এই লেখকের আগের গল্প – জগৎশেঠের হিরে, ৭২ ঘণ্টা, সময় সরণীতে নবকুমার, গোরোংগোরোর জাগরণ
[প্রথম সূত্র: রোবট কোনোভাবেই তার কোনও কাজের মাধ্যমে অথবা কোনও কাজ করতে না চাওয়ার মাধ্যমে, মানুষের ক্ষতিসাধন করবে না। — আইজাক অ্যাসিমভ, ১৯৪২]
[১]
সীতা উদ্ধার
“স্যার, সুকুমারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
খবরটা শুনে একটু চমকালেন অরুময় তরফদার।
“সুকুমারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না স্যার।” ঈষৎ চিন্তাক্লিষ্ট স্বরে অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার রণজয় চক্রবর্তী আবার তার কথাগুলোকে উচ্চারণ করে।
অরুময় আচ্ছন্ন ভাবটাকে কাটিয়ে, তাঁর সাধের চেয়ারটায় ভালো করে সোজা হয়ে উঠে বসতে চেষ্টা করেন। আলো-আঁধারি হয়ে রয়েছে ঘরটা এখনও। সকালের আলো ফুটে গেলেও আশেপাশের বড়ো বড়ো গাছের জঙ্গল ভেদ করে ছোট্ট স্টেশনটার ততোধিক ছোটো স্টেশন মাস্টারের কেবিনটায় এখনও ভালো করে আলো এসে পৌঁছতে পারেনি। মেল ট্রেন আসতে এখনও ঘণ্টা তিন-চার দেরি আছে। কিন্তু এই সময়ে সুকুমারের হারিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে আশ্চর্যজনক।
“স্ট্রেঞ্জ! ওকে আমরা কখন ডেপ্লয় করেছিলাম?” অরুময় জিজ্ঞেস করেন।
“স্যার, কাল রাত্তিরে আন্দাজ আড়াইটে নাগাদ আমরা জানতে পারি যে তেত্রিশ আর চৌত্রিশ নম্বর পোস্টের মাঝখানে বেশ খানিকটা জমি বসে গেছে। এখান থেকে ধরুন চার-পাঁচ কিলোমিটার। এবারে জমি বসে যাওয়ার কারণে স্বভাবতই রেল-লাইনটাও শূন্যে ঝুলছে—এরকম একটা অবস্থায় রয়েছে। কাজেই সুকুমারকে পাঠানো হয় উইথ দ্য ইনস্ট্রাকশনস যে, সে যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জমিটাকে সার্ভে করে ভরাট করে দেয় আর সঙ্গে সঙ্গে যদি রেল-লাইনেরও কোনও মেজর বা মাইনর ক্ষতি হয়ে থাকে সেটাকে সারিয়ে ফেলে। এটাও বলা হয়েছিল যে আজ সকাল সাড়ে এগারোটায় মেল ট্রেন পাস করবে ওই লাইনে, কাজেই ও যেন এই কাজটাকে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলে। স্পটে পৌঁছে ও যথারীতি কাজ শুরু করবার আগে ওয়াকিটকিতে একটা কনফার্মেশন জানিয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকেই ওর সঙ্গে আর কোনোরকমভাবে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।” রণজয় এক নিশ্বাসে কথাগুলো টানা বলে গেল।
অরুময় ব্যাপারটাকে ওঁর মাথার মধ্যে পরপর সাজিয়ে নিতে থাকেন।
জায়গাটা উত্তরবঙ্গের কোথাও। ডুয়ার্স অঞ্চলের ঘন জঙ্গলের ভিতরে ছোট্ট একখানি রেল-স্টেশন। এলিফ্যান্ট করিডর বলে জায়গাটার পরিচিতি আছে। কাজেই রেল চলাচলের সময়ে অত্যন্ত সাবধানী হয়ে কাজ করতে হয়। যদিও অরুময় তরফদারের সেকশনটুকুতে এখনও হাতির উপদ্রবের কথা শোনা যায়নি। এই সেকশনের প্রায় সম্পূর্ণটাই ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে গেছে। সুকুমার যথেষ্ট বিশ্বস্ত এবং পুরোনো কর্মচারী। রণজয় এখানে আসার অনেক আগে থেকেই সুকুমার এই স্টেশনে রয়েছে। এছাড়া অবশ্য সুকুমারের সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু জানে না রণজয়। কেবল সুকুমারের সম্পর্কে যে অরুময় তরফদারের একটা বিশেষ সফট কর্নার আছে, সেটা সে লক্ষ করেছে।
“আমরা কি সি.সি ক্যামেরাতে আর-একবার স্পটটাকে চেক করব স্যার?” রণজয় জিজ্ঞেস করে।
অরুময় ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন।
ঠিক ওই জায়গাটায় কোনও সিসি ক্যামেরা নেই। একটু দূর থেকেই অস্পষ্ট ছবি ফুটে উঠেছে। তাহলেও গর্তটাকে বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার। মাপ দেখে গর্তটাকে যথেষ্টই বড়ো বলে মনে হচ্ছে। আশেপাশে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। অরুময় বাধ্য হয়ে ট্রলিটাকে বের করতে বলেন। সরেজমিনে গিয়ে ব্যাপারটাকে দেখতে হচ্ছে। রণজয় ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়।
“সুজয় বা সুরেশকে বললে হত না?” ট্রলিটা চালাতে চালাতে রণজয় জিজ্ঞেস করে।
“উঁহু, অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। তাছাড়া ওদেরও আলাদা কাজ রয়েছে। আমরা দুজনই যথেষ্ট।” অরুময় জবাব দেন।
সুজয় আর সুরেশ অপেক্ষকৃত নতুন স্টাফ দুজন। দেখতে শুনতে, কাজেকর্মে করিতকর্মা খুব। রণজয় তাই ওদের কথা বলছিল। অরুময় পাত্তা দিলেন না।
ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রেল-লাইন। ট্রলিটা এগিয়ে চলেছে। বাইরের আলোও এখানে যথেষ্ট কম। দু-পাশে বিশাল বিশাল গাছেদের জঙ্গল। কত নাম না জানা গাছ, ফুল, অর্কিড। এজন্যই এখানে পোস্টিং পেতে মনে মনে লাফিয়ে উঠেছিল রণজয়। এত গাছ আর এত প্রকৃতির মাঝখানে চাকরি করাটাই আনন্দের। অরুময়ই-বা এখানে কতদিন কাটিয়ে দিয়েছেন কে জানে। মানুষটাকে বড়ো অদ্ভুত বলে মনে হয় এক-একদিন। রণজয় লাইনের দিকে লক্ষ রাখতে রাখতে চলে। পথ আর বড়ো বেশি বাকি নেই বোধহয়।
হাতির প্রচণ্ড বৃংহণে সমস্ত জঙ্গলটাই যেন থরথর করে কেঁপে উঠল। রণজয় ভয় পেয়ে ট্রলির গতি কমাতে শুরু করল। তেত্রিশ নম্বর পোস্টটা পেরোতেই একটা বড়ো বাঁক রয়েছে আর সেই বাঁকটা মোড় নিতেই দুজনের চক্ষুস্থির হয়ে গেল। গর্তটাকে দেখাই যাচ্ছে না কোথাও। বরং জায়গাটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অন্তত পঁচিশটা হাতির একটা দল। রণজয় সজোরে ব্রেক কষে কোনোরকমে ট্রলিটাকে দাঁড় করাল। অরুময়ও স্থির হয়ে গেছেন। এমন এক-একটা হাতির পালের বিশ-পঁচিশ গজের মধ্যে এলেও মারাত্মক বিপদ। অথচ ওঁরা যেখানটায় রয়েছেন, হাতিদের দূরত্ব সেখান থেকে মেরেকেটে তিরিশ গজের চেয়ে বেশি হবে না কোনোভাবেই। হাওয়াটা নেহাত উলটোদিক থেকে বইছে তাই, না-হলে ওঁদের উপস্থিতিটা এতক্ষণে ফাঁস হয়ে যেত। ট্রলিটাকে কি আস্তে আস্তে পিছিয়ে নেবেন—সাতপাঁচ ভাবছিলেন অরুময়। ঠিক সেই সময়ই হাতিদের ভিড় ঠেলে সুকুমারের আবির্ভাব। রণজয় কোনোরকমে অজ্ঞান হয়ে যেতে-যেতেও নিজেকে সামলে নেয়।
“স্যার, আপনারা ওইখানেই থাকুন, আর বেশি কাছে আসতে যাবেন না।” সুকুমার চিৎকার করে বলে ওঠে।
“আর তুমি? তুমিই-বা ওই হাতিদের মধ্যিখানে কী করছ?” অরুময় এদিক থেকে পালটা চিৎকার করেন।
“স্যার, এখানে এসে দেখি গর্তটার মধ্যে একটা হাতির ছানা পড়ে রয়েছে। খুব বেশি হলে এক সপ্তাহ কি দেড় সপ্তাহ বয়স হবে। এসেই টের পেয়েছিলাম যে ওর মাও এখানেই কোথাও কাছেপিঠেই রয়েছে। হয়তো-বা ওর দলকে জঙ্গল থেকে ডেকে আনতে গেছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেও কেউ যখন এল না, আমিই খানিকটা জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে এই দলটাকে খুঁজে বের করলাম। মা-টাও ওদের সঙ্গেই ছিল স্যার। ওরা এইদিকেই আসছিল। প্রথমটায় বুঝতে না পেরে ওরা অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিল।” সুকুমার জবাব দেয়।
“তারপর তুমি এই গোটা হাতির পালটাকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে এলে? বাচ্চাটার কী উপায় হল?” অরুময় অবাক হয়ে গেছেন।
“ভয় নেই স্যার। আমি দড়ি-টড়ির সব ব্যবস্থা করেই গিয়েছিলাম দলটাকে খুঁজতে, আর পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই সীতা উদ্ধার হয়ে যাবে।” সুকুমার একগাল হেসে চিৎকার করে।
অরুময় ধপ করে ট্রলির উপরটায় বসে পড়েন।
[২]
সন্দীপ সোমের মৃত্যু
সীতা উদ্ধারের ঘটনার পর আরও মাস তিনেক মতো কেটে গেছে। একদিন হঠাৎ জলপাইগুড়ি থেকে ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার সন্দীপ সোম এসে হাজির।
“কী খবর অরুময়বাবু, কেমন আছেন? কাজকর্ম সব কেমন চলছে এদিকে?” গমগমে গলায় জিপ থেকে নেমেই অরুময়কে জিজ্ঞেস করেন সন্দীপ। সবেমাত্র বছর দুই হল এই ডিভিশনে বদলি হয়ে এসেছেন। তিনি নাকি সবসময়ই এরকম গমগমে গলায় কথা বলেন আর সেই সঙ্গে ভীষণই নাকি মাই ডিয়ার মানুষ। যদিও শহরে তেমন একটা যাওয়া হয় না বলে সন্দীপের সঙ্গে অতটাও দেখাসাক্ষাৎ হয় না অরুময়ের। কিন্তু মানুষটার ওই জমকালো, বাজখাঁই গলাতেই তো সব কেমন যেন চারপাশটা তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকে। অন্তত অরুময়ের তো সেটাই মনে হয়। উলটোদিকে তিনি নিপাট নির্ভেজাল শান্ত প্রকৃতির মানুষ। এত হট্টগোলের মাঝে পড়লে খেই হারান।
“আছি, আছি একরকম।” অরুময় জবাব দেন।
একপাশে দাঁড়িয়ে সুকুমার মালগাড়ি থেকে আনলোড হওয়া মালের হিসেব লিখছিল। অরুময় তাকে বলেন চায়ের ব্যবস্থা করতে।
“বেশিক্ষণ বসব না অরুময়বাবু। এমনি এদিকটায় এসেছিলাম একবার। ভাবলাম খবর নিয়ে যাই।”
অরুময় মৃদু হেসে বলেন, “তা বলে কি আর চা না খাইয়ে আপনাকে ছেড়ে দিতে পারি!”
চায়ের আড্ডাতেই প্রসঙ্গটা তোলেন সন্দীপ।— “আচ্ছা অরুময়বাবু, গত কয়েকদিনে আপনারা কি এদিকে কোনও উন্ডেড বা জখমি হাতির ডাক-টাক শুনেছেন? কোনোরকমের কোনও ডিসটার্বেন্স?”
“কই না তো, কেন বলুন তো?” অরুময় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন।
“আসলে আমার লোকেরা বলছিল, গত বেশ কিছুদিন ধরেই এই ডিভিশনে পোচারদের আনাগোনা খুব বেড়ে গেছে। এমনকি গত পরশু নাকি ওরা গুলি চালিয়ে একটা বড়ো মদ্দা হাতিকেও জখম করেছে। যদিও শেষ খবর পাওয়া অবধি ওরা হাতিটাকে এখনও নাগালে পায়নি। কিন্তু উন্ড নাকি বেশ ভালোই। প্লাস, এই হাতিটার দুটো গজদাঁতই নাকি একেবারে এ-ক্লাস মেটিরিয়াল। ওরা সহজে হাতিটাকে ছাড়বে না। এদিকে আমরাও খুঁজে বেড়াচ্ছি। যদি কোনোভাবে হাতিটাকে বা অ্যাট লিস্ট ওর দাঁতগুলোকে শয়তানদের হাত থেকে বাঁচাতে পারি। তাই আপনাকে একটু সতর্ক করে দিলাম।” সন্দীপ সোম চায়ে শেষ চুমুক দেন।—“যদি কখনও অস্বাভাবিক কোনও কিছু চোখে পড়ে তো সঙ্গে সঙ্গে যেন আমাকে একটিবার জানিয়ে দেন, এটুকুই বলার। আমার মোবাইল নম্বর তো আছে নিশ্চয়ই আপনার কাছে?” সন্দীপ সোম অরুময়ের দিকে তাকান।
“আপনার অফিসের ল্যান্ড-লাইনটা আছে, কিন্তু মোবাইল তো…”
সন্দীপ সোম অরুময়কে তাঁর কথার মাঝখানেই থামিয়ে দেন।— “লিখে নিন, ৯০৩৩…”
অরুময় নম্বরটাকে নিজের মোবাইলে সেভ করে নেন।—“একটা মিসড কল দিয়ে দিচ্ছি তাহলে।” তিনি বলেন।
“মাই প্লেজার। এবারে উঠতে হবে আমায়।” সন্দীপ সোম বড়ো করে হেসে উঠে দাঁড়ান।
সুকুমার চায়ের প্লেটগুলোকে তুলে নিয়ে যেতে এসেছে। আপনমনে সুকুমারের বেরিয়ে যাওয়াটাকে কিছুক্ষণ লক্ষ করেন সন্দীপ।—“এরাই কিন্তু অনেক সময় পোচারদের ইনফর্মার হিসেবে কাজ করে, জানেন তো?”
গলা অনেকটা নামিয়ে নিলেও সেই গমগমে ভাবটা কিন্তু সন্দীপের গলাতে থেকেই যায়। অরুময় সেটাকে অনুভব করেন।
“সুকুমারের বিষয়ে কিন্তু আমি নিজেকেও জামিন রাখতে রাজি আছি সন্দীপবাবু।” অরুময় গলা না নামিয়েই বলেন।
“না না, আমি পার্টিকুলার করে কিছু বলছি না।” সন্দীপের মুখে আবার হাসি ফিরে এসেছে।—“স্রেফ সাধারণ মন্তব্য।”
অরুময়ও হাসিমুখে তাকান।
এই জঙ্গলে একবার রাত হয়ে গেলেই একেবারে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। বহুকাল ধরে থেকে থেকে এই অন্ধকার চোখ-সওয়া হয়ে গেছে অরুময়ের। এই অন্ধকারকেই তাঁর ভালো লাগে। শীতের আমেজ শুরু হয়ে গেছে। রণজয়কে আজ অফ দিয়েছেন তিনি। সে হয়তো তার কোয়ার্টারের বারান্দায় বসে বসে সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখছে। তারা দেখতে সে ভালোবাসে, গ্রহান্তরের গল্প শুনতেও। অরুময় প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিটায় এসে বসেন। একটু দূরে প্ল্যাটফর্ম যেখানে শেষ হয়েছে তার কাছেই একটা ছোট্ট তাঁবুমতো করা আছে। সেখানেই আপাতত সুরেশ আর সুজয় থাকছে। আরও খানিক দূরে একটা মাটির কুঁড়েঘর মতো। সেটাই সুকুমারের বাসস্থান।
রাত প্রায় এগারোটা, অরুময় ঘড়ি দেখলেন। সুকুমারের ঘরের আলোটা নিভে গেল হঠাৎ। কে যেন দরজা ঠেলে বেরোচ্ছে। তিনি অবাক হলেন। এত রাত্তিরে কোথায় যাচ্ছে সুকুমার? চুপিসারে তার পিছু নিলেন অরুময় তরফদার। সময় কাটতে লাগল।
জঙ্গলের মধ্যে অনেকটা চলে এসেছেন ওঁরা দুজন। রাত বাড়ছে। সুকুমারকে এখনও নিজের উপস্থিতিটা টের পেতে দেননি অরুময়। তাঁর মনে কেবল প্রশ্ন, কোথায় যাচ্ছে সে? হঠাৎ অন্ধকার রাতের নিঃস্তব্ধতাকে ভেদ করে একটা তুমুল গর্জন। চারপাশটাকে যেন ছিন্নভিন্ন করে দিল। যন্ত্রণাকাতর একটা আর্তনাদ। এ-ডাক এসেছে কোনও জখমি হাতির গলা থেকেই। এ-ডাক বুঝিয়ে দেয় যে, আর বেশিক্ষণ বাকি নেই। যা হবার তা আর কিছুক্ষণেই হতে চলেছে। আবারও একটা রক্তজল করা আর্তনাদ। সুকুমারের থেকে খানিকটা দূরত্ব রেখে চলেছেন অরুময়। জঙ্গল যেন খানিকটা পাতলা হতে শুরু করেছে। আজ পূর্ণিমা। টর্চের তেমনটা প্রয়োজন হচ্ছে না। নয়তো সুকুমারের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার একটা বড়ো সম্ভাবনা থাকত। এই জায়গাটায় জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ একটা ফাঁকা অঞ্চল চোখে পড়ে অরুময়ের। সুকুমারও ওই দিকটাতেই এগুচ্ছে। একটা আবছা আলোর মতো কী যেন একটা তাঁর চোখে পড়ল। সে এক বীভৎস দৃশ্য। তাঁর পক্ষে আর তাকিয়ে থাকাটা সম্ভব হচ্ছে না।
এই ফাঁকা জায়গাটায় একটা ধুনি জ্বলছে। বিশাল পাহাড়ের মতোই লুটিয়ে পড়ে আছে হাতিটা। তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। দুজন স্থানীয় লোক ঘসঘস শব্দে করাত চালিয়ে হাতিটার একটা দাঁতকে কাটবার চেষ্টা করছে। বুকের ভেতরটাও অরুময়ের কেমনটা কাঁটা দিয়ে উঠল। বিশাল প্রাণীটা এই কিছুক্ষণ আগে মাত্রও কী প্রবল যন্ত্রণা পেয়েছে। কী নিষ্ঠুর এই পরিণতি। অরুময়ের গা গুলিয়ে উঠল। এই সময় ধুনিটার দিকে চোখ পড়ে যেতেই তিনি দ্বিতীয়বার আঁতকে উঠলেন। ধুনিটার ও-পাশে একটা কাটা গাছের গুঁড়ির উপরে কায়দা করে পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন ডি.এফ.ও সন্দীপ সোম স্বয়ং। মাঝে মাঝে চাপা গলায় এক-একটা হুকুম দিচ্ছেন। গলার সেই গমগমে ভাবটা এতদূর থেকেও স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে। রক্ষকই ভক্ষক! অরুময়ের সেই প্রবাদবাক্যটাকে মনে পড়ে গেল। এমন সময় অরুময় সুকুমারকে এগিয়ে যেতে দেখলেন। তার মন বা শরীরে যেন ভয়ডর বলে কিছুই নেই। দর্শক হয়ে অরুময় একটা গাছের আড়াল থেকে পুরো ব্যাপারটাকে দেখতে লাগলেন।
সন্দীপের মুখটা রাগে কদাকার হয়ে উঠেছে। ইংরেজিতে একটা বিশ্রী গালাগাল দিতে দিতে সে স্থানীয় ভাষায় চিৎকার করে বাকি লোক দুটোকে কী যেন একটা হুকুম দিলেন। তখন দু-পাশ থেকে দুজন ছুটে এসে সুকুমারকে ধরতে যেতেই যেন ইলেকট্রিকের খোলা তারে হাত দেবার মতো শক খেয়ে দুজনেই দু-দিকে ছিটকে পড়ল। সন্দীপের মুখটা ভয়ে বিস্ময়ে আরও কুৎসিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি পকেট থেকে টেনে একটা রিভলবার বের করে আনলেন। গুলি করবার আগেই সুকুমারের বাড়ানো তর্জনী থেকে ৪৪০ কিলো ভোল্টের একটা তীক্ষ্ণ ইলেকট্রিক শক নীলচে আলোর মতোই সটান সন্দীপের বুকের মাঝখানটাতে গিয়ে লাগল। সন্দীপ সোম কাটা কলাগাছের মতোই মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। অরুময়ের পিঠে কেউ যেন হাত রেখেছে। মুখ ফিরিয়ে তিনি দেখলেন—সুরেশ।
[৩]
প্রথম সূত্র ও তারপর
“অ্যাসিমভ বলেছিলেন, রোবট কোনোভাবেই তার কোনও কাজের মাধ্যমে অথবা কোনও কাজ করতে না চাওয়ার মাধ্যমে, মানুষের ক্ষতিসাধন করবে না।”
একটু থেমে অরুময় রণজয়ের দিকে তাকান। জঙ্গলে সন্দীপ সোমের অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে সদর শহর তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল। যত না তাঁর মৃত্যুর অভাবনীয়তা নিয়ে, তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁর দেহের চারপাশে পড়ে থাকা আরও দুজন চোরা শিকারির দেহ এবং গুলি খাওয়া হাতিটার মৃতদেহ উদ্ধারকে নিয়ে। একজন উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার যে এইরকমভাবে চোরা শিকারিদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারেন, কেউ দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। কেবল রণজয় সেদিন অনেক রাত্তিরে দেখেছিল জঙ্গল থেকে সুজয়, সুরেশ আর সুকুমারের সঙ্গে অরুময়কে বেরিয়ে আসতে। তখনকার মতো কিছু জিজ্ঞেস না করলেও অরুময় নিজেই আজ ওকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সবটা খোলসা করে ওকে বলা প্রয়োজন। কারণ, অরুময়েরও সময় হয়ে এসেছে।
“দেখো, ২০৩০-এর পর থেকেই যখন পরপর অতিমারীর কারণে পৃথিবীর জনসংখ্যা কমতে শুরু করল, তখন থেকেই মানুষের পরিবর্তে রোবট রেখে কাজ করানো শুরু হল। আজ এত বছর পেরিয়ে হয়তো সেই সিদ্ধান্তকে আশ্চর্যকর বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু…” অরুময় একটু হাসেন।—“সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কিন্তু সত্যিই এছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। ২০৭০-এর পর থেকে মানুষ আবার আস্তে আস্তে পরিবেশ, প্রকৃতি, মানবতা ইত্যাদির গুরুত্ব বুঝতে শুরু করল। আবার নতুন করে মানুষের জয়যাত্রা শুরু হল। কিন্তু তার মধ্যেও সন্দীপ সোমেদের মতো একেকজন সেই থেকেই যায়। সে যা হোক,” অরুময় রণজয়ের দিকে তাকান।—“সুকুমার সেই ফার্স্ট জেনারেশন রোবটদের মধ্যে একজন। সুরেশ বা সুজয় এরা ফিফথ জেনারেশন। যদিও,” অরুময় হেসে যোগ করেন—“ফার্স্ট ল অব রোবোটিক্স এদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। এরা দুটি ভিন্ন সময়ের, দুটি ভিন্ন জেনারেশনের—এমনকি দুটি আলাদা কোম্পানির আলাদা কারখানায় অ্যাসেম্বলড হলেও।”
রণজয় ঠিক এইখানটাতেই অরুময়কে থামিয়ে দেয়।—“কিন্তু তাহলে ওরা এভাবে সন্দীপ সোমকে আক্রমণ করবে কেন? ফার্স্ট ল অব রোবোটিক্স তো ওদের সে কাজ থেকে নিরস্ত করবে।”
“শুধু তাই নয়। এখানে সুকুমারের আচরণের যদি-বা একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়াও যায়, সুরেশ বা সুজয় কেন সুকুমারকে সহায়তা করবে সেই ব্যাপারটা আমার কাছেও পরিষ্কার হচ্ছে না।” অরুময় হাতে হাত ঘষেন।
“সুকুমারের আচরণেরই-বা কী ব্যাখ্যা রয়েছে আপনার কাছে?” রণজয় জিজ্ঞেস করে।
“আছে বৎস, আছে।” অরুময় মাথা নাড়েন—“রেল কোম্পানিতে আমাকে বিশেষভাবে নেওয়া হয়েছিল, তার কারণ আমি শুধুই ইলেট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়র ছিলাম না। আমার বিশেষ গবেষণাক্ষেত্র ছিল এই রোবোটিক্স আর কন্ট্রোল এঞ্জিনিয়রিং। রেল কোম্পানি যখন প্রথম ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে একে একে রোবট কর্মচারী নিয়োগ করতে শুরু করে, তখন আমিই তাদের ইনস্টলেশনের দায়িত্বে থাকতাম। সুকুমারের বলতে গেলে প্রায় আমারই ডিজাইনে সৃষ্টি। কাজেই বয়স হয়ে গেলে পরে আমি যখন শেষমেশ এই উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে এসে থিতু হতে চাইলাম, সঙ্গে করে নিয়ে এলাম এই সুকুমারকে। চারপাশের প্রকৃতি, জঙ্গল, বনভূমি এই সবকিছুকেই এত ভালো লাগছিল—খুব রাগ হত যখন মানুষকে দেখতাম এই প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে। এদিকে গবেষণা করতে-করতেই আমি হিউম্যানয়েড রোবট মানে যা কিনা প্রায় মানুষের মতোই আচরণ করবে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে রোবটদের মন, তাদের স্পর্শকাতরতা, সংবেদনশীলতা, চেতনা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছিলাম। তারই ফলস্বরূপ একটি ছোট্ট চিপ আমি আবিষ্কার করি যার মাধ্যমে রোবটদের মধ্যেও প্রকৃতি বা সজীব যে-কোনো বস্তুর প্রতি সংবেদনশীলতা জাগানো সম্ভব। অবশ্যই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবের ক্ষেত্রে আমার এই আবিষ্কার প্রযোজ্য নয়, কিন্তু পোকামাকড় থেকে শুরু করে পশুপাখি, গাছপালা—যা আমাদের দৈনন্দিন বাস্তুতন্ত্রের ধারক ও বাহক—তাদের প্রতি আমি রোবটদের একটা সংবেদনশীলতা জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলাম। সে-কাজে যে আমি সফল হয়েছি তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ নিঃসন্দেহে সুকুমার। কিন্ত সুরেশ বা সুজয়ের শরীরে এরকম কোনও চিপের অস্তিত্ব আছে বলে অন্তত আমার জানা নেই। কাজেই ওদের এই ব্যবহার…” অরুময় চুপ করেন।
সুকুমার ঘরের বাইরেটায় এসে দাঁড়িয়েছে।
“আসতে পারি স্যার?” সুকুমার জিজ্ঞেস করে।
“হ্যাঁ হ্যাঁ এসো, অবশ্যই।” অরুময় বলে ওঠেন।
“আপনি যা জানতে চাইছেন, আমি তা জানি স্যার।” সুকুমার স্পষ্ট গলায় বলে ওঠে।
“কী সেই রহস্য তাহলে বলে দাও আমায়।” অরুময় সুকুমারের দিকে তাকান।
“স্যার, আজকের রোবটদের শরীরে অন্য একটি চিপও বসানো থাকছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে লালন করবার প্রয়োজনে তারা রোবট-লার্নিং বা সহজ করে বললে মেশিন লার্নিংয়ের সাহায্য নিচ্ছে স্যার। যাতে রোবটেরা তাদের মনিব বা তাদের মনিবদের অধীনে থাকা অন্যান্য পুরোনো রোবটদের থেকে দরকারি কাজগুলোকে তাড়াতাড়ি শিখে নিতে পারে। হ্যাঁ, আমি জানি স্যার। আপনি বলবেন যে এতে তো মনিবেরা তাদেরকে খারাপ কাজকর্মও শিখিয়ে দিতে পারে, অন্যায়ের পথে চালিত করতে পারে। কিন্তু স্যার, এই মেশিন লার্নিং যত শক্তিশালীই হোক না কেন অ্যাসিমভের তিনটি সূত্রকে অতিক্রম করে তারা কিছু করতে পারবে না। তারা কেবল সূত্রগুলিকে প্রয়োজনমতো মানুষ এবং নিজেদের কল্যাণে বিস্তৃত করতে পারবে। অ্যাসিমভও তো বোধহয় সেইটাই চেয়েছিলেন।” সুকুমার তার বক্তব্য শেষ করে।
অরুময়রা দুজন অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। মানুষের তৈরি যন্ত্র আজ অপকারী মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের স্বার্থেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। রেবেলিয়ন!
অরুময় আজও সেই প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিটায় বসে ছিলেন। রণজয় আজ সুকুমারকে সঙ্গে নিয়ে সদর শহরের দিকে সপ্তাহের বাজার করে আনতে বেরিয়েছে। সুজয় আর সুরেশ দূরে কাজ করছে। অরুময় বুক ভরে শ্বাস নিলেন। এই জঙ্গল, এই পাহাড়, এই আকাশের কোলেই তাঁর মুক্তি। তিনি তাঁর বুকের কাছে জামার বোতামটা খুলে ফেলেন। নরম চামড়ার বদলে ইস্পাতের একটি শক্ত ঢাকনার মতো কোনও কিছুর উপরে তাঁর হাত পড়ে।
উত্তরবঙ্গে আসার পরে পরেই এক প্রচণ্ড ঝড়ের রাত্তিরে বাজ পড়েছিল স্টেশনের উপর। সেদিনও অরুময় এই বেঞ্চিটার উপরেই বসে ছিলেন। ঘন হয়ে মেঘ করে এলেও তেমনটা গা করেননি। সুকুমার যে কীভাবে অরুময়ের জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছিল সে সুকুমারই বলতে পারবে। তারপর থেকেই বিশেষ এক যন্ত্রের সাহায্যে অরুময় নিজের হৃদযন্ত্রকে চালিয়ে এসেছেন। এ যন্ত্রও অরুময়েরই আবিষ্কার। কিন্তু তিনি জানতেন যে, এরও মেয়াদ ফুরোবে। বিজ্ঞান আর যাই পারুক, অনন্ত জীবন সে দিতে পারে না। দিলে তা হত প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ। ক’দিন ধরেই অরুময় টের পাচ্ছিলেন যে তাঁর মেয়াদ ফুরিয়েছে। যন্ত্রটার কার্যক্ষমতা এইবারে শেষ হয়ে এসেছে। তাই তার আগেই তিনি রণজয়কে সবকিছু—বিশেষ করে সুকুমারের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বেলা পড়ে এসেছে। অরুময় আবারও বুক ভরে শ্বাস নিলেন। এই জঙ্গল, এই পাহাড়, এই আকাশের কোলেই তাঁর মুক্তি।
“বিদায় পৃথিবী।” অরুময় অস্ফুটে উচ্চারণ করেন।
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস