জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- এভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়) অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)
এই অভিযানের আগের পর্ব- পর্ব ১
(ডেভিড লিভিংস্টোন ছিলেন পেশায় ডাক্তার। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন খ্রিস্ট ধর্মযাজকও। লিভিংস্টোন প্রথম আফ্রিকা পাড়ি দেন ১৮৪১ সালে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। আফ্রিকার অবাধ দাস ব্যাবসার বিরোধী ছিলেন তিনি। বেশ কয়েক দশক ধরে আফ্রিকায় অভিযানে যান ডক্টর লিভিংস্টোন। প্রতিটি অভিযানে আফ্রিকার জনজাতি, ভূতত্ত্ব, পরিবেশ খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য লিখে রাখেন নিজের ডায়েরিতে। এই ধারাবাহিকে তাঁর নীলনদের উৎসের খোঁজে যাত্রার গল্প শুনছি আমরা।)
দাস ব্যাবসা
রোভুমা নদী আমাদের যত কাছে আসছে, ততই যেন এই এলাকায় খাদ্যাভাব দেখা যাচ্ছে। মানুষজন বা কোনও গ্রামের দেখা নেই। রুক্ষ পাথুরে প্রান্তর, কোথাও কোথাও ঘাস বা ঝোপঝাড় দেখা যায়। এই পথটা আমরা খুব তাড়াতাড়ি পার হয়ে যেতে চাই, তাই জোরে পা চালালাম। পথের ধারে একটা মরা মানুষের দেহ পড়ে থাকতে দেখলাম। মনে হয় না খেতে পেয়েই লোকটা মরে গেছে। আমরা নোজো পাহাড় পর্যন্ত হেঁটে যাব আপাতত। কিন্তু পথে কোনও জলের ঝোরা পাওয়া যাচ্ছে না। খাওয়ার জন্য বালি খুঁড়ে জল বার করতে হচ্ছে কোথাও কোথাও। সবে বর্ষা শেষ হতে চলেছে, এর মধ্যেই যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে নিশ্চয়ই বছরের বাকি সময় খরা থাকে।
আমি দলের থেকে একটু এগিয়ে ছিলাম। একজায়গায় দেখি এক তরুণী ছোট্ট কুয়ো থেকে জল তুলছে। আমি জল চাইতেই সে হাঁটু মুড়ে দুই হাতে পাত্র তুলে আমাকে জল দিল। বুঝলাম, এই দেশের সম্মান জানানোর রীতিই এমন।
শুনলাম, আরবি দাস ব্যবসায়ীরা ইংরেজদের পছন্দ করে না বলে পরিকল্পনা করে আমাদের যাওয়ার পথ থেকে সরে থাকছে। কিন্তু স্থানীয় কুলিরা আর এগোতে সাহস করছে না, এইটা হল সমস্যা। তাদের ভয়, ফিরতি পথে আরবিরা তাদের ধরে বিক্রি করে দেবে। কুলিদের পাওনা মিটিয়ে বিদায় দেওয়া ছাড়া আর উপায় রইল না। ভাগ্য ভালো এখানে কয়েক ঘর মানুষের বসতি দেখা গেল। একজন বয়স্ক মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। আমি এই দেশে কেন এসেছি তা জানতে চেয়ে খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনল। বাইবেল বলে যে একটা বই আছে লোকটা তা জানে এবং ভগবানে বিশ্বাস করে। তার বউয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে এসে আমার জন্য অনেকটা শস্য দিয়ে গেল। ওর শরীরের ট্যাটুর ছবি দেখে চেনা যায় সে মাতাম্বে উপজাতির লোক। এদের শরীরে ট্যাটুগুলোর সঙ্গে জলের ঢেউয়ের মিল আছে। মিশরে ঠিক একইধরনের ট্যাটু ব্যবহার হত। আবার এদের শরীরে দেখলাম গাছ আর বাগানের ছবিও আছে। মাতাম্বেরা আবার তাদের সামনের পাটির দাঁতগুলো ঘষে ছুঁচলো করে রাখে। তাই তাদের একটু হিংস্র দেখায়।
সঙ্গে আনা পশুগুলো হারিয়ে আমি কুলিদের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছি। তাই মেতাবা গ্রামের দিকে এগোতে লাগলাম যদি কিছু কুলি আরও জোগাড় করা যায়। রোভুমা থেকে মেতাবার দিকে যাবার পথে এক গ্রাম চোখে পড়ল। এখানে মানুষ শস্য সংগ্রহ করে গোলায় জমিয়ে রাখে।
গ্রামের মোড়ল ভীষণদর্শন। সে আমাদের নিয়ে গেল তার বিশাল জমায়েত ঘরে। সেখানে অনেক দো-আঁশলা আরবি বসে আছে, সবার হাতে বন্দুক। আসবার সময় পথের ধারে ফেলে দেওয়া ক্রীতদাসদের বন্দি করার কাঠের যন্ত্র দেখতে পেয়েছি, তাই এরা সবাই যে দাস ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ রইল না। তাদের কাছ থেকে এইটুকু জানা গেল যে, সামনে হ্রদের ধারে মাতাকা নামের একটা শহর আছে, যেখানে খাবারদাবারের অভাব নেই।
চলতে চলতে এক ভয়ংকর দৃশ্য দেখে চমকে গেলাম। এক স্থানীয় মহিলার শব একটা গাছের ডালে ঝুলছে! কাছের গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই মহিলা আরবিদের ক্রীতদাস ছিল। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আরবিরা ওকে বর্জন করবে বলে ঠিক করে। যাতে অন্য কোনও দাস ব্যবসায়ীর হাতে সে না পড়ে, সেজন্য তাকে ওরা মেরে রেখে গেছে। বড়ো যন্ত্রণাদায়ক এই দৃশ্য। এরপর আরও অনেক শব আমরা গাছের ডালে ঝুলতে দেখলাম। এমনকি পথে মৃতদেহ পড়ে থাকতেও দেখলাম।
মেতাবায় পৌঁছে দুঃসংবাদ পেলাম। সেখানকার মোড়ল জানাল, কারও কাছে শস্য উদ্বৃত্ত নেই, যে বিক্রি করা যাবে। বিক্রয়যোগ্য কিছু নেই, কিন্তু এখানে মানুষ বিক্রি হয় অবাধে। বদমাইশ মোড়ল দাস ব্যাবসায় আরবিদের হাতে হাত মিলিয়েছে। তার গায়ে মূল্যবান আরবি পোশাক, আর যথেচ্ছ পাউডারের ব্যবহার। আমাদের কাছ থেকে সবচাইতে দামি কয়েক গজ কাপড় আর অনেক ইচ্ছেমতো জিনিস নিয়ে মাত্র সামান্য একটু পরিজ আর একটা মুরগি দিল, যা আমাদের পক্ষে যৎসামান্য।
মেতাবা ছেড়ে আমরা রোভুমা নদীর দিকে গিয়ে একটা দ্বীপ দেখতে পেলাম। এখানে অনেক ঘর মানুষের বাস, তারা মাকোন্ডে উপজাতির। দ্বীপের জমি বেশ উর্বর। এর কারণে এরা ভালোই চাষ-আবাদ করেছে দ্বীপে। জঙ্গলও বেশ ঘন। চাষের জমি উর্বর করার জন্য জঙ্গল পোড়ানো হয়, তার প্রমাণ পাওয়া গেল।
এখানকার লোকগুলো বেশ শান্তশিষ্ট। ভগবানে বিশ্বাস করে, তবে কোনও দেবতার পুজো করে না। এরা মাথায় আর গলায় নানা রঙের পুঁতির মালা লাগিয়ে রাখে। এদের আগুন জ্বালানোর কায়দা বহু প্রাচীন। সেই প্রস্তর যুগের পরবর্তী ধাপ। বুনো ডুমুরগাছের কাঠ দিয়ে লাঠি বানিয়ে সে-লাঠির আগায় থুতু লাগিয়ে ভিজিয়ে নেয়। তারপর সেই ভেজা দিকটাতে বালি লাগিয়ে একটা গর্তের মধ্যে জোরে জোরে ঘোরালেই আগুনের ফুলকিতে শুকনো কাঠ আর লতাপাতায় আগুন ধরে যায়।
এরা পাথর গরম করে রান্না করতে জানে না। উনুন বানায় পিঁপড়ের ঢিপিতে, না-হয় গর্তের উপর। সেখানেই হাতির পা বা জেব্রার মাথা সেদ্ধ করে বা পুড়িয়ে খায়। তবে যেসব পশু মানুষ মেরে খায়—যেমন হায়েনা, চিতা বা সিংহ, তাদের মাংস এরাও খায় না।
গ্রামের মোড়ল চিরিকালোমাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মানুষখেকো মানুষ আছে নাকি এই দেশে?”
সে বলল, “আছে, তবে আমরা তাদের দেখতে পাই না। শুনেছি তারা শুধু সমুদ্র পার হয়ে এ-দেশে আসা তোমাদের মতো মানুষদেরই শুধু দেখা দেয়। এই দেশে এমন দৈত্য আছে, যাদের সামনের দিকে দুটো চোখ ছাড়াও পিছনদিকে দুটো চোখ আছে। তারাও শুধু সাদা চামড়ার লোকদের চোখে ধরা দিতে পারে, কিন্তু আমরা তাদের দেখতে পাই না।”
ঢিমে আঁচে মাছ, মাংস রান্না করার জন্য এরা উঁচু মাচা বানায়। মাচার নীচে ধিকি ধিকি কাঠকয়লার আগুন জ্বলে। আবার রাতে আঁচ কমে এলে মাচার উপরেই শুয়ে পড়ে। এখানে এখন এই জুন মাসের শেষের দিকে রাতে বেশ ঠান্ডা পড়ে। তাই মাচায় শুয়ে থাকলে ওম পাওয়া যায়, আবার মশার উৎপাতের হাত থেকে বাঁচা যায়।
মাকোন্ডেদের মাটির বাসন বানাবার কায়দা দেখার মতো। মেয়েরাই এইসব কাজ করে। স্রেফ চোখের আন্দাজে একাবারে নিখুঁত গড়নের মাটির পাত্র বানিয়ে ওরা সরু বাঁশের তক্তি দিয়ে মসৃণ করে। তারপর রোদে সেই বাসন শুকোতে দেয়। বার বার মাটির প্রলেপ লাগিয়ে ঢিমে আগুনে পুড়িয়ে বাসনগুলো শক্ত করা হয়। পাত্রগুলোর কানায় সুন্দর কারুকার্য দেখার মতো।
আবার রোভুমা নদীর ধার দিয়ে আমাদের চলা শুরু। ইতিমধ্যে আমার তেরো জন সেপাইয়ের মধ্যে ছয় জন আমাদের দলে ফিরে এল। যদিও এখনও তারা আমার বশ্যতা স্বীকার করে অভিযানে সঙ্গে থাকবে, এমন আমার মনে হল না। আমার সহকারী মুসা হয়তো তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে, কিংবা স্রেফ সমুদ্রের পাড় পর্যন্ত অনিশ্চিত যাত্রার ভয়ে তারা মত বদলেছে। সঙ্গের পশুদের মধ্যে একটি মাত্র খচ্চর তারা বাঁচিয়ে আনতে পেরেছে। বাকি সব পশুরা মারা গেছে। এরা তাদের কেটে খেয়েছে, নাকি তারা অসুখে মরেছে—তা কে জানে?
সামনে যে গ্রামের দেখা পেলাম, তাদের সবার গায়ে সাদা দামি কাপড়। বোঝাই যাচ্ছে, আরবি দাস ব্যবসায়ীরা এদের যথেচ্ছ কাপড় বিলি করে হাত করেছে। বুঝলাম, কাপড়ের বিনিময়ে একদানা শস্যও খাওয়ার জন্য এখানে মিলবে না। খোঁজ নিয়ে জানলাম, আরও অনেক দূরে লেক নয়াসার উত্তরদিকে নিন্দি উপজাতির লোকেরা বাস করে, সেখানে গেলে খাবারের অভাব হবে না। তবে গ্রামবাসীরা নাকি মাজিটুদের কাছে ট্রেনিং পেয়ে চুরি ডাকাতি শিখে ফেলেছে। সেদিকে যাওয়া আমাদের পক্ষে খুব একটা সমীচীন হবে না।
শোনা গেল রোভুমা নদীর উপত্যকায় ওয়াইইউ উপজাতির এক প্রভাবশালী নেতা আছে, যার নাম মাতাকা। তারা এক শহর বানিয়েছে পাহাড়ের উপর। ঠিক করলাম কয়েকদিন যাত্রা করে ওখানেই পৌঁছে যাই। তাহলে খাবারের অভাব হওয়ার কথা নয়।
শেষ খচ্চরটাও মারা গেল। কারণ বোঝা গেল না। কিন্তু তার চাইতেও মারাত্মক একটা দৃশ্য দেখলাম একদিন। আমাদের চিৎকার করে ডেকে এক সুসজ্জিত মহিলা তার করুণ কাহিনি শোনানোর জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগল। কাছে গিয়ে দেখি সদ্য তার গলায় একটা দাসদের বশ করার কাঠের যন্ত্র লাগানো হয়েছে। জানা গেল, নদী পার হয়ে সে তার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিল, তখন গাঁয়ের এক বুড়ো তাকে বন্দি করে দাস বানায়। ধরে-বেঁধে বুড়োর বাড়ির লোক তার গলায় কাঠের বন্ধন আটকে দিয়েছে। সেই মহিলা আবার পিছনে ফেলে আসা গ্রামের মোড়ল চিরিকালমার আত্মীয়। আমি মধ্যস্থতা করে দোষী বুড়োকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করলাম, “একে বন্দিমুক্তি দিতে চিরিকালমার কাছ থেকে তুমি কী চাও?”
সে উত্তর দিল, “কিচ্ছু চাই না।”
ইতিমধ্যে দেখি অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে, যারা সবাই দাস ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত বলে মনে হল। তাই বুড়োকে বেশ খানিকটা কাপড়ের বিনিময়ে ওকে মুক্তি দিতে বললাম। লোকটা আমার কথা শুনল। ভিড় পাতলা হয়ে গেল। আমরা আবার এগোতে লাগলাম।
আর একটু এগোতে আবার এক গুলিবিদ্ধ মহিলাকে দেখতে পেলাম। উলটোদিকে একদল স্থানীয় মানুষ সেই দৃশ্য দেখছে। সকালবেলাতেই নাকি আরবি দাস ব্যবসায়ীরা অসুস্থ ক্রীতদাসটিকে গুলি করেছে তাকে বিক্রি করে দাম পাওয়া যাবে না বলে। অসুস্থ অবস্থায় সে দাস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আর পথ চলতে পারছিল না।
পরদিন আরেকটা লোককে রাস্তায় মৃত অবস্থায় দেখতে পেলাম। তার কঙ্কালসার চেহারা দেখে মনে হল, সে না খেতে পেয়েই মারা গেছে। আমাদের দলের একজন একদল লোককে কাঠের দাস-শিকলে বাঁধা অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখল। এরা সবাই তাদের মালিকের পরিত্যক্ত। দুর্বল শরীরের জন্য এদের কারও গলা দিয়ে আওয়াজ পর্যন্ত বেরোচ্ছিল না।
দু-দিন পর আমরা দুই গ্রামের লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। একদিকের গ্রামবাসী অপরদিকের গ্রামবাসীদের বন্দি করে ক্রীতদাস বানিয়ে বেচে দেবার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমি মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করলাম। উলটে যারা ডাকাতি করছিল, তারা আমাদের আরবিদের দলের লোক ভেবে বসল। নানারকমভাবে মানুষদের বন্দি বানাবার জন্য আমাদের প্ররোচিত করতে লাগল। শেষে সেই জায়গা ছেড়ে যেতে বাধ্য হলাম আমরা। কিন্তু তখন খাবারের অভাবে আমাদের সবাই প্রায় ধুঁকছে। রাতের আশ্রয় নিতে বাধ্য হলাম এক বাজরার ক্ষেতে, কিন্তু সেখানে একদানা শস্য নেই। তাই বাধ্য হয়ে বাজরার পাতা চিবিয়েই খিদে মেটাতে হল।
আরেকটা গ্রামে পৌঁছে দেখি সেখানে মাটি খুব উর্বর, অনেক বাজরা ফলেছে। কিন্তু আরবিদের দাস ব্যাবসা এ-দেশের মানুষকে এত কলুষিত করেছে যে প্রায় সবাই হাতসাফাইতে ওস্তাদ। এখানে এসে সেই মহিলার সঙ্গে দেখা হল, যাকে আমরা ক্রীতদাস হওয়া থেকে বাঁচিয়েছিলাম। সে আমাদের অনেক খাবার এনে দিল, অনেক কম কাপড়ের বিনিময়ে। আমাদের জন্য কিছু খাবার রান্না করেও দিল। আসলে মহিলা আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত যতদূর সম্ভব সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছিল।
এর মধ্যে আমাদের অনেক জিনিস—যেমন ছুরি, চায়ের কেটলি আরও অনেক কিছু চুরি হয়ে গেল। যদিও গ্রামের মোড়লের সহায়তায় সে-সব খুব তাড়াতাড়ি ফেরতও পাওয়া গেল। চোরদের মধ্যে থাকা শ্রেয় না মনে হওয়ায় সেই গ্রাম থেকে তাড়াতাড়ি পিঠটান দিলাম।
রোভুমা নদীর উপত্যকায় গভীর জঙ্গলের সুযোগ নিয়ে চলা অবাধ দাস ব্যাবসায় সরল মানুষদের কষ্টকর জীবন দেখে বুক ফেটে গেলেও কার্যত আমার কিছুই করার নেই। এই দাস ব্যাবসার শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত গেড়ে বসেছে। যেখানেই গ্রামের মোড়লকে বোঝাতে গিয়েছি যে দাস ব্যাবসায় উৎসাহ না দিয়ে চাষবাসে পরিশ্রম বেশি করলে মানুষের অনেক উন্নতি সম্ভব, সেই-ই অন্য গাঁয়ের দিকে আঙুল তুলে বলেছে, “ওরা আমাদের সব ফসল চুরি করে আমাদের গাঁয়ের মানুষকে বন্দি করে দাস বানিয়ে আরবিদের কাছে বেচে দেবে। তাই চাষবাস করে তেমন কিছু লাভ নেই।”
পথে এক বিশাল দাস ব্যবসায়ীর দলের সঙ্গে আমাদের দেখা হল। সব মিলিয়ে প্রায় জনা ষাটেক মানুষ মিছিল করে চলেছে আমাদের উলটো পথে। এদের প্রধান মহম্মদ সেইফ, আমার সঙ্গে দেখা করে অনেক রান্না করা খাবার আর একটা জ্যান্ত ষাঁড় উপহার দিল। তার উপঢৌকন নিতে কুণ্ঠা হলেও অর্ধভুক্ত মানুষদের দিকে তাকিয়ে সে-সব খাবার নিতে আমি বাধ্য হলাম। এমনকি সেই দাস ব্যবসায়ী আমার দলের পিছিয়ে পড়া সেপাইদেরও কিছু খাবার দিল। আমি মূল্যস্বরূপ তাকে কিছুটা কাপড় দিলাম। আমাকে সে অভয় দিল যে, সিপাইদের দেখাশুনো করার দায়িত্ব সে যত্নসহকারে পালন করবে।
খাবার, অনেক খাবার
ওয়াইইউ জনজাতির সেই শহর খুঁজে পেলাম পাহাড়ে ঘেরা এক উঁচু উপত্যকায়। প্রায় হাজার খানেক ঘরবাড়ি সেখানে। পাহাড় এখানে ন্যাড়া নয়, সবুজ জঙ্গলে ঢাকা। অনেকটা জায়গা জুড়ে জঙ্গল সাফ করে চাষাবাদ করেছে লোকে। ওরা আগে নাকি অন্য জায়গায় বাস করত। মাজিটুদের তাড়া খেয়ে এখানে এসে বসতি গড়ে তুলেছে। বেশিরভাগ বাড়ি আরবি কায়দায় তৈরি, চৌকো আকৃতির। এরা দেখি মটরের চাষও করে। খুব সম্ভব ইউরোপ থেকে মটর আমদানি করা হয়েছে। আফ্রিকায় মটর পাওয়া যাওয়ার কথা নয়। এছাড়া মেটে আলু, তামাক আর ভুট্টার চাষও হয় এখানে। খুব যত্নসহকারে প্রাকৃতিক ঝরনাগুলো কাজে লাগিয়ে এরা সেচের কাজ করেছে বলেই চাষ এত ভালো হচ্ছে। আরবিদের সংস্কৃতির ছাপ এদের জীবনে স্পষ্ট।
দলপতি মাতাকার দেখা পেতে অনেক সময় লেগে গেল। বিরাট এক চৌকো বাড়ির বারান্দায় সে আমাদের দর্শন দিল। ষাটের কাছাকাছি বয়স, হাসিখুশি লোকটার পরনে দামি সাদা আরবি পোশাক। আমাকে সে বলল যে এই প্রথম সে কোনও ইংরেজকে দেখল। মাতাকার সঙ্গে দেখা হতেই আমাদের খাদ্য সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। পরিজ আর রান্না মাংস দিয়ে সে আমাদের ভুরিভোজ করাল। এখানে অনেক ছাগল, ভেড়া পালন হয়। দুধের কোনও অভাব নেই।
মাতাকা আমার থাকার জন্য বেশ বড়সড় একটা বাড়ি ছেড়ে দিল। ক’দিন একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকা যাবে।
পরদিন সকালে মাতাকা আমাদের জন্য অনেক দুধ পাঠিয়ে দিল। অনেকদিন পর আমরা দুধ খেয়ে চাঙ্গা হলাম।
পরদিন খোঁজ নিয়ে জানলাম, লেক নয়াসা যাবার দুটো রাস্তা—একটা পশ্চিমের দিকে গেছে, সেদিক দিয়ে গেলে মাত্র পাঁচদিনে পৌঁছানো যায়, কিন্তু পথে খাবার পাওয়ার সম্ভাবনা কম। আরেকটা রাস্তা দক্ষিণের দিকে চলে গেছে, সেই পথে গেলে সাতদিন লাগবে। ওদিকে লোকালয় পাওয়া যাবে আর খাবারের অভাব হবে না।
এর মধ্যে একটা কাণ্ড ঘটে গেল। মাতাকার শহরের কিছু লোক তার বিনা অনুমতিতে লেক নয়াসার দিকে গিয়ে অনেক দাস আর গোরু-ছাগল ধরে নিয়ে এসেছে। সেই শুনে মাতাকা সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দিল, এখুনি যেন সব বন্দি মানুষ আর পশু সেখানে ফিরিয়ে দিয়ে আসা হয়। ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগল। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি যে, মাতাকা সরাসরি দাস ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আজ সে উলটো সুরে গাইছে। যাই হোক, ওর হৃদয় পরিবর্তন হওয়াও অস্বাভিক কিছু নয়।
মাতাকাকে যখন বললাম যে তার বিচার আমার খুব পছন্দের হয়েছে, তখন সে নিজের ভাষায় ডাকাতি করে ফিরে আসা মানুষদের ঝাড়া লেকচার দিয়ে বোঝাল যে, জ্ঞানী ব্যক্তিমাত্রই তাদের এই কাজ সমর্থন করবে না। বন্দি মানুষ আর পশুদের ফিরিয়ে দেবার জন্য একটা দল তখুনি রওনা দিল। কিন্তু ক’দিন পর যখন আমরা লেক নয়াসার দিকে এগোচ্ছি, শহর থেকে একটু দূরে দেখি পশুর মাংস বিক্রি হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মাতাকার লোকেরা মানুষ ফিরিয়ে দিয়ে এসেছে, কিন্তু পশুগুলো বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে চড়া দামে।
আমার সেপাইরা দলে ফিরে এল, কিন্তু আমার একমাত্র গাধাটা তাদের সঙ্গে দেখা গেল না। গাধার খোঁজ চাইতে জবাব এল, “জঙ্গলে একটা বাঘ এসে গাধাটাকে ঘাড় মটকে দিয়ে খেয়ে ফেলেছে। আমরা কোনোমতে বাঘের কবল থেকে বেঁচে পালিয়ে এসেছি।”
আমি এই উত্তর শুনে জিজ্ঞেস করলাম, “বাঘটার গায়ে কি ডোরা ডোরা দাগ ছিল?”
সেপাইরা তাদের ঘোলাটে চোখ তুলে আগ্রহ নিয়ে বলল, “হ্যাঁ হুজুর, তা আর বলতে? লম্বা লম্বা ডোরাকাটা দাগ ছিল তার শরীরে!”
আমি ধমক দিলাম, “হতভাগার দল! এই তল্লাটে কেন, গোটা আফ্রিকা তন্নতন্ন করে খুজলেও এমন ডোরাকাটা বাঘ দেখা যাবে না। সত্যি করে বল, যে তোরা তাকে কেটে খেয়েছিস!”
বুঝলাম এরা কেউ সত্যি কথা বলবে না।
আরও এক কাণ্ড ঘটল। আমার ঘর থেকে সিপাইদের একজন বন্দুকের গুলি, কিছু পোশাক আর শুকনো মাংস চুরি করল। বাধ্য হয়ে ওদের খেদিয়ে দিলাম। ঠিক করলাম, আর নয়, এদের নিয়ে অভিযান করলে আমার বা দলের অন্য লোকের প্রাণ যাবার সম্ভাবনা পর্যন্ত আছে। আঠারো গজ কাপড় দিয়ে ওদের বিদেয় করলাম। কোনও আরবি অভিযাত্রী দলের সঙ্গে সমুদ্রের পাড় পর্যন্ত অনায়াসে ওরা ফিরে যেতে পারবে। মাতাকাকে আটচল্লিশ গজ কাপড় দিয়ে ওর আতিথেয়তার ঋণ মেটালাম।
মাতাকার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় একটা সংবেদনশীল ঘটনা ঘটে গেল। আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য অনেক লোক জুটেছিল। আমার দলের নাসিক বয়েজদের মধ্যে আব্রাহাম নামের ছেলেটা হঠাৎ তার এক চাচাকে সেই ভিড়ের মধ্যে আবিষ্কার করে ফেলল। তারপর দুজনে দুজনকে জড়িয়ে খুব একচোট কাঁদল। জানা গেল, আব্রাহামের মা আর বোন দুজনকেই আরবিরা দাস বানিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। সেই শুনে আব্রাহাম আরও ভেঙে পড়ল। ওর চাচা তার কাছেই আব্রাহামকে থেকে যেতে বলল। কিন্তু আব্রাহাম বুক চাপড়ে বলল, যখন মা আর বোনই রইল না, এই দেশে থেকে যাওয়ার চাইতে সাহেবের অভিযানে সঙ্গী হওয়াই তার উচিত।
আগে এগিয়ে দেখলাম অনেক জমি এমনিই পড়ে আছে যেখানে মাইলের পর মাইল কোনও মানুষের বসতি নেই। কিন্তু এখানে একসময়ে মানুষ বাস করত। লোহা গলানোর প্রাচীন মাটির তৈরি নল আর পরিত্যক্ত হাপর দেখতে পেলাম অনেক জায়গায়। মাটির ভাঙা বাসনপত্রও দেখলাম এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলতে চলতে আমি দেখলাম এই জায়গাটা সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৩,৪০০ ফুট উঁচুতে। অনেক ঝরনার পাশ দিয়ে আমরা হেঁটে যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু স্নান করা সম্ভব নয়, কারণ এই জায়গাটা বেশ ঠান্ডা।
তিনদিন ক্রমাগত মনুষ্যবিহীন প্রান্তর পার হয়ে এক গ্রামে এসে পৌঁছলাম। গ্রামের মোড়ল খুব খাতির করল। অনেক খাবার কিনলাম আমরা এই গ্রাম থেকে। এখানেও দেখলাম সেই একই কায়দায় সেচের ব্যবস্থা করে মটর চাষ হয়। এখানে মাটি বেশ উর্বর। তবে আমরা যে পথ পেরিয়ে এসেছি, সেই পাথুরে পথের পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য লিখে রেখেছি রয়াল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটিকে জানাব বলে। সবচাইতে উল্লেখযোগ্য হল, এখানে মাটির নীচে কয়লার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। পাথরের গুণাগুণ বিচার করে আমার তাই মনে হয়েছে।
আবার চলা শুরু হল। মনোরম এক পাহাড়ের নীচে ঝরনার ধারে আমরা বিশ্রাম নিচ্ছি, এমন সময় দেখি আমাদের খুব কাছ দিয়ে বিরাট এক আরবি দাস ব্যবসায়ীর দল যাচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছে ছিল ওদের সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু শুনলাম, ইংরেজ বলে আমার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছে তারা। দলে নিদেনপক্ষে ৮০০ ক্রীতদাস ছিল। আসলে এই আরবিরা চায় না তাদের ব্যাবসা সম্পর্কিত তথ্য ইংরেজ শাসকেরা জেনে যাক।
বেচুয়ানা বলে একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম। এখন বাতাস বেশ ঠান্ডা। চারদিকে নানা গাছগাছালি, পাখিরা গাছের মাথায় কিচিরমিচির করছে। বেশ মনোরম পরিবেশ। গাম কোপাল গাছই বেশি। কয়েক ঘর মানুষের বসতিও দেখা যাচ্ছে। এখানেও লোহা গলানোর হাপর এদিক ওদিক দেখা গেল। এই গ্রামে একদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু হল পথচলা।
এর পরে একটা গ্রামে এলাম, যার নাম মিউল। এখানে গ্রামের মোড়লকে জিজ্ঞেস করলাম, ফেলে আসা বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে এত লোহা গলানোর নানা চিহ্ন কেন দেখা যায়। সে বলল, আগে ওখানে মানুষ লোহার যন্ত্রপাতি বানাত। কিন্তু দাস ব্যাবসা আর খরার কারণে এই দেশ ছেড়ে চলে গেছে তারা। তার সঙ্গে আলাপ জুড়ে অনেক অদ্ভুত তথ্য পেলাম। মিউল গ্রামে লোকে চাষবাস করতে কাঠের তৈরি যন্ত্র ব্যবহার করে। লোহার ব্যবহার সেখানে হয় না। এর কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পেলাম না।
আমরা মিউল ছেড়ে লেক নয়াসার দিকে এগোতে লাগলাম। লয়েন্ডি নদীতে যে শেষ ঝরনাটা বয়ে গেছে, তার পাশেই রাতের আস্তানা গাড়া হল। একটা উঁচু জায়গায় এসে লেক নয়াসার নীল জলের দর্শন পেলাম। মনটা খুশিতে ভরে গেল। এখানে দু-তিন জায়গায় কিছু বড়ো বড়ো পাথর জড়ো করে রাখা। মনে হয় মানুষ কবর দেওয়ার জন্য জায়গাটা ব্যবহার করত। হ্রদের জলে একটা কুড়ি ফুটমতো চওড়া জলের স্রোত মিশেছে। সেটা হাঁটু পর্যন্ত গভীর। আমরা সেই ঝোরা পেরোলাম। আরও নীচের দিকে মানুষের বসতি। এখানে খুব চাষাবাদ হয়, তাই খাবারের অভাব হবে না।
আমাদের দেখে স্থানীয় মানুষ খুব খুশি হল। তারা খুবই অতিথিবৎসল। আমাদের চারটে মুরগি, একধামা ভুট্টা, প্রচুর কুমড়ো আর একটা মোটাসোটা কৃষ্ণসার হরিণ দিয়ে দিল। বিনিময়ে কিছুই দিতে হল না। এদের এখানে খাবার উদ্বৃত্ত। তারা আবার আদর করে আমাদের কিছুদিন এই গ্রামে থেকে যেতে বলল। অনেক দূরে হাত দেখিয়ে বলল, সেখানে গেলে নাকি অনেক মোষ, হরিণ, হাতি আর জলহস্তী শিকার করা যায়।
যে ঝোরাটা আমরা পার হয়ে লেকের ধারে এই গ্রামে এসে পৌঁছেছি, তার নাম মিসিঞ্জে। ভগবানকে আমি ধন্যবাদ জানালাম এই পর্যন্ত আমাদের সুরক্ষিত রেখে এসে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেবার জন্য। এই গ্রামের মোড়লের নাম মোকালোসে। দেখা করতে এসে সে অনেক ভেট নিয়ে এল—রান্না করা হিপোর মাংস, পরিজ, দুধ ইত্যাদি। সে খুব গপ্পে লোক। জানাল, এরা সবাই মাঙ্গাঞ্জা উপজাতির মানুষ, যাদের গায়ের চামড়া মিশমিশে কালো। তখুনি আরেকজন লেকের মাছ নিয়ে এল বিক্রি করার জন্য। এই মাছ ঢিমে আঁচে সেঁকে নিলে খুব উপাদেয়। তবে যৎসামান্য দাম দিতে হল। মাত্র দু-গজ কাপড় দিয়ে পঞ্চাশটা বড়ো বড়ো মাছ কিনলাম। এই মাছ আবার দেশের ভিতরের দিকে খুব চড়া দামে বিক্রি হয়।
(ক্রমশ)