এইলেখকের আগের গল্প কৃপণের বামমুঠি
ভোরবেলা হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখি মা নেই। মেলা থেকে কেনা আমাদের দেয়াল-ঘড়িটা অনেকদিন খারাপ হয়ে পড়ে আছে। তবে বাইরে তাকালে মোটামুটি সময় বোঝা যায়। মনে হল সদ্য ভোর হয়েছে।
ধড়মড় করে উঠে বসলাম। আমাদের একটাই ঘর। একপাশে রান্নার জায়গা। বাইরে টিনের চাল দিয়ে ঘেরা বাথরুম। ঘরের দরজাটার ছিটকিনি ভিতর থেকে খোলা। মা নিশ্চয়ই বাইরে গেছে। দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভোর হচ্ছে। বাতাসে ভোরের সবুজ গন্ধ। চারদিকে পাখপাখালি ডাকছে। বাড়ির দু-দিকে পায়ে চলার পথ নিঝুম নিঃসাড় পড়ে রয়েছে৷ মা কোথাও নেই। দৌড়ে ঘরে ফিরে এলাম। পাশের খাটে বাবা শুয়ে ঘুমোচ্ছে। বাবাকে ডাকব?
ভাবতে ভাবতে দেখি আমার বালিশের তলা থেকে একটা কাগজ বেরিয়ে আছে। তুলে দেখি মার হাতে লেখা একটা চিঠি। আমি এখন ধরে ধরে মোটামুটি পড়তে পারি। দেখি আমার নামেই চিঠিটা। মা লিখেছে, ‘টুকু, আমি কৃষ্ণনগরে যাচ্ছি। দু-দিন পরে এসে তোকে নিয়ে যাব। রান্না করে গেলাম, ফুটিয়ে ফুটিয়ে খেয়ে নিস।’
চিঠিটা পড়ে প্রথমেই মনে হল, যাক দু-দিনের রান্না করা আছে। আমাদের ফ্রিজ-টিজ নেই, একটা মিটসেফ আছে। খুলে দেখি ভাত, ডাল আর কিছু একটা তরকারি করা আছে। চুপ করে এসে খাটে বসে রইলাম। আকাশপাতাল ভাবছিলাম। কৃষ্ণনগরে মার বাপের বাড়ি। এখন মামারা থাকে। হঠাৎ মনে হল, মা সত্যি ফিরে আসবে তো?
কালকে রাতে বাবা আর মার তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। ঝগড়া থেকে মারামারি। বাবা মদ খেয়ে বাড়ি এসে চেঁচামেচি করছিল, যেমন করে। মা ঠান্ডা গলায় বাবাকে শুয়ে পড়তে বলেছিল। উত্তরে বাবা মাকে জোরে একটা চড় মারে। আমাকেও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। মদ খেলে বাবা এরকমই করে। দাদার কাছে শুনেছি আগে আমাদের অবস্থা এরকম ছিল না। আমরা কলকাতার কাছেই একটা ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। বাবা একটা ক্যুরিয়ার না কী যেন কোম্পানিতে ম্যানেজারের কাজ করত। মা বাড়িতে বাচ্চাদের পড়াত। আমি তখন খুবই ছোটো, তবে দাদা স্কুলে পড়ত। দাদার কাছে শুনেছি, তখন আমাদের জন্মদিনে কেক কাটা হত, পাড়ার সব বাচ্চাদের ডাকা হত৷ তারপর বাবার চাকরিটা চলে যায়। বাবা অনেক চেষ্টা করেও এই বয়সে অন্য কোথাও কিছু পায়নি। মার টিউশনির পয়সায় কলকাতায় বাড়িভাড়া করে থেকে সংসার চালানো সম্ভব ছিল না। শেষপর্যন্ত আমরা আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। এখানে আগে দাদু-ঠাকুমা সবাই থাকত, এখন কাকারা থাকে। আমরা আসার পর কাকা একটা পাঁচিল তুলে বাড়িটা দু-ভাগ করে দেয়। আমাদের কিছু চাষের জমি আছে, কাকা সে-সব দেখে। আমরা ফসলের ভাগ পাই। মার কাছে শুনেছি, ওই ক’টা টাকায় সারাবছর সংসার চলে না। বাবা মাঝেমধ্যে যাত্রাদলে পার্ট করে কিছু রোজগার করে, কিন্তু সে পয়সা নেশাতেই চলে যায়। অগত্যা মা রোজগারের চেষ্টায় নামে। প্রথমে কলকাতার মতো বাচ্চাদের পড়ানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এই গণ্ডগ্রামে কেউ পয়সা দিয়ে পড়ায় না। স্কুলে পাঠায় মিড ডে মিলের জন্য। যেরকম আমিও যাই। শেষপর্যন্ত মা অন্য একটা কাজ ধরে। মা হাতের কাজ ভালো পারে, দিদার কাছে খুব ভালো মাটির পুতুল বানাতে শিখেছিল। এখানেও মাটি দিয়ে পুতুল আর নানারকম জিনিস বানিয়ে শনিবার শনিবার গ্রামের হাটে বিক্রি করতে নিয়ে যায়। তাতে দুটো পয়সা আসে।
এইভাবে চলছিল। এখন কী হবে জানি না। কৃষ্ণনগরে মামাও সামান্য চাকরি করে, সেখানে আমরা থাকতে পারব কি না জানি না। মা বোধ হয় সেইসব বুঝে দেখতেই গেছে।
বসে বসে খিদে পাচ্ছিল। আমাদের বাড়িতে সকালে জলখাবারের চল নেই। খিদে পেলে জল দিয়ে মুড়ি-টুড়ি খেয়ে নিই। তাই খেলাম।
খেতে খেতেই বাবার ঘুম ভাঙল। আমাকে একা একা শুকনো মুখ করে বসে থাকতে দেখে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করল। আমি মার চিঠিটা এগিয়ে দিলাম। চিঠিটা পড়ে বাবার মুখচোখের চেহারা পালটে গেল। দাঁতে দাঁত চিপে বলল, “ঠিক আছে, আমিও দেখব।” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোকেও নিয়ে যাবে বলেছে। তাহলে চলে যা, এখনও পড়ে আছিস কেন?”
বলতে বলতে বাবা বিছানা ছেড়ে উঠে এল। মারতে আসছে ভেবে আমি সিঁটিয়ে গিয়ে দুই হাতে মাথা আড়াল করলাম। বাবা কিছু করল না। বোধ হয় বাইরে বাথরুমে মুখ ধুতে গেল। ফিরে এসে আলনা থেকে জামা টেনে নিয়ে গায়ে চড়িয়ে আবার বেরিয়ে গেল। হয়তো সিধুকাকার দোকানে চা খেতে গেল। আমি কোনোদিন নিজের হাতে চা বানাইনি, তবে মাকে করতে তো দেখি। মনে হল বাবা বললে আমিও চেষ্টা করে বানিয়ে দিতে পারতাম।
একা একা বসে রইলাম। বাইরে ধীরে ধীরে রোদ উঠছে। আমাদের ঘরেও রোদ এসে পড়েছে। ঘরে থাকার বলতে শোওয়ার জন্য দুটো তক্তপোষ, একটা টিনের ট্রাঙ্ক, জামাকাপড় রাখার জন্য একটা আলনা, মেলা থেকে কেনা একটা সস্তার র্যাক এইসব। র্যাকে আমার স্কুলের বইপত্র আর টুকটাক জিনিসপত্র থাকে। দাদার বইপত্র নীচের তাকে এখনও রাখা আছে। দাদা ক্লাস সিক্সে পড়ত। গতবছর গ্রামে সার্কাসের দল এসেছিল, তাদের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। দাদা না থাকায় মাঝে মাঝে খুব ফাঁকা লাগে, ভয়ও করে।
আজকে স্কুলে যাব কি না বুঝতে পারছিলাম না। আজকে বুধবার, স্কুলে মিড ডে মিলে ডিম দিত। কিন্তু আমি গেলে বাবাকে খেতে দেবে কে? চুপ করে বসে রইলাম।
দেখতে দেখতে দু-দিন কেটে গেল। মা আসেনি বা কোনও খবরও পাঠায়নি। মার কাছে অবশ্য মোবাইল নেই। মামার কাছে আছে, তবে তার নম্বর আমার কাছে নেই। থাকলে পাশের বাড়িতে কাকুর ফোন থেকে চেষ্টা করে দেখতাম। এই দু-দিন বাবা বাইরে বাইরেই কাটিয়েছে। খালি অনেক রাত করে মদ-টদ খেয়ে শুতে এসেছে। খাওয়াদাওয়া কোথায় করেছে জানি না৷ যা রান্না করা ছিল তা দু-বেলা ফুটিয়ে ফুটিয়ে আমি দু-দিন চালিয়েছি। কাল রাতে অবশ্য খেতে বসে যেন টকটক গন্ধ পাচ্ছিলাম, তারপর ডাল-তরকারি যা বেঁচে ছিল ধরে বাইরে ফেলে দিয়েছি৷ কুকুরগুলো খেয়ে নেবে৷ এবার আমার খাওয়ার চিন্তা। সকালে স্কুলে গেলে অবশ্য একবেলার খাবার জুটে যাবে। রাতের আর ছুটির দিনের জন্য রান্না করতে হবে। ঘরে চাল আছে, ফুটিয়ে ভাত করে নিতে পারব মনে হয়। সঙ্গে তেল আর আলুসেদ্ধ। মা মাঝেমধ্যে করত। অবশ্য বাবা বাড়িতে খেতে এলে এ-জিনিস চলবে না। ডাল-তরকারি করাটা কাকিমার কাছ থেকে দেখে আসতে হবে৷ দু-দিন পরে বাবার কাছ চাল-ডাল-তেল-মশলা কেনার জন্য পয়সাও চাইতে হবে।
এসব ভাবতে গিয়ে কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। মা এখনও আসছে না কেন?
সেদিন রাতে বাবা ফিরল না। আমি অনেক রাত অবধি জেগে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে ঘুম ভেঙে দেখি বাবা আসেনি। একা একা একটা রাত কাটিয়ে দিলাম।
একটু পরে হাতমুখ ধুয়ে দরজায় তালাটা লাগিয়ে বেরোলাম। বাবার খোঁজ করতে হবে। প্রথমেই গেলাম বাড়ির কাছেই সিধুকাকার চায়ের দোকানে। সকালবেলা দোকানের বাইরে অনেক লোক বসে চা খাচ্ছিল। আমাকে দেখে চুপ করে গেল। মা যে চলে গেছে সবাই জানে। তবে বাবার খোঁজ কেউ দিতে পারল না। সেখান থেকে মুদির দোকান। শেষে বাবার মদের ঠেকে। এইভাবে প্রায় গোটা গ্রাম চষে ফেললাম। শেষে একজন বলল, “টুকু, তোর বাবা বোধ হয় সজলদের দলের সঙ্গে চলে গেছে। কাল বিকেলে তোর বাবাকে সজলের সঙ্গে কথা বলতে দেখছিলাম। সাতগ্রামে ওদের শো আছে।”
সজলকাকু যাত্রা দলের ম্যানেজার। বাবা এরকম আগেও গেছে। ক’দিন পরে ফিরেও এসেছে। বুঝলাম, আমাকে আপাতত কোনোরকমে একাই থাকতে হবে।
দু-দিন পরে সন্ধ্যাবেলা বাবা ফিরে এল। হাতে একটা চটের ব্যাগ। তার মধ্যে বিস্কুটের প্যাকেট, পাঁউরুটি, ডিম, চা পাতা এরকম কয়েকটা জিনিস। আর একটা প্যাকেটে একটা জামা। আমার জন্য। এটা খুব কাজে লাগবে। আমার একটাই বাইরে পরার জামা, সেটাও কাঁধের কাছটায় ফেঁসে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, “চা করে দেব?”
বাবা কিছুটা যেন অবাক হয়ে বলল, “তুই পারবি? দে তাহলে।”
বাবার জন্য দুধ ছাড়া চা করে একটা প্লেটে দুটো বিস্কুট দিয়ে নিয়ে এলাম। বাবা চুমুক দিয়ে বলল, “বেশ হয়েছে।” তারপর হেসে বলল, “বেশ বানিয়েছিস। তোর মা যাবার পর তুই সব শিখে গেছিস দেখছি।”
বাবা আজ মদ খায়নি। সাহস করে বললাম, “কৃষ্ণনগরে একবার ফোন করে দেখবে?”
বাবা গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, “আমার কাছে ওদের নম্বর নেই। কেন, তোর মা নিজে করতে পারে না?”
ভয় পেয়ে চুপ করে গেলাম। মার জন্য আবার নতুন করে মনখারাপ করছিল।
বাবা বাইরে থেকে হাতমুখ ধুয়ে এল। বলল, “রাতে কী খাবি? ডিমসিদ্ধ করে ঝোল করতে পারবি? আর ভাত?”
মাঝে একদিন কাকিমার কাছ থেকে তরকারি রান্নার ব্যাপারটা দেখে এসেছিলাম। খুব একটা শক্ত কিছু নয়। ওইভাবে ডিমের ঝোলও করে নিতে পারব।
রাঁধলাম। বলতে গেলে আমার প্রথম রান্না। বাবা খেয়েদেয়ে বলল, “মন্দ হয়নি।” তারপর একটা বিড়ি ধরিয়ে দুটো টান দিয়ে বলল, “তুই স্কুলে যাচ্ছিস?”
ঘাড় নেড়ে না বললাম। বাবা বলল, “কাল থেকে যাস। একবেলার খাওয়াটা পাবি।” তারপর গম্ভীর হয়ে বলল, “এখন থেকে নিজেরটা নিজে সামলাবি। আমি কবে কোথায় থাকি ঠিক নেই।” বলে উঠে গিয়ে আলনায় ঝোলানো শার্টের পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বার করে আমাকে দিল। বলল, “চাল-টাল ফুরিয়ে গেলে কিনে নিস।”
পরের দিন স্কুলে গেলাম। আমাদের ক্লাস-টিচার মিনুদি আমাকে চেনে। মার সঙ্গেও আলাপ ছিল। ক্লাসের পরে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে সবকথা জানতে চাইল। শুনে-টুনে বলল, “তুই এভাবে কতদিন থাকতে পারবি?”
চুপ করে রইলাম।
ছুটির পর বাড়ি ফিরে দেখি বাবা নেই। বোধ হয় আবার চলে গেছে, কারণ কাঁধের ব্যাগটা নেই। ওটা নিয়েই বাবা ঘোরে।
সন্ধ্যাবেলা লন্ঠন জ্বালিয়ে স্কুলের বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। মা আমাকে পড়া দেখিয়ে দিত। এখন কী করব জানি না। মিনুদি অবশ্য আজ বলেছে ওদের বাড়িতে গেলে পড়া দেখিয়ে দেবে। কিন্তু গ্রামের রাস্তায় অন্ধকারের মধ্যে বেরোতে ভয় করে। একটা টর্চ আছে, কিন্তু ব্যাটারি নেই।
এইসময় কাকিমা এল। হাতে একটা বাটিতে সুজি না কী যেন। আমার হাতে দিয়ে বলল, “রাতে কী খাবি?”
বললাম, “ভাতে ভাত করে নেব।”
কাকিমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল, “এইটুকুনি মেয়ে, তোর তো আমাদের সঙ্গেই থাকার কথা। কিন্তু আমার এমন কপাল… যাক গে শোন, সন্ধ্যার পরে দরজা দিয়ে বসবি৷ কেউ ডাকলে-টাকলে দরজা খুলবি না।”
ঘাড় নাড়লাম। কাকিমা চলে গেলে দরজা বন্ধ করে আবার বসলাম। কিন্তু পড়ায় মন বসছিল না। একটু পরে বই বন্ধ করে উঠলাম। একমুঠো চাল আর একটা আলু নিয়ে আন্দাজমতো জল দিয়ে বসিয়ে দিলাম। দিয়ে জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম। জানালাটা রাস্তার দিকে। আজ জ্যোৎস্না আছে। গ্রামের দিকে সন্ধ্যার পরে রাস্তায় বিশেষ লোক থাকে না৷ তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিলাম। এই বাড়িতে কিছুদিন আগেও আমরা চারজন ছিলাম। এখন আমি একা। মা, দাদা কোথায় জানি না। বাবা থেকেও নেই। ভাবতে ভাবতে গলা দিয়ে দলা পাকিয়ে কান্না উঠে আসছিল, কিন্তু সামলে নিলাম। মা বলত, ‘যতই বিপদ-আপদ আসুক, মনের জোর রাখবি।’
এইভাবে কয়েকদিন গেল। টাকা শেষ, কেষ্টকাকুর দোকান থেকে ধার করে চাল আনিয়েছি। বাবার পাত্তা নেই। সন্ধ্যা হলে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকি। ভয় কাটাতে বই খুলে চিৎকার করে পড়তে থাকি। একসময় গলা শুকিয়ে যায়। একটু থেমে দু-ঢোঁক জল খাই। আবার পড়ি।
সেদিন স্কুলে মিনুদি বলল, মিনুদির বাবা আর আরও কয়েকজন মিলে নাকি জেলা শহরে ফোন করেছে। আমাকে নাকি মেয়েদের হোমে পাঠিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে। হোম কীরকম হয় আমার কোনও ধারণা নেই। মিনুদিকেই জিজ্ঞেস করলাম। মিনুদি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “এভাবে একা একা থাকার চেয়ে তো ভালো থাকবি।”
আমি হোমে চলে গেলে মা ফিরে এলে কী হবে? বাবাও তো মাঝেমধ্যে আসবে নিশ্চয়ই। বাড়িতে কেউ থাকবে না?
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে দেখি দরজায় হেলান দিয়ে বাবা বসে আছে। দেখে খুব আনন্দ হল। দৌড়ে গিয়ে ব্যাগ থেকে চাবি বার করে তালা খুলে দিলাম।
বাবা এবারেও কিছু জিনিসপত্র এনেছে। তার মধ্যে চাল আর ডিম দেখে খুব আনন্দ হল। অনেকদিন শুধু আলুসেদ্ধ-ভাত খেয়ে আছি। সেই চালও প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। অবশ্য কেষ্টদার ধারের টাকাটা দিতে হবে। বাবাকে বললাম। বাবা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ঠিক আছে, আমি পরে দিয়ে দেব।”
দু-বেলার মতো রান্না করলাম। খেয়েদেয়ে খাটে বসে বাবা একটা বিড়ি ধরাল। তারপর বলল, “টুকু, তোর সঙ্গে কথা আছে৷”
ভয়ে ভয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাবা বলল, “আমি ভেবে দেখলাম, এভাবে চলবে না। তুই এভাবে একা থাকিস, তা নিয়ে লোকে অনেক কথা বলছে৷ আর আমারই-বা ক’টা টাকা রোজগার!”
চুপ করে রইলাম। বাবা বলল, “আমি শহরে এক বাড়িতে কথা বলেছি। তাদের সবসময়ের জন্য একটি মেয়ে দরকার। কর্তা-গিন্নি দুজনেই খুব ভালো লোক। তুই তাদের বাড়িতে মেয়ের মতো থাকবি আর টুকটাক ঘর-গেরস্থালির কাজে সাহায্য করবি। আমি মাঝেমধ্যে গিয়ে দেখে আসব।”
আমি ঘাড় তুলে বললাম, “আর স্কুল?”
বাবা হঠাৎ রেগে গেল। বলল, “এই অবস্থায় আর পড়াশুনো কী করে হবে? তোর মা তো তোকে আমার ঘাড়ে ফেলে রেখে পালিয়ে গেল। আমি কত দিক সামলাব?” তারপর একটু শান্ত হয়ে বলল, “এখন যা, কিছুদিন থাক, তারপর আস্তে আস্তে দেখা যাবে।”
আমি আর কিছু বললাম না। পরের দিন স্কুলে মিনুদিকে বললাম। মিনুদি শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, “তোর বাপ তোকে ঘাড় থেকে নামাতে চাইছে। কে জানে, হয়তো মাসে মাসে কিছু টাকাও পাবে। তবে পড়াশুনো একবার বন্ধ হয়ে গেলে আর হয় না রে টুকু। তুই বরং হোমেই চলে যা। কপালে থাকলে পড়াশুনো করে একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবি। এখানে গেলে তোকে সারাজীবন কাজের মেয়ে হয়েই থাকতে হবে।”
কিন্তু সন্ধ্যাবেলাই বাবার কাছে একটা ফোন এল। বাবা কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রেখে আমাকে ডেকে বলল, “তুই তোর জামাকাপড় গুছিয়ে নে। ওরা ডাকছে, কাল সকালে গিয়ে তোকে ওখানে রেখে আসব।”
পরের দিন ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল। জামাকাপড় কাল রাতেই একটা ব্যাগে ভরে নিয়েছি। সাবধানে দরজাটা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর একটু পরেই হয়তো বেরিয়ে যেতে হবে। এই বাড়িতে আবার কবে ফিরব, আদৌ কোনোদিন ফিরব কি না জানি না।
এখনও মিনুদিদের বাড়িতে চলে যাওয়া যায়। ওরা বারণ করলে বাবা কি আমাকে নিয়ে যেতে পারবে? জানি না। কিংবা মিনুদির কাছ থেকে দশটা টাকা নিয়ে চুপিচুপি ট্রেনে উঠে কৃষ্ণনগরেও চলে যাওয়া যায়। কৃষ্ণনগর বড়ো শহর, তবে মামাদের বাড়ি স্টেশনের কাছেই। অনেকদিন আগে মার সঙ্গে গেছি, আবছা আবছা মনে আছে। খুঁজলে হয়তো পেয়ে যাব। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ভোরের মিষ্টি নরম আলোটা ধীরে ধীরে প্রখর হয়ে উঠছে। একটু পরেই রোদ উঠবে। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম৷
অলঙ্করণ-শ্রীময়ী