাথ আর গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস।”
কলম্বিয়ার লেখক মার্কেসের লেখা সব বই-ই কৌশিক পড়েছে, আর পড়ে একেবারে অন্ধ ভক্ত হয়ে গেছে।
“ইয়েস, আমার এরকমই ধারণা ছিল। ইন্ডিয়ানরা টেগোর নিয়ে একটু বেশি পাগল। রবীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ অটোগ্রাফ করা বই আমার নিউইয়র্কের বাড়িতে আছে। আর মার্কেস তো চোখের সামনে দেখতেই পাচ্ছ। এই সব বই প্রথম সংস্করণ, আর সমস্ত বই-ই মার্কেসের সই করা।”
“সই করা, মানে অটোগ্রাফ করা?” কৌশিক ভাবতেও পারছে না যে তার প্রিয় লেখক এই সব বই নিজে ছুঁয়ে দেখেছেন।
“ওঁকে আমি তিনবার মিট করি—নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন আর একবার স্পেনের বার্সেলোনায়। এই ছোটো গল্পের বইটা দেখো, ইনোসেন্ট এরেন্দিরা।” খুলে দেখালেন মার্কেস একটা নীল কালিতে ছোটো ফুল এঁকে দিয়েছেন,“আর এইটা দেখো। স্পেশাল এডিশন। দ্য জেনের্যাল ইন হিজ ল্যাবিরিন্থ—মাত্র তিনশো পঞ্চাশটা ছাপা হয়েছিল। আমেরিকাতে আছে প্রায় দেড়শটার মতো আর ব্রিটেনে প্রায় সত্তরটা। কয়েকটা নষ্ট হয়ে গেছে আর বাকিগুলো ওয়ার্ল্ডওয়াইড, গোটা ইন্ডিয়াতে এক-দুটো থাকলেও থাকতে পারে। প্রত্যেকটা বই মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো আর নম্বর দেওয়া আর সই করা। অসাধারণ সুন্দর। এই তো কয়েক বছর আগে ছাপা, কিন্তু এখন এক্সট্রিমলি রেয়ার।”
“আপনি কী করে জানলেন কোথায় ক’টা আছে?” কৌশিক অত্যন্ত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে। গুল মারবার আর জায়গা পায়নি।
“আমরা যারা বই কালেক্ট করি আমেরিকায়, তাদের এ-খবর রাখতে হয় ভাই। কার কাছে কী কী বই আছে, অবশ্য যারা সিরিয়াস কালেক্টার তাদের কথাই বলছি, এই তো গত বছর এক ইন্ডিয়ান কিনল একটা, একশো পঁচাত্তর নম্বরটা, বিয়ান্ডোপ্যাঢি না কী নাম, লোকটা ব্রিটেনেই থাকে।”
কৌশিকের হাসি পেল বাঙালির বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমেরিকার গিবসনের মুখে এই দুর্গতি দেখে।
মিস্টার গিবসন সোফায় বসলেন আর ওকেও বসতে ইশারা করলেন। একটা লোক টি-পট রেখে গেছে। চা ঢাললেন। দার্জিলিং টি। দুজনেই দুধ ছাড়া চা। চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “কৌশিক, বইটা আমার চাই।”
কৌশিক প্রায় চমকে সোফা থেকে লাফিয়ে উঠল,“কোন বইটা?”
“যেটা তুমি কলকাতা থেকে কিনেছ। আমার কালেকশনে ওটা নেই আর ওটা আমার লাগবে।”
“আপনার লাগবে মানে? ওটা আমি কিনেছি। আইনত বইটা এখন আমার।”
“কৌশিক, বইটা আমার লাগবে আর তার জন্যে যা যা করার দরকার আমি করব। আমি রিকোয়েস্ট করছি বইটা আমাকে দিয়ে দাও।” কেটে কেটে বললেন ডেভিড গিবসন। ভদ্রলোকের ফরসা গাল একটু লালচে হয়ে উঠেছে।
কৌশিকের মাথা খুব দ্রুত কাজ করছিল। তার মানে অত সহজে গিবসন সাহেব বইটা পাননি। সে দেখেছে ডিটেকটিভরা এই সময় যত প্রশ্ন সব করে নেন। যেহেতু মিস্টার গিবসনের বইটা দরকার, তিনি উত্তর নিশ্চয় দেবেন।
“মিস্টার গিবসন, আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে।” একবারে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করা ভালো। গিবসন সাহেব মাথা নাড়লেন।
“বইটা যে আমার কাছে আছে তা আপনি কী করে জানলেন?”
“তোমার কাছে শুধু কেন? বইটার আমেরিকা থেকে চুরি যাবার পর ইন্ডিয়াতে দেখা গেছে, সেখান থেকে তুমি কিনেছ—সব আমার জানা। আর আশ্চর্য কী জানো? এর জন্যে আমার খুব বেশি পাউন্ড খরচ করতেও হয়নি। অবশ্য দামটা আমার কাছে সব সময়ই গৌণ।”
“চিনে লোকটাকে খুন কে করল?”
“মার্ডার? সে কি? অবশ্য কীভাবে কোন বই পাওয়া গেল, সেটা আমি জানি না—তাতে আইনের ঝামেলা প্রচুর। ওটা গ্রাহাম সামলায়। ওকে বলা আছে আমাকে এসব ব্যাপার সম্বন্ধে না বলতে।” ফোনটা তুলে গিবসন সাহেব বললেন, “এই গ্রাহাম, একটু আসবে প্লিজ।”
মিনিট খানেকের মধ্যে যে লোকটি ঘরে ঢুকল, তাকে দেখে কৌশিক আবার চমকে উঠল। এ তো সেই প্লেনের লম্বা ছিপছিপে চেহারার ব্রিটিশ লোকটি যাকে সে বারকিং স্টেশনেও দেখেছিল। ঘরে ঢুকে একটু হেসে সে হাতটা বাড়িয়ে দিল, “হ্যালো কৌশিক, হাউ ডু ইউ ডু?”
কৌশিক কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। শুধু ঘাড় নেড়ে বলল, “ফাইন, থ্যাঙ্কস।”
মিস্টার গিবসন খুব ঠান্ডা গলায় বললেন, “গ্রাহাম, কোনও ক্যাজুয়াল্টি হয়েছে নাকি ইন্ডিয়াতে?”
“আর বলবেন না। লোকটাকে বলেছিলাম একশো ডলার অবধি উঠতে—খুব বেশিও নয়, আবার খুব কমও নয়; ও গিয়ে দাম করেছে একশো রুপিজ। বইটা বিক্রি করেনি ওকে।”
“ন্যাচারালি।” বললেন মিস্টার গিবসন।
“ওকে সে কথাটা বলতেই আবার আমাদের শাসাতে লাগল যে পুলিশকে বলে দেবে আমরা বিদেশি, স্মাগলিং করছি। উপায় ছিল না স্যার।”
এবারে বেশ উদার গলায় হাসলেন মিস্টার গিবসন,“হান্ড্রেড ডলার আর হান্ড্রেড রুপিজ! যাক গে, পৃথিবী থেকে আরেকটা বোকা লোক কমল।”
কৌশিকের মাথা খুব দ্রুত কাজ করছিল। বইটা পাওয়ার জন্যে এরা সব কিছু করতে পারে, কিন্তু বইটা পাওয়ার আগে তার কোনও ক্ষতি এরা করতে চাইবে না কিছুতেই। সে জিজ্ঞেস করল, “কলকাতায় কি কেউ আমার উপর নজর রাখছিল?”
“অফ কোর্স!” গ্রাহাম যেন প্রশ্ন শুনে তাজ্জব।
“কিন্তু আমি যে বিলেতে আসছি সেটা আপনারা জানলেন কী করে?”
“কেন?” গ্রাহাম বলে চলে, “তোমার ওই বইয়ের দোকানদারই তো বলল। অবশ্য এসব তথ্যের বিনিময়ে ওর দোকানটা ঠিক করে দিতে হল।”
কৌশিকের হতাশা বাড়ছিল। শঙ্করদাও পয়সার লোভে তার খবর বিক্রি করে দিল? এটা সে আশাই করেনি। কিন্তু এই যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তার কোনোটাই কি সে আশা করেছিল?
মিস্টার গিবসন বললেন, “এটা কিন্তু খুব ভালো কাজ করেছ গ্রাহাম। ওর দোকানটা ঠিক করে দিয়েছ। এমনিতেই ইন্ডিয়ানদের পয়সা নেই, তারপরে দোকানটা ভেঙে গেল। না না, এটা জেনুইন ভালো কাজ হয়েছে।”
কৌশিক আবার অবাক। একটা লোক মরে গেল আর গিবসন সাহেব হাসলেন, এখন একটা দোকান সারানো হল আর কত আন্তরিকভাবে খুশি হলেন মিস্টার গিবসন। এরা কী ধরনের মানুষ সে ধরতেই পারছে না।
“অবশ্য আই মাস্ট সে যে প্যাটেলও খুব হেল্প করেছে।”
“আঙ্কল? আপনাকে হেল্প করেছে?”
“ও ইয়েস, ওর জন্যে খরচও বেশি হয়নি। তোমার কোনও বন্ধু ওকে দেরিতে স্টেশনে যেতে বলেনি ভাই, গল্পটা ওরই তৈরি করা যাতে তোমার ব্যাগটা সরানো যায়।”
“আমার ব্যাগটা কে নিয়েছে গ্রাহাম?”
“কেন, পাভেলকে লাগিয়েছিলাম বারকিং স্টেশনে। বুঝতে পারিনি যে বইটা হাতে নিয়ে ফোন করতে যাবে তুমি। ও বাইরে বসে বার্গার খাচ্ছিল। তুমি যেই স্টেশনে ঢুকলে, ও ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। অবশ্য ওকে তার বদলে সাতদিন ম্যাকডোনাল্ডে খাওয়ার পয়সা দিতে হয়েছে। কিন্তু লোকটা অনেস্ট। যখন শুনল যে আসল জিনিস পাওয়া যায়নি, আবার ট্রাই নিল সন্ধেবেলা আর তোমার বন্ধুর কাছে মার খেল।”
ঠিক, এইবার কৌশিকের মনে পড়েছে। সেই লোকটাই ওর ব্যাগ ছিনতাই করার চেষ্টা করেছিল। তখন চেনা চেনা লেগেছিল, কিন্তু মনে করতে পারেনি। সে এবার মিস্টার গিবসনকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, “একটা কথা আমার মাথায় অনেকদিন ধরে ঘুরঘুর করছিল। আমার পাসপোর্ট কেন মেডিক্যাল কাউন্সিলে পাঠালেন? এতে আপনার কী স্বার্থ?”
“আমি চাইনি তুমি দেশ ছেড়ে চলে যাও। তুমি ইন্ডিয়াতে ফিরে গেলে তোমাকে ট্রেস করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যেত ভাই। তোমাদের দেশে এত লোক চারদিকে গিজগিজ করছে, ওখানে তোমাকে খুঁজতে হোক আমি চাইনি। সেজন্যই পাঠিয়ে দিলাম ফ্যাক্স করে।”
“আমি ঠিকই ধরেছিলাম।” কৌশিক বলল, “যে-কোনো আজেবাজে চোর হলে জানবে কী করে যে আমি কেন এ-দেশে এসেছি? ঠিক জায়গায় পাসপোর্ট পাঠানোতেই আমার সন্দেহ হয়েছিল যে এটা যে-কোনো চোরের কাজ নয়।”
“তুমি তো বেশ স্মার্ট আছ মাই বয়! আমার সঙ্গে কাজ করতে পার। ডাক্তার হয়ে যা মাইনে পাবে তার চেয়ে এখানে বেশিই পাবে।”
কৌশিকের ভীষণ অপমান হল এই প্রস্তাবে। কিন্তু ইংরাজিতে সে জুতসই জবাব খুঁজে পেল না। বাংলা কিংবা হিন্দি হলে ভালো করে লেকচার দিতে পারত। শুধু বলল, “না, ডাক্তারি আমার ভালো লাগে। আর এইসব বেআইনি কাজ আমি করব না।”
“আরে না না, কী যে বলো, মজা করছিলাম। যাক গে, কত টাকায় বিক্রি করবে বলো বইটা।”
কৌশিকের মনখারাপ হয়ে গেল। বিদেশ-বিভূঁইয়ে এইরকম হেভিওয়েট শত্রুর সঙ্গে লড়াই করে থাকা, পরীক্ষা পাশ করা খুব মুশকিল। তার জীবনে প্রথম আর শেষ উমবের্তো একোর সই করা বই বোধহয় হাতছাড়া হয়ে গেল। না দিলে এরা নির্ঘাত স্যুটকেস সমেত চুরি করে নেবে। শেষ চেষ্টা করার জন্যে সে প্রায় শুকনো গলায় বলল, “বই আমি বিক্রি করি না, এটা আমার নীতির বিরুদ্ধে।”
এক্কেবারে ডাহা মিথ্যে কথা। সে প্রচুর পড়ার আর এক-দুটো গল্পের বইও বিক্রি করেছে এর আগে আর সেই পয়সা দিয়ে নতুন বই কিনেছে। কিন্তু এইসব অপরাধীদের একটু নীতির জ্ঞান দিতে তার একটু বেশ ভালোই লাগল। এই দুরাশা তার কখনোই নেই যে তার কথা শুনে এরা মনখারাপ করে বলবে, ‘আহা, সত্যিই তো। তাহলে আর কী করা যাবে। ও-বই তোমার কাছেই থাক ভাই। বলো তো আরও দুয়েকটা বই নিয়ে যাও।’
কিন্তু সে অত্যন্ত অবাকই হল মিস্টার গিবসনের কথা শুনে। এই নিয়ে তৃতীয়বার এক বিকেলের মধ্যে তাকে অবাক হতে হল।
“অবশ্য সেটা আমি খেয়াল করে দেখিনি। তুমি তো সত্যি সত্যি বই ভালোবাসো দেখছি। হোয়াট টু ডু নাউ? আচ্ছা, একটা বিজনেস করি। তুমি আমাকে তোমার বইটা দাও, বদলে এই আলমারি থেকে যে-কোনো একটা বই নিয়ে যাও। এটা কিন্তু দারুণ প্রস্তাব! ভেবে দেখো।”
এটা কৌশিক একেবারেই আশা করেনি। এই বিশাল বইয়ের সমারোহ থেকে কাকে ছেড়ে কাকে নেবে? সে উঠে গেল আলমারির কাছে। মার্কেস তাকে টানছে, আবার সলমান রুশদির সই করা বই সে কোনোদিন চোখেই দেখতে পাবে কি না ঠিক নেই। তাঁকে বই লেখার অপরাধে এখনও প্রায় আত্মগোপন করে থাকতে হচ্ছে। মাত্র কয়েক বছর আগে হোসে সারামাগো নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন, তাঁর বইও রয়েছে।
তাকে দাঁড়াতে দেখে নিজের সোফা থেকেই মিস্টার গিবসন বললেন, “সারামাগো? গুড চয়েস। আমার কাছে ওঁর সেরা বই ব্লাইন্ডনেসের প্রুফ কপি অটোগ্রাফ করা আছে, চাইলে সেটা নিতে পার। পৃথিবীতে সব মিলিয়ে শ-খানেক আছে, তাও বেশিরভাগ সই না করা।”
কৌশিকের কেমন বুক ধড়ফড় করছে। এত বই থেকে একটা বই বেছে নেওয়া অসম্ভব ব্যাপার। সে চোখ বন্ধ করল। আর বন্ধ চোখের সামনে ভেসে উঠল মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেসের সই করা ‘গোলকধাঁধায় সেনাপতি’ বা ‘জেনের্যাল ইন হিজ ল্যাবিরিন্থ’ বইটা। অনেক বইয়ের ভিড়ের মাঝে যেন কেউ তার হাতে ধরিয়ে দিল বইটা। লেখকের সই করা। পৃথিবীতে মাত্র সাড়ে তিনশো কপি ছাপা হয়েছে। এ-বই কেনার সামর্থ্য তার জীবনে হবে না। মাথা ঠান্ডা করে সে ভেবে দেখল, এ-লড়াই সে চালিয়ে যেতে পারবে না। হয় উমবের্তো একোকে নষ্ট করে দিতে হবে, যেটা তার পক্ষে অসম্ভব; অথবা এই প্রস্তাবে রাজি হতে হবে। বদলে মার্কেস।
সে ঘুরে দাঁড়াল। এই সিদ্ধান্ত নিতে অসীম বুদ্ধি লাগে না। বলল, “আমি হয় সই করা মার্কেসের বই নেব অথবা হোসে সারামাগোর ব্লাইন্ডনেস নেব।”
“এক্সেলেন্ট! তোমার পছন্দের তারিফ করতে হয়। বই এখন তোমার কাছে আছে?”
“না। পরশু পরীক্ষা, সেদিন সন্ধেবেলা আসব আমি। আমার বন্ধুও আসতে পারে। আমি বই নিয়ে আসব।”
“গ্রেট। তাহলে সেই কথাই রইল। আমি কথা দিলাম এই দু-দিন তোমাকে কেউ ডিস্টার্ব করবে না। আর পরীক্ষার পর যদি কোথাও চাকরি লাগে, বোলো আমাকে। আই ক্যান হেল্প।”
৬
বন্ধ দরজাটা পিছনে রেখে রাস্তায় নেমে এল কৌশিক। রাজ্যের ক্লান্তি তার শরীরে। সঙ্গে দুঃখ, ভয়, সবরকম অনুভূতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এমনিতে তার মাথা ঠান্ডা, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ঠান্ডা মাথা কি আর ঠান্ডা থাকে? একোর বইটার জন্য তার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। আরও কষ্ট হচ্ছে কেউ ভয় দেখিয়ে নিয়ে নিচ্ছে বলে। নিজেকে কেমন অসহায় মনে হল তার। হঠাৎ মনে পড়ল, দু-দিন পরেই তার পরীক্ষা এবং এই পরীক্ষার উপর নির্ভর করছে তার সারাজীবন। কিন্তু তার সঙ্গে মনে একটু আনন্দও দানা বাঁধছে—মার্কেসের বইটা এতটাই আকর্ষণীয়।
আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন থেকে ট্রেন নিয়ে যখন ফিরল, দশটা বেজে গেছে। রোহিত পড়ছিল বসার ঘরে বসে। কৌশিককে দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল তার দিকে,“এত দেরি?”
“অনেকগুলো কোশ্চেনের উত্তর পেয়ে গেছি রোহিত।”
“মানে?”
“আঙ্কল কোথায়?”
“শুয়ে পড়েছে।”
“শিওর?”
“আমি নিজে দেখেছি।”
কৌশিক পুরো ঘটনাটা বলল। রোহিত চুপ করে শুনল। এমনিতেই সে কম কথা বলে আর তার মুখচোখে একটা আত্মবিশ্বাস সবসময় থাকে, সেজন্যই কৌশিক এত ভরসা করতে পারে তাকে।
“কৌশিক, এটা পুরোটাই তোমার ডিসিশন। তোমার বন্ধু হিসেবে আমি তোমার সিদ্ধান্তকে মেনে নেব। তোমার বই তুমি দিতেও পার নাও দিতে পার। না দিলে ওরা আপ্রাণ চেষ্টা করবে নিয়ে নেওয়ার। একটা নতুন দেশে পাসপোর্ট ছাড়া পরীক্ষার এই চাপ মাথায় নিয়ে তুমি কি লড়াই চালাতে পারবে? এরপরে আবার চাকরি খোঁজার সমস্যা। দেখতেই পাচ্ছ গিবসনের ক্ষমতা কতটা। চাকরিতে সাহায্য করতে পারার কথাটাও কিন্তু একরকম শাসানি। যে হেল্প করতে পারে সে চাকরি না পাওয়াতেও পারে। এ তো দেখছি সবাইকেই কিনে রেখেছে! আরও আশ্চর্য ব্যাপার হল যে এর জন্যে ওর বিশেষ পয়সা কিন্তু খরচ হয়নি। আমাদের মূল্যবোধ কি এত সস্তা হয়ে গেছে কৌশিক?”
“না রোহিত, হয়তো যারা যারা আমার খবর দিয়েছে, তারা হয়তো পুরো গল্পটা না জেনেই দিয়েছে। সবাইকে সন্দেহ করা হয়তো ঠিক নয়।”
“হতে পারে। যাই হোক, তুমি কী করবে ঠিক করো। আমাদের হাতে শুধু কালকের দিনটা। পরশু পরীক্ষা। তারপর কেন্সিংটন।”
“না রোহিত, অনেক ঝামেলা। আমি বইটা দিয়েই দেব। বদলে একটা ভালো বই নিয়ে নেব। মার্কেস বা সারামাগো, দুটোর দামই অনেক হবে। আর দুজনেই আমার খুব প্রিয় লেখক।”
“আমার মনে হয় সেটাই ভালো। তাও যদি তোমার সিদ্ধান্ত বদল করো, আমাকে বোলো। আর আমি যাব তোমার সঙ্গে যদি তোমার আপত্তি না থাকে।”
“না, আপত্তি কেন? আমি ওঁকে বলেই এসেছি।”
“গুড। কালকে পড়াশোনা করে পরীক্ষাটা দিই, আর ভেবো না বইয়ের কথা।
সকালবেলা উঠে আবার পড়া শুরু। দুজনে বসে আলোচনা করে পড়তে সুবিধা হয়। যেহেতু তাদের দুজনেই পড়াশোনায় ভালো, তাই বই দেখে পড়তে হচ্ছেই না। কিন্তু দুজনকেই বার বার সমস্যায় পড়তে হচ্ছে কথা বলাতে, কী করে রোগীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। সারাদিন ধরে দুজনে দুজনকে ঠিক করতে লাগল—এটা এভাবে নয়, ওইভাবে বলতে হবে। মন দিয়ে রোগীর সমস্যাটা শুনতে হবে। যত সময় যায় তত তারা দুজনেই চিন্তিত হয়ে পড়ে।
সাড়ে এগারোটা নাগাদ রোহিত বলল, “আমি একটু বেড়িয়ে আসি, আর পড়লে পাগল হয়ে যাব।”
কৌশিক জানালার পর্দা সরাতেই একটা আবছা রোদের আলো এসে পড়ল ঘরে। গত দশদিনে এই প্রথম। রাস্তার ধারে বরফগুলো থেকে যেন আলো ঠিকরে পড়ছে। ওদের বাড়ির উলটোদিকে একটা ছোটো পার্ক। তাতে অনেকগুলো বাচ্চা নানা রঙের জ্যাকেট আর টুপি পরে খেলছে, বরফ নিয়ে মারপিট করছে। কয়েকটা ছোটো লোমশ কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। এই প্রথম বাড়ি থেকে এত দূরে এই ঠান্ডায়, এই বন্ধুবান্ধবহীন দেশে কৌশিকের মনটা ভালো হয়ে গেল। সে বলল, “চলো, আমিও যাই।”
দুজনে তৈরি হচ্ছে যখন, তখনই বেলটা বাজল। ওরা জানে প্যাটেল আছে ঘরে, ওদের তো আর চেনাজানা কেউ নেই, প্যাটেলের কেউ হবে। দুজনে একটুও আগ্রহ দেখাল না দরজা খুলতে। প্যাটেলই দরজা খুলল। ওরা যখন বেরোচ্ছে তখন দেখল পোস্টম্যান। প্যাটেল সই করে একটা খাম নিল আর বলল, “শিওর, থ্যাঙ্কস।”
রোহিত প্যাটেলের দিকে তাকিয়ে বলল, “আঙ্কল, একটু হেঁটে আসছি।”
কৌশিক অবশ্য গিবসন সাহেবের সঙ্গে দেখা হবার পর আর কথা বলেনি প্যাটেলের সঙ্গে। প্যাটেল কি বুঝতে পেরেছে যে তারা জানে সবকিছু? গিবসন সাহেব একটুও চিন্তিত নন প্যাটেল সম্বন্ধে ওরা কী ভাবছে তাই নিয়ে। তাঁর প্যাটেলকে নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। তাঁর কাজ হয়ে গেলেই হল।
রোহিত একটু এগিয়ে পিছন ফিরে দেখল। তাদের বাড়ির দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। চাপা গলায় কৌশিককে বলল, “বাঁদিকে ঘোরো। কোনোদিকে তাকিও না।”
বাঁদিকে ঘুরেই ওরা লোকটাকে দেখতে পেল। পোস্টম্যান। কৌশিক জিজ্ঞেস করল, “কী হল আবার?”
রোহিত তাকে ইশারা করে থামতে বলে সোজা গটগট করে এগিয়ে গেল লোকটার দিকে,“এক্সকিউজ মি। কৌশিক একটা ইম্পরট্যান্ট চিঠির জন্যে ওয়েট করছে কাল থেকে। খুব আর্জেন্ট, মানে, ওটা কি এসেছে? কাল আমরা কেউ থাকব না বাড়িতে।”
পোস্টম্যান তার দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, “ঠিকানাটা কী, বলুন তো।”
রোহিত ঠিকানাটা বলতেই বলল, “এই তো দিয়ে এলাম পাঁচ মিনিট আগে। আপনাদের দেখলাম তো বেরোতে। সই করে নিয়ে নিলেন তো ভদ্রলোক।”
“মেনি থ্যাঙ্কস।” বলে কৌশিকের হাত ধরে রোহিত বলল, “কুইক, বাড়ি ফেরো।”
কৌশিক কথা না বাড়িয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল হনহন করে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে বাড়ির দরজায় পৌঁছে গেল তারা। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। কৌশিক বেল বাজাতে যাবে, রোহিত ইশারায় মানা করল।
বাড়ির পিছনে রান্নাঘরের দরজাটা খোলা ছিল। দুজনে পা টিপে টিপে ঢুকে গলা শুনতে পেল প্যাটেলের। দোতলায় কথা বলছে। দু-একটা কাটা কাটা কথা শুনতে পেল তারা—“ইয়েস, ইয়েস। … অ্যারাইভড … ওরা হাঁটতে গেছে।”
রান্নাঘর থেকে খুব সন্তর্পণে তারা বসার ঘরের দিকে গেল। টেবিলে খোলা খামটা রাখা আছে। রুপোলি রঙের বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ‘রয়াল মেল’। রোহিত একটুও শব্দ না করে খামটা নিয়ে দেখল উপরে কৌশিকের নাম। খুলতেই বেরিয়ে এল তার নীল রঙের পাসপোর্ট। কৌশিক আনন্দে উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, রোহিত ঠোঁটের উপর একটা আঙুল ধরে চুপ করতে বলল। তারপর রান্নাঘরের সে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল দুজনে।
বাইরে এসে রোহিত বলল, “ঠিক হয়েছে। তোমার পাসপোর্ট এখন তোমার কাছে। প্যাটেলের বিপদ হবে যখন দেখবে যে পাসপোর্ট লোপাট।”
এতদিন পরে দুজনে প্রাণ খুলে হাসল। পাসপোর্ট না পেয়ে প্যাটেলের কী দশা হবে সেটা তারা কল্পনা করেই দারুণ মজা পেল।
প্রায় ঘণ্টাখানেক বেড়িয়ে তারা আবার ফিরে এল। রোহিত বেরোনোর সময় খেয়াল করেছিল খামের উপরে কৌশিকের নাম লেখা। সেটা কৌশিকেরই সই করে নেওয়ার কথা, আঙ্কল কেন সই করে নেবে? এই কথাটা ভাবতে-ভাবতেই তার মাথায় এল, পাসপোর্ট। পাসপোর্ট ছাড়া আর কী আসবে? আর অন্য চিঠি হলে প্যাটেল লুকোবে কেন?
সামনের দরজায় বেল বাজাতে দরজা খুলল প্যাটেল নিজে। বসার ঘরে এসে কৌশিক আবিষ্কার করল যে খামটা নেই। আর প্যাটেল গোটা ঘরে যেন কী একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করল, “আঙ্কল, কিছু হারিয়েছে?”
প্যাটেল কেমন চমকে উঠে বলল, “না বেটা, কিছু তো হারায়নি। ইট ইজ ওকে।”
কিন্তু তারপর যতবার প্যাটেলের সঙ্গে তার দেখা হল সেদিন, ততবার প্যাটেলকে কেমন অন্যমনস্ক দেখাল। খাওয়ার টেবিলে সেই অন্যমনস্কতা দেখে রোহিত শুধু একটু মুখ টিপে হাসল।
৭
পরীক্ষার জন্য সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হল দুজনকে। কৌশিকের সঙ্গে কাঁধে নেওয়ার ব্যাগ। তাতে উমবের্তো একোর বইটা, কয়েকটা নোটস আর জলের বোতল।
কৌশিকের মনটা সকাল থেকেই খারাপ। তার সঙ্গে একটা তীব্র ভয়। যদি প্ল্যাব পরীক্ষায় পাশ না করতে পারে, তাহলে হয়তো তাকে দেশেই ফিরে যেতে হবে। আগের দিন অরিন্দমদাকে ফোন করে মোটামুটি গল্পটা বলেছে। শুনে অরিন্দমদাও একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে নিজেও মাত্র মাস আটেক আগে এসেছে। সব শুনে বলল, “দরকার হলে তাড়াতাড়ি ফোন করিস। আমার মোবাইল নম্বরটা মুখস্থ রাখ।”
কৌশিক অরিন্দমদার উপদেশ সবসময়ই বেশ গুরুত্ব দিয়ে শোনে। এটাও শুনল। কিন্তু অত সহজে কি একটা গোটা নম্বর মনে থাকে? একটা কাগজে লিখে পকেটে রেখে দিল।
পরীক্ষাটা মন্দ হল না। দুজনে মিলে অক্সফোর্ড স্ট্রিটে একটু ঘুরে, আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন নিয়ে সোজা কেন্সিংটন। দুজনে এসে সেই বিরাট বাড়িটার সামনে দাঁড়াল যখন, তখন ঠিক ছ’টা বাজে।
বেল টিপতে গ্রাহাম দরজা খুলে দিল। দৃশ্যতই বেশ খুশি হয়েছে ওদের দেখে,“স্যার লাইব্রেরিতে আছেন। কী নেবেন, কফি না চা?”
দুজনেই বলল, “কফি প্লিজ।”
পরীক্ষার টেনশনে মাথাটা একটু ধরে আছে। কফি খেলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।
লাইব্রেরিতে ঢুকে দেখল গিবসন সাহেব মন দিয়ে একটা বই পড়ছেন। দু-হাতে সাদা গ্লাভস। ওদের দেখেই উঠে দাঁড়ালেন,“প্লিজ কাম ইন। একদম সময় ধরে এসেছ। আমার পাংচুয়াল লোকদের খুব পছন্দ।”
কৌশিক বুঝতে পারল যে ভদ্রলোক মুখে যতই হাসি ধরে রাখুন, ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত অস্থির। তাই কথা বলছেন একটু বেশি।
“বইটা এনেছ কৌশিক?” সম্বিৎ ফিরল কৌশিকের গিবসন সাহেবের কথায়।
“ইয়েস।” ব্যাগ থেকে বার করে দিল কৌশিক। মোটা, সই করা, প্রায় নতুনের মতো চকচকে ‘আইল্যান্ড অফ দ্য ডে বিফোর’।
“হোয়াট ইস দিস? এটা কী? আমার বইটা কোথায়?” গিবসন সাহেবের সাদা গাল দুটো লাল হয়ে গেছে। গলায় একটা ভয়ংকর রাগের আভাস।
“এটাই তো আপনি চেয়েছিলেন!” কৌশিক প্রচণ্ড অবাক,“এটাই তো আমি কলকাতায় কিনেছিলাম।”
“এটা? এই বইটা আমি চেয়েছিলাম?” রাগে যেন ফেটে পড়বেন গিবসন সাহেব,“এই দুশো ডলারের বই নিয়ে আমি কী করব? এ তো আমি চাইলে নিজে গিয়েই সই করাতে পারতাম।”
“তাহলে?” কৌশিক বুঝতেই পারে না কী চাইছেন গিবসন সাহেব।
“আমার টেমার লেন কোথায়? আমার সঙ্গে চালাকি কোরো না কৌশিক।”
“টেমার লেন? ওই চটি কবিতার বইটার জন্যে এত ঝামেলা?”
“চটি কবিতার বই? ও-বই অমূল্য, জানো তুমি? কোথায় বইটা?”
“ওই তো, ওর মধ্যেই আছে।”
“না! এর মধ্যে নেই।” গর্জন করে উঠলেন গিবসন সাহেব,“ইয়ার্কি মেরো না কৌশিক, বইটা আমাকে বার করে দাও।”
“আমি সত্যি জানি না। ওর মধ্যেই তো ছিল। হয়তো আঙ্কল সরিয়েছে।”
“না, ওটা আমি সরিয়েছি।” হঠাৎ রোহিতের গলা শুনে দুজনেই চমকে উঠল,“সরি কৌশিক। তুমি সব ঘটনা বলার পর আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে বুঝতে পারি কোন বইটার জন্য তোমার এত ঝামেলা চলছে। বুঝে ওটাকে সেফ জায়গায় সরিয়ে রেখে দিই। বাড়িতেই আছে।”
“শেষ করে দেব একেবারে।” গলাটা খাদে নেমে গেছে গিবসন সাহেবের। প্রায় হিসহিস করে বলেন তিনি।
“ইয়েস, ইউ ক্যান ডু দ্যাট, কিন্তু বইটা পাবেন না। আর আমার নিজের দাদা থাকেন লিডসে। তিনি জানেন আমি কোথায় আসছি। আপনি রিস্ক নিয়ে দেখতে পারেন।” রোহিতের গলা শান্ত।
কৌশিক এই টানাপোড়েন আর সহ্য করতে পারছিল না। সে বলল, “আমি দিয়ে দেব বইটা। কিন্তু কী আছে এই বইটায়? কত দাম এটার যে আপনি হন্যে হয়ে খুঁজছেন এটা?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গিবসন সাহেব সোফাতে এলিয়ে বসলেন,“গুড ডিসিশন কৌশিক। এই বইটার একটা গল্প আছে। তোমাকে সংক্ষেপে বলি।”
তৈমুর লঙ রহস্য
“টেমার লেন বইটা জেরি পায় একটা পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে। দু-ডলারে সে এই সম্পত্তি হস্তাগত করে। সে আজ প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। তখনও সে জানে না কী সম্পত্তি সে পেয়েছে। অনেকগুলো চটি বইয়ের মধ্যে চল্লিশ পাতার এই চটি বইটাও ছিল। ভালো করে দেখে তো জেরির চোখ কপালে উঠেছে। বোস্টনিয়ান আর কেউ নন, বিখ্যাত আমেরিকান লেখক এডগার অ্যালান পোর ছদ্মনাম। বইটা তিনি লিখেছিলেন আঠারশো সাতাশ সালে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে। কল্পনা করতে পারো, আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং বিখ্যাত লেখকের এই বইটার অস্তিত্বের কথাই কেউ জানত না! এমনকি যখন এডগার অ্যালান পো পরে বলেন যে টেমার লেনই তাঁর প্রথম বই, কেউ বিশ্বাস করেনি। মাত্র চল্লিশ-পঞ্চাশ কপি ছাপা হয় আর তার বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে যায়। আঠারশো ছিয়াত্তর সালে প্রথামত আমেরিকা থেকে ব্রিটিশ লাইব্রেরির জন্য প্রচুর বই পাঠানো হচ্ছিল, তখনই আবিষ্কৃত হয় বইটা। বইটা যে ছাপানো হয়েছিল, এই প্রথম তা জানা গেল। পরের কপি আবিষ্কৃত হতে কেটে গেল আরও ষোলো বছর। সারা পৃথিবীতে এখন বারো কপি অবশিষ্ট আছে। ভাবতে পারো? মাত্র বারো কপি! এত রেয়ার হবার জন্যই একে আমরা বলি বইয়ের জগতে ‘ব্ল্যাক টিউলিপ’। পড়েছ কি ব্ল্যাক টিউলিপ? অ্যালেক্সান্ডার ডুমার অমর উপন্যাস। টিউলিপ যেমন কালো হয় না, অনেক কষ্ট করে কালো টিউলিপ তৈরি করতে হয়, এ বই ঠিক ততটাই রেয়ার! এমনকি এডগার অ্যালান পোর কাছেও কোনও কপি ছিল না। ভেবে দেখো একবার, লেখকের কাছেই তাঁর প্রথম বইয়ের কোনও কপি নেই!
“আমরা যারা বই সংগ্রহ করি, অর্থাৎ কালেক্টর, তারা তোমাকে অতি সহজে বলে দেবে কার কাছে কোন কপিটা আছে। মাত্র তিনটে কপি আছে প্রাইভেট কালেক্টারদের কাছে, বাকি সবই কোনও না কোনও লাইব্রেরিতে। বইটার দাম এখনও পর্যন্ত আমেরিকার বইয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। চার লাখ ডলার! চার লাখ ডলার, কৌশিক। তুমি হাঁ-টা বন্ধ করতে পার। এর আগে সবচেয়ে বেশি দামি বই বিক্রি হয়েছে আড়াই লাখ ডলারে, এই বইটারই অন্য কপি। শুধু তাই নয়, প্রতিটা কপি কার কার কাছে ছিল এ-খবরও আমাদের রাখতে হয় কৌশিক। কারণ তো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছ নিজেই। জেরি বইটা কিনে আমাদের জনা দশেক কালেক্টারদের ফোন করে বলে। যেদিন দুপুরে বইটা আবিষ্কার করে, সেদিনই জেরি মারা যায় অ্যাক্সিডেন্টে। আর বইটা চুরি যায় তার কাছ থেকে। চোর ধরা পড়ে, কিন্তু জানা যায় না কে তাকে বলেছে চুরি করতে। মামুলি চুরির দায়ে সে ধরা পড়ে। কিন্তু আমরা সবাই জানি বইটা কার কাছে আছে। তার নামটা ইম্পরট্যান্ট নয়, কিন্তু আমরা দশজন নিজের মতো করে বইটা খুঁজে চলি। আমাদের মিলিত সম্পত্তিতে আমরা বাইরের হেল্পও নিই।”
রোহিত জিজ্ঞেস করে, “কন্ট্রাক্ট কিলার?”
“শুনতে খারাপ লাগে, কিন্তু ঝামেলা কিছু নয়, ও-দেশে ব্যাপারটা সহজ অনেক। বন্দুক অনেক সহজেই পাওয়া যায়। মানে ধরো, সুপার মার্কেট থেকে চাল, ডাল, বন্দুক আর একটা ফুলকপি একসঙ্গেই কিনতে পারো। আমাদের মধ্যে একটা ভদ্রলোকের চুক্তি হল। যে পাবে বই, সেটা সে নিজের কাছেই রাখবে। লোকটাকে ফলো করতে করতে আমার এজেন্ট চলে আসে কলকাতায়। সেখানে চৌরঙ্গীর হোটেলে লোকটাকে সে খতমও করে, কিন্তু বই পায় না। আগেই চুরি হয়ে গেছে সে-বই। কিন্তু চোর অত্যন্ত মামুলি, তাই কলেজ স্ট্রিটে বেচে দেয় দাম না জেনে। কলেজ স্ট্রিটের সেই দোকানে গিয়ে আমার এজেন্ট বইটার সন্ধান পায়। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ আমার মনের তখন কী অবস্থা। এত কাছে সেই জুয়েল, সব বইয়ের সেরা বই, কালেক্টরদের স্বপ্নের মতো সেই বই! আমি ছটফট করছি। গ্রাহাম আমাকে নিরস্ত করল। হি আস্কড মি নট টু রাশ। এজেন্ট নিজের সাব-এজেন্ট, মানে তোমার সেই চাইনিজ লোকটিকে ডেকে পাঠাল তক্ষুনি। আর তার পরের গল্প তো তুমি জানোই। বইটা ট্রেস যখন আমি করেছি, ওটা আমিই নেব, নেবই, সেটাও নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারছ।”
সামনের গ্লাসটা থেকে একটু জল খেলেন তিনি। কৌশিক খুব আস্তে আস্তে বলল, “এত দামি বইটার বদলে আপনি আমাকে হাজার ডলারের একটা বই অফার করছিলেন! এটা কি ঠিক হচ্ছিল?”
“অ্যাবসল্যুটলি। তুমি যদি চাইতে, তোমাকে আমি দুটো বই-ই দিতাম। কিন্তু যদি ঠিক- বেঠিকের কথা বলো, তাহলে এটা বলাই ভালো, তুমি ও-বই নিজের কাছে রাখতে পারবে না। ওটা আমি নেবই। সুতরাং আমি কিছু না দিয়েও ও-বই পেতে পারতাম। কিন্তু আমার একটা সততা আছে বলেই আমি তোমাকে কিছু দিচ্ছিলাম।”
রোহিত একটু হেসে উঠল,“আপনাদের এই সততার নমুনা দেখে আমি মুগ্ধ মিস্টার গিবসন। বইটা কিন্তু কৌশিকের, সুতরাং কৌশিকের ডিসিশনই ফাইনাল।”
“বইটা তো আমার কাছে এই মুহূর্তে নেই, কিন্তু আমি আপনাকে দিয়ে দেব। এত দামি বইয়ের যত্ন আমি করতে পারব না।” কৌশিক বলল।
“যত্ন কী ছোকরা, তুমি ওর ইনস্যুরেন্সই দিতে পারবে না। এই বইয়ের প্রিমিয়াম কী হবে বুঝতে পারছ? কয়েক হাজার ডলার প্রতি মাসে।”
এটাও কৌশিকের খেয়াল ছিল না। সত্যি, অত টাকা সে পাবে কোত্থেকে? তার চেয়ে বইটা ভালো থাকলেই ভালো। কিন্তু আবার তার মনে হল যে বইটা তো তারই কেনা। সে ভালো করে রাখতে পারুক বা না পারুক, অন্য কারও সেটা দেখার কোনও অধিকার আছে কি?
কৌশিক বুঝতেই পারছে না কী করবে। এসব ব্যাপারে সে সবসময় যা করে এবারেও তাই করবে ঠিক করল। আরও সময় চাই তার ভাবার জন্য। কী করবে সে? বিনা বাধায় বইটা দিয়ে দেবে? সারাজীবন সে সেই দুঃখ নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে? আর এই লোকটা বইটা লাইব্রেরিতেও দান করবে না, সুতরাং জনগণের কোনও উপকার সে করছে না। আবার এই বই তার কাছে আছে, এ-খবর অনেক কালেক্টরই জানে এখন। তার জীবন বিপন্ন হতে পারে এই জন্য। সে শান্ত গলায় বলল, “মিস্টার গিবসন, আমি বাড়ি গিয়ে বইটা নিয়ে আসব, আপনাকেই দিয়ে দেব। সত্যিই এর ইনস্যুরেন্স করার ক্ষমতাই আমার নেই।”
“দারুণ। গ্রাহাম, এদের সঙ্গে দুজন লোককে দিয়ে দাও যেন চোখের আড়াল না হয়। কোনোরকম চালাকি করলে শেষ করে দিও। তারপর আমি ওই বাড়ি থেকে বইটা নিয়ে নেব।” গিবসনের গলা এক্কেবারে শান্ত।
এবার রোহিত জিজ্ঞেস করল, “একবার এমার সঙ্গে দেখা করা যাবে?”
“এমা? সে এখানে কী করবে? তার কাজ ছিল তোমাদের এখানে পৌঁছে দেওয়া। তার জন্য রীতিমতো টাকা পেয়েছে সে।”
কৌশিক আর রোহিত বাইরে এল। অন্ধকার হয়ে গেছে তখন। সামনেই টিউব স্টেশন। দুজনে সামনে হাঁটছে আর তাদের কিছুটা পেছনে যে দুজন বেশ লম্বাচওড়া ব্রিটিশ লোক, তারা সশস্ত্র। টিউবে টিকিট কেটে দুজন উঠল। লোক দুটোও উঠল। ট্রেন চলছে, স্টেশন আসছে মিনিট দুয়েক পরপর, লোকে উঠছে নামছে। দুটো স্টেশন পেরিয়ে এবার ভিক্টোরিয়া স্টেশন। কৌশিক হঠাৎই হাতে একটু চাপ অনুভব করল। রোহিতের দিকে তাকাতেই রোহিত চাপা গলায় বলল, “দরজা খোলার পর তিন অবধি গুনবে, তারপর তাড়াতাড়ি নেমে যাবে।”
কৌশিক কোনও কথা বলল না। ভিক্টোরিয়াতে ট্রেন দাঁড়াল। কৌশিক ঠিক তিন সেকেন্ড গুনে আচমকা দৌড়ে দরজা দিয়ে নেমে গেল, পাশে রোহিতও। লোক দুটো ওদের পেছনে নামতে যাবে, কিন্তু দরজার সামনে অন্য লোকেদের আচমকা জটলায় আটকে গেল।
ট্রেনের দরজাটা বন্ধ হয়ে ট্রেন চলতে শুরু করল। জানালা দিয়ে লোক দুজন ওদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
“নামার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার পা মাড়িয়ে দিয়ে এসেছিলাম।” কৌশিক খুব শান্ত গলায় বলে।
“জেনে, না না জেনে?”
“জেনে।”
“গুড। ভালো বুদ্ধি। ওই জন্যেই ওরা নামতে পারল না।”
“এবারে বলো, নামতে বললে কেন?”
“দুটো কারণে। এটা রাখো।” বলে সাদা কাগজে মোড়া টেমার লেন কৌশিকের হাতে তুলে দেয় রোহিত।
“মানে!” কৌশিক অবাক,“তুমি এটা নিয়ে সিংহের গুহায় ঢুকেছিলে?”
“হ্যাঁ!” যেন অবাক হয় রোহিত,“বাড়িতে রেখে গেলে আর পেতে না। এত দামি বই!”
কৌশিক সত্যি আবার অবাক হয়। রোহিত ইচ্ছে করলে বইটা তাকে না দিতেই পারত। এই লোভ সামলানো রীতিমতো কঠিন। রোহিত বলে চলে, “আমরা এখান থেকে বাসে করে যাব। ওরা নিশ্চয় ট্রেনের দিকে নজর রাখবে।”
ভিক্টোরিয়া বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দুটো টিকিট কাটল তারা। রোহিত যাবে লিডস আর কৌশিক এডিনবরা হয়ে যাবে পার্থ। অস্ট্রেলিয়ার পার্থ নয়, স্কটল্যান্ডের পার্থ। সেখানেই অরিন্দমদার বাড়ি।
সারা রাতের জার্নি। বাস ছাড়তে আর মিনিট পনেরো দেরি। সামনের ফোন বুথে গিয়ে রোহিত ওর দাদাকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে সে আজ রাতেই পৌঁছবে। আর কৌশিক অরিন্দমদাকে। সংক্ষেপে বলতেই অরিন্দমদা বলল, “তুই চিন্তা করিস না। আমি প্যাটেলের কাছ থেকে তোর স্যুটকেস আনার ব্যবস্থা করছি।”
রোহিত সঙ্গে সঙ্গে বলল, “তোমার দাদা যদি আমার মালপত্রটাও কালেক্ট করে নেয়, তাহলে সত্যি খুব ভালো হয়।”
অরিন্দমদাকে বলতেই অরিন্দমদা রাজি হয়ে গেল। অরিন্দমদার এক বন্ধু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে কাজ করে। তাকে সঙ্গে গিয়ে নিয়ে আসবে সে। আজ রাতেই প্লেনে আসবে অরিন্দমদা আর কাল সকালেই ফেরত যাবে।
বাস ছেড়ে দিল কৌশিক এসে বসতেই। মিনিট দশেক বাদেই রোহিতের বাস ছাড়বে। দুজনে ফোন নম্বর নিয়ে নিয়েছে। রাত ন’টার পরে বাসের আলোগুলো নিভিয়ে দেওয়া হল। বেশিরভাগ লোক ঢুলছে। মাঝরাত নাগাদ ম্যানচেস্টারে বাস দাঁড়াল। কফি ব্রেক। লোকে টয়লেট যাওয়া বা কফি, এমনকি কেউ কেউ বার্গার দিয়ে ডিনার পর্যন্ত সেরে ফেলল। কৌশিক একটা কফি নিল। এই ঠান্ডায় গরম কফি দারুণ লাগল। দু-হাত দিয়ে সে কফির কাপটা ভালো করে ধরল। কাপের ওমটা হাতের তালুতে নিয়ে সে বাসে এসে বসল, অন্তত ভিতরে হিটিং চলছে, গরম রয়েছে। হঠাৎ বাইরে তাকাতেই তার গা হিম হয়ে গেল। একটা লোক একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। চোখাচোখি হতেও চোখ সরাল না লোকটা। কৌশিক বুঝতে পারল যে সে ধরা পড়ে গেছে। এবার আর তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
৮
বাস ছাড়ল সেখান থেকে মিনিট পনেরো পর। লোকটা কিন্তু উঠল না বাসে। জায়গাও ছিল না। পরের স্টপ সকালে এডিনবরায়। সকাল ছ’টায় এডিনবরায় এসে দাঁড়াল বাসটা। এখানে বাস স্ট্যান্ডকে বাস স্টেশন বলে। কৌশিক ভয়ে ভয়ে জানালা দিয়ে তাকাল এবং আবার সে লোকটাকে দেখতে পেল। তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। কৌশিকের আর মাথা কাজ করছে না। একবার ভাবল নেমে যাবে। কিন্তু লোকটা তো সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। আরও লোক থাকাও অস্বাভাবিক নয়। ওরা গাড়িতে করে এসেছে। হয়তো বাসের পিছন-পিছনই এসেছে। যা থাকে কপালে, কৌশিক ভাবল। আগে গিয়ে তো পৌঁছাই অরিন্দমদার বাড়ি, তারপর দেখা যাবে। এডিনবরা থেকে পার্থ যেতে হলে একটা বিশাল ব্রিজ পেরোতে হবে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে সে-ব্রিজ, ফোর্থ রোড ব্রিজ। ফোর্থ মানে চতুর্থ নয়, নদীটার নামই ফোর্থ। পাশেই রেল ব্রিজ। সেটা দেখেই কৌশিক চমকে উঠল। এই ব্রিজটা তো সে জেমস বন্ডের সিনেমায় দেখেছে! ‘থার্টি নাইন স্টেপস’ বলে একটা সিনেমা হয়েছিল, তাতেও। কী আশ্চর্য! এই সেই ব্রিজ! রোড ব্রিজের ঠিক মুখটাতে বাস দাঁড়িয়ে গেল। কী ব্যাপার? ব্রিজ বন্ধ, ফাটল ধরেছে ব্রিজে। আজ সকাল থেকে আগামী মাস তিনেক বন্ধ থাকবে। সে আবার কী? এরকম তো কলকাতায় কখনও দেখেনি সে। তাড়াতাড়ি জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখল একটা রুপোলি হন্ডা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে তাদের বাসের পাশের লেনে। আর এবার সে দেখতে পাচ্ছে লোকগুলোকে। কালকের লোক দুটো তো আছেই, আরও দুটো লোক আছে। এবারে কৌশিক বাস থেকে নেমে পড়ল। লোকগুলোও। সকাল প্রায় সাতটা বাজে, কিন্তু আকাশ এখনও পরিষ্কার হয়নি তেমন। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। কৌশিক নিজে জানে না কেন নেমে পড়ল, হয়তো ভয়ে। নেমে সে ব্রিজের দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করল। সঙ্গে-সঙ্গেই গাড়ি থেকে নেমে লোক চারজন নেমে তার পিছনে দৌড়াতে আরম্ভ করল। কিন্তু ততক্ষণে কৌশিক অনেকটাই এগিয়ে গেছে। প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছে কৌশিক আর লোকগুলো কিছু পয়সার লোভে বইটাকে কেড়ে নেবে বলে দৌড়াচ্ছে। সেজন্যই হয়তো তাদের মধ্যেকার দূরত্ব বেড়েই চলেছে। কৌশিক ব্রিজের মাঝামাঝি গিয়ে কৌশিক দেখতে পেল ব্রিজের অন্যদিক দিয়ে গিবসন সাহেব, গ্রাহাম আর আরেকজন আসছে।
“কৌশিক, এবার বইটা আমাকে দিয়ে দাও প্লিজ।”
কোনও কথা না বলে কৌশিক বইটা বার করে দিল ব্যাগ থেকে। এগিয়ে দিল গিবসন সাহেবের দিকে। তার এখন কোনও ইন্টারেস্ট নেই টাকার উপর, বইটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার দুঃখই বড়ো হয়ে উঠেছে। হঠাৎ গ্রাহাম ছিটকে আসে তার দিকে। বইটা হাতে নিয়ে নেয়। তার হাতে রিভলভার, ছোট্ট কালো রঙের,“কেউ এক পা এগুবে না। এটা আমার। এর জন্যে আমাকে জেরিকে খুন করতে হয়েছে। আরও এক-দুটো করতে আমার কোনও অসুবিধে হবে না।”
“গ্রাহাম!” গিবসন সাহেব চিৎকার করে ওঠেন,“জেরিকে তুমি…”
“ইয়েস, আমি। ওটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়। ওকে মেরে গাড়িটা গড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমাকে ও বইটা দিতে চায়নি। এবারে তোমাদের অবস্থাও একইরকম হবে। তার চেয়ে আমাকে যেতে দাও। কথা দিচ্ছি কারও কোনও ক্ষতি হবে না।”
“গ্রাহাম,” গিবসন সাহেব ঠান্ডা গলায় বলেন, “তুমি রাখতে পারবে ওটা? মনে রাখবে আমরা দশজন আছি।”
“সেটা আমার উপর ছেড়ে দিন মিস্টার গিবসন। আমাকে কিছু করার আগেই আমি বেচে দেব বইটা, আপনারা হদিসও পাবেন না।”
“গ্রাহাম,” গিবসন সাহেব বলে চলেন, “যদি অন্য কালেক্টররা জানতে পারে যে তুমি এইরকম বেইমানি করেছ, তুমি বেঁচেই থাকবে না।”
“আবার বলছি মিস্টার গিবসন, সেটা আমাকেই ভাবতে দিন।”
কৌশিক ভাবছিল কী ব্যাপার, গিবসন একই কথা বার বার বলছে কেন? ঘাড় ঘোরাতেই সে দেখতে পেল আধো অন্ধকারে একটা লোক সন্তর্পণে গ্রাহামের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। যে লোকগুলো তাকে লন্ডন থেকে ধাওয়া করেছিল তাদেরই একজন। সে বুঝল যে মিস্টার গিবসন সময় নষ্ট করছেন শুধু যাতে এই লোকটা আক্রমণ করতে পারে গ্রাহামকে।
আচমকা আঘাতের জন্য গ্রাহাম প্রস্তুত ছিল না। লোকটার প্রচণ্ড ঘুসি যখন তার ঘাড়ে পড়েছে সে ঠিক তিন-চার পা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো। আর ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা। বইটা তার হাত থেকে ছিটকে চলে এল ব্রিজের একবারে ধারে আর রিভলভারটা সোজা নীচে নদীতে। যেখানে ব্রিজের ফ্রেমটা একটু ফাঁকা আর নীচে নদীটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওই আধো অন্ধকারেও, সেইখানে পড়ে আছে বইটা। গ্রাহাম সেটা দেখতে পেয়েই নিজেকে সামলে দৌড়ে বাঁচাতে গেল বইটা। কৌশিক ওই হতভম্ব অবস্থাতেও চেঁচিয়ে উঠল, “কেয়ারফুল!”
শেষ মুহূর্তে বইটা ধরতে যাবে গ্রাহাম, তার পা-টা পিছলে গেল ব্রিজ থেকে। ওই ছোটো ফাঁক থেকে বইটা আর গ্রাহাম দুজনেই সেই অন্ধকার কালো জলে অদৃশ্য হয়ে গেল। নীচে তাকিয়ে দেখল কৌশিক, কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। গিবসন সাহেব মাথা ঝাঁকিয়ে শুধু বললেন, “বইটা নষ্ট হয়ে গেল।”
একই স্বর শুনতে পেয়েছিল কৌশিক যখন গিবসন সাহেব চিনে লোকটা খুন হবার খবর পেয়েছিলেন। তাঁর কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে বইয়ের দাম অনেক বেশি।
“মিনিট পাঁচেক হয়ে গেছে, এবারে পুলিশে ফোন করি। এতক্ষণে যা হওয়ার নিশ্চয় হয়ে গেছে। এই ব্রিজ থেকে পড়ে গিয়ে বাঁচা অত্যন্ত কঠিন।”
ব্রিজের মাঝখানে একটা হলুদ ফোন রাখা আছে, রিসিভার তুললেই পুলিশ অফিসে রিং হবে।
“হ্যালো, আই ওয়ান্ট পুলিশ প্লিজ। ইয়েস অফিসার, আমার নাম ডেভিড গিবসন। আমার এক বন্ধু ফোর্থ রোড ব্রিজ থেকে লাফিয়ে সুইসাইড করেছে এক্ষুনি। প্লিজ তাড়াতাড়ি আসুন। আমরা সাতজন এখানে ওকে আটকানোর চেষ্টা করছিলাম… হ্যাঁ, ডিপ্রেশনের হিস্ট্রি আছে। ও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অফিসার।”
৯
বছর পাঁচেক পর।
ঠিক বারোটা নাগাদ অরিন্দমদার কালো জাগুয়ার গাড়িটা আমার বাড়ির সামনে দাঁড়াল। রবিবার, চমৎকার রোড উঠেছে সকাল থেকে, বেশ গরমও। প্রায় পঁচিশ ডিগ্রি তাপমান। স্কটল্যান্ডে এটাই গ্রীষ্মকাল। সকালেই অরিন্দমদা ফোন করেছিল,“কী রে শুভায়ু, বাড়ি আছিস নাকি?”
“হ্যাঁ, আজ কাজ নেই দাদা। কী খবর?”
“শোন, আমারও কাজ নেই আজ, তোর ওখানে আসছি।”
“চলে এসো, বারবিকিউ করব। আমরা রেডি করছি, তুমি এসো।”
“আমরা তো আসছি। বাড়িতে কৌশিক এসেছে, জুনিয়র। তোর মনে আছে কি? ওকেও নিয়ে আসছি।”
“কোনও প্রবলেম নেই, প্রচুর চিকেন আছে, ল্যাম্ব আছে, ভুট্টা আছে, কাবাবও করা যাবে চমৎকার। সঙ্গে স্বাস্থ্যকর স্যালাডও আছে।”
“স্যালাডটা তুই খা আর আমার জন্যে চিকেন আর ল্যাম্ব রেখে দে।”
“ঠিক আছে, তুমি এসো তো।”
“আরে আধঘণ্টা লাগবে এখান থেকে। সাড়ে এগারোটায় বেরোলেই হবে। তারপর তো সারাদিন খাওয়াদাওয়া হবেই।”
“ঠিক আছে।”
বাগানে কাঠের বেঞ্চে বসে খেতে খেতে এই গল্প হচ্ছিল। আমার সঙ্গে কৌশিকের দেখা মেডিক্যাল কলেজ ছাড়ার পর এই প্রথম। ওর কাছ থেকে পুরো গল্পটা শুনলাম। আমি এক্কেবারে অবাক,“বলিস কী কৌশিক! তুই টেমার লেন হাতে ধরেছিস? এর কপি আছে আমেরিকার লিলি লাইব্রেরি, হান্টিংটন লাইব্রেরি, বারগ কালেকশন আর অলডারম্যান কালেকশনে। হাতে ধরার নিয়ম নেই। খুব বিখ্যাত লোকের রেকমেন্ডেশন ছাড়া দেখায় পর্যন্ত না।”
অরিন্দমদা হাসতে হাসতে বলল, “কী রে শুভায়ু, তোরও তো বইয়ের শখ, দেখেছিস তো, কী হয় কালেক্টরদের অবস্থা।”
“ঠিক বলেছ অরিন্দমদা,” আমি বললাম, “গিবসন আজ প্রায় চার বছর হল মারা গেছে। শেষের দিকে মাথাটা একটু খারাপ হয়ে যায়, শুধু বলত আই মিসড ইট। তখন বুঝিনি কী মিস করছে। এখন বুঝলাম।”
“তুমি চিনতে নাকি গিবসনকে?” কৌশিক জিজ্ঞেস করে।
“না রে, চিনতাম না। তবে আমরা কালেক্টররা মোটামুটি খবর রাখি বাকি কালেক্টরদের। এক সেকেন্ড অরিন্দমদা, আমার সঙ্গে একটু উপরতলায় এসো। কৌশিক তুই একটু সাবান দিয়ে ভালো করে হাতটা ধুবি?” আমার হঠাৎই একটা কথা মনে পড়েছে।
“হা হা হা। এই রে, তুইও তো গিবসন-ব্যাটার মতো করছিস। আমাকে একটা ভালো মুরগির রোস্ট দিয়ে তোরা উপরে যা।” অরিন্দমদা মজা করে বলে।
কৌশিক বিনা বাক্যব্যয়ে হাতটা ধুয়ে ভালো করে মুছে আমার সঙ্গে উপরতলায় আসে, আমার লাইব্রেরিতে। সেখানে বাঁদিকের আলমারি থেকে একটা সাদা গ্লাভস ওকে পরতে দিলাম। গ্লাভস পরার পর ওকে একেবারে চমকে দিয়ে আমার আলমারির থেকে আমার সবচেয়ে প্রিয় বইগুলোর একটা ওকে বার করে দিলাম। কমলা রঙের খাঁটি মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো ‘দ্য জেনের্যাল ইন হিজ ল্যাবিরিন্থ’—গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেসের অমর সৃষ্টি, সই করা, সাড়ে তিনশো কপির একশো পঁচাত্তর নম্বর কপিটা, যেটা বিলেতের সেই বিয়ান্ডোপ্যাঢি, থুড়ি, বন্দ্যোপাধ্যায় কিনেছিল।
ভেতরের অলঙ্করণ- অর্ক পৈতণ্ডী। শীর্ষচিত্রে মূল বইটির ছবি-লেখক কর্তৃক সংগৃহীত