প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব , চতুর্থ পর্ব, পঞ্চম পর্ব, ষষ্ঠ পর্ব, সপ্তম পর্ব, অষ্টম পর্ব
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
আগের পর্বের পর
নবম পর্ব
উরুবেলার পথে বুদ্ধ
শ্রমণ পথ চলেছেন। দূরে দূরে ছোটো ছোটো টিলা পাহাড়। মাটি এখনও রুক্ষ। শীত শেষে সবে বসন্ত এসেছে। পাহাড়গুলি দূর থেকে গাঢ় সবুজ রংয়ের মনে হচ্ছে। তিনি একা পথ চলেছেন। একা থাকতে তিনি বিশেষ পছন্দ করেন, যেন উপভোগ করেন সেই নিঃসঙ্গতাকে। এক একটি গ্রামের সীমানা শেষেই আছে অরণ্য। বহু মানুষ এই বনভূমি থেকে তাদের দৈনন্দিন সামগ্রী সংগ্রহ করে নেয়। এমনকী রাজাও নেন। বনভূমির পুষ্ট বাঁশঝাঁড় থেকে রাজবাড়ির প্রয়োজনে বাঁশ এবং বিরাট মহীরুহগুলি থেকে আসবাবের উপযোগী কাঠ যায়। গরীব সাধারণ মানুষ বন থেকে চন্দন কাঠ, অগরু, ধুনো, মধু, মোম ও ফুল সংগ্রহ করে, এবং নগরের দোকানগুলিতে তা বেচে তারা সংসার নির্বাহ করে। গোপালকেরা অনেকেই বনের সীমানায় ঘর বেঁধে থাকে, যাতে তাদের পোষ্যদের খাবারের অভাব না হয়। শ্রমণ লোকালয় বর্জন করে বনের পথ ধরলেন। এইসময়ের প্রকৃতির রূপ তাঁর বড়ো প্রিয়। পলাশ, শাল্মলী ফুটেছে রাশি রাশি। ফুটেছে শত শত রুদ্রপলাশ। শালের ফুলের অপরূপ সুগন্ধে বনের বাতাস ভরে উঠেছে।
ঘন লালের সেই শোভাযাত্রা দেখতে দেখতে পথ চলেছেন তিনি, তাঁর খাদ্য সংগ্রহের জন্য লোকালয়ের ভেতর দিয়ে পথ চলার কোনো ইচ্ছেই নেই। তিনি প্রবল কষ্টসহিষ্ণু। দু একদিন উপবাসে তিনি দুর্বল হন না। তিনি একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষের ছায়ায় বসে তাঁর পরবর্তী কার্যপ্রণালী ভাবতে লাগলেন।
এমন সময় তার ভেতর থেকে কথা বলে উঠল মার। সে এখনও তথাগতকে ছেড়ে যায়নি। একাকী এবং ক্লান্ত ও অভুক্ত তথাগতর সামনে এবার প্রকটিত হল মার। তার গায়ের রং গহীন কালো। ঘনকালো দুটো বিরাট গহ্বরের মধ্যে থেকে আগুনের মত ধকধক করছে তার দুটো চোখ। তথাগতর শান্ত সমাহিত মূর্তি মারের অসহ্য মনে হল। সে বলল,
‘হে শ্রমণ এবার তুমি ক্ষান্ত হও। এই ধর্মের প্রচার তোমার এক অন্তহীন প্রচেষ্টা। পৃথিবীতে এই ধর্মের কতটুকুই বা প্রভাব হবে? কেন তুমি এমন বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছো? এতে সামান্য কয়েকজন মানুষ ছাড়া কারোও মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষেরা এত কৃচ্ছ সাধনে কখনও আগ্রহী হবে না। ধর্মাচরণ বলতে তারা বোঝে ভিক্ষু ও আজীবকদের দিনে কেবল একবার ভিক্ষা দান করা। তারা ভোগ আর কাম সুখের পথ ছেড়ে কেউ কখনও এগিয়ে আসবে না। তোমার সব চেষ্টা ব্যর্থ হবে। তুমি ফিরে যাও, কেন এমন কঠোর পরিশ্রম করে উরুবেলার পথে নিজেকে টেনে নিয়ে চলেছো? জগতে জন্মলাভ করে মানুষ কেবল নিজের ভোগের উপকরণ খুঁজে বেড়ায়। তুমি নিজেকে বন্ধন মুক্ত ভাবলেও আসলে তোমার মনের গভীরে এই ধর্ম প্রবর্তনের প্রবল আগ্রহ ও চিন্তাই হল তোমার জাগতিক বন্ধন। তুমি বৃথাই নিজেকে বন্ধনমুক্ত ও মায়ামুক্ত ভাবো।”
বুদ্ধ মারকে অগ্রাহ্য করে বলে উঠলেন,
”আমার প্রতি তোমার আধিপত্য এখন শেষ হয়েছে। আমি এখন সকল বন্ধন থেকে মুক্ত। আর তুমি তোমার রক্তচক্ষু দিয়ে আমাকে শাসন করতে পারবে না। আমি মার বিজয় করে ত্রিভুবন জয় করেছি এবং আমার ভেতরের সমস্ত শত্রুদের নাশ করেছি আমি। এবার আমার প্রবর্তিত ধর্ম এই জগতের মঙ্গলসাধন করবে। ভীতপঙ্কিল মানব হৃদয় লাভ করবে নির্মল পরা শান্তি। তুমি এখন বিদায় হও মার! আমার হৃদয়ে তোমার আর কোথাও স্থান নেই।”
তথাগত এখন এই বনভূমি পেরিয়ে গেলেই উরুবেল কাশ্যপের আশ্রমে পৌঁছবেন, কিন্তু সেখানে নিজের শক্তি প্রকাশ করবেন কিনা ভাবতে লাগলেন তিনি। ঋদ্ধিশক্তি প্রদর্শন তাঁর তীব্র অপছন্দের। উরুবেল কাশ্যপ অহংকারী, তাঁর দর্পচূর্ণ করতে হলে তাঁকে নিজের বিশেষ অলৌকিক শক্তির প্রদর্শন করতেই হবে। শ্রমণ উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর মুখে কৌতুকের স্মিত হাসি। তবে তাই হবে তাঁর উরুবেলার পরবর্তী কার্যপ্রণালী।
তথাগত জানেন উরুবেল কাশ্যপ তাঁকে নিয়ে শঙ্কিত, উরুবেল খবর পেয়েছেন অল্প সময়ের মধ্যেই শ্রমণ গৌতমের প্রতিপত্তি ও নাম যশ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র, এবং তা এখন ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। উরুবেলের আশ্রমে তাঁর আশ্রয় পাওয়া তাই সহজ হবে না, এ কথাও আন্দাজ করতে পারছেন তথাগত।
প্রায় দুদিন তিনি কেবল জল ও বনের ঝরে পড়া দু একটি কীটদষ্ট ফল ছাড়া কিছুই খাননি, অথচ পরিক্রমণ করেছেন দীর্ঘ পথ, কিন্তু তাঁর মুখে ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই। এক অপরূপ জ্যোতি তাঁর সমস্ত শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তাঁর গায়ের সোনালী রং সেই জ্যোতির আলোয় অপূর্ব ভাস্বর হয়ে উঠেছে।
তথাগত ধীর পদক্ষেপে উরুবেল কাশ্যপের আশ্রমের দ্বারে এসে নিজের পরিচয় দিলেন—বললেন,
”আমি সম্যক সম্বুদ্ধ। তথাগত-বুদ্ধ। বহুদূর পথ পরিক্রমণ করে আচার্য উরুবেলের সঙ্গে সাক্ষাত করতে এসেছি। শুনেছি তিনি একজন পরম ধার্মিক ও জ্ঞানী পুরুষ।”
উরুবেলের আশ্রমের অগ্নি উপাসক আশ্রমিক শত শত শিষ্যরা বুদ্ধকে দেখেই বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইলেন। কেবল বুদ্ধের উপস্থিতিই তাঁদের মনে তাঁর প্রতি মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছে। তাঁরা ভাবতে লাগলেন,
কে এই অনিন্দ্যকান্তি যুবক? কেনই বা তাঁদের এই আশ্রমে তাঁর আগমন?
বুদ্ধ এবার বললেন,
”আমি কয়েকদিন এই আশ্রমের অতিথি হতে চাই। শ্রদ্ধেয় উরুবেল কাশ্যপের নাম শুনেছি। তাঁর সাথে আমার ধর্মালোচনা করার ইচ্ছে। জানতে চাই তাঁর দীর্ঘ চর্চাধীন ধর্মদর্শন ও অভিমত।”
”আমাদের প্রভু এখন কার্পাস বনের দিকে একাকী ধ্যান-সাধনার উদ্দেশ্যে গেছেন, তিনি আগামী কাল ভোরে ফিরবেন।”
”বেশ। তবে আমিও ওই দিকেই যাই, হয়তো পথে তাঁর সঙ্গে দেখাও হতে পারে।”
”রাত্রে ওই বন শ্রমণদের থাকার জন্য সঠিক নয়। ওটি একটি প্রমোদ উদ্যান। মহান উরুবেল কাশ্যপও রাত্রে ওই বনে থাকবেন না, নিকটস্থ উরগ বনে থাকবেন। বৈশালীর ধনপতি শ্রেষ্ঠীদের পুত্ররা ওই বনে এখন প্রমোদ বিহারে গেছেন। নৃত্যগীত পারদর্শী বহু নর্তকী ও বাদ্যযন্ত্র বাজানোর জন্য অনেক যন্ত্রীরাও এখন ওই বনে আছেন।”
উত্তরে বুদ্ধ কিছু না বলে নীরবে সামান্য হাসলেন। তারপর বড়ো বড়ো পা ফেলে তিনি কার্পাস বনের দিকেই এগিয়ে গেলেন।
বুদ্ধ বনের ভেতর কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে অবশেষে এসে বসেছেন একটি বিরাট চিলবিল গাছের নীচে। গাছে ফুল এসেছে। ফুলগুলি দেখতে শিরাযুক্ত দুটি জোড়া সবুজ পাতার মত। পাতলা পাখার মত দেখতে সেই ফুল থেকে যখন ফল হয় তখন তা সহজেই সেই পাখা দুটিতে ভর করে বাতাসে উড়ে বহুদূরে ছড়িয়ে যায়। ফলের দুটি পাতলা পাখার ভেতর একটি বীজ থাকে। পাকা বীজ বাদামের মত খেতে, শিশুরা খেয়ে আনন্দ পায়। ঝড়ে বহুদূর উড়ে যায় এই গাছের পাকা ও শুকনো ফল।
গভীর রাত। ঝম ঝম ঝম দ্রুত লয়ে বাজছে আলম্বর। অন্ধকার বনে নিশাচর পশুর ডাক ছাড়া দূর থেকে ভেসে আসছে নারী কন্ঠের মিলিত সঙ্গীত। শোনা যাচ্ছে একত্রে বীণা, আলম্বর, তালবাদ্য ও মঞ্জিরের ঝংকার। রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিচ্ছে উল্লাসভরা তরুণদের চিৎকার এবং সেইসঙ্গে নারীদের কলহাস্য। বুদ্ধ তবুও এতটুকুও বিরক্ত হননি। তিনি নীরবে যেন কারুর আগমনের প্রতিক্ষা করছেন। ক্রমে রাত আরও বাড়তে লাগল। ভোগী মানুষদের সমস্ত চিৎকার একসময় থেমে গেল। মাঝরাতে সব একেবারে নিস্তব্ধ হল। সমগ্র বনভূমি জুড়ে বিরাজ করতে লাগল কেবল নৈশব্দ্য আর শান্তি। শেষ রাতে ঠাণ্ডায় বনের গাছের পাতার গা বেয়ে নিঃশব্দে শিশির ঝরে পড়তে লাগল। রাতের হিম ঝরে পড়ছে তথাগতর শরীরে। তার চীবর শিশিরে ভিজে গেছে। তবুও গাছতলাতে একভাবে বসে রইলেন তিনি।
একটু পরে একজন অপরূপ সুন্দরী নারী বনের ওই শিশির ভেজা পথ দিয়ে দ্রুত যেতে লাগল। তার হাতে একটা বিরাট বড়ো কাপড়ের পুটুলি, সারা শরীরে নানা রকমের গয়না। বুদ্ধ দূর থেকে মেয়েটিকে দেখলেন কিন্তু তিনি তাকে কিছু বললেন না।
মেয়েটি চলে যেতেই তিনি যেন নিশ্চিন্ত হয়ে ধ্যানে মগ্ন হলেন এবং একটু পরেই তাঁর সম্পূর্ণ বাহ্য চেতনা লুপ্ত হল।
ভোরের নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে বনের ভেতর। সকালের বাতাস এখনও বেশ ঠান্ডা। বুদ্ধ বনের ভেতর একটি শীর্ণ ও স্বচ্ছ জলধারায় হাতমুখ ধুয়ে নিলেন। তিনি অর্জুন গাছের একটি শাখা ডাল দিয়ে দন্তধাবন করলেন। তারপর বনের ভেতর গাছের তলায় পাকা ও ঝরে পড়া একটি সবুজাভ হলুদ রংয়ের পাকা হরীতকী নিয়ে মুখে দিলেন, ও সামান্য জল খেলেন। বসন্তে হরীতকী পেকে গাছের তলায় ঝরে পড়েছে। শুকিয়ে গেলে তা ক্রমশ কালো দেখায়, সতেজ এবং পাকা হরীতকী নরম, তার রং সবুজাভ হলুদ। তখন সহজেই বীজ থেকে তার ছাল আলাদা করা যায়। এবার তথাগত বনের ভেতর সামান্য সময় চঙ্ক্রমণ করলেন। এখনও তাঁর অপেক্ষা শেষ হয়নি। একটু পরেই সেখানে কোলাহল করতে করতে তিরিশজন তরুণ যুবক এসে উপস্থিত হল। তাদের সকলের পরনে কৌপীন। তারা অনেকেই প্রায় অর্ধনগ্ন। কেউ বা লজ্জা ঢাকতে উত্তরীয় দিয়ে সমস্ত শরীর ঢেকেছে, এবং তাদের সকলের শরীরই অলঙ্কার শূন্য।
বুদ্ধকে দেখতে পেয়ে যুবকের দল তাঁর কাছে ছুটে এল। এরাই গতকাল এই বনের প্রমোদ উদ্যানে এসেছিল।
”প্রণাম ভদন্ত!”
বুদ্ধ উত্তরে হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন। যুবকের দল বিভ্রান্ত। তারা বলল, ”প্রভু! আপনি কি কিছুক্ষণ আগে কোনো সুন্দরী নারীকে এখান থেকে যেতে দেখেছেন?”
”কুমার! আপনাদের সেই মহিলাকে কেন প্রয়োজন?”
”ভগবান সেই স্ত্রীলোকটি একজন নর্তকী। তাকে মধ্যদেশ থেকে আনা হয়েছিল। আমরা সকলেই বিবাহিত, আমরা এই উদ্যানে আমাদের ধর্মপত্নীদের সঙ্গে এসেছিলাম, কিন্তু আমার বন্ধু উপকিষ্য এখনও বিবাহ করেনি। আমরা ওর জন্যই সেই নর্তকীকে এনেছিলাম। তবে সে আমাদের সকলের বস্ত্র ও অলঙ্কার নিয়ে গতরাতে পালিয়ে গেছে। গতকাল আমরা সকলেই নেশাকর পানীয় পান করে, রাত্রে নৃত্য ও গীত শেষ হবার পরে ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েছিলাম। সেই অবসরে কখন নর্তকী চলে গেছে।”
”কুমারগণ! এখন আপনাদের গতরাতের কাজের জন্য অনুশোচনা হচ্ছে নিশ্চয়?”
”হ্যাঁ প্রভু! এখন আমরা সকলেই অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছি। এই অবস্থায় নগরে ফিরে যাওয়াও একেবারেই অসম্ভব। বনের বাইরে বের হলে লোকে এখন আমাদের পাগল বলবে।”
”জ্ঞানী ব্যক্তিরা এই জগতে মোহান্ধ মানুষের বিচরণকে পাগলের কার্যকলাপ মনে করেন। যিনি রাগ বা কামনা শূন্য, তাঁর কাছে আসক্ত মানুষের আচরণও পাগলের মত উদ্ভট মনে হয়।”
”প্রভু জ্ঞানী রাগ রহিত হয়ে কী করেন?”
জ্ঞানীব্যক্তি আত্মানুসন্ধান করেন। আমাদের শরীরে যে অবিনশ্বর প্রাণ বা শ্বাসবায়ু আছে, জ্ঞানী মানুষ সর্বদা সেইদিকে তাঁর দৃষ্টি ও মনোযোগ নিবদ্ধ রাখেন। একে বলে আনাপান স্মৃতি। শ্বাসই পরম গতি। জীবন চলে গেলে শরীরে আর শ্বাসের প্রবাহ থাকে না। যে কাজ করলে মন অনুশোচনায় দগ্ধ হয়, সেই কাজ থেকে নিবৃত্ত হওয়াই উচিত। তাই নয় কি? এখন কোন কাজটি আপনাদের উচিত মনে হচ্ছে কুমারগণ! সেই স্ত্রীলোকের অনুসন্ধান না আত্মানুসন্ধান?”
তিরিশজন যুবক যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে বুদ্ধের কথা। এই শ্রমণ কোনো বাগাড়ম্বর করেননি নিজেকে একবারও শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করেননি। সহজ সরল ভাষায় কথা বলেছেন। তবে তাঁর কথা মনোমুগ্ধকর। তাঁর কথাগুলি যুক্তিপূর্ণ, যেন মর্মে গিয়ে প্রবেশ করছে। সুতরাং তাঁকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে তাদের সবার। তিরিশজন মোহান্ধ বিষয়ী তরুণদের মন বুদ্ধের সঙ্গে সামান্য সময় কথা বলেই সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেল। তারা আর সংসারে ফিরে যেতে চাইল না। তারা বুদ্ধকে বলল,
”হে প্রভু! আত্মানুসন্ধানই শ্রেয়!”
শুনে খুশি হলেন বুদ্ধ। বললেন,
”এখানে আমার সামনে একান্তে উপবেশন করো। আমি তোমাদের ধর্মোপদেশ প্রদান করব।”
যুবকের দলকে তখনই বুদ্ধ চতুরার্য সত্য উপদেশ দিলেন। এরপর তারা সকলে বুদ্ধের অধীনে প্রব্রজ্যা গ্রহন করল। বুদ্ধ কার্পাসবন ত্যাগ করে এগিয়ে চলেছেন। এর মধ্যেই তরুণেরা বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে। তাদের জন্য গেরুয়া কাপড় এসেছে। সকলেই চুল ও দাড়ি কেটে ফেলেছে। এক নতুন জীবনের পথে যেতে তারা সকলে এখন প্রস্তুত।
পথে যেতে যেতে অনেকেই বুদ্ধকে প্রণাম জানাচ্ছে। অনেকে আবার এই যুবকদের চেনে। কী করে এদের হঠাৎ এমন পরিবর্তন সম্ভব হল, সবার কাছেই এ এক বিরাট বিস্ময়! কয়েকজন পথিক যুবকদের দলকে চিনতে পেরেছে। তাদের পরনে কাষায় বস্ত্র দেখে বিস্মিত হয়ে তারা বলে উঠল,
”ভদন্ত গতরাতে এরা সবাই ছিল কামভোগী বিষয়ী। আজ কীভাবে তারা প্রব্রজিত হল?”
বুদ্ধ উত্তরে স্মিত হাসলেন। বললেন,
”আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্যি। প্রকৃতপক্ষে এই যুবকের দল অতি পুণ্যবাণ। এদের সঙ্গে আমার সাক্ষাত পূর্বনির্ধারিত এবং কাল নির্দিষ্ট। এরা পূর্বজন্মে বহু সুকৃতিশালী সাধক ছিল। সকলেই এরা একসাথে ধর্মাচরণ করত, তাই আজ এরা সকলে একত্রে প্রব্রজ্যা পেয়েছে।”
কথা শেষ করে বুদ্ধ একটি গাথা রচনা করলেন, এবং পথিকদের উদ্দেশ্যে তা আবৃত্তি করলেন।
”মুহুত্তমপি চে বিঞ্ঞ্ পণ্ডিতং পয়িরুপাসতি।
খিপ্পং ধম্মং বিজানাতি জিব্হা সুপরসং যথা।।”
অর্থাৎ ”জিভ যেমন এক মুহূর্তের মধ্যে বিনা দ্বিধায় সুস্বাদু রান্নার স্বাদ বুঝতে পারে, তেমন পণ্ডিত ব্যক্তিও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ধর্ম কী? তা উপলব্ধি করতে পারে।”
তিরিশজন নতুন প্রব্রজিত তরুণদের নির্জনে সাধনা অভ্যাস করতে বলে বুদ্ধ এগিয়ে চললেন। তাঁকে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। তা হল অহঙ্কারী উরুবেল কাশ্যপের অহংকার নাশ করা। এর জন্য তাঁকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হবে। তবে সেই যুদ্ধ বাস্তবে ঘটবে না। সংঘর্ষটি হবে একটি অহঙ্কারী মনের সঙ্গে একটি স্থিতধী মনের। বুদ্ধ দ্রুত পথ চলতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি এসে পৌঁছালেন উরুবেল কাশ্যপের আশ্রমের প্রাঙ্গনে।
২
তথাগত জটিল সম্প্রদায়ের আচার্য্য উরুবেলকে বললেন, ”হে জটিল আমি তোমার আশ্রমে আজকের রাতটুকু বিশ্রাম করতে চাই।”
উরুবেল বিরক্ত স্বরে বললেন, ”এখানে থাকবার কোনো জায়গা নেই শ্রমণ গৌতম। একমাত্র ফাঁকা আছে একটিই কক্ষ, এবং সেটি হল আমাদের অগ্নিশালা। অগ্নিশালার অগ্নিই হল আমাদের কাছে পরম পবিত্র ও তা হল আমাদের উপাস্য। সেখানে অগ্ন্যাগারের আগুন কখনও তাই নেভানো হয় না। সাধন বলে আমি সেখানে এক মহা বিষধর সাপকে বন্দী করে রেখেছি। সেই সাপ আমার কখনও কোনো ক্ষতি করেনি। তবে সে ভিন্ন সম্প্রদায়ের কোনো মানুষকে একেবারেই সহ্য করবে না। এদিকে আমার আশ্রমে দ্বিতীয় এমন কোনো ঘর নেই যেখানে তোমার মতো সম্মানীয় শ্রমণকে থাকতে দিতে পারি। সুতরাং এই আশ্রমে এখন তোমার থাকার কোনো জায়গা হবে না।”
তথাগত মৃদু হাসলেন। বললেন, ”আমি না হয় আপনার অগ্ন্যাগারেই থাকব। সাপ আমার কোনো ক্ষতি করবে না।”
উরুবেল ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন। বললেন, ”সাপের ভয়ানক তেজে সেখানে তোমার শরীরে ভীষণ দহন জ্বালা হবে। সে তোমার সহ্য হবে তো? সেই মহাতেজে এমনকী তোমার প্রাণও চলে যেতে পারে। সুতরাং এখনও সাবধান হও! পরে তোমার ক্ষতি হলে আমি তার জন্য দায়ী হতে চাই না।”
তথাগত বললেন, ”বেশ জটিল! তুমি দায়ী হবে না। আমি তো স্বেচ্ছায় সেখানে থাকব বলছি। বিষাক্ত সাপ নিয়ে না হয় তখন চিন্তা করা যাবে। তবে এটুকু বলতে পারি যত বড়ো বিষাক্ত নাগরাজই হোক না কেন, সে তথাগতর এতটুকু কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।”
অগ্নিশালাটি বেশ বড়ো। কথা মত তথাগত রাতে বিশ্রাম করবেন বলে সেই ঘরে এসে একপাশে পদ্মাসনে বসলেন। ঘরের চারিদিকে অসংখ্য বড়ো বড়ো কাঠের টুকরো স্তূপাকারে রাখা আছে। সেগুলি ক্রমাগত অগ্নিশালার বিরাট আগুনের কুণ্ডে দিয়ে আগুনকে সর্বদা প্রজ্জ্বলিত রাখা হয়। ঘরটিতে তাই জ্বালানী কাঠ সব সময় মজুত থাকে। আশ্রমের শিষ্যরা বন থেকে কাঠ কেটে আনেন এবং তা কয়েক ঘন্টা পর পর আগুনে ঘি সহ আহুতি দেওয়া হয়। এটাই জটিলদের উপাস্য দেবতার একটি পূজার পদ্ধতি। অগ্নিকুণ্ডের ভেতর লাল গনগনে আঁচে কাঠকয়লা হচ্ছে সুবিশাল একটি শাল গাছের কাণ্ড। ঘরটিতে খুব একটা ধোঁয়া নেই কারণ, শাল কাঠটি বেশ শুকনো।
বুদ্ধ আগুনের দিকে মুখ করে বসেছেন। একটু দূরেই একটি সুবিশাল শঙ্খচূর সাপ ফনা তুলে ফোঁস ফোঁস করছে। সেদিকে তাকিয়ে তথাগত মৃদু হাসলেন। মৈত্রীচিত্ত দিয়ে প্রথমে সাপটিকে শান্ত করতে চাইলেন বুদ্ধ। তবুও সাপটি বশীভূত হল না। বরং মুখ থেকে ক্রমাগত বিষ বের করে বাতাসে ছিটিয়ে দিতে লাগল। বুদ্ধ তখন যোগবলে নিজের দেহটিকে ঘরের ভেতর কিছুটা উচ্চতায় শূন্যে ভাসমান রাখলেন। সাপ বিষ ছিটিয়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারল না। সে ব্যর্থ চেষ্টা করে সারা ঘরে ছুটে বেড়াতে লাগল। বুদ্ধ শূন্যে ধ্যানে বসেছেন, সম্পূর্ণ অবলম্বনহীন অবস্থায় আছে তাঁর দেহটি। এটি একটি বিশেষ অবস্থা। শত শত বছর আগে আর্য ঋষিরা যোগের মাধ্যমে কী করে এই অবস্থা লাভ করা যায় বিশদে তার উপায় ব্যক্ত করেছিলেন তাদের শিষ্যদের কাছে। এই প্রক্রিয়াটি মানসিক শক্তির উপর নির্ভরশীল। ধ্যানে দেহবোধ হারা হতে পারলে সহজেই এই অবস্থাপ্রাপ্তি ঘটে।
বুদ্ধ তাঁর দেহটি ধীরে ধীরে এবার আদীপ্ত করলেন। ঘরের কুণ্ডের আগুনের মত তাঁর শরীরটিও তখন কিছুক্ষণের জন্য তীব্র উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে উঠল। সাপটি ভয়ে ফনা নামিয়ে নিতেই বুদ্ধ সাপটিকে ধরে ফেললেন। তারপর একটি মাটির হাঁড়ির ভেতর ভরে সরা চাপিয়ে দিলেন।
জটিলের আশ্রমের সমস্ত শিষ্যরা আগেই বুদ্ধকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এখন অগ্নিশালার বাইরে থেকে সাপের ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনে তাঁরা সকলে অন্তরে খুব দুঃখিত হলেন। সকলেই বলতে লাগলেন,
”না জানি সেই তরুণ শ্রমণ ঘরের ভেতর এখন কতই না কষ্টে আছেন!”
ভোর হতেই বুদ্ধ মাটির হাঁড়িটি হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। উরুবেল দেখলেন তাঁর ঘোর ঋদ্ধিমায়া শক্তি সম্পন্ন বিষাক্ত সেই সাপটি নিস্তেজ হয়ে হাঁড়ির ভেতর মড়ার মত পড়ে আছে। তিনি বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগলেন এই শ্রমণ গৌতম নিঃসন্দেহে একজন উচ্চশ্রেনীর সাধক। অবশ্যই অসীম যোগবিভূতি ও ঋদ্ধিশক্তি আছে তার। তবে যতই শক্তি থাকুক সে কিছুতেই আমার সমকক্ষ নয় এবং তা কখনও হতেই পারে না। তবুও উরুবেল এখন বুদ্ধের প্রতি কিছুটা প্রসন্ন হয়েছেন। তিনি দেখলেন তাঁর শিষ্যরাও বুদ্ধের প্রতি অতিমাত্রায় অনুরক্ত। আশ্রমিকেরা তথাগতকে বললেন,
”হে মিত্র! আপনি দয়া করে আর কিছুদিন এখানে থেকে যান। আগামী পূর্ণিমায় আমাদের আশ্রমের মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হবে। তাতে বহুদূর থেকে চম্পানগর ও মগধের বহু মানুষ এসে যোগ দেন। আমরা চাই আপনিও তাতে যোগদান করুন।” ভদ্রতা দেখিয়ে তখন উরুবেলও তথাগতকে থেকে যেতে বলতে বাধ্য হলেন। তিনি বললেন,
”আমার আশ্রমের তোমার থাকার জায়গা না হলেও তুমি কিছুদিন এই আশ্রম সংলগ্ন কার্পাস বনে বাস করতে পারো। আমার আশ্রমিকেরা তোমার খাদ্য সেখানে পৌঁছে দিয়ে আসবে। আমি কিছুদিন খাদ্যদানের মাধ্যমে তোমার সেবা করতে চাই।”
বুদ্ধ নীরবে তাতে সম্মতি জানালেন।
উরুবেলের আশ্রম সংলগ্ন বনে বুদ্ধ একটি বিরাট গাছের নীচে আশ্রয় নিয়েছেন। উরুবেল বুদ্ধের গতিবিধি সব সময় নজরে রেখেছেন। তাঁর শিষ্যদেরও নির্দেশ দিয়েছেন বুদ্ধ রাত্রে কী করেন? তা লক্ষ্য করার জন্য।
রাত গভীর হলে বুদ্ধ যেখানে ধ্যানাবিষ্ট ছিলেন সেখানটা ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে উঠল। উরুবেল দূর থেকে দেখতে পেলেন চারটি আলোকিত দেহধারী ছায়ামানব বুদ্ধের চারদিকে জোড়হাতে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। গভীর ধ্যানে মগ্ন বুদ্ধের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। প্রথমদিন এমন হবার পর উরুবেল এসে তথাগতকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে বুদ্ধ বললেন যে গতরাতে তাঁর কাছে চারটি দিকের দিকপাল মৃত রাজারা ধর্মকথা শুনতে এসেছিলেন।
দ্বিতীয় দিনে সমগ্র বনভূমিটি গভীর রাতে যেন হঠাৎ উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল। উরুবেল ভাবতে লাগলেন সবই এই অসামান্য শক্তিশালী ঋদ্ধিমান শ্রমণের প্রভাবে ঘটছে। তিনি ভোর হতেই তথাগতর কাছে গিয়ে আবার জানতে চাইলেন,
”গতরাতে সমগ্র বনভূমি কেন আলোয় ভরে গেছিল?”
উত্তরে বুদ্ধ বললেন, ”গতরাতে ব্রহ্মা ও বৃহষ্পতি আমার সঙ্গে ধর্মালোচনার জন্য এইখানে এসেছিলেন। তাঁদের শরীরের জ্যোতিতে বনভূমি আলোকিত হয়েছিল।”
জটিল অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন তথাগত কতই না ক্ষমতাশালী, তার কাছে স্বয়ং ব্রহ্মাও ধর্মকথা শুনতে আসেন! কিন্তু তথাগত যতই ঋদ্ধিশক্তি সম্পন্ন হোক না কেন আমার মতো শক্তিশালী কখনও সে হতে পারবে না।
এভাবে দিন কাটতে লাগল। দেখতে দেখতে উরুবেলের আশ্রমের তিথিপূজার বিশেষ দিনটি এসে গেল। উরুবেল মনে মনে জেনেছেন বুদ্ধ অতি শক্তিশালী কৃতবিদ্য এক সাধক। তাঁর রূপ ও ব্যক্তিত্ব এমন মনোহর যে তাঁর দিকে দৃষ্টি পড়া মাত্রই মানুষ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়। তিনি মনের গভীরে চাইলেন আশ্রমের পুজোর সময় কিছুতেই যেন শ্রমণ গৌতম তাঁর আশ্রমের ধারে কাছেই না আসে। সমস্ত দিন ধরে বহু লোক সমাগম হল আশ্রমে। দানে দক্ষিণায় ভরে উঠল প্রাঙ্গণ। নানা রকম সুখাদ্য রান্না হয়েছে আশ্রমে। এই একটি দিনে আশ্রমিকেরা পেট ভরে নানা উৎকৃষ্ট খাদ্য পায়। উরুবেল কাজের মাঝে সারাদিন ধরে শঙ্কিত হয়ে রইলেন। তাঁর বারে বারে মনে হচ্ছিল এই বুঝি সেই সুদর্শন শ্রমণ এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু নাহ্! আসেনি। একবারও শ্রমণ গৌতমকে দেখা যায়নি সারাদিন।
দান হিসেবে বহু নতুন কার্পাস বস্ত্র ও সোনার অলঙ্কার পেয়েছেন উরুবেল। তিনি সেই স্তূপাকার বস্ত্রগুলি সরিয়ে রেখে তাঁর সঞ্চয় থেকে একটা ধূলি মলিন ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো দেখতে পাংশুকুলিক বের করলেন। পাংশুকুলিক হল মৃতদের শরীর দাহ করার আগে যে ছোটো কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঢাকা থাকে সেটি। ভিক্ষুরা অনেক সময় শ্মশান থেকে এই পাংশুকুলিক সংগ্রহ করে পরিধান করেন। মৃতের পরিত্যক্ত কাপড় পরলে মনে জীবন সম্পর্কে বাসনা থাকে না। মন নির্মল হয়। তাছাড়া এটি এক ধরণের কৃচ্ছ সাধন। যা তরুণ শ্রমণদের পালন করা উচিত বলে উরুবেল মনে করেন।
বস্ত্রটি হাতে নিয়ে তিনি কার্পাস বনে বুদ্ধের উদ্দেশ্যে গেলেন। বুদ্ধকে দেখে উরুবেল অবাক হয়ে গেলেন। বুদ্ধের মুখে উপবাসের চিহ্ন নেই। তবে কি বনে কোনো উপাসকেরা এসে ভিক্ষা দিয়েছে শ্রমণ গৌতমকে? উরুবেল দেখলেন বুদ্ধের হাতে ভিক্ষা পাত্রে খানিকটা পানীয় জল। এবং সেই জল বেশ উষ্ণ। কারণ জল থেকে মৃদু ধোঁয়া বের হচ্ছে। ভোরের ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় উষ্ণ জল খাওয়া তো খুবই আরামদায়ক! কিন্তু গভীর বনের ভেতর গরম জল কোথায় পেল এই শ্রমণ? হতবাক উরুবেল প্রশ্ন করলেন,
”এই উষ্ণ জল কোথা থেকে পেয়েছো?”
”এই জল অনন্তকাল এমন মৃদু উষ্ণ থাকবে। এই জল উত্তরকুরুর অনবতপ্ত হ্রদ থেকে আনা হয়েছে। আমি সেখানেই গতকাল আমার খাবার খেয়েছি ও চঙ্ক্রমণ করেছি। আপনার আশ্রমের কাছেই আসিনি।”
”কেন কাল এলে না? কত উপাসকেরা এসেছিল! সুখাদ্যও অনেক রকম রাখা ছিল তোমার জন্য, হে তরুণ ভিক্ষু! তুমি না এসে সবকিছুই হারিয়েছো।”
বুদ্ধ মৃদু হাসলেন। তারপর তীব্র শানিত দৃষ্টি হেনে উরুবেলকে বললেন,
”গতকাল আপনিই তো মনে মনে একেবারেই চাননি যেন কখনও আমি আপনার আশ্রমে পদার্পণ করি। আপনার চাহিদাকে সম্মান প্রদর্শন করে আমি গতকাল আপনার আশ্রমের কাছাকাছি ছিলাম না। বরং এই অঞ্চল ছেড়ে হিমবন্ত প্রদেশের অনবতপ্ত হ্রদের পাশে সময় কাটিয়েছি। খেচরী বিদ্যার মাধ্যমে আমি জগতের যে কোনো জায়গায় ইচ্ছামাত্র চলে যেতে পারি। আজ এই বনে আবার ফিরে এসেছি আপনার দর্শনলাভের মানসে। আমি কি আপনার মনের ইচ্ছাটির কথা কিছু ভুল বললাম?”
উরুবেল অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন এই শ্রমণ এমন ঋদ্ধিসম্পন্ন যে সে অন্যের মন জানতে সক্ষম। তবুও কিছুতেই এই শ্রমণ আমার সমকক্ষ নয়। এমনটা হতেই পারে না।
উরুবেল প্রতিদিন বুদ্ধকে অবজ্ঞা ও অপমান করতে চাইছেন, কিন্তু কিছুতেই তিনি তা পারছেন না। বুদ্ধের কাছে এলেই চিন্তা করার ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে যায় তাঁর। তিনি তাঁর হাতে ধরা পাংশুকুলিক বস্ত্রের কথা এতক্ষণ একেবারে ভুলেই গেছিলেন। হঠাৎ সে কথা মনে এল তাঁর। উরুবেল এবার ছেঁড়া ও অপরিষ্কার কাপড়টি বুদ্ধকে দান করলেন। বুদ্ধ সেই মলিন কাপড়টি গ্রহণ করলেন। সেদিকে তাকিয়ে উরুবেলের মনে এবার একটু আনন্দ হল। তিনি শান্তি পেলেন এই ভেবে যে বুদ্ধ তাঁর মতো একটিও নতুন বস্ত্র দান হিসেবে পায়নি। শেষ পর্যন্ত তাঁরই দেওয়া পুরনো কাপড়টি গ্রহন করেছে।
মলিন কাপড়টি হাতে নিয়ে বুদ্ধ ভাবতে লাগলেন কীভাবে এই কাপড়টিকে তিনি পরিষ্কার করবেন? বুদ্ধের ইচ্ছা সঙ্গে সঙ্গে কার্যে পরিণত হল। হঠাৎ সেই মুহূর্তে বনভূমির বুকে সেই বৃক্ষের খানিকটা দূরে বনভূমির মাটি সরে গিয়ে একটি জলপূর্ণ দীঘির সৃষ্টি হল। বুদ্ধ সেদিকে তাকাতেই দীঘির ঘাটে অন্তরীক্ষ থেকে একটি সুবিশাল মসৃন শিলাখণ্ডও এসে স্থাপিত হল, বুদ্ধ যাতে সেই শিলাখণ্ডের উপর বসে তাঁর মলিন কাপড়টি ধুয়ে নিতে পারেন। একটু পরেই অপর একটি চেটালো ও মসৃন পাথরও স্থাপিত হল দীঘি থেকে একটু দূরে। সেখানে ধোয়া পরিষ্কার কাপড়টি বুদ্ধ শুকিয়ে নিতে পারবেন। বুদ্ধ দীঘির দিকে এগিয়ে যেতে গেলে বনের ককুধ গাছের একটি সুবিশাল ডাল নীচে নেমে এল একেবারে জলের উপরের তল পর্যন্ত, যাতে বুদ্ধ সেই শাখাটি ধরে দীঘিতে নামতে পারেন।
পরেরদিন খুব ভোরে বুদ্ধের খাবার নিয়ে এলেন উরুবেল। এসেই তিনি বনের ভেতর হঠাৎ একটি বিশাল দীঘি ও তার পাড়ে শিলাখণ্ড ও অবনমিত ককুধ বৃক্ষের ডালটি দেখতে পেলেন। এই অস্বাভাবিক অলৌকিক ঘটনা দেখেও উরুবেল ভাবলেন বুদ্ধ কিছুতেই তাঁর সমকক্ষ নয়। বুদ্ধকে খাবার দিয়ে ফেরার সময় তিনি মনে মনে অপদেবতার কথা ভাবতে লাগলেন। তিনি ভাবলেন ‘এই অলৌকিক ঘটনাগুলি কি কোনো পিশাচের না দেবতার? তথাগত কি কোনো পিশাচকে বশীভূত করেছে?’ তথাগত সম্পর্কে কুচিন্তা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে উরুবেল দেখলেন সদ্য ভোরের আধো অন্ধকার বনভূমির বুকে কাদের যেন ছায়া! তাঁর অন্তর ভয়ে কেঁপে উঠল। তিনি হঠাৎ চেয়ে দেখলেন সেই বনের গাছের ডালে ডালে অসংখ্য মৃত মানুষের হাড় ও বীভৎস দর্শন বহু নরমুণ্ড ঝুলছে। উরুবেল ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্রাণ হাতে করে সেখান থেকে কোনো রকমে পালিয়ে গেলেন। পরদিন আশ্রমের একজন তরুণ আশ্রমিক এসে বুদ্ধকে জানালেন,
”আগামীকাল থেকে উরুবেল আর অন্ন নিয়ে কার্পাস বনে আসবেন না। আশ্রমের অন্য কেউও আসবে না। গুরুদেবের আদেশ হয়েছে যে আপনাকেই আশ্রমে গিয়ে অন্নগ্রহন করতে হবে।”
সে কথা শুনে বুদ্ধ প্রসন্ন মুখে বললেন। ‘তথাস্তু।’ পরেরদিন থেকে রোজ ভোরে বুদ্ধ উরুবেলের আশ্রমে অন্নগ্রহন করতে যেতে লাগলেন।