ভ্রমণ আজটেকদের দেশে(৪)-মলয় সরকার-বসন্ত ২০২২

আগের পর্ব–> পর্ব-১ পর্ব -২, পর্ব- ৩

bhroomonaztektitle

এই যোকালোর অঞ্চলটাকে বলে সেন্ট্রো হিস্তোরিকো। এত বড়ো খোলা জায়গা দেখে আমি আশ্চর্য। এখানে প্রায় এক লক্ষ মানুষ জমায়েত হতে পারে। আর এই সেই জায়গা, যেখানে ছিল আজটেকদের পুরানো সাম্রাজ্যের রাজধানী টেনোচটিটলান (Tenochtitlan)। সেটিকে স্পেনীয় বিজেতারা নির্মমভাবে ধ্বংস করে তার রাজত্বেরই উপরে তৈরি করেছে আজকের মেক্সিকো শহর, যার নাম দিয়েছিল নিউ স্পেন। আজকের অনেক বাড়িঘরও সেই সমস্ত ধ্বংস করা ঘরবাড়ির জিনিসপত্র ও মশলা দিয়েই তৈরি।
এখানকার অনেক বাড়িই ঐতিহাসিক এবং জায়গাটিকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আর প্যালেসটিকে বলে প্লাজা ডে লা কন্সটিটিউশন। এটিই আজটেক রাজত্বের রাজাদের মূল শাসনকেন্দ্র ছিল। এখানে আজ যা আছে তা প্রধানত দ্বিতীয় মন্টেজুমার ষোড়শ শতাব্দীর জিনিসপত্র।

bhromonaztec01এই প্রাসাদের ঐশ্বর্য দেখে স্পেনীয় বিজেতা নেতা হার্নান কর্টেস চমৎকৃত হন। এর অনেক কিছুই ধ্বংস করা হয়। আমরা তো যোকালোর চত্বরের মধ্যে দিয়ে যেতে পারলাম না। সোজাসুজিও যেতে পারলাম না, ঘুরে ঘুরে পাশ দিয়ে গিয়ে পিছন ঘুরে গেলাম রাজপ্রাসাদে বা ন্যাশনাল প্যালেসে। প্রথমে পড়ল প্যালেস মিউজিয়াম। সেখানে প্রদর্শনী মূল্য নেই। তবে সমস্ত কিছু, এমনকি টুপি পর্যন্ত জমা রেখে তবে যেতে হল ভিতরে। এটি প্রাসাদের একপাশে। বর্তমান প্রাসাদ-দর্শক পথের মূল দরজার পাশে। এখানে বেশ কিছু জিনিসপত্র আছে। তবে চিন, জাপান, মিশর প্রভৃতি দেশের বিভিন্ন গ্যালারি বা ঘর আছে। এখানে সব জায়গায় দেখেছি, যে-কোনো দর্শনীয়গুলো বেশিরভাগই স্প্যানিশ ভাষায় বর্ণিত। কেন রে বাবা, স্প্যানিশ ছাড়া কি অন্য ভাষাভাষীরা বা অন্য দেশের মানুষ আসবে না! নিদেন ইংরাজিতে তো লিখতে পারত। তা নয়। ইংরাজিতে না হওয়ার জন্য অনেক কিছুই আন্দাজ করে নিতে হয়, ভাষা না জানার জন্য। সঠিক জানা হল না। পরে এটা অনেক জায়গাতেই আমাদের ভুগিয়েছে। এর আগে চিনেও এই জিনিস আমরা দেখেছি। এটা কেন যে দেশের সরকারি আমলারা বোঝেন না! স্বাদেশিকতা ভালো, কিন্তু দেশের পর্যটনক্ষেত্রগুলোতে তো অন্তত ইংরাজি রাখতেই পারে। যাক, এখানে বেশ কয়েকটি দেশের গ্যালারি দেখে মনে হল, আমার মতো যারা অন্যান্য দেশ ঘুরে সেই দেশের নিজস্ব মিউজিয়াম দেখেছি সেখানে এই দেশে এসে অন্য দেশের জিনিসপত্র দেখার কোনও মানে হয় না। ভেবেছিলাম এখানকার রাজপ্রাসাদের মিউজিয়াম, স্থানীয় প্রাচীন জিনিসপত্রে ভর্তি থাকবে, তা নয়। আসলে, তা থাকবে কী করে! স্পেনীয়রা তো বিজয়ের পর নির্মমভাবে সমস্ত কিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। পুরানো বিশেষ কিছু জানার উপায় রাখেনি। তাই সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে এলাম।
এখান থেকে বেরিয়ে পাশেই মূল প্রাসাদের দর্শক দরজায় গেলাম। এখানে প্রত্যেককে চেক করে পরিবার পিছু একটা অন্তত আইডেন্টিটি কার্ড, পাসপোর্ট জমা রেখে, সমস্ত জিনিসপত্র জমা রেখে ঢুকতে দিচ্ছে। আমার অবশ্য এটাকে বেশ রাজপ্রাসাদ বলে মোটেই মনে হয়নি। রাজপ্রাসাদ মানে প্রথমেই মনে হয়, অন্তত কুচবিহারের রাজপ্রাসাদের মতো হবে। তা নয়, হাবভাবে এটা অনেকটাই আমাদের রাইটার্স বিল্ডিং-এর মতো। রাস্তা থেকে শুধু চারপাশে পাশাপাশি প্রচুর জানালাওলা একটা বিরাট বাড়ি। তেমন বৈচিত্র্য নেই। তবে রাজকীয় ব্যক্তিদের জন্য প্রবেশ পথ সামনের অর্থাৎ যোকালোর দিক। আর অন্য সবার জন্য একপাশে।
এই সেই প্রাসাদ, যেখানে মন্টেজুমা (২য়)-র প্রাসাদ ছিল এবং যার তৈরির মালমশলা অনেকখানিই সেই প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ থেকে আহরিত। এর ধনবৈভব দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে গিয়েছিলেন স্প্যানিশ বিজয়ী হার্নান কর্টেস। ঢুকেই একটা ছোটো চত্বর, সেখানে কিছু গাছগাছালি ও ছোটো বাগানমতো আছে। কোনও বিশেষত্ব বা নজর কাড়ার মতো কোনও চাকচিক্য নেই। বাড়িটি ত্রিতল এবং ঢংটি সেই একই, চারধারে ঘর ও মাঝে ফাঁকা চাতাল। তবে এখানে ঘরের সংখ্যা প্রচুর। সমস্তরকমের কর্মচারী, অফিস, মিটিং, রাষ্ট্রপ্রধানদের বাসগৃহ সবই ছিল এখানে। ফলে ঘরের সংখ্যাও প্রচুর। এখানকার সমস্ত অফিস, বাড়ি সবকিছুতেই এক ঢং। পরবর্তীকালে ভাইসরয় বারনার্দো গ্যালভেজ-এর পছন্দ হয়নি এই সবকিছু অফিস, কর্মচারীদের সঙ্গে থাকা। তিনি তাই তাঁর বাসভবন কিছু দূরে নির্জনে চিপুলটেক পাহাড়ের মাথায় চিপুলটেক দূর্গে স্থানান্তরিত করেন। সেটা ১৭৮৫ সাল। অবশ্য এর আগে ১৬২৪ সালে ধর্মপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানের বিরোধে এটিতে অগ্নিসংযোগ করা হয় ও পরে প্রায় সম্পূর্ণ ভস্মীভূত ও নষ্ট করা হয়। এর পর যখন পুনর্নির্মাণ করা হয় ১৭১১ সালে, তখন এর আমূল পরিবর্তন করা হয়। তারপর স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত বিশেষ কিছু পরিবর্তন করা হয়নি। এখানেই প্রধান প্রবেশ পথের মাথার উপরে রাখা আছে সেই বিখ্যাত ঘণ্টা (The Dolores Bell) যা স্বাধীনতা উপলক্ষ্যে মিগুয়েল হিডালগো নিজে বাজিয়েছিলেন।

bhromonaztec02

তার ঠিক নীচেই সেই ব্যালকনি যেখান থেকে দাঁড়িয়ে ১৫ই সেপ্টেম্বর মেক্সিকোর স্বাধীনতা উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ঠিক ১৫ই আগষ্টে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর লালকেল্লায় ভাষণ দেওয়ার মতো। বাড়িটির শেষ ক্ষতি করা হয় ২০১৪ সালে কিছু বিদ্রোহীদের দ্বারা। পরে অবশ্য তা সারিয়ে ফেলা হয়। যোকালোর দিকে মুখ করে যে প্রধান প্রবেশ দরজা, সেখানকার দ্বিতলের বারান্দা থেকেই এখানকার প্রেসিডেন্ট স্বাধীনতা দিবসে বক্তৃতা দেন জাতির উদ্দেশে। এখানেই রয়েছে বিখ্যাত চিত্রকর দিয়েগো রিভেরার সেই বিখ্যাত সবচেয়ে বড়ো ম্যুরাল পেন্টিং, যেটা অবশ্য আমার আরেক প্রধান আকর্ষণ এই বাড়িতে।
এখানে ঢুকে সোজা গেলাম দোতলায়। গিয়ে দেখি পর্যটকদের জন্য দেখার জায়গার সীমানা নির্দিষ্ট করা আছে। এটিই হল আজটেক সম্রাটদের রাজত্বকাল থেকে আজ পর্যন্ত শাসনকর্তাদের অফিস, কখনো-কখনো বাসস্থান। এখানে রাজকীয় ব্যক্তিদের ঢোকার জন্য যেটি মূল দরজা, সেই প্রধান দরজার মুখেই আজটেক রাজত্বের প্রতীক ঈগল ও সাপ করা আছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ডানহাতে দেখলাম সুন্দর পার্লামেন্ট রুম। তবে আমাদের পার্লামেন্টের মতো বড়ো নয়, ছোটো কিন্তু সুদৃশ্য গোল গ্যালারি করে বসার চেয়ার সাজানো। চকচকে পালিশ, কার্পেট পাতা কাঠের ঘর। বেশ নয়ন মনোহর। এই ঘরেই ১৮২৯ সাল থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত ডেপুটিদের অফিস ছিল। এখানেই তাদের Reform Constitution of 1857 লিখিত হয়। তবে বর্তমানে দরজার বাইরে থেকে এটি দেখা যায়, ভিতরে ঢোকার অনুমতি নেই। এই বিশাল বাড়ির রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনেক ইতিহাস আছে অনেক উত্থান পতনের, কান্নাহাসির; তবে আজকে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য তার অনেকখানিই উন্মুক্ত নয়। এখানে শিল্পী দিয়েগো রিভেরার বিখ্যাত সবচেয়ে বড়ো ম্যুরাল ছাড়াও রয়েছে অনেক বিখ্যাত ছবি। ওই পার্লামেন্ট রুমের পাশের ঘরটি একটি ছোটো মিউজিয়াম। কিছু জিনিসপত্র আছে। কিন্তু ওই যে বললাম, ওদের মাথায় নেই যে, আমাদের মতো হস্তীমূর্খরা এটি দেখতে আসবে যারা স্প্যানিশ ভাষা বোঝে না। আর না বুঝে শুধু আন্দাজে জিনিস বোঝা বেশ মুশকিল।
যাই হোক, দোতলায় টানা বারান্দা চারদিক ঘিরে, যেমন এখানে সব বাড়ি বা অফিসে হয়। আর বিপরীত দেওয়াল জুড়ে একের পর আঁকা। এগুলি বেশ কয়েকজন শিল্পীর মিলিত আঁকা। বেশ বড়ো বড়ো দেওয়ালজোড়া ছবি। ছবিগুলো কয়েকটি যুগ ভাগ করে করা হয়েছে। তাতে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা, তাদের উপর বিদেশিদের নৃশংস অত্যাচারের ছবি, আজটেক দেবতাদের ছবি বা তাদের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ছবি, স্বাধীনতার লড়াইয়ের ছবি এইসব দেখানো হয়েছে। ছবিগুলো প্রতিটিই সুন্দর। যদিও আমি চিত্র বিশেষজ্ঞ নই, তবু ইটালির বা ফ্রান্সে যা ছবি দেখেছি, এগুলো যেন সেই ধারার নয় বলেই মনে হল। তবে কেমন তা বললে আমি বলতে পারব না। সেটা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। রং খুব উজ্জ্বল নয় অথচ রঙের তীব্রতা আছে, বক্তব্য পরিষ্কার। কেমন যেন মনে হয় অনেক আঁকা একটু কিউবিজম ঘেঁষা। সব মিলিয়ে খুব চোখ টানে। এই সারিতে সর্বশেষ ছবি হল সেটি, যেটির জন্য আমার এখানে আসা। সেটি হল দিয়েগো রিভিয়েরার আঁকা সবচেয়ে বড়ো ম্যুরাল।

bhromonaztec03

এটি তিনটি দেওয়াল জুড়ে আঁকা ৭০ মি. x ৯ মি. ম্যুরাল। তার মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণের চেয়ে মাঝের দেওয়ালটিই বেশি বড়ো। উত্তরদিকের দেওয়ালে বিধৃত হয়েছে প্রধানত আজটেকদের জীবনযাত্রা। সাধারণ মানুষের নিশ্চিন্ত চলমান জীবন, পূজা, সূর্যদেবতা, চাষবাস, জীবজন্তু, পিরামিড ইত্যাদি। আর মাঝের বা পশ্চিমদিকের দেওয়ালটি সবচেয়ে বড়ো। এখানে বর্ণিত ঘটনাও বেশি। রিভেরার ছবিটি সম্বন্ধে, তাঁর নিজের কথায়, the mural represents ‘the entire history of Mexico from the Conquest through the Mexican Revolution… down to the ugly present.” এখানে প্রধানত যুদ্ধবিগ্রহ, বিদেশিদের অত্যাচার এগুলিই দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে আছে দেশীয় অধিবাসীদের আক্রমণকারী স্প্যানিশ ও ফরাসিদের আক্রমণ ঠেকানো, বিজেতা স্প্যানিশরা কীভাবে আজটেক সভ্যতা ও স্থাপত্য নষ্ট করছে, কীভাবে আদিবাসী রমণীর উপর অত্যাচার করছে, কীভাবে স্প্যানিশরা তাদের ভাষা ভুলিয়ে স্প্যানিশ শিখতে বাধ্য করছে, তাদের ক্রীতদাস বানিয়ে নির্মমভাবে পশুর মতো খাটাচ্ছে, তাদের ধর্মান্তরিত করছে এইসবই রয়েছে আর একধারে ইউরোপীয় শাসনের শেষ ঘোষণা হচ্ছে, মানুষের মুক্তির দাবি সোচ্চারিত হচ্ছে। কার্ল মার্ক্সকেও দেখা যাচ্ছে সাম্যবাদের কথা বলতে। পতাকায় ‘Tierra y Libertad’ (Land and Liberty) দেখা যাচ্ছে। আর শেষ বা দক্ষিণ দেওয়ালে ভবিষ্যতের মেক্সিকোর সুন্দর ছবি আঁকা রয়েছে। এখানে সোভিয়েত প্রভাব, কার্ল মার্ক্স বা শিল্পী ফ্রিডা কালোকেও দেখা যাচ্ছে, ছেলেমেয়েরা স্কুল যাচ্ছে, কলকারখানা চলছে এইসব ছবি। মোটামুটিভাবে প্রায় একশো বছরের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে এখানে। ছবিটি সোজাসুজি দেওয়ালের প্লাস্টারের উপর আঁকা। তখন এই ধরনের ছবি আঁকার চল ছিল এখানে এবং ইউরোপে। এই প্রাসাদটি ছিল আজটেকদের সম্রাট মন্টেজুমা (দ্বিতীয়)-র। পরে (১৫২১) স্পেন বিজয়ের পর এখানে ছিলেন বিজয়ী হার্নান কর্টেজ। কাজেই এই প্রাসাদটি নিজেই একটি ইতিহাসের কেন্দ্র। সেই জন্যই আঁকার জন্য এই প্রাসাদটিই নির্বাচন করা হয়েছে।
এককথায় রিভেরা ছিলেন একটু স্বাধীনচেতা ও কম্যুনিষ্ট মনোভাবাপন্ন। এখানে তিনি দেখিয়েছেন শুভ ও অশুভের দ্বন্দ্ব। যা কিছু আদিতে ছিল, সেই গরিব মানুষদের সৎ স্বাভাবিক জীবনযাত্রার প্রতি তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। আর ঘৃণা করতেন ধনী বিজয়ীদের এই দমনমূলক মনোবৃত্তি, যা অশুভ। এই ছবিটি তিনি সরকারি আনুকূল্যেই এঁকেছিলেন, যা আঁকতে সময় লেগেছিল প্রায় ৬ বছর (১৯২৯-৩৫)। আমার এখানে এই প্রাসাদে আসার মূল উদ্দেশ্যটা পূরণ হল।
দোতলায় আর কিছু দেখার নেই কিংবা দেখার থাকলেও আমাদের যাওয়ার অধিকার নেই। দড়ি দিয়ে লক্ষণের গণ্ডির মতো সীমারেখা টানা আছে। অতএব বাধ্য হয়ে নামতে হল।
নীচে এসে ঢুকলাম আরেকটা মিউজিয়ামে।
এই মিউজিয়ামে প্রাচীন যুগের মেক্সিকোর অনেক কিছুই দর্শনীয় জিনিসপত্র রয়েছে। আছে জামাকাপড়, বাসনপত্র বা কিছু মূল্যবান দলিল, ম্যাপ ইত্যাদি। বেশ সুন্দর এই মিউজিয়ামটি। ছোটোর উপরে মোটামুটি ভালোই দর্শনীয়।
নীচে নামতেই দেখি আমার শ্রীমতী একজায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে একদৃষ্টে কী দেখছেন। পিছু ফিরে বললাম, “এসো, দেরি হয়ে যাবে।”
উনি সাড়া না দিয়ে দাঁড়িয়েই রইলেন। বাধ্য হয়ে আমিই কৌতূহল নিয়ে ফিরলাম কী এত জিনিস দেখছেন উনি, রিভেরার আঁকার চেয়েও যা আকর্ষণীয়! দেখে আমি থ! দেখি একটি গাবদা-গোবদা বিড়াল সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে সামনের বাগানের ধারে ওঁর দিকে তাকিয়ে আছে। আর উনি ওকে ইশারা করছেন কাছে আসার জন্য। আমি বললাম, “ওহ্, এই! ও কি তোমার বাংলা বোঝে? ওকে স্প্যানিশে ডাকতে হবে।”
বলতে বলতে দেখি আরও গোটা তিনেক মোটাসোটা বিড়াল এখন ওখান থেকে দেখা গেল। দেখি একটা ঘরমতোও করা রয়েছে বাগানে। তার সামনে কিছু খাবার দেওয়া রয়েছে। একটি বিড়াল তার মধ্যে বসে রয়েছে। উনি বললেন, “দেখো, কী সুন্দর!”
আমি বললাম, “হবেই তো। এরা হল রাজবাড়ির বিড়াল। আগেকার দিনে রাজাদের হাতি-ঘোড়া থাকত। এখন তো আর সে দিন নেই। তাই হাতিশাল, ঘোড়াশালও নেই, আছে মার্জারশাল। এদের আদরযত্নই আলাদা। হয়তো দেখবে, এদের দেখাশোনা করার জন্যই আলাদা লোক রাখা আছে।”
যাক, অনেক কষ্টে, প্রায় টেনে সেখান থেকে ওকে আনা হল। এখানে উদ্যানের পরিসর খুব বড়ো নয়, তবে পরিচ্ছন্ন।
এই যোকালোর চারদিকের উত্তরদিকে আছে বিখ্যাত ক্যাথিড্রাল, দক্ষিণে ফেডারেল ডিস্ট্রিক্ট বিল্ডিং, পূর্বদিকে এই ন্যাশনাল প্যালেস। তার বিপরীতেই Old Portal de Mercaderes।
এখানে রয়েছে সেই পুরানো দিনের বিল্ডিং সব, যেগুলো ব্যবহৃত হয় এবং হয়েছে নানা অফিস বা দোকান হিসাবে। যোকালোতেই হয়েছে ১৫ই সেপ্টেম্বর ২০১০-এ মেক্সিকোর দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপন। যোকালোর মাঝে রয়েছে মেক্সিকান ফ্ল্যাগ। এখানে সেই পুরানো দিনের থেকে আজও চলে আসছে একই ধারা, যে, এখানে সমস্ত রাজকীয় উৎসব, বড়ো সামাজিক উৎসব, মিটিং, অনুষ্ঠান সমস্ত কিছুই হয়ে চলেছে পূর্বের ধারা বহন করে।

bhromonaztec05

আমরা যখন ন্যাশনাল প্যালেস থেকে বাইরে এলাম, তখনও দেখছি অনুষ্ঠান চলছে, আর সেই খোলা রোদে মানুষ অত গরম আর রৌদ্র সহ্য করে চেয়ারে বসে বা দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান দেখছে। চলছে সুন্দরী নর্তকীদের নাচ, তারপর গান ইত্যাদি। সঙ্গে সঙ্গে চলছে জায়ান্ট স্ক্রিনে তাৎক্ষণিক ভিডিও প্রদর্শন। আমরাও একধারে দাঁড়িয়ে দেখলাম খানিকটা। তারপরই শেষ হয়ে গেল অনুষ্ঠান। শুনলাম দু-দিন পরেই এখানে আসছে আমেরিকার বিখ্যাত গানের দল ‘ব্যাক স্ট্রিট বয়েস’। সেই জন্য নাকি অনেকদিন আগে থেকেই এর আশেপাশে সমস্ত হোটেলের সব রুম বুকড হয়ে গেছে। গানের জন্যও মানুষ কত পাগল হতে পারে তাই দেখলাম।
এটা শেষ হল দেখে আমরা ঢুকে পড়লাম উলটোদিকের ক্যথিড্রালের প্রধান দরজা দিয়ে। ঢুকেই একেবারে হাঁ হয়ে গেলাম। মনে পড়ল প্যারিসের বিখ্যাত (বর্তমানে পুড়ে যাওয়া) নোতরদাম গির্জার কথা। বিশালত্বে তার খুব কম হবে না বোধ হয়। এখানে যা দু-তিনটি চার্চ দেখেছি, সবই বেশ বড়ো বড়ো। অনেক উঁচু এবং যথেষ্ট কারুকাজ এবং অনেক দামি দামি কারুকার্যে সাজানো। আরেকটা কথা। তা হল, অন্যান্য সমস্ত জায়গায় যেমন থাকে, ঢুকে সোজাসুজি দূরে বেদির উপরে যিশুর মূর্তি এবং তার নীচে পুরোহিতের বেদি এবং একেবারে সামনে ভক্তদের প্রার্থনা করার বেঞ্চ, এখানে সেটা তো আছেই, এছাড়া চার্চের ভিতরের চারদিক ঘিরে আরও বেশ কিছু যিশুর মূর্তি বা কোনও সেন্টের কি মাদার মেরির মূর্তি রয়েছে, সেখানেও সামনে প্রার্থনা বা ধূপ-দীপ জ্বালানোর ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে আর দুটি জিনিস আছে। এখানে আছে আমেরিকার সবচেয়ে বড়ো অর্গান দুটি এবং সেগুলি অষ্টাদশ শতাব্দীর তৈরি হলেও এখনও চালু আছে। যখন বাজে গোটা চার্চের ভিতর গমগম করে। আর আছে সেই কাচের বাক্সে একটি কিশোরীর মমি। আমি সঠিক জানি না, কোনটা আসল, গুয়াদালাহারারটি, না এইটি, নাকি কোনোটাই নয়। এখানে ৫৬টি খুব দামি দামি চিত্র আছে। আর যেহেতু এটি প্রায় ২৫০ বছর লেগেছিল তৈরি করতে তাই নানা সময়ের নানা জায়গার নানা শিল্পীর নানা ধারার শিল্পের মিশ্রণ রয়েছে এই চার্চের ভিতর। এই চার্চের ভিতটা গড়তেই লেগেছিল প্রায় বিয়াল্লিশটি বছর। তার কারণ এখানকার মাটির প্রকৃতি এবং এটি একটি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা।

bhromonaztec04

এই চত্বরে যা কিছু আছে সে সমস্তের নীচে জমা চাপা পড়ে আছে এক গৌরবময় দিনের নির্মম ধ্বংসপ্রাপ্ত হৃদয়ের অস্ফুট কান্না। এই অঞ্চলের নামই ছিল, আজটেক আমলে টেনক্টিটলান বা টেনোচটিটলান, যারা এক যথেষ্ট উন্নত সমাজ ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিল। আজও যা কিছু রাস্তাঘাট আছে এই অঞ্চলে তা হয় পুরানো রাস্তারই উপরে বা সেই পুরানো রাস্তাই নতুন নামে নতুন ঢঙে। আজও বেশ কিছু পুরানো, মাটি খুঁড়ে পাওয়া ধ্বংসাবশেষের টুকরো এখানে ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে এবং মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই বিস্মৃত দিনের গৌরবগাথা। চত্বরে যা যা তৈরি হয়েছে পরবর্তীকালে, তাতে বেশিরভাগই ব্যবহার করা হয়েছে সেই ভেঙে ফেলা বাড়িঘর বা প্রাসাদের টুকরো-টাকরা। স্প্যানিশ বিজেতা বা কঙ্কুইস্তাদর হার্নান কর্টেস যখন বর্তমান হন্ডুরাস থেকে সমস্ত বিজয় সেরে ফিরলেন, তখন এখানেই ক্যাথেড্রাল বানানোর সিদ্ধান্ত নেন, কারণ এখানেই ছিল আজটেকদের বিখ্যাত বিশাল মন্দিরজোড়া যা দেবতা কোয়েটজালকোটল এবং যুদ্ধের দেবতা হুইটজিলোপোকটলিকে উৎসর্গীকৃত। এছাড়াও ছিল বৃষ্টি ও শস্যের দেবতা কোয়েটজালকোটল মন্দির।
যাক, দক্ষিণমুখী এই চার্চের ভিতরের উচ্চতা অনেক। চার্চের ভিতরের অত্যুজ্জ্বল আলোয়, নিস্তব্ধ একটা গমগমে পরিবেশে মনটা যেন হারিয়ে যায় কোন অসীমে। ভক্তিতে মন আপনি নুয়ে আসে পরিবেশের গুণে। এই চার্চটি ভার্জিন মেরিকে উৎসর্গীকৃত। এটি গথিক, বারোখ ও নিও ক্ল্যাসিক্যাল স্থাপত্যের মিশ্রণে তৈরি। ২২০ ফুট উচ্চতার এবং ১৫০ জানালাওয়ালা এই ক্যাথিড্রালটি ১৮১৩ সালে দর্শকদের জন্য উন্মোচিত হয়। এটি তৈরিতে লেগেছিল সুদীর্ঘ সময় ১৫৭৩ সাল থেকে ১৮১৩ পর্যন্ত। এখানে যে কারুকাজ বা সাধুসন্তদের মূর্তি আছে, সবই প্রায় ভীষণ দামি দামি মেহগনি, আখরোট বা সিডার কাঠের তৈরি। এর যে দুটি বেল টাওয়ার আছে তাতে ঘণ্টা আছে ২৫টি। অতীতে এখানেই ছিল আজটেকদের সবচেয়ে বড়ো মন্দির টেমপ্লো মেয়র, যেটির কিছুটা এখন দেখা যায় খোঁড়াখুঁড়ির পর যা পাওয়া গেছে তার থেকে।
বেরোতে মন চাইছিল না। এটা যেন দেখে আশ মেটে না, আবার সঠিক বর্ণনাও করা যায় না। সৌন্দর্যের কোনও সঠিক বর্ণনা বা ব্যাখ্যা হয় কি না আমার অন্তত জানা নেই। এটা অনুভবের ব্যাপার এবং সেটা অনুভূতি হবে যার যেমন বোধ তেমন।

(চলবে)

ভ্রমণ সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s