গল্প-হাচিসন সায়েবের ফটোগ্রাফ -মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য শরৎ ২০২২

মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের আরো গল্প  কালাচাঁদ  হাইলাকান্দির হুডিনি,  ভূত জোলাকিয়া   রংঝুরি রহস্যভয় আমাদের বিচিত্র অনুষ্ঠান, অশৈলী কান্ড জোড়াকদমে , রঙ্গোর রঙ্গ , মুষিক নিধন প্রকল্প

golpomriganka

শতদ্রু, চম্পক, টুবলু আর আমি ছোটবেলার বন্ধু। ইশকুলের পাট চুকিয়ে কলেজে ভর্তি হলেও চারমূর্তির সখ্য আজও অটুট। টুবলুরা বনেদি বড়লোক। কুমুদিনী নামে ওদের একটা চা বাগান আছে ডুয়ার্সে। টুবলুর মুখে শুনেছি, ওর ঠাকুরদা গোরাচাঁদ নিয়োগী, সারা শহর যাঁকে গোরা নিয়োগী নামে চেনে, তাঁর মায়ের নামে পত্তন করেছিলেন এই চা বাগানের। ভদ্রলোক এতদিন নিজেই বাগানের কাজকর্ম দেখতেন, হালে বয়সের কারণে ছেলের ওপর সেই গুরুদায়িত্ব সঁপেছেন। তবে ঘরবন্দি হয়ে বসে থাকার মানুষ তিনি নন। বয়স্ক শিক্ষা, রক্তদান কর্মসূচি, দরিদ্রদের শীতবস্ত্র বিতরণের মতো সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে তিনি আজও জড়িয়ে রেখেছেন নিজেকে। নিয়োগীবাড়িতে যাতায়াতের সূত্রে আমাদের বহু বছর ধরেই তিনি চেনেন। মজলিসি মানুষ, দাবা খেলতে ভালবাসেন, তাঁর গল্পের স্টক অফুরন্ত। গল্প করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়ে দিতে পারেন অক্লেশে।

টুবলুদের দোতলা বাড়ি। দরজায় দারোয়ান থাকে পাহারায়। বাড়ির সামনে ফুলের বাগান। একজন মালি আছে দেখভাল করার। একদিকে গ্যারাজ। দুটো গাড়ি থাকে সেখানে। একটা সাদা সেডান। তাতে চড়ে টুবলুরা। আর আছে পুরনো মডেলের একটা কালো অ্যামবাসাডর। সেটায় চলাফেরা করেন গোরাচাঁদ নিয়োগী। কানে খাটো বলে হিয়ারিং এড ব্যবহার করতে হয় তাঁকে। এই ব্যাপারটা ছাড়া বার্ধক্যের লক্ষণ নেই তাঁর। এখনও স্মৃতি প্রখর। গায়ের রং গোরা সায়েবদের মতো টকটকে। বয়স নব্বই হয়ে গেলেও চেহারা টসকায়নি এতটুকু।

বাড়ির দোতলায় থাকে টুবলুরা। নিচতলায় থাকেন ওর বিপত্নীক ঠাকুরদা। একটেরে বারান্দা। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি ওঁর ঘরের পাশ দিয়ে। যাতায়াতের সময় পর্দা টানা ঘরের ভেতর দেখতে পাই ওঁকে। হয় নাকের ডগায় চশমা সেঁটে বই পড়ছেন নয় একা একা দাবা খেলছেন। আমাদের দেখতে পেলে বলেন, দাবা হবে নাকি একহাত ? হাতে কাজ না থাকলে চম্পক আর শতদ্রু সিঁধিয়ে যায় ভেতরে। পেছন পেছন ঢুকে পড়ি আমি। জমে যায় দাবাযুদ্ধ। সুস্বাদু খাবার চলে আসে। মুখ চলে, সেই সঙ্গে চলে গল্পগুজব।

ভদ্রলোকের ঘরে আসবাব বলতে একটা পালঙ্ক, একটা জলচৌকি, একটা বইয়ের আলমারি। চারটে দেওয়ালই ন্যাড়া। কোনও ছবি নেই চার দেওয়ালে। বিছানার পাশে একটা বেঁটে টেবিল। তার ওপর রাখা একটা পেতলের বুদ্ধমূর্তি। তার পাশে এক শ্বেতাঙ্গ যুবকের ছবি। ফ্রেমে বাঁধানো পোস্টকার্ড সাইজের ফোটোটার ব্যাপারে যতবারই জানতে চেয়েছি প্রতিবারই গোরা নিয়োগী কপালে হাত ঠেকিয়ে বলেছেন, উনি হাচিসন সায়েব। জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি ভগবান বুদ্ধের কৃপায়। আর যদি কাউকে কৃতিত্ব দিতে হয় তা দেব এই সায়েবকেই। এর বেশি কিছু ভেঙে বলেন না। ফলে ছবির সায়েবকে নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা কৌতূহল রয়ে গেছে ছোটবেলা থেকেই। 

সেদিন বিকেলে আড্ডা দিতে গিয়েছি টুবলুদের বাড়ি। দারোয়ান আমাদের বহু বছর ধরে দেখছে। ফলে আটকায় না। একতলার বারান্দা দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিলাম আমরা। গোরা নিয়োগী হাঁক দিয়ে বললেন, কে ওখানে ?

আমরা দাঁড়িয়ে পড়ে সাড়া দিলাম। হাসিমুখে উঁকি দিলাম ওঁর ঘরে। উনি বললেন, টুবলু তো বাড়িতে নেই। ওর বাবা-মা জরুরি কাজে কলকাতা যাচ্ছেন। টুবলু তাঁদের এয়ারপোর্টে ড্রপ করতে গেছে। ফিরতে ফিরতে সন্ধে হবে। আমরা ফিরে আসছিলাম। তিনি বললেন, টুবলু নেই তো কী হয়েছে, চলে এসো ভেতরে, এক হাত দাবা হয়ে যাক।  দুটো দাবার বোর্ড পাশাপাশি সাজিয়ে বসে পড়লেন টুবলুর ঠাকুরদা। একটা বোর্ডে শতদ্রু, অন্যটায় চম্পক। দুজনেরই প্রতিপক্ষ তিনি। দুজনেই চেকমেট হয়ে গেল ঝটপট। ইতিমধ্যে বৃদ্ধের নির্দেশে চিংড়ির চপ চলে এসেছে আমাদের জন্য। গল্প হচ্ছিল এটা সেটা। চপে একটা কামড় দিয়ে আমি বললাম, বহুদিন ধরেই একটা কথা জিজ্ঞেস করব ভাবি, ওই যে হাচিসন সায়েব, ওঁর পুরো নাম কী ? গোরা নিয়োগী আমাকে এক পলক দেখে বললেন, মিলার রিসেস হাচিনসন। কেন বলো তো ? আমি বললাম, উনি কি কোনও ধর্মগুরু ? গোরা নিয়োগী বললেন, ধর্মগুরু কেন হতে যাবেন ? উনি তো একজন ইঞ্জিনিয়ার।

এই এতদিনে সায়েবের পুরো নাম জানা গেল। কলেজে ওঠার পর একটা মোবাইল কিনে দিয়েছে বাড়ি থেকে। পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করে সায়েবের পুরো নামটা বললাম গুগলবাবাজির কাছে। মোবাইলের স্ক্রিনে চলে এল সায়েবের একাধিক ছবি। সঙ্গে অজানা বহু তথ্য। দেখি হিয়ারিং এড আবিস্কারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ারের নাম। সেটাই বললাম ওঁকে। গোরা নিয়োগী বললেন, হাচিসন সায়েব হিয়ারিং এড যন্ত্রের আবিষ্কারক। ১৯২০ সালে বাজারে আসে তাঁর আবিস্কৃত যন্ত্র। টেকনোলজি যত উন্নত হতে থাকে তত আপডেটেড ভার্সন বেরোতে থাকে। ভারতে অবশ্য এসেছে বহু বছর পর। কিন্তু হাচিসন সায়েবই তো পায়োনিয়ার। সে কারণেই ওঁর ছবি কলকাতা থেকে আনিয়ে বাঁধিয়ে রেখেছি ঘরে।

আমি বললাম, বুঝলাম। কিন্তু খটকাটা অন্যখানে। ঠাকুর-দেবতা বা নিজের পূর্বপুরুষের ছবি নয়, এই মার্কিন সায়েবের ছবি বেডসাইড টেবিল ভক্তিশ্রদ্ধা করে সাজিয়ে রেখেছেন বহু বছর ধরে। কিন্তু কেন ? তাঁর আবিষ্কার করা যন্ত্র সুফল দিয়েছে শুধু এই কারণে ? উঁহু সেই যুক্তি মানলে প্রতিদিনের জীবনে কত যন্ত্র ব্যবহার করি তার প্রত্যেক আবিষ্কারকের ছবিই তো ঠাকুরঘরের কুলুঙ্গিতে সাজিয়ে রাখতে হয়। তা তো করেননি। নির্ঘাত কোনও রহস্য আছে এর মধ্যে। শতদ্রু আর চম্পকও নড়েচড়ে বসে বলল, রহস্য তো কিছু আছেই। সেটা না শুনে আজ নড়ছি না আমরা।

গোরা নিয়োগী বললেন, প্রত্যেক বিজ্ঞানীই আমার কাছে নমস্য, কিন্তু হাচিসন সায়েব আমার যা উপকার করেছিলেন তার সঙ্গে আর কিছুরই তুলনা হয় না। ব্যাপারটা কাউকেই বলিনি আজ অবধি। ডায়েরি লেখার অভ্যেসও নেই যে সব লিখে যাব। এদিকে বয়স তো কম হল না, আজ আছি কাল নেই। তোমরা যখন এত করে শুনতে চাইছ … ঠিক আছে বলছি পুরোটা …। আমার বাবা ছিলেন হেডমাস্টার। ধীরস্থির স্বভাবের শান্তশিষ্ট মানুষ। বাবা যে ইশকুলে পড়াতেন আমি তার ছাত্র। পড়াশোনায় আমার মাথা ছিল না। দশ ক্লাস অবধি উঠেছিলাম কায়ক্লেশে। আমার ম্যাট্রিক পাশ করার কথা ছিল না। করলামও না। বাবা আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। পরের বছর আবার পরীক্ষা দিলাম। আবার ফেল। বাবা বললেন, তোর দ্বারা হবে না। আমি নতুন উদ্যমে বসলাম পরীক্ষায়। আবারও ফেল। এবার বাবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। যে মানুষটা এর আগে কখনও আমার গায়ে হাত তোলেননি, তিনি আমার দুই গালে দুটো দানবিক চড় মারলেন।

গোরা নিয়োগী আপনমনে খানিক হেসে নিয়ে বললেন, তাঁর বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় খেয়ে পড়ে গেলাম চিৎপাত হয়ে। তখনও রাগ যায়নি, একটা বেতের কঞ্চি দিয়ে আমাকে পেটাচ্ছিলেন বাবা। সেদিন মা না থাকলে আমাকে মেরেই ফেলতেন। বাবা গজগজ করতে করতে চলে যাবার পর দেখি কানে ভাল শুনতে পাচ্ছি না। রাতে খেলাম না। মনে মনে বললাম নিকুচি করেছে লেখাপড়ার। গৃহীর জীবন আমার জন্য নয়। এর থেকে সন্ন্যাস নেওয়া ভাল। সারা রাত জেগে কাটালাম। ভোররাতে চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাস ধরে চলে গেলাম শিলিগুড়ি। চেপে বসলাম গ্যাংটকের বাসে। এদিকে পকেটে পাঁচ টাকা। সহযাত্রীদের মধ্যে এক লামা ছিলেন, তিনি আমাকে জরিপ করে যাচ্ছিলেন। রংপোতে বাস দাঁড়াল। খিদেয় পেট জ্বলছে। খরচের ভয়ে পেটে কিল মেরে বসে আছি। সেই লামা আমার পাশে এসে শান্ত গলায় বললেন, বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছ ? দেখলাম লুকিয়ে লাভ নেই। বললাম, আমি সন্ন্যাসী হতে চাই। লামা বললেন, অত সহজ নয়, অনেক ত্যাগ স্বীকার করার পর পাওয়া যায় অন্বিষ্টকে। অনেকেই আসে সন্ন্যাসী হতে। কিন্তু তাদের আকুলতা কতটা গভীর সেটা বুঝে নেবার জন্য কিছু পরীক্ষা নিতে হয়। তুমি পরীক্ষা দেবে ? আমি বললাম, নিশ্চয়ই দেব।

চম্পক বলল, কী পরীক্ষা দিতে হল আপনাকে ?

