বন বন্দুকের ডায়েরি আগের পর্বঃ হাতি হাতি, শঙ্খচূড়ের ডেরায়, আলাদিনের গুহা, শিকারী বন্ধু গোন্দ, হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (১), হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (২), বোয়া সাপের খপ্পরে, বে-ডর লছ্মণ
মূল: বন বন্দুকের ডায়েরি-মার্ভিন স্মিথ
পি ডবলু ডি-র এক ইঞ্জিনিয়ার কিছুদিন আগে আমায় বলছিলেন, ভারতে যত বন্যজীব আছে তাদের একজনও সাহস বা হিংস্রতায় ভারতীয় নেকড়ের ধারেকাছে আসে না। ভদ্রলোক জীবনের বড়ো একটা অংশ কাটিয়েছেন উত্তর-পশ্চিমে আর অযোধ্যা এলাকায়। ওসব দিকে নেকড়ের প্রাদুর্ভাব বেশি। নেকড়ে যে হিংস্রতায় নরখাদক বাঘকেও কখনো কখনো ছাপিয়ে যেতে পারে তার যথেষ্ট প্রমাণ তিনি ও-সব অঞ্চলে পেয়েছেন।
গয়ার কাছে শিগোটিতে জি টি রোডের ওপর একটা ব্রিজ তৈরি হচ্ছিল। তার জন্য কাছাকাছি ইটের ভাঁটা বসেছে। তার রাতপাহারায় থাকা দিশি সেপাইদের ওপরে নজর পড়েছিল একজোড়া নেকড়ের। প্রায় রাত্রেই তাদের কাউকে না কাউকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল তারা। শেষমেষ অবস্থা এতদূর গড়াল যে দিশি সেপাইদের কেউ আর সন্ধের পর একা সেখানে রাতপাহারায় থাকতে চায় না।
দেখেশুনে ভাঁটার ইট বরাবর চুল্লির ধার ঘেঁষে একটা ঘর তোলা হল। তাতে দুজন করে সেপাইকে একসঙ্গে পাহারায় লাগানো হল। এরপর কয়েকদিন শান্তিতে কাটল। সেদিন রাতে বেশ গরম পড়তে দুই সেপাই মিলে বারান্দায় এসে শুয়েছে। দিশি লোকজনের যেমন স্বভাব, দুজনেই চাদর দিয়ে মাথা ঢাকা দিয়ে ঘুমিয়েছে। মাঝরাতে ঘর ঘর করে একটা শব্দ শুনে এক সেপাই চোখ মেলে দেখে একটা বিরাট নেকড়ে এসে তার বন্ধুর টুঁটি কামড়ে ধরে তাকে টেনে নিয়ে যাবার উপক্রম করেছে আর নেকড়েনি পাশে চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে তার কর্তার কীর্তিকলাপ দেখছে।
দেখেই তো দু-নম্বর সেপাই তার লাঠিগাছা হাতে লাফ দিয়ে উঠে নেকড়ের গায়ে এলোপাথাড়ি পিটতে লেগেছে। প্রথমে তো মার খেয়েও সে কামড় ছাড়বে না, শেষমেশ বেদম মার খেয়ে খানিক পিছিয়ে গিয়ে সে গ্যাঁট হয়ে বসল। তারপর কর্তাগিন্নী মিলে দাঁত বের করে সে কী গরগরানির ধুম!
