গল্প-সেই রাত-বনবীথি পাত্র-শীত ২০২১

সন্ধ্যা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য প্রতিযোগিতা’২০২১-দ্বিতীয় স্থান

golpoSei Raat_Illustration

সিঁড়িটা কেমন যেন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে গেছে দোতলায়। বাড়ির মূল অংশটার সঙ্গে এই ঘরটার কোন যোগাযোগ নেই। বাড়ির মধ্যে না ঢুকে বাইরে দিয়ে ছাদে ওঠার জন্য মনে হয় এই সিঁড়িটা। লোহার সিঁড়ি, রোদে জলে পুরু মরচে পড়ে গেছে। দেখলেই মনে হয় অনেক বছর কেউ ওঠানামা করেনি এই সিঁড়ি দিয়ে।

আজ স্কুল ছুটি। দুপুরবেলা কিছুতেই ওর ঘুম আসে না। তাই ঘরের জানলার ধারে বসে আনমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল কলি। বাগানের মধ্যেই ঘরটা তাই চারদিকে অনেক বড়ো বড়ো গাছ আছে। এই গরমের দুপুরেও একদম ঠাণ্ডা এই ঘরটা। একটা টেবিল ফ্যান থাকলেও সেটা চালানোর দরকার হয় না। কলির তো মাঝে মাঝে কেমন যেন শীত শীত করে ওঠে। কাঁটা ফুটে ওঠে হাত পায়ে। ঘরের সামনে ছায়া ঘেরা ফাঁকা জায়গাটুকুতে বড়ো বড়ো গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে আসা আলোর আলপনাগুলো কেমন যেন নড়াচড়া করে প্রতি মুহূর্তেই নিজেদের পাল্টে ফেলে। একদৃষ্টে আলোর আলপনা দেখতে দেখতে কেমন যেন ভয় ভয় করে কলির। চুপ করে কান পাতলে একটা ছন্দমাখা টিক টিক আওয়াজ ভেসে আসে। মা বলেছে, দোতলার বৈঠকখানায় একটা ইংরেজ আমলের দেওয়াল ঘড়ি আছে। এ নাকি তারই আওয়াজ।

প্রথম প্রথম খুব ভয় করত কলির। মনে হত সে বুঝি সেই রূপকথার বন্দী রাজকুমারী। কোন দুষ্টু রাক্ষসী বুঝি দূর থেকে তার ওপর নজর রাখছে। এখন আর অতটা ভয় করে না। স্কুল থেকে ফিরেও ঢাকা দিয়ে রাখা ভাতটুকু খেয়েই জানলা ধারে এসে বসে। পড়ন্ত বেলা হলেও তখনও কিছুক্ষণ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এসে কমলা রোদ আঁকিবুকি কাটে উঠানে। আলো ছায়ার ওই আলপনায় নতুন নতুন ছবি খুঁজে বের করাটা কলির যেন নেশার মত হয়ে গেছে। কখনও যেন মনে হয় রাবণ সীতাহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। কখনও আবার মনে হয় মা দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করছেন। কখনও ভীষ্মের শরশয্যা, কখনও ডাইনোসর, কখনও টারজান। সবাইকে সে খুঁজে পায় এখানে। একদিন রাপুনজেলকে লম্বা চুল ছড়িয়ে বসে থাকতেও দেখেছিল।

রাত্রিবেলা শোয়ার আগে রাতের খাবার নিয়ে যখন মা এই ঘরে আসে, তখন চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যায়। তাই ইচ্ছা করলেও মাকে ওই আলোছায়ার চলচ্চিত্র দেখাতে পারে না কলি। রাতে শুয়ে শুয়ে মাকে সারাদিনের যত জমানো কথা সব কটর কটর করে বলতে থাকে। কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারে মা ঘুমিয়ে গেছে। কলি বুঝতে পারে মায়ের সারাদিন কত পরিশ্রম যায়। মায়ের মুখটাও আর মা দুর্গার মুখের মত লাগে না। কেমন যেন ফ্যাকাশে মলিন। কান্না পেয়ে যায় কলির। মা ঘুমিয়ে গেলেও মায়ের বুকে মুখ গুঁজে দেয়। পরক্ষণেই মুখটা সরিয়ে নেয়। মায়ের সারা গায়ে ওষুধের গন্ধ। মায়ের গায়ের সেই মা মা গন্ধটাও হারিয়ে গেছে। পাশ ফিরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে কলি। মা তো সারাদিনে এই রাতটুকুই একটু বিশ্রাম পায়। ভোর হলে কলির ঘুম ভাঙার আগেই মা এই ঘর থেকে চলে যায়। পাছে কান্নার আওয়াজে মায়ের ঘুম ভেঙে যায় বলে বালিশে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে থাকে।

বাবার কথা ভীষণ মনে পড়ে। বাবা যদি হঠাৎ করে অমন মারা না যেত, আজ কি ওকে আর মাকে এখানে এসে পরের বাড়িতে থাকতে হত? পরের বাড়ি নয়তো কী! নামেই মায়ের দূর সম্পর্কের মামার বাড়ি। মামার বাড়ি হলে মাকে কখনও সারাটা দিন রুগীর সেবা করতে হয়? মায়ের মামার বাড়ি মানে তো কলির দাদুবাড়ি। দাদুবাড়িতে কাউকে কখনও বাগানের মধ্যে এমন একটা ঘরে থাকতে দেয়? আজ অবধি কোনদিন ওই দোতলা বিশাল বাড়িটার ত্রিসীমানাতেও যেতে পায়নি কলি। প্রথমদিন গাড়ি রাখার ঘরটা পেরিয়ে ওই বাড়ির দিকে মাকে খুঁজতে যাচ্ছিল কলি। তখন একটা বুড়ো লোক এমন বকুনি দিয়েছিল, তারপর আর কখনও ওদিকে যায়নি। মা যতই বোঝাক দাদু হয় তাই বকেছে। কলি আসল সত্যিটা ভালোই বুঝতে পারে। মায়ের বড়োলোক মামা তার বাড়িতে গরিব বিধবা ভাগ্নী আর তার মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছে এই অনেক। তার বদলে মাকে সারাটা দিন মায়ের মামির সেবাযত্ন করতে হয়। তিনি নাকি আজ বহুবছর বিছানা ছেড়ে উঠতেও পারে না। তাঁর সব কাজ মাকেই করে দিতে হয়।

মায়ের জন্য খুব কষ্ট হয় কলির। তাই তো ও খুব মন দিয়ে পড়াশুনো করে। যাতে বড়ো হয়ে একটা চাকরি পেয়ে মাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে পারে। কয়েক মাস তো হল এখানকার এই ইস্কুলে ভর্তি হয়েছে। পড়াশুনো করে বলে দিদিমণিরা সবাই ভালোবাসা কলিকে। এখানকার বন্ধুগুলোও ভালো। সবাই ওকে কৃষ্ণকলি বলেই ডাকে, পুরনো স্কুলের মত কেউ ওকে পিঁয়াজকলি বলে রাগায় না।

আকাশে আজ বোধহয় মেঘ করেছে। গাছের ফাঁক দিয়ে আসা আলোর নকশাগুলো কেমন যেন আবছা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। এমন মেঘলা দিন একটুও ভালো লাগে না কলির। আকাশের সঙ্গে ওর মনটাও কেমন যেন মেঘলা হয়ে আসে। তবে আজ মেঘের জন্য মনখারাপ নয়, ওর মনখারাপ অন্য কারণে। সোমবার বাংলা ক্লাসে ওকে দিদিমণির কাছে হোমটাস্ক না করে নিয়ে যাওয়ার জন্য বকুনি খেতে হবে।

বিকাল হলেই মালিদাদু বাগানে গাছে জল দিতে আসে। শুধু কী জল দেয়! সব গাছেদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেয়াল করে। কোনও গাছে পোকা লাগল কি না, কোন্ গাছে কুঁড়ি এল, কোনও গাছের পাতা হলুদ হচ্ছে কিনা সব লক্ষ্য করে। বাগানের সব ঝরা পাতা ঝুড়িতে তুলে বাগান পরিষ্কার করে। এই বাড়িতে মালিদাদুর সঙ্গেই শুধু ভাব হয়েছে কলির। দাদু যতক্ষণ বাগানে কাজ করে, ও দাদুর সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরে বেড়ায়। দাদুর সঙ্গে বাগানের পাতা পরিষ্কার করে। দাদুর কাছে গাছেদের গল্প শোনে। দাদুকে ওর আলো ছায়ার রূপকথার গল্প শোনায়। অন্যদিনের মত কলিকে ঘর থেকে বেরতে না দেখে দাদু বলে, “কী হল কলিরাণী আজ অমন মুখভার করে বসে আছো কেন?”

“মনটা ভালো নেই গো দাদু,” আনমনে উদাস সুরে উত্তর দেয় কলি।

“কেন দিদিমণি হঠাৎ মনখারাপ হল কেন? কারণটা বলো একবার শুনি। দেখি আমার কলিরাণীর মনটা ভালো করে দিতে পারি কি না!”

কলি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দাদুর কাছে আসে।

“না গো দাদু, তুমি আমার মন ভালো করে দিতে পারবে না। আমাকে ইস্কুলে রচনা লিখে নিয়ে যেতে বলেছে।”

মালিদাদু হেসে বলে, “রচনা তো আমরাও ইস্কুলে লিখতাম। বই থেকে মুখস্থ করে নিয়ে তুমিও লিখে ফেলো রচনা। এতে মনখারাপের কী আছে?”

“দিদিমণি এবার যে রচনা লিখে নিয়ে যেতে বলেছে সেটা কোন বইতে নেই। হয় নিজের অভিজ্ঞতা না হলে কারও কাছে শুনে নিয়ে নিজের মত করে লিখতে হবে। আমার তো নিজের অ্যাডভেঞ্চারের কোন অভিজ্ঞতাই নেই। তাহলে কী লিখব বলো? আর আমাকে অ্যাডভেঞ্চারের গল্পই বা কে শোনাবে!”

মালিদাদু ঝুমকোলতা গাছটার লতাগুলোকে কঞ্চির মাচায় জড়িয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করে, “অ্যাডভেঞ্চার! সেটা আবার কী জিনিস আছে?”

“হে ভগবান, তুমি অ্যাডভেঞ্চার কী তাই জানো না! এই নাকি তুমি আমাকে রচনা লিখতে সাহায্য করবে!” মালিদাদুর কথাতে একটু যেন ভরসা পেয়েছিল কলি। ওর গলাটা এবার কেমন যেন হতাশ শোনাল।

“আহা ওই অ্যাডভেঞ্চার জিনিসটা কী আছে আমাকে একটু বুঝিয়েই বলো তো।”

“দুঃসাহসিক, ঝুঁকিপূর্ণ কোন ঘটনাকেই অ্যাডভেঞ্চার বলে। এই ধরো তুমি মরুভূমিতে বেড়াতে গিয়ে মরুঝড়ের মধ্যে পড়ে গেলে, বা জঙ্গলে গিয়ে হিংস্র কোন পশুর মুখোমুখি হয়ে গেলে। সেই মুহূর্তটাতে তোমার যে অনুভূতি, সেই বিপদ থেকে কিভাবে নিজেকে বাঁচালে সেটাই অ্যাডভেঞ্চার। আমি তো কোনদিন কোথাও বেড়াতেই যাইনি, এসব আমি কী করে লিখব! আমাদের ক্লাসের মৌটুসিরা সবাই মিলে গতবছর পুরীতে বেড়াতে গিয়েছিল। সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে আর একটু হলে ওর কাকিমা সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে চলে যাচ্ছিল। ও সেই ঘটনার কথা লিখবে। সুনন্দার মামা পাহাড়ে ট্রেকিং করে, ও মামার কাছ থেকে কোন গল্প শুনে লিখবে। তিতলিরা সুন্দরবনে গিয়ে কুমীর দেখেছিল, ও সেটাই লিখবে। কিন্তু আমি কী লিখব দাদু?”

গরম পড়েছে প্রচণ্ড। মালিদাদু হাতের খুরপিটা নামিয়ে রেখে বসে পড়ে আমগাছের গোঁড়ার বাঁধানো চাতালটায়।কোমর থেকে গামছাটা খুলে মুখের ঘামটা মুছে নেয়। কলিকে পাশে ডেকে বসিয়ে বলে, “তা তোমার অ্যাডভেঞ্চার বুঝি শুধু ওই পাহাড়, সমুদ্র আর জঙ্গলেই হয় দিদিমণি? আমাদের এই গ্রামে গঞ্জে বুঝি তোমার ওই অ্যাডভেঞ্চার হয় না?”

“ধুস গ্রামে আবার অ্যাডভেঞ্চার কী করে হবে?” কলি জোর গলায় উত্তর দেয়।

“আচ্ছা অ্যাডভেঞ্চার না হয় না হবে। তোমাকে একটা গল্প বলি চলো। শুনবে?”

গল্প শুনতে তো কলির ভালোই লাগে। বাবা তো রোজ ওকে গল্প বলেই ঘুম পাড়িয়ে দিত। কতদিন গল্প শোনেনি কলি। গল্পের কথা শুনেই এতক্ষণের মনখারাপ যেন হুশ করে ভ্যানিস হয়ে যায় কলির মন থেকে। সে হাসি হাসি মুখে মালিদাদুর কাছ ঘেঁষে বসে।

“তখন ঘোর বর্ষা। গাঁয়ে হঠাৎ এক অজানা জ্বর দেখা দিল। এখনকার মত অত ওষুধবদ্যি ছিল না তখন। জ্বর হলে মানুষ দুদিন সাবু খেত আর কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকত। তিনদিনের দিন সকালে জ্বর আপনি সেরে যেত। নিতান্ত না সারলে দুর্যোধন কবিরাজের কাছে যেতে হত। সে ছিল সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। নিজে হাতে এমন পাঁচন তৈরি করে দিত, রোগ বালাই সব বাপ বাপ বলে দেহ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচত।”

“পাঁচন কী?” কথার মাঝেই জিজ্ঞাসা করে কলি।

“পাঁচন জানো না দিদিমণি? পাঁচন হল অনেক রকমের ওষধি গাছপালার শিকড়, জরিবুটি একসঙ্গে ফুটিয়ে তৈরি একধরনের ওষুধ। বাপরে কী তেতো সে ওষুধ। ছেলেপিলেদের তো পাঁচন খাওয়ার নামেই রোগ সেরে যেত।”

কলির মনে পড়ে গত বছর দুর্গাপুজোর সময় ওর যখন জ্বর হয়েছিল, গ্রামের বিধু ডাক্তার ওকে কী তেতো একটা ওষুধ দিয়েছিল।

“তো যে কথা বলছিলাম, সেবার গাঁয়ে এমন জ্বর দেখা দিল যে দুর্যোধন কবিরাজের ওষুধেও রোগ সারল না। একের পর এক মানুষ ওই জ্বরে মারা যেতে থাকল।”

“হাসপাতালে বড়ো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে না রুগীদের?” কলি জিজ্ঞাসা করে।

“বড়ো হাসপাতাল, সে তো অনেক দূর!এখনকার মত তখন তো এমন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। কোথাও যেতে গেলে হয় পায়ে হাঁটা, নয়তো গরুর গাড়ি। একে তখন বর্ষাকাল। গাঁয়ের পথে তখন এক হাঁটু কাদা। ওর মধ্যে গরুর গাড়ি চলবে না। আর রুগী মানুষ কি ওই অত পথ হেঁটে শহরের হাসপাতালে যেতে পারে? ভগবানকে ডাকা আর দুর্যোধন কবিরাজের ওষুধকে ভরসা করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না।

“কিন্তু জ্বরের প্রকোপ যেন বাড়তেই লাগল। গাঁয়ে প্রায় মড়ক লাগার মত অবস্থা। আমাদের গাঁয়ে শ্মশান কালী খুব জাগ্রত ছিল। অমাবস্যার রাতে পুজোর সময় পুরুত মশাইয়ের ভর হল। ভরে জানত পারল এই জ্বর নাকি এক ডাইনির কাজ। সেই ডাইনিকে শেষ করতে পারলে তবে নাকি এই জ্বরের প্রকোপ থেকে গ্রামের মানুষদের বাঁচানো যাবে। নদীর ধারে গাঁয়ের নীচু জাতের মানুষদের বাস ছিল। জগা বাউরীর একটা বোবা মেয়ে ছিল, সেই নাকি আসলে ডাইনি। তার কুনজরেই নাকি গাঁয়ের ওই সব্বোনাশ।

“গাঁয়ের মাথা মুরুব্বিদের সভা বসল, কী করে ওই ডাইনির রোষ থেকে গ্রামকে বাঁচাবে। অবশেষে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন এক রাতে তার ঘরে আগুন দিয়ে তাকে পুড়িয়ে মারবে।”

“ইস তোমাদের গাঁয়ের ওই লোকগুলো কী দুষ্টু গো! একজন মানুষকে অমন ভাবে পুড়িয়ে মারলে তার বুঝি কষ্ট হবে না?” কলির গলাটা ভীষণ দুঃখ দুঃখ শোনাল।

“আমরা তখন বছর বারো তেরো। আমাদের কিশোর দলের অলিখিত নেতা কেষ্টদা। কেষ্টদা আমাদের থেকে কিছুটা বড়ো। সে বছর ইস্কুল ফাইনাল দিয়ে পাশ করতে পারেনি বলে পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছে। পড়াশুনো ছাড়লে কী হবে, ফুটবল খেলে দারুণ। সবাই বলত, খেলার কোঠায় সরকারি দপ্তরে ওর চাকরি বাঁধা। কেষ্টটার চেহারা তাকিয়ে দেখবার মত। হাতের মাসল কী! যেমনি তার চেহারা, তেমনি তার সাহস। কেষ্টদার দাদু ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী। ইংরেজদের গুলিতে মারা গিয়েছিল তবু গোপন ডেরার খবর দেয়নি সাহেবদের। কেষ্টদা ওর দাদুর মত সাহসী ছিল। সে একাই গাঁয়ের মুরুব্বিদের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করল। একজন মানুষ কখনও ডাইনি হতে পারে না। ওসব কুসংস্কার। তার কথা তো কেউ শুনলেই না, উল্টে কেষ্টদার বাবাকে আদেশ দিল ছেলেকে ক’টা দিন বাড়িতে আটকে রাখতে। কেষ্টদার বাবা গদাইকাকা ছিল ভোলাভালা ভালো মানুষ। মুরুব্বিদের আদেশ কী আর অমান্য করতে পারে! ছেলেকে চিলেকোঠার ঘরে আটকে রাখল।”

“তারপর কী হল?”

“কী আর হবে, মুরুব্বিদের আদেশই বহাল থাকল। চারদিকে জ্বরজ্বালা বলে আমাদের ঘর থেকে বেশি বাইরে বেরনো নিষেধ। একদিন রাতে খেতে বসে বাবা মাকে বলল, ‘আজ রাতেই আপদ বিনাশ হবে। কাল অষ্টপ্রহর একটা যজ্ঞ হবে কালীতলায়। শ্মশান কালীর কৃপায় এবার বোধহয় গাঁয়ের মানুষগুলো রক্ষা পাবে।’

“মনটা খারাপ হয়ে গেল। জগা বাউরীর মেয়েটার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। খুব ছোটবেলায় একবার নাকি শালের আগুনে পুড়ে গিয়েছিল।”

“শালের আগুন কী দাদু?”

“আখের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করাকে শাল বলে। সেই ঝলসে যাওয়া চেহারা নিয়ে কোনদিনই সে কারও সঙ্গে মিশতে পারেনি। মেয়েটা কোনদিন কারও সঙ্গে মিশতে দেখিনি। মনটা ভীষণ খারাপ করছিল খবরটা শুনে। কিছুদিন আগেই সাপে কেটে জগু বাউরী মারা যাওয়ার পর মেয়েটা ঘরে একাই থাকে। কী খায়, কীভাবে ওর দিন চলে সে খোঁজ কেউ তো কখনও রাখেনি। অথচ ওকেই আজ হোগলাপাতার ঘরে জীবন্ত পুড়িয়ে মারবে! ভাতের শেষটুকু আর খেতেই পারলাম না। আমাদের খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘর। ঘরের লাগোয়া দাওয়ায় কুপি জ্বেলে রাতের খাওয়া চলছে। সেই আলোই এসে পড়েছে সামনের এক চিলতে জমিতে। তোলা জলে এঁটো হাতটা ধুচ্ছি হঠাৎ কে যেন একটা হ্যাঁচকা টানে আমাকে ঘরের পিছনে নিয়ে গেল। আমি তো ভয়ে ভূত বলে আর একটু হলেই চিৎকার করে উঠছিলাম। কেষ্টদা আমার মুখটা চেপে ধরে বলল, “ওরে ভূত নয়, আমি কেষ্ট।”

আমার তখনও যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। কাঁপা কাঁপা গলায় শুধোলাম, “তুমি তো চিলেকোঠার ঘরে আটকা ছিলে, বেরিয়ে এলে কী করে?”

“সে সব কথা পরে বলব। তুমি দাঁড় বাইতে পারিস?”

“মাঝির ঘরের ছেলে গো আমি। বাপ, ঠাকুর্দা পুরো গুষ্টি আমাদের নদীতে নাও বাইছে, আর আমি দাঁড় বাইতে পারব না?”

“চল তবে আর এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করিস না।”

“এত রাতে কোথায় যাব?”

আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোয় কেষ্টদার মুখটা দেখতে পেলাম। দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস করে বলল, “আন্নাকালীকে বাঁচাতে হবে।”

চমকে উঠলাম কেষ্টদার কথায়।

“বাবা বলছিল, সে যাতে পালাতে না পারে তার জন্য মুরুব্বিরা পাহারাদার দিয়ে এলাকা ঘিরে রেখেছে। একবার যদি… কথা বলে নষ্ট করার মত সময় নেই। একা মেয়েমানুষ, ভরা নদীতে ঝাঁপ দিলে ডুবে মরবে। তাই নদীর পাড়ের দিকে পাহারা নেই।”

“এত রাতে বাড়িতে কী বলব?”

“বল মাধো এসে খবর দিল কেষ্টদাকে সাপে কেটেছে। তাই তুই যাচ্ছিস।”

এমন ঘোর বর্ষায় এই জলা জঙ্গলে দাঁড়িয়ে সাপের নাম নিতে অবধি মানুষে ভয় পায়। সেখানে দিব্যি নিজেকে সাপে কাটার কথা বলছে! ঘরে গিয়ে কেষ্টদার শেখানো কথাটা বলেই মায়ের কোন কথা শোনার অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে এসেছিলাম। নদীর ধার এই বর্ষায় আগাছায় ছেয়ে গেছে। তার ওপর দিয়ে ভয়ে ভয়ে পা ফেলে ফেলে যাচ্ছি। কেষ্টদা অনেকটা এগিয়ে গিয়ে বিরক্তির গলায় বলে, “অমন পা মেপে মেপে চললে বিপদটা আটকানো যাবে না।”

জোড়া পাকুড় গাছের কাছে পথটা গড়ান হয়ে নেমে গেছে নদীতে। ভোলা মাঝির ছোট নৌকাখানা এই ঘাটেই নোঙর করা থাকে। কেষ্টদা হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “আমার হাতটা ধরে আস্তে আস্তে নেমে আয়। পা পিছলে গেলে একেবারে নদীতে গিয়ে পড়বি।”

নদীর স্রোতের আওয়াজ কানে আসছে। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “এমন ভরা নদীতে কখনও দাঁড় বাইনি।”

“জোয়ার চলছে। আমরা তো উজানে যাব, ঠিক পারবি। তুই দাঁড়া। আমি নৌকার নোঙরটা খুলি। খেয়াল রাখিস স্রোতে নৌকা যেন ভেসে না যায়।”

আমি নৌকাতে উঠে বসলাম। কেষ্টদা হেঁইও বলে একটা ঠেলা দিয়ে নৌকাটাকে জলে ঠেলে দিয়েই নৌকার ওপর লাফিয়ে উঠে পড়ল। নদীর যা স্রোত নৌকা যেন তার আপন খেয়ালে ভাসতে লাগল। মিশকালো অন্ধকারে খানিক দূরে কয়েকটা আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে। কেষ্টটা ফিসফিস করে বলল, “পাহারাদারদের হাতের মশাল দেখা যাচ্ছে। সামনেই সরকার পাড়ার কাছে নদীটা ডাকদিকে বেঁকে গেছে। ওই বাঁকটার পরেই বাউরীদের চানের ঘাটের কিছুটা আগেই নৌকাটা পাড়ে ভেরাতে হবে। চানের ঘাটে পাহারায় থাকতে পারে। তুই নৌকাতেই বসে থাকবি। আমি আন্নাকে নিয়ে নৌকাতে ফিরলেই তুই নৌকা ছেড়ে দিবি।

বাঁক ঘুরতে গিয়েই বুঝতে পারলাম নদীতে জলের স্রোত বাড়ছে। এমন স্রোতের টানে দাঁড় বেয়ে নৌকা টেনে নিয়ে যাওয়া মুখের কথা নয়। আরও কিছুটা এগোতেই পাহারাদারদের মশালের আগুন দৃষ্টির সীমানায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেষ্টদা হঠাৎ বলে, “আর এগোলে চলবে না। তুই নৌকা পাড়ে লাগা।”

নদীর দুপারে শর বনের জঙ্গল। কোন রকমে দাঁড় টেনে পাড়ের কাছে নিয়ে গেলাম। কেষ্টটা এক লাফে নৌকা থেকে নেমে পড়ল শরের বনে। লাফ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একদলা কাদা ছিটকে যায় চারপাশে। আমাকে ফিসফিসিয়ে বলে, “একবারে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাক নদীর মধ্যে, মশালের আলোতে যেন ফাঁকা নৌকাটাই নজরে পড়ে।”

নৌকার পাটাতনে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়লাম। ঝিঁঝিঁর ডাক আর মশার অত্যাচারে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। একটা করে মুহূর্ত মনে হচ্ছে বোধহয় এক একটা ঘণ্টা। কেষ্টদা কখন ফিরবে কে জানে!

হঠাৎ শরবনের মধ্যে দিয়ে কিছু একটা ছুটে আসার আওয়াজে লাফিয়ে উঠলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, কেষ্টদা আন্নাকে নিয়ে ফিরছে হয়তো। কিন্তু পরমুহূর্তেই কিছু একটা ছুটে এসে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে জলে সাঁতার কেটেই একটু দূরে ডাঙায় গিয়ে উঠল। গাঁয়ের ছেলে। জন্ম থেকে নদীর ধারে বাস। বুঝলাম জেলেদের তাড়া খেয়ে প্রাণ বাঁচাতে কোন বুনো শুয়োর এদিকে ছুটে এসেছিল। মনে মনে আমি তখন দুগ্গামায়ের নাম জপছি। একবার এই বুনো শুয়োরের খপ্পরে পড়লে এ যাত্রা আর রক্ষে নেই। সামনের দাঁত দুটো দিয়ে পেট ফুটো করে একবারে ভবলীলা সাঙ্গ করে দেবে।

হঠাৎ ঝুপ করে পরপর দুটো আওয়াজে চমকে উঠে পিছনে তাকিয়েই দেখি কেষ্টদা, সঙ্গে মাথা মুখ কাপড়ে ঢাকা আর একটা মানুষ। বুঝলাম কেষ্টদা আন্নাকালীকে ওদের নজর এড়িয়ে নিয়ে আসতে পেরেছে। আন্নাকে ধরে নৌকায় তুলে দিয়ে নিজে নৌকায় উঠতে উঠতে বলল, “ওরা মনে হয় টের পেয়ে গেছে। নৌকা নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের চোখের আড়ালে চলে যেতে হবে।”

আসার সময় না হয় স্রোতের টানে এসেছি। এখন স্রোতের নামুতে দাঁড় টেনে এগোতে তো সময় লাগবে।”

“তবে স্রোতের টানেই চল। সবার আগে এদের নজর এড়িয়ে পালাতে হবে।”

অনেকগুলো পায়ের ছুটে আসার আওয়াজ ভেসে আসছে। আর ভাবনা চিন্তা করে নষ্ট করার মত সময় এখন নয়। স্রোতের টানেই নৌকা বাইতে থাকলাম। গাঁয়ের শেষ সীমানার কাছে নদীর খাত অনেক গভীর। ভেবেছিলাম ঠিক পেরিয়ে যাব। কিন্তু দেবতা বাদ সাধলেন। প্রবল স্রোতে একটা ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে নৌকা গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করল। দিশেহারা অবস্থা তখন আমাদের। দাঁড় বেয়ে কোনরকমে ঘূর্ণি থেকে বেরনোর চেষ্টা করছি। দূরে মনে হচ্ছে কেউ যেন নৌকা বেয়ে আমাদের ধরতেই আসছে। কেষ্টদা বলল, “জলে ঝাঁপিয়ে সাঁতার কেটে পাড়ে ওঠা ছাড়া গতি নেই।”

“এই স্রোতের মধ্যে সাঁতার?”

“ক্ষুধার্ত পশুর মুখ থেকে শিকার ছিনিয়ে আনলে সে যেমন হিংস্র হয়ে পড়ে, এখন ওদের অবস্থাও তেমন। একবার যদি ধরতে পারে তিনজনকেই নদীর গাবায় পুঁতে দিয়ে যাবে। নয়ত…”

শেষটুকু আর শোনা হয় না। তার আগেই আন্নাকালীর হাত ধরে নদীতে ঝাঁপ দেয় কেষ্টদা। হাত বাড়িয়ে আমাকেও টেনে নেয় জলে। তারপর পায়ের ধাক্কায় নৌকাটা উল্টে দিয়ে সাঁতার কাটতে থাকে পাড়ের দিকে। আন্না সাঁতার জানে। বাঁচার তাগিদে আপ্রাণ সাঁতরে পাড়ে ওঠার চেষ্টা করছে। পাড় বলতে শর বন। পায়ের নীচে পাঁক মাটি। পা তুলতে গেলে যেন বেশি করে গেঁথে যায়।

কোনোরকমে শরীর টেনে নিয়ে আশ্রয় নিলাম শরবনে। গাছের খোঁচায় সারা শরীর আহত। হঠাৎ পায়ের ওপর দিয়ে ঠাণ্ডা কী যেন একটা চলে গেল। ভয়ে চিৎকার করে ওঠার আগেই কেষ্টটা মুখটা চেপে ধরল।

“হেলে কেন গোখরোও হতে পারে। ওদের আঘাত না করলে ওরা কোন ক্ষতি করবে না। কিন্তু মানুষ আরও ভয়ঙ্কর। ওরা আমাদের ধরতে পারলে লাশ বানিয়ে ছাড়বে।”

আঁধারে ততক্ষণে চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেছে আমাদের । দেখতে পেলাম নদীতে একটা ছোট নৌকা করে কয়েকজন আমাদের খুঁজছে। উল্টো নৌকাটা দেখে ভাবল বোধহয় এই স্রোতে যাত্রীরা বুঝি ভেসেই গেছে। কাল সকালে লাশ পাওয়া যাবে আশপাশের গ্রামের কোনও ঘাটে।

তারা ফিরে গেলেও আমরা সারারাত ওখানেই লুকিয়ে থাকলাম। ভোর রাতে আমি বাড়ি ফিরে এলাম। কেষ্টদা আন্নাকে নিয়ে তখনই গাঁয়ে ফিরতে পারবে না। আন্নার একটা ব্যবস্থা করে তবে সে গাঁয়ে ফিরবে। গ্রামে ততক্ষণে রটে গেছে কেষ্টদা আন্নাকালীকে নিয়ে পালিয়েছে।

ভোরবেলা চোরের মত চুপি চুপি বাড়ি ফিরলেও সারা শরীরের আঁচড়গুলো দেখে বাবা বুঝি সত্যিটাই আন্দাজ করলেন।

“কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করে জলে বাস করা যাবে না। মুরুব্বিদের বিপরীতে গিয়ে এ ছেলে আমাদের গাঁয়ের বাস উঠিয়ে ছাড়বে।”

সেদিনই বাবা আমাকে শহরে এক দূর সম্পর্কের কাকার কাছে রেখে গেলেন। ইস্কুল বন্ধ হয়ে একটা চায়ের দোকানে কাজ পেলাম। তারপর এ কাজ, সে কাজ করতে করতে আজ পঁচিশ বছর হল এই বাড়িতে মালির কাজ করছি। কলির কৌতুহলী প্রশ্ন, “কেষ্টদা আর আন্নাকালীর কী হল জানতে পারোনি?”

“ওরা আর গাঁয়ে ফেরেনি। অনেক বছর পর গাঁয়ের সিধুখুড়োর সঙ্গে হাওড়া স্টেশনে কেষ্টদার দেখা হয়েছিল। সে নাকি আন্নাকালীকে বিয়ে করে সংসার পেতেছে। ওই বোবা মেয়েটার এর থেকে ভালো আর কী বা হতে পারত!

তা দিদিভাই এটা তোমার ওই অ্যাডভেঞ্চার রচনাতে চলবে নাকি?”

“চলবে গো চলবে। এটা গল্পটাই লিখব আমি।” কলির গলায় এবার যেন তৃপ্তির সুর…

অলঙ্করণ-স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

1 thought on “গল্প-সেই রাত-বনবীথি পাত্র-শীত ২০২১

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s