সবিতা বিশ্বাসের আগের গল্প- চিকু, গল্প-ভুতুড়ে শহরের খোঁজে
লালবাগ শহরটার গায়ে ইতিহাসের গন্ধ। শুধু কি গন্ধ? সময়ের ধুলো পড়লেও হিরে-জহরত-মণি-মুক্তো থেকে জেল্লা বেরোয় এখনও। লালবাগ মানে মুর্শিদাবাদ, আইন-ই-আকবরিতে উল্লেখ আছে, নাম ছিল মখসুসাবাদ, বর্তমানের প্রায় তিনশত বছরের পুরোনো মুর্শিদাবাদ শহর। এই শহরের অলিতে-গলিতে কত যে গল্প! কত যে রহস্য! সত্যি, এখানে না এলে জানতেই পারতাম না এসব ব্যাপার। যার সঙ্গে কথা বলি সেই বলে আমরা নবাবের বংশধর! অবশ্য অবিশ্বাস করার মতো কিছু নেই, গায়ের রঙ একেবারে তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ। দু-একজনের রঙ সময়ের আস্তরণে তাম্রবর্ণ হয়ে গেছে, তবুও!
যেদিন লালবাগ ব্রাঞ্চে জয়েন করি, সেই প্রথম দিনের ঘটনা কিছুতেই ভুলতে পারি না।
প্রমোশন পেয়ে স্কেল-ওয়ান অফিসার হিসেবে জয়েন করেছি ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার এই শাখায়। প্রথম দিনই ডেপুটি ম্যানেজারের অনুপস্থিতিতে তাঁর চেয়ারে। হঠাৎ অসুস্থ হওয়াতে আসতে পারেননি তিনি। অন্য কোনও কাজ নয়, সই মিলিয়ে চেক, উইথড্রয়াল স্লিপ পাস করে দিতে হবে। সপ্তাহের প্রথম দিন, প্রচণ্ড ভিড় কাউন্টারে। চেষ্টা করছি মোটামুটি সই মিললেই ছেড়ে দেওয়ার, কিন্তু আটকে গেলাম জেবুন্নেসা বেগমের চেকে। আকাশ-পাতাল তফাত। যিনি নিয়ে এসেছিলেন, তাঁকে কথাটা বলতেই খুব রেগে গেলেন—এর আগে নাকি কখনও এমন হয়নি। সে একটা বিশ্রী ব্যাপার। এমনও শুনতে হল, আমি কিছুই জানি না। আমারও জেদ চেপে গেল। বললাম, হবে না। যার অ্যাকাউন্ট তাকে আসতে হবে। তিনি এলেন, বোরখায় ঢাকা সর্বাঙ্গ। কাঁপা কাঁপা হাতে সই করলেন। একজন মানুষের হাত যদি এত সুন্দর হয় তবে মুখ না জানি কত সুন্দর! দেখলাম, জানলাম, তিনি শেষ নবাব ওয়ারিস আলি মির্জা পরিবারের পুত্রবধূ। সই ঠিকঠাক মিলল না, মনে হল পার্কিনসন্স অসুখে ভুগছেন। সিগনেচার পাস করতেই অন্যদের সঙ্গে একজন কলিগও বলে ফেলল, ‘ফালতু ঝামেলা করে লাভ হল কিছু?’
