প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব , চতুর্থ পর্ব, পঞ্চম পর্ব, ষষ্ঠ পর্ব, সপ্তম পর্ব, অষ্টম পর্ব, নবম পর্ব
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
আগের পর্বের পর
দশম পর্ব
ভোর হতেই বুদ্ধ এখন রোজ আশ্রমের অগ্নিশালায় উপস্থিত হচ্ছেন। উরুবেল তাঁকে সেখানেই খাবার দিলে তা গ্রহণ করে আবার কার্পাস বনে চলে যান তিনি। একদিন বুদ্ধকে দূর থেকে আশ্রমে আসতে দেখে উরুবেল খাবার নিয়ে অগ্নিশালায় গেলেন। কিন্তু সেখানে ঢুকে দেখলেন বুদ্ধ আগেই উপস্থিত হয়ে বসে বসে কী যেন খাচ্ছেন। অবাক হয়ে উরুবেল বললেন, ”শ্রমণ গৌতম তুমি কী খাচ্ছ? তুমি এখানে আমার আগে কেমন করে এলে? আমি তো তোমাকে বহুদূর থেকে হেঁটে আসতে দেখেই এখানে খাবার নিয়ে এলাম।”
”বুদ্ধ উত্তরে হাসলেন। তারপর তাঁর ভিক্ষাপাত্রটি দেখালেন। পাত্রটি পাকা জামে ভর্তি। বুদ্ধ বললেন আমাদের এই সুবিশাল দেশের নাম জম্বুদ্বীপ। কারণ প্রাচীনকালে এখানে একটি অতি প্রাচীন ফলবতী জম্বুবৃক্ষ ছিল। আমি সেই সুপ্রাচীন ফলবতী জম্বুবৃক্ষের ফল নিয়ে এসেছি আজ। খেয়ে দেখুন! এই ফল যেমন মিষ্টি তেমনই রসালো।”
অসময়ে এমন পাকা জাম দেখে উরুবেল বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলেন। এবার তাঁর বুদ্ধের তুলনায় নিজেকে একান্তই তুচ্ছ মনে হল। উরুবেল বললেন, ”না না। ও আমার চাই না, বরং তুমি সংগ্রহ করেছো, তুমিই খাও।”
উরুবেল ভাবতে লাগলেন, ‘এই তরুণ শ্রমণ কতই না ঋদ্ধিমান! অথচ তাঁর এতখানি বয়স হয়েছে, এমন ঋদ্ধিশক্তি তাঁর কখনও হয়নি। পরক্ষণেই ভাবলেন আমি অর্হৎ। আমার মতো শক্তি গৌতম কেমন করে পাবে? এ নিশ্চয় তার পিশাচসিদ্ধ কোনো শক্তি।’
এমন করে বুদ্ধ এক একদিন এক এক রকম অসময়ের পাকা ফল নিয়ে আসেন। বিস্ময়ে হতবাক হলেও কিছুতেই উরুবেল বুদ্ধের বশ্যতা স্বীকার করছেন না। একদিন কোন এক স্বর্গীয় সুগন্ধী ফুল দেখিয়ে উরুবেলকে মুগ্ধ করলেন বুদ্ধ। সেই ফুলও জীবনে প্রথমবার দেখলেন উরুবেল। জীবনে শত শত বনে প্রান্তরে ঘুরেছেন তিনি। অরণ্যের অভ্যন্তরেই বলতে গেলে তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় কেটে গেছে, তবুও এমন শোভন, এমন সুন্দর ফুল তিনি কখনও দেখেননি। হতবাক উরুবেল বললেন, ”এই ফুল তুমি কোথায় পেয়েছো শ্রমণ?”
”এই ফুল হল স্বর্গের উদ্যানের পারিজাত। এই ফুল আমি আপনার জন্য এনেছি।”
অহঙ্কারী উরুবেল সেই ফুল গ্রহণ করেননি। তাঁর ভেতরে সারাক্ষণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কী এই শ্রমণের ধর্মাচরণ পদ্ধতি? তিনি অগ্নি উপাসনা করেছেন আজীবন কিন্তু এমন ক্ষমতা লাভ করতে পারেননি। তিনি এখন কিছুতেই অবজ্ঞা করতেও আর পারছেন না শ্রমণকে। তাঁর আশ্রমের বহু তরুণ সাধনায় অমানুষিক পরিশ্রম করছেন রাতদিন ধরে। তাঁরা সকলেই এখন শ্রমণ গৌতমের অনুগমন করতে আগ্রহী এ কথা তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন, তবে কি শেষ পর্যন্ত তাঁর আশ্রমটি ভেঙে যাবে? তাঁর এই উপাসনা পদ্ধতি ভ্রষ্ট বলে পরিত্যক্ত হবে? মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে উরুবেলের। এক একদিন এক একটি নিদারুণ ঋদ্ধিমায়া দেখাচ্ছেন শ্রমণ গৌতম।
ভোর হতেই আশ্রমিকদের কলরোলে ছুটে এসেছেন উরুবেল। কেউই হঠাৎ কাঠ কাটতে পারছেন না। অগ্নিতে কাঠ দেওয়া দরকার। অথচ কাঠ কাটা যাচ্ছে না। তাদের দা, কুড়ুল, কোদাল সব কিছু যথেষ্ট ধারালো কিন্তু কিছুতেই কাঠে এতটুকু দাগও কাটা যাচ্ছে না। এমন ঘটনার ফলে রান্না করাও সম্ভব হবে না। অগ্নি উপাসকেরা অগ্নিকে নিবেদন না করে অন্নগ্রহণ করেন না। এবার তবে কী উপায় হবে? কাঠ কাটা না গেলে কোনো কাজই করা যাবে না।
কলরব শুনে বুদ্ধ এসেছেন অগ্নিশালায়। বললেন, ”আমি একবার চেষ্টা করে দেখি!”
সকলে সম্মত হতেই বুদ্ধ এক মুহূর্তে সমস্ত কাঠ কেটে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। এবার আশ্রমের আগুন প্রজ্জ্বলিত হল। পাকশালায় আগুন জ্বলল, শুরু হল অন্ন প্রস্তুত কার্য। উরুবেল এই ঘটনায় চুড়ান্তভাবে অপমানিত হয়েছেন। তিনি যে নেহাতই শক্তিহীন তা বুদ্ধ বারে বারে প্রমাণ করে দিচ্ছেন। শিষ্যদের মাঝে এখন শ্রমণ গৌতম যেন তাঁর থেকেও বেশি জনপ্রিয়।
পরদিন সকালে জটিলদের অগ্নিশালায় হঠাৎ আগুন নিভে গেল। সেই আগুন আবার কেউ জ্বালাতে পারলেন না। এমনকী বহুবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন উরুবেল। এবার সকলেই বলতে লাগলেন এ-সবই বুদ্ধের ঋদ্ধিমায়ায় সম্ভব হয়েছে। তথাগতও যথারীতি এসে এক নিমেষে পুনরায় আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। তথাগতর ঐশীশক্তি দেখে সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল। কেবল উরুবেল গম্ভীর মুখে মৌন রইলেন।
দেখতে দেখতে আশ্রমে অন্তরাষ্টকের তিথি পুজো এসে গেল। কার্তিক পূর্ণিমার পর কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ থেকে ফাল্গুনী পূর্ণিমা পর্যন্ত চারমাস হল হেমন্ত ঋতু। এই সময় মাঘমাসের শেষ চাররাত্রি এবং ফাল্গুন মাসের প্রথম চাররাত্রিতে প্রচণ্ড শিশির পড়ে। একেই অন্তরাষ্টক বলা হয়। এই সময় পিতৃপুরুষের তর্পণ করার প্রশস্ত সময়। হেমন্ত ও শীতের কৃষ্ণপক্ষের গভীর রাতে জটিলেরা সবাই সারা রাত ধরে নদীতে ডুব দেন ও ভেসে ওঠেন। একে উদক অবতরণ বলা হয়। এটি একটি বিশেষ তপোকৃচ্ছ। বুদ্ধ জটিল শিষ্যদের তপোকৃচ্ছ দেখে করুণাবশত পাঁচশো মৃদু আগুনের মালসা তৈরি করে নদী তীরে অপেক্ষা করছিলেন। জল থেকে জটিলরা রাত্রি শেষে উঠে এলে তিনি তাঁদের সেই মালাসাগুলি এগিয়ে দিলেন। যাতে তাঁরা সেই উষ্ণতায় খানিকটা আরাম পান।
উরুবেল সবই লক্ষ করছিলেন। তিনি দেখলেন মুহূর্তের মধ্যে বুদ্ধ এই জ্বলন্ত পাঁচশো মালসা প্রস্তুত করে তা প্রজ্জ্বলিত করলেন। তবুও তিনি আপন মনে বললেন, ”শ্রমণ গৌতম যা খুশি করুক! তবুও সে কিছুতেই আমার সমকক্ষ নয়।”
বুদ্ধ নৈরঞ্জনা নদীর একটি শাখানদী মহীর পারে গিয়ে কিছুদিন থাকবেন বলে আশ্রম ত্যাগ করে গেছেন। নির্জনে না থাকতে পারলে তথাগতর একদম ভালো লাগে না। তিনি অরণ্যের ধ্বনি ও আরণ্যক পরিবেশ পছন্দ করেন। ভালোবাসেন নদীর কলতান। মহীনদী এখন শান্ত, তবে বর্ষায় তা ফুলে ওঠে। তখন এই নদী বড়ো ভয়ানক আকার ধারণ করে। তখন তার দু-কূল প্লাবিত হয়। নদীর পারে গভীর জঙ্গল। দু-একটি কাঠকুড়ানীর বসতি আছে। তারাও খারাপ আবহাওয়ায় নদীর তীরের কাছে থাকে না।
বুদ্ধ বেশ কিছুদিন আশ্রমে মানুষের সংসর্গে আছেন। এতে তাঁর মন হাঁফিয়ে উঠেছে। তিনি অবশেষে নিবিড় অরণ্যে এসে একটু শান্তি পেলেন। দূরে দূরে ছোটো ছোটো টিলা পাহাড়। মহী পাহাড় বেয়ে কুল কুল করে বইছে। তীরের জঙ্গলে একজন পশুপালক তার পরিবার নিয়ে থাকে। তার নাম ধনিয়। ধনিয় বুদ্ধকে ভিক্ষান্ন দিতে চাইল। বুদ্ধ তার সারল্যে ভরা মুখ দেখে খুশি হলেন। তিনি ধনিয়কে বললেন, ”আমি এখানে কিছুদিন বিশ্রাম করব। ধ্যানসাধনে ব্যস্ত থাকব। আমাকে কেবল সূর্যোদয়ের পরে একবার মাত্র কিছু আহার দিতে পারো। সারাদিনে আর কখনও আমার সঙ্গে কোনো কথা বলবে না।”
ধনিয় বুদ্ধকে প্রণাম করে চলে গেল। চারিদিকে সবুজের নানা রকম রং। কোথাও ফিকে আবার কোথাও গাঢ়। বুদ্ধ সকালে একা হাঁটতে হাঁটতে টিলা পাহাড়ের চারপাশ ঘুরে দেখলেন। বহুদূরে একটা বিন্দুর মতো উরুবেলের আশ্রমটিকে দেখা যাচ্ছে। আশ্রমের রোজকার বিরাট কর্মকাণ্ড দেখে তথাগতর ক্লান্ত লাগে। তিনি বন্ধন অপছন্দ করেন। আশ্রমিক জীবনচর্চাও একধরণের বন্ধন। ভিক্ষু ও সাধক হবেন বন্ধনহীন এবং একা! জগতে একাই আসতে হয়, ফিরে যেতেও হয় একা।
বুদ্ধ হাঁটতে লাগলেন। নিবিড় জঙ্গলের এক অপরূপ গন্ধ আছে। তিনি ঠিক করলেন রাতটা টিলার উপর কাটাবেন। এমন সময় কড়কড় শব্দে মেঘ ডেকে উঠল। শুরু হল আকাশভাঙা বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি কখনও দেখেননি তিনি। তথাগত পাহাড়ের কন্দরে একটি গুহার মত ছোটো কোটরে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে জল ও ঝড়ের কোনো প্রকোপ নেই। সেখানে নিশ্চিন্তে ধ্যানে ডুবে গেলেন তিনি। এভাবে তিনদিন কেটে গেল। ঝড় জলও কম হল না। সূর্যও উঠল না। আকাশের রং ঘন কালো। যেন চারিদিক ঘন তমসায় আচ্ছন্ন। তীব্র বৃষ্টিতে মহী নদীর দু-কূল প্লাবিত হয়ে ভয়ঙ্কর বন্যা দেখা দিল। নদী তীরের ছোটো ছোটো অস্থায়ী সব ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে গেল বন্যার জল। বনের ভেতর খলখল শব্দে নদীর জল বইতে লাগল।
উরুবেল এতদিন এতটুকু সময় পাননি। নৌকায় করে আশ্রমের মজুত খাদ্য সামগ্রী শুকনো জায়গায় পাঠাতে হয়েছে তাঁকে। আশ্রমিকদের বিভিন্ন উপাসকদের বাড়িতে আশ্রয়ের জন্য পাঠিয়েছেন তিনি। এমন ভয়ানক বন্যা তিনি নিজের গোটা জীবনে একবারও দেখেননি। স্রোতের মুখে আসা জল যেন বনবন করে ঘুরছে।
তিনদিন পরে উরুবেলের মনে শ্রমণ গৌতমের জন্য চিন্তা দেখা দিল। তিনি ভাবলেন এমন বৃষ্টিতে সে এখন কোথায় আশ্রয় নিয়েছে? আশ্রমিকেরা বললেন, ”শ্রমণ গৌতমকে এই ভীষণ বন্যা থেকে উদ্ধার করতে হবে।”
উরুবেল কাশ্যপ একটি বিশাল নৌকা নিয়ে তখন মহী নদীর তীরের দিকে যাত্রা করলেন। দূর থেকে তিনি দেখতে পেলেন নদী বলে আলাদা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। নদীর সীমানা সম্পূর্ণ মুছে গেছে। চারিদিক জলে ডুবে গেছে। কেবল বনের মধ্যে বড়ো বড়ো গাছের মাথাগুলো জেগে আছে।
তবুও উরুবেল নৌকা নিয়ে কিছুদূর এগিয়ে দেখলেন জলে ডোবা বনভূমির ভেতর একটা সমতল জায়গা কেবল কেন যেন প্লাবিত হয়নি। সেই শুকনো জমিতে শ্রমণ গৌতম একাকী পায়চারী করছেন। এই ভয়ানক দুর্যোগে কেন শুধু ওই সমতল জমিটুকু জলে ডোবেনি তা অনুমান করা বিশেষ কঠিন নয়। তবুও উরুবেল তথাগতর প্রতি নিজের আনুগত্য স্বীকার করলেন না।
তখন বুদ্ধের মনে হল আরও শত শত ঋদ্ধিশক্তির প্রদর্শনেও এই বৃদ্ধ জটিল সম্প্রদায়ের আচার্য্য নিজের আত্মগর্ব ছাড়তে পারবেন না। তিনি তখন উরুবেল কাশ্যপের মনে শঙ্কার সৃষ্টি করতে চাইলেন। বুদ্ধ বললেন, ”আপনি কি অর্হৎ উরুবেল কাশ্যপ?”
”অবশ্যই।” হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন শ্রমণ গৌতম?”
”তাহলে আপনি এই দুর্যোগ ও ঝড়ের পূর্বাভাস কেন আগে থেকে পাননি? কেন সতর্ক করতে পারেননি আশ্রমিকদের? কেন নিজে প্রস্তুত থাকেননি? প্রকৃতপক্ষে আপনি কোনো অর্হৎ নন উরুবেল। এমনকী অর্হৎ হবার পথেও চলছেন না, বরং মিথ্যা গর্ব আপনার অগ্রগতির সব পথ রোধ করেছে। আপনার লাভের আশা শূন্য, কারণ আপনার পথ সঠিক নয়। আপনার প্রতিপদ পন্থা নেই, যা দিয়ে আপনি কখনও অর্হৎ হতে পারবেন।”
বুদ্ধের এই কথায় উরুবেলের আত্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ল। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বুদ্ধের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বললেন, ”প্রভু আপনি আমাকে ক্ষমা করুন! আমি আপনাকে বহুবার তুচ্ছ করেছি, কখনও আপনি সম্বোধন পর্যন্ত করিনি। অতিথি হয়ে আপনি যখন এলেন তখন আমি আপনাকে ভীষণ বিষাক্ত সাপের ঘরে পর্যন্ত বিশ্রাম করতে পাঠিয়েছি। এখন কি আমাকে ক্ষমা করবেন প্রভু? আমি ভুল করেছি। আমার ভুলও স্বীকার করছি। আজীবন আমি সাধনা করেছি, সত্যিই প্রভু আমি আপনার মত এতটুকু ঐশীশক্তি লাভ করতে পারিনি। আমি কলুর ষণ্ডের মতো কেবল বোঝা বয়েছি। এতটুকু খাদ্যের স্বাদ পাইনি। এখন আমাকে আপনার চরণে স্থান দিন আমি আপনার কাছে প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা লাভ করতে চাই।”
”বেশ কাশ্যপ তাই হবে। তবে তোমার পাঁচশো শিষ্য আছে। তারাও সাধনার জন্য জীবনপাত করছে, তুমি তাদের প্রতি কী নির্দেশ দেবে?”
উরুবেল তখন আশ্রমের শিষ্যদের ডেকে বললেন, ”আমি শ্রমণ গৌতমের অধীনে প্রব্রজ্যা নেব। এবার তোমরা তোমাদের ইচ্ছা মতো কাজ করো।”
আশ্রমিকেরা সমবেতভাবে বললেন, ”আমরাও চাই শ্রমণ গৌতমের অধীনে থেকে ব্রহ্মচর্য পালন করতে।”
চারিদিকে সমবেত তুমুল হর্ষধ্বনি দেখা দিল। সঙ্গে সঙ্গে জটিলদের দল তাঁদের কেশ দাড়ি কেটে ফেললেন। অগ্নিহোত্রের সব সামগ্রী জলে বিসর্জন দিয়ে তাঁরা দলে দলে এসে তথাগতর শরণ নিলেন। বুদ্ধও আনন্দিত হয়ে বললেন, ”এসো ভিক্ষুগণ! এই ধর্ম সু-আখ্যাত। এই ধর্মপালনে দুঃখের শেষ হয়ে নির্বাণলাভ হয়।”
জ্যেষ্ঠর খবর লোকমুখে পেয়ে ছুটে এলেন নদী কাশ্যপ। তিনিও তখন সশিষ্য বুদ্ধের শরণ নিয়ে দাদার পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন। বুদ্ধ তাঁদের সকলকেও উপসম্পদা দিলেন। বাকি ছিলেন গয়া কাশ্যপ। তিনি দেখলেন নদীতে অগ্নিহোত্রের সামগ্রী ভেসে যাচ্ছে। তিনি আশঙ্কায় ছুটে এলেন উরুবেল কাশ্যপের কাছে। উরুবেলের কথা শুনে তিনিও সশিষ্য বুদ্ধের কাছে উপসম্পদা নিয়ে কৃতার্থ হলেন।
তথাগতর শিষ্যদের সংখ্যা এখন অগণিত। এই সহস্রাধিক শিষ্যদের নিয়ে ভগবান উরুবেলায় কিছুদিন কাটিয়ে গয়াশীর্ষ অভিমুখে যাত্রা করলেন। বন্যার পরে গ্রামে ভিক্ষা বেশ দুর্লভ হয়েছে। এবার গৃহস্থদের ফসল ক্ষেতেই নষ্ট হয়েছে। বুদ্ধ উরুবেলা ছেড়ে ভিক্ষুদের সুলভ ভিক্ষার প্রত্যাশায় গয়াশীর্ষ অভিমুখে যাত্রা করলেন। সেখানে আজীবকদের আবাস। তাঁরাও ভিক্ষান্নজীবী। হয়তো সেখানে ভিক্ষা সুলভ হতে পারে।
সশিষ্য পথ পেরিয়ে চলেছেন বুদ্ধ। সকাল থেকে প্রায় দুপুর হতে চলেছে। ক্লান্তিহীন ভাবে একটানা পথ চলেছেন তিনি ও তাঁর শিষ্যরা। সকাল থেকে কেউ জল ছাড়া কিছু খাননি। বুদ্ধ প্রবল কষ্ট সহিষ্ণু। ঝড়ের পর থেকে আবহাওয়া অসম্ভব গুমোট, চারদিক সূর্যের প্রবল তাপে যেন ঝলসে যাবে। উরুবেলা থেকে গয়া আসার পথে কোথাও ছায়াদায়ী বৃক্ষ নেই। যাত্রাপথের কোথাও এতটুকু বৃষ্টি হয়নি। প্রায় সারাদিন পরে তাঁরা যেখানে এসেছে সেখানে চারদিক শুকনো। এখানে বহুকাল অনাবৃষ্টি চলছে। বুদ্ধ সশিষ্য গয়াশীর্ষ পাহাড়ের উপরে উঠলেন। এই স্থান লোকালয় থেকে দূরে এবং কোলাহল বর্জিত। পাহাড়ের উপর থেকে দেখা যাচ্ছে দূরে সূর্যাস্ত হচ্ছে। বুদ্ধ ক্লান্ত ও অভুক্ত ভিক্ষুদের দেখালেন দূরে আকাশের গায়ে সব রং ঢেলে দিয়ে সূর্যাস্ত হচ্ছে।
ঠিক এই সময় দূরে পাহাড়ের বুকে ঘন কালো বনে হঠাৎ দাবানলের অগ্নিশিখা জ্বলে উঠল। সেদিকে তাকিয়ে চারিদিক যেন প্রজ্বলিত মনে হল ভিক্ষুদের। সূর্য প্রজ্বলিত, প্রজ্বলিত তাঁদের ক্ষুধা, বনে দাবানলের আগুনও প্রজ্বলিত। চারিদিকের এই জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি দেখে বুদ্ধ আবৃত্তি করলেন আদীপ্ত পর্য্যায় দেশনা।
বুদ্ধ বললেন, ”দেখো ভিক্ষুগণ! সমস্তই প্রজ্বলিত। মানব শরীরের চক্ষুদুটি জ্বলছে, রূপ জ্বলছে, চোখ দিয়ে দেখা সবকিছু জ্বলছে এমনকী বেদনা, সুখ সবই জ্বলছে। এই জ্বলন সংঘটিত হচ্ছে রাগাগ্নি, দ্বেষাগ্নি ও মোহাগ্নির দ্বারা। বাইরের প্রকৃতির এই আগুনের মত মানব মনের অন্তরেও এই একই জ্বালা নিরন্তর কাজ করে চলেছে। জন্ম থেকে মানুষ জ্বলছে। তার এই জ্বালা জন্মের কারণে, জরা ও মৃত্যুর কারণে শোক, পরিবেদনা ও নৈরাশ্য নিয়ে আসে।
পৃথিবীর জাগতিক সকল বিষয় এমনই। জগতের রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ ও মন কেবল জ্বলনের উপাদানকেই বয়ে আনে। এইসব জেনে শ্রুতবান শ্রাবক সকল বিষয়ে নিরাসক্ত হয়ে নির্বেদ প্রাপ্ত হয়। নির্বেদ প্রাপ্ত হলে বীতরাগ হয়, বীতরাগ হলে সে বিমুক্ত হয়, বিমুক্ত হলে জ্ঞানের সঞ্চার হয়, সে তখন জানতে পারে তার জন্ম জন্মান্তরে যাতায়াত ক্ষীণ হয়েছে, ব্রহ্মচর্যব্রত পালিত হয়েছে, পৃথিবীতে করণীয় শেষ হয়েছে এবং তাকে পৃথিবীতে আর পুনরায় আসতে হবে না।”
বুদ্ধের অসামান্য এই দেশনায় নবীন ভিক্ষুরা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হলেন। গয়াশীর্ষে কিছুদিন থেকে গেলেন বুদ্ধ। যথাশক্তি উদ্বুদ্ধ করলেন ভিক্ষুদের। এবার তিনি ঠিক করেছেন রাজগৃহে যাবেন। বহদিন আগে তিনি মগধরাজ বিম্বিসারকে কথা দিয়েছিলেন যে কখনও যদি বোধিজ্ঞান লাভ করতে পারেন তাহলে একবার তাঁর সঙ্গে অবশ্যই সাক্ষাত করবেন। মহারাজের কাছে দেওয়া কথা রাখতে বুদ্ধ সশিষ্য রাজগৃহের দিকে যেতে লাগলেন। গয়াশীর্ষ থেকে রাজগৃহ খুব একটা বেশি পথ নয়। তথাগত গ্রামের ভেতর দিয়ে পথ চলেছেন। ভিক্ষু ও জটিল কাশ্যপ তিনভাই উরুবেল, নদী ও গয়া কাশ্যপও তাঁর সঙ্গে চলেছেন। তাঁরা বয়সে প্রবীণ। বুদ্ধ বয়সে তরুণ, তবে তিনিই সকলের আচার্য, এ-কথা যেন পথচারীদের বিশ্বাসই হয় না। তারা অনেকেই সুবিশাল দলটি দেখে জিজ্ঞাসা করে, “এই দলের আচার্য্য কে?”
এতজন ভিক্ষুদের নিয়ে নগরের ভেতর না ঢুকে বুদ্ধ রাজগৃহের দক্ষিণ পশ্চিমে লট্ঠি বনে সুবিশাল সুপ্রতিষ্ঠিত চৈত্যের কাছে আশ্রয় নিলেন এবং সেখানেই বিশ্রাম নিতে লাগলেন। ভিক্ষুরাও বহুক্ষণ পরে এবার একটু বসার সুযোগ পেলেন। সকলেই তাঁরা পথশ্রমে ভীষণ ক্লান্ত।
এইসময় রাজার কয়েকজন কর্মীক সেই চৈত্যের কাছে এসে দাঁড়ালেন। আসলে তাঁরা হলেন রাজার গুপ্তচরদের দল। এতজন বহিরাগত নগরে ঢোকার একটু আগে সম্মিলিত হয়েছেন জেনে তাঁরা নিঃসন্দেহ হতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছেন। বুদ্ধ তাঁদের সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন। বুদ্ধের সঙ্গে কথা বলতেই চরদের অনেকেরই মনে পড়ে গেল বুদ্ধ কিছু বছর আগে এখানে এসেছিলেন। ইনিই সেই কপিলাবস্তুর রাজপুত্র সিদ্ধার্থ। বর্তমানে তিনি এই সহস্র জটিলদের প্রতিভূ হয়েছেন। বুদ্ধ তাঁদের কিছুক্ষণ ধর্মকথা বললেন। তাঁরা নিঃসংশয় হয়ে রাজার কাছে ফিরে গেলেন। বুদ্ধের কথা শুনে তাঁরা মোহিত হয়েছেন।
গুপ্তচরদের দল বিম্বিসারকে খবর দিলেন, ”মহারাজ! শাক্যকুলের প্রব্রজিত রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম এখন শ্রমণ হয়েছেন। তিনি রাজগৃহের লট্ঠি বনে আছেন। তিনি অর্হৎ এবং সাক্ষাত দেবতা স্বরূপ। শত সহস্র জটিলেরা তাঁর শিষ্য হয়েছে। তিনি লোকবিদ এবং দেব ও মানুষের শাস্তা। ইনি এমন ধর্মোপদেশ দান করেন যার আদি মধ্য ও অন্তে কল্যাণ। এই অর্হতের দর্শন করাও মহান পুণ্যের।”
বিম্বিসারের তক্ষুণি সব কথা মনে পড়ে গেল। তিনি সেই সময় যেমন সিদ্ধার্থকে রাজগৃহবাসী করতে চেয়েছিলেন তেমনটি এখনও চাইলেন। রাজা মন্ত্রীসভার বৈঠক ডাকলেন দ্রুত। বিচক্ষণ তিন মন্ত্রীর দল একত্রিত হলেন। রাজা বললেন, ”আমি চাই শ্রমণ গৌতম যেন আমার রাজ্য ত্যাগ করে না যেতে পারেন। এর জন্য আমার কী কী করণীয়?”
প্রথম মন্ত্রী বললেন, ”মহারাজ কি শ্রমণ গৌতমকে বন্দীশালায় বন্দী করতে চান? কিংবা কোনো রাজকীয় কারাগারের অভ্যন্তরে তাঁকে রাখতে চান?”
রাজা বললেন, ”ছি ছি তা কখনও নয়। তবে আমার মনোগত অভিপ্রায়টি আপনাদেরকে জানালাম।”
”আপনি শ্রমণের জন্য রাজগৃহে একটি উত্তম বাসস্থানের ব্যবস্থা করুন। তাঁকে একাকী রাজপ্রাসাদে ডেকে ভোজন দান করুন। এতেই তিনি রাজগৃহের স্থায়ী বাসিন্দা হবেন আর আপনার অভিপ্রায়ও সিদ্ধ হবে।”
দ্বিতীয় মন্ত্রী বললেন, ”মহারাজ এই রাজ্যের অধিবাসীরা যাতে গৌতমের ধর্মমত গ্রহণ করেন তার ব্যবস্থা করুন। গৃহী উপাসকের সংখ্যা বাড়লে এই রাজ্য ছেড়ে শ্রমণ গৌতম আর কোথাও যাবেন না।”
তৃতীয় মন্ত্রী বললেন, ”মহারাজ আপনার যদি মনে হয়, আপনি শ্রমণ গৌতমের ধর্মের উপাসকও হতে পারেন। আপনি গৌতমের ধর্মমত গ্রহণ করলে রাজ্যবাসীরাও অবশ্যই তা করবে। যেখানে উপাসকের সংখ্যা বেশি সেখানেই শ্রমণ গৌতম থাকবেন, এতে আর সন্দেহ কীসের!”
বিম্বিসার তখন শুভ্রবস্ত্র পরে ফুলের মালা ও প্রস্ফুটিত শত সহস্র শ্বেত পদ্মফুল নিয়ে পায়ে হেঁটে লট্ঠিবনে সুপ্রতিষ্ঠিত চৈত্যে বুদ্ধের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। তাঁর সঙ্গী হয়েছেন রাজগৃহের বিশিষ্ট অধিবাসীবৃন্দের একটি বিরাট দল।
মগধের এই অধিবাসীরা তরুণ বুদ্ধকে দেখে উরুবেলের শিষ্য মনে করলেন। তাছাড়া এঁরা আগে কখনও বুদ্ধকে দেখেননি। সকলেই বলতে লাগলেন, ”এত ভিড়ে কে এই শ্রমণ গৌতম?”
বুদ্ধ মগধের অধিবাসীদের মনের কথা বুঝতে পেরে একটি গাথায় উরুবেল কাশ্যপকে বললেন, ‘
‘ওহে উরুবেলবাসি, কৃশতনু জটিলের গুরু তুমি ছিলে,
বলো তুমি কী দেখে, হে কাশ্যপ, হে তপস্বি, অগ্নিরে ত্যাজিলে?
কী কারণে অগ্নিহোত্র, অগ্নিচর্য্যা, সকলি ত্যাজিলে?” (প্রজ্ঞানন্দ স্থবির)
তখন জটিলদের গুরু বৃদ্ধ উরুবেল কাশ্যপ বুদ্ধকে দেখিয়ে বললেন,
”হেরি সেই শান্তপদ, নিরুপাধি, কামমুক্ত, যাহা অকিঞ্চন,
অন্যথা যাহার নাই, ভূততা তথতা যাহা অনন্যগমন।
সেই শান্তিপদে রত, নিরুপাধি, অনাসক্তি, যাহা অকিঞ্চন,
ইষ্টযজ্ঞে, অগ্নিহোত্রে, রূপে শব্দে আর রসে রত নাহি মন।” (প্রজ্ঞানন্দ স্থবির)
উরুবেল কাশ্যপ এবার তাঁর আসন থেকে উঠে উত্তরাসঙ্গ দ্বারা কাঁধের একাংশ ঢেকে বুদ্ধের পায়ে মাথা রেখে বললেন, ”প্রভু আপনিই আমার শাস্তা। আমি শ্রাবক।”
মগধবাসীরা এবার তথাগত কে তা বুঝে সকলে সমবেত স্বরে বলে উঠলেন ”সাধু! সাধু!”
বুদ্ধ মগধবাসীর উদ্দেশ্যে উপদেশ দান করলেন। বুদ্ধ বললেন দান-কথা, শীল-কথা ও ধর্ম-কথা। সেই আসনে একই দিনে বিম্বিসার সহ শত শত মগধবাসী বুদ্ধের উপাসক হলেন।
বিম্বিসার বুদ্ধের কাছে ধর্মকথা শুনে বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে গেছেন। তিনি এখন বুদ্ধের একজন উপাসক। রাজা বুদ্ধ এবং ভিক্ষু সংঘকে রাজপ্রাসাদে অন্নভোজনের আমন্ত্রণ জানালেন। বুদ্ধ মৌনভাবে তাতে সম্মতি জানালেন।
যথা সময়ে বুদ্ধ রাজার প্রাসাদে উপস্থিত হলেন। বিম্বিসার এখন প্রবলভাবে চাইছেন তাঁর প্রভু বুদ্ধ যেন এরপর থেকে রাজগৃহে সর্বদা থাকেন। তিনি নিজের হাতে বুদ্ধ ও সংঘকে খাদ্য পরিবেশন করার পর একটি সোনার ভৃঙ্গার থেকে বুদ্ধের হাতে জল ঢেলে নগরের অনতিদূরের বেণুবন উদ্যানটি বুদ্ধকে দান করলেন। সেখানে একটি অড্ঢযোগ আছে। অর্থাৎ একটি ঈগলের ডানার মতো ছাদযুক্ত ঘর আছে। আরও কিছু মণ্ডপ ও বেদীও তৈরি আছে সেই উদ্যানে। আপাতত সেখানে ভিক্ষুরা শেয্যার আচ্ছাদনে থাকবেন। শেয্যা হল অস্থায়ী কাপড়ের তৈরি ছাউনি। পরবর্তীকালে ভিক্ষু সংঘের জন্য সেখানে সঙ্ঘারাম তৈরি করা হবে। বেণুবন বিরাট বড়ো একটি উদ্যান। এখানে সাজানো গাছের সঙ্গে বনের বহু গাছপালাও আছে। বেণুবনের বাঁশগাছগুলির ভেতর থেকে বাতাস বইবার সময় বাঁশির মতো সুরেলা সুর শোনা যায়, সেই কারণে নির্জন এই উদ্যানটির নাম বেণুবন। রাজার দানে বুদ্ধ খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেন। তাঁর ভিক্ষু সংঘের শীত বর্ষা ও রোদের হাত থেকে বাঁচার একটা আশ্রয় হল। নিজের জন্য তাঁর কখনও ভাবনা হয় না।
রাজার দান পাবার পর থেকে বুদ্ধ একদম মৌন হয়ে আছেন। তাঁর মনে কেবলই চিন্তা আসছে। এভাবে তিনিও কি উরুবেলের মত একজন আশ্রমের অধিপতিতে পরিণত হলেন? তাঁরই মতো আশ্রমের চাল ডালের হিসেব রক্ষক এবং দান ও দক্ষিণার প্রত্যাশী? না না তা কিছুতেই হতে পারে না। একজন পরিব্রাজক হবেন একটি বহতা নদীর মতো। ভিক্ষুরাও তাই হবে। তিনি নিয়ম করেছেন এক জায়গায় কেউ একটি বর্ষার বেশি বাস করতে পারবে না। সেখানে সংঘের ছাদযুক্ত আচ্ছাদন না থাকলেও বনের গাছতলা কিংবা গিরিগুহার তো অভাব নেই জম্বুদ্বীপে!
রাজার আতিথ্য ছেড়ে বুদ্ধ আবার পথে বেরিয়ে পড়েছেন। এবার তিনি আবার একা। বুদ্ধ রোজই গ্রামের পথে প্রান্তরে বহু দূরে দূরে পরিভ্রমণ করেন। রাতে নগরের বাইরে কোনো কুমোর বা কামারের কর্মশালায় অতিথি হয়ে রাতটুকু থেকে যান তিনি। গৃহস্থের বাড়িতে কখনও বাস করেন না।
হাঁটতে হাঁটতে পথ চলেছেন বুদ্ধ। তিনি আজ ভোরে রাজগৃহ ছেড়ে এসেছেন। যাবার আগে বিম্বিসারকেও তিনি কিছু জানাননি। পরিব্রাজক তাঁর কাজের কোনো ব্যাখ্যা গৃহী উপাসককে দিতে বাধ্য নয়। হাঁটতে হাঁটতে একসময় মহী নদীর তীরে আবার ফিরে এসেছেন বুদ্ধ। তাঁকে অনেকদিন পরে আসতে দেখে গোপালক ধনিয় খুব খুশি হল। নদীর তীরের সবুজ ঘাস খেয়ে তাঁর গাভীগুলো এখন খুব ভালো দুধ দিচ্ছে। সে এতে বড়োই সুখী। ধনিয় বুদ্ধকে ভক্তিভরে প্রণাম জানালো।
গভীর জঙ্গলের মধ্যে ধীরে ধীরে রাত নেমে এল। বুদ্ধ তারাভরা আকাশের নীচে একটি গাছের তলায় তৃণশয্যায় ধ্যানে বসার প্রস্তুতি নিলেন। আকাশের বুকে শত সহস্র তারাদের মেলা। দেখা যাচ্ছে অনন্ত নক্ষত্রবীথি। মানুষ হল এই অনন্তের সন্তান। জগতের প্রাণ হল বাতাস, আর এই বাতাসের মাধ্যমে পরমাত্মা তাঁর সৃষ্ট সকল জীবের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। বুদ্ধ ধীরে ধীরে ধ্যানে ডুবে গেলেন। নদীর বুকে উত্তাল ঝোড়ো হাওয়া বইছে। নদীর বুকের প্রবল হাওয়া দেখে সংসারের সাধারণ সুখে সুখী ও আত্মতৃপ্ত ধনিয় একটি গান ধরেছে।
”পক্কোদনো দুগ্ধখীরোহহমস্মি
অনুতীরে মহিয়া সমানবসো।
ছন্না কুটি আহিতো গিনি
অথ চে পত্থয়সি পবস্স দেব।।”
অর্থাৎ আমার খাবার পাক করা আছে, গাভীর দুধও দোহান আছে। মহীনদীর তীরে বাস করি আমরা সমান বয়সী সব গোয়ালারা। আমার কুটিরটিও ছাওয়া আছে, ঘরে জোগাড় করে রেখেছি অসময়ের দরকারী আগুন। এখন তুমি বর্ষণ করতে পারো হে মেঘের দেবতা!”
অন্ধকারে নিশীথে চরাচর নিস্তব্ধ। ধনিয়র গান অনেক দূর থেকে শুনতে পেলেন তথাগত। ধনিয়র গান শুনে বুদ্ধ ভাবলেন, তাঁর ঘর নেই, পোষ্য নেই, সঞ্চয় নেই, তাই তাঁর কোনো উদ্বেগও নেই। বিরাট বিশ্বে তিনি গৃহছাড়া, প্রকৃতই এক বন্ধনহীন মানব। উন্মুক্ত মহাবিশ্বের বিশাল দরজা খোলা আছে তাঁর জন্য। সেখানে বন্ধনের কথাও কোনো চিহ্ন নেই। তিনি আকাশ আর খোলা বাতাসের মতো উদার আর মুক্ত। তিনিও তখন ধনিয়র সুরে এক বন্ধনহীন আত্মসুখে একটি গাথায় স্বগতোক্তি করলেন,
”অক্কোধন বিগতখিলোহহমস্মি
অনুতীরে মহিয়া একরত্তিবাসো।
বিবটা কুটি নিব্বুতো গিনি
অথ চে পত্থয়সি পবস্স দেব।।”
অর্থাৎ ক্রোধজয় করে, হয়েছি বন্ধনহীন। এই মহী নদীর তীরে আমি একরাত্রির বাসিন্দা। আমার কুটীরটি খিল বা খুঁটিহীন। এখানে ঘর অর্থাৎ দেহ, অর্গলহীন অর্থাৎ দেহ সকল বন্ধন মুক্ত। তাঁর বাসস্থান এই আকাশতল। আমার সব আগুন নেভানো, অর্থাৎ আমি কামনাশূন্য। এবার যদি ইচ্ছা করো প্রবল বেগে বর্ষণ করো, হে মেঘের দেবতা।
গভীর রাত। নদীর জল শান্ত। বুদ্ধ ধ্যান শেষে নদীতীরে চঙ্ক্রমণ করছেন। দূরে জঙ্গল থেকে রাতজাগা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। সামনে তাঁর অনেক কাজ। সংঘ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, এখন ভিক্ষুদের সঠিক পথের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অবশ্য এখনই অনেকে মার্গের অন্তে পৌঁছে অর্হৎ হয়েছেন। তাঁরাও তাঁকে এই কাজে সাহায্য করবেন। তবে তাঁর দুজন জ্ঞানী এবং কৃতবিদ্য প্রধান সহায়ক প্রয়োজন। যে দুজন সংঘে তাঁর অবর্তমানেও কিছুটা পরিচালনার ভার নেবেন। নতুন ভিক্ষুদের শিখিয়ে দেবে সংঘের নিয়ম ও শীল। যাদের মাধ্যমে তাঁর ধর্ম দিকে দিকে প্রতিষ্ঠিত হবে। এমন কেউ এখনও সংঘে যদিও আসেনি, তবে বুদ্ধ জানেন তাঁরা আসবেন। কারণ তাঁর জগতের সব মানুষকে এই পরম শান্তির ভাগ দিতে হবে, এবং এই কাজে তাঁর সহায়করাও তাই অবশ্যই আসবেন।
বুদ্ধের মনে হল আরও একটা বিশেষ কাজ এখনও তাঁর করা বাকি। একটিবার কপিলাবস্তু নগরে তাঁকে যেতে হবে। জগতকে শান্তির পথ দেখালেও আজও তাঁর পিতা, ও ভাই নন্দ ও জ্ঞাতি সব আত্মীয় ও ভাইয়েরা তাঁর ধর্ম কী? তা জানে না। কপিলাবস্তু নগরবাসীও জানে না তাঁর ধর্মের কথা। নারীদের প্রব্রজ্যায় এখনও কোনো অধিকার দেননি তথাগত। তবুও তাঁর একটি অশ্রুমুখী নারীর মুখ আজ অনেকদিন পরে হঠাৎ মনে পড়ে গেল। তথাগত জানেন তিনি এখনও মনেপ্রাণে রোজ তাঁর আগমনের প্রতীক্ষা করে আছেন। তিনি যশোধরা। কপিলাবস্তুর রাজবাড়ি থেকে বিদায় নেবার আগের মুহূর্তে শেষবার তাকে দেখেছিলেন তথাগত। পুত্র রাহুলকে নিয়ে তখন শয্যায় নিদ্রামগ্ন ছিলেন যশোধরা! সেই রাহুল এখন সাত বছরে পদার্পণ করেছে। এতদিন পরে পরিচিত ও জ্ঞাতিদের সঙ্গে দেখা করার সময় এসেছে তথাগতর।
অবশেষে বুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি কপিলাবস্তুতে যাবেন।
(প্রথম পর্ব সমাপ্ত)