টুবলুর ঠাকুরদা বললেন, সেই লামার নাম থেনডুপ। গ্যাংটক পৌঁছবার পর তিনি নিয়ে গেলেন একটা মঠে। দশজন সমবয়সি তরুণের সঙ্গে আলাপ হল। সকলেই বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো ছেলে। সকলেই সন্ন্যাসী হতে চায়। মঠের ভেতর আমাদের থাকতে দেওয়া হল। মেঝেতে ঢালাও শোয়ার ব্যবস্থা। এল গরম কম্বল আর চাদর। ভরপেট খাবার জুটে গেল। পরদিন বাসে চেপে পৌঁছলাম চুংথাং। সেখানে ক্যাম্প করে থেকে পরের রাত কাটালাম লাচেনে। চতুর্থ দিন লাচেন থেকে পৌঁছলাম গুরুদুম্মার লেক। চোলামু পাহাড়ের মাথায় একটা বুদ্ধমন্দির আছে। সেখানে পায়ে হেঁটে উঠতে হবে আমাদের। আঠারো হাজার ফুট উঁচু জায়গা। তুমুল ঠাণ্ডা। অক্সিজেনের অভাব হচ্ছিল। মাথার মধ্যে ঝিম ধরা ভাব। বিদেশিরা বেশি উচ্চতায় গ্যামোব্যাগ বা অক্সিজেন টেন্ট ব্যবহার করে। কিন্তু তখনও সে জিনিস এদিকে আসেনি। থেনডুপ লামা পপকর্ন এনে দিয়ে বললেন চিবোতে। তাহলে নাকি শরীরে বা মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরাবরাহের মাত্রা বাড়বে। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে কি না জানি না, কিন্তু পপকর্ন চিবিয়ে যে আশাতীত ফল পেয়েছিলাম তা স্বীকার করতেই হবে।

শতদ্রু বিস্মিত হয়ে বলল, সে তো অনেক উঁচু পাহাড় ! পায়ে হেঁটে উঠলেন আপনারা ?

গোরা নিয়োগী সায় দিয়ে বললেন, গুরুদুম্মার লেক থেকে খানিক দূরে একটা মঠ ছিল। সেখানে নিয়ে যাওয়া হল আমাদের। কয়েকজন লামা ছিলেন। একটা সাদা ঘোড়া বাঁধা ছিল মঠের উঠোনে। পুঁটলিতে চিঁড়ে, ছাতু, গুড় দেওয়া হল আমাদের। সঙ্গে খাওয়ার জলের বোতল। শুরু হল পথ চলা। ঘোড়ার পিঠে থেনডুপ লামা, পেছন পেছন পায়ে হেঁটে আমরা। গন্তব্য চোলামু পাহাড়ের মাথার বুদ্ধমন্দির। উঠছি তো উঠছিই। পথ আর ফুরোয় না। আকাশ মেঘলা। কুয়াশায় ঝাপসা দেখাচ্ছে সব। হাওয়া দিচ্ছে উলটোপালটা। শীতে জমে যাচ্ছি। প্রচণ্ড হাওয়ায় কান ভোঁ ভোঁ করছে। পথশ্রমে কাবু হয়ে পড়েছি, শরীর চলছে না। ভাবছি কেন মরতে এলাম এখানে !

চম্পক বলল, খিদে পেল না অতটা হেঁটে ?