দু-নম্বর সেপাইয়ের মাথা বেজায় ঠাণ্ডা। বুদ্ধিও নেহাত মন্দ নয়। আড়চোখে তাকিয়ে সে দেখে সন্ধেবেলা যে আগুন জ্বালানো হয়েছিল তাতে তখনো খানিক আংরা ধিকিধিকি জ্বলছে। দেখেই সে একহাতে ঘরের চাল থেকে খানিক খড় টেনে আঙরার ওপর ফেলতে আগুন দপ করে জ্বলে উঠেছে আর নেকড়েদুটোও ভয় পেয়ে একছুটে উধাও। এক ওই আগুনেই যা একটু ভয় খায় এরা।
এক নম্বর সেপাই তখন অজ্ঞান। মাথায় মুড়ি দেওয়া চাদরটা মোটা হওয়ায় তার গলায় সঙ্গে সঙ্গে দাঁত বসাতে পারেনি নেকড়ে। কাজেই ছোটোখাটো কাটাছেঁড়ার ওপর দিয়েই ফাঁড়া কেটেছিল তার সে-রাত্রে।
কয়েক বছর আগের কথা। নাগপুর থেকে জব্বলপুর যাবার হাইওয়ের পাশে সাত-বাউরি (সাত-কুয়ো) গ্রামের পাশে আমি তখন তাঁবু ফেলেছি। গ্রামটা খুব সুবিধের নয়। ওর ঘরে ঘরে চোর। লোকে তাই ওকে সাত-বাউরির বদলে চোর-বাউরি বলে ডাকত। আসলে ও-জায়গার উত্তরের পাহাড়গুলোয় ভিলদের বাসা। ভিলরা হল দেশের সেরা চোর। তা এহেন ভিল মহাপ্রভুদের বেশ কয়েকঘর সে-গ্রামে এসে বাসা নেওয়াতেই গ্রামের এহেন সুনাম। শোনা যাচ্ছিল, ও-এলাকার চারপাশে চুরিডাকাতির রমরমা ব্যাবসা ফেঁদেছে তারা।
তবে তখন সম্প্রতি সে-গ্রামে অন্য একটা রহস্যময় অপরাধ কর্তৃপক্ষের নজর টেনেছিল। গ্রাম থেকে মাঝে মধ্যেই কিছু মানুষ কোনো চিহ্ন না রেখে উধাও হয়ে যাচ্ছিল। কর্তৃপক্ষের তাই সন্দেহ হয়, শুধু চোর নয়, কিছু ঠগিও এসে জুটেছে ও-গ্রামে। সরকারের ঠগি দমন বিভাগের থেকে এক লেফটেন্যান্ট কাম্বারলেজ নামে এক অফিসারও তাই সেখানে এসে থানা দিয়েছেন তখন।
এই কাম্বারলেজ আমাকে একটা আশ্চর্য গল্প শোনায়। গ্রামে এসে তল্লাশি চালিয়ে সে কোনো উটকো লোকজনের সন্ধান পায়নি। ঠগির দল অনেক সময় হিন্দু তীর্থযাত্রী বা ব্যবসায়ীর দলের ভেক ধরেও এসে হাজির হয়। কিন্তু তেমন কোনো দলেরও সন্ধান মেলেনি গ্রামের আশেপাশে। ওদিকে লোক হারানোও থামেনি সে-সব তল্লাশিতে।
ঠগিতত্ত্ব ব্যর্থ হওয়ায় কাম্বারলেজ ভাবল তাহলে বোধ হয় গ্রামের ভিলগুলোই অপকর্মের নাটের গুরু। কিন্তু তত্ত্বতালাশ নিয়ে দেখা গেল ভিলদের নিজেদেরই বেশ কয়েকজন লোক ওইভাবে নিখোঁজ হয়েছে। তারা নিজেরাই তাতে ভয়ে কাতর। বলে এসব ভূতের কীর্তি। তাছাড়া ব্যাপারটা ডাকাতিও হতে পারে না, কারণ যারা হারিয়ে গেছে তারা বেজায় গরিব লোকজন। চুরি করবার মত কানাকড়িও তাদের সঙ্গে ছিল না।
অতএব এইবার কাম্বারলেজের সন্দেহ হল,হয়ত কোনো মানুষখেকো বাঘ ঢুকেছে এলাকায়। কিন্তু সে-তত্ত্বও তার খাটল না। গ্রামের আশপাশে কোথাও বাঘের থাবার কোনো ছাপ নেই। খোঁজারুর
দল এলাকার সমস্ত জঙ্গল ঢুঁড়েও বাঘের কোনো চিহ্ন খুঁজে পেল না।
এইবার সন্দেহ গিয়ে পড়ল মানুষখেকো নেকড়ের ওপর। নেকড়ে ক্বচিৎ মানুষখেকো হয়। কিন্তু একবার হলে তার সাহস ভয়ানক বেড়ে ওঠে। আরো কিছু চিহ্ন ছিল। লোকগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল রাতের বেলা বারান্দায় ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায়। নেকড়ে নিশাচর। দুর্ভাগা মানুষগুলোর একটুকরো হাড়ও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। বাঘ সাধারণত বড়ো হাড়গুলো ফেলে রেখে গেলেও নেকড়ে তার শিকারের হার কড়মড়িয়ে চিবিয়ে খায়। কুকুরের চেয়েও এই হাড়প্রীতি তাদের অনেক বেশি।
কিন্তু এই নেকড়ে তত্ত্বেও ফাঁক থেকে যাচ্ছিল একটা। কারণ, শুরুতে কোনো নেকড়ের থাবার ছাপও দেখা যাচ্ছিল না গ্রামের আশপাশে।
অবশেষে সাবধানে নজরদারি করতে দেখা গেল হারিয়ে যাওয়া লোকজনের বাড়ির কাছাকাছি কিছু সন্দেহজনক পায়ের ছাপ। কোনো চেনা প্রাণীর চিহ্ন নয় সেগুলো। অতএব সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামের ভিল আর অন্যান্য শিকারিরা তাদের ‘ভূত বা রাক্ষস’ তত্ত্বকে ফের জোরদার করে তুলল। চিহ্নগুলো ছিল চারটে করে গোল গর্ত। পনেরো ইঞ্চি তফাতে এক জোড়া করে। আর তার আগেপিছে ব্রাশের দাগের মত কিছু দাগ। তাদের এগিয়ে চলার পথের মাঝে মধ্যে আবার ওরকম দাগটাগ কিচ্ছুই নেই।
সব মিলিয়ে কাম্বারলেজ একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। আমায় যখন সে গল্পটা বলছে তখন সে-গ্রামে তার দিন পনেরো হয়ে গেছে। রহস্যের সমাধানের দিকে এগোনো দূরস্থান, গোটা বিষয়টাই আরো গোল পাকিয়ে গিয়েছে তদ্দিনে। সে আসবার পরেও, তার নাকের ডগা দিয়েই আরো দুজন মানুষ হারিয়ে গেছে গ্রাম থেকে। তাদের একজন হল গ্রামের এক রাখালের বউ। তাকে কুঁড়ের ভেতর থেকে তুলে নিয়ে গেছে। আর অন্যজন হল বছর সতেরোর এক ছোকরা। গ্রামের একেবারে মাঝখানটায় একটা দোকান আছে। শেষবার যখন তাকে দেখা যায় তখন সে ওই দোকানঘরের ভেতর ঘুমিয়ে ছিল।
সব বলেটলে কাম্বারলেজ বলে, “আপনি তো শুনছি মাসখানেক এখানে থাকবেন। কিছু সাহায্য পেলে ভালো হত।”
এর সপ্তাহখানেক বাদে গ্রামের চৌহদ্দি থেকে খানিক দূরে এক ভিলের ছোটো বাচ্চা তার কুঁড়ের ভেতর মায়ের কোল থেকে হারিয়ে গেল। জিজ্ঞাসাবাদ করতে তার মা জানাল, গভীর রাতে সে নাকি কুঁড়ের পাশে হালকা একটা খসখস শব্দ পেয়েছিল। তাইতে চোখ মেলে সে দেখে কোলে তার বাচ্চা নেই। প্রথমে সে ভেবেছিল, বুঝি জেগে উঠে হামা টেনে ঘরের ভেতর কোনোদিকে গিয়েছে। কিন্তু ঘর তোলপাড় করে খুঁজেও তার কোনো চিহ্ন না দেখে সে হাঁকাহাঁকি করে লোক জড়ো করে। বাইরে এসেও বাচ্চাটির কোনো চিহ্ন মেলেনি। শুধু শক্ত মাটির বুকে দু-একফোঁটা রক্তের দাগ বুঝিয়ে দিচ্ছিল, তাকে কোনো জন্তু মুখে করে নিয়ে গেছে।
এইবার বোঝা গেল আমাদের চোরচূড়ামণি আসলে নেকড়েই। কারণ কাম্বারলেজ আর আমি দুজনেই এ-দেশে রাতের অন্ধকারে নেকড়েদের ঘুমন্ত মায়ের কোল থেকে শিশু চুরি করে নিয়ে যাবার ঘটনার কথা আগেও শুনেছি। বেশ কয়েকটা শিকারি কুকুর সঙ্গে নিয়ে এইবার গোটা এলাকাটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলাম আমরা দুজন মিলে। কিন্তু তাতে কোনো ফল হল না।
দিন দুই বাদে লেফটেন্যান্টের খাস আর্দালি সকালবেলা এসে বলে, তার মালিক আমায় ডাকছেন। নাকি আগের রাত্রে বদমাশটা গ্রামে এসে গ্রামের স্যাকরাকে তুলে নিয়ে গেছে। রাস্তায় তার সেই অচেনা থাবার দাগও দেখা গেছে।
তাড়াতাড়ি উঠে গ্রামের ভেতর গিয়ে দেখি স্যাকরার বাড়ির সামনে বেজায় ভিড় জমে গেছে। বাড়ির সামনে ধুলোর ওপর পায়ের ছাপগুলোকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।
এইবারের ছাপগুলো বেশ পরিষ্কার ছিল। পরীক্ষা করে দেখা গেল আগের সব ছাপগুলোর সঙ্গে একইরকম সেগুলোও। তবে এখানে, প্রতিটা ছাপের সামনের গর্তদুটোর চাইতে পেছনের গর্তদুটো যে খানিক বড়ো সেইটা বোঝা যাচ্ছিল। পেছনের গর্তদুটোর থেকে প্রায় দশ ইঞ্চি লম্বা একটা দাগ বেরিয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে আরেকটা আঙুলের গাঁটের মত ছাপে। সামনের গর্তগুলোর সামনের দিকেও সেই গাঁটের দাগ আছে বটে, তবে তা আছে আরো খানিক দূরে।
ওদিকে গ্রামের লোকজন তো তখন রাক্ষসের ব্যাপারে মোটামুটি একমত। এক বুড়ো আবার বলে সে নাকি দানবটাকে চাক্ষুষ দেখেও ফেলেছে। প্রথমে সে দেখা দিয়েছিল একটা বুড়ো মানুষের রূপ ধরে। তারপর সে রূপ বদলে একটা কুকুর হয়ে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
দানবের এহেন ভেলকির কথা শুনে আমরা হাসাহাসি করলেও গ্রামের লোকজন দেখি তার কথায় দিব্যি বিশ্বাস করে ফেলেছে। তবে তখন এ-নিয়ে হাসাহাসি করলেও পরে দেখা গিয়েছিল তার কথাটায় খুব একটা মিথ্যে ছিল না।
খুব সাবধানে চিহ্নগুলো ধরে ধরে এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল, সেগুলো গ্রাম ছাড়িয়ে একটা পাথুরে জমিতে এসে উঠেছে। সেখান থেকে এগোলে চিহ্নটিহ্ন সব অদৃশ্য।
ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে ফের স্যাকরার বাড়িতে গিয়ে উঠেছি নতুন কোনো ক্লু পাই কি না তার খোঁজে, এমন সময় হঠাৎ একটা পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল আমার। এমন চিহ্ন আমি আগেও অন্য কোথাও দেখেছি! তাড়াতাড়ি আমি সামনে দাঁড়ানো একটা দিশি লোককে বললাম, “মাটিতে একটু হামাগুড়ি দে দেখি! কনুই আর হাঁটু মাটিতে ঠেকিয়ে হামাগুড়ি দিবি।”
সে হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে তার হাতপায়ের যে-চিহ্নগুলো মাটিতে পড়ল সেগুলো বেশ খানিক আলাদা হলেও রহস্যময় শিকারির ছাপগুলোর সঙ্গে তার মিলটা বেশ পরিষ্কার। চারটে করে গর্তের ছাপ, সামনের কনুইয়ের ছাপদুটো পেছনের হাঁটুর ছাপ থেকে খানিক বড়ো! শিকারিও কি তাহলে…
“নেকড়ে-মানুষ?” আমি ফিসফিস করে কাম্বারলেজকে জিজ্ঞাসা করলাম। কাম্বারলেজ জবাবে খানিক অবিশ্বাসের হাসি হাসল। বলে, “একে নেকড়ে-বালক, তায় মানুষখেকো! ছাড়ো তো! যতোসব গেঁয়ো গালগল্প।”
আমি মাথা নাড়লাম, “মানুষগুলোকে যে কোনো নেকড়ে-মানুষ তুলে নিয়ে যাচ্ছে এ-কথা আমি জোর দিয়ে বলছি না। তবে হ্যাঁ নেকড়ে-মানুষ বাস্তবে আছে। নেকড়েদের কাছে পালিত মানুষের শিশু। আমি কিছুদিন আগে সিওনিতে তেমন একজনকে দেখেছি। সাধারণত মানুষ হামাগুড়ি দেয় হয় হাতপায়ের তেলো দিয়ে কিংবা হাতের তেলো আর হাঁটু দিয়ে। কনুই আর হাঁটু দিয়ে হামাগুড়ি কোনো মানুষ দেয় না। সিওনির নেকড়ে-মানুষের ক্ষেত্রে আমি তেমনটা দেখেছি।”
কাছাকাছি কোনো নেকড়ে মানুষকে কখনো দেখা গেছে কি না সে-খোঁজ করতে লোকজন নেকড়েদের মানুষের বাচ্চা তুলে নিয়ে যাবার হাজারটা গল্প শুনিয়ে দিল। কিন্তু নেকড়ে-মানুষ স্বচক্ষে দেখেছে বলে একজনও নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারল না। তবে দাগগুলোর বিষয়ে আমার ব্যাখ্যাটা দেখা গেল তাদের মনে ধরেছে। ভূতপেত্নির ভয়টাও ঘুচে গেছে। এইবার এক বুড়ো ভিল এগিয়ে এল। বলে, গ্রামের বাইরে জঙ্গলের ভেতর একটা পুরোনো মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ আছে। সেখানে সে নাকি ওইরকম আরো দাগ দেখেছে। চাইলে আমাদেরও নিয়ে যেতে পারে সে সেখানে। অতএব আমরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তার সঙ্গে চললাম।
পাথুরে জমি ধরে প্রায় আধমাইলটাক গিয়ে একটা সরু নদী পড়ল। তার খাত ধরে মাইলদেড়েক উজিয়ে যেতে একটা পাহাড়ি এলাকা। জায়গাটা ঘন কাঁটাঝোপের জঙ্গলে ছাওয়া। এইখানে এসে দূরে একটা ঘন ঝোপের ভেতর ভাঙাচোরা শিবমন্দিরটার অবয়ব চোখে পড়তে আমরা সাবধান হয়ে গেলাম। নিঃশব্দে ছড়িয়ে গিয়ে মন্দিরটাকে ঘিরে একটা বিরাট বৃত্ত গড়ে তুলল আমাদের সশস্ত্র দলটা।
দাগগুলো সে কোথায় দেখেছে প্রশ্ন করতে বুড়ো ভিল এইবার আমাদের নিয়ে চলল নদীর দিকে। খানিক এগিয়েই নদীখাতের একধারে একটা জলভরা গর্ত। কাছে গিয়ে দেখি চেনা দাগগুলো সেখানেও দেখা যাচ্ছে। তার একটা সার সেখান থেকে পোড়ো মন্দিরটার দিকে এগিয়ে গেছে। দাগগুলোর পাশাপাশি আবার বড়োসড়ো একটা নেকড়ের থাবার ছাপও পরিষ্কার বোঝা যায়।
লোকজনকে নির্দেশ দেওয়া হল, নেকড়ের যা খুশি হোক, কিন্তু নেকড়ে-মানুষের যেন কোনো ক্ষতি কেউ না করে। তাকে জীবন্ত ধরতে হবে। এইবার আস্তে আস্তে বৃত্তটাকে ছোটো করে আনতে শুরু করলাম আমরা। তারপর পোড়ো মন্দির লক্ষ করে শুরু হল পাথরবৃষ্টি।
কিন্তু কোনো লাভ হল না তাতে। পাথরবৃষ্টির উত্তরে একেবারেই নীরব রয়ে গেল পোড়ো মন্দিরের ঝোপঝাড়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃত্ত ছোটো করতে করতে আমরা মন্দিরটার দেওয়ালের একেবারে কাছে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু কোথায় কী? না নেকড়ে, না নেকড়ে-মানুষ! কাকপক্ষীরও সাড়া নেই সেখানে।
ঝোপঝাড় সরিয়ে খানিক বাদে মন্দিরের গর্ভগৃহের দরজার দেখা মিল। জায়গাটায় ঢোকবার একটামাত্র সরু দরজা। সেটা আবার ঝোপঝাড়ে ঢাকা। নেকড়েরা সাধারণত এমন জায়গায় বাসা বানাতে পছন্দ করে। দরজাটা দেখে দলের লোকজন বলে, ওর ভেতরে নেকড়ের আড্ডা থাকতে বাধ্য। এবারে দরজা দিয়ে বেশ ক’খানা বড়ো বড়ো পাথর ছুঁড়ে মারা হল ভেতরে। তাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। ডাণ্ডার মাথায় আগুন দিয়ে তা-ও ছুঁড়ে মেরে দেখা হল। ফল হল না। শেষে সাহস করে এক ভিল শিকারি একটা গাছের ডাল জ্বালিয়ে তাই নিয়ে দরজার ভেতরে গিয়ে ঢুকল। দেখা গেল সেখানে জন্তুজানোয়ার আসবার কোনো চিহ্নই নেই।
বিরক্ত হয়ে সবাই মিলে ফিরে যাবার তোড়জোর করছি এমন সময় দলের একজন হঠাৎ দেখে মন্দিরের চত্বরের একধারে খানিক তাজা রক্তের দাগ আর কয়েকগোছা মানুষের চুল লেগে আছে। রক্তের ঘষটানো দাগটা দেখে বোঝা যাচ্ছিল কিছু আগেই সেখান দিয়ে কোনো শরীরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এবার মহা উৎসাহে ফের মন্দিরের তল্লাশি নেওয়া শুরু হল। রক্তের দাগটা মন্দিরের যে দেওয়ালের কাছে দেখা গিয়েছিল, সে দেওয়ালটার ওপরের দিকটা খানিক ভেঙে একটা হাঁ মুখের মত হয়ে রয়েছে। তার ওপর থেকে মন্দিরের ঢালু আর্চ চলে গিয়েছে বিপরীত দেওয়ালের দিকে। সেদিকে মাথা উঁচিয়ে দেখা গেল, দেওয়ালের মাথার ভাঙা জায়গাটার মুখেও রক্তের ছাপ। এইবার এক উৎসাহী দেওয়াল বেয়ে কোনোমতে ফুটোর কাছাকাছি গিয়ে সেখান দিয়ে উঁকি দিয়েই হাঁক দিয়ে উঠল। আর্চের নিচে, দেওয়ালের চওড়া মাথার ওপর একটা নেকড়ে আর একটা মৃতদেহ দেখতে পেয়েছে সে। সেখানে বেয়ে উঠে দেখা গেল সত্যিই একটা মৃতদেহ। তাকে আগলে বসে নেকড়েটা দাঁত খিঁচুচ্ছিল আমাদের দিকে। তবে সে আর কতক্ষণ। কাম্বারলেজের বন্দুকের একটা গুলিতেই দাঁত খিঁচুনি চিরতরে ঘুচে গেল তার।
নেকড়ে আর তার শিকার দুটিকেই নিচে নামিয়ে এনে দেখা গেল, প্রাণীটা মেয়ে। মৃতদেহটা ছিল সেই স্যাকরার। তার শরীরের অনেকটাই খুবলে খেয়ে নেওয়া হয়েছে। পেটের নাড়িভুঁড়ি খাওয়াও শেষ। তার ঘাড়ের কাছে নেকড়ের দাঁতের গভীর দাগ বলে দিচ্ছিল, ঐখানেই মরণকামড় দিয়েছে তাকে শিকারি প্রাণীটা। এক কামড়েই প্রাণবায়ু বের হয়ে গিয়েছে তার।
শরীরটার গায়ের দাঁতের দাগগুলোকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতেই এক ভিল আধখাওয়া একটা হাতের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল আমাদের, “এইখানে দাঁতের দাগগুলো দেখুন সাহেব। মানুষের দাঁত! এইখানটা নেকড়ে-মানুষের পেটে গেছে!
দৃশ্যটা কল্পনা করতে গিয়ে গা শিউরে উঠছিল আমাদের। একটা মানুষের শিশু, হিংস্র দাঁত বসিয়ে তাজা নরমাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে!
সতর্ক হয়ে গেলাম আমরা। নেকড়ে-মানুষের সন্ধানে পাহারা আরও কড়া করে তোলা হল এরপর থেকে। তবে কেমন করে শেষমেষ তাকে কব্জা করা হয়েছিল সে কাহিনি পরের অধ্যায়ে।
বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে