গল্প-৭২ ঘণ্টা-অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায় -বর্ষা ২০২২

এই লেখকের আগের গল্প – জগৎশেঠের হিরে

golpo72ghanta

সন্দেশ একদৃষ্টে লোকটার দিকে তাকিয়ে ছিল। লোকটার ভাবগতিক ওর মোটেই ভালো ঠেকছিল না। একদিকে সমুদ্রের গর্জন যেন একেক বারে কানে আছড়ে পড়ছে। বোল্ডারগুলোর উপরে জোয়ারের সুতীব্র একেকটা ঢেউ। ছোট্ট নদীটা নাচতে নাচতে যেন আপন খেয়ালে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে যেতে চলেছে। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছিল। সন্দেশ তবুও লোকটার থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছিল না। সময় চলে যাচ্ছে…

[১]

সন্দেশ আর চমচম, দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু। ভালো নাম ওদের দুজনের একটা করে আছে বটে, কিন্তু সে কেবল রহড়া ভবনাথ ইনস্টিটিউশন ফর গার্লস হাই স্কুলের ক্লাস টুয়েলভের রেজিস্টার খাতার প্রয়োজনে। পাড়া থেকে শুরু করে আত্মীয়-মহল অবধি ওরা সন্দেশ আর চমচম—এই দুই নামেই পরিচিত। পাশাপাশি বাড়ি হলে যা হয়—ছোটো থেকেই ওরা একসঙ্গে বড়ো হয়েছে; একসঙ্গে ফেলুদা, শার্লক হোমস, গোয়েন্দা গন্ডালুর বই পড়তে শিখেছে। মাধ্যমিক পাশ করাতে একসঙ্গে দুই বন্ধুতে দুটি নতুন স্মার্টফোন হাতে পেয়েছে। আর সেই থেকেই যত ঘটনার সূত্রপাত।

কী ভাগ্যি ঠিক সেই সময়েই ওদের দুজনের সঙ্গে অনিমেষকাকুর দেখা হয়ে গিয়েছিল। নইলে যে সন্দেশের কী পরিণতি হত, ভাবতেই এখনও চমচমের গা শিউরে ওঠে। সন্দেশের অবিশ্যি বিশেষ ভাবান্তর হয় না। ও আবার কলকাতায় ফিরেই নিয়মিত ওর ক্যারাটে ক্লাস আর আঁকার হোমওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাছাড়াও ক্লাস টুয়েলভের সায়েন্স মানে কি কেবল চাট্টিখানি কথা নাকি? সে যা হোক। এত কিছুর মধ্যে দিঘায় সে-বারের ঘটনাটা, সেই কারণে ওরা প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিল। আমি তাই ওদের অনুমতি নিয়ে ঝটপট সেই গল্পটা এখানে লিখে ফেললাম।

এপ্রিল, ২০১৯। ক্লাস ইলেভেনের অ্যানুয়াল পরীক্ষাও ততদিনে শেষ হয়ে গেছে। দুই বন্ধুতে তাই গরমের ছুটিটা বাড়িতে বসে বসে কী করবে ভাবছিল, এমন সময় একদিন হঠাৎ মেঘ না চাইতেই জল! সন্দেশের বাবা সেদিন অফিস থেকে ফিরে, বেশ জুতটি করে বসে খোশমেজাজে আদা-এলাচ দেওয়া ভুরভুরে মশলাদার চায়ের পেয়ালাতে আলতো করে সুখ-চুমুক দিচ্ছিলেন। দিতে-দিতেই তিনি হঠাৎ ওর মাকে উদ্দেশ করে বলে ওঠেন, “বুঝলে গো, অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম, বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের অফিসে বাড়তি কাজের চাপ খানিকটা কমের দিকেই রয়েছে। এদিকে মেয়ে দুটোও তো সেই পরীক্ষার পর থেকেই বাড়িতে বসে বসে গরমে সেদ্ধ হচ্ছে। তাই ফেরবার পথে একবার শুভময়দের বাড়িতে ঢুঁ মেরে ওকে বলে এলাম, এই উইক-এন্ডে যদি শুক্রবারটা কোনোরকমে ছুটি করিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে দিব্যি দুটি পরিবার মিলিয়ে বেশ একটা ছিমছাম, মনের মতো দু-রাত তিনদিনের সারপ্রাইজ দিঘা ট্রিপ হয়ে যেতে পারে। আইডিয়াটা কেমন বলো দিকিনি?”

এখানে চুপিচুপি বলে রাখা দরকার, শুভময় চমচমের বাবার নাম।

“তোমার কোনও আপত্তি নেই তো এতে?” সন্দেশের বাবা ওর মাকে জিজ্ঞেস করেন।

এদিকে সন্দেশ তখন পাশের ঘর থেকে দমবন্ধ করে শুনছে। ওর মা যে চাপা স্বরে ওর বাবাকে এই প্রশ্নের উত্তরে ঠিক কী বললেন, সন্দেশ এদিক থেকে সেটা তেমন স্পষ্ট করে শুনতে পায় না। কিন্তু পরক্ষণেই সে শুনতে পায় ওর বাবা বলছেন, “হ্যাঁ বেশ তো, ফিরে এসে যে ওকে ওর পড়াশুনোর বিষয়ে আরও মন দিতে হবে, সেটুকু তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আমার ওর উপরে পুরো ভরসা আছে। এই সময়ে কোথাও একটু ঘুরে আসাটাও যে দরকার ওদের। সেই কতদিন ধরে আমরা বাইরে কোথাও যাইনি বলো তো?”

