আগের পর্ব–> পর্ব-১ পর্ব -২
বাইরে এসে দেখি মিউজিও কাবানাস-এর সামনে গোল বেদির মতো একটা জায়গায় গোল করে সাজানো রয়েছে বেশ কিছু ব্রোঞ্জের শক্তপোক্ত চেয়ার এবং মাঝে একটি টেবিল। এ চেয়ার-টেবিলগুলো সাধারণ চেয়ার-টেবিল নয়। প্রতিটিই নানারকম মানুষের বিভিন্ন ভঙ্গির অনুকরণে শিল্পী Alejandro Colunga ১৯৯৩ সালে বেশ মজাদার মনোবৃত্তিতে বানিয়েছিলেন ও সাজিয়েছেন। চেয়ারের পাগুলি মানুষের পায়ের অনুকরণে এবং গোটা শরীরটাই মানুষের অনুকরণে। সুন্দর, দেখার মতো। এখানে সবাই বসে ছবি তোলে, আমরাও তুললাম।
এরপর গেলাম লিবার্টাদ মার্কেটে। এটি এখানকার দর্শনীয় বস্তুর মধ্যে একটি অবশ্য দ্রষ্টব্য। ৪,০০,০০০ বর্গমিটারের উপর ২৮০০ স্টল নিয়ে তৈরি বাজারটি ল্যাটিন আমেরিকার সর্ববৃহৎ ছাদের নীচের বাজার। আমার দেখা তুরস্কের ইস্তাম্বুলের গ্র্যান্ড বাজারের মতো এটিও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তবে এটি গ্র্যান্ড বাজারের মতো একতলা নয়, তিনতলা। ১৯৫৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর শুরু হয়ে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাজার থাকে সরগরম। যাঁরা কলকাতার নিউ মার্কেট দেখে সন্তুষ্ট থাকেন, তাঁদের কাছে এর বিশালত্বের অনুমান করা মুশকিল। আমর ঢুকেছিলাম অন্য দরজা দিয়ে, প্রধান দরজা দিয়ে নয়, যদিও এর অনেকগুলি দরজা আছে। ঢুকেই দেখি শুধু ঘোড়ার আর কাউ-বয়দের জিনিসপত্রের বাজার, একেবারে ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি পাশাপাশি জিনিসপত্রে ঠাসা দোকান। ভর্তি শুধু সম্ব্রেরো টুপি, ঘোড়ার জিন, নাল, কাউ-বয়দের জুতো, ঘোড়া সাজাবার জিনিস এইসব। আমরা অনেক খুঁজেও অন্য জিনিস পাচ্ছি না আর ভাবছি, এত নামডাক একটা বাজারের, সে কি শুধু ঘোড়ার জিনিসপত্রের জন্য! তাছাড়া এত ঘোড়াই-বা কোথায়, এত কাউ-বয়ই-বা কোথায়, একটাও তো শহরে দেখিনি। ভাবলাম হয়তো গ্রাম থেকে আসা লোকেদের জন্য হতে পারে। দোকানে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, অন্য জিনিস দেখতে হলে আরও অন্যদিকে যেতে হবে। ও বাবা! এগিয়ে তো সব দেখে মাথা ঘুরছে। পরে মেক্সিকোতেও একটা বাজার দেখেছি, এতটা না হলেও ছোটো নয়। দেখি, যেখানে খাবার দোকান, সেখানে কত দোকান পরপর যে করা আছে, তাদের নানা মেনু, খাবার তৈরি হচ্ছে, সামনে পাতা টুলে বসে কত মানুষ ঘেঁষাঘেঁষি করে খাচ্ছে, বলে বোঝানো যাবে না। দামও বেশ সস্তা, উপাদেয় এবং যে-কোনো বাইরের হোটেলের থেকে অনেক সস্তা। আমি মনে মনে হিসাব করে দেখলাম কোন কোন খাবার পেট ভরানোর জন্য হয়তো ভারতের থেকেও কম দাম লাগবে। এখানকার ট্যাকো, পোজোলে, বিখ্যাত। এই তিনতলা বাজারে দুটি পার্কিং প্লেস আছে। এখানে পাওয়া যায় না এমন কোনও জিনিস নেই। জামাকাপড়, চশমা, ঘড়ি, জুতো, সবজি, মিষ্টি, ইলেক্ট্রনিক্স সমস্ত পাওয়া যায় এবং যেহেতু প্রচুর মানুষ আসেন এবং প্রচুর দোকানি, কম্পিটিশনও আছে। কাজেই দামও বেশ সস্তা। সব ভাগ ভাগ করে জিনিসপত্র আছে। যেখানে সবজি, সেখানে শুধু সবজি, যেখানে ইলেক্ট্রনিক্স, সেখানে শুধু ইলেক্ট্রনিক্স। এইরকম আর কি! এখানে ঢুকে মনে হল, না এলে ভুল করতাম। কিন্তু একটা ব্যাপারে খুব ভালো লাগল। এত লোক, এত দোকান, কিন্তু আওয়াজে কান ঝালাপালা হচ্ছে না আবার অপরিচ্ছন্নও নয়। মাঝে মাঝেই বাজার চলতে চলতেই পরিষ্কার হচ্ছে, এত লোকজন থাকা সত্ত্বেও। আমাদের দেশের অনেক কিছু শেখার আছে এই সমস্ত দেশের মানুষের কাছে।
এখান থেকে বেরিয়ে বাইরে পা রাখতেই দেখি সামনে অনেক হকার রয়েছেন। রোদে তাঁদের মুখগুলো পুড়ে যাচ্ছে। দেখে মেক্সিকোর আদি মানুষ বলে মনে হল, কে জানে। সামনে সাজানো রয়েছে মেক্সিকোর ট্র্যাডিশনাল ছেলে ও মেয়েদের জামাকাপড়, টুপি এবং সঙ্গে সেই মেয়েদের আদি ও অকৃত্রিম হার-মালা-দুল, পুঁতির জিনিস। পৃথিবীর সমস্ত দেশেই বোধ হয় এই হার-মালা-দুলের বেশ আকর্ষণ আছে মেয়েদের কাছে। বেশ লাগল এই ট্র্যাডিশনাল জামাকাপড় দেখতে। যদিও ছবি ছাড়া এরকম জামাকাপড় পরা মানুষ দেখিনি।
এখান থেকে বেরিয়ে দেখি সামনে রাস্তার পাশে দু-তিনটি ছেলে তাদের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বাজাচ্ছে আর গান গাইছে। আর দু-একটি ছেলে লোকের কাছে পয়সা চাইছে। পরে দেখি, এই গান গেয়ে পয়সা চাওয়াটা ওখানে একটা সাধারণ ব্যাপার। এখানে যত্রতত্র রাস্তায় রাস্তায় গান করে মানুষ। আমরা দুপুরে একটা দোকানে খেতে গেলাম। খেতে গিয়ে দেখি, অনেকটা আমাদের দেশের দোকানের মতোই লাগল। এখানে খাওয়া হল বিড়িয়া আর ভাত। ছেলে তো অর্ডার দিয়ে মিটিমিটি হাসছে আর বলছে, দেখো না, এখানকার দেশি বিড়ি খেয়েই একবার দেখো। খারাপ লাগবে না। ও মা, দেখি, একটা বড়ো বাটি করে পাঁঠার মাংসের হালকা ঝোল আর কর্নের রুটি দিয়ে গেল। বেশ স্বাদ। একেই বলে বিড়িয়া।
এটি মোটেই আমাদের কলকাতার সাধারণ পাঁঠার মতো নয়। বরং বাঁকুড়া-মেদিনীপুরের গ্রামে যেমন ছোটো কচি পাঁঠার হালকা ঝোল হয়, তেমন। বেশ সুন্দর। ওদিকে তখন দরজার সামনে গান ধরেছে একটি মেয়ে জিন্স আর গেঞ্জি পরে, গলায় গিটার ঝুলিয়ে মেক্সিকান সুরে। এখানকার মেক্সিকান সুরের যেন আমি প্রেমে পড়ে যাচ্ছি মনে হচ্ছে ক’দিনেই। যেখানে যাচ্ছি, রাস্তাঘাটে সর্বত্রই গান। সেটা জাইলোফোনও হতে পারে, কিংবা গিটার বা ড্রাম ইত্যাদির মিশ্রিত বাজনা সমেত। আর হোটেলে গান তো প্রায় সর্বত্র। বেশ কিছু হোটেলে গানের জন্য আলাদা জায়গা করা আছে, সেখানে গানবাজনা চলতেই থাকছে। গান বা বাজনা শেষে শিল্পীকে হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করা হয় খাওয়ার টেবিল থেকে এবং তারপর তাদের কিছু দক্ষিণা দেওয়াই রীতি। যাই হোক, মেক্সিকান সুরের গানের তালে তালে দুপুরের খাওয়া ভালোই জমল।
এখানে প্রথমদিনেই দু-একটা জিনিস চোখে পড়ল। আতিথেয়তা এবং ভদ্রতা বোধ এদের যথেষ্ট। রাস্তাঘাটে মেয়েরা বা ছেলেরাও মোটেই অশালীন নয় বা অশালীন পোশাক পরে না। বেশি থাকতে থাকতে বরং আমাদের দেশের সংস্কৃতির কথাই মনে পড়ে। এরা আমাদের মতোই ডাল-ভাত খায়, তবে একটু ভিন্নভাবে। ভুট্টা বা কর্নটা বেশি খায়, বিভিন্নভাবে। রুটি বা চিপস যাই হোক সবটাই হয় ভুট্টার। এছাড়া খায় রাজমা বা বিনস জাতীয় জিনিস, যদিও সবজি বাজারে নেই এমন জিনিস নেই। আমাদের দেশের মতো প্রায় সব জিনিসই পাওয়া যায়। তার ফলে আমরা যত জিনিস গমের ময়দা দিয়ে করি, এরা সেগুলোই ভুট্টার আটা দিয়ে করে। তবে আমার মনে হয়, আমরা তো কোনও মেক্সিকান পরিবারে খাওয়ার সুযোগ পাইনি। হোটেলে বা বাইরে খেয়েছি। তা দেখে এখানকার খাওয়াদাওয়া সম্বন্ধে বেশি সঠিক মন্তব্য করা যায় না। হয়তো কারোর বাড়ি গিয়ে খেলে দেখতাম আমাদের মতোই খায়, না-হলে এত সবজি, আমাদের দেশের মতোই, তা দিয়ে কী করে!
এখানকার রাস্তাঘাট খুব পরিষ্কার এবং মোটেই উঁচুনীচু নয়। সব জায়গাই সমান, একটা হ্যান্ডিক্যাপড বা শারীরিক অসমর্থ মানুষও তার হুইল চেয়ার নিয়ে বা একজন অন্ধও নিশ্চিন্তে পথ চলতে পারে। সাধারণ রাস্তায় শহরে, যদিও সিগনাল আছে, তবুও মানুষ রাস্তা পেরোলে চলমান গাড়িও তাকে আগে নিজে দাঁড়িয়ে রাস্তা ছেড়ে দেয়। এটা আমাদের দেশে আশাই করা যায় না। এ ব্যাপারটা আমেরিকার সংস্কৃতিতেও দেখেছি। আর আমাদের দেশে তো আমাকে সেদিন এক টোটোওয়ালা, রাস্তার ধারে থাকা সত্ত্বেও পিছন থেকে এসে অল্প ধাক্কা দিয়ে জোর বেরিয়ে গেল (ভাগ্য ভালো, বেশি জোরে লাগেনি)। আবার যাবার সময় পিছন ফিরে বলে গেল, রাস্তায় ঠিক করে চলতে পারেন না? আমি হতবাক!
এখানে দেখি প্রতিটি ফোয়ারায় জল আছে এবং সুন্দর পরিষ্কার, ভালোভাবে জল ছুড়ছে। রাস্তার পাশে গাছপালা সজীব এবং সেগুলোতে নিয়মিত জল দেওয়া হয়। এখানে যা কিছু বিশেষ করে দেখার জিনিস, তা এই সেন্ট্রো হিস্টোরিকো অঞ্চলের মধ্যেই প্রায় সীমাবদ্ধ। তার ফলে মাত্র তিন-চার কিমি হাঁটলেই প্রায় অনেকখানি দেখা হয়ে যায়।
বিকেলের আগেই রওনা হওয়া গেল এয়ারপোর্টের দিকে। এর পরের গন্তব্য মেক্সিকো সিটি। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের উড়ান।
মেক্সিকো সিটি বিমানবন্দরে এসে প্লেন থেকে নেমে মাটিতে পা রাখতেই মনটা কেমন চনমন করে উঠল। এলাম তাহলে মেক্সিকোতে। যদিও এর আগে যে গুয়াদালাহারাতে ছিলাম, সেখানটাও খুব সুন্দর ও প্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ। যদিও গুয়াদালাহারাও মেক্সিকোর মধ্যেই, তবু আমি মেক্সিকো বলতে মেক্সিকো সিটি আর তার আশেপাশের অঞ্চলকেই বোঝাতে চাইছি। তবু, প্রথমত গুয়াদালাহারার এত আলোচনা আগে শুনিনি, আসার আগেই যা শুনেছিলাম আর পড়েছিলাম। আর মেক্সিকো সিটির কথা তো কবে থেকেই জানি। আমার স্বপ্নের দেশ। আসলে এর প্রাচীনত্ব এবং এর রহস্যময়তা, এর প্রাচীন সংস্কৃতিই আমাকে এতদিন ধরে টেনেছে। সেখানে যে আসতে পারব কখনও ভাবিনি তো। এখানে সারাদেশের আনাচে-কানাচে প্রাচীনত্ব ছড়িয়ে আছে, যদিও বহু বহু প্রাচীন স্থাপত্য বা সংস্কৃতির নিদর্শন বিজেতা স্পেনীয়রা নির্মমভাবে নির্বোধের মতো ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। আজ আর অনেক কিছুই দেখার বোঝার বা জানার কোনও উপায় নেই। কাকে আর বলব। আমাদের দেশের অবস্থাও তাই। এতবার বিজিত হয়েছে যে বিজেতারা আর কিছুই বাকি রাখেনি। যেটুকু দয়া করে বা ভুল করে রেখে দিয়েছে, তাই নিয়েই আমরা গর্ব করি। তাও যেটুকু আছে সেটারও আমরা সঠিক যত্ন নিচ্ছি না, বরং স্থানীয় মানুষের অবহেলায় অনেক দামি দামি পুরাতত্ত্ব নিজেরাই নষ্ট করে দিচ্ছি। দেশের সরকারও এ বিষয়ে উদাসীন, দেশের নিরক্ষর অজ্ঞান অবিবেচক জনসাধারণও তাই। কাজেই যা হবার হচ্ছে। দুঃখ করে আর কী করব? বামিয়ান বা তার ধ্বংসের ঘটনা কি ভারতবর্ষের বাইরেই সত্য আর আমরা ধোয়া তুলসিপাতা? তা তো নয়। আজও ঘটে চলেছে একই ঘটনা সমানভাবেই। আর আমরা বিদেশি শাসকদের রচিত ভুল ইতিহাসকেই সত্য মেনে নিয়েছি আমাদের প্রাচীন গৌরব সম্বন্ধে। আমরা বার বার হারতে হারতে, বিজিত হতে হতে, মাথা নীচু করা শিখতে শিখতে শিরদাঁড়া সোজা করতে ভুলেই গিয়েছি। আজ আর শত চেষ্টাতেও তা সোজা হয় না। না-হলে আমাদের প্রাচীন গৌরবই-বা কি কম ছিল! কোনারক, ভীমবেটকা, কেদার বদ্রী, কি যন্তর মন্তর, দক্ষিণ ভারতের মন্দির অজন্তা ইলোরা নালন্দা, মাধেপুরা, বেদ উপনিষদ, গার্গী, খনা আরও কত কী। সব আমরা ঠিকমতো জানিইনি, বুঝিওনি। কী তাদের বিজ্ঞান বা কী তাদের দর্শন, কিছুই প্রকৃতপক্ষে জানি না।
আজ মেক্সিকোরও তাই অবস্থা। শুধু মেক্সিকো নয়, সারা দক্ষিণ আমেরিকা সহ পৃথিবীর বহু জায়গায়, যেখানেই প্রাচীন কিছু আছে, যেমন মিশর কি রোম সমস্ত জায়গাতেই মানুষ হাঁ হয়ে যায়, বর্তমানের নতুন সমস্ত প্রযুক্তি বিজ্ঞান নিয়েও বুঝতে পারছে না, কী করে সেকালে এত সমস্ত জিনিস তৈরি হয়েছিল, যেটা আজকের যুগে এত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি নিয়েও করা অসম্ভব। সব অহংকার চূর্ণ হয়ে যায়। তখন মানুষ বলে ওঠে, ‘সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে’।
যাক, এখানে এসে একটু অপেক্ষা করতে হল, মেয়ে ভারত থেকে সোজা এখানে আসছে, আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে। ও এল, তারপর ওকে নিয়ে উবেরে করে সোজা হোটেলে। হোটেলটা এয়ারপোর্ট থেকে একটু দূরে শহরের মধ্যে। তা হলেও বেশ শান্তমতো জায়গাটা। ও বাবা, হোটেলে এসে তো ‘চেক ইন’ হল। প্রথমে বুঝতে পারিনি, ছেলেও গোপন রেখেছিল একটা সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য। হোটেলের ঘর তো নয়, একটা পুরো সাজানো গোছানো অ্যাপার্টমেন্ট। ঘরে কী নেই! চেয়ার, টেবিল, ডাইনিং টেবিল, বড়ো আরামদায়ক সোফা, ফ্রিজ, মাইক্রোওভেন, সমস্ত বাসনপত্র, গ্যাস ওভেন, দুটো বড়ো টিভি, আলনা, ড্রেসিং টেবিল, বড়ো বড়ো দুটো খাট, মায় কাপ-ডিস, সমস্ত কাটলারি, রান্নার জিনিসপত্র পর্যন্ত সমস্ত কিছু। চাই কি, একটা চেয়ার সমেত ব্যালকনিও রয়েছে। ভীষণ ভালো লাগল। আসলে পাঁচতারা থেকে শুরু করে অনেক বড়ো বড়ো হোটেলে থেকেছি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, কিন্তু এরকমটা দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। কিছু অবশ্য এ.আর.বি.এন.বি-তেও থেকেছি, (ইটালির স্ট্রেসাতে এক ভদ্রলোকের বাড়িতেও এরিস্টোক্র্যাটিক ব্যাপার-স্যাপার দেখে চমকে গিয়েছিলাম। সে গল্প অন্য জায়গায় সুযোগ হলে বলব) কিন্তু এবারের সমস্ত কিছুর মান যেন অনেক উন্নত। যাক, বিদেশে এসে এতকিছু পেয়ে মনটা ভরে গেল। হোটেলে পৌঁছতে রাত হয়ে গিয়েছিল। তাই দেরি না করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে খাবার কিনে আনা হল।
১৯/০২
আজ সকাল থেকেই মনটা উৎফুল্ল হয়ে আছে মেক্সিকোকে নিজের চোখে দেখার অপেক্ষায়। তবে কাল রাস্তায় আসতে আসতে যা দেখেছি তাতে রাস্তাঘাট অনেকটা আমেরিকার মতোই লেগেছে। তার সঙ্গে দেখলাম আমেরিকান দোকানগুলোও রয়েছে, সেই স্টার-বাক্স, কে.এফ.সি, ওয়ালমার্ট, ম্যাকডোনাল্ড। ভাবলাম, এ তাহলে কোথায় এলাম! আমি যা ভেবেছিলাম, সে কি ভুল? পরে মাথায় এল, আরে সে তো ইতিহাসের কথা। কোনও জায়গাই কি আর থেমে থাকে আগের মতো? ইতিহাসের চাকাও গড়িয়ে গেছে অনেকদিন। চলমান এই জগৎ নদীর ধারার মতো কত কিছু ঘটনার সাক্ষী, কিন্তু কিছুই আঁকড়ে ধরে বসে থাকে না। তাকে বুকের মধ্যে ভরে নিয়েই এগিয়ে চলে বর্তমানকে সঙ্গে নিয়ে। এই মেক্সিকোর উপর বহুদিন সগৌরবে রাজত্ব করেছে বিদেশিরা। তারা তাদের মতো দেশকে সাজিয়েছে, তৈরি করেছে নিজের মতো, মুছে দিতে চেয়েছে পুরানো ইতিহাস, স্থাপত্য, সংস্কৃতি। দেশের মানুষকে ভুলতে বাধ্য করেছে তাদের নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা।
আজকের মেক্সিকোকে দেখে পুরানো ইতিহাসকে মনে করতে চাইলে গরমিল তো হবেই। জায়গায় দাঁড়িয়ে সেই জায়গাটার মাটির ভিতর কান পাততে হবে, শুনতে হবে পুরানো পাথরে বা দেওয়ালে অতীত দিনের জমা গুমরানো কান্না, তবেই হয়তো ইতিহাস সদয় হলেও হতে পারে নিজের মনের কথা উজাড় করতে। হয়তো ক্ষুধিত পাষাণের মতো কোথাও বেজে উঠতে পারে নর্তকীর পায়ের নিক্কণ, অথবা বধ্য বলির প্রাণভেদী আর্তনাদ। চলমান বাস্তব থেকে মুখ ঘুরিয়ে একটু অন্যদিকে দেখতেই হবে তাকে অনুভব করতে গেলে।
আমরা যদি পিছিয়ে যাই, বেশ কিছু বছর আগে দেখতে পাব, বেশিদিন নয়, মাত্র হাজার কি এগারোশো বছর আগে এখানে ছিল টোলটেক জাতির এক সভ্যতা। তারা বড়ো বড়ো শহর-বাড়ি-দালান-কোঠা-মন্দির সব তৈরি করেছিল। তাদের রাজধানী ছিল বর্তমান মেক্সিকো সিটি থেকে ষাট মাইল উত্তর-পশ্চিমে বর্তমান টুলায়, নাম ছিল টোলান। তারা অনেক উন্নত সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল। তারা লেখার কৌশল ও পঞ্জিকা তৈরিও জানত। সে সভ্যতা ১০০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি নহুয়াভাষী কিছু জাতির আক্রমণে নষ্ট হয়ে যায়। নতুন বিজেতাদের প্রধান শহর ছিল কুলহুয়াকান। আজ যেখানে মেক্সিকো সিটি, সেখানে ছিল এক বিশাল হ্রদ। সেটি শুকিয়ে গেছে বা জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে তাকে শুকিয়ে ফেলে নগর তৈরি করা হয়েছিল, আমাদের বর্তমান কলকাতার সল্ট লেকের মতো। এখানে যে নতুন সভ্যতা গড়ে উঠল, তার নাম হল আজটেক সভ্যতা। এখানে কিছুদিনের মধ্যেই আরেকটি নতুন নহুয়া ভাষাভাষী দল এসে বাস করতে শুরু করে। তাদের নাম টেনোচকা। তাদের রাজধানী ছিল টেনোচটিটলান। ক্রমশ তারাই আধিপত্য বিস্তার করে এবং তারাই প্রধান আজটেক হয়ে ওঠে। স্পেনীয়রা এখানে আসে ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে। তারা এদের হারিয়ে মেক্সিকো দখল করে। তারা এদেরই আজটেক বলে। অর্থাৎ আজ যেখানে মেক্সিকো সিটি, সেটিই সেদিন ছিল আজটেকদের রাজধানী টেনোচটিটলান। এদের রাজত্বের রাজা ১ম মন্টেজুমা ১৪৪০ খ্রিস্টাব্দে রাজা হয়ে পূর্বদিকে পুয়েব্লা ও ভেরাক্রুজ পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। ১৪৬৯ সালে এঁর মৃত্যুর পর ছেলে আক্সায়াক্যাটল-এর সময় রাজত্বের সীমা আরও বাড়ে এবং ধর্ম ও সংস্কৃতিতে অনেক উন্নত হয়। এ সময় এরা একটি পঞ্জিকা তৈরি করেছিল এবং সেটি একটি বিশাল পাথরের উপর, যেটির ওজন ছিল ২০ টনের (সাড়ে পাঁচশো মন) কিছু বেশি। এ পাথরের উপর জ্যোতির্বিদ্যার অনেক কিছুই খোদাই ছিল।
এদের এত উন্নতির মধ্যে একটি নৃশংস ধর্মীয় প্রথা ছিল নরবলি দেওয়া। সাধারণত যুদ্ধবন্দিদেরই বলি দেওয়া হত। যদি সেরকম বন্দি না থাকত, বন্দি সংগ্রহের জন্য একটি খেলা বা লড়াই হত। যে দল হারবে, তাদের দেবতার উদ্দেশে বলি দেওয়া হত। এ নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। আপাতত তৈরি হওয়া যাক পরের দিনের জন্য।
যাই হোক, পরের দিন আমরা ঠিক করলাম আজ একেবারে কোনও খোঁজাখুঁজি না করে সোজা যাব যোকালোতে। যে-কোনো বড়ো শহরেই একটা যোকালো আছে, যেটা মূলত শহরের প্রাণকেন্দ্র। এখানেই বেশিরভাগ মিটিং-মিছিল-বক্তৃতা হয়। আর প্রধান প্রধান বাড়ি, প্রাসাদ ইত্যাদি এর চারপাশেই, অনেকটা আমাদের এস্প্ল্যানেড বা ধর্মতলা চত্বরের মতো। এখানেই মানুষ একটু খোলামেলা জায়গায় বেড়াতে আসেন বা ছেলেমেয়ে পরিবারের সঙ্গে ঘুরতে আসেন। এখানে যোকালোতে গেলেই একেবারে প্রধান ক্যাথিড্রাল, প্যালেস ইত্যাদি সবকিছু পাশাপাশি দেখা হয়ে যাবে। গুয়াদালাহারাতেও তাই দেখেছি।
এলাম যোকালোতে উবেরেই। বেশ একটু দূর হোটেল থেকে। এখানে নেমেই দেখি, ও বাবা, এ তো জনসমুদ্র! জিজ্ঞাসা করলাম লোককে, বলল কী একটা গানবাজনার অনুষ্ঠান চলছে। ভাবলাম, এরকম দেখা তো অভ্যেস নেই। চড়চড়ে রোদে দিনের বেলায় খোলা স্টেজের উপর চারদিকে নাচগান হচ্ছে। বড়ো বড়ো স্ট্যান্ড লাগানো বক্স স্পিকার লাগিয়ে, পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ, ব্যারিকেড ঘেরা জায়গায় প্রচুর লোক, শ্রেণিভেদে চেয়ার বা দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান শুনছে। স্টেজের উপর বড়ো বড়ো ভিডিও ক্যামেরা ঘাড়ে ফোটোগ্রাফার, দু-তিনটে জায়েন্ট ডিজিটাল স্ক্রিন, তিনদিকে সেই অনুষ্ঠানের ভিডিও কাস্টিং হচ্ছে। আর স্টেজের উপর, মনে হল, খুব নামিদামি শিল্পীরা কখনও একক বা কখনও গ্রুপে নাচ-গান পরিবেশন করছেন। পুরো ট্রাফিক বন্ধ করে বা ঘুরিয়ে দিয়ে অনুষ্ঠান চলছে। এত বড়ো স্টেজ, ভাবলেই অবাক লাগছিল। এর থেকেও বড়ো অবাক হওয়ার পালা বাকি ছিল। সেটা পরে বলছি।
ক্রমশ
(চলবে)
খুবই সুন্দর ভ্রমন কাহিনী।
LikeLike