পিয়ালি গাঙ্গুলীর আগের লেখা– ফোচনের কীর্তি , ফোচনের আরেক কীর্তি মিঠে প্রতিশোধ , বেলুন দাদু , দুটি অণুগল্প , নতুন বছর , বাঘমামার বিয়ে, মাম্বোর শুঁড় , জঙ্গলের নতুন নিয়ম , টুংটাং, লেজ নিয়ে
টিনটিন আগেই সবাইকে জুম মিটিংয়ের লিংক পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেইমতো ঋজু, জয়ী, শুবান, বৃষ্টি সবাই রাত ন’টায় মিটিং জয়েন করেছে। আজ এক সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে টিনটিনদের পাড়ায়। টিনটিনদের বাড়ির সামনেই একটা গ্যারেজ। সেখানে কিছুদিন আগে চারটে কুকুরছানা জন্মেছিল। দেখতে দেখতে চোখের সামনে বাচ্চাগুলো একটু একটু করে বড়ো হচ্ছিল। টিনটিনদের ডাইনিং টেবিল থেকে সোজাসুজি দেখা যায় গ্যারেজটা। গ্যারেজের লোহার গেটের তলার ফাঁকা জায়গা দিয়ে মাঝে-মাঝেই ওদের দেখা যেত। মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরছে, কখনও কৌতূহলী হয়ে গেটের তলা দিয়ে মুখ বাড়াচ্ছে। ওদের দেখতে পেলেই টিনটিন আর ওর মা ‘কী সুইট, কী সুইট’ বলতে বলতে হাঁ করে ওদের দেখত। ওদের দেখা গেলে টিনটিনের দাদু-ঠাকুমাও ওকে ডেকে ডেকে দেখাতেন।
আজ সকালে, বেলার দিকে কুকুরছানাদের মা বোধহয় খাবারের খোঁজে বেরিয়েছিল। সেই সুযোগে কৌতূহলী ছানাগুলো গেটের তলার ফাঁক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। রাস্তা দিয়ে এক মহিলা হেঁটে আসছিলেন। গ্যারেজের গেটের কাছে এসে নীচু হয়ে কুকুরছানাগুলোকে আদর করতে করতে হঠাৎ একটাকে চাদরের তলায় ঢুকিয়ে নিয়ে সোজা হাঁটা লাগালেন।
কী ভাগ্যিস মায়ের ফোনে টিনটিন অনেকগুলো ছবি তুলেছিল ওদের। শেয়ার স্ক্রিন করে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুদের দেখিয়ে দিল কোন ছানাটা চুরি গেছে। সাদা আর বাদামি ছোপ ছোপ, লেজটা সাদা। এবার শুরু হল ব্রেন স্টর্মিং।
ঋজু বলল, “মহিলা হেঁটে হেঁটে আসছিল যখন, মনে হয় কাছাকাছিই থাকে। কুকুরছানাকে চাদরে লুকিয়ে নিশ্চয়ই অটো বা বসে চড়ে কোথাও যায়নি। অতএব আমাদের আশেপাশের এলাকাতেই নজরদারি করতে হবে।”
এমনিতেই ওরা ছোটো, একা বাড়ি থেকে বেরোতে পারে না আর এখন এই করোনার পরিস্থিতে তো ওদের বাড়ি থেকে বেরোনো একদমই বন্ধ। তাহলে খোঁজখবর কী করে নেয়া যায়?
টিনটিন বলল, “খবরের কাগজওয়ালারা তো কাগজ দিতে বাড়ি বাড়ি যায়।”
“হ্যাঁ, ঠিক।” জয়ী বলল। “তাছাড়া কাজের মাসি, রান্নার মাসি ওরাও তো অনেকের বাড়িতে যায়। ওদেরকে দলে নিতে হবে।”
বৃষ্টি ওদের মধ্যে সবচেয়ে শান্তশিষ্ট লক্ষ্মী মেয়ে। কুকুরছানার কথা ভেবে হাপুস নয়নে কেঁদে ফেলল বেচারি। ফুলো ফুলো গালগুলো লাল হয়ে গেল। কান্নার চোটে ঝুঁটি দুটোও নড়তে লাগল।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। পরদিনই যে-যার খবরের কাগজ বিলি করা দাদা বা কাকুকে, কাজের আর রান্নার মাসিদের পুরো ব্যাপারটা খুলে বলে ওদের সহযোগিতা চাইল। ছোট্ট একটা কুকুরছানার অসহায় কাহিনি সবারই মনে ছাপ ফেলে গেল। আর তার সঙ্গে সঙ্গে এই ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েগুলোর উদ্যোগ। ওরা সবাইই বলল ওরা চোখ-কান খোলা রাখবে আর কিছু সন্দেহজনক মনে হলেই ওদের জানাবে।
শুবান ভালো ছবি আঁকে। ও চটপট বেশ কতগুলো সুন্দর পোস্টার তৈরি করে ফেলল। শুবানের মা দুর্দান্ত আঁকেন; তিনিও ছেলে আর ছেলের বন্ধুদের এই প্রচেষ্টায় হাত লাগালেন। ঋজুর মা ভালো লেখেন, উনি সুন্দর একটি অ্যাপিল লিখে দিলেন। কুকুরছানার ছবিসমেত এই পোস্টারগুলো মায়েরা তাদের নিজের নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে পোস্ট করলেন। রাতারাতি অনেক শেয়ার হয়ে গেল পোস্টগুলো। এবার অপেক্ষা কোথাও থেকে কোনও খবর আসে কি না।
চুরির ঘটনাটা নিজের চোখে পুরোপুরি দেখেছিলেন টিনটিনের জেম্মা। তাঁর কাছ থেকে মহিলার নিখুঁত বিবরণ জেনে নিয়েছে ওরা। সেইমতো বর্ণনা দিয়ে দিয়েছে যাদের যাদের দেয়ার। দ্রুত গতিতে কেটে গেল ক’টা দিন। দেখতে দেখতে ২০২০ শেষ হয়ে নতুন বছর এসে গেল। কিন্তু কুকুরছানার কোনও হদিস পাওয়া গেল না। গ্যারেজের দিকে তাকালেই টিনটিনের মন খারাপ হয়ে যায়। ওদিকে ছানাটা একা একা কোথায় আছে কে জানে, নিশ্চয়ই মায়ের জন্য কাঁদছে। আর এদিকে মা আর ওর ভাইদেরও নিশ্চয় মন খারাপ। বাকি কুকুরছানাগুলো আজকাল আর বেরোয় না। কখনও একটা এগিয়ে এলে, বাকিগুলো সেটাকে টেনে নিয়ে চলে যায়। ওদের মাও আজকাল ওদের বেশি পাহারা দেয়। এসব টিনটিন বসে বসে লক্ষ করেছে। মানুষের সঙ্গে কোনোই তফাত নেই ওদের অনুভূতির।
একদিন বেলার দিকে জয়ী ফোন করল টিনটিনের মায়ের ফোনে— “মাসি, শিগগির টিনটিনকে দাও তো!”
“কেন রে, তোদের ইনভেস্টিগেশন কিছু এগোল?” টিনটিনের মা জিজ্ঞেস করলেন।”
“হ্যাঁ, সে-বিষয়েই জরুরি কথা আছে।”
জয়ীদের বাড়িতে দুধ দেয় যে কাকু, তিনি খবর দিয়েছেন, ওই চার্চের পেছন দিকে একটা ভাঙাচোরা একতলা বাড়ি আছে। সেখানে এক খিটখিটে মহিলা থাকেন। একা। তিনি ক’দিন ধরে এক প্যাকেট করে এক্সট্রা দুধ নিচ্ছেন। এমনিতেই তো হাড়কিপটে, দুধের দাম মেটান না ঠিকমতো, তিনি আবার এক্সট্রা দুধ নিচ্ছেন। তাছাড়া তাঁর বাড়িতে দুধ দিতে গিয়ে ক’দিন ধরে একটা কুঁই কুঁই কান্নার আওয়াজও পেয়েছেন উনি।
“জয়ী, তুই ওঁকে মহিলার ডেসক্রিপশন দিয়েছিস তো ভালো করে?” ঋজু আর টিনটিন প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল কনফারেন্স কলে।
“হ্যাঁ রে বাবা, দিয়েছি। উনি বলেছেন আরও পাকা খবর এনে দেবেন।”
পাকা খবর পেতে বেশি দেরি হল না। মহিলার বর্ণনা একদম নিখুঁতভাবে মিলে গেছে। আর কুকুরছানারও। সে-বেচারি খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, সারাক্ষণ শুধু কাঁদে। বারান্দায় একটা চটের ওপর শুয়ে নিশ্চয়ই ওর ঠান্ডাও লাগে। এবার ওকে তাড়াতাড়ি উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু স্ট্র্যাটেজি কী হবে? আরেকটা জুম মিটিং হয়ে গেল এই নিয়ে। কুকুরের বাচ্চা চুরির কমপ্লেন নিয়ে পুলিশের কাছে গিয়ে কোনও লাভ নেই, ওরা পাত্তা দেবে না। চোর, ডাকাত, গুণ্ডা, বদমায়েশ ধরতেই ওরা নাজেহাল।
ঋজু বলল, “চোরের ওপর বাটপারি।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, এটাই ঠিক।” জয়ী, শুবান, টিনটিন এমনকি বৃষ্টিও এতে সায় দিল। “যে যেরকম, তার সঙ্গে সেরকমই করতে হয়।”
ওদের পরামর্শমতো দুধওয়ালা কার্তিকদা ও-পাড়ার খবরের কাগজ বিলি করা ছেলে বাবলুর সঙ্গে মিলে একটা প্ল্যান করে ফেলল। দুধের দাম মেটানো নিয়ে কার্তিকদা একদিন জোর বচসা শুরু করে দিল মহিলার সঙ্গে।—“আজকে আমি টাকা নিয়েই যাব। নতুন বছরে আমি আর ধারে দুধ দিতে পারব না। আমার টাকা আপনাকে আজকেই মিটিয়ে দিতে হবে, নইলে আমি পাড়ার লোক জড়ো করব। আপনি তো জানেনই আপনাকে এমনিতেই কেউ পছন্দ করে না।”
অনেক তর্কাতর্কির পর বেগতিক দেখে মহিলা যখন ঘরের ভেতরে ঢোকেন টাকা আনতে, অমনি সেই সুযোগে কার্তিকদা ঝপাং করে কুকুরছানাকে নিয়ে পাচার করে দেন বাবলুকে। বাবলু তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে কুকুরছানাকে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেয় জয়ীদের বাড়িতে।
জয়ীর দাদু আর মা ডাক্তার। ওদের বাড়িতে অনেক ওষুধপত্র থাকেই। মা তো সকালে হসপিটালে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু দাদু-দিদার সাহায্যে জয়ী বেশ ভালোমতোই যত্ন নিল ছানাটার। ভিডিও কলে তখন টিনটিন, ঋজু, শুবান, বৃষ্টি সকলের কী আনন্দ!
“ওর একটা নাম দিতে হবে।” শুবান বলল।
সঙ্গে সঙ্গে টিনটিন বলল, “বিস্কিট।”
“আরে, আমিও তাই ভাবছিলাম!” বৃষ্টি উত্তেজিত হয়ে বলল।
ঋজু বলল, “হ্যাঁ, বেশ বিস্কিটের মতো গায়ের রংটা ওর। নামটা ভালো মানাবে।”
বিকেলে জয়ীর মা হসপিটাল থেকে ফিরলে গাড়ি করে জয়ী আর ওর মা বিস্কিটকে নিয়ে এল টিনটিনদের বাড়িতে। ঋজুর বাবা বিদেশে থাকেন, কিন্তু এই সময় উনি এখানে আছেন। তাই ঋজুও বায়না করে বাবা মাকে নিয়ে চলে এল। শুবান আর বৃষ্টিই-বা বাকি থাকে কেন এই পুনর্মিলন উৎসবে? শুবানের মা হাতের কাজে খুব ভালো। উনি চারটে সুন্দর কলার বানিয়ে এনেছেন বিস্কিট আর ওর ভাইদের জন্য। টিনটিনের বাবা আগেই গ্যারেজের লোকেদের সব বলে রেখেছিলেন। ওরাও সবাই খুব খুশি। সবাই মিলে বিস্কিটকে ওরা নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল ওর মায়ের সামনে। ওর মা দৌড়ে এসে বিস্কিটকে চেটে-চুটে আদরে আদরে ভরিয়ে দিল। বাকি ছানাগুলোও ছুটে এসে বিস্কিটকে আদর করতে লাগল। এই ফ্যামিলি রিইউনিয়ন দেখে সকলেরই চোখে প্রায় জল এল। আজ শুধু কুকুর ফ্যামিলির রিউনিয়ন হল তাই নয়, গোটা ২০২০-র পরে এই পঞ্চপাণ্ডবদেরও রিইউনিয়নও হল। টিনটিনের বাবা-মা আগেই সুইগিতে অর্ডার করে দিয়েছিলেন। সবাই মিলে একসঙ্গে ডিনার করা হল। নাহ্, এবার সত্যিই সকলের মনে হচ্ছে হ্যাপি নিউ ইয়ার। আর এই জুনিয়র পাণ্ডব গোয়েন্দাদের জন্য সবাই একসঙ্গে হাততালি দিল। টিনটিনদের ফ্ল্যাটের সকলে এসেও ওদের একবার করে অভিন্দন জানিয়ে আর আদর করে গেলেন। সকলেই আশীর্বাদ করলেন এই সংবেদনশীল নরম মন যেন ওদের চিরকাল থাকে।
অলঙ্করণ- জয়ন্ত বিশ্বাস
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে