পিয়ালি গাঙ্গুলীর আগের লেখা– ফোচনের কীর্তি , ফোচনের আরেক কীর্তি মিঠে প্রতিশোধ , বেলুন দাদু , দুটি অণুগল্প , নতুন বছর , বাঘমামার বিয়ে, মাম্বোর শুঁড় , জঙ্গলের নতুন নিয়ম
সকালে সুযোগ পেয়ে এক ফাঁকে বেশ খানিকটা কুলের আচার চুরি করে ওর গুপ্ত ডেরায় লুকিয়ে রেখে এসেছিল দুষ্টু। দুপুরে সবাই শুয়ে পড়লে আরাম করে গাছের ডালে বসে পা নাচাতে নাচাতে খাবে বলে। বাগানের কোণের সবচেয়ে বড়ো আমগাছের কোটরটা হল দুষ্টুর মূল্যবান সম্পদ রাখার গোপন ঠিকানা। কোটর হাতড়ালে একটা ভাঙা টর্চ, কতগুলো কাপড় শুকোতে দেওয়ার ক্লিপ, দু-চারটে ভাঙা খেলনা, কিছু পুরোনো সি.ডি, কিছু টুথ পিক—এরকম আরও কিছু মূল্যবান সম্পত্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু এ কী, আচারের বাটিটা গেল কই? নিজে হাতে করে রেখে গেছিল সকালে। ভালো করে দেখবে বলে কোটরের ভেতরে তাকাতেই দুষ্টুর চক্ষুস্থির। মানুষের মতো দেখতে দুটো ক্ষুদে প্রাণী দিব্যি চেটেপুটে বাটি থেকে আচার খাচ্ছে।
“এই, তোমরা কারা? আমার আচার খেয়ে নিচ্ছ কেন তোমরা?”
ধরা পড়ে গিয়ে ওরাও খুব অপ্রস্তুত। দুষ্টু ভালো করে চেয়ে দেখল অবিকল মানুষের মতো দেখতে, বড়োজোর এক আঙুল লম্বা। পিঠে দুটো ছোট্ট ডানা। একটা ছেলে, একটা মেয়ে।
“আমরা তিড়িংবিড়িং। আমরা মেঘের রাজ্যে বাস করি। পূর্ণিমার রাতে আমরা পৃথিবীতে নেমে আসি। পনেরো দিন থেকে ফিরে যাই, আবার পরের পূর্ণিমায় আসি। তোমাদের এই গাছের কোটরটা আমাদের খুব পছন্দ, তাই আমরা বেশ কিছুদিন ধরে এখানেই থাকি।”
দুষ্টু হাত বাড়িয়ে দিতেই তিড়িংবিড়িং ভাইবোনে ওর হাতে উঠে বসল। দুষ্টু জিজ্ঞেস করল, “তা, তোমাদের নাম তিড়িংবিড়িং কেন?”
“আমরা তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে লাফিয়ে চলি বলে আমাদের তিড়িংবিড়িং বলে। আমরা তোমাদের মতো হাঁটতে পারি না, শুধু লাফাতে আর উড়তে পারি। তোমার আচার খেয়ে নেওয়ার জন্য আমরা খুবই দুঃখিত। আসলে আচারটা এতই সুস্বাদু ছিল যে আমরা দুই ভাইবোনে লোভ সামলাতে পারিনি।”
রাগ কমে দুষ্টুর একটু মায়াই হল ওদের ওপর। বলল, “আর আচার খাবে তোমরা? আমার ঠাম্মা দারুণ আচার বানায়। আমাদের বাড়িতে আরও অনেকরকমের আচার আছে।”
লোভে দুই ভাইবোনের চোখ চকচক করে উঠল। দুজনে প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, “হ্যাঁ, খাব।”
দুষ্টুর হাতে চড়েই ওরা দুষ্টুদের বাড়িতে চলল। বাড়িতে তখন মা, ঠাম্মা দুজনেই ঘুমোচ্ছে। চুপিচুপি রান্নাঘরে ঢুকল দুষ্টু। পরপর কাচের বয়ামে আম, কুল, তেঁতুল, লেবু—সবরকমের আচার রাখা। তিড়িংবিড়িংদের আনন্দ আর ধরে না। দুষ্টু সাবধান করে দিল, “অত খেও না একসঙ্গে, অম্বল হবে।”
“আমাদের ওসব হয় না।”
আচার খাওয়া হয়ে গেলে দুষ্টু ওদের বাড়িটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল তিড়িংবিড়িংদের।
তারপর দুষ্টু নিজের গল্পের বই থেকে ওদের বেশ কয়েকটা গল্প পড়ে শোনাল। তিড়িংবিড়িংরাও নিজেদের মেঘের রাজ্যের অনেক গল্প করল। মেঘের ওপর ওদের বাড়ি কেমন ভেসে ভেসে চলে, মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার আগে ওরা কীরকম লাফিয়ে বা উড়ে অন্য মেঘে চলে যায়—এসব শুনে দুষ্টুরও খুব ইচ্ছা করল মেঘে চড়ে ভেসে ভেসে যেতে। ইস্, কী মজাটাই না হত!
গল্প করতে করতে বিকেল গড়িয়ে এল। এক্ষুনি মা চলে আসবে দুধের গ্লাস হাতে। “চলো আজকের মতো টা টা, আবার কাল দেখা হবে।”
দুষ্টুকে টা টা করে তিড়িংবিড়িং ভাইবোনে জানালা দিয়ে উড়ে চলে গেল।
সেদিন পড়তে বসে দুষ্টুর আর পড়ায় মন বসছে না। একের পর এক মাল্টিপ্লিকেশন ভুল করছে। মায়ের কাছে বেশ কয়েকটা চড়-থাপ্পড় খেয়ে গেছে। পেটের মধ্যে কথাটা ভুর ভুর করছে, কাউকে না বলা পর্যন্ত শান্তি হচ্ছে না। বনুকে কি বলবে? ও যদি বড়োদের বলে দেয় আর বড়োরা যদি তিড়িংবিড়িংদের সঙ্গে মিশতে বারণ করে দেয়? অনেক চিন্তাভাবনা করে শেষপর্যন্ত রাত্তিরে বনুকে বলেই ফেলল কথাটা। বলার আগে অবশ্য বনুকে দিয়ে গড প্রমিস করিয়ে নিয়েছে যে ও কাউকে বলবে না। বললে ও আর কোনোদিন চকোলেট খেতে পারবে না, খেলেই পেট ব্যথা হবে।
পরের দিন বিকেলে দুষ্টু বনুকে নিয়ে গেল আমগাছের কাছে। গাছের কোটরে মুখ নিয়ে গিয়ে ডাকল তিড়িংবিড়িং বলে। ডাকা মাত্রই দুই ভাইবোনে তিড়িংবিড়িং করতে করতে কোটর থেকে বেরিয়ে এল। ওদের দেখে তো মিষ্টি আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। ঠিক যেন ওর পুতুলদের মতো।
তিড়িংবিড়িংরা বলল, “আমাদের আরও বন্ধু আছে এখানে, ওদের ডাকব?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ডাকো।”
সঙ্গে সঙ্গে একটা সুরেলা শিসের আওয়াজ শোনা গেল আর পলক ফেলতেই আশেপাশের গাছপালা থেকে তিড়িংবিড়িংয়ের দল লাফিয়ে লাফিয়ে আর উড়ে উড়ে এসে জড়ো হল ওদের সামনে। দুষ্টু আর মিষ্টির আনন্দ আর ধরে না। ঠিক যেন ফেয়ারি টেল। বন্ধুদের যদি দেখাতে পারত! সামার ভ্যাকেশনের পর স্কুল খুললে বন্ধুদের বললে ওরা হয়তো বিশ্বাসই করবে না।
তিড়িংবিড়িংরা সকলেই খুব ভালো, তাই সকলের সঙ্গেই চট করে ভাব হয়ে গেল। আর সবাই মিলে কী খেলাটাই না হল! সামার ভ্যাকেশনের দিনগুলো এভাবেই মজা করে কাটতে লাগল। দুষ্টু-মিষ্টি বাড়ি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে আচার, কেক, বিস্কুট যেদিন যা পারে নিয়ে আসে আর সবাই মিলে ভাগ করে খায়। তিড়িংবিড়িংরাও আনে অদ্ভুত সব খাবার। চকচকে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ খাবার। একেকটা একেকরকম আকৃতির আর কী সুস্বাদু খেতে সে আর বলার নয়। দুষ্টু-মিষ্টি ভাবে, ওদের মা কেন যে এরকম খাবার বানাতে পারে না। মাকে যদি বলতে পারত তিড়িংবিড়িংদের মায়েদের কাছ থেকে শিখে নিতে, কী ভালোটাই না হত।
দুষ্টুদের সামার ভ্যাকেশন আর তিড়িংবিড়িংদের পৃথিবীতে থাকার মেয়াদ দুই-ই প্রায় একসঙ্গে ফুরোতে লাগল। জমে থাকা হলিডে হোম-ওয়ার্ক শেষ করতে অনেকটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দুষ্টু। মিষ্টি সবে নার্সারি ওয়ানে পড়ে, তাই ওর কোনও হোম-ওয়ার্ক নেই। ঠাম্মাকে দিয়ে পুতুলের জামার নাম করে বেশ অনেকগুলো ছোটো ছোটো জামা বানিয়ে নিয়েছে মিষ্টি তিড়িংবিড়িং ভাইবোনের জন্য। ওহ্, ওদের নামগুলো তো বলাই হয়নি। ওদের নাম টুং আর টাং। ওদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার দিনে দুষ্টু আর মিষ্টি মিলে ওদের জন্য একটা গিফট প্যাক তৈরি করল। তাতে ওদের জন্য জামা, কিছু চকোলেট আর একটা ছোট্ট কৌটো করে একটু কুলের আচারও দিয়ে দিল। ওরা রাত্তিরে বাড়ি যাবে, কিন্তু সন্ধেবেলায় তো আর বাগানে যাওয়া যাবে না, তাই বিকেলবেলাতেই দেখাসাক্ষাৎ সেরে নিল দুষ্টুরা।
টুং বলল, “আরে এত মনখারাপ করছ কেন, আমরা তো আবার ক’দিন পরেই ফিরে আসব। তোমাদের বাড়িতেই আসব। আমরা কক্ষনও আমাদের বন্ধুদের ভুলি না। আর এর মাঝে যদি কখনও আমাদের জন্য খুব মনখারাপ করে তাহলে এই বলটার মধ্যে তাকিয়ে দেখো, আমাদের দেখতে পাবে, আমাদের সঙ্গে কথাও বলতে পারবে।”
এই বলে টুং একটা ছোট্ট ক্রিস্টালের বল দুষ্টুর হাতে ধরিয়ে দিল।
সেদিন রাতে শুয়ে শুয়ে দুষ্টু আর মিষ্টি দুজনেই জানালা দিয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। টুং-টাংরা হয়তো এতক্ষণে বাড়ি পৌঁছে গেছে। আচ্ছা, কোন মেঘটায় ওদের বাড়ি? ওরা কি আমাদের দেখতে পাচ্ছে? আমরাও যদি ওদের সঙ্গে মেঘের রাজ্যে বেড়াতে যেতে পারতাম… এইসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুম নেমে এল দুই ভাইবোনের চোখে।
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে