গল্প-আষাঢ়ে গপ্পো- সৌমিক ভট্টাচার্য্য-শীত ২০২০

সেদিন রোববারে সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। নয় নয় করে দুপুর অবধি বৃষ্টি হয়ে গেছে চারবার। বিকেলবেলা পাড়াসুদ্ধু দামাল ছেলেদের দল খেলতে বেরিয়ে দেখে খেলার জায়গা কই! মাঠঘাট, উঠোন সব তো জলে থইথই। সব দেখেশুনে ছেলেদের চোখে জল। হপ্তায় এই একটা দিনই তো সম্বল! তার মধ্যে এসব কী বলো তো! ভগবানের যদি আক্কেল বলে একটা জিনিস হত…

মণি কাঁদো কাঁদো গলায় বললে, “আজকে পুরো দিনটাই মাটি।”

বিশু ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলে, “তাহলে আর কী, চল সবাই যে যার বাড়ির পথেই হাঁটি।”

দলের ভেতর গুজগুজ ফুসফুস, আজকের খেলা কি তবে এভাবেই শেষ! ধুস!

ছেলেদের হাট ভেঙেই যাচ্ছিল প্রায়, হঠাৎ কে যেন কে বলে উঠল, “এই, আজকে কি দাদুর বাড়ি যাওয়া যায়?”

আরে, তাই তো! অ্যাত্তো সোজা কথাটা আগেই মাথায় এলে হত!

দাদু অবশ্যি কারুর নিজের দাদু নয়। বয়স ওই সত্তরের ঘরেই বোধ হয়। খেলার মাঠে তাঁর প্রত্যহ আনাগোনা। ছেলেরা খেলে, উনি বেঞ্চের এককোণ ঘেঁষে বসে থাকেন—উদাস, আনমনা। দাদুর বয়স যখন ষোলো, তখন নাকি ঘর থেকে পালিয়ে ছিলেন নিজে কী এক ব্যাবসা করবেন বলে। তারপর নানা লোক, নানা কাজ দেশের নানান অঞ্চলে। দাদুই বলেন সেসব গল্প কখনো-সখনো—উটের পিঠে চড়া, জঙ্গলের রাত, মাটির নীচের অগাধ ধনরত্ন… অনেকে আগাগোড়া মেনে নেয় সব, অনেকে মানে না এক অক্ষরও, তবুও গল্প শুরু হলেই ভিড় জমে যায়, গল্প শুরু হলেই সক্কলের চোখ বড়ো বড়ো।

গল্পের লোভেই ছেলেদের দল এক ছুট্টে দাদুর বাড়ির উঠোনে। এই বাড়িটা যদিও শহরের একটু নির্জনে, তবু পুরো বাড়িটায় একাই থাকেন উনি। চিন্তা দেখালে বলেন, “ধুর, আমার কী আর ভয়! আমি তো বুড়ো শকুনি।” ওঁর একমাত্র ছেলে কোথায় যেন চাকরি সূত্রে আছে। সে প্রসঙ্গ উঠলেই বলেন, “ঘর পালানো রক্ত আমাদের গায়ে। এই ঘরের চার দেওয়ালে কি ও আর বাঁচে?”

ছেলেদের দল অবিশ্যি মাথা ঘামায় না অতশত। বড়োদের মুখের ভারিক্কি কথাবার্তা যত! কিছু ওলোটপালোট হলেই তাদের দাদুর কথা মনে আসে। এই যেমন ধরো আজকে। এমনি নানান ‘বিপুল সর্বনাশে’ ওই উঠোনের ইজি-চেয়ারের পাশে ভিড় জমে যায়। আজকেও অন্যথা হল না কিছু। ভাবতেই দেরি যেটুকু, তারপর উঠোন উপচে গেল কচিকাঁচায়।

মণি আদুরে গলায় টেনে টেনে বলে ওঠে, “দাদু… গল্প।”

দাদু চোখ নাচিয়ে বলেন, “গল্প? কীসের গল্প?”

“যা হোক! কে কবে কোথায় রাজা হল, কে এখন কী যুদ্ধ লড়ছে, তোমার যা মনে পড়ছে তাই বলো। বলো, বলো, বলো!”

দাদু হেসে বলেন, “আহা! ভাবতে দিবি তো! আমার কি আর মনে আছে অত!”

“আচ্ছা, তুমি এক্ষুনি যা ভাবছিলে সেটাই বলো।”

আকাশের তখনো চোখ ছলোছলো। দাদু গভীর গলায় বলেন, “রূপকথার গল্প শুনবি? রূপকথা?”

বাপ্পা একটু নাক সিঁটকিয়ে বলল, “রূপকথা? ওই যাতে ভর্তি শুধু দত্যি-দানো?”

“এ-গল্প অমনিও নয় রঙ মাখানো। সবার যেমন বয়েসের হিসেব থাকে—আমার, তোর… কিন্তু লোকে ভুলেই গেছে এ গল্পের হিসেবের গাছ-পাথর। তাই আদর করে ডাকে রূপকথা।”

মণির গলায় অস্থিরতা, “শুনব! শুনব! শুনব! বাপ্পাটা একটা মাথামোটা। তুমি বলো। বাদ দেবে না অল্পও।”

দাদু চোখ বুজে চেয়ারে হেলান দিলেন। “এ সে অনে-এ-ক দিনের গল্প…

ভারতের পশ্চিমে রাজত্ব করতেন চন্দ্রবংশীয় রাজা অজাতশত্রু। কচ্ছের রণ থেকে তাঁর সাম্রাজ্য একদিকে ছুঁয়েছে নর্মদার কূল, অন্যদিকে শতদ্রু। তাঁর রাজধানী অবন্তিনগর, কেউ তা দেখে বলে তুলনাহীন, কেউ বা বলে সাক্ষাৎ দেবতার ঘর। প্রজাপালনে জুড়ি মেলা ভার রাজা অজাতশত্রুর। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন, প্রজা রক্ষায় তাঁর উৎসাহও প্রচুর। শুধু দোষের মধ্যে দোষ একটাই, রাজার যখনি যা মনে হবে তা তক্ষুনি করা চাই। তবে প্রজারা গা করে না অত। মালওয়ার, মেবারের মতো রাজারা যাঁর পদানত তাঁর হতেই পারে অমন একটু আধটু খেয়াল। বলা যায় দারুণ সুখেই কাটছিল অবন্তিনগরের মাস, বছর, সাল।

এমনি একদিন রাজসভা তখন গুছিয়ে উঠছে সবে। সেনাপতি বীরসেন আর প্রধানমন্ত্রী পরীক্ষিৎ আলোচনায় বসেছেন সুরক্ষায় অবন্তিনগরে নতুন আর কী কী ব্যবস্থা হবে… গুরুতর আলোচনা আর তার সঙ্গে সঙ্গেই চলছে নতুন যুদ্ধনীতি আঁকা। এদিকে রাজার সিংহাসন কিন্তু তখনো ফাঁকা। বিদূষক বলে চলেছেন, “মহারাজের তো সকাল সকালই আসা অভ্যেস। তবে কি গুরুতর কিছু…”

ঠিক তখনই মহারাজ অজাতশত্রুর প্রবেশ—উদ্যত তলোয়ার হাতে একশত দেহরক্ষী তাঁর পিছু পিছু। রাজসভায় ধ্বনি ওঠে, ‘মহারাজের জয়! অবন্তিনগরের জয়!’ মহারাজের কিন্তু চোখের তলায় কালি, মুখজোড়া চূড়ান্ত সংশয়।

বিদূষক চিন্তিত গলায় বলেন, “রাজাধিরাজের নিশ্চয় ঘুম হয়নি কাল রাত!”

সেনাপতি গম্ভীর গলায় বলেন, “মহারাজ, মগধের দিক থেকে কি কিছু খারাপ সংবাদ?”

প্রধানমন্ত্রী ঘন ঘন দাড়িতে হাত বোলান, কুঁচকে দুটো ভ্রূ। চিন্তিত মুখে সিংহাসনে এসে বসেন রাজা অজাতশত্রু। ধীর গলায় রাজা বলেন, “ঠিকই বলেছ বিদূষক। কাল রাতে আর ঘুম এল না এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে।”

“মাফ করবেন রাজা, ওরা সব আহাম্মক। এই কে আছিস, রাজবদ্যি ডাক।” বিদূষক কন হেঁকে।

রাজা বলেন, “উঁহু! বদ্যি নয়, রাজজ্যোতিষীকে দরকার।”

“যো হুকুম সরকার।” বিদূষক হাঁকেন, “রাজজ্যোতিষী এখন যেখানে যে হালে আছেন এক্ষুনি তুলে নিয়ে আয় তাঁকে রাজার কাছে।”

দেখতে দেখতেই হাজির রাজজ্যোতিষী। সঙ্গে তাঁর বিশেষজ্ঞ শিষ্য, সহযোগী, যারা স্বপ্নবিচার করে দিবানিশি। জ্যোতিষী জোড়হাতে বলেন, “মহারাজ, শুনলাম এক স্বপ্ন নিয়ে নাকি আপনি নিদারুণ চিন্তিত!”

রাজা বলেন, “আর বোলো না জ্যোতিষী! যদি একদণ্ডও ঘুমাতে দিত… যখনই চোখ বুজি, একই দৃশ্য!”

“কী দৃশ্য মহারাজ?”

“নিঃস্ব! নিঃস্ব! আমি ছেঁড়া রাজবেশ পড়ে নিঃস্ব হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি অবন্তির পথে পথে। এর কী মানে জ্যোতিষী? আমার কি তবে কোনো বিপদ আছে নিকট ভবিষ্যতে?”

গণনায় বসলেন রাজজ্যোতিষী। আমরা আজকাল কী আর অঙ্ক কষি! রাজার সে স্বপ্নের বিচার চলল তিনদিন তিন রাত—কোন গ্রহ কোথায় বসে, কার কী কী অভিসম্পাত… এদিকে রাজার চোখে ঘুম নেই। চোখ বুজলেই যে-কে-সেই একই স্বপ্ন ঘুরে ফিরে চেপে পড়ে ঘাড়ে। শেষমেশ চতুর্থ দিন সকালে জ্যোতিষী উপস্থিত হলেন রাজার দরবারে। রাজা সিংহাসন ছেড়ে উঠে পড়লেন তাড়াতাড়ি, “জ্যোতিষী, আঁক কষে কী হল স্থির?”

জ্যোতিষীর মুখ গম্ভীর। “মহারাজ!। এই একদণ্ড আগে শেষ হল গণনার কাজ। তবে…”

“আহ্‌ জ্যোতিষী! ওই তবে-টবে পরে হবে। আগে বলো গণনার ফল ভালো?”

জ্যোতিষীর মুখ আঁধার কালো। “ঘোর, ঘোর অর্থনাশের সম্ভাবনা অবন্তির ওপর। অধমকে মাপ করবেন মহারাজ।”

এদিকে ততক্ষণে সভাঘরে পড়েছে বাজ! প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এ অসম্ভব! নর্মদা-শতদ্রুর কল্যাণে এ রাজ্যে কী না ফলে? ধান, গম, যব… ঘরে ঘরে সমৃদ্ধি, রাজকোষে অপার বৈভব… পঞ্চাশ হাজার সেনা সদাজাগ্রত আছে অবন্তির প্রতিটি অঞ্চলে। অবন্তি আক্রমণ করে এত সাহস নেই কোনো শত্রুর দলে।”

“কিন্তু গ্রহ-তারা তাই নির্দেশ করছে সক্কলে।”

রাজা ভারী গলায় জিজ্ঞেস করেন, “গণনা নির্ভুল?”

“আজ্ঞে, হিসেবে ফাঁক নেই একচুল। অমঙ্গলের ঘরে গ্রহ-তারা সব।”

“অসম্ভব।” প্রধানমন্ত্রী ফের বলে ওঠেন, “একথা জানেন স্বয়ং মহা…”

“আহা!” রাজার গলা গাঢ়, “প্রধানমন্ত্রী, জরুরি বৈঠক ডাকো যত শীগগিরি পারো।”

সভাঘরে গোপন বৈঠক বসে সে রাতে। প্রধানমন্ত্রী হিসেব দিলেন রাজকর, কৃষি, বাণিজ্য আর রাজ্যের কী কী আয় কোন কোন খাতে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মহারাজ, সমস্ত তথ্য রাজ্যেরই অনুকূল।”

রাজা বলেন, “তোমার কথা আপাত নির্ভুল। কিন্তু যদি ধরো মন্বন্তর আসে? কিংবা ধরো বছর তিন মেঘই দেখা দিল না আকাশে! তখন?”

“এ তো সাক্ষাৎ শমন! কিন্তু মহারাজ, এসব হওয়ার সম্ভাবনা কতটা?”

“না হওয়ার সম্ভাবনা ঠিক যতটা, ততটা। এভাবে হবে না পরীক্ষিৎ, অর্থ-খাদ্য-জলের চাই একটা সঠিক বিহিত।”

“কিন্তু এমন না ঘটা বিপদের বিহিত তো কেউ জানে না হুজুর!”

“তবে লোক পাঠাও, তারা যাক চোখ যায় যতদূর। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর আমি চাই।”

চাই মানে চাই।

লোক ছুটল দেশে, দেশান্তরে, নগরে, বন্দরে। কেউ গেল সিংহল, কেউ গেল কাশী, কেউ গেল বৃজি, কোশল, অযোধ্যা, কামরূপ…

এতখানি বলেই দাদু চুপ। মণি বলে, “তারপর?” বিশু বলে, “তারপর?”

দাদু হেসে বলেন, “তারপর কিছুদিনের ভেতরই এক গুপ্ত খবর নিয়ে হাজির রাজার চর। অবন্তিনগরের খানিক দক্ষিণেই বয়ে চলেছে গোদাবরী। তার দু-কূল জুড়ে শ্রাবন্তী নগরী। সে দেশের লোকেরা যদিও খানিকটা বন্য, তবে আসল খবর অন্য। সে দেশের যিনি রাজা তাঁর রাজকোষাগারে এমন এক মানিক আছে যা নাকি লোহাকেও সোনা করে দিতে পারে। খুবই গোপন সংবাদ। কিন্তু কথাটা সত্যি নির্ঘাত। ওই বন্যরা যে অত বুক ফুলিয়ে ঘোরে তা নাকি কেবল ওই আশ্চর্য মানিকের জোরে।

রাজা বলেন, “আর তোমার কথা যদি না মেলে?”

গুপ্তচর বলে, “বলতে পারি জান বাজি ফেলে। ‘ও-দেশ লোহাকেও সোনা করে দেয়’ ওরা নিজেরাই বলে!”

“বটে! শ্রাবন্তীর এত দেমাক তবে এই কৌশলে! সেনাপতি, যুদ্ধের আদেশ দাও। দশ হাজার সৈন্য, ঘোড়া, রথ আর জলপথে যাবে তিনশত যুদ্ধের নাও।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কিন্তু মহারাজ, কী দরকার এ যুদ্ধের?”

রাজা দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “এ যুদ্ধ নিশ্চয়তার, এ যুদ্ধ ভবিষ্যতের।”

রণডঙ্কা বেজে উঠল অবন্তিনগরে। ধারালো তলোয়ার হাতে তৈরি হল সেনাদল। মহারাজ অজাতশত্রু চললেন সকলের সামনে রাজহস্তী চড়ে। টানা তিন মাস তিনদিন চলে রাজসেনা শেষে এসে পৌঁছাল গোদাবরীর কোলে।

রাজা আদেশ দিলেন, “আজ রাতটুকু আরাম করে নাও যার যে মতো দরকার। কাল সকালে দেখা যাবে অবন্তির তরোয়ালে কত ধার।”

পরদিন ভোরের আলোর সঙ্গে সঙ্গে দশ হাজার তলোয়ার উঠল হাতে। রাজাও যুদ্ধবেশে উঠলেন হাতির উপর, হাতে উন্মুক্ত তরবারি। তারপর রে-রে শব্দে কেঁপে উঠল শ্রাবন্তীর ঘরবাড়ি। দু-দেশেরই মানুষের রক্তে গোদাবরীর দু-কূল গেল ভেসে। পনেরোদিন পনেরো রাত যুদ্ধের পর শ্রাবন্তী পরাজিত হল অবশেষে। তারপর পলক ফেলতে যা দেরি, শ্রাবন্তীর রাজাকে বেঁধে আনা হল, তার পায়ে শিকল, হাতে বেড়ি।

অজাতশত্রু বলেন, “রাজা, শ্রাবন্তীর ওপর আমার লোভ নেই সকলেই জানে। আমি এসেছি কেবল সেই আশ্চর্য মানিকের সন্ধানে।”

শ্রাবন্তীর রাজা অবাক গলায় বলে, “কোন মানিক?”

অজাতশত্রু রূঢ় কণ্ঠে বলেন, “রাজা, খবর দাও ঠিক ঠিক। শ্রাবন্তীর রাজার কাছে আছে পরশ পাথর—এ পাকা খবর।”

শ্রাবন্তীর রাজা ধীর কণ্ঠে বলে, “আপনার ভুল হয়েছে রাজন, পরশপাথর সত্যিই হয়, একথা কে শুনেছে কখন?”

অজাতশত্রু চিৎকার করে ওঠেন, “ছলনা কোরো না অযথা, ‘এদেশে লোহাও সোনা হয়’—এ তোমাদেরই কথা!”

শ্রাবন্তীর রাজা সশব্দে হেসে ওঠেন, “বটে! তবে এই কারণ আপনার শ্রাবন্তী আসার? সংবাদ ঠিক। আপনার পরশপাথর ওই যে, তাকান ওইদিক।”

রাজা অধীর কণ্ঠে বলেন, “কোথায়?”

“যতদূর চোখ যায়।”

রাজা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, “এ কীরকম ছল! সামনে তো কেবল অসীম গোদাবরী, তার নিবিড় কালো জল!”

শ্রাবন্তীর রাজা হেসে বলেন, “ঠিক। এটাই আপনার পরশ মানিক।”

অজাতশত্রু চমকে বলেন, “মানে?”

“একথাটা শ্রাবন্তীর সকলেই জানে। এখান থেকে খানিক দূরেই সাগরসঙ্গম। সেখান থেকে বঙ্গ, শ্যাম, উৎকলের দূরত্ব সাগর পথে খুবই কম। এই যে শ্রাবন্তী আজ এত ঐশ্বর্যে ঝলমল, এ আসলে সেই বাণিজ্যের ফসল।”

এতখানি বলে দাদু আবার চুপ।

মণি বলে, “বলো না দাদু কী হল? অজাতশত্রু দুঃখ পেল খুব?”

বাপ্পা বলল, “এরপরটা আমি জানি। সব গল্পের একই কাহিনি। এরপর রাজা ভুল বুঝতে পেরে রাজ্যে ফিরে আসেন। মন্ত্রীর কথামতো মন দেন দেশের বাণিজ্য আর চাষবাসে। তারপরে সবাই খুব খুশি।”

“তোকে মারব এক ঘুসি!” মণি বলে, “দাদু, বলো না!”

দাদু হেসে বলেন, “তোরা সব বুঝে গেছিস গল্পের ফাঁক-তাল। তাই রূপকথার গল্প বলিই না আজকাল। কিন্তু এ কাহিনি খানিক ভিন্ন। রাজা অজাতশত্রু আর তাঁর সেনারা অনেক খুঁজলেন, কিন্তু সত্যিই পরশপাথরের নেই চিহ্ন। এক পক্ষকাল পরে যখন অজাতশত্রু যখন ভাবছেন যে তাঁর বাকি সাত হাজার সৈন্যসামন্ত নিয়ে ফিরে যাবেন, তখন কি তিনি জানতেন যে তিনি এমন এক আজব খবর পাবেন যাতে সব গুলিয়ে যাবে শেষমেশ? শ্রাবন্তীর উত্তর-পূর্বে উৎকল দেশ। সে দেশ যে এমন শস্যশ্যামল সারাবছর, তার আসল কারণ খুঁজে নিয়ে এল রাজার এক গুপ্তচর। সে দেশের রাজার কাছে নাকি আছে এমন এক বাঁশি, যাতে ফুঁ দিলেই নদী গর্জন করে ওঠে, তা খরা যতই হোক সর্বনাশী। রাজা যদিও এবার বিশ্বাস করলেন না একথা, তবু ভাবলেন, এতটা পথ এসে ফিরে যাবেন অযথা?”

মণি গল্পের মাঝেই চেঁচিয়ে ওঠে, “আরে না না, ওদিকেও কিছু নেই, বাড়ি চল বাড়ি চল!”

দাদু হেসে বলে, “কিন্তু সেকথা কোনদিন কে শোনে দাদুভাই? পথ ভেঙে উৎকল চলল সাত হাজার সেনার দল। প্রচুর সেনা হারিয়ে অবন্তি সে যুদ্ধও জিতে গেল কোনোক্রমে, উৎকলের রাজাকেও ধরে আনা হল প্রবল উদ্যমে। সে দেশের রাজা যা বললেন তা আরোই অবাক! উৎকল আসলে বঙ্গসাগরের একটা বাঁক। সেদেশে কিছুকাল অনাবৃষ্টি হলে সাগরপার থেকে কাজল কালো মেঘ নিজেরাই ছুটে আসে দলে দলে। সে ঝড়ের হাওয়া উৎকলের জঙ্গলের ভেতর বয়ে গেলে মনে হয় কে যেন বাঁশি বাজাচ্ছে শয়ে শয়ে। তবে উৎকলের যে প্রধান শত্রু, মগধ—যার সম্পদ যুগ যুগ ধরে অমর অক্ষয়, তার গোপন রসায়নাগারে এমন এক বীজ আছে যা নাকি জল, মাটি, হাওয়া ছাড়াই বাঁচে। অজাতশত্রু দু-বার ঠকেছেন, তাঁর মনে হল একথাও ফাঁকি। আর তাছাড়া তাঁর সঙ্গে কেবল সাতশো সেনা বাকি। এদিকে গুপ্ত সান্ত্রী খবর এনেছে ঘোড়ার পিঠে চড়ে, প্রজাদের ভেতর বিদ্রোহ জাগছে অবন্তিনগরে। রাজ্যপাট লণ্ডভণ্ড, একবছর রাজার দেখা নেই! অজাতশত্রু ঠিক করলেন অবন্তি ফিরবেন কালকেই।

কিন্তু গোটা রাত ঘুম এল না রাজার চোখে। উৎকলের সীমানা থেকে মগধ চার ক্রোশ। খবরটা যদি সত্যি হয়? যাচাই করতে কী দোষ? রাত থাকতে থাকতে গিয়ে চলে আসা যায়। এ খবর যদি সত্যিই হয় তবে গেলেই খোঁজ মিলে যাবে পথে-ঘাটে, যে-কোনো সরাইখানায়। খবরের সত্যতা মতো না হয় ভবিষ্যৎ কাজ করা যাবে স্থির।

বাইরে তখন আঁধার কালো, বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির। রাজা ঠিক করলেন নিজেই ছদ্মবেশে গিয়ে দেখবেন কী হালচাল। মগধের রাজা তখন শিশুপাল। অজাতশত্রু পথে নামেন বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। চলতে থাকেন জঙ্গলের পথ দিয়ে। রাত থাকতেই ফিরে আসা চাই যতই হোক কষ্ট। তারপরের ঘটনাক্রম খানিকটা অস্পষ্ট। শোনা যায় সেই রাতে অজাতশত্রু ধরা পড়ে যান মগধ সেনার হাতে।

তারপর বহুবছর কেটে যায়। অজাতশত্রু বন্দি পড়ে থাকেন নাম-না-জানা কারাগারে কঠিন প্রহরায়। অজাতশত্রুর শরীর ক্রমশ ভেঙেছে, মুখে ছাপ পড়েছে বয়সের। সেখানে বসেই খবর পান অবন্তিতে জয় হয়েছে প্রজা বিপ্লবের। প্রজারা যাকে সিংহাসনে বসিয়েছে তার নাম দামোদর। অবন্তিরও নাম বদলে এখন বিজয়নগর।

এভাবেই না জানি কেটে গেছে কতকাল। হঠাৎ একদিন খবর এল, কাল থেকে মগধের রাজসিংহাসনে বসবেন শিশুপালের বড়ো ছেলে ইন্দ্রপাল। সেই রাজ্যাভিষেক ঘিরে মগধের রাস্তাঘাট উপচে পড়ছে মিছিলে মিছিলে। ইন্দ্রপাল রাজা হয়েই পাঁচশত যুদ্ধবন্দিকে ছেড়ে দিলে। অজাতশত্রুও ছিলেন সেই দলে। ততদিনে তাঁকে অবশ্য আর চেনা যায় না, দেহ ঝুঁকে পড়েছে, শরীরের সব হাড় গোনা যায়—কে বলবে ইনিই ছিলেন সেই রাজা যিনি রাজ্য জয় করতেন নাম বলে বলে! মুক্তি পেয়েই হয়তো-বা রাজা ঘরের পথ ধরেন। যদিও এ ঘটনার পর অজাতশত্রুর হদিশ মেলে না কোনো লিখিত অক্ষরে, তবু এরপর তাঁর নাম একবারই মাত্র শোনা যায়, তবে সেটা কিন্তু একদম অন্য ইতিহাসের একটুকু কোণ জুড়ে।

রাজা দামোদর রাজকার্যে তো ভালো, তবে যুদ্ধে যে তিনি একেবারেই নারাজ, এই খবরটা বোধ হয় ছড়িয়েছিল অনেক দূরে দূরে। বিজয়নগরের এককোণ ঘেঁষেই উজ্জ্বয়িনী। সে দেশের রাজা যেমন বড়ো যোদ্ধা, তেমনি সুযোগসন্ধানী। বিজয়নগর তার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের আগেই উজ্জ্বয়িনী বিজয়নগর আক্রমণ করে। সে এক অন্য গল্প, অন্য যুদ্ধ—সে নাহয় বলব অন্য অবসরে।

কিন্তু সেই যুদ্ধযাত্রার বিবরণের মাঝেই লেখা আছে এক অদ্ভুত কথা। তখন গ্রীষ্মকাল, সূর্যের তখন প্রবল তীব্রতা। সেই সময়ে উজ্জ্বয়িনীর সেনা যখন বিজয়নগরের থেকে মাত্র আট ক্রোশ দূরে, তখন সেনারা অদ্ভুত এক পাগলকে ধরে আনে রাজার কাছে। পাগলের শরীরের ভগ্নদশা। ঠিক নেই কোন মুহূর্তে মরে বাঁচে। এক সৈন্য বলে, “মহারাজ, এ এক অদ্ভুত পাগল! রাস্তায় পড়ে খালি কাতরাচ্ছিল, ‘জল, জল।’ ওকে জল দিলে বলে, ‘তোমরা কারা? কোথা যাও?’ আমরা বলি, ‘আমরা যাচ্ছি বিজয়নগর। সেখানে যুদ্ধ হবে। আমাদের রাজা মহারাজ সদাশিব রাও।’ সেই থেকে ও খালি হেসেই চলেছে খলখল আর বলে যাচ্ছে, ‘আমাকে তোদের রাজার কাছে নিয়ে চল।’ একে কী করি মহারাজ?”

সদাশিব রাওয়ের তখন অনেক কাজ। তিনি বিরক্ত হয়ে হুকুম দিলেন, “ওকে পাশের কোনো গাছে বেঁধে রেখে এগিয়ে চল।”

হুকুমের তামিল হল। পাগলকে গাছে বেঁধে এগিয়ে চলল সৈন্যদল। তারপর সবাই সে পাগলের কথা ভুলেই গেছে কোনো না কোনো ফাঁকে। শুধু সদাশিব রাওয়ের সেনাপতি ভুলতে পারেনি তাকে। অবন্তিনগরে ছিল সেনাপতির মাসির ঘর। সেখানে সে যখন যেত তখন সে নিতান্তই ছোটো, বয়স সাত কি আট বছর। সে খানিক চিনতে পেরেছিল চওড়া ললাট, দীর্ঘ গ্রীবা… তবে এ কেমন ভগ্নদশা! তবে কি ভ্রান্তি? কোথায় সে তেজ, সেই প্রবল পরাক্রান্তি যার কথা মাথা পেতে নিত নর্মদা থেকে শতদ্রু?

বিশু চেঁচিয়ে ওঠে, “রাজা অজাতশত্রু? ওই পাগল?”

দাদু মাথা নেড়ে বলেন, “ওখানেই তো গণ্ডগোল। তাঁর মতো মনে হলেও সেনাপতি নিসংশয় হতে পারেননি কখনো। তাই তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সেকথা ছিল হৃদয়েই লুকোনো। হয়তো ছিল সে-ই। এরপর কোনো ইতিহাসে অজাতশত্রুর আর কোনো চিহ্ন নেই।”

বাপ্পা জিজ্ঞেস করল, “আর যুদ্ধটা? সেটা কীসের জন্য? কেউ জানে?”

“ইতিহাস বলে উজ্জ্বয়িনী নাকি শুনেছিল অপার ঐশ্বর্য গোপনে লুকানো আছে বিজয়নগরের কোনোখানে—সোনাদানা, মানিক, হাঁসের ডিমের মতো বড়ো বড়ো হিরে। সেই শুনেই উজ্জ্বয়িনীর রাজা ষাট হাজার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে নামেন নর্মদার তীরে। যুদ্ধে উজ্জ্বয়িনীর একতরফাই জিত হল। যুদ্ধ শেষে তারা কতজনকে যে মারল, কাটল, শূলে দিল… তারপর ঘরবাড়ি, মন্দির ভেঙে ভেঙে শুরু হল ধনরত্ন খোঁজা। কিন্তু কোথায় কী! রাজকোষের সামান্য সম্পদ ছাড়া বাকি সব ভোঁ-ভাঁ।”

মণি ছল ছল চোখে বলল, “অজাতশত্রু তাহলে আর বাড়ি ফিরতে পারেনি?”

“কী জানি। তবে হয়তো পারেননি।”

বাইরে আবার তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হল, মেঘ ডাকছে গরগর গরগর। দাদু উদাস গলায় বললেন, “কিছু না পেয়ে একমাস পর উজ্জ্বয়িনীর সেনা দেশে ফিরে যায়। কিন্তু ফেরার আগে তারা রাগে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে যায় সমস্ত বিজয়নগর।”

জয়ঢাকের গল্পঘর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s