ধারাবাহিক অভিযান-খোটানের বালুসমাধিতে-অরেল স্টাইন-অনু-অরিন্দম দেবনাথ-শীত ২০২১

জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- ভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়)  অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)

obhijjaankhotancover

স্যার অরেল স্টাইন ছিলেন একজন ব্রিটিশ পুরাতাত্ত্বিক। ১৮৬২ সালের ২৬ নভেম্বর তাঁর জন্ম হাঙ্গেরিতে। তিনি ব্রিটিশ সময়কালে নানা ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। তিনি মধ্য এশিয়ায় একাধিক প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে নেতৃত্ব দেন। তিনি শুধু একজন প্রত্নতাত্ত্বিকই ছিলেন না, ছিলেন একজন নৃতাত্ত্বিক, ভূগোলবিদ, ভাষাবিদ এবং জরিপকারী।

ডানহুয়াং গুহা থেকে উদ্ধারকরা পুথি এবং পাণ্ডুলিপির সংগ্রহ মধ্য এশিয়ার ইতিহাস এবং বৌদ্ধধর্মের শিল্প ও সাহিত্যের অধ্যয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর অভিযান এবং আবিষ্কারের উপর বেশ কিছু বই লিখেছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাচীন খোটান, সেরিন্ডিয়া এবং আভ্যন্তরীণ এশিয়া বিষয়ক বই। সংস্কৃত থেকে রাজতরঙ্গিণীর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন তিনি।

চিরকুমার অরেল স্টাইন ১৯৪৩ সালের ২৬ অক্টোবর কাবুলে দেহত্যাগ করেছিলেন।

এই নিবন্ধে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে চলেছে তাঁর তাকলামাকান মরুভূমির প্রত্নতাত্ত্বিক খোটান অভিযানের কথা।

পর্ব-১

কলকাতা থেকে কাশ্মীর

obhijaankhotan01

কাশ্মীরের মোহন্দমার্গের আলপাইন অধিত্যকাতে টানা তিনটি গ্রীষ্ম আমার শিবির ছিল।

১৮৯৮-এর জুন মাসে ভারত সরকারের কাছে কাশ্মীরের পাহাড় পার হয়ে উত্তরের খোটানের মরুভূমিতে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা জমা দিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম। তারপর দু-বছর কেটে যাওয়ার পর ১৯০০ সালের মে মাসে আবার ফিরে গিয়েছিলাম ১০,০০০ ফুট উঁচু মোহন্দমার্গের শিবিরে। দূরের তুষারে ঢাকা পাহাড়গুলো আমাকে স্বাগত জানিয়েছিল। এখানে বসেই আমি মরুতে অভিযান চালানোর রূপরেখা ছকেছিলাম যে!

পাক্কা দু-বছর লেগিয়েছিল দিস্তা দিস্তা চিঠি আর ফাইল চালাচালি করে অনুমতি পেতে। অনেক টানাহ্যাঁচড়ার পর অভিযান চালানোর প্রস্তুতি শুরু করতে পেরে খানিক স্বস্তি এসেছিল। এরই মধ্যে সরকারি দায়িত্ব পালনের জন্য ছোটো ছোটো নানা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থল ঘোরাঘুরিতে ভারতের বহু জায়গা দেখার সুযোগ হয়ে গিয়েছিল। ছুটিগুলো মহানন্দে উপভোগ করতাম দৌড়াদৌড়ি করে। এর আগে লাহোরে এগারো বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে কাটিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সময় সবসময় যেন প্রাচ্যের প্রাচীন ছোঁয়া অনুভব করতাম। সেখান থেকে আমার বদলি হয়েছিল কলকাতায়। কলকাতার স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া আর পাশ্চাত্য ধাঁচের বড়ো বড়ো প্রাসাদে ভরা পরিবেশে আমার দম বন্ধ হয়ে আসত। মনে হত আমি বোধ হয় লন্ডনেই আছি।

কলকাতা থেকে আমি সিকিমে যাই। ওখান থেকেই দেখেছিলাম সবুজের মাঝে তিব্বতের বরফ ছাওয়া মালভূমি।

গিয়েছিলাম দক্ষিণ বিহারে। মগধে পৌঁছে বৌদ্ধ স্তূপ ও মঠগুলো পরিদর্শন করতে করতে উপলব্ধি করেছিলাম বিখ্যাত তিব্বতি পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ বর্ণিত ১২০০ বছর প্রাচীন ভারতের ঘ্রাণ।

দেখেছিলাম উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের ইন্দাস উপতক্যার অসাধারণ সব শিল্পকলা ও মূর্তি। যদিও প্রাচীন ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির আর মঠের গায়ে জড়িয়ে থাকা অসংখ্য ‘গ্রেকো-বুদ্ধিস্ট’ ভাস্কর্য খানিক বুড়ি ছোঁয়ার মতোই একঝলক দেখেছিলাম।

যতই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই না কেন, আমার মাথার পেছনে একটাই ছবি ঘুরে ফিরে আসত, হিমালয়ের ও-পারে কী আছে। মে মাসের ভ্যাপসা গরমের এক রাতে কলকাতায় বসে আমার অভিযানের প্রস্তাব অনুমোদন পেতে খানিক হাঁফ ছেড়েছিলাম। শুরু করেছিলাম প্রস্তুতি। এই অভিযানের জন্য হাজারও খুঁটিনাটি জিনিসের প্রয়োজন ছিল।

অভিযান শুরুর আগে অফিসের নানা কাজের পাশাপাশি অনেক লেখালেখিও শেষ করা জরুরি ছিল। ব্যক্তিগত সরঞ্জাম ছাড়াও প্রচুর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির প্রয়োজন ছিল অভিযানের জন্য। তার জোগাড়যন্ত্রটাও একটা ছোটো অভিযান। তাঁবুর অর্ডার দিয়েছিলাম কৌনপোর (কানপুর) এলগিন মিলসকে। গ্যালভানাইজড লোহা দিয়ে জলের ট্যাঙ্ক বানাতে বলেছিলাম কলকাতার এক কারখানাকে। মরুভূমিতে এগুলো সব লাগবে। টিনবন্দি খাবার, ছবি তোলার সরঞ্জাম, আর অনেকটা আর্টিক অঞ্চলে কাটানোর উপযোগী শীতবস্ত্রের অর্ডার করেছিলাম লন্ডনে।

ঝিলম উপত্যকায়

অভিযানের সব সরঞ্জাম এক এক করে শ্রীনগরে পৌঁছচ্ছিল।

শহুরে কলকাতায় নয়, শ্রীনগরে বসেই আসল অভিযানের প্রস্তুতি সম্ভব ছিল। অপরিচ্ছন্ন কলকাতায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়াতে খারাপ লাগলেও আমি খানিক আনন্দ পেয়েছিলাম। প্লেগের হাত থেকে রক্ষা পেতে কলকাতা অফিস গ্রীষ্মের ঢের আগেই গ্রীষ্মকালীন ছুটি ঘোষণা করে দিয়েছিল। ফলে আমিও অফিসের কাজ থেকে ছাড়া পেয়ে এপ্রিলের এক তারিখে উত্তরের দিকে রওয়ানা দিয়েছিলাম। যাত্রা শুরুর আগে অধুনা প্রয়াত বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জন উডবার্নের সঙ্গে দেখা করে আমার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম। উনি ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহ প্রকাশ করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দিলে এই অভিযান করা যেত না।

সপ্তাহটাক সময় লাহোরে কাটিয়েছিলাম অভিযানের প্রস্তুতিতে। পোশাক-আশাক ছাড়াও অনেক খুঁটিনাটি জিনিস দরকার ছিল। এই কাজে লাহোরের পুরোনো বন্ধুরা আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। শুধু কেনাকাটা নয়, সেগুলো কাশ্মীরে পাঠানোর বন্দোবস্তও করতে হয়েছিল। কলকাতার তুলনায় পাঞ্জাবের বসন্ত অনেক অনেক আরামদায়ক। রাওয়ালপিন্ডিতে টাঙ্গায় চেপে মুরির দিকে যেতে যেতে ঝিলম উপত্যকার ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে গিয়েছিল। আমি লাহোরে থাকাকালীন প্রাচীন হাইডাসপেস (Hydaspes) ধরে প্রায়শই বেরিয়ে পড়তাম। ঝিলম এখানেই পাহাড় থেকে সমতলে মিশেছে। তবে আসতাম আরও খানিক পরে। আরও গরম পড়লে। তখন ছোটো ছোটো গাছের ঝাড়গুলো ফুলে ছেয়ে উঠত। মিষ্টি গন্ধ মিশে থাকত হাওয়ায়। দূরে বরফ ঢাকা পাহাড়ের বরফে ঢাকা চূড়াগুলো চকচকে  করত।

২৫ এপ্রিল বারামুল্লা উপত্যকায় আরও একবার পা রাখলাম। প্রাচীনকালে এই বারামুল্লাই ছিল কাশ্মীরে প্রবেশের পশ্চিমের দরজা। দূরের পিরপাঞ্জাল এখনও বরফে মুড়ে। এই পিরপাঞ্জাল পর্বতমালাই প্রাচীরের মতো কাশ্মীরকে বাকি দুনিয়া থেকে আড়াল করে রেখেছে। বারমুল্লা থেকে সামনের নদী-সমতল ফুলে ছেয়ে। বসন্ত-কার্পেট বিছিয়েছে সর্বত্র। নীল-সাদা… ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে আনাচকানাচ।

বারামুল্লাতে আমার চাকরের দল অপেক্ষা করছিল। ভারী লটবহর নিয়ে ওদের আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এখান থেকে শ্রীনগরে যাওয়ার জন্য আমরা নৌকোয় উঠেছিলাম। আমার আগের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, শ্রীনগরে যাওয়ার এর থেকে মনোমুগ্ধকর যাত্রাপথ আর হয় না।

সে-দিনটা একটা টাঙ্গা নিয়ে পরিচিত উলার লেকের আশেপাশে চষে বেড়িয়েছিলাম। বেশ কয়েকমাস পর ঝিলমের ফুরফুরে বাতাস সব ক্লান্তি মুছিয়ে আমাকে চাঙ্গা করে করে দিয়েছিল। অজস্র শাপলা আর জলজ ফুলের দঙ্গল জলের মধ্যে মাথা তুলে ছিল।

ঝিলম নদীর ঘাট আর চিনারগাছের ছায়ায় ঢাকা আশেপাশের গ্রামগুলো। পিরপাঞ্জালের তুষারাবৃত ওই উঁচু চূড়াগুলো, যাদের ঘিরে আমার যাত্রা শুরু হবে আর দিন কয়েকের মধ্যে, তাদের স্নিগ্ধতা, মাধুর্য আর আকর্ষণ কোনোদিন ম্লান হবার নয়।

দ্বিতীয় রাতে উপত্যকাকে বেড় দিয়ে আমাদের নৌকো শ্রীনগরের অন্য পারে পৌঁছেছিল। প্রতি নৌকোযাত্রার পর উপত্যকার নতুন রূপ ফুটে উঠত আমার চোখের সামনে। পরদিন সকালে নদী পার হয়ে আমার প্রিয় চিনারবাগের ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে পা রাখতেই মনটা আনন্দে নেচে উঠেছিল।

প্রতিবছরই ভারতের সমতল থেকে দলে দলে ছুটি কাটাতে আসা ইউরোপিয়ানদের দৌলতে আপেল বাগানের ছায়াঘেরা শ্রীনগরের নিরিবিলিত্ব অনেকটাই চলে গিয়েছিল। পাশাপাশি সারাদিন চলা কাশ্মীরি ব্যবসায়ী আর হস্তশিল্পীদের ‘সাহেব’দের ক্যাম্পিংয়ের বায়নাক্কা আর চাহিদা মেটানোর কচকচানিতে পুরো অঞ্চলটা একটা বাজারের মতো হয়ে উঠেছিল। সে যাই হোক, শ্রীনগরে এটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা।

অভিযানের জন্য অনেক কিছু জোগাড় করা বাকি ছিল। যেমন ঘোড়া, বাক্স, চামড়া মোড়া ঝুড়ি… এতে খাবারদাবার, নানা যন্ত্রপাতি ভরে নিয়ে যেতে হবে। চামড়ার কোট ও নানাধরনের গরম জামাকাপড় প্রচুর পরিমাণে দরকার ছিল নিজের ও আমার দলবলের জন্য। পামির আর  তুর্কিস্থানের প্রচণ্ড ঠান্ডা থেকে বাঁচতে এগুলো লাগবেই লাগবে। অনেক থলেও দরকার। আমার আগের অভিজ্ঞতা বলে, ব্যক্তিগত সরঞ্জাম সহ অভিযানের সব জিনিসপত্র ঠিকঠাক রাখতে বোঁচকাবুঁচকি ঠিকমতো বাঁধাছাঁদা ভীষণ জরুরি। দুর্গম অজানা পথে তো বটেই।

