তারপর ছিটকিনি খুলে বাইরে গিয়ে দেখি কেউ কোথাও নেই। বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা। হাড় কাঁপানো শীতে ঘুমের ভেতর উঠতে সত্যি ভীষণ বিরক্ত লাগে।
লাভার রিম্ভিক গ্রামের এক হোম-স্টেতে আজ সকালেই আমি আর ভবানীপ্রসাদ উঠেছি। বৌদ্ধদের বাস এখানে। চারদিকে ঈশ্বর সব যেন নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়েছেন। সারাদিন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেশ ক্লান্ত শরীরে ঘরে ঢুকে খাবার তাগাদা দিতেই চাপরাশি অনন্ত রাই আমায় বলল, “বাবু আজ যে বনমুরগি পেয়েছি এমন মুরগি আমরা খুব কমই পাই। আমি বেশ কষা কষা করে রেঁধেছি।”
রাতের খাবারটা বেশ আয়েস করেই খেলাম। চারদিকে একটা চাপা নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে অজানা পাখির বীভৎস চিৎকারে বুকের নীচের ধুকপুক যন্ত্রটা থেমে থেমে যাচ্ছিল।
রাতে দরজায় আরো দু-বার নক করার শব্দ পেয়ে দরজা খুলে দেখেছি কেউ কোথাও নেই। এভাবেই সারাটা রাত কেটে গেল আমাদের। ভোর তখনো হতে কিছুটা বাকি। ভোররাতে ঘুম ভেঙে যায় আমার। আর না ঘুমিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে করতে অনন্তকে চা দিতে বললাম। অনন্ত পাহাড়ের ঢালটায় বসে পাইনের ডাল কাটছিল রান্নার জন্য। রাত থাকতেই এরা দিনের কাজ শুরু করে দেয় বোধ হয়।
অনন্ত বলল, “আজ হাটের দিন। আপনাদের খাবার তৈরি করে টেবিলে রেখে দিয়েছি। আপনারা খেয়ে নেবেন সময়মতো।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কখন ফিরবে হাট থেকে?”
অনন্ত বলল, “শাম হয়ে যাবে বাবু।”
“আচ্ছা, তাড়াতাড়ি চলে এসো।”
লাভার একদিকটায় বৌদ্ধ মনাস্ট্রি, আর অন্যদিকে গভীর ঘন জঙ্গল। সরু একটা রাস্তা চলে গেছে ইচ্ছে-গাঁওয়ের দিকে। আমরা প্রাতরাশ সেরে একটু আশপাশটা ঘুরে নিলাম। একটু বিশ্রাম করেই বেরিয়ে পড়ব ইচ্ছে-গাঁওয়ের দিকে। আকাশ আজ বেশ পরিষ্কার। অন্যদিনের মতো মেঘলা নয়। দুপুরে পাহাড়ি মাছের ঝোল আর লেটুস শাকের তরকারি বেশ মনোমতো খেয়েছি। বিছানায় শরীর ফেলতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ভবানীপ্রসাদের ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘড়িতে তখন প্রায় তিনটা। পাহাড়ে সন্ধে নামে চারটা নাগাদ। তবুও দুই বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়লাম ইচ্ছে-গাঁওয়ের দিকে। অনেকটা হাঁটার পর ছোট্ট একটা গ্রাম। মাত্র চার ঘর মানুষকে নিয়ে গ্রামটা। এটাই বোধ হয় ইচ্ছে-গাঁও।
পাইন বনটা পার হতেই সন্ধে নেমে এল। বিকেলে আমরা কিছুই খাইনি। এক কাপ চা পর্যন্ত না। একটা দোকানও চোখে পড়ছে না। এমন সময় ছিপছিপানি বৃষ্টি শুরু হল।
আমরা সম্পূর্ণ না ভিজলেও আধা ভিজে হয়ে গেছি। ভবানীপ্রসাদ আমাকে হাতের কনুই দিয়ে একটা গোত্তা দিয়ে বলল, “ওই দেখো, একটা আলো দেখা যাচ্ছে। গিয়ে দেখি কিছু পাওয়া যায় কি না।”
আমরা অনেকটা চড়াই-উতরাই পার হয়ে শালপাতায় মোড়ানো একটা দোকানের বারান্দায় গিয়ে উঠলাম। এটা একটা দোকানই বটে। জিজ্ঞেস করলাম, “চা পাওয়া যাবে?”
লোকটা কথাটার কোনো উত্তর না দিয়ে তাচ্ছিল্যের চাহনিতে ভেতরে চলে গেল। আমরা বোকার মতো চেয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। চমকে উঠলাম একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বরে। “হাঁ বাবু, এখানে মোমো পাওয়া যাবে। আপনারা মোমো খেতে খেতে আমি চা বানিয়ে দেব। খাবেন তো?”
“বানাও। তবে তাড়াতাড়ি করবে। আমাদের এ পথটা অজানা অচেনা।”
“কুছু ভাববেন না বাবুরা। আমাদের কাঞ্চা আপনাদের পথ দেখিয়ে লিয়ে যাবে।”
“বাহ্, বেশ বেশ।”
আমি ভবানীর দিকে তাকিয়ে দেখি ভবানী ছড়া লেখায় ব্যস্ত।
‘অন্ধকারে পাহাড় বেয়ে
আমরা দুটি প্রাণী,
ফিরব ঘরে বৃষ্টি নিয়ে
প্রচণ্ড হয়রানি।’
ভবানীপ্রসাদ একালের একজন নামকরা শিশুসাহিত্যিক। আমাদের বন্ধুত্ব প্রায় পঞ্চাশ বছরের। আমি হেসে বললাম, “চা খেতে খেতে রাত হয়ে যাবে ভবানী।”
ভবানী বলল, “ঘড়িতে দেখো কয়টা বাজে।”
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত দশটা বাজে। ঠান্ডায় শরীরে একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম। মেয়েটিকে বললাম, “তোমার কাঞ্চা কোথায় বহিন?”
মেয়েটি ডাকল, “এ নাশু। কুথায় গেলি রে, জলদি আয়।”
মিনিট দশেকের মধ্যে একটা কালো ছিপছিপে প্রায় ছ’ফুট লম্বা লোক হাতে একটা জংধরা টর্চ নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। গামছায় গা-টা ঢাকা। এই শীতে খালি গায়ে আছে কীভাবে মানুষটা! বুকের সবক’টা হাড় বাইরে বেরিয়ে আসছে। চোখ কোটেরের ভেতর থেকে যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। একটা ভয়ার্ত চেহারার মানুষ। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “চলিয়ে।”
আমরা দ্রুত পা চালিয়েও ওর সঙ্গে পেরে উঠছি না। পাহাড়ি রাস্তা, তায় বেশ পিচ্ছিল। আমরা বার কয় আছাড় খেলাম। আমাদের পথ দেখিয়ে নেয়া নাশু গটগট করে চলছে যেন এটা সুন্দর রাস্তা। একবার আমাদের বলল, “জলদি যেতে হবে বাবু। সুবে আমার বহুত কাজ আছে, তখন কিন্তু আমি আর যাব না বাবু।”
বেশ দূরে বনমোরগের তীক্ষ্ণ ডাকে সারা বনটা চমকে উঠল। সেই ডাকেই ভবানী চমকে গিয়ে পাহাড়ের ঢালটায় গড়িয়ে গেল বেশ খানিকটা। ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ চিৎকার করতেই নাশু পটাপট ওকে তুলে নিয়ে এল। আশ্চর্য হলাম এই ভেবে যে পাহাড়ের পিচ্ছিল উঁচুনীচু রাস্তাটায় কত অভ্যস্ত এরা।
আর হাঁটার শক্তি পাচ্ছে না পা-দুটো। নাশুকে বললাম, “আর কতটা যেতে হবে ভাই?”
“নজদিকেই আছে।”
“আমরা আসার সময় তো এত সময় লাগেনি ভাই! আমরা ঠিক যাচ্ছি তো?”
“ইটা অন্য রাস্তা আছে বাবুজী। ইকটু ঘুরতি রাস্তা। সময় লাগবেই।”
রাত গভীর থেকে আরো গভীর হয়েছে। এখান থেকে আমরা আমাদের হোম-স্টে কোথায় বলতেও পারব না। শুধু হোম-স্টে নামটা মনে আছে ‘অনন্তঘর’।
হাতের ঘড়িতে এলার্ম বেজে উঠল ভোর চারটের।
এ-ত রাত!
নাশু আমাদের একটা পাহাড়ি ঢাল দেখিয়ে দিয়ে বলল, “ই রাস্তা কা নীচে আপনাদের স্টে আছে বাবু।” বলেই দ্রুত কুয়াশায় হারিয়ে গেল।
আমরা ভোর না হওয়া পর্যন্ত রাস্তার পাশেই স্থায়ী একটা বাঁশের বেঞ্চে বসে পড়লাম। পাহাড়ি মশার প্রায় হাজার খানেক কামড় খেয়েও ঠিক ছিলাম। পায়ে চুলকাতেই বুঝলাম অন্তত কয়েকশো জোঁক পায়ে কামড়ে ধরে আছে। আগে বুঝতেই পারিনি। জোঁক ছাড়াতে ছাড়াতেই ভোরের আলো ফুটতে লাগল। আস্তে আস্তে লোটা হাতে পাহাড়ি মানুষজন সকালের কাজ সারতে এদিক ওদিক যাচ্ছে।
গাছের ডালে দাঁত ঘষতে ঘষতে একটা পাহাড়ি ছেলে কীসব যেন আমাদের বলে চলে গেল। ভাষাটা জানা না থাকায় কিছুই বুঝতে পারলাম না।
আমরা ভীষণ ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত। একদল লোক আমাদের দিকেই আসছে মনে হয়। আমরা কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেও ভয়ের কিছুই ছিল না। লোকগুলো আমাদের কাছে এসে কী যেন জিজ্ঞেস করল। আমি হিন্দিতে বললাম, “সমঝা নেহি।”
এবার যিনি কাছে এলেন তিনি দস্তুর বাঙালি। গোলগাল চেহারা, মুখে খোঁচা দাড়ি। বয়েস ষাট পেরিয়ে গেছে। আমার দিকে বারকয়েক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা এখানে এই শ্মশানে কী করছেন?”
শ্মশান!
আমরা বললাম, “আমরা পথ হারিয়ে এখানে এসেছি। আমরা ইচ্ছে-গাঁও দেখতে বের হয়েছিলাম। সন্ধে হওয়ায় আমরা এখান থেকে বেশ কিছুটা গেলে যে দোকানটা পড়ে সেখানে মোমো-চা খেতে খেতে রাত হয়ে যাওয়ায় ওই দোকানের মেয়েটা তাদের নাশু কাঞ্চাকে দিয়ে আমাদের ‘অনন্তঘর’-এ পাঠাতে দিয়েছিল। কিন্তু ভোরের আগেই নাশু চলে যাওয়ায় আমরা ভোরের অপেক্ষা করছিলাম।”
ভদ্রলোক চোখদুটো বড়ো বড়ো করে বললেন, “ইচ্ছে-গাঁও? দোকানে মোমো খেয়েছেন? নাশু কাঞ্চা? অনন্তঘর? আচ্ছা, সব ঠিক আছে। আগে আসুন, কিছু খেয়ে নিন। তারপর সব শোনা যাবে।”
আমরা চা-পাউরুটি খেয়ে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি কিছুই জানি না।
ভদ্রলোকের কথায় ঘুম ভাঙতেই চেয়ে দেখি ঘরভর্তি লোকজন।
দুপুরের খাওয়া এখানেই বাধ্য হয়ে করতে হল। একদম বাঙালি খানা। নিরামিষ। খাওয়ার পর গোলগাল ভদ্রলোক আমাদের বললেন, “আপনাদের জিনিসপত্র কোথায় আছে?”
“কেন, ওই অনন্তঘরে।”
“আচ্ছা।”
ভদ্রলোক একটা ছেলেকে ডেকে বললেন, “একটা মোটর সাইকেল নিয়ে দেখে আয় সব মালপত্র আছে কি না।”
আমরা শুধু ওদের কথাবার্তায় অবাক হয়ে যাচ্ছি। কিছুই বুঝতে পারছি না।
ভদ্রলোক এবার বললেন, “আপনারা মৃত আত্মার খপ্পরে পড়েছিলেন।”
কথাটা শোনামাত্র আমি ঘামতে শুরু করলাম।
ভদ্রলোক আবার বললেন, “তিন বছর আগে এক পাহাড়ি ধ্বসে ওই দোকান সহ চারজনের মৃত্যু হয়েছিল। অনেকের মুখেই শুনেছি। চলুন, আপনাদের নিয়ে জায়গাগুলো দেখিয়ে আসি। ভয় পাবেন না, আমরা ভূত-টুত নই।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা নেপালি ড্রাইভার একটা গাড়ি এনে বাড়িটার গেটে দাঁড় করাতেই ভদ্রলোকটি বললেন, “চলুন, দেখিয়ে আনি।”
আমরা রাজি না হলেও একরকম জোর করেই গাড়িতে উঠিয়ে নিলেন।
এবড়োখেবড়ো রাস্তায় গাড়িটা চলছে। চারদিকে শুধু পাহাড় আর জঙ্গল। গাড়িটা একটা হালকা ব্রেক কষে পাহাড়ের ঢালটায় দাঁড়িয়ে পড়ল।
“দেখুন তো এ-ই জায়গাটা কি না।”
একটা ফলন্ত ডালিমগাছ দেখে ভবানী বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো সেই ডালিমগাছটা। এখানে আমার ভেজা রুমালটা মেলে দিয়েছিলাম। ওই তো আমার রুমাল। হ্যাঁ, এটাই সেই জায়গা।”
দেখলাম, কিছু নুড়িপাথর ধ্বসে নীচে নেমে গেছে। বাড়িটার ভাঙা কিছু অংশ মুখ থুবড়ে পাহাড়ের গায়ে পড়ে আছে। দিন আর রাতের কত পার্থক্য। নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছি না।
“চলুন এবার অনন্তঘরে।”
আমি বললাম, “না, থাক।”
উনি আবার বললেন, “তবু চলুন, দেখে আসবেন। অনন্তঘরে একসময় কিছু ভুটানি মেষপালক থাকত। ভেড়ার দুধ আর লোমের ব্যাবসা ছিল এদের। চিন ও ভুটান ছিল এদের ব্যাবসার পীঠস্থান। ইঙ্গ-ভুটান যুদ্ধে অনন্তঘরের প্রায় সবাই মারা যায়। থেকে যায় অনন্তঘর। এক ভূতুড়ে ঐতিহাসিক সাক্ষী।
“কাল রাতে আপনারা এই ভূতুড়ে বাড়িতেই রাতটা কাটিয়েছেন। আপনারা তো ভাগ্যবান মশাই! ভূতের বাড়িতে রাত কাটানো কি সবার ভাগ্যে জোটে!”
ভবানী আমায় ছোট্ট একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “চলো বন্ধু, অনেক হয়েছে। এবার ভালোয় ভালোয় ঘরে ফিরে যাই।”
আমরা আমাদের গাড়ির কাচ দিয়ে দেখছি সুন্দরী কালিম্পংকে, আর চোখ বন্ধ করলেই দেখছি কালকের সেই ভয়ংকর রাত্রির বীভৎস চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা। তবে কি সত্যি আমরা লাভার জঙ্গলে প্রেতাত্মার সঙ্গে একটি রাত কাটিয়ে এলাম?
অলঙ্করণ:রাহুল মজুমদার