নতুন জায়গা, প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা সুখকর হল না। রিকশায় চেপে ভাড়া বাড়িতে ফিরতে ফিরতে সে-কথাই ভাবছি। কী জানি বাড়িতে গিয়ে আবার কী শুনব! যদিও বেশ ভালো বাড়ি পেয়েছি, খুব পছন্দ হয়েছে আমার। প্রায় এক বিঘা জায়গা, পাঁচটা পরিবার থাকে। বাড়িওয়ালা থাকেন বহরমপুর, নাম করা ব্যবসায়ী, চন্দ্র জুয়েলারি ওঁদের। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আম, লিচু, কাঁঠাল, নারকোলের বাগান আর যার যার ঘরের সামনের ফাঁকা জমিতে ভাড়াটিয়ারা সবজি, ফুলের বাগানও করেছে। একদম ভাগীরথী নদীর কাছে মানে হাজারদুয়ারি প্যালেসের কাছেই চকবাজারে।
অফিস থেকে একটু দূরে হলেও এলাকা ভালো, একজন সহকর্মী ঠিক করে দিয়েছেন। সেটা একটা ভরসার কথাও বটে! আপদে-বিপদে চেনা লোক পাব। এসেছি কন্যাকে নিয়ে, এই সবে সাত মাস বয়স। একেবারে নতুন জায়গা, সাহস বলতে যে ওকে সবসময় দেখত সে সঙ্গে এসেছে। তার কাছে কন্যা ভালোই থাকে, এইটুকুই যা স্বস্তি।
ঘরে ঢুকতেই স্বস্তি উধাও হয়ে গিয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। বিজলীদি মানে আমার কন্যার সর্বক্ষণের সঙ্গী বলল, “আমি আর একেনে থাকবোনি, আমাকে বাড়ি পাটিয়ে দাও।”
কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতে হাউ-মাউ করে কান্না। কান্না থামলে যা বলল তা শুনে আমি যে কী করব বুঝে উঠতে পারলাম না। ঘটনাটা এইরকম, তিন্নিকে স্নান করিয়ে, খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে বিজলীদি স্নান করতে গিয়েছিল। সেই সময় লোডশেডিং থাকায় পাখা চলছিল না। বাগানের দিক থেকে ভালো হাওয়া আসছে দেখে ওইদিকের দরজাটা খুলে রেখে গিয়েছিল। স্নান সেরে ফিরে এসে দেখে তিন্নির মাথার কাছে খাটের ওপর বিশালাকার এক হনুমান বসে তিন্নির মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। বিজলীদি ওই দেখে চিৎকার করবে কী, গলা দিয়ে ‘গঁ-গঁ’ ছাড়া আর কিছুই বের হচ্ছে না। সেই আওয়াজে হনুমানটা বিশ্রীভাবে দাঁত খিঁচিয়ে উঠে তাড়া করেছে বিজলীদিকে। বিজলীদি বাথরুমে ঢুকে অজ্ঞান হয়ে গেছিল; তারপর জ্ঞান ফিরতে উঁকি মেরে দেখে তিন্নি তখনও ঘুমোচ্ছে, হনুমান নেই। সেই থেকে দরজা-জানালা বন্ধ করে তিন্নিকে কোলে নিয়ে বসে আছে।
সর্বনাশ! কী হবে? এইরকম হনুমানের উত্পাত, এ-কথা তো আগে কেউ বলেনি। সেই ছোটবেলায় শুনেছিলাম কোথায় যেন ছোট্ট একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হনু চড়ে বসেছিল গাছের মগডালে। কলা, বিস্কুট আরও অনেক কিছুর লোভ দেখিয়েও তাকে নামানো যায়নি। লোকজন গাছে চড়তেই বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে অন্য একটা ডালে লাফ দিলে বাচ্চাটা হনুমানের কোল থেকে নীচে পড়ে যায়। আসলে ওদের নিজেদের বাচ্চা মাকে জড়িয়ে ধরে থাকে, মনুষ্য-শিশু তো সেই কায়দা জানে না। সেই কথা মনে পড়তেই আমার মাথা ঘুরতে লাগল। কী করব এখন! অন্য বাড়ি খুঁজে পেতে কিছু সময় তো লাগবেই। আজই জয়েন করেছি, ছুটি নেব কী করে?
পরের দিন ছুটি নিতেই হল। হনুমানের টিকিও দেখা গেল না। অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বললাম। সকলেই বলল, না না, কোনও ভয় নেই। মনে হচ্ছে লাল্টু। ও কারও ক্ষতি করে না। কীভাবে ঘরে ঢুকে পড়েছিল! তবে ওকে দেখলে চেঁচামেচি করলে বিপদ। না হলে ও কিচ্ছু করে না। বড়োজোর সবজির ঝুড়ি থেকে আলু-পটল বা বিস্কুটের কৌটো নিয়ে পালাতে পারে। মনে মনে বললাম, ওইটাই যে লালবাগের লাল্টু, চিনব কী করে? মুখে কিছু বললাম না। প্রতিবেশীরাও অপিরিচিত, যদি কিছু মনে করে!
তার পরের দিন বিজলীদিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে অফিস গেলাম। বললাম, “একদম বাগানের দিকের দরজা খুলবে না। অত বড়ো শরীর নিয়ে সে তো জানালা দিয়ে ঢুকতে পারবে না!”
তখন কি আর জানি, হনু জানালার শিক ধরে বসে থাকবে সারাদিন!
অফিসে কলিগদের বলতে তারা হো হো করে হেসে উড়িয়ে দিল ব্যাপারটা। লালবাগে হনুমান কোথায় নেই? এত বড়ো বড়ো নবাব-পসন্দ, বেগম-পসন্দ আমবাগান ছেড়ে ওরা অন্য কোথাও যাবে নাকি!
লালবাগেই বাড়ি শ্যামলদার। খুব ভরসা দিল, “কিচ্ছু হবে না। অত ভালো বাড়ি কেউ ছাড়ে? হাজারদুয়ারি, ইমামবাড়া এ-বেলা ও-বেলা দেখতে পাচ্ছেন, গঙ্গার হাওয়া খেতে পাচ্ছেন, ঘর থেকে বেরোলেই বাজার।”
আমার স্বামীর পোস্টিং শালবনীতে, অফিস থেকেই ওঁকে ফোন করলাম। উনিও একই কথা বললেন, “ক’টা বাড়ি পালটাবে? এরকম ভয় পেলে তো শেষমেশ চাকরি ছেড়ে দিতে হবে।”
এর আগে কখনও মুর্শিদাবাদ আসা হয়নি। কলেজ থেকে একবার এক্সকারশনে বহরমপুর রেশম গবেষণা কেন্দ্রে এসেছিলাম। তখন কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজে পড়ি, হোস্টেলে থাকি। দু-দিনের ট্যুর। ঠিক ছিল প্রথম দিন বহরমপুর রেশম গবেষণা কেন্দ্র দেখে দ্বিতীয় দিন মুর্শিদাবাদ যাব, সে পরিকল্পনাতে বাদ সেধেছিল হনুমান। একেবারে যাচ্ছেতাই কাণ্ড! বাসের টায়ার পাংচার হওয়ায় পালটানোর জন্য রাস্তার ধারে দাঁড়াতে সবাই হুড়মুড় করে নেমে পড়েছিল। বিকেল হয়ে যাওয়ায় একটু একটু খিদেও পেয়েছিল অনেকের, তাই সকালের টিফিনে দেওয়া কলা-বিস্কুট হাতে নিয়ে হইহই করে মজা করতে করতে গল্প করছিল সবাই। আর আমার মতো নিদ্রাপ্রিয় কয়েকজন এই সুযোগে বাসের মধ্যে হাত-পা ছড়িয়ে নাসিকা গর্জন করছিলাম। হঠাৎ সকলের কান্নাকাটি, চিৎকারে চোখ খুলে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি সর্বনাশ! হনুমানের একটা দল ঘিরে ধরে কলা-বিস্কুট কেড়ে নিয়েছে। শ্রাবণীর নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে, রমিতার হাতে হনুমান আঁচড় দিয়েছে। এক-দু’জন নয়, চারজন ইনজুরড। মাথায় উঠল মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ, লালবাগ যুব আবাসের বুকিং ক্যানসেল করে বাস ছুটল শক্তিনগর হাসপাতালে।
এখনও পর্যন্ত হনুমান নিয়ে কোনও অভিজ্ঞতাই সুখের বা আনন্দের নয় বরং আতঙ্কের। কলেজের হোস্টেলে থাকতে হনু টিম পুরো দু-দিন আমাদের হোস্টেলের গেটের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ করেছিল। তাতে রবিবারে যেসব অভিভাবক আমাদের দেখতে এসেছিলেন তাঁরা দেখা করা তো দূরে থাক, হোস্টেলের সামনেই আসতে পারেননি। যাঁরা কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজ আগে থেকে চেনেন, তাঁরা জানেন মাঠের মাঝখানে বিশাল একটা তেঁতুল গাছ ছিল। হনুদের উপদ্রবে তেঁতুল পাওয়া দূরের কথা, মাঠে বসতেই ভয় লাগত। ওরা মুখের স্বাদ পালটাতে আমাদের ও গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুলের হোস্টেলের আম-কাঁঠাল-কলা কিছুই বাদ রাখত না। বড়ো বড়ো বস্তা দিয়ে ঢেকে রাখত আমাদের মালিকাকু, তবুও রোজই ঝামেলা হত। একদিন পটকার আঘাতে একটা হনুর বাচ্চা আহত হয়েছিল। হনুরা তার শোধ তুলেছিল আমাদের ঘেরাও করে। এমন কপাল, কর্মস্থলে এসেও শান্তি নেই! কথায় আছে, তুমি যাও বঙ্গে, কপাল যায় সঙ্গে। আমার সঙ্গে যায় পবননন্দন।
পরের সপ্তাহে তিন্নির বাবা এলেন। তাঁর দারুণ ভালো লাগল জায়গাটা, আমারও। হাজারদুয়ারি প্যালেস, মিউজিয়াম, ইমামবাড়া, মতিঝিল, কাটরা মসজিদ দেখে এত আনন্দ পেলাম, ভুলেই গেলাম লাল্টুর কথা। আমরা না-হয় ভুলে গেছি লাল্টুর কথা, লাল্টু কি ভুলেছে? ভোলেনি যে তার প্রমাণ পাওয়া গেল আতা গাছের ডাল থেকে লম্বা লেজ ঝুলতে দেখে। ওই লেজ দেখেই রেণুমাসিমা মানে আমার নতুন প্রতিবেশী স্বপনদার মা বলে দিলেন ওইটা লাল্টু। লাল্টুকে চিনলেন কী করে এই প্রশ্ন করতে রহস্যের পর্দা উন্মোচিত হল। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। এই এলাকাতে বরাবরই হনুর উত্পাত তার ওপর পুঁচকে হনু মানে লাল্টুর বাঁদরামির জ্বালায় কেউ ছাদে বা উঠোনে কিচ্ছু মেলতে পারত না। আচার, বড়ি, ডাল, এমনকি জামাকাপড় রোদে দিলেও দড়ি থেকে টেনে টেনে পেড়ে লণ্ডভণ্ড করত। তখনও কেউ ওর নাম দেয়নি। মিল্টু নামের একটা বিচ্ছু ছেলে বিস্কুট হাতে নিয়ে ওকে লোভ দেখাত—লে লে, টু টু, খা খা। যদিও সেগুলো আসলে বিস্কুট ছিল না, ছিল মাটির ঢেলা। একদিন ক্ষেপে গিয়ে মিল্টুকে তাড়া করেছিল, তখন মিল্টুর ঠাকমা জাঁতি দিয়ে সুপুরি কুচোচ্ছিল। সেই জাঁতি ছুড়ে মারতেই কুচ করে হনুর লেজের ডগা কেটে যায়। সেইদিন থেকে লে-লে-টু-টু হয়ে গেল লেজ কাটা লেল্টু তার থেকে লাল্টু।
তিন্নির বাবা যে-ক’দিন ছিলেন, কোনও ঝামেলা হয়নি। বাগানের দিকের মানে রেণুমাসিমার বাড়ির দিকের দরজাও খোলাই থাকত সারাদিন। আসলে তিন্নিকে মাসিমারা সব্বাই এত ভালোবেসে ফেলেছেন, আমার চিন্তা কমে গেছে অনেকটাই। বিজলীদিও খুশি, রবিবার হলেই মাসিমার সঙ্গে গঙ্গায় স্নান করতে যাচ্ছে। আর যেটা গোপন কথা, এখানকার জল এত ভালো, হজমের কোনও অসুবিধে নেই। যেমন দেউঘর, ঘন দুধের চা, প্যাঁড়া, সমোসা যাই খাও নিমেষে হজম হয়ে যাবে। কিন্তু এত ভালো সইলে হয়। ওই লাল্টুকে দেখে কেমন যেন সন্দেহ হয় আমার। বেশিরভাগ সময়ই গাছের ডাল থেকে তিন্নির দিকে চেয়ে থাকে। আর একটা জিনিস খেয়াল করেছি, লাল্টু কোনও দলে থাকে না। মনে হয় ওকে দল থেকে কোনও কারণে বহিষ্কার করেছে। কাকে বলি? বললেই বলবে কল্পনাশক্তি বটে!
কল্পনা নয়, কল্পনা নয়, যা ঘটল তা যে বাস্তবে ঘটতে পারে এটা ঘুমে-জাগরণে-স্বপ্নে-কল্পকাহিনিতে কেউ আজ পর্যন্ত শোনেনি, পড়েনি। আগেই বলেছি বিজলীদির মন থেকে ভয় উবে গিয়েছে, আর মাসিমা-মেসোমশাই মাঝে-মাঝেই তিন্নিকে দেখতে আসেন, তাই বাগানের দিকের দরজা খোলাই থাকে বেশিরভাগ সময়। সেদিনও খোলা ছিল। তিন্নি ঘুমিয়ে, বিজলীদি রনির মায়ের সঙ্গে গল্পে মশগুল। এর ফাঁকে লাল্টু ঘরে ঢুকে খাটে বসে তিন্নিকে কোলে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, মাথার কাছে ভাঁজ করে রাখা একটা তোয়ালেও নিয়েছে কোলে। মাসিমা আসছিলেন তিন্নির খোঁজ নিতে, এই দৃশ্য দেখে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। মাসিমাকে দেখে বিজলীদি এগিয়ে আসতে মাসিমা বিজলীদির মুখ চেপে ধরে সরিয়ে নেয়। কেউ জানে না লাল্টু কতক্ষণ আগে ঘরে ঢুকেছিল। তবে মাসিমা আসার মিনিট পাঁচেক বাদে বেরিয়ে যায়। যাবার আগে তিন্নিকে শুইয়ে দেয় বিছানায়। এও কি সম্ভব? সিনেমায় এমন দৃশ্য দেখা গেলেও যেতে পারে—ট্রেনিং, ক্যামেরার কারিকুরি। কিন্তু সত্যি সত্যি চোখের সামনে! আমি অফিস থেকে ফিরতেই দেখি গলির মোড়ে, রাস্তায় জটলা। আমাকে দেখে সবার মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল। তিন্নির কিছু হয়নি তো!
কী হবে এখন? ছোটবেলায় শোনা সেই গল্পের মতো যদি হয়! এই প্রথম আমি তিন্নিকে বুকে চেপে কেঁদে ফেললাম। কী করব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। সারারাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। চোখ বুজলেই বিশালাকায় লোমশ দুই হাতের মাঝে তিন্নিকে দেখতে পাচ্ছি। ভোররাতের দিকে ক্লান্তিতে চোখটা লেগে এসেছিল। ঘুম ভাঙল একটা ঝুমঝুমির আওয়াজে। প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলাম না শব্দটা কোথা থেকে আসছে। উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না। দরজাটা খুলতেই দেখি মূর্তিমান লাল্টু, হাতে একটা ছোট্ট ঝুমঝুমি। আমাকে দেখে আমার পায়ের কাছে ঝুমঝুমিটা রেখে এক লাফে গাছের ডালে। নীচু হয়ে কুড়িয়ে নিলাম। লাল্টু কোথা থেকে আনল এটা? আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ল। কেমন যেন মনে হল লাল্টু আমার তিন্নির কোনও ক্ষতি করতে পারে না, কক্ষনও না।
তারপর থেকে লাল্টু রোজই একবার করে আসে, বসে থাকে তিন্নির পাশে। তিন্নিও খুব চিনে গেছে ওকে। এই পৃথিবীতে কত না আশ্চর্য ঘটনা ঘটে, কিছুতেই যার ব্যাখ্যা মেলে না। লাল্টু পুরুষ হনুমান, ওর মধ্যে এত অপত্যস্নেহ? হনুমানের অনেক কীর্তির কথা শুনেছি, খবরের কাগজে পড়েছি। সেগুলোর বেশিরভাগই কুকীর্তি। কিন্তু লাল্টুর মতো এমন কখনও শুনিনি। আমার নিজের জীবনে না ঘটলে বিশ্বাসও করতাম না। তিন বছর ছিলাম লালবাগে, একটা আঁচড়ের দাগও পড়েনি তিন্নির গায়ে। বরং লাল্টু দু-দু’বার রক্ষা করেছে তিন্নিকে।
তিন্নি তখন নতুন নতুন হাঁটতে শিখেছে। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছিল কুন্দ ফুলের ঝোপের কাছে। এঁকে-বেঁকে এক নাগকন্যা এক্কেবারে তিন্নির সামনে। লাল্টু লাঠি দিয়ে সাপটাকে না মারলে… না, তারপর আর ভাবছি না। আর একবার রাস্তায়, দুটো রিক্সার সংঘর্ষে আমার কোল থেকে তিন্নি ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল। সেবারও পবননন্দন লাল্টু উদয় হয়ে জন্টি রোডসের মতো ক্যাচ ধরে তিন্নিকে রক্ষা করে।
খুব চিন্তা ছিল, ট্রান্সফার হলে কী করে এখান থেকে যাব! লাল্টু কি যেতে দেবে? কিন্তু না, সে-সব কিছুই হয়নি। আসার আগে জিনিসপত্র প্যাকিং করছি দরজা বন্ধ করে, জানালা খোলা ছিল। দেখি লাল্টু, চুপ করে জানালার শিক ধরে বসে আছে। ওই শেষ দেখা। আমরা চলে আসার পরে রেণুমাসিমার চিঠিতে জানতে পারি লাল্টুকে ওরাও আর দেখেননি। লাল্টু কি অভিমান করে অন্য কোথাও চলে গেছে?
ছবি- জয়ন্ত বিশ্বাস
জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি