সকাল আটটায় সুধাংশুবাবুর বাড়ির বেল বাজল। সুধাংশুবাবু বিপত্নীক, একাই থাকেন, সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন। এখন তাঁর কাজের মেয়েটি সকাল ন’টায় আসে। কাগজওয়ালা দরজার হাতলে কাগজ আটকে দিয়ে চলে যায়। সুতরাং বিস্মিত ও কিছুটা বিরক্ত হয়ে তিনি দরজা খুললেন। সামনে তাঁর পাশের বাড়ির মেয়ে জিনিয়া, এক মুখ হাসি দিয়ে বলল, “গুড মর্নিং কাকু। সরি, এত সকালে আপনাকে বিরক্ত করলাম।”
সুধাংশুবাবু কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন। এই মেয়েটি ছোটোবেলায় তাঁর প্রয়াত স্ত্রীর খুব প্রিয় ছিল। নিঃসন্তান সুষমা জিনিয়াকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন। সেই সূত্রে সুধাংশুবাবুরও কিছুটা দুর্বলতা রয়ে গেছে। জিনিয়া এখন বাড়ির কাছেই একটা স্কুলে পড়ায়। তিনি মুখে হাসি টেনে বললেন, “আরে তুমি! ভিতরে এসো।”
জিনিয়া ভিতরে ঢুকে সোফায় তাঁর মুখোমুখি বসল। হেসে বলল, “কাকু, আপনি তো রিটায়ার করেছেন, কালকে আমাদের সঙ্গে একজায়গায় যাবেন? একটা দিন দিতে হবে।”
সুধাংশুবাবু বিস্মিত হয়ে বললেন, “কোথায়!”
জিনিয়া বলল, “সুন্দরবনে গোসাবার কাছে একটা গ্রামে। ওখানে আমি আর আমার এক বন্ধু গ্রামবাসীদের সাহায্য করার জন্য কাজ করছি।”
সুধাংশুবাবু জিনিয়াকে লুকিয়ে একটা শ্বাস ফেললেন। ব্যাপারটা বোঝা গেছে। এরা সুধাংশুবাবুকে নিজেদের এন.জি.ও-র কাজকর্ম দেখিয়ে কিছু সাহায্য চায়।
এইখানে বলে রাখা ভালো, পাড়ায় কৃপণ বলে সুধাংশুবাবুর দুর্নাম আছে। তাঁর কাছ থেকে চাঁদা আদায় করাটা পাড়ার ছেলেদের কাছে দুঃস্বপ্ন ছিল। তাঁর জীবনযাত্রাও খুব সাধারণ ছিল। ভালো রোজগার করতেন, কিন্তু স্ত্রীর শত অনুযোগ সত্ত্বেও কোনোরকম বিলাসিতাকে কখনো প্রশ্রয় দেননি।
তিনি আমতা আমতা করে বললেন, “জিনিয়া, তুমি তো জানো আমি…”
জিনিয়া তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “কাকু, আমি কিন্তু আপনার কাছে কোনো ডোনেশনের জন্য আসিনি। আসলে এই গ্রামটায় আমরা অনেকদিন ধরে কাজ করছি। আমি আর আমার এক বন্ধু শুভম, আমরা দুজনেই যাই। গত সপ্তাহে সাইক্লোনের ধাক্কায় গ্রামটা একদম লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। তাই, মনে হয়েছিল আপনার মতো একজন সিনিয়র লোককে আমাদের সঙ্গে দেখলে ওরা কিছুটা ভরসা পাবে। বাকি কাজ যা করার আমরাই করব।”
সুধাংশুবাবু একটু ভাবলেন। জিনিয়া যা বলছে তা পুরোপুরি সত্যি না হলেও ঘুরে আসতে বাধা নেই। তাছাড়া এত কাছে হলেও সুন্দরবনের দিকটায় তাঁর যাওয়া হয়নি। এই সুযোগে ঘুরে আসা যেতেই পারে। তিনি নিমরাজি হবার ভাব করে বললেন, “আমাকে কী করতে হবে?”
জিনিয়া হেসে বলল, “কিচ্ছু না। আপনি খালি কাল সকাল সাতটার মধ্যে রেডি হয়ে থাকবেন।”
পরের দিন ঠিক সাতটাতেই যাত্রা শুরু হল। বাড়ি থেকে ট্যাক্সি ধরে শিয়ালদা স্টেশন। শুভম এখানে ওঁদের সঙ্গে যোগ দিল। ছেলেটি কলেজে জিনিয়ার সহপাঠী ছিল। এখন একটি প্রাইভেট অফিসে কাজ করে আর অবসর সময়ে সোশ্যাল ওয়ার্ক করে। হাসিখুশি মৃদুভাষী ছেলেটিকে সুধাংশুবাবুর ভালোই লাগল।
শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে ক্যানিং। সেখানকার বাজারে জিনিয়ারা চাল, ডাল, মশলা, নুন ইত্যাদি কেনাকাটা করল। অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন মোমবাতি, দেশলাই, ব্লিচিং পাউডার এবং কিছু ওষুধপত্র এসবও নিল। মালপত্র বইতে তাদের সাহায্য করার জন্য বাজার থেকে সারাদিনের কড়ারে দুজন লোককেও নিয়ে নিল। তারপর পাঁচজনে মিলে মালপত্র নিয়ে একটা গাড়ি করে সোনাখালি। সেখান থেকে মোটরচালিত নৌকো।
সুধাংশুবাবুর ভালোই লাগছিল। অনেকদিন পরে কলকাতার বাইরে বেরোনো হল। চাকরি-জীবনে স্ত্রীকে নিয়ে দিঘা বা বকখালি ছাড়া বিশেষ কোথাও যাননি। তাও শেষদিকে স্ত্রীর অসুস্থতার জন্য বন্ধ ছিল।
প্রায় ঘণ্টা দুই পরে চালক ও তার সহকারী দুজনে মিলে নৌকাটা যেখানে থামাল সেখান থেকে পাড় বেশ কিছুটা দূর। মাঝখানে কাদায় ভর্তি। জিনিয়া, শুভম আর লোকদুটি জুতো হাতে নিয়ে কাদার মধ্যেই দিব্যি নেমে পড়ল। সুধাংশুবাবু ইতস্তত করছিলেন। তাই দেখে লোকদুটি নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করে সুধাংশুবাবুর কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আসেন বাবু।”
সুধাংশুবাবুর মৃদু আপত্তি অগ্রাহ্য করে ওরা অনায়াসে তাঁকে কাঁধে তুলে নিল। একটু পরে কাদা ভেঙে শুকনো জায়গায় নামিয়েও দিল। দিয়ে আবার নৌকায় ফিরে গেল জিনিসপত্র আনতে। জিনিয়া আর শুভমও ততক্ষণে পৌঁছে গেছে।
সুধাংশুবাবু এবার পিছনে ঘুরে দেখলেন। এখান থেকে একটা সরু কাঁচা রাস্তা কিছুটা উপরে উঠে গেছে। দু-পাশে ঝোপঝাড়। দু-দিকে জমা জলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
একটু পরেই লোকদুটি চাল-ডালের বস্তা পিঠে নিয়ে এসে গেল। অন্যান্য জিনিসপত্র দুটো বড়ো ব্যাগে করে জিনিয়া আর শুভম নিয়ে চলেছে। জিনিয়া যেতে যেতে বলল, “কাকু, এই গ্রামটার নাম বৈকুণ্ঠপুর। আমরা এখানেই কাজ করি।”
উপরে উঠে সামনে তাকিয়ে সুধাংশুবাবুর মুখ দিয়ে তাঁর অজান্তেই একটা বিস্ময়সূচক শব্দ বেরিয়ে এল। সামনে এক ফালি রাস্তা শুধু জেগে রয়েছে। দু-পাশে নীচু জমির বেশিরভাগই জলের তলায়। চাল উড়ে যাওয়া বাড়িগুলির কয়েকটি দেয়াল ইতস্তত জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে। জলে ভাসছে দরমার বেড়া ও অ্যাসবেস্টসের চাল। এ-পাশে ও-পাশে মাঝেমধ্যে জলের মধ্যে শুয়ে পড়া কয়েকটি ছোটোবড়ো গাছ। কোথাও মানুষজনের সাড়া নেই। ভূতুড়ে গ্রাম যেন। পাশে জিনিয়ারা থাকা সত্ত্বেও সুধাংশুবাবুর গা ছমছম করে উঠল।
জিনিয়া তাঁকে লক্ষ করছিল। বলল, “নদীর বাঁধ ভেঙে এই অবস্থা। এখানে তবু রাস্তাটা জেগে আছে, অনেক জায়গায় নৌকা করেই পুরোটা যেতে হয়।”
জিনিসপত্র নিয়ে সরু রাস্তা দিয়ে তাঁরা এগোতে থাকলেন। মাঝেমধ্যেই রাস্তা জুড়ে গাছ পড়ে রয়েছে। সাবধানে ডালপালা সরিয়ে যেতে হচ্ছিল।
মিনিট দশেক এভাবে হাঁটার পর স্কুলবাড়িটা দেখা গেল। একটু উঁচু জমির উপর ছড়ানো বাড়ি। মাঝখানে একটা উঠোন ঘিরে চারদিকে সারি দিয়ে কয়েকটি ক্লাস-রুম। মানুষগুলিকেও দেখা যাচ্ছিল—কেউ কেউ ক্লাস-রুমে, কয়েকজন উঠোন ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। আরো কয়েকজন গেটের কাছে সম্ভবত তাঁদেরই প্রতীক্ষায়। এবার তাঁদের দেখতে পেয়ে একটা সমবেত উল্লাসের আওয়াজ ছিটকে উঠল। সেই শব্দে অন্য লোকজনরাও ক্লাস-ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গলা মেলাল।
স্কুলের গেটে পৌঁছানোর আগেই কয়েকজন দৌড়ে এসে তাঁদের কাছ থেকে জিনিসপত্র ভিতরে নিয়ে গেল। জিনিয়া একটি লোককে মৃদু কন্ঠে কিছু জিজ্ঞেস করে সুধাংশুবাবুকে বলল, “পাঁচদিন আগে এসেছিলাম। যা দিয়ে গেছিলাম, দু-দিন আগেই ফুরিয়ে গেছে। এ গ্রামটা একটু ভিতরে বলে এখানে সরকারি ত্রাণের সামগ্রী এখনো সেভাবে পৌঁছতে পারেনি।”
তাঁরা গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে একটি ক্লাস-ঘরে গিয়ে বসলেন। বাইরে উঠোনে বোধ হয় উনুন জ্বেলে রান্নার বন্দোবস্ত শুরু হয়ে গেছে। জিনিয়া ও শুভম উঠে সেদিকে গেল। জিনিয়া একটু পরে এক বৃদ্ধকে নিয়ে ফিরে এল। সুধাংশুবাবুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল, “চাচা, ইনি কলকাতা থেকে তোমাদের দেখতে এসেছেন।”
লোকটির নাম কাশিম, পরনে রঙ উঠে যাওয়া চেক লুঙ্গি ও ময়লা ফতুয়া, মুখে অজস্র বলিরেখা, চোখ গর্তে বসা। বয়স বোঝা মুশকিল। হাত তুলে সুধাংশুবাবুকে সেলাম করে বলল, “আল্লা আপনাদের দোয়া করবেন কর্তা।”
বৃদ্ধকে সুধাংশুবাবুর কাছে বসিয়ে দিয়ে জিনিয়া আবার চলে গেল। টুকটাক কথাবার্তা শুরু হল। ধীরে ধীরে জানা গেল, এক হপ্তা আগে সাইক্লোনের দিন সন্ধ্যাবেলা এরা সবাই তল্পিতল্পা নিয়ে স্কুলবাড়িতে এসে আশ্রয় নেয়। গরু-বাছুর খুঁটিতে বাঁধা ছিল, আসার আগে খুলে দিয়ে এসেছিল। কিছু বেঁচেছে, কিছু ভেসে গেছে। সেদিন ক্লাস-ঘরে মাথা গুঁজেই সবাই সারারাত ধরে ঝড়ের হিংস্র গর্জন শুনেছে। পরের দিন সকালে ঝড় থামতে ফিরে গিয়ে দেখেছে বাড়ি প্রায় না থাকার মতোই। অগত্যা আবার স্কুলেই আশ্রয় নেওয়া। প্রায় তিনদিন সঙ্গের সামান্য শুকনো খাবার খেয়ে অর্ধাহারে অনাহারে কাটানোর পর জিনিয়ারাই প্রথম চাল-ডাল-মশলা ইত্যাদি নিয়ে আসে। সেই থেকে স্কুলের উঠোনে উনুন বানিয়ে খিচুড়ি রান্না করে চলছে। মাঝখানে একদিন বিডিওর অফিস থেকে লোক এসে তাদের চিঁড়ে-মুড়ির প্যাকেট এবং জলের পাউচ দিয়ে গেছে এবং নাম-ঠিকানা ইত্যাদি লিখে নিয়েছে। বলেছে আরো ত্রাণ আসবে, তবে ক’দিন সময় লাগবে। গোটা সুন্দরবন এলাকাই নাকি এখন জলের তলায়।
সুধাংশুবাবু অবাক হয়ে শুনছিলেন। তাঁর চেনাজানার একেবারে বাইরে এই জগৎ সম্বন্ধে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এই প্রথম।
লোকটিকে কথায় পেয়েছে। সে বলল, “আমরা দীন-দুঃখী মানুষ গো কর্তা। এসব আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। প্রতিবছর ঝড়ে, বানে, অসুখ-বিসুখে গেরামে কত লোক মারা যায়। মিথ্যা বলবনি, শহরের বাবুরা আসেন, চালটা টাকাটা দিয়ে যান, তবে ওই যে বললাম, আমাদের ফাটা কপাল।”
সুধাংশুবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “অসুখ-বিসুখ হলে কোথায় যান?”
লোকটি এক মুখ হেসে বলল, “গ্রামে ভালো ওঝা আছে বাবু, ছোটোখাটো অসুখে সে-ই জলপড়া-টড়া দিয়ে দেয়। তাতে কাজ না হলে পাশের গাঁয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, সেখান থেকে ওষুধ নিয়ে আসি।”
কথার ফাঁকে একটি মেয়ে এসে ভাঁড়ে করে চা দিয়ে গেল। তাঁকে বিস্মিত হতে দেখে মেয়েটি হেসে বলল, “ওই জিনিয়াদিদিই চা-দুধ-চিনি সব নিয়ে এসেছেন।”
বলতে বলতেই চায়ের ভাঁড় হাতে জিনিয়ার প্রবেশ। এক ঝলক হাসি দিয়ে বলল, “চা কিন্তু আমি বানিয়েছি কাকু, ভালো হয়েছে?”
কাশিমকে বলল, “চাচা, চা খেয়ে নাও, পরে পাবে না।”
কাশিম উঠে দ্রুতপায়ে চা নিতে চলে গেল। জিনিয়া পাশে এসে বসল। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। তারপর সুধাংশুবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের মতো আরো অনেকে নিশ্চয়ই এদের জন্যে কাজ করছে?”
জিনিয়া বলল, “সে তো বটেই, তবে এখানে আমরা ছাড়া এখনো কেউ আসেনি।”
“তোমরা শুরু করেছিলে কীভাবে?”
জিনিয়া হেসে বলল, “শুরু করেছিল শুভম। ও আগে এক অফিসে কাজ করত। সেখানকার ক্যান্টিনের একটি ছেলের বাড়ি এই গ্রামে। তার সঙ্গে কয়েকবার এখানে এসে ও ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে। পরে আমাকেও টেনে নেয়। আমাদের সামর্থ্য কম, অন্য কাজও করি, তবু চেষ্টা করি মাসে অন্তত একবার আসতে। তাছাড়া এরকম ঝড় বা বন্যা ইত্যাদি হলে তো আসতেই হয়। পরে ইচ্ছে আছে সপ্তাহে অন্তত একদিন করে এখানে একজন ডাক্তারকে নিয়ে আসার। দেখা যাক।”
ওঁরা উঠে বাইরে এলেন। মাটির উনুনে কাঠের জ্বালের উপর খিচুড়ির চাল-ডাল ফুটছে। সামান্য উপকরণ, তাতেই চমৎকার গন্ধ বেরিয়েছে। ছোটোবড়ো ক্ষুধার্ত মুখগুলি হাঁড়ি ঘিরে দাঁড়িয়ে, পারলে এখনই শালপাতার থালায় তুলে নেয়।
একটু পরেই গরম গরম খিচুড়ি পরিবেশন করা শুরু হয়ে গেল। সুধাংশুবাবুও খেলেন। চমৎকার স্বাদ।
খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলে জিনিয়া আর শুভম রাঁধুনিদের নিয়ে বসল। হিসেব করে দেখা গেল, যে পরিমাণ চাল-ডাল আনা হয়েছে তাই দিয়ে দু-বেলা রাঁধলে মেরেকেটে দিন তিনেক চলবে। তার মধ্যে যদি সরকারি ত্রাণের জিনিস চলে আসে তো ভালো, নয়তো এদের উপোস করতে হবে। শুভম আর জিনিয়া মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। একজন বয়স্কা মহিলা রান্নার ব্যাপারটা তদারকি করছিলেন, তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললেন, “তোমরা এসো বাপু সুবিধামতন। আমরা না হয় একবেলা খেয়েই আরো কয়েকদিন চালিয়ে নেব।”
ফেরার সময় গ্রামের দুটি লোক এসে ওঁদের নৌকা অবধি এগিয়ে দিয়ে গেল। তবে সুধাংশুবাবু এবারে আর কাঁধে চড়তে রাজি হলেন না, জুতো হাতে নিয়ে প্যান্ট গুটিয়ে কাদাতেই পা ডোবালেন।
ফেরার সময় নৌকোয় বসে টুকটাক কথা হচ্ছিল। সুধাংশুবাবু আশেপাশের গ্রামের কথা জিজ্ঞেস করলেন। জিনিয়া লজ্জিত মুখে বলল, “গেছি দু-একবার। একইরকম অবস্থা। বৈকুণ্ঠপুরে তবু একটা স্কুল আছে। পাশের গ্রামগুলিতে তাও নেই। বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরই ইচ্ছা থাকলেও পড়াশুনোর সুযোগ নেই। তবে কী জানেন কাকু, আমাদের সাধ্য কম, যেটুকু পারি, করি।”
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বাজল। বাড়ির দরজার সামনে এসে সুধাংশুবাবু জিনিয়াকে বললেন, “কাল সকালে একবার এসো।”
পরের দিন জিনিয়ার স্কুল ছিল। সে যাবার জন্য তৈরি হয়ে নিয়ে ন’টা নাগাদ সুধাংশুবাবুর বাড়ির বেল বাজাল। সুধাংশুবাবু তাকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে ভিতরে গেলেন। তারপর একটা চেক এনে তার হাতে দিলেন। চেকটা জিনিয়ার নামেই লেখা। টাকার অঙ্কটা দেখে তার মাথা ঘুরে গেল। এই টাকায় সে আগামী একবছর বৈকুণ্ঠপুর ও তার আশেপাশের গ্রামের জন্য অনেক কিছুই করতে পারবে। আনন্দে তার চোখের কোনা দিয়ে জল গড়িয়ে এল। সে চোখ মুছে নিয়ে চেকটা আবার সুধাংশুবাবুর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “কাকু, আপনার কাছে একটা কথা না বলে এই চেকটা আমি নিতে পারব না।”
সুধাংশুবাবু বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালেন। জিনিয়া মাথা নামিয়ে বলল, “কাল আপনাকে মিথ্যা কথা বলেছিলাম। আপনাকে বৈকুণ্ঠপুরে নিয়ে যাবার পিছনে আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আপনার কাছ থেকে যদি কিছু ডোনেশন পাওয়া যায়।”
সুধাংশুবাবু কয়েক মুহূর্ত তাকে দেখলেন তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে জিনিয়ার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “ওরে, ষাট বছর ধরে জমিয়ে কিপটেমো করেছি। কেউ একটা পয়সা বার করতে পারেনি। তোর মতো একটা বাচ্চা মেয়ে আমার চোখে ধুলো দেবে? তবে কী বল তো জিনিয়া, তোর মতো কারো কাছে একবার জেনেশুনে ঠকে যাওয়াটা বোধ হয় বড়ো দরকার ছিল।”
অলঙ্করণ-সায়ন মজুমদার
জয়ঢাকের গল্পঘর
গল্পটি লেখকের কুড়িটি কিশোর কাহিনির সঙ্কলন ‘ভয়ের ভাক্সিন” নামের বই থেকে থেকে নেয়া। বইটি সম্বন্ধে জানতে ও জয়ঢাক প্রকাশনের বুকস্টোর থেকে অর্ডার দিতে নীচের ছবিতে ক্লিক করুন