কাশ্মীরি কারিগররা ভীষণ বুদ্ধিমান। কঠিন আবহাওয়ায় জিনিসপত্র কী করে নিরাপদে টিকিয়ে রাখতে হয় তা ভালোই জানে। তাছাড়া অভিযানের মালপত্র যাবে ঘোড়া বা মানুষের পিঠে চেপে। তাই থলের মান ঠিক হওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই নিয়ে কারিগরদের সঙ্গে পদে পদে প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছিল। সঙ্গে দর কষাকষি তো ছিলই। চূড়ান্ত ব্যস্ততার পাশাপাশি সামনের যাত্রাপথ প্রথম ভাগ নিয়ে খোঁজখবর জড়ো করছিলাম।

ভারত সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তর কাশগড় যাবার জন্য আমাকে গিলগিট-হুনজা গিরিপথ ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন। ‘গিলগিট ট্রান্সপোর্ট রোড’ ব্যবহারে বেশ কয়েকটি শর্ত ছিল। যেমন আমাকে আগেভাগে যাত্রার সময়, দলের লোকসংখ্যা, লটবহর নিয়ে যেতে ব্যবহৃত পরিবহণের ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি জানাতে হবে। আমি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম মে মাসের শেষাশেষি যাত্রা শুরু করব। কারণ, ওটাই ওই গিরিপথ দিয়ে যাতায়াতের শ্রেষ্ঠ সময়। আমার সৌভাগ্য ক্যাপ্টেন জি. এইচ. ব্রেথারটন, ডি. এস. সি, কাশ্মীরের সহকারী কমিশনার জেনারেল, যাঁকে এই বিষয়গুলো আমার জানানোর কথা, তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন আমাকে সাহায্য করতে। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি আমাকে সমস্ত পথের বর্ণনাই শুধু দেননি, কী কী নিতে হবে, কতটা নিতে হবে, কীভাবে এগোতে হবে তার নিখুঁত ফর্দ বানিয়ে দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র হুনজা পর্যন্তই নয়, একেবারে চিনের সীমান্ত পর্যন্ত পরিকল্পনা ছকে দিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেনের কষে দেওয়া ছক আমার দারুণ কাজে এসেছিল। এই ছকের সাহায্যেই আমি ঝটপট আমার দলের সব তথ্য গিলগিট আর কাশগড়ে আগেভাগে পাঠিয়ে অনুমতি সংক্রান্ত অনেক সময় বাঁচিয়ে ফেলেছিলাম। মাত্র পাঁচদিনের মধ্যেই আমার যাত্রাপথের যাবতীয় কাগজপত্র তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে যে ক’দিন বেঁচে ছিল, সে সময়গুলো আমি নিশ্চিন্তে লেখালেখিতে কাজে লাগিয়েছিলাম। এই লেখালেখিগুলো কাশ্মীর ছাড়ার আগে আমায় শেষ করতেই হত।

গত দশ বছরে যখনই কাজের বাইরে অবসর পেয়েছি তখনই মেতে থেকেছি সংস্কৃতে লেখা রাজতরঙ্গিণী থেকে ‘কাশ্মীরের রাজাদের ক্রমপঞ্জিকা’ তৈরিতে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সাহিত্যে একমাত্র মহান কবি কলহনের সংস্কৃত-গাথাতেই কাশ্মীরের ইতিহাসের লিখিত বিবরণ আছে। ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিকতা, ভূগোল আর ধর্ম সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে পাঠরত শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু বিষয় আমি ইতিপূর্বে সম্পাদনা করেছি। কিন্তু আমার করা অনুবাদ আর ভাষ্যের জন্য কাশ্মীরে এই বিষয় সংক্রান্ত যা কিছু অবশিষ্ট আছে তা খুঁজে বের করে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন। শুধু প্রাচীন দলিল বা দস্তাবেজই নয়, লোকগীতি, আচার-অনুষ্ঠান, লোককথা সবকিছুরই বিশ্লেষণ আবশ্যক। প্রয়োজন এগুলোর সংরক্ষণও। এই নিয়ে লেখা দুটি খণ্ডের বিশাল কাজ বই আকারে ছাপার অবস্থায় এসে গেছে, শুধু এই কাজের জন্য পাগল করা খাটনির কথা মানে যাকে বলে মুখবন্ধ, আর পুস্তক পরিচিতির কথা লেখাটাই শেষ করতে হবে। ঠিক সময়ে সব শেষ করার জন্য নির্জনতা ভীষণ প্রয়োজন ছিল।

নির্জনতা আর মনের একাগ্রতা ভীষণ দরকার। শ্রীনগর আর তার আশপাশ যে এর জন্য উপযুক্ত তাতে কোনও দ্বিমত নেই। মোহন্দমার্গ-এর আমার পাহাড়ি আবাসস্থলের তুলনা নেই। দূরের পাহাড়গুলো এখনও তুষারে ঢাকা।

কাশ্মীরের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে আমার জ্ঞান আমাকে অনেক কিছু সহজেই খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে। ফলে সামান্য ঘোরাঘুরির পরই সিন্ধু উপত্যকায় যেখান থেকে মোহন্দমার্গের উত্থান শুরু হয়েছে সেখানে দুদারহম গ্রামের কাছে নদীর ধারে আমি আমার তাঁবু ফেলেছিলাম। চিনারগাছের ছায়ার নীচের তাঁবু থেকে দূরের হারামুখ (Haramukh) পর্বতের উঁচু বরফ ঢাকা চূড়াগুলোকে সঙ্গী করে আমি দিনরাত কাজে মেতে ছিলাম।

obhijaankhotan02

একটা সুবিশাল বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিনের কাজ পুনরায় পর্যালোচনা করে, স্বল্প সময়ে তার সংক্ষিপ্তসার লেখা খুবই কঠিন কাজ ছিল। তবুও কাজটা ঠিক ঠিকমতো করতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। সন্দেহ নেই উপতক্যার চিনারের ছায়া আর দূরের বরফঢাকা পর্বতরাজি আমাকে মনের প্রশান্তি ধরে রেখে কাশ্মীর বিষয়ক গবেষণার কাজটা করতে সাহায্য করেছিল। আমি উত্তেজনায় ছটফট করছিলাম আরও উত্তরে গিয়ে আমার ভবিষ্যৎ অভিযানের দিকে। সেই উত্তরের দিকে, যা এই মোহন্দমার্গ থেকে দূরে বহুদূরে।

মনে কোনও চাপ না থাকায় বিগত কিছুদিনের ছোটাছুটি পর নির্বিঘ্ন মনের কাজটা ছিল অনেকটা ছুটি কাটানোর সামিল। ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে শান্তিতে বসে আমি আমার লেখার শেষ অংশ ২৩ মে শেষ করেছিলাম।

অভিযান শুরুর দিন ঘনিয়ে এসেছিল। কাজেই ভিড়াক্রান্ত শ্রীনগরে ফিরে যেতে হয়েছিল অভিযানের শেষে মুহূর্তের খুঁটিনাটি কাজগুলো সেরে নিতে।

কাশ্মীরের প্রাণজুড়ানো জলপথের জবাব নেই। আনচার লেকের সঙ্গে প্রাচীন মার খাল দিয়ে ডাল লেকের সঙ্গে যুক্ত জলপথ ধরে একরাতের নৌকাযাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিলাম শ্রীনগরে। গিয়ে দেখেছিলাম থিক থিক করছে ইউরোপিয়ানদের ভিড়। এর আগে একসঙ্গে এত লোকসমাগম দেখিনি। শিকারাগুলো সব ভর্তি। লেকের ধারে সার সার তাঁবু খাটান। কোথাও নতুন করে তাঁবু খাটানোর জায়গা নেই। আমার ওই অঞ্চল সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকায় ক্যাম্প করার ভালো জায়গা খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি। শহরের পশ্চিমে তখত-ই-সুলায়ামান পাহাড়ের নীচে একটা খোঁচের মতো অংশে আমার তাঁবু খাটিয়েছিলাম। এখান থেকে শ্রীনগর শহর আর ডাল লেকের অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়। উইলোর জঙ্গল আর লেকের ভাসমান বাগানের পেছনে লুকোনো এই অংশ ছিল আমার অভিযান শুরুর গোছগাছ শেষ করার জন্য যাকে বলে একেবারে আদর্শ স্থান।

ওখানের দিনগুলো কেটেছিল চূড়ান্ত ব্যস্ততায়। অভিযানের জন্য জোগাড় করা প্রতিটি জিনিস শেষবারের মতো ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নেওয়া। নতুন আসা জিনিসপত্র মিলিয়ে নেওয়া। তারপর সেগুলো খচ্চরের পিঠে চাপানোর মতো করে বস্তাবন্দি করা। প্রয়োজনীয় প্রতিটি যন্ত্রপাতি ঠিকমতো কাজ করছে কি না দেখে সেগুলো যাতে কুলি বা ঘোড়ার পিঠে নিতে গিয়ে কোনোভাবেই ভেঙেচুরে না যায় তা নিশ্চিত করাও খুব জরুরি ছিল। এছাড়া সামলাতে হচ্ছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে আসা কাশ্মীরি বন্ধুদের। শুভানুধ্যায়ী কাশ্মীরি পণ্ডিত বন্ধুদের অভিযানের যাত্রাপথ আর উদ্দেশ্য বার বার করে বুঝিয়ে বলতে হচ্ছিল। ওঁরা আমার যাত্রার উদ্দেশ্যের পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে পরিচিত থাকলেও যাত্রাপথের অনিশ্চয়তা বা ভয়াবহতা আন্দাজ করতে পারছিল না। ‘উত্তরাকুরু’ – যে প্রাচীন বৈদিক সভ্যতার কথকতার জগতে আমি যাত্রা করতে চলেছিলাম, তা নিয়ে আমি কিছুতেই ওঁদের সংশয় দূর করতে পারছিলাম না।

ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল কর্নেল সেন্ট জর্জ গোর, তাঁর অধীনে কর্মরত গুর্খা উপ-জরিপকার রাম সিংকে বিভাগীয় যন্ত্রপাতি সহ আমার অভিযানে অংশগ্রহণকারী হিসেবে কাজ করতে অনুমতি দিয়েছিলেন। যেদিন আমি শ্রীনগরে পৌঁছেছিলাম, কথামতো রাম সিং ঠিক সেইদিনই পৌঁছে গিয়েছিলেন শ্রীনগরে। কিছুদিন আগেই তিনি ক্যাপ্টেন ডেইসির সঙ্গে কারাকোরাম পর্বতমালার ইয়ারকান্দ (Yarkand) নদীর উৎসমুখের খুব কাছ পর্যন্ত গিয়েছিলেন। এছাড়া কুনলুন পর্বতেও ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। ওঁর ওই অঞ্চল সম্পর্কে ব্যবহারিক পরিচয় আমাদের অভিযানের প্রস্তুতিতে একটা বড়ো সম্পদ হয়ে উঠেছিল। রাম সিংয়ের সঙ্গেই এসেছিল যশবন্ত সিং। রোগা টিংটিঙে কাংরা রাজপুত, রাম সিংয়ের ব্যক্তিগত চাকর ও রাঁধুনি। যশবন্তও ক্যাপ্টেন ডেইসির দলে চিনের তুর্কিস্থান অভিযানে ছিল।

২৮ মে আমাদের দলে যোগ দিল সাদাক আকুন। এক তুর্কিস্থানি চাকর। কাশগড়ের ব্রিটিশ প্রতিনিধি মি. জর্জ জ্যাকার্টনে, সি.এল.ই, আমার জন্য ওকে পাঠিয়েছেন। এপ্রিলের প্রথমদিকে বাড়ি থেকে রওনা হয়ে একদম ঠিক সময়ে এসে যোগ দিয়েছিল আমার দলে। আমার দলে ওর ভূমিকা হবে রাঁধুনি তথা সর্দার গোছের। কোকান্দ অঞ্চলের লোক মির্জা আলম, যাকে আমি মাস চারেক আগে পেশোয়ারে আমার চাকর হিসেবে নিযুক্ত করেছিলাম, সে মন থেকেই সাদাককে স্বাগত জানিয়েছিল। মির্জা এ-ক’দিন ধরে আমাকে কাজ চালানোর মতো তুর্কি ভাষা শিখিয়েছে। কিন্তু সাহেবের চাহিদামতো তুর্কি সাহিত্য থেকে নানা কাহিনি না শোনাতে পেরে খানিক হতাশ হয়ে পড়েছিল। বেচারার করারই-বা কী ছিল! দিনের অধিকাংশ সময় ওকে রান্নাবান্না নিয়েই পড়ে থাকতে হয়েছিল। আমার কাজে যোগ দেবার আগে মির্জা, কাবুল আর পেশোয়ারে খুচখাচ ব্যাবসা করত। যে কাজ আমার এখানে ওকে করতে হচ্ছিল তার জন্য ও মোটেই মন থেকে তৈরি ছিল না। ওর কথা শুনে ওকে কাজে ধরে রাখতে পারব কি না তা নিয়ে আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। সাদাক এসে যাওয়াতে আমরা দুজনেই হাঁফ ছেড়ে ছিলাম। মির্জার দায়িত্ব বদলে ওকে যাত্রাকালীন সময় মালপত্র দেখাশোনার ভার দিয়েছিলাম। সাদাক আকুনের উপস্থিতি শুধু একজন  সর্দারের মতোই ছিল না, ওর ইউরোপিয়ান রান্নার শিক্ষা আমার চাহিদা মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল। ও পশমের টুপি মাথায়, টানটান ধোপদুরস্ত পোশাকে, হাঁটু পর্যন্ত উঁচু লাল রঙের বুট পরে ক্যাম্পের মধ্যে চলাফেরা করা শুরু করাতে ক্যাম্পের মধ্যে সত্যিকারের মধ্য এশিয়ার রঙের ছোঁয়া লেগিয়েছিল।

কিন্তু শুধুমাত্র উত্তরের ছোঁয়া আমার দুশ্চিন্তা দূর করতে পারছিল না। আমি জেনে গিয়েছিলাম, আমি যেখানে অভিযানে যাচ্ছি সেখানে কোনও ইউরোপিয়ান চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়ে সঙ্গী হবে না। আমি তাই প্রয়োজনীয় ওষুধের অর্ডার লন্ডনের মেসার্স বার্গ ওয়েলকাম কোম্পানিকে দিয়ে রেখেছিলাম। এরা ছোটোখাটো অসুখের ওষুধের জন্য বিখ্যাত। দক্ষিণ আফ্রিকার যুদ্ধ ছাড়াও অন্যান্য কারণে ওষুধগুলো এসে পৌঁছতে দেরি করছিল। ওষুধগুলো কলকাতা পৌঁছানোর খবর টেলিগ্রাম মারফত পেলেও আমার সন্দেহ ছিল ঠিক সময়মতো ওগুলো হাতে পাব কি না। ইন্ডিয়া পোস্ট যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে গিলগিটের মতো সীমান্ত অঞ্চলে মালপত্র পৌঁছানোর চেষ্টা করলেও কাজটা সহজ ছিল না। বরফঢাকা গিরিপথে গতি শ্লথ হতে বাধ্য। সময়ে শ্রীনগরে আমার কাছে  ওষুধ পৌঁছানোর আশা খুবই কম ছিল। ভাগ্য আমার সহায় ছিল। ২৯ মে যাত্রা শুরুর আগেরদিন সন্ধেবেলা ছোটো নৌকোয় লেকের ওপর শ্রীনগর পোস্ট অফিসের কাছেই বসে ছিলাম। তখন পোস্টমাস্টার লালা মাঙ্গু হাঁক পেড়ে আমাকে ওষুধের বাক্স পৌঁছানোর খবর দিয়েছিলেন।

আমার হাতে ওষুধের বাক্স সঁপে দিয়ে উনিও যেন খানিক নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। ভারতের ভেনিস থেকে আমার বিদায় নেবার সময় হয়ে গিয়েছিল। নদী বেয়ে যেতে যেতে মন্দিরের ভাঙা চাতাল দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল ঈশ্বরের করুণা আমার ওপর বর্ষিত হয়েছে। প্রায় মধ্যরাতেও নিজ নিজ বাড়ির কাছের ঘাটে আমার কাশ্মীরি পণ্ডিত বন্ধুরা আলো হাতে আমাকে বিদায় জানানোর অপেক্ষায় ছিলেন।

সকালে নৌকায় ঘুম ভাঙতে দেখি আমার নৌকা উলার লেকের এক খাঁড়িতে ঢুকছে। উত্তরের দিকে বরফঢাকা পাহাড়ের মাথায় মেঘের সমারোহ বুঝিয়ে দিচ্ছিল গত কয়েকদিনের বৃষ্টি গিরিপথগুলোতে নতুন করে বরফ ঝরিয়েছে। আর ওই পথ দিয়েই আমাদের যেতে হবে। খানিক বাদেই বান্দিপুর গ্রামে পৌঁছেছিলাম। এখান থেকেই শুরু হবে গিলগিটের পথে যাত্রা।

obhijaankhotan03

গিলগিটের পথে

পথটা খুব চেনা মনে ঠেকছিল, ১৮৮৯ সালে স্কার্দু উপত্যকায় এই পথ দিয়েই গিয়েছিলাম। কিন্তু পথের বদল খুব নজরে আসছিল, বিশেষ করে পরিবহণ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হয়েছে। গিলগিটে ‘ইম্পেরিয়াল গ্যারিসন’ স্থাপনের পর নবনির্মিত ‘গিলগিট ট্রান্সপোর্ট রোড’-এর এই উন্নতি। ইন্ডিয়ান কমিশনারেট বিভাগ এখন এই রাস্তায় যানবাহনের দায়িত্বে।

ক্যাপ্টেন ব্রেথারটন আমার তরফে আগেভাগেই সব ব্যবস্থা করে রাখায় ভীষণ সুবিধা হয়েছিল। আমাদের দলের জন্য কুলি আর মালবাহী ঘোড়া পেতে যাতে কোনও অসুবিধা না হয় সে বিষয়টা একজন কমিশনারেটের ওয়ারেন্ট অফিসার নিশ্চিন্ত করছিলেন। সময়মতো এ-পথে কুলি আর  ঘোড়ার সরবরাহ ভীষণ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। গিলগিট সেনাছাউনিতে নিয়মিত মালপত্রের সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য এই পথে পর্যটকদের যাত্রা ও  সংখ্যা প্রায়শই নিয়ন্ত্রিত হয়।

আমার মনে আছে, একটা সময় ছিল যখন এই পথে কুলি পেতে নাজেহাল হতে হত। সেনাবাহিনীর মালপত্র টানতে কুলির এত চাহিদা হত যে, কাশ্মীরের গ্রামের পর গ্রামের বিপুল সংখ্যক লোককে এই কাজে টেনে নেওয়া হত। গ্রামে গ্রামে আতঙ্কের ছায়া নেমে আসত। হাজারে হাজারে চাষি এই কাজে নিয়োজিত হত। এদের অনেকেরই আর গ্রামে ফেরা হত না। অপর্যাপ্ত পোশাক আর খাদ্য অথবা মহামারীর কবলে পড়ে অধিকাংশই মারা যেত। ইন্ডিয়ান কমিশনারেট এই পথের দায়িত্ব নেবার পর এখন পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। গিলগিট রোড নতুন করে তৈরি হবার পর এই পথ উট ও অন্যান্য ভারবাহী পশু চলাচলের উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল। ফলে গ্রীষ্মের তিন মাসে মানবশ্রমের ব্যবহার আর খুব দরকার হত না।

৩১ মে সকালে ১৬টা ঘোড়া এসে গেল আমাদের তাঁবু, খাবারদাবার সহ অন্যান্য বোঝা বইবার জন্য। আমার কাছে এই লটবহর খুব বেশি মনে হচ্ছিল। কারণ, আমি এতদিন কাশ্মীরের আনাচকানাচ ঘুরে বেড়িয়েছি খুব কম মালপত্র নিয়ে। তবে আমার দেখে ভালো লাগছিল লটবহরের মধ্যে আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের পুঁটলিটাই সবচাইতে ছোটো।

মালবাহী পশু, উপ-জরিপকারী আর চাকরের দল রওনা দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেও খানিক অপেক্ষা করতে হল কমিশনারেটের করণিকের তৈরি একগুচ্ছ কাগজপত্রে সই করে টাকাপয়সা মেটানোর জন্য। কমিশনারেটের অফিসের ছাড়পত্র ছাড়া কারও এই পথ ধরে এগোনোর অনুমতি নেই। যদিও বিষয়টা দক্ষতার সঙ্গেই সামলায় ওরা, তবুও আমার মনে হয় এটা ব্রিটিশ অফিসারদের অযাচিত খবরদারি। কাশ্মীরের প্রাচীন উপত্যকায় ঢোকার সব পথকে ওরা কড়া নজদারিতে রাখতে চায়। বান্দিপুর বাজারের ভেতরের একসার কাঠের কুঁড়ের ধার দিয়ে মাইল চারেক যাবার পর মধুমতী ঝোরার পাশের খোলা জায়গায় পৌঁছেছিলাম। মধুমতীর দু-পাশের রৌদ্রোজ্জ্বল চাষের ক্ষেতে সবুজ ধান গাছে সবে ছড়া এসেছে। ক্ষেত ছাড়িয়ে চিনার আর  আখরোট গাছের ছায়ার আধো অন্ধকারে ঢেকে একের পর এক গ্রাম। আর দূরে পাহাড়শ্রেণি। বসন্তের এই দৃশ্য একান্তই কাশ্মীরের। আর এসব ছেড়ে আমি চলেছি অনেক অনেক দূরের অজানা এক সাম্রাজ্যের খোঁজে। মাতারগম গ্রামের কাছ থেকে উত্তরের দিকে এঁকে-বেঁকে চড়াই পথের শুরু হয়েছিল। কৃষ্ণাগঙ্গা আর কাশ্মীর উপতক্যার জলবিভাজিকার রূপ এখানে স্পষ্ট। প্রবল বেগে হাওয়া বইতে থাকা চড়াইয়ের এক বাঁকের মুখ থেকে উলার লেককে সামনে রেখে তুষারঘেরা পাহাড়শ্রেণির মাঝে বরফঢাকা উত্তুঙ্গ হারমুখ শৃঙ্গের এক অসাধারণ দৃশ্য আমাকে মোহিত করে দিয়েছিল। নয় হাজার ফুট উঁচু পাইনের বনের মাঝ দিয়ে যেতে যেতে ট্রাগবল নামের এক জায়গায় পৌঁছানোর পর চোখের সামনে থেকে তুষারমৌনিরা সব উধাও হয়ে গিয়েছিল, এসেছিল স্যাঁতস্যাঁতে জমিতে কার্পেট হয়ে থাকা পাহাড়ি ফুলের সাম্রাজ্য।

একটা ভাঙাচোরা ছাতা পড়া কাঠের গেস্ট হাউস নজরে পড়তে ওখানেই প্রথম রাতের আস্তানা গেড়েছিলাম আমরা। ভালোই হয়েছিল, অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে না আসতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল ঝড়। ঝড়ের সঙ্গে যা অবধারিত ছিল, সেই তুষারপাত শুরু হয়ে গিয়েছিল অচিরেই।

সদ্য ঝরা তুষারে আমাদের চলার পথ হয়ে উঠেছিল ভয়াবহ। সামনে কম করেও হাজার দুয়েক ফুটের চড়াই। তারপর বেশ কয়েক মাইল খাড়া পাহাড়ের ন্যাড়া মাথা ধরে প্রবল হাওয়ার সঙ্গে যুঝতে যুঝতে যাত্রা। সদ্য তুষারপাতে রাস্তার চিহ্ন বলে কিছু ছিল না। মেঘলা আকাশ সূর্যের রশ্মিকে আটকে দিয়েছিল। ফলে তুষার জমে শক্ত হয়ে ছিল। খানিক পরেই আবার শুরু হয়ে গিয়েছিল জোরকদমে তুষার ঝরা। প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়ায়, কাঁপতে কাঁপতে আমরা ছুটেছিলাম সামনের ডাকবাহকদের আস্তানার দিকে। খানিক বাদেই তুষারপাত বন্ধ হয়ে গেলেও ১১,৯০০ ফুট উঁচু ট্রাগবল পাসের কুখ্যাতির প্রমাণ মনে গেঁথে গিয়েছিল।

ট্রাগবল পাস থেকে নামার সময় আমাকে ঘোড়ার দলের মালিক ‘শীতকালীন’ পথ ধরে চলার কথা বলেছিল। এই পথ খাড়া নামলে নাকি দ্রুত পৌঁছানো যায় বরফঢাকা নালার কাছে। নরম তুষারে ছেয়ে থাকলেও ঘোড়ার দল কোনও অঘটন না ঘটিয়েই দ্রুত পৌঁছেছিল নালার কাছে।

কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছিল কৃষ্ণাগঙ্গা উপত্যকার দিকে প্রবাহিত নালার ওপরে জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করায়। এমন একটা জায়গাও আমরা পাচ্ছিলাম না, যেখানকার শক্ত বরফের ওপর দিয়ে হেঁটে অনায়াসে নালা পার হওয়া যায়। নালার ধার ধরে লটবহর পিঠে চাপানো পশুর দল নিয়ে হেঁটে সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছে নালা পার হবার চেষ্টা একদম অবাস্তবিক হত। একটাই উপায় ছিল, যে ঢালু পথ দিয়ে নেমে এসেছিলাম সে পথ বেয়ে আবার উঠে মূল রাস্তায় ফিরে সাপের মতো আঁকাবাঁকা অনেকটা পথ পার হয়ে নদী পেরোনো। ওঠা মানেই ছিল খাড়াই ভাঙা। সময় আর শক্তির চূড়ান্ত অপব্যবহার হত।

ঘোড়ার মালিক আর দলবল ছিল সত্যিকারের পরিশ্রমী কাশ্মীরি আর দর্দ উপজাতির লোক। ওরা ঠিক করল, যেখানে বরফের ফাটল অপেক্ষাকৃত কম চওড়া আর বরফের স্তর অনেকটাই পুরু, সেখান দিয়ে নালা পার হবার চেষ্টা করে দেখবে একবার। তিনজনে মিলে পাশাপাশি ধরে একটা ঘোড়াকে পার করাতে যেতেই সে-ব্যাটা গিয়ে হড়কে পড়েছিল জলে। জন্তুটাকে জলে পড়ার থেকে বাঁচাতে গিয়ে সাদাক আকুনও ছিটকে পড়েছিল বরফ-ঠান্ডা নালায়। ভাগ্য ভালো ঘোড়াটা বা সাদাক কারও কোনও চোট লাগেনি এবং ভেসে যাওয়া মালপত্রও উদ্ধার করা গিয়েছিল দ্রুত।

এরপর আরও সতর্কতার সঙ্গে পার হবার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। তবে এবার আর বরফের চাঙড়ের ওপর দিয়ে নয়, নালার বিপদজনক জায়গায় বড়ো বড়ো পাথর ফেলে নালা পার হবার মতো খানিক পথ তৈরি করে নিয়ে। যা হোক করে এক-একটা ঘোড়াকে মালপত্র সহ খুব সন্তর্পণে নালা পার করানো হয়েছিল। আমার ভয় ছিল সঙ্গের যন্ত্রপাতিগুলোকে নিয়ে। সার্ভে আর অন্য কাজের জন্য আনা সরঞ্জামগুলো ভিজে গেলেই হয়েছিল আর কি। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছিল অঝোরে বৃষ্টি। শেষ ঘোড়াটাকে নালা পার করিয়ে যখন আমরা সবাই নিরাপদে অন্য পাড়ে পৌঁছেছিলাম ততক্ষণে সবাই চুপচুপে ভিজে ঢোল হয়ে গিয়েছিল। শীতে কাঁপছিলাম সবাই ঠকঠকিয়ে।

একটা নাগাদ আমরা গিয়ে পৌঁছেছিলাম গোড়াই রেস্ট হাউসে। পুরো উপত্যকাই বরফের চাদরে মুড়ে গিয়েছিল। পাক্কা সাত ঘণ্টা লেগিয়েছিল মাত্র এগারো মাইল রাস্তা পার হতে। ছোট্ট গেস্ট হাউসটা মেঘলা দিনের আধো অন্ধকারে খুব ম্যাড়ম্যাড়ে দেখাচ্ছিল। আগে থেকেই আরও তিন সাহেব গেস্ট হাউসে ছিলেন। ওঁরা কাশ্মীরের সমতলের নালাগুলোর আশেপাশে শিকার করে ফিরছিল। ওঁরা আমার যথেষ্ট খাতিরযত্ন করলেও আমি ঠিক করেছিলাম আরও এগিয়ে যাব। সামনেই গুরেজ বলে একটা জায়গা আসবে। ওখানে অনেক থাকার জায়গা আছে। তাছাড়া প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিসও ওখানে পাওয়া যায়।

পর্ব ২

দর্দ উপত্যকায়

খানিক বকশিস আর এর থেকে শুকনো জায়গার লোভ দেখিয়ে ঘোড়ার মালিক আর ওর দলবলকে রাজি করিয়েছিলাম। আমাদের ছোট্ট ক্যারাভ্যান উতরাই বেয়ে চলতে শুরু করার মাইল চারেকের মধ্যে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম কৃষ্ণাগঙ্গার মূল উপত্যকায়। এটাই ছিল প্রথম দর্দ গ্রাম। তারপর আরও মাইল দশেক হেঁটে আমরা পৌঁছেছিলাম গুরেজ গ্রামে।

মাইল খানেক চওড়া সমতল জায়গা জুড়ে অনেকগুলো ছোটো ছোটো মহল্লা নিয়ে গ্রামটা। পাহাড়ের ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া পাইনবনের জঙ্গলের মাঝে মেঘলা অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝিরঝিরে বৃষ্টিস্নাত গ্রামটাকে ভূতুড়ে মনে হচ্ছিল। কাঠের গুঁড়ি দিয়ে পাহাড়ের ধাপ আর নদীর কালচে বালির ধারে খাপছাড়াভাবে তৈরি অপরিচ্ছন্ন বাড়িগুলোর জন্য পরিবেশটা আরও গা-ছমছমে লাগছিল। এই কালচে বালির জন্য এই নদীর নাম ‘কালো গঙ্গা’, সংস্কৃতে ‘কৃষ্ণাগঙ্গা’।  আশেপাশের গাছপালার রূপ বলে দিচ্ছিল সমুদ্রতল থেকে আট হাজার ফুট উঁচুতে বসন্তের পা পড়েছে। গ্রীষ্মের স্বল্প উপস্থিতি আর প্রখর রোদের অভাবে এখানে শুধুমাত্র খানিক বার্লি আর তুম্বা নামের একধরনের ফল ফলে। গ্রামে লোকজনও খুব কম। কাশ্মীরের সঙ্গে এটি একটি পরিষ্কার নৃতাত্ত্বিক সীমারেখা। এরপর থেকে যত আরও হিন্দুকুশের উত্তরে যাওয়া যাবে ততই দর্দ উপজাতির লোকজনের সঙ্গে কাশ্মীরের লোকদের ফারাক চোখে পড়বে। ভাষা আর চেহারার অমিল পরিষ্কার বোঝা যাবে। দর্দ আর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ইন্দো-আর্য ভাষার সঙ্গে ভারতের অন্য কোনও ভাষার মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু ভাষা যতই দুর্বোধ্য হোক না কেন, সন্দেহ নেই দর্দ উপজাতির লোকেরা প্রাচীন সংস্কৃতিকে আঁকড়ে রেখেছে। এদের কাছ থেকে প্রাচীন বিদ্যা বা জ্ঞানের সন্ধান ফিরে পাওয়া যেতেই পারে।

হেরোডোটাসও (খ্রিস্টপূর্ব সময়ের গ্রিক লেখক তথা ভূগোলবিদ ও ঐতিহাসিক) এদের কথা বলেছিলেন। এরা সেই তাঁর বর্ণিত জায়গাতেই এখনও বসবাস করে। তাঁর বর্ণনা করা এই উপজাতির লোকেরা সেই একইরকমভাবে এখনও সিন্ধু আর কৃষ্ণাগঙ্গার মাঝামাঝি অঞ্চলে জল চেলে সোনা বের করে।

আমাদের ঘোড়ার দলের দর্দ মালিকের মধ্যে সহানুভূতি জাতীয় ব্যাপার-স্যাপারগুলো একটু কম। বুদ্ধি, রসবোধ আর চেহারার ঔজ্জ্বল্যে কাশ্মীরিদের তুলনায় ও অনেক পিছিয়ে। তবে সাহসের তুলনা নেই। পাঠানদের মতোই লড়াকু ও স্বাধীনচেতা। দর্দ উপজাতির লোকেরা হাজার হাজার বছর ধরে কঠোর জলবায়ুর মধ্যে অনুর্বর জমিকে সঙ্গী করে টিকে আছে। এরা অনেকটাই খাইবার উপত্যকার আফ্রিদি উপজাতির মানুষদের মতো। ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস এই আফ্রিদি উপজাতির লোকদের কথাও বলে গেছেন। উত্তর-পশ্চিম ভারতে এরা অনেক লড়াই-যুদ্ধের মধ্যেও এদের নিজস্বতা নিয়ে পাহাড়ের মতোই অবিচল থেকেছে। গুরেজ একসময় ছিল দর্দ উপজাতির রাজধানীর মতো, এরা একসময় কাশ্মীরি শাসকদের জেরবার করে ছেড়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, দ্বিগুণ রাস্তা পার করে আমাদের দল যখন ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত, তখন এদের কাছ থেকে ভীষণ সহযোগিতা পেয়েছি। নতুন একটা বাড়ি আমাদের থাকার জন্য দিয়ে দিয়েছিল।

পরদিন আমরা ওখানে ছিলাম। বিশ্রাম নেবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সঙ্গের জিনিসপত্র শুকনো করে নতুনভাবে প্যাক করারও প্রয়োজন ছিল। এখান থেকে মালপত্র নেবার জন্য নতুন করে ব্যবস্থা করার কথা ছিল। শ্রীনগরেই জেনেছিলাম, অ্যাস্টর পৌঁছতে বুরজিল (Burzil) পাস অতিক্রম করার জন্য আমাদের কুলি নিতে হবে। এখানে এত বরফ জমে থাকে যে শুধুমাত্র কুলিরাই পারে এই পথে পিঠে করে মাল বয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু পথে দেখা হওয়া কিছু দর্দ দলের কাছে শুনেছিলাম, ওরা নিরাপদে ঘোড়ার পিঠে মাল চাপিয়ে অ্যাস্টর থেকে মাল খালাস করে ফিরছে। দিন কয়েক আগেই গুরেজ গ্রামের প্রায় সব পুরুষ আমাদের আগে আগে চলা এক  ব্রিটিশ সার্ভে দলের মালপত্র নিয়ে গেছে। কাজেই ঘোড়ার পিঠে মালপত্র চাপিয়ে রওনা হওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় ছিল না। ৩ জুন আমরা রওনা হয়েছিলাম। শুধু ছবি তোলা আর  সার্ভের যন্ত্রপাতি, যেমন থিওডোলাইট ইত্যাদি জনাকয়েক কুলি জুটিয়ে তাদের পিঠে তুলে দিয়েছিলাম।

obhijaankhotan04

আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। গুরেজ থেকে বুরজিল থেকে নেমে আসা নালার পাস দিয়ে হাঁটতে বেশ ভালো লাগছিল। আমাদের পশ্চিমে বরফঢাকা পাহাড় আর ডানদিকে পাহাড়ের ঢালে পাইনের সবুজ ঢল চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছিল। ধ্বস নেমে সামনের রাস্তার খানিকটা অংশ হারিয়ে গিয়েছিল। আমাদের আগে থেকে অনেকেই অপেক্ষা করছিল ভাঙা অংশটা পার হবার জন্য। কয়েকদিন আগের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে খাদের গা ঘেঁষে পিচ্ছিল জায়গা দিয়ে আমি ঘোড়া নিয়ে পার হবার ঝুঁকি নিতে চাইনি, তাই থেকে গিয়েছিলাম পুসওয়ারি গ্রামে। পরদিন ভোরে যাত্রা শুরু করে একইরকম প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করতে করতে মিনিমার্গ পৌঁছেছিলাম। জায়গাটা সমুদ্রতল থেকে দশ হাজার ফুট উঁচুতে। গবাদিপশুর পাল নিয়ে বেশ কিছু গুজ্জরের দল এখানে আগে থেকেই ঘাঁটি গেড়ে ছিল। ছোটো ছোটো কুঁড়ে বানিয়ে পশুচারণদাররা পুরো গ্রীষ্মটা এখানে কাটাবে। দিন দশেক আগেই এখানকার বরফ গলে গিয়েছিল। কচি কচি সবুজ ঘাসে পুরো উপত্যকা ছেয়ে উঠেছিল। ঘাসের মাঝে মাথা তুলে থাকা ছোটো ছোটো রঙিন পাহাড়ি গুল্ম আমাকে মোহন্তমার্গের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। এই পাস ও উপত্যকার সব খবরাখবর দেওয়া নেওয়া করা টেলিগ্রাফ অফিসটাকে দেখে এখানকার শীতকালীন অবস্থার আভাস টের পেয়েছিলাম। জমি থেকে অনেক ওপরে চতুর্দিকে পালিশ করা শক্তপোক্ত ছাউনি দেওয়া বারান্দা ঘেরা অফিসটাকে ছোটোখাটো দুর্গ বলে ভুল হতে পারে। লম্বা শীতে প্রবল তুযারপাতের মধ্যে অফিসটাকে মানুষের বাসযোগ্য ও কর্মক্ষম রাখতে এইরকম মজবুত গড়ন অবশ্যই দরকার ছিল।

মিনিমার্গ থেকে উত্তর-পশ্চিমদিকে বাঁক নিয়ে প্রায় পাঁচ মাইল পথ চড়াই ভেঙে বুরজিল পাসের পাদদেশের রেস্ট হাউসে পৌঁছেছিলাম। ঝলমলে মিনিমার্গ পার হবার পর থেকেই ইতিউতি জমাট বরফের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল। আর যেখানে পৌঁছেছিলাম সেটা তো ছিল পুরোটাই বরফে ঢাকা। এই বরফই জানান দিচ্ছিল শীতে কী ভয়ংকর রূপ ধারণ করে এই অঞ্চল। সে যাই হোক, ঝকঝকে পরিষ্কার নীল আকাশ দেখে আমি মনে মনে নিশ্চিন্ত হয়ে ছিলাম যে, ভারী মাল পিঠে ঘোড়াগুলো যে এই পাস নির্ঝঞ্ঝাটে পার হয়ে যেতে পারবে। শুধু জানতাম যাত্রা শুরু করতে হবে মাঝ রাত্তিরে। সূর্য উঠে বরফ গলিয়ে নরম করার আগেই বিপদজনক গিরিপথটা পার হতে হবে। রাত একটার সময় উঠে তৈরি হয়ে নিয়েছিলাম। তার ঠিক একঘণ্টা পর আমাদের ক্যারাভ্যান বরফঢাকা পথ ধরে যাত্রা শুরু করেছিল। পথ বলে কোনও কিছুর হদিশ নেই। ঘণ্টা দুয়েক ক্রমাগত চড়াই ভেঙে আমরা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিলাম যেখানে বুরজিল পাসের সঙ্গে উত্তর-পূর্বদিকের দেওসাই নামের একটা উঁচু মালভূমি থেকে একটা পথ এসে মিশেছিল। এখানে ফুট তিরিশ উঁচু খুঁটির মাথায় কাঠের তৈরি একটা টেলিগ্রাফ অফিসের কুঁড়ে ছিল। খুঁটির মাথার ওই কুঁড়েটাই শীতে ডাকবাহকদের আশ্রয় নেওয়া আর গিলগিটের পথের নিশানা দেখানোর কাজ করে। ওই ঘরের উঁচু খুঁটিগুলো ফুট দশেক বরফের তলায় ডুবে ছিল।

আমাদের সৌভাগ্য, ঠান্ডা খুব বেশি থাকায় এখানকার বরফ যথেষ্ট শক্ত ছিল, ফলে ঘোড়াগুলোর চলতে অসুবিধা হচ্ছিল না। সূর্যের প্রথম আলো দেখা দেবার আগেই আমরা গিরিপথের সর্বোচ্চ অংশ ১৩,৫০০ ফুট উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। ছয় মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে গিয়েছিল। খুব দূরের কিছু নজরে আসছিল না। বরফ চাদর মোড়া চতুর্দিকে নতুন করে পড়া বরফের আস্তরণ দাগহীন করে দিয়েছিল পাহাড়ের শরীরকে। এ দৃশ্য ভোলা যাবে না কোনোদিন। ডাকহরকরাদের কুঁড়েতে বসে ঝটপট প্রাতরাশ সেরে নিয়েছিলাম।

গিরিপথের উত্তরদিকের উতরাই বেয়ে নামাটা শুধু ক্লান্তিকরই ছিল না। যথেষ্ট সময় নিচ্ছিল। পুরো পথটাই বরফে ঢাকা। সূর্য যত মাথার ওপর উঠছিল পিঠের বোঝা ততই ভারী লাগতে শুরু করেছিল। বরফের রাজ্যে একটাই জীবিত বস্তু চোখে পড়েছিল, পাহাড়ি কাঠবিড়ালি – মারমট। গর্ত থেকে বেরিয়ে রোদ পোয়াতে পোয়াতে তীক্ষ্ণ ‘কিইইই’ শব্দে ডাক ছাড়ছিল ওরা। কোনও বিপদের আভাস পেলে বিদ্যুতের গতিতে গর্তে সেঁধিয়ে যায় এই কাঠবেড়ালিরা। আমার ফক্স টেরিয়ার কুকুরটার কাঠবেড়ালিদের গতিবিধি টের পেতে খানিক সময় লেগিয়েছিল। বাতাসে ওদের গন্ধ পেতেই ওদের ধরার জন্য ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছিল। ও এই দীর্ঘ পথ বরফের ওপর দিয়ে অক্লেশে হেঁটে এসেছে। এর আগে পাঞ্জাবের শুকনো সমতল বা সিকিমের স্যাঁতসেঁতে জঙ্গলে একইভাবে আমার সঙ্গে হেঁটেছে। তুর্কি চাকররা আমার বিশ্বস্ত সঙ্গীটাকে প্রাণ দিয়ে দেখভাল করত আর ভালোবাসত খুব।

একটার সময় আমরা চিল্লুম চৌকিতে পৌঁছেছিলাম। অ্যাস্টরের দিকে এটাই প্রথম রেস্ট হাউস। মাইল দুয়েক পেছনে বরফের রাজত্ব ফেলে এসেছি। সবক’টা ঘোড়াই ঠিকঠাক এসেছিল, একটা ছাড়া। একটা ঘোড়া যে পৌঁছায়নি সেটা আমার টের পেয়েছিলাম ব্রেকফাস্ট করার সময়। যে ঘোড়াটা এসে পৌঁছায়নি সেটা আমাদের ‘কিচেন’ বইছিল। ঘণ্টা খানেক উৎকণ্ঠার সঙ্গে অপেক্ষা করার পর দলের সার্ভেয়ার, যিনি দলের পেছনে পেছনে আসছিলেন, তিনি এসে খবর দিলেন নরম তুষারে একটা ঘোড়া গেঁথে গেছে। মালপত্র আর ঘোড়াটাকে উদ্ধারের জন্য আমি সঙ্গে সঙ্গে কিছু কুলিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সন্ধে ছ’টা নাগাদ মির্জা সবকিছু নিয়ে ফেরত এসেছিল।

এই টানাপোড়েনের মধ্যেই মানসিক খানিক তৃপ্তি দিয়েছিলেন এক রোড এঞ্জিনিয়ার। তিনি শিকার করতে এসে এই রেস্ট হাউসেই উঠেছিলেন। তিনিই জানিয়েছিলেন প্রিটোরিয়া দখল করা সম্ভব হয়েছে। টেলিগ্রাফের তার বেয়ে খবর দ্রুত ছোটে। যদিও গিলগিটের রাজনৈতিক এজেন্ট ছাড়া বারজিলের এ-পাশে খবর দেওয়া-নেওয়ার মতো কোনও গ্রাহক ছিল না। কিন্তু অ্যাস্টরের টেলিগ্রাফ মাস্টার আর তাঁর বন্ধুরা সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকাতে কী কী ঘটে চলেছে তার খবর ভালোই জানতেন।

যে ঘোড়ার দলটায় গুরেজ থেকে মালপত্র চাপিয়ে নিয়ে এসেছিলাম, সেগুলোই ছিল এ বছর বুরজিল পাস পার করে আসা প্রথম ঘোড়াবাহিনী। ওই ঘোড়াগুলো বদলে অ্যাস্টর থেকে পাঠানো অন্য এক ঘোড়ার দলের পিঠে লটবহর চাপিয়ে ৬ জুন চিল্লুম চৌকি থেকে অ্যাস্টরের দিকে রওনা হয়েছিলাম আমরা। যে কঠিন পথ পার হয়ে এসেছি, সেই পথের তুলনায় এই পথ অনেক আরামদায়ক। ঝকঝকে নীল আকাশ, ঝোরার জলের পাশে ইতিউতি জমে থাকা বরফের চাঙড় আর উপত্যকার বহু নীচ দিয়ে সবুজের বুক চিরে বয়ে চলা ফেনিল নদী। ঝিলম আর সিন্ধুর জল বিভাজিকার মাঝে এ এক অন্যরকম কঠোর প্রকৃতি। পাহাড়ের গা এখানে কাশ্মীর বা কিষণগঙ্গা উপত্যকার মতো সবুজে মোড়া নয়। ন্যাড়া পাহাড়ের পাথরের ঢালে কয়েকটা জুনিপারের কল্যাণে খানিক সবুজের ছোঁয়া চোখে পড়েছিল। প্রতিকূল মাটি আর আবহাওয়ার দৌলতে চাষবাস এখানে নামমাত্র হয়। খুব আনন্দ লেগিয়েছিল পথের পাশে সযত্নে তৈরি একখণ্ড মাঠ দেখে। পাথরের ওপর বড়ো বড়ো করে লেখা ছিল ‘পোলো খেলার মাঠ’। দর্দ উপজাতির জাতীয় খেলা হল পোলো। হতদরিদ্র গ্রামবাসীর এই একখণ্ড জমির প্রতি মমত্ব প্রমাণ করে খেলাটার প্রতি তাদের ভালোবাসা। এই পোলো খেলাই তাদের অন্যতম বিনোদন।

প্রায় সতেরো মাইল হেঁটে গাদোই পৌঁছে বেশ গরম লাগছিল। কাশ্মীর ছাড়ার পর এত গরম এই প্রথম লাগল। যদিও প্রায় নয় হাজার ফুট উচ্চতায় অ্যানেরয়েড যন্ত্র যথেষ্ট ঠান্ডার ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

৭ জুন ভোর হতে না হতেই আমরা রওনা হয়েছিলাম অ্যাস্টরের উদ্দেশ্যে। অ্যাস্টর হল এই পাহাড়ি জেলার প্রধান স্থান, বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই স্থান প্রসিদ্ধ। গাদোই থেকে খানিক নামতেই ন্যাড়া পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে ঝিকমিকিয়ে উঠল বরফের মুকুট পরা নাঙ্গা পর্বত। কাশ্মীরের মোহন্তমার্গে মেঘের পর্দা সরিয়ে বহুবার দেখা দিয়েছে ২৬,৬০০ ফুট উঁচু পিরামিড সদৃশ এই মহান শৃঙ্গ। এমনকি রাওয়ালপিন্ডির মুরি থেকেও অনেকবার দেখেছি এঁকে। কিন্তু এখান থেকে দেখছি হাতের তালুর মতো। ওঁর পাহারাদার আঠারো থেকে তেইশ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়গুলোও প্রায় হাতের মুঠোয়। পাখির মতো উড়ে যেতে পারলে ওই মহান পর্বতরাজি থেকে আমাদের দূরত্ব হবে মাইল দশেক। মাথা নত হয়ে এসেছিল। আমি পাহাড়ের গায়ের হিমবাহগুলো খুঁটিয়ে দেখছিলাম।

যত নীচের দিকে নামছিলাম ততই গরম বাড়ছিল। গুরিকট থেকে খানিক এগিয়ে যেখানে দুটো নদী এসে পরস্পরের সঙ্গে মিশেছে, সেখান থেকেই ধুলো বোঝাই রাস্তার শুরু হয়েছিল। বাঁদিকে উপত্যকার খাড়া পাহাড় ছাড়াতেই গ্রামের পর গ্রামের দেখা পাচ্ছিলাম। অ্যাস্টরের ছোঁয়া টের পেতেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে গিয়েছিল। ওখান থেকে যে দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল তাতে এই অঞ্চলের রুক্ষতা বোঝা যাচ্ছিল। এক বিশাল পাথুরে দেওয়াল উপত্যকার উত্তরে নাক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। অন্যদিকে নীচের সমতল মালভূমি দিয়ে বয়ে চলা উচ্ছল নদী এক অপূর্ব বিপরীত দৃশ্য সৃষ্টি করে রেখেছে।

তিনটের সময় অ্যাস্টরের বাংলোতে পৌঁছেছিলাম। বাংলোটা একদম অ্যাস্টরের প্রভাবশালী অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। গাছের ছায়ামাখা ও ঠান্ডা। বাংলোটার থেকে খানিক দূরে শিখদের একটি দুর্গ। বর্তমানে ওটি কাশ্মীর ইম্পিরিয়াল বাহিনীর সেনাছাউনি। বাংলোর দক্ষিণে বাগান সমাচ্ছন্ন জায়গাটি অ্যাস্টরের রাজাদের সম্পত্তি। শিখদের আগ্রাসনের পর অ্যাস্টরের রাজারা মধ্যস্থতা করেন ও নিজেদের কাশ্মীরের অধীনে তহশিলদার হিসেবে প্রতিপন্ন করেন। এই পার্বত্য অঞ্চলে শিখদের শাসনে উদারতার কোনও অভাব ছিল না। আর পাহাড়ি রাজাদের বংশ নিয়ে গর্ব করার মতো খুব সামান্যই অবশিষ্ট ছিল।

obhijaankhotan05hunjabaltitfort

অ্যাস্টরের উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে ৭৭০০ ফুট। সন্ধেবেলা প্রবল ঝড়জল বয়ে গিয়েছিল উপত্যকা জুড়ে। পরদিন ৮ জুন তারিখেও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু আমি দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ধীরে ধীরে নামতে নামতে সিন্ধুনদের দিকে এগোচ্ছিলাম আমরা। যতই নীচের দিকে নামছিলাম ততই চারপাশের উজ্জ্বলতা হারাচ্ছিল। পাথরের গায়ে লাল, হলুদ আর কালচে রঙের দাগ স্পষ্ট হয়ে ফুটে ছিল। গাছপালার অভাব পাথরের রঙ পুষিয়ে দিয়েছিল খানিকটা। অনুর্বর মাটিতে ইতিউতি গজিয়ে ওঠা বুনো গোলাপের ঝাড়ে ফুল ফুটে আছে অল্পস্বল্প। রুক্ষ পাথুরে মাটিতে গোলাপের বেগুনি রঙে সহজেই চোখ আটকে যায়। অ্যাস্টর থেকে প্রায় মাইল পনেরো পথ হেঁটে দাসকিন গ্রামের কাছে পৌঁছে প্রথম নজরে এসেছিল পাহাড়ের বুকে খানিক সবজে চাষের মাঠ। টের পেয়েছিলাম দুয়ানের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছিলাম আমরা। ওখানে ক্যাপ্টেন জে. ম্যানার্স স্মিথের সঙ্গে দেখা করার জন্য মুখিয়ে ছিলাম আমি। তাই রাত কাটাতে কোথাও না থেমে  সামনে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি। যদিও ভারী মাল নিয়ে আমাদের ঘোড়াগুলোর গতি খুব কমে এসেছিল। ঘোড়ার মালিকও গাঁইগুঁই করা শুরু করেছিল। না-হলে বাকি বারো মাইল পথ খুব আরামদায়কই ছিল।

প্রায় পাঁচ হাজার ফুট উঁচুতে সগর্জনে বয়ে চলা নদীর পাশ ঘেঁষে আমাদের চলার পথ ক্রমশই ওপরের দিকে উঠছিল। পাইনের বনের ভেতর দিয়ে চলা রাস্তা অস্তমিত সূর্যের আলো আঁধারিতে অপূর্ব লাগছিল। সবুজ হয়ে থাকা পাহাড়ের ঢালের মাথায় যদিও এখন বরফ জমে আছে। ক’দিন পর ছুটে চলা জলের স্রোতের পাশে সবুজের ঢল দেখে মনে মনে খানিক শান্তি পেয়েছিলাম। একটা বাঁক পেরোতেই এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল।

অ্যাস্টরকে ঘিরে থাকা পাহাড়শ্রেণির ফাঁক দিয়ে বয়ে চলেছে সিন্ধু। পাহাড়ের ঢল নদের দু-পাশ দিয়ে ঢেউয়ের মতো ক্রমশ উত্তরের দিকে এগিয়ে গেছে। হালকা মেঘ দূরের পাহাড়ের মাথায় ঝুলে আছে। তারই মাঝে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বরফাবৃত মাউন্ট রাকাপোশিকে চিনতে আমার ভুল হয়নি। সিন্ধুদেব আমাকে যেন অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন পুরোনো বন্ধুর মতো। এই নদের ধারাকে আমি বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জায়গায় বিভিন্ন রূপে দেখেছি। বাল্টিস্থানের পাথুরে বুক চিরে এগোতে দেখেছি। ইউসুফজাইের সমতলে ও পাঞ্জাবের আটকেও দেখেছি। কিন্তু পাহাড়ের উঁচু দু-দেওয়ালের মাঝে এখানকার মতো উচ্ছল মনোমুগ্ধকর রূপ কোথাও দেখিনি। সূর্যের কিরণ পড়ে ঝলকে উঠছিল জলের কণা। দ্রুত ঘনিয়ে আসা আঁধার, গিরিখাতে উপস্থিত হয়ে প্রবহমান উজ্জ্বল উপস্থিতিকে আড়ালে নিয়ে গিয়েছিল আমার দৃষ্টি থেকে। ক্লান্ত শরীরে দু-গুণ হেঁটে আমরাও পৌঁছে গিয়েছিলাম আমাদের লক্ষ্যে।

দুয়ান বাস আমার খুব কাজের ও মজার হয়েছিল। জুনের ৯ তারিখ গিলগিট ও সংলগ্ন অঞ্চলের পলিটিক্যাল এজেন্ট ক্যাপ্টেন জে. ম্যানার্স স্মিথ শিকার ভ্রমণ সেরে ফেরার পথে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে আমাকে ওঁর তাঁবুতে একটা দিন কাটিয়ে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। পাহাড়ি পথে লম্বা সফরের মাঝে আমি ওই বিশিষ্ট অফিসারের আমন্ত্রণ খুব খুশি মনে গ্রহণ করেছিলাম। আমি আমার দলবলকে রওনা করিয়ে দিয়ে ওঁরই পাঠানো একটা ঘোড়ায় চেপে উপস্থিত হয়েছিলাম ওঁর তাঁবুতে।

রাস্তা থেকে হাজার দেড়েক ফুট উঁচুতে ফার গাছে আচ্ছাদিত যে পাহাড়ি ঢালের মাথায় ওঁর শিবির ছিল, সেটি একটি অসাধারণ জায়গা। অজস্র ছোটো ছোটো পাহাড়ি ফুল কার্পেটের মতো ফুটে ছিল ঢাল জুড়ে। ছবির মতো তো বটেই, মহা পরাক্রমশালী পলিটিক্যাল এজেন্টের শিবিরস্থলকে মনোরম করতে ওই ফুলের ঝাড়গুলো গিলগিট, হুঞ্জা আর চিলাসের বিভিন্ন জায়গা থেকে আনানো হয়েছিল। এছাড়া ঢালের বুক বেয়ে চলা ছোট্ট একটা পাহাড়ি ঝরনা ছিল জায়গাটার মুখ্য আকর্ষণ।

মিস্টার ও মিসেস স্মিথের বন্ধুত্বপূর্ণ আতিথ্য আমার বহুকাল মনে থাকবে। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলারা ভালোভাবেই জানেন কীভাবে নিজের রাজপাট থেকে বহুদূরে জীবনকে উপভোগ করতে হয়। প্রকৃতিও ওঁদের শিবিরকে ঢেলে সাজিয়েছিল। এরকম সুন্দর একটা জায়গায় সময়টা ঝড়ের গতিতে উড়ে গিয়েছিল। ক্যাপ্টেন স্মিথ এই অঞ্চলের ব্রিটিশরাজের পলিটিক্যাল এজেন্ট হয়ে কাজ করছেন বারো বছরেরও বেশি সময় ধরে। ভিক্টোরিয়া ক্রস প্রাপ্ত ক্যাপ্টেন স্মিথের নাম ইতিহাসে লেখা থাকবে হুঞ্জাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রভূত পরিবর্তন নিয়ে আসার জন্য। নিঃসন্দেহে এই পার্বত্য জাতি ও এই অঞ্চলকে সম্ভবত আর কোনও ইউরোপিয়ান ওঁর থেকে ভালো জানে না। এই পার্বত্য জাত তাদের রীতিনীতি সম্পর্কে ওঁর উৎসাহ এসেছিল ওঁর শিবিরে কাজ করা বিভিন্ন পাহাড়ি মানুষগুলোর কাছ থেকে। চিলাসের দিকের পুনিয়াল গ্রামের প্রধান আমাকে এই অঞ্চলের প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা নানা সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থার কথা শুনিয়েছিলেন। বলতে গেলে মুহাম্মদবাদ কিছুদিন আগে থেকে এখানে খানিক প্রভাব ফেলেছে, কিন্তু প্রাচীন ঐতিহ্য আর পূজা-আচ্চার রীতি উপত্যকার অধিকাংশ জায়গায় প্রবলভাবে এখনও বহমান। গোর গ্রামের পাকা দাড়ির মোড়ল তো পুরোনো দিনের গল্পের ঝাঁপি খুলে ধরেছিল।

তার গ্রামের বাড়ির কাছে আছে এক প্রাচীন কবরস্থান। মহম্মদের জন্মের আগে তাদের পূর্বপুরুষদের মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে ওখানে মাটির তলায় পোঁতা হত। সবাই ওই জায়গাটাকে এড়িয়ে চলে। বলতে গেলে ওই জায়গাটা ছিল এক নিষিদ্ধ অঞ্চল। গোর গ্রামের সেই বুড়ো মোড়ল তার ছোটোবেলায় একবার ওই জায়গায় গিয়ে খানিক খোঁড়াখুঁড়ি করেছিল। তারপর বাড়িতে এসে সে-কথা গর্ব করে বলার পর তার মা তাকে বেদম পিটিয়েছিল ‘ওঁদের’ বিরক্ত করার জন্য। শুধু এই দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই মহিলারাই রক্ষা করে চলেছেন প্রাচীন রীতি ও ঐতিহ্যকে।

সুদূর পশ্চিমের সব রাজনৈতিক তাজা খবরাখবর আধুনিক টেলিগ্রাম যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে স্মিথের টেবিলে হাজির। মনে হয়েছিল যেন কোনও নির্জন দুর্গম উপত্যকায় নয়, বসে আছি লাহোরের এক ক্লাবে। আমার নিমন্ত্রণ-কর্তার বাচ্চারা বাক্যালাপে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল সুউচ্চ পাহাড় টপকে ধীরে ধীরে অনেকটাই ইউরোপের প্রভাব ফেলছে এই অঞ্চলে। উজ্জ্বল গোলাপি গালের ব্রিটিশ শিশুরা যেন এই ভারতীয় সীমান্তে আধুনিক সভ্যতার পথিকৃৎ হিসেবে আবির্ভূত। স্বীকার করতে কোনও সংশয় নেই, আমি অনেক অদ্ভুত জায়গায় গিয়েছি, আর সব জায়গাতেই দেখেছি শিশুরা আমাকে পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রেরণা জুগিয়েছে। আর  ব্রিটিশ শিশুরা ভারতে ব্রিটিশ অগ্রগতির সঙ্গে দ্রুত তাল মিলিয়ে চলে। শৈশবেই এরা অনেকে দেখে নিয়েছে নানা লড়াই। যেমন ব্রিটিশদের সঙ্গে আফগান উপজাতিদের ফোর্ট লকহার্ট ও মালাকান্দের যুদ্ধ। সামগ্রিকভাবে এটি ব্রিটিশ জয়যাত্রারই দৌড়। শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার প্রয়োজনে এই ঘটনাগুলো প্রায়শই ঘটে চলেছে কাশ্মীর ও তার আশেপাশের পার্বত্য অংশে।

দুপুরের পর ক্যাপ্টেন স্মিথ আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন শিবিরের থেকে খানিক ওপরের এক অসাধারণ খানিক সমতল জায়গায়। এখানে চা পানের বন্দোবস্ত হয়েছিল। ওখান থেকে সিন্ধু উপত্যকার চমৎকার দৃশ্য চোখের সামনে ফুটে উঠেছিল। পাথর আর বালির বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছাড়িয়ে দূরবর্তী চিলাস আর দারেলের দিকে এগিয়ে গেছে সিন্ধু। হয়তো সে-দিন আবার আসবে যখন নদীর পাশ ঘেঁষে ভারতীয় সমভূমিতে যাবার সেই পুরোনো দিনের আদিযাত্রার প্রকৃতি পথ খুলে যাবে। যে পথ এখন বন্ধ। এত বাধাবিপত্তির রাস্তা দিয়ে কঠিন গিরিপথ পার না হয়েও নদীর ধারার ধার দিয়ে অক্লেশে মালপত্র আনা নেওয়া করা যাবে। ভারী বিপদের মুখোমুখি হতে হবে না।

জুনের ১০ তারিখ সকালে আমি ক্যাপ্টেন স্মিথ ও তাঁর পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অ্যাস্টর নদীর কোল ঘেঁষে দ্রুত চলা শুরু করেছিলাম বুঞ্জি অভিমুখে, ওখানেই আমার শিবির থাকার কথা ছিল। দ্রুত গরম বাড়ছিল। ‘হাতু পির’ নামের এই পথ যে ভয়াবহ, সে-খবর জেনে গিয়েছিলাম। খাওয়ার জলও পাওয়া যায় না এ-পথে। কোনও সবুজের ছোঁয়া নেই এখানে। দিনের বেলায় সূর্যের প্রখর তাপ লেপটে থাকে সবসময়। এগারো মাইল হাঁটার পর আমি সিন্ধু ও অ্যাস্টর নদীর সঙ্গমের কাছাকাছি পৌঁছেছিলাম। সারা পথে একজনের দেখাও পাইনি। বুঝতে পারছিলাম, এ-পথে কুলিদের মাল বয়ে নিয়ে যেতে কী হাল হয়। রোদের তাপে ঝলসে বুঞ্জি বাংলোতে যখন পৌঁছেছিলাম তখন দুপুর একটা। বাংলোর পাশের দুর্গে কাশ্মীরি বাহিনীর কিছু সৈন্য ছিল। সিন্ধুনদের ব্যস্ত জলপথ নতুন রাস্তা তৈরির পর আর ব্যবহার হয় না বললেই চলে। সূর্যের তাপের থেকে বাঁচতে তারপর আমি আর বাংলোর বাইরে বেরোইনি। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা একটা ধোঁয়াশার আঁধারে নাঙ্গা পর্বত লুকিয়ে ছিল। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে আকাশের ক্যানভাস জুড়ে থাকে নাঙ্গা পর্বত। প্রবল বাতাসে নদীতটের শুকনো বালি উপত্যকা জুড়ে উড়ে বেড়ায়। ঘর বন্ধ থাকলেও উড়ন্ত বালির থেকে রেহাই নেই। এহেন বুঞ্জিতে বেশি সময় থাকার কোনও মানে নেই। গ্রীষ্মের জম্বুর সমতলের কথা মনে পড়ছিল।

বুঞ্জিতে পশুখাদ্য অমিল। এখান থেকে এগিয়ে আমার ক্যাম্পে যাবার জন্য একটা ঘোড়া ভাড়া পেতে নাজেহাল হয়ে গিয়েছিলাম। শেষে এক তহশিলদার যখন তার ঘোড়া আমাকে দিল তখন অন্ধকার নেমে এসেছিল। বালিময় সমতল উপত্যকার সিন্ধুনদের ওপরকার ঝুলন্ত সেতু একাকী যখন পার হয়েছিলাম ততক্ষণে হালকা মেঘের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা চাঁদের নরম আলো আমার সঙ্গী হয়ে গেছে। পাথরের বুক বেয়ে এগিয়ে চলা নদীটিকে অসাধারণ লাগছিল। চাঁদের আলোয় রুক্ষ পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসে গিলগিট নদীর সিন্ধুনদে মেশার দৃশ্য ভোলার নয়।

ধীরে ধীরে ওপর পানে উঠতে থাকা পাহাড়ি নদীর কোল ঘেঁষা পথের খোঁচা পাথর এড়িয়ে, আবছায়া আলোয় ঘোড়ায় চেপে চলা খুব একটা সুখের অভিজ্ঞতা ছিল না। এবড়োখেবড়ো বিপদজনক পথের চৌহদ্দি পেরিয়ে গিলগিট উপত্যকার নিরাপদ সুখজনক অংশে পা রাখতে না রাখতেই চারদিক অন্ধকার করে শুরু হয়ে গিয়েছিল বৃষ্টি। মাইলের পর মাইল পার হয়েও রেস্ট হাউসের খোঁজ পাইনি যেখানে আমার দলের সঙ্গীরা আছে। হিসেবমতো এতক্ষণ লাগার কথা নয়। তবে কি আমি অন্ধকারে বুঝতে না পেরে রেস্ট হাউস পার হয়ে এসেছি? শঙ্কাটা মনের মধ্যে চেপে বসেছিল। আমার সামনে দুটো পথ খোলা ছিল, হয় আরও এগিয়ে গিলগিটে চলে যাওয়া, অথবা পিছিয়ে গিয়ে বাংলোটাকে খুঁজে বের করা। ঘন অন্ধকারে ভিজে থাকা আমি বাংলোটা খুঁজে বের করাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেছিলাম। পেছনদিকে চলতে শুরু করে খানিক পরেই মূল রাস্তা থেকে একটা সরু পথ নজরে এসেছিল। সেই পথ ধরে আধ মাইলটাক এগিয়ে পৌঁছেছিলাম রেস্ট হাউসে। যখন ডিনার শুরু করেছিলাম তখন মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। যদিও আমার চাকররা আমার খাবার বানিয়েই রেখেছিল, কিন্তু এটা ভাবেনি যে আমি মাঝরাতে হাজির হব সে খাবার খেতে।

পারি, যেখানকার বাংলোয় বাকি রাতটুকু কাটিয়েছিলাম, ভোরের আলো ফুটতেই টের পেয়েছিলাম নদীর বালুতীরে নিঝুম জায়গাটি আসলে লালচে-বাদামি পাহাড় ঘেরা প্রকৃতির একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার। কোনও চিত্রকরের আঁকা একটি ইজেল। পরবর্তী নয় মাইল পথ আমরা পার হয়েছিলাম এই চিত্রপটের মধ্যে দিয়ে। একটা বাঁকের পর আমরা গিয়ে পড়েছিলাম আবার এক রুক্ষ পাথুরে অঞ্চলে। ওখান থেকে পুরো গিলগিট উপত্যকার ছবি ধরা দিয়েছিল চোখে।

মিনাউর ছিল গিলগিট উপত্যকায় আমাদের পথে আসা প্রথম গ্রাম। চাষের জমির দেখা মিলেছিল এখান থেকেই। নদীর বাঁ-পাশে জমা হওয়া পলিময় অংশে খুব যত্নের সঙ্গে গড়ে ওঠা একের পর খণ্ড জমিতে জলসিঞ্চন করে সবুজের চোখ ঠান্ডা করা সমারোহ।

মাইল কয়েক যেতেই উত্তরের দিক থেকে আসা হুঞ্জা নদীর দেখা মিলেছিল। আসছিল একের পর এক গ্রাম। ফসলে ভরে থাকা চাষ জমি আর ফলের বাগান। পার হয়ে আসা রুক্ষ, ফ্যাকাসে, সবুজহীন দৃশের ঠিক বিপরীত ছবি। ঘোড়ার পিঠে চেপে যেতে যেতেই হাতে এসেছিল এজেন্সির প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন বার্ডেনের লেখা একটি আমন্ত্রণ পত্র। এর আগে ক্যাপ্টেন স্মিথের আতিথ্যই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আন্তরিকতা কাকে বলে।

খানিক সময়ের মধ্যেই একটি আরামদায়ক বাংলোয় আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, গিলগিটে এজেন্সির কর্মকর্তারদের কেউই আতিথ্যে খুঁত রাখতে চাননি। সংখ্যায় কম হলেও আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য এঁরা মুখিয়ে ছিলেন। এঁদের প্রতেক্যেই, তিনি কাশ্মীর ‘ইম্পিরিয়াল আইস ট্রুপ’-এর প্রধানই হোন বা বাহিনীর সৈন্য জোগানদার অথবা ‘পাবলিক ওয়ার্ক’ বিভাগ বা হাসপাতালের কর্তা, নিঃসন্দেহে এই অঞ্চল সম্পর্কে এঁদের জ্ঞান ও ভালোবাসা ছিল নিখাদ। প্রায় স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারা ও রাজনীতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিজ নিজ ক্ষেত্র পরিচালনায় এঁদের অভিজ্ঞতার ঝুলি ছিল পরিপূর্ণ। সুস্থভাবে কোনও সাম্রাজ্য পরিচালনা ও ছোটো সেনাছাউনির জন্য যা প্রয়োজন যেমন স্কুল, হাসপাতাল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গোছানো নানা দপ্তর, বাজার, এমনকি মহিলাদের জন্য স্বতন্ত্র হাসপাতাল ও স্কুলও এঁরা এখানে বানিয়েছেন। ইউরোপীয় অফিসারদের জন্য এখানকার পাহাড়ের ঢালে আছে ছোটো ছোটো আরামদায়ক বাংলো, আছে লাইব্রেরি সহ ক্লাব। মাত্র এগারো বছর আগে গিলগিটে তৈরি হওয়া সেনাছাউনিকে ভিত্তি করে এই উন্নতি দেখে এর আগের অবস্থার কথা কল্পনা না করাই ভালো।

বর্তমান দুর্গটি ভাঙাচোরা একটি শিখ ঘরানার কাঠের কাঠামোর ওপর গড়ে তোলা। এই কাঠামোটি আগের সময়কার গিলগিটের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যখন সৈনিকের শুধু খুব কম বেতনই পেত না, তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা নামক বস্তুর অভাব ছিল প্রকট। সদিচ্ছার অভাবে উর্বর জমি পতিত হয়ে পড়েছিল। বর্তমানে শান্তিতে থাকা দর্দরা কথায় কথায় ভয়ংকর সহিংস বিদ্রোহ শুরু করে দিত।

পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গিলগিটে একদিন থাকার কথাই ছিল। মূলত দলের সঙ্গীদের বিশ্রাম ও সঙ্গের জিনিসপত্র টুকটাক মেরামতের জন্য দিনটা প্রয়োজন ছিল। ঘোড়া ও কুলিবাহিনী পালটে নতুন ঘোড়া আর কুলি জোগাড় করে হুঞ্জার দিকে চলা শুরু করতে গিয়ে তিনদিন সময় লেগে গিয়েছিল।

বিপুল কাজের চাপ আর আতিথ্যের বাহারে যে যাত্রাপথে দেরি হয়ে যাচ্ছে সেটা খানিক ভুলে গিয়েছিলাম। সরকারি পরিবহণের সবকিছু দূরবর্তী শিবিরগুলোতে ন্যস্ত ছিল। আর স্থানীয় ঘোড়ার দলকেও অনেক দূরের তৃণভূমিতে চরাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সৈন্যশিবিরের এক চটপটে অফিসার তৃতীয়দিন আমাদের জন্য একটা দারুণ শিক্ষিত ঘোড়াবাহিনী জোগাড় করে দিয়েছিলেন। যাদের পিঠে মালপত্র চাপিয়ে চোখ বুজে হুঞ্জা পৌঁছানোর ভরসা করা যায়। যাত্রাপথে আমার পোশাক খানিক ছিঁড়ে গিয়েছিল, সেগুলো গিলগিটের সহৃদয় লোকজনের সহায়তায় দ্রুত মেরামত হয়ে গিয়েছিল। কমিশনারাটের স্টোর আমার লোকেদের জন্য গরম পোশাক আর পথের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যদ্রব্য দিয়ে দিয়েছিল। আমার স্টকে ফটো-থিওডোলাইট যন্ত্রের জন্য অতি প্রয়োজনীয় সূক্ষ্ম সুতো প্রায় নেই জেনে এই স্টেশনে অবস্থানকারী একমাত্র মহিলা, মিসেস ডাবলিউ ওঁর মাথার সোনালি লম্বা চুল যন্ত্রের সুতো হিসেবে ব্যবহারের জন্য দিয়েছিলেন। আমি পরে কতবার যে পাহাড়ের মাথায় ঝড়ের বেগে বয়ে চলা বাতাসে সূক্ষ্ম যন্ত্রটা ব্যবহার করতে গিয়ে ওঁর কথা স্মরণ করেছি তার হিসেব নেই।

হুঞ্জা-তে

১৫ জুন দুপুরে গিলগিট থেকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মানুষগুলোর আন্তরিক অভ্যর্থনায় ভরপুর হয়ে ফুরফুর মনে যাত্রা শুরু করেছিলাম। প্রথম আঠারো মাইলের অধিকাংশ পথটাই ছিল অনুর্বর উপত্যকায় হুঞ্জা নদীর জলকে কাজে লাগিয়ে চাষাবাদ যোগ্য করে সবুজে ছাওয়া মরূদ্যানের মধ্যে দিয়ে। মেঘলা আকাশ থাকায় আমরা সেরকম কোনও পরিশ্রমও অনুভব করিনি। ১৮৯১-এর ছোটোখাটো যুদ্ধের পর হুঞ্জায় ব্রিটিশ কর্তৃত্ব জোরদার হয়ে উঠেছিল এই অঞ্চলে। রাস্তা থেকে সবেরই ব্যাপক উন্নতি হয়েছিল ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপে। আমি কৃতজ্ঞ গিলগিটের ১৭ বেঙ্গল ল্যানসার-এর কমান্ডিং অফিসার মেজর মেডলির কাছে। তিনি নদীতল থেকে সোজা কয়েকশো ফুট উঁচু খাদের ধার ঘেঁষা সংকীর্ণ চড়াই পথে চলার জন্য শিক্ষিত পাহাড়ি ঘোড়া জোগান দিয়েছিলেন বলে। খুব আরামদায়ক ছিল ঘোড়ার পিঠে যাত্রা।

খাড়া পাহাড়ের মাঝ দিয়ে নদী এঁকে-বেঁকে তার পথ বানিয়ে নিয়েছে। দিনের শেষে গিলগিট প্রদেশের শেষ সীমা চাল্ট-এ পৌঁছেছিলাম। প্রশস্ত উপত্যকা এখানে পূর্বদিকে মোড় নিয়েছে। কাশ্মীর ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের একটি সৈন্যদল এখানে বহাল ছিল। সামরিক নির্মাণ বিভাগের একটি বাংলোতে ওঠার খানিক পরেই আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন সৈন্যদলের কমান্ডার। সুবেদার পদের ওই ভদ্রলোক ছিলেন এক বয়স্ক গাড়োয়ালি। কথাপ্রসঙ্গে ভদ্রলোক আমাকে বিশ-তিরিশ বছর আগের গিলগিটে কাশ্মীর বাহিনীর সৈন্যদলের অবস্থান ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। অনেক মেহনত করে কমিশনারেট বর্তমান পরিস্থিতিতে পৌঁছেছেন। এতে করে সৈন্যদল ও স্থানীয় মানুষজন অনেক স্বস্তিতে আছেন। ওঁর কথা থেকেই জানতে পারি, মহারাজা রণবীর সিংয়ের আমলের ডোগরা বাহিনীতে প্রচলিত সংস্কৃত নির্দেশমূলক শব্দ কিছুদিন আগে পর্যন্ত এখানকার সৈন্যবাহিনীতে ব্যবহৃত হত।

১৭ তারিখ সকালে যাত্রা শুরুর আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে সেদিনই হুঞ্জা উপত্যকার মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছতেই হবে। ওখান থেকেই ঘোড়াবাহিনীকে ছেড়ে পরবর্তী যাত্রাপথে মালবহনের জন্য কুলিবাহিনী নিয়ে এগোতে হবে তাগদুম্বাশ পামির পর্যন্ত।

চাল্ট-এ নদী পার হয়েছিলাম একটি শক্তপোক্ত ঝুলন্ত সেতুর ওপর দিয়ে। কাশ্মীরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেতুর মতো এই সেতু টেলিগ্রাফের মোটা তার থেকে তৈরি। রয়েল ইঞ্জিনিয়ার বাহিনীর কর্নেল আইলমার প্রথম এইধরনের ঝুলন্ত সেতু এই পার্বত্য প্রদেশে বানানোর ঝুঁকি নেন। তাঁর উদ্যোগ বহুল প্রশংসিত হয়েছিল, কারণ এই অঞ্চলে সেতু তৈরির জন্য এই উপকরণ নিয়ে আসাটাই একটা দুঃসাধ্য কাজ ছিল।

মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থাকায় রাকিপোশি পর্বত ছিল চোখের আড়ালে। আমরা উপত্যকার পথ ধরে দক্ষিণ-পশ্চিম অভিমুখে চলেছিলাম। বিশাল বিশাল পাথরের চাঙড় নদীর বুক জুড়ে থাকায় নদীর গতিপথকে করে তুলেছে আঁকাবাঁকা। খানিক পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে যেতে নীল আকাশের বুকে ধপধপে সাদা বরফে ঢাকা ২৫,৫০০ ফুট উঁচু রাকিপোশির রূপ ধরা দিল। আশেপাশে আরও বেশ কয়েকটি উঁচু পর্বত থাকলেও খানিক একাকী দাঁড়িয়ে থাকা রাকিপোশির সৌন্দর্য অতুলনীয়। আপার হুঞ্জা উপতক্যার রূপ মাহাত্ম্যের চাবিকাঠি রাকিপোশিতেই ন্যস্ত। প্রায় সারাদিনই রাকিপোশির অপার দৃশ্য চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছিল। শুধু কয়েকবার নদীর পাড়ে রাকিপোশি থেকে এসে জমা হওয়া পাথরের স্তূপ পার হতে গিয়ে তাকে দেখতে পাইনি। রাকিপোশির হিমবাহ থেকে সৃষ্ট বেশ কিছু ছোটো ছোটো নালা নানা গিরিখাত বেয়ে এসে পড়েছে নদীর মূল ধারায়। পাহাড়ের উঁচু অংশের বরফ থেকে নির্গত আর্দ্রতা উপত্যকার চাষাবাদকে সমৃদ্ধ করছে। এখানে পাইনের বন আর ঘাসে ছাওয়া চারণভূমির দেখা মেলে সেই বরফের সীমানা পর্যন্ত। পাহাড়ের মাথা ধবধবে বরফ সাদা, তারপর খানিক ধূসর অংশ, শেষমেশ সবুজে ছেয়ে উঁচু পাহাড়ের গা লম্বা জিভের মতো এসে ঠেকেছে সমুদ্রতল থেকে ছ’ থেকে সাত হাজার ফুট উঁচু উপত্যকায়।

চাল্ট থেকে মাইল আটেক পথ পার হয়ে আমরা পৌঁছেছিলাম নিলথ নামের একটি গ্রামে। এ-পথের প্রথম নাগির গ্রাম। ১৮৯১ সালে এখানেই এক লড়াইয়ে হুঞ্জা আর নাগিরের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছিল। উপত্যকার ডান আর বাম দিকের দুটো ছোটো পাহাড়ি রাজ্য, এই দুই পাহাড়ি রাজ্য মিলিতভাবে কানজুট নামে পরিচিত ছিল। এখানেই এই দুই রাজ্য মিলে ডোগরা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতে তাদের স্বাধীনতা বজায় রেখেছিল। ছোট্ট পার্বত্য অঞ্চলে নিজেদের জীবিকার পরিসর সীমিত হলেও এরা শক্তিধর। দীর্ঘকাল ধরে হুঞ্জার মীর বা প্রধানের আয়ের একটা বড়ো অংশ ছিল উপত্যকার নীচু অংশ থেকে মানুষ ধরে ক্রীতদাস বানানো। পামির পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত কারাকোরামের বুকচেরা এই বাণিজ্য পথে ব্যবসায়ীদের ক্যারাভান প্রায়শই লুঠ করত যাযাবর শ্রেণির ভয়ংকর কানজুটিস উপজাতিয়েরা। (এমনকি এরা কিরঘুজদের ধরে ক্রীতদাস হিসেবে চাইনিজদের কাছে বিক্রি করে দিত।) মুজতাগ পর্বতশ্রেণির বিশাল হিমবাহ অতিক্রম করে কানজুটিস দস্যুর দল এসে হামলা চালাত বাল্টিস্থানের উপত্যকাগুলোতে। এগারো বছর আগে ব্রালদো উপত্যকরা বায়াফো হিমবাহের মুখের কাছে দেখা পাথরের স্তূপ আমার বেশ মনে আছে। এই একই ধরনের পাথর ছুড়ে আক্রমণ শানাত দস্যুর দল। ওইরকম একটি প্রকৃতির দুর্লঙ্ঘ অংশও যে আক্রমণের পথ হতে পারে এবং হুঞ্জাকে রক্ষা করতে তাতে প্রহরা বসাতে হবে তা ওরাই দেখিয়েছিল। সবকিছুর শুরু আর শেষ হয়েছিল এই নিলথ-এ। টাইমসের প্রতিবেদক মিস্টার নাইট যিনি গিলগিট থেকে একটা ছোটো সৈন্যদলের সঙ্গে এ অঞ্চলে এসেছিলেন, তিনি তাঁর প্রতিবেদনে এই অঞ্চলের ছবি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।

নিলথ গ্রামের যে ছোট্ট বাগানে আমরা প্রাতরাশের জন্য থেমেছিলাম, তার আশপাশটা আমি ভালো করে খুঁটিয়ে দেখেছিলাম। কর্নেল ডুরান্ডের বাহিনী এখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে তছনছ করে দিয়েছিল। কিন্তু সামনের ভয়ংকর পাহাড়ি পথের জটিলতা তাঁকে তিন সপ্তাহের বেশি এখানেই আটকে রেখেছিল। উলটোদিকের খাড়া পাহাড়ের মাথায় ঘাঁটি গেড়ে থাকা নাগির যোদ্ধার দল দুরন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে রুখে দিয়েছিল কর্নেলের বাহিনীকে। সেইসব লড়াইয়ের চিহ্ন এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। গ্রামের সেইসব যোদ্ধাদের কয়েকজন আমার সঙ্গে গল্পগুজবে মেতে আমাকে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের স্থানগুলো দেখিয়েছিল। নীতি ও কৌশলগত কারণে এই যুদ্ধের কথা এখানকার মানুষ ভুলবে না। লড়াকু দলের যোদ্ধারা হাজার ফুট সোজা উঠে যাওয়া পাহাড়ের এক  খাড়া ঢাল দেখিয়েছিল, সবার চোখের আড়ালে যে ঢাল বেয়ে উঠে কর্নেলের বাহিনীর ক্যাপ্টেন ম্যানার্স স্মিথ (তখন লেফটেন্যান্ট ছিলেন) গুটিকয়েক ডোগরা আর গুর্খা সৈন্য নিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন নাগিন যোদ্ধাদের প্রতিরোধ, আর এই সাহসিকতার জন্য পরে উনি ‘ভিক্টোরিয়া ক্রস’ পেয়েছিলেন। ওরা সম্ভবত এত কথা বলেছিল এটা বোঝাতে যে স্থানীয় লোকজন ও শাসকরা বিদেশি শক্তির কর্তৃত্ব ভালোভাবে নেয়নি। অবশ্য ‘কাশ্মীর ইম্পিরিয়াল সার্ভিস’-এর যে ছোটোখাটো সৈন্যদল এই উপত্যকায় মোতায়েন হয়েছিল, বছর কয়েক আগে তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ রাজনৈতিক কর্তা, যিনি হুঞ্জা ও নাজিরের প্রধানদের উপদেষ্টা হিসেবে বহাল ছিলেন, তাঁকেও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ প্রভাব আর কিছু বজায় না থাকলেও ব্রিটিশদের দৌলতে একটি ভালো রাস্তা পেয়েছে এই অঞ্চল। আর পথচারীদের নিরাপত্তা বিষয়টিও অনেক সুরক্ষিত হয়েছে।

ব্রিটিশদের চিত্রালদুর্গ অভিযানের সময় কানজুটিসরা এগিয়ে এসেছিল সহযোগিতায়। দুর্গ দখলের পর ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের অরাজক পরিস্থিতির বদল হতে শুরু করে। যদিও বরফ আর পাথরে ঘেরা উপত্যকার অসম সাহসী এই স্বল্প ক’জন পাহাড়ি মানুষগুলোর জীবিকাসংগ্রাম একই রয়ে গেছে, তবে হানাদারদের উপদ্রব থেকে রক্ষা পেয়েছে ওরা।

নিলথ গ্রাম থেকে রাস্তা এগিয়ে গেছে সুন্দর চাষভূমির মধ্য দিয়ে। হিমবাহ-পুষ্ট জলের ধারায় উর্বর এই অঞ্চল। চতুর্দিকে ফলের বাগান আর তাতে ফলে ছিল পুষ্ট মালবেরি। ছবির মতো সুন্দর করে সাজানো উপত্যকা। নদীপাড়ের খাড়া খাতের ধারে জমি পাথরের টুকরো দিয়ে তৈরি দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, মাঝে মাঝে পাথর জড়ো করে বানানো চতুষ্কোণ এক-একটি মিনার। বোঝাই যায়, গ্রামবাসীরা নিরাপত্তার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। এই ছোটো ছোটো জনপদগুলো যে যথেষ্ট প্রাচীন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রাচীনত্বের নিদর্শন হিসেবে এখনও পর্যন্ত ভূমিপৃষ্ঠের ওপর যা নজরে এসেছ তা হল থল গ্রামের উপকণ্ঠে একটি বৌদ্ধস্তূপ। দশ বর্গ ফুট শক্তপোক্ত ভিতের ওপর প্রায় কুড়ি ফুট উঁচু স্তূপটি। স্তূপের ভিতের একটা কোনা পাশ ঘেঁষে তৈরি রাস্তার কারণে খানিক ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত, আধুনিক ভারতের অতি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ‘জনগণের কাজ’-এর জন্য অন্যান্য অঞ্চলের মতোই সুপ্রাচীন সৌধও ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই পায় না।

সবুজে ছাওয়া সমৃদ্ধ নাগির উপত্যকার ঠিক বিপরীত ছবি হুঞ্জাতে। এর বেশিরভাগটাই পাথুরে ভূমি। এর মূল কারণ হল রাকিপোশির জল। রাকিপোশির জলই নাগিরের স্বাচ্ছ্যন্দের উৎস। দর্দ আর নাগির উপত্যকা প্রায় একইরকম সুফলা।

ক্রমশ

খেলার পাতায় সমস্ত ধারাবাহিক অভিযান একত্রে

1 thought on “ধারাবাহিক অভিযান-খোটানের বালুসমাধিতে-অরেল স্টাইন-অনু-অরিন্দম দেবনাথ-শীত ২০২১

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s