গল্প-নীলগাই রহস্য-নীলাশিস ঘোষদস্তিদার -বসন্ত ২০২২

প্রতিযোগিতায়  পুরস্কৃত অন্যান্য গল্পেরা-প্রথম স্থান-অভিশপ্ত একশৃঙ্গী, দ্বিতীয় স্থান-সেই রাত তৃতীয় স্থান- নীল পাহাড়ের জ্বলন্ত মূর্তি

সন্ধ্যা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য প্রতিযোগিতা’২০২১-চতুর্থ স্থান

golponilgai_rahosyo

“রাহুল দেববর্মণের ডাকনাম? পঞ্চম বললে নম্বর নেই।”

“টুবলু।”

“টাইগার পতৌদি, রাণা সঙ্গ আর মহারাজা রণজিৎ সিংজীর মধ্যে মিল?”

“প্রিলিমিনারি। তিনজনই এক চোখে দেখতে পেতেন না।”

“চান্দু বোরদে, বিজয় হাজারে, রজার বিনি আর ডেভিড জনসনের মিল?”

“ক্রিকেটার্স। হে হে। কিডিং।”

“হবে?”

“পারব না। পাস।”

“চারজনই খ্রিস্টান!”

“এরকম আউট অফ সিলেবাস কোশ্চেন চলবে না।”

এই সময়ে কুইজ মাস্টার রঞ্জুদা, রুদ্রনীল মিত্রদার মোবাইল ফোন বাজল। ইশারায় আমাদের পাঁপড়-মুড়ি-চা খেতে বলে রঞ্জুদা উঠে গেল বাইরে, ব্যালকনিতে। ছত্তরপুরের শেষ সীমানার এই ফার্ম হাউসগুলোয় ফোনের কানেক্টিভিটি ভালো নয়। বাইরে ঝুপঝাপ বৃষ্টি হচ্ছে। জানালা দিয়ে ফার্ম হাউসের বাইরে গাছ আর গাছ। পড়ন্ত বিকেলের মেঘলা আঁধার ঘনিয়ে আসা আলোয় গাছগুলো বেশ মায়াবী সেজেছে আর আশিকড় ভেজান ভিজছে। আমরা চা-মুড়িতে মন দিলাম।

আমরা বলতে রণো অর্থাৎ শরণ্য সেন আর আমি, ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী। দুজনেই প্রবাসী, গুরুগ্রামে নামি আইটি ফার্মে চাকরি করি। ব্যাচেলার, থাকি একটা ফ্ল্যাট শেয়ার করে। অফিস টিমের হয়ে ছত্তরপুরে মধ্য ডিসেম্বরের শীতে কর্পোরেট ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে রাত এগারোটায় এক দলের কাছে গো-হারান হারছি, অবাক হয়ে দেখলাম এক পাকা চুল-দাড়ির যুবক টার্ফের মাঠে কী অনায়াসে খেলছে! ম্যান অফ দ্য ম্যাচ ঘোষণার সময় ঘোষক জানালেন ইনি পঞ্চাশ উত্তীর্ণ। তারপর রুদ্দরনীল মিত্রা নাম বলায় বুঝলাম ইনিও বঙ্গনন্দন। এগিয়ে গিয়ে দুজনেই আলাপ করলাম। সেই থেকে উনি আমাদের রঞ্জুদা।

রঞ্জুদার বিচিত্র জীবন। ওর ঠাকুরদা উনিশশো এগারোয় রাজধানী কলকাতা থেকে স্থানান্তরিত হওয়ায় আসেন দিল্লিতে। রঞ্জুদার বাবা কেন্দ্রীয় সরকারে চাকরি করতেন, মারা গিয়েছেন। মা এখন আছেন রঞ্জুদার ছোটো ভাইয়ের কাছে, সিডনিতে। রঞ্জুদার জ্যাঠামশাই কৃষিবিদ ছিলেন, সরকারি চাকরি ছেড়ে চলে গেছিলেন কেনিয়া। অপুত্রক জ্যাঠামশাই রঞ্জুদাকেও টেনে নিয়ে গেছিলেন সেখানে। এ-দেশে রঞ্জুদা এগ্রিকালচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়েছিল। পরে মাস্টার্স করতে যায় জার্মানিতে। সেখানে চাকরিও করছিল। এর মধ্যে জ্যাঠামশাই কেনিয়া থেকে ফিরে দিল্লি-গুরুগ্রামের সীমান্তে ছত্তরপুরে জমি কিনে এই ফার্ম হাউস বানান, একটা ব্যাবসাও শুরু করেন। জ্যাঠামশাই মারা গেলে জ্যাঠাইমার জন্য রঞ্জুদা ফিরে আসে। জ্যাঠাইমা এখন হুগলীতে, রঞ্জুদাদের পৈতৃক বাড়িতে। গ্রামে শতাব্দীপ্রাচীন রথের মেলা হয়। সেটাতে ওঁদের অনেক অবদান থাকে। উলটোরথ কাটিয়ে  ফিরবেন। ভারতে কৃষি-নির্ভর উদ্যোগ বাড়ছে। রঞ্জুদার কাজ আধুনিক গ্রিন-হাউস, কোল্ড স্টোরেজ ইত্যাদি বানানোতে বা অন্যান্য কারিগরি বিষয়ে সাহায্য করা। নতুন কাজ আসে, আর রাত জেগে পড়াশুনো বা অনলাইন কোর্স ইত্যাদি করে রঞ্জুদা আরও তৈরি হয়। কাজের পরিধি বাড়ছে। কাজের চাপে জেরবার আমরাও মাঝে মাঝে ভাবি ওর সঙ্গে ভিড়ে গেলে হয়! একটা বড়ো কারণ মাঠে-ময়দানে ঘোরার সুযোগ যদি হয়, তাহলে আরেকটা বড়ো কারণ অ্যাডভেঞ্চার।

ব্যাপারটা এরকম। নানা বিষয়ে রঞ্জুদার অগাধ জ্ঞান। পড়াশুনো ছাড়া আগ্রহও আছে। সেই সঙ্গে আছে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর অলরাউন্ড দক্ষতা। ফলে সাধারণ রুটিন কাজের পাশাপাশি রঞ্জুদা কিছু জায়গায় অনেকরকম গোলমালের জট ছাড়িয়ে, দুরূহ সমস্যার সমাধান করে অল্পস্বল্প নাম করে ফেলেছে। সেজন্য আজকাল এমন ডাক আসে, যেখানে অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ আছে। আমরাও সঙ্গ নেবার চেষ্টা করি। শুক্রবারের বিকেলে চলে আসি এই ফার্ম হাউসে—শনিবার রবিবার ফুটবল-ক্রিকেট খেলি, রঞ্জুদার সঙ্গে গল্পগাছায় সমৃদ্ধ হই। রবিবার সন্ধ্যায় বাসায় ফিরি। ফার্ম হাউসে থাকার অসুবিধা নেই। এক মধ্যবয়স্ক দম্পতি আর তাদের পুত্র-পুত্রবধূ বহুবছর ধরে সব কাজ সামলায়—প্লাম্বিং থেকে কুকিং, গোরুর দেখভাল থেকে ড্রাইভিং। একর তিনেক জমির এক একরে ফুল ও সবজির চাষ হয়, বাকি দুই একর জুড়ে খেলার মাঠ। সপ্তাহান্তে বা ছুটির দিনে খেলা-পাগলরা খেলতে আসে ফুটবল-ক্রিকেট-ব্যাডমিন্টন, প্রণামীর বিনিময়ে।

ব্যালকনি থেকে ফিরে এসেছে রঞ্জুদা। কপালে ভাঁজ। মোবাইলটা নিয়ে আনমনে লোফালুফি খেলছে। আমার আর রণোর চোখাচোখি হল। আমি গলা খাঁকারি দিলাম, প্রশ্নের অবতারণা। তার আগেই রঞ্জুদা প্রশ্ন করল, “নীলগাই প্রাণীটা কী, কেমন?”

রণো একবার আমাকে দেখে নিয়ে বলল, “এশিয়ার বৃহত্তম অ্যান্টিলোপ। অ্যান্টিলোপ, তাই গোরুর সঙ্গে কিছু মিল আছে। পুরুষগুলো নীল রঙের, তাই নীলগাই নাম।”

“বেশ। আর কিছু? ধ্রুব কী বলে?” আমার দিকে তাকাল রঞ্জুদা।

“দলে থাকে। বেশ বড়োসড়ো হার্বিভোর। ফসলের প্রচুর ক্ষতি করে। নামে গাই, তাই লোকে মারে না। তবে হরিয়ানা না মধ্যপ্রদেশে নামটা পালটে ‘রোজ’ রাখা হয়েছে, যাতে লোকেরা মারে। ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্টের প্রাণী। তবে আমেরিকায় টেক্সাসে বোধ হয় এর ফার্মিং হয়। আমার এক টিম-মেট একবার ফরিদাবাদ যাবার পথে নীলগাই দেখে বলছিল ও টেক্সাসে এর স্টেক খেয়েছে।”

“ব্রাভো! দারুণ ইনফো। এর প্রিডেটর কে? ন্যাচারাল এনিমি?”

রণো চিবুকে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “বাঘ-সিংহ! চিতাবাঘ। জংলি কুত্তা, নেকড়ে?”

“সাবাস। নেকড়ে আর জংলি কুকুর বা ঢোল ভীষণ কমে যেতে নীলগাইয়ের বাড়বাড়ন্ত। লেপার্ড যদিও সংখ্যায় বেড়েছে, খোলা মাঠে চরতে থাকা দ্রুতগতির নীলগাইকে তাড়া করে ধরার চেয়ে বনের ছোটো শিকার বা গ্রামের হাঁস-মুরগি, ছাগল-ভেড়া ইজিয়ার কিল।”

রণো এবার জিজ্ঞাসু নেত্রে আমার দিকে তাকাল। হঠাৎ নীলগাই নিয়ে কেন পড়েছে রঞ্জুদা? আমিও উশখুশ করছি দেখে রঞ্জুদা বলল, “উত্তরাখণ্ডে আমার একটা প্রোজেক্ট চলছে হলদোয়ানির কাছে, তোমরা জানো। নীলগাই ওদিকের গ্রামে এখন খুব উৎপাত করে। ফার্মারদের হিউজ লস হয়। আমার প্রোজেক্ট আসলে কালাধুঙ্গির রাস্তায়, জঙ্গলের পাশেই। নীলগাইয়ের দল ফেন্সিং টপকে এসে এক্সোটিক ফ্লাওয়ার প্ল্যান্টস, ফ্রুট স্যাপলিং খেয়ে যাচ্ছিল। এমনকি পলি-হাউসের প্লাস্টিক ফাটিয়ে ভিতরে ঢুকে সব দামি ফ্রুট স্যাপলিং খেয়ে গেছে, হার্ডেনিং চেম্বারের গাছও ছাড়েনি।”

আমরা ঘাড় নাড়লাম। রঞ্জুদার এক ক্লায়েন্ট টিস্যু কালচার ল্যাব করেছে ওদিকে, সঙ্গে বেশ ক’টা পলি-হাউস। এক্সোটিক ফ্লাওয়ার আর ফ্রুটসের চাষ করছে। ক্লায়েন্টের পার্টনারদের মধ্যে রঞ্জুদার এক বান্ধবীও আছে শুনেছি।

রঞ্জুদা আবার বলল, “দুই-তিন উইক আগে উৎপাত হঠাৎ বেশ কমে যায়। আমি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ঠিক করে এলাম, তার পরেই। দেখতে গেলে এটা ভালো খবর। মুশকিল হয়েছে সঙ্গীতাকে নিয়ে, মানে ওয়ান অফ দ্য ক্লায়েন্টস, চেনো তো?”

আমরা সুবোধ বালকের মতো ঘাড় নাড়লাম। ব্যাপার ঘোরালো!

রঞ্জুদা খেই ধরল, “সঙ্গীতার হাজব্যান্ড, সুরেশ পন্ত আমার বন্ধু। ওরা দুজনেই পন্তনগরে আমার ব্যাচমেট ছিল। সুরেশ এখন হলদোয়ানির ফরেস্ট কনজার্ভেটর। নীলগাইয়ের উৎপাত কমেছে কেন দেখতে আউট অফ কিউরিওসিটি পাশের জঙ্গলে গিয়ে দেখে বেশ কিছু কারকাস পড়ে আছে নীলগাইয়ের। আনইউজুয়াল। চান্স ছিল, যদি নীলগাইয়ের আক্রমণে ফেড-আপ ফার্মাররা পয়জন দিয়ে বা গুলি করে মেরে থাকে। পোস্ট-মর্টেমে সে-সব নেই। লাশগুলোতেই এভিডেন্স ছিল, বিগ ক্যাট মেরেছে, খেয়েছে, তারপর ছোটো প্রিডেটর, মানে শিয়াল-শকুনে খেয়েছে। মুশকিল, এতগুলো নীলগাই মরল, মানে বেশ কিছু বিগ ক্যাট ওখানে এখন আছে, যেটা আগে ছিল না। কোথা থেকে এল, কেন নীলগাই মারছে? ইউজুয়ালি বড়ো বাঘের ডায়েটে নীলগাই কম থাকে। লেপার্ড? এক ঝাঁক লেপার্ড এসে থাকলে পাশের গ্রামগুলোকে সাবধান থাকতে হবে। এদিকে এ-দেশে সবকিছুতে পলিটিক্স! পলিটিশিয়ানরা এরই মধ্যে খোঁজখবর নিয়েছে। কোনও ইস্যু যাতে না দাঁড়িয়ে যায়, সেজন্য ওপরমহল থেকেও চাপ আছে, জলদি ছানবিন করে রিপোর্ট দাও। সুরেশ হেল্প চাইছে। ভাবছি, কী করা যায়।” জানালার বাইরে তাকিয়ে কথাগুলো বলল রঞ্জুদা।

আমরা সমস্বরে বললাম, এরকম একটা দুর্ধর্ষ ব্যাপারে রঞ্জুদার এগোনো তো উচিতই, আমরাও সঙ্গে আছি। রঞ্জুদা মুখ ফিরিয়ে আমাদের দিকে একটা প্রশ্রয়ের হাসি দিল।

কাজে লেগে গেলাম। রণো আর আমার বস একই। খুব স্পোর্টি লোক। রোজ সকালে তিরিশ কিমি সাইক্লিং করে। ব্যাপার শুনে বলল, কাজের চাপ না থাকলে নিজেও যেত। আমাদের জন্য ওয়ার্ক ফ্রম হোম সম্ভব। হলদোয়ানিতে হাই স্পিড ওয়াই-ফাই পেলেই হল, ওখান থেকেও কাজ করা যাবে। তবে সাবধানতা চাই। জঙ্গলে আমাদের কোনও ক্ষতি যেন না হয়।

আজ শুক্রবার সন্ধ্যা। আগামীকাল ভোরবেলা বেরোনো। আমরা ফ্ল্যাটে গিয়ে জামাকাপড়, রেনকোট, বড়ো ছাতা, ফ্লাস্ক, কম্পাস, টর্চ, গামবুট, হান্টিং নাইফ ইত্যাদি গুছিয়ে আনলাম। এয়ারগানটা নিলাম। কিছু না হোক, প্র্যাক্টিস করা যাবে। ফিরে দেখি রঞ্জুদাও দিল্লি থেকে কীসব কিনে ফিরল। তার ম্যান ফ্রাইডে অর্থাৎ ফার্মের কেয়ারটেকার বিশ্বাস দম্পতির ছেলে মন্টু আর তার বৌ। রঞ্জুদার কালো রঙের ফোর হুইল ড্রাইভ মাহিন্দ্রা থর এস.ইউ.ভি-কে ধোয়ামোছা কাজ। মন্টু খুব এক্সপার্ট ছেলে, বনেট খুলে ইঞ্জিনের হালহকিকত দেখে নিচ্ছে। মন্টু জানাল, সেও সঙ্গে যাবে, দাদাবাবুর তাকে দরকার। আর তাদের গ্রামও ঘুরে আসা যাবে। আমরা জানি, পাঞ্জাব ও পুববাংলার অনেক রিফিউজিকে জায়গা দেওয়া হয়েছিল কুমায়ুনের তরাইতে।

জলদি ডিনার করে শুয়ে, ভোর ভোর বেরোলাম। গাড়িতে কভারে ঢাকা রঞ্জুদার লাইসেন্সড ডাবল ব্যারেল গান আর একটা বাক্স আছে। অ্যামুনিশন ছাড়া একটা হ্যান্ডগানও থাকবে। ফ্লাস্কে চা, টিফিন-বাক্সে স্যান্ডউইচ। গাজিয়াবাদ, হাপুর সাঁ সাঁ পেরিয়ে মুরাদাবাদ হয়ে বামে মোড় নিয়ে বাজপুর হয়ে সাড়ে চার ঘণ্টায় কালাধুঙ্গি। দেখি তিনদিকে জঙ্গল দিয়ে ঘেরা একর পাঁচেকের একটা ফার্ম। তাতে টিস্যু কালচার ল্যাবরেটরি, কোল্ড স্টোরেজ, পলি-হাউস ইত্যাদি রয়েছে। দামি ফুল আর ফলের গাছ বড়ো করে, চাষিদের সাপ্লাই দেওয়ার ব্যাপার। সঙ্গীতা-ম্যাডাম ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। এরই মধ্যে এসে গেলেন সুরেশ পন্ত আর ফার্মের প্রধান পার্টনার সঞ্জয় বিস্ত। দুজনেই হাসিখুশি। সঞ্জয় বিস্ত সমস্যার কথায় চোখ কপালে তুললেন, সমস্যা কোথায়! যা হচ্ছে তা তো খুবই ভালো, ঈশ্বর কি দেন! একটা ট্রাককে দেখালেন আঙুল তুলে। এই প্রথম চেরি, টোম্যাটো, প্যাশন ফ্রুট আর অর্কিড পাঠাচ্ছেন দিল্লি আর লখনৌতে। কী একধরনের ব্লু-বেরির অর্ডার থাকা সত্ত্বেও এতদিন পাঠাতে পারেননি হতচ্ছাড়া নীলগাইগুলোর দৌরাত্ম্যে। এবার পন্তনগর এয়ারপোর্ট থেকে কার্গো প্লেনে পাঠানো যাবে। ফার্মে অনেক খরচ করে উঁচু ফেন্সিং করে নীলগাই ঠেকালে কী হবে, কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিং-এর চাষিরা কী করবে? তবে বন্ধু সুরেশের চাকরির কথা ভেবে তদন্তও জরুরি, ব্যাপারটার কার্যকারণ জানাও জরুরি। নীলগাই ঘাতক যদি দু-দিন বাদে ওয়ার্কারদের উপর হানা দেয়, যারা পাশের গ্রামে থেকে জঙ্গুলে পথ দিয়ে আসে? ফসল বাঁচল বলে শুরুতে যে গ্রামবাসীরা আনন্দ করছিল, তাদের অনেকের মধ্যে এখন আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

সেটা বোঝা গেল প্রথম গ্রামটাতেই। ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। দূরে পাহাড়ের নীল নীল আভাস। ছোটো গ্রামের মাঝে একটা জটলা। একজন উত্তেজিত হয়ে কীসব বলছে, আর সবাই ভিড় করে শুনছে। সবাই সঞ্জয় বিস্তকে চেনে। তারা জানাল, এই লোকটি মাঝরাতে স্বপ্নে দেখতে পায়, বহুবছর আগে দুই পুরুষ নীলগাইয়ের শিংয়ের গুঁতোয় মৃত এক রাখাল বালকের প্রেতাত্মা ভয়ংকর মূর্তি ধরে নীলগাই ধরছে, মারছে আর ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। সেই প্রেতাত্মার ডাকে সে ভোররাতে উঠে জঙ্গলে যায় আর বেশ কিছুটা ভিতরে গিয়ে দেখতে পায় একটা সদ্যমৃত নীলগাই মরে পড়ে আছে, শরীরের অনেকটা খাওয়া। প্রেতাত্মা নাকি বলে, ঘটা করে তার শ্রাদ্ধশান্তি করাতে, দক্ষিণা সহ পণ্ডিত অর্থাৎ ব্রাহ্মণভোজন করাতে। না-হলে নীলগাই ছেড়ে সে গৃহপালিত ছাগল-ভেড়ার দিকে নজর দেবে! অন্যরা যে প্রভাবিত, তাদের চোখমুখ দেখে মনে হল।

সঞ্জয় বিস্ত তাকে জেরা করে জানলেন যে সে নিজে এক পণ্ডিত। সকালে সে প্রাতঃকৃত্য সারতে গেছিল জঙ্গলে। সরকার টয়লেট বানিয়ে দিলে কী হবে, জঙ্গলের খোলা জায়গায় শৌচের মতো আরাম নেই। আর যত মাজনই আসুক, নিম কা দাঁতন কা কোই জবাব নহি। সুরেশ এবার ভয় দেখালেন, আষাঢ়ে গল্প ছড়িয়ে মুফতে ব্রাহ্মণভোজনের ধান্দা করলে সোজা পুলিশ হাজতে ভরে দেবেন। সঙ্গের খাকি পরিহিত দুই ফরেস্ট গার্ডের দিকে একবার তাকিয়ে লোকটা মুহূর্তের মধ্যে কোথায় উধাও হল। রঞ্জুদা বাঘে ছুঁলে আঠারো আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা, প্রবাদটা তর্জমা করে বলায় সবাই একচোট হেসে নিলাম।

একটা খোলা জায়গায় নীলগাই একটা সত্যি মরে পড়ে আছে। তিন-চতুর্থাংশ খাওয়া। চোখ বিস্ফারিত, যেন খুব ভয় পেয়েছিল। চারপাশে বেশ কিছুটা জায়গা একেবারে সমতল, যেন নীলগাইটাকে মাটিতে অনেকটা জায়গা জুড়ে ঘষটানো হয়েছে। আর অনেক মানুষের পায়ের ছাপ। গ্রামবাসীদের নিশ্চয়ই। তবে বৃষ্টির দরুন সবই অস্পষ্ট। বেশ কিছুটা খোঁজার পর একজন ফরেস্ট গার্ড অনেকটা দূরে ক’টা পায়ের ছাপ আবিষ্কার করল, যেগুলো দেখামাত্র সুরেশ বলে দিলেন ওগুলো বেশ বড়ো তেন্দুয়া বা লেপার্ডের পায়ের ছাপ। রঞ্জুদা আর ওঁর আলোচনা থেকে বুঝলাম, চিতাবাঘটা দৌড়চ্ছিল। পাশেই নীলগাইয়ের খুরের ছাপ। সেও দৌড়চ্ছিল। মানে চিতাবাঘটা তাড়া করেছিল। রঞ্জুদা কপালে ভাঁজ নিয়ে অনেক খুঁজল এদিক ওদিক।

এদিকে রণো বেশ কয়েকবার চাপা স্বরে জিজ্ঞাসা করছে ফার্মে যাওয়া যাবে কি না। ওর একটু লুজ মোশনের ধাত আছে। ইশারায় ঝোপে ঢুকে যেতে বলে নিজেই হাসলাম। কমোড ছাড়া ওর চলে না। আমরা ফার্মে ফেরা মাত্র রণো টয়লেটে। লাঞ্চ করতে-করতেও রঞ্জুদা অন্যমনস্ক। সে কী ভাবছে জিজ্ঞাসা করায় বলল যে চিতাবাঘে শিকার ধরেছে ঠিকই, কিন্তু একবারে নীলগাইয়ের এতটা মাংস খেয়ে ফেলা—একটা নয়, তিন-চারটে পূর্ণবয়স্ক চিতাবাঘের জন্যও শক্ত। চিতাবাঘ সলিটারি অ্যানিম্যাল। একসঙ্গে এতগুলো থাকে না। অতগুলো পায়ের ছাপই-বা কই? রণো ওদিকে রাজমা-চাওল সাঁটিয়ে যাচ্ছে। এত টেস্টি রাজমা গুরুগ্রামে খাই না আমরা।

বিকেলের দিকে আরেকটা নীলগাইয়ের বডি দেখতে গেলাম আমরা। একইরকম, খোলা জায়গায় পড়ে আছে, অনেকটা খাওয়া। চিতাবাঘ তাড়া করেছিল, শিকার ধরার পর অনেকটা ঘষটে নিয়ে গেছে। এখানেও মানুষের পায়ের ছাপ অনেক। যারা দেখেছে প্রথম, তারাই খবর দিয়েছে। আন্দাজমতো এটাকেও গত রাতে মারা হয়েছে।

আমরা থাকছি ফার্মের গেস্ট রুমে। সঞ্জয় হলদোয়ানির ভালো হোটেলে নিয়ে যাচ্ছিলেন, রঞ্জুদা কাজের সুবিধার জন্য ফার্মে থাকতে চাইল। দিব্যি ব্যবস্থা। ল্যাবরেটরি আর কোল্ড স্টোরেজের ওপরে গোটা তিনেক ঘর, টয়লেট কমন। মশারোধী ক্রিম মেখে বাইরের ব্যালকনিতে বসে দেখলাম রঞ্জুদা একটা বড়ো কাগজে ম্যাপ বানাচ্ছে। উঁকি মেরে দেখলাম, জঙ্গলের ম্যাপে অনেকগুলো ‘কিল’ হবার স্পট নির্দেশিত। রঞ্জুদা স্কেল-পেন্সিল দিয়ে ডটগুলো জুড়ছে, মাপজোখ করছে।

পরদিন সকালে যে আলু-পরোটা খেলাম, অমন জীবনে খাইনি। সঙ্গীতা-ম্যাডাম জানালেন, পন্তনগর হোস্টেলের অন্যতম বিখ্যাত জিনিস এই পরোটা। রঞ্জুদা এলে এই দিয়েই ট্রিট দেওয়া হয়। রবিবার হলেও উনি এসেছেন স্রেফ ব্রেকফাস্টের তদবির করতে।

সুরেশ এলে আমরা চললাম রাস্তা ধরে ফের বাজপুরের দিকে। অল্প এসে ফের ডানে মোড় নিয়ে জঙ্গুলে রাস্তা দিয়ে। সুরেশের বোলেরোর পিছে আমরা। প্রথমে একটা ফার্ম হাউসে ঢোকা হল। একশো একরের ফার্মের মালিক সর্দারজীর কাছে নাকি সাংঘাতিক কুকুর আছে। টিবেটান ম্যাস্টিফ, খান চারেক। ভয়ালদর্শন হলেও তাদের নিবিষ্ট মনে দেখে রঞ্জুদা পিছন ফিরল।

গাড়ি এখন চালাচ্ছেন সুরেশ। মন্টু ওঁর গাড়িতে। রঞ্জুদা জানাল, কুকুরগুলো এত আদরে বাঁদর যে জঙ্গলের নীলগাইকে তাড়া করে ধরা ওদের কাজ নয়। বেশ কয়েকটা ফার্ম ঘোরা হল। বড়ো কুকুর প্রায় সর্বত্র। একটা ফার্মে একটা পোষা চিতাবাঘ আছে, তবে ছোটো। মাতৃহারা শিশুকে বড়ো করছেন সর্দারজী। বড়ো হলে চিড়িয়াখানায় দিয়ে দেবেন। আমরা এখানে কেন ঘুরছি জিজ্ঞাসা করায় জানালাম, নীলগাইয়ের ওপর আক্রমণ হয়েছে একটা কেন্দ্রীয় জায়গা থেকে চারদিকে। আমরা ওই কেন্দ্রেই ঘুরছি।

রণোর মুখ দেখে রঞ্জুদা খিদে পেয়েছে কি না জিজ্ঞাসা করায় শশব্যস্ত সুরেশ জানালেন, লাঞ্চের ব্যবস্থা কাছেই একটা রিসার্চ স্টেশনে। পৌঁছে দেখলাম জঙ্গলের মাঝে ফেন্সিং-এ ঘেরা একটা বড়ো জায়গা। বেশ কিছু কামরা, ওয়ার্কশপ, শেড। বাইরে একটা বোর্ড জানাচ্ছে আন্তর্দেশীয় ও সরকারি মান্যতা-পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে জুওলজিক্যাল রিসার্চ চলছে। লাঞ্চ করতে করতেই জানা গেল, পন্তনগরে রঞ্জুদাদের কয়েক ব্যাচ সিনিয়র এক ভেটেরিনারিয়ান রাওত দম্পতি এটা চালাচ্ছেন। কাজ জঙ্গলের অসুস্থ প্রাণীদের বাঁচিয়ে তোলা আর তাদের ওপর মানবসৃষ্ট দূষণের প্রভাব দেখা। ল্যাবরেটরিগুলো দেখার পর আমরা দেখলাম চিড়িয়াখানার আদলে বেশ কয়েকটা এনক্লোজার আছে। দুয়েকটা খালি, বাকিগুলোয় এক বা একাধিক অসুস্থ প্রাণী। একটা খোঁড়া চিতাবাঘ দেখলাম। কাঁটাতারের বেড়ায় বা চোরা শিকারির ফাঁদে পড়ে তার একটা থাবা নেই। একটা বুড়ি বাঘিনী আছে, নড়তে পারে না। একটা আক্রান্ত, আহত নীলগাইকেও দেখলাম। আমাদের দেখেই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে ছাউনির তলায় আশ্রয় নিল। মাঝে প্লাস্টিকের বড়ো খাঁচায় স্তূপাকৃতি প্লাস্টিক। মৃত তৃণভোজীদের পাকস্থলী থেকে বেরোনো। সভ্য মানুষের দান। ফার্মে দুটো মোটা জাল দিয়ে ঘেরা গাড়ি আছে, পশুদের পরিবহণের জন্য। ট্র্যাক্টর ইত্যাদিও আছে। শেষপ্রান্তে গিয়ে রঞ্জুদা দূরে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইল। একটা সরু রাস্তা চলে গেছে সেদিকে। জানলাম, এদিক দিয়ে সহজে নৈনিতাল যাওয়া যায়।

রাতে নির্মেঘ আকাশে দূরে আলো ঝলমল নৈনিতাল দেখতে দেখতে ঘুমোলাম। রঞ্জুদা ফোনে কথা বলছে ফরেস্ট গার্ডদের সঙ্গে, নীলগাইদের ট্র্যাকিং হচ্ছে। ওর ল্যাপটপে নীলগাইদের দলের অনেক ছবি দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্য, পরের দু-দিন ধরে নীলগাই মারা যাবার খবর নেই! আমরা অফিসের কাজ করলাম, রঞ্জুদা কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াল। তৃতীয় দিন রঞ্জুদা জানাল, আমরা ফিরে যাব। তৈরি হচ্ছি, ভেটেরিনারিয়ান ড. রাওত এলেন। রঞ্জুদা ওঁকে জানাল, ছিটকে আসা চিতাবাঘ নীলগাই মারছে, ভালোই। কাজের জন্য আমরা ফিরে যাচ্ছি। উনি আবার এলে ওঁদের রিসার্চ দেখতে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে সঙ্গীতা-ম্যাডামের কাছ থেকে কিছু চারাগাছ নিয়ে চলে গেলেন।

ফিরছি, মনে দ্বিধা নিয়ে। কিছুই হল না। গাড়ি দেখি মুরাদাবাদের বদলে ডানে মুড়ে রামনগরের রাস্তা ধরল। করবেটের বাইরে একটা রিসর্টে ঢুকলাম। রঞ্জুদাকে চিন্তিত দেখে আমরা চুপ। ওয়াই-ফাই পেতেই অফিস-ওয়ার্ক। সন্ধ্যাবেলায় নদীর ধারে একটু চক্কর দিয়ে এসে দুজনেই একটু ঘুমিয়ে পড়েছি, মন্টু এসে আমাদের তুলল। জলদি ডিনার সেরে বেরোতে হবে, যদি যেতে চাই। প্রশ্ন নয়। ডিনার করে, জঙ্গলে রাত কাটাবার সাজসরঞ্জাম নিয়ে গাড়িতে। গাড়ির ছাদে একটা রিট্র্যাক্টেবল উইন্ডো আছে। তার সামনে একটা সার্চ-লাইট ফিট করা দেখলাম। বন্দুক কভারের বাইরে, রিভলভার রঞ্জুদার হোলস্টারে। রঞ্জুদার গলায় একটা ইনফ্রা-রেড বাইনোকুলার ঝুলছে, হাতে একটা ওয়াকি-টকিও। এয়ারগানে ছররা ভরছি দেখে রণো মুখ টিপে হাসল। কিন্তু ওটাই কাজে লাগল।

কালাধুঙ্গির কিছুটা আগেই বাঁদিকের সেই জঙ্গুলে পথ ধরে বেশ কিছুটা যাওয়া। সর্দারজীদের ফার্ম পেরিয়ে যে রাস্তা ধরলাম, সেটা ড. রাওতদের রিসার্চ স্টেশনের পিছনের নৈনিতাল যাবার রাস্তা। কিছুটা এসে ডানে একটা খোলা মাঠের পাশে কয়েকটা গাছের জটলার মধ্যে একটা লাল আলো দেখা গেল। একটা কালো রঙের জিপসি গাড়ি দাঁড়িয়ে। পাশে আমরা থামার পর জানালার কাচ নামিয়ে সুরেশ হ্যালো করলেন। ফ্লাস্ক থেকে কালো কফি খাচ্ছি। মশারোধী মলমের দরুণ মশা কামড়াচ্ছে না। অনেক অপেক্ষার পর চোখ একটু লেগে এসেছিল। হঠাৎ রঞ্জুদার হাতের ওয়াকি-টকি বেজে উঠল। একজন ফরেস্ট গার্ড জানাল নীলগাইয়ের টার্গেট ঝুন্ড আসছে ডানে, আধা কিমি দূরে। সচকিত হয়ে তাকালাম। রঞ্জুদার চোখে নাইট-ভিশন বাইনোকুলার। ডানের মাঠে খানিক পরেই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে ঢুকে এল একদল নীলগাই। কেউ তাড়া করেছে? মাঠের মাঝামাঝি এসেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক ওদিক পালাতে লাগল। আর ভয়ানক গর্জন করে কিছু একটা তাদের ওপর লাফিয়ে পড়ল। খানিক পর আবছা চাঁদের আলোয় দেখা গেল, দুটো নীলগাই মরে পড়ে আছে। একটাকে খেতে ব্যস্ত দুটো প্রকাণ্ড আর একটা ছোটো জানোয়ার। রঞ্জুদার বাইনোকুলার নিয়ে তিনজনই দেখলাম। কেউই এমন আকারের এমন অদ্ভুত বাঘ জীবনে দেখেনি! সঙ্গে একটা, না, দুটো চিতাবাঘও আছে! এমন অদ্ভুত দল অভাবনীয়।

মাঠের অপর পারে কোন একটা গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। খানিক বাদে একটা পিক-আপ ভ্যান এসে থামল জানোয়ারগুলোর পাশে। একটা ফর্ক-লিফটও। আস্ত নীলগাইটাকে ফর্ক-লিফটটা ভ্যানের পিছনে তুলে দিয়ে চলে গেল। এবার দেখা দিল একটা ট্র্যাক্টর। পিছনের লেভেলার দিয়ে মাটি সমান করতে করতে এসে অকুস্থলের চারপাশে ঘুরে চলে গেল। জানোয়ারগুলো খেয়ে চলেছে। পাশে সুরেশের গাড়ির ছাদ থেকে ভিডিও রেকর্ডিং হচ্ছে মনে হল। রঞ্জুদাও ছাদের উইন্ডো সরিয়ে ছাদ থেকে ছবি তুলছে। এই সময় মাঠের শেষপ্রান্তে একটা গাড়ির আলো জ্বলে উঠেই নিভে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা টানা হুইসিল বেজে উঠল আর জানোয়ারগুলো দৌড়তে শুরু করল বাঁদিকে। রঞ্জুদা সার্চ-লাইট ফেলল তাদের ওপর। বাঘের চেয়ে বড়ো এমন জানোয়ার দেখিনি! সেগুলো থামল না। কিন্তু একটা চিতাবাঘ আমাদের দিকে হিংস্রভাবে তাড়া করে এল। রঞ্জুদা বন্দুকটা ধরেও ছেড়ে দিল। রিভলভার হাতে উঠেছে। পাশে সুরেশের গাড়ির কাচ নেমে বন্দুকের নল বেরিয়েছে। মারবে? আমি কাচ অল্প নামিয়ে এয়ারগান শুট করে দিলাম। চিতাবাঘটা মুখ ঘুরিয়ে উধাও হয়ে গেল। মাঠের অন্যদিক থেকে দুটো গাড়ি এল। গার্ডদের গাড়ি। এক ড্রাইভার ভুলে হেড লাইট জ্বেলে ফেলেছিল। সুরেশ খাপ্পা। কিন্তু রঞ্জুদা বলল, যা হয়েছে ঠিক আছে।

রাওত রিসার্চ স্টেশনে পৌঁছলাম ভোরের কিছু পরে। জানোয়ারগুলো চিনতে পেরেছি কি না জিজ্ঞাসা করায় দ্বিধা নিয়ে বলে ফেললাম, লাইগার। বাঘিনীর গর্ভে সিংহের সন্তান। রঞ্জুদা সাবাস জানাল। রাওত দম্পতি ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে আমাদের অপেক্ষায় বসে। রঞ্জুদা কী করে বুঝল জিজ্ঞাসা করায় রঞ্জুদা বলল, এতগুলো চিতাবাঘ একসঙ্গে শিকার করছে বা এত মাংস খাচ্ছে এত দ্রুত, এটা অভাবনীয়। কেনিয়ায় লাইগার দেখে আসা রঞ্জুদার প্রথম সন্দেহ এতেই। দুই, কোথাও সেভাবে পাগ মার্ক নেই, আক্রমণ করে আসা চিতাবাঘের ছাড়া। এমনভাবে মাটি সমান, যেন যন্ত্র করেছে। তিন, বিভিন্ন নীলগাইয়ের দলের ছবিতে এক-দুটো প্রাণীর কানে ট্যাগ দেখা গেছে, যেন কেউ তাদের ট্র্যাক করছে। চার, নীলগাই দিনের বেলায় চরে, অথচ সমস্ত আক্রমণ হয়েছে রাতে, যেন আততায়ী দিনের বেলায় দেখা দিতে চায় না। রাওতদের ওপর সন্দেহ, তাঁরা প্রাণীদের নিয়ে কাজ করেন, যন্ত্রপাতি, গাড়ি সব আছে, তাঁদের রিসার্চ স্টেশন আক্রমণস্থলের কেন্দ্রে। রঞ্জুদা সদলবল স্টেশনে তদন্ত করতে আসার পর দু-দিন কোনও আক্রমণ হল না, এতেই সন্দেহ পাকা। সেজন্য দিল্লি ফিরে যাচ্ছি বলে ফাঁদ পাতা। নীলগাইয়ের একটা দলকে গার্ডরাই ঠেলে দূর থেকে পাঠিয়ে দেয় নির্দিষ্ট দিকে, যাতে আক্রমণকারীরা সেদিকে আকৃষ্ট হয়। স্টেশনের সব মাংসাশী প্রাণীর খোরাক সম্ভবত জোগায় নীলগাই। তাতে টান পড়ার কথা, ফাঁদে পা দিতেই হত!

ড. রাওত হাততালি দিলেন। জানালেন, এটাই তাঁদের প্রোজেক্টের আসল কাজ। ধর্মভীরু গ্রামীণরা নীলগাই মারবে না। এমন প্রিডেটর চাই, যারা শুধু নীলগাই মারবে। আর দ্রুত খেয়ে নীলগাইয়ের সংখ্যা কমাবে। সেজন্য বাঘিনীর গর্ভে এশিয় সিংহের ঔরসে দুটি লাইগারের সৃষ্টি। মুশকিল, লাইগারগুলি ওজনে প্রায় পাঁচশো কেজি, শ্লথ, দৌড়ে নীলগাই ধরতে পারবে না। তাই দুই চিতাবাঘকে তাদের সঙ্গে ট্রেনিং দেওয়া। চিতাবাঘ তাড়া করে নীলগাইকে নিয়ে আসবে, লাইগার মারবে। প্রাণীগুলো লুকোনো থাকত ফাঁকা এনক্লোজারের তলায়, ভূ-গর্ভস্থ চেম্বারে।

প্রাণীগুলোকে দেখা যাবে? ড. রাওত জানালেন, আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ওদের অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হবে। জানাজানি হয়ে যাবার পর ওদের নিরাপত্তার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্যত্র। আমাদের সবার নিমন্ত্রণ রইল সেখানে।

সুরেশ রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলেন, ছিটকে আসা চিতাবাঘের আক্রমণে নীলগাই মারা গেছে গোটা দশেক।

ছবি- জয়ন্ত বিশ্বাস

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s