মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের আরো গল্প কালাচাঁদ হাইলাকান্দির হুডিনি, ভূত জোলাকিয়া রংঝুরি রহস্য, ভয় আমাদের বিচিত্র অনুষ্ঠান, অশৈলী কান্ড জোড়াকদমে , রঙ্গোর রঙ্গ
ক্যারম খেলা চলছে ক্লাবঘরে। আমি আর ভুলু পার্টনার। বিপক্ষে পিন্টু আর রানা। যারা হারবে তাদের কেশর কুলপি কিনে আনতে হবে, তা খাওয়া হবে চারজন মিলে। উত্তেজক জায়গায় এসে গেছে গেম। আমাদের একটাই সাদা গুটি বোর্ডে। ওদের দুটো কালো গুটি আছে এখনও। কঠিন অ্যাঙ্গেলের রেড ফেলেছি এইমাত্র। শেষ গুটিটা ফেলতে পারলেই ম্যাচ আমাদের। দু-আঙুল দূরের গুটি। কিন্তু সেই সহজ গুটিটাই বেমক্কা মিস করে বসলাম। ভুলুর জোর ঠান্ডা লেগেছে ক’দিন হল। ফ্যাসফেসে গলাতেই চিল-চিৎকার দিয়ে উঠল, “হায় হায়, এটা তুই কী করলি চপ্পল! এই জলভাত গুটি কেউ মিস করে?”
আমার নাম মোটেই চপ্পল নয়, চপল, কিন্তু হতচ্ছাড়া ভুলু কিছুতেই সেই নামে ডাকবে না আমাকে। মেজাজ চটিতং হয়ে গেল ভুলুর কথা শুনে। নিমতেতো মুখ করে বললাম, “আমি কী করব? এত ইঁদুরের অত্যাচার হলে মনোসংযোগ করা যায় কখনও? যখন টিপ করছিলাম তখন আমার পায়ের ওপর দিয়ে সরসর করে কী একটা চলে গেল। সে কারণেই তো ছেতরে গেল আমার কনসেন্ট্রেশন।”
আমার কথা শুনে সকলে সচকিত হয়ে এদিক ওদিক তাকাল। ওরাও জানে আমার অজুহাত মিথ্যে নয়। গত কয়েক মাস ধরে ক্লাবঘরে ইঁদুরের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। তাদের উপদ্রবে নাজেহাল অবস্থা আমাদের। কী করা হয়নি গণেশের বাহনদের হাত থেকে বাঁচতে। কিন্তু কোনও কায়দাতেই তাদের বশ করা যায়নি। সে যাই হোক, খেলা শুরু হল আবার। পরের বোর্ডে আমরা দাঁড়াতেই পারলাম না। পিন্টু দুরন্ত খেলে ফিনিশ দিয়ে দিল। আমাদের তীরে এসে তরী ডুবল। হেরে গেলাম ওদের কাছে। ভুলু গজগজ করতে লাগল আপন মনে। পিন্টু পিত্তি জ্বালানো হাসি হেসে বলল, “যা চপল, চারটে কেশর কুলপি কিনে নিয়ে আয়।”
ব্যাজার মুখ করে আইসক্রিম কিনে নিয়ে এলাম নিধিরামদার দোকান থেকে। চারজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলাম তক্তপোষে। এই ক্লাবঘর একশো বছরের পুরোনো। একটা সময় আমাদের বাপ-জ্যাঠারা আড্ডা দিত এখানে। তারও আগে এই ক্লাবে পায়ের ধুলো পড়ত আমাদের ঠাকুর্দাদের প্রজন্মের। দুর্গাপুজোর সময় এই ক্লাবঘরেই হত নাটকের মহড়া। খোঁড়া বাদশা, আমি সিরাজ বলছি, রক্তাক্ত পানিপথ, যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ—কত যে নাটক প্রযোজিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। একবার পাহাড়ি সান্যাল নাকি কী একটা কাজে এসেছিলেন এই শহরে। সেদিন ছিল বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠান। তিনি নাটক দেখেছিলেন সামনের সারিতে বসে। রানার দাদু তৈমুরলঙের ভূমিকায় অনবদ্য করেছিলেন সেবার। যবনিকা পতনের পর পাহাড়ি সান্যাল নাকি জড়িয়ে ধরেছিলেন তাঁকে। রানা এখনও সুযোগ পেলেই সেই গল্প শোনায় আমাদের।
সে ছিল একটা সময়। শুনেছি, তখন নাটক ঘিরে পুজোর দু-মাস আগে থেকেই উৎসাহ আর উদ্দীপনায় ফুটত পাড়ার মানুষজন! কে কাকে টেক্কা দিয়ে ছাপিয়ে যাবেন তা নিয়ে চাপা উত্তেজনায় ভুগতেন অভিনেতারাও। দর্জি ডেকে নাটকের কস্টিউম বানানো হত ফি-বছর। কলকাতা থেকে প্রপস বানিয়ে আনা হত চাঁদা তুলে। আগের প্রজন্মের বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে দুটো ঢাউস কাঠের আলমারিতে যত্ন করে রাখা পোশাকগুলোর সঙ্গে। কিন্তু এর মধ্যে একদিন হল কেলো।
সেদিন আমরা ক্যারম খেলছিলাম যথারীতি। একটা গুটি ছিটকে গিয়ে পড়ল মেঝেতে। সেটা কুড়োতে গিয়ে দেখি মেঝের মধ্যে বেশ কিছু টুকরো টুকরো জরি বসানো ঝলমলে কাপড়। প্রমাদ গুনলাম। তড়িঘড়ি ড্রয়ার থেকে চাবি দিয়ে দুটো আলমারি খুললাম এক এক করে। দেখি নাটকের রংচঙে পোশাক কেটে ছত্রাকার করে দিয়েছে ইঁদুর। রানার দাদুর সেই তৈমুরলঙের কস্টিউমটার দফারফা করে দিয়েছে শয়তানের দল। রানা দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “জানি প্রাণীহত্যা পাপ, কিন্তু এই অপরাধের কোনও ক্ষমা নেই। কালই ইঁদুর মারার বিষ কিনে আনতে হবে। এর বদলা চাই।”
আমি আর রানা র্যাট কিলার কিনতে এসেছি শুনে দোকানি নিধিরামদা গম্ভীর হয়ে গেল। ভুরু কুঁচকে বলল, “হঠাৎ র্যাট কিলার কেন? তোমাদের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে নাকি?”
আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, “এটা কি পরীক্ষার সিজন নাকি!”
নিধিরামদা বলল, “দিনকাল ভাল না ভায়া। পরীক্ষায় ফেল করলে র্যাট কিলারের বিক্রি বেড়ে যায় কিনা, তাই জানতে চাইলাম আর কি। মানুষ মেরে জেলে যেতে চাই না। সেখানে শুনেছি খাওয়াদাওয়ার বড়ো কষ্ট। তাছাড়া নিজের থালা-বাটি নিজেকেই ধুতে হয়।”
আমরা ছাত্র ভালো নই ঠিকই, কিন্তু তাই বলে ফেল করার মতো দশাও আমাদের নয়। মেজাজ খাট্টা হয়ে গেল নিধিরামদার ওপর। ভাবে কী আমাদের! তবে রাগ হলেও ভালোমানুষের মতো মুখ করে ইঁদুরের কথা বিশদে জানালাম নিধিরামদাকে। সব শুনে নিধিরামদা লুডো খেলার বোর্ডের মতো একটা গ্লু-বোর্ড এনে আমার হাতে দিল। দেঁতো হাসি হেসে বলল, “সন্ধেবেলা এই আঠালো বোর্ড শুধু ক্লাবের মেঝেতে পেতে রেখে দাও। যে-কোনো সাইজের ইঁদুর আটকে যাবে এই আঠায়।”
রানা বলল, “একটা দুটো তো নয়, ক্লাবে গাদা গাদা ইঁদুর। আমাদের র্যাট কিলারই চাই। এক প্যাকেট নয়, দু-প্যাকেট।”
নিধিরিমদা একটুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর সন্ত্রাসবাদীর হাতে বেআইনি বন্দুক তুলে দিচ্ছে এমন একটা মুখ করে ইঁদুরমারা বিষ আমাদের হাতে তুলে দিল। ষড়যন্ত্র-কুটিল মুখে বলল, “এ নামি কোম্পানির দামি জিনিস ভাই। মোক্ষম বস্তু। খেতে হবে না, শুধু জিভ ছোঁয়াক। এক ছোবলে ছবি হয়ে যাবে সব ব্যাটা।”
আমি আঁতকে উঠে বললাম, “সব ক’টা একসঙ্গে মরলে তো পচা গন্ধে আমরাই মারা যাব!”
নিধিরামদা হেসে বলল, “এই বিষ যেমন তেমন নয়। ইঁদুর বিষ খাবে এখানে, তাদের লাশ পড়বে গিয়ে শ্মশানে।”
আমি হাঁ হয়ে গিয়ে বললাম, “কোন শ্মশানে?”
নিধিরামদা বলল, “ওদের তো আর নিমতলা বা ক্যাওড়াতলা মহাশ্মশান নেই ভাই, মাঠঘাটেই ওদের জন্ম আর মৃত্যু লেখা। সেখানেই গিয়ে দেহ রাখবে। নাও, এবার চল্লিশ আর চল্লিশ মোট আশি টাকা দাও।”
সন্ধেবেলা রুটির সঙ্গে ইঁদুরমারা বিষ মাখিয়ে রুটির টুকরো রেখে দেওয়া হল ক্লাবঘরে। পরদিন ক্লাবঘরের তালা খুলে ভেতরে ঢুকতেই চক্ষু চড়কগাছ। ক্লাবঘরে একটা ডেস্কটপ ছিল। চিঠিচাপাটি করতে গেলে মাঝেমধ্যে খোলা হয় সেটা। ইঁদুরের বৈদ্যুতিন যে প্রতিরূপ আছে, সেই মাউসের তার দেখি কেটে দিয়েছে হতচ্ছাড়ারা। বাপ্পা জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করে বলল, “তারওয়ালা মাউস কিনে লাভ নেই। বিনা তারের লেজার মাউস কিনে আনাই ভালো। ক্লাবঘর ইঁদুরমুক্ত করতে না পারলে এমন ঘটনা রোজ ঘটবে।”
শীতের সময় ক্লাবের সামনের জমিতে নেট টাঙিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলা হয়। র্যাকেটগুলো সারাবছর খাপবন্দি অবস্থায় রাখা থাকে তক্তপোষের ওপর। সেদিন দেখি ছ-ছ’টা র্যাকেটের জ্যাকেট ফুটো করে সবগুলোর স্ট্রিং দাঁতে কেটে দিয়েছে ইঁদুর। রাসেল মাথা চুলকে বলল, “ওদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বলেই কি এভাবে বদলা নিল ইঁদুরের দল?”
পিন্টু ভালো ব্যাডমিন্টন খেলে। ওর রাগ হয়েছে সবথেকে বেশি। পিন্টু খেপচুরিয়াস গলায় বলল, “আর বিলম্ব নয়, কালই ইঁদুর-ধরা কল নিয়ে আসব। এর শাস্তি পেতেই হবে ব্যাটাচ্ছেলেদের।”
বড়সড় ইঁদুরের কল কিনে আনা হল। ক্লাবঘর বন্ধ করার সময় বিস্কুটের টোপ দিয়ে খুলে রেখে দেওয়া হল কলের খাঁচা। পরদিন ক্লাবঘরে এসে দেখি কলে ইঁদুর ধরা পড়েনি, বরং একটা সাংঘাতিক কাণ্ড হয়েছে। স্টিলের র্যাকে একগাদা বই ছিল, তার বেশিরভাগ বই ছিঁড়ে ফর্দাফাই করেছে ইঁদুর। না, কোনও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করা যাবে না। গল্প উপন্যাস ভ্রমণ কবিতা প্রবন্ধ – দাঁতে কাটার সময় কোনও বইয়ের বাছবিচার করেনি তারা। আমরা ক্রুদ্ধ হলাম, কিন্তু সবচাইতে বেশি মর্মাহত হল বাপ্পা। বাপ্পার ঠাকুরদা গণ্যমান্য আইনজ্ঞ ছিলেন। আইনের বই ছাড়াও নানা বিষয়ের বই পড়তেন। তিনি মারা যাবার পর তাঁর বইগুলি দান করা হয়েছিল আমাদের ক্লাব লাইব্রেরিকে। বাপ্পা রেগে কাঁই হয়ে বলল, “এবার ইঁদুরের পাল বুঝবে কত ধানে কত চাল।”
বাপ্পাদের বাড়িতে মানুষ চারজন, বেড়াল এগারোখানা। তার মধ্যে হুলো বেড়াল দুটো। একটার নাম রোনাল্ডো, অন্যটা মেসি। বাপ্পার মা আর দিদির অগাধ প্রশ্রয়ে দুধে-ভাতে বেড়ে উঠেছে বেড়ালগুলো। তারা মানুষ দেখে মোটেই ভয় খায় না। বাঘের মতো রাজকীয় ভঙ্গিতে অলস পায়ে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়ায়। পরদিন বাপ্পা দুটো বেড়ালকে একটা রিক্সায় চাপিয়ে নিয়ে এল বাড়ি থেকে। গাবদা-গোবদা ছাই রঙের বেড়ালদুটোর কপালে দেখি রক্তচন্দনের ফোঁটা। বাপ্পা বলল, “ক্লাবঘরে ওদের ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেব। ফ্রি হ্যান্ড দেওয়া থাকবে ওদের। দেখে নিস সব ক’টা ইঁদুরকে খুবলে খেয়ে নেবে ওরা।”
সেদিন কেশর কুলপি খাওয়ার পর ভুলুর গলা আরও বসে গেছে। যা বলে তার চার আনা বোধগম্য হয়, বারো আনা আন্দাজ করে নিতে হয়। ভুলু বসা গলায় জানতে চাইল, “ওদের কপালে তিলক কীসের রে?”
বাপ্পা বুঝিয়ে বলল, “মা আর দিদি বাড়ির কুলপুরোহিতকে ডেকে পাঠিয়েছিল। মেসি আর রোনাল্ডো যাতে এই মিশনে সফল হতে পারে তার জন্য ওদের কপালে জয়তিলক পরিয়ে দিয়েছে ঠাকুরমশাই।”
বাপ্পা বেড়ালদুটো মাথা আদর করে ঘেঁটে দিয়ে বলল, “সিংহবাড়ির মান রাখিস তোরা, কেমন?”
কী বুঝল কে জানে, দুই মার্জার হাই তুলল বড়ো করে।
সেদিন সন্ধেবেলা বেড়ালদুটোকে ক্লাবঘরে ছেড়ে রেখে বাইরে থেকে মূল দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল। আমরা বাড়ি ফিরে এলাম ঠিকই, কিন্তু সারাটা রাত কাটল অধীর উত্তেজনায়।
পরদিন ক্লাবঘরে এসে ভেতরে ঢুকতেই সুরুৎ-সরাৎ করে আমাদের পায়ের ফাঁক দিয়ে গোটা পাঁচেক ইঁদুর বেরিয়ে গেল। মেসি আর রোনাল্ডো নেই কোথাও। নেই মানে নেই। ভুলু বসা গলায় হাঁকাহাঁকি করল। লাভ হল না। বেড়ালদুটো লা-পাতা। সকলে মেসি আর রোনাল্ডোর নাম ধরে ডাকাডাকি করলাম। কোনও সাড়া নেই। পিন্টু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “আমার ভয় ভয় করছে। ইঁদুরগুলো যা ডাকাবুকো আর দানব স্বভাবের, ওরা মেসি আর রোনাল্ডোকে খেয়ে ফেলেনি তো?”
বাপ্পার চোয়াল ঝুলে গেল পিন্টুর কথা শুনে। শুকনো গলায় বলল, “ওদের কিছু হলে মা আর দিদি আমাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে।”
বাপ্পার কথাটা শেষ হতে না হতেই মিহি গলায় মিউ মিউ ডাক শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখি লম্বা আলমারির একেবারে টঙে উঠে বসে আছে সিংহবাড়ির দুই সন্তান। নার্ভাস হলে বেড়ালেরও যে চোয়াল ঝুলে যায় সেটা নিজের চোখে দেখলাম। আন্দাজ করলাম কাল সারারাত টম অ্যান্ড জেরি লাইভ শো হয়েছে এই ক্লাবঘরে। বেড়ালদুটোকে নিয়ে রাতভর চু-কিতকিত খেলেছে রাক্ষুসে চেহারার ইঁদুরগুলো। তাই প্রাণ বাঁচাতে আলমারির মাথায় গিয়ে উঠেছে দুই মার্জার। সেখান থেকে ভিতু ভিতু মুখ করে কুঁই কুঁই করছে।
ইঁদুরমারা বিষে কাজ হয়নি। আঠালো বোর্ড কিংবা বেড়াল দিয়েও হল না। আমাদের হতাশা ক্রমশ বাড়ছিল। ইঁদুরগুলো মনে হয় বুঝতে পারছিল যে, আমাদের অস্ত্রাগারের সব অস্ত্র শেষ। আগে তাদের নড়াচড়া টের পেতাম, চোখে বড়ো একটা দেখতে পেতাম না। এখন আমাদের সামনে দিয়েই ডাঁটের মাথায় ঘোরাফেরা করতে শুরু করল হতচ্ছাড়াদের দল। যেন ক্লাবঘরটা ওদের আর আমরাই বহিরাগত।
সেদিন ক্যারম খেলার পর ভবেশদার দোকান থেকে কোল্ড ড্রিঙ্কের ক্যান আনিয়ে খাচ্ছিলাম আমরা। ভুলুও লোভ সামলাতে না পেরে খেয়ে ফেলল এক ক্যান হিমশীতল পানীয়। আমাদের মন এতটাই খারাপ ছিল যে, কোল্ড ড্রিঙ্কও বিস্বাদ লাগছিল। ভুলু কাশছিল খকখক করে। আমি হতাশ গলায় বললাম, “সব আশা শেষ। এখন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালাকে খবর দেওয়াটাই যা বাকি।”
আমার কথা শেষ হতে না হতেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল রাসেল। চোখেমুখে একশো ওয়াটের আলো জ্বালিয়ে বলল, “চপল, গ্র্যান্ড আইডিয়া দিয়েছিস! হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা তো আমাদের হাতের কাছেই আছে!”
পিন্টু কৌতূহলী হয়ে বলল, “মানে?”
রাসেল বলল, “আমাদের পাড়ার বাঁশি ব্যানার্জিকে চিনিস তো? সায়েন্টিস্ট ছিলেন কী একটা সংস্থায়। আত্মভোলা লোক, বিয়ে-থা করেননি। সেদিন বাঁশিকাকুকে দেখাচ্ছিল লোকাল টিভি নিউজে। তিনি নাকি এই লকডাউনের বাজারে ঘরে বসেই নানারকম ক্ষতিকর পোকামাকড় আর কীটপতঙ্গ তাড়াবার যন্ত্র তৈরি করেছেন। পেস্ট কন্ট্রোল দপ্তরকে চিঠিও দিয়েছেন সে ব্যাপারে। চল তো ওঁর কাছে একবার।”
তামাটে গায়ের রং। চুল শেষ কবে কেটেছিলেন বলা মুশকিল। একগাল কাঁচাপাকা দাড়ি। পুরুষ্টু গোঁফ। ঘাড়ে গর্দানে চেহারার বাঁশি ব্যানার্জি লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে বসে ছিলেন বাইরের ঘরে। ঘরে ডেস্কটপ কম্পিউটার আছে একটা। বিভিন্ন সাইজের সাউন্ড বক্স, চোঙাকৃতি মাইক, আরও কীসব উদ্ভট ধরনের যন্ত্রপাতি রাখা। এসব আগে কখনও দেখিনি, নামও জানি না। টাইল দেওয়া মেঝেতে থেবড়ে বসে হিমসাগর আম, মালভোগ কলা, এক জামবাটি ভর্তি ঘন সরতোলা দুধ আর খই খাচ্ছিলেন মনোযোগ দিয়ে। গোঁফে লেগে ছিল দুধের সর। আমরা এই পাড়ায় থাকি শুনে ভেতরের ঘরে বসালেন। ভুলুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী ভায়া, কী ব্যাপার বলো।”
সেদিন কোল্ড ড্রিঙ্ক খাওয়ার পর ভুলুর গলা আরও খোলতাই হয়েছে। ভুলু কথা বলতে গেল। কিছুই বোঝা গেল না। ভুলুর দিকে অবাক হয়ে খানিক তাকিয়ে থাকলেন ভদ্রলোক। পাশ থেকে আমি বললাম, “স্যার, এটা ওর নর্মাল গলার স্বর নয়। ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাচ্ছে, গরম জলে নুন দিয়ে গার্গল করছে, আবার রোজ আইসক্রিম আর কোল্ড ড্রিঙ্কও খাচ্ছে। কী করে গলা ঠিক হবে বলুন?”
ভুলু দাঁত কটমট করে দেখতে লাগল আমাকে। বাঁশি ব্যানার্জি আমার উদ্দেশে বললেন, “কী কারণে আমার কাছে এসেছ বলো ভায়া।”
শুরু থেকে সব গুছিয়ে বললাম। আমাদের সমস্যা মন দিয়ে শুনলেন ভদ্রলোক। ভুরু কুঁচকে বললেন, “ইঁদুর খুব বিপজ্জনক জিনিস। বিউবোনিক প্লেগ, রিকেটশিয়া, লেপ্টোপাইরোসিস, সিউডোমোনাস, স্টেপ্টোব্যাসিলাস জাতীয় ভয়ংকর সব রোগ হতে পারে এদের থেকে। তা, কী ধরনের ইঁদুরের উৎপাত তোমাদের ক্লাবে? হাউজ মাইস, র্যাট্রেস র্যাট্রেস, নাকি র্যাট্রেস নন-ভেজিকা?”
আমরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মুখ তাকাতাকি করছিলাম। বাঁশি ব্যানার্জি বুঝিয়ে বললেন, “বিশ্বে রয়েছে প্রায় একশো তিরিশ প্রজাতির ইঁদুর। ভারতে আছে পঁচিশ থেকে তিরিশ রকম। তবে এসব দিকে দৌরাত্ম্য মোটামুটি তিন জাতের—নেংটি, মাঝারি আর ধেড়ে। জেনে রেখো ভায়া, নেংটি ইঁদুর হয় দু-ইঞ্চি লম্বা, ল্যাজ চার ইঞ্চি। তারা হাউজ মাইস। মাঝারি ইঁদুর হল র্যাট্রেস র্যাট্রেস। এরা তিন ইঞ্চি লম্বা, ল্যাজ তিন ইঞ্চি। র্যাট্রেস নন-ভেজিকা হল ধেড়ে ইঁদুর, যারা আট থেকে নয় ইঞ্চি লম্বা, ল্যাজ চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি। এবার বলো, তোমাদের ক্লাবে কোন ধরনের ইঁদুরের উৎপাত?”
ভুলু দু-হাত দিয়ে ধেড়ে ইঁদুরের মাপ বুঝিয়ে কী একটা বলতে গেল। কিন্তু মুখ দিয়ে যথারীতি কোনও শব্দ বের হল না। পিন্টু ভুলুকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তিন সাইজেরই ইঁদুর আছে ক্লাবঘরে। তারা সংখ্যায় অগুনতি। র্যাট কিলার, গ্লু-বোর্ড, ইঁদুরের কল, হুলো বেড়াল—সবকিছু ট্রাই করেছি। কোনও লাভ হয়নি। আপনি কিছু একটা উপায় বাতলে দিন স্যার।”
বাঁশি ব্যানার্জি ধীরেসুস্থে তাঁর ফলার শেষ করলেন। বিশাল একটা ঢেঁকুর তুলে বললেন, “সমস্যা যেমন আছে তার সমাধানও আছে। এক কাজ করো ভায়া, রোডেন্ট রিপেলার যন্ত্র ইনস্টল করে নাও। তাহলেই ইঁদুরের জন্য একেবারে নো এন্ট্রি বোর্ড পড়ে যাবে তোমাদের ক্লাবে।”
আমি ঢোঁক গিলে বললাম, “ইয়ে মানে স্যার, কী নাম বললেন যন্ত্রটার?”
বাঁশি ব্যানার্জি উত্তর দিলেন না। ধীরেসুস্থে উঠে গিয়ে ভেতরের ঘর থেকে একটা থান ইট সাইজের যন্ত্র নিয়ে এলেন। কালো রঙের সেই বস্তুটিকে দেখিয়ে বললেন, “এই মেশিন চালু হলে নাগাড়ে শব্দতরঙ্গ তৈরি হয়। গণেশবাবাজির বাহন সেই চড়া আওয়াজ সহ্য করতে পারে না। চম্পট দেয় এলাকা ছেড়ে। এটা আমি ডাম্প করে ফেলে দেওয়া বিভিন্ন প্লাস্টিকের জিনিস থেকে তৈরি করেছি। পার মেশিন হাজার চারেক মতো খরচ হবে।”
আমার একটু খটকা লাগল। মাথা চুলকে বললাম, “সেই শব্দতরঙ্গে ইঁদুর না-হয় পালাবে, কিন্তু এত আওয়াজের মধ্যে আমরা ক্যারম খেলব কী করে?”
বাঁশিকাকু হো হো করে হাসলেন। হাসির দমক থামলে বললেন, “রোডেন্ট রিপেলার থেকে বের হওয়া শব্দ কুড়ি হাজার হার্জ ছাড়ালে সাধারণ মানুষ তার আওয়াজ পায় না। কিন্তু ওই শব্দতরঙ্গ ইঁদুরের কান ঝালাপালা করে দেয়। তারা তখন এলাকা ছেড়ে চোঁ-চোঁ দৌড় দেয়। এক কাজ করো ভায়া, ক্লাবঘরের দেওয়ালে এই যন্ত্র বসিয়ে নাও। ক্লাবের বাইরে মাটির নীচেও পুঁতে দাও এই জিনিস। ব্যস, কেল্লা ফতে।”
আমরা আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললাম, “মাত্র চার হাজার টাকাতেই কাজ হয়ে যাবে? এটুকু টাকা আমরা চাঁদা তুলে ঠিক জোগাড় করে ফেলব স্যার।”
আমার পাশে বসা বাপ্পা কীসব হিসেবনিকেশ করছিল। মুখ তুলে বলল, “অত লাফাস না। একটা মেশিন কিনলেই তো হবে না। ক্লাবঘরের প্রত্যেক দেওয়ালে এই যন্ত্র লাগাতে গেলে, সেই সঙ্গে ক্লাবের বাইরের মাটিতে পোঁতা হলে তার খরচ কত হবে ভেবে দেখেছিস?”
বাপ্পার কথা শুনে আমরা সকলে মুষড়ে পড়লাম। রাসেল শুকনো মুখে বলল, “তাহলে?”
বাঁশিকাকু চিন্তিত মুখে পায়চারি করছিলেন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভুলুকে জরিপ করলেন একবার। বললেন, “এই যে ভায়া, তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়াও দেখি একবার।”
ভুলু থতমত খেয়ে গেছে। কিছু বুঝতে না পেরে উঠে এসে দাঁড়াল বাঁশিকাকুর সামনে। বাঁশিকাকু একটা মাউথপিসের মতো জিনিসের সঙ্গে তাঁর ডেস্কটপটাকে সংযুক্ত করলেন কর্ড দিয়ে। মনিটরে ই.সি.জি.-র গ্রাফের মতো কীসব রেখা ফুটে উঠল। সেই মাউথপিস্টা ধরলেন ভুলুর সামনে। বললেন, “জোরসে চেঁচাও।”
ভুলু তাকিয়ে আছে ভ্যাবাচ্যাকা মুখে। আমরাও কিছুই বুঝতে পারছি না। বাঁশিকাকু বিরক্ত হয়ে বললেন, “চ্যাঁচাতে বলছি, চুপ করে আছ কেন? তেরো কিংবা উনিশের ঘরের নামতা বলো দেখি। কী হল, নামতা মুখস্থ নেই? ইচ্ছে করলে রাইমও বলতে পারো। জনি জনি, টুইঙ্কল টুইঙ্কল, ব্যা ব্যা ব্ল্যাকশিপ—যেটা খুশি বলো। কিন্তু যেটাই বলবে, বেশ জোরে জোরে বলতে হবে। নাও, শুরু করো।”
ভুলু পড়েছে মুশকিলে। বাঁশিকাকুর চেহারা কুস্তিগীরদের মতো বেশ বড়সড়। জাপটে ধরে রেখেছেন ভুলুকে। ভুলুর পালাবার পথ নেই। বাধ্য হয়ে বেচারি মাউথপিস হাতে কিছু একটা বলে চলেছে নাগাড়ে। কিন্তু গলা বসে যাওয়ায় মুখ দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোচ্ছে না। শুধু অস্পষ্ট একটু শব্দ বেরোচ্ছে। ফলে নামতা বলছে, না হরিনাম করছে, নাকি রাইম বলছে সেটাও আন্দাজ করা যাচ্ছে না।
বাঁশিকাকু একটা যন্ত্র ধরে রেখেছেন ভুলুর মুখের সামনে। মিনিট দুয়েক চেষ্টা করেও ভুলু মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারল না। বাঁশিকাকুর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গেল। কিন্তু কোনও কিছুই বোঝা গেল না। বাঁশিকাকু একগাল হেসে বললেন, “হ্যাঁ, ওতেই হবে।”
বাঁশিকাকুর এবার ভুলুকে ছেড়ে মগ্ন হয়ে পড়েছেন তাঁর কম্পিউটারের ওপর। নিবিষ্ট হয়ে কীসব করছেন। আমরা যে ঘরে বসে আছি সেদিকে তাঁর খেয়াল নেই। একটু পরে বাঁহাতের চেটোতে ডানহাত দিয়ে সজোরে ঘুসি মারলেন। ভুলুর তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “মার দিয়া কেল্লা! আমার গাট ফিলিং বলছিল তোমাকে দিয়ে হবে। তাই তোমার গলার টিম্বার নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলাম। বুঝলে ভায়া, মিরাকিউলাস রেজাল্ট পেলাম। তোমার এই জলভরা ফাটা বাঁশের মতো গলা কুড়ি হাজার হার্জ ছাড়িয়ে গেছে।”
আমরা একসঙ্গে বললাম, “তাতে কী হল?”
বাঁশি ব্যানার্জি ভুলুর উদ্দেশে বললেন, “তুমি হলে সাক্ষাৎ ঈশ্বরের সন্তান। মহিষাসুরকে বধ করার জন্য যেমন অসুরদলনী দুর্গার আবির্ভাব, ঠিক তেমনি মূষিক নিধন প্রকল্পের জন্যই তোমার জন্ম। মনোযোগ দিয়ে চেঁচালে রোডেন্ট রিপেলারের থেকেও তোমার গলা ভালো কাজ করবে। শোনো ভায়া, এখানে যেমন করলে ঠিক সেভাবে তোমাদের ক্লাবে গিয়ে তুমি ঘণ্টা খানেক ধরে গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচাবে। এই আমি, বাঁশি ব্যানার্জি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি, বড়োজোর দু-সপ্তাহ, একটা ইঁদুরও সেই শব্দতরঙ্গ সহ্য করে টিকতে পারবে না। পালাবে চোঁ-চা করে।”
প্রশস্তি শুনলে কে না খুশি হয়। কিন্তু বাঁশিকাকুর গালভরা প্রশংশা শুনে ভুলু যে খুব খুশি হয়েছে এমন মনে হল না। বাঁশি ব্যানার্জি বললেন, “তবে হ্যাঁ ভায়া, একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, এই আশ্চর্য গলার আওয়াজই হল তোমার পাশুপত অস্ত্র। তাই যতদিন ইঁদুরের বংশ ধ্বংস না হয় তোমার টোনাল কোয়ালিটি এমনই রাখতে হবে। তার জন্য দু-সপ্তাহ ধরে রোজ একটা করে কেশর কুলফি খেয়ে যেতে হবে তোমাকে। কোল্ড ড্রিঙ্কের ক্যান খেলেও কাজ চলবে। খুব শিগগিরি তোমরা রেজাল্ট পেয়ে যাবে। ক্লাবের সমস্ত ইঁদুর বিনাশ হবে।”
বাপ্পা হিসেবনিকেশ করে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। মুচকি হেসে বলল, “একগাদা টাকা খরচ করে রোডেন্ট রিপেলার কেনার থেকে কেশর কুলফি বা কোল্ড ড্রিঙ্কের খরচ আমাদের অনেক কম পড়বে। হিউম্যান রোডেন্ট রিপেলারের খাতে ক্লাব ফান্ড থেকে এটুকু খরচ করাই যায়। বড়োরাও কেউ আপত্তি করবে বলে মনে হয় না।”
পিন্টু, রাসেল, রানা হৈ হৈ করে উঠল আমার কথায়। ভুলু মুখটা কচ্ছপের মতো করে রেখেছে। হতাশা, ক্রোধ, বিরক্তি, বিবমিষা ইত্যাদি ইত্যাদি অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে মুখে। ভীষণ রেগে গিয়ে গলার রগ ফুলিয়ে একনাগাড়ে অনেক কিছু ভুলু বলতে গেল। কিন্তু এমন ফাটা কপাল বেচারির, মুখ দিয়ে ভসভস করে খানিক হাওয়া বেরোল শুধু, একটা বোধগম্য কথাও বেরোল না।