পিয়ালি গাঙ্গুলীর আগের লেখা– ফোচনের কীর্তি , ফোচনের আরেক কীর্তি মিঠে প্রতিশোধ , বেলুন দাদু , দুটি অণুগল্প , নতুন বছর , বাঘমামার বিয়ে, মাম্বোর শুঁড় , জঙ্গলের নতুন নিয়ম , টুংটাং
হনুমানের বংশধর বলে বাঁদররা বরাবরই একটু কলার উঁচু করে চলে। ব্যাপারটা বেবুনদের মোটেও ভালো ঠেকে না। এই নিয়ে খুটোখুটি চলতেই থাকে। মাঝে মাঝে হাতাহাতিও লেগে যায়। বড়োরা বসে তখন মিটমাট করে দেন। সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য একসঙ্গে খেলাধুলো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এসব আয়োজন করেন বড়োরা। কে কীরকম লাফাতে পারে, কে কীরকম দাঁত খিঁচোতে পারে, কার কামড়ে কত জোর, কার লেজ কত লম্বা, কত বাহারি এইসব প্রদর্শন করা হয় অনুষ্ঠানে। আর বছরে একটা হনুশ্রী প্রতিযোগিতা হয়। সারাবছরের কর্মকাণ্ডের ওপর বিচার-বিবেচনা করে বিচারকমণ্ডলী বিজেতার নাম ঘোষণা করে। নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য এই বিচারকমণ্ডলীতে কোনও বাঁদর বা বেবুন থাকে না, এটা শিম্পাঞ্জিদের দায়িত্ব।
প্রতিবারের মতো এ-বছরও বাঁদর আর বেবুনদের একটা মধ্যে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ চলছে। কারা কত তাড়াতাড়ি কত ফল ছুড়ে ফেলতে পারে। বলাই বাহুল্য, ফ্রেন্ডলি ম্যাচ কোনও বছরই আর ফ্রেন্ডলি থাকে না। দুটো টিমই নিজেদের মধ্যে খেলোয়াড় ভাগাভাগি করে নিয়েছে। এক দল তাড়াতাড়ি গাছ থেকে ফল পাড়বে, অন্য দল সেগুলো ছুড়বে। এই ছোড়াছুড়িতে একটা নারকেল এসে লাগল যুবরাজ লেজুকুমারের লেজুতে। ‘আহ্’ বলে চিৎকার করে লেজে হাত দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল লেজুকুমার। মুহূর্তের মধ্যে লেজুকুমারের পেছনটা বেবুনদের মতো লাল হয়ে গেল।
ম্যাচটা বেবুনরা জিতে গেছে শুনে লেজুকুমারের শুধু লেজু নয়, চোখমুখও লাল হয়ে গেল রাগে আর লজ্জায়। এদিকে লেজুতেও বেশ টনটন করে ব্যথা করছে। ওদের হনুনগরীর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সরবত নদী। নদীর জল সরবতের মতো মিষ্টি। শুধু তাই নয়, নদীর জলের অনেক ঔষধি গুণও আছে। সরবতের জলে লেজ ডুবিয়ে বসে আছে লেজুকুমার। পাশেই দুই সাগরেদ বিটকেল আর পাটকেল বসে যুবরাজের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কলাপাতা দিয়ে মাথায় হাওয়া করছে আর বেবুনদের শ্রাদ্ধ করছে। এমন সময় হঠাৎ ‘বাবা রে, মরে গেলাম রে’ বলে লেজুকুমার তড়াং করে লাফিয়ে উঠল। সরবত নদীতে অনেক কুমির বাস করে। তাদেরই মধ্যে এক ব্যাটা চুপিচুপি এসে লেজুকুমারের লেজুতে দিয়েছে কামড়ে। সেই যে একবার এক বাঁদর কুমিরকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছিল, কুমিরের গিন্নির আর বাঁদরের হৃৎপিণ্ড খাওয়া হয়নি, সেই থেকে কুমিরদের বাঁদরদের ওপর রাগ। সুযোগ পেলেই আক্রমণ করে। কটাস কটাস বলে যে কুমিরটা কামড়ে দিয়েছিল, উৎসাহ পেয়ে সে আবার এসেছে কামড়াতে। সঙ্গে এবার আরও দলবলও আছে। কটকট, মটমট, কটাং কটাং, ঘটাং ঘটাং, আরও যতসব চ্যাংড়া কুমিরের দল এসে জুটেছে।
বিটকেল-পাটকেলও ততক্ষণে নিজেদের দলবল জুটিয়ে ফেলেছে। ‘মার মার, মার ব্যাটাদের মার। ভেঙে দে ব্যাটাদের দাঁতগুলো।’ পটাপট বড়ো বড়ো পাথর আর নারকেল মিসাইলের মতো ধেয়ে গেল কুমিরদের দিকে। বেশ কয়েকটার দাঁত সত্যি সত্যিই ভেঙে গেল। দাঁত ভাঙতেই সেগুলো ঝুপঝাপ করে ডুব দিল জলের তলায়।
এদিকে যুবরাজ লেজুকুমারের অবস্থা ততক্ষণে বেশ খারাপ। কুমিরের কামড়ে লেজু কেটে ঝুলছে, তাতে আবার ইনফেকশন হয়ে ফুলে গেছে। ইনফেকশন থেকে জ্বরও এসে গেছে। বিটকেল, পাটকেল, লেজবাহার, লেজময় সবাই মিলে ধরাধরি করে লেজুকুমারকে বাড়ি নিয়ে গেছে। মহারাজ লেজনারায়ণ আর মহারানি লেজবতী চিন্তায় অস্থির। রাজবৈদ্য ঔষধেশ্বরকে খবর দেওয়া হয়েছে। তিনি এলেন বলে। তিনি এসে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করে গম্ভীর মুখে বললেন, “সাংঘাতিক ইনফেকশন হয়ে গেছে। এর অব্যর্থ ওষুধ জোগাড় করা খুব কঠিন। সরবত নদীর ও-পাড়ে কিরিমিরি বনে ধুত্তেরি গাছের ফল এর একমাত্র ওষুধ। কিন্তু ওই গভীর জঙ্গলের অত অত গাছের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ধুত্তেরি গাছ খুঁজে পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য। তাছাড়া সরবত নদী পার হবেই-বা কী করে?”
নির্ভরযোগ্য কয়েকজন সেপাইকে নিয়ে সেনাপতি লেজবাহাদুর সঙ্গে সঙ্গে বসে গেলেন কৌশল ঠিক করতে। হনুমানের মতো লাফ দিয়ে নদী পেরোনোর ক্ষমতা তো এ-যুগে কারও নেই। অতএব নদীতে নামতেই হবে, আর নদীতে নামলেই কুমিরবাহিনী নিশ্চিত আক্রমণ করবে। লেজবাহাদুরের কথামতো বাঁদরসেনা বড়ো বড়ো কলাগাছ উপড়ে ফেলতে লাগল। আরেক দল সঙ্গে সঙ্গে কলাগাছের কাণ্ডগুলো একসঙ্গে বেঁধে ভেলা তৈরি করতে জুটে গেল। ভেদাভেদ ভুলে বেবুনরাও এই কাজে হাত লাগিয়েছে। শিম্পাঞ্জিরা আছে। যতই যাই হোক, সবাই তো ওরা বাঁদর সম্প্রদায়ের, নিকট আত্মীয় বলে কথা। ঠিক হল, ভেলায় একজন দাঁড় বাইবে আর তাকে ঘিরে থাকবে অন্যান্যরা। তাদের হাতে থাকবে বড়ো বড়ো পাথর, নারকেল, আর গাছের শক্তপোক্ত ডাল।
এরপর শুধু প্রতীক্ষার পালা। কাল সকালের আগে কিচ্ছু হবে না। সন্ধে বা রাতের অন্ধকারে নদীতে নামা ঠিক হবে না। তাছাড়া অন্ধকারে জঙ্গলে গাছও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পরদিন বেলা হতে কুমিরগুলো যখন রোদ পোহাতে ডাঙায় উঠেছে সেই সুযোগে বাঁদর আর বেবুনের দল কলাগাছের ভেলায় চড়ে পাড়ি দিল কিরিমিরি বনের উদ্দেশ্যে। একজন প্রাণপণ জোরে দাঁড় বাইছে আর তাকে ঘিরে অ্যাকশন স্কোয়াড অস্ত্র হাতে তৈরি হয়ে বসে আছে। ওদের মারমুখী হাবভাব দেখে খুব বেশি কুমির কাছে ঘেঁষতে সাহস করেনি। ওদের দাঁতের জোর যতই বেশি হোক, বুদ্ধিতে যে ওরা বাঁদরদের সঙ্গে পারবে না সে-কথা ওরাও জানে। তাও দু-চারটে মস্তান গোছের কুমির হাঁ করে এগিয়ে এসেছিল। আসতেই বেচারারা কী মারটাই না খেল! একটা অবশ্য ল্যাজের ঝাপটায় ভেলাটা উলটে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সেটা হলেই কেলেঙ্কারি হত। হনুমান ঠাকুরদাদার আশীর্বাদে খুব জোর রক্ষা পেয়েছে ওরা।
কিরিমিরি বনে পৌঁছে ওরা অনেকগুলো ছোটো ছোটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। ঠিক হল, যারা আগে ধুত্তেরি গাছের সন্ধান পাবে তারা আওয়াজ করে অন্যদের ডেকে নেবে। ধুত্তেরি গাছ খুঁজতে খুঁজতে কতবার যে ওরা বিরক্ত হয়ে ‘ধুত্তেরি’ বলে উঠেছে, তার হিসেব নেই। বনের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় অবশেষে সেই আশ্চর্য গাছের সন্ধান পাওয়া গেল। রাজবৈদ্য ওদের ভালো করে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলেন কী করে ধুত্তেরি গাছ চিনবে। ধুত্তেরি নাম হলেও গাছটা কিন্তু বেশ দেখতে। ডালে ডালে সোনালি ফল ঝলমল করছে। আর কী মিষ্টি গন্ধ! বাঁদর-বেবুনের দল পটাপট অনেকগুলো ফল ছিঁড়ে নিয়ে ফেরার পথ ধরল।
যাওয়াটা যত সহজ ছিল ফেরাটা কিন্তু অত সহজ হল না। ততক্ষণে বিকেল হয়ে এসেছে। পুরো কুমির পরিবার তখন জলে। ওরাও অপেক্ষা করে বসে ছিল। জানতই বাঁদরদের নদীপথেই ফিরতে হবে। ওরা যখন মাঝনদীতে তখন অতর্কিতে হামলা করল কুমিরবাহিনী। গতকালের আর আজ সকালের হারের বদলা এ-বেলা নিয়েই ছাড়বে। কী ভয়ানক যুদ্ধটাই না হল! কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়বে না। কত কুমিরের মাথা ফাটল, কত বাঁদরের গা-হাত-পা-লেজ খাবলে খুবলে ক্ষতবিক্ষত হল, সে আর বলে কাজ নেই। কী ভাগ্যিস ওরা বেশি করে ফল তুলে এনেছিল।
ফল হাতে পেয়েই রাজবৈদ্য কাজ শুরু করে দিলেন। জ্বরের ঘোরে লেজুকুমার ততক্ষণে প্রায় অচৈতন্য। কিন্তু কী আশ্চর্য আর অব্যর্থ ওষুধ! দু-ফোঁটা মুখে যেতেই রাজকুমার চোখ মেলে উঠে বসল। যুবরাজের পরে তারপর আহত বাঁদরসেনাদের একে একে শুশ্রূষা করা হল। তারাও নিমেষে সেরে উঠল। রাজা লেজনারায়ণ খুশি হয়ে রাজবৈদ্যকে জঙ্গলের সবচেয়ে ভালো দু-কাঁদি কলা উপহার দিলেন। তার সঙ্গে ঘোষণা করলেন, আগামীকাল জঙ্গলে মহাভোজ হবে। শুধু বাঁদর সম্প্রদায় নয়, জঙ্গলের সমস্ত পশুপাখির সেখানে নেমন্তন্ন।
সুস্থ হয়ে উঠে লেজুকুমার বিটকেল-পাটকেলকে নিয়ে হাজির হল বেবুনদের ডেরায়।
“ক্ষমা করে দে ভাই, আর কোনোদিন তোদের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি, মারপিট করব না। আজ বিপদের দিনে তোরা যেভাবে আমার প্রাণ বাঁচালি, তা আমি কোনোদিনও ভুলব না।”
বেবুনরাও একে একে এসে গলা জড়াজড়ি করল। বলল, “আজ থেকে আমরা ফ্রেন্ডস ফর এভার।”
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে