বাংলার মুখ -আগের লেখা –পিসির বাড়ি, মকর সংক্রান্তি ও আলুর দম মেলা , মকরসংক্রান্তির পরব ভেজা বিঁধা
ঘুম ভাঙত খটখট শব্দে… এই শব্দটার সাথে বর্তমান প্রজন্মের হয়তো তেমন পরিচয় নেই কিন্তু আমরা জানতুম এটা শিলনোড়ার শব্দ। আজ বৈশাখ বার। ভোরবেলা থেকে শিলে নিম- হলুদ পেষা শুরু হয়েছে।
নিমের নরম তিতকুটে গন্ধটা এলোমেলো দখিন হাওয়ায় ভর করে ঘুরে বেড়াত ঘরের আনাচ-কানাচ।
ওদিকে ঠাম দিদির স্নান হয়ে গেছে। কোনোমতে মুখ হাত ধুয়ে উঠানে নামতুম। বছরকার গোলাঘরের পুজোটা দিদিমা-ই দেন। ঝিমা মানে ঠাম দিদির শ্বাশুড়ি মা বড় বউ এর হাতে নোয়ার সাথে এই স্বত্ত্বটুকু তুলে দিয়ে গেছেন হাতে ধরে। আজ ঠাকুরঘর সামলাবেন মা আর জেঠি -খুড়িরা। ঠাম দিদি বলতো, “গোলা লক্ষ্মীর ঠাঁই, তিরুটি হলেই চিত্তির। তোরা ছেলেমানুষ মা পারবি না অতশত। “
বছরে এই একদিন আর লক্ষ্মী পূজার দিন ঠামদিদি পায়ে আলতা আর গরদের শাড়ি পরতেন। ভারী সুন্দরী লাগতো দিদিকে।
আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখতুম, সদ্য পাট ভাঙা গরদের শাড়িখানা ফুলে ফেঁপে আমাদের শীর্ণকায় দিদিকে আড়ে বহরে দ্বিগুণ করে দিয়েছে। এলোচুলে আলগোছে খোঁপা মেথি গন্ধ, ট্রাঙ্ক বন্দী শাড়ির কর্পূর – কষ্টিক গন্ধ, সদ্য নিকোনো গোলা বারান্দার গোময়ের গন্ধ— সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত আবেশ।
আলতা সিঁদুর গুলে ভারী সুন্দর করে মাঙ্গলিক আঁকতেন দিদি। এই মাঙ্গলিক দেখার জন্য আমাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে যেত কেউ বলত, “ও দিদি মাথাটা একটু বেশি গোল হয়ে গেল না।” আবার কেউ বলত, “ও দিদি পা-টা একটু সরু লাগছেনা” ইত্যাদি… তারপর দিদি কপট রাগ দেখিয়ে বলতেন,” তোরা যা দিখি আমি প্রসাদ হলে তোদের ডাকব।”
এরপর আমরা ছুটে যেতাম পুকুরপাড়ে। জানতুম পুকুরপাড়ে আজকে ভারি উৎসব। ধানের কুড়া, তুঁষ ছড়ানো হবে। পুকুর জুড়ে ছোট বড় কতরকম বৃত্ত। দাদু বলতেন ওরা হল পুকুরের ফসল। আজ ওদের পুষ্টি দেবে। আজ জাল ফেলতে নেই বাপধনেরা। মনে রাখবে, এরা সবাই চাষির ঘরের জানকী। এদের কখনো অনাদর করবে না।
তারপর আমাদের হাত ধরে নিয়ে যেতেন গোয়ালে সেখানে তখন দুলে পাড়ার রাখালরা প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজ গোদিগে স্নান করানো হবে৷ খড়ের নুটি আর মোলায়েম চাঁচা মাটি দিয়ে ঘষে ঘষে পরিস্কার করা হবে ওদের গা। গোয়ালের ঝুল দিয়ে পরিস্কার করা হবে জিহ্বা। তারপর তকতকে নিকোনো মেজলায় ফ্যান, খড় দিতে প্রস্তুত করা হবে জাবনা। ধুনুচিতে জ্বালিয়ে দেওয়া হবে অগুরু আর ধুনো। বড় দাদু এসে গলকম্বলে চুলকে দিয়ে বলবে- “খা’রে বেটি। আজ তোর বাপ সাধ্যমতো থালা সাজিয়েছে।” বুধনি, শমু, কুলি, ধবলীরা বুঝতে পারে কিনা জানি না, তবে শিং নেড়ে মুখ ডোবায় মেজলায়। অন্যথা হয় না কোনওবারেই।
এরপর নাচতে নাচতে আমরা ছুটতুম রান্নাঘরে। অনেকক্ষণ ধরে ঘি আর মধুপাকের গন্ধ পাক মারছে। যেতে চাইতুম না কারণ গেলেই মা-জেঠিরা হাঁই হাঁই করে উঠতো। আসলে আমরা খুব শান্ত ছিলুম কিনা… তো যাইহোক সেখানে তখন মহা হইহই। আজকের দিনে প্রাণী হত্যা করা হয় না।আজকে নিরামিষ রান্না হবে। অথচ সমস্ত হালি, রাখাল, নিত্যকার কাজকর্মের সহকারীরা আজ পাত পেড়ে খাবেন। তাই আয়োজন বিস্তর~
ডগমগে লাউ শাক দিয়ে পোস্ত। এলাচ, দারচিনি , ঘি আর নারকোল এর সান্তাল দেওয়া ঘন করে মুগের ডাল। তালুর ন্যায় লম্বা মুক্তকেশী বেগুন ভাজা। চাটিম কলার মোচাঘণ্ট। কুমড়ো-ছানার মিষ্টি কতাই আর চামরমণি চালের পায়েস আর ঘরে তৈরি মধু দেওয়া দানাদার, আমাদের মধুপাক।
খাওয়া শেষে দাদা সবার হাতে একখানা করে দশটাকার নোট আর দোক্তা পান দিতেন…. এই একদিন আমরাও পান খেতে পেতুম অবশ্য দোক্তাতামাক ছাড়া।
আজও যাই কখনও, আড়ম্বরহীন থমথমে সকাল। ভাঙা সিংহ দরজা পেরিয়ে বৈঠকখানার সামনে থমকে দাঁড়াই। বামপাশে গোয়লঘরটা কোনো এক শরিকের শাড়ির গোডাউন।
দু’ধাপ পেরিয়ে উপরে উঠি। দাদা-দিদিরা দেওয়ালে স্থির, নিস্পন্দ হয়ে বসে থাকেন। এলোমেলো দখনো হাওয়া আসে খটখট শব্দ হয়। শিলনোড়া নয়, দেওয়ালে বাড়ি খায় ফুল, মালা, চন্দন চর্চিত ফোটো ফ্রেমগুলি।।