গল্প- সাভান্ত-বিশ্বদীপ সেনশর্মা -বসন্ত২০২৩

এইলেখকের আগের গল্প কৃপণের বামমুঠি, দহনভার, পরবাস

golposavant

চোখ খুলে কয়েক মুহূর্ত সে তাকিয়েই রইল। সে দেখছে, কিন্তু এখনও যেন বোধ আসেনি। শরীর ও মনে আচ্ছন্ন ভাব।

কয়েকবার সে চোখের পাতা ফেলল। ধীরে ধীরে সংবিৎ ফিরে এল৷ তারপর সে বিস্মিতভাবে চারদিকে দেখতে লাগল। এটা কোন জায়গা?

একটা খুব ছোটো ঘর। যে খাটে সে শুয়ে আছে সেটা ছাড়া তার ঘরে অন্য আসবাব নেই। খাটের উলটোদিকে একটা হলুদ   রঙ করা দরজা বোধহয় বাইরে থেকে বন্ধ করা। মাথার উপরে একটা ছোটো জানালা, সেটাও বন্ধ৷ ছাদ থেকে একটা সিলিং ফ্যান ঝুলছে।

এখানে তাকে কে নিয়ে এল? তার কী হয়েছিল? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সে মাঠ থেকে ফুটবল খেলা দেখে হোমে ফিরছিল। সে খেলতে পারে না, তবে দেখে।

তারপর কী হল? হ্যাঁ, রাস্তায় একটা কাকু এগিয়ে এসে তার সঙ্গে আলাপ করে। তার পর? নাহ্‌, আর কিছু তার মনে পড়ছে না।

সে খাট থেকে নামল। দরজাটা টেনে দেখল বাইরে থেকে বন্ধ। ধাক্কা দিতে গিয়েও কী ভেবে থেমে গেল। বাইরে কারা আছে? এটা কোন জায়গা? সেই কাকুটা কি তাকে ধরে এনেছে? কেন? সে কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল? এখন ক’টা বাজে? তার কি ওষুধ খাবার সময় হয়েছে? প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা হোমে পারুলদি তাকে একটা ওষুধ দেয়। ওটা না খেলে তার শরীর খারাপ হয়।

তার ভয় করছে। তার ভিতর থেকে একটা কান্না উঠে আসছে। সে নিঃশব্দে চোখ বন্ধ করল।

॥ ২॥

পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান সুহাস চ্যাটার্জি উত্তেজিত হয়ে টেবিলের কাচের উপরেই জোরে কিল মারলেন। কাচটা ঝনঝন করে উঠল।—“শহরের বুকের উপর থেকে একটার পর একটা ছেলে উধাও হয়ে যাচ্ছে। আর এরা সবাই অটিস্টিক অর্থাৎ কোনও না কোনোভাবে মানসিক সমস্যা আছে। আর আমাদের কাছে এখনও কোনও সূত্র নেই?”

টেবিলের উলটোদিকে ইন্সপেক্টর সুপ্রতিম বসু। সে আগে একটা থানায় ছিল। কয়েকটা স্থানীয় কেসে ভালো কাজ করার সুবাদে তাকে প্রোমোশন দিয়ে গোয়েন্দা বিভাগে বদলি করা হয়েছে৷ তুখোড় ছেলে। এই মুহূর্তে সে জানে চ্যাটার্জির রাগটা বিশেষ কারও উপর নয় যতটা নিজের উপর। এই কেসগুলি উনি নিজে খুঁটিয়ে দেখেছেন। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল এখনও এগোনোর মতো সেরকম কোনও সূত্র পাওয়া যায়নি। এদিকে মিডিয়ায় তুমুল হইচই আরম্ভ হয়েছে। একটি বাংলা চ্যানেল কাল রাতে এই ইস্যু নিয়ে আধঘণ্টার একটা বিশেষ প্রোগ্রাম করেছে। তাতে বিরোধী পক্ষের এক নেতা ও এক প্রাক্তন পুলিশকর্তা এ-ব্যাপারে পুলিশের ব্যর্থতা নিয়ে কটাক্ষ করেছেন।

সে বিনীতভাবে বলল, “স্যার, আমরা তো সবরকমভাবে চেষ্টা করছি। ছেলে তিনটির আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে খুঁটিয়ে জেরা করা হচ্ছে। আমাদের খবরি নেটওয়ার্ককেও সক্রিয় করা হয়েছে। কিন্তু এখনও সেভাবে কোনও সূত্র পাওয়া যায়নি। কারও বাড়িতে মুক্তিপণ চেয়ে কোনও ফোনও আসেনি।”

চ্যাটার্জি স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “সুপ্রতিম, মাথাটা একটু খাটাও। তিনটি ছেলের মধ্যে একজন অনাথ আশ্রমের। বাকি দুজনের বাড়ির অবস্থাও নিতান্তই সাধারণ। তোমার মনে হয় কেউ টাকার লোভে এদের কিডন্যাপ করেছে?”

চ্যাটার্জির কথায় যে যুক্তি আছে সুপ্রতিম জানে৷ তবু তার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল, কেউ যদি ফোন করে! সে চুপ করে রইল। চ্যাটার্জি এবার কতকটা স্বগতভাবে বললেন, “তিনটে কেসই আর-একবার শুরু থেকে দেখা যাক। প্রথম কেস, শুভম বলে ছেলেটি। কতদিন হল তাকে পাওয়া যাচ্ছে না?”

“দশদিন স্যার।”

“হুম। ক্লাস এইটে পড়ে৷ স্কুল থেকে বন্ধুদের সঙ্গে হেঁটেই বাড়ি ফিরত। সেদিন আর ফেরেনি। বন্ধুরা বলছে, অনেকটা রাস্তা অবধি তাদের সঙ্গেই ছিল, তার পরে আলাদা হয়ে যায়।”

সুপ্রতিম ঘাড় নাড়ল। চ্যাটার্জি বললেন, “দ্বিতীয় কেস, সায়ন্তন। সাতদিন হল নিখোঁজ। এ-ছেলেটি ক্লাস সিক্সে পড়ে। স্কুল ছুটির পর মা তাকে নিতে আসতেন। সেদিন ভদ্রমহিলার যেতে একটু দেরি হয়েছিল, তার আগেই একটি লোক এসে সায়ন্তনকে নিয়ে যায়। স্কুলের দারোয়ান তাকে দেখেছে। লোকটির স্কেচও করানো হয়েছে, কিন্তু আমাদের ডেটাবেসে এরকম কারও ছবি নেই।

“শেষ কেস, অর্ক। ছেলেটির বাবা-মা নেই। একটি হোমে থাকত। এ-বছর মাধ্যমিক দেবার কথা। অর্ক স্কুলের ছুটির পর বন্ধুদের সঙ্গে পাশের মাঠে ফুটবল খেলা দেখতে গেছিল, তারপর থেকে তাকে আর কেউ দেখেনি। বন্ধুরা কেউ কিছু বলতে পারছে না। এটা মোটে তিনদিন আগের ঘটনা।”

সুপ্রতিম আবার ঘাড় নাড়ল। চ্যাটার্জি বিরক্তভাবে বললেন, “তিনটে ছেলে এভাবে রাতারাতি উধাও হয়ে যেতে পারে না। যদি ধরেই নিই একটাই দল এসব করছে, তাদের উদ্দেশ্য কী? পাচার করবে?”

সুপ্রতিম বলল, “স্যার, হতেও পারে। আরবদেশে বাচ্চা ছেলেদের পাচার করার একটা চক্র আছে শুনেছি। কিন্তু প্রশ্ন হল, বেছে বেছে অটিস্টিক বাচ্চাদের কেন? এদের তো এমনিতেই সামলানো মুশকিল।”

চ্যাটার্জি ঘাড় নেড়ে বললেন, “সেটাই তো রহস্য।”

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলেন। তারপর সুপ্রতিম ধীরে ধীরে বলল, “স্যার, আর-একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় আসছে। অটিস্টিক বাচ্চাদের মানসিক সমস্যা থাকলেও এদের অনেকের নাকি কোনো-কোনো ব্যাপারে বিশেষ প্রতিভা থাকে। কেউ ভালো ছবি আঁকতে পারে, কেউ অঙ্কে খুব ভালো হয়—এইসব। হয়তো যারা এসব করাচ্ছে তারা সে-ব্যাপারে আগ্রহী।”

চ্যাটার্জি বললেন, “এদের দিয়ে স্টেজে শো করিয়ে পয়সা কামাবে বলছ? আমার মনে হয় না। তাহলে তো এদের প্রকাশ্যে আনতে হয়। আর তাতে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। যাই হোক, এদের বাড়িতে কথা বলে দেখতে পারো।”

এর দু-দিন পরের কথা। সুপ্রতিম চ্যাটার্জির ঘরেই বসে আছে। তদন্ত চলছে। এখনও সেভাবে কোনও অগ্রগতি হয়নি। চাপ ক্রমশ বাড়ছে। প্রতিটি কাগজে লেখালেখি হচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলি প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা প্রাইম টাইমে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মুখরোচক আলোচনা করছে ও পুলিশের ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা করছে। পুলিশ কমিশনার নিজে গতকাল সংশ্লিষ্ট থানাগুলির ওসিদের হেড-কোয়ার্টারে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। চ্যাটার্জি ও সুপ্রতিমও সেই মিটিংয়ে ছিলেন।

কথার মধ্যেই চ্যাটার্জির মোবাইলে একটা কল এল। চ্যাটার্জি কথা শেষ করে ফোনটা নামিয়ে রেখে হতাশভাবে বললেন, “আরও একটা কেস। রবি বলে একটি ছেলে। ক্লাস নাইনে পড়ে। আজ সকালে স্কুলে যাবার পথে নিখোঁজ।” তারপর ম্লান হেসে বললেন, “সুপ্রতিম, কিছু একটা করো, না-হলে আমাদের দুজনকেই এবার চাকরি-বাকরি ছেড়ে পান-বিড়ির দোকান খুলতে হবে।”

সুপ্রতিম স্তম্ভিত৷ তার মনে হল, সে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। তারপর খেয়াল হওয়ায় চ্যাটার্জির দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, এই ছেলেটিও কি, মানে, অটিস্টিক?”

চ্যাটার্জি ম্লান হেসে বললেন, “সারপ্রাইজিংলি নো। ব্যাপারটা আরও জট পাকিয়ে গেল। আগের তিনটে কেস কি তাহলে নিছকই সমাপতন ছিল?”

সুপ্রতিম বলল, “স্যার, একসঙ্গে তিন-তিনটে কেস সমাপতন হতে পারে না। আমার মন বলছে, এই কেসের সঙ্গে ছেলেগুলির অটিস্টিক হবার একটা সম্বন্ধ আছে।”

চ্যাটার্জি পালটা প্রশ্ন করলেন, “তাহলে এই ছেলেটি কেন?”

এ-প্রশ্নের উত্তর সুপ্রতিমের কাছে নেই, তাই সে চুপ করে রইল।

চ্যাটার্জি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “বসে থেকে লাভ নেই। চলো একবার ছেলেটির বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। লোকাল থানায় একটা ফোন করে দাও।”

ছেলেটির বাড়ি গিয়ে অবশ্য নতুন কিছু জানা গেল না। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা-মা দুজনেই একেবারে ভেঙে পড়েছেন। সকালে রবির স্কুলের বাস আসে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। রবি ওটুকু হেঁটে যায়। সকালে রোজকারমতো পিঠে স্কুল-ব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছিল। দুপুরে না ফেরায় স্কুলে ফোন করে জানা যায় রবি আজকে স্কুলেই আসেনি। বন্ধুরা জানিয়েছে, বাসেও ওঠেনি। তারপরই থানায় খবর দেওয়া হয়।

তারা আবার অফিসে ফিরে এল।

চ্যাটার্জি বললেন, “চলো, কমিশনার সাহেবকে রিপোর্ট দিতে হবে।”

কমিশনার রজত ভার্মা এমনিতে গম্ভীর ও কম কথার লোক। তাঁকেও আজকে রীতিমতো অসহায় দেখাচ্ছিল। বললেন, “আমাদের হাতে খুব বেশি হলে দুই কি তিনদিন সময় আছে। তারপরে আর কিছু করার থাকবে না। বিরোধী পক্ষ ইতিমধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে।” তারপর সুপ্রতিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ইয়াং ম্যান, ডু ইউ হ্যাভ এনি ব্রাইট আইডিয়া?”

ফেরার পথে গাড়িতে বসে একটা কথা সুপ্রতিমের মনে হয়েছিল। চ্যাটার্জিকেও এখনও বলা হয়নি। সে বলল, “স্যার, এরা যদি ছেলেগুলিকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে থাকে তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু যদি আশেপাশে কোথাও রেখে থাকে… ফ্ল্যাটে রাখা সম্ভব নয়, এদের কোনও ফাঁকা জায়গায় একটা বেশ বড়ো বাড়ি দরকার হবে। বাগান ও পাঁচিল-টাচিল সমেত। এদের গ্যাংয়ের লোকরা থাকবে, তারাও কয়েকজন হবে।”

কমিশনার ও চ্যাটার্জি দুজনেই মন দিয়ে শুনছিলেন। কমিশনার বললেন, “গো অ্যাহেড, উই আর লিসনিং।”

সুপ্রতিম বলে চলল, “স্যার, খুব সম্ভবত এই কাজটা যারা করছে তারা এই শহরের অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত নয়। কারণ, তাহলে আমাদের ইনফর্মারদের কাছে এতদিনে খবর পেয়ে যেতাম। এরা শহরের বাইরের গ্যাং। এবার বাইরের গ্যাং হলে এদের এই বড়ো বাড়িটা ভাড়া নিতে হবে। কাছাকাছির মধ্যে হলে ভালো হয়, নয়তো ছেলে চুরি করে নিয়ে যাবার সময় চেকিং হলে ধরা পড়ে যাবে। এবারে আমরা যদি আশেপাশের সমস্ত থানাকে বলি গত দু-তিন মাসের মধ্যে এই বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায় এরকম কোনও বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে কি না চেক করতে, তারপর সেই বাড়িগুলি সার্চ করি…”

সুপ্রতিম থেমে গেল। কমিশনার উত্তেজিতভাবে বললেন, “ইউ হ্যাভ আ পয়েন্ট। অ্যাট লিস্ট, সামথিং টু ওয়ার্ক অন। লেট আস অর্গানাইজ।”

॥ ৩॥

“এদের কি জোর করে ধরে আনা হয়েছে?” বৃদ্ধ ভদ্রলোক বেশ রাগতভাবেই প্রশ্নটা করলেন।

প্রশ্নটা যাকে করা হল, লোকটি মাঝবয়সি, ছোটোখাটো চেহারা। একনজরে দেখলে তাকে সাধারণ ভালোমানুষ বলেই মনে হয়। কিন্তু প্রশ্নটা শুনে তার মুখে যে হাসিটা ফুটে উঠল, সেটা দেখে খুব ভরসা হবার কথা নয়। সে বলল, “স্যার, এরা বাচ্চা ছেলে… বুঝতেই তো পারছেন, মানে ওই একটু বোঝাতে হয়েছে আর কি। হে হে…”

ভদ্রলোক কিছুক্ষণ লোকটিকে দেখলেন। তারপর রাগে কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন৷ বললেন, “আমি এসবের মধ্যে নেই। আমি চলে যাচ্ছি। আর এক্ষুনি এদের বাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা করো, নয়তো আমি পুলিশে খবর দেব।”

“বসুন প্রফেসর।”

লোকটির হাতে এবার ছোটো একটি কোল্ট অটোমেটিক উঠে এসেছে। সেটা প্রফেসরের দিকে তাক করা। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “এখন পিছিয়ে আসার প্রশ্ন নেই। আপনি আপনার কাজ করুন। বাকিটা আমি দেখছি।”

প্রফেসর চমকে গেলেও ভয় পাননি। তবে এদের সঙ্গে তিনি গায়ের জোরে পারবেন না। মাথা ঠান্ডা রেখে পালিয়ে যাবার সুযোগ খুঁজতে হবে। তিনি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “ঠিক আছে, নতুন ছেলেটিকে নিয়ে এসো।”

লোকটি খুশি হয়ে বলল, “এই তো সমঝদারের মতো কথা।”

॥ ৪॥

শহরের এক নম্বর নিউরো-সার্জন অমিতাভ সেনের চেম্বারে রোজকারমতোই প্রচুর ভিড়। এক এক করে ডাক পড়ছে। সুপ্রতিম চুপ করে এক কোনায় বসে আছে। তার পরিচয় শুনে ড. সেন তাকে পাঁচ মিনিট সময় দিতে রাজি হয়েছেন।

একটু পরেই তার ডাক পড়ল। ড. সেনের পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স, উজ্জ্বল সৌম্যকান্তি চেহারা। দেখলে মনে ভরসা হয়। তিনি সুপ্রতিমকে বসতে বলে বললেন, “বলুন কী জানতে চান?”

সুপ্রতিম ভনিতা না করে সরাসরি কাজের কথায় গিয়ে বলল, “অটিস্টিক বাচ্চাদের সম্বন্ধে কিছু জানতে চাই। এদের সকলেরই কি বিশেষ প্রতিভা থাকে?”

ড. সেন বললেন, “সকলের নয়, তবে অনেকেরই থাকে।”

“নিউরোলজিক্যালি এর ব্যাখ্যা কী যদি একটু বলেন।”

ড. সেন বললেন, “সংক্ষেপে বলছি। আমাদের ব্রেনের দুটো অংশ—রাইট অ্যান্ড লেফট হেমিস্ফিয়ার। এর মধ্যে রাইট ব্রেন সৃজনশীল বা ক্রিয়েটিভ অ্যাক্টিভিটির জন্য দায়ী। লেফট ব্রেন সেটা নিয়ন্ত্রণে রাখে৷ অটিস্টিকদের মধ্যে যারা বিশেষ প্রতিভার অধিকারী, তাদের ব্রেনের স্ক্যান করে দেখা গেছে তাদের লেফট ব্রেনের একটা বিশেষ অংশ (লেফট অ্যান্টেরিয়র টেম্পোরাল লোব) নিষ্ক্রিয়। যার জন্য রাইট ব্রেন অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে এবং এরা মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন ছবি আঁকা, সংগীত, মেন্টাল ম্যাথস বা আরও কোনো-কোনো বিষয়ে সুপার হিউম্যান প্রতিভা প্রদর্শন করে। এদের বলা হয় সাভান্ত (Savant)। আবার এরকমও দেখা গেছে, সুস্থ মানুষও মাথার বাঁদিকে বিশেষ জায়গায় আঘাত পেয়ে সাভান্তদের মতো বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছে। যদিও সংখ্যাটা খুব কম।”

সুপ্রতিম নিবিষ্ট মনে শুনছিল। এবার সে বলল, “একজন সুস্থ মানুষকে কি মাথার বাঁদিকে এই বিশেষ জায়গায় আঘাত করে এই ক্ষমতা জাগিয়ে তোলা যেতে পারে?”

ড. সেন বললেন, “না, সেটা সম্ভব নয়। তবে যেটা করা সম্ভব এবং এটা নিয়ে পৃথিবীর কোনো-কোনো ল্যাবরেটরিতে কাজ চলছে যে ম্যাগনেটিক পালস স্টিমুলেশন (TMS বা Trabscranial magntic stimulation) করে অনেক সময় একজন সুস্থ মানুষ বা শিশুর মধ্যেও এই বিশেষ ক্ষমতাগুলি জাগিয়ে তোলা যায়। আমি যতদূর জানি, এ নিয়ে এখনও কাজ চলছে। তবে এইসব গবেষণার একটা সুদূরপ্রসারী সামাজিক তাৎপর্য থাকায় অনেকেই এ-ব্যাপারে গোপনীয়তা বজায় রাখেন।”

“আমাদের দেশের কোনও বিজ্ঞানী এ নিয়ে কাজ করছেন?”

ডঃ সেন কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন। তারপর বললেন, “এখানকার কেউ কাজ করছেন বলে আমার জানা নেই। তবে মুম্বইতে প্রফেসর মনোজ গুপ্তার সঙ্গে একটা সেমিনারে আলাপ হয়েছিল। উনি এ ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ। হাতে কলমে কাজ করছেন কি না বলতে পারব না।”

ড. সেনকে ধন্যবাদ দিয়ে সুপ্রতিম উঠে পড়ল। তার যা জানার জানা হয়ে গেছে।

আবার অফিস। কমিশনারের ঘরে চ্যাটার্জি ও সুপ্রতিম। ড. সেনের কাছ থেকে সুপ্রতিম যা জেনেছে চ্যাটার্জি কমিশনারকে ব্রিফ করছেন।

কমিশনার সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, “এই প্রফেসর গুপ্তার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করছি না কেন? হয়তো উনি এ-ব্যাপারে আরও কিছু ইনফরমেশন দিতে পারবেন।”

চ্যাটার্জি বললেন, “স্যার, আমরা মুম্বই পুলিশের মাধ্যমে ওঁর সঙ্গে ইতিমধ্যেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। ওঁর বাড়ি থেকে জানিয়েছে, উনি একটা বিশেষ কাজে কয়েকদিনের জন্য মুম্বইর বাইরে গেছেন। কোথায় গেছেন বাড়িতে বলে যাননি। ওঁর মোবাইল সুইচড অফ আসছে।”

কয়েক মুহূর্ত সকলেই চুপ করে রইলেন। কমিশনার শিস দিয়ে উঠলেন। তারপর সুপ্রতিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওদিকের কী খবর?”

সুপ্রতিম বলল, “স্যার, গতকাল পর্যন্ত আশেপাশে আমাদের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায় এরকম প্রায় কয়েকশো বাড়ি স্থানীয় থানা থেকে চেক করা হয়েছে। সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি। তবে অনেক থানা থেকে এখনও রিপোর্ট আসেনি।”

কমিশনার চ্যাটার্জিকে বললেন, “পুরো ফোর্স লাগিয়ে দিন। সব থানাকে বলুন এটা টপ প্রায়োরিটি। আমার কালকের মধ্যে রিপোর্ট চাই।”

চ্যাটার্জি ঘাড় নাড়লেন।

॥ ৫॥

এরা রোজ একবার করে দরজা খুলে তাকে নিয়ে যায়। একটা ঘর, তাতে অনেক যন্ত্রপাতি। লাল-সবুজ আলো জ্বলে। একটা জেঠু বসে থাকে। জেঠুটা মনে হয় ভালো, অন্য লোকগুলির মতো নয়। জেঠুটা মিষ্টি হেসে মাথায় একটা অদ্ভুত দেখতে হেলমেটের মতো জিনিস পরিয়ে দেয়। সামনে একটা মেশিনের পর্দায় ছবি ফুটে ওঠে। জেঠুটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে।

এরা কেন তাকে ধরে এনেছে? পর্দার ওই ছবিগুলোর মানে কী? জেঠুটা কে? এরা জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না, শুধু দু-বেলা খাবার দিয়ে যায়। এখানকার খাবার তার ভালো লাগে না। বাড়িতে তার জন্য আলাদা করে রান্না হত। বাড়ির কথা মনে হলেই তার কান্না পায়। আচ্ছা, বাবা-মা এখন কী করছে? মা নিশ্চয়ই তার জন্য খুব কাঁদছে? বাবা নিশ্চয়ই পুলিশে খবর দিয়েছে। কবে সে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে?

॥ ৬॥

অফিস থেকে ফিরে ধড়াচুড়ো ছাড়তে না ছাড়তেই মোবাইলে চ্যাটার্জির কল ঢুকল। বললেন, “তাড়াতাড়ি চলে এসো। একটা সন্দেহজনক বাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে। থানা থেকে রেইড করতে যাচ্ছে। কমিশনার চাইছেন আমরাও যেন যাই।”

সে ধড়াচুড়ো পরে পড়ি কি মরি করে বাইক চালিয়ে অফিসে পৌঁছল। চ্যাটার্জি গাড়ি নিয়ে বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন; চটপট গাড়িতে তুলে নিলেন। যেতে যেতে বললেন, “বাড়িটা একটা বাগানবাড়ি। তিন মাস আগে মুম্বইর এক ভদ্রলোক ভাড়া নিয়েছেন। আমাদের খবর অনুযায়ী, বাড়িতে কোনও কাজের লোক নেই। জনা চারেক অবাঙালি লোক থাকে, তারাই বাজারহাট করে। বাড়ির সামনে একটা কালো কাচ লাগানো সুমো গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে, সেটাকে মাঝেমধ্যে যাতায়াত করতে দেখা গেছে।”

প্রথমে থানায় গিয়ে ওসি ও আরও দুজন অফিসারকে তোলা হল। সকলেই সশস্ত্র।

থানা থেকে বাড়িটায় পৌঁছতে মিনিট দশেক লাগল। বড়ো রাস্তা থেকে অনেকটা ভিতরে। চারদিক গাছপালা দিয়ে ঘেরা। দরজায় কোনও বেল নেই। থানার ওসি এগিয়ে গিয়ে দরজায় জোরে আঘাত করে বললেন, “থানা থেকে আসছি, দরজাটা খুলুন।”

বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি ও দরজা ধাক্কানোর পরেও কেউ সাড়া দিল না। চ্যাটার্জি নির্দেশ দিলেন, “দরজা ভেঙে ফেলো।”

এবারে সুপ্রতিম ও আরও কয়েকজন পালা করে দরজায় দমদম করে লাথি মারতে লাগল। পুরোনো কাঠের দরজা, বেশিক্ষণ সেই চাপ নিতে পারল না।

হাতে রিভলভার উঁচিয়ে ওঁরা ভিতরে ঢুকলেন। এখনও কারও সাড়াশব্দ নেই। দরজা দিয়ে ঢুকে একটা লম্বা বারান্দা, তার দু-পাশে সারি সারি ঘর। বাইরে থেকে শিকল দেওয়া। শিকল খুলে তিনটি ঘর থেকে তিনটি সন্ত্রস্ত ও বিভ্রান্ত শিশুকে পাওয়া গেল। তাদের একজন লোক দিয়ে বাইরে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসানো হল। অন্য ঘরগুলি ফাঁকা। তবে লোকজনের বসবাস করার চিহ্ন স্পষ্ট। মনে হয় খবর পেয়ে পালিয়েছে।

একদম শেষের ঘরটিতে ঢুকে দেখা গেল এক সৌম্যকান্তি প্রৌঢ় ভদ্রলোক একটি কিশোর ছেলের মুখোমুখি বসে আছেন। ছেলেটির মাথায় ও কপালে একটি হেলমেট ও আরও কীসব যন্ত্রপাতি লাগানো আছে। তাদের দেখে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে উৎফুল্লভাবে বললেন, “আপনারা এসে গেছেন?”

সুপ্রতিম বলল, “আপনি প্রফেসর গুপ্তা?”

ভদ্রলোক হেসে বললেন, “হ্যাঁ, সব বলছি। কিন্তু আপনারা বন্দুকগুলো নামিয়ে নিলে ভালো হয়। আমিও এই ছেলেগুলির মতো বন্দি হয়েই আছি।”

তিনি ছেলেটির মাথা থেকে যন্ত্রপাতিগুলি খুলে নিলেন। চ্যাটার্জির ইঙ্গিতে একজন অফিসার ছেলেটিকে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসাল। প্রফেসর গুপ্তা বললেন, “চলুন কোথায় যেতে হবে।”

কিছুক্ষণ পরে চ্যাটার্জির ঘরে সকলে বসে ছিলেন। ছেলেগুলির বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে। একটু পরেই ওদের বাড়ির লোক এসে নিয়ে যাবেন। ওদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, সেই সঙ্গে কম্পিউটারে মুম্বই পুলিশের দাগি অপরাধীদের পিকচার গ্যালারিতে নিয়ে গিয়ে তিনজনকে আইডেন্টিফাই করা হয়েছে। দলের পাণ্ডাটিকে আইডেন্টিফাই করেছেন প্রফেসর গুপ্তা স্বয়ং। লোকটির নাম বিকাশ সাওন্ত। মুম্বইতে বিভিন্ন অপরাধে বেশ কয়েকবার জেল খেটেছে।

প্রফেসর গুপ্তার কাছ থেকে যা জানা গেল তা মোটামুটি এই—

মুম্বইতে একটি অটিস্টিক ছেলে সম্প্রতি ছবি এঁকে শিল্পী হিসাবে বেশ নাম করেছিল। তিনি ছেলেটির বাবা-মার সঙ্গে দেখা করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তার ব্রেন স্ক্যান করেন। স্ক্যানে ছেলেটির লেফট অ্যান্টেরিয়র লোবে কিছু অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে। তাঁর মনে হয় TMS করে একটি সুস্থ ছেলের মধ্যেও এই ক্ষমতা জাগিয়ে তোলা সম্ভব। তিনি এ নিয়ে একটি জার্নালে একটি আর্টিকল লেখেন। তবে আরও বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল কয়েকজন ভলান্টিয়ারের।

এই সময় কীভাবে খবর পেয়ে সাওন্ত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে। সে প্রস্তাব দেয়, প্রফেসর গুপ্তা যদি কিছুদিনের জন্য অন্যত্র যেতে পারেন, সে সব ব্যবস্থা করে দেবে ও ভলান্টিয়ারও জোগাড় করে দেবে। সেখানে তার চেনা-পরিচিতি আছে। প্রফেসর অত সাত-পাঁচ না ভেবেই রাজি হয়ে যান।

প্রফেসর থামলেন। পুলিশ কমিশনার ঘরে এসে ঢুকেছেন। তিনি প্রফেসর গুপ্তাকে বললেন, “অপরাধীদের ছবি চারদিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই ধরা পড়ে যাবে। তবে কেস এখানকার কোর্টে চলবে। সাক্ষী দিতে মাঝেমধ্যে আপনাকে আসতে হবে।”

প্রফেসর হাসিমুখে বললেন, “আসব। এদের শাস্তি হওয়া দরকার।”

কমিশনার বললেন, “আর আর-একজনের পুরস্কার৷ তিনি সস্নেহে সুপ্রতিমের কাঁধে হাত রাখলেন। সুপ্রতিম লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিল।”

জয়ঢাকের গল্পঘর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s