আহ্, কী সুন্দর ছিল সেই দিনটি! কখনো ভুলবে না সৌমিলি। দেশ ছেড়ে এসে তো আরো বেশি করে মনে পড়ে। প্রায়ই।
সে আর অভিজিৎ, একেবারে ছোটোবেলার বন্ধু। কাজও করছে একসঙ্গে, বেশ অনেক দিন। কাজের ক্ষেত্র তাদের বিরাট। সাব-অলটার্নদের অর্থনীতি। সাব-অলটার্ন মানে ‘পিছড়ে বর্গ্’, পিছিয়ে পড়া মানুষজন। কেমন থাকে তারা, আদিম পেশাগুলির—ঘরামির কাজ, জঙ্গলের পাতা, মোম, মধু আনা, শিকার ইত্যাদির ওপর আজও নির্ভর করে কি না। সরকারের সাহায্যের কথা আদৌ কিছু জানে? পৌঁছায় সেসব? এমনসব নানাদিক নিয়ে গবেষণার কাজ। কিন্তু সৌমিলি সেদিন ভুলে গেছে সব। সে নিজেকে ভাবছে রূপকথার চরিত্র। ঘটছিলও সব সেরমকই। সৌমিলির বিশ্বাস হচ্ছিল না, সে স্বপ্ন দেখছে না সত্যি সত্যি হচ্ছে সব তার চোখের সামনে।
বাবুই দড়ির খাটিয়ায় ভূষণ কিস্কুর উঠোনে বসে সে অভিজিৎকে নীচু গলায় বলেছিল, “ল্যাপটপ-ফপ সব রেখে দে। এদের সঙ্গে শুধু আনন্দ করি। এবার লাভ শুধু এটাই, বুঝলি গবুচন্দর?”
অভিজিৎ বলল, “রিপোর্ট রেডি করার কথা যে মানডের মধ্যে, খেয়াল আছে রে পেত্নী?”
সৌমিলি বলল, “না, নেই। চুলোয় যাক সব।”
কথা হচ্ছিল ইংরেজিতে। ভূষণ কিস্কু, একানব্বই বছর বয়স, বিকেলের ম্লান আলোয় দিব্যি বিনে চশমায় উঠোনের শিরীষগাছের নীচে পাখির কলরবের ভেতর অলচিকি ভাষার নতুন ব্যাকরণ রচনা করছেন। নানারকমের অক্ষর। সৌমিলি কিংবা অভিজৎ কারুর কিছুই মাথায় ঢুকল না এই মোটা ফাউন্টেন পেনে লেখা পাণ্ডুলিপি দেখে, যতক্ষণ না নিজে তিনি বুঝিয়ে দিলেন তাঁর কাজ সম্পর্কে ওদের। টুকটাক কথা বলছে এ-ওর সঙ্গে। সবই সাঁওতালি ভাষায়। তবে বাংলা সবাই বোঝে তো বটেই, ভূষণ কিস্কুর নাতির মেয়ে, সে পড়ছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আর সেটা তার ক্লাসের বই নয়, বলল।
কথা শুনে পাছে কিছু মনে করে ওরা তাই ইংরেজির আশ্রয় নেওয়া। কিন্তু ইংরেজি শুনেও হেসে উঠল ভূষণ কিস্কুর নাত-বৌ। অভিজিৎ ভিরমি খেয়ে পড়ে আর কী। সৌমিলির হাসি পেয়ে গেল ওর দশা দেখে। এটা যে রূপকথার দেশ, সৌমিলি বুঝে গেছে। এখানে প্রস্তুত থাকতে হবে কখন কী আশ্চর্য শোনে, কী অবাক কাণ্ড ঘটে তার প্রতীক্ষায়। সৌমিলির বুক ঢিপঢিপ করছে রোমাঞ্চে। আবার আনন্দও হচ্ছে দারুণ মনে মনে।
অভিজিৎ সাংঘাতিক সিরিয়াস ছেলে, একটুও সময় নষ্ট করতে সে রাজি নয়। সে ল্যাপটপ কোলে তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। সৌমিলি ভূষণ কিস্কুর কাছে গেল। ভূষণ কিস্কু ঘোলাটে চোখে তাকালেন। ফোকলা মুখে হাসলেন বিকেলে প্রথম দেখার সময়ের সেই মুশকিল আসান করে দেওয়া শান্ত হাসিটি। হাতটা এগিয়ে দিয়ে সৌমিলির মাথাটা ছুঁতে চাইলেন বোধ হয়। সৌমিলি মাথাটা নিচু করে এগিয়ে দিল। বুড়ো হাত বুলোলেন। বললেন, “একটা খণ্ড লেখা শেষ করে ছাপতে দিয়েছি। প্রথম প্রুফ আসবে সন্ধেবেলা। নাতি নিয়ে আসবে।”
