গল্প-অভিমানিনী- সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়-শরৎ ২০২২

আগের গল্প- প্যানগমে প্যানিক

golpoOBHIMANINI final

আজ সকালে প্রথম ঘটনাটা ঘটল। মানে জলের মগ হাতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সজল। সেই চন্দনতুলসী গাছটা, সেটা গেল কোথায়? এই তো এখানেই ছিল। তারপর? কেউ তুলে ফেলে দিল নাকি? না, ওই তো ওখানেই আছে। মানে যেখানে পোঁতা হয়েছিল। তবে তেমনভাবে দেখা যাচ্ছে না। সজল এগিয়ে গিয়ে চেষ্টা করে গাছটাকে হাতে ধরে দাঁড় করিয়ে দিতে। হয় না। গাছটা আবার শুয়ে পড়ে। সজলের একটু চিন্তা হয়। মাসিমণি বেরিয়েছে। ফিরে এসে ওকেই দোষ দেবে না তো? তবে দোষ ওর আছে বৈকি। সারাক্ষণ আজেবাজে চিন্তার ফল তো ফলবেই। আসলে মাসিমণির কাছে বেড়াতে আসার পর এই একটা ব্যাপারই ওর একদম ভালো লাগছে না। সেটা হল সকাল-সন্ধে গাছে জল দেওয়া। প্রতি বছরেই গরমের ছুটিতে মাসিমণির বাড়িতে বেড়াতে আসে ও। এই রঘুনাথপুর গ্রামটা বসিরহাটের কাছাকাছি। আগে এখানে পাকা রাস্তা ছিল না, ইলেকট্রিক ছিল না। উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে সে অবস্থা অনেকটাই পালটেছে। এখন গরমকালে দিব্যি ফ্যান চালিয়ে শোওয়া যায়। বর্ষাকালে পথে কাদায় চটি বসে যায় না।

এ-বছরে ও খুব চিন্তায় ছিল। গরমের ছুটির সময়েই বাবা-মাকে শিলিগুড়ি যেতে হবে  বাবার এক বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে। ওখানে যদি ওকেও ওরা নিয়ে যান, রঘুনাথপুরের হাজার মজা একেবারে মাটি হয়ে যাবে। ওখান থেকে বিলুর ফোনও এসেছিল। এবারে ওদের সাঁতারের প্রতিযোগিতা ওই গরমের ছুটিতেই হবে। নদীতে নৌকা বাওয়ার প্রতিযোগিতাও আছে। তাছাড়া ইচ্ছেমতো আগানে-বাগানে ঘোরা, গাছে উঠে আম-জাম খাওয়া তো আগেও ছিল, এখনও আছে।

মা এবারেও ওকে শিলিগুড়ি টেনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। বাবাকে বলছিলেন, “প্রতিবার প্রতিমার কাছে ওকে রেখে আসি। এবারে আমাদের সঙ্গেই নিয়ে যাব। বড়ো হচ্ছে, সারাক্ষণ তো প্রতিমা চোখে চোখে রাখতে পারবে না। কোথায় কী কাণ্ড ঘটাবে তার ঠিক আছে? ওর চিন্তায় বিয়েবাড়িতেও অস্থির লাগবে আমার।”

বাবা থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “না। ও রঘুনাথপুরেই যাক। ওখানে ওর সমবয়সি বিলু আছে। খোলা হাওয়া, গাছপালা ঘেরা পরিবেশে খেলাধুলোয় সময়টা ভালো কাটবে। চাই কি শরীর-স্বাস্থ্যের উন্নতিও হতে পারে। বিয়েবাড়ি গিয়ে অচেনা লোকেদের মধ্যে ওর তেমন ভালো লাগবে না।”

মা একটু খুঁতখুঁত করলেও শেষে রাজি হয়েছিলেন। তারপরেই ওর এখানে আসা। বিলু  মাসিমণির ছেলে, ওর পাঁচ বছরের রুপু নামের একটা বোনও আছে। ও আবার সজলকে দাদা বলে ডাকে। ওরা দুজনেই খুব খুশি হল সজলকে পেয়ে।

মাসিমণির বাড়ি খুবই খোলামেলা। বাড়িতে গোরু আছে, টিয়াপাখি, এমনকি একটা পোষা বেড়ালও আছে। মাসিমণি খুব নিয়মে চলে। বাড়ির বেশিরভাগ কাজই নিজের হাতে করতে ভালোবাসে। তবে গরমের ছুটির সময় বিলুকে আর তাকে কিছু কাজ বুঝিয়ে দেয়। সেগুলো  নিয়মিতভাবে ওদেরই করতে হয়। এবার যেমন বিলু বেড়াল, পাখির দেখাশোনা করছে আর গোয়ালাদাদুর কাজে সাহায্য করছে। আর ওকে দু-বেলা সব গাছে জল দিতে হচ্ছে।

এ-বাড়ির বাগান দেখবার মত। কতরকমের যে গাছ আছে। প্রচুর ফুল-ফলও হয়। বেশিরভাগ গাছ মাটিতে পোঁতা। তাই মাসিমণি বলেছে দু-বেলাই জল দিতে। বাগানে একটা পাম্পের কল আছে। সেটাতে পাইপ লাগিয়ে খুব সহজেই সব গাছে জল দেওয়া যায়। কিন্তু খেলতে যাবার জন্য মনের মধ্যে এমন তাড়া থাকে ওর, যে তখন আর গাছে জল দিতে ভালো লাগে না। মনে হয় এত গাছের কী দরকার ছিল? জল দিতে দিতে তো বেশ খানিকটা খেলার সময় চলে যাচ্ছে। চন্দনতুলসী গাছটা ও তখনই খেয়াল করে। গাছটা তো তেমন কাজে আসে না। তবে শুধু শুধু ওই গাছটা লাগানো হয়েছে কেন ও বুঝতে পারে না।

মেসোকে ও কথাটা বলেছিল।—“তোমাদের বাগানে কিছু ফালতু গাছ আছে। ওগুলো রেখে কী লাভ?”

মেসো অবাক হয়ে বলেছিলেন, “মানে? গাছ কখনও ফালতু হয় নাকি? সব গাছেরই কিছু না কিছু উপকারিতা আছে তো।”

তখন ও জানতে চেয়েছিল—“ওই চন্দনতুলসী গাছের উপকারিতা কী? আমাকে একটু বলবে?”

মেসো বলেছিলেন, “তেমন বিশেষভাবে জানি না, তবে তুলসী গাছ তো সবসময়ই উপকারী।”

ও বলেছিল, “এই বাগানে অনেক ফালতু গাছ আছে যেগুলো কোনও কাজে লাগে না।  সেগুলো উপড়ে দেওয়াই ভালো।”

মেসো হেসেছিলেন ওর কথা শুনে।—“ঠিক আছে, তোমার মাসিমণির সঙ্গে কথা বলতে পারো। আমি গাছের ব্যাপারে থাকি না। ওটা ওর ডিপার্টমেন্ট।”

ঠিক তখন ও তাকিয়ে দেখেছিল, টবে পোঁতা গাছটা কেমন হেলে যাচ্ছে মাটির দিকে। ওর মনে হয়েছিল, গাছটার কী হল? ওরকম করে হেলে যাচ্ছে কেন?

তবে ওইটুকুই। খেলতে যাওয়ার তাড়া ছিল। সামান্য একটা গাছকে নিয়ে অত ভাবার সময় ছিল না।

পরদিন সকালে জল দিতে গিয়ে ও খুব আশ্চর্য হল। গাছটাকে প্রথমে চোখেই পড়ছিল না। টবের মাটিতে শুয়ে পড়েছে। সেই টাটকা সবুজ ভাবটা নেই। মাথার দিকে চুড়ো হওয়া পাতাগুলোর সজীবতা উধাও। কেমন একটা ফ্যাকাসে হলুদের মতো দেখাচ্ছে রঙটা। পাশের লংকা গাছ তার সবুজ পাতা নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। জবা গাছে কুঁড়ি ধরায় হাবেভাবে তার অহংকারও চাপা থাকছে না। কিন্তু চন্দনতুলসী গাছটা অমন হয়ে গেল কেন? বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু বলেছিলেন, গাছেদের প্রাণ আছে। তিনি তো বলেননি, গাছেদের তীক্ষ্ণ এক জোড়া কান আছে।

ঠিক তখনই টুলি নামের বাড়ির বেড়ালটা গাছটার পাশে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে মিউ মিউ করতে লাগল। তাহলে কি টুলি বলতে চাইছে ওর কথা শুনেই গাছটা মরে যাচ্ছে? ওর সঙ্গে কি গাছেদের কথা হয়? কে জানে?

অপরাধবোধে মন ভারী হয়ে গেল সজলের। ছিঃ ছিঃ! এ কী করল ও! নিজের হাতে একটি নিরাপরাধের মৃত্যু ঘটাল? তবু নিজেকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে খেলতে চলে গেল ও। আসলে খেলার তাড়ার জন্যই তো অত বেশি গাছে জল দিতে চায়নি সজল।

মাঠের কাবাডি খেলায় সারাক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে রইল ও। তাহলে কি ওর কথাতেই অভিমান করে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিল গাছটা? ওকে কি আর বাঁচানো যাবে না?

খেলার মাঠ থেকে ফিরে সোজা বাগানে গেল। ওই গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলল, ‘প্লিজ তুলসী, সরি বলছি। আমার কথায় অভিমান করে মরে গেলে আমি খুব কষ্ট পাব। তুমি বেঁচে ওঠো। আর কখনও আমি এমন ভুলভাল কথা বলব না।’

***

মাসিমণির এখানে নিয়ম বড়ো কড়া। বাড়িতে ছুটির দিনে বেলা আটটা অবধি অনায়াসেই ঘুমোনো যায়। কেউ কিছু বলে না। রঘুনাথপুরে প্রতিদিন দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে বিছানায় শুতে, আর সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠতেই হয়। উঠে দাঁত মেজে আদা আর ছোলা খেয়ে এক-দু’পাক দৌড়ে এসে বিস্কুট আর গরম এক গ্লাস দুধ খেয়ে কাজকর্মের শুরু। বড়োদের জন্যই শুধু চায়ের ব্যবস্থা।

ওর প্রথম কাজ গাছে জল দেওয়া। জল দিতে গিয়ে চন্দনতুলসীর কাছে আগে গেল ও। গাছটা মাটিতেই শুয়ে আছে। সজল একটা কাঠি পুঁতে দিয়ে তার সঙ্গে নরমভাবে গাছটাকে বাঁধল। তারপর বলল, “আমি সত্যি খুব ভুলভাল বকেছি। এবারটার মতো আমায় ক্ষমা করা যায় না?”

দুটোদিন ওভাবেই ঝিমিয়ে রইল গাছটা। তিনদিনের দিন সজল গাছটার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করল। গাছটা যেন কাঠিটার ওপর নেতিয়ে দাঁড়িয়ে নেই। নিজের জোরেই একটু মাথা নাড়ছে। সেইদিন থেকেই একনাগাড়ে ক্ষমা চেয়ে যাচ্ছিল সজল। সাতদিনের দিন গাছটা আবার আগের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়াল। আর নিশ্চিন্ত হল ও।

ছুটি শেষ হতে বাড়ি ফিরে যাবার ডাক এল। ততদিনে চন্দনতুলসী গাছের বাড়বাড়ন্ত দেখে ও যথেষ্ট সন্তুষ্ট হয়েছে। তবু বাড়ি ফিরে যাবার আগে ও ওই চন্দনতুলসী গাছের কাছে গেল। কিছু বলার আগে গাছটার গায়ে আদরের হাত বোলাল একবার। তারপর বলল, “ভালো থেকো। আর কেউ আমার মতো তোমায় বিরক্ত করলে তাকে ক্ষমা করে দিও।”

অবাক হয়ে ও দেখল গাছটা তার ঝাঁকড়া চুলে ভরা মাথা ঝাঁকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।

অলঙ্করণ- সায়ন মজুমদার

জয়ঢাকের গল্পঘর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s