বাংলার মুখ-চুবড়ি মেলা-তমোঘ্ন নস্কর-বসন্ত ২০২২

বাংলার মুখ -আগের লেখা –পিসির বাড়ি, মকর সংক্রান্তি ও আলুর দম মেলা , মকরসংক্রান্তির পরব ভেজা বিঁধা,আমাদের বৈশাখী

banglarmukh80

গরমের দিনে সাঁওতাল পরগনার বিকালটা খাটিয়া নির্ভর। আজও তাই, চাঁদের আলো গায়ে মাখতে মাখতে বুবুনের বুড়ো দাদার কাছে গল্প শুনছিলাম। সে এক অদ্ভুত পরিবেশ। মাথার ওপর দ্বাদশীর ঈষৎ টোপা চাঁদ। আর তার নীচে জারুলি গাছ আর মরাইটা জড়াজড়ি করে আছে। সেই ছায়ায় আমরা যেন কোন অপার্থিব লোকের মানুষ। বাইরে উনুনশালে ঠাকমা বুড়ি রান্না করছেন। লালচে আলোয় বলিরেখাগুলো জ্বলজ্বল করছে, যেন সমুদ্রের বালুতট। উচ্ছ্বাস গেছে, ঢেউ গেছে, শুধু আঁকিবুঁকি বেঁচে আছে। আজকে আমি অতিথি এসেছি বলে আমার জন্য তিনিই সব রান্না করবেন।

কজুড়ির অখ্যাত চুবড়ি মেলা দেখতে এসেছি, মেলা দেখে রাতের সেবাটা এখানেই সারব।

প্ল্যান্টের মিস্ত্রি বুবুন হাঁসদার কাছে শুনেছিলাম এই মেলার কথা। কিন্তু আগের বছর এই সময় ভায়ের বিয়ে পড়ে যাওয়ায় সময়-সুযোগ হয়নি। আজ তাই আমার জন্য বরাদ্দ ঢরঢরে উইলির জিপখানা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম।

বুবুনের বাড়ি আসতে বেলা গড়িয়েছিল। বুবুনকে বগলদাবা করে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়েছিলাম সেই মেলায়। ইয়াশিকার ক্যামেরাটা ভরে গেছে চুবড়ির ছবিতে। বেতের, টুল কাঠের, চ্যাড়ার, আড়ুনি, খাগড়ু—কীসের চুবড়ি নেই! কেউ ন্যাংটা, উদোম গা কেউ আবার আলপনায় রাঙানো। কেউ ঘষে-মেজে মোলায়েম তো, কেউ এতই কড়কড়ে মাছের আঁশ, তাল-নোদ (পাকা তালের শাঁস) পর্যন্ত ঘষে ছাড়ানো যাবে। অদ্ভুত ব্যাপার, এই মেলায় বিক্রি হয় বলতে চুবড়ি আর চপ-বেগুনি। সঙ্গে চুড়ি-মাকড়িটাও ওই মেলায় বিক্রি হয় না। না থাকে নাগরদোলা আর ভেঁপু। শুধু চুবড়ি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হলে পেটে কিছু দেওয়া প্রয়োজন, তাই চপ-বেগুনি।

সন্ধ্যাবেলায় সানকিতে মুড়ি আর পাটালি গুড়ের ডেলা নিয়ে বসেছিলাম। বুবুনের দাদা এ-গ্রামের বুড়া পাহান। কত দেখেছে যে বুড়ো তার ইয়ত্তা নেই। চোখ কুঁচকে বুড়ো বলেছিল, ‘এই মেলার কিসসা বড়ো আজিব। কোন এককালে কোন এক বানজারা দল গ্রামের বাইরে তাঁবু ফেলে। এক বুড়ো বানজারনি বাজার থেকে খরিদ করে আনা ভাঙা মাছ চুবড়িতে করে ধুতে যাচ্ছিলেন। এদিকে ওই পুকুরে কেউ আসে না যখের ভয়ে। জনশ্রুতি বলে, অগ্নিদেবের দাররক্ষী ছিল যখ। একদা যখের সামান্য ত্রুটির জিন্য অগ্নিদেবের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটে। অগ্নিদেব ক্রোধে হুতাশন রূপ নেন। যখ পালিয়ে আসে। প্রচণ্ড ক্রোধে যখন এ-অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যান, যক এক বৃহৎ পুষ্করিণীতে আশ্রয় নেয়। দিন যায়, মাস যায়, যখ পুষ্করিণীতেই লিকিয়ে থাকে। একে একে পুকুরের মাছ সব খেয়ে যখ সাবাড় করেছে। আর খাবার কিছু নেই। এখন ক্ষুধায় কাঁন্দা করে খালি।

‘সেদিন সেই বানজারনির চুবড়ির খোল সামান্য ভাঙা ছিল। এদিকে কই মাছের জীবন। জল পড়তেই মাছেরা ছটফটিয়ে উঠে ভাঙা খোল দিয়ে পুকুরে পড়ে যায়। যখের দীর্ঘদিনের ক্ষুধার পরিসমাপ্তি ঘটে। বানজারনিকে তিনি দেখা দেন এবং এখানে চুবড়ির মেলা বসাতে নির্দেশ দেন। একে তাই ক্ষি-চুবড়ির মেলাও বলে অনেকে।’

তারপর থেকে নিয়ম করে চুবড়ির মেলা এখানেই হয়ে আসছে। সেই কান্নার আওয়াজ হলেই এখানে মেলা চালু হয়। যদিও তার অজস্র প্রাকৃতিক এবং বৈজ্ঞানিক কারণ থাকতে পারে, তবুও বিশ্বাস বিষম বস্তু। শহর থেকে ব্যবসায়ীবাবুরা আসেন না, আসেন আদিবাসীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা স্থানীয় কনট্রাক্টররা। নানারকমের চুবড়ি নিয়ে যান। চড়া দামে বিক্রি করেন শহরের বাবুদের কাছে৷ তাঁরা তাদের বাড়িতে হাতের কাজের সামগ্রী, দরকারি সামগ্রী হিসাবে রাখেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা তাদেরকে ইচ্ছা করেই আড়ালে রেখে দেয়। অবশ্য বুধনরাও ভিড় চায় না। তাদের এই চুবড়ির মেলার নাম হলে যে-পরিমাণ বাইরের লোক এখানে আসা শুরু করবে, তাতে করে তখন তাদের এখানে টেকা মুশকিল হয়ে যাবে।

এরপর ঠাকুমা ডাক পাড়লেন।

নিকোনো দাওয়ায় (বারান্দায়) কানা উঁচু সানকিতে করে ভাত বাড়া হয়েছে। আয়োজন মাছের ওপর, কারণ এই সময়টা যেহেতু যখ মাছে উপবাস ভেঙেছিল তাই সবার বাড়িতেই মাছ রান্না হয়।

বুবুনরা ল্যাটা মাছ জিইয়ে রেখেছিল মেজলায়। সেই ল্যাটা ধনে-জিরে-লঙ্কা বাটা আর কাঁচা সর্ষের তেল দিয়ে মজিয়ে কুমড়ো পাতার ভেতর বেঁধে ভাপানো হয়েছে। সেটাকে ঠাসা হয়েছে ভাজা মশলা দিয়ে। সবুজ রঙা সেই ঝাল ঝাল মাখাটা জিভে দিলেই সোজা মাথায় গিয়ে ধাক্কা মারছে।

আমি আসব বলে আরেক বাড়ি থেকে বড়ো একখানা আড় মাছ দিয়ে গেছিল ওদেরই কোন এক জ্ঞাতি। সেই আড় মাছটাকে পাকা শশা আর পেঁয়াজ বাটা দিয়ে রসিয়ে শুকনো করা হয়েছে। তাই দিয়ে মেখে অন্তত শ-গ্রাম চালের ভাত খাওয়া যায়।

এবারে এল ট্যাংরা। ছোটো ছোটো কড়ে আঙুল সাইজের ট্যাংরারা পাকা তেঁতুল আর গোটা সর্ষের ফোড়নে মজে এল শেষ পাতে। বলাই বাহুল্য, সে-রাতে সেই তৃপ্তির ঢেঁকুরটার আওয়াজ কলকাতায় আমার বাড়ি অবধি এসে পৌঁছেছিল।

খাওয়া শেষে পেট আইঢাই করছিল। দাদাই দাওয়াই দিলেন। এনামেল করা গ্লাসে এক গ্লাস করে মহুয়া আর মশলা মাখানো ভাজা কাঁচা লঙ্কা নিয়ে বসলুম খাটিয়ায়। সে-রাতে গল্পের বান ডেকেছিল। চুবড়ি ভাঙা মাছের মতো অজস্র গল্প বুবুনের দাদা সেদিন বলে গেছিলেন। গ্রন্থিত হবে হয়তো কখনও, কখনও নয়।

এত কথা বলার কারণ একটাই, সকালবেলায় বুবুনের ফোন পেয়েছিলাম। দাদা নেই। দাদার বয়স হয়েছিল সেই সঙ্গে শারীরিক সমস্যাগুলো বাড়ছিল। ভেবেছিলাম কলকাতা নিয়ে এসে আমাদের বাড়িতে কয়দিন রেখে চিকিৎসা করাব। সেই মর্মে সব ঠিকও হয়েছিল, কিন্তু করোনা তা হতে দিল না। দাদা একেবারেই বিছানা নিলেন। দেখতে যাওয়াও হল না।

দাদা চলে গেলেন। শুধু সেই রাতে গল্পগুলোর এক প্রচণ্ড দায়ভার চাপিয়ে দিলেন আমার কাঁধে। আমি লেখক নই, কিন্তু এক হিসাবে কথক তো বটেই। ওই গল্পগুলো যে বলে যেতেই হবে। পৌঁছে দিয়ে যেতে হবে সবার কাছে।

ছবি- ইন্টারনেট দেখে ও ভাবনা মিশিয়ে এই অধম।

 

 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s