ঘরটা বেশ পছন্দ হয়ে গেল সুবীরের। যদিও আজকাল এইসব ওয়ো, মেক মাই ট্রিপ ইত্যাদির দৌলতে কোথাও বেড়াতে যাওয়াটা কোনো ব্যাপারই নয়। অবিশ্যি সুবীরের এই আসাটাকেও ঠিক বেড়ানো বলা চলে না। খানিকটা কাজই বলা উচিত। তবু বলতেই হবে যে, কলকাতার বাইরে যে-কোনো জায়গাতে চটজলদি পছন্দমতো হোটেল খুঁজে নিতে হলে এই সমস্ত অ্যাপগুলোর জুড়ি মেলে না। এ জায়গাটা ঠিক দিঘাও নয়, তালসারিও নয়, বাংলা-উড়িষ্যা বর্ডারে উদয়পুর বলে ছোট্ট, আংশিক বিচ্ছিন্ন একটি জনপদ। সুন্দর একফালি সৈকত আছে, তারই আশপাশ ঘিরে দামি, কম দামি হোটেলের ছড়াছড়ি। নতুন গজিয়ে ওঠা বড়োলোকেরা একেকজন পরিবেশ নষ্ট করছেন। এরই মধ্যে সুবীরকে আসতে হয়েছে তাদের কোম্পানির কাজ নিয়ে। সুবীরদের একটা টেবল ফ্যান তৈরির কারখানা আছে, জগদ্দলের ওদিকটায়। স্থানীয় উদ্যোগে তৈরি। কিন্তু গুণমানের দিক থেকে ভালো বলেই হয়তো-বা, এই সামান্য কয়েক বছরের মধ্যেই ওরা নিজেদের বেশ নাম করে ফেলতে পেরেছে। সেই ব্যাবসা-সংক্রান্ত কাজেই উদয়পুর। এখান থেকে খানিক দূরে চন্দনেশ্বরের মন্দির, তালসারির সৈকত ভূমি। আশেপাশে গজিয়ে ওঠা হোটেল ব্যাবসার কারণে স্থানীয় কেউ যদি সুবীরদের টেবল ফ্যানের ডিলারশিপে আগ্রহী হয় সেটা খুঁজে বের করতেই সুবীরের হেথায় আগমন, আর সেই সূত্রেই হোটেল ব্লু মুনের আতিথ্যে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা। নামটাও বেশ ভালো লেগেছিল সুবীরের। কেমন যেন একটা শান্ত শান্ত, আবার গা ছমছমে একটা ভাব। নির্জন সমুদ্রতীরে থাকবার ব্যবস্থা। যদিও হোটেলের একতলার ঘরগুলোর মধ্যে একটি থেকেও সমুদ্র দেখা যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। চারপাশে ঘন তাল আর নারকেলগাছের জঙ্গল। দোতলা বা তিনতলা থেকে হয়তো-বা দেখা গেলেও যেতে পারে। ছাদ থেকে অবশ্যই দেখা যাবে, সে-কথা আলাদা। এ সত্ত্বেও সুবীরের হোটেলটা বেশ পছন্দ হয়ে গেল। খাট-বিছানা থেকে বাথরুম, সবই তকতকে পরিষ্কার। নতুন হ্যান্ড ওয়াশ, স্যানিটাইজারের বোতল, কাচা তোয়ালে। মধ্যবিত্ত ছিমছাম ব্যবস্থা। দু-তিনটে রাত বেশ আরামেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে, মনে মনে ভাবছিল সুবীর। সমুদ্র দেখা না গেলেও সমুদ্রের গর্জন কানে আসে। রাতে জোয়ার এলে সমুদ্র আরো এগিয়ে আসবে। জলের শব্দ শুনতে শুনতে এসবই ভাবছিল সুবীর। সমুদ্রকে তার বড়ো ভালো লাগে, ছোটবেলা থেকেই।
***
“এই সর্বত্র এয়ারকন্ডিশনের যুগে কে নেবে আপনার টেবিলফ্যান?”
প্রশ্নটা তাচ্ছিল্যের বলে মনে হলেও প্রশ্নকর্তা কিন্তু অতটাও তাচ্ছিল্যের ভাব নিয়ে প্রশ্নটা করেননি। খানিকটা যেন বোধ হয় অনুকম্পারই ছোঁয়াচ লেগে ছিল কথাগুলোয়। ভদ্রলোকের অনেক বয়স হয়েছে দেখেই বুঝতে পারছিল সুবীর। রাত্রে খাওয়ার আগে সে হোটেলের লবিতে এসে ম্যানেজারের সঙ্গে একটু আধটু গল্পগুজব করতে চেষ্টা করছিল। সময় কাটানোর মতো সেরকম তো কোনো কাজও নেই। কাজেই খেজুরে আলাপের মতলব। এই ভদ্রলোকও সেখানে বসে ছিলেন। কথাবার্তায় বেশ বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি স্থানীয় লোক এবং হোটেলের ম্যানেজারেরও পূর্বপরিচিত। আগে নাকি স্থানীয় হাই স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন। সেই রাশভারী ব্যাপারটাও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এখনো পুরোপুরি মিলিয়ে যেতে পারেনি। বেশ একটা দাপট ছিল এককালে, বোঝাই যায়।
“তবু আপনাদের মতো একেকজন যে উদ্যোগ নিয়ে এসব করছেন, নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছেন, দেখতেও ভালো লাগে।” ভদ্রলোক বলেন।
সুবীর মৃদু হাসল।
“আপনি কত নম্বরে উঠেছেন?” ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেন।
“এই তো ১০৩, করিডর দিয়ে হেঁটে গেলেই শেষ মাথার ঘর।” সুবীর জবাব দেয়।
ভদ্রলোক যেন কেমন একটা চমকালেন বলে মনে হল।
“১০৩! ১০৩ বললেন আপনি?” ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞেস করেন।
“হ্যাঁ, কেন বলুন তো?” সুবীর অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।
কিন্তু ভদ্রলোক কিছু বলবার আগেই ম্যানেজার মাঝখান থেকে কথা বলে ওঠে, “আহ্ স্যর, আপনি আবার আমার গেষ্টদেরকে মিছিমিছি ভয় দেখাতে শুরু করবেন না তো! ও-ঘরের কোথাও কোনো সমস্যা নেই। এতজন গেষ্ট এতদিন অবধি ও-ঘরে থেকেছে, খেয়েছে। কেউ তো আজ পর্যন্ত কোনো কমপ্লেন করেনি। শুধু আপনারই যত…”
“কিন্তু রোজারিও! রোজারিওর ঘটনাটা তো আর মিথ্যে নয়। এরপরেও কি তোমরা…” ভদ্রলোক কেমন যেন একটা খ্যাপাটে দৃষ্টিতে তাকান।
ম্যানেজার মুখ ফিরিয়ে নেয়। “আপনার প্রেতচর্চার স্বভাব গেল না মশাই।”
সুবীর হেসে ফেলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ভদ্রলোকের চোখের দিকে একবার তাকাতেই আর হাসি পেল না তার। ভদ্রলোকের চোখ দুটো যেন কোটরের মধ্যে থেকেই ধক করে জ্বলে উঠল একবার।
“খাবার দেওয়া হয়েছে।” কিচেনের দিকে তাকিয়ে হাঁক দিল ম্যানেজার।
ভদ্রলোক আবার যেন খানিকটা নিভে গেলেন।
“উঠি তাহলে আজ।” ভদ্রলোক সুবীরকে নমস্কার করেন। “আলাপ হয়ে ভালো লাগল। আমার নাম বিশ্বরূপ জানা। আবার দেখা হবে।”
“নিশ্চয়ই দেখা হবে। আছি তো এখন এখানে কয়েকদিন।” সুবীরও শুকনো হেসে হালকা একটা প্রতি নমস্কার জানিয়ে কিচেনের দিকে এগোল। জব্বর খিদে পেয়েছে আজ।
***
“আচ্ছা, এই রোজারিওর ব্যাপারটা কী বলুন তো মশাই?” রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করে সুবীর।
“আর বলবেন না স্যর! এই নিয়ে আপনাদের চিন্তার কোনো কারণ নেই। কেবল এই বিশ্বরূপবাবুই মাঝে মাঝে এসে আমার গেষ্টদেরকে ভয় দেখিয়ে যান। কী আর বলব বলুন, সিনিয়র মানুষ, কত বছর ধরে এখানে রয়েছেন। কিছু বলতেও পারি না। ওসব নিয়ে আপনি একদম ভাববেন না স্যর। ও-ঘরের কোথাও কোনো সমস্যা নেই।”
“আহা, সে না-হয় বুঝলাম, কিন্তু রোজারিও না কার যেন নাম বলছিলেন…”
“সে অনেক পুরোনো ঘটনা স্যর। প্রায় আট-দশ বছর তো হবেই। কোথা থেকে এক বাঙালি ক্রিশ্চান ছোকরা একবার এখানে এসে দিন দুয়েকের জন্য ঘর ভাড়া নিতে চেয়েছিল। ওই ঘরটাই তাকে দিয়েছিলাম। প্রথম রাতেই সে ছোকরা হঠাৎ ঘর থেকে উধাও হয়ে যায়। মালপত্তর সবই রাখা ছিল, কোনো মারামারি-ধ্বস্তাধ্বস্তির কোনো চিহ্ন নেই। কেবল সকালবেলা বেয়ারা চা নিয়ে গিয়ে দেখছে ঘরের দরজা খোলা, ছোকরার দেখা নেই কোথাও। সে অনেক ঝামেলা তারপর। থানা-পুলিশ আরো কত কী! কোনো ট্রেস পাওয়া যায়নি আর। পুলিশও কিছুদিন ঘোরাঘুরি করে হাল ছেড়ে দেয়। কে জানে কী করত, কোনো উলটোপালটা কাজে জড়িয়ে গিয়েছিল বোধহয়। আর রাতের অন্ধকারে এই সমুদ্রে কেটে লাশ ভাসিয়ে দিলে কেউ জানতেও পারবে না। তাই হয়েছিল বোধ হয়।”
ম্যানেজার চুপ করে গেল। বোধ হয় মনে মনে ভাবছে রাতবিরেতে গেষ্টকে এত কথা বলে দেওয়াটা কি ঠিক হল?
সুবীর সশব্দে হেসে ওঠে এবার। ম্যানেজারের কাঁচুমাচু মুখে আবার হাসি ফোটে।
“আপনি একদম চিন্তা করবেন না মশাই, রাতে আমার গাঢ় ঘুম হয়। রোজারিও কেন, তার মাসতুতো-পিসতুতো ভাইবোনেরা সকলে মিলে এলেও আমার ঘুম ভাঙবে না।” সুবীর ম্যানেজারকে আশ্বস্ত করে।
ম্যানেজারও হাত কচলায়।
“কাল সকালে ঠিক সাতটায় চা দেবেন কিন্তু। আর এখন যদি আপনার আপত্তি না থাকে, আমি বরং টুক করে বিচ থেকে একটু হেঁটে আসি? সবে তো সাড়ে দশটা।” সুবীর ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করে।
“না না স্যর, খুব শান্ত জায়গা মশাই উদয়পুর। চোরছ্যাঁচড়ের কোনো বিপদ নেই। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুরে আসুন। আমরা বারোটার আগে মেন গেটে তালা দিই না।”
সুবীর আশ্বস্ত হয়।
***
সমুদ্রে ভাটা পড়েছে এখন। কাল পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নায় বেলাভূমি আলো হয়ে রয়েছে। সুবীর আপন মনে জলের কাছটায় গিয়ে দাঁড়ায়। জল বেশ অনেকটাই দূরে সরে গেছে। ছোটো ছোটো ঢেউ পায়ে এসে লাগছে তার। সুবীর জলের খুব কাছে না গেলেও আলতো করে পা ভেজায়। বালির উপরে কাঁকড়াদের দৌড়োদৌড়িকে খুব মন দিয়ে দেখতে চেষ্টা করে। অনেক দূরে সমুদ্রের উপরে চাঁদের আলো পড়েছে। ঢেউয়ের ফসফরাসের উপর সেই আলো যেন ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে, আবার চুরমার হয়ে ভেঙে যাচ্ছে কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই। চাঁদনি রাতের মায়াবী সমুদ্রের সেই রূপ যে না দেখেছে তাকে সে-কথা বলে বোঝানো চলে না। সুবীর তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ।
“কাল পূর্ণিমা।”
সুবীর হঠাৎ কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কথাটা শুনতে পেতেই ভয়ানক চমকে ঘুরে দাঁড়াল। হোটেলের সেই আলাপী হেড মাস্টার ভদ্রলোক কখন যেন চুপিসারে তার পাশটিতে এসে দাঁড়িয়েছেন। “পূর্ণিমা আগামীকাল। রাত বাড়লে সাগরে জোয়ার আসবে। ভরা পূর্ণিমার জোয়ার। সব ডুবে যাবে এখানে আশেপাশে যা দেখছেন।” ভদ্রলোক ফিসফিস করে বলে চলেন, “রোজারিও, হ্যাঁ রোজারিও-ও সেদিন ডুবে গিয়েছিল বোধ হয়।”
সুবীরের একটু অস্বস্তি হয়। সৈকতভূমিতে তারা ছাড়া আর তৃতীয় কোনো ব্যক্তি নেই। সে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে, “রোজারিওকে নিয়ে আপনার এত মাথাব্যথা কেন মশাই?”
ভদ্রলোক উত্তর দেন, “সকলেই ফিরে আসে। সবসময়। সাগর সব্বাইকে ফিরিয়ে দেয়। রোজারিওকেও ফিরে আসতে হবে। কেউ তাকে আটকাতে পারবে না।”
ভদ্রলোক আবার সেইরকম একটা খ্যাপাটে দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। মাঝরাত্তিরে আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেল যা হোক, সুবীর মনে মনে ভাবে। মুখে সে বলে, “তাই? আচ্ছা, সে ফিরে এলেই-বা আপনার লাভটা কী হবে? আজ এতদিন পরে সে ফিরল কি ফিরল না সেই নিয়েই-বা আপনার এত দুশ্চিন্তা কীসের?”
ভদ্রলোক একদৃষ্টিতে সমুদ্রে দিকে চেয়ে থাকেন। “অতীতের একেকটা রূপ বড়ো সুন্দর, বড়ো কাছের।”
বিশাল একটা ঢেউ ভাঙল। জলের আওয়াজে ভদ্রলোক যেন খানিকটা সম্বিৎ ফিরে পেলেন।
“রাত হয়েছে মাস্টারমশাই, আপনি বাড়ি ফিরবেন না?” সুবীর জিজ্ঞেস করে।
ভদ্রলোক ঘাড় নাড়েন। “ফিরব, আর একটুক্ষণ থাকি এখানটায়। একা মানুষ, স্ত্রী গত হয়েছেন। ছেলেপুলে নেই কেউ দেখবার মতো। এই সাগরেই আমার সুখ। আমার অবসর।”
ভদ্রলোক জলের আরো খানিকটা কাছে গিয়ে দাঁড়ান। লটপটে পায়জামায় জল এসে লাগছে, পায়জামা ভিজতে শুরু করেছে। ভদ্রলোকের কোনো খেয়ালই নেই। সুবীর আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে।
“আপনি চাইলে হোটেলে ফিরে যেতে পারেন, আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। আমি এখানে থাকব আর একটুক্ষণ।” ভদ্রলোক সুবীরকে উদ্দেশ করে বলেন।
সুবীর মাথা নেড়ে পিছিয়ে আসে এবার। একেকটা সময় একেকজন মানুষকে একা ছেড়ে দেওয়া উচিত। সুবীর হোটেলের পথে পা বাড়ায়।
মাঝরাত্তিরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল সুবীরের। কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। নীলচে নাইট ল্যাম্পের আলোয় ঘরটাকেও কেমন যেন মায়াবী দেখাচ্ছে। সুবীর বিছানার পাশের টেবলটায় হাত বাড়িয়ে এক গ্লাস জল খেল। বারান্দা থেকে ঘুরে আসবে একবার? জোলো হাওয়ায় খানিকটা ভালো লাগবে কি? সুবীর সাতপাঁচ ভেবে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। পায়ের তলায় মোটা কার্পেট বিছানো রয়েছে। বারান্দার ছিটকিনিটা খুলে বাইরেটায় এসে দাঁড়াল সুবীর। চাঁদের আলোয় সমস্ত দিক ভেসে যাচ্ছে। হঠাৎ যেন দমকা হাওয়ার একটা জোরালো ঝাপটা তার গায়ে এসে লাগল। আকাশে মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। এমন সময় কি ঝড় উঠবে হঠাৎ? সুবীর অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই দেখল একেকটা তারা যেন কেমন একেকটা জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে নিঃস্পন্দ চেয়ে রয়েছে তার দিকেই। আবার যেন একটা দমকা হাওয়ার ঝাপটাকে টের পেল সুবীর। অদৃশ্য, অস্বাভাবিক ঠান্ডা একঝলক বালির আস্তরণ যেন তাকে ঠেলে তার ঘরের ভেতরটায় ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। সুবীর একটু ভয় পেল এবার। এইসবের কথাই কি বিশ্বরূপবাবু বলছিলেন তখন?
সুবীর ঘরে ফিরে এসে বিছানার উপরে বসল। বারান্দার ছিটকিনিটাকে বেশ জোরের সঙ্গেই সে বন্ধ করে দিয়েছে। রাতটুকু এখন কেবল কাটিয়ে দিতে পারলেই নিশ্চিন্দি। কাল সকালেই ম্যানেজারকে ঘর পালটানোর কথা বলতে হবে। সুবীরকে যদি কেউ ভিতু ভাবতে চায় তো ভাবুক। কিন্তু এই অস্বস্তি নিয়ে রাত্তিরগুলোয় ঘুমোনো চলবে না।
কীসের যেন একটা গন্ধ নাকে এল সুবীরের। মিষ্টি ফুলের মতো একটা গন্ধ। দামি কোনো পারফিউমের সুবাস? যে অদৃশ্য বালির ঝাপটাটাকে সামলাতে সামলাতেই ঘরে ঢুকে এসেছিল সুবীর, সেই গুঁড়ো বালিরই একটা আলগা স্তূপ যেন ক্রমশ ফুটে উঠতে চাইছে বিছানো কার্পেটের উপরটায়। সেই স্তূপ ক্রমশ বাড়ছে, যেন কোনো একটা রকমে ভেসে উঠতে চাইছে। ভেসে বেড়াচ্ছে। আবছা একটা অবয়ব তৈরি হচ্ছে, হলিউডের কোনো সিনেমার মতোই।
অবয়ব সম্পূর্ণ হয়ে এসেছে। মানুষের মতো সেই চেহারাটা হেঁটে গিয়ে সুবীরেরই বিছানার উপরটায় গ্যাঁট হয়ে বসল। দৃষ্টি সোজা সুবীরের উপর। হাতজোড় করে নমস্কারের ভঙ্গিতে বলল, “আমি হান্স, হান্স ক্রিশ্চিয়ান রোজারিও, আপনাকে এত রাত্তিরে বিব্রত করার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আপনি প্লিজ ওই চেয়ারটায় বসুন। একটু জল খাবেন?”
ভূতেরাও কি এতটাই ভদ্র হয়? জানা ছিল না সুবীরের। থতমত খেয়ে সে ধপ করে বসে পড়ল। হাত বাড়িয়ে আধখালি জলের গ্লাসটাকে টেনে নিয়ে চোঁ চোঁ করে সেটাকে দু-চুমুকে শেষ করে ফেলল। একটু যেন গলাটা ভিজল, মনটাও শান্ত হল। সুবীর এবারে হান্সের দিকে তাকাল। খুব ফরসা না হলেও মোটামুটি ফরসা রঙ, টিকলো নাক, সুন্দর দেখতে ছেলেটিকে। গলায় একটা যিশুর আইকন ঝুলছে। পরনে রঙিন শার্ট, জিনসের প্যান্ট। পারফিউমের গন্ধটাও যে এরই গা থেকে আসছে সেটা আর আলাদা করে কাউকে বলে দিতে হয় না। রীতিমতো শৌখিন ব্যাপার। সুবীর মনে মনে যেন আরো একটু আশ্বস্ত হল। যদিও ধোপদুরস্ত ভূত হলেই যে সে আর জীবন্ত মানুষের ঘাড় মটকাতে আগ্রহ দেখাবে না, এমনতর তো আর লেখা নেই কোথাও। তবু একেকটা সময়ে একেকটা এইরকম অদ্ভুত বিশ্বাসেই কাউকে না কাউকে ভর করে এগিয়ে চলতে হয়। সুবীর এটুকু বুঝতে পেরেছে যে, এক্ষুনি, এক্ষুনিই অন্তত ভূতবাবাজির কোনোরকমের অনিষ্টসাধনের বাসনা নেই। আলাপ করেই দেখা যাক না বরং, সুবীর সাতপাঁচ ভাবতে শুরু করে।
‘আমার নাম সুবীর, আপনার কথা শুনেছি।’ কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল সুবীর। এভাবে কি কোনো জলজ্যান্ত ভূতের সঙ্গে আলাপ শুরু করা যায় নাকি! কিন্তু তাকে কিছুই বলতে হল না। হান্স যেন নিজেই প্রশ্নটাকে মনে মনে ধরতে পেরে বলে উঠল, “আমার কথা আপনি শুনেছেন, কিন্তু পুরোটা শোনেননি। সেটুকু শোনাতেই আজ আমার আপনার ঘরে এসে হানা দেওয়া। হ্যাঁ, হানা দেওয়াই বলছি। সত্যিটাকে সত্যির মতো করেই বলা উচিত। ভূত মানে কী, অতীত। সেই অতীত বা স্মৃতিকেই যখন কোনো যন্ত্রের মাধ্যমে আপনারা দেখেন তখন কি আপনারা ঘাবড়ে যান? আমরাও তেমনি, প্রাকৃতিক শক্তির সাহায্যে একেকটি বিস্তৃত অথবা ব্যক্তিগত স্মৃতির আরো সূক্ষ্ম, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বহিঃপ্রকাশ।”
হান্স থামে, একটু যেন দম নেয়। “কাজেই ভয়ের কারণ নেই। কেবল, এই যে বাকি রাতটুকু আপনাকে গল্প শোনাব, আমার গল্প শোনাব—বিনিময়ে একটা ছোট্ট কাজ করে দিতে হবে আমার। বলুন করবেন?”
হান্স স্থিরদৃষ্টিতে তাকায়। সুবীর অনেক কিছু বলতে চাইলেও কিছুই বলতে পারে না। ঘাড় নেড়ে কেবল সায় দেয় বোধ হয়। হান্স আশ্বস্ত হয়ে তার গল্প শুরু করে। বাইরে সমুদ্রের আওয়াজ ক্রমশ কমে এসেছে। নীলচে নাইট ল্যাম্পের আলোয় এক অদ্ভুত পরিবেশে সুবীর হান্সের কথায় সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করে। বাইরের গাছগুলো হাওয়ায় নড়তে থাকে, আর সরসর শব্দ করে কেমন।
“আমার নাম হান্স, হান্স ক্রিশ্চিয়ান রোজারিও। কিন্তু এটা আমার প্রথম নাম নয়। আমার পিতৃদত্ত নাম ছিল প্রণবেশ। বাঙালি হিন্দু পরিবারের সন্তান। আমাদের আদি বাড়ি ছিল শ্রীরামপুরে। হুগলী নদীর ধারেই পাকা বাড়ি ছিল আমাদের। একটু দূরেই শ্রীরামপুরের বিখ্যাত ডেনমার্ক ট্যাভার্নের ধ্বংসাবশেষ। পুরোনো ঘাট, গির্জে। আমি পড়তাম ওখানকার ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে। ১৮৮৪-তে প্রতিষ্ঠিত, শুনেছি স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নাকি আমাদের স্কুল উদ্বোধন করেছিলেন। সে যা হোক, পড়াশোনায় ততটা ভালো না হলেও আমার ছিল গানের নেশা। সেই নেশাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ফাদার পিয়ের। স্থানীয় একটি গির্জায় তিনি কয়্যার পরিচালনা করতেন, আর পার্ট টাইমে আমাদের স্কুলে ভূগোলের ক্লাস নিতেন। গরমের ছুটির দুপুরে গির্জার পিছনে তাঁর ঘরটিতে গেলেই তিনি আমাদের সুস্বাদু বিস্কিট খেতে দিতেন আর বাইবেল থেকে গান গেয়ে শোনাতেন। সেই দুপুরের গরমে আলো আঁধারিতে শ্বেতশুভ্র চেহারার ফাদারকে মুখভর্তি দাড়িগোঁফের আড়ালে যেন বা সেই যিশুখ্রিস্টের মতোই মনে হত। প্রাণভরে আমরা সেই গান শুনতাম, আর কেমন একটা ভক্তিতে মন ভরে উঠত। এভাবেই যেন কখন আমিও ফাদারের সঙ্গে ওঁর কয়্যারের দলে ঢুকে পড়ে গান গাইতে শুরু করেছিলাম। তখন হিন্দু ক্রিশ্চান ভেদাভেদ ছিল না। আমি হিন্দু হয়েও দিব্যি সাদা জোব্বা পরে কয়্যারের সুরে সুর মেলাতাম। গানের আওয়াজে গির্জার ভেতরটা গমগম করত। আমরা আমাদের প্রাণের মানুষটাকে খুঁজতাম।”
হান্স একটু থামে। “ফাদার পিয়ের শেষ অবধি সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিলেন। সেই কবে সুদূর বেলজিয়ম থেকে তিনি এদেশে চলে এসেছিলেন। শেষকালে শহরের বাইরে কাছাকাছি কোন একটি জায়গায় গির্জার কাজের জন্য রুগী দেখতে গিয়ে অন্ধকারে তিনি সাপের ছোবল খান। দু-তিন ঘন্টাও সময় পাওয়া যায়নি। আমরা বন্ধুরা সবাই ফাদারের শেষকৃত্যে গিয়েছিলাম।
“হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করতে না করতেই ঝোঁক চেপে গেল যে গান করব। গান গেয়েই নিজের পায়ে দাঁড়াব। বাবা চেয়েছিলেন আমি কলকাতার কলেজে ভর্তি হই। বঙ্গবাসী কলেজে এসে ইতিহাস নিয়ে ভর্তিও হলাম। কিন্তু মন পড়ে থাকত গানের দিকেই, আর আমাকে তখন বিশেষভাবে টানত পাশ্চাত্য সঙ্গীত। এক-আধজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বন্ধু জুটে গেল। বাখ, বেটোফেন, শোপ্যাঁর কিছু রেকর্ড কিনে ফেললাম। যদিও আমার নেশা ছিল মূলত ধর্মসঙ্গীতে। কলকাতার গির্জাতে গির্জাতে ঘুরে বেড়াতাম, গ্রেগ্ররিয়ান ধর্মসঙ্গীতে মজে গিয়েছিলাম। আপনি হয়তো অবাক হচ্ছেন,” হান্স আবার একটু থেমে জিজ্ঞেস করে, “যে একজন বাঙালি মধ্যবিত্ত সন্তান হঠাৎ কীভাবে এমন করে গির্জার গানে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, এটাই হয়েছিল। একটু আধটু বেহালা বাজাতেও শিখলাম তখন। কলকাতার কাছেই বজবজে একটা গির্জাতে গিয়ে যোগাযোগ করলাম তাদের কয়্যার মাস্টার হতে চাই বলে। সেখানকার ফাদার অনেক বোঝালেন, বললেন যে এভাবে হয় না। এটা আমার কেরিয়র হতে পারে না। কেন বোঝালেন জানি না, আমি মিশনারি হতে চাইছিলাম কি না তাও জানি না, আর ঠিক এমন একটা সময়েই আমার অ্যান্ড্রু এবং ওর মায়ের সঙ্গে আলাপ।
“নাতালি আন্টির বয়স তখন আন্দাজ পঞ্চান্ন-ছাপান্ন। ওঁর ছেলে অ্যান্ড্রু আমাদের সঙ্গে পড়ত। ওঁদের বাড়ি ছিল বো-ব্যারাকের কাছেই। আমাকেও তিনি ছেলের মতোই দেখতেন। কোনো তফাত করেননি। আমি থাকতাম সুকিয়া স্ট্রিটের কাছেই একটা মেস বাড়িতে। সপ্তাহান্তে শ্রীরামপুর না গেলে চলে যেতাম অ্যান্ড্রুদের বাড়িতে। ওদের সঙ্গেই থাকতাম। খেতাম। রবিবার সারাটা দিন ধরে গান হত। ও গিটার বাজাত। অ্যান্ড্রুর মা আমাদের উৎসাহ দিতেন। অ্যান্ড্রুর পিসেমশাইরা থাকতেন অস্ট্রিয়ায়, সালজবার্গে। আমরা স্বপ্ন দেখতাম, পড়াশোনা শেষ করেই নিজের নিজের বাপ-মাকে রাজি করিয়ে—যদিও অ্যান্ড্রুর বাবা বেঁচে ছিলেন না তখন, পাড়ি জমাব অস্ট্রিয়ায়। সেখান থেকে ভিয়েনার মিউজিক স্কুলগুলোয়। অ্যান্ড্রুর মা আমাদেরকে উৎসাহ দিতেন। এভাবেই পরীক্ষার পাট চুকল একদিন। বাড়িতে গিয়ে আমার পরিকল্পনার কথাটা বলতেই বাবা একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। জানি না, আমারও সেদিন মাথাটা গরম ছিল বোধ হয়, দু-কথা শুনিয়ে দিলাম। বাবা এক-কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন, আর কখনো ও-বাড়িতে ফিরে যাইনি।
“এখানেই শেষ নয়।” হান্স একটু দম নিয়ে বলে, “কলকাতায় ফিরে শুনলাম চলন্ত বাস থেকে নামতে গিয়ে অ্যান্ড্রু, অ্যান্ড্রুও…” হান্স চুপ করে যায়।
সুবীর কী করবে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে, “একটু জল?”
হান্স একমুখ হেসে তার দিকে তাকায়। সুবীর ঘড়িতে দেখে রাত পৌনে তিনটে। সমুদ্রের আওয়াজটা যেন জোর হতে শুরু করেছে আবার।
“নাতালি আন্টি আমাকে দত্তক নিলেন।” একটু দম নিয়ে হান্স বলে, “নাহ্, আইনত দত্তক হয় না ওভাবে, আমি জানি। কিন্তু অ্যান্ড্রুর জায়গায় উনি যেন আমাকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছিলেন, আর আমিও হয়তো-বা কিছুটা বাবার উপরে রাগ করেই ধর্ম পালটালাম। প্রণবেশ থেকে হয়ে গেলাম হান্স ক্রিশ্চিয়ান। নাতালি আন্টির কাছেই থাকতাম, ছোটোখাটো টুকটাক কিছু কাজ করতাম। সেলসম্যানের কাজ করেছি, এজেন্সিতে ব্যাবসা করতেও চেষ্টা করেছি। কিছুতেই কিছু দাঁড়ায়নি। কেবল কোনোরকমে ঠিক চলে যাচ্ছিল। এদিকে নাতালি আন্টিরও বয়স হচ্ছিল। একদিন অনেক রাত্তিরে উনি ডাকলেন আমায়। বেশ বুঝতে পারছিলাম, হার্ট অ্যাটাক। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ারও সময় ছিল না। যাবার আগে উনি আমার হাতে এটা গুঁজে দিয়ে গিয়েছিলেন। অস্ফুটে কেবল এটুকু বলতে পেরেছিলেন যে এই জিনিসটাই ওঁর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি।”
হান্স তার পকেট থেকে জিনিসটা বের করে এনে সুবীরের চোখের সামনে রেখেছে। আলোর ছটায় সুবীরের চোখ ধাঁধিয়ে আসবার উপক্রম।
হিরের মাপ যে এতটাও বড়ো হতে পারে সুবীর তা কখনো চিন্তা করেও দেখেনি। ছোটোখাটো একটা পায়রার ডিমের মতো চেহারা। জাত জহুরির হাতে কাটা হয়েছে, আলোর ঝলকানিতেই তা পরিষ্কার। সুবীর হাত বাড়িয়েও হাত টেনে নেয় আবার। হান্স সুবীরের হাতটাকে টেনে আনে, দিব্যি রক্তমাংসের মানুষের মতোই। হাতের উপরে হিরেটাকে দেখতেও গা ছমছম করছে সুবীরের। সুবীর প্রায় কাঁপতে কাঁপতে হান্সের দিকে তাকায়।
“এই হিরের মালিক নাকি আদতে মুর্শিদাবাদের জগৎ শেঠ। কীভাবে তা চুরি গিয়ে হাত ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ে অ্যান্ড্রুর প্রপিতামহ জেমস হিলবার্ট রোজারিওর দপ্তরে। সুদের কারবার খুলেছিল রোজারিও, আর এই হিরে আসার পর থেকেই তার কারবার যেন আরো ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে। সেই থেকেই এই হিরে ক্রমশ অ্যান্ড্রুদের পারিবারিক সম্পত্তি হয়ে থেকে যায়। দিনে দিনে ওদের অবস্থা পড়লেও হিরেটাকে বিক্রির কথা ওরা কেউ কোনোদিন ভাবতেও পারেনি। কালের নিয়মে সেই হিরে কিনা এসে পড়ল আমার হাতে।” হান্স অদ্ভুত একটা হাসিমাখা চোখ নিয়ে সুবীরের দিকে তাকায়। “ভেবেছিলাম বাবার কাছে চলে যাব। সবকিছু স্বীকার করে তাঁর সঙ্গেই থাকব। এর মধ্যে প্রায় সাত-আট বছর কেটে গেছে। ততদিনে নিশ্চয়ই তাঁর রাগ পড়ে যেত। সে আর হল কই! শ্রীরামপুর ফিরে যাবার তোড়জোড় করছি, যদিও খবর পেয়েছিলাম যে বাবা নাকি শ্রীরামপুরের বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছেন। তাহলেও ওখানে গেলে পরে চেনা কারোর সঙ্গে দেখা করে ঠিক বাবার খোঁজ পেয়ে যেতাম। কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ একদিন দুপুরে নাতালি আন্টিদের বাড়িওলা জর্জ কোথা থেকে এসে হম্বিতম্বি করতে শুরু করল। আমি নাকি নাতালি আন্টির ঘর থেকে জিনিসপত্র সরিয়েছি। কোত্থেকে সে কী টের পেয়েছিল জানি না। কিন্তু খেয়াল করলাম, আমার ঘরের বাইরে দুটো গুন্ডামতো চেহারার লোক ঘুরঘুর করছে। ভয় পেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। লোক দুটো কিছুতেই পিছু ছাড়ছিল না। এসপ্ল্যানেডের বাস টার্মিনাসে এসে দিঘার বাসে উঠে বসলাম। সঙ্গে সামান্য কিছু পুঁজি ছিল। ভেবেছিলাম দিঘাতে এসে দিনকতক গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারব। কিন্তু কোথায় কী। সেখানেও দুই মক্কেল হাজির। পালিয়ে এলাম উদয়পুরে। মাঝরাত্তিরে বারান্দার দরজা খুলে ঢুকে এল সেই দুজন। ছিটকিনিটা ভাঙা ছিল বোধ হয়। তারপর,” হান্স গল্প থামিয়ে দেয়। সে উঠে দাঁড়িয়েছে, “আমাকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও ওরা কিচ্ছুটি পায়নি সেদিন… আজও, আমার এখনো সেই জায়গাটা স্পষ্ট মনে আছে। বালির অনেকটা নীচে, অনেকটা গভীরে পুঁতে দিয়েছিল ওরা আমার দেহটাকে। এখনো, এখনো খানিকটা খুঁড়লেই… আপনি আমাকে সাহায্য করবেন না সুবীরবাবু?” হান্সের চোখে যেন সম্মোহনের ঝিলিক। “দরোয়ান এখন ঘুমোচ্ছে। ওর ঘরের পাশে একটা কোদাল রাখা থাকে সবসময়। আপনি দেখেছেন। একবার, একবার আমার অতীতটাকে…”
সুবীর যেন কীসের টানে ঘর থেকে বের হয়ে হান্সের সঙ্গে যেন-বা হাঁটতে হাঁটতে, ভাসতে ভাসতে চলেছে। আট-দশ বছর আগেকার কোন ভীষণ অন্যায়ের যেন-বা প্রায়শ্চিত্ত আজ।
***
সমুদ্রে জোয়ার এসেছে। কলকল করে জল ছুটে আসছে, আর কী প্রচণ্ড তার আওয়াজ! সুবীর প্রাণপণে কোদাল চালাচ্ছিল। প্রতিটা ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গেই সমুদ্র যেন আরো এগিয়ে আসছে। এই জায়গাটায় বেলাভূমি যেন খানিকটা বাঁক নিয়েছে। জায়গাটার কাছেই এক-আধটা বোল্ডার রয়েছে। একেকবারে জলের ছিটে লাগছে গায়। ভয় করছে সুবীরের, তবুও কীসের যেন আকর্ষণে সে বালি খুঁড়ে চলেছে। একটা কিছুতে কোদালটা ঠেকল। ঠক করে আওয়াজ হল কীসের। হান্স!
কে যেন সুবীরের পিঠে হাত রেখেছে। “সুবীরবাবু।”
সুবীর পিছনে ফিরে তাকাল। সন্ধের সেই হেড মাস্টার ভদ্রলোক। চোখ দুটো যেন এখন স্পষ্ট আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলছে। “কী খুঁড়ছেন সুবীরবাবু? রোজারিওকে?”
সুবীরের কোদালের ফালে একটা প্রাচীন কঙ্কালের পায়ের অংশ উঠে এসেছে। হঠাৎ চারদিকে জল। প্রবল জোয়ারের টান। পায়ের তলা থেকে সরসর করে বালি সরে যাচ্ছে। সুবীর ডুবে যাচ্ছে। হেড মাস্টারের চোখ দুটিতে যেন আগুন!
সুবীর ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসল। সকাল হয়ে গেছে। জানালা দিয়ে বিছানার উপরে রোদ এসে পড়েছে। সুবীর হাতঘড়িতে সময় দেখল, পৌনে সাতটা। সে বড়ো করে একটা শ্বাস ফেলল। এমনও দুঃস্বপ্ন হয়!
ম্যানেজার চা দিতে এসেই খবরটা দিল। আজ ভোরবেলায় নাকি বিশ্বরূপ জানার মৃতদেহ পাওয়া গেছে সমুদ্রসৈকতে। তাঁর হাতে নাকি ছিল একটি কোদাল, আর সারা দেহে নাকি বালি লেগে ছিল। গভীর রাত্তিরে সৈকতের বালি সরিয়ে তিনি বোধ হয় কোনো কিছুকে খুঁড়ে বের করতে চেষ্টা করছিলেন। তখন সেই একই জায়গাতে খানিকটা বালি খুঁড়তেই নাকি একটা কঙ্কালেরও হদিশ পাওয়া গেছে। পুলিশ সন্দেহ করছে সেটা নাকি সেই রোজারিওর।
“যাই বলুন মশাই, ভদ্রলোকের মাথায় ছিট ছিল বটে। শেষমেশ রোজারিওর লাশকে খুঁড়ে বের করতে গিয়েই কিনা নিজের জীবনটাও খোয়ালেন।” ম্যানেজার আলগা মন্তব্য করে।
সুবীরের কানে আর এইসব ঢুকছে না।
পূর্ণিমার সমুদ্রের একটা আশ্চর্য রূপ হয়। যা না দেখলে পরে, কেবল বর্ণনা করে বোঝানো চলে না। সুবীর জানে হান্স ক্রিশ্চিয়ানের আসল নাম প্রণবেশ। প্রণবেশ জানা, সাকিন শ্রীরামপুর। সে বিশ্বরূপ জানার সন্তান। ভাগ্যচক্রে সে হান্স রোজারিওর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। সুবীর এও জানে রোজারিওকে তার বাবা উদয়পুরের হোটেলে ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন। পরের দিন ছেলের সঙ্গে দেখা করবারও ইচ্ছে ছিল তাঁর। কিন্তু সেই রাত্তিরেই যে রোজারিওকে চিরতরে চলে যেতে হবে, তা ভাবতেও পারেননি বিশ্বরূপ। এতদিনে তাঁর প্রতীক্ষার অবসান হল।
সুবীরের পায়ে জল এসে লাগছে। জ্যোৎস্না-ঢালা সমুদ্রের জল বারে বারে তার পা ধুইয়ে দিচ্ছে। সুবীর তার বারমুডার পকেটে হাত ঢুকিয়ে জিনিসটাকে বের করে আনে। যেটা আজ সকাল থেকে তার পকেটে পকেটেই ঘুরে বেড়িয়েছে। মনে মনে সে আবৃত্তি করে, “কী সুন্দর মালা আজি পরিয়াছ গলে – প্রচেতঃ,” প্রচেতঃ অর্থে সমুদ্র। ছোটবেলায় বাংলার ক্লাসে মাস্টারমশাইরা পড়িয়েছিলেন। জগৎ শেঠের ইতিহাস আজ কলঙ্কে পর্যবসিত হয়েছে। একটি নয়, সুবীরেরই জানাশুনোর মধ্যে অন্তত দু-দুটি প্রাণের হিসেব এর গায়ে অদৃশ্য অক্ষরে লেখা হয়ে রয়েছে। এই হিরের মূল্য অনেক হতে পারে, কিন্তু এই হিরে আসলে এক অভিশাপ। কে জানে আরো কত মানুষের দুঃখ-কষ্ট-অভিমানের খতিয়ান এর প্রতিটি পলকাটা সমতলে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। সুবীর কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সমুদ্রের গর্জনে কেউ শুনতেও পেল না যে, সমুদ্রের অতলে একটা ছোট্ট গোলমতো অল্প ভারী বস্তুকে ছুড়ে ফেলল কেউ। জগৎ শেঠের ইতিহাস সকলের অলক্ষে মিলিয়ে গেল লোকচক্ষুর অগোচরে – অন্ধকার সমুদ্রে, চিরতরেই।
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস