উপন্যাস-বুধাই নদীর আতঙ্ক-অলোক স্যান্যাল-বসন্ত ২০২২

আগের সংখ্যার সম্পূর্ণ উপন্যাস- তৃণার স্বপ্নপৃথিবী-মল্লিকা ধর

(এক)

uponyasbudhai (1)

কাঁকড়াপোলি জায়গাটা মন্দ নয়। গ্রামের পাশ দিয়ে বুধাই নদী ধীরেসুস্থে দু-কদম এগিয়ে মোহনায় মিশেছে। অনেকটা জায়গা নিয়ে মোহনার ভেজা মাটি। দিনে দু-বার জোয়ারের সময় সাগরের জল বেলাভূমিকে ভিজিয়ে দিতে আসে। একমাত্র তখন মোহনা জল থইথই করে, তবে তার পরিমাণও খুব বেশি নয়। বড়োজোর কোমর ছাড়িয়ে গলা জল থাকে তখন। সাগর যেন নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও মোহনার মাটি ছুঁয়ে যেতে আসে। এখান থেকে মাইল খানেক গেলে বসতি। ছাড়া-ছাড়াভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাউ গাছগুলো বুঝি গ্রামের পাহারাদার। তাদের ফাঁক গলে মোহনার দিক থেকে আসা এলোমেলো বাতাসের সঙ্গে কাচের গুঁড়োর মতো নোনা জল ভেসে আসে। গ্রামের অন্য পাশে বুধাই নদীর পার ঘেঁষে নানা ক্ষুপ গুল্ম। কাঁকড়াপোলি রাজ্য হিসেবে উড়িষ্যায় পড়ে বটে, কিন্তু বঙ্গদেশ ঘেঁষা হওয়ায় গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই বাঙালি। যে কয় ঘর উড়ে রয়েছে, তারাও নিজেদের বাঙালি ভাবে। উড়ে হোক বা বাঙালি, মানুষগুলো বড়োই সরল-সিধে। নিজেদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয় না এমন নয়, তবে তা ক্ষণস্থায়ী।

কাঁকড়াপোলির ঠিক উলটোদিকে পায়ে পায়ে মোহনা পার হলে ছোটোখাটো একটা জঙ্গল। ভাঙা গড়ও আছে সেখানে একটা। ওদিকটায় অবশ্য বসতি নেই কোনও। তবে যারা হজরত মুন্সির দরগা কিংবা কিসমতগঞ্জের দিকে যাওয়া-আসা করে, তারা মাঝেমধ্যে ঘুরপথ এড়াতে ভাঙা গড়ের রাস্তা নেয়। অবশ্য সেই সময় যদি জোয়ার না থাকে তবেই।

দরগা ফেরত সেই রাস্তা নিয়েছিল মকবুল। প্রতি শুক্রবার মাগরিবের নামাজটা সে হজরত মুন্সির দরগাতেই পড়ে। শীতের বেলা শেষ হতে সময় নেয় না। লণ্ঠনটা তাই সঙ্গে করে নিয়ে বেরিয়েছিল মকবুল। জঙ্গলের মাঝামাঝি এসে ভাঙা গড়ের দিকে নজর পড়তে সে থমকে দাঁড়াল। অন্ধকারে ভাঙা ইটের হাড়-পাঁজর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাজবাড়িকে কালো পাহাড়ের মতো লাগছে। সেই জমাট অন্ধকারের মাঝে একটা আলোর রেখা! দিন-মানেও ওদিকটায় কেউ যায় না। সাপখোপের আড্ডাখানা। অবশ্য এই সময় তেনারা শীতঘুমে থাকেন বলে ভয় খানিক কম। তবুও ভাঙা গড়ে কার কী দরকার থাকতে পারে? মকবুল আলো লক্ষ্য করে কয়েক পা এগোতেই অন্ধকার ফুঁড়ে একটা দীর্ঘকায় ছায়া বেরিয়ে এসে তার পথ আটকাল। ভাঙা গড়ের আলোর রেখাটা ততক্ষণে মুছে গিয়েছে।

“কে রে বাপ? এই অবেলায় গড়ের মধ্যে ঘুরঘুর করছিস কেন?”

ছায়াটাকে লক্ষ্য করে প্রশ্নগুলো ছুড়ে দিয়ে হাতের লণ্ঠনটা ওপরে তুলে ধরতে যাচ্ছিল মকবুল, হঠাৎ ভারী কিছু এসে আঘাত করল হাতে। লণ্ঠনটা ভেঙে মাটিতে পড়তেই চারপাশের অন্ধকার যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল তার গায়ে। এমন অবস্থায় অন্য কেউ হলে কী করত বলা মুশকিল, মকবুলের শক্ত জান, ওস্তাদ লাঠিয়েল সে। মহরমের সময় কেবল তার লাঠি খেলা দেখতে আসে অনেকে। এখন সঙ্গে লাঠি নেই বটে, কিন্তু সাহসটা তো আর বাড়িতে ফেলে আসেনি! গলার পর্দা চড়িয়ে এবার সে বলল, “মশকরা হচ্ছে! জানিস আমি কে? মোরা নামা মকবুল অছি। এত সাহস…”

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল মকবুল, গলার কাছে একটা ঠান্ডা ধাতব স্পর্শ তার মুখের বাকি কথা কেড়ে নিল। তখনই একটু দূর থেকে কেউ একজন খনখনে গলা আর দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলল। প্রতিপক্ষ একা নয় এবং খালি হাতেও নেই বুঝতে পেরে পিছু হটল মকবুল মিঞা। সাহস তার কম নেই, তা বলে দুঃসাহস দেখানোর মতো নির্বোধও সে নয়। অজানা ভাষায় বলা কথাগুলো বুঝতে না পারলেও অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো যে তার উপস্থিতি পছন্দ করছে না, এটুকু না বোঝার কথা নয়। তাছাড়া এমন দশাসই চেহারা আদৌ কোনও মানুষের কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কথা বাড়ায় না সে। পেছন ঘুরে জোরে পা চালাতে শুরু করে।

জঙ্গল পার হয়ে লন্ঠন না থাকায় আর অসুবিধা হয়নি তেমন। দিন তিনেক পরেই পূর্ণিমা। খাবলানো চাঁদের আলো পড়ে মোহনায় ছোটো ছোটো পলির ঢেউয়ের আড়ালে থাকা জলকণাগুলো চিকচিক করছে। মোহনা পেরিয়ে আর বাড়ির রাস্তা ধরে না মকবুল। ভর সন্ধেবেলায় গড়-জঙ্গলে যা ঘটল, কোনও সদুত্তর নেই তার কাছে। বিষয়টা হর-মাস্টারকে জানানো আশু প্রয়োজন।

হরনাথ সমাদ্দার কাঁকড়াপোলি নিম্ন বুনিয়াদি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। কাজ থেকে পাকাপাকিভাবে ছুটি নেওয়ার কথা বললে অবশ্য মকবুল মিঞাও রিটায়ার্ড হয়েছে বছর দুয়েক হল। ভাগের জমি-জিরেত দেখাশোনার ভার এখন তার দুই ছেলের ওপর। হর-মাস্টারের মতো তারও সারাদিনে কাজ বলতে একটাই—গ্রামের প্রায় শেষ মাথায় বুড়ো বটগাছের বাঁধানো চাতালে বসে দাবা খেলা, গল্প করা। গল্প বলার দায়টা বেশিরভাগ সময় অবশ্য রাধাকান্ত দলুই নিজের ঘাড়ে নিয়ে থাকেন। তিনিও কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন বেশ কয়েক বছর হল। শহরের ব্যাঙ্কে কাজ করার সুবাদে তাঁর ঝুলিতে সরস গল্পের মজুত কম নেই। তাছাড়া বলার ভঙ্গিটিও এমন সরেস যে পথচলতি অনেকে কাজ ভুলে দাঁড়িয়ে পড়ে। বটতলার এই আসরে আরও কয়েকজন সভ্য আছে এবং তারাও যথারীতি বাকিদের মতো রিটায়ার্ড। যেমন, জেলে পাড়ার জীবন বিশ্বাস। নৌকার হাল ছেলের হাতে ধরিয়ে সে এখন সকাল-সন্ধে বটতলার বাসিন্দা। সব আসরেই যেমন সভাপতি থাকে, তেমনই এখানকার অলিখিত নেতা হলেন হরনাথ সমাদ্দার ওরফে হর-মাস্টার।

হরনাথের বড়ো হয়ে ওঠা এই গ্রামেই। বিচক্ষণ, স্থিতধী মানুষ হওয়ায় অনেকেই বিপদে-আপদে তাঁর কাছে পরামর্শ চাইতে আসে। সন্ধের ঘটনার পর তাই খবরটা প্রথমে হর-মাস্টারকে দেওয়ার কথাই মাথায় এসেছিল মকবুল মিঞার। নদীর রাস্তা ধরে কিছুটা এগোতেই একটা জোরালো আঁশটে গন্ধ এসে তার নাকে ধাক্কা মারল।

“ডাকাত বা উগ্রপন্থী নাকি?”

মকবুলের কাছ থেকে পুরোটা শোনার পর প্রথমে এই প্রশ্নটাই মাথায় এসেছিল হরনাথ সমাদ্দারের। সীমান্তবর্তী এলাকা হলেও কাঁকড়াপোলিতে ডাকাতি-রাহাজানি খবর নেই বহুবছর। দু-একটা ছোটোখাটো চুরি-চামারি হয় বটে, তবে সে-সব নিতান্তই পেটি কেস। সংখ্যাতেও হাতে গোনা। বাইরের ছিঁচকে চোরের দল যাওয়া-আসার পথে হয়তো কখনো-সখনো দুষ্কর্ম ঘটায়, কিন্তু আজ মকবুলের সঙ্গে যা হয়েছে তা কোনও ছিঁচকে চোরের কাজ নয়। শুধু হুমকি নয়, রীতিমতো বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে শাসিয়েছে!

“তুই কি নিশ্চিত মকবুল, লোকগুলো ভিনদেশি ছিল?”

“তেমনটাই তো মনে হল। দু-একটা ইংরেজি কথা তো তোমার কিংবা রাধাদার মুখে শুনেছি, কিন্তু এমন হাউ-মাউ-খাউ কথা আমি জন্মে শুনিনি। ভিনদেশি নয় হরদা, আমার মনে হচ্ছে ওরা নির্ঘাত অন্য জগতের কেউ। কী বিরাটা চেহারা গো! তার ওপর মোহনার কাছে অমন আঁশটে গন্ধ! আমার দাদিও বলত, জ্বিন-পরিদের গায়ে নাকি আঁশটে গন্ধ থাকে।”

“তোর দাদির জ্বিন-পরিরা সব কাজ শিকেয় তুলে মানুষকে অস্ত্র নিয়ে ভয় দেখাচ্ছে! উঁহু, ব্যাপারটা অতটা সরল নয় মনে হচ্ছে রে।”

“কী যে বলো না হরদা! জ্বিন-পরি, ভূত-প্রেতদের তো ওটাই কাজ। মানুষদের ভয় দেখানো।”

“তা বলে বন্দুক নিয়ে! তুই একটু চুপ করে বস তো, আমায় ভাবতে দে।”

হরনাথ মাস্টার যখন ভাবনায় মজে ঠিক তখনই দুটো অস্পষ্ট ছায়াকে হাজির হতে দেখা যায় ঝাউ গাছ পেরিয়ে গ্রামের সীমানায়। একজনের চেহারা প্রায় দৈত্যের মতন। পাশের জনকে সেই অতিকায় চেহারার পাশে আরও বেশি খাটো মনে হচ্ছে। শীতের সময়। ঘড়িতে ঘণ্টার কাঁটা আটটার ঘর পার করতে না করতে পাড়া ঘর ঝিমোতে শুরু করে দেয়। এদিকটায় ইলেকট্রিক লাইন আসব-আসছি করছে। তবে তার জন্য বিশেষ অসুবিধা নেই এখন। রাস্তাঘাট চাঁদের হালকা নীল আলো মেখে থাকায় আবছা হলেও দেখা যাচ্ছে। মকবুলকে ভড়কে দেওয়া মানুষ দুটো কাঁচা রাস্তা ধরে গ্রামের পশ্চিমদিকে শেষ মাথার বাড়িটা লক্ষ্য করে এগোতে থাকে। অচেনা মানুষের পায়ের শব্দে রাস্তার নেড়িগুলো হাঁকডাক শুরু করতে বেঁটে লোকটা তার ঝোলা থেকে গোলমতো কিছু বের করে বিক্ষোভের দিকে তাক করে ছুড়ে মারে। বলটা মাটিতে পড়তেই ‘ভুউস’ আওয়াজে তা থেকে গব গব করে বেরিয়ে আসতে থাকে ধোঁয়া। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তে ধাক্কায় উলটে যাওয়া কাঠের পুতুলের মতো ধুপধাপ লুটিয়ে পড়ে সারমেয়দের দল। এবার নিশ্চিন্ত পায়ে এগিয়ে চলে দুজন। তাদের লক্ষ্য উঁচু পাঁচিলঘেরা বাড়িটা।

গবেষকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা নীল আলোর স্তম্ভটার দিকে একভাবে তাকিয়ে ছিলেন হরনাথ মাস্টার। কিছুদিন হল এই এক নতুন খেলা শুরু করেছেন অমলেন্দু বটব্যাল। রাত্তিরে মাঝে মাঝে জোরালো নীল আলো সার্চ লাইটের মতো উঠে যাচ্ছে আকাশ ফুঁড়ে। তারপর আকাশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা ঘোরাঘুরি করে আবার নিভে যাচ্ছে। গতকাল মাঝরাতেও আলোটা জ্বলতে দেখেছিলেন হরনাথ।

“ব্যাটা পশুপাখিদের ছেড়ে এবার গ্রহ-নক্ষত্রের পেছনে পড়ল নাকি!”

বাপ-দাদার অগাধ টাকাপয়সা থাকলে যে গবেষণাও কারও শখ হতে পারে তা অমলেন্দু বটব্যালকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। এমনটাই মনে করেন হরনাথ। অবশ্য এমন ধারণার পেছনে যতটা না সঙ্গত কারণ রয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি আছে কিশোর বয়স থেকে জমতে থাকে অভিমান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ক্রমে পুঞ্জীভূত হয়ে এই অবসরকালীন বয়সে ক্ষোভের আকার নিয়েছে। তবে এখন গবেষককে নিয়ে ভাবার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল গড়-জঙ্গলে অজানা আগন্তুকদের আগমনের হেতু অনুসন্ধান। জানালার পাল্লা দুটো বন্ধ করতে ঠান্ডা বাতাসের দাপট কমে আসে। হরনাথ মাস্টার আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই দেখতে পেতেন তাঁর বাড়ির পেছনের রাস্তা ধরে একটি অতিকায় এবং একটি খর্বকায় চেহারা হেঁটে চলেছে কিশোরবেলার একসময়ের বন্ধুর বাড়ির দিকে।

(দুই)

uponyasbudhai (2)

লোকে বলে কাঁকড়াপোলির তালুকদার বাড়ির চৌহদ্দির ধারেকাছে মানুষ তো ছাড়, চিল-শকুনেরও দেখা পাওয়া যায় না। কথাটা যে একেবারে মিথ্যে তা বলা যাবে না। আশেপাশের মানুষজন তালুকদার বাড়িকে, বলা ভালো তালুকদার বাড়ির মালিকটিকে এড়িয়েই চলেন। তার কারণও আছে। আসলে বাড়ির মালিক বিশ্বম্ভর তালুকদারকে সবাই হাড়ে-মজ্জায় চেনে। না, মানুষটি যে মন্দ তা নয়, বরং পাড়াপড়শির বিপদে-আপদে নির্দ্বিধায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। উপযাচক হয়ে সাহায্যও করতে চান সবার। মিতব্যয়ী হলেও তাঁকে কঞ্জুস বলা চলে না মোটেও। বাড়িতে দ্বিতীয় কোনও মানুষ না থাকায় রান্না করা, কাপড় কাচা, ঘরদোর পরিষ্কার সব একা হাতেই করতে হয়। সুতরাং তিনি কুঁড়ে, এমন বদনামও দেওয়া যায় না। বিশ্বম্ভরবাবুর দোষ বলতে কেবল একটি। আর সেই একমাত্র দোষের কারণে পাড়াপড়শি থেকে শুরু করে যাঁরা তাঁকে চেনেন, সভয়ে এড়িয়ে চলেন।

পৌষের সকাল। মেঘলা থাকায় ঠান্ডাটা একটু কম বোধ হচ্ছে। কুয়াশার চাদর মুড়ে রয়েছে পুকুর, মেঠো রাস্তা, চাষের জমি। বাড়ির রোয়াকে বসে নিমের দাঁতন দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করছিলেন বিশ্বম্ভরবাবু। এমন সময় দেখতে পেলেন কায়েত পাড়ার নিমাই পণ্ডিত তাঁর ভাঙাচোরা সাইকেলখানি নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে চলেছেন। তালুকদারকে বাড়ির রোয়াকে বসে থাকতে দেখে তড়িঘড়ি প্যাডেলে চাপ বাড়িয়ে ছিলেন নিমাই পণ্ডিত। গত মাসে বিশ্বম্ভরবাবুর ডাকে সাড়া দেওয়ায় জন্য বড়োরকম মাশুল গুনতে হয়েছে তাঁকে। ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম, ‘আপন পাঁজি পরকে দিয়ে, দৈবজ্ঞ বেড়ায় পথে পথে’।

ঘটনাটা বরং খুলেই বলা যাক। গত মাসে সন্ধের আগে আগে যজমানি করে বাড়ি ফিরছিলেন নিমাই পণ্ডিত। দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে দ্বিধা কাটিয়ে শেষমেশ তালুকদার বাড়ির সামনের রাস্তা নিয়েছিলেন তিনি। হিসেবে ভুল থাকার কথা ছিল না। পণ্ডিতমশাই ঠিকই জানতেন যে বিশ্বম্ভর তালুকদার প্রত্যেকদিন বিকেলে নদী-পাড়ে হাওয়া খেতে যান। তবে যা তাঁর জানা ছিল না, পৈটিক গোলযোগের কারণে তালুকদারকে অসময়ে বৈকালিক ভ্রমণে ছেদ টানতে হয়েছিল। ফলত, পুকুরের কাছাকাছি এসে মূর্তিমান বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁকে। বাকিদের মতো বিশ্বম্ভরবাবুর একমাত্র বদগুণটি সম্পর্কে পণ্ডিতমশাইও যথেষ্ট সচেতন ছিলেন, তবুও রক্ষা পাওয়া যায়নি। আসলে মানুষটার সামনে একবার দাঁড়িয়ে পড়লে আর রেহাই মেলে না সহজে। কথার পর আরও কথার জালে জড়িয়ে বিশ্বম্ভরবাবু কীভাবে যে তাঁর উদ্দেশ্য পূরণ করে ফেলেন, বোঝা যায় না। যখন মালুম হয়, ততক্ষণে যা হারানোর, গিয়েছে। গত মাসে যেমন গিয়েছিল নিমাই পণ্ডিতের হাত দেখার যন্ত্র ম্যাগনিফাইং গ্লাসটি। পণ্ডিতমশাই মহাভারতের কৃষ্ণ চরিত্রটিকে নিয়ে চর্চায় এমন বুঁদ হয়ে গিয়েছিলেন যে নিজের অজান্তেই কখন সাধের আতশ কাচটিকে তালুকদারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন টের পাননি। যজমানি ছাড়াও নিমাই পণ্ডিতকে নিয়ম করে হপ্তায় তিনদিন ‘লক্ষ্মী জুয়েলার্স’-এ বসতে হয় হস্তরেখা বিচার করতে। চোখের কারণে যন্ত্রটি ছাড়া সে-কাজ করা বড়োই দুরূহ। পরের দিন তাই নিজের চেম্বারে বসতেই মনে পড়েছিল গতকাল সন্ধেবেলা বিশ্বম্ভরবাবু তাঁর কাছ থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটি ধার নিয়েছেন।

ধার নেওয়া। এটাই বিশ্বম্ভরবাবুর একমাত্র বদগুণ। চেনা হোক বা অচেনা, মুখ দেখলেই তার কাছ থেকে কিছু না কিছু ধার করা তালুকদারের অভ্যাস। ‘অর্থই অনর্থের মূল’ এই স্তোকবাক্যটি মেনে টাকা ছাড়া আর যা কিছু ধারে নেওয়া সম্ভব সবেতেই তিনি দারুণ পেশাদারিত্বের ছাপ রাখেন। আর একবার যা ধার হিসেবে তাঁর বাড়িতে ঢোকে, তা বের করা শিবেরও অসাধ্য। এমন নয় যে ধার চাওয়া জিনিসটি বড়ো কাজের বা তাঁর কোনও উপকারে আসবে। কিন্তু ওই, স্বভাবদোষ। দোষ-গুণ যাই হোক না কেন বাড়িতে বাথরুম, রান্নাঘর, শোওয়ার ঘর মিলিয়ে মগ আর বালতি রয়েছে গোটা পঞ্চাশ। জীবনে কোনোদিন মাছ না ধরলেও হাত জাল রয়েছে তিনটি। বাড়িতে একজন মাত্র লোকের জন্য এক ডজন বেতের মোড়া, চেয়ার। খাটের তলায় লণ্ঠনের স্তূপ, আলমারির মাথায় মশারি-গামছা-চাদরের পুঁটুলি। এমন হাজারো জিনিসে ঘর উপচে বারান্দা হওয়ার জোগাড়। গত মাসে নিমাই পণ্ডিতের কাছ থেকে পাকাপাকিভাবে ধার নেওয়া আতশ কাচটিও এই তালিকায় রয়েছে। দূর থেকে বিশ্বম্ভরবাবুকে রোয়াকে বসে থাকতে দেখে তাই সাইকেলের স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছিলেন পণ্ডিত মশাই, কিন্তু লাভ হল না কিছু। রোগজর্জর সাইকেলটি ঠিক তালুকদার বাড়ির সামনে এসেই বিগড়াল। পড়ে যাওয়া চেনটা তাড়াহুড়োয়  তুলতে গিয়ে গেল জট পাকিয়ে। তারই মাঝে নিমাই পণ্ডিত আড়চোখে দেখতে পেলেন তালুকদার রোয়াক ছেড়ে তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছেন। বিষয়টা বোঝা মাত্র পণ্ডিতের মনে সাইকেলটিকে বগলদাবা পত্রপাঠ স্থান ত্যাগের ভাবনা মাথায় এসেছিল বটে, তবে তা বাস্তবায়নের আগেই বিশ্বম্ভরবাবুর মোলায়েম গলা শুনতে পাওয়া গেল, “বলি ও পণ্ডিত, এত তাড়া কীসের? দু-দিন আগেই তোমার কথা ভাবছিলাম। তিনকাল গিয়ে তো এককালে এসে ঠেকেছে। ভাবছি বাড়ির নটরাজ পুজোটা আবার চালু করলে মন্দ হয় না। কী বলো?”

“তা করলেই হয়। পুজো-আচ্চা করলে পুণ্যি বাড়ে বৈ তো কমে না। সমস্যা হল আমার কাছের নজর ঝাপসা। এদিকে আবার আতশ কাচটা তোমার কাছে রয়ে গিয়েছে। ওই যন্তরটি ছাড়া যে আমি পাঁজি দেখতে পারি না তালুকদার। পুজো করতে গেলে যে শুভ দিনক্ষণ যাচাই করাটাও জরুরি।”

“সেই জন্যই তো তোমাকে ডাকা হে। কই, তোমার পাঁজিখানা দেখি। এককালে পাঁজি দেখাটা নেশার মতো ছিল বুঝলে। দাও, আরও একবার ঝালিয়ে নিই। সঙ্গে সঙ্গে পুজোর দিনটাও ফাইনাল করে নেওয়া যাবে।”

বিশ্বম্ভর তালুকদারের কথা শুনে নিমাই পণ্ডিতের ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থা। তাঁর কাঁধের ঝোলায় নতুন কেনা পাঁজি রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা ঝোলা থেকে বেরিয়ে এলে ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বরাবর। আবার না করলেও পুজোর বরাতটা ফস্কে যেতে পারে।

গ্রামের সবাই এড়িয়ে চলে বলে তালুকদার বাড়িকে খাটো করে দেখলে ভুল হবে। উড়িষ্যার শেষ হিন্দু রাজা মুকুন্দদেবের ঘনিষ্ঠ ছিলেন দিগম্বর তালুকদার। মোহনার কাছে ভাঙা গড়ের অধিপতি ছিল তালুকদারেরা। সঙ্গে আরও কতগুলো তালুকের মালিকানা ছিল তাঁদেরই হাতে। সে-সময় মহা ধুমধামে নটরাজ পুজো হত তালুকদারদের গড়ে। তারপর আফগানরা এল। সুলতান সুলায়মানের হাতে রাজা মুকুন্দদেবের মৃত্যু হওয়ার পর তালুকদার বংশেও দুর্যোগ নেমে আসে। সে-সব অবশ্য কয়েকশো বছর আগের কথা। তারপরেও দিগম্বর তালুকদারের বংশধররা টিকেছিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। এখন সেই গাছের ডালপালা ছাঁটতে ছাঁটতে একটিতে এসে ঠেকেছে। জমি-জিরেত যা অল্প কিছু আছে, ভাগে চাষ করতে দেওয়া। সেখান থেকে একজন মানুষের পেটের জোগাড় হয়ে যায়। পূর্বপুরুষদের রীতি মোতাবেক বিশ্বম্ভর তালুকদারও বেশ কয়েকবার নটরাজ পুজো করেছিলেন। তেমন জাঁকজমক না হলেও গ্রামের সকলে দু-বেলা পেট ভরে খিচুড়ি, সঙ্গে আলুর দম খেয়েছিল। শেষ পাতে বোঁদেও জুটেছিল এক হাতা করে। তাতেও খরচপাতি নেহাত কম হয়নি। নিমাই পণ্ডিতের কপালেও দক্ষিণা নেহাত মন্দ জোটেনি। পূর্ব অভিজ্ঞতা স্মরণ করে শেষ পর্যন্ত ঝোলা থেকে পাঁজিখানা বেরই করে ফেললেন নিমাই পণ্ডিত।

বিশ্বম্ভর তালুকদারকে নিজের নতুন কেনা পাঁজিখানা ধার দিয়ে বটতলায় এসে সাইকেল থেকে নামলেন পণ্ডিত মশাই। সেখানে শীতের সকালে রোদ পোহাতে ততক্ষণে অনেকেই হাজির। হর মাস্টার, ব্যাঙ্কের কেরানি রাধাকান্ত দলুই, জেলে পাড়ার মকবুল দফাদার আর জীবন বিশ্বাস সকলেই উপস্থিত। অবসরকালীন জীবনে তাদের কাজ বলতে নাওয়া-খাওয়ার সময় ছেড়ে বাকিটা এই বটতলায় বসে খোশগল্প কিংবা দাবা খেলায় মশগুল থাকা। আসরের একমাত্র সভ্য নিমাই পণ্ডিত পুজো কিংবা যজমানির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন পুরোদমে। আসলে এ-তল্লাটে তাঁর পেশায় অন্য কেউ আর নেই। এমনকি নিজের ছেলেটাও কলেজ পাশ দিয়ে শহরে চাকরি নিয়ে চলে গেছে। এদিকে গ্রামে বারো মাসে তেরো গুণে দুই ছাব্বিশখানা পার্বণ। আচার-বিচার মেনে চলা সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ ছাড়া সে-সব পালন করা দায়। তাছাড়া এইসব পুজো-পার্বণ থেকে আমদানিও হয় কিছুটা। মোদ্দা কথা কারণ যাই হোক, হর মাস্টার কিংবা মকবুল মিঞার মতো সুখী অবসর জীবন যাপন করা নিমাই পণ্ডিতের আর হয়ে ওঠেনি। তাঁকে আজও প্রতিদিন ভোর ভোর নদীতে স্নান-সূর্যপ্রণাম সেরে, গৃহদেবতার পুজো করে সাইকেল নিয়ে ছুটতে হয় গ্রামের কালী মন্দিরে। মায়ের পায়ে ফুল-বেলপাতা ঠেকিয়ে যেতে হয় গ্রামের শেষ মাথায়। সেখানে শনিদেবকে তুষ্ট করে তবে পেটে দানাপানি কিছু দিতে পারেন। আজও পুজো সেরে জলখাবার খেতে বাড়ি ফিরছিলেন। রাস্তায় বিশ্বম্ভর তালুকদারের হাতে ধরা পড়ে পাঁজিখানা হাতছাড়া হয়েছে। সেই শোকে জলখাবারের কথা ভুলে সোজা হাজির হয়েছেন বটতলায়। উদ্দেশ্য, এর একটা বিহিত করা। গ্রামে এমন কেউ নেই যার কাছ থেকে ধার নেননি তালুকদার। সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে কীভাবে কথাটা সবার সামনে পাড়া যায় ভাবছিলেন নিমাই পণ্ডিত। কিন্তু আজ আসরের গুরুগম্ভীর ভাব দেখে কোনও থই খুঁজে পেলেন না। কী করা যায় সে-সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগেই হর মাস্টারের কথা শুনে কপালের ভাঁজ চওড়া হয় পণ্ডিতমশাইয়ের।

“ব্যাপারটা বড়োই গোলমালে ঠেকছে হে। কাঁকড়াপোলিতে আগে কোনোদিন গুন্ডা-বদমায়েশদের আনাগোনা তো ছিল না! তার ওপর নতুন করে জন্তুজানোয়ারের উপদ্রব।”

“কেন হরদা, গুরুতর কিছু হয়েছে নাকি?”

“তুমি আর টের পাবে কী করে! সকাল থেকে তো ঝোলায় পাঁজি আর নারায়ণ শিলা নিয়ে এ-মন্দির থেকে ও-বাড়ি ওম নমঃ করে ছুটেই চলেছে। চোখ-কান খোলা রেখে দেখার সময় আছে তোমার?”

মকবুলের কথা শুনে কিছুক্ষণ আগে নতুন পঞ্জিকাখানা খোয়ানোর দৃশ্য নিমাই পণ্ডিতের চোখের সামনে আবার ভেসে ওঠে। চেপে রাখা রাগ এবার ঠেলা মেরে বেরিয়ে আসতে চায়—“কী হয়েছে বলে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। তা না করে খোঁচা মেরে লাভ আছে? তাছাড়া গ্রামে দায়িত্ব সামলানোর মতো তেমন কেউ থাকলে আমিও তো সব ছেড়েছুড়ে ঝাড়া হাত-পা হয়ে বটতলায় দাবা খেলে কাটিয়ে দিতে পারতাম। সবার কি আর তোমার মতো সোনা বাঁধানো কপাল মকবুল?”

পালটা কিছু বলতে যাচ্ছিল মকবুল, বেগতিক দেখে হাল ধরলেন রাধাকান্ত দলুই। ব্যাঙ্কে চাকরি করার সুবাদে মাথা ঠান্ডা রাখার কৌশল তাঁর ভালো জানা আছে। চাকরি-জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কাস্টমারদের হাজারো প্রশ্ন, ঝাঁঝালো উত্তর সব সামলে নিজের কাজ করে যেতে হয়েছে তাঁকে। মাথা ঠান্ডা না রাখতে পারলেই হিসেবের গোলমাল। আর তা হলে নিজের গাঁটের কড়ি দিয়ে ভরপাই করতে হয়। অবসর নিলেও সেই অভ্যাসটা এখনও রয়ে গিয়েছে। দু-পক্ষকে শান্ত করতে তাঁকেই মাঠে নামতে হয়।

“মকবুল ভাইয়ের কথায় রাগ করো না পণ্ডিত। জানি তোমারও এই এক কাজ করতে ইচ্ছে করে না। উপায় যে নেই এ তো সত্যি। তবে আশেপাশে যা হচ্ছে তাতে আমাদেরও দুশ্চিন্তা বড়ো কম নয়।”

“এ তো আচ্ছা মুশকিল হল দেখছি! সবাই আসল কথাটা বাদ রেখে কেবল হিজিবিজি বকে চলেছে। বলি সমস্যাটা ঠিক কী তা কেউ খুলে বলবে? তোমরা না বললে আমিই বরং বলি। আমিও কম বিপদে পড়ে নেই।”

“তোমাকেও ধরেছিল নাকি পণ্ডিত! হাতে কী ছিল—কালাশনিকভ, নাকি ন্যাপলা?”

“মানে! কার ধরার কথা বলছ রাধাদা? আর ওই কালাকভ, ন্যাপলা, ওগুলো কী?”

“নাহ্‌, তুমি দেখছি মন্ত্র ছাড়া আর কিছুই ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারো না! কালাশনিকভ হল একধরনের বন্দুক। ন্যাপলা হল নেপালি দারোয়ানদের কোমরে গোঁজা বাঁকানো ছুরির মতো জিনিসটা। সে-সব এখন থাক। কিছু বুঝলে মাস্টার? প্রথমে মকবুল। এখন আবার নিমাই। না হে,  ব্যাপারখানা দেখছি ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠছে!”

হরনাথ মাস্টার এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন। পরশু সন্ধেতে মকবুলের অচেনা বিপদের মুখোমুখি হওয়ার বিষয়ে জট ছাড়াতে গিয়েছিলেন গড়-জঙ্গলে। দিনের আলোয় চারপাশ বরাবরের মতো শান্ত ছিল। ঘুঘু পাখির ডাক ছাড়া আর কিছু শুনতে পাননি। ভাঙা গড়ে দু-জোড়া পায়ের ছাপ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনি। তবে বাইরের লোক যে কাঁকড়াপোলিতে ঘাঁটি গেড়েছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তারা কারা, কী উদ্দেশ্যে এমন গণ্ডগ্রামে এসে হাজির হয়েছে, এসবের উত্তর মেলেনি। আর এসবের মাঝেই নতুন বিপদ এসে হাজির। মনে মনে নানা প্রশ্ন নিয়ে কাটাকুটি করছিলেন হরনাথ মাস্টার। রাধাকান্ত দলুইয়ের কথায় সে-সব ক্ষণিকের জন্য সরিয়ে রেখে বললেন, “অনেকগুলো খটকা রাধাকান্ত। ভাঙা গড়ে অজ্ঞাত দুষ্কৃতী, গ্রামে হিংস্র পশুর হামলা, গবেষকের বাড়ি থেকে বেরোনো নীল আলোর স্তম্ভ। সবগুলো মনে হচ্ছে এক সুতোয় বাঁধা, কিন্তু কীভাবে সেটাই বুঝতে পারছি না। আর হ্যাঁ, নেপালিদের ওই অস্ত্রটাকে কুকরি বলে।”

জীবন বিশ্বাস এত সাতে-পাঁচে থাকে না। মকবুলের মতো মাছ ধরা ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে তার কেবল একটাই নেশা। দাবা। ঘোড়ার আড়াই-চাল নিয়ে তার যত মাথাব্যথা। হরনাথ মাস্টারের ছাত্র হয়ে ইদানীং গুরুকেও মাঝেমধ্যে কিস্তি দিচ্ছে। আজ অবশ্য গুরু বা চ্যালা, কারোরই সাদা-কালো ঘরগুলোতে মন টিকছে না। বটতলার এককোণে চুপচাপ বসে ছিল জীবন। এবার মুখ খোলে সে, “মন্দ বলোনি হরদা। আমারও এখন তেমনটাই মনে হচ্ছে বটে। কথাটা আগে বলিনি, পাছে তোমরা মশকরা করো। মাছ ধরা ছেড়ে দিলেও অন্ধকার থাকতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার অভ্যাসটা তো আর মরে যায়নি। দিন তিনেক আগে ঘুম ভাঙতে হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে এসে বসেছিলুম। জলো হাওয়ায় ঘুমটা আবার বেশ পাকিয়ে উঠছিল। ভাবছিলুম গামছা পেতে আরও একপ্রস্থ জিরিয়ে নিই। এমন সময় আঁশটে গন্ধ নাকে এল! চটকা ভাঙতে দেখি সামনে দুজন দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে মুখ বুঝতে না পারলেও মনে হল একজন দস্তুরমতো লম্বাচওড়া। পাশের জন অনেকটাই বেঁটে। লম্বা লোকটার হাতে লাঠিমতো কিছু ধরা। আমাকে উঠে বসতে দেখে বেঁটে লোকটা হাত-পা ছুড়ে কীসব বলল। ভাব দেখে মনে হল, চলে যেতে বলছে। সারাজীবন তো কম মাছ নাড়াচাড়া করিনি হরদা, মানুষের গায়ে অমন উৎকট আঁশটে গন্ধ জন্মে দেখিনি! বিষয়টা ঠিকঠাক ঠাহর করে ওঠার আগেই কানের মধ্যে কতগুলো কনকনে অদ্ভুত শব্দ সেঁধিয়ে যেতে লাগল। লোক দুটো তা শুনে তিড়িংবিড়িং করে হাওয়া। আমিও আর দেরি করিনি। গামছাখানা ফেলেই টানা দৌড়ে বাড়ি ফিরে তবে হাঁপ ছাড়ি।”

জীবন বিশ্বাসের কথা শুনে কিছুই বোধগম্য হয় না নিমাই পণ্ডিতের। সারাদিন এ-পাড়া ও-পাড়া ভাঙা সাইকেল নিয়ে ঘুরে ঘুরে সন্ধের আগে বাড়ি ফেরা। একবারই অন্ন গ্রহণ করেন নিমাই পণ্ডিত। সূর্যাস্তের আগে। দুপুরটা যজমানদের বাড়িতে ফলমূল খেয়ে কাটিয়ে দেওয়ার পর সূর্যদেব পাটে বসার আগে গরম ভাত পেটে পড়তে যা দেরি। বিছানায় মশারি খাটানোই থাকে। শরীরটা কোনোমতে কম্বলের মধ্যে ভরে দিয়ে অন্য জগতে পাড়ি দেন। সুতরাং হপ্তা খানেকের মধ্যে গ্রামে এমন কী হল তা পণ্ডিতমশাইয়ের জানার কথা নয়। বিষয়টা তাই এবারে খুলে বললেন হর মাস্টার, “গত কয়েকদিন ধরে গ্রামের আশেপাশে অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। সন্ধের পর অচেনা লোকজন অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে। তার ওপর গতকাল নাকি শিব মুখুজ্জের বাড়িতেও বড়োসড়ো অঘটন ঘটেছে। রাত্তিরে শিবেনের বলদটাকে সাবাড় করে দিয়ে গিয়েছে কোন ভয়াল জন্তু! খাটালে শুধু হাড়গুলো পড়ে ছিল। রাতারাতি নিশ্চয়ই একপাল শেয়াল শিবেন মুখুজ্জের বাড়িতে হামলে পড়েনি। তার ওপর খাওয়ার ধরনও বেজায় অদ্ভুত। প্রতিটা হাড় থেকে মাংস যেন আইসক্রিম খাওয়ার মতো চুষে খেয়েছে। ছিটেফোঁটাও চর্বি বা মাংস লেগে নেই!”

“সে কি! অমন তাগড়াই বলদটাকে চুষি কাঠির মতো চুষে খেয়ে চলে গেল আর কেউ টের পর্যন্ত পেল না!”

“পেয়েছিল। শিবেনদার বৌ নাকি মাঝ রাত্তিরে একটা আঁশটে গন্ধ পেয়েছিল। সঙ্গে কনকনে শব্দ। গতকাল মাঝরাতে আমি গবেষকের বাড়ি থেকে আবার ওই আজব নীল আলোর স্তম্ভটা বের হতে দেখেছিলাম। হ্যাঁ গো রাধাকান্তদা, আলোর ব্যাপারখানা কিছু আন্দাজ করতে পারো?”

মকবুলের প্রশ্নে রাধাকান্ত দলুই গম্ভীর মেজাজে বলে,  “সার্কাস পার্টি এলে অনেক সময় আকাশে সার্চ লাইট মেরে নিজেদের বিজ্ঞাপন করে বটে। আর আমাদের গবেষকের বাড়ির সার্কাস এর চেয়ে কম কীসে? আমার তো ওই বাড়ির ধারেকাছে যেতেও ভয় করে। রাত-দিন পশুপাখি নিয়ে গবেষণা করেই চলেছে। তেমনই কোনও বিষয় হবে হয়তো। আফসোস কেবল জগৎবাসী অমলকে ঠিকমতো চিনতে পারল না। পারলে হকিং সাহেবের মতো আমাদের অমলও বিখ্যাত হয়ে যেত।”

কথার মাঝে এমন উদ্ভট নমুনা টেনে আনা রাধাকান্তের স্বভাব। একটু আগে নেপালিদের ঘুনসিতে গুঁজে রাখা কুকরিকে ন্যাপলা নামে চালিয়ে দিয়েছিলেন। তখন মনের ভেতর প্রশ্নোত্তরে মজে ছিলেন বলে হরনাথ কিছু বলেননি। এবার তিনি বেশ বিরক্তির সুরেই বললেন, “তা হয়তো যেত, তবে স্টিফেন হকিংয়ের মতো নয়। ওঁর গবেষণার সাবজেক্ট পদার্থবিদ্যা। তোমাদের গবেষকের জীববিদ্যা। এক্ষেত্রে বরং জগদীশ বোস বা চার্লস ডারউইনের তুলনা টানলে ভালো করতে।”

সবার কথার মাঝে নিমাই পণ্ডিত ক্রমশ অধৈর্য হয়ে পড়ছিল। যজমানি করতে গড়-জঙ্গল পেরিয়ে পাশের গ্রামেও যেতে হয়। কখনও সেরকম হিংস্র জন্তুর মুখোমুখি হতে হয়নি। আছে তো ক’টা শেয়াল। মানুষ দেখলে তারাই আগে পালায়। তাছাড়া তালুকদার বাড়িকে এড়িয়ে চলার জন্য মাঝেমধ্যে নদীর রাস্তা ধরেও আসাযাওয়া করেন। ভোর ভোর স্নান করতেও নদীতে যেতে হয়। কোনোদিন কুমির বা কামটের কথা শোনেননি। এখন আচমকা এসব শুনে নাকে একটা আঁশটে গন্ধ এসে ধাক্কা মারে যেন। নিমাই পণ্ডিত দুর্বল চিত্তের মানুষ। ঘটনার ঘনঘটা শুনে নিজের হৃদয়ে আর চাপ বাড়াতে চাইলেন না। আজ আবার কিসমতগঞ্জে একটা শ্রাদ্ধ আছে। বেলা থাকতে ফিরে আসতে গেলে এখনই রওনা হওয়া দরকার।

“হরদা, আমার তাড়া আছে। চললাম। মকবুল, পারলে গবেষকের বাড়ির দিকে নজর রাখিস। নীল আলো মানে শনিদেবের নজর পড়েছে গ্রামে।” এই বলে সাইকেলে উঠে প্যাডেলে চাপ দিলেন নিমাই পণ্ডিত।

(তিন)

uponyasbudhai (3)

রোজ বিকেলবেলা নদী-পাড়ে হাঁটাহাঁটি করা বরাবরের অভ্যাস বিশ্বম্ভর তালুকদারের। তাছাড়া টুকিটাকি কেনাকাটাও থাকে। এ-ব্যাপারে অবশ্য তিনি ধার-বাকির ধার মাড়ান না। কাঁচা বাজার হোক বা মুদিখানা, নগদেই সেরে থাকেন। তবে হ্যাঁ, কখনো-সখনো ফেরার সময় দোকানির কাছ থেকে বাটখারা কিংবা কানে গুঁজে রাখা হিসেব লেখার কলমটি ধার করতে ভোলেন না। পঁচিশ গ্রাম থেকে পাঁচ কেজি ওজনের বাটখারা, দুখানা দাঁড়িপাল্লা তাঁর বাড়িতে মজুত। অন্যান্য দিনের মতো আজও বৈকালিক হাঁটা শেষ করে সবেমাত্র বাজারের পথ ধরেছেন, এমন সময় দূরে টুপি মাথায় ভিনদেশি সাহেবকে নদীর দিকে আসতে দেখলেন বিশ্বম্ভরবাবু।

জাপানি সাহেবটিকে আগেও অনেকবার দেখেছেন গ্রামে। নামটি বেজায় খটমটে। ওশেমুরো ওনিসি না কী একটা যেন। চট করে মাথায় আসে না। ভারতের পূর্বদিকের দেশগুলির মানুষদের নাম বোধ করি এমনই হয়। ভদ্রলোক গবেষক অমলেন্দু বটব্যালের বন্ধুস্থানীয় মনে হয়। বছরে বার তিনেক কাঁকড়াপোলিতে নিয়ম করে আসতে দেখা যায়। গবেষকও নাকি মাঝেমধ্যে তাঁর বন্ধুটির দেশে আসাযাওয়া করেন।

সাহেবকে আসতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন বিশ্বম্ভর তালুকদার। গ্রামে এলেও জাপানি সাহেবটিকে তাঁর বন্ধুর মতোই রাস্তাঘাটে দেখা যায় না খুব একটা। দুই বন্ধুতে মিলে চিড়িয়াখানার মতো অদ্ভুত বাড়িটাতেই ছাইপাঁশ গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আজ সামনে পেয়ে তাই আলাপের সুযোগটা আর হাতছাড়া করতে চাইলেন না তালুকদার। কথাবার্তা চালানোর মতো ইংরেজিতে মোটামুটি দখল তাঁর আছে। স্কুল থেকে কলেজ, পড়াশোনায় খুব উঁচু দরের না হলেও গড়পড়তা ছাত্র ছিলেন তিনি।

জাপানি সাহেবকে কাছাকাছি চলে আসতে দেখে সর্বপ্রথম একটা কথাই মাথায় আসে বিশ্বম্ভর তালুকদারের—লোকটার কাছে জামাকাপড়ের দ্বিতীয় কোনও জোড়া নেই। গ্রামে ঢুকতে-বেরোতে যতবার দেখেছেন, পরনে সেই এক জলপাই সবুজ রঙের জামা, হাফপ্যান্ট আর চওড়া ঘেরওয়ালা রোদ-টুপি। সজ্জায় আজ সামান্য ব্যতিক্রম চোখে পড়ে তালুকদারের। কানের নতুন ধরনের কান-পট্টিটা আগে কখনও দেখেছেন কি না মনে করতে পারলেন না। আজ আবার হাতে বৈদ্যুতিক বাতি গোছের একটা যন্ত্রও রয়েছে। এই সময় গ্রামে-গঞ্জে সন্ধের পর অন্ধকার নেমে আসে ঝুপ করে। গবেষকের সাহেব বন্ধুটি ফুট তিনেকের মধ্যে আসতেই মাথা নীচু করে কোমর বেঁকিয়ে জাপানি কায়দায় অভিবাদন জানালেন বিশ্বম্ভর তালুকদার।

“গুড ইভনিং ওনিসি সাহেব।”

তালুকদারের সম্ভাষণে কিঞ্চিত বিস্ময়ের সঙ্গে এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন, তারপর অভিবাদনের জবাব দিলেন জাপানি সাহেব। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি আমায় কিছু বলছেন?”

“আশেপাশে আর কাউকে তো নজরে পড়ছে না। তা ভর-সন্ধেবেলায় কোথায় চললেন? নদীর পাড়ে হাওয়া খেতে নাকি? এ হে, গায়ে তো কিছুই নেই দেখছি! নিদেনপক্ষে একটা শাল বা চাদর তো চাপিয়ে আসতে হয়! পৌষের হাওয়ায় ঠান্ডা লেগে যাবে যে।”

“ডিয়ার ফ্রেন্ড, এতটা চিন্তিত হওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমার অভ্যাস আছে। তবে সন্ধের পর নদীর ধারে আপনাদের থাকাটা ঠিক নয়। আর একটা কথা, আমার নাম ওশিনেরি ওসুমি। আসছি। নমস্কার।”

সাহেবের কথায় কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ হলেন বিশ্বম্ভর তালুকদার। তাঁদের নিজেদের গ্রাম। স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য কতদিন ধরে বিকেলে এদিকটায় হাঁটতে আসেন। কোথাকার কোন এক বিদেশি এসে তা নিয়ে ঠিক-বেঠিকের প্রশ্ন তুললে অল্পবিস্তর রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। তালুকদারমশাই তাঁর মনের ভাবকে তেড়েফুঁড়ে প্রকাশ করতেই পারতেন, কিন্তু সেটা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। সুতরাং মুখের মিটিমিটি হাসিকে অক্ষুণ্ণ রেখে তিনি বললেন, “ডোন্ট ওরি সাহেব। আমাদেরও অভ্যাস আছে। ছোটবেলা থেকে এখানেই মানুষ কিনা। আপনি এত হন্তদন্ত হয়ে চললেন কোথায়? হাতের ওইটি কী, টর্চ বুঝি? তা ভালোই করেছেন, অচেনা জায়গায় অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে পড়তে হবে নইলে। এদিকে ক’দিন হল অন্ধকারে আমিও একেবারে কানা হয়ে যাচ্ছি, বুঝলেন…”

“না, টর্চ নয়। এটা একধরনের অস্ত্র বলতে পারেন। আত্মরক্ষার জন্য সঙ্গে রাখা। নদীর ধারে বিপদ আছে। কয়েকটা দিন এদিকে আসবেন না দয়া করে।”

জাপানি সাহেব এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে অপর পক্ষের প্রত্যুত্তরের জন্য অপেক্ষা করলেন না। তালুকদারকে পেছনে ফেলে সন্তর্পণে নদীর রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেন। সাহেবের কথা শুনে বিশ্বম্ভরবাবু কিছুক্ষণ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন নিজের জায়গায়। লোকটা পাগল হয়ে গেল নাকি? নদীর ধারে বিপদ! কই, তেমন কিছু টের পাননি তো। গতকালও এসেছিলেন। বুধাই নদীতে এই সময় জল কিছুটা কম থাকে। কুলকুল শব্দে তার বয়ে যাওয়া, দূর মোহনায় দুধ-সাদা কুয়াশায় সূর্যের কমলালেবু রং গলে মিশে যাওয়া, কিংবা জলো হাওয়ায় শিরশিরে অনুভূতি—সবকিছু গতকাল যেমন ছিল, আজও তাই। আলাদা কিছু বুঝতে পারেননি। হ্যাঁ, দিন কয়েক ধরে সন্ধের পর একটা উদ্ভট আঁশটে গন্ধ নাকে আসছে বটে, কিন্তু সে তো নদীতে মাছেদের আনাগোনা বাড়লে অসম্ভব কিছু নয়। তাহলে ওসুমি সাহেব কোন বিপদের কথা বোঝাতে চাইলেন? তাছাড়া হাতের জিনিসটা যে বাতির মতো দেখতে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, অথচ সাহেব বললেন ওটা নাকি অস্ত্র! আত্মরক্ষার জন্য সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন। নদীর পাশে এমন কী বিপদের আবির্ভাব হল?

অমলেন্দু বটব্যালের জাপানি বন্ধুটির হাতে ধরা বিশেষ বৈদ্যুতিক বাতিটি দেখে তালুকদারের মনে সেটি ধার হিসেবে সংগ্রহ করার বড়ো ইচ্ছা জেগেছিল। অমন জিনিস তাঁর সংগ্রহে নেই। দু-এক কথার পর সুযোগ বুঝে সেই প্রসঙ্গে ঠিক ঢুকেও পড়বেন ভেবেছিলেন। সাহেব সে সুযোগই দিলেন না! এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার বান্দা বিশ্বম্ভর তালুকদার নন। সামনের বাঁকে আবছা হতে থাকা ছায়া শরীরটির লক্ষ্য করে দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে চললেন তিনি।

কিছুটা দূরত্ব রেখেই ওসুমি সাহেবকে অনুসরণ করছিলেন বিশ্বম্ভর তালুকদার। তাও প্রায় ঘণ্টা খানেক হল। নিমাই পণ্ডিতের কাছ থেকে ধার নেওয়া পাঁজি খুলে দেখেছিলেন আজ পূর্ণিমা। অকালে জমা হওয়া মেঘের দল পূর্ণ শশীকে আড়ালে রেখেছে বলে অন্ধকার একটু ঘন। ঠান্ডা নেমেছে জাঁকিয়ে। হাওয়াও যেন অন্যদিনের তুলনায় বেশি। গায়ের পুরোনো শালে শীত বাগ মানতে চাইছে না। পাড় থেকে ফুট পঞ্চাশ দূরে ছোটো ছোটো ঝোপঝাড় এঁকে-বেঁকে চলে গিয়েছে নদীর পাশাপাশি মোহনার দিকে। মাঝে মাঝে ঝোপ-শূন্য ফাঁকা ঘাসজমি হামাগুড়ি দিয়ে পার হচ্ছিলেন বিশ্বম্ভর তালুকদার। অন্ধকার সয়ে আসা চোখে তীক্ষ্ণভাবে নজর রাখছিলেন কিছুটা দূরে নদীর ধার ঘেঁষে এগিয়ে যাওয়া ছায়াটির দিকে। গবেষকের জাপানি বন্ধুটির ভাবগতিক মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে তাঁর। কিছু একটা খুঁজছেন। মাঝেমধ্যে হাতের বৈদ্যুতিন বাতিটার আলো ফেলছেন জলে। এমনিতে জাপানিদের সম্পর্কে তালুকদারের ধারণা উঁচুই বলা যেতে পারে। ওরা নাকি সহজ-সরল হয়। দেশাত্মবোধও বেশ চড়া সুরে বাঁধা থাকে। কিন্তু এখন যেন এই সাহেবটিকে দেখে তাঁর সেই ধারণা টাল খাচ্ছে। হাতের টর্চখানাকে বেমালুম হাতিয়ার বলে চালিয়ে দিল! আর টর্চের আলোও অন্যরকম। অদ্ভুত নীল রং। ঠিক নীলও নয় যেন, কিছুটা শ্যাওলা রং মিশে আছে। মাঝেমধ্যে সেই নীল-সবুজ আলো ফেলে নদীর জলে কী দেখছেন সাহেব? নাকি দেখছেন না, দেখাচ্ছেন! সিগন্যাল পাঠাচ্ছেন কাউকে?

স্মাগলার নাকি!

বহুবছর আগে কলেজে ভর্তির পরপর বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে একবার সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন বিশ্বম্ভর তালুকদার। রঙিন পর্দায় এমনভাবে টর্চের আলো জ্বালিয়ে আর নিভিয়ে স্মাগলারদের একদল অপর পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। আজকের ঘটনাও যেন তেমনই! মনের মধ্যে হাজার কৌতূহল উঁকি দিলেও চোখজোড়া সামনের ছায়াটিকে অনুসরণ করে চলছিল। আচমকা সেই উদ্ভট আঁশটে গন্ধটা বিশ্বম্ভর তালুকদারের নাকে এসে ধাক্কা মারল, আর তারপরেই কনকনে ঠান্ডার মতো কিছু অদ্ভুত শব্দ। ঠিক শব্দ নয়, একটানা বেজে চলা সুরের মতো অনেকটা। কেউ বুঝি ভীষণ অপটু হাতে ভায়োলিন বাজাচ্ছে, কিংবা চেলো। খরখরে বরফকুচির মতো সেই সুর অসহ্য হলেও ভীষণভাবে আকর্ষণ করছে। তালুকদার কান খাড়া করে শব্দগুলোর অর্থ বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন। কয়েক সেকেন্ড বা মিনিট হবে হয়তো, তাঁর মনে হল ওই বেসুরো সুর বুঝি ঝিমুনি ধরিয়ে দিচ্ছে মস্তিষ্কের কোষে কোষে। এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই আর। ঝোপের আড়ালেই অবসন্ন শরীর নিয়ে বসে পড়লেন তিনি। দু-চোখের পাতা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। পুরোপুরি অন্ধকার নেমে আসার আগে ঝাপসা হতে থাকা দৃষ্টিতে তাঁর নজরে আসে, অল্প দূরে জাপানি সাহেবের ছায়া শরীর হাতের সবুজ-নীল আলোটা প্রবলভাবে নাড়িয়ে চলেছে। সেই মৃদু আলোতে অস্পষ্টভাবে দেখা গেল ধোঁয়া ধোঁয়া আরও একটা শরীর উঠে এল জল থেকে। কী ওটা! কুমির? বুধাই নদীতে কুমির আছে এমন তো কখনও শোনা যায়নি। তাছাড়া কুমির অমন হেলেদুলে হাঁটে নাকি! বিশাল ছায়াটা কখনও চার হাতে-পায়ে, কখনও দু-পায়ে ভর দিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে এগিয়ে চলেছে জাপানি সাহেবের দিকে। সাহেব হাঁটু মুড়ে বসে হাত দোলাচ্ছেন। নীল বাতিটা মাটিতে নামিয়ে রাখা। সেই কনকনে ঠান্ডার মতো সুরের তীব্রতা আরও বাড়ছে। হঠাৎ বাতিটা নিভে যেতে অজানা কোন ভাষায় আর্ত চিৎকার নদী-পাড়ের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে গেল। মুহূর্তের জন্য, তারপরেই আবার চারপাশ আগের মতো নিস্তব্ধ, নিথর। ভেজা ঘাসে শুয়ে পড়া বিশ্বম্ভর তালুকদার আর চোখ মেলে রাখতে পারলেন না। শিশির কণার পরশে তাঁর পরনের ধুতি, পাঞ্জাবি, শাল ক্রমে ভিজে যেতে থাকল।

বেশিক্ষণ নয়, বড়োজোর আধঘণ্টা-চল্লিশ মিনিট ওইভাবে মাটিতে শুয়ে ছিলেন বিশ্বম্ভর তালুকদার। ঘোর কাটতে ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আকাশের গা থেকে মেঘের প্রলেপ ততক্ষণে মুছে গিয়েছে। গোল চাঁদের রুপোলি আলোয় নদীর জল চিকচিক করছে। পৌষের বুধাই নদী আগের মতো শান্ত। ফটফটে জোৎস্নায় চারপাশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এখন। নদীর দিক থেকে আসা তিরতিরে হাওয়ায় ঝোপের মাথাগুলো নড়ে চলেছে বিরামহীনভাবে। খুলে যাওয়া এক পাটি চটি খুঁজে পায়ে ভরে নিলেন তালুকদার। ভেজা শালটা দিয়েই শিশিরভেজা মাথাখানি একবার মুছে নিলেন। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন নদীর পাড়ের দিকে যেখানে কিছুক্ষণ আগে অমলেন্দু বটব্যালের জাপানি বন্ধুটিকে শেষবার দেখেছিলেন। জ্ঞান হারাবার আগে ওসুমি সাহেবের নীল বাতি, হাত দোলানো এবং নদী থেকে অদ্ভুত দর্শন প্রাণীটার উঠে আসার কথা আবছা হলেও মনে আছে। অথচ এখন আশেপাশে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই! চিরকাল যেমন দেখে এসেছেন অবিকল তেমনভাবে সেজে রয়েছে প্রকৃতি। তবে জল থেকে উঠে আসা অদ্ভুত প্রাণী, জাপানি সাহেবের উদ্ভট আচরণ, বরফের মতো ঠান্ডা সেই অদ্ভুত শব্দ কিংবা তাঁর আচমকা ঘুমিয়ে পড়া—সবকিছুই কি নিছক ভ্রম? তাই-বা কী করে হয়! তিনি যে এতক্ষণ ভেজা ঘাসে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছিলেন তা তো মিথ্যে নয়! জাপানি সাহেবের পিছু নিয়ে তিনি নদীর পাড়ে এসেছিলেন স্পষ্ট মনে আছে। শুধু তারপরের ঘটনাগুলোই কেমন ধোঁয়াটে। সাহেব কি তবে ফিরে গিয়েছেন?

কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই নিজেকে করা প্রশ্নের উত্তর মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলেন বিশ্বম্ভর তালুকদার। ওসুমি সাহেবের রোদ-টুপি আর সেই অদ্ভুত নীল বাতি গড়াগড়ি খাচ্ছে!

“সব ফেলে মানুষটা গেল কোথায়? তবে কি…”

ভাবতে শিরদাঁড়া বেয়ে চোরা হিমশীতল স্রোত বয়ে যায় যেন।

জাপানি সাহেব কোথায় গেলেন তার উত্তর খোঁজার মতো সাহস তালুকদারের আর অবশিষ্ট ছিল না। তিনি চট করে টুপি আর বৈদ্যুতিন বাতি মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে দ্রুত পা চালালেন গ্রামের দিকে। এখন মনে হচ্ছে ওসুমি সাহেব ভুল কিছু বলেননি। নদীর দিকে সত্যিই অজানা কোনও বিপদ ঘাপটি মেরে রয়েছে। সবাইকে সাবধান করা দরকার।

ঝোপঝাড় পেরিয়ে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। তারপর কাঁচা রাস্তাটা এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে গ্রামের দিকে। রাস্তায় ওঠার আগেই চাঁদের আলোয় কাউকে হেঁটে যেতে দেখা গেল। একটু জোরে পা চালিয়ে দূর থেকেই হাঁক পাড়লেন তালুকদার।

হরনাথ মাস্টারের সঙ্গে যে এখানে দেখা হয়ে যাবে ভাবতে পারেননি বিশ্বম্ভর তালুকদার। অনুভবটা বোধ হয় ভাইস-ভার্সা ছিল, কারণ হরনাথ মাস্টার বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, “তালুকদার! তুমি এদিকে কখন এসেছিলে?”

“অনেকক্ষণ। অমলদার জাপানি বন্ধুটির পিছু নিয়ে এসেছিলাম। আর এসে যা দেখলাম হরদা!”

“জানি আমি। এখন চলো, জায়গাটা ছেড়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এগিয়ে যাই। বাকি কথা গ্রামে ঢুকেই বলা যাবে।”

বয়সে দুজনের ফারাক আহামরি এমন নয়। বিশ্বম্ভর তালুকদারের আটান্ন হলে হরনাথের ষাট পেরিয়েছে গত পৌষে। গড়পাড় নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছেন সদ্য। গ্রামের অনেকেই আপদে-বিপদে এই বিচক্ষণ স্কুল মাস্টারটির কাছে পরামর্শ নিতে আসে। আপাত শান্ত, রাশভারী স্বভাবের মানুষটিও আজ সন্ধেতে দেখা দৃশ্য মনে করে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছেন, যদিও বাইরের থেকে তার কোনও আঁচ পাওয়া যাচ্ছে না। দুজনে গ্রামের মুখ ছাড়িয়ে একটু ভেতরে যে বুড়ো বটগাছ রয়েছে, সেখানে বাঁধানো চাতালে পাশাপাশি বসলেন। গোটা রাস্তায় কেউ একটা শব্দ খরচ করেননি। বিশ্বম্ভর তালুকদার অনেকক্ষণ ধরে উশখুশ করছিলেন। প্রথম প্রশ্ন তিনিই করলেন, “হ্যাঁ গো হরদা, ব্যাপারখানা কী বলো তো? আমি তো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। জাপানি সাহেব গেলেন কোথায়? আর ওই অদ্ভুত দেখতে জন্তুটাই-বা কী?”

“তুমি যতটুকু দেখেছ, আমিও ততটুকুই জানি। বেয়াই-বাড়ি থেকে ফেরবার সময় ভাবলাম নদীর রাস্তা নিলে একটু তাড়াতাড়ি হবে। কে জানত অমন একটা ঘটনার সাক্ষী হতে হবে! জন্তুটা কী তা আমিও অন্ধকারে ঠিকমতো ঠাহর করতে পারিনি। তবে… আচ্ছা, তুমি মারমেডের কথা জানো তালুকদার?”

“মারমেড… মানে মৎসকন্যা? রূপকথার গল্পে পড়েছি এককালে। এমন একটা হাড় হিম করে দেওয়া সময়ে তোমার রূপকথার গল্প মনে পড়ছে!”

“পড়ছে। তার কারণও আছে। গোটা পৃথিবী জুড়ে মৎসকন্যাদের নিয়ে নানা গল্পকথা প্রচলিত। আগেকার দিনের অনেক নাবিক তাদের লেখাতেও মারমেডদের দেখতে পাওয়ার কথা বলে গিয়েছেন। সে-সব কতটা সত্যি তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। আমিও মারমেডকে রূপকথার গল্প বলেই মানতাম।”

“মানতাম মানে! তোমার কী মনে হয় হরদা, জল থেকে উঠে আসা ওই জন্তুটা কোনও মৎসকন্যা?”

“কন্যা কেন, পুরুষও হতে পারে। মারমেডদের মতন মারমেনদের কথাও রয়েছে অনেক উপকথায়। সে যাই হোক, ওইরকম বরফের মতো ঠান্ডা শব্দ, কানে যাওয়া মাত্র কেমন দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করছিলে মনে আছে?”

“ওই পর্যন্তই তো মনে আছে হরদা। কেউ যেন বেসুরো সুরে ভায়োলিন বাজাচ্ছে মনে হয়েছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘুমে কাবু করে ফেলল! ঘুমের ঘোরে যা দেখেছি, সবই কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া। আর তারপর যে কী হয়েছে কিছুই তো জানি না।”

“কোন এক সাহেব নাবিকের ডায়েরি পড়েছিলাম ম্যাগাজিনে। নামটা মনে নেই তার। সে নাকি মারমেড দেখেছিল। গল উপকূলের এক খাঁড়িতে তাদের জাহাজ আটকে পড়েছিল। মাঝে মাঝে রাতে দূর সমুদ্রে জেগে থাকা পাথরের ওপর অপূর্ব সুন্দরী মৎস্যকন্যাকে দেখা যেত দুর্বোধ্য ভাষায় গান করতে। বুঝতে না পারলেও তার সুরের জাদুতে পাগল হয়ে সবাই লাফিয়ে পড়ত জলে। শেষমেশ জেগে থাকা পাথরের কাছে পৌঁছালে দেখা যেত, কোথায় কী, সব ভোঁ ভাঁ! আবার সাঁতরে ফিরে আসত প্রায় সবাই। কেবল প্রতিবার একজন করে জাহাজ কর্মীর আর কোনও খোঁজ পাওয়া যেত না।”

“বলো কী হরদা, এসব সত্যি নাকি? আর সেই নাবিক, যে এসব লিখেছে, সে ফিরে এল কীভাবে?”

“পরিষ্কার মনে নেই। বাকিদের মতো সেও মৎস্যকন্যার আকর্ষণে ছুটে গিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে কিছু হয়নি। পরে সহকর্মীদের সংখ্যা কমছে দেখে খটকা লেগেছিল হয়তো। রাত নামলেই সে সমুদ্রের ধার থেকে দূরে পালিয়ে যেত। তাছাড়া মারমেডের ডাক যাতে কানে না পৌঁছায় তার জন্য কিছু দিয়ে ঢেকে রাখত বোধ হয়। তারপর একদিন অন্য কোনও জাহাজ তাকে দেখতে তুলে নেয়।”

“ঠিক বলেছ। আমিও জাপানি সাহেবকে শেষবার কেমন অদ্ভুত দেখতে কানপট্টি পরে থাকতে দেখেছিলাম। আমার কিন্তু বেশ ভয় ভয় করছে হরদা। গ্রামের সবাইকে ব্যাপারটা এখনই জানিয়ে দেওয়া উচিত।”

“সেটা কি ঠিক হবে তালুকদার? শেষ পর্যন্ত হয়তো দেখা গেল ঘটনাটা অতটা গুরুতর নয়। খামোখা সকলকে চিন্তায় ফেলা হয়ে যাবে। যা দেখেছি তা মনের ভুলও হতে পারে। তার চেয়ে তুমি বরং কাল একবার গবেষকের বাড়িতে যেও। ওসুমি সাহেবের টুপি আর বাতিও সঙ্গে নিও। সেরকম চিন্তার কিছু হলে গবেষকের অজানা হবে বলে মনে হয় না। আর তেমন হলে কোনও না কোনও উপায় নিশ্চয়ই বাতলে দেবে।”

হরনাথ মাস্টারের সঙ্গে গবেষক অমলেন্দু বটব্যালের আবাল্য রেষারেষির কথা গ্রামের কারও অজানা নয়। দুজনেই একসঙ্গে একই স্কুল থেকে বোর্ডের পরীক্ষা দিয়েছিলেন। স্কুল-জীবন থেকেই ক্লাসের প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থানাধিকারী ছাত্রটির মধ্যে তুমুল দ্বন্দ্ব ছিল। অবশ্য স্কুলের চৌহদ্দির বাইরে দুই বন্ধু ভাবও কম ছিল না। অমলেন্দু বটব্যাল বোর্ড পরীক্ষায় দুরন্ত ফল করেছিলেন। সদ্য পিতৃবিয়োগ হওয়াতে হরনাথ সমাদ্দার জুতসই টক্কর দিতে পারেননি। তবে দুই বন্ধুর মনোমালিন্যের কারণ আলাদা। পরীক্ষার পর বাড়ির চাপাচাপিতে অমলেন্দু বটব্যাল উচ্চশিক্ষার জন্য চলে গেলেন বিদেশে। বিদেশ থেকে ফিরে এসেছিলেন গবেষণায় বুঁদ হয়ে থাকা একজন মানুষ। গ্রামের পুরোনো মানুষগুলোর সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ বা সময়, কোনোটাই ছিল না তাঁর। অবশ্য প্রাক্তন সহপাঠীর সম্পর্কে হরনাথের মূল্যায়ন অন্যরকম। তাঁর মনে হয়, অমলেন্দু বটব্যাল আসলে বিদেশে শিক্ষালাভ করে অহংকারী হয়ে উঠেছেন। গবেষণার ব্যস্ততা বাহানা মাত্র। পুরোনো বন্ধুদের অনেকে রয়ে-সয়ে গবেষকের সঙ্গে দেখা করতে যায় বটে, কিন্তু হরনাথ সে-পথ মাড়াননি। আজ তাই প্রয়োজন থাকলেও অনুসন্ধানের ভার বিশ্বম্ভর তালুকদারের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইলেন।

“এ কিন্তু তোমার অন্যায় হরদা। মানছি অমলদার সঙ্গে তোমার আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক, তা বলে এমন বিপদের দিনে নিজের মান-অভিমানটাই তোমার কাছে বড়ো হল!”

“আহা, আমি কি বলেছি আমার কোনও চিন্তা নেই! গ্রামের কোনও বিপদে আজ পর্যন্ত আমাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখেছ? তুমি গুছিয়ে কথা বলতে পারো বলেই… আচ্ছা বেশ, আমিও না-হয় তোমার সঙ্গে যাব, তবে ওই গেটের বাইরে পর্যন্ত। চেষ্টা করো গবেষকের কাছ থেকে যতটা বেশি সম্ভব ইনপুট নিয়ে আসার। বিপদটা ঠিক কেমন আমাদের জানাটা খুব জরুরি।”

(চার)

uponyasbudhai (4)

অন্যদিন এই সময় নিজের ল্যাবরেটরিতে রিসার্চের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন ড. অমলেন্দু বটব্যাল। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বিশাল বাড়িটার একটা অংশকে আলাদা করে ঘিরে নিয়ে নিজের গবেষণা কক্ষটি বানিয়েছেন তিনি। ঘেরা অংশের বাইরে বাড়ির বাকি ঘরগুলি দেখলেও মানুষের বাসের অযোগ্য বলে মনে হয়। একটা ঘরে শেলফের ওপরে থরে থরে সাজিয়ে রাখা বড়ো বড়ো কাচের জার। তার মধ্যে নানান প্রজাতির প্রজাপতি। প্রতিটা জারের গায়ে সাদা কাগজে মোটা করে লেখা তাদের অদ্ভুত বাংলা নাম। বরুণপাখা, মোউরাল, খাগড়া, আলতে, হরতনি, ফুরুস, ধুলকাপাস, চন্দনদাঁড়ি, তাতপাল্লা—এমন হরেক নাম লেখা কাগজের নীচের দিকে ইংরেজিতে তাদের বিজ্ঞানসম্মত নাম লেখা। বাকি ঘরগুলোতেও কোনোটায় সাপ, ব্যাঙ, বাদুর, ইঁদুর রাখা, কোনোটায় নানান মাপের অ্যাকুরিয়ামে আশ্চর্যরকম দেখতে মাছ। অ্যাকুরিয়ামে জলের তাপমাত্রা ও অন্যান্য উপাদান যাতে সঠিক মাত্রায় বজায় থাকে তার জন্য উন্নত যান্ত্রিক ব্যবস্থা কাজ করে চলেছে নিরন্তর। সবাই বলে গবেষকের বাড়ি নয়, ওটা আসলে চিড়িয়াখানা।

অমলেন্দু বটব্যাল রাতদিন এ-সমস্ত প্রাণীদের স্বভাব, আচরণ, বৈশিষ্ট্য নিয়ে খুঁটিনাটি গবেষণা করে চলেন। বিভিন্ন মূল্যবান এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির তদারকিও তাঁকে করতে হয়। তবু এরই মাঝে গ্রামের কচিকাঁচাদের দল তাঁর চিড়িয়াখানায় ভিড় জমালে সকলকে ধরে ধরে প্রজাপতি চেনান—“এই যে বড়ো কালো প্রজাপতিগুলো দেখছিস, এগুলো উড়ন্ত অবস্থাতেই ফুল থেকে মধু পান করে। আর এই ছোটো নীল প্রজাতিরগুলো মাটি ছুঁয়ে উড়ে বেড়ায়।”

ছেলের দল কতটা কী বোঝে কে জানে। শুধু চোখ বড়ো বড়ো করে শোনে আর পরের কাচের জারে শান্ত হয়ে বসে থাকা প্রজাপতির দিকে আঙুল তুলে বেখাপ্পা প্রশ্ন করে। হাসিমুখেই তাদের উত্তর দেন ড. বটব্যাল। বয়স্কদের সঙ্গে তাঁর ভাব সেরকম না জমলেও ছোটোদের পেলে নিজের কাজ ফেলে খুশি মনে তাদের কৌতূহল মেটানোর চেষ্টা করেন। আজও তেমনটাই করছিলেন অমলেন্দু বটব্যাল।

বুধাই নদীর গা ঘেঁষে অনেকটা জায়গা নিয়ে উঁচু পাঁচিল ঘেরা গবেষকের বাড়ি। বড়ো লোহার গেট থাকলেও পাহারাদার নেই কোনও। দরকারও পড়ে না তার। জন্তুজানোয়ারের ভয়ে চোরও এই বাড়িতে পা রাখার সাহস পায় না। গেট থেকে মোরাম বিছানো রাস্তা চলে গেছে বাড়ির একেবারে পেছন দিকটায়। গবেষণা কক্ষের মতো বাড়ির এদিকেও সবার আসার অনুমতি নেই। ছোটো-বড়ো-মাঝারি খাঁচায় খ্যাঁকশিয়াল, ভাম, গন্ধগোকুল, বাঘরোল, গোয়ারগেল এমনকি বুনো শুয়োর আর নেকড়েও আছে। আর এদের দেখাশোনা করার জন্য রয়েছে গোবিন্দ। বুড়ো রামলাল রয়েছে পুকুরের মাছ, বেড়াল, প্রজাপতিদের তদারকি এবং বাগান পরিষ্কার করার জন্য। ঘরের বাকি কাজ, রান্নাবান্না করে গ্রামেরই মেয়ে তুলসী। তাকে অবশ্য ঠিক ভৃত্যের শ্রেণিতে ফেলা যায় না, বরং গোটা বাড়িটার অলিখিত কেয়ারটেকার সে-ই। তুলসী জন্ম থেকেই মা-হারা। বাপও চলে গিয়েছে বছর সাতেক হল। সেই থেকে সে গবেষকের বাড়িতে কাজ করছে। প্রথমদিকে সকালে এসে সব কাজকর্ম সেরে সন্ধেয় নিজের বাড়ি ফিরে যেত। ইদানীং নিজের বাড়ি ছেড়ে চিড়িয়াখানাতে রাত গুজরান করে। চারটে পেটের জন্য আহামরি কিছু রান্না করতে হয় না। বাড়ির মালিক তো কাজের নেশায় এমন মজে থাকেন যে কী মুখে তুলছেন তাকিয়েও দেখেন না। রান্নাঘরে চাপ না থাকলেও বাইরের দিকে আজকাল নজর রাখতে হয় তুলসীকে। অন্য দুজন কাজে ফাঁকি দেওয়া শুরু করেছে। তার কারণ তুলসী। সে আসার পর থেকে খরচ-খরচা বাবদ যে দু-চার পয়সা এদিক ওদিক করার সুযোগ মিলছিল, বন্ধ তা। অমলেন্দু বটব্যাল নিজের গবেষণার কাজ ছাড়া ফুরসত পান কম। সংসার নিয়েও মাথাব্যথা নেই। তুলসী আসার পর নিশ্চিন্ত মনে গোটা বাড়ির জিম্মা তার ওপরে দিয়ে আরও বেশি করে সময় কাটাচ্ছেন বাঁদর, বাদুড় নিয়ে। তুলসীও দায়িত্ব হাতে পাওয়ার পর থেকে পাই-পয়সার হিসেব নেওয়া শুরু করেছে। বাপ-মা মরা মেয়ে বলে অমলেন্দু বটব্যাল তাকে বেশি লাইও দিয়ে থাকেন। গোবিন্দ আর রামলাল অন্তত তেমনই মনে করে। উপরি আমদানি বন্ধ হতে আজকাল তাদের কাজে মন লাগে কম। তুলসীকে ঘর ছেড়ে তাই বাইরের কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে কি না সেদিকটাও দেখতে হয়।

বাগানের মাঝখানে পেল্লায় সাইজের একটা পুকুর। তার পাড় ঘেঁষে হিঞ্চে, জলধনে, কুলেখাড়া, কলাফুল, আরও নানা গাছ। পুকুরে আছে পোদ কই, পুঁটি, গুড়ি খলসে এমন হারিয়ে যেতে বসা অনেক মাছ। হেঁসেলের অনেকটা জোগাড় তুলসী এখান থেকেই সেরে ফেলে। আজও সেই কাজেই এসেছিল। পুকুরে পানা জমতে শুরু করেছে। দু-দিন ধরে বুড়ো রামলালকে তাগাদা দিয়েও কোনও লাভ হয়নি। রোজকার মতো সে বুড়ো রামলালের ওপরে গজগজ করছে তুলসী। রামলাল কানে খাটো। তুলসীর কথাগুলো কতটা তার কানে ঢুকছে বোঝা মুশকিল। সে হাত-জাল দিয়ে সরপুঁটি তোলায় ব্যস্ত।

একটু দূরেই পুকুরপাড়ে আজকের ক্লাস বসিয়েছেন অমলেন্দু বটব্যাল। হাতেকলমে গাছ চেনাচ্ছেন খুদে পড়ুয়াদের। ব্রাহ্মী, বেকুনজুবাজ, কলমির মতন গাছগাছড়ার বিজ্ঞানসম্মত নাম, তাদের ভেষজ গুণ বলে চলেছেন নাগড়ে। বাংলার মানুষ হয়ে এ-দেশের পশু-পাখি, গাছগাছালি সম্পর্কে সবার সচেতন থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি। কথা বলছেন বটে, কিন্তু ক্লাসে যেন আজ তাঁর মন নেই। একমাত্র এই সময় গবেষকের গম্ভীর মুখ জুড়ে খুশির ছোঁয়া টের পাওয়া যায়। আজ যেন তাতে গ্রহণ লেগেছে। কেবলই মনে হচ্ছে তাঁর জন্য গ্রামের মানুষগুলো বিপদে পড়বে না তো?

ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই কাঁচুমাচু মুখে সামনে হাজির হয় গোবিন্দ। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে, “বাবু, আমারে ছুটি দেন। এখানে কাজ করা আর সম্ভব নয়।”

“কেন রে! কী হল আবার?”

“আপনারে তো আগেও বলেছি ওই আঁশটে গন্ধটার কথা। তাছাড়া রোজ একটা করে ধাড়ি ছাগল কোন রাক্ষসের পেটে যাচ্ছে তাও তো খুলে বলেন না আপনি। এদিকে কাল রাত্তিরে আমি তার খাবারের জোগান দিতে গিয়ে নিজেই… না বাবু, আপনি আমারে ছুটি করে দেন।”

“আহা, খুলে বলবি কিছু? তখন থেকে শুধু ছুটি ছুটি করছিস! তোকে বলেছি না ছাগল আমার গবেষণার জন্য লাগছে? সাবজেক্টদের খাবার তো তুই নতুন দিচ্ছিস না! তাহলে এর মধ্যে আবার রাক্ষসকে অযথা টেনে নিয়ে আসছিস কেন?”

“নেকড়ে বা খ্যাঁকশিয়ালকে খাওয়ানো আর আপনার নতুন সাবজেককে খাওয়ানো এক নয় তা বেশ বুঝতে পারছি। আপনি যাই কন না কেন, এ আসলে কোনও দানো। ক’দিন আগে গ্রামের শিবেন মুখুজ্জের বলদটাকেও কোন এক জন্তু হজম করে দিয়ে গেছে। এ নির্ঘাত আপনার নতুন সাবজেককের কাজ। একটা ছাগলে তার পেটের আগুন আর নিভছে না। আর কাল রাতে যা দেখলাম…”

“কী দেখেছিস তুই? তোকে বলেছি না রাতে খাবার দেওয়ার সময় কানের মেশিনটা পরে থাকতে? খাবার রেখে দাঁড়িয়ে থাকবি না।”

“ওইটেই তো ভুল করে ফেলেছিলাম। ভাগ্যিস কানে আপনার দেওয়া যন্তরখানা ছিল। কে অমন আস্ত ছাগল চুষি কাঠির মতো খেয়ে শুধু হাড়গোড় ফেলে যায় দেখার লোভ সামলাতে পারিনি। কী বিশ্রী গন্ধ তার গায়ে! আর অদ্ভুত আওয়াজ। ডাক তো নয়, যেন বরফের ছুরি! না বাবু, আপনি আমার পাওনা-কড়ি মিটিয়ে ছুটি করে দেন। ছাগল-গোরুর মতো মরতে চাই না আমি।”

পুকুরপাড়ের ক্লাস শেষের ঘণ্টা আজ সময়ের আগেই বেজে ওঠে। এমনিতেও অমলেন্দু বটব্যালের মনমেজাজ ভালো ছিল না। তার ওপর গোবিন্দের কথায় তাঁর দুশ্চিন্তা আরও ঘন হয়ে ওঠে। যদিও মাসের মাঝামাঝি, তবুও গোবিন্দর পুরো মাসের বেতন মিটিয়ে দিতে বলেন তুলসীকে। তারপর গম্ভীর মুখে নিজের গবেষণা কক্ষের দিকে পা বাড়ালেন। পুকুরপাড়ে জড়ো হওয়া ছেলেদের দল বুঝতে পারল অন্যদিনের মতো নিত্যনতুন স্বাদের ‘লজেঞ্চুস’ আজ আর জুটবে না। তারা উদাস মনে বড়ো লোহার গেট পেরিয়ে চিড়িয়াখানার বাইরে বেরিয়ে আসে।

অমলেন্দু বটব্যালের বিশাল গবেষণা কক্ষটি বাইরের থেকে দেখলে পুরোনো মনে হলেও ভেতরে নানা আধুনিক যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত। বেশ কয়েকটা ছোটোবড়ো কম্পিউটার, নানান মাপের কাচের জারে বিভিন্ন রাসায়নিক। কিছু কাচের জারে আবার ফরমালিনে চুবিয়ে রাখা টিকটিকি, সাপ, ধারালো দাঁতওয়ালা মাছ। দেখে বোঝার উপায় নেই তারা জীবিত না মৃত। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা কাচের ঘেরা জায়গা বিশেষভাবে তৈরি করা। ছোটোখাটো একটা অপারেশন টেবিলও রয়েছে সেখানে। ঘরের বাকি জায়গার মতো সেটাও নানা সূক্ষ্ম অথচ জটিল যন্ত্রপাতি ভর্তি। দেয়াল জুড়ে অজস্র সরু ও মোটা তার মাকড়সার মতো জাল বুনে এঁকে-বেঁকে চলে গিয়েছে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। উত্তরদিকে ঘরের কোনায় দুটো টেবিল পাশাপাশি রাখা। হিজিবিজি অঙ্ক আর ছবি আঁকা রাশি রাশি কাগজ স্তূপীকৃত সেখানে। শব্দ ও বায়ু নিরোধক হওয়ায় ধুলোবালি এ-ঘরে ঢোকে না বললেই চলে, তবু রোজ দু-বেলা শক্তিশালী ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে আনাচ-কানাচ পরিষ্কার করেন অমলেন্দু বটব্যাল নিজে। তাঁর অনুমতি ছাড়া এই ঘরে প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি তুলসীকেও খুব জরুরি দরকারে ওয়াকিটকিতে কথা বলে নিতে হয়। জিনিসটার ব্যবহার তাকে অমলেন্দু নিজেই শিখিয়ে দিয়েছেন। এদিকে টেলিফোন লাইন আসেনি এখনও। অগত্যা তুলসীকে প্রয়োজনে সারাদিনে দু-তিনবার ওয়াকিটকিতেই যা জানাবার জানাতে হয়। বেশিরভাগ সাংসারিক প্রয়োজনের কথা। হাতের টাকা ফুরিয়েছে কিংবা খেতে বসার তাগাদা দেওয়ার জন্য। কাজে একবার ডুবে গেলে নাওয়া-খাওয়ার হুঁশ থাকে না গবেষকের। তখন ওয়াকিটকির খরখরে আওয়াজেও সাড়া দেন না। আজ অবশ্য কারণ আলাদা। ল্যাবরেটরিতে ঢুকে কোণের নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে চিন্তায় ডুবে ছিলেন অমলেন্দু বটব্যাল। তাঁর মনে একটাই প্রশ্ন নদীর ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করছিল, পরিকে কি তবে আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না?

পরির জন্মের প্রথম দিনটা ভীষণরকম আনন্দের ছিল তাঁদের কাছে। তাঁদের বলতে ড. অমলেন্দু বটব্যাল নিজে এবং তাঁর সুযোগ্য সহকারী তথা বন্ধু গবেষক ওশিনেরি ওসুমি। সমস্ত পৃথিবী, এমনকি জাপানেও গবেষকেরা যখন ক্লোনিংয়ের চর্চা নিয়ে আগ্রহী, কেবল তাঁরা দুজন সময়ের থেকে এগিয়ে ভাবার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। সেই ভাবনা, তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল অবশেষে প্রাণ পেয়েছিল একটা কাচের বাক্সে। এসব কিছুর শুরু হয়েছিল দীর্ঘ কুড়ি বছর আগে।

সে-সময় লন্ডনে অ্যাডভান্স সায়েন্স ইন জেনেটিক স্ট্রাকচার নিয়ে পাঁচদিন ব্যাপী বড়োসড়ো একটা সেমিনার চলছে। দেশ-বিদেশ থেকে নামকরা সব জীববিজ্ঞানী এসেছেন। সেমিনারের মূল সুর একটাই। ক্লোনিং, অর্থাৎ কোনও জীবের হুবহু এক আদর্শ প্রতিলিপি তৈরি। সেমিনারে উপস্থিত সমস্ত বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়বস্তু এক, কেবল কাজের ধরন কিছুটা আলাদা। চারদিন ধরে নিয়ে বিস্তর আলোচনার পর শেষদিন সভা শেষের মুখে ডাক পড়েছিল ভারত থেকে আসা অখ্যাত জীববিজ্ঞানী ড. অমলেন্দু বটব্যালের। কতই-বা বয়স হবে তখন তাঁর? বড়োজোর চল্লিশ। ভারতীয়রাও যে ক্লোনিং নিয়ে গবেষণা করে, এমন ধারণা সভায় উপস্থিত অধিকাংশ প্রাজ্ঞ ও খ্যাতনামা প্রতিনিধিদের ছিল না। তার ওপর সেই গবেষক আবার তুলনায় যথেষ্ট নবীন। স্বভাবতই অমলেন্দু বটব্যালের মিউটেশন নিয়ে রাখা বক্তব্যে সেভাবে কারও আগ্রহ ছিল না। যে জনাকয়েক প্রতিনিধি সভায় উপস্থিত ছিলেন, তাঁরাও অমলেন্দু বটব্যালের জেনেটিক মিউটেশন সংক্রান্ত বক্তব্য শুনে গাদা গাদা বক্রোক্তি ছুড়ে দিয়েছিলেন। বিরাট সেমিনার হলের একেবারে শেষের সারিতে বসা একজন ব্যক্তি কেবল গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছিলেন অমলেন্দুর বলা প্রতিটি কথা। অভিজ্ঞতার বিচারে তাঁকে তরুণ বলা যেতে পারে। জাপান থেকে আসা সেই মানুষটি কিন্তু সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে সম্মেলনে আসেননি, বরং অনেক কষ্টে সম্মেলনে উপস্থিত থাকার অনুমতি পত্র জোগাড় করে নিজের খরচে লন্ডনে এসেছিলেন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসায়। সেই একমাত্র শ্রোতা ছিলেন ওশিনেরি ওসুমি। সম্মেলন শেষ হতে নিজে এগিয়ে গিয়ে আলাপ করেছিলেন গবেষকের সঙ্গে। চিন্তাসূত্র মিলে যাওয়ায় সখ্য গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। দুজনের নিরলস গবেষণার ফলেই জন্মে নিয়েছিল পরি।

পরি। এক বিচিত্র প্রাণী সে। বিচিত্র কারণ সে পাঁচটি প্রাণীর শংকর রূপ। আরশোলা, মোরে ইল, সি এলিগ্যান্স, সি লায়ন আর ওরাংওটাংয়ের মিশ্র গুণ সমন্বিত এক আশ্চর্য প্রাণী। দীর্ঘ কুড়ি বছর আগে মিউটেশনের মাধ্যমে জিনে অদলবদল ঘটিয়ে সম্পূর্ণ নতুন কোনও প্রাণ সৃষ্টির বিষয়টা প্রথম মাথায় এসেছিল অমলেন্দু বটব্যালের। তাতে যোগ্য সঙ্গত করেছিলেন ওশিনেরি ওসুমি। দুই বন্ধুতে কত রাতভর গবেষণা কক্ষে কাটিয়েছেন। কখনও জাপানে, কখনও এদেশে বিরামহীন চলেছে তাঁদের গবেষণা। এক অতি উন্নত জীব সৃষ্টির জন্য নিরলস পরিশ্রম।

সবচেয়ে কঠিন ছিল এমন নতুন প্রাণ সৃষ্টির জন্য উপযুক্ত প্রাণীদের চিহ্নিত করা। অনেক হিসেব কষে পাঁচটি প্রাণীকে নির্বাচন করেছিলেন তাঁরা। আরশোলা এমন এক প্রাণী যে কয়েক হাজার বছর ধরে বদলে যাওয়া জলবায়ু, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে আজও একইভাবে বেঁচে আছে। সি এলিগ্যান্স সবচেয়ে দ্রুত তাদের কোষবৃদ্ধি করে পূর্ণতা পায়। জন্ম নিলেই তো হবে না, বেঁচে থাকতে হবে লড়াই করে। তাই বেছে নেওয়া হয়েছিল মোরে ইল মাছকে। সবকিছু যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মানুষের না হলেও তার কাছাকাছি বুদ্ধির প্রয়োজন। সুমাত্রা থেকে ছোটো মেয়ে ওরাংওটাং জোগাড় করতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। এই সমস্ত প্রাণীদের ডি.এন.এ থেকে জিনগুলোকে আলাদা করা, তারপর সেই বিশেষ গুণ সম্বলিত জিনগুলো একে একে নতুন প্রাণীর ডি.এন.এ-তে লাগানো। বহু সময় চলে গিয়েছিল সিঁড়ির প্রতিটা ধাপে জিনগুলোকে বসাতে। কোনোক্রমে তা উতরে গেলেও সমস্যা দেখা দিল অন্য জায়গায়। বিশেষভাবে তৈরি ডি.এন.এ-কে এবার কোনও প্রাণীর ডিম্বাণুর মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হবে, যাতে তার সন্তান জন্মালে সমস্ত গুণ অক্ষুণ্ণ থাকে। এখানে এসেই বার বার আটকে যাচ্ছিলেন দুই বন্ধু। অনেক পরীক্ষানীরিক্ষার শেষে একমাত্র জাপানিজ সি লায়নের শরীরে ওই মিশ্র গুণ সমন্বিত ডি.এন.এ-কে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল। ওসুমি ছিলেন বলেই জাপানের পশ্চিম সমুদ্র উপকূলে একটা ছোটো অস্থায়ী গবেষণাগার বানিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। স্থানীয়রা জানত তাঁরা সি লায়নের একধরনের রোগের ওপরে গবেষণা করছেন। ইচ্ছে করেই গোটা ব্যাপারটা গোপন করা হয়েছিল। অবশ্য তাতে যে খুব একটা লাভ হয়েছিল এমন নয়। এক বিদেশি সংস্থা গোপনে তাঁদের কাজের ওপর নজর রাখছে টের পেতে দেরি হয়ে গিয়েছিল অনেকটা। ততদিনে পরির জন্ম নেওয়ার সময় এগিয়ে এসেছে। শেষ পর্যন্ত যে পরিকে নিয়ে এদেশে ফিরে আসতে পেরেছিলেন, তার পুরো কৃতিত্বই ওসুমির। প্রথমে প্রাইভেট জেটে করে মালোয়েশিয়া। সেখান থেকে লঞ্চে করে ভারতীয় জলসীমায় ঢুকে পড়া। ভীষণ উৎকণ্ঠায় কেটেছিল কয়েকটা দিন। আর ওই কয়দিনের মধ্যে পরি বেড়ে উঠছিল দ্রুত গতিতে। সব বিপদ, ভয় কাটিয়ে দুই বন্ধু নিজেদের সৃষ্ট নতুন প্রাণকে নিয়ে নিরাপদে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু তার পরেও যে নতুন করে বিপদে পড়তে হবে ভাবতে পারেননি অমলেন্দু বটব্যাল।

গোবিন্দর কথা যদি সত্যি হয়, তাঁর আশঙ্কা যদি সত্যি হয়, তবে এই বিপদের দিনে ওসুমি পাশে থাকলে অনেক নিশ্চিন্ত বোধ করতেন ড. বটব্যাল। হয়তো সমাধানও বেরিয়ে আসত দ্রুত। কিন্তু গতকাল থেকে ওসুমির কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। জ্বলজ্যান্ত মানুষটা না বলে-কয়ে কোথায় চলে গেলেন! এ-দেশে তাঁর দেখা করার মতো কেউ আছে বলে তো জানা নেই। কোনও বিশেষ দরকারে যদি যেতেও হয়, এভাবে? তাছাড়া লাগেজগুলোও সব যেমন-কে-তেমন পড়ে রয়েছে। ওসুমির উধাও হয়ে যাওয়া রহস্যময়। দুশ্চিন্তারও বটে।

চেয়ারে বসে একমনে ভেবে চলেছিলেন গবেষক। এমন সময় সামনের টেবিলে রাখা ওয়াকিটকিতে আবার তুলসীর খড়খড়ে গলা ভেসে এল, “জেঠু, জেঠু, শুনতে পাচ্ছ? তালুকদারকাকা এসেছেন দেখা করতে। বসতে বলব? জেঠু, শুনতে পাচ্ছ?”

(পাঁচ)

uponyasbudhai (5)

অন্ধকার পুরোপুরি কেটে ওঠার আগেই নদীতে স্নান সেরে রোজকার কাজ শুরু করতে হয় নিমাই পণ্ডিতকে। কাচা ধুতিটা পাড়ে রেখে সবে জলে নামতে যাচ্ছেন এমন সময় পেছন থেকে নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়ালেন তিনি।

“ক’টা দিন ভোরবেলায় নদীর স্নান বাদ দাও হে পণ্ডিত।”

“হরদা, তুমি এত সকাল সকাল এদিকে যে বড়ো!”

“কারণ অনেক। সবটা আমার কাছে এখনও পরিষ্কার নয়। শুধু এটুকু জানি জলে বিপদ ঘাপটি মেরে রয়েছে। শুধু জলেই বলি কেন, ডাঙাতেও কম বিপদ নেই।”

“তোমরা সকলে মিলে আজকাল বড্ড হেঁয়ালি শুরু করেছ। সেদিনও হাজার গণ্ডা কথা বললে, কিছু বুঝতে পারলাম না।”

“বোঝাবুঝি পরে হবে’খন। এখন চট করে মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে শুদ্ধ হয়ে নাও দেখি। মন্দিরে দুটো ফুল-পাতা ফেলেই বেরিয়ে পড়তে হবে। বেশি দেরি হয়ে গেলে আবার খালি হাতে ফিরে আসতে হবে।”

“কোথায় যাবে সেটা তো বলবে?”

“গড়-জঙ্গলে। মকবুলের কথা শোনার পরের দিনই গিয়েছিলাম। একটু বেলা হয়ে গিয়েছিল। লোকজনও ছিল সঙ্গে। আজ শুধু তুমি আর আমি।”

মোহনা পেরিয়ে দুই প্রবীণ যখন জঙ্গলে পা রাখলেন তখন সূর্য দিগন্তরেখা ছেড়ে উঁকি দিতে শুরু করেছে। জঙ্গল বলতে বেশিরভাগই শাল। মাঝে মাঝে হিজল, কামরুল আর মাটির কাছে জবা-ধুতুরার ঝোপ। পড়ে থাকা কিছু হলুদ ভেজা পাতা মারিয়ে ঘুরপথে ভাঙা গড়ের পেছনে বেশ মোটা হিজল গাছের আড়ালে এসে দাঁড়ালেন নিমাই পণ্ডিত এবং হরনাথ মাস্টার। চুপচাপ অপেক্ষা করলেন কিছুক্ষণ। বুঝে নিতে চাইলেন আশেপাশে কোনও জনপ্রাণী রয়েছে কি না। হরনাথ নিশ্চিন্ত হয়ে আড়াল ছেড়ে বের হওয়ার আগে নিমাইকে বললেন, “তুমি এখানেই থাকো পণ্ডিত। নজর রেখো চারপাশে। কাউকে আসতে দেখলে ডাক দিও। ছোটোবেলায় তোমাকে সবাই হরবোলা বলতাম। আশা করি সে-সব পুরোপুরি ভুলে যাওনি।”

“না, হরদা। নাতিটা মাঝেমধ্যেই বায়না করে বলে গুণটা এখনও অল্প-স্বল্প টিকে আছে৷ তুমি ভেব না। ধারেকাছে কারও আভাস পেলেই মুরগির ডাক শুনতে পাবে।”

“সেটা কি ঠিক হবে? জঙ্গলে আগে কখনও মুরগি চোখে পড়েনি। যারা এখানে দু-দিন রয়েছে বিষয়টা কি তারাও খেয়াল করেনি? মুরগির নয়, তুমি বরং ঘুঘুর ডাক দিও।”

নিমাই পণ্ডিতকে সব বুঝিয়ে গাছের আড়াল ছেড়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলেন হরনাথ মাস্টার। চারপাশে আরও একবার দ্রুত চোখ বুলিয়ে টুক করে ঢুকে পড়লেন গড়ের মধ্যে। আগে অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে থাকলেও কালের স্রোতে অধিকাংশই এখন মাটির নীচে চাপা পড়েছে। মাটির ওপর জেগে থাকা অংশও ঝোপঝাড়, লতাপাতায় ঢাকা। যে কয়খানা ঘর কোনোমতে টিকে রয়েছে, তার প্রায় সবগুলোর থেকেই মাথার ওপর উঁচু শাল গাছের পাতা আর তার ফাঁক দিয়ে নীল আকাশ দেখতে পাওয়া যায়। পশ্চিমে কোণের দিকে একটা মাত্র ঘর বহুবছরের ঝড়-ঝাপটা সামলে আজও সুস্থভাবে দাঁড়িয়ে। যদিও তার ছাদের নীচে থাকাটাও যথেষ্ট বিপজ্জনক। ছোটোবড়ো ফাটলের রেখা নানা অদ্ভুত জ্যামিতিক নকশা কেটেছে ছাদের গায়ে।

কেউ যে ছিল তা আগের দিন এই ঘরে এসে টের পেয়েছিলেন হরনাথ। জমে থাকা ধুলোয় দু-জোড়া জুতোর ছাপ। একটার মাপ বেশ বড়ো। মকবুলের কথা মোতাবেক সেটা দীর্ঘদেহী আগন্তুকের হওয়া স্বাভাবিক। ছাপ ছাড়া অন্য কিছু নজরে আসেনি। আজ অবশ্য জুতোর ছাপ ছাড়াও দুটো কালো রঙের বড়ো বাক্স দেখতে পাওয়া গেল। অপরের জিনিস অজ্ঞাতে কখনও ছুঁয়ে দেখেননি তিনি। খানিক দ্বিধা ভরে বাক্সগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন হরনাথ। ভালো মানের ফাইবার বডি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ মজবুত। নাম্বার লকিং ব্যবস্থা রয়েছে। হাত দিতেই অবাক হলেন হরনাথ। বাক্সের মালিক সেটা লক করে রাখেননি! জঙ্গলে এত সকালে কারও আসার কথা নয়। হয়তো তাই নিশ্চিন্তে রয়েছে। এমনও হতে পারে হঠাৎ কোনও কারণে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে, তাড়াহুড়োতে বাক্সটা বন্ধ করার কথা আর খেয়াল ছিল না। কারণ যাই হোক, এতে যে তাঁর কিছুটা সুবিধা হল বলাই বাহুল্য। গড়-জঙ্গলে যারা লুকিয়ে রয়েছে, অকারণে মানুষদের ভয় দেখাচ্ছে, তাদের আসার উদ্দেশ্য হয়তো আন্দাজ করা যাবে।

ডালা খুলতে বাক্সের মধ্যে কালো রঙের স্পঞ্জ জাতীয় জিনিস দেখতে পেলেন হরনাথ। স্পঞ্জের গায়ে নানা আকৃতির খোপ কাটা। স্টিলের আর কাচের মিশেলে তৈরি অদ্ভুত আকৃতির সিরিঞ্জ এবং অ্যাম্পুল কিছু খোপে। বাকিগুলো ফাঁকা। গড়-জঙ্গলে ঘাঁটি গেঁড়ে বসা আগন্তুকরা যে সাধারণ কোনও উদ্দেশ্যে আসেনি, বুঝতে অসুবিধা হয় না। আরও একটা বিষয় পরিষ্কার হয় হরনাথের, লোকগুলোর কাঁকড়াপোলিতে আগমনের সঙ্গে গবেষক বটব্যালের কোনও না কোনও যোগসূত্র রয়েছে৷

প্রথম বাক্সটা বন্ধ করে দ্বিতীয়টায় হাত দিতেই চমকে যান হরনাথ মাস্টার। একইরকম কালো রঙের স্পঞ্জের গায়ে লম্বাটে চারটে ঘর। দুটো খালি। বাকি দুটোতে লম্বা নলের মতো যন্ত্র। ধরার জায়গাটা দেখলে বন্দুকের হাতল বলে মনে হয়। ট্রিগারও রয়েছে। তার ঠিক নীচে চকচকে ইস্পাতের ফলা। গোটাটা জুড়ে নিলে অনেকটা হারপুনের মতো দেখতে হবে। ছবিতে এমন অস্ত্র দেখেছেন হরনাথ। জলের নীচে হাঙর বা ওই জাতীয় প্রাণী শিকার করতে ব্যবহার হয়। তবে কি লোক দুটো বুধাই নদীর বিপজ্জনক জন্তুকে মারার জন্য এসেছে? তাহলে তো তাদের শত্রুপক্ষ বলা যায় না! কিন্তু উদ্দেশ্য সাধু হলে বন্দুক নিয়ে ভয় দেখাবে কেন? উত্তর খুঁজতে এসে নতুন করে আরও প্রশ্ন ভিড় জমাতে শুরু করে হরনাথ সমাদ্দারের মাথায়। হঠাৎ কাছাকাছি কুব কুব ডাক শুনতে পাওয়া যায়। বিপদ বুঝলে নিমাই পণ্ডিতের ঘুঘু পখির ডাক দিয়ে জানান দেওয়ার কথা। দ্রুত বাক্স বন্ধ করে বেরিয়ে আসেন তিনি। হরনাথের মন বলছে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর রয়েছে গবেষকের কাছে।

গড়-জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নিমাই পণ্ডিতকে পৌঁছে দিয়ে হরনাথ মাস্টার যখন বিশ্বম্ভর তালুকদারের বাড়ি পৌঁছলেন, ততক্ষণে বেলা কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে। বাড়ির দরজা বন্ধ দেখে এখন কী করা উচিত ভাবতে কিছুটা সময় নিলেন তিনি। দেশে ফেরা ইস্তক অমলেন্দুর চিড়িয়াখানায় পা রাখেননি। আবাল্যকাল থেকে পুষে রাখা অভিমান চোরা স্রোতের মতো আজও বয়ে চলেছে তিরতির করে। তালুকদারকে গতকাল বলেছিলেন গবেষকের সঙ্গে দেখা করার কথা, যদি গ্রাম জুড়ে ঘটে চলা অঘটনের কিছু তত্ত্বতল্লাশ পাওয়া যায়। হয়তো সেখানেই গিয়েছে। সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা সময় নিলেন হরনাথ। তারপর চিড়িয়াখানার দিকে পা বাড়ালেন।

গবেষক অমলেন্দু বটব্যালের বৈঠকখানায় বসে ছিলেন বিশ্বম্ভর তালুকদার। বৈঠকখানা হলেও এই ঘরে কাচের জার বা ঘন বুননের জালবন্দি খাঁচায় সাদা ইঁদুরের দেখা মেলে। লোকজন এলে তাদের বসার জন্য বেতের মোড়া রয়েছে খান চারেক। তারই একটায় বসে আনাচে-কানাচে নজর বোলাচ্ছিলেন তালুকদার। একটু আগে তুলসীর দিয়ে যাওয়া বিটকেল স্বাদের চায়ে একবার ঠোঁট ছুঁইয়ে দ্বিতীয়বার তাতে চুমুক দেওয়া ঠিক হবে কি না স্থির করে উঠতে পারেননি এখনও। প্রায় ভর্তি পেয়ালাটা তাঁর ডানহাতে ধরা ছিল। গবেষকের গুরুগম্ভীর স্বরে সেখান থেকে কিছুটা চা চলকে পড়ে তালুকদারের আধময়লা সাদা পাজামায়।

“হোয়াইট টি। কুঁড়ি ফোটার আগেই পাতা তুলে ফেলা হয়। সঠিক উষ্ণতায় না ফোটালে এর স্বাদ-গুণ বজায় রাখা কঠিন।”

“সাদা চা! তা হবেও বা। কোনোদিন খাইনি কিনা, তাই গরম জল মনে হচ্ছে। স্বাদ একটা আছে বটে, তবে… চায়ের কথা থাক অমলদা। চারদিকে যা হচ্ছে সে-সম্পর্কে কি আপনার কোনও ধারণা আছে?” পেয়ালাটা পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে বলেন বিশ্বম্ভর তালুকদার।

তাঁর বলার সুরে কোথাও একটা উদ্বেগ ধরা পড়ে যা ছুঁয়ে যায় গবেষককেও—“কোন অঘটনের কথা বলছ বিশ্বম্ভর? আমি সারাদিন নিজের রিসার্চের কাজ নিয়ে পড়ে থাকি। এই চৌহদ্দির বাইরে কী ঘটছে তার খবরাখবর রাখার সময় পাই না। অবশ্য গত কয়েকদিন ধরে আমিও কিছু আভাস পাচ্ছি। গ্রামের লোকজন কি সমস্যায় পড়েছে?”

“সমস্যা নয় অমল, বরং বিপদ বলা যেতে পারে।”

দরজার বাইরে থেকে বলা হরনাথ মাস্টারের কথা শুনে কৌতূহলী চোখে তাকালেন দুজনেই। পুরোনো মান-অভিমান ভুলে, সমস্ত দ্বিধা সরিয়ে রেখে তিনিও আজ অমলেন্দু বটব্যালের বৈঠকখানায় হাজির হয়েছেন। দু-জোড়া চোখ তাঁর দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে বুঝতে পেরে গলা খাঁকারি দিয়ে আবার বলতে শুরু করেন হরনাথ সমাদ্দার, “গ্রামে এক ভয়ংকর উভচর প্রাণীর উপদ্রব শুরু হয়েছে। শিবেনের বলদটার হাড় থেকে চেঁছেপুঁছে মাংস খেয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে এলাকায় দুজন উটকো লোক হাজির হয়েছে। তাদের কালো বাক্সে হারপুন জাতীয় অস্ত্র, বন্দুকের মতো দেখতে সিরিঞ্জ, নানারকমের ওষুধের অ্যাম্পুল। লোক দুটো যে নিছক চোর-ডাকাত নয় সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তাদের কোনও বিশেষ অভিসন্ধি রয়েছে এবং তা ওই জন্তুটার সঙ্গে যুক্ত। আর এই সবকিছুর সঙ্গে তোর গবেষণার সম্পর্ক রয়েছে বলে আমার অনুমান। অমলকে কি জিনিসগুলো দেখিয়েছ তালুকদার?”

হরনাথ মাস্টারের কথা শেষ হতে তাড়াতাড়ি বাজারের ব্যাগে করে নিয়ে আসা জাপানি সাহেবের টুপি আর বাতিটা বের করে মেঝেতে রাখেন বিশ্বম্ভর তালুকদার।

“এগুলো তো ওসুমির! সে কোথায়?” জিনিসগুলো দেখে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন অমলেন্দু বটব্যাল।

গবেষকের প্রতিক্রিয়া যে এমন হবে, কিছুটা আন্দাজ করেছিলেন হরনাথ নিজেও। তিনি স্বভাবোচিত শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, “মাথা ঠান্ডা রাখ অমল। বিপদে যে সে পড়েছে তা নিয়ে আমাদের কোনও সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হল, কতটা বিপদ। তুই কি এ-বিষয়ে আলোকপাত করতে পারিস? জানি তুই কাজের মানুষ, আমাদের সে অর্থে বেকারদের দলেই ফেলা চলে। তোর মতো বিদ্যাবুদ্ধিও নেই। তবে যতটুকু আছে তাতে মনে হচ্ছে গ্রামের মানুষগুলো নিরাপদে নেই। তোর কাছে আসার কারণ সেটাই।”

“আমি নিজেও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না হর। পুরোটা না শোনা পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। তোরা যে বিপদের কথা বলছিস তার সঙ্গে আমার রিসার্চের যদি সত্যিই কোনও যোগসূত্র থাকে, তবে তা ইচ্ছাকৃত নয় রে। বিশ্বাস কর, আমি কখনও কাউকে বিপদে ফেলতে চাইনি।”

কথাগুলো বলতে গিয়ে গলার স্বর কেঁপে যায় গবেষক অমলেন্দু বটব্যালের। মোড়ায় বসে দুই প্রাক্তন সহপাঠীর আপাত শান্ত অথচ আবেগ-সিঞ্চিত কথোপকথন প্রত্যক্ষ করছিলেন বিশ্বম্ভর তালুকদার। হাতে ধরে রাখা চা তার উষ্ণতা হারিয়েছে অনেক আগেই। পেয়ালায় এক চুমুক দিয়ে মনঃস্থির করেছিলেন, বাকিটা বরং অনাস্বাদিতই থাক। পরে গবেষকের মুখে সাদা চায়ের গুণাগুণ শুনে হয়তো সে-সিদ্ধান্ত বদলেও ফেলেছিলেন তালুকদার। দুই সহপাঠীর কথা শুনতে শুনতে কখন যে অজান্তেই নামিয়ে রাখা পেয়ালা হাতে তুলে নিয়েছিলেন নিজেও টের পাননি। এবার প্রায় ওষুধ গেলার মতো ঢক করে পুরোটা গলায় ঢেলে উঠে দাঁড়ালেন বিশ্বম্ভর তালুকদার।

“নাও, এবারে দুই বন্ধুতে মিলে জুতসই একটা প্ল্যান বানিয়ে ফেলুন তো দেখি। ওই হাড়বজ্জাত লোক দুটোর সঙ্গে মৎসকন্যাকেও যাতে জব্দ করা যায়। আমি ততক্ষণে মকবুল আর রাধাকান্তদাকে জরুরি সভার এত্তেলা দিয়ে আসি। একটা অনুরোধ ছিল অমলদা। জাপানি সাহেবের নীল বাতিখানা দিন কয়েকের জন্য নিতে পারি?”

গবেষকের অনুমতির অপেক্ষা না করেই বাতিটা নিজের থলেতে পুরে বৈঠকখানা ছাড়লেন তালুকদার। তিনি বেরিয়ে যেতে বেশ চিন্তান্বিত সুরে বললেন অমলেন্দু বটব্যাল, “আমি ভীষণ উৎকণ্ঠায় আছি রে হর। পুরোটা তোকে হয়তো বোঝাতে পারব না। ওসুমি থাকলে সুবিধা হত। একা বড়ো দুর্বল লাগছে রে।”

“অত ভাবিস না। কিছু বুঝি বা না বুঝি, আমরা সবাই তোর সঙ্গে রয়েছি। আমারও অনেক কথা আছে তোর সঙ্গে। আমি নিশ্চিত, এই বিপদ থেকে পরিত্রাণের একটা উপায় তুই ঠিক খুঁজে পাবি। শান্ত থাক। ভরসা রাখ নিজের ওপর।”

(ছয়)

uponyasbudhai (6)

তখন সবে সন্ধে নেমেছে। আজ আর নামাজ শেষে গড়-জঙ্গলের রাস্তা নেয়নি মকবুল। ভয় নয়, বরং সাবধানতার কারণে সে বুধাই নদী পেরিয়ে হজরত মুন্সির দরগায় এসেছিল। ফেরার সময়ও একই পথ ধরেছে। দু-দশজন মানুষের মহড়া নেওয়ার ক্ষমতা ছিল তার এককালে। কিন্তু এখন সাহস নয়, বুদ্ধি খাটিয়ে চলার কথা বলে দিয়েছেন হরনাথ মাস্টার। দুপুরবেলায় বিশ্বম্ভর তালুকদার এসে বলে গিয়েছিলেন গবেষকের চিড়িয়াখানায় রাতে নাকি জরুরি আলোচনা রয়েছে। হরদা, রাধাকান্তদা, এমনকি নিমাই পণ্ডিতও থাকবেন। আর থাকবেন অমলেন্দু বটব্যাল নিজে।

জোরে পা চালিয়ে নদীর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল মকবুল। তার নিজের ছোটো ডিঙিখানা মাছ ধরার কাজে আর লাগে না। ছেলেরা এখন বড়ো লঞ্চে করে সমুদ্রে যায়। গ্রাম থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে মেছুনিদের বন্দর রয়েছে। হপ্তা ভর সেখানেই থাকতে হয় তাদের। দুই ছেলে মাঝেমধ্যে বদলা-বদলি করে আসে আব্বাকে দেখতে। একা থাকা কতকটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে মকবুল মিঞার। ছেলেরা বলে, “কেন ভাঙা চালে একা পড়ে থাকবে? তার চেয়ে আমাদের সঙ্গে চলো। পাকা দালান। ছোটো হলেও মাথার ছাদ তো পোক্ত। তোমার থাকার কোনও অসুবিধা হবে না। তাছাড়া তুমি গেলে আমাদের চিন্তাও কমে।”

“না রে বেটা। এই ভাঙা চালে তোদের আম্মির কত স্মৃতি এদিক ওদিক ছড়িয়ে। দালানের ওইখানে উনুনে রান্না করত সে। ওই যে টিনের তোরঙ্গখানা, ওতে তার কাপড়, চুলের ফিতে, সাজের জিনিস রাখা। আজও যখন বেড়া ঠেলে দালানে পা রাখি, মনে হয় তোদের আম্মি পান সেজে বসে রয়েছে৷ এই শেষের দিনে শুধু ওই স্মৃতিগুলোই বাঁচিয়ে রেখেছে আমায়। নইলে এ-জীবনে আর আছেটা কী বল? আমি যেতে পারব না রে। এই ভাঙা চাল, এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও গিয়ে আমি শান্তি পাব না।”

মকবুল তার ভাঙা চাল, গ্রামের টান উপেক্ষা করে যেতে পারেনি। চুল্লিতে নিজেই দুটো চাল ফুটিয়ে নেয়। আলু ফেলে দেয় তার মধ্যে৷ আলুসেদ্ধ-ভাত আর তার সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা পেঁয়াজ—এই হচ্ছে তার দিন-রাতের মেনু। নিমাই পণ্ডিতের সঙ্গে দৃশ্যত ততটা সদ্ভাব না থাকলেও যেদিন পুজোতে বা যজমানি করে ফল-মিষ্টি দুটো বেশি জোটে, ফিরতি পথে তার ভাঙাচোরা সাইকেল নিয়ে হাজির হন তিনি। বেড়ার বাইরে থেকেই বলেন, “মকবুল আছ নাকি? তাড়াতাড়ি এস দেখি। আজ আর কষ্ট করে রাতে হাঁড়ি চড়াতে হবে না। ফলার খেয়ে কাটিয়ে দিও। ঘরে খই আছে তো, নাকি?”

“তা আছে, কিন্তু তুমি শুধুমুধু কষ্ট না করলেও পারতে।”

“এ-পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম, তাই… আমার ভাগেরটা তোমায় দিচ্ছি ভেব না। নেহাত আজ পুজোয় ফল-মিষ্টি আজ একটু বেশি পড়েছে তাই। নাও নাও, ধরো দেখি।”

উত্তর জানা থাকলেও মকবুল ছোঁয়া বাঁচিয়ে ফল-মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে সেই এক প্রশ্ন করে, “এট্টু জল-বাতাসা খেয়ে যাও না কেন? সারাদিন রোদ্দুরে সাইকেল নিয়ে চরকি পাক ঘুরছ। জল খেয়ে শরীর ঠান্ডা করে যেও।”

“রাম রাম, কী যে বলো! ব্রাহ্মণ হয়ে মুসলমানদের ঘরে জলগ্রহণ করব! জাত যাবে যে। কোন মুখ নিয়ে ঠাকুরের সামনে বসব? না হে, ইহজন্মে তোমার দাওয়াতে পা রাখা হবে না আমার।”

কথাগুলো বলে তাঁর উঁচু সাইকেলে বসে লড়ঝড়ে আওয়াজ তুলে চলে যায় নিমাই পণ্ডিত। মকবুল দাঁড়িয়ে হাসে আর ভাবে, কোনটা সত্যি? পুজোর ফল-মিষ্টি তাকে দিয়ে যাওয়া, নাকি বে-জাতের দাওয়াতে পা রাখতে না পারা। সত্যি যাই হোক, নিমাই পণ্ডিত এবং মকবুল মিঞার অম্লমধুর সম্পর্কের কথা অজানা নয় কারও। নামাজ শেষে ফেরার পথে মকবুল ভেবেছিল পণ্ডিতের বাড়ি হয়ে যাবে। মানুষটা নাকি বেশ ভয়ে ভয়ে রয়েছে। সন্ধের পর উঠোনেও পা রাখছে না। মকবুল জানে সে পাশে থাকলে পণ্ডিত ভরসা করে গবেষকের চিড়িয়াখানা পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারবে।

সেই মতোই নদীর কাছাকাছি চলে এসেছিল মকবুল মিঞা। ডিঙি এ-পাড়ে বাঁধা রয়েছে৷ জল পার হয়ে দু-কদম হাঁটলেই ও-পাড়ে নিমাই পণ্ডিতের বাড়ি। এমন সময় আচমকা গন্ধটা নাকে এল তার। তীব্র আঁশটে গন্ধে ভরে যাচ্ছে চারপাশ। ভালো করে নজর করতেই চোখে পড়ল, একটু দূরে নদীর ধার ঘেঁষে দুটো নীল আলোর বৃত্ত নড়াচড়া করছে। ঠিক নীল নয়, কিছুটা শ্যাওলা-সবুজ রঙ মিশে রয়েছে। আগুপিছু ভাবনা মকবুলের বরাবরই কম। তায় আজকাল আবার সে পাকা বাঁশের তেল চুকচুকে লাঠিটা কাছ ছাড়া করে না। সেই লাঠির গাঁটগুলোতে লোহার বেড় পরানো। মাথাতেও গোল লোহার টুপি। মকবুলের লাঠির ঘায়ে বড়োসড়ো পাথরের গায়েও চিড় ধরে যেতে পারে৷ এই অস্ত্রটি সঙ্গে থাকলে মকবুল একা হাতে দশজনের মহড়া নিতে পারে। আলোর নিশান চোখে আসা মাত্র তার গত শুক্রবারে গড়-জঙ্গলের ঘটনাটা মনে পড়ে যায়। সেদিন যদি লাঠিটা হাতে থাকত, সামনের অস্ত্রধারীকে জোর শিক্ষা দিত সে। তবে আজকের দিন আলাদা। আজ আর সে নিরস্ত্র নেই। সেই লোক দুটো হলে সব পাওনাগণ্ডা সুদ সহ চুকিয়ে দেবে।

আধো অন্ধকারে ফাঁকা-ফাঁকাভাবে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর আড়াল নিয়ে নিঃশব্দে যতটা সম্ভব দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে মকবুল। একটু আগে যেমন হঠাৎ করে উৎকট গন্ধটা হাজির হয়েছিল, আবছা হয়ে গেছে তেমনভাবে। নীল আলোর বৃত্তদুটোও নড়তে নড়তে ছোটো হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে লোক দুটো দৌড়াচ্ছে। মকবুলও হালকা চালে ছুটতে শুরু করে। তার পায়ের ধাক্কায় সরে যাওয়া শুকনো পাতায় সড়সড় আওয়াজ হতে থাকে।

মিনিট দশেক ছোটার পরে মকবুলের মনে হয় প্রতিপক্ষ বোধ হয় তার উপস্থিতি টের পেয়ে গিয়েছে। আলোর নিশান আর দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারও গাঢ় হয়েছে কিছুটা৷ যদিও তাতে মকবুলের কোনও সমস্যা নেই। এখানকার মাটি, বাতাস সবকিছুর সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক। ছোটা থামিয়ে এবারে মেপে পা ফেলতে থাকে মকবুল মিঞা। দু-পা আরও এগোতে ভুস করে একটা আওয়াজ কানে আসে। মকবুল বুঝতে পারে তার কানের পাশ দিয়ে ‘সোঁ’ শব্দে কিছু ছুটে গিয়ে শব্দ করে গেঁথে গেল পাশের শাল গাছের গায়ে। বিপদ বুঝে এবার আড়াল নেয় মকবুল। উলটোদিক থেকে গুলি ছুড়ছে নির্ঘাত। কিন্তু গুলি চালাবার কোনও শব্দ নেই কেন! অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে জায়গা বদল করে নেয় মকবুল। তারপর চিতাবাঘের মতো ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় শিকারের দিকে। মোটা গাছের পেছনে লুকিয়ে থাকলেও দশাসই চেহারাখানা তার নজর এড়ায়নি। ওই লোকটাই সেদিন তার গলায় বন্দুক ঠেকিয়েছিল। গাছের আড়াল থেকে মাঝে মাঝে মুখ বের করে অনুসরণকারীর হদিস নিতে চাইছে। কয়েক হাত সন্তর্পণে এগিয়ে গিয়ে হাঁক পাড়ে মকবুল, “খবরদার!”

ভারি গলার স্বর নদী-তীরের নিস্তব্ধতা চিরে গমগম করে ওঠে। ঠিক যেমন ভেবেছিল, তার গলার আওয়াজে লোকটা আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। ঝাপসা হলেও মকবুল দেখতে পায়, লোকটার ডানহাত সামনে বাড়িয়ে রাখা। আর অপেক্ষা করে না সে। হাতের পাকা বাঁশের লাঠিটা ছায়া শরীর লক্ষ্য করে ছুড়ে মারতেই আলতো শব্দ শুনতে পাওয়া যায়, “ওহ্!”

নির্ভুল ঠিকানায় আঘাত করার পরেই এবার ক্ষুধার্ত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মকবুল।

যত সহজ হবে ভেবেছিল মকবুল, আসরে নামার পর বুঝতে পারল আসলে তা নয়। সামনের লোকটার গায়ে ষাঁড়ের মতো জোর। লাঠির ঘা খেয়েও দমেনি এতটুকু! বয়সের সঙ্গে তার মনের জোর না কমলে কী হবে, শারীরিক সক্ষমতায় সে প্রতিপক্ষের তুলনায় পিছিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাঁফাতে শুরু করল মকবুল। লোকটা তাকে চিত করে বুকে উঠে আসতে চাইছে। পায়ের কাছে একটা গাছের গুঁড়ি পেতে জোর ধাক্কা দেয় সে। এখান থেকে মাটি কিছুটা ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে নদীতে। পায়ের ধাক্কায় দুজনেই গড়িয়ে নেমে যেতে থাকে নদীর দিকে, আর তখনই আবছা হয়ে যাওয়া উৎকট গন্ধটা আবার জেগে ওঠে। সঙ্গে একটানা অদ্ভুত সুর।

শব্দগুলো কানে যেতেই ঠান্ডা যেন এক ধাক্কায় কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে মনে হয় মকবুলের। ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার সময় নিজেকে আলগা করে নিয়েছিল মকবুল। গড়িয়ে পড়তে পড়তে সামলেও নিয়েছিল। লোকটার শরীর ভারী হওয়াতে বোধ হয় তার চেয়ে একটু বেশি নেমে গিয়েছে৷ জলের কাছে আধশোয়া শরীরটা দেখতে পেয়ে আবার নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা ভেবেছিল বটে, কিন্তু সুরের মূর্ছনা বাড়তে মকবুলের শরীর জুড়ে কেমন ঝিমঝিমে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ঘুম পাচ্ছে এই অসময়ে! নিভে আসা চোখের দৃষ্টিতে জল থেকে এক অদ্ভুতদর্শন চারপেয়ে জন্তু উঠে আসা দেখতে পায় সে। জন্তুটা থমকে দাঁড়াল একবার। চোখের পাতলা স্বচ্ছ পর্দা খোলা আর বন্ধ হওয়ার মাঝে মকবুল দেখে ভয়াল দর্শন প্রাণীটার বড়ো মার্বেল গুলি মাপের চোখের মণি দুটো অন্ধকারেও যেন নীল আগুনের শিখার মতো জ্বলছে। দু-পায়ে ভর দিয়ে সেটা এগিয়ে যায় একটু দূরেই আধশোয়া শরীরের দিকে। লোকটাও বোধ হয় তার মতো নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়েছে। হঠাৎ পেছনে জোরালো আলো ঝলসে ওঠে৷ চোখে পুরোপুরি অন্ধকার নেমে আসার আগে মকবুল পলকের জন্য জন্তুটাকে দেখতে পায়। গায়ের চকচকে আঁশে আলো পিছলে যাচ্ছে৷ সামনের ছোটো পা দুটো হাতের মতো বাড়িয়ে ধরা। কানের কাছটায় বড়ো ফুলকা মতো। অদ্ভুত সুর বোধ হয় সেখান থেকেই বেরিয়ে আসছে। সবচেয়ে ভীষণ তার জিভ। ব্যাঙের মতো উলটো হয়ে লেগে থাকা বিশাল জিভে অগুনতি চোষক। প্রচণ্ড শব্দের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মকবুল।

বন্দুকের আওয়াজ বাতসে ভর দিয়ে নদীর এ-পাড়েও পৌঁছে গিয়েছিল। নিমাই পণ্ডিত মকবুলের অপেক্ষা করতে করতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন। শেষমেশ আর ধৈর্য রাখতে না পেরে গায়ে চাদর আর তার নীচে পৈতেটাকে শক্ত হাতে ধরে গায়ত্রী মন্ত্র জপতে জপতে নেমে এসেছিলেন রাস্তায়৷ মৃদু হলেও বেসুরো সুর কানে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। আচমকা আলোর ঝলকানি দিয়ে শব্দ আর তার সঙ্গে সুতীব্র জান্তব চিৎকার হতে পরনের ধুতিটাকে হাঁটু পর্যন্ত তুলে ধরে ছুটতে শুরু করেছিলেন অমলেন্দু বটব্যালের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

গবেষণা ঘরে সারাদিন ধরে জরুরি আলোচনায় মগ্ন ছিলেন কিশোরবেলার দুই বন্ধু। হরনাথকে তাঁর রিসার্চের প্রতিপাদ্য এবং পরির কথা যতটা সম্ভব বুঝিয়ে বলেছেন। সবকথা শোনার পর গ্রামের মাস্টারমশাই বলেছিলেন, “প্রকৃতির তৈরি একটার পর একটা নিয়ম আমরা বিজ্ঞান সাধনার নামে ভেঙে চলেছি। মানুষ যে কবে থামা শিখবে। থাক এখন এসব কথা, বরং বল এই বিপদ থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়। তোর পরি যে খিদের তাড়নায় যা পাচ্ছে, যাকে পারছে খেতে শুরু করেছে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই আর। তাকে আটকানো দরকার।”

“শুধু পরিকে নয় রে হর, আমার মনে হয় যে বিদেশি সংস্থার ভয়ে আমাদের চলে আসতে হয়েছিল, তারাও পিছু ধাওয়া করে এখানে চলে এসেছে। ওদের হাতে যদি আমাদের গবেষণার কাগজপত্র পড়ে তবে সর্বনাশ।”

“পুড়িয়ে ফেল। নষ্ট করে দে সমস্ত তথ্য যা দিয়ে এমন রাক্ষস তৈরি করা যায়। ফর গড সেক অমল, পৃথিবীকে নতুন কোনও বিপদে ফেলিস না।”

“নষ্ট করে দেব! আমার এতদিনের রিসার্চ, স্বপ্ন পুড়িয়ে ফেলব!”

“তোর স্বপ্নের হাত ধরে ভয়ংকর সর্বগ্রাসী এক শক্তি যদি চারদিক তছনছ করে দেয়, শান্তি পাবি তো? আরও অনেকে আসবে তোর রিসার্চের লোভে, ঠেকাতে পারবি তো সবাইকে?”

কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিলেন গবেষক অমলেন্দু বটব্যাল। নিজের স্বপ্ন, পরিশ্রমের এমন পরিণতি মেনে নেওয়া সহজ নয়। তবুও মনকে রাজি করাতে কিছুটা সময় নিয়ছিলেন গবেষক। তারপর লঘু স্বরে বলেছিলেন, “কোনোভাবে পরি কিংবা ওর এক ফোঁটা রক্তও যদি ভুল হাতে পড়ে তাহলে ঘোরতর বিপদ। আমাদের সবার আগে পরিকে খুঁজে বের করা দরকার।”

“কিন্তু কীভাবে? আর যদি-বা পাওয়া যায়, জন্তুটার ডাক কানে গেলেও তো…”

“কানের ডিভাইসটা সেই কারণেই তৈরি করা। পরির গলার স্বরের একেবারে বিপরীত শব্দ তরঙ্গ বিপজ্জনক সুরকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।”

“আর নীল আলোটা বুঝি ওকে ডাকার জন্য?”

“ঠিক ধরেছিস। পরি মাত্র দু-সপ্তাহে এত দ্রুত বড়ো হয়ে গিয়েছিল যে ঘরের অ্যাকুরিয়ামে ওকে আর রাখা সম্ভব হয়নি। নদীতে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। দিনের আলোয় কিন্তু ও এদিকে আসে না। জোয়ারের সময় সমুদ্রে চলে যায়। রাতে জল বাড়লে আবার ফিরে আসে নদীতে। তখন নীল আলো জ্বালিয়ে ওকে ডেকে আনি।”

“তাহলে আর দেরি করে লাভ নেই অমল। আজ রাতেই যা করার করে ফেলতে হবে। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। সকলে ভীষণরকম আতঙ্কিত। বড়ো কোনও অঘটন হওয়ার আগে পরিকে থামানোর কোনও উপায় বের কর।”

সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল পরির জন্য বিশেষ ঘুমপাড়ানি ওষুধ তৈরি করতে। এমনিতেও দ্রুত জীবনচক্রের শেষদিকে চলে এসেছে সে। পড়ে থাকা ক’টা দিন তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখাই সাব্যস্ত করেছিলেন অমলেন্দু বটব্যাল। জন্মদাতা হিসেবে নিজের সন্তানকে মেরে তো আর ফেলা যায় না।

বন্ধু যখন গবেষণা কক্ষে ব্যস্ত, হরনাথ বুড়ো রামলালকে নিয়ে নেমে পড়েছিলেন পুকুরের আগাছা সাফ করতে। সে-সব সেরে-সুরে দুপুরে হেলেঞ্চা শাক আর কই-তেল দিয়ে এক থালা ভাত খেয়ে ওঠার পর বেজায় ঘুম পেয়েছিল তাঁর। গবেষকের চিড়িয়াখানায় শোওয়ার ঘর বলতে কিছু নেই। তুলসী তাই তার পুরোনো মাস্টারমশাইকে নিজের ঘরেই বিছানা করে দিয়েছিল। অনেকদিন পর একটা আস্ত দুপুর ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলেন হরনাথ। সন্ধে হতে বারান্দায় বসে তুলসীর করে আনা সাদা চায়ে চুমুক দিতে দিতে রাতের পরিকল্পনা ছকে নিচ্ছিলেন, এমন সময় গেট পার হয়ে নিমাই পণ্ডিতকে হনহনিয়ে আসতে দেখা গেল। তাঁর ভাবগতিক বলে দিচ্ছিল গুরুতর কিছু হয়েছে৷ মুখটা ভয়ে পাংশুটে৷ শীতের সন্ধেতেও দরদরিয়ে ঘামছেন পণ্ডিত। এক পায়ে চটি থাকলেও অন্য পা যে মাটিতে, উত্তেজনায় তারও বোধ নেই!

নিমাই পণ্ডিতের অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন স্বরেই প্রশ্ন করলেন হরনাথ মাস্টার, “কী হল নিমাই, এত হাঁফাচ্ছ কেন? কুকুর-টুকুর তাড়া করেছিল নাকি?”

ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় নিলেন পণ্ডিতমশাই। হরনাথের পাশে রাখা জগের প্রায় পুরো জলটাই উপুড় করে দিলেন নিজের গলায়। তারপর অগোছালোভাবে যা বললেন, শুনে আর বসে থাকতে পারলেন না গ্রামের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক। “তুমি বসো পণ্ডিত। আমি অমলকে ডেকে আনি। আর অপেক্ষা করা যাবে না। মকবুলের জন্য বড়োই চিন্তা হচ্ছে।”

(সাত)

uponyasbudhai (7)

ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁক গলে আধখানা বাঁকা চাঁদের যতটুকু আলো এসে পড়ছে মাটিতে, তাতে পথ চলতে অসুবিধা হচ্ছে না কারও, কেবলমাত্র গবেষক ছাড়া। হরনাথ মাস্টার তাই লন্ঠন হাতে বন্ধুর পাশে পাশে হাঁটছেন। তাঁদের পেছনেই রয়েছেন বিশ্বম্ভর তালুকদার এবং নিমাই পণ্ডিত। অন্য অনেক কিছুর মতো কোনও এক কালে কারও কাছ থেকে একখানা বর্শা ধার নিয়েছিলেন। আজ রাতের অভিযানে গোটা দলটার অস্ত্র বলতে একমাত্র সেটি। অবশ্য প্রয়োজনে তার জং ধরা ফলা আর ঘুণ ধরা দেহ কতটা কাজে আসবে তা বলা ভারি মুশকিল। নিমাই পণ্ডিত তবুও সেই আশ্বাসে তালুকদারের পাশে। অস্ত্র অবশ্য আরও একখানা রয়েছে। অমলেন্দু বটব্যালের নতুন তৈরি করা ঘুমপাড়ানি ওষুধ। তবে সেটিও বর্শার মতো দরকারে আদতে কাজে আসবে কি না তার পরীক্ষা করার সুযোগ মেলেনি। প্রত্যেকের কানেই গবেষকের দেওয়া বিশেষ কানপট্টি, যাতে পরির গানের সুরে মূর্ছিত না হয়ে যান কেউ।

মোহনা পার হয়ে গড়-জঙ্গলে পা রাখতে সবাইকে সাবধান করে দিলেন হরনাথ, “লন্ঠন নিভিয়ে দিতে হবে। খুব সাবধান, কেউ যেন টের না পায়। পণ্ডিত, তোমার অনুমান আওয়াজটা ভাঙা গড় ছাড়িয়ে নদীর দিক থেকে এসেছে তো?”

“তেমনই তো মনে হল। শুধু আওয়াজ নয়, জোরালো আলোও দেখেছিলাম। নীল রঙের।”

“বেশ, তবে তাড়াতাড়ি পা ফেলে চলো। অমল তুই রেডি থাকিস। যদি পরির সামনাসামনি হতে হয় তবে তোর ওষুধই একমাত্র ভরসা।”

“মকবুলের কিছু হয়নি তো হরদা?”

নিমাই পণ্ডিতের আকুল প্রশ্নের সঠিক জবাব খুঁজে পেলেন না হরনাথ মাস্টার। একই দুশ্চিন্তা তাঁর মনেও ঝড় তুলেছে। তবুও নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললেন, “ঈশ্বরকে ডাকো পণ্ডিত, তার যেন কোনও ক্ষতি না হয়।”

ভাঙা গড়ের কাছাকাছি আসতে গাছের ফাঁক দিয়ে আলোটা নজরে আসে সকলের। অপর পক্ষের লোকেরা ভাবতে পারেনি এত রাতে কেউ এখানে আসবে, নইলে নিশ্চিন্তে আলো জ্বালিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিত না। কয়েক পা এগোতেই অন্ধকার ফুঁড়ে কেউ হাজির হয় হরনাথদের সামনে। রাতের অন্ধকারে জঙ্গল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা গবেষকের ইতিপূর্বে ছিল না। তাছাড়া বিপদ আশেপাশে ঘাপটি মেরে থাকায় মন অস্থির হয়ে ছিল। আচমকা একটা ছায়া শরীরকে সামনে দেখে ঘাবড়ে চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলেন তিনি। তাঁকে থামিয়ে সামনের অন্ধকার মেখে থাকা লোকটা হিসহিসে গলায় বলে, “অমলদা চেঁচিও না, আমি মকবুল।”

“মকবুল! তুমি ঠিক আছ?”

“আমি ঠিক আছি হরদা। কিন্তু আপনাদের এখানে আসা ঠিক হয়নি। শিবেনদার বলদ আর জাপানি সাহেবকে যে জন্তুটা খেয়েছে, সে অতি ভয়ংকর।”

“ওর নাম পরি। ওকে এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”

গবেষকের কথা শুনে অবাক হয়ে যায় মকবুল মিঞা। অমন বিভীষিকাময় চেহারা যার, তার নাম পরি! নাম যাই হোক, সে যে কী করতে পারে তা তো নিজের চোখেই দেখেছে। ষণ্ডামতো যে লোকটার সঙ্গে তার হাতাহাতি হচ্ছিল, এখনও পড়ে রয়েছে নদীর পাড়ে। অবশ্য অর্ধেক। কোমরের নীচ থেকে বাকি অর্ধেক ওই দানবটা নিপুণ দক্ষতায় চেঁচেপুঁছে খেয়ে গিয়েছে। সেই বীভৎস মৃত্যু দেখার পর স্বাভাবিকভাবেই বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল মকবুল। আগেকার অকুতোভয় ভাবও উধাও হয়ে গিয়েছে।

ব্যাপার বুঝে মকবুলকে শান্ত হতে বললেন হরনাথ, “আমরা সবাই আছি মকবুল। ভয় পেও না। অমল জানে কীভাবে জন্তুটাকে বশ করা যায়।”

“প্লিজ হর, তোরা বার বার ভুলে যাচ্ছিস ওর একটা নাম আছে।”

“জানি। আর এটাও জানি নিজের সৃষ্টির ওপরে সন্তানসম মায়া রয়েছে তোর। কিন্তু অমল, সন্তানের কারণে যদি অন্যদের প্রাণসংশয় দেখা দেয়, তবে তার প্রতিকারের দায়ভারও তোর। প্রয়োজন হলে…”

মকবুল, নিমাই পণ্ডিত, তালুকদার কেউই কথাগুলোর বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারছিলেন না। শুধু অনুমান করছিলেন ওই ভয়ংকর উভচর প্রাণীর সঙ্গে তাঁদের অমলদার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তবে শেষ না করা কথাটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারোরই। প্রয়োজনে জন্তুটাকে নিকেশ করে দিতে হবে।

হরনাথের কথা শুনে মনখারাপ লাগা আরও জাঁকিয়ে বসে অমলেন্দু বটব্যালের মনে। সি-এলিগেন্সের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পরি যত দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে, পরিণতিও তত তাড়াতাড়ি নেমে আসার কথা। সবরকম প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করবার এক আশ্চর্য ক্ষমতা জন্মায় তার শরীরে। বিষয়টা আগেও খেয়াল করেছিলেন অমলেন্দু। তাঁদের গবেষণার সমস্ত হিসেব মেলেনি। বাছাই করা জেনেটিক কোড ছাড়াও পরি আরও কিছু বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে এসেছিল। অদ্ভুত শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে উলটোদিকের প্রাণীর মস্তিষ্ককে সাময়িকভাবে অচল করে দেওয়া ছিল তার মধ্যে অন্যতম। বিষয়টা যে তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, ওসুমিকে বললেও কানে নেননি। গবেষণার সাফল্য নিয়েই উচ্ছ্বসিত ছিলেন। আজ তাঁদের ভুলের মাশুল চোকাতে হতে পারে পরিকে। হ্যাঁ, নতুন ঘুমের ওষুধ যদি কাজ না করে, তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থাও সঙ্গে এনেছেন তিনি। পরিকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দেবে সেই অস্ত্র। তবে সে-কথা কাউকেই বলেননি অমলেন্দু। হরনাথকে আশ্বস্ত করার ঢঙে বললেন, “পরিকে নিয়ে তোদের অত ভাবতে হবে না। এখন ওই লোক দুটোর কথা ভাব। যদি গবেষণার কোনও তথ্য ওদের হাতে চলে যায়…”

“দুজন নয়, একজন অমলদা। পালোয়ানটাকে তোমার পরি অর্ধেক সাবাড় করে দিয়েছে। বাকি অর্ধেক এখনও নদীর ধারে পড়ে।”

শুনে ভেতরে কেঁপে উঠলেও হরনাথের কথায় মনে হয় যেন স্বস্তি পেয়েছেন গবেষক। “যাক, তবে তো ভালোই হল। একজনকে কাবু করতে আমাদের বিশেষ বেগ পেতে হবে না।”

যার কথা হরনাথ বলছিলেন, সেই খাটো চেহারার মানুষটা তখন ভাঙা গড়ের পশ্চিমে আধ-ভাঙা ঘরে ব্যস্ত রয়েছে নিজের কাজে। ভাঙা জানালার পাশে বসে সে দ্রুত হাতে প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছিল বড়ো কালো বাক্সটায়। সদ্য সঙ্গী হারা হলেও তার আবেগহীন মুখ দেখে তা বোঝা দায়। বরং ভাবভঙ্গি বলে দিচ্ছিল, কাঁকড়াপোলিতে তার আসার উদ্দেশ্য বোধ হয় সফল হয়েছে। ব্যাটারি আলোটার ঠিক পাশটায় রাখা একটা চকচকে কালো অত্যাধুনিক পিস্তল আর একটা স্যাটেলাইট ফোন। ঠিক তার পাশে রাখা মোটা কাচের ফয়েলে উজ্জ্বল নীল রঙের থকথকে জেলির মতো পদার্থ। লোকটা শিশিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। হারপুন থেকে তির ছুড়েও সঙ্গীকে বাঁচাতে পারেনি, তবে তাতে ঘায়েল হওয়ায় নতুন আবিষ্কার এখন হাতের মুঠোয়। সংস্থার আধুনিক ল্যাবরেটরিতে প্রাণীটার রক্তের নমুনা পরীক্ষা করলে এমন অনেক জীব সৃষ্টির কৌশল জানা হয়ে যাবে। আধুনিক যুদ্ধের ধোঁয়া বা দূষণের ভার আর নিতে হবে না পৃথিবীকে। নতুন প্রাণীরা হবে সেই যুদ্ধের অস্ত্র। হঠাৎ ঝট করে সামনে রাখা পিস্তল তুলে ঘুরে দাঁড়ায় লোকটা। প্রবেশপথ আটকে দাঁড়িয়ে চারজন বয়স্ক মানুষ। প্রথমজন তার দস্তুরমতো চেনা। বস্তুত ড. অমলেন্দু বটব্যালের গবেষণার হদিস পেয়ে তাঁকে ছায়ার মতো পিছু নিয়েছে অনেক বছর ধরে।

“খেলা শেষ। পিস্তল দিয়ে ভয় দেখিয়ে কোনও লাভ হবে না। আপনার সাগরেদটির খবর জানেন আশা করি?” বিদেশি আগন্তুকের উদ্দেশে স্পষ্ট ইংরেজি উচ্চারণে বলেন হরনাথ।

খর্বকায় চেহারার লোকটার চোখ দুটো জ্বলে ওঠে। মুহূর্তের জন্য। তারপর আবার হিমশীতল চাউনি ছুড়ে দেয় উলটোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা চারজনের প্রতি। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে এবার সে বলে, “ওসুমি যদি ঠিক সময়ে আপনার গবেষণার বিবরণ আমাদের হাতে তুলে দিত, তাহলে এত মৃত্যুর প্রয়োজন হত না ড. বটব্যাল। আপনি এখন আমাকে নিয়ে না ভেবে নিজেকে এবং নিজের সঙ্গীদের নিয়ে ভাবুন। আমি জানি আপনার প্রাণীটির আয়ু আর বেশি নেই। ওসুমি বলেছিল। কিন্তু তার আগে সেই নরখাদকের পেটে আরও কতজনকে হজম হতে হবে তার হিসেব করুন আপনারা।”

“ওসুমি! সে বলেছে মানে? তার সঙ্গে আপনাদের কী সম্পর্ক?”

“যেমন আপনার সঙ্গে ছিল। আপনার কী মনে হয় ড. বটব্যাল, ওসুমি একার সামর্থ্যে আপনাকে জাপান থেকে ইন্ডিয়ায় নিয়ে এসেছিল? একা ওর পক্ষে জাপানের পশ্চিম উপকূলে একটা গবেষণাগার তৈরি করে ফেলা সম্ভব ছিল রাতারাতি? আপনি যে আমাদের শর্ত মানবেন না আমরা জানতাম ড. বটব্যাল। ভারতীয়রা বড়ো আবেগপ্রবণ হয়। তাই… যাই হোক, এখন এসব বলার মতো সময় আমার হাতে নেই। খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার বোট একটু পরেই চলে আসবে। আপনি থাকুন আপনার সৃষ্টি নিয়ে। আমাকে যেতে দিন। অনর্থক মানুষ মারা আমার পছন্দ নয়।” স্যাটেলাইট ফোনটার দিকে ইশারা করে বলে লোকটা।

তার বলা কথাগুলো হতবাক করে দিয়েছিল গবেষককে। এতগুলো বছর যার সঙ্গে সে রিসার্চ করে এসেছে, বন্ধু ভেবে এসেছে, সে-ই কিনা… অমলেন্দু বটব্যালের চিন্তার স্রোত থেমে যাওয়ার আগেই সেই বিশ্রী আঁশটে গন্ধটা হুড়মুড় করে ঘরের ভেতর ঢুকে আসতে শুরু করে। পিস্তল হাতে লোকটা নিমেষে চমকে ওঠে। বিশেষ কানপট্টিখানা সে কোথায় রেখেছে খুঁজে পাওয়ার আগেই ভাঙা জানালা টপকে ভেসে আসতে থাকে বেসুরো সুর। কেউ বুঝি ভীষণ অপটু হাতে ভায়োলিন বাজাচ্ছে।

বাকি ঘটনা ঘটে যায় খুব তাড়াতাড়ি। পরির সুর কানে যেতে নিস্তেজ হয়ে যায় ভিনদেশি আগন্তুক। হরনাথ মাস্টার ভেবে পাচ্ছিলেন না ঠিক কী করা উচিত এই মুহূর্তে। আর তখনই ভাঙা জানালা দিয়ে দেখা গেল পরিকে। মুহূর্তের জন্যই। কিছু করার আগেই তার লম্বা চ্যাপ্টা চোষকওয়ালা জিভ ছুড়ে দিল সে মাটিতে পড়ে যাওয়া লোকটার দিকে। সবার হুঁশ ফিরল যখন সামনে কেবল একটা কঙ্কাল। আঁশটে গন্ধটাও মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। হরনাথ লক্ষ করলেন, তাঁদের মাঝ থেকে কিশোরবেলার বন্ধুটিও উধাও।

গবেষককে অবশ্য পাওয়া গিয়েছিল পরে। নদীর ধারে একা বসেছিলেন। ঠিক সময়মতো পরির পিছু ধাওয়া করে এসেছিলেন তিনি। ভিনদেশি লোকটা একটা কথা ঠিকই বলেছিল। পরিকে আর একটা দিন বাঁচিয়ে রাখার অর্থ আরও মৃত্যু। বিজ্ঞানের সাধক হয়ে তা তিনি কখনোই হতে দিতে পারেন না। নদীর জলে হারিয়ে যাওয়ার আগেই তিনি পরিকে লক্ষ্য করে মৃত্যুবাণ ছুড়ে দিয়েছিলেন। সেই বিশেষ রাসায়নিক যা পরির জুড়ে থাকা জেনেটিক কোড ভেঙে দেবে মুহূর্তের মধ্যে। ঘুম নামিয়ে আনবে তার চোখে অকস্মাৎ। চিরতরে।

বটতলার আসর এখন আর বসে না। তা এখন স্থানান্তরিত হয়েছে গবেষকের চিড়িয়াখানায়। বৈঠকখানার ঘরটাকে সাফসুতরো করে মজলিস চলে জোরদার। নির্দিষ্ট বিরতি মেনে তুলসী সাদা চায়ের জোগান দিয়ে যায়। তালুকদারের আজকাল সেই চা ছাড়া অন্য কিছু মুখে রোচে না। তার ধার চাওয়ার বাতিকও আর নেই। স্বভাবতই নিমাই পণ্ডিতকে ঘুর পথে নিজের বাড়ি আসাযাওয়া করতে হয় না। আসরে ড. অমলেন্দু বটব্যালও যোগদান করেন নিজের গবেষণার ফাঁকে ফাঁকে। তবে সবার থেকে আনন্দে রয়েছেন হরনাথ মাস্টার। কিশোরবেলার বন্ধুটির ওপর জমে থাকা অভিমান বাষ্প হয়ে উবে গিয়েছে তাঁর।

uponyasbudhai (8)

     অলঙ্করণ- মৌসুমী

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s