রুমেলা দাসের আগের গল্প/উপন্যাস/অণুগল্পঃ বাদুড় মানুষ, মিত্র ও মিথ, উইশ, পরিচিত, ম্যাজিক
ক’দিন ধরে ঝেঁপে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। আকাশের মুখটুকু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। রোদের দেখা পাওয়া তো দুরস্ত। সব কেমন যেন ম্যাড়মেড়ে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। বুবলিনের কি এসব দেখে মন ভালো লাগে? বাড়ির কড়া নির্দেশ, ঘরের চৌকাঠ কোনোভাবেই পেরোনো যাবে না। এমনকি জানলার পাল্লা কোনোমতে খুলে যে ঘরের দমবন্ধকর পরিস্থিতি থেকে একটু প্রাণখোলা বাতাস নেবে, বিধিনিষেধ সেখানেও। স্কুলও ছুটি দিয়ে দিয়েছে এমন বিপর্যয়ে। আগামী আরো কয়েকদিন নাকি এভাবেই বৃষ্টি চলবে। মাঝে মাঝে কড়কড়ে দাঁত বের করে আকাশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত হেসেও যাবে বিদ্যুতের দল। বুবলিন এসব ভারী কথা বোঝে না। বুঝতে চায়ও না। বোঝার মধ্যে চারপাশটা কালো করে আসা, আর খেলাধূলার অভাব বোধ করায় মনটা ভয়ানক খারাপ হয়ে পড়েছে। ড্রয়িং-রুমে টিভির প্লাগটাও আপাতত খোলা। খুব জোরে বাজ পড়ছে। তাই বিদ্যুৎ সংযোগে বিপদ আছে বলে মা সতর্ক করে দিয়েছে। সারা বাড়ি ঘোরা ছাড়া উপায় আর কী? বাবা এই বৃষ্টিতেও কাজে বেরিয়েছে। বুবলিনের মন বলছে, একদিনের জন্য হলেও যদি বাবার মতো বড়ো হতে পারত, তাহলে বাইরে বেরোনোর এই সুবর্ণ সুযোগটা তো পেত! অগত্যা। বাড়িতে থাকার মধ্যে বুবলিন আর ওর বাবা-মা। তাই স্কুলে বইখাতা নিয়ে বসতে ভালো না লাগলেও খেলার দেদার মজাটা তো পাওয়া যায়! একা একা কি খেলা যায়? সারা বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। জানালার এপার থেকে বাইরেটা পর্দা সরিয়ে একবার দেখার চেষ্টা করল। নাহ্, একটুও আলো ফোটেনি বাইরে। অথচ ঘড়ির কাঁটা বলছে, সবে সকাল দশটা। মায়ের রান্নাঘরে উঁকি দিতে দেখল, মা মন দিয়ে দরজার দিকে পিছন করে কীসব রান্না করে চলেছে। ঘুরে ফিরে নিজের ঘরেই ফিরে আসতে হল বুবলিনকে। আর ঠিক তখনই বীভৎস শব্দ করে বাজ পড়ল কাছেপিঠে। বুবলিনের বুকের ভিতরটাও সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো দাপাদাপি শুরু করে দিল। শুনতে পেল, মা খুব জোরে শাঁখে ফুঁ দিয়েছে। এই সময়টায় সবাই তাই করে। মামার বাড়িতে দিদাকেও বাজ পড়ার সময় শাঁখ বাজাতে দেখেছে। শঙ্খধ্বনির শক্তি এত যে, এই আওয়াজে মেঘে মেঘে ঠোকাঠুকির আওয়াজও আমাদের কানে এসে পৌঁছবে না। আর বাজ পড়ার ভয়ও থাকবে না। এসব ভাবতে ভাবতে বুবলিনের মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। তাই তো! এটা এতক্ষণে মনে পড়ল? আর একটু আগে মনে পড়লে এতটা সময় বোর তো হত না। রং! হ্যাঁ, রং দিয়ে মন ভরানো যেতে পারে এখন। মনেরই বা দোষ কী! সবে ক্লাস ফোর, কিন্তু পড়ার চাপে রং-পেন্সিল ছাড়া আর কিছু করার সময়ই পায় না। একবছর আগে তাও ছুটির দিনে কখনো-সখনো রং নিয়ে বসত। এখন! মা দেখলেই বলে, ‘বুবলিন, সময় নষ্ট না করে বই নিয়ে বস!’ ধুর ছাই! বুবলিন আর কোনোদিকে না তাকিয়ে বিছানার উপর ডিঙি মেরে উঠে ওর দেওয়াল আলমারি থেকে খাতাপত্র সরিয়ে প্যাস্টেল কালারের সেটটা বের করে আনল। ইশ, কী সাংঘাতিক ধুলো! কতদিন ব্যবহার না করার ফল। ধুলো ঝেড়ে মনের মতো করে ড্রয়িং পেন্সিল নিয়ে বসল বুবলিন। ঠিক এই মুহূর্তে চারপাশের বৃষ্টি, বাইরের কালো করা আকাশের মাঝে বয়ে চলা সোঁ সোঁ ঝড় কিংবা বাজের চোখ রাঙানো মনে থাকল না কিছুই। সবচেয়ে পছন্দের রোদ ঝলমলে একটা দিন আঁকবে ঠিক করে কিছুক্ষণের মধ্যেই খাতার পাতা ভরিয়ে তুলল বুবলিন। এবার রঙের পালা। বুবলিনের মুখের চওড়া হাসিটা বুঝিয়ে দিচ্ছিল মনে মনে কী দারুণ খুশি হয়েছে ও! কিন্তু এ কী? দু-আঙুলের মাঝখানে রং নিয়ে সাদা পাতায় সমানে ঘষে চলেছে, একটুও রং তো খাতার পাতায় পড়ছে না! এটা কী হল? পরপর লাল, হলুদ, বেগুনি, কমলা কোনটারই রং নেই! তাহলে কি রংগুলো পুরোনো হয়ে গেছে বলে এরকম হচ্ছে? পাতলা একটা ছাই ছাই রং একটু একটু করে ওর আঁকা ছবিটায় ফুটে উঠছে। এই রংটা কোথা থেকে এল? ছাই রংটা কি এই বিভিন্ন রঙের প্যাস্টেল থেকে বেরিয়েছে? বুবলিনের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। কিছুই বুঝতে পারছে না ও। কান্না পাচ্ছিল রং করতে না পারায়। আচ্ছা, জলরং করতে পারে তো! বাবা গতবছর কিনে দিয়েছিল বক্স ওয়াটার কালার। চৌকো চৌকো খোপে হরেক রং। শুধু তুলিকে জলে ভিজিয়ে খোপে পছন্দমতো রং মাখিয়ে খাতায় লেপে দাও! এ আরেক মজার খেলা। ওয়াটার কালারের সরঞ্জাম বের করে বুবলিন যেই না রং করতে শুরু করেছে, সঙ্গে সঙ্গে সেখানেও একই অবস্থা দেখে যারপরনাই নিরাশ হয়ে পড়ে সে। পরপর দুটো রঙের একই হাল, একটাতেও রং হচ্ছে না। যে রংই করে, সেটাই হয় সাদা, নয়তো ছাই রং হয়ে ধরা দেয়। ইশ, পুরো পাতাটাই দেখতে দেখতে তুলিতে জল নিতে নিতে ভিজে টইটুম্বুর হয়ে গেল। এদিকে বৃষ্টিরও থামবার নাম নেই। ড্রয়িং খাতার পাতার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুবলিনের চোখটাও ভিজে এল। ঘুম ঘুম ভেজা চারপাশে মনখারাপের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের মধ্যে একটা আলসেমি ঢুকে পড়ল হুড়মুড়িয়ে।
ছবি রং করতে না পারার কষ্টটা তো ছিলই, তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল আরো কয়েকটি ভয়। বৃষ্টির পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছিল। বুবলিনদের বাড়ির সামনে এখন নৌকা চলার মতো অবস্থা দাঁড়িয়েছে। বাবা-মা সবাই ওরই মতো ঘরে বন্দি। কেউ বলতে পারছে না বৃষ্টি কবে থামছে। তারপর দু-দিন ধরে বৃষ্টি পড়ার সঙ্গে একটা ভ্যাপসা পচা গন্ধে ভরে যাচ্ছে গোটা এলাকাটা। বন্ধুদের ফোন করে তাদের সঙ্গে কথা বলবে, সে অবস্থাও নেই। বাবা-মা কারুর ফোনের নেটওয়ার্কই নেই। একটু আধটু কথা হচ্ছে পাশের বাড়ির সীমাকাকিমার মেয়ে জ্যোৎস্নার সঙ্গে। ওর রংগুলো, রংহীন হওয়ার ঘটনাটা বুবলিন জ্যোৎস্নাকেই প্রথম বলেছিল। জ্যোৎস্না কিছুতেই বিশ্বাস করেনি। এখন তো বুবলিনের জ্যোৎস্নার বাড়ি যাওয়া বন্ধ, নাহলে ও প্রমাণ করে দিত ও কতটা সত্যি। মাকেও কথাটা বলতে গিয়েছিল বুবলিন। কিন্তু এ কয়দিনে বাবা-মা এত দুশ্চিন্তায় আছে যে ওদের সামনে কিছু আর বলে উঠতে পারেনি বুবলিন।
আজকাল যেন সবকিছুই খুব এলোমেলো হচ্ছে। টানা বারোদিন বৃষ্টির পর হঠাৎ করে আজ রাত আটটা নাগাদ এক ফালি রোদ এসে ওর বিছানায় পড়ে। আচমকা এক ফালি হলুদ আলোকে প্রথমটা রাস্তার আলো মনে হলেও, পরে বড়োদের মধ্যে কথা বলাবলি শুরু হতেই ভুল ভেঙে যায় বুবলিনের। আজব কাণ্ড! হচ্ছেটা কী? রোদটা আকাশ আলো করা নয়, অথচ বিকেলের অস্ত যাওয়া সূর্যের মতো কোনাচে কমলা হয়ে পড়ছিল আধঘণ্টামতো। পরপর দু-দিন। চারদিক ভেজা গন্ধে ভরপুর হলেও বুবলিন এই এক ফালি রোদের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতে শুরু করে। কারণ, ওই রোদের মধ্যে হাতটা মেলে ধরলে মনটা হঠাৎ করেই ফুরফুরে হয়ে উঠত। মনে হত, এই আলোই পারে চারপাশের বাসটে পরিবেশটাকে দূর করতে। আচ্ছা, আরব্য রজনীর গল্পের মতো রোদটাকে বাক্সবন্দি করে রাখা যায় না? তাহলে বেশ অনেকটা রোদ জমাতে পারলে আকাশে ছড়িয়ে দিত আর একটা রোদ ঝলমলে দিন ফুটে উঠত নীল দিগন্তের এপার থেকে ওপার।
“বুদ্ধিটা খুব বোকা বোকা।” বলেছিল জ্যোৎস্না।
কিন্তু বুবলিন তাতে একেবারেই দমে যায়নি। উপরন্তু নতুন উদ্যমে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিল রাতে আসা রোদটাকে ধরে রাখার। মা-বাবার চিন্তা, গুরুগম্ভীর ভাবটা যেন আরো বেড়ে যাচ্ছিল। চার-পাঁচদিন ফালি রোদ আসার পরই বুবলিন লক্ষ করল, ওর ঘরের মানি-প্ল্যান্টটাও হেলে রোদের দিকে খানিক বেঁকে গেছে। তাই তো! বুবলিন তো খেয়ালই করেনি। প্রয়োজনমতো সূর্যের আলো না পেলে গাছ খাবার তৈরি করবে কী করে? আর খাবার তৈরি না হলে গাছ খাবেটাই বা কী? তাই আলো আসার জায়গাটাতে বুবলিন গাছের জারটাকে এনে রেখেছে।
এদিকে আরো একটা খারাপ খবর পায় ও। দিদার নাকি খুব শরীর খারাপ। শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে। চারদিকে এত জল, দিদাকে হসপিটালে নিয়েও যাওয়া যাচ্ছে না। জলের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির দুর্গন্ধে সবাই দরজা দিয়ে বসে আছে। গন্ধটা বাইরের চারদিকে তো ছিলই, বুবলিনদের ঘরেও এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে যেদিন থেকে গাছটা একটু একটু করে রোদ পেতে শুরু করে ওর ঘরের মধ্যে, বাড়ির অন্যান্য ঘরের তুলনায় অতটা আর দমবন্ধ লাগছিল না। আর থাকতে পারেনি বুবলিন। জ্যোৎস্নাকে গোটা ব্যাপারটা জানায়। ততক্ষণ সারা পাড়ার প্রতিটা বাড়িরই কেউ না কেউ অসুস্থ হতে শুরু করেছে। এবারে আর জ্যোৎস্না বুবলিনের কথা উপেক্ষা করতে পারেনি। অনেক ভেবে বাড়ির কোথা থেকে একটা তুলসীগাছের টব এনে জ্যোৎস্নাও ওদের বারান্দায় রাখে। আর তেমনই অদ্ভুতভাবে কষ্ট কমে আসতে শুরু করে। জ্যোৎস্না বুবলিনের তুলনায় বয়সে সামান্য বড়ো। তাই ওর মনেই আগে প্রশ্নটা আসে। তাহলে কি ওদের চারপাশে অক্সিজেন কমে যাচ্ছে আস্তে আস্তে? বিলুর জেঠু, সুমন্তর দাদু—এভাবে আরো অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছে খবর আসছে। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে পরিষ্কার আকাশ দেখা যাচ্ছে না। তাহলে উপায়! বড়োরা তো চিন্তা করছিলই, ছোটোদের মধ্যেও স্কুল বন্ধের ছুটি কাটানোর মজা কমে গিয়ে ভয় ঢুকে যাচ্ছিল। বড়োদের কথাও একটু একটু করে বুঝতে পারছিল বুবলিন, জোৎস্না। চারপাশের পরিবেশ দূষণে ভরে যাওয়ার ফলেই এই বিপদ। সবুজটি কবে হারিয়েই গেছে। শুধু বাড়ি আর মানুষ। বাবাদের সময়ের পার্কগুলো উঠে গিয়ে এখন ইনডোর প্লে এরিয়া তৈরি হয়েছে। গাড়ির ধোঁয়া, জ্বালানির ব্যবহার, গাছপালা কেটে ফেলার ফলে বায়ুমণ্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নেবার ক্ষমতা কমে গেছে। আর এই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী মিথেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড। এই বিষাক্ত বায়বীয় গ্যাস এতটাই বেড়ে গেছে যে, দিনরাতের পার্থক্যও হারিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। হারিয়ে যাচ্ছে রঙিন যা কিছু আছে চারপাশে। খবর আসছে গোটা কলকাতা, এমনকি ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও নাকি এভাবেই আকাশ কালো করে বিপর্যয় নেমেছে। আর বেশিদিন এমন চলতে থাকলে প্রতিটা মানুষই অসুস্থ হয়ে পড়বে। বাবার কথাগুলো বিছানায় শুয়ে শুয়েও কানে আসছিল বুবলিনের। মানুষের অসচেতনতার জন্য বিগত তেরো বছরে জলবায়ু কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ৪২%। আমরা তাহলে বাঁচব কী করে? বুকের ভিতরটা থেকে থেকেই ডুকরে উঠছিল। এভাবে চলতে থাকলে তো… ওর দিদা, সুমন্তর দাদুর কি তাহলে শ্বাসকষ্ট হল বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের কারণে? অসম্ভব অস্বস্তি হচ্ছিল। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। এখন আর আলাদা করে রাত হয় না। তাই ঘুম ঘুম আলসেমি জড়তা সবসময় ওকে আঁকড়ে থাকে। ঘরের বাইরে ড্রয়িং-রুমে গেলে, রান্নাঘরে গেলেও নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় বুবলিনের।
বিছানা থেকে উঠে বুবলিন জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। চিরচিরে আলোর ঝিলিক মেঘ ফুঁড়ে হেসে ওঠে যেন বাইরে। পিঠের মধ্যে দিয়ে চোরা আতঙ্কের স্রোত বয়ে যায়। ঘড়িতে এখন সন্ধে সাতটা প্রায়। আজও কি রোদ দেখতে পাবে ও? ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় কোনাচে আলো এসে পড়ার জায়গাটায়। চওড়া একটা হাসি গালের দু-পাশে লম্বা হয়ে ফুটে ওঠে।
সারারাত জেগে ছিল বুবলিন আর জ্যোৎস্না। বাড়ির বাকিরা নিজেদের মধ্যে কীসব আলোচনায় ব্যস্ত ছিল। শ্বাস নেবার কষ্ট হলেও বুবলিন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিল জ্যোৎস্নার সঙ্গে। বলেছিল মনের মধ্যে উঁকি দেওয়া উপায়টাও। কোনোরকমে যদি ওদের বন্ধুদের রাজি করানো যায়, তাহলে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
জ্যোৎস্না কীভাবে যেন ওর কাকাইয়ের মোবাইল ফোনের টাওয়ার পেয়েছিল। আর সেই সময়টাকে কাজে লাগিয়েই ও দীপন, প্রমা, টুয়া সব্বাইকে জানিয়েছে বুবলিনের কথাটা। এখন অপেক্ষা করতে হবে। শুধুই অপেক্ষা। তবে গোটা ব্যাপারটা বড়োদের থেকে লুকিয়েই রাখতে হবে। যদি এই দুর্যোগের মধ্যে বড়ো প্ল্যানটা ভেস্তে দেয়!
দেখতে দেখতে কেটে গেছে একটা মাস। বৃষ্টির পরিমাণ আগের চেয়ে কমলেও বন্ধ হয়নি। যে যতটা পেরেছে জোগাড় করেছে বাড়ির আনাচ-কানাচ থেকে। আর সবাইকে একই জায়গায় থাকতে বলেছে। বড়োরা প্রথমে বিষয়টাকে পাত্তা না দিলেও একটু একটু করে ওদের কথা বোঝার চেষ্টা করেছে। আর রোদ? আগের চেয়েও কিছুটা বেশি সময় আসে। তবে রাতে নয়। আস্তে আস্তে বিকেলের সময়ের দিকে রোদ দেখা দিতে থাকে। বাতাসের ভারী ভাবটা কি কাটছে? বুঝতে তেমন না পারলেও বড়োরা পাশে আছে বুবলিন-জ্যোৎস্নাদের। ওরা যে সবাইকে বাঁচানোরই চেষ্টা করে চলেছে। ওদের ছোট্ট মাথায় এটুকু বুদ্ধিই এসেছে। হ্যাঁ, একমাত্র সবুজই পারে এই কালো, এই দুর্যোগ কাটাতে। বুবলিনের মাথায় এসেছিল যখন দেখেছিল ঘরের মানি-প্ল্যান্টটা যেখানে ছিল সেখানে কী অদ্ভুতভাবে ওর থাকতে একটুও কষ্ট হত না। কিন্তু বাড়ির অন্যান্য জায়গা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। বইতে পড়েছিল, গাছই আমাদের প্রাণের জোগান দেয় বাতাসে। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমিয়ে, অক্সিজেনের জোগান দেয়। আর তাই বন্ধুদেরও বলেছিল, বাড়ির কোথাও থেকে একটা অন্তত গাছ এনে রাখতে ঘরে। ওদের সীমানার বাইরের পৃথিবীটা অনেক বড়ো হলেও ছোট্ট ছোট্ট উপায়গুলো যদি সব বাড়িতে একটু একটু করে জড়ো করা যায়!
এখন বুবলিনের ঘরে মা-বাবা এসে থাকে। বাবার সঙ্গে ধরাধরি করে টগরগাছের একটা টবকেও ঘরে এনে রাখা হয়েছে। নাহ্, এখানে এই ঘরে কারুরই তেমন কষ্ট হয় না। জ্যোৎস্না বলেছে, বাকি বন্ধুরাও তাই করছে। এরপর কী হবে বুবলিন জানে না। জানে না কবে রোদ ঝলমলে দিন আসবে। তবে একদিন ঠিক এই ধূসর রাক্ষস সরে গিয়ে সবুজ স্বচ্ছ দিন ঝলমলিয়ে উঠবে। ঝলমলিয়ে হেসে খেলে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। আবার ওরা আগের মতো স্কুলে যাবে। বাবা অফিসে।
বন্ধ ড্রয়িং খাতাটা মেলে ধরে সামনে বুবলিন। এক এক করে রংগুলো হাতে নিয়ে সাহস করে ওর আঁকা পেন্সিলের দাগে দিতে শুরু করে। বুবলিনের রংগুলো কি আবার তাদের রং ফিরে পাবে? একটা নতুন সকালের মতো কালোর পর্দা সরে রামধনুর রং ফিরে আসবে আমাদের চারপাশে? অপেক্ষায় আছি আমরা সবাই।
অলঙ্করণ-অংশুমান দাশ
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস