বন বন্দুকের ডায়েরি আগের পর্বঃ হাতি হাতি, শঙ্খচূড়ের ডেরায়, আলাদিনের গুহা, শিকারী বন্ধু গোন্দ, হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (১), হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (২), বোয়া সাপের খপ্পরে
মূল: বন বন্দুকের ডায়েরি-মার্ভিন স্মিথ
সামু নামে আমার এক মাঝি ছিল। জাতে সে ঝোরা। তার মত এমন খাসা গল্প বলতে আমি আর কাউকে শুনিনি। কথা খুব কম বলে। কিন্তু ওর সঙ্গে নানান অঙ্গভঙ্গি আর নকলনবিশি করে সে এমন আবহ তৈরি করবে যে গল্প শুনতে শুনতে মনে হবে যেন চোখের সামনে সবকিছু দেখতে পাচ্ছি একেবারে। নিজের গ্রাম থেকে কুড়ি মাইলের বেশি দূরে কখনো পা পড়েনি তার। অথচ ওইটুকু দুনিয়াতেই আশ্চর্য সব অভিজ্ঞতা জমেছে তার ঝুলিতে। আর তাদের মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্য গল্প হচ্ছে তার বোয়া সাপের গল্প।
নিতান্ত কিপলিং-এর জাঙ্গল বুক-এ সর্পরাজের সঙ্গে বান্দর-লোগ-এর লড়াইয়ের বর্ণনার সঙ্গে সামুর সাপের হাবভাবের মিল রয়েছে, নইলে এ-গল্প হজম করা আমার পক্ষে খানিক শক্তই হত। সামুর অঙ্গভঙ্গিটঙ্গিগুলো তো আর লিখে দেখাতে পারব না, তাই কলম দিয়েই যদ্দূর পারি ছবিটা ধরবার চেষ্টা করছি।
“বর্ষার সময় ছিল হুজুর। বছরতিনেক আগের কথা। কোয়েল-এ সেবার বান ডেকেছে। আমি গিয়েছিলাম তার গাগ্রায় (খাড়াই জায়গায় নদী নেমে যাবার আগে তার তিরবেগে ছুটে যাবার এলাকা)মাছ ধরতে। গাগ্রা শুরু হবার খানিক আগে একজায়গায় ঘোলা জল বেশ আস্তে-ধীরে পাক দিচ্ছে, সেইখানটায় একটা বড়ো পাথরের চাঙড়ের পাশে জুত করে বসেছি তখন। ছোটোছোটো ট্যাংরা মেলে ভাল এই জায়গাগুলোতে। ছিপ ফেললেই এসে ঠোকরাবে।
“সবে ছিপ ফেলেছি তখন হঠাৎ শুনি উজানের দিকে গজবিশেক দূরে লম্বা লম্বা ঘাসের ভেতরে খসখস শব্দ। যেন একদঙ্গল গাইগরু জল খেতে নামছে। আর তারপরেই ঝপ ঝপ করে দু’বার শব্দ। চেয়ে দেখি, ওরে বাবা, হরু কোথা, এ যে দুটো বিশাল বিশাল সাপ! দশ-পনেরো হাত করে লম্বা, তাদের একেকটা আমার এই থাইটার মতন মোটা হবে। দেখে তো ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে গেছে। উঠে যে দৌড় লাগাব সে-সাহসও নেই। কী আর করি, পাথরের আড়ালে লুকিয়ে বসে দেখতে লাগলাম।
“তারা লড়াই ঝগড়া করছিল না খেলা করছিল সে আমি জানি না। দুটোতে জড়াজড়ি করে বারবার শুধু জল থেকে মানুষসমান লম্বা হয়ে খাড়া হয়ে ওঠে আর তারপর ঝপ করে ফের আছাড় খায়। এই করতে করতে ওদের মধ্যে ছোটোটা পাক খুলে বেরিয়ে সাঁতরে নদীর ওপাড়ের দিকে চলে গেল। সেটাকে আর দেখতে পেলাম না। আর তার জুড়িটা বেশ খানিক গোল হয়ে সাঁতার-টাতার কেটে দেখি এ-পারে এসে উঠেছে।
“উঠে এসেই সে বালির ওপর পড়ে থাকা একটা লম্বা শালবল্লার পাশে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। এমন কায়দায় সে লুকিয়েছে, যে চোখের সামনে থাকলেও, যদি আগে থেকে না দেখতাম তাহলে টেরও পেতাম না ওখানে অতবড়ো একটা সাপ শুয়ে আছে।
“আরো খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আমি উঠলাম। মতলব ছিল চুপি চুপি জায়গাটা ছেড়ে বাড়ি চলে যাব। সবে কয়েক পা গেছি তখন হঠাৎ পেছনদিকে, ওপরের জঙ্গল থেকে কীসে যেন ক্যাঁওম্যাও করে উঠল, আর তার সঙ্গে ঘোঁতঘোঁত শব্দ। সাপটাও বোধ হয় টের পেয়েছিল কিছু। কারণ তার দিকে চেয়ে দেখি সে মাথাটা শালের গুঁড়িটার ওপরে তুলেছে। শরীরটাও খানিক এঁকেবেঁকে কুণ্ডলি পাকাবার মতলবে আছে।
“ওপরের জঙ্গল থেকে একটা সরু নালা নদীর দিকে নামছিল। শালের গুঁড়িটা তার ওপর আড়াআড়ি পড়ে। ওই নালাটা বেয়ে তখন ঘোঁতঘোঁত শব্দটা ছুটে আসছে জঙ্গলের ভেতর থেকে। খানিক বাদেই নালাটা থেকে একটা বুনোশুয়োর বেরিয়ে এসে সটান নদীর দিকে ছুটল। যেতে যেতে যেই না সে শালের গুঁড়ির ওপর দিয়ে লাফ দিয়েছে অমনি সাপটাও লাফিয়ে উঠে তার পেটে আর গলায় পাক দিয়ে ধরেছে। শুয়োর বেচারা কয়েকবার হাত পা ছুঁড়ে একটু লড়াই দিল। তাতে ফল হল না কোনো। খানিক বাদে তার প্রাণ বেরিয়ে গেল।
“শুয়োর সবে মরেছে, সাপ তখনো তার পাক ঢিলে করেনি, এমন সময় হঠাৎ দেখি জঙ্গল থেকে একপাল বুনো কুকুর তেড়ে আসছে সেদিকে। বোঝাই যাচ্ছিল শুয়োরটাকে তাড়া করেছিল তারা। তাদের পালের গোদাটার তখন শিকার করার ফুর্তিতে আর কোনোদিকে খেয়াল নেই। এক ছুটে সে প্রায় সাপের ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। দেখে সাপও তার পাক খুলে নিয়ে শালের গুঁড়ির আড়ালে গিয়ে থানা দিয়েছে। সেখান থেকে হিসহিসিয়ে সে পালের গোদাকে ভয় দেখাবার চেষ্টায় ছিল।
“ওদিকে কুকুরের গোটা দলটা তখন এসে তাদের কর্তার পেছনে খাড়া হয়ে গেছে। শুয়োরটার শরীরের দিকে চোখ ধরে রেখে সে কী তাদের দাঁতখিঁচুনি আর চিল্লামিল্লির ধুম! সাপও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। ভয়ডরের বালাই নেই তার শরীরে। শরীরটাকে কুণ্ডলি পাকিয়ে লড়াই দেবার জন্য সে-ও তৈরি। কুণ্ডলি থেকে তার লেজটা খালি এদিক-ওদিক নড়ে আর মুখ থেকে চেরা জিভটা বারবার বেরোয় আর ঢোকে। কুকুর যত ঘেউ ঘেউ করে ততই সে হিসহিসিয়ে তার জবাব দেয়।
“খানিকক্ষণ তো এইভাবেই ধমকধামকের পাল্লা দেওয়া চলল। তারপর হঠাৎ একটা কুকুর দেখি লাফ দিয়ে এগিয়ে এসে শুয়োরটার গায়ে একটা কামড় বসাবার চেষ্টা করেছে। অমনি কুণ্ডলি থেকে তিরের মত ছিটকে এল সাপের মাথাটা। তারপর প্রায় ছ-ফিট লম্বা একটা বল্লমের মত গিয়ে কুকুরের পাঁজরে এক মোক্ষম ঢুঁ। গুঁতো খেয়ে কুকুর ছিটকে গিয়ে তার নিজের জায়গায় আছড়ে পড়ে দুচারবার ঠ্যাং নেড়েচেড়ে ভবলীলা সাঙ্গ করল।
“বলি, হাসছেন কেন হুজুর? যা বলছি তা বর্ণে বর্ণে সত্যি। এই সাপগুলো এভাবেই লড়াই দেয়। বোয়ার মাথার ঢুঁ খেয়ে কুকুর তো ছাড় আমি পেল্লায় ষাঁড়ের পাঁজরার হাড় অবধি ভেঙে যেতে দেখেছি। শুনুন তবে। বোয়ার মাথাটা লক্ষ করেছেন কখনো? ষাঁড়ের নাকের মতই। চৌকোমতন। তবে মোটেই অমন নরম নয়। শক্ত। হাড্ডিসার। আট ফিট দূরে দাঁড়ানো জানোয়ারকে কুড়িটা জোয়ানের সমান শক্তিতে ঢুঁ মারতে পারে ওই হাতুড়িমার্কা মুণ্ডু।
“সে যাই হোক, দলের একজন মারা যেতে কুকুররা এইবার খানিক দূরে সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে নিল খানিক। তারপর সবাই মিলে সাপটাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পায়চারি শুরু করে দিল। ঘুরতে-ঘুরতেই একটা কুকুর সাপের দিকে পা বাড়ায়। সাপ যেই তার দিকে মুণ্ডু ছোঁড়ে অমনি উল্টোদিক থেকে আরেকটা কুকুর তার গায়ে এসে দাঁত বিঁধিয়ে দিয়েই পালিয়ে যায়।
“খানিকক্ষণ এই কায়দায় বেশ ভাল কাজ হল। সাপটার গায়ে এখানে ওখানে তখন বেশ ভাল রক্ত ঝরছে। দেখে আমি ভাবলাম এইবার বুঝি কুকুরদের যুদ্ধ জেতবার দেরি নেই আর। ঠিক তখন দেখি, বোয়া সাবধান হয়েছে। চুপচাপ খানিক অপেক্ষা করল সে। তারপর যেই না একটা কুকুর তাকে আক্রমণের ভান করেছে অমনি সটান উল্টোদিকে ফিরে সে মুণ্ডু চালিয়ে দিয়েছে পেছন থেকে এগিয়ে আসা আসলি হানাদারের পাঁজরার দিকে। খানিক বাদে দেখা গেল কুকুরদের বেশ ক’টার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছে বোয়া।
“শত্রুর হাতে মার খেয়ে এইবার কায়দা বদলাল কুকুরের দল। হঠাৎ গোটা দলটা একসঙ্গে ধেয়ে এসে চারপাশ থেকে বোয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বোয়ার মুণ্ডুটা কামড়ে ধরা তাদের লক্ষ। কিন্তু ধরতে পারলে তবে তো। সে মুণ্ডু চোখের পলকে একবার এদিকে যায় তো একবার ওদিকে। তাকে ধরে কার সাধ্য! আবার তার মধ্যেমধ্যেই কখনো একটা কুকুরের দাঁত বোয়ার গায়ে নাগাল পায় তো পরমুহূর্তে বোয়ার মাথার গুঁতোয় আরেক কুকুর মাটি নেয়।
“আহা হুজুর! সে যে কী লড়াই কী বলব। আহা! ওয়াহ! কুকুরের ঘেউ ঘেউ, সাপের হিসহিসানি, মাথার গুঁতো খেয়ে মরতে বসা কুকুরের কেঁউকেঁউ সব মিলিয়ে জঙ্গল তখন জমজমাট। খানিক বাদে কুকুরের দলে খাড়া রইল আর তিনটে মাত্র জীব। তখন তারা রণে ভঙ্গ দিয়ে জঙ্গলে ফিরে গেল। আর বোয়াও ফের শালের গুঁড়ির পাশে গিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল, যেন কিচ্ছুটি হয়নি। খানিক বাদে আমিও আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এক ছুটে গ্রামে ফিরে গেলাম।
“সেদিন বিকেলে লোকজন জুটিয়ে, একটা নৌকো নিয়ে ফের আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে এসে হাজির। জলের ওপর থেকেই শালের গুঁড়িটার দিকে টিপ করে অনেক ঢিলটিল ছোঁড়া হল। কিন্তু কোথায় সাপ? তার কোনো চিহ্নই ছিল না সেখানে। শেষে সাহস করে নেমে এসে দেখি সেখানে শুয়োর আর আটটা বুনো কুকুরের শরীর পড়ে আছে। সাপ জঙ্গলে ফিরে গেছে। মাটিতে তার চলে যাবার পথে রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছিল, তবে সেই ধরে ধরে তার পেছন নেবার সাহস ছিল না আমাদের। কুকুরগুলোকে আমরা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। আর শুয়োরটা নিয়ে গিয়ে খেয়েছিল গোদামারির সাঁওতালরা।”
তা এই হল সামুর গল্প। তার কতটা সত্যিমিথ্যে জানি না। তবে গ্রামের লোকজন বলে সবটাই সত্যি। আমি নিজেও একবার একটা রক-স্নেককে ওভাবে একটা ছাগল মারতে দেখেছিলাম। সাধারণত বড়ো সাপ তার শিকারকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরে পিষে মারে বলেই আমরা জানি। কিন্তু সামুর গ্রামের লোকজনের বক্তব্য, বোয়া তার শিকারকে পাকে দিয়ে পিষে ঠিকঠাক চেহারা করে নিয়ে তাকে গিলে খায়। তবে তার আগে শিকারকে ঢুঁ মেরে তার ভবলীলা সাঙ্গ করে নেয়।
হবে হয়ত!
বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে