পরিব্রাজক(প্রথম পর্ব),পরিব্রাজক (২য় পর্ব) পরিব্রাজক (৩য় পর্ব), পরিব্রাজক (৪র্থ পর্ব), পরিব্রাজক (৫ম পর্ব) পরিব্রাজক (৬ষ্ঠ পর্ব) পরিব্রাজক (৭ষ্ঠ পর্ব)
(অষ্টম পর্ব)
স্বামী বিবেকানন্দ
কলকাতা বন্দর থেকে বাষ্পচালিত জাহাজ গোলকোন্ডায় তিন সন্ন্যাসীকে সঙ্গে নিয়ে বিবেকানন্দ চলেছেন পশ্চিমের উদ্দেশ্যে। জাহাজে বসে উদ্বোধন পত্রিকার সম্পাদক স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লেখা চিঠিতে জানাচ্ছেন—
১৪ই জুলাই রেড-সী পার হয়ে জাহাজ সুয়েজ পৌঁছুল। সামনে সুয়েজ খাল। জাহাজে সুয়েজে নামাবার মাল আছে। তার উপর এসেছেন মিসরে প্লেগ, আর আমরাও সম্ভবত প্লেগ আনছি। দুই তরফের ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়। মাল নামবে, কিন্তু সুয়েজের কুলি জাহাজ ছুঁতে পারবে না। জাহাজে খালাসী বেচারাদের আপদ আর কি! তারাই কুলি হয়ে ক্রেনে করে মাল তুলে আলটপকা নীচে সুয়েজী নৌকায় ফেলছে, তারাই নিয়ে ডাঙায় যাচ্ছে। কোম্পানীর এজেণ্ট ছোট লঞ্চে করে জাহাজের কাছে এসেছেন, ওঠবার হুকুম নেই। কাপ্তেনের সঙ্গে জাহাজে নৌকায় কথা হচ্ছে। এ তো ভারতবর্ষ নয় যে, গোরা আদমী… প্লেগ আইন-ফাইন সকলের পার—এখানে ইওরোপের আরম্ভ। পাছে স্বর্গে ইঁদুর-বাহন প্লেগ ওঠে, তাই এত আয়োজন। প্লেগ-বিষ—প্রবেশ থেকে দশ দিনের মধ্যে ফুটে বেরোন, তাই দশ দিনের আটক।
আমাদের কিন্তু দশ দিন হয়ে গেছে—ফাঁড়া কেটে গেছে। কিন্তু মিসরী আদমীকে ছুঁলেই আবার দশ দিন আটক। তাহলে নেপল্সেও লোক নামানো হবে না, মার্সাইতেও নয়। কাজেই যা কিছু কাজ হচ্ছে, সব আলগোছে। ধীরে ধীরে মাল নামাতে সারাদিন লাগবে। রাত্রিতে জাহাজ অনায়াসেই খাল পার হতে পারে, যদি সামনে বিজলীর আলো পায়। কিন্তু সে আলো পরাতে গেলে, সুয়েজের লোককে জাহাজ ছুঁতে হবে। তাহলেই দশ দিনের কোয়ারেন্টাইন (quarantine)। কাজেই রাতেও যাওয়া হবে না, চব্বিশ ঘণ্টা এইখানে পড়ে থাকো—সুয়েজ বন্দরে।
এটি বড় সুন্দর প্রাকৃতিক বন্দর। প্রায় তিন দিকে বালির ঢিপি আর পাহাড়, জলও খুব গভীর। জলে অসংখ্য মাছ আর হাঙর ভেসে ভেসে বেড়াচ্চে। এই বন্দরে আর অষ্ট্রেলিয়ার সিডনি বন্দরে যত হাঙর, এমন আর দুনিয়ার কোথাও নাই। বাগে পেলেই তারা মানুষ খেয়েছে। জলে নামে কে?
সকাল বেলা খাবার-দাবার আগেই শোনা গেল যে, জাহাজের পেছনে বড় বড় হাঙর ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে। জলজ্যান্ত হাঙর আগে আর কখনও দেখিনি। গতবারে আসবার সময়ে সুয়েজে জাহাজ অল্পক্ষণই ছিল, তা-ও আবার শহরের গায়ে। হাঙরের খবর শুনেই, আমরা তাড়াতাড়ি উপস্থিত। সেকেণ্ড কেলাসটি জাহাজের পিছনদিকে। সেই ছাদ থেকে বারান্দা ধরে কাতারে কাতারে স্ত্রী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে, ঝুঁকে হাঙর দেখছে। আমরা যখন হাজির হলুম, তখন হাঙর মিঞারা একটু সরে গেছেন। মনটা বড়ই ক্ষুণ্ণ হল। কিন্তু দেখি যে, জলে গাঙধাড়ার মত এক প্রকার মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে ভাসছে। আর এক রকম খুব ছোট মাছ জলে থিকথিক করছে। মাঝে মাঝে এক-একটা বড় মাছ, অনেকটা ইলিশ মাছের চেহারা, তিরের মত এদিক ওদিক দৌড়চ্ছে। মনে হল, বুঝি উনি হাঙরের বাচ্চা। কিন্তু জিজ্ঞাসা করে জানলুম—ওর নাম ‘বনিটো’। আগে ওর বিষয়ে পড়া ছিল বটে। মালদ্বীপ হতে উনি শুঁটকিরূপে আমদানী হন হুড়ি চড়ে—তাও পড়া ছিল। ওর মাংস লাল ও বড় সুস্বাদ—তাও শোনা আছে। এখন ওর তেজ আর বেগ দেখে খুশি হলাম। অত বড় মাছটা তিরের মত জলের ভিতর ছুটছে, আর সে সমুদ্রের কাঁচের মত জল, তার প্রত্যেক অঙ্গ-ভঙ্গি দেখা যাচ্ছে।
ক্রমে তিতিবিরক্ত হয়ে আসছি, এমন সময়ে একজন বললে—ওই ওই! দশ-বারো জনে বলে উঠল—ওই আসছে, ওই আসছে! চেয়ে দেখি, দূরে একটা প্রকাণ্ড কালো বস্তু ভেসে আসছে, পাঁচ সাত ইঞ্চি জলের নীচে। ক্রমে বস্তুটা এগিয়ে আসতে তার প্রকাণ্ড থ্যাবড়া মাথা দেখা দিল। গদাইলস্করি চালে আসছে, আগে আগে দু-একটা ছোট মাছ। কতকগুলো ছোট মাছ তার পিঠে গায়ে পেটে খেলে বেড়াচ্ছে। কোন-কোনটা আবার জেঁকে তার ঘাড়ে চড়ে বসছে। ইনিই স-সাঙ্গোপাঙ্গ হাঙর। যে মাছগুলি হাঙরের আগে আগে যাচ্ছে, তারা হল আড়কাটী মাছ—‘পাইলট ফিস’। হাঙরকে শিকার দেখিয়ে দিয়ে তারা বোধহয় প্রসাদ-ট্রসাদ পায়।
যে মাছগুলি আশেপাশে ঘুরছে, পিঠে চড়ে বসছে, তারা হাঙর-‘চোষক’। তাদের বুকের কাছে প্রায় চার ইঞ্চি লম্বা ও দুই ইঞ্চি চওড়া চেপ্টা গোলপানা একটি স্থান আছে। তার মাঝে… যেমন ইংরেজী অনেক রবারের জুতোর তলায় লম্বা লম্বা জুলি-কাটা কিরকিরে থাকে, তেমনি জুলি-কাটাকাটা। সেই জায়গাটা ওই মাছ, হাঙরের গায়ে দিয়ে চিপসে ধরে। এরা নাকি হাঙরের গায়ের পোকা-মাকড় খেয়ে বাঁচে। এই দুইপ্রকার মাছ পরিবেষ্টিত না হয়ে হাঙর চলেন না। আর এদের, নিজের সহায়-পারিষদ জ্ঞানে কিছু বলেনও না।
সেকেণ্ড কেলাসের লোকগুলির বড়ই উৎসাহ। তাদের মধ্যে একজন ফৌজি লোক—তার তো উৎসাহের সীমা নেই। কোথা থেকে জাহাজ খুঁজে একটা ভীষণ বঁড়শি যোগাড় করল। সেরখানেক মাংস দড়ি দিয়ে বঁড়শিতে জড়িয়ে বেঁধে তাতে মোটা এক কাছি বাঁধা হল। হাত চার বাদ দিয়ে একখানা মস্ত কাঠ ফাতনার জন্য লাগানো হল। তারপর ফাতনা-সুদ্ধ বঁড়শি ঝুপ করে জলে ফেলে দেওয়া হল।
জাহাজের নীচে একখান পুলিশের নৌকা—আমরা আসা পর্যন্ত চৌকি দিচ্ছিল, পাছে ডাঙার সঙ্গে আমাদের কোন রকম ছোঁয়াছুঁয়ি হয়। সেই নৌকার উপর আবার দুজন দিব্যি ঘুমচ্ছিল, আর যাত্রীদের যথেষ্ট ঘৃণার কারণ হচ্ছিল। এক্ষণে তারা বড় বন্ধু হয়ে উঠল। হাঁকাহাঁকির চোটে আরব মিঞা চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালেন। কী একটা হাঙ্গামা উপস্থিত ভেবে তিনি কোমর আঁটবার যোগাড় করছেন, এমন সময়ে বুঝতে পারলেন যে অত হাঁকাহাঁকি, কেবল তাকে—কড়িকাষ্ঠরূপ হাঙর ধরবার ফাতনাটিকে টোপ সহ কিঞ্চিৎ দূরে সরিয়ে দেবার অনুরোধ-ধ্বনি। তখন তিনি নিঃশ্বাস ছেড়ে, আকর্ণ-বিস্তার হাসি হেসে একটা বল্লির ডগায় করে ঠেলেঠুলে ফাতনাটাকে দূরে ফেললেন। আর আমরা উদ্গ্রীব হয়ে, পায়ের ডগায় দাঁড়িয়ে, বারান্দায় ঝুঁকে, ওই আসে ওই আসে—শ্রীহাঙরের জন্য ‘সচকিতনয়নং পশ্যতি তব পন্থানং’ হয়ে রইলাম। কিন্তু যার জন্যে মানুষ একপ্রকার ধড়ফড় করে, তাই হতে লাগল—‘সখি শ্যাম না এল’।
সকল দুঃখেরই একটা পার আছে। তখন সহসা জাহাজ হতে প্রায় দুশ’ হাত দূরে, বৃহৎ ভিস্তির মসকের আকার কি একটা ভেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ‘ওই হাঙর, ওই হাঙর’ রব। ‘চুপ চুপ—হাঙর পালাবে।’ ‘বলি, ওহে! সাদা টুপিগুলো একবার নাবাও না, হাঙরটা যে ভড়কে যাবে’—ইত্যাকার আওয়াজ যখন কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে, তাবত সেই হাঙর লবণসমুদ্রজন্মা, বঁড়শিসংলগ্ন মাংসের তালটি উদরাগ্নিতে ভস্মাবশেষ করবার জন্যে, পালভরে নৌকার মত সোঁ করে সামনে এসে পড়লেন। আর পাঁচ হাত—এইবার হাঙরের মুখ টোপে ঠেকেছে। তার ভীম পুচ্ছ একটু হেলল—সোজা গতি চক্রাকারে পরিণত হল। আবার পুচ্ছ একটু বাঁকল, আর সেই প্রকাণ্ড শরীর ঘুরে, বঁড়শিমুখো দাঁড়াল। আবার সোঁ করে আসছে—ওই হাঁ করে বঁড়শি ধরে ধরে! আবার সেই পাপ লেজ নড়ল, আর হাঙর শরীর ঘুরিয়ে দূরে চলল। আবার ওই চক্র দিয়ে আসছে, আবার হাঁ করছে। ওই টোপটা মুখে নিয়েছে। এইবার—ওই চিতিয়ে পড়ল। টোপ খেয়েছে—টান টান টান, চল্লিশ পঞ্চাশ জনে টান, প্রাণপণে টান। কী জোর মাছের! কী ঝটাপট, কী হাঁ। টান টান। জল থেকে এই উঠল, ঐ যে জলে ঘুরছে, আবার চিতুচ্ছে, টান টান। যাঃ টোপ খুলে গেল! হাঙর পালাল। তাই তো হে, তোমাদের কি তাড়াতাড়ি বাপু! একটু সময় দিলে না টোপ খেতে! যেই চিতিয়েছে অমনি কি টানতে হয়? আর—‘গতস্য শোচনা নাস্তি’; হাঙর তো বঁড়শি ছাড়িয়ে চোঁচা দৌড়। আড়কাটী মাছকে উপযুক্ত শিক্ষা দিলে কিনা তা খবর পাইনি, মোদ্দাকথা— হাঙর চোঁচা।
কিন্তু নেহাত হতাশ হবার প্রয়োজন নেই—ঐ যে পলায়মান ‘বাঘার’ গা ঘেঁষে আর একটা প্রকাণ্ড থ্যাবড়ামুখো চলে আসছে! আহা, হাঙরদের ভাষা নেই। নইলে ‘বাঘা’ নিশ্চিত পেটের খবর তাকে দিয়ে সাবধান করে দিত। নিশ্চিত বলত, ‘দেখ হে সাবধান, ওখানে একটা নতুন জানোয়ার এসেছে, বড় সুস্বাদ সুগন্ধ মাংস তার, কিন্তু কি শক্ত হাড়! এতকাল হাঙর-গিরি করছি, কত রকম জানোয়ার—জ্যান্ত, মরা, আধমরা—উদরস্থ করেছি, কত রকম হাড়-গোড়, ইঁট-পাথর, কাঠ-টুকরো পেটে পুরেছি, কিন্তু এ হাড়ের কাছে আর সব মাখম হে—মাখম! এই দেখ না—আমার দাঁতের দশা, চোয়ালের দশা কি হয়েছে’—বলে একবার সেই আকটিদেশ-বিস্তৃত মুখ ব্যাদান করে আগন্তুক হাঙরকে অবশ্যই দেখাত।
সেও প্রাচীনবয়স-সুলভ অভিজ্ঞতা সহকারে—চ্যাঙ-মাছের পিত্তি, কুঁজো-ভেটকির পিলে, ঝিনুকের ঠাণ্ডা সুরুয়া ইত্যাদি সমুদ্রজ মহৌষধির কোন-না-কোনটা ব্যবহারের উপদেশ দিতই দিত। কিন্তু যখন ওসব কিছুই হল না, তখন—হয় হাঙরদের ভাষার অভাব, নতুবা ভাষা আছে, কিন্তু জলের মধ্যে কথা কওয়া চলে না! অতএব যতদিন না কোন প্রকার হাঙুরে অক্ষর আবিষ্কার হচ্ছে, ততদিন সে ভাষার ব্যবহার কেমন করে হয়?—অথবা ‘বাঘা’ মানুষ-ঘেঁষা হয়ে মানুষের ধাত পেয়েছে, তাই থ্যাবড়াকে আসল খবর কিছু না বলে, মুচকে হেসে, ‘ভাল আছ তো হে’ বলে সরে গেল।
(ক্রমশ)
কৃতজ্ঞতা: উদ্বোধন কার্যালয়, রামকৃষ্ণ মিশন