-পেলই তো। চিঁড়ে আর গুড় খেলাম জল দিয়ে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। আমরা হেঁটেই চলছি। হাঁফ ধরে গেছে। পা চলছে না। একসময় এল চোলামু লেক। এমনিতে বরফ, কিন্তু দিনের মধ্যে ঘণ্টাখানেক রোদের তাপে গলে গিয়ে জল হয়। এই জলই লাচেন হয়ে পৌঁছেছে তিস্তায়। এই জলের ধারাকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে সভ্যতা, জলসেচ প্রকল্প। তখন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার মতো মনের অবস্থা নেই। ঠাণ্ডা বাড়ছে। হাওয়া দিচ্ছে তেড়েফুঁড়ে। এক জায়গায় দেখি পথের ধারে বিশাল একটা শ্লেটরঙা পাথর ঝুলে আছে পাহাড়ের গায়ে। থেনডুপ লামা বললেন, বুদ্ধমন্দির আরও বেশ খানিকটা উঁচুতে। তবে এত কাছে এসে আমার আর তর সইছে না। আমি সন্ধের আগেই পৌঁছব সেখানে। যারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছ ওভারহ্যাংয়ের নিচে রাতটুকু বিশ্রাম নিতে পার। এখানে বুনো জন্তুর ভয় নেই। কাল সূর্য উঠলে চলে আসবে এই খাড়া পথ ধরে। আমি বুদ্ধমন্দিরে তোমাদের অপেক্ষা করব। আর যারা আমার সঙ্গী হতে চাও তারা এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।

আমি বললাম, আপনি কী করলেন ?

বৃদ্ধ বললেন, সবাই হা-ক্লান্ত। সকলে এগোল প্রাকৃতিক ছাউনির দিকে। একা দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি। আমার দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকলেন থেনডুপ লামা। একসময় জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। রুদ্ধ গলায় বললেন, গোরাচাঁদ, তুমি আমাকে অবাক করেছ। এসো, তুমি উঠে এসো ঘোড়ার পিঠে। সন্ন্যাসীদের মেজাজ মর্জি বোঝা মুশকিল। যাই হোক আমাকে আর হাঁটতে হল না। ঘোড়ার পিঠে চেপে দুজন সন্ধের দিকে পৌঁছলাম বুদ্ধমন্দিরে। যেতে যেতে আমার ঠিকুজিকোষ্ঠী সবই তিনি জেনে নিলেন পথে। মন্দিরে কয়েকজন সন্ন্যাসী এসে স্বাগত জানালেন আমাদের। বুদ্ধদেবের আবক্ষ এক মূর্তি আছে ভেতরে। আমরা প্রণাম করলাম ভগবান বুদ্ধকে। থেনডুপ লামা চলে গেলেন। ফিরে এলেন পেতলের এক বুদ্ধমূর্তি হাতে।

আমি বললাম, ওই যে বুদ্ধমূর্তিটা আপনার বেডসাইড টেবিলে শোভা পাচ্ছে সেটার কথা বলছেন ?

গোরা নিয়োগী সায় দিয়ে বললেন, ওটাই সেটা। ওই মূর্তিটা আমার হাতে দিয়ে থেনডুপ লামা বললেন, গোরাচাঁদ, তুমি বাড়ি ফিরে যাও। আমি তথাগতর পায়ে ছোঁয়ানো ফুল তোমার হাতে দিচ্ছি। মন দিয়ে লেখাপড়া করো। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াও। মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করো। উপভোগ কর কর্মজীবন। জাগতিক ভোগের নিবৃত্তি ঘটবে একদিন। তখনও যদি সন্ন্যাসী হতে ইচ্ছে করে তবে চলে এসো এই গুম্ফায়। সেই ঘোড়ার পিঠে চেপে থেনডুপ লামা আর আমি নেমে এলাম লাচেনে। সেখান থেকে বাসে চেপে শিলিগুড়ি হয়ে ফিরে এলাম বাড়িতে। মা শয্যা নিয়েছিলেন। বাবা ধরে নিয়েছিলেন ছেলে আর নেই। আমাকে দেখে তাঁদের ধড়ে প্রাণ এল। টের পেলাম একটা বদল ঘটছে আমার ভেতর। চোলামু যাবার আগের আমি আর চোলামু থেকে ফিরে আসার পরের আমি – দুজন যেন আলাদা দুই মানুষ। বুদ্ধের করুণাতেই কি না কে জানে, ম্যাট্রিক পাশ করে গেলাম। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে কলেজের বাধাও ডিঙিয়ে গেলাম এক চান্সে। এদিকে বাবা আচমকা মারা গেলেন। বাড়িতে বিধবা মা আর আমি। ভাবলাম চাকরির চেষ্টায় সময় নষ্ট করলে চলবে না। ব্যবসা করতে হবে আমাকে। কিন্তু ক্যাপিটাল কোথায় পাব ?

আমি বললাম, তার পর কী হল ?

গোরা নিয়োগী বললেন, অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা শুরু করলাম। টাইপরাইটার, সাইক্লোস্টাইল মেশিন থেকে কাগজ, খাম, আঠা, আলপিন হোলসেল রেটে কিনে রিটেল রেটে সরকারি অফিসগুলিতে সাপ্লাই করতাম। সততাই ছিল আমার মূলধন। তখন ব্রিটিশরা দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে। আজকের মতো দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির ঘুণ ধরেনি। সরকারি আধিকারিকরা আমাকে পছন্দ করতেন। তাঁদের সহযোগিতায় আমি গভর্নমেন্ট কন্ট্রাক্টর হলাম। তাঁরা রাস্তা, ব্রিজ, বাঁধ তৈরির বিজ্ঞাপন দিতেন খবরের কাগজে। সেই টেন্ডারগুলো ধরে কাজ করতে লাগলাম। টাকাপয়সা জমল কিছু। একদিন সাহস করে একটা চা বাগান পাঁচ বছরের কড়ারে লিজ নিলাম। মায়ের নামে নাম রাখলাম – কুমুদিনী চা বাগান। বিয়ে হল। কর্মক্ষেত্রে আরও উন্নতি হল। কুমুদিনী বাগানের চা এক্সপোর্ট হতে লাগল বিদেশে। ছেলে জন্মাল। সংসারে এমন জড়িয়ে মড়িয়ে গেলাম যে, আমার আর সন্ন্যাসী হওয়া হল না। এই হল আমার ইতিহাস, বুঝলে দাদুভাইরা।

আমি বললাম, লামার দেওয়া সেই বুদ্ধমূর্তি ভক্তিভরে কেন সাজিয়ে রেখেছেন সেটা বোঝা গেল। কিন্তু এর মধ্যে হাচিসন সায়েব এলেন কোত্থেকে ?

গোরা নিয়োগী স্মিতমুখে বললেন, সেদিন থেনডুপ লামা যখন আমাদের ওভারহ্যাংয়ের নিচে বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলছিলেন তখন ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছিল। একে অত উঁচু পাহাড়ে মারাত্মক হাওয়ার প্রকোপ, তার মধ্যে বাবার থাপ্পড়ের কারণে কানে কম শুনি, ফলে বাকিরা লামার কথা শুনতে পেলেও আমার কানে কিছুই যায়নি। সে কারণেই তো আমি স্থির  দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাগ্যিস হিয়ারিং এড তখনও এদেশে এসে পৌঁছয়নি। হাচিসন সায়েব যদি কয়েক বছর আগে সেই যন্ত্র আবিষ্কার করতেন, তাহলে ভারতের বাজারে সেটা চলে আসত আরও আগে। আর সেদিন যদি আমার কানে হিয়ারিং এড থাকত তবে কী হত ভেবে দেখেছ? আমিও বাকিদের মতো ওভারহ্যাংয়ের দিকে পা বাড়াতাম বিশ্রাম নিতে। এবার তোমরাই বলো, এই যে জীবনে আজ দুটো পয়সার মুখ দেখেছি তার জন্য হাচিসন সায়েবকেই কৃতিত্ব দিতে হয় কি না ?

এবার বোঝা গেল পুরো বৃত্তান্ত। আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম, ঠিক। একদম ঠিক।

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস

1 thought on “গল্প-হাচিসন সায়েবের ফটোগ্রাফ -মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য শরৎ ২০২২

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s