কথায় অনেক বিরতি, অনেক ছেদ। বুড়ো হয়ে গেছেন বলে কষ্ট হয় শরীরে। আধঘণ্টা আগেই যে কাণ্ড তিনি করেছেন সেই বিস্ময় তাকে অনেকগুলো রাত ঘুমোতে দেবে না। তবু তাঁর বাংলা কথা আটকে যায়। কারণ বললেন নিজেই। প্রায় তিরিশটি বছর এইভাবে, এই উঠোনে, এই শিরীষগাছের নীচে মাতৃভাষার সাধনায় নিমগ্ন আছেন। বাইরের লোকজন বিশেষ কেউ আসে না। নাতি-নাতবৌ, তাদের দুটি মেয়ে আসে, আর গাঁয়ের লোক থাকে, এদের সঙ্গে সাঁওতালিতেই কথাবার্তা হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তিনি ভালোবাসেন। রবীন্দ্রনাথ একজন মহাপুরুষ। কিন্তু চর্চার অভাবে বাংলায় কথাবার্তাও গুছিয়ে আর বলতে পারেন না সেই পুরোনো দিনের মতো।
বিকেলবেলা এঁর কাণ্ড শুনলে কেউ ঘুণাক্ষরেও বিশ্বাস করবে না এই কথা বার বার মনে হচ্ছে সৌমিলির। অভিজিৎ তার সঙ্গে না থাকলে সেও করত না। কিন্তু এবার বেচারার মুখ পুরো সিল হয়ে গেছে।
আর আধঘণ্টা পরেই তখন বেলা হবে ডুবু ডুবু। গুগল ম্যাপ বলছে, ওদের গন্তব্য, এই সাঁওতাল গ্রামটি, যার নাম কাওয়া বাথান, আর মোটে দেড় কিমি। আসলে সঠিক লোকেশন দেখা যাচ্ছে না। কাছেই আছে নিবিড় এক বন, সেটাই দেখতে পাচ্ছে গুগলের চোখ। অভিজিৎ একসময় গ্রামের নামের মানেটি জিজ্ঞেস করে ভূষণ কিস্কুকে, খুব বাধ্য ছাত্রের মতো, আপনি আজ্ঞে দিয়ে। সৌমিলির হাসি পেয়ে যায়। কেন জানি প্রথম থেকেই সে নিজে মানুষটার সঙ্গে স্বাভাবিক হতে পেরেছে।
ভূষণ কিস্কু বলেন, “যারা যেখানে থাকে সেই জায়গার নামের ব্যুৎপত্তি নিয়ে মাথা ঘামায় না। আপনি প্রশ্নটা তুলে ভালোই করেছেন। বাথান অর্থে জীবজন্তুর জমায়েতের স্থান। আহারের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে একসময় তারা একটা জায়গায় সমবেত হয়। বিশ্রামই তাদের উদ্দেশ্য। এখানে অনেক কাওয়া এসে জোড়ো হত বোধ হয় কোনো এক প্রাচীন কালে। কাওয়া মানে কাক।”
সৌমিলি বলল, “বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না।”
ভূষণ কিস্কু বললেন, “হ্যাঁ, শুনেছি বটে। কিন্তু আমাদের গ্রামে একসময় দারুণ দারিদ্র্য ছিল। তবু কাকেরা আসত কেন?”
সৌমিলি বলল, “আপনারা যে ওদের ভালোবাসেন, ওদের সবাইকে নিয়েই থাকেন। তাই তো আপনাদের গ্রাম আজও সবুজ।”
শীতকাল, তবু বৃষ্টি হচ্ছিল মাঝে মাঝেই। আগেরদিনই হয়েছে। এখানে আসার সময় একটা কালভার্ট পেরিয়ে গাঁয়ের দিকে বাঁদিকের রাস্তায় নামাতে গেছে অভিজিৎ গাড়িটা, কাদায় ফেঁসে গেল। একেবারে বাচ্চা বয়স থেকে গাড়ি চালাচ্ছে অভিজিৎ, কিন্তু এই জেদি কাদার কাছে তার অভিজ্ঞতাও হেরে ভূত হয়ে গেল।
শেষে কাঁচুমাচু খেয়ে সৌমিলি যখন তার ওপর ভরসা করে, নিশ্চিন্ত মনে দূর আকাশের বুকে আসকে পিঠের মতন মেঘগুলোকে, যাদের কোনায় শুধু গোধূলির হালকা রং ধরেছে সবে, তাদের, আর তাদের নীচে সবুজ ছায়ায় ঢাকা সাঁওতাল গ্রামটিকে মগ্ন হয়ে দেখছে—অভিজিৎ এসে বলল, “একটু ঠেলে দিবি সৌমি, প্লিজ?”
সৌমিলি যেটুকু খেয়ে এসেছে তার নির্যাস নিংড়ে দিল গাড়ির ওপর। তাতে কিছুই হল না। হাতিরাও মাঝে মাঝে কাদায় পড়ে, তখন তাদের খুব দুর্দশা হয়, ব্যাঙও এসে লাথি মারে। দুটো এই বড়ো সোনা ব্যাঙ সত্যিই গাড়িতে উঠে এসেছে। ওরা ভীষণ ফুর্তিবাজ। খুব লাফাচ্ছে। সৌমিলির নিজেকে অসহায় লাগছে। তখন দেখা দিলেন বৃদ্ধ মানুষটি, এই ভূষণ কিস্কু। এগিয়ে এলেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে।
সৌমিলি বলল, “না না, ছি, আপনি কেন? আমরা দেখছি।”
সৌমিলি ভেবেছে এত বয়স এঁর, এঁকে এত ভারী কাজে সাহায্য করতে বলাই তো অন্যায়। যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন?
বুড়ো মানুষটি তার মন ঠিক পড়তে পারলেন। পেরে বললেন, “ঠিক এই জায়গায় মাঝে মাঝেই এরকম হয়। মাটিতে চুম্বক আছে।”
হা হা করে হেসে উঠলেন তিনি। তারপর গাড়িটার পিছনে গিয়ে ঠেলা দিতে লাগলেন। অভিজিৎ রইল স্টিয়ারিংয়ে বসে। একবার আস্তে ধাক্কা, একবার প্রবল। গাড়িটা প্রথমে নড়ল, তারপর শৃঙ্খল মোচন হল তার।
বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই বুড়ো তাদের অতিথি করে তাঁর ঘরে নিয়ে এলেন।
অভিজিৎ মনে মনে খুব খুশি হল। তাদের কাজের জন্যে একজন স্থানীয় মানুষ চাই-ই। বৃদ্ধকে পেয়ে তারা বেঁচে গেল।
সেই থেকে ভূষণ কিস্কুর মস্ত আকাশের ছাতা মাথায় দেওয়া উন্মুক্ত অঙ্গনে ওরা। অনেকগুলি ঘর। সবই মাটির। কিন্তু কী পরিচ্ছন্ন! একটুকরো লালচে আলো শিরীষগাছের মাথায়। প্রতিটি ঘরে নীচু দাওয়া। পা ঝুলিয়ে বসার জায়গা। এরা বলে ‘ধারি’। মাটির কারুকার্যে চোখ জুড়ানো শান্ত সৌন্দর্য। ওপরে এক পোঁচ কালো রং। সৌমিলি তার মধ্যমা আর তর্জনী আঙুল দুটো একত্রিত করে একটু ঘষে দেখল, নাহ্, রং একদমই উঠছে না।
“উঠবেও না। সবই প্রাকৃতিক উপাদান।” বলল ভূষণ কিস্কুর নাত-বৌ। ইংরেজিতে।
অভিজিৎ খাচ্ছিল প্রমাণ আকারের কাঁসার গেলাসে জল। বিষম খেয়ে সত্যি সত্যি নাকের জলে চোখের জলে হয়ে গেল।
সৌমিলি লজ্জা পেয়ে বৌটিকে বলল, “আমরা বাঙালি। বাংলায় বললেই আমরা স্বচ্ছন্দ বোধ করব।”
বৌটি বলল, তারা এখানে থাকে না, তবে প্রায়ই আসে। এলে সে নিজের হাতে ঘর নিকোয়, নকশা তোলে। পলিমাটি আর কয়লার গুঁড়ো, যাকে ওরা বলে ‘মলা’, তাই দিয়ে এই কালো।
নামও জানা গেল বৌটির। সবরমতী। গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো কালো, কিন্তু কী সুন্দর মুখশ্রী।
অভিজিতের মন আবার গেছে কাজে। সৌমিলি দেখছে এই ঘর, এই বিকেল। দূর আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর বুকের খাঁচার মতো ইলেকট্রিকের তার-খুঁটি। সেখানে যত বালিহাঁস আর শামকাঁহালদের বাসা। শামকাঁহাল পাখি কোনোদিন দেখেনি সৌমিলি। সবরমতী তার মোবাইল ফোনে তোলা ছবি এনে দেখাল সৌমিলিকে। মস্ত শরীর, এই লম্বা শক্ত একখানি ঠোঁট, জলার ধারে থাকে বসে। সন্ধ্যার আগে খুব করে ডেকে নেয় সবাই মিলে। কর্কশ কণ্ঠের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে দূরদূরান্তে।
মন উদাস হয়ে গেল সৌমিলির।
সবরমতী বলল, “আগে কুসুম বিচ দেওয়া দুটি মুড়ি খান। একেবারে টাটকা ভাজা। ওই ঘরে আছেন আমাদের ঠাকুমা। তিনি নিজের হাতে এখনো মুড়ি ভাজতে ভালোবাসেন। আর গোটা সন্ধেবেলাটা ঝাঁটা বোনেন মনযোগী ছাত্রীর মতো।” হাসল সবরমতী। দাঁতগুলো ধপধপে সাদা। এরই নাম দন্তরুচি কৌমুদী। কৌমুদী মানে জ্যোৎস্না।
মুড়ি আসার আগে সৌমিলি গেল সেই ঘরে। এত ঝাঁটা বুনে কী করেন তিনি? ঝাঁটার স্তূপের আড়ালেই প্রায় বসে আছেন। একটি অর্ধসমাপ্ত ঝাঁটায় একেবারে দেহ-মনে ডুবে আছেন। সৌমিলিকে দেখলেন। মুখ তুলে চাইলেন। হাসলেনও। তারপরে আবার কাজে ফিরে গেলেন।
সবরমতী মুড়ি নিয়ে ফিরে এসে হেসে বলল, “ঝাঁটা বোনাই তাঁর হবি। নিজে চোরকাঁটা তুলে আনেন। চোরকাঁটার নাম এদিকে জুরগুন্ডা। আর কাশের দিনে সবুজ তাজা কাশ।”
তারপর বিকেলের মতোই এল আরেক দফা অল্প মিষ্টির সুস্বাদু চা। মার আঁচল ধরে একটি শিশুও এল। মেয়ে। কী সুন্দর দেখতে। চার বছর আন্দাজ বয়েস হবে। রংচঙে জামা গায়ে।
সৌমিলি তার গাল টিপে জিজ্ঞেস করল, “কী নাম গো তোমার?”
মেয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু। তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল, “সীতা, সীতা।”
সৌমিলি দেখল, এই মোটাসোটা একটা দেশি কালচে খয়েরি রঙের কুকুর, কাশ ফুলের মতো পুরুষ্টু লেজ নাড়তে নাড়তে ঘরে ঢুকল। উঠোনে পড়ে ছিল একটা বল, সেটা পা দিয়ে শিশুটির দিকে গড়িয়ে দিয়ে চুপ করে বসে পড়ল।
সবরমতী বলল, “মেয়ে এখনো বাংলায় প্রত্যুত্তর করতে পারে না। কুকুরকে আমরা বলি সীতা। তবে বাংলা ভাষাকেও আমরা ভীষণ ভালোবাসি। সেটা একটু একটু করে শিখিয়ে দিলেই হবে।” তারপর নিজে সে সাঁওতালি ভাষায় মেয়েকে কী বলল।
মেয়েটি বলল, “কুকমু।”
সবরমতী বলল, “ওর নাম। কুকমু মানে স্বপ্ন।”
সৌমিলি আবেগ ভরে শিশুটিকে কোলে তুলে বলল, “ওমা, কী সুন্দর নাম!”
শিশুটি কাতুকুতু খেয়ে হাসতে লাগল খলখল করে। আর তাদের মাথার ওপর আবছা অন্ধকারে উড়তে লাগল একটা অচেনা পাখি।
মোটা মোটা মাংসের পুর দেওয়া পিঠে খেয়ে নাচ দেখা। অভিজিৎ অনেক তথ্য নিয়ে ফেলেছে, ফিরতে চাইছিল। সবাই ওদের থাকতে বলল রাতটা, রাতেই তো ফুর্তি। আজ যে ওদের বাঁদ্না পরব। সৌমিলিও বলল, সে থাকবে।
আজ ইলেকট্রিকের আলো জ্বালা মানা। দিব্যি ফুটফুটে জ্যোৎস্না।
ভূষণ কিস্কুর ঘরের পরেই অনেক গাছগাছালি। তারপর একটা পাথুরে জায়গা। বড়ো বড়ো পাথর-চাটান। যেন পাহাড়ের জন্ম থমকে আছে। তারপরেই সত্যিকার একটা বন। শেয়াল ডাকছে কাতারে কাতারে, নিভছে জ্বলছে জোনাকি।
বিকেলের রূপ বর্জন করেছেন সবরমতী। এখন তার তেল চুপচুপে চুল আঁট করে বাঁধা। খোঁপায় বুনো ফুল। গাছকোমর করে পরা শাড়ি হাঁটু পর্যন্ত উন্মুক্ত। সৌমিলিরও খুব ইচ্ছে করছিল সবরমতীর সাজে সাজতে।
সবরমতীর স্বামী প্রুফ নিয়ে ফিরে এসেছেন। তিনি একটি ব্যাঙ্কের আধিকারিক। কিন্তু ফিরে এসেই তিনি লুঙ্গির মতন করে পরেছেন ধবধবে ধুতি আর স্যান্ডো গেঞ্জি। মাদল বাজাচ্ছেন অন্য চারজন জোয়ান ঘর্মাক্ত পুরুষের সঙ্গে।
সবরমতী নাচছে অন্য রমণীদের হাত ধরে। সবার মাথায় কাঁসার ঝকঝকে কাঁসার ঘটি, চাঁদের আলোয় মনে হচ্ছে রুপো। হাত দিয়ে ধরে নেই কেউই, ঘটির দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে নাচের ভারসাম্যও নষ্ট হতে দিচ্ছে না। সবরমতী গান গাইছে অপূর্ব সুরেলা কণ্ঠে। সবাই গলা মেলাচ্ছে।
এমন সময় একটি মেয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। মুখে গ্যাঁজলা উঠছে। খোঁপা খুলে এলো চুল, চোখদুটো নেশাচ্ছন্ন। রমণীটি ঘোরের মধ্যেই সাঁওতালি ভাষায় নানা কথা বলতে লাগল। একবার উঠে চেষ্টা করল উদ্ভ্রান্ত পায়ে ছুটে পালাতে।
সবরমতী এক ছুটে ঘরে গিয়েই আবার তক্ষুনি এল ফিরে। হাতে উন্মুখ এক ইনজেকশন।
সৌমিলি আঁতকে উঠল। হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে নিজেরাই কেন ইনজেকশন দিচ্ছে ওরা? এ যে সাংঘাতিক ব্যাপার! হাত চেপে ধরল সৌমিলি সবরমতীর।
একজন নারী এগিয়ে এসে সৌমিলিকে বললেন, “উয়াকে ছাড়ে দে। উ ডাক্তারবাবু বঠে।”
সবরমতী বলল, “ছাড়ুন, দেরি করা যাবে না। এরকম ওর মাঝে মাঝে হয়।”
ইনজেকশন দেওয়ার পরে রমণীটি শান্ত হয়ে গেল।
সৌমিলি দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেছে। শরীরটা কাঁপছে। কেঁদে ফেলেছে। সবকিছু মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল। ছন্দপতন হয়ে গেল যেন সমস্ত ভালোলাগাটির। পুরুষ হাতের স্পর্শ তার কাঁধে। অভিজিৎ।
ঘরের ভেতর আবার গিয়ে আবার ফিরে এসে সবরমতীও রাখল তার অন্য কাঁধে হাত। মুখ তুলে সৌমিলি দেখল, তার চোখের সামনে একটা কাগজ ধরে দাঁড়িয়ে সবরমতী। ডাক্তারের প্যাড। সবরমতী সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার।
অনেকদিন কেটে গেছে। সৌমিলি আর অভিজিৎ এখন থাকে সানফ্রান্সিসকোতে।
সৌমিলি যখনই অভিজিৎকে সেই দিনটির কথা বলে, অভিজিৎ বলে, “দূর, ওটা একটা রূপকথার গল্প ছিল যা দুজনে আমরা একসঙ্গে পড়েছি। আসলে ওরকম কিছু কোনোদিন ঘটেইনি।”
অভিজিতের মুখ দেখে সৌমিলির সন্দেহ হয়, সত্যিই কি তাই?
অলঙ্করণ-রাহুল মজুমদার