ধারাবাহিক অভিযান-নাইল নদের খোঁজে-লিভিংস্টোন-অনু-অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়-শীত ২০২১

জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- ভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়)  অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)

obhijaanlivingstone02

(পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পর্তুগিজ অভিযাত্রী প্রিন্স হেনরি প্রথম আফ্রিকা মহাদেশকে সমুদ্রপথে প্রদক্ষিণ করেন। সভ্য দুনিয়ার গোচরে আসে অন্ধকার দেশ, আফ্রিকা। ঘন জঙ্গলে ঢাকা আফ্রিকার রহস্য তখনও অনাবৃত বাইরের দুনিয়ার কাছে। প্রাকৃতিক দুর্গমতার কারণে আফ্রিকার অভ্যন্তরে ঢোকা মানুষের পক্ষে অসম্ভব ছিল। যারা বুকে সাহস সঞ্চয় করে তার পেটের ভিতরে ঢুকে পড়ত, তারা কিছুদূর এগিয়ে অভিযান স্থগিত রেখে ফিরে এসে জানাত আফ্রিকার জঙ্গলে আছে হিংস্র জন্তু, বিষধর সাপ, খরস্রোতা নদী আর বিচিত্র আদিম মানুষ যারা মানুষ ধরে খায়, যাদের ভাষা দুর্বোধ্য।

এরপর চার শতাব্দী ধরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ আরব, স্পেন, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড থেকে দুর্ধর্ষ অভিযাত্রীরা আফ্রিকার রহস্য আবিষ্কারের নেশায় বারে বারে দুর্ভেদ্য জঙ্গলে অভিযান চালায়। হাতির দাঁত, মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় উপনিবেশকারীদের প্রয়োজন হয় কায়িক পরিশ্রম করবার জন্য মানুষ। শুরু হয় দাস ব্যাবসা। আফ্রিকার কালো মানুষদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় আরব, আমেরিকা, ভারত ও আরও অনেক দেশে।

ডেভিড লিভিংস্টোন ছিলেন পেশায় ডাক্তার। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন খ্রিস্ট ধর্মযাজকও। লিভিংস্টোন প্রথম আফ্রিকা পাড়ি দেন ১৮৪১ সালে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। আফ্রিকার অবাধ দাস ব্যাবসার বিরোধী ছিলেন তিনি। বেশ কয়েক দশক ধরে আফ্রিকায় অভিযানে যান ডক্টর লিভিংস্টোন। প্রতিটি অভিযানে আফ্রিকার জনজাতি, ভূতত্ত্ব, পরিবেশ খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য লিখে রাখেন নিজের ডায়েরিতে।

অসম সাহসী ডক্টর লিভিংস্টোন প্রতিটি অভিযানে তাঁর সঙ্গে নিতেন ওষুধের বাক্স। শুধু নিজের দলের লোকদেরই নয়, আফ্রিকার মানুষের চিকিৎসাও তিনি করতেন। তাদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করতে এতটুকু দ্বিধা ছিল না ডক্টর লিভিংস্টোনের। তাই আফ্রিকার সরল মানুষেরা তাঁর খুব কাছের হয়ে ওঠে। বিভিন্ন উপজাতীয় ভাষাও শিখে ফেলেন তিনি।

লিভিংস্টোনের আফ্রিকা অভিযান লন্ডন এবং আমেরিকার বিভিন্ন পত্রিকার নজর কাড়ে। তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৮৬৬ সালে নীলনদের উৎস সন্ধানে আফ্রিকার সমুদ্র উপকূলে জাঞ্জিবর শহর থেকে জীবনের শেষ আফ্রিকা অভিযানে যান লিভিংস্টোন। কিন্তু সেই বছরের শেষের দিকে হঠাৎ জানা যায় আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে তাঁর মৃত্যু হয়েছে জুলু উপজাতির লোকের হাতে। সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসেন ডক্টর লিভিংস্টোন। তাঁর খোঁজখবর শুরু হয়ে সরকারি উদ্যোগে।)

x-default

বম্বে থেকে ভারত মহাসাগর পার হয়ে এসে পৌঁছলাম জাঞ্জিবর। এটি আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের এক দ্বীপ। এই দ্বীপের এক রাজা আছে, যে নিজেকে ‘সুলতান’ বলে পরিচয় দেয়। এখন তার প্রতিপত্তি অস্তাচলে। এই দ্বীপে অবাধে চলে দাস ব্যাবসা। অজস্র নিরপরাধ আফ্রিকার সরল মানুষকে বন্দি করে চালান দেওয়া হয় ইউরোপ, আরব, আরও নানা সভ্য দেশে। জাঞ্জিবরে যারা এই ব্যাবসা চালায়, তারা হল আরবি। ওরা সুলতানকে কমিশন দেয় দাস ব্যাবসা চালানোর জন্য। সুলতান মাজিদ-বিন-সৈয়দকে হাতে না রাখলে আমার আফ্রিকা অভিযান অসম্ভব। লোকলশকর, জিনিসপত্র বোঝাই করে পাড়ি জমাতে হবে আফ্রিকার জঙ্গলে। ভারতের বম্বে শহরের গভর্নর ফ্রেরি জাঞ্জিবরের সুলতানকে চিঠি লিখে আমাকে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেছেন। তিনি আবার সুলতানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আসলে এই বন্ধুত্ব সেই দাস ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত। আগে ভারতেও আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস পাঠানোর ব্যাবসার রমরমা ছিল। এখন লন্ডনের রানি আইন করে সেই প্রথা রদ করেছেন। কিন্তু আরবিরা সেই আইন মানে না।

obhijaanlivingstone03

আফ্রিকা আমার হাতের পাতার মতো চেনা। ষোলো বছর একটানা এই অন্ধকার মহাদেশের এক কোনা থেকে আরেক কোনায় অভিযান চালিয়েছি। দাসপ্রথা থেকে আফ্রিকাকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছি। প্রভু যিশুর শুকনো বাণী ছড়িয়ে ওদের চেতনা আনা যাবে না—এই বিশ্বাস আমার চিরকালের। রোগমুক্ত করতে হবে এই অসহায় মানুষগুলোকে। তাই ওষুধের বাক্স নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি আফ্রিকার জঙ্গলে। ইউরোপীয় চিকিৎসাই কালো মানুষগুলোকে উদ্ধারের পথ দেখাবে, এই ভরসা আমার সম্বল।

লন্ডনের রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটি আমাকে অর্থ দিয়েছে এই অভিযানের জন্য। তাদের উৎসাহ এবং আমার উপর ভরসা অনেকের মনে ঈর্ষা জাগায়। এবারের আফ্রিকা অভিযানের আসল উদ্দেশ্য হল নাইল নদের উৎস আবিষ্কার করা। আমার ধারণা, লেক টাঙ্গানাইকা থেকেই বেরিয়েছে নাইল নদ।

ভারত থেকে কিছু কুলি নিয়ে এসেছি। আগের অভিযানে এরা আমার সঙ্গী ছিল। এবারে এককথায় তারা রাজি হয়ে গিয়েছিল আমার সঙ্গে আফ্রিকার জঙ্গলে ভ্রমণ করতে। এদের উপর ভরসা করা যায়। আগে এরা সবাই ক্রীতদাস ছিল, এখন মুক্ত। ওরা বম্বের কাছে নাসিকে কুলির কাজ করছিল, তাই ওদের নাম দিয়েছি ‘নাসিক বয়েজ’। ওরা আফ্রিকার ভাষা জানে, আবার হিন্দুস্থানের ভাষাতেও সড়গড়। বম্বের গভর্নর ফ্রেরি হিন্দুস্থানের তেরো জন সিপাই দিয়েছেন আমার সঙ্গে আফ্রিকা অভিযানে যাবার জন্য। তারা সবাই ভারতীয়। এরা বন্দুক চালাতে বেশ পটু, এমন কথাই জানতে পেরেছি। আফ্রিকার জঙ্গলে পদে পদে বিপদ ওত পেতে থাকে। তাই ওদের সঙ্গী না করে উপায় নেই। তবে জাহাজে জাঞ্জিবর আসবার সময় বুঝতে পেরেছি সিপাইগুলো একটু কুঁড়ে প্রকৃতির। ওরা ইংরেজি কম বোঝে। কিন্তু নাসিক বয়েজরা দোভাষীর কাজ করে দিচ্ছে বলে খুব অসুবিধা হচ্ছে না।

জাঞ্জিবর খুব নোংরা শহর। শহরের যত আবর্জনা আর মল-মূত্র দুই বর্গ কিলোমিটার সমুদ্রতটকে কলুষিত করে ভারত মহাসাগরে গিয়ে পড়েছে। কিন্তু দ্বীপের সৌন্দর্য অপরিসীম। চারদিকে নারকেল আর জলপাইগাছ। অনুচ্চ পাহাড়গুলো জঙ্গলে ঢাকা। সমুদ্রের পাড়ে একটা বাড়ি নিতে হল ভাড়ায়। যতদিন না একটা জাহাজের ব্যবস্থা হয়, আর কেনাকাটা শেষ হয়, আপাতত এই জঘন্য শহরেই কাটাতে হবে। এখানের বাতাস দূষিত, দম বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। আরও কিছু লোকও জোগাড় করে তবে অভিযানে বেরোতে হবে।

সময় কাটানোর জন্য একদিন জাঞ্জিবরের বাজারে গিয়ে দেখি প্রায় তিনশো ক্রীতদাসের এক বাজার বসেছে। কালো আফ্রিকানদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে আরবিরা মানুষ কেনাবেচা করছে। পোশাক উঠিয়ে ক্রেতারা দেখে নিচ্ছে ক্রীতদাসদের পায়ের গোছ শক্তপোক্ত কি না। কাউকে আবার একটা জিনিস দূরে ছুড়ে দিয়ে বলা হচ্ছে— যা, কুড়িয়ে আন। ক্রীতদাসের দৌড়ের গতি দেখে ক্রেতারা বুঝে নিচ্ছে তাদের মানবসম্পদের দর কত। এই বাজার থেকে ঘেন্নায় মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া ছাড়া আমার কাছে আর কোনও পথ খোলা ছিল না।

obhijaannile (4)

মাস খানেক এভাবেই কেটে গেল জাঞ্জিবরে। মার্চ মাসের শুরুতে বৃষ্টি শুরু হল। আমি দলবল নিয়ে প্রতীক্ষা করে আছি কবে জোহানা থেকে পেঙ্গুইন জাহাজ এসে আমাদের নিয়ে যায়। রোভুমা নদী পর্যন্ত সেই জাহাজ আমাদের নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেবে। তারপর শুরু হবে আমাদের আফ্রিকার পেটের ভিতর ঢোকা। রসদ বোঝাই করা শেষ। রসদ বলতে কয়েক টন কাপড়, পুঁতি, ময়দা, চা, চিনি, কফি ইত্যাদি। বেশ একটা বড়ো রসদের ভাণ্ডার পাঠিয়ে দেওয়া হল লেক টাঙ্গানাইকার কাছের শহর উজিজিতে।

উজিজি আরবিদের দখলে। ওই পথে ওদের যাতায়াত আছে। তাই তাদের হাত দিয়েই সেই রসদ উজিজি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন জাঞ্জিবরের সুলতান সৈয়দ। আর আমার সঙ্গে চলল ওষুধের প্যাঁটরা, ছয় মাসের জন্য কিছু শুকনো খাবারদাবার। কাপড় আর পুঁতির বোঝাও নিতে হয়েছে। আফ্রিকার মানুষদের কাছ থেকে কিছু কিনতে হলে ওই দুটো জিনিসের বিনিময়ে সব পাওয়া যায়। স্থানীয় মুদ্রা হলে এটাই। ষাট জনের দল তৈরি হয়ে গিয়েছে। এবার শুধু জাহাজ আসার অপেক্ষা।

বহু প্রতীক্ষিত জাহাজ পেঙ্গুইন এসে পৌঁছল ক’দিন পর। আমি সঙ্গে নিলাম বড়ো নৌকো। তাতে ছ’টা উট, তিনটে মোষ, একটা বাছুর, দুটো খচ্চর আর চারটে গাধা তোলা হল। জাহাজে চাপল মানুষ। সুলতানের দয়ায় কয়েকটা কুলি জোহানা থেকেও এসে জুটেছে। চারদিন পর আমরা রোভামা নদীর মুখে পৌঁছলাম। স্টিমারের শক্তিতে চলা পেঙ্গুইন জাহাজ তরতর করে নদীতে ঢুকে পড়ল, কিন্তু সেই নদীতে অত বড়ো জাহাজ বেশি দূর যেতে পারল না। এদিকে স্রোতের উলটোদিকে বড়ো নৌকোয় চড়ে যাওয়া খুব কষ্টকর। বর্ষার সময় বাতাসে জোর নেই আর খরস্রোতা মাঝ দরিয়ায় দাঁড় টেনে এগোনো অসম্ভব। তাই পেঙ্গুইন ছেড়ে দিয়ে নৌকোয় চড়ে নির্দেশ দিলাম নদীর বামদিক ঘেঁষে ঢুকে পড়তে। পাড়ের দিকে স্রোতের টান কম। যদি দাঁড় টেনে কোনোমতে সুবিধাজনক তীরে পৌঁছতে পারি, তবে আমাদের স্থলপথ যাত্রা শুরু হতে পারে।

নদীর ডান পাড়ে জলের গভীরতা কিছুটা কম। পাড়ের দিকে স্রোতের বেগও কম। কিন্তু সুবিধা হল না। কাঁটা ঝোপ আর বাঁশের বনে ঢাকা বিস্তীর্ণ পলিমাটির মধ্যে দিয়ে পশুদের হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে নদীর তীরে তোলা একেবারেই সম্ভব নয়।

রোভুমা নদী বেয়ে আফ্রিকার ভিতরে ঢোকার কোনও পথই পাওয়া না যাওয়ায় সেদিন হতাশ হয়ে জাহাজে ফিরে এলাম। পেঙ্গুইনের কাপ্তান আমাকে যথেষ্ট ভরসা দিলেন। শেষে জানা গেল, রোভুমার মোহনা থেকে পঁচিশ মাইল দূরে সমুদ্রের খাঁড়িতে একটা বন্দর আছে, যার নাম মিকিন্ডেনি। সেখান দিয়ে ঘুরপথে যেতে হবে। পেঙ্গুইন আমাকে লোকলশকর, গোরু-মোষের পাল সহ মিকিন্ডেনিতে নামিয়ে দিয়ে ফিরে গেল জাঞ্জিবর।

মিকিন্ডেনি খাঁড়ির তটভূমিতে নেমে একটা ছোট্ট গ্রাম দেখতে পেলাম। জিনিসপত্র আর পশুদের নামানো হল নৌকো থেকে। সেখানেই খুঁজে পেতে একটা বাড়ি ভাড়া নিলাম মাস খানেকের জন্য। এখান থেকে পরিকল্পনামতো এগোতে হবে জঙ্গলে।

গ্রামের বাসিন্দারা সবাই দো-আঁশলা জাতীয়—অর্ধেক আরবি, অর্ধেক আফ্রিকান। তবে ওদের সবার গায়ের রঙ কালো। তারা খুব শান্তশিষ্ট। আমাদের আফ্রিকা আগমনের কারণ বার বার জিজ্ঞেস করছে দেখে বললাম, “এই দেশ থেকে ক্রীতদাস প্রথা যাতে উচ্ছেদ হয়ে যায়, সেই আশায় আমরা এখানে কাজ করতে এসেছি।”

আমার কথাটা কদ্দুর ওদের বিশ্বাসযোগ্য হল তা বোঝা গেল না, কিন্তু এগিয়ে এসে ওরা আমাদের সাহায্য করতে লাগল।

এখানে ধান আর ভুট্টার চাষ হয়। সামান্য কিছু কাপড়ের বিনিময়ে সেইসব খাবার ওরা স্বচ্ছন্দে আমাদের বাহিনীর জন্য দিয়ে দিল। এখানে আরেকটা জিনিসের চাষ হয়, যাকে বলা হয় গাম কোপাল। রাবারগাছের মতো বড়ো বড়ো পাতাযুক্ত গাছের গায়ে কোপ বসিয়ে দিলেই চ্যাটচেটে আঠা বেরোয়। সেই আঠার অনেক কাজ – ওষুধ বানানো যায়, শুকনো করে পুড়িয়ে দিলে সুন্দর গন্ধযুক্ত ধোঁয়া ওঠে। এই জিনিসের চাহিদা আরবদেশে খুব। জাঞ্জিবর হয়ে সেই গাম বা আঠা চালান হয় আরবে। জাঞ্জিবরের সুলতান তার এক মুন্সিকে বসিয়ে রেখে এখান থেকে ব্যাবসা-বাণিজ্য দেখাশোনা করে।

গাঁয়ের মোড়লের সঙ্গে একদিন দেখা হল। বয়স্ক মানুষ। বেশ হাসিখুশি। পরিচয় দিয়ে বলল, সে একজন ডাক্তার। আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আফ্রিকার সব গাঁয়ের মোড়লরাই এক-একজন ডাক্তার। কেউ মানুষের চিকিৎসা করে, কেউ আবার বৃষ্টি আনে—তারা হল বৃষ্টির ডাক্তার। মাত্র তিন গজ কাপড় দিতে সেই মোড়লমশাই গ্যালন খানেক মধু, চারটে মুরগি আর একধামা ধান দিয়ে দিল আমাদের খাবার জন্য। মোড়লের বউ আবার যত্ন করে সেই ধান ভেনে চাল বার করে দিল।

আমাদের জিনিসপত্র সব ঘরের বাইরের চত্বরে ফেলে রাখা ছিল। হিন্দুস্থানি সেপাইগুলো কুঁড়ের বাদশা, শুধু ঘুমায় আর ঘুম থেকে উঠে তামাকের ধোঁয়া ওড়ায়। ওদের বললাম রাতে মালপত্র পাহারা দেওয়ার জন্য পালা করে ঘরের বাইরে রাত্রি জাগরণ করতে। আমার আদেশে তারা খুব একটা খুশি হল বলে মনে হল না। এদিকে আবার গাঁয়ের মোড়লমশাই পাহারাদারি দেখে ক্ষেপে গিয়ে আমাকে দু-কথা শুনিয়ে দিয়ে বললেন, “কী ভেবেছ? এখানকার মানুষ সব চোর? আমাদের দেশে আর যাই পাও, চোর-ডাকাত পাবে না বাপু।”

মোড়লের ভাষা আমার কাছে অনেকটাই দুর্বোধ্য। এরা সোহাইলি ভাষায় কথা বলে। আমার দোভাষীর কাজ করে দিল জোহানা থেকে আসা কুলিরা। কিন্তু এই গাঁয়ে চোর যে আছে, সেটা দু-দিন পর জানতে পারলাম। শুনলাম, একজন সেপাইয়ের আনকোরা নতুন জামা চুরি করে পলাতক হয়েছে একটা স্থানীয় লোক। আমার লোকেরা তাকে কোথা থেকে খুঁজে এনে ধরে আনল। মোড়লমশাই বিচার করে বললেন, “এই জামার যা দাম, তার চারগুণ দামের জিনিস ফিরিয়ে দিলে ওকে ছেড়ে দাও, অন্যথায় যা ইচ্ছে শাস্তি দাও।”

আর যাই হোক, মোড়লমশাই যে খুবই ন্যায়পরায়ণ, এই বিষয়ে আমার আর কোনও সন্দেহই থাকল না।

এদেশে কোনও পশুপালন করা হয় না, শুধু মুরগি ছাড়া। সেটসি মাছির আক্রমণ তখনও শুরু হয়নি। তাই আমার সব পশুগুলো সুস্থই ছিল। কিন্তু একদিন আমাদের একটা মোষ হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে একটা গাধাকে এত জোরে গুঁতিয়ে দিল, যে সে-বেচারা খুব খারাপভাবে জখম হল। তার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে একটা গুলি করে তাকে চিরবিদায় দেওয়া হল। শাস্তিস্বরূপ চাকু দিয়ে মোষটার শিং কেটে ভোঁতা করে দেওয়া হল। এবার ওর গুঁতোয় আর কারও প্রাণ যাবার ভয় থাকল না।

দিন দশেক পর জঙ্গল কেটে রাস্তা বার করার কাজ শুরু হল। পেমা হ্রদের দক্ষিণ-পশ্চিম ধার দিয়ে হাঁটতে থাকলে রোভুমা নদীতে পোঁছে যাওয়া যাবে। আমার সেক্সট্যান্ট যন্ত্র তেমনই নির্দেশ দিল। ঘন বাঁশবন কেটে এগোতে হবে। জঙ্গল কাটার জন্য স্থানীয় কয়েকটা লোককে ভাড়া করেছি। তাদের সারাদিনের পারিশ্রমিক হল তিন ফুট করে কাপড়।

কখনও চড়াই, কখনও উতরাই পার করে, জঙ্গল কেটে আমাদের দল এগোতে লাগল। এখানেই প্রথম সেটসি মাছি আমাদের কয়েকটা পশুকে আক্রমণ করল। তবে সামান্য একটু ঝিমিয়ে পড়া ছাড়া তারা বড়ো রকমের অসুস্থ হয়ে পড়ল না। আমাদের দলের কয়েকজন কুলির জ্বর হয়েছিল, কিন্তু তারা চলা থামায়নি। আমার ওষুধেই কাজ হল, তাদের জ্বর সেরে গেল।

কিন্ডানি বলে একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম। এখানে হ্রদের ধারে প্রায় পাঁচ-ছ’টা গ্রাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে। লোকে খুব চাষাবাদ করে। জোয়ার আর গাম কোপালের চাষ হয়। একদিন রাতটা এই গ্রামেই কাটিয়ে দেওয়া গেল। এক সোমালি গাইড নিযুক্ত করলাম। তার নাম বেন আলি। নোমানো পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বেন আলির সঙ্গে কুড়ি ডলারে রফা হল। যাবার রাস্তাটা একটা উপত্যকা বেয়ে, যার ঘাস মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে আকাশের দিকে। ঘাস না কেটে আমরা তো ছার, পশুগুলোরও যাবার উপায় নেই। ফলে আমাদের গতি খুব ধীর হয়ে গেল। পশুদের গতি আরও কম। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখি, অতিরিক্ত বোঝা চাপানো হয়েছে তাদের পিঠে। আর এই কাজটা করেছে হিন্দুস্থান থেকে আসা সেপাইগুলো। আসবার আগে ওদের মাথাপিছু ভার নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনের অনেক বেশি জিনিসপত্র বেঁধে নিয়ে এসে এরা পশুগুলোকে কষ্ট দিচ্ছে। কষে ধমক দিলাম। ওরা শোধ তুলল মোটা লাঠি দিয়ে গাধা আর উটগুলোকে পিটিয়ে। খুব রেগে গেলাম। ওষুধ দিয়ে পশুগুলোর মারের জায়গার ক্ষতস্থানগুলোর চিকিৎসা করলাম।

তিনদিন এইভাবে জঙ্গল সাফ করে এগিয়ে গিয়ে চতুর্থ দিনে আবিষ্কার করলাম, আমাদের গাইড বেন আলি আমাদের ঘুরপথে নিয়ে গেছে। বেজায় রেগে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করলাম। সে-ব্যাটা দেখি বেপাত্তা। পরদিন সকালে সে এক মহিলাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে দাঁত বার করে হাসতে হাসতে পরিচয় করিয়ে দিল। জানা গেল মহিলা স্থানীয় মাকন্ডে উপজাতির—বেন আলির বিয়ে করা বউ। বউয়ের সঙ্গে দেখা করবে বলে সে আমাদের ঘুরপথে নিয়ে এসেছে। এখন আর রাগ করেও কোনও লাভ নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “একেও তোমার ধর্মে দীক্ষিত করে ফেলেছ নিশ্চয়ই?”

বেন একগাল হেসে বলল, “আর বলবেন না কর্তা! এই জাতির লোকেরা ভগবান মানে না। ওদের কিছু শেখালেও শেখে না। আরবিরা ওদের ক্রীতদাস করে ধরে নিয়ে গিয়ে মুসলমান করে দেয় কি না জানি না, তবে এখানে ধর্মান্তর করার চেষ্টা তারা করে না। এরা সংখ্যায় ক্রমশ কমে আসছে হুজুর।”

বেন আলির সব কথা বিশ্বাস হল না। বিশেষত মাকন্ডে উপজাতির লোকদের ঈশ্বর বিশ্বাস করে না, এ-কথা হজম করা আমার মতো অভিজ্ঞ লোকের পক্ষে অসম্ভব। নাসিক থেকে আসা কুলিদের জিজ্ঞেস করে দেখলাম ওরা মাকন্ডেদের ভাষা জানে কি না। ওরা আমাকে হতাশ করে জানাল এই ভাষা তারা জানে না। চলার পথে মাকন্ডেদের অনেক ক্ষেত আমাদের পশুদের পায়ের চাপে নষ্ট হল। তারা অসন্তুষ্ট হল, কিন্তু আমাদের কিছু বলল না। বেন আলি জানাল, মাকন্ডেরা সাদা চামড়ার লোকদের ভয় পায়।

একজন মাকন্ডের সঙ্গে একাই গেলাম গাম কোপালের বাগানে। কীভাবে গাছ থেকে আঠা পাওয়া যায় দেখলাম। সে আমাকে হাবেভাবে বোঝাল, একদিনে যে অনেক আঠা পাওয়া যাবেই এমন নয়। আকাশের দিকে, গাছেদের দিকে ইশারা করে যা বোঝানোর চেষ্টা করল, তা হল ঈশ্বরের হাত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হল, এরা ঈশ্বর মানে, তবে তা প্রকাশ পায় না প্রকটভাবে।

সেই মাকন্ডে লোকটা আমাকে আরেকটা গাছ চিনিয়ে দিল, তাকে ওরা ওদের ভাষায় বলে মালোলে। এই গাছের কাঠ দিয়ে ওরা তির-ধনুক বানায়। লক্ষ করে দেখলাম, মালোলে গাছের কাঠ বেশ মসৃণ আর নমনীয়, তবে খুব সহজে ভাঙে না।

জঙ্গলে চলতে চলতে হঠাৎ দেখি একজায়গায় কাঠকুটো জ্বালিয়ে একটা জংলি জানোয়ার পোড়ানো হচ্ছে। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করতে জানতে পারলাম, একটা চিতাবাঘ মাকন্ডেদের হাতে মারা পড়েছে। সেটার ছাল ছাড়িয়ে মাংস পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আরও জানা গেল, চিতাবাঘের মাংস এরা খায় না, কারণ চিতা মানুষ খায়। এটা প্রমাণ করে যে মাকন্ডেরা মানুষখেকো নয়। যদিও শুনেছি অনেক আফ্রিকান উপজাতি মানুষ খায়।

জঙ্গল সাফ করে রোভুমা নদীর দিকে আমরা এগোতে থাকলাম। যতই আমরা এগোই ততই নজরে পড়ে মানুষ বেশি করে টাটু লাগায় গায়ে। মেয়েরা ঠোঁটে নথের মতো গোল আংটা লাগায়। নদীর দক্ষিণদিকে গিয়ে দেখি এক উপজাতির পুরুষেরাও ঠোঁটে আংটা লাগায়।

অবশেষে রোভুমা নদীর দেখা পাওয়া গেল। এবার জঙ্গল কমে এসেছে। গাছ কাটার আর বেশি প্রয়োজন হচ্ছে না। কোথাও কোথাও জমির নীচে জল থাকায় আমাদের পশুগুলোর পা হড়কে যাচ্ছে। চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে আমাদের দল। এক অদ্ভুত গ্রামে এসে পৌঁছলাম, যার নাম টান্ডে। গোটা গ্রাম বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ি আর লতাপাতা দিয়ে তৈরি পাঁচিল দিয়ে সুরক্ষিত। খোঁজ নিয়ে জানলাম, মাবিহা উপজাতির লোকেরা টান্ডেদের উপর হঠাৎ আক্রমণ করে তাদের মেয়েদের ধরে নিয়ে যায় দাস বানিয়ে বিক্রি করে দেবে বলে। মাবিহাদের সঙ্গে অবশ্য আগের এক অভিযানে আমার দেখা হয়েছিল। প্রাণে বাঁচতে তাদের উপর গুলি চালাতেও হয়েছিল। ওরা বন্দুক চালাতে জানে। আমার নৌকোর পাল ফুটো করে দিয়েছিল গুলি করে।

মাকোনে গ্রামে এসে আরেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। এক বয়স্ক মহিলা এই গ্রামের মোড়ল। গ্রামের লোকেরা আমাদের অনেক খাবার দিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু বিনিময়ে কোনও মূল্য দাবি করেনি। প্রায় মাতৃস্নেহে মোড়লমহাশয়া আমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে এল। আমি দাম দিতে চাইলাম পুঁতির বিনিময়ে, সে একেবারে অস্বীকার করল। শেষে অনেক বুঝিয়ে তাকে কিছু কাপড় আর পুঁতি দেওয়া হল।

মাকোনেরা খুব বেশি ট্যাটু বানায় শরীরে। তারা কেমন করে ট্যাটু তৈরি করে ভালো করে লক্ষ করলাম। প্রথমে ছুরি দিয়ে ওরা শরীরে ক্ষত সৃষ্টি করে। তারপর সেই ঘায়ের উপর পোড়া কাঠ ঘষে ঘষে মাংস তুলে দেয়। ক্ষতস্থান শুকিয়ে গেলে ট্যাটুগুলো প্রকট হয়ে ওঠে চামড়ার উপর। যাই হোক, ট্যাটুর জন্য এদেশের মানুষগুলোকে ভয়ংকর লাগে দেখতে, যতটা হয়তো তারা আদৌ নয়।

যতই আমরা এগোতে লাগলাম, সেটসি মাছির আক্রমণ ততই বাড়তে লাগল। সেটসি মাছির কামড়ে একটা মোষের শরীর থেকে গাঢ় লাল রঙের রক্ত চুইয়ে পড়তে লাগল। আবার একটা গোরুর একটা চোখ ফুলে গেল দেখে পরীক্ষা করেও বুঝলাম না তা সেটসির কামড়ে, নাকি সেপাইদের চোরাগোপ্তা অত্যাচারে হয়েছে। গাধা, খচ্চর আর উটদের শরীরে সেটসির আক্রমণের কোনও লক্ষণ দেখতে পেলাম না।

নিয়াম্বা গ্রামে একটা রাত কাটালাম আমরা। সেখানে আরেক বৃষ্টির ডাক্তারের দেখা পেলাম। সে এক মধ্যবয়স্ক রমণী। ভালোবেসে সে এক ঝুড়ি ডাল আর একটা বিশাল মুরগি দিয়ে গেল। সেপাইরা বলল, হিন্দুস্থানে এই ডালকে বলে মুগ। মহিলার সারা শরীর উল্কিতে ঢাকা। তার শক্তপোক্ত শরীর বলে দিচ্ছে তার গায়ে বেজায় জোর।

রোভুমা নদীর পাড় দিয়ে দক্ষিণ অভিমুখে যেতে গিয়ে পাহাড়ের পাথরের রূপ বদলে যেতে দেখলাম। এতদিন বেলেপাথর দেখা যাচ্ছিল। এবার গ্রানাইট পাথর দেখা যাচ্ছে। পাথরের প্রকার বদল হতেই গাছপালা কমে এল। কাঁটা ঝোপওয়ালা আকাসিয়া গাছ আর বেঁটে ঘাসের জঙ্গল ভেদ করে পথ পার হতে অসুবিধা হচ্ছে না। আমরা নদীর উত্তর পাড় ধরে যেতে যেতে হঠাৎ দেখি পশ্চিম পাড়ে একটা বিশাল পাহাড়, একেবারে যেন একটা সিংহ বসে বসে জিরোচ্ছে। স্থানীয় লোকেরা এই পাহাড়ের নাম দিয়েছে সিম্বা। এই পাহাড়ে নাকি মাবিহা উপজাতির লোকেরা অনেক সংখ্যায় বাস করে। তারা মাঝেমধ্যে পাহাড় থেকে নেমে এসে লুঠপাট করে, আবার পাহাড়েই ফিরে যায়।

এর মধ্যে আমার একটা উট মারা গেল। সেটসি মাছির কামড়ে উটের কোনও ক্ষতি হয় না, সেটা এই অভিযানে খুব বুঝেছি। মনে হয় সেপাইদের অতিরিক্ত ভার বহন করে আর ওদের চোরাগোপ্তা অত্যাচারে বেচারার প্রাণ গেছে। সেপাইগুলো শুধু খেয়ে পেট বোঝাই করে আর হজম না করতে পেরে বমি করে ভাসায়। গ্রামবাসীদের ক্ষেত থেকে ভুট্টা বা অন্য শস্য চুরি করে খেতে আবার তারা খুব ওস্তাদ। উপজাতিদের যে-ক’টা গ্রামে গেছি, সব ঝকঝকে পরিষ্কার। কিন্তু এই হতচ্ছাড়া সেপাইগুলো সেইসব গ্রাম একেবারে নোংরা করে দিয়েছে।

কয়েকটা খচ্চর আর গাধার শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে স্থির করলাম, কয়েকজন কুলি সঙ্গে নিয়ে এদের সঙ্গ ত্যাগ করব। আপাতত ওদের সঙ্গ ত্যাগ করাই শ্রেয় বলে মনে হল। ওরা না-হয় ধীরে সুস্থে আমার পিছনে আসুক। তাই চব্বিশজন কুলি আর মালপত্র নিয়ে আমি আগে এগোতে লাগলাম। নাসিক বয়েজদেরও সেপাইদের সঙ্গে রেখে এলাম।

এবার খাদ্য জোটানো মুশকিল হল। কারণ, এই পাথুরে এলাকায় একে তো ফসল ভালো ফলে না, তার উপর বৃষ্টি না হওয়ায় ফসল উৎপাদন ঠিক হয়নি। বেন আলি বলল, রোভুমা নদীর পশ্চিম পাড় দিয়ে গেলে খাবার পাওয়া যেতে পারে। গাইডের কথা শুনতেই হয়, তাই একটা ক্যানোতে চাপিয়ে আলি আর মুসাকে পাঠিয়ে দিলাম খাবারের জোগাড়ে। কিন্তু খুব সামান্য খাবারই পাওয়া গেল। ভাগ্যিস গ্রামবাসীদের কাছ থেকে সামান্য মূল্যে কিছু জোয়ার আমি কিনে নিতে পেরেছিলাম। প্রায় অভুক্ত অবস্থায় আমরা এগোতে লাগলাম। প্রান্তর ক্রমশ রুক্ষ হতে লাগল। ডলোমাইট আর কোয়ার্জাইট পাথরে কি আর ফসল ফলে?

সেদিন রাতটা একটা গ্রামে কাটালাম। গ্রামের মোড়ল দেখি বাতের ব্যথায় কাতরায়। আমার সঙ্গে দেখা করে যখন সে জানতে পারল যে আমি একজন ডাক্তার, ওষুধ চেয়ে বসল। তা দিলাম ওষুধ। ওষুধ নিয়ে চলে গিয়ে ডাক্তারের ফি বাবদ এক ধামা মুগডাল আর জোয়ার পাঠিয়ে দিল। আমি অযাচিত দক্ষিণা পেয়ে বেজায় খুশি হলাম, কারণ সঙ্গীদের খিদের কষ্ট আর চোখে দেখা যাচ্ছিল না।

পরের দিন আমরা রোভুমার আসল উৎস লোয়েন্ডি নদীতে পৌঁছলাম। দুই নদীর মোহনা হলেও এখানে স্রোত তেমন নেই। ক্যানো নিয়ে বা সাঁতরেই লোকে নদী পারাপার করে। এখানে দেখলাম মেয়েরা সাঁতারে পুরুষদের চাইতে কিছু কম যায় না। খোঁজ করে জানলাম, দুটি নদীর আসল উৎস হল লেক নয়াসা। এখানকার এক স্থানীয় নেতা টাইপের মানুষ বলল, নদীর দিক থেকে নৌকা বেয়ে লেক নয়াসা যাওয়া অসম্ভব। মাঝে নাকি অনেক বিপদজনক জলপ্রপাত আছে। সেই পথে আরও বিপদ—মাজিটু উপজাতির মানুষখেকোরা সেই পথে ঘোরাঘুরি করে। একবার ধরলে নির্ঘাত কাঁচা খেয়ে নেবে।

মাজিটুদের কথা আমি আগে অনেকবার শুনেছি, তবে তাদের চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য হয়নি। এদের বউ, ছেলেমেয়ে সব আছে, কিন্তু তারা নাকি ডাকাতি করতে আর মানুষ ধরে খেতেই বেশি ভালোবাসে। যাই হোক, আপাতত বেন আলির সঙ্গ শেষ। তাকে পারিশ্রমিকের উপরি কিছু বকশিস দিয়ে খুশি করে বিদায় দিলাম। এবার মাতাম্বে উপজাতির দুই গাইড জোগাড় করে নিলাম পথ দেখানোর জন্য।

একটু এগিয়েছি কি নাসিক বয়েজদের একজন এসে খবর দিল হিন্দুস্থানের সেপাইরা নাকি বিদ্রোহ করেছে। তারা অভিযানের পরবর্তী পর্যায়ে আমার সঙ্গী হতে নারাজ। খুব রাগ হল। শুনলাম, তারা নাকি বন্দুক আর গুলির বোঝা বহন করার জন্য স্থানীয় কুলি ভাড়া করেছে। এক-একটা নবাব যেন! ঠিক করলাম, বোঝা বাড়িয়ে লাভ নেই। ওদের বর্জন করাই উচিত। তাই চিঠি লিখে ওদের জানালাম, তারা স্বচ্ছন্দে উপকূলের দিকে চলে যেতে পারে ঘরে ফিরে যাবার জন্য।

(ক্রমশ)

খেলার পাতায় সমস্ত ধারাবাহিক অভিযান একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s