বনের ডায়েরি-বন বন্দুকের ডায়েরি- সাদা বাঘ -মার্ভিন স্মিথ অনু-দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য-শীত২০২২

বন বন্দুকের ডায়েরি আগের পর্বঃ হাতি হাতি, শঙ্খচূড়ের ডেরায়, আলাদিনের গুহা, শিকারী বন্ধু গোন্দ, হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (১), হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (২)বোয়া সাপের খপ্পরে, বে-ডর লছ্‌মণ, মানুষখেকো নেকড়ে , নেকড়ে মানুষ সিয়াল, বাঘমারা ভীম, ডাইনি প্যান্থার, মহিষাসুরের খপ্পরে, অরণ্যের সন্তান জুয়াং, জল হুপু

bonerdiarysadabagh

“এখন তক সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কোন জানোয়ার আমার হাতে শিকার হয়েছে তাই জানতে চাইছেন সাহেব? তা আমরা বাঘমারিরা আর ও-সব ভয়টয় আর পাব কেমন করে? ফাঁদ পেতে বসে থাকি। নসিবে থাকলে তাইতে শিকার পড়ে, নইলে পড়ে না। তাতে বিপদটপদ তেমন কিছু নেই তো! সন্ধেবেলা গিয়ে তিরধনুক লাগিয়ে ফাঁদ পেতে রেখে আসি, আর সকালবেলা গিয়ে দেখি তার তির ছুটেছে কি না, ব্যস। যদি ছুটে থাকে তাহলে ঘা খাওয়া জানোয়ারটার পায়ের ছাপ ধরে গিয়ে তার শরীরটা খুঁজে বের করে আনি। বড়োজোর একটা দিন সময় লাগে তাতে।  তবে হ্যাঁ, মুশকিল হয় ভালুকে তির খেলে। একে তো মরতে সময় নেয় বেশি, তার ওপরে তির খেলে এরা সোজা নিজের গুহায় পালিয়ে যায় মরবার জন্য।

“উঁহু। ঘা খাওয়া জানোয়ারকে জ্যান্ত পেলে আমরা কক্ষণো তার কাছ ঘেঁষি না। চুপচাপ ফিরে যাই। তারপর কিছু বাদে ফের গিয়ে দেখি তার প্রাণটা গেল কি না। কেউটের বিষ মাখা তির কাজে লাগালে জন্তুটার চোখে কালঘুম নামবে। সেই ঘুমের মধ্যেই প্রাণটা বেরিয়ে যাবে তার। কুচিলার বিষ, সে-ও বেশ ভাল। তবে করেত সাপের বিষ খুব একটা সুবিধের নয়। ও সাপের বিষমাখানো তিরের ঘা থেকে খানিক রক্ত বেরিয়ে গেলেই বিষ আর কাজ করে না।

“আজ্ঞে হ্যাঁ সাহেব। এই সব বিষেরই পালটা ওষুধও আমাদের জানা। মানুষজন বিষের তিরের খোঁচা খেলে জঙ্গলের পাতালতার পুলটিশ বানিয়ে আমরা তাইতে লাগাই। ওতেই তারা সেরে যায়। তবে হ্যাঁ, খোঁচা খাওয়ার আধঘণ্টার ভেতর সেখানটায় যদি ফোস্কা ওঠে, তাহলে লোকটা প্রাণে বেঁচে যাবে।  সেইটি না হলে তার প্রাণের আশা ছাড়তে হয় আমাদের।

“তবে হ্যাঁ, জংলি জানোয়ারের থেকে এমনিতে বিপদ আপদ বিশেষ না এলেও একবার কিন্তু আমি বেজায় মুশকিলে পড়েছিলাম একটা শিকার করতে গিয়ে। ঐ একখানা জানোয়ারের জন্য, গাংপুরে বছরসাতেক আগে বিশটা লোক প্রাণের ভয়ে কেঁপেছিল। সেই কথাই বলি।

“সাহেব তো মোটি-জোড় চেনেন। কদিন আগেই তো ও-হাঁস নদীর ধারে শিকার করলেন আপনি। বড়োসড়ো। হলুদ রঙের বুক। তার ও-নাম কেন জানেন? ও জীব একবার জুড়ি বাঁধলে তখন সারাজীবনেও সে জুড়ি ভাঙে না। বড়ো ভাবভালোবাসা হয় সে-জুড়িতে। এমন মজবুত জুড়ি বলে আমরা ওকে মোটি জোড় বলি। গ্রামগঞ্জে মেয়েমদ্দে অমন ভাবভালোবাসা দেখলে আমরা তাই তাদের মোটি জোয়ারের জুটি বলে ডাকি। যে পাখিটাকে আপনি মেরেছিলেন, তার জুড়িটা সেদিন ওখানেই চুপটি করে দাঁড়িয়েছিল খেয়াল করেছিলেন? হুজুরের দয়ার শরীর তাই সেটাকে বাগে পেয়েও ছেড়ে দিলেন সেদিন। কিন্তু ওর কাছে হেঁটে গিয়ে বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করলেও ও জুড়ির মরবার জায়গাটুকু ছেড়ে নড়ত না। ওর দলবল সব উড়ে গেল। আর ও বেচারা একলা একলা ওইখানটাতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকল। এর চাইতে বেশি ভালোবাসা আর কার হয়?

“রাতের বেলা ওরা দল বেঁধে থাকে না কিন্তু। জোড়ায় জোড়ায় নদীর ওপারে গিয়ে রাত কাটায়। সাহেব তো রাত জুড়ে ওদের সেই ‘কোয়া কোয়া’ ডাক শুনেইছেন।

“আহা ব্যস্ত হবেন না। আসল গল্পে এইবারে আসব আমি। সাদা বাঘের গল্প সাহেব। আজ্ঞে হ্যাঁ। সাদা বাঘ! নফর হুজুরের কাছে মিথ্যে বলবে না। এই দুটো চোখ দিয়ে আমি তাকে দেখেছি। আরো অনেকে দেখেছে, কিন্তু তাদের কেউ তো আর এখানে নেই, যে আমার কথায় সাক্ষি দেবে?

“না না, খোদ ডোরাকাটা বাঘ সাহেব, প্যান্থার নয়। এই নফর তো সারাজীবন জঙ্গলে-জঙ্গলেই কাটিয়ে দিল। এইটুকু তফাৎ সে বুঝবে না?  হ্যাঁ। গাংপুরে সাদা বাঘ আছে বইকি। নিশ্চয় আছে। আমি নিজে হাতে তাদের একটাকে মেরেছিলাম তো।

“আমাদের রাজাসাহেবের ঘর সেখানে, সেই গ্রামে সেবার বাঘ বের হল। কয়েকটা গরুমোষ মারলও। তার থাবার ছাপগুলো খানিক ছোটো ছোটো। তাই দেখে কেউ কেউ বলল, ও-জন্তু বাঘ নয়। প্যান্থার। কিন্তু আমি ঠিক বুঝেছিলাম, চেহারায় ছোটো হলে কী হয় ও আসল বাঘেরই থাবার দাগ। থাবাটার সামনে পরিষ্কার আঙুলের ছাপ ছিল। ওইটে বাঘেরই লক্ষণ। প্যান্থারের ছাপে আঙুলের চিহ্ন খুব হালকা হয়। ওরা গাছে চড়ে কি না! তাই নোখের ধার বাঁচাবার জন্য থাবার পেছনটা দিয়ে ছোটে। মাটিতে আঙুলের ওপর মোটে চাপ দেয় না। বাঘ তেড়ে এলে হুজুর গাছে উঠে জান বাঁচাতে পারবেন। কিন্তু প্যান্থার? তার কাছে গাছে উঠে পালাবার জো নেই। একবার  নিজের চোখে দেখেছিলাম আমি। ঠিক কাঠবেড়ালির মত তড়বড়িয়ে গাছে উঠে মগডালে গিয়ে লুকোনো লোকটার ঠ্যাঙে কামড়ে দিয়েছিল।

“তা আমি যখন বললাম জন্তুটা বাঘ, তখন রাজা বলে ‘তাহলে ওইটেকে মেরে দেখাও।’

এরপর বাঘটা যখন ফের গরু মারল, আমি গিয়ে সেখানটায় বিষের তির পেতে এলাম। কিন্তু বাঘ সে-এলাকার ধারেকাছেও ফিরে এল না। এমন করে যতবারই ফাঁদ পাতি, চালাক বাঘ ঠিক তাকে এড়িয়ে পালায়। পরপর ক’দিন এমন হতে   লোকজন আমায় নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিল। বলে, ‘ব্যাটা বাঘমারি না তাঁতী রে? যা যা, বাঘ ছেড়ে শাড়ি বোন গিয়ে ঘরে বসে।’ ”

এই অবধি বলে সে একবার নিজের গোঁফটা চুমড়ে নিল। তারপর ফের বলে, “কিন্তু হুজুর আমি হলাম গিয়ে বাঘমারি। একটা জানোয়ারের কাছে হার মানলে মান-ইজ্জত কিছু থাকবে?  তখন, কাউকে কিচ্ছু না বলে আমি রোজ চুপচাপ জঙ্গলে গিয়ে ঘোরাঘুরি শুরু করলাম। আমার গায়ে কাদা ছুঁড়ে লোক হাসিয়েছে যে কুত্তা তাকে আমি ছাড়ব না। কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করেই নজরে পড়ল, থাবার ছাপ পাশাপাশি দুটো জানোয়ারের। একসঙ্গে ঘোরে তারা। বুঝে গেলাম এরা বাঘ-বাঘিনির জুটি। তারপর থেকে সে-জঙ্গলে যেখানে যা মরে আমি সেখানেই ছুটে যাই আর তাদের পায়ের ছাপ খুঁজি। এই জানোয়ার সব খায়। মাংস হলেই হল। সে হরিণই হোক কী সাপ, ইঁদুর হোক। 

“খুঁজতে খুঁজতে যেখানেই তাদের থাবার ছাপ পাই, সেগুলো কোনদিকে গেছে সেইটে খেয়াল করি। এমনি করে বেশ কিছুদিন খুঁজতে খুঁজতে যতগুলো জায়গায় সে-ছাপ পেলাম তার সবকটাই দেখি সেখান থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের একটা জায়গার দিকেই যাচ্ছে। সে-জায়গাটা একটা পাথুরে এলাকা। বেজায় ঘন জঙ্গল।

“বুঝে গেলাম এইখানটায় বাঘ-বাঘিনির বাসা। এইবার শুরু হল সে-জায়গাটা ঘিরে তল্লাশ। কয়েকদিন ঘোরাফেরা করেই সেখানে তাদের জল খেতে যার রাস্তাটার খোঁজ পেয়ে গেলাম। আর যেখানেই যাক বা না যাক, ওই জল খাবার রাস্তায় তো তাদের দিনে একটিবার হলেও যেতেই হবে! সেই খুঁজে পেয়ে মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললাম, সাবাশ! এইবার সারা গ্রামের লোক দেখবে আমি বাঘমারি না তাঁতী।

“সেদিন সন্ধেবেলা সেই রাস্তায় বিষের তিরের ফাঁদ পেতে রেখে আমি বেশ খুশি খুশি হয়ে বাড়ি গেলাম। গ্রামের কাকপক্ষিকেও বললাম না কোথায় ফাঁদ পেতে রেখে এসেছি। আগে তো মরুক, তারপর বুক বাজিয়ে সবাইকে বলা যাবে’খন। সে-রাত্রে দুচোখ জুড়োতে পারলাম না আমি। ভোর হতে না হতেই ঘর ছেড়ে ফের গিয়ে উঠলাম ফাঁদের কাছে। গিয়ে দেখি কাজ হয়েছে। দুটো তিরই ধনুক থেকে ছিটকে বেরিয়েছে। চারপাশে কোথাও তাদের দেখা নেই। আর মাটিতে রক্ত মাখামাখি হয়ে আছে। তাকে ঘিরে বাঘের হুটোপুটির দাগ।

“আগের দিন তিরে একদম তাজা কেউটের বিষ মাখিয়েছিলাম আমি হুজুর। জানতাম ওতে কাজ হবেই। তখন আমার সে যা আনন্দ, কী বলব! বিয়ের সময় গায়ে হলুদ দিতে বসলে, বা ধরুন আধা দামে একজোড়া হেলে বলদ যদি পেয়ে যান, কিংবা জমিতে চল্লিশগুণ ফসল হলে বা জাতশত্তুরের প্রাণ গেলে যতটা খুশি হয়, তার সবগুলোকে এক করলেও সে-আনন্দের কাছে আসে না। গাছ থেকে ধনুক খুলে নিয়ে আমি যখন গ্রামে ফিরলাম তখন তো আমার বুকের ছাতি এই এতটা বেড়ে গেছে। ঢুকেই সটান পঞ্চায়েত বসবার গাছের তলায় গিয়ে হাজির।

“আমায় দেখেই একটা লোক কাঁধের দড়িদড়া আর ধনুকটা দেখিয়ে ফুট কেটে বলে, “হ্যাঁ রে তাঁতির পো, কাঁধে কি ওটা তাঁত গুটিয়ে রেখেছিস?” শুনে আরেকজন আমার ধনুকটা ধরে বলে, “ওরে তোর এই তাঁতটা দিয়ে আমার বউকে একখানা শাড়ি বুনে দে না। ক্ষেতের আনাজ উঠলে আধমনটাক তাই নিয়ে যাস।”

“সেই শুনে তো চারপাশে হাসির হুল্লোড় উঠল একেবারে। সেই শব্দ শুনে তখন সেখানে আরো লোক এসে জড়ো হচ্ছে। আমি কোনো কথার জবাব না দিয়ে  গ্যাঁট হয়ে বসে রইলাম। খানিক বাদে মুখিয়া সেখানে আসতে মুখ খুললাম আমি। বললাম, ‘ভাইসকল, আর না হেসে গরিব তাঁতির সঙ্গে একবার আসবার আজ্ঞা হোক। একখানা জিনিস  দেখাব আপনাদের।’

“এই বলে আমি একেবারে রাজার হাতির মতন দুলকি চালে  রওনা দিলাম। খানিক বাদে পিছু ফিরে দেখি গোটা গাঁ আমার সঙ্গে চলেছে।  তাদের নিয়ে আমি সটান আমার ফাঁদের জায়গাটাতে গিয়ে হাজির। চোট পেয়ে বাঘ সেখান থেকে যে-পথে পালিয়েছে তার চিহ্ন সেখানে তখন দিব্যি দেখা যাচ্ছে। সেই ধরে ধরে শ-খানেক গজ গিয়েই মহারাজের দেখা পাওয়া গেল। ততক্ষণে সে মরে কাঠ।

“সে ছিল একখানা সাদা বাঘ হুজুর। একেবারে ধবধবে সাদা। গায়ে একটা কালো দাগ অবধি নেই।

“সেই দেখে তখন লোকজনের আমায় নিয়ে সে কী শোরগোল। এমন সময় জীবনে বেশি আসে না সাহেব। তা খানিক পরে আনন্দফুর্তি সেরে লোকজন চলে গেল। শুধু পুজো দেবার জন্য আমার সঙ্গে রইল শুধু গ্রামের শিকারিরা। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বুড়ো যে , সে এবার আমার কপালে একটুখানি খোঁচা মেরে রক্ত বের করল প্রথমে। তারপর সেই রক্ত হাতে নিয়ে মরা বাঘটার মাথায় মাখিয়ে দিল। তারপর সবাই অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়াল আর আমি বাঘটাকে ঘিরে তিনপাক হেঁটে তার গায়ে কপাল ঠুকে তিনবার প্রণাম করলাম। সে-সব শেষ হলে একটা ডান্ডায় বাঘটাকে ঝুলিয়ে নিয়ে গ্রামে ফিরে এলাম দল বেঁধে।  গ্রাঁমে ঢুকতেই শিকারিদের বউরা এসে আমার পা ধুইয়ে দিয়ে সে কী প্রণামের ঘটা!

“আহা আমি বুঝি সাহেব। আপনি এ-সব কথা মোটে শুনতে চান না। বিপদ যে বলেছি সেইটে কোথায় হল তাই শুনার জন্য ছটফট করছেন। একটু সবুর। সব বলছি। সেদিন গ্রামে আর কী কী আনন্দ-ফূর্তি হয়েছিল সে-সব গল্প তাহলে বাদ দিয়ে যাচ্ছি এখন। রাজা কেমন করে আমায় দুটো টাকা আর একটা ধুতি দিল, গাঁয়ের লোকজনও যার যা সাধ্য জিনিসপত্র এনে ডাঁই করে দিল আমার সামনে সে-সব গল্পও আর বলছি না তাহলে। আহা রাগ করবেন না হুজুর। লড়াই জেতার গল্প কাউকে বলতে পারলে আপনি আমি কে না খুশি হই বলুন?

“তা বাঘটার ছালটাল ছাড়িয়ে দেখা গেল সে বেজায় বুড়ো হয়েছে। পুরো পনেরো বছর বয়েস। ছাল ছাড়িয়ে বয়েস ধরলাম কেমন করে? বলছি। বাঘের বয়েস বলে তার যকৃত দেখে। তাতে যতগুলো ভাগ বাঘেরও তত বছর বয়েস হয়।  এর যকৃতে পনেরোটা ভাগের দাগ ছিল। প্যান্থারেরও এ-দাগ হয় সাহেব। কিন্তু আর কোনো জানোয়ারের এমনটা হয় না। সব শিকারিই এইটে জানে। আসলে বাঘ মারলে আগে আমরা ওর যকৃতটা কেটে নিই কি না! ও-দিয়ে দামি ওষুধ তৈরি হয়।

“তা সে যাই হোক, চামড়া ছাড়িয়ে সেটা তো শুকোবার জন্য টাঙিয়ে দেয়া হল। তার মাথাটার হাড় বের করে ফেলে দিয়ে তাতে খড় পুরে মুখখানাকে হাঁ করিয়ে রাখা হয়েছিল। রাত হলে চামড়াটা খুলে এনে একটা খালি গোয়ালের ভেতর কয়েকটা কাঠি পুঁতে তার ওপরে রেখে দিয়ে এলাম। সে গোয়াল আমাদের ঘর থেকে গজতিরিশেক দূরে। তবে ওর পাশেই আরেকটা গোয়ালে বেশ কটা বলদ বাঁধা ছিল।

“কাজটাজ মিটিয়ে ঘরে ফিরে দু-দণ্ড বসেছি সবে, তা হঠাৎ দূরে শুনি আরেকটা বাঘ ঘাঁউ ঘাঁউ করে ডাক ছেড়েছে।  বুঝলাম, সেটা এই বাঘটার জুড়ি। বাঘ সাধারণত তার জুড়িকে ডাকবার সময় ছাড়া অমন আওয়াজ ছাড়ে না।

“খানিক বাদে শুনি শব্দটা বেশ কাছে এগিয়ে এসেছে। একটু বাদেই সেটা একেবারে সেই গোয়ালের ধারে পৌঁছে গেল। পাশের গোয়ালের বলদগুলোর তখন ভয় পেয়ে সেকি হাঁকডাক! বাঘ তাড়াবার জন্য আমরা তখন সবাই মিলে বেজায় চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিয়েছি। কিন্তু তাতে সে বাঘের কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই তখন। সে কেবল গোয়ালটা ঘিরে পাক মারে আর ঘাঁউ ঘাঁউ করে ডাকে। খানিক বাদে শব্দ শুনে টের পেলাম সে লাফ মেরে গোয়ালের চালে উঠেছে। ভয়ে তখন আমরা সব চুপ মেরে গেছি। গোয়ালের ছাদে খানিকক্ষণ গরগর করে শব্দ হল। তারপর হুড়মুড় করে চাল ভেঙে পড়ার আওয়াজ আর সেই সঙ্গে বাঘের বিরাট হাঁকার উঠতে বুঝলাম চালের খড় ছিঁড়ে বাঘ গোয়ালের ভেতরে ঢুকেছে। খানিক বাদে খালি গোয়াল ছেড়ে সে এসে তার পাশের গোয়ালে ঢুকতে সেখানকার বলদগুলো ভয়ে দড়িকাড়া ছিঁড়ে পালাবার তাল করেছিল। কিন্তু বাঘের সঙ্গে পারলে তো! লাফ মেরে তাদের মধ্যে পড়ে চোখের নিমেষে চারচারটে বলদের এন্তেকাল করে দিল সে থাবার ঘায়ে। আর তারপর ফের খালি গোয়ালের ভেতরে গিয়ে ঢুকে সেকী হাঁকডাক তার। এই গরগর করে তো এই আকাশ ফাটানো হাঁক দেয়। একেকবার শদুয়েক গজ দূরে গিয়ে একটা করে হাঁক দেয়, তারপর কান খাড়া করে শোনে। খানিক বাদে জবাবি হাঁক না পেয়ে ফের ফিরে আসে গোয়ালের ভেতরে।

“ সারাটা রাত সে এই করে কাটিয়েছিল সেদিন। গ্রামের একটা প্রাণী সেদিন ভয়ের চোটে ঘুমোতে পারেনি। তারপর সকালের আলো ফুটতে না ফুটতে সে-বাঘ হাঁকার ছাড়তে ছাড়োতে গ্রাম পেরিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে গেল। তখন বাইরে বেরিয়ে দেখি, সে এক সাংঘাতিক দৃশ্য। গোয়ালের ছাদ ভেঙে চুরমার। বেড়ার মোটা মোটা বাঁশগুলো অবধি রাগের চোটে কামড়ে দুখানা করে রেখেছে সব। গোটা গোয়ালটা একেবারে তছনছ করে রেখে দিয়ে গেছে সে। শুধু তার মধ্যে রাখা বাঘের চামড়াটাকে ছুঁয়েও দেখেনি। 

 “চামড়াটা খুলে নিয়ে আমরা দু-মাইল দূরে রাজার ঘরে গেলাম। সেখানে এক বুড়ো শিকারি বসে ছিল তখন। জঙ্গলের সব খবর থাকে তার কাছে। রাজাকে যখন আমাদের গল্প বলছি তখন তাই শুনে সে মাথা নেড়ে বলে, ‘এ-হল মোটি-জোড় বাঘ। ওর সাথীর চামড়া যেখানেই থাকুক, প্রাণ থাকতে ও কিছুতেই তার কাছছাড়া হবে না। আর যে গ্রামে ও জিনিস থাকবে সেখানে একটা জনপ্রাণীও বাঁচবে না ওর হাতে থেকে।

“শুনে রাজা চামড়াটাকে একটা শক্তপোক্ত গোলার ভেতর রাখবার হুকুম দিলেন। তারপর বিশটা বন্দুকবাজকে বললেন গোলার কাছে মাচান বেঁধে পাহারা দিতে। সেখানে বাঘ এলে তার আর নিস্তার নেই। সে-রাত্রে গ্রামের সবাই দরজায় শক্ত করে খিল এঁটে, সামনে কাঠকুটো দিয়ে বেড়া বানিয়ে রেখে শুতে গেল। আমি শিকারিদের সঙ্গে মাচানের ওপর উঠলাম গিয়ে।

“রাত হল। বাঘের কোনো সাড়াশব্দ ওঠে না আর। এমনি করে আধাআধি রাত যখন নির্ঝঞ্ঝাটে পেরিয়ে গেছে তখন আমাদের ভয় কেটে মন বেশ হালকা হল। সবাই মিলে তখন সেই বুড়ো শিকারিকে নিয়ে হাসিঠাট্টা শুরু হয়ে গেল মাচানের ওপরে। আর ঠিক তখনই আচমকা মাচানের ঠিক নীচে থেকে রক্তজমানো হাঁকার উঠল একটা। শুনেই তো  আমরা সবাই মাচানের ওপর শুয়ে পড়ে মুখ ঢেকে ফেলেছি ভয়ে।

“খানিক বাদে সেই শুয়েশুয়েই শুনি গোলার দরজায় বাঘের নখের আওয়াজ উঠছে। বুঝলাম বাঘটা গোলার দরজা ভাঙবার তালে আছে। অন্ধকারে বাঘটাকে দেখা যাচ্ছিল না। তবু ওর মধ্যেই আমাদের কয়েকজন হইহল্লা করে বন্দুক ফাটিয়ে তুলকালাম জুড়ে দিল, যদি বাঘ তাতে ভয় পায়। কিন্তু কোথায় কী? বাঘ সে’সবে পাত্তাই দিল না কোনো। সে তখন একমনে গোলার দরজায় নখ চালিয়ে চলেছে। আর তার সঙ্গেসঙ্গে সে কী হুঙ্কার! খানিক সেইরকম চলবার পর, ঠিক করা হল বেশ ক’জন মিলে একসঙ্গে গোলার দরজা তাক করে গুলি চালানো হবে। সেইমতন গুলি তো চালানো হল। তাতে ফল হল উলটো। বাঘ দেখি আরো দ্বিগুণ তেজে হাঁক দিয়ে গোলার দরজা ছেড়ে এসে, যে গাছে মাচানটা বাঁধা হয়েছে তাইতে চড়বার তাল করছে।

“দলের  আটটা গাদাবন্দুকের মধ্যে ছ-খানার গুলি তখন চালানো হয়ে গেছে। বাকি আছে আর মোটে দু-খানা। ওদুটোয় কাজ না হলে, বাঘ যদি একবার মাচায় এসে উঠতে পারে তাহলে তো আমরা গেছি। বলব কী হুজুর, আমার দশা তখন একটা ন্যাকড়ার পুতুলের মত। একেবারে নেতিয়েই পড়েছি বাঘের ভয়ে। ওদিকে বাঘ তখন বারবার লাফ দিয়ে গাছের গুঁড়িটা বেয়ে খানিক দূর উঠে আসে, তারপর ধপ করে তলায় গিয়ে পড়ে। এমনি বেশ কয়েকবার চেষ্টাচরিত্র করে তারপর ফের সে ফিরে গেল গোলার দরজার দিকে।

“এই ফাঁকে আমাদের  দলের ছটা খালি বন্দুকে ফের বারুদ ঠাসা হয়ে গিয়েছিল। ঠিক করা হল একেকবারে চারটে করে বন্দুক থেকে গুলি ছোঁড়া হবে। তা, বেশ কয়েকবার সেই কায়দায় গুলি চালাবার পর দরজায় আঁচড়ানো থেমে গেল। তবে তখনো তার হাঁকডাক থামেনি। ওঝা গেল খানিক কাজ হয়েছে। তখন তো দ্বিগুণ উৎসাহে ফের বারুদ ঠুসে ঠুসে গুলি চালাবার পালা। সেই করতে করতে অনেকক্ষণ পরে তার হাঁকডাকও থেমে গেল।

“সকালে উঠে দেখলাম, গোলার দরজার পাশটিতে, তার সঙ্গিনীর চামড়ার কাছে মুখ ত্থুবড়ে পড়ে মরে আছে সে। কুড়িটা গুলি লেগেছিল তার গায়ে হুজুর। হ্যাঁ! ছিল বটে একখানা মোটি জোড় ওই বাঘ-বাঘিনি। জান দিয়েছে, কুড়িখানা বুলেট খেয়েছে, তবু সঙ্গীর পাশ ছেড়ে একচুল নড়েনি হুজুর!

বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s