ও-পাশ থেকে আবার সন্দেশের মা কিছু বলেন। কিন্তু তারই মধ্যে ওর বাবার ফোনটা বেজে ওঠে। ওর মায়ের কথার জবাবে সন্দেশের বাবা হো হো করে হাসতে হাসতে বলে ওঠেন, “বেশ তো, তাই হবে এখন। এই দেখো, বলতে না বলতেই শুভময়ের ফোন। মনে হচ্ছে সেও বোধহয় তার গিন্নিকে রাজি করিয়ে ফেলেছে।”

সন্দেশের আর কিছুই শোনবার প্রয়োজন ছিল না। এক লাফে সে চেয়ার থেকে সটান বিছানাতে গিয়ে পড়েই ওর নতুন পাওয়া স্মার্টফোনটাকে হাতে তুলে নিল।

***

সেদিন ছিল বুধবার। একদিনের মধ্যেই যে বাবা আর শুভময়কাকু মিলে পুরো ব্যবস্থাটা করে ফেলবেন, সে নিয়েও সন্দেশের মনে কোনও সংশয় ছিল না। বৃহস্পতিবার সারা দিনটা সন্দেশের শুধু কেটে গেল চমচমের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে আর ভিডিও কল করতে। কী কী নিতে হবে, কোন জামাটা ছেড়ে কোনটা নিলে ভালো হয়, চমচমের আবার এইসব ব্যাপারে একটু পিটপিটেমি আছে। সন্দেশের এসবের কোনও বালাই নেই। কিন্তু টর্চ, ব্যান্ড-এইড, আর বাইনোকুলার—এই তিনটে জিনিস ছাড়া সে নড়বেই না কোথাও।

অনেক কষ্টে রাত এগারোটার সময় যা হোক করে দুজনের সবকিছু বাঁধাছাঁদা শেষ হল। পরের দিন সকালেই ট্রিপ শুরু। এবারেও দুটো গাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গাড়ির ডিকিতেই দুটো পরিবারের মালপত্র চলে যাবে। ওল্ড দিঘাতে সমুদ্রের পাশেই শুভময়কাকুর এক বন্ধুর চেনা হোটেল রয়েছে। কাজেই কোনও অসুবিধে হবে না। কেবল সেদিন সন্ধেয় চমচমকে হোয়াটসঅ্যাপ করতে গিয়ে সন্দেশ একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করেছিল। পরে সেটাকে নিয়ে চমচমের সঙ্গে আলোচনা করবে বলে বিষয়টাকে তখনকার মতো সে আর আমল দেয়নি।

দিঘার সি-বিচে দাঁড়িয়ে, এখন হঠাৎ সন্দেশের কি সেই বিষয়টাই মনে পড়ে গেল?

[২]

ওরা দাঁড়িয়ে ছিল দিঘার মোহনাতে। পাথরের লম্বা জেটিটা যেখান থেকে শুরু হয়েছে, তার ঠিক মুখেই। তিনটে টোটো ভাড়া করে আসা হয়েছিল। কিন্তু এখানে এসেই সন্দেশ আর চমচম সটান জানিয়ে দিল যে তারা বিচ বরাবর হেঁটে ফিরতে চায়। কাজেই দুটো টোটোতে চেপে ওদের মা-বাবারা ফিরে গেলেন। তিন নম্বর টোটোটা খানিক দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই সময়েই লোকটাকে প্রথম দেখল সন্দেশ।

লোকটার ভাবগতিক ওর মোটেই ভালো ঠেকছিল না। একদিকে সমুদ্রের গর্জন যেন একেকবারে কানে আছড়ে পড়ছে। বোল্ডারগুলোর উপরে জোয়ারের সুতীব্র একেকটা ঢেউ। ছোট্ট নদীটা নাচতে নাচতে যেন আপন খেয়ালে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে যেতে চলেছে। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছিল। সন্দেশ তবুও লোকটার থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছিল না। ফিসফিস করে লোকটা ওদের সেই ছেড়ে দেওয়া টোটোওলাটার সঙ্গে একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছিল। কথা বলার ধরনটা কেমন যেন সন্দেহজনক। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা, লোকটাকে কেন জানি না কিছুতেই মন থেকে সে সরাতে পারছিল না। কোনও একটা বিষয়ে লোকটাকে যেন ভীষণ চেনা চেনা মনে হচ্ছিল সন্দেশের।

চমচম তখন সমুদ্রের ধারে গিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত। সন্দেশ আস্তে আস্তে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওকে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করল, “এই, আমাদের টোটোওলাটার সঙ্গে যে লোকটা কথা বলছে তাকে চিনতে পারছিস?”

চমচমও হঠাৎ তড়বড় করে মাথা ঘোরাতে যেতেই ওর মাথায় এক চাঁটি মারল সন্দেশ।—“ওভাবে না হতভাগা! বুঝতে পারলে সন্দেহ করবে যে। সাবধানে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখ।”

চমচম তাই করল। তারপর সন্দেশের দিকে তাকিয়ে দু-পাশে মাথা নাড়ল।—“কেন রে? কী করেছে লোকটা?”

“তাই যদি জানতাম তাহলে তো তোকে জিজ্ঞেসই করতাম না।” সন্দেশ আপনমনে বলে, “কিন্তু লোকটাকে কেন জানি না কোনও একটা বিষয়ের সঙ্গে রিলেট করতে পারছি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কীসের সঙ্গে, সেটা কিছুতেই এখন মাথায় আসছে না।”

“তার মানে? লোকটাকে চিনিস নাকি তুই?” চমচম জিজ্ঞেস করে।

“উঁহু! লোকটাকে আমি চিনি না। কস্মিনকালে দেখিওনি। কিন্তু কেন যে ওই লোকটা আমাকে এত ভাবাচ্ছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না।” সন্দেশ বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ে।

এদিকে লোকটাও বোধহয় কিছু একটা আন্দাজ করেছিল, তড়িঘড়ি কথা শেষ করে সে একবার ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে ওল্ড দিঘার দিকে চলে গেল।

“যাক, বাঁচা গেছে। আপদ বিদেয় হয়েছে।” চমচম আবার খুশি হয়ে সমুদ্রের দিকে মোবাইল তাক করল।

সন্দেশ একদৃষ্টে লোকটার চলে যাওয়ার পথের দিকেই তাকিয়ে রইল।

কিছু দূর গিয়ে আবারও লোকটা থমকে দাঁড়াল। একবার পিছন ফিরে সন্দেশের দিকে দেখল। ওর মুখেও যেন একটা প্রশ্নের ভাব জেগে উঠেছে। সন্দেশ মুখ ফিরিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পরে সে মুখ ফিরিয়ে দেখল ততক্ষণে লোকটা অনেক দূরে চলে গেছে। ওর সঙ্গে আরও একটা লোক এসে যোগ দিয়েছে। এদিকে চমচমের ছবি তোলা হয়ে গেছে। এরপর দুই বন্ধুতে বোল্ডারগুলোর উপর দিয়ে সাবধানে জেটি বেয়ে আরও সমুদ্রের দিকে এগোল।

[৩]

দুই বন্ধুতে হোটেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল। হোটেলে ঢুকতে-ঢুকতেই ওরা শুনতে পেল লাউঞ্জ থেকে ওদের দুজনার বাবারই উদাত্ত গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। মনমেজাজ এতটাই খুশ তাহলে সবার? রিসেপশন পেরিয়ে লাউঞ্জ এরিয়াতে ঢুকতেই দুজনে কারণটা বুঝতে পারল। মা-বাবারা সবাই তো আছেনই, আর তারই সঙ্গে আরও একটা সোফাতে ঘর আলো করে বসে আছেন ওদের প্রিয় অনিমেষকাকু। পুরো নাম অনিমেষ মুখার্জী, লালবাজারের গোয়েন্দা দপ্তরের বড়ো অফিসার। ওদের দুজনকে দেখতে পেয়েই অনিমেষকাকু গমগমে গলায় হাঁক ছাড়লেন, “এইত্তো! আসল লোকেরা এইবার এতক্ষণে এসে গেছেন। আসতে আজ্ঞা হোক দিদিমণিরা! কী খবর সকলের? দিঘার সমুদ্রসৈকতে আবার নতুন কোনও রহস্যের খবর পাওয়া গেল নাকি?”

অনিমেষকাকু ওদের দুজনকেই অসম্ভব ভালোবাসেন। এমনকি ওদের দুজনেরই যে গোয়েন্দাগিরি নিয়ে বিশেষ একটা টান আছে, সে খবরও রাখেন।

অনিমেষকাকুর প্রশ্নের উত্তরে সন্দেশ কিছু বলবার আগেই পাশ থেকে চমচম তড়বড় করে বলে উঠল, “হ্যাঁ গো, মোহনার কাছে সন্দেশ একটা হাইলি সাসপিশাস লোককে নাকি ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে। হাবভাব ভীষণ সন্দেহজনক। বল না তুই!” সে সন্দেশের দিকে তাকাবার আগেই পিঠে একটা মোক্ষম চিমটি খেয়ে চুপ করে গেল।

“তেমন কিছু না গো কাকু।” সন্দেশ চমচমের মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে বলল, “একটা গুন্ডামতন লোককে দেখে চমচমের কেবল একটু ভয় করছিল। ওই আর কী!” সে চমচমের দিকে একটা আগুনঝরা দৃষ্টিতে থাকায়।

“তাই নাকি?” অনিমেষকাকু অবশ্য এই বিষয়টাকে খানিকটা সিরিয়সলিই নিলেন বলে মনে হল।—“তেমন কিছু সন্দেহ করলে আমাকে অবশ্যই কিন্তু জানিও তোমরা। মিস হোমস আর মিস ওয়াটসন।” তিনি হেসে ওদের দুজনের দিকে তাকান।—“হয়তো তেমন কিছুই না। তবে পরশু এখানে গভর্নর আসছেন। সেটা জানো তো?”

সন্দেশ আর চমচম দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে।—“কই, না তো!”

“হ্যাঁ,” অনিমেষকাকু পুরো ব্যাপারটা খোলসা করে বলেন, “পরশু এখানে কয়েকটা প্রকল্পের উদ্বোধন করতে রাজ্যপালের আসার কথা রয়েছে। কাজেই আমাদেরও খুব সতর্ক থাকতে হচ্ছে। যদিও,” উনি হেসে যোগ করেন, “এমনটাও হতে পারে যে তোমরা প্লেন ক্লদসে আমাদেরই কোনও লোককে দেখেছ। ওদের একেকজনকেও বেশ ষণ্ডামার্কা দেখতে কিনা।” অনিমেষকাকু মিটিমিটি হেসে বলেন।

সন্দেশ আর চমচমও এই কথা শুনে হেসে ফেলে। আজকের সন্ধেটা যে ওদের এভাবেই দিব্যি কেটে যাবে সেটা ওরা বেশ বুঝতে পেরেছে।

***

রাত্তিরে সবাই শুয়ে পড়ার পর নিজেদের ঘরে বসে দুই বন্ধুতে কথা বলছিল। প্রথমেই চমচমের পিঠে সজোরে একটা ঘুসি মারল সন্দেশ।—“অনিমেষকাকুকে কিছু না জেনেই তড়বড় করে অত কথা বলার কী দরকার ছিল রে তোর?”

“বা রে!” চমচমও একবার উফ্‌ করে উঠে এবার পালটা সন্দেশকে ঘুসি দেখায়।—“অনিমেষকাকু তো অনিমেষকাকুই। ওঁকে বললে আর কী চাপ!”

“তুই বুঝবি নে।” সন্দেশ বলে, “প্রথম প্রথম কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকে কিছু বলতে নেই। আর তাছাড়াও, আমাদের কপাল ভালো যে বাবা-মারা কিছু খেয়াল করেনি ওই সময়। নইলে আমাদের একা একা ঘুরে বেড়ানোর বারোটা বেজে যেত। সে খেয়াল আছে?”

চমচম এবার ঘুসি নামিয়ে নিয়ে মাথা নাড়ে।—“এটা তো ভেবে দেখিনি। আর হবে না এরকম।”

“হুম,” সন্দেশও মাথা নাড়ে।—“মনে রাখিস।” তারপর একবার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে সে ঘড়িটা দেখল।—“সাড়ে এগারোটা প্রায় বাজে। শুয়ে পড়া যাক।”

“দাঁড়া, একবার হোয়াটসঅ্যাপটা চেক করে নিই। সারাদিন তো দেখা হয়নি।”

চমচম মাথা নীচু করে ফোনটা আনলক করতে যাবে, এমন সময় ‘ইউরেকা!’ বলে একটা চিৎকার করে প্রায় লাফ দিয়ে ওর ঘাড়ের উপরে এসে পড়ে সন্দেশ।—“ইউরেকা! সব মনে পড়ে গেছে রে চমচম। লোকটাকে কেন চেনা লাগছিল আমার—সব মনে পড়ে গেছে!”

“তার মানে?” চমচম অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।

“শোন বলছি।” সন্দেশ পাশবালিশটাকে কোলের উপরে ভালো করে টেনে নিয়ে বাবু হয়ে বসে ওর কথা শুরু করে। চমচম অবাক বিস্ময়ে কান খাড়া করে শুনে যায় কেবল। ওরা স্বপ্নেও এমনটা কোনোদিন ভাবতে পারেনি বোধহয় যে ঘরের কাছে দিঘাতে বেড়াতে এসে ওরা এরকম একটা জটিল ব্যাপারে জড়িয়ে পড়বে।

[৪]

কাজের সূত্রে চমচমের বাবাকে এর আগে একটা সময় অবধি মাঝেমধ্যেই দিঘা বা কাঁথিতে যাতায়াত করতে হত। সেই সূত্রেই নিউ দিঘা বা ওল্ড দিঘা চত্বরটাকে খুব ভালো করেই তাঁর চেনা আছে। তাঁর কথামতোই পরের দিন দুপুরে ওরা সবাই লাঞ্চ সারছিল হোটেল শ্যামলীতে। নিউ দিঘাতে একেবারে বিচের কাছেই হোটেল। রান্নার স্বাদের প্রশংসা করতেই হয়। লোটে মাছের ঝুরোটা খেতে খেতে চমচমের মন একেবারে ভরপুর হয়ে যাচ্ছিল। সন্দেশ কিন্তু যথারীতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশটা নজর রাখছিল। খেতে-খেতেই সে ফিসফিস করে চমচমকে বলল, “লোকটাকে খুঁজে পেলে ভালো, নয়তো বিকেলে একবার অনিমেষকাকুকে ফোন করে সবটা বলতে হবে। যদিও উনি এমনিই আসবেন বলেছেন। কিন্তু কোনও কারণে যদি না আসতে পারেন, অন্তত ফোন করেও জানিয়ে দেব। কী বলিস?”

চমচম হাত চাটতে চাটতে সায় দিল। কালকে রাতের ব্যাপারটা সত্যিই ওদের দুজনকে ভাবিয়ে তুলেছে। অনিমেষকাকুকে সবটা জানানো সত্যিই দরকার এখন। কিন্তু তার আগে লোকটাকে যদি অন্তত আর একটিবারও ভালো করে দেখা যেত। সন্দেশ খেতে-খেতেই বাইরের দিকে তাকাচ্ছে। মনে মনে ভালোই টেনশন হচ্ছে ওর।

***

বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে ওরা দুজনে আবার সেই মোহনার কাছেই এসে পড়েছিল। সেখানেই লোকটাকে আবারও লক্ষ করল সন্দেশ। আজ লোকটার সঙ্গে শুরু থেকেই আরও একটা লোক রয়েছে। একটা টোটোওলার সঙ্গে কীসব যেন কথা বলে লোকটা বিচের রাস্তাটা ছেড়ে ভিতরে মাছ-বাজারে যাওয়ার রাস্তাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সন্দেশ ফিসফিস করে চমচমকে বলল, “তুই হোটেলে ফিরে যা। যদি দেখিস অনিমেষকাকু এসেছেন, ওঁকে সবটা খুলে বল। আমি ততক্ষণে একটু চেষ্টা করে দেখি, যদি কোনোভাবে লোকটার আস্তানাটাকে বের করতে পারি।”

চমচম সন্দেশের হাতটা খপ করে টেনে ধরল।—“কী বলছিস তুই!”

“কী অর্ডারে ওরা ডেঞ্জারাস হতে পারে জানিস? খবরদার না, সন্দেশ! এতটা বাড়াবাড়ি আমি তোকে করতে দেব না।”

সন্দেশ গায়ের জোরে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল।—“আহ্‌, ডরপোক কাঁহিকা! কিচ্ছুটি হবে না আমার। তাছাড়া আমি তো আর ওদের পিছু ধাওয়া করছি না। শুধু আশপাশটা একটু ঘুরে-ফিরে দেখব কেবল।” সন্দেশ একবার হাতের মাসলটা ফুলিয়ে নেয়।—“যা তো, পালা এখন। লোকটা না আবার হারিয়ে যায়! হুশ হুশ।” চমচমকে সে তাড়া দেয় এবার, “দেরি করিস না। লোকটাকে দেখতে পেয়েইছি যখন, যতটা পারা যায় ইনফর্মেশন জোগাড় করে নিতে চাইছি। তুই বরং হোটেলে ফিরে গিয়ে অনিমেষকাকুকে বসিয়ে রাখ। আমি একঘণ্টার মধ্যেই ফিরছি।”

সন্দেশ হনহন করে মাছ-বাজারের রাস্তাটার দিকে চলে গেল। চমচম জানে এই ডেয়ারডেভিল মেয়েটা কোনও কথা শোনার নয়। সে একবার ফোনটাকে বের করে কী যেন দেখল। তারপর বেশ জোরে-জোরেই হাঁটা লাগাল শহরের দিকে।

[৫]

রাত আটটা বেজে গেছে। এখনও সন্দেশ ফেরেনি। রাজ্যপালের অনুষ্ঠানের জন্য যে বিশাল শামিয়ানাটা করা হয়েছে, তার ঠিক পিছনেই একটা ছাউনির তলায় ওরা সকলে বসে ছিল। ওরা বলতে চমচম, সন্দেশের বাবা, শুভময়কাকু, অমিমেষকাকু আর তার সঙ্গে আরও চার-পাঁচজন পুলিশ অফিসার। সবটুকু বলার পর ওর বাবার কাছে প্রচণ্ড একটা ধমক খেতে যাচ্ছিল চমচম। অনিমেষকাকুই বাঁচিয়ে দিয়েছেন। সন্দেশের মোবাইল লোকেশনটাও চমচমের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ দিয়ে শেয়ার করা ছিল। কিন্তু সাতটার পর থেকেই সেই লোকেশনটাও আর কাজ করছে না। শেষ লোকেশন পাওয়া গেছে ওই মাছ-বাজারের জায়গাটার কাছেই। পুলিশ তন্নতন্ন করে জায়গাটা সার্চ করছে। মাঝে-মাঝেই অনিমেষকাকুর ওয়্যারলেসে খবর আসছে। এ-পাশ থেকে সব শুনতে শুনতে অনিমেষকাকুও ক্রমশই গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হয়ে উঠছেন।

আটটা পনেরো যখন, অনিমেষকাকু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আর দেরি করলে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। আমি নিজেই স্পটে যাব। গাড়ি রেডি করো।”

কয়েকজন কনস্টেবল দৌড়ে চলে গেল। চমচমের বুকের ভিতরটা ধুকধুক করেই চলেছে।

***

অনেক দূরে, ঠিক সেই সময়েই দু-হাতে প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যে জ্ঞান ফিরে এল সন্দেশের।

স্যাঁতস্যাঁতে একটা মেঝের উপরে সন্দেশ উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। মুখটা ধুলোর উপরে। হাতের যন্ত্রণাটাকে টের পেতেই সন্দেশ বুঝল ওকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে রেখেছে শয়তানগুলো। ও ভেবে ভেবে মনে করতে চেষ্টা করল, একটা চায়ের দোকানে বসে লোক দুটো কথা বলছিল। একটু দূরে অন্য একটা দোকানের আড়ালে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে সন্দেশ ওদের কথা শোনবার চেষ্টা করছিল। ঠিক সেই সময়েই তৃতীয় আরেকজন কেউ পিছন থেকে এসে ওর মুখে একটা মিষ্টি গন্ধওলা রুমাল চেপে ধরে। ক্লোরোফর্মই হবে বোধহয়। তারপর সন্দেশের আর কিছু মনে নেই। এখন এই ঘরটা থেকে বেরোতে চেষ্টা করতে হবে।

একটু নড়তে-চড়তেই সে বুঝতে পারল, বেশ শক্ত করেই হাত দুটোকে বাঁধা হয়েছে। একটা গল্পে ও পড়েছিল, এই অবস্থায় নাকি শরীরটাকে কায়দা করে বেঁকিয়ে হাত দুটোকে পায়ের তলা দিয়ে বের করে সামনে নিয়ে আসা যায়। সেইমতো শরীরটাকে বাঁকাতে চেষ্টা করল সন্দেশ। কিন্তু কিছুক্ষণ চেষ্টা করেই বুঝল এভাবে হওয়ার নয়। অন্ধকারে ঘরে চারপাশটা ভালো করে দেখাও যাচ্ছে না। এমন সময় খুটখুট করে কীসের একটা শব্দ পেতেই সে শরীরটাকে টান করে রইল। একটা দরজা খুলে যাচ্ছে। প্রথম দিনের লোকটার সঙ্গে যে দ্বিতীয় লোকটা ছিল, সেই লোকটাই ঢুকে এসেছে ঘরের মধ্যে। হাতে একটা খাবারের প্লেট মনে হচ্ছে। সন্দেশ মাথার মধ্যে সমস্তটা সাজিয়ে নিতে চেষ্টা করল। লোকটা ওর কাছে এসে উবু হয়ে বসে প্লেটটা নামিয়ে রাখছে।

“খিদে পেয়েছে?”

সন্দেশ এই প্রশ্নের কোনও জবাব দিল না। লোকটা ওর হাতের বাঁধন খুলে দিচ্ছে।—“এই বয়সে এতটা পাকামি না করলেই পারতে। চুপচাপ খেয়ে নাও, রাত্তিরে মেজর আসবে।”

লোকটার কথা শেষ হল না। তার আগেই হাতটা খুলে দিতে সন্দেশের ডানহাতের জোরালো একটা ঘুসি গিয়ে পড়েছে ঠিক ওর ঘাড়ের কাছে একটা বিশেষ জায়গাতে। লোকটা জানত না যে সন্দেশ ক্যারাটেতে স্টেট রিপ্রেজেন্ট করেছে। যদিও সন্দেশও ভাবতে পারেনি যে এত সহজে প্রথম চেষ্টাতেই ও একেবারে সঠিক লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারবে। কপালের জোর আছে বলতে হবে। সন্দেশ একবার লোকটার নাকের কাছে হাত রেখে নিশ্চিত হয়ে নিল। সাময়িকভাবে অজ্ঞান হয়ে গেছে লোকটা। এবার এখান থেকে পালাতে হবে। আপাতত দরজার বাইরে কেউ নেই বলেই মনে হচ্ছে।

বাড়িটা দোতলা। সিঁড়ি বেয়ে ঝটপট নেমে এল সন্দেশ। সদর দরজাটা খুলতেই দেখল সামনে একটা ছোটো পোড়ো জমি, তারপর একটা ভাঙাচোরা লোহার গেট। ও-পাশ থেকেই বালিয়াড়ি শুরু হয়েছে। সন্দেশ সমুদ্রের আওয়াজ পাচ্ছিল। গেটটা খুলে ও বেরোতে যাবে, ঠিক তখনই পিছন থেকে ও শুনতে পেল উপরের লোকটাও দুড়দাড় করে দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। জ্ঞান ফিরেছে তাহলে। তাড়াহুড়োয় সন্দেশ দরজাটাও লাগিয়ে আসতে ভুলে গেছে। এবার?

একবার পিছনে ফিরে সে দেখল বাড়িটার পিছনের দিকেও একটা কম্পাউন্ড রয়েছে। তার সামনে দিয়ে একটা পাকা রাস্তা চলে গেছে। একবার সে মনে মনে ভাবল, রাস্তাটার দিকে গেলেই কি ভালো হবে? কিন্তু তখনই সে দেখল একটা কালো স্কর্পিও গাড়ি ধীরগতিতে সেই রাস্তা ধরেই বাড়িটার দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে। সন্দেশ আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। গেটটা ঠেলে কোনোমতে বেরিয়েই সে বালিয়াড়ির উপর দিয়ে ছুটতে শুরু করল।

খানিকদূর যেতে না যেতেই সে বুঝতে পারল মস্ত ভুল করে ফেলেছে। একে তো ঝুরঝুরে বালির উপর দিয়ে ছোটা যাচ্ছে না। ওদিকে সমুদ্রে এখন জোয়ার আসছে। আর দু-চার পা যেতে না যেতেই জল ওর পা ছুঁয়ে ফেলল। পিছনের লোকটাও অনেকটা কাছে এসে পড়েছে। এখন আর একটা লোক নয়। স্কর্পিও গাড়িটা থেকে সেই পুরোনো লোকটাকেও নামতে দেখেছিল সন্দেশ। কী যেন নাম, মেজর! পিছন থেকে মেজর চিৎকার করে কিছু বলল। কানফাটানো গুলির শব্দ। সন্দেশ এঁকেবেঁকে ছুটতে চেষ্টা করল। এরকমভাবে ছুটলে নাকি গুলির হাত থেকে বাঁচা যায়। সন্দেশের দম ফুরিয়ে আসছে। ওর পায়ে জল এসে লাগছে। পিছনের লোক দুটো চেঁচিয়ে উঠে আবারও কী যেন বলল। জল প্রায় গোড়ালি ডুবিয়ে দিচ্ছে। আবারও গুলির শব্দ। হঠাৎ ডানদিক থেকে জোরালো একটা সার্চ লাইটের আলো এসে পড়ল সন্দেশের উপর। লোক দুটোও কি থেমে গেছে? দুটো শক্ত হাত কোথা থেকে এসে পড়ে যেন সন্দেশকে লুফে নিল। জলপাই রঙের উর্দি পরা একটা চেহারা। আরও গুলির শব্দ। সন্দেশ কিছুই বুঝতে পারছে না। অনেক লোক বিচে নেমে পড়েছে। অনেক আলো চারদিকে। সন্দেশের মনে হল ও যেন অনিমেষকাকুর গলা শুনতে পাচ্ছে। চমচম! সন্দেশের চোখের উপরে আবারও অন্ধকার নেমে এল।

উপসংহার

রাজ্যপালের অনুষ্ঠান ভালোয় ভালোয় মিটে গেছে। কলকাতা ফেরার সময় উনি সন্দেশ আর চমচমের সঙ্গেও একবার দেখা করে গেছেন। বলেছেন, কলকাতায় ফিরে গিয়েই উনি ওদের বিশেষ পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। সন্দেশের সাহসিকতারও ভূয়সী প্রশংসা শোনা গেছে ওঁর গলায়।

দিঘায় এখন রাত। একটা রাত্তির অতিরিক্ত থাকতে হচ্ছে সন্দেশদের। কাল সকালে ওরা অনিমেষকাকুর সঙ্গেই সবাই একসঙ্গে বাড়ি ফিরবে।

হোটেলের লাউঞ্জে বসে কথা হচ্ছিল। অনিমেষকাকু পা দুটোকে আরাম করে ছড়িয়ে বসে বলতে শুরু করলেন, “আমিই কি সবটা বলে দেব নাকি? মিস হোমস, মিস ওয়াটসন?”

সন্দেশ, চমচম মৃদু হেসে ওঁর দিকে তাকায়।

“বেশ আমিই বলছি। তবে সন্দেশ-চমচমের সাহস আর উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হবে। ওরা ছিল বলেই যে আজ শুধু এত বড়ো গ্যাংটা ধরা পড়ল তাই নয়, রাজ্যপালও নিশ্চিত একটা বড়ো হামলার হাত থেকে বেঁচে গেলেন।”

সন্দেশের বাবা, শুভময়কাকু সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন।

“সবটাই খুলে বলছি।” অনিমেষকাকু আরাম করে পা দুটোকে আরও ছড়িয়ে দিলেন।—“এখানে আসার আগের রাত্তিরে শ্রীমান সন্দেশবাবাজিকে কোনোভাবে নম্বর ভুল করে নিজেদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অ্যাড করে ফেলেছিল ওই মেজর। ওর আসল নাম সুরেশ গণপতি। উত্তরবঙ্গের একটা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে ওর আঁতাত রয়েছে। গ্রুপে অ্যাড করার পর দু-চারটে মেসেজ নিজেদের মধ্যে চালাচালি হতে না হতেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে মেজর সন্দেশকে গ্রুপ থেকে রিমুভও করে দেয়। আগের মেসেজগুলোও সব মুছে দেয়। কিন্তু এরই মধ্যে সন্দেশ ব্যাপারটা টের পেয়ে গ্রুপের যে প্রোফাইল ছবিটা ছিল তার একটা স্ক্রিনশট আর গ্রুপের বাকিদের ফোন নম্বরেরও একটা ছবি তুলে নিজের কাছে রেখে দেয়। যদিও সন্দেশ এটা তেমন কিছু ভেবে করেনি। আর যে মেসেজগুলো ও দেখতে পেয়েছিল সেগুলোর মধ্যেও ভয়ংকর তেমন কিছু ছিল না। তবু স্রেফ কৌতূহল থেকেই সন্দেশ এই কাণ্ডটি করেছিল, আর করেছিল বলেই এখানে এত কিছু ঘটে গেল।” অনিমেষকাকু একটু দম নিতে থামেন।

“আমি তখনই বলেছিলাম এসব ফোন-টোন কিনে দিও না ওদের, এখন কথা ফলল তো?” সন্দেশের মা চাপা স্বরে সন্দেশের বাবাকে উদ্দেশ করে বলেন।

“আহা বউদি, তেমন কিছুই নয়। বাকি গল্পটা তো শুনুন।” অনিমেষ মুখার্জী পরিবেশটাকে হালকা করার চেষ্টা করেন।—“মেজরকে দেখে সন্দেশের যে চেনা চেনা মনে হয়েছিল তার প্রধান কারণ হল, ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের প্রোফাইল পিকচার হিসেবে যে ছবিটা ছিল, হুবহু সেই একই রকমের একটা ছবি মেজরের হাতেও উল্কি করা ছিল। সেই থেকেই সন্দেশের মনে প্রথম সন্দেহ জাগে। ঠিক সেই সময় ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও রাতে চমচমের সঙ্গে গল্প করতে করতে ওরা বিষয়টাকে ধরে ফেলে। এরপর সন্দেশের ফোনে ওই ছবিটার স্ক্রিনশট আর তার তলায় লেখা খুদে খুদে অক্ষরে ইংরেজিতে কয়েকটা শব্দকে দেখেই চমচম গুগলে খুঁজতে খুঁজতে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের লোগোটাকে হাতে পেয়ে যায়। ওরা বুঝতে পারে, কী ভয়ানক একটা জিনিসের সঙ্গে ওরা জড়িয়ে পড়েছে। প্রথমেই ওরা সরাসরি আমাকে খবর দিলে পারত। কিন্তু সেটা না করে সন্দেশবাবাজির আরও একটু ডানপিটেমো করার বাসনা হয়। এদিকে ওরাও বুঝতে পারেনি যে, একই কায়দাতে মেজরও নিজের ভুলটা করার পর নিজের মোবাইলে সন্দেশের হোয়াটসঅ্যাপ প্রোফাইলের একটা ছবি তুলে রেখেছিল। তাই মেজরও সন্দেশকে চিনে ফেলে। বিকেলে সন্দেশ যখন চমচমকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে একা-একাই মেজরের পিছু নেয়, তখনই ওরা সন্দেশকে কিডন্যাপ করে। এই সাহসটা কিন্তু সন্দেশের তরফে দেখানোটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।” অনিমেষ হালকা রাগের ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকান। সন্দেশ দুষ্টু দুষ্টু হেসে ফেলে আবার।

“সে যা হোক, আমাদের কপাল ভালো যে আমরাও সঠিক সময়ে ওর কাছে পৌঁছে গিয়েছিলাম, আর মেজরের সঙ্গীকেও আমাদের সন্দেশ ওর ক্যারাটের কীর্তির মাধ্যমে ভালোরকমই কাবু করেছিল। যে জন্য বিদেশি রিভলবারটাও ওরই কাছে থাকলেও গুলিগুলোর একটাও টার্গেটে আসছিল না।” অনিমেষ হেসে জিভ কাটেন একবার।

“তার মানে ওই লোক দুটো রাজ্যপালের সভায় বিস্ফোরণ ঘটাতে চেয়েছিল?” সন্দেশের মা আতঙ্কিত সুরে জিজ্ঞেস করেন।

“একদমই তাই বউদি। ওদের ডেরা থেকে সেই সংক্রান্ত সব জিনিসপত্রই আমরা উদ্ধার করেছি। সন্দেশ আর চমচম ছিল বলেই ওদের প্ল্যানটাকে এভাবে ভেস্তে দেওয়া গেল। হ্যাটস অফ টু দেম। আমরা প্রেসিডেন্টস মেডেলের জন্যও ওদের নাম কলকাতা পুলিশের তরফ থেকে বিশেষ প্রোপোজাল হিসেবে পাঠাব।” অনিমেষকাকু চওড়া করে হাসেন এবার।

“কলকাতা ফেরো, মেডেল পাওয়া ঘোচাচ্ছি তোমাদের। বউদি, ফোনগুলোকে শুধু তুমি তোমার জিম্মাতে সরিয়ে নিও।” এতক্ষণে চমচমের মা প্রথম কথা বলেন।

সন্দেশ আর চমচম এবারে রীতিমতো ভয়ে ভয়ে দুজন-দুজনের দিকে তাকায়। এই হুমকিগুলোর ফল যে কী হতে পারে ভালোমতোই সেটা জানা আছে ওদের।

***

অনেক রাত। পাশাপাশি ওরা দুজন খাটে শুয়ে আছে।

চমচমই প্রথম বলল, “ইস্‌, মূল অ্যাকশনের ভাগটা সেই তুই-ই নিয়ে নিলি। এটা কি তাহলে আমাদের প্রথম রহস্য অ্যাডভেঞ্চার, সন্দেশ? কী মনে হচ্ছে?”

সন্দেশ মিটিমিটি হাসে। চমচমও হাসল।—“তবে তোর জন্য ওই হাত-পা চালানো, ঘুসোঘুসিটাই ঠিক আছে। মাথা খাটিয়ে লোগোটাকে তো সেই আমিই খুঁজে বের করেছিলাম।”

“তাই নাকি?” সন্দেশের হাতটা আবারও একবার কোত্থেকে যেন আলতো করে উঠল আর নামল।

চমচম কাঁদো কাঁদো স্বরে পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, “ওফ্‌, তোপসেকেও বোধহয় ফেলুদা এতবার করে গাঁট্টা মারত না!”

সন্দেশ হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, “কারেক্ট আছে তাহলে!”

বেলাভূমিতে সমুদ্রের জল আবারও সশব্দে আছড়ে পড়ছে।

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s