পরিব্রাজক(প্রথম পর্ব),পরিব্রাজক (২য় পর্ব) পরিব্রাজক (৩য় পর্ব), পরিব্রাজক (৪র্থ পর্ব), পরিব্রাজক (৫ম পর্ব) পরিব্রাজক (৬ষ্ঠ পর্ব) পরিব্রাজক (৭ষ্ঠ পর্ব), পরিব্রাজক অষ্টম পর্ব, পরিব্রাজক নবম পর্ব,দশমপর্ব,একাদশ পর্ব
(দ্বাদশ পর্ব)
স্বামী বিবেকানন্দ
(১৮৯৯ সাল। কোলকাতা বন্দর থেকে বাষ্প চালিত জাহাজ গোলকোন্ডায় তিন সন্ন্যাসীকে সাথে নিয়ে বিবেকানন্দ রওনা দিলেন পশ্চিমের উদ্দেশ্যে। সাথে চলেছেন ভগিনী নিবেদিতা, আর তিন শিষ্য। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে জুলাই পরের বছর জুলাই মাসে পৌঁছলেন প্যারিস। প্যারিস থেকে শুরু হল অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশগুলি ঘুরে বেড়ানো। স্বামীজি তাঁর প্রিয় শিষ্য স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লেখা চিঠিতে তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন। প্যারিস ভ্রমণ শেষ হয়েছে। এবার চলেছেন অস্ট্রিয়া ও তুরস্ক)
অস্ট্রিয়ার রাজবংশের এখনও ইওরোপের সকল রাজবংশের অপেক্ষা গুমর। তাঁরা অতি প্রাচীন, অতি বড় বংশ! এ বংশের বে-থা বড় দেখে শুনে হয়। ক্যাথলিক না হলে সে বংশের সঙ্গে বে-থা হয়ই না। এই বড় বংশের ভাঁওতায় পড়ে মহাবীর ন্যাপোলঅঁর অধঃপতন। কোথা হতে তাঁর মাথায় ঢুকল যে, বড় রাজবংশের মেয়ে বে করে পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে এক মহাবংশ স্থাপন করবেন। যে বীর, ‘আপনি কোন বংশে অবতীর্ণ?’—এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন যে, ‘আমি কারো বংশের সন্তান নই, আমি মহাবংশের স্থাপক’, অর্থাৎ আমা হতে মহিমান্বিত বংশ চলবে, আমি কোন পূর্বপুরুষের নাম নিয়ে বড় হতে জন্মাইনি, সেই বীরের এ বংশমর্যাদারূপ অন্ধকূপে পতন হল!
রাজ্ঞী জোসেফিনকে পরিত্যাগ, যুদ্ধে পরাজয় করে অস্ট্রিয়ার বাদশার কন্যা গ্রহণ, মহা-সমারোহে অষ্ট্রীয় রাজকন্যা মেরী লুইসের সহিত বোনাপার্টের বিবাহ, পুত্রজন্ম, সদ্যোজাত শিশুকে রোম-রাজ্যে অভিষিক্ত-করণ, ন্যাপোলঅঁর পতন, শ্বশুরের শত্রুতা, লাইপজিগ, ওয়াটারলু, সেণ্ট হেলেনা, রাজ্ঞী মেরী লুইসের সপুত্র পিতৃগৃহে বাস, সামান্য সৈনিকের সহিত বোনাপার্ট-সম্রাজ্ঞীর বিবাহ, একমাত্র পুত্র রোম-রাজের মাতামহগৃহে মৃত্যু—এ সব ইতিহাস প্রসিদ্ধ কথা।
ফ্রান্স এখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থায় পড়ে প্রাচীন গৌরব স্মরণ করছে—আজকাল ন্যাপোলঅঁর-সংক্রান্ত পুস্তক অনেক। সার্দ প্রভৃতি নাট্যকার গত ন্যাপোলঅঁর সম্বন্ধে অনেক নাটক লিখছেন। মাদাম বার্নহার্ড, রেজাঁ প্রভৃতি অভিনেত্রী, কফেলাঁ প্রভৃতি অভিনেতাগণ সে সব অভিনয় করে প্রতি রাত্রে থিয়েটার ভরিয়ে ফেলেছে। সম্প্রতি ‘লেগলঁ’ (গরুড়-শাবক) নামক এক নাটকে অভিনয় করে মাদাম বার্নহার্ড প্যারিস নগরীতে মহা আকর্ষণ উপস্থিত করেছেন।
‘গরুড়-শাবক’ বোনাপার্টের একমাত্র পুত্র, মাতামহ-গৃহে ভিয়েনার প্রাসাদে এক রকম নজরবন্দী। অষ্ট্রিয় বাদশার মন্ত্রী মেটারনিক, বালকের মনে পিতার গৌরবকাহিনী যাতে একেবারে না স্থান পায়, সে বিষয়ে সদা সচেষ্ট। কিন্তু দুজন পাঁচজন বোনাপার্টের পুরাতন সৈনিক নানা কৌশলে সানব্রান-প্রাসাদে অজ্ঞাতভাবে বালকের ভৃত্যত্বে গৃহীত হল। তাদের ইচ্ছা—কোন রকমে বালককে ফ্রান্সে হাজির করা এবং সমবেত ইওরোপীয় রাজন্যগণ দ্বারা পুনঃস্থাপিত বুর্বঁ বংশকে তাড়িয়ে দিয়ে বোনাপার্ট-বংশ স্থাপন করা। পিতার রণ-গৌরবকাহিনী শুনে শিশু মহাবীর-পুত্রের সুপ্ত তেজ অতি শীঘ্রই জেগে উঠল। চক্রান্তকারীদের সঙ্গে বালক সানব্রান-প্রাসাদ হতে একদিন পলায়ন করলে। কিন্তু মেটারনিকের তীক্ষ্ণবুদ্ধি পূর্ব হতেই সব টের পেয়েছিল। সে যাত্রা বন্ধ করে দিলে। বোনাপার্ট-পুত্রকে সানব্রান-প্রাসাদে ফিরিয়ে আনলে বদ্ধপক্ষ ‘গরুড় শিশু’ ভগ্নহৃদয়ে অতি অল্পদিনেই প্রাণত্যাগ করলে!
এ সানব্রান-প্রাসাদ সাধারণ প্রাসাদ। অবশ্য ঘর-দোর খুব সাজান বটে! কোন ঘরে খালি চীনের কাজ, কোন ঘরে খালি হিন্দু হাতের কাজ, কোন ঘরে অন্য দেশের—এই প্রকার। প্রাসাদস্থ উদ্যান অতি মনোরম বটে, কিন্তু এখন যত লোক এ প্রাসাদ দেখতে যাচ্ছে, সব ওই বোনাপার্ট-পুত্র যে ঘরে শুতেন, যে ঘরে পড়তেন, যে ঘরে তাঁর মৃত্য হয়েছিল—সেই সব দেখতে যাচ্ছে। অনেক আহম্মক ফরাসী-ফরাসিনী রক্ষী-পুরুষকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘এগ্লঁ’র ঘর কোন্টা, কোন্ বিছানায় শুতেন? আহাম্মকরা জানে সে বোনাপার্টের ছেলে। এদের মেয়ে জুলুম করে কেড়ে নিয়ে বোনাপার্টের সম্বন্ধ হয়েছিল, সে ঘৃণা এদের আজও যায় না। খালি অস্ট্রিয়ার নাতি—কাজেই ড্যুক, বস্। তাকে এখন ‘গরুড় শিশু’ করে এক বই লিখেছিস, আর তার উপর নানা কল্পনা জুটিয়ে, মাদাম বার্নহার্ডের প্রতিভায় একটা খুব আকর্ষণ হয়েছে, কিন্তু এ অষ্ট্রিয় রক্ষী সে নাম কী করে জানবে বল? তার উপর সে বইয়ে লেখা হয়েছে যে ন্যাপোলঅঁর-পুত্রকে অস্ট্রিয়ার বাদশা মেটারনিক মন্ত্রীর পরামর্শে একরকম মেরেই ফেললেন। রক্ষী—‘এগ্লঁ’ শুনে, মুখ হাঁড়ি করে, গজগজ করতে করতে ঘর-দোর দেখাতে লাগল। কী করে, বকশিসটা ছাড়া বড়ই মুশকিল! তার উপর, এসব অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশে সৈনিক বিভাগে বেতন নাই বললেই হল, এক রকম পেটভাতায় থাকতে হয়; অবশ্য কয়েক বৎসর পরে ঘরে ফিরে যায়। রক্ষীর মুখ অন্ধকার হয়ে স্বদেশপ্রিয়তা প্রকাশ করলে, হাত কিন্তু আপনা হতেই বকশিসের দিকে চলল। ফরাসীর দল রক্ষীর হাতকে রৌপ্য-সংযুক্ত করে, ‘এগ্লঁ’র গল্প করতে করতে আর মেটারনিককে গাল দিতে দিতে ঘরে ফিরল। রক্ষী লম্বা সেলাম করে দোর বন্ধ করলে। মনে মনে সমগ্র ফরাসী জাতির বাপন্ত-পিতন্ত অবশ্যই করেছিল।
ভিয়েনা শহরে দেখবার জিনিস মিউজিয়ম, বিশেষ বৈজ্ঞানিক মিউজিয়ম। বিদ্যার্থীর বিশেষ উপকারক স্থান। নানাপ্রকার প্রাচীন লুপ্ত জীবের অস্থ্যাদি সংগ্রহ অনেক। চিত্রশালিকায় ওলন্দাজ চিত্রকারদের চিত্রই অধিক। ওলন্দাজী সম্প্রদায়ে রূপ বার করবার চেষ্টা বড়ই কম। জীবপ্রকৃতির অবিকল অনুকরণেই এ সম্প্রদায়ের প্রাধান্য। একজন শিল্পী বছর কতক ধরে এক ঝুড়ি মাছ এঁকেছে, না হয় এক থান মাংস, না হয় এক গ্লাস জল—সে মাছ, মাংস, গ্লাসে জল, চমৎকারজনক! কিন্তু ওলন্দাজ সম্প্রদায়ের মেয়েরা চেহারায় সব যেন কুস্তিগির পালোয়ান!
ভিয়েনা শহরে জার্মান পাণ্ডিত্য বুদ্ধিবল আছে, কিন্তু যে কারণে তুর্কী ধীরে ধীরে অবসন্ন হয়ে গেল, সেই কারণ এথায়ও বর্তমান—অর্থাৎ নানা বিভিন্ন জাতি ও ভাষার সমাবেশ। আসল অস্ট্রিয়ার লোক জার্মান-ভাষী, ক্যাথলিক। হুঙ্গারির লোক তাতারবংশীয়, ভাষা আলাদা। আবার কতক গ্রীকভাষী, গ্রীকমতের ক্রিশ্চান। এ সকল বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একীভূতকরণের শক্তি অস্ট্রিয়ার নেই। কাজেই অস্ট্রিয়ার অধঃপতন।
বর্তমানকালে ইওরোপখণ্ডে জাতীয়তার এক মহাতরঙ্গের প্রাদুর্ভাব। এক ভাষা, এক ধর্ম, এক জাতীয় সমস্ত লোকের একত্র সমাবেশ। যেথায় ঐ প্রকার একত্র সমাবেশ সুসিদ্ধ হচ্ছে, সেথায়ই মহাবলের প্রাদুর্ভাব হচ্ছে; যেথায় তা অসম্ভব, সেথায়ই নাশ। বর্তমান অষ্ট্রিয় সম্রাটের মৃত্যুর পর অবশ্যই জার্মান অষ্ট্রিয় সাম্রাজ্যের জার্মানভাষী অংশটুকু উদরসাৎ করবার চেষ্টা করবে, রুশ প্রভৃতি অবশ্যই বাধা দেবে— মহা আহবের সম্ভাবনা। বর্তমান সম্রাট অতি বৃদ্ধ—সে দুর্যোগ আশুসম্ভাবী। জার্মান সম্রাট তুর্কীর সুলতানের আজকাল সহায়। সে সময়ে যখন জার্মানী অস্ট্রিয়াগ্রাসে মুখ-ব্যাদান করবে, তখন রুশ-বৈরী তুর্ক, রুশকে কতক বাধা তো দেবে! কাজেই জার্মান সম্রাট তুর্কের সহিত বিশেষ মিত্রতা দেখাচ্ছেন।
ভিয়েনায় তিন দিন—দিক্ করে দিলে! প্যারিসের পর ইওরোপ দেখা, চর্ব্যচুষ্য খেয়ে তেঁতুলের চাটনি চাটা। সেই কাপড়চোপড়, খাওয়া-দাওয়া, সেই সব এক ঢঙ— দুনিয়াসুদ্ধ সেই এক কিম্ভূত কালো জামা, সেই এক বিকট টুপি! তার উপর—উপরে মেঘ আর নীচে পিল পিল করছে এই কালো টুপি, কালো জামার দল। দম যেন আটকে দেয়। ইওরোপসুদ্ধ সেই এক পোষাক, সেই এক চাল-চলন হয়ে আসছে! প্রকৃতির নিয়ম—ঐ সবই মৃত্যুর চিহ্ন! শত শত বৎসর কসরত করিয়ে আমাদের আর্যেরা আমাদের এমনি কাওয়াজ করিয়ে দেছেন যে, আমরা এক ঢঙে দাঁত মাজি, মুখ ধুই, খাওয়া খাই, ইত্যাদি ইত্যাদি। ফল—আমরা ক্রমে ক্রমে যন্ত্র হয়ে গেছি, প্রাণ বেরিয়ে গেছে, খালি যন্ত্রগুলি ঘুরে বেড়াচ্চি! যন্ত্র ‘না’ বলে না, ‘হ্যাঁ’ বলে না, নিজের মাথা ঘামায় না, ‘যেনাস্য পিতরো যাতাঃ’—(বাপ দাদা যে দিক্ দিয়ে গেছে) সে দিকে চলে যায়, তার পর পচে মরে যায়। এদেরও তাই হবে! ‘কালস্য কুটিলা গতিঃ’—সব এক পোষাক, এক খাওয়া, এক ধাঁজে কথা কওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি—হতে হতে ক্রমে সব যন্ত্র, ক্রমে সব ‘যেনাস্য পিতরো যাতাঃ’ হবে, তার পর পচে মরা!
২৮শে অক্টোবর রাত্রি ৯টার সময় সেই ওরিয়েণ্ট এক্সপ্রেস ট্রেন আবার ধরা হল। ৩০শে অক্টোবর ট্রেন পৌঁছুল কনষ্টাণ্টিনোপলে। এ দু-রাত একদিন ট্রেন চলল হুঙ্গারি, সর্বিয়া এবং বুলগেরিয়ার মধ্য দিয়ে।
হুঙ্গারির অধিবাসী অষ্ট্রিয় সম্রাটের প্রজা। কিন্তু অষ্ট্রীয় সম্রাটের উপাধি ‘অস্ট্রিয়ার সম্রাট ও হুঙ্গারির রাজা’। হুঙ্গারির লোক এবং তুর্কীরা একই জাত, তিব্বতীর কাছাকাছি। হুঙ্গাররা কাস্পিয়ান হ্রদের উত্তর দিয়ে ইওরোপে প্রবেশ করেছে, আর তুর্করা আস্তে আস্তে পারস্যের পশ্চিম প্রান্ত হয়ে এশিয়া-মাইনর হয়ে ইওরোপ দখল করেছে। হুঙ্গারির লোক ক্রিশ্চান, তুর্ক মুসলমান। কিন্তু সে তাতার রক্তে যুদ্ধপ্রিয়তা উভয়েই বিদ্যমান। হুঙ্গাররা অস্ট্রিয়া হতে তফাত হবার জন্য বারংবার যুদ্ধ করে এখন কেবল নামমাত্র একত্র। অস্ট্রিয়া সম্রাট্ নামে হুঙ্গারির রাজা। এদের রাজধানী বুডাপেস্ত অতি পরিষ্কার সুন্দর শহর। হুঙ্গার জাতি আনন্দপ্রিয়, সঙ্গীতপ্রিয়—প্যারিসের সর্বত্র হুঙ্গারিয়ান ব্যাণ্ড।
ছেঁড়া ন্যাতা-চোতা পরনে, শূকরসহায় সর্বিয়া বা বুলগার! বহু রক্তস্রাবে, বহু যুদ্ধের পর, তুর্কের দাসত্ব ঘুচেছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিষম উৎপাত—ইওরোপী ঢঙে ফৌজ গড়তে হবে, নইলে কারো একদিনও নিস্তার নেই। অবশ্য দুদিন আগে বা পরে ওসব রুশের উদরসাৎ হবে, কিন্তু তবুও সে দুদিন জীবন অসম্ভব—ফৌজ বিনা! ‘কনসক্রিপশন্’ চাই।
কুক্ষণে ফ্রান্স জার্মানীর কাছে পরাজিত হল। ক্রোধে আর ভয়ে ফ্রান্স দেশশুদ্ধ লোককে সেপাই করলে। পুরুষমাত্রকেই কিছুদিনের জন্য সেপাই হতে হবে—যুদ্ধ শিখতে হবে, কারো নিস্তার নেই। তিন বৎসর ব্যারাকে বাস করে—ক্রোড়পতির ছেলে হোক না কেন, বন্দুক ঘাড়ে যুদ্ধ শিখতে হবে। গবর্ণমেণ্ট খেতে পরতে দেবে, আর বেতন রোজ এক পয়সা। তারপর তাকে দু-বৎসর সদা প্রস্তুত থাকতে হবে নিজের ঘরে, তারপর আরও ১৫ বৎসর তাকে দরকার হলেই যুদ্ধের জন্য হাজির হতে হবে। জার্মানী সিঙ্গি খেপিয়েছে—তাকেও কাজেকাজেই তৈয়ার হতে হল। অন্যান্য দেশেও এর ভয়ে ও, ওর ভয়ে এ—সমস্ত ইওরোপময় ঐ কনসক্রিপশন্, এক ইংলণ্ড ছাড়া। ইংলণ্ড দ্বীপ, জাহাজ ক্রমাগত বাড়াচ্ছে। কিন্তু এ বোয়ার যুদ্ধের শিক্ষা পেয়ে বোধ হয় কনসক্রিপশন্ বা হয়। রুশের লোকসংখ্যা সকলের চেয়ে অধিক, কাজেই রুশ সকলের চেয়ে বেশী ফৌজ খাড়া করে দিতে পারে। এখন এই যে সর্বিয়া বুলগেরিয়া প্রভৃতি বেচারাম দেশ সব তুর্কীকে ভেঙে ইওরোপীরা বানাচ্ছে, তাদের জন্ম না হতে হতেই আধুনিক সুশিক্ষিত সুসজ্জিত ফৌজ তোপ প্রভৃতি চাই। কিন্তু আখেরে সে পয়সা যোগায় কে? কাজেই চাষা ছেঁড়া ন্যাতা গায়ে দিয়েছে, শহরে দেখবে কতকগুলো ঝাব্বাঝুব্বা পরে সেপাই। ইওরোপময় সেপাই, সেপাই—সর্বত্রই সেপাই। তবু স্বাধীনতা এক জিনিষ, গোলামী আর এক। পরে যদি জোর করে করায় তো অতি ভাল কাজও করতে ইচ্ছা যায় না। নিজের দায়িত্ব না থাকলে কেউ কোন বড় কাজ করতে পারে না। স্বর্ণশৃঙ্খলযুক্ত গোলামীর চেয়ে একপেটা ছেঁড়া ন্যাকড়া পরা স্বাধীনতা লক্ষগুণে শ্রেয়। গোলামের ইহলোকেও নরক, পরলোকেও তাই। ইওরোপের লোকেরা ঐ সর্বিয়া বুলগার প্রভৃতিদের ঠাট্টা বিদ্রূপ করে—তাদের ভুল অপারগতা নিয়ে ঠাট্টা করে। কিন্তু এতকাল দাসত্বের পর কি এক দিনে কাজ শিখতে পারে? ভুল করবে বৈকি—দু’শ করবে, করে শিখবে, শিখে ঠিক করবে। দায়িত্ব হাতে পড়লে অতি-দুর্বল সবল হয়, অজ্ঞান বিচক্ষণ হয়।
রেলগাড়ী হুঙ্গারি, রোমানী প্রভৃতি দেশের মধ্য দিয়ে চলল। মৃতপ্রায় অষ্ট্রিয় সাম্রাজ্যে যে সব জাতি বাস করে, তাদের মধ্যে হুঙ্গারিয়ানে জীবনীশক্তি এখনও বর্তমান। যাকে ইওরোপীয় মনীষিগণ ইন্দো-ইওরোপীয়ান বা আর্যজাতি বলেন, ইওরোপে দু-একটি ক্ষুদ্র জাতি ছাড়া আর সমস্ত জাতি সেই মহাজাতির অন্তর্গত। যে দু-একটি জাতি সংস্কৃত-সম ভাষা বলে না, হুঙ্গারিয়ানেরা তাদের অন্যতম। হুঙ্গারিয়ান আর তুর্কী একই জাতি। অপেক্ষাকৃত আধুনিক সময়ে এই মহাপ্রবল জাতি এশিয়া ও ইওরোপ খণ্ডে আধিপত্য বিস্তার করেছে।
যে দেশকে এখন তুর্কীস্থান বলে, পশ্চিমে হিমালয় ও হিন্দুকোশ পর্বতের উপরে স্থিত সেই দেশই এই তুর্কী জাতির আদি নিবাসভূমি। ঐ দেশের তুর্কী নাম ‘চাগওই’। দিল্লীর মোগলবাদশাহ-বংশ, বর্তমান পারস্য-রাজবংশ, কনষ্টাণ্টিনোপলপতি তুর্কবংশ ও হুঙ্গারিয়ান জাতি—সকলেই সেই ‘চাগওই’ দেশ হতে ক্রমে ভারতবর্ষ আরম্ভ করে ইওরোপ পর্যন্ত আপনাদের অধিকার বিস্তার করেছে এবং আজও এই সকল বংশ আপনাদের ‘চাগওই’ বলে পরিচয় দেয় এবং এক ভাষায় কথাবার্তা কয়। এই তুর্কীরা বহুকাল পূর্বে অবশ্য অসভ্য ছিল। ভেড়া ঘোড়া গরুর পাল সঙ্গে, স্ত্রীপুত্র ডেরা-ডাণ্ডা সমেত, যেখানে পশুপালের চরবার উপযোগী ঘাস পেত, সেইখানে তাঁবু গেড়ে কিছু দিন বাস করত। ঘাস-জল সেখানকার ফুরিয়ে গেলে অন্যত্র চলে যেত। এখনও এই জাতির অনেক বংশ মধ্য-এশিয়াতে এই ভাবেই বাস করে। মোগল প্রভৃতি মধ্য-এশিয়াস্থ জাতিদের সহিত এদের ভাষাগত সম্পূর্ণ ঐক্য—আকৃতিগত কিছু তফাত, মাথার গড়নে ও হনুর উচ্চতায় তুর্কের মুখ মোগলের সমাকার, কিন্তু তুর্কের নাক খ্যাঁদা নয়, অপিচ সুদীর্ঘ চোখ সোজা এবং বড়, কিন্তু মোগলদের মত দুই চোখের মাঝে ব্যবধান অনেকটা বেশী। অনুমান হয় যে, বহুকাল হতে এই তুর্কী জাতির মধ্যে আর্য এবং সেমিটিক রক্ত প্রবেশ লাভ করেছে। সনাতন কাল হতে এই তুরস্ক জাতি বড়ই যুদ্ধপ্রিয়। আর এই জাতির সহিত সংস্কৃতভাষী, গান্ধারী ও ইরানীর মিশ্রণে—আফগান, খিলিজী, হাজারা, বরকজাই, ইউসাফজাই প্রভৃতি যুদ্ধপ্রিয়, সদা রণোন্মত্ত, ভারতবর্ষের নিগ্রহকারী জাতিসকলের উৎপত্তি। অতি প্রাচীনকালে এই জাতি বারংবার ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তস্থ দেশসকল জয় করে বড় বড় রাজ্য সংস্থাপন করেছিল। তখন এরা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিল, অথবা ভারতবর্ষ দখল করবার পর বৌদ্ধ হয়ে যেত। কাশ্মীরের প্রাচীন ইতিহাসে হুষ্ক, যুষ্ক, কনিষ্ক নামক তিন প্রসিদ্ধ তুরস্ক সম্রাটের কথা আছে। এই কনিষ্কই ‘মহাযান’ নামে উত্তরাম্নায় বৌদ্ধধর্মের সংস্থাপক।
বহুকাল পরে ইহাদের অধিকাংশই মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে এবং বৌদ্ধধর্মের মধ্য-এশিয়াস্থ গান্ধার, কাবুল প্রভৃতি প্রধান প্রধান কেন্দ্রসকল একেবারে উৎসন্ন করে দেয়। মুসলমান হওয়ার পূর্বে এরা যখন যে দেশ জয় করত, সে দেশের সভ্যতা বিদ্যা গ্রহণ করত এবং অন্যান্য দেশের বিদ্যাবুদ্ধি আকর্ষণ করে সভ্যতা বিস্তারের চেষ্টা করত। কিন্তু মুসলমান হয়ে পর্যন্ত এদের যুদ্ধপ্রিয়তাটুকুই কেবল বর্তমান, বিদ্যা ও সভ্যতার নামগন্ধ নেই, বরং যে দেশ জয় করে, সে দেশের সভ্যতা ক্রমে ক্রমে নিভে যায়। বর্তমান আফগান, গান্ধার প্রভৃতি দেশের স্থানে স্থানে তাদের বৌদ্ধ পূর্বপুরুষদের নির্মিত অপূর্ব স্তূপ, মঠ, মন্দির, বিরাট মূর্তিসকল বিদ্যমান। তুর্কী-মিশ্রণ ও মুসলমান হবার ফলে সে সকল মন্দিরাদি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে এবং আধুনিক আফগান প্রভৃতি এমন অসভ্য মূর্খ হয়ে গেছে যে, সে সকল প্রাচীন স্থাপত্য নকল করা দূরে থাকুক, জিন প্রভৃতি অপদেবতাদের নির্মিত বলে বিশ্বাস করে এবং মানুষের যে অত বড় কারখানা করা সাধ্য নয়, তা স্থির ধারণা করেছে।
বর্তমান পারস্য দেশের দুর্দশার প্রধান কারণ এই যে, রাজবংশ হচ্ছে প্রবল অসভ্য তুর্কীজাতি ও প্রজারা হচ্ছে অতি সুসভ্য আর্য—প্রাচীন পারস্য জাতির বংশধর। এই প্রকারে সুসভ্য আর্যবংশোদ্ভব গ্রীক ও রোমদিগের শেষ রঙ্গভূমি কনষ্টাণ্টিনোপল সাম্রাজ্য মহাবল বর্বর তুরস্কের পদতলে উৎসন্নে গেছে। কেবল ভারতবর্ষের মোগল বাদশারা এ নিয়মের বহির্ভূত ছিল—সেটা বোধ হয় হিন্দু ভাব ও রক্ত-সংমিশ্রণের ফল। রাজপুত বারট ও চারণদের ইতিহাসগ্রন্থে ভারতবিজেতা সমস্ত মুসলমান বংশই তুরস্ক নামে অভিহিত। এ অভিধানটি বড় ঠিক, কারণ ভারতবিজেতা মুসলমানবাহিনীচয় যে-কোনও জাতিতেই পরিপূর্ণ থাক না কেন, নেতৃত্ব সর্বদা এই তুরস্ক জাতিতেই ছিল।
বৌদ্ধধর্মত্যাগী মুসলমান তুরস্কদের নেতৃত্বে—বৌদ্ধ বা বৈদিকধর্মত্যাগী তুরস্কাধীন এবং তুরস্কের বাহুবলে মুসলমানকৃত হিন্দুজাতির অংশবিশেষের দ্বারা পৈতৃকধর্মে স্থিত অপর বিভাগদের বারংবার বিজয়ের নাম ‘ভারতবর্ষে মুসলমান আক্রমণ, জয় ও সাম্রাজ্য সংস্থাপন’। এই তুরস্কদের ভাষা অবশ্যই তাদের চেহারার মত বহু মিশ্রিত হয়ে গেছে, বিশেষতঃ যে সকল দল মাতৃভূমি চাগওই হতে যত দূরে গিয়ে পড়েছে, তাদের ভাষা তত মিশ্রিত হয়ে গেছে। এবার পারস্যের শা প্যারিশ প্রদর্শনী দেখে কনষ্টাণ্টিনোপল হয়ে রেলযোগে স্বদেশে গেলেন। দেশকালের অনেক ব্যবধান থাকলেও, সুলতান ও শা সেই প্রাচীন তুর্কী মাতৃভাষায় কথোপকথন করলেন। তবে সুলতানের তুর্কী—ফার্সী, আরবী ও দু-চার গ্রীক শব্দে মিশ্রিত, শা-এর তুর্কী—অপেক্ষাকৃত শুদ্ধ।
প্রাচীনকালে এই চাগওই-তুরস্কের দুই দল ছিল। এক দলের নাম ‘সাদা-ভেড়ার’ দল, আর এক দলের নাম ‘কালো-ভেড়ার’ দল। দুই দলই জন্মভূমি কাশ্মীরের উত্তর ভাগ হতে ভেড়া চরাতে চরাতে ও দেশ লুটপাট করতে করতে ক্রমে কাস্পিয়ান হ্রদের ধারে এসে উপস্থিত হয়। সাদা-ভেড়ারা কাস্পিয়ান হ্রদের উত্তর দিয়ে ইওরোপে প্রবেশ করলে এবং ধ্বংসাবশিষ্ট এক টুকরা নিয়ে হুঙ্গারী নামক রাজ্য স্থাপন করলে। কালো-ভেড়ারা কাস্পিয়ান হ্রদের দক্ষিণ দিয়ে ক্রমে পারস্যের পশ্চিমভাগ অধিকার করে, ককেশাস পর্বত উল্লঙ্ঘন করে, ক্রমে এশিয়া-মাইনর প্রভৃতি আরবদের রাজ্য দখল করে বসে ও ক্রমে খলিফার সিংহাসন অধিকার করে। পশ্চিম রোম সম্রাজ্যের যেটুকু বাকী ছিল, সেটুকুও পরে উদরসাৎ করে। অতি প্রাচীনকালে এই তুরস্ক জাতি সাপের পূজা করত। বোধ হয় প্রাচীন হিন্দুরা এদেরই নাগ-তক্ষকাদি বংশ বলত। তারপর এরা বৌদ্ধ হয়ে যায়। পরে যখন যে দেশ জয় করত, প্রায় সেই দেশের ধর্মই গ্রহণ করত। অপেক্ষাকৃত আধুনিককালে—যে দু-দলের কথা আমরা বলছি, তাদের মধ্যে সাদা ভেড়ারা ক্রিশ্চানদের জয় করে ক্রিশ্চান হয়ে গেল, কালো-ভেড়ারা মুসলমানদের জয় করে মুসলমান হয়ে গেল। তবে এদের ক্রিশ্চানী বা মুসলমানীতে অনুসন্ধান করলে নাগপূজার স্তর এবং বৌদ্ধ স্তর এখনও পাওয়া যায়।
হুঙ্গারিয়ানরা জাতি এবং ভাষায় তুরস্ক হলেও ধর্মে ক্রিশ্চান রোমান-ক্যাথলিক। সেকালে ধর্মের গোঁড়ামি—ভাষা, রক্ত, দেশ প্রভৃতি কোন বন্ধনী মানত না। হুঙ্গারিয়ানদের সাহায্য না পেলে অস্ট্রিয়া প্রভৃতি ক্রিশ্চান রাজ্য অনেক সময়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হত না। বর্তমানকালে বিদ্যার প্রচার, ভাষাতত্ত্ব, জাতিতত্ত্বের আবিষ্কার দ্বারা রক্তগত ও ভাষাগত একত্বের উপর অধিক আকর্ষণ হচ্ছে, ধর্মগত একত্ব ক্রমে শিথিল হয়ে যাচ্ছে। এইজন্য কৃতবিদ্য হুঙ্গারিয়ান ও তুরস্কদের মধ্যে একটা স্বজাতীয়ত্ব ভাব দাঁড়াচ্ছে।
অস্ট্রিয়া-সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হলেও হুঙ্গারি বারংবার তা হতে পৃথক্ হবার চেষ্টা করেছে। অনেক বিপ্লব-বিদ্রোহের ফলে এই হয়েছে যে হুঙ্গারি এখন নামে অষ্ট্রিয় সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ আছে বটে, কিন্তু কার্যে সম্পূর্ণ স্বাধীন। অষ্ট্রিয় সম্রাটের নাম ‘অস্ট্রিয়ার বাদশা ও হুঙ্গারির রাজা’। হুঙ্গারির সমস্ত আলাদা, এবং এখানে প্রজাদের ক্ষমতা সম্পূর্ণ। অষ্ট্রিয় বাদশাকে এখানে নামমাত্র নেতা করে রাখা হয়েছে, এটুকু সম্বন্ধও বেশী দিন থাকবে বলে বোধ হয় না। তুর্কীর স্বভাবসিদ্ধ রণকুশলতা, উদারতা প্রভৃতি গুণ হুঙ্গারিয়ানে প্রচুর বিদ্যমান। অপিচ মুসলমান না হওয়ায়, সঙ্গীতাদি দেবদুর্লভ শিল্পকে শয়তানের কুহক বলে না ভাবার দরুন সঙ্গীত-কলায় হুঙ্গারীয়ানরা অতি কুশলী ও ইওরোপময় প্রসিদ্ধ।
পূর্বে আমার বোধ ছিল, ঠাণ্ডা দেশের লোক লঙ্কার ঝাল খায় না, ওটা কেবল উষ্ণপ্রধান দেশের কদভ্যাস। কিন্তু যে লঙ্কা খাওয়া হুঙ্গারিতে আরম্ভ হল ও রোমানী বুলগারী প্রভৃতিতে সপ্তমে পৌঁছল, তার কাছে বোধ হয় মান্দ্রাজীও হার মেনে যায়।
(ক্রমশ)