এই লেখকের আগের লেখা- মূর্তি উধাও রহস্য
স্কুলে আমাদের ইতিহাস পড়াতেন চন্দ্রিমাদি। উনি বলতেন, “আমি আসি তোমাদের সঙ্গে গল্প করতে। ইতিহাস মানে তো শুধু নীরস কিছু বিষয় আর সাল-তারিখের সমাহার নয়, ইতিহাস হল একটা লিপিবদ্ধ কাহিনি। সে প্রাচীন যুগ বলো, মধ্যযুগ বলো, কি আধুনিক যুগ বলো, যুগ যুগ ধরে ভারতবর্ষের নানান কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন ঐতিহাসিকেরা। তোমাদের পাঠ্যপুস্তকে তার সামান্যই লেখা আছে। বাকিটা জানতে হলে তোমাদের অনেক অনেক বই পড়তে হবে। প্রতিটি মানুষকে অবশ্যই তার নিজের দেশের ইতিহাস জানতে হবে। আজ আমি তোমাদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের কাহিনি শোনাব। আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে অর্থাৎ ১৯১৯ সালের এই দিনটিতে কী হয়েছিল তোমরা কেউ বলতে পারবে?”
দিতিপ্রিয়া, সমাদৃতা, শালিনী, মুস্তান এ ওর মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু কেউই সদুত্তর দিতে পারল না।
চন্দ্রিমাদি বললেন, “আজ কত তারিখ সেটা বলতে পারবে নিশ্চয়ই?”
সকলে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, “১৩ই এপ্রিল ম্যাডাম।”
চন্দ্রিমা ম্যাডাম বললেন, “তোমরা নিশ্চয়ই পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরের নাম শুনেছ, শিখদের পবিত্র তীর্থভূমি। সেই অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির থেকে মাত্র ছয়শো মিটার দূরে অবস্থিত জালিয়ানওয়ালাবাগ নামে একটি শহর। এই দিনটিতে শিখদের নববর্ষ উৎসব পালিত হত। হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন সেই উদ্যানে। সেই সময়ে পাঞ্জাবে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে। কিন্তু সে-সব অগ্রাহ্য করেও পাঞ্জাবের প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ সেখানে মিলিত হয়েছেন। কেন জানো? সেই কাহিনিই তোমাদের আজ শোনাব, আর তার সঙ্গে শোনাব এমন একজন মানুষের কাহিনি যিনি এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।”
চন্দ্রিমাদি বলে চলেছেন সেই রোমহর্ষক গল্প। আর আমরা অবাক হয়ে শুনতে লাগলাম সেই কাহিনি।
এক
১৩ই মার্চ, ১৯৪০, ইংল্যান্ডের ক্যাক্সটন হল।
১০ নম্বর ক্যাক্সটন হলের দিকে সেদিন এগিয়ে আসছেন দীর্ঘদেহী, প্রখর ব্যক্তিত্বশালী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং আত্মবিশ্বাসপরায়ণ মানুষটি। সেন্ট্রাল এশিয়ান সোসাইটি এবং ইস্ট ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সভা বসেছে ইংল্যান্ডের ক্যাক্সটন হলে। দর্শকাসন পরিপূর্ণ। মঞ্চে উপবিষ্ট আছেন ইংল্যান্ডের কয়েকজন মান্যজন। দর্শকদের ভিতরেও বহু বিশিষ্ট মানুষ উপস্থিত আছেন। একের পর এক তাঁরা বক্তব্য রেখেছেন। এরপর বক্তব্য রাখতে উঠলেন পঁচাত্তর বছর বয়স্ক একজন প্রৌঢ়। সকলে মন দিয়ে শুনছিলেন তাঁর কথাগুলো। সেই সময়ে পুরোপুরি সাহেবি পোশাক পরে হলের ভিতরে প্রবেশ করলেন চল্লিশ বছর বয়স্ক এক পুরুষ। তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মঞ্চের কাছাকাছি দেওয়ালের দিকে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়ে দেখে নিলেন গোটা পরিবেশটা। তাঁর হাতে ধরা ছিল একটা মোটাসোটা বাঁধানো বই। মাইক্রোফোনের সামনে ভাষণরত ইংরেজ প্রৌঢ়কে দেখে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। এই তো সেই মানুষটি। তাঁর নিষ্ঠুর চাহনি, কুটিল হাসি, শ্লেষাত্মক বাচনভঙ্গি, ভারতবাসীর প্রতি তীব্র বিদ্রূপ তাঁকে মনে করিয়ে দিল ১৩ই এপ্রিলের সেই স্মৃতি। কথাটা মনে পড়তেই সমস্ত শরীরে অগ্নিস্রোত প্রবাহিত হল। এতদিন বুকের ভিতরে যে আগ্নেয়গিরি সুপ্ত ছিল, আজ সহসা সেটা জাগ্রত হল। বুকের ভিতরে অনুভূত হল গলন্ত লাভাস্রোতের আলোড়ন। তিনি আজ একুশ বছর ধরে এই দিনটার অপেক্ষাতেই ছিলেন। আজ সেই মুহূর্তকাল তার সামনে উপস্থিত।
বক্তা তাঁর বক্তব্য শেষ করে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। তারপর কয়েক পা এগিয়ে এসে লর্ড জেটল্যান্ড (সেক্রেটারি অফ স্টেট, ইন্ডিয়া)-এর দিকে কিছু একটা বলার জন্যে এলেন।
ইংরেজের পোশাক পরিহিত পুরুষটি এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সকলের অজান্তে চুপিসারে বইয়ের ভিতর থেকে পয়েন্ট ৪৫ স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন রিভলভারটা বের করলেন। তারপর গুলি ছুড়লেন প্রৌঢ়কে লক্ষ্য করে। পরপর ছয় রাউন্ড গুলি ছুড়লেন। দুটো গুলির একটা তাঁর হৃৎপিণ্ড এবং ফুসফুস ভেদ করে বেরিয়ে গেল এবং অপর গুলিটি তাঁর কিডনি বিদ্ধ করল। প্রৌঢ় তৎক্ষণাৎ নীচেয় লুটিয়ে পড়লেন এবং মৃত্যুবরণ করলেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন লর্ড জেটল্যান্ড, লুইস ডেন, চার্লস বেইলি (লেফটেন্যান্ট গভর্নর অফ পাঞ্জাব) এবং বোম্বের লেফটেন্যান্ট গভর্নর লর্ড ব্যারন ল্যামিংটন। তাঁরাও গুরুতরভাবে আহত হলেন।
গুলির শব্দে হলের সকলে হতচকিত হয়ে পড়ল। দর্শকদের ভিতরে তুমুল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। তাঁরা আসন ছেড়ে যে যার মতো পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে লাগলেন।
“সেদিনের সেই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি কথা তোমাদের জেনে রাখতে হবে। প্রায় কুড়ি বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনা। খুব মন দিয়ে শোনো।”
দুই
১৩ই এপ্রিল, ১৯১৯ সাল। পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক একটি উদ্যান ছিল। পাঞ্জাবে তখন সামরিক শাসন জারি হয়েছে। ইংরেজ সরকার বিভিন্ন সভা-সমিতি এবং জমায়েতের উপরে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সংবাদপত্রের সমস্ত রকমের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। রাউলাট আইনের প্রতিবাদে সমগ্র পাঞ্জাব অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। গান্ধীজি রাউলাট আইনের প্রতিবাদে ৩০শে মার্চ এবং ৬ই এপ্রিল হরতালের ডাক দিলেন। তাঁর এই আবেদনে পাঞ্জাবের মানুষ বিপুলভাবে সাড়া দেন। হরতালে হিন্দু এবং মুসলমানের সংহতি দেখে ব্রিটিশ সরকার বিচলিত হল এবং ভয় পেল। পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে ভেবে পাঞ্জাবের গভর্নর পাঞ্জাবে গান্ধীজির প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিলেন। খবরটা তুষের আগুনের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সমগ্র পাঞ্জাবে আগুন জ্বলল। এই সময়ে গান্ধীজি পাঞ্জাবে এলে তাঁকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হল। অপর দুইজন নেতা সত্যপাল এবং সইফুদ্দিন কিচলুর কারাবাস হল। কারণ, তাঁরা নাকি বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। সকলে বুঝতে পারল সরকার রাউলাট আইন প্রণয়ন করে জনগণকে কোণঠাসা করতে চাইছে।
অমৃতসর শহরে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক এক সংরক্ষিত উদ্যানে সেদিন এই রাওলাট আইনের প্রতিবাদে সভা বসেছিল। প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। তাদের ভিতরে ছিল মহিলা, শিশু, যুবক, যুবতী এবং বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। প্রায় দশ ফুট উঁচু পাচিল এবং বড়ো বড়ো অট্টালিকার প্রায় মাঝখানে ছিল এই উদ্যানটি। সেখানে প্রবেশের দুটো মাত্র পথ ছিল। প্রবেশপথও ছিল খুবই সংকীর্ণ। বৈশাখের প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করেও বহু দূর থেকে তাঁরা একে একে জমায়েত হয়েছিলেন। অত্যাচারী ইংরেজ সরকারের নিপীড়ন এবং দমননীতির বিরুদ্ধে আলোচিত হচ্ছিল। মঞ্চে বক্তব্য রাখছিলেন একজন সংগ্রামী নেতা। সকলে নেতার সেই জ্বালাময়ী বক্তব্য মন দিয়ে শুনছিলেন। ইংরেজ সরকারের প্রতি তাদের ক্ষোভ উগরে উঠছিল।
তাঁরা জানেন ইংরেজ সরকার ভারতবাসীর সঙ্গে কী বেইমানিটাই না করল। ১৯১৪তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল। সেই সময়ে সেখানে বহু ভারতীয় সেনাদের যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করেছিল ইংরেজ সরকার। ইংরেজ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যুদ্ধ-শেষে ভারতকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হবে। ১৯১৯-এ যুদ্ধ শেষ হল। কিন্তু সরকার তার কথা রাখল না। উপরন্তু যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হাজার হাজার সৈনিক বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। গান্ধীজি সহ তাবড় তাবড় নেতারা সরকারকে তার প্রতিশ্রুতির কথা মনে দিলেও কোনো কাজ হল না। এর ভিতরে দেশ জুড়ে দেখা দিল অর্থনৈতিক মন্দা। জনগণের ভিতরে সরকার বিরোধী মনোভাব দানা বাঁধতে লাগল। ইংরেজ সরকার বুঝতে পেরে সকল বিক্ষোভকারীদের কঠোর হাতে দমন করার জন্যে নির্যাতন মূলক আইন প্রণয়ন করল। বিনা বিচারে গ্রেফতার, কোনোরকম প্রমাণ ছাড়াই বন্দি এবং নিপীড়ন চালাতে লাগল। প্রকাশ্যে মিটিং মিছিল বন্ধ করে দেওয়া হল। মহাত্মা গান্ধী তখন অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মাধ্যমে এর প্রতিবাদ করতে তৎপর হলেন এবং গ্রেফতার হলেন। এই সংবাদ শোনার পরে এর প্রতিবাদে আমেদাবাদে শিল্প শ্রমিক এবং পাঞ্জাবের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। তাঁরা সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করতে লাগলেন। সরকার গান্ধীজিকে বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিলেও অপর দুই নেতা সত্যপাল এবং সৈফুদ্দিন কিচলুর কারাবাস হল। পাঞ্জাবের মানুষ ক্ষোভে ফুঁসতে লাগলেন। পাঞ্জাবের তখনকার গভর্নর ছিলেন জেনারেল মাইকেল ও ডায়ার। তিনি সামরিক শাসন জারির নির্দেশ দিলেন। জারি হল ১৪৪ ধারা। প্রকাশ্যে সভ্য, সমিতি, মিটিং, মিছিল এবং একত্রে জমায়েত বন্ধ হল।
মানুষ বুঝতে পারল সরকার অন্যায়ভাবে তাদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করছে। সকলে এর প্রতিবাদে জালিয়ানওয়ালাবাগে জমায়েত হলেন। কথাটা গোপন রইল না।
সংবাদটা কানে যাওয়া মাত্র সামরিক প্রধান ব্রিগেডিয়ার এডওয়ার্ড হ্যারি ডায়ার পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর মাইকেল ও ডায়ারের সঙ্গে আলোচনা করলেন। গভর্নরের নির্দেশমতো তৎক্ষণাৎ সামরিক প্রধান হ্যারি ডায়ার প্রস্তুত হলেন। তিনি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সৈনিকদের প্রস্তুত হতে বললেন। খুব অল্প সময়ের ভিতরে ১০০ জন গোর্খা সৈন্য এবং দুটো সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে রওনা দিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগের উদ্দেশে। সামনের গাড়িতে অন্য একজন সামরিক অফিসারের সঙ্গে জেনারেল ডায়ার বসে আছেন। তাঁর চোয়াল শক্ত। ক্রুর দৃষ্টি দিয়ে চারদিকটা দেখতে দেখতে চলেছেন আর মনে মনে কীসের একটা হিসাব কষে চলেছেন। তাঁর কুটিল চাউনি বলে দিচ্ছে তিনি ভয়ংকর কোনো খেলায় নামতে চলেছেন। পিছনে ছন্দোবদ্ধভাবে জোর পায়ে ছুটে আসছে ১০০ সৈন্য। তাদের পদভারে কম্পিত হচ্ছে অমৃতসর শহরের রাজপথ। শহরবাসী শঙ্কিত হলেন। যাঁরা বাড়িতে ছিলেন, তাঁরা জানালার কপাট একটুখানি খুলে দেখতে লাগলেন। এক অশনি সংকেতে তাদের বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। কোথায় চলেছেন এরা? মনে মনে বললেন তাঁরা। ইংরেজ সরকারের মতিগতি সত্যি বোঝা দায়। এমনিতে পথঘাট প্রায় জনহীন। নিতান্ত প্রয়োজন না পড়লে কেউই পথে বের হচ্ছে না। সরকারের নির্দেশমতো তিন থেকে চারজনের বেশি কোথাও একত্রে জমায়েত হওয়া আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যাঁরা পথে বেরিয়েছিলেন, তাঁরা পরস্পরের ভিতরে আলোচনা করতে লাগলেন। চোখের সামনে দিয়ে সৈন্যদল ছুটে বেরিয়ে গেল। ঠিক যেমন যুদ্ধের আগে সেনাপতির নির্দেশে সৈন্যদল চলে, ঠিক সেইরকম।
জালিয়ানওয়ালাবাগের সামনে এসে তাঁরা দাঁড়ালেন। জেনারেল ডায়ার সাঁজোয়া গাড়ি থেকে নামলেন। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে সেনাদের দিকে তাকালেন। হাতের ইঙ্গিতে কিছু একটা বুঝিয়ে উদ্যানের সেই সংকীর্ণ পথের ভিতর দিয়ে ডায়ার তাঁর সৈন্যদের নিয়ে প্রবেশ করলেন।
প্রখর গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহ উপেক্ষা করে মানুষ সেদিন জমায়েত হয়েছিলেন। আশেপাশের গ্রামগঞ্জ থেকে তাঁরা এসেছিলেন এখানে। সেই সকাল থেকে দূরদূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে একে একে জমায়েত হয়েছিলেন। তাঁরা সকলেই ছিলেন তৃষ্ণার্ত। দলের অনেকেই পিপাসার্ত মানুষদের জল দান করছিলেন। তাদের ভিতরে উনিশ বছর বয়সী একজন সৎ, সাহসী এবং উদ্যমী তরুণ ছিল। সে এবং তার কয়েকজন সঙ্গীসহ সেই সরু গলিপথ দিয়ে কুয়ো থেকে জল এনে উপস্থিত জনতার তৃষ্ণা মোচন করছিল। জল এনে গলিপথ দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই হঠাৎ তার নজরে পড়ল শ’ খানেক সৈন্যদের উপস্থিতি। একেবারে গোটা উদ্যান ঘিরে ফেলেছে তারা। প্রত্যেকের হাতেই উদ্যত ছিল রাইফেল। তরুণের বুকের ভিতটা কেঁপে উঠল সহসা। এক ভয়ংকর বিপদের আভাস পেল সে। কথাটা কাউকে বলার আগেই সে দেখতে পেল ডায়ারের নির্দেশে সৈন্যরা দুটো দলে ভাগ হয়ে ডায়ারের দুই পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। মঞ্চে তখন জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছিলেন একজন সংগ্রামী নেতা। উপস্থিত সকলে গভীর মন দিয়ে শুনছিলেন তাঁর কথাগুলো। ডায়ার এই সুযোগে দ্রুত সৈন্যদের উদ্যানের ভিতরে চারদিক ঘিরে ফেলার নির্দেশ দিলেন। তারপর অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে উদ্যান থেকে বের হওয়ার দুটি পথই বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন।
ছেলেটি কাউকে কিছু বলার আগেই ডায়ার তাঁর সৈন্যদের জনগণের দিকে মুখ করে গুলি চালানোর নির্দেশ দিলেন।
১৬৫০ রাউন্ড গুলি চলল টানা দশ মিনিট ধরে নিরস্ত্র জনতার উপরে। গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন অসংখ্য মানুষ। শয়ে শয়ে মানুষ অচিরেই মৃত্যুবরণ করলেন। শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বাঁচার জন্যে পাগলের মতো ছুটোছুটি করতে লাগলেন। শিশুদের ভিতরে অনেকেই পদপিষ্ট হয়ে মারা গেল। যারা ছুটোছুটি করছিল তাদের কারো গায়ে, বুকে, মাথায় গুলি এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিল। তারা সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল। অনেকেই প্রবেশপথের কাছে এসে দেখলেন সেই পথ বন্ধ। লোহার গেট বেয়ে উপরে ওঠার ব্যর্থ প্রয়াস চালালেন। কেউ কেউ বাঁচার জন্যে পাশের কুয়োতে ঝাঁপ দিল। কিন্তু তাতেও রেহাই পেল না তারা। সেখানেও গুলি ছুড়ে এবং পাথর ফেলে তাদের হত্যা করা হল। অসহায় আহত, যন্ত্রণাক্লিষ্ট, রক্তাক্ত মানুষের ক্রন্দনে বাতাস ভারী হয়ে এল। তাদের মরণ যন্ত্রণা আর মর্মান্তিক আর্তনাদে ডায়ার পরিতৃপ্তির হাসি হাসলেন। এইসব কিছু ঘটেছিল সেই উনিশ বছর বয়সী ছেলেটার চোখের সামনে। সেও সেদিন গুলির আঘাতে গুরুতরভাবে জখম হল। কাঁধে গুলি লাগায় সে মাটিতে শুয়ে পড়েছিল। পরে সেখানেই মড়ার মতো পড়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ। ঘটনাচক্রে সে সেদিন বেঁচে গিয়েছিল। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে একসময় মাটিতে শুয়ে সে সবকিছু প্রত্যক্ষ করতে লাগল। কী নৃশংস হত্যালীলা চালিয়ে গেলেন ডায়ার। গুলির শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠল গোটা শহর। রক্তের বন্যা বয়ে গেল জালিয়ানওয়ালাবাগে। অসহায়, নিরস্ত্র মানুষগুলো বাঁচার জন্যে কেউ পাঁচিল ডিঙানোর চেষ্টা করতে লাগল, কেউ-বা দেওয়াল বেয়ে পালানোর চেষ্টা করেও অসফল হল। তাদের মারণ চিৎকার, বাঁচবার প্রবল আকুতি, যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীরের ছটফটানি, গোঙানি, একটু জলের জন্যে হাহাকার—মর্মান্তিক হাড় হিম করা দৃশ্য তার চোখের সামনে ঘটে গেল। গুলিবিদ্ধ মানুষের রক্তে ভেজা মাটিতে শুয়ে সমস্ত যন্ত্রণা মুখ বন্ধ করে সহ্য করে সে সৈন্যদের ফিরে যাওয়ার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করল। একটানা দশ মিনিট ধরে এলোপাথাড়ি গুলি চলল। কসাইখানার মতো মাটির উপরে পড়ে থাকল মানুষগুলোর শবদেহ।
যতদিন বেঁচে ছিল ছেলেটি একদিনের জন্যেও কিন্তু সে ভুলতে পারেনি ১৩ই এপ্রিলের সেই ভয়াবহ স্মৃতি। আজও তাঁর স্পষ্ট মনে আছে সেদিন ইংরেজ সরকার সমস্ত সংবাদপত্রের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল যাতে কেউ এই সংবাদ ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল মাত্র তিনশো জন মারা গেছে। আসলে সেদিন ১৮৮০ জন মারা যায় এবং ১২০০-র কাছাকাছি মানুষ গুরুতরভাবে জখম হয়েছিল। এই ঘটনায় গোটা বিশ্ব শিহরিত হয়। ইংরেজ সরকারের এই নগ্ন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ভারতে যে মহাযুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেয় তা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব এবং পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে সবার হৃদয়কে আন্দোলিত করে।”
কংগ্রেস নেতা সি.এফ অ্যানড্রুজ একে ‘কসাইখানার গণহত্যা’র সমতুল্য বলে তীব্র নিন্দা করেন। এই ঘটনায় সমগ্র কলকাতা উত্তাল হয়ে ওঠে। যদিও বেশ পরে তারা এই সংবাদটা পায়। রবীন্দ্রনাথের কাছে খবরটা পৌঁছায় ২২শে মে। তিনি সংবাদটা শোনামাত্র কিছুটা সময় শোকস্তব্ধ হয়ে বসে ছিলেন। তারপর ঘরের ভিতরে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলেন। কিছু একটা তাঁকে করতে হবে। এই নৃশংস বর্বরতা কিছুতেই তিনি সইতে পারছিলেন না। প্রথমে ভাবেন আন্দোলন করবেন এর প্রতিবাদে। পরে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরে তীব্র ঘৃণা এবং চরম ধিক্কার এবং অনুশোচনা বোধ থেকে তিনি ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত নাইট উপাধি ত্যাগ করলেন। তখন ভারতের ভাইসরয় ছিলেন লর্ড চেমসফোর্ড। তিনি ভাইসরয়ের কাছে চিঠি লিখে জানালেন, ‘আমাদের বহু কোটি যে ভারতীয় প্রজা অদ্য আকস্মিক আতঙ্কে নির্বাক হইয়াছে, তাহাদের আপত্তিকে বাণী দান করিবার সমস্ত দায়িত্ব এই পত্রযোগে আমি নিজেই গ্রহণ করিব।’
সেদিনের সেই ঘটনার পরেই উধম প্রকৃত সংগ্রামে জড়িয়ে পড়লেন। ১৯২৪-এ যোগ দিলেন ‘গদর পার্টি’তে। পরের কয়েক বছর কেটে গেল বিদেশে। বিদেশে থাকার পরে ভারতে ফিরে এলেন। অস্ত্র রাখার কারণে পাঁচ বছর তাঁর কারাবাস হল। ১৯৩১ সালে ছাড়া পাওয়ার পরে তিনি চলে গেলেন জার্মানিতে। সেখান থেকে লন্ডনে। সেখানে কিছুদিন একটা কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করলেন। তাঁর একটাই উদ্দেশ্য, সেদিন জালিয়ানওয়ালাবাগের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়া।
আজও কথাগুলো মনে পড়লে তাঁর বুকের ভিতরে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরে ডায়ার তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করেন এইভাবে, ‘হি অ্যাজ কনফ্রন্টেড বাই এ রিভলিউশানারি আর্মি।’
ডায়ারের এই ঘৃণিত কাজের পক্ষে মত দেন জেনারেল উইলিয়াম ব্যানন—‘ইয়োর অ্যাকশন কারেক্ট অ্যান্ড লেফটেন্যান্ট গভর্নর অ্যাপ্রুভস।’
এরপরে অমৃতসর শহর এবং তার আশেপাশে যাতে মার্শাল ল জারি করা হয় সেই ব্যাপারে চেমসফোর্ডকে অনুরোধ করেন ডায়ার। সমগ্র দেশবাসী তখন ডায়ারকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখছিল। ডায়ার সেটা ভালোই বুঝতে পারছিলেন।
চেমসফোর্ড শোনামাত্র মার্শাল ল জারির ক্ষেত্রে অনুমোদন করেন।
তিন
ডায়ারকে হত্যার অপরাধে সেদিন লন্ডনের ক্যাক্সটন হলে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন উধম সিং। কিন্তু তিনি নির্বিকার। তাঁর ভিতরে কোনো ভয় কিংবা অনুশোচনা দেখা গেল না। তাঁকে যখন কড়া পুলিশ পাহারায় আদালতে নিয়ে যাওয়া হল এবং কাঠগড়ায় তোলা হল তখন আদালতে বিচারকের প্রতিটা কথার স্পষ্ট উত্তর দিলেন। নির্ভীক চিত্তে সমস্ত দোষ স্বীকার করলেন।
ডায়ারের হত্যার অপরাধে তাঁকে দোষী সাব্যাস্ত করা হল। কিছুদিনের জন্যে তাঁকে রাখা হল বন্দিশালায়। লোহার গরাদে বসে তিনি মৃত্যুর প্রহর গুনতে লাগলেন। সেলের ভিতরে নিঃসঙ্গ একাকী চুপচাপ বসে থাকেন উধম। তাঁর মনে পড়ল ছেলেবেলার সেইসব দিনগুলোর কথা। খুব ছোটবেলায় তিনি তাঁর মাকে হারিয়েছিলেন। তাই মায়ের মুখটা সেভাবে তাঁর মনে পড়ে না। তাঁর যা কিছু আবদার ছিল বাবার কাছে। বাবা তাঁকে ডাকতেন ‘শের’ বলে। তাঁর দাদার নাম ছিল মুক্তা সিং আর তাঁর নাম শের সিং। তাঁর বাবা ছিলেন একজন রেলকর্মী। রেলের ওয়াচম্যানের চাকুরি করতেন উপালিতে। তাঁদের বাড়ি ছিল সুনামে। পাঞ্জাবের সাঙ্গুর জেলায়।
উধমের মনে পড়ে এক বৈশাখী মেলার কথা। বাবা আর দাদার সঙ্গে গিয়েছিলেন মেলা দেখতে। খুব ছোটো ছিলেন বলে বাবা তাঁকে কাঁধে চাপিয়ে মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন। পাঁপড়, মিঠাই আর হরেকরকমের খেলার সামগ্রী কিনে দিয়েছিলেন বাবা তাঁকে এবং দাদাকে। এর কিছুদিন পরেই কী এক অজানা জ্বরে বাবা মারা যান। মৃত্যু কী জিনিস সেটা তখনো তিনি বুঝতেন না। শুধু এটুকু বুঝেছিলেন, বাবা মারা যাওয়ার পরে তাঁরা অনাথ হয়ে গেলেন। কয়েকদিন তাঁদের পাড়া-প্রতিবেশীরা দুই ভাইয়ের দেখভাল করল। তারপর একদিন তাঁদের পাড়াতুতো এক কাকা দুই ভাইকে নিয়ে এলেন অমৃতসরে। সেন্ট্রাল অরফানেজ হোমে। এখনো মনে আছে ‘পুতলিঘর’ তার নাম। নামটা শুনেই তাঁর ভালো লেগেছিল। এখানেই তাঁরা বড়ো হতে লাগলেন। এখানেই তাঁর নাম রাখা হল উধম সিং কম্বোজ।
উধমের মনে পড়ে আশ্রমের প্রতিটা আবাসিকের কথা। দাদা ছাড়া এখানে তাঁর রক্তের সম্পর্কের কেউ না থাকলেও সকলেই তাঁকে খুব ভালোবাসত। ছোটো ভাইয়ের মতো তাঁকে স্নেহ করত। উধম আস্তে আস্তে সকলের সাহচর্যে বড়ো হতে লাগলেন। এখান থেকেই তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল সতেরো। এর কিছুদিনের ভিতরে তাঁর দাদার আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। দাদার মৃত্যুতে উধম এবারে সত্যি সত্যই অনাথ হয়ে গেলেন। পৃথিবীতে নিজের বলতে আর কেউই রইল না।
দাদা মারা যাবার পরে এখানে আর তাঁর মন টিকল না। উধম একদিন কাউকে কিছু না বলে আশ্রম ত্যাগ করলেন। পাগলের মতো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। কোনো কিছুতেই তাঁর মন বসে না। কী করবেন, কোথায় যাবেন বুঝতে পারেন না। দেশের পরিস্থিতি তখন অগ্নিগর্ভ। একের পর এক নেতারা কারাবরণ করছেন। পুলিশ নিরীহ দেশবাসীর উপরে নিপীড়ন চালাচ্ছে। তাদের অত্যাচারের সীমা আকাশ স্পর্শ করেছে। ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে উধম বেশ কিছু সংগঠনের সংস্পর্শে আসেন। একদিন তিনি জানতে পারেন রাউলাট আইনের প্রতিবাদে গান্ধীজিকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এই ঘটনায় পাঞ্জাব তথা সমস্ত দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। সরকার তখন গান্ধীজিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এরপরেই পুলিশ পাঞ্জাবের দুইজন বিশিষ্ট নেতাকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ সৈনিকদের দিকে গুলি ছোড়ার অপরাধে। পাঞ্জাবের মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়।
***
আদালতে তোলা হল উধম সিংকে। কাঠগড়ায় নিঃস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। বিচারক তাঁর কাছে ডায়ার হত্যার কথা জানতে চাইলে নিজের মুখে সহজ ইংরাজিতে তিনি তাঁর দোষ স্বীকার করলেন। তিনি পরিষ্কারভাবে জানালেন, “আই ডিড ইট। … আই ডোন্ট কেয়ার। আই ডোন্ট মাইন্ড ডাইং।”
জেরায় তিনি স্বীকার করলেন, “আই বট দ্য রিভলভার ফ্রম এ সোলজার।“
শুধুমাত্র ডায়ারকে হত্যার জন্যেই তিনি এটা কিনেছিলেন। তাঁর পাখির চোখ বলতে একজনই, তিনি হলেন তৎকালীন পাঞ্জাবের গভর্নর ডায়ার। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের আসল কালপ্রিট।
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পরে দেখতে দেখতে কীভাবে যে একুশটা বছর কেটে গেছে। এই একুশটা বছর ধরে উধম এই হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে বদ্ধপরিকর ছিলেন। জেলে থাকাকালীন এরপরে প্রায় ৪২ দিন তিনি অনশনে ছিলেন। তাঁকে খাওয়ানোর জন্যে নানাভাবে জুলুম করা হচ্ছিল। তবুও তিনি অনড় ছিলেন। উধমের স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপের দিকে গড়াতে লাগল। তবুও তিনি নির্বিকার।
৪ঠা জুন, ১৯৪০ সালে তাঁকে আরেকবার কাঠগড়ায় তোলা হল।
ধীর পায়ে কাঠগড়ার দিকে এগিয়ে এলেন উধম সিং। শক্ত চোয়াল, দুটি চোখে আগুন বর্ষিত হচ্ছে। তাঁকে যখন এই হত্যার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হল তখন তিনি বলেন, “আই ডিড ইট বিকজ হি ওয়াজ এ রিয়েল কালপ্রিট। হি ওয়ান্টেড টু ক্রাশ দ্য স্পিরিট অফ মাই পিউপিল। সো আই হ্যাভ ক্রাশড হিম। আই অ্যাম হ্যাপি দ্যাট আই হ্য্যভ ডান দ্য জব। আই অ্যাম নট স্কেয়ারড অফ জব। আই অ্যাম ডাইং ফর মাই কানট্রি।”
তাঁর চোখে মুখে ফুটে উঠল এক তৃপ্তি-সুখ। শয়তান জেনারেল ডায়ারকে হত্যা করতে পেরে বাস্তবিকই তিনি সুখ অনুভব করছেন। এরপর বিচারে যদি মৃত্যু হয় তবু তাঁর কোনোরকম দুঃখ থাকবে না।
চার
ইংল্যান্ডের পেন্টভাইল প্রিজন।
সেদিন বেশ সকাল সকাল উঠে পড়েছেন উধম। গতকাল জেলার সাহেবের মুখে শুনেছিলেন আজ তাঁর শুনানি আছে কোর্টে। জেলার এবং সুপারিন্টেনডেন্ট সাহেব বেশ সকাল সকাল চলে এসেছেন। আজ উধম সিংয়ের চূড়ান্ত শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। আজই বোঝা যাবে তাঁর ভাগ্যে কী লেখা আছে।
আমরা সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি চন্দ্রিমাদির মুখের দিকে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। শ্রেণিকক্ষে তখন পিন পতনের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
পেন্টভাইল প্রিজন থেকে নির্ধারিত সময়ে জেল সুপারিন্টেনডেন্ট কয়েকজন নিরাপত্তা রক্ষীসহ প্রিজন ভ্যানে উধমকে আদালতে পাঠিয়ে দিলেন। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে মুড়ে ফেলা হয়েছে আদালত চত্বর। প্রায় সকলেই জানে উধমের ফাঁসির শুনানির কথা। শুধু বিচারকের মুখ থেকে শোনার অপেক্ষা।
হাতকড়াসহ দুইজন নিরাপত্তারক্ষী উধমকে প্রিজন ভ্যান থেকে নামিয়ে আদালত কক্ষে নিয়ে এল। সকলেই উপস্থিত আছেন সেই শুনানি কক্ষে। বিচারকের নির্দেশমতো কাঠগড়ায় তোলা হল উধমকে। কক্ষে উপস্থিত সকলের চোখ এখন উধমের দিকে।
বিচারক তাঁর শুনানি শুরু করলেন। যতক্ষণ শুনানি চলল উধম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
বিচারে উধমের ফাঁসির সাজা হল। সকলের সামনে দিন ধার্য হল ৩১শে জুলাই। কাঠগড়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন উধম সিং। বিচারক এবং আদালত কক্ষের সকলে অবাক হয়ে দেখছিলেন এই মানুষটিকে। কী কঠিন ধাতুতে গড়া এই মানুষটি। মৃত্যু সুনিশ্চিত জেনেও তিনি নির্বিকার রইলেন। যেন এতদিন বাদে ডায়ারকে হত্যা করতে পেরে জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ চরিতার্থ করতে পারলেন। একটা আত্মতৃপ্তির হাসি ঝুলে রইল তাঁর ঠোঁটের কোণে। সেই হাসির ব্যাঞ্জনা অনেক।
চন্দ্রিমাদি গল্প শেষ করতেই ছুটির ঘণ্টা বেজে উঠল। তিনি ধীর পায়ে শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। আমরা উঠতে ভুলে গেছি। পাথরের মূর্তির মতো বসে আছি বেঞ্চে। আমাদের সকলের চোখের জলে চিবুক ভিজে যাচ্ছে তখন।
অলঙ্করণ- শিমুল সরকার
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস