জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- এভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়) অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)
এই ধারাবাহিকের আগের পর্ব- পর্ব ১
স্যার অরেল স্টাইন ছিলেন একজন ব্রিটিশ পুরাতাত্ত্বিক। ১৮৬২ সালের ২৬ নভেম্বর তাঁর জন্ম হাঙ্গেরিতে। তিনি ব্রিটিশ সময়কালে নানা ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। তিনি মধ্য এশিয়ায় একাধিক প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে নেতৃত্ব দেন। তিনি শুধু একজন প্রত্নতাত্ত্বিকই ছিলেন না, ছিলেন একজন নৃতাত্ত্বিক, ভূগোলবিদ, ভাষাবিদ এবং জরিপকারী।
ডানহুয়াং গুহা থেকে উদ্ধারকরা পুথি এবং পাণ্ডুলিপির সংগ্রহ মধ্য এশিয়ার ইতিহাস এবং বৌদ্ধধর্মের শিল্প ও সাহিত্যের অধ্যয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর অভিযান এবং আবিষ্কারের উপর বেশ কিছু বই লিখেছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাচীন খোটান, সেরিন্ডিয়া এবং আভ্যন্তরীণ এশিয়া বিষয়ক বই। সংস্কৃত থেকে রাজতরঙ্গিণীর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন তিনি।
চিরকুমার অরেল স্টাইন ১৯৪৩ সালের ২৬ অক্টোবর কাবুলে দেহত্যাগ করেছিলেন।
এই নিবন্ধে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে চলেছে তাঁর তাকলামাকান মরুভূমির প্রত্নতাত্ত্বিক খোটান অভিযানের কথা।
পর্ব-২
হুঞ্জার ভাষা
গিলগিটের নিম্ন উপত্যকার মানুষজন ‘সিনা’ (Shina) ভাযাতে কথা বললেও হুঞ্জার ভাষা ‘বুড়িসিকশি’তেও (Burisheski) এরা স্বাচ্ছন্দ্য। ‘বুড়িসিকশি’র সঙ্গে ভারতীয় বা ইরানের ভাষার কোন মিল নেই। এই ভাষায় তুর্কি শব্দের ব্যবহার নেই। ক্ষীণ মিল আছে ইয়াসিন উপত্যকায় কথিত উরসুকি (Wurshki) ভাষার সঙ্গে। কী ভাবে যে এই উপজাতীয় ভাষার উৎপত্তি হয়েছিল তা ঐতিহাসিক প্রমাণ দিয়ে বলা কখনই সম্ভব হবে না। কোন অদ্ভুত কারণে, হয়ত কোন বনিকের মাধ্যমে একটা স্বতন্ত্র ভাষা থমকে জমে গিয়েছিল উপত্যকার খানিক অংশে। দক্ষিনে দর্দ আর উত্তরে ইরানিয়ান ও তুর্কি উপজাতিদের অবস্থানের মাঝামাঝি অংশে এরকম একটা ভাযা টিকে থাকার অন্যতম কারণ হতে পারে এই দুর্গম গ্রামগুলোর বিছিন্ন অবস্থান।
বিগত কিছু বছর ধরে এই অঞ্চলগুলোতে হিন্দুস্থানি ভাষার প্রচলন বহুগুণ বেড়ে গেছে। উপত্যকায় আসা সৈন্যবাহিনীর শতশত মানুষ আর তাদের মালপত্র বয়ে নিয়ে আসা হাজারো কুলি ও বণিকদের বদান্যতায় হিন্দুস্থানি ও পাঞ্জাবী ভাযা, অজান্তেই জীবিকার কারণে করায়ত্ত করে নিয়েছে পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষগুলো। সময়… সময়ই বদলে দেয় সবকিছু, এ এক পরীক্ষিত সত্য। একইভাবে মুসলিমদের বিজয় অভিযানের মাধ্যমে আরবি আর ফার্সি শব্দ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল এশিয়ার নানা প্রান্তে।
ক্রমাগত উঁচু-নিচু সর্পিল পথ ধরে প্রায় ছাব্বিশ মাইল পথ চলে চাল্ট থেকে আলিয়াবাদে পৌঁছে, পিছনে ফিরে আধো আলোয় ফেলে আসা পথটাকে দেখেছিলাম। নদীর পাথর ভরা বুকের ওপরকার সেতু পেরিয়ে নুড়িপাথরের পথটা, বড়ো বড়ো রুক্ষ পাথরের মাঝ দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে তাশসোট গ্রামের দুর্গের দিকে। রাস্তার ভয়ংকর আলগা পাথরের টুকরোগুলো সাবধানে টপকে যখন এগোচ্ছি, তখনই আলো কমে এসেছিল। সন্ধের স্তিমিত আলোতে নদীর দু’পাশে খাড়া উঠে যাওয়া পাঁচ-ছ হাজার ফুট পাথরের দেওয়ালগুলোর মাঝে রাকিপোশির ছলকে ওঠা ফেনিল জলের কণাগুলোকে লাগছিল ফরাসি চিত্রকর গুস্তাভ ডোর-এর আঁকা ছবির মতো।
হুঞ্জাকে সাময়িকভাবে দখল করার পর আলিয়াবাদের ছোটো দুর্গটি তৈরি হয়েছিল। এই দুর্গের কাছেই পলিটিক্যাল অফিসারের বাংলো। যদিও বাংলোর বাসিন্দা ক্যাপ্টেন পি জে মাইলস ছুটিতে গিয়েছিলেন কিন্তু তাঁর বাংলোতে আতিথ্য পেতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি। এই সীমান্ত অফিসারের ছোট্ট বাংলোর আরাম আমার মন ভরিয়ে দিয়েছিল। ক্যাপ্টেনের করিতকর্মা হুঞ্জা চাকরটাও আমার খাওয়া-দাওয়া আর বিশ্রামের ব্যবস্থায় কোনো খুঁত রাখেনি।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই এক অত্যাশ্চর্য দৃশ্য আমার মন ভরিয়ে দিয়েছিল। উত্তর-পূর্বের আকাশ জুড়ে থাকা রাকিপোশির নিষ্কলুষ স্বর্ণাভ বরফ মুকুট। আকাশে ছিটেফোঁটা মেঘ বা কুয়াশা ছিল না। দুচোখ ভরে উপভোগ করেছিলাম ২৫০০০ ফুট উঁচু রাকিপোশি পর্বতের স্নিগ্ধতা। এছাড়াও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল উত্তর জুড়ে বিস্তৃত বরফঢাকা পর্বতমালা – আমার আগামি পথ।
গিলগিট আর হুঞ্জার মাঝে ডবল মার্চ করে দুটো দিন সময় বেঁচেছিল। সেই বেঁচে যাওয়া দুটো দিন আমরা আলিয়াবাদে কাটিয়েছিলাম। প্রথমত- সঙ্গের মালপত্রগুলো একবার নতুন করে বাঁধাছাদার প্রয়োজন পড়েছিল নতুন কুলির দলের পিঠে চাপাবার জন্য। তাছাড়া কিছু চিঠিপত্র পাঠাবার ছিল। এটা ঠিকই যে হুঞ্জাতে সে অর্থে কোন ডাকঘর বা ডাকব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু একদিন পরপর গিলগিট থেকে কূটনৈতিক চিঠিপত্রের আদান প্রদান চলত। সামনের লম্বা সফরের আগে খবর পাঠানোর এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি।
পরদিন সকালে হুঞ্জার উজির আমার সঙ্গে দেখা করে আশ্বস্ত করলেন যে আগামি যাত্রার সব আয়োজন সম্পূর্ণ। উজির হুমাউন হুঞ্জার একজন গন্যমান্য প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি বংশানুক্রমিক পদাধিকার বলে হুঞ্জার প্রধান উপদেষ্টা ও কার্যনির্বাহী কর্তা বা মীর। লম্বা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মীর হুমায়ুনের বয়স হবে পঞ্চাশের আশপাশে। একমুখ দাড়ি, ইউরোপিয়ান ধাঁচের পোশাক পরিহিত মানুষটিকে একঝলক দেখলেই যেকোনো লোকের মনে সম্ভ্রম জাগবে। পূর্ববর্তী বছরগুলোতে সারিকোল, গিলগিট আর বাল্টিস্থানে কানজুটদের নিয়ে নানা আক্রমণে উজির বা মীরদের আগ্রাসি ভূমিকা ছিল। উনি যখন গল্পচ্ছলে ব্রালদো উপত্যকা আর তাশকুরঘনে অভিযানের কথা বলছিলেন তখন ওঁর চোখগুলো উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছিল।
এখন সেই রক্তঝরা লড়াইয়ের দিন আর নেই। উনি এখন এই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য লড়ে যাচ্ছেন। কাজটা মোটেই সহজ নয়। একদিকে সীমিত চাযযোগ্য জমি অন্যদিকে বেড়ে চলা জনসংখ্যা। উপত্যকার পাথুরে জমিতে বহুদূরের হিমবাহ থেকে নালা খুঁড়ে জল নিয়ে এসে আবাদ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে নিরন্তর।
হুঞ্জার সঙ্গে চিনের প্রাচীন সাম্রাজ্যের সম্পর্ক কেমন ছিল জানার কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছিল। হুঞ্জার মানুষ বহুকাল আগে থেকেই চাইনিজ তুর্কিস্থানের ওপরাং উপত্যকার ইয়ারখন্দ নদী আর অন্যান্য প্রবাহের জলের ওপর দখলদারি চালিয়ে আসছিল। আর সম্ভবত সেই কারণেই ধীরে ধীরে বলবৎ হওয়া ব্রিটিশ সার্বভৌম অধিকারের ফলস্বরূপ বর্তমান কাশগর কর্তৃপক্ষ এই জল দখলদারিকে উপহার হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়েছে।
আবার অন্যদিকে হুঞ্জা এই ‘উপহার’-এর ফেরত ‘উপহার’ও দিয়েছিল। এক চুক্তির বলে সারিকোল আর কারাকোরাম রক্ষা পেয়েছিল কানিজুটদের আক্রমণের হাত থেকে। এই সুরক্ষা সংক্রান্ত চুক্তির নথিপত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে উজির জানিয়েছিলেন, চাইনিজ ভাযা আর তার ফার্সি ও তুর্কি অনুবাদ সহ সমস্ত নথি ১৮৯১ সালের দখলদারির পর মীরের বাসস্থান থেকে সিমলাতে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নথিগুলো দেখতে পারলে জানা যেত যে কূটনীতিক চুক্তির মাধ্যমে কানজুটি প্রধানদের ঠিক কী মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল।
আলিয়াবাদে
যদিও হুঞ্জায় ব্রিটিশ আধিপত্য ছিল, কিন্তু আধিপত্য এসেছিল কোন বলপ্রদর্শন ছাড়াই। অলীক গল্প নয়, এ বাস্তব সত্য। আলিয়াবাদে যে ছোটো কেল্লাটা আছে বর্তমানে সেটা কমিশনারেটের ‘গুদাম।’ সামান্য অর্থের বিনিময়ে কিছু স্থানীয় গ্রামবাসী কেল্লাটা পাহারা দেয়। নানা জায়গায় এরকম কেল্লা পাহারাদার গ্রামবাসীর সংখ্যা একশো আশির মতো। চিত্রাল অভিযান ও প্রচারের সময় এই গ্রামবাসী পাহারাদাররা খুব কাজে এসেছিল। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে এই অসামরিক স্থানীয় পাহারাদাররা রাজনৈতিক ব্যবস্থাপকদের অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের অসামান্য যন্ত্র স্বরূপ। নিয়মিত বেতনের বিনিময়ে সহজ পরিষেবা মূলক কাজে এই পাহারদারদের দিয়ে চমৎকার ফল মিলেছে। আফগান সীমান্তে কর্মসংস্থান এক কুখ্যাত বিষয়। অর্থের বিনিময়েও নিরাপদ ও বিশ্বাসযোগ্য কর্মী পাওয়া দুরহ। কিন্তু হুঞ্জার ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব খাটে না। বিচক্ষণ কর্তৃপক্ষ এখানকার মানুষজনকে বাধ্য ও ভীষণ কর্তব্যপরায়ণ বলে স্বীকার করেছেন। এদের পুরনো ইতিহাস যাই হোক না কেন এদের সম্পর্কে বর্তমান সময়ের মূল্যায়ন যথার্থ বলে আমার মনে হয়েছে।
আলিয়াবাদের দ্বিতীয় দিন হুঞ্জার আরেক মীর মুহাম্মদ নাজিম আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। ইনি ১৮৯১র ব্রিটিশ অধিগ্রহণের পর মীরের পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। খোলা মনের, পেটানো চেহারার মীরের বয়স হবে বছর পঁয়ত্রিশ। বুদ্ধিমান, স্পষ্টবাদী ও দৃঢ়চেতা নাজিম নিঃসন্দেহে এই পদের যোগ্য অধিকারী।
কথোপকথন চলেছিল ফার্সিতে। আলোচনার মোড় ঘুরে গিয়েছিল এই অঞ্চলের পুরোনো অবস্থার সঙ্গে বর্তমান অবস্থার আমূল পরিবর্তন নিয়ে। আগে তারা হত্যা ও লুঠতরাজে মেতে থাকত চিরকাল। তার জায়গায় রাস্তা তৈরি, টিকাকরণ হেন পশ্চিমা উন্নতির প্রভাব এখানকার প্রাচীন পরিবারের এই প্রতিনিধির কাছে অদ্ভুত বলে মনে হয়েছিল। এই সংস্কার ও পরিবর্তন আসলে ব্রিটিশ শান্তি (pax Britannica) অভিযানের ফল।
উজিরের মাধ্যমে আমি দু’জন হাঞ্জাবাসীকে আমার দলের সঙ্গে সারিকোল পর্যন্ত গাইড হিসেবে যাবার জন্য আমি নিযুক্ত করেছিলাম। এই দু’জন ইতিপূর্বে পামিরে ছিল। মীরের দেহরক্ষী দলের প্রধান মুহাম্মদ রাফি আমাদের অভিযানের পরিবহনের জন্য একটি ষাট কুলির দল জোগাড় করে দিয়েছিল। এতগুলো কুলি আর দলের লোকজন নিয়ে আমাদের ক্যারাভ্যান একটা বিশাল আকার নিয়েছিল।
২০জুন সকালে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। অল্প পথ পার হয়ে পৌঁছোলাম হুঞ্জার প্রধান শহর বাল্টিট-এ। এই শহরেরই খানিক উঁচু অংশে মীরের বাসস্থান। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ফলের বাগানের মাঝে লম্বা মিনারওয়ালা তাক লাগানো দুর্গ তথা প্রাসাদ। প্রাসাদ থেকে দূরে, পাহাড়ের নীচু অংশে পাথরের ওপর পাথর চাপিয়ে তৈরি গায়ে-গা লাগিয়ে থাকা শ-দুয়েক বাড়ি।
চোখ জুড়ানো সবুচিনার গাছের ছায়াঘেরা সদ্য তৈরি একটা বাংলোয় আমি গিয়ে উঠলাম। সেটা একদম শহরের পোলো খেলার মাঠের লাগোয়া। উপত্যকার দক্ষিণে বিশাল বরফের নদী সুমাইয়ার হিমবাহ ঝকঝক করছিল। তার পেছন থেকে উঁকি মারছিল তুষারঢাকা বরফ চূড়া। দুপুরে মীরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে হুঞ্জা শাসকদের প্রাসাদটি ভালোভাবে দেখার সুযোগ হল। শক্তপোক্ত ভিতের ওপর উঁচু পাঁচিল ঘেরা প্রাসাদ। এক বাল্টিক রাজকুমারীর সঙ্গে আসা বাল্টিক শ্রমিকদের হাতে তৈরি এই প্রাসাদ। বাল্টিক রাজকুমারীর সৌজন্যে এই জায়গার নাম হয় বাল্টিট। প্রাসাদের ছাদ থেকে সযত্নে রক্ষিত হুঞ্জা উপত্যকার বিস্তৃত অঞ্চলের দারুণ দৃশ্য দেখেছিলাম। প্রাসাদের একটি নতুন তৈরি অংশে বসিয়ে আমাকে চা ও কেক দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়েছিল। সেখান থেকেও হুঞ্জার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল।
ইউরোপিয়ান ঘরানার কিছু আসবাবপত্র দিয়ে প্রাসাদের এই নতুন অংশটি সাজানো। বোঝা যাচ্ছিল মধ্য-প্রাচ্য তথা ইউরোপের ছাপ এই অঞ্চলে পড়তে শুরু করেছে।
ইয়ারখন্দের কার্পেট, চিনা সিল্ক আর কাশগরের রঙিন ছাপা কাপড় সারিকোল গিরিপথ বেয়ে এখানে হাজির হতে শুরু করেছিল ভারত থেকে গিলগিট পথ বেয়ে আসা দ্রব্য সামগ্রী সবরাহ চালু হবার অনেক আগে থেকেই। বরং উত্তর থেকে আসা দ্রব্যসামগ্রীর তুলনায় পশ্চিমি সামগ্রীর চাহিদা ও জোগান অনেক বেশি।
প্রাসাদ থেকে ফেরার পথে বেশ কয়েকটি কাঠের তৈরি মসজিদ নজরে এসেছিল। মসজিদের কাঠের থামগুলোতে খোদাই করা হাতের কাজগুলো সত্যিই তারিফ করার মতো। অনেকটা কাশ্মিরি দারুশিল্পীদের মতো ‘চৈত্য’ ঘরানার, খিলানাকৃতি আকারের মধ্যে প্রাচীন ভারতীয় কৃষ্টির চাকা ও স্বস্তিকা চিহ্ন ধরণের। যদিও এই খিলানগুলো খুব প্রাচীন নয়। কিন্তু অলঙ্করণে দক্ষিণী প্রভাব আমাকে কৌতূহলী করে তুলেছিল।
জুনের ২১ তারিখের হাঁটাটা ম্যাপে কম দেখালে হবে কী, যা খবর জুটেছিল তাতে বুঝে গিয়েছিলাম একটা কঠিনতম পথ পেরোতে যাচ্ছি। বাল্টিট ছেড়ে মাইল দুয়েক এগোবার পর চোখের সামনে থেকে ছবির মতো সাজানো মনোরম বাল্টিট আর আল্টিটের দুর্গ গ্রাম উধাও হয়ে গিয়ে এসে হাজির হল বৃক্ষহীন পাথরের সাম্রাজ্য। এক কণা সবুজের ছোঁয়া নেই কোথাও। উদ্দাম হওয়া ঠেলে এক চিলতে খাড়াই পথ দিয়ে এগোতে হচ্ছিল আমাদের। একবার পা হড়কালেই স্থান হবে কয়েকশো ফুট নীচ দিয়ে বয়ে চলা ফেনিল নদীতে। কখনও আবার নেমে আসতে হচ্ছিল নদীর পাশে। পথের ওঠাপড়া লেগেই ছিল।
মাইলচারেক চলার পর মুহম্মদাবাদ নামের একটা ছোট্ট গ্রামের দেখা পেলাম, কিন্তু গ্রামটা ছিল আমাদের চলার পথের বহু নীচে নদীর ধার ঘেঁষে একটা বালিময় মালভূমির মাঝে। নদীর ধার ঘেঁষা গ্রামের পাশ দিয়ে ওই পথ চলাচলের জন্য সহজ হলেও শুধুমাত্র শীতের সময় যখন নদীতে জল কম থাকে তখনই টাট্টু নিয়ে নদী পারাপার করা যায়। ও পথ ধরে চলতে গেলে বহুবার নদী এপার-ওপার করতে হয়। পাহাড়ের বরফগলা শুরু হয়ে গিয়ে নদীতে জল বেড়ে গেলে তখন ওই নদী পারাপার করা সম্ভব হয় না। এখন বরফ গলার কাল। তাই ওই আলগা পাথরভরা পাহাড়ের ভয়ংকর খাড়া গা বেয়ে পা হড়কানো পায়ে চলা পথ ধরে এগোন ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিল না।
আতাবাদে
একসময় আমাদের নিচের দিকে নামা শুরু হয়েছিল, আর ঘাম ঝরানো, পা টিপে টিপে হাঁটার শেষে হয়েছিল আতাবাদের নদীর ধারের ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে পৌঁছে। যে গ্রামের থেকে এই অঞ্চলের নাম, সেটা এই ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে প্রায় দেখাই যাচ্ছিল না। খাড়া পাথরের দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে আছে গ্রামটা। ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডটাকে নীরস লাগছিল। বছর পঞ্চাশেক আগে পাহাড়ের এক ভয়ংকর ধ্বসে এই পুরো উপত্যকাটা লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। আর পাহাড়ের ওপরের অংশে সৃষ্টি হয়েছিল এক বিশাল জলাশয়ের। হুঞ্জা নদীর বয়ে নিয়ে আসা হিমবাহের কালো পলি, রোদের তাপে নদীর তটে শুকিয়ে, সন্ধে হতে না হতেই তীব্র ঝড়ো হাওয়াতে উড়ে বেড়াতে শুরু করে উপত্যকা জুড়ে। এখানকার খাবার আর পানীয়ের মধ্যেও বালির দানা মিশে। মনে হচ্ছিল যেন খোটানের মরুযাত্রার মহড়া শুরু হয়ে গেছে।
এইরকম এক নির্জন জায়গায় ডাক-রানার রাতের বেলায় আমার ব্যক্তিগত কিছু চিঠির বোঝা নিয়ে হাজির হয়েছিল। এই প্রত্যন্ত দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে চিঠিগুলো পেয়ে ডাক-রানারের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না।
পরের দিনের হাঁটাপথটা ছিল এক চরম পরীক্ষা। আতাবাদ থেকে স্বল্প দূরত্ব অতিক্রম করতে আমাদের কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। নদীর ধার থেকে পথ উঠে গিয়েছিল পাহাড়ের খাড়া গা বেয়ে। সে-পথ শুধু খাড়াই নয়, সংকীর্ণ ও আলগা নুড়িতে বোঝাই। পদক্ষেপে একটু এদিক-ওদিক হলে খাদ বেয়ে সটান ছিটকে পড়তে হবে বহু নীচে। খানকতক সরু জলের ধারাও বয়ে গেছে পথের ওপর দিয়ে। মাঝে মাঝেই এই পথ বিপজ্জনকভাবে বাঁক নিয়েছে। স্থানীয়রা এই বাঁকগুলোকে বলে ‘রাতিক’। এখানে পদক্ষেপে সামান্যতম ভুল হলেই ভয়াবহ মাশুল গোনা ছাড়া উপায় নেই।
আবার কিছু জায়গায় পথ খাড়া হলেও খানিক সিঁড়ির মতো করা আছে। এই পথে ঘোড়ার পিঠে বোঝা চাপিয়ে চলা একটা দুর্বিষহ কাজ। সে-ঘোড়া যতই পাহাড়ি পথে চলতে অভ্যস্ত হোক না কেন! বেশ কয়েক জায়গায় আমার টেরিয়ার কুকুর ‘ইওলিচ বেগ’কে ওর আপত্তি সত্ত্বেও কোলে তুলে পার করাতে হয়েছিল। কারণ, লক্ষ করেছিলাম পাথরের ওপর ও বারবার হড়কে যাচ্ছিল। এর আগেও কাশ্মীরে কয়েক জায়গায় দেখেছি বেশ কিছু ধরণের পাথরের ওপর ও ঠিকমতো চলতে পারে না। পিছল খেতে থাকে ক্রমাগত।
পুরো পথটায় খুব সামান্য জায়গায় ক্ষীণ জলের ধারার পাশের নামমাত্র ঝোপঝাড় নজরে এসেছে। ধূসর পাথরের বুকে ছিটেফোঁটা সজীবতার ছোঁয়া। ঘণ্টাছয়েক হাঁচোড়পাঁচোড় করে পা টিপে টিপে খাড়াই পথ চলার পর নজরে এলো দূরে বিস্তৃত এক উপত্যকার। আরো ঘণ্টা দুয়েক লেগেছিল গুলমিত গ্রামে পৌঁছতে। হিমবাহের কোল ঘেঁষা গ্রামের, ক্ষেত আর ফল বাগিচার আঙিনা ছাড়িয়ে দূর বরফ-নদীর ধবধবে সাদা বরফ দেখা যাচ্ছিল স্পষ্ট।
হুঞ্জা উপত্যকার অংশ গুলমিত গ্রাম ছোটো গুহিয়াল নামেও পরিচিত। এই গ্রামের বাসিন্দাদের থেকেই এই পরিচয়। বর্তমান গ্রামবাসীদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন ওয়াখি অভিবাসী। অক্সাস নদীর কূলবর্তী গুহিয়ালের বাসিন্দা। (গ্রিস দেশের মানুষ।)
গ্রামপ্রধান অনেক লোকজন নিয়ে অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছিলেন আমাকে স্বাগত জানাতে। প্রথম দর্শনেই বুঝতে পেরেছিলাম এই গ্রামবাসীদের স্বাতন্ত্র্য। লম্বা-সুগঠিত সুদর্শন দেহ জানান দিয়েছিল গ্রিক উপস্থিতি। মীরের আত্মীয়, মুহাম্মদ নাফিজ, যিনি মীরের প্রতিনিধি হিসেবে এই অঞ্চলে কাজ করেন, তিনিও গ্রাম প্রধানের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।
গ্রামের লোকেরা শোভাযাত্রা করে আমাদের নিয়ে গেলেন একটি ন্যাসপাতি গাছের বাগানে। এই বাগানেই আমাদের শিবির স্থাপনের জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন ওঁরা। আমি ওয়াখানের ভাষা শুনে ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলাম। ভারতে আসার অনেক আগেই এখানে পূর্ব ইরানের এই ভাষার চলের কথা শুনেছিলাম। আমি নিজেও যে এই অসাধারণ ভাযার একজন রক্ষাকারী বংশধর! সম্ভবত একই ভাষা জানা আমিই প্রথম বহির্জগতের ব্যক্তি যিনি প্রাচীন এই ভাষাগোষ্ঠীর সংস্পর্শে এলেন। তাও পাহাড়ের অতি উচ্চতায় এক দুর্গম কন্দরে।
এই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছিল আমি শুধু পামিরের অনন্য ভৌগলিক বিভাজনের মুখে দাঁড়িয়ে নেই, দাঁড়িয়ে আছি এমন এক অবস্থানে যেখানে এখনও সঙ্গোপনে রক্ষিত ও জীবন্ত এক প্রাচীন ভাযা ও তাঁর সংস্কৃতি। অক্সাস, ইন্দাস আর ইয়ারকন্দ নদীর জলবিভাজিকা কাছের কিলিক পাসে এই অঞ্চলের অনেক প্রাচীন ইতিহাস লুক্কায়িত। ভারত, ইরান আর তুর্কিনিস্থানের অনেক জাতিগোষ্ঠীর প্রভাব এই অঞ্চলে ছড়িয়ে।
ওয়াখি বসতি
ছোটো গুহিয়াল বা গুলমিট গ্রামের জনসংখ্যা হবে হাজারের মতো। বলিষ্ঠ চেহারা, গড়পড়তা হুঞ্জাবাসীর তুলনায় বেশ লম্বা। ধারালো বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ, ঈগলের ঠোঁটের মতো বাঁকানো নাক, গায়ের রং পরিষ্কার বুঝিয়ে দিচ্ছিল এঁদের স্বতন্ত্রতা। ইরানিদের প্রতিটি বৈশিষ্ট এঁদের চলনে-বলনে। এঁদের অনেকেই ফারসি ভাষায় পটু। কাজেই সরাসরি এঁদের সঙ্গে কথা বলতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি।
ওয়াখানের সঙ্গে সারিকোলের যোগাযোগ এখনও রক্ষিত মূলত বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে। একদা যুদ্ধবাজ, জমির অধিকার রক্ষায় সচেতন হুঞ্জাবাসীরা যে কী করে ওয়াখিদের প্রবেশ মেনে নিয়েছিল তার ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল। ওয়াখিদের শান্তিপূর্ণ চরিত্র বা অবস্থানকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। যে কোন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান গৃহকর্তা থেকে গ্রামের প্রতিটি অধিবাসী সুচারুভাবে পালন করে। প্রতিটি অনুষ্ঠানে এরা সঙ্গে নেয় লম্বা হাতলওয়ালা হার্ট-আকারের বেলচা। যা এই অঞ্চলের উর্বরতা বাড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার। এই বেলচা সেচের খালগুলোতে বাঁধ দেওয়া ও বাঁধ খোলার কাজে ব্যবহৃত হয়। ব্যবহৃত হয় জমি খোঁড়া থেকে পরিষ্কার করা সহ নানান কাজে। এঁদের মধ্যে উন্নয়নের অন্যতম প্রতীক এই বেলচা।
গুলমিত খুব বেশি সাহেব মানুষ দেখেনি। পরিচ্ছন্ন ফল-বাগানে আমাদের গাড়া তাঁবু ঘিরে গ্রামবাসীরা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। পরদিন সকালে কুলি পাল্টাতে হওয়ায় আমাদের যাত্রা শুরু করতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। কুলি পাল্টানোর সময় প্রতিবারই এটা হয়। কুলিদের বোঝা বাছাই করে পিঠে তুলতে তুলতেই কেটে যায় বহু সময়। যদিও পরবর্তী লক্ষ পাসু’র দূরত্ব খুব বেশি ছিল না। আর রাস্তাটাও ছিল আগের দিনের তুলনায় অনেক সহজ। তবে এতো সহজ বা মসৃণ নয় যে ওই পথ দিয়ে বাচ্চাকে প্যারাম্বুলেটারে চাপিয়ে গড়গড় করে টেনে নিয়ে যাওয়া যাবে!
গুলমিতের খানিক দূরে প্রায় নদীর কোল ঘেঁষে গলকিন হিমবাহ। অসংখ্য ছোটো ছোটো ঘোলা জলের ধারা হিমবাহ থেকে বেরিয়ে এসে মিশেছে নদীতে। বরফ গলার ঋতুতে এই পথে চলাচল খুবই কষ্টকর। যদিও এখানে উপত্যকা অনেক চওড়া আর নদীর ডানদিকের পাথুরে পাড় চলাচলের জন্য যথেষ্ট আরামদায়ক।
গন্তব্যে পৌঁছোবার খানিক আগেই আমাদের আসতে হয়েছে পাসু হিমবাহের সামনে দিয়ে। বড়ো বড়ো পাথরে বোঝাই এই চিরতুষারের নদী নেমে এসেছে দূরের পঁচিশ হাজারেও বেশি উঁচু পাহাড়শৃঙ্গগুলো থেকে।
আলিয়াবাদ আর বাল্টিট থেকে এই হিমবাহের দেখা মেলে। হিমবাহের পাশের স্তূপাকৃতি মোরেন বা পাথরের স্তূপ দেখে সহজেই বোঝা যায় যে এই হিমবাহটি আগে আরও বড়ো ছিল।
হিমবাহের ধার ঘেঁষে
হিমবাহের মুখ থেকে খানিক উত্তরে এগিয়েই পাসু গ্রাম। গ্রামের সবুজ শস্যক্ষেত আর ফলের বাগান চারপাশের ধূসর বর্ণের মাঝে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। হিমবাহ নির্গত জল, সেচ নালার সাহায্যে ধরে নিয়ে আসার সুফল এই সবুজের সমারোহ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু বাড়িঘরের মাঝের ছোট্ট বাগানে আমারা আমাদের তাঁবু খাটিয়েছিলাম। ঠাণ্ডা বাতাস, ওট আর বাজরা ক্ষেতের উপস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছিল এই জায়গার উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে আট হাজার ফুটের আশেপাশে। ক্ষেত ঘিরে ফুলের গাছগুলো সংখ্যায় কম হলেও মনোরম বসন্তের পুরো আমেজ ধরে রেখেছিল।
পরদিন ২৪ জুন, পাসু থেকে মাইল তিনেক এগিয়ে আমরা সুবিশাল বাতুরা হিমবাহে পৌঁছোলাম। উত্তরপশ্চিম দিক থেকে নেমে আসা প্রায় চব্বিশ মাইলেরও বেশি লম্বা এই হিমবাহের অংশ উপত্যকার একটা দিক ধরে এগিয়ে এসেছে। আগে পার হয়ে আসা হিমবাহগুলোর মতো নয়। এর হিমায়িত শরীর চলে গেছে নদীর তলদেশে।
মাইলের পর মাইল বিস্তৃত হিমবাহের উপরিভাগ ভর্তি কুঁচো পাথরে। আর এই কুঁচো পাথরের কল্যাণেই হিমবাহের ওপর দিয়ে আমাদের পথ চলা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। এই পাথরের ওপর পা রেখে আমি হিমবাহের ওপর দিয়ে ঘণ্টায় মাইল দেড়েক পথ অতিক্রম করতে পারছিলাম। যদিও পিচ্ছিল বরফের কারণে কুলিদের গতি ছিল তুলনায় অনেক কম।
হিমবাহের অনাবিষ্কৃত উপরিভাগ থেকে নেমে আসা বরফের চাঁই পেরিয়ে মানুষের পক্ষে এই সুবিশাল বরফনদী পার হওয়া আগে অসম্ভব কাজ ছিল। পশুদের পিঠে মাল চাপিয়ে এই পথ পার হওয়া যেত না। ভয়াবহ এই পথের বাধা এড়িয়ে পথ খুঁজতে সক্ষম হয়নি কোন ইঞ্জিনিয়ারও। প্রাকৃতিক এই প্রতিরক্ষা প্রাচীর এই পথ ধরে উত্তরের বহিরাক্রমণ থেকে হুঞ্জা উপত্যকাকে রক্ষা করে এসেছে অনাদিকাল ধরে।
বাতুর হিমবাহ পরবর্তী পথ ছিল আরো উচ্চতা দিয়ে। আলগা পাথর বোঝাই পথের দু’পাশে পাথরের দেওয়াল। পাসুর পর বসতির দেখা মেলে সেই খাইবার পার হয়ে। এখানে পাশ দিয়ে বয়ে চলা পাহাড়ি নালাটি হিমবাহের জলে পুষ্ট নয়। যদিও ক্ষীণকায়া নালাটি এই গ্রীষ্মে যথেষ্ট ভয়াহব। দু’পাশের পাহাড়ের শিরাগুলো থেকে সোজা ওপরে উঠে যাওয়া পাথর চুড়াগুলো সব অসাধারণ আকারের।কিন্তু এখানে বরফের দেখা নেই।
নাগাড়ে ঘণ্টাছয়েক ধরে ক্লান্তিকর হাঁটার খাইবারের যে গ্রামটায় আমরা পৌঁছেছিলাম সেটি উপত্যকার সরু মুখের ধারে বালিময় ভূমির ওপর গড়ে ওঠা। গ্রামটা ভীষণ রকম নির্জন। বাসযোগ্য জমি প্রায় নেই বললেই চলে। তারই মধ্যে আধডজন মতো পরিবারের বাস। প্রকৃতি এখানে ভয়ংকর রকমের কঠোর। এখানে বেঁচে থাকতে হলে প্রকৃতির নির্মমতার সঙ্গে যুঝতে হয় প্রতিনিয়ত।
খাইবার থেকে মিসগার যাওয়ার দুটি পথ আছে। একটি নদীর বাঁদিক দিয়ে গিরচা গ্রামের মধ্যে দিয়ে। আর একটি নদীর ডানদিক ধরে খুবাদাবাদ গ্রাম ছুঁয়ে। যদি নদীতে জল বেশি না থাকে তবে গিরচা গ্রাম হয়ে পথটাই হাঁটার জন্য সহজ।
২৫ জুন সকালে গিরচা গ্রামের পথ ধরে রওনা হবার খানিক পরেই খবর এল, সামনে ওই পথের অবস্থা খুব খারাপ, ওই পথ ধরে এগোন বোকামি হবে। আবার পিছু ফিরে নদীর ডানদিকের রাস্তা ধরতে হল। চলার পথে কোনো বাধা না এলেও বড়ো বড়ো পাথর ডিঙিয়ে নদীর ধারের নুড়ির ওপর দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে হাঁটাটা খুবই কষ্টের ছিল।
মুরখুন গ্রামের ঠিক উল্টো দিকে একটা রাস্তা পূর্বমুখি চলে গেছে শিমশাল উপত্যকার দিকে। খাড়া পাহাড়ের পাথুরে শরীর ঘেঁষে রাস্তাটা ক্রমাগত নিচের দিকে নেমে গেছে। এই পথে একটি স্বাদু পানীয় জলের ঝরনা আছে। এ’পথে চলচলকারীদের কাছে ওই ঝরনার আকর্ষণ প্রবল।
খানিক এগোতেই হুঞ্জার ওয়াজিরের এক বার্তাবাহকের সঙ্গে দেখা হল। সে আমার যাত্রার খবর নিয়ে তাশকুরগানের রাজনৈতিক মুন্সির কাছে গিয়েছিল। লোকটা ১৮ই জুন তারিখে হুঞ্জা থেকে হাঁটা শুরু করে, তাশকুরগান পৌঁছে মুন্সির কাছ থেকে উত্তর নিয়ে সেখান থেকে ব্যক্তিগত ব্যবহারের কিছু মালপত্র কিনে, সেই বোঝা পিঠে চাপিয়ে এতটা পথ ফিরেও এসে গিয়েছিল।
নিঃসন্দেহে হুঞ্জার পুরুষদের হাঁটার ক্ষমতার তুলনা নেই। হুঞ্জা থেকে কালিকের দূরত্ব প্রায় একাশি মাইল, আর সে পথের চরিত্র আমাদের পার হয়ে আসা পথের মতোই কঠিন। কালিক থেকে তাগদুম্বাসের দূরত্ব চল্লিশ মাইলের মতো। তাছাড়া লোকটা পামিরের তাগদুম্বাস থেকে তাশকুরগান গিয়ে আবার ফেরত এসেছে। তাগদুম্বাস থেকে তাশকুরগানের দূরত্ব আশি মাইল। মানে তাগদুম্বাস থেকে তাশকুরগান গিয়ে ফিরে আসতে লোকটাকে ১৬০ মাইল পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় চল্লিশ মাইল মতো পথ হেঁটেছে লোকটা। লোকটার এই হাঁটার গতি বুঝিয়ে দেয় অতীতে কী করে কানজুটিদের দল দ্রুত আক্রমণ হেনে লুটপাট সেরে ফিরে যেত।
মিসগারের পথে
আটটি বাড়ি নিয়ে গড়ে ওঠা গ্রাম খুদাবাদে পৌঁছে আমাদের সেদিনের হাঁটা শেষ হয়েছিল। এটা কোন ওয়াখি বসতি নয়। একটা ছোটো হুঞ্জাদের গ্রাম।গ্রামের লোকদের নিজস্ব ভঙ্গীর উচ্চারণে বলা কথা আমার তাঁবু থেকে স্পষ্ট শোনা যেত। তুর্কিতে আমার চাকরদের সঙ্গে কথাবার্তা চালালেও ফার্সি ভাষাতেই কথা বলতাম আমার ওয়াখি গাইড আর গ্রামবাসীদের সঙ্গে।ফার্সিতেই এরা বেশি স্বচ্ছন্দ। আমার কুলিরা ওয়াখি, বুরিশেস্কি আর দর্দ ভাযা মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বলত। এতসব ভাযা ছাড়াও আমার সাব সার্ভেয়ার রাম সিং তার রাঁধুনি তথা তার ব্যাক্তিগত চাকর যশবন্ত সিংএর সঙ্গে হিন্দুস্থানি ভাষায় কথা বলত। খাসগরে আমার দলে যোগ দেওয়া সাদিক আখুনের আগে আমার যে কাশ্মীরি চাকরটা সঙ্গে আসছিল, তাকে আনলে ওর সঙ্গে কাশ্মীরি ভাষায় কথা বলতে হত।ভাযাই ভাষা! এতগুলো ভিন্ন ভাযার সমারোহ এক জায়গায় হলেও কারো কথাবার্তা চালাতে অসুবিধা হচ্ছিল না। কারণ অনেক শব্দের মধ্যেই আশ্চর্য রকম মিল।
২৬ জুন খুদাবাদ থেকে মিসগরের পথে যাত্রা শুরু করেছিলাম। এই দূরত্বটা যে এই অংশের যাত্রাপথের সবচাইতে ভয়াবহ ভাগ তা আগেই জেনে গিয়েছিলাম। অনেকটা আল্পাইন ধাঁচের আরোহণ যে এই যাত্রায় হবে তা বুঝে সেইমত একটা ছকও কষে নিয়েছিলাম। উত্তর-পশ্চিম দিকের ইরশাদ আর চিলিঞ্জি পাসের কাছের হিমবাহ থেকে নেমে আসা চাপরসুন নদীর জল খুদাবাদের কাছে খুব ভোরে কম থাকে। সে সময় এই নদী পার হতে খুব একটা সমস্যা হয় না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীতে শুধু জলই বাড়ে না, স্রোতও ভয়ংকর রূপ নেয়। চক্কর কাটা লম্বা পথ এড়াতে খুব ভোরে নদী পার হয়েছিলাম। ওখানকার নদীর ওপরকার নড়বড়ে দড়ির সেতু ব্যবহারের ঝুঁকি আমরা নিইনি।
কিন্তু এই হাঁটার অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। আগের সমস্ত প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। খানিক পর পর শুধু তীক্ষ্ণ বাঁক বা রাফিকই ছিল না, সংকীর্ণ পথের একধারের মাটি-পাথরের দেওয়াল থেকে বেরিয়ে থাকা পাথরের টুকরোগুলো ছুরির ফলার মতো ধারালো। বাঁকের মুখে মাটি-পাথরের বুক খুদে তৈরি করা কোনরকমে পা রাখা যায়, এ’রকম সিঁড়ির মতো ধাপগুলো না থাকলে মালের বোঝা পিঠে নিয়ে এগোনো একটা অসম্ভব কাজ হত।প্রায় হামাগুড়ি দেবার মতো করে আলগা নুড়ির ওপর দিয়ে খাড়াই বেয়ে এগোতে হয়েছিল আমাদের। একচিলতে পায়ে চলার পথের ধারে গভীর খাড়া খাদ। খাদের নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে তুমুল খরস্রোতা নদী।একবার পা হড়কানো মানে সোজা কয়েক’শ ফুট নিচের নদীর বুকে পতন। আগের পাঁচদিনের হাঁটার অভিজ্ঞতা অবশ্য আমাদের এই ধরণের পথের সঙ্গে খানিক পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ফলে আগেই খানিক পথের চরিত্রের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে থাকায়, নির্বিঘ্নেই ভয়ংকরতম পথ পার হয়ে পৌঁছেছিলাম খুঞ্জেরাব নদীর গিরিসঙ্কটে। মিসগারের কয়েক মাইল আগে নির্জন মালভূমির এক অংশে দেখা হয়েছিল শুল্ক আদায়কারী জনাকয়েক পুরুষের সঙ্গে। ছোট্ট গ্রামের মাঝে তারা পথচারী ও ব্যবসায়ীদের মালপত্র পরীক্ষা করে শুল্ক আদায়ের কাজটা করে।
রুক্ষ পাথুরে সাম্রাজ্য আর হিমবাহ থেকে বেড়িয়ে আসা অগণিত ঝোরা পার হয়ে সবুজ চাষের ক্ষেতগুলো নজরে আসতে বুঝে গিয়েছিলাম পৌঁছে গিয়েছি মিসগারের চৌহদ্দিতে। চোখ খানিক আরাম পেয়েছিল সবুজ দেখতে পেয়ে। খুঞ্জেবার নদীর বাঁ-পাশে, নদী থেকে তিনশো ফুট মতো ওপরে মিসগারের জনপদ। গ্রামের পূর্বদিকের এক গিরিসঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসা স্ফটিক-স্বচ্ছ জলের ধারাকে ধরেবেঁধে ছোটো ছোটো নালার মাধ্যমে সেই জল নিয়ে যাওয়া হয়েছে উপত্যকার নানা অংশে। আর এই জলকে কাজে লাগিয়েই গড়ে উঠেছে একের পর এক চাষযোগ্য জমি আর ফলের বাগান। বাজরা আর ‘রিশখা’ গাছের কচি পাতাগুলো ফনফন করে বেড়ে উঠেছে, যদিও ফসল ঘরে তোলার এখনও ঢের দেরি। উপত্যকার পুব কোনার এই অংশে গ্রীষ্মের প্রভাব পড়ে খানিক দেরিতে।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বসত ভিটেগুলোর মাঝে খানিক ফাঁকা জমিতে আমারা আমাদের শিবির ফেললাম। বেশ কিছুদিন পর আবার সবুজ ঘেরা জায়গায় থাকার সুযোগ এল। জায়গাটার একদম পাশেই এক স্থানীয় সাধক পীর আকতাশ সাহেবের দরগা। দরগা ঘিরে বাতাসে পতপত করে উড়ছে অসংখ্য রংবেরং-এর পতাকা। ঠিক যেন সিকিম বা লাদাখের কোন বৌদ্ধ স্তূপ।
বিস্তীর্ণ, খোলা, সবুজে ছাওয়া উপত্যকার মাঝে আমাদের বর্তমান শিবির যেন বিগত কয়েকদিনের অন্ধকারাচ্ছন্ন বন্দীদশা থেকে মুক্তির সামিল। উত্তরপশ্চিমে যে বরফে ঢাকা শৈলশিরার অস্পষ্ট আভাষ দেখা যাচ্ছে তা অক্সাসের জলবিভাজিকার অংশ। বুঝিয়ে দিচ্ছিল আমরা পৌঁছে গিয়েছি পামিরের খুব কাছে।
মিসগারে এ’কদিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করা কুলির দলকে ছেড়ে দিলাম। ওদের তুলনা নেই। এই দুরারোহ বিপজ্জনক পথে আমাদের সঙ্গের মালপত্রের বোঝায় একটা আঁচড় লাগতে দেয়নি।
২৭ জুন আমরা মাল পরিবহণের জন্য নতুন দল নিলাম। এবার আর কুলি নয়। তরতাজা টাট্টুঘোড়ার দলের পিঠে মাল চাপালাম আমরা। সামনের পথ সারা বছর ধরে পশু চলাচলের উপযুক্ত। এ’পথ বিপজ্জনক না হলেও, সারা পথ বড়োবড়ো পাথরে বোঝাই থাকায় সেগুলো কাটিয়ে হাঁটাটা খুব ক্লান্তিকর ছিল।
তোপখানায় পৌঁছে দেখা পেয়েছিলাম প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া এক ওয়াচ-টাওয়ারের। এটা এক প্রাচীন বসতি ছিল। এখানেই আলাপ হল সারিকোলের এক হাসিখুশি স্বভাবের বাসিন্দার সঙ্গে। ওর পোশাক আর চেহারার বৈশিষ্ট্য বুঝিয়ে দিয়েছিল যে ও চীনা অঞ্চল থেকে এসেছে। ও ছিল মিনতাক গিরিপথে রাখা সৈন্যবাহিনীর একজন ‘কারৌল’ বা প্রহরী। ওকে পাঠানো হয়েছিল আমার আগমন সম্পর্কে খোঁজখবর নেবার জন্য। ওর পিঠে একটা আদ্যিকালের লম্বা গাদা বন্দুক ‘ম্যাচলক’ ঝোলানো ছিল।
পুরো চাইনিজ সাম্রাজ্য জুড়ে অধিকাংশ সৈন্যদের পিঠে এই ধরণের বন্দুক ঝোলে, এটা রাজকীয় সৈনিকদের একটা অপরিহার্য অংশ। লালচে গাল, পশমের টুপি, শক্তপোক্ত বুট আর লম্বা ঝুলের মোটা ‘চোগাস’ বা কোটে ছেলেটিকে মানিয়েছিল বেশ। একবারে রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর উপযুক্ত। ছেলেটি আমাকে প্রথমেই জানিয়ে দিল যে আমার পরবর্তী যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় ইয়াক আর টাট্টু ঘোড়ার দল তৈরি আছে। ওর মিশুকে ভাব দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন আমার দলের সঙ্গে প্রথম থেকেই আছে।
সীমান্ত অঞ্চল হলেও বাস্তবে এখানে সৈন্যবাহিনী নয়, ওয়াখি পশুপালকদের বাস। বারো মাইলের বেশি পথ হাঁটার পর আমরা পৌঁছোলাম মুরকুশিতে। এখান থেকে কিলাক আর মিন্টাকা যার পথ ভাগ হয়ে গেছে।
সীমান্ত অঞ্চলের নানা অংশ থেকে আসা একদল হাসিমুখের ঝলমলে পোশাক পরা ওয়াখি আমাকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছিল। ওরা সীমান্তের ওপারে ওদের ইয়াকগুলো ছেড়ে দিয়ে এসেছে, ওটা ভালো চারণভূমি হবার দরুন। রামধেনুর রঙ ধরানো ইয়ারখন্দের পোশাক পরা লোকগুলোকে দেখে আমার মন আনন্দে ভরে গিয়েছিল। লোকগুলোর ইরানিদের মতো ধারালো নাকমুখ আর ইউরোপিয়ানদের মতো গায়ের রঙের সঙ্গে অজস্র রঙ মেশানো কিরগিজিয় পোশাক এক আকর্ষণীয় বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছে বলে আমার মনে হয়েছে।
নদীর ধারে বার্চগাছের বনে যেখানে আমরা তাঁবু খাটিয়েছিলাম, সেখানে সেরকম ঠাণ্ডা ছিল না। অন্তত বারো হাজার ফুট উচ্চতায় যেরকম ঠাণ্ডা থাকা উচিৎ সেরকম ছিল না। পরদিন সকাল ছ’টায় থার্মোমিটারে তাপমাত্রা দেখেছিলাম সাড়ে আটচল্লিশ ডিগ্রি ফারেনহিট (৮.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস)।
২৮ জুন চার ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা পৌঁছেছিলাম উচ্চ মালভূমি শিরিন ময়দানে। শিরিন ময়দান কথাটির ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘মিল্কি প্লেইন’। এটা একেবারে কুলিক পাস-এর পাদদেশে। উচ্চতাজনিত শীতের কামড় এখানে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছিল। দুপুরবেলা নাগাদ সূর্য মেঘের আড়ালে চলে যেতেই তীব্র হাওয়ায় ভেসে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা কামড় বসাল শরীরে। লটবহর নিয়ে ইয়াকের দল পৌঁছতেই আমি আগে আমার ব্যাগ থেকে পশমের কোটটা বের করে গায়ে চড়িয়ে নিয়েছিলাম।
উত্তরের দিকে যে পাহাড়-সারিগুলো গিরিপথের কাছ ঘেঁষে গিয়েছে সেগুলোর ফাঁক দিয়ে দূরের বরফঢাকা চূড়াগুলো দেখা যাচ্ছিল। তাগদুম্বাসের দিকের জলবিভাজিকার থেকেও অপরূপ লাগছিল পশ্চিমদিকের পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে দৃশ্যমান বহুদূরে অবস্থিত একটি হিমবাহকে। ওর পিছনেই আছে অক্সাস আর আব-ই-পাঞ্জা নদীর উৎস।
এখন আর সঙ্গে কুলির দল নেই, এখন কোলাহলহীন শান্ত ক্যাম্পসাইট। মুহাম্মদ ইউসুফ, সারিকোলের মোড়ল আর তার সাত সঙ্গী যারা ইয়াকের দল নিয়ে আমার সঙ্গে চলছিল তাদের সঙ্গে কথা বলতে খুব ভালো লাগছিল। প্রাণোচ্ছল একটি দল। ওর তুর্কিতে ভালোই দক্ষ আর কথাবার্তাতেও ওস্তাদ। এতক্ষণে আমার মনে হতে শুরু করেছিল যে ভারত থেকে আমি অনেক দূরে চলে এসেছি।
তাকদুম্বাস পামিরে
২৯ জুন খুব ভোরে যখন কুলিক পাশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে আমরা তাঁবুটাঁবু গোটাতে শুরু করেছিলাম তখন জমির উপরিভাগে পাতলা স্বচ্ছ বরফের স্তর কাচের মতো জমে ছিল। আর ছোটো ছোটো জলের ধারাগুলো জমে প্রায় বরফের নদী হয়েছিল। যদিও তলায় তলায় কুলকুল করে জল বইছিল।
আমরা চেষ্টা করেছিলাম সকাল সকাল রওয়ানা দিতে, কিন্ত ইয়াকের পিঠে মালপত্র চাপিয়ে হাঁটা শুরু করতে করতেই সকাল আটটা বেজে গিয়েছিল। তাপ বাড়ার আগে রওয়ানা দিতে পারলে বরফ খানিক শক্ত পাওয়া যেত, তাতে চলতে সুবিধা হত। আগের দিনগুলোর তুলনায় ইয়াকদের সঙ্গে যাত্রায় আমার চাকররা হালকা হয়ে চলতে পেরে অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করছে দেখে ভালো লাগছিল। একটা কঠিন চড়াই পথ ওরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পার করে ফেলেছিল।
আস্তে আস্তে সামনের পথ ক্রমশই চওড়া হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। একটা প্রায় জমে থাকা জলাশয় দেখতে পেলাম। পুবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে একটি হাজার কুড়ি ফুট মতো উচ্চতার বরফ শৃঙ্গ। পশ্চিমদিক থেকে দুটো ছোটো হিমবাহ পাহাড়ের ফাঁক বেয়ে নেমে এসেছে। এই অঞ্চলই হল অক্সাস, সিন্ধু আর ইয়ারখন্দ নদীর জলবিভাজিকা।
মালভূমির মাথায় কুলিক পাস প্রায় মাইলখানেক চওড়া। এর মধ্যে জলবিভাজিকার সবচাইতে নীচু অংশ যে কোনটা তা বোঝা যাচ্ছিল না। যে জায়গাটা আমার সবচেয়ে নীচু মনে হয়েছিল সেখানে পৌঁছে খানিক থামলাম হাইপসোমিটারের জন্য জল গরম করার জন্য। মন সঠিক জায়গাটা নির্ধারণ করতে চাইছিল।
কনকনে ঠাণ্ডা আর ঝড়ো হাওয়ায় জল গরম করাটা বেশ ঝামেলার কাজ ছিল। কিন্তু যতক্ষণে হাইপসোমিটারে জল ভরে উচ্চতা ১৫৮০০ ফুট মাপতে পেরেছিলাম ততক্ষণে তুষারপাত শুরু হয়ে গিয়েছিল। উত্তরের কালো মেঘে ঢাকাটা দিকটায় রাশিয়ান পামিরের শুরু। ঠাণ্ডা হাওয়া মুখের খোলা অংশে ছুরির ফলার মতো আঘাত করতে করছিল। পা ডুবে যাওয়া নরম বরফে হাঁটাটা মোটেই সুখের ছিল না।
এই পথে ইয়াকগুলো বারবার প্রমাণ করে দিচ্ছিল ওরাই এই পরিস্থিতির জন্য আদর্শ। দুপুর একটার সময় পাক্কা দুঘণ্টা ধরে উৎরাই ভেঙে তাকদুম্বাস পামিরের মালভূমিতে পৌঁছেছিলাম। জায়গাটার নাম কক-তোরক। তুর্কি ভাষার এই শব্দটার মানে ‘নীল পাথর’।
যে জায়গায় আমাদের ক্যাম্প করার কথা ভাবছিলাম, সেদিকে এগোতেই একজন অশ্বারোহী ছুটে এল আমার দিকে। এসে আমাকে অভিবাদন করে জানালেন তিনি তাশকুরঘানে নিযুক্ত রাজনৈতিক মুন্সি শের মহম্মদ। মিস্টার ম্যাকাটর্নির নির্দেশে তিনি এসেছেন আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে। সুঠাম চেহারার প্রবল ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন শের মহম্মদকে দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিল। এক গুরুত্বপূর্ণ পদের অধিকারি সব কাজ ফেলে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছেন আমাকে স্বাগত জানাতে। তিনি আমাকে জানালেন যে তাশকুরঘান ছাড়িয়ে অনেক জায়গাতেই সারিকোলি বেগরা আমার দলের প্রতীক্ষায় আছেন।
মুন্সি শের মহম্মদ লাহোরের ওরিয়েন্টাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি জানতেন যে আমি ওই কলেজের দায়িত্বে ছিলাম দীর্ঘকাল। তিনি তাঁর সমস্ত প্রতিপত্তি খাটিয়ে আমার পরবর্তী যাত্রাপথের জন্য যা যা ব্যবস্থা দরকার সব করে রেখেছিলেন।
ঠাণ্ডাটা বিচ্ছিরি রকম পড়েছিল। ঝড়ো হাওয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। আমরা পৌঁছোবার খানিক পরেই শুরু হয়ে গিয়েছিল তুষারপাত। ১৮৯৭ সালে ক্যাপ্টেন ডেইজি ঠিক এই জায়গাতেই এক অভিযানের জন্য শিবির গেড়েছিলেন। তিনিই হিসেব করে জানিয়েছিলেন এই জায়গাটার উচ্চতা চোদ্দহাজার ফুটের মতো।
৩০ জুন সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙল তখন সুর্যদেব অনেকটাই মাথার ওপর চড়ে বসেছিলেন। সকাল ৬টায় তাঁবুর ভেতর তাপমাত্রা দেখাচ্ছিল ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হওয়া চলছিল না, ফলে ঠাণ্ডার কনকনে ভাব ততটা ছিল না। আশপাশের বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়াগুলো নীল আকাশের মাঝে ঝকঝক করছিল। সার্ভের কাজ করার জন্য একদম আদর্শ আবহাওয়া।
সকাল আটটার সময় আমি আর সার্ভেয়ার খুসবেল চূড়ার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। ওটাই আমাদের সার্ভে স্টেশন হিসেবে কাজ করবে। কুলিক পাস-এর উঁচু পাহাড়গুলো থেকে নেমে আসা পাহাড়গাত্রের একটা খোঁচ হল খুসবেল চূড়া। অন্য চূড়াগুলো থেকে খানিক দূরে একাকি দাঁড়িয়ে থাকায় খুসবেলের মাথা থেকে তাগদুম্বাসের অনেকটা অংশের পরিষ্কার দৃশ্য দেখা যায়।
আমরা ইয়াক নিয়ে শীর্ষের কাছাকাছি, ১৬,২৮০ ফুট উচ্চতায় পৌঁছে গেলাম। এই কঠিন পথে আমাদের ও আমাদের যন্ত্রপাতি পিঠে নিয়ে, প্রথমে খানিক ঘাস জমির ওপর দিয়ে, তারপর খানিক বরফে ঢাকা ঢাল বেয়ে ও শেষে আলাগা পাথরের ওপর দিয়ে ইয়াকের দল যে দক্ষতায় আমাদের ওই উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল তাতে এই অঞ্চলে অভিযান চালাতে এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কোনভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই।
এই অঞ্চলের অতি উচ্চতার প্রাথমিক অংশে পর্বতারোহণের প্রাথমিক অসুবিধাগুলো ইয়াক ব্যবহার করে অনেকটাই কম করা যেতে পারে। খুশবেলের চূড়া থেকে আমরা মুরঘাব আর হুঞ্জা উপত্যকার দিকের বেশ কিছু চূড়াকে চিনতে পেরেছিলাম। এই চূড়াগুলোকে চিহ্নিতকরণের কাজ ক্যাপ্টেন ডেইজি করে গিয়েছিলেন। সাব-সার্ভেয়ার রাম সিং যখন তার ‘প্লেন-টেবিল’ (সার্ভের কাজে ব্যবহৃত একধরণের ম্যাপিং যন্ত্র) নিয়ে কাজ করছিল তখন আমি ব্রিজ-লির ফটোথিওডোলাইট যন্ত্র নিয়ে পড়েছিলাম। এটা ছিল মধ্য এশিয়ায় ফটোথিওডোলাইট যন্ত্রের প্রথম ট্রায়াল।
দুপুর হতে না হতেই হাওয়া চড়তে শুরু করেছিল। সম্ভবত এটাই এখানকার আবহাওয়ার চরিত্র। সন্ধে ছ’টায় তাঁবুতে ফিরে স্বস্তি পেলাম।
কক-তোরক থেকে ওয়াখজির পাস এতো কাছে যে কিছুতেই জায়গাটা দেখার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। ওখানেই অক্সাস আর ইয়ারখন্দ নদীর জলবিভাজিকা। এখানে সাব-সার্ভেয়ার রাম সিং এর পাক্কা দুদিনের কাজ আছে। আমি একটা সামান্য পোঁটলা নিয়ে সাব-সার্ভেয়ার রাম সিংএর দায়িত্বে কক-তোরকের শিবিরের ভার দিয়ে ১লা জুলাই ওয়াখজির পাসের দিকে রওয়ানা দিলাম কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে।
খোলা উপত্যকা বেয়ে পশ্চিমমুখো মাইলপাঁচেক গিয়ে রাস্তাটা সরু হতে হতে একটা দক্ষিণ-পশ্চিমমুখো সংকীর্ণ উপত্যকায় পরিণত হয়েছিল। জায়গায় জায়গায় জমে থাকা বরফ আর কমে আসা ঘাস যা কক-তোরকের আশপাশে বিস্তর মেলে, বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে ক্রমেই আমি উঁচু থেকে আরো উঁচু এলাকায় পৌঁছোচ্ছি।
অবশেষে সমুদ্রতল থেকে ১৫,৩০০ ফুট ওপরে পৌঁছে খানিক শুকনো জায়গা দেখে আমরা তাঁবু খাটালাম। ইতিউতি বরফ জমে। কোথাও বা বরফ গলে মাটি-পাথর বেরিয়ে ছিল। জায়গাটা থেকে সামনের দিকে অসংখ্য ছোটো ছোটো হিমবাহ দেখা যাচ্ছিল। উপত্যকার দক্ষিণ দিকের ঢাল বস্তুত হিমাবাহের চাদরে ঢেকে ছিল।
পরদিনটা একবারে হয়রানির একশেষ হয়ে দাঁড়াল ঝড় আর বিপুল তুষারপাতের জন্য। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জ্বালানীর অভাব বোধ করছিলাম। এখানকার মোটা মোটা ঘাসের শুকনো শেকড়- যা সারিকোলিদের কাছে ‘ডিলডুং’ আর কিরগিজদের কাছে ‘বার্স’ নামে পরিচিত, আর ইয়াকের শুকিয়ে থাকা গোবর এই অঞ্চলে জ্বালানীর কাজ দেয়। কিন্তু অতো উঁচুতে সে-সব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পরদিন অবশ্য আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। আর পথ চলতে কোন অসুবিধা হয়নি। ঘণ্টা দেড়েক বরফের ওপর দিয়ে ইয়াকের পিঠে চেপে একটা লেকের পাশ ঘেঁষে পৌঁছে গিয়েছিলাম কাঙ্খিত জলবিভাজিকায়। হিমবাহ গলা জলে পুষ্ট দুটি ভিন্ন স্রোত বয়ে চলেছে এখান থেকে। একটা পাথরের ফাঁকে খানিক আগুন জ্বেলে জল গরম করে হাইপসোমিটারে ভরে দেখি জায়গাটার উচ্চতা দেখাচ্ছে ১৬,২০০ ফুটের মতো।
ক্রমশ