গল্প-লাঠি-বনবীথি পাত্র-বর্ষা২০২২

এই লেখকের আগের গল্প- সেই রাত, ইচ্ছেডানা

golpolathi

সামনে সাধারণ জ্ঞানের বইটা খোলা থাকলেও সেদিকে মন নেই তিতলির। উঠোনের কাঞ্চনগাছটার সাদা ফুলগুলোর ওপর একটা নীলচে রঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে, সেটাই দেখছে তিতলি। ইরার মাসিমণি দিল্লিতে থাকে, কিছুদিন আগে ওদের বাড়ি বেড়াতে এসেছিল। ওর মাসতুতো বোনটা ইরার থেকেও ছোটো। তাও নাকি গড়গড় করে হিন্দি বলতে আর লিখতে পারে। তিতলি তো হিন্দি বলা বা লেখা দূরে থাক, টিভির হিন্দি অনুষ্ঠানগুলো ভালো করে বুঝতেই পারে না। ইরার কাছ থেকেই তিতলি জেনেছে, তিতলি মানে নাকি প্রজাপতি। প্রজাপতিটাকে দেখছিল আর তিতলি ভাবছিল, ও বেশ প্রজাপতিটার মতো যদি যখন যেখানে খুশি উড়ে বেড়াতে পারত! তাহলে কী মজাই না হত! বুড়ো শিবতলাতে এখন কত কী হচ্ছে। সব সন্ন্যাসীরা আসবে ওখানে। বাণ-ফোঁড়া, ফল হরিলুট, ধুনো পোড়ানো, আরও না জানি কত কী! নূপুর-ঝুমা-সোনাই ওরা সবাই যাবে বলেছিল। তিতলিও যাবে ভেবেছিল। কিন্তু সে-কথা মায়ের কাছে বলতেই মা বারণ করে দিয়েছে। ওসব জায়গায় ছোটোদের নাকি যেতে নেই। তিতলি তো এখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। থ্রিতে পড়া মেয়ে কখনও ছোটো হয়! অথচ মা নিজেই মাঝে মাঝে বলে, ‘তিতলি, তুমি বড়ো হয়ে গেছ। ছোটোদের মতো বায়না করতে নেই।’ কখনও বলবে ছোটো, কখনও আবার বড়ো। তিতলি নিজেই বুঝতে পারে না সে বড়ো না ছোটো!

“সামনে বইটা খুলে রেখে অন্যদিকে তাকিয়ে কী ভাবছিস? সব পড়া মুখস্থ না পেলে আমি কিন্তু বিকালে চড়কের মেলাতেও যেতে দেব না।”

ইস্, মা যে কখন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে তিতলি খেয়াল করেনি। মা যেন কেমন করে সবকিছু বুঝে যায়! তিতলি যে বই খুলে অন্য কথা ভাবছিল, সেটাও ঠিক বুঝতে পেরে গেছে।

মা পিসিঠাম্মাকে ঘর থেকে হাত ধরে নিয়ে এসে বারান্দার কাঠের চেয়ারটাতে বসাচ্ছিল। পিসিঠাম্মা চোখে তো কিছুই দেখতে পায় না। ডাক্তারবাবু বলেছেন, পিসিঠাম্মার রক্ত নাকি মিষ্টি বেশি। অনেক ওষুধ দিয়েছেন ডাক্তারবাবু। ওগুলো খেয়ে রক্তের মিষ্টতা কমলে চোখ অপারেশন করবে। তখন পিসিঠাম্মা নিজে-নিজেই সব করতে পারবে। মা রান্নাঘরে যাচ্ছিল। তিতলি জানে পিসিঠাম্মার খাবার আনতে যাচ্ছে মা। ছোটো বাচ্চাদের মতো ভাত মাখিয়ে পিসিঠাম্মাকে খাওয়াবে এবার।

তিতলি উঠে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে।—“ও মা, চড়কের মেলাতে ম্যাজিক শো এসেছে। দারুণ দারুণ সব ম্যাজিক দেখাচ্ছে নাকি। সবাই বলছিল, চল্লিশ টাকা করে টিকিট। আমিও ম্যাজিক দেখব মা।”

মা তিতলির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “তুই তো আমার লক্ষ্মী মেয়ে। অমন বায়না করতে নেই। জানিস তো বাপীর দোকানে আর আগের মতো কেনাবেচা হয় না। তার ওপর পিসিমার অত ওষুধের খরচ…”

কথার মাঝেই মাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের পড়ার জায়গায় এসে বসে তিতলি। মনটা খারাপ। ছোটো মফস্‌সল শহর ওদের। তাও এখন অনেক বড়ো বড়ো দোকান হচ্ছে। একটা শপিং-মলও হয়েছে। মানুষজন এখন ওইসব জায়গাতেই কেনাকাটা করতে যায়। বাজারের কাছে বাপীর ছোটো কাপড়ের দোকানটায় তাই আর আগের মতো বেচাকেনা হয় না। পিসিঠাম্মার জন্য কত কত ওষুধ কিনতে হচ্ছে। বাপী এত টাকা কোথায় পাবে! সব বুঝলেও মনটা খারাপ হয়ে যায় তিতলির। ম্যাজিক শোটা দেখার ভীষণ ইচ্ছা ছিল তার। আর ভেবেছিল গতবারের মতো টয়ট্রেনেও চাপবে। কিন্তু সে তো অনেকগুলো টাকার ব্যাপার। মা তো অত টাকা দেবেই না তিতলিকে! বন্ধুরা সবাই যখন টয়ট্রেনে চাপার জন্য তিতলিকে ডাকাডাকি করবে, তখন কী বলবে তিতলি ওদের? তার থেকে বরঞ্চ মেলাতেই যাবে না তিতলি।

আগের বছরও সবকিছু যেন অন্যরকম ছিল। মায়ের সঙ্গে মেলায় গিয়ে কত আনন্দ করেছিল তিতলি। মেলাতেই দেখা হয়ে গিয়েছিল মৌটুসিদের সঙ্গে। সবাই মিলে টয়ট্রেনে চেপেছিল। গতবার মেলাতেই প্রথম বরফগোলা খেয়েছিল। ঠান্ডা লেগে কাশি হবে বলে মা প্রথমে কিনে দিতে রাজি না হলেও পরে কিনে দিয়েছিল। তিতলি খেয়েছিল লিচুর স্বাদ আর মৌটুসি খেয়েছিল আমের স্বাদের বরফগোলা। তারপর দুটো পুতুল কিনেছিল। পাঁপড়ভাজা খেয়েছিল। তারপর মেলার থেকে ফেরার পথে বাপীর দোকান থেকে একটা সুন্দর জামা নিয়ে এসেছিল তিতলির জন্য। পয়লা বৈশাখের জামা।

কালকেই তো পয়লা বৈশাখ। এখনও তো কোনও জামা বাপী এনে দেয়নি তিতলিকে। এবার মনে হয় পয়লা বৈশাখে আর নতুন জামা হবে না তিতলির। পিসিঠাম্মা এই বাড়িতে আসার পর থেকে মা-বাপী সবাই যেন পিসিঠাম্মাকে নিয়েই ব্যস্ত। আগের মতো করে তিতলির কথা ভাবার যেন সময়ই নেই ওদের।

পিসিঠাম্মার জন্য অত ওষুধ কিনতে না হলে মা নিশ্চয় টাকা দিত তিতলিকে। আর তিতলিরও ম্যাজিক দেখা, টয়ট্রেনে চাপা সব হত। একটু রাগ রাগ মুখেই তিতলি তাকায় পিসিঠাম্মার দিকে। খাওয়া শেষ পিসিঠাম্মার। মা মুখ ধুয়ে দিচ্ছে। নিজের শাড়ির আঁচলটা দিয়ে পিসিঠাম্মার মুখটা মুছে দিতে দিতে মা বলে, “যা তো তিতলি, ঘর থেকে ঠাম্মার দুপুরের খাওয়ার পরের ওষুধটা নিয়ে আয়। একেবারে ঠাম্মাকে ওষুধটা খাইয়ে দিয়ে আমি স্নান করতে যাব। তারপর এসে তোর পড়া ধরব। ঠাম্মা যদি জল খেতে চায়, এই গ্লাসের জলটা ঠাম্মার হাতে ধরিয়ে দিবি।”

“আমার জন্য তোমার কত কষ্ট হচ্ছে বৌমা। আমার চোখটা অপারেশন হয়ে গেলে তো চোখে দেখতে পাব। বঙ্কুকে বোলো তখন একটা লাঠি কিনে দিতে। আমি তখন লাঠি ধরে ধরে নিজেই চলাফেরা করতে পারব।”

কাঁপা কাঁপা গলায় পিসিঠাম্মার কথাগুলো শুনে তিতলির মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। একটু আগেই রাগ হচ্ছিল পিসিঠাম্মার ওপর, অথচ এখন কেমন একটা কষ্ট হচ্ছে মনটাতে। নিজের চোখ দুটো কিছুক্ষণ বন্ধ করে থাকে। চারপাশটা তখন শুধুই অন্ধকার। ইস্, যারা চোখে দেখতে পায় না তাদের কত কষ্ট। ঠাকুর কেন কাউকে এমন কষ্ট দেন, কে জানে!

***

অন্যবার মায়ের সঙ্গেই চড়কের মেলায় যায় তিতলি। কিন্তু এবার পিসিঠাম্মাকে একা রেখে মা তো আর মেলায় যেতে পারবে না। তাই পাশের বাড়ির মণিদিদির সঙ্গেই মেলায় যাবে তিতলি। মা বার বার বলে দিয়েছে মণিদিদির হাত ধরে থাকতে; একটুও দুষ্টুমি না করতে। লক্ষ্মী মেয়ের মতো মায়ের কথায় ঘাড় নেড়ে সায় দেয় তিতলি। মা পঞ্চাশ টাকা দিয়েছে। খুব খুশি তিতলি। ম্যাজিক শো দেখবে, আবার টয়ট্রেনেও চাপবে। ওর অনেক পুতুল আছে, তাই আর পুতুল কিনবে না।

মণিদিদি ক্লাস টেনে পড়ে। মাস্টারমশাই পড়াতে আসবে, তাই সন্ধে হওয়ার আগেই মেলা থেকে ফিরে আসে ওরা। মা আর পিসিঠাম্মা দুজনেই উঠোনে বসে গল্প করছে। তিতলিকে দেখেই মা জিজ্ঞাসা করে, “কী রে, কেমন মজা হল মেলাতে? ম্যাজিক দেখলি? দুষ্টুমি করিসনি তো? কী কিনেছিস দেখি মেলাতে।”

উফ্, মা একসঙ্গে এত প্রশ্ন করলে কোনটার উত্তর দেবে তিতলি! তাই মায়ের কোনও কথার উত্তর না দিয়ে ছুটে গিয়ে এক হাতে জড়িয়ে ধরে পিসিঠাম্মাকে। তারপর পিছনে লুকানো অন্য হাতটা সামনে এনে লাঠিটা ধরিয়ে দেয় পিসিঠাম্মার হাতে। তারপর এক মুখ হাসি হেসে বলে, “মেলাতে পিসিঠাম্মার জন্য এই লাঠিটা কিনেছি। চোখ অপারেশন হয়ে গেলে পিসিঠাম্মা লাঠিটা ধরে নিজে নিজে হাঁটবে।”

“ম্যাজিক দেখবি বলে এত বায়না করছিলি, ম্যাজিক দেখিসনি?” মা অবাক হয়ে জানতে চায়।

তিতলি দু-দিকে ঘাড় নাড়িয়ে জবাব দেয়, “না।”

তিতলিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছে পিসিঠাম্মা। ওর গালে চুমু খেতে খেতে বলছে, “তুই তো আমার সবথেকে বড়ো লাঠি দিদিভাই।”

অবাক হয়ে পিসিঠাম্মাকে দেখছে তিতলি। দু-চোখে জলের ধারা অথচ মুখে যেন এক মুখ হাসি। যারা ম্যাজিক শো দেখে খুশি খুশি মুখে বেরিয়ে আসছিল, তাদের থেকে অনেক খুশি দেখাচ্ছে পিসিঠাম্মাকে।

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s