ধারাবাহিক অভিযান-নাইল নদের খোঁজে(৩)-লিভিংস্টোন-অনু-অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়-বর্ষা২০২২

জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- ভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়)  অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)

এই অভিযানের আগের পর্ব- পর্ব ১, পর্ব ২

obhijaanlivingstone02

(ডেভিড লিভিংস্টোন ছিলেন পেশায় ডাক্তার। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন খ্রিস্ট ধর্মযাজকও। লিভিংস্টোন প্রথম আফ্রিকা পাড়ি দেন ১৮৪১ সালে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। আফ্রিকার অবাধ দাস ব্যাবসার বিরোধী ছিলেন তিনি। বেশ কয়েক দশক ধরে আফ্রিকায় অভিযানে যান ডক্টর লিভিংস্টোন। প্রতিটি অভিযানে আফ্রিকার জনজাতি, ভূতত্ত্ব, পরিবেশ খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য লিখে রাখেন নিজের ডায়েরিতে। এই  ধারাবাহিকে তাঁর নীলনদের উৎসের খোঁজে যাত্রার গল্প শুনছি আমরা।)

লেক নয়াসা অভিযান

মিসিঞ্জে থেকে নয়াসায় তরী ভাসাতে হবে। নৌকো খুঁজে আনতে লোক পাঠালাম। আরবেরা টালবাহানা করতে লাগল। এদিকে এই গ্রামে বাস করে, খাওয়াদাওয়া আর বিশ্রাম করে আমাদের শরীরে বল আর মনে খুব ফুর্তি এসে গেছে। দলের সবাই গাঁয়ের লোকের আদরযত্নে খুব খুশি। মাতব্বর টাইপের একটা লোক এল অনেক খাবারদাবার নিয়ে। সে বলল, “আর ক’দিন থেকে যাও। তারপর না-হয় দক্ষিণদিক বরাবর রওনা দিও।”

নৌকা জোগাড় হচ্ছে না। খাওয়াদাওয়া আর ডায়েরিতে লেখাজোখা করে আমি সময় কাটাচ্ছি। মাঝেমধ্যে কিছু পর্যবেক্ষণ করতে হচ্ছে যন্ত্রপাতি দিয়ে। ম্যাপ বানাচ্ছি রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটির জন্য। মোড়ল মোকালোসা এল গল্প করার জন্য। শুনলাম, তার একটা বউ পালিয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, “ক’টা বউ তোমার?”

সে-ব্যাটা নির্দ্বিধায় বলল, “পনেরোটা।”

আমি বললাম, “এতগুলো বউ রাখার দরকার কী?”

সে বলে, “এতগুলো বউ যদি না রাখি, তবে বাড়িতে রান্নাবান্না করার অসুবিধা হয়ে যাবে।”

মোকালোসার ধারণা, আরবরা আমাকে নৌকো দিতে ভয় পাচ্ছে। লেকের উত্তরদিকে গেলে আমি নাকি ওদের দাস-ব্যাবসার ক্ষতি করে দিতে পারি। ঠিক করলাম, নৌকো পেলে আমি যদি দক্ষিণদিকে পাড়ি দিই তবে সবদিক থেকে ভালো হবে।

ইতিমধ্যে গ্রামের একজন দৌড়োতে দৌড়োতে এসে খবর দিল, একজন ইংরেজ আমাকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকে রওনা দিয়েছে। তার নাকি সামনের দিকে দুটো চোখ ছাড়াও পিছনেও দুটো চোখ আছে। কত কী যে রটে এই দেশে!

নৌকো জোগাড় করতে না পেরে আমরা লোয়াঙ্গা নদীর দিকে এগিয়ে চললাম পায়ে হেঁটে। সাত মাইল রাস্তাটার পুরোটাই এবড়োখেবড়ো পাথরে ভরা। ওয়াইইউদের কাছে আবদার করে একটা ঘর পেলাম রাতের আশ্রয়ের জন্য। এদিকে একধরনের সাংঘাতিক আফ্রিকান পিঁপড়ের কামড়ে প্রাণ যায় যায়। সারারাত পিঁপড়ের কামড় খেয়ে আমরা কেউ দু-চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। পরদিন দক্ষিণদিকে রওনা দিলাম, ওদিকে নাকি এই পিঁপড়ের উৎপাত নেই।

এখানে গ্রামের মোড়ল বলল, দুটো নৌকো নাকি লোসেওয়া নামে একটা গ্রামে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু জানতে পারলাম, দুটো নৌকোই ক্রীতদাসদের চালান করার জন্য ব্যবহার করে আরবরা। তাই তারা কোনোমতেই সেই দুটো আমাকে দেবে না। আবার আমাদের পথ চলা শুরু হল, যদি লেক নয়াসা থেকে শিরি নদীর উৎসমুখে পৌঁছতে পারি।

ওয়া-নয়াসা নামে এক বহু প্রাচীন উপজাতির বাস এখানে। স্থানীয়রা নিজেদের মাঙ্গাঞ্জাও বলে থাকে। এদের মাথায় ঘন চুল, শরীরের গঠন শক্তপোক্ত। এরা খুব পরিশ্রমী। চাষ-আবাদ সব মেয়েরাই করে। আর পুরুষেরা সারাদিন মাছ ধরার জাল বুনে সন্ধ্যাবেলা বেরিয়ে পড়ে লেকের জলে মাছ ধরতে। গভীর রাতের আগে তারা ফিরে আসে না বাসায়। লেক নয়াসার পাড়ের সুন্দর সৈকত এখান থেকে দৃশ্যমান।

নয়াসার সৈকত দিয়ে আমরা হেঁটে চললাম। দক্ষিণদিকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বালিয়াড়ি। মধ্যে মধ্যে প্যাপিরাস গাছ দেখা যায়। দুটো পাহাড়ি ঝোরা পেরলাম হাঁটুজলে। এই ঝোরাতে প্রচুর মাছ। লেক থেকে উঠে এসে এই ঝোরায় মাছেরা ডিম পাড়ে। আমরা যে অঞ্চলটা দিয়ে হেঁটে গেলাম, সেখানে একসময় কোনও প্রাচীন গ্রাম ছিল। ভাঙাচোরা কুঁড়েঘর, মাটির বাসনপত্র, পোড়া ইট—সব জানান দেয় যে, একসময় অনেক মানুষ এখানে বসবাস করত। এই এলাকা ছেড়ে তারা চলে গেছে বা তাদের হয়তো দাস বানিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে আরবে। কিছু মানুষের শরীরের হাড়গোড় এদিক ওদিক পড়ে থাকতে দেখলাম।

লেক নয়াসা এখন সামান্যই দূরে। শিরি নদী এখান থেকে পার হলেই হয়। কিন্তু আমি স্থির করলাম আরও একটু দক্ষিণ বরাবর এগোনো যাক। ওদিকে কিছু গ্রাম আছে যেখানে মোড়লরা দেশি লোক ধরে ধরে আরবদের হাতে তুলে দেয় দাস বানাবে বলে। একবার যদি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওদের এই কাজ থেকে বিরত করতে পারি, তবে এবারের অভিযান সার্থক। তিন ঘণ্টা হেঁটে আমরা লেকের ধার ঘেঁষে দুটো অনুচ্চ পর্বতমালা দেখতে পেলাম। একটা পাহাড়ের মাথায় বেশ ঘন জনবসতি দেখা গেল। আর একটা পাহাড়ের ঘন সবুজ জঙ্গলে ঢাকা।

গ্রামের মোড়ল মুকাতের বাড়িটা বিশাল। আরবদের কায়দায় চৌকো মাপের বাড়ি। মুকাতে এই প্রথম কোনও সাদা চামড়ার মানুষ দেখল। সে ও তার দলবলের আমার প্রতি কৌতূহলের সীমা নেই। নানা প্রশ্ন করে করে মাথার পোকা নাড়িয়ে দিল। তার সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠতা হতেই কথায় কথায় দাস-ব্যাবসার প্রসঙ্গ তুললাম। সে জানাল, আরবরা আমাদের আসবার খবর আগেভাগেই তাকে জানিয়ে রেখেছে। তারা ওকে ভয় দেখিয়ে বলেছে, ইংরেজদের আসল উদ্দেশ্য হল আফ্রিকার মানুষদের ক্রীতদাস বানিয়ে ধর্মান্তরিত করা।

মুকাতেকে যখন বললাম আসবার পথে অসংখ্য মরা মানুষের হাড়গোড় দেখে মনে হচ্ছে এই দেশে গণহত্যা করা হয়েছে আরব দাস-ব্যবসায়ীদের স্বার্থে, তখন আমার কথা সে হেসে উড়িয়ে দিল। কিন্তু তার সাঙ্গপাঙ্গদের মধ্যে কেউ কেউ আমার কথায় সায় দিল। তাদেরই একজন হঠাৎ আমার কানে ফিসফিস করে বলে গেল, “মুকাতেকে বলুন না সাহেব, এই মানুষ শিকার করে দাস বানানোর ধান্দাটা যেন ও বন্ধ করে দেয়।”

দেখলাম মুকাতে লোক ভালো। আটখানা ক্যানো জোগাড় করে একটা উপহ্রদ পার করিয়ে আমাদের ছেড়ে দিয়ে এল লেক নয়াসার দিকে। এদিকে আমাদের ভয়ে সেখান থেকে এক দাস-ব্যবসায়ীর দল পালিয়েছে উপত্যকার ভিতর দিকে। একজন মাত্র সহকারী নিয়ে আমি ক্রীতদাসদের খুব কাছ থেকে দেখতে গেলাম। স্থানীয় লোকদের কাছে খোঁজখবর করে একজন নেতা-গোছের লোককে খুঁজে পেলাম। কিন্তু সে আমাদের কোনও গাইড দিতে পারল না। জানলাম, সবাই আমার আসবার খবরে ভীত। এখানে পাশাপাশি দুটো লেক—নয়াসা আর শিরওয়া। এখানে দু-দুটো লেক থাকায় জমিতে খুব ভালো ফসল ফলে। লেকের সুস্বাদু মাছ খেয়ে রসনা তৃপ্তি করলাম। এদিকে আমার আসবার খবরে ততক্ষণে দাস-ব্যবসায়ীরা তাদের আস্তানা ছেড়ে পালিয়েছে।

মোন্ডা নামের স্থানীয় নেতা-গোছের একটা লোক দেখা করতে এল। তাকে খুব একটা সুবিধের লোক বলে মনে হল না। কথায় কথায় সে জানাল, তার নাকি ইউরোপিয়ানদের সম্বন্ধে জানবার প্রচুর ইচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গে সে এতটাই সহজ হয়ে গেল যে লেক টাঙ্গানাইকা পর্যন্ত আমাদের অভিযানে সঙ্গী হতে চাইল। আমি বললাম, “এই অভিযানে কিন্তু অনেক ঝুঁকি, প্রাণও যেতে পারে।”

সে-ব্যাটা দার্শনিকের মতো বলে, “মারা তো একদিন যেতেই হবে, যাওয়ার আগে আমার দেশটা একটু ঘুরে দেখে নিই। আপনার কাছে কত কী শেখার আছে!”

মোন্ডার সাহায্যে অবশেষে সেই দাস-ব্যবসায়ীর দলটাকে খুঁজে পেলাম। ও আমাকে সাবধান করে দিয়ে বলল, “দেখবেন, শেষে এই গাঁয়ে যেন রক্তারক্তি না হয়! ওরা হয়তো আপনার উপর আক্রমণ করে ফেলতে পারে!”

আমি মোন্ডাকে অভয় দিয়ে বললাম, “ওই ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দাও। শুধু আমাকে দেখতে দাও ওদের কাজকারবার।”

obhijaannile (2)

ক্রীতদাসদের দলটায় প্রায় আশি-পঁচাশি জন মানুষ, যাদের মধ্যে বালকের সংখ্যাই বেশি। ছয়জন দো-আঁশলা আরব ওদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। প্রায় সবার গলায় কাঠের দাস শৃঙ্খল। কারও গলায় চামড়ার তৈরি বকলস লাগানো। প্রথমে আমাদের দেখে চারদিক থেকে ওরা ঘিরে ধরল। আমি শান্ত থেকে ওদের কিছু প্রশ্ন করলাম। জানা গেল, এই দাসদের বিক্রি করে দেবার জন্য জাঞ্জিবর নিয়ে যাওয়া হবে। তবে এই দলটাকে সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ওদের তেমন কিছু রোজগার হবে না। আরেক দল আছে যারা সমুদ্র উপকূল থেকে জাহাজে ক্রীতদাস বোঝাই করে জাঞ্জিবরে নিয়ে গিয়ে তাদের বিক্রি করে অনেক চড়া দামে। যখন ওদের বললাম যে এই ব্যাবসা অত্যন্ত ঘৃণার যোগ্য, তারা চুপ করে রইল। কিন্তু আমাদের খাওয়ার জন্য অনেক মুরগি দিয়ে দিল।

মোন্ডা তার গাঁয়ের এক বাচ্চার চিকিৎসা করাল আমাকে দিয়ে। বাচ্চাটা আমার ওষুধে সেরেও উঠল পরদিন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মোন্ডা আমাদের অনেক খাবারদাবার দিয়ে দিল।

মাজিটুদের ভয়

মাউন্ট গোমে পাহাড় এড়িয়ে পথ চলতে চলতে আমরা লেক নয়াসার কাছাকাছি চলে এলাম। একটু পরেই লেকের বিস্তীর্ণ জলভূমি নজরে এল। শিরি নদীর উৎসমুখ পরিষ্কার দেখতে পেলাম। এইখানেই কোথাও বিশপ ম্যাকেঞ্জি চিরনিদ্রায় শায়িত। তিনি এই দেশে দাস-ব্যাবসা তুলে দেবার জন্য বাইবেলের গল্প শোনাতেন। বিশপ মারা যাবার পর আফ্রিকার এই নদীতে ব্যাবসা-বাণিজ্যের তরণীর বদলে চলছে ক্রীতদাস বোঝাই নৌকোর অবাধে যাতায়াত। হয়তো একদিন সুদিন আসবে, দাস-ব্যাবসার অবসান হবে। ততদিন আমি আর বেঁচে থাকব না সেই স্বর্ণযুগ দেখার জন্য।

স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, গতবছর এখানে এক ভয়ংকর ভূমিকম্প হয়ে গেছে। তিন মাস ধরে একটা দ্বীপে ফাটলের মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরিয়েছে। ভূমিকম্পের প্রভাবে সমস্ত বাড়িঘর খুঁটো থেকে উপড়ে গেছে। তবে এখানকার লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষের কাছ থেকে অনেক ভূমিকম্পের গল্প শুনেছে। ভূমিকম্প সম্পর্কে তাদের ধারণা খুব বিচিত্র। তারা মনে করে, আকাশ থেকে বড়ো বড়ো পাথর বৃষ্টি হলে সমুদ্রে তুফান ওঠে। সে তুফান নাড়া দেয় পায়ের তলার জমিটাকে।

এই জায়গাটার নাম পামালম্বে। পাশেই একটা গ্রাম। সেখানে মানুষ আমাদের দেখে পালাতে লাগল। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে, আশ্বাস দিয়ে তাদের মধ্যে কিছু লোককে ফেরানো গেল। পামালম্বেতে খুব শাকসবজি হয়। একধরনের স্বচ্ছ জলজ উদ্ভিদ জলে ভেসে আসে লেকের পাড়ে। বড়ো সুস্বাদু। লেকের জলের মাছ খুব তৈলাক্ত, মিষ্টি খেতে। এই মাছের স্থানীয় নাম কাডিয়াকোলা। একটা জিনিস লক্ষ করলাম, এই এলাকায় ভাষার পার্থক্য বড়ো একটা নেই। মনে হয়, লেক টাঙ্গানাইকা, লেক নয়াসা, এমনকি জাম্বেসির লোকেরাও একই উপজাতি থেকে উদ্ভূত।

মাইল খানেক হেঁটে যেতে একজায়গায় দেখি তিন-চারশো লোক একসঙ্গে লবণ তৈরি করছে। মাটি জলে গুলে প্রথমে তারা একটা দ্রবণ বানায়। একটা বড়ো পাত্রের উপরে ফুটোওয়ালা ঢাকনায় রাখা থাকে একধরনের পাতলা ঘাস। মাটি আর জলের দ্রবণকে ঘাসের তৈরি ফিল্টারের মধ্যে দিয়ে পাঠিয়ে সংগ্রহ করা হয় পাত্রের তলায়। পরিস্রুত জল এরপর আগুন জ্বালিয়ে ফোটানো হয়। জল উবে গেলে পাত্রে পড়ে থাকে লবণ।

টানা দু-দিন পথ চলে আমরা কেপ ম্যাক্লিয়ার পার করলাম। ঘন জঙ্গলে ঢাকা এই পাহাড়ের মাথা নয়াসা লেক থেকে প্রায় ৭০০ ফুট উপরে। একটা জলের ছোট্ট ঝোরার পাশে শুয়ে আমরা একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার চলতে শুরু করলাম। সাত ঘণ্টা একটানা পায়ে হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম এক গ্রামে, যার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদী উসাঙ্গাজি। নদী বয়ে চলেছে নামাসি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে।

পশ্চিমদিকে রওনা দিয়ে পদব্রজে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমরা কেপ ম্যাক্লিয়ারের পাদদেশে এসে পৌঁছলাম। জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ি পথ দিয়ে চলতে লাগলাম। এখানে একটা মনুষ্য বসতি নজরে এল। খরস্রোতা পাহাড়ি নদী উসাঙ্গাজির ধারে আমরা রাত কাটালাম। পরদিন সকালে গ্রামে ঢুকতেই একদল লোক আমাদের ঘিরে ধরল। অনেক জিজ্ঞেস করেও মোড়ল যে কে তা জানা গেল না। অথচ শুনলাম, সে নাকি ভিড়ের মধ্যেই আছে। যেই আমি চালাকি করে বললাম, “নিশ্চয়ই এই গ্রামের মোড়ল একজন বুড়ি মহিলা, যে আমাকে দেখে খুব ভয় পেয়েছে!” অমনি সবাই একটা একচোখো লোকের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠতে সেও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে হাসতে লাগল। পরিচয় বেরিয়ে পড়তে সে আমরা কী কী খেতে চাই জিজ্ঞেস করল।

এই গ্রামটা অয়াওইউদের গ্রামের চাইতে নোংরা। সেখান থেকে বেরিয়ে একেবারে লেক নয়াসার কোল-ঘেঁষা একটা গ্রামে পৌঁছলাম। এদের মোড়ল ভয়ানক চামড়ার অসুখে ভুগছিল। সম্ভবত আরবদের কাছ থেকে আমদানি করা রোগ এটা। কিছু ওষুধ দিতে তার একটু আরাম হল। বাবিসা উপজাতির মানুষ এরা। দাস-ব্যাবসায় আগে ওয়াইইউদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অনেক মানুষ বিক্রি করেছে। এই কাজ করতে গিয়ে আরবদের সান্নিধ্যে এসে এদের অনেকেই এই ছোঁয়াচে রোগের শিকার। তবে এখন আর তারা ওই ব্যাবসা করে না। এরা চাষ-আবাদ করে, পশুপালন করে, কিন্তু পশুদের দুধ দোয়াতে জানে না।

এখানকার মাটি স্পঞ্জের মতো নরম, আঠালো। পা ফেললেই হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে। শক্ত জমি পাওয়া ভার। বর্ষায় নিশ্চয়ই অবস্থা আরও করুণ হয়। পরদিন সকালে গ্রামের মোড়ল মারেঙ্গা টকটকে লাল পোশাক পরে, সঙ্গে দশটা বউ নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে হাজির। তার সঙ্গে বেশিরভাগ আলোচনাই হল চামড়ার অসুখ নিয়ে। কথায় কথায় জানতে পারলাম, এই দেশে স্মল পক্সও একসময় থাবা গেড়েছিল।

একদিন এক আরব দাস-ব্যবসায়ী আমার সহকারী মুসাকে বলে গেল, সামনেই নাকি মাজিটু উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা। তার দলের ছেচল্লিশ জন আরবকে তারা মেরে ফেলেছে, কিন্তু শুধু সেই-ই প্রাণে বেঁচে গেছে। এই কথা শুনে মুসা আর বাকি জোহানা বয়েজ প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল, সামনে এগোতে তারা নারাজ। মাজিটুদের ভয়ে ভীত মুসা বলল, সে নাকি জোহানায় তার বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে চায়। আমি প্রমাদ গোনে মারাঙ্গার কাছে মুসাকে নিয়ে গিয়ে মাজিটুদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। মারেঙ্গা বলল, “ওসব মাজিটু-টাজিটু সব বাজে কথা। সামনে যে পথ ধরে তোমরা যাবে, সেখানে ধারেকাছেও মাজিটুরা থাকে না।”

আমি বুঝলাম, দাস-ব্যাবসায় ক্ষতি হওয়ার ভয়ে আরবটা মুসাকে মাজিটুদের মিথ্যে ভয় দেখিয়ে আমাকে আটকানোর চেষ্টা করছে। মুসাকে বললাম, “মারেঙ্গা স্থানীয় লোক, ওর কথায় আস্থা নেই কেন তোর? কোথাকার কে এক আরবের কথায় বিশ্বাস করে ফেললি?”

মুসা মানতে রাজি নয়। সে মাজিটুর ভয়ে কেঁচো হয়ে গেল। বাকি জোহানার ছেলেগুলো মালপত্র মাটিতে ফেলেই পালাল। এবার একেবারে ছোটো দল হয়ে গেল আমার। ক্যানোতে মালপত্র চাপিয়ে আমরা লেকের দিকে নামতে থাকলাম। মাউন্ট মালান্ডিনির নীচে নেমে দেখলাম জায়গাটা আমার চেনা, আগের অভিযানে এখানে এসেছি। গ্রামটা আগের চাইতে বেশ বড়ো হয়ে গেছে। মোড়ল কিমসুসা আমাদের আসবার খবর শুনে অনেক খাবারদাবার পাঠিয়ে দিলেও নিজে এল না। বিরাট পাত্র হাতে তার এক বউ এসে আমাদের অনেকটা পানীয় দিয়ে গেল। পরদিন কিমসুসা নিজে এল। পুরোনো বন্ধুকে দেখে সে বেজায় খুশি। তার পিছনে পিছনে এল একটা বিরাট মোটাসোটা ভেড়া। ভেড়াটা এত বড়ো যে, তিন-চারজন লোক মিলে তাকে ধরে-বেঁধে নিয়ে এল। কিমসুসা নাকি আমাদের খাওয়ার জন্য ভেড়াটা নিয়ে এসেছে। এইটা হচ্ছে আফ্রিকার লোকের ভালোবাসা জানানোর চরম উপায়—অতিথিদের অনেক মাংস আর মদ ভেট দেওয়া।

কিমসুসা জানাল, গতবার আমার দেওয়া উপদেশ পালন করার ফলে আজ ওর গ্রাম তিনগুণ বড়ো হয়েছে। শুধুমাত্র মানুষ বিক্রি করা ছেড়ে চাষ-আবাদে মন দেওয়ার জন্য প্রচুর বিত্তশালী হয়েছে তারা।

আমি বলি, “হাতির দাঁতের ব্যাবসা করো না কেন? এতে অনেক লাভ আছে। তাহলে মানুষ বেচার দরকার হয় না।”

সে বলে, “নিজের লোকদের যে হাতির দাঁত কিনে আনতে টাকাপয়সা দিয়ে পাঠাই, তো তারা সব মেরে দেয়। আর আরবদের যদি টাকা দিই তবে ওরা এনে দেয় ঠিকই, কিন্তু তাতে লাভ কম হয়।”

বুঝলাম, মাঙ্গাঞ্জা জাতির লোকেরা, যারা ওর নিজের দেশের লোক, তাদেরই কতখানি অবিশ্বাস করে কিমসুসা।

এখান থেকে আমরা যাব মারাভি। কিন্তু মাল বইবার জন্য কুলি পাওয়া মুশকিল হল। কিমসুসার সঙ্গে আলোচনা করেও কোনও লোক পাওয়া গেল না। কেউ সেদিকে যেতে রাজি নয়। শুধু মাজিটুদের ভয় নয়, মারাভির দিকে নাকি একদল আরব দাস-ব্যবসায়ী সেখানকার মানুষের হাতে প্রাণ দিয়েছে। তাই মাঙ্গাঞ্জা মানুষদের মনে এমন ভয় চেপে বসেছে যে কাউকে রাজি করানো গেল না ভার বহন করার জন্য। কিমসুসা বলল, সে নিজে তার বউকে সঙ্গে নিয়ে কুলির কাজ করতে রাজি আছে। বন্ধুর কোনও অসুবিধা তার একেবারে না-পসন্দ। কিন্তু গ্রাম-প্রধানকে কুলি বানানোর কোনও ইচ্ছেই আমার হল না।

এদিকে আমার এক ভারবাহক চুমাকে দেখেই স্থানীয় এক মহিলা নিজেকে তার পিসি বলে পরিচয় দিল। চুমা খুব ছোটবেলায় ক্রীতদাস হয়ে গিয়েছিল। তাই সে বার বার তার বাবা আর মায়ের নাম জিজ্ঞেস করে সেই মহিলাকে পরীক্ষা করতে লাগল। শেষে সে একাবারে নিঃসন্দেহ হয়ে গেল যে, এই মহিলাই তার পিসি। চুমার পিসির কথায় সে আর আমার সঙ্গের আরও কয়েকটি ছেলে মাজিটুদের হাতে আমাদের প্রাণ যাবার বিষয়টা আরও বড়ো করে দেখতে লাগল। তারা আর এগোতে অস্বীকার করল। এবার আর কিমসুসাকে আটকানো গেল না। সে নিজে তার সব বউ সঙ্গে নিয়ে আমার সঙ্গে মারাভি পর্যন্ত যাবে বলে জেদ ধরে বসল।

আমরা উত্তরদিকে দলবল নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। প্রায় সাত মাইল হাঁটার পর আমরা পৌঁছলাম গডেজা নদীর পাড়ে এক গাঁয়ে। এখানে এসে কিমসুসার আচার-আচরণ একেবারে যেন রাজাদের মতো হয়ে যেতে লাগল। তার নির্দেশে আমাদের জন্য নানা সুস্বাদু মাংস আর পরিজ রান্না করল তার বউয়েরা। কিমসুসা খুব গর্বের সঙ্গে গাঁয়ের সব লোককে জানাতে লাগল যে এই সাদা চামড়ার মালিক তার পরম বন্ধু।

আরও এগোতে থাকলে প্রচুর কৌতূহলী লোক জুটে গেল দলে। এরা সবাই ওয়াইইউ উপজাতির লোক। অনাহূতের মতো তারা যখন-তখন আমার তাঁবুতে ঢুকে বন্দুক আর গুলি চাইতে লাগল। আরবদের সান্নিধ্যে এসে এদের বারোটা বেজে গেছে। কিমসুসা কষে তাদের ধমক দিল। কিন্তু দু-চারজন কুলি জোগাড় হতে আমি কিমসুসাকে বিদায় দেওয়াই শ্রেয় মনে করলাম। ওর বউদের আমি পারিশ্রমিক দিলাম।

লেক নয়াসা থেকে প্রায় বাইশ হাজার ফুট উঁচুতে পাহাড়ে চড়তে আমাদের মাত্র তিন ঘণ্টা লাগল। একটা গ্রাম দেখতে পেলাম, পাহাড়ের নীচে আরও একটা। জানতে পারলাম দুই গ্রামের মানুষের মোটে সদ্ভাব নেই। পরস্পরকে তারা বেশ ভয় করে। উপরের গ্রামে আশ্রয় দিল সেই গ্রামের মোড়ল গম্বা। দলে দলে লোক আমাকে দেখতে এল। এমন বিচিত্র প্রাণী নাকি ওরা কোনোদিন দেখেনি।

এখানে একধরনের শক্ত ঘাস জন্মায়। সেই ঘাস বুনে তৈরি হয় পোশাক। মেয়েরাই সেই পোশাক বেশি পরে। পুরুষদের গায়ে ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক। এখানে কোনও জংলি জানোয়ার দেখতে পাওয়া যায় না।

চলার পথে প্রতিটি বাঁকে আমরা অনেক মানুষের দেখা পেলাম। তারা আমাদের দেখার জন্যই দল পাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অনেক গ্রাম, বহু মানুষ, তাদের কাঁধে তির-ধনুক। এরা বাঁশের তৈরি লম্বা লম্বা ধনুক ব্যবহার করে। কারো-কারো কাছে লোহার চাকুও আছে। পুরোনো মিশরের মানুষদের মতো এখানকার নারীপুরুষ নির্বিশেষে কানে ঘাড় পর্যন্ত লম্বা দুল পরে। কোনো-কোনো মেয়েরা আবার তাদের বাহুতে ছুরি দিয়ে কেটে দাগ কেটেছে। কারও আবার সারা গায়ে এমন দাগ আছে। এই দাগগুলো তৈরি করতে গিয়ে তাদের কী যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে, সেই ভেবে শিউরে উঠলাম। তবে এই মারাভি উপজাতির লোকেরা যতই আদিম যুগে পড়ে থাকুক না কেন, তারা সবাই খুব অতিথিবৎসল।

মোড়ল গম্বার অনুরোধে আমি এখানকার মানুষদের সামনে যিশুর বাণী শোনালাম। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, মানুষ বেচে দেওয়া পাপ। সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান, তাই তাদের নিয়ে ব্যাবসা করে আরবরা ভুল করছে। মানুষ ব্যাবসার কারণেই আফ্রিকার উপজাতিদের মধ্যে লেগে আছে নিরন্তর যুদ্ধ।

তামিয়ালা নামের একটা জায়গা থেকে আবার আমাদের চলা শুরু হল। সকালটা ছিল বেশ মনোরম। সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল হলুদ ঘাসের ঘন ঝোপের মধ্যে দিয়ে। লেভিজে নদী পেরিয়ে গেলাম আমরা। এই নদীর জল স্বচ্ছ আর স্বাদু। এই নদী গিয়ে মিশেছে লেক নয়াসায়। এখানে নানা ফল আর ফুলের গাছ। একটা নতুন ফল দেখলাম, স্থানীয়রা বলে বকন্টো। সেটি নাকি খুব সুস্বাদু। ফুলের গাছও আছে অনেক। গাছগুলো ফুলের ভারে ঝুঁকে পড়েছে।

চার মাইল হাঁটার পর একটা গ্রাম এল, নাম চিটিম্বা। এদের তৈরি কুঁড়েঘরগুলো খুব মজবুত। ছাতগুলো এমনভাবে তৈরি, যাতে একটু আলোও ঘরের মধ্যে ঢুকতে না পারে। আলোর চলাচলের একমাত্র রাস্তা হল ঘরের একটিমাত্র দরজা। গাঁয়ের মোড়ল কুলু আমাদের সহজে যেতে দিল না, দুইদিন সেখানে বিশ্রাম নিতে বাধ্য করল। আমার জন্য তারা সুন্দর একটা কাঠের টুল এনে দিল বসার জন্য। গাছের গুঁড়ি কেটে বানানো টুলটায় নানা কারুকাজ করা, যা সত্যিই বিস্ময়কর। কুলুকে আমাদের সাহায্য করার জন্য একটুকরো কাপড় দিতে সে খুব খুশি হল, কিন্তু তার মনে হল সে তার কাজের বিনিময়ে অনেক বেশি দাম পেয়ে গিয়েছে। জনে জনে সেটা আবার বলেও বেড়াল।

obhijaannile (3)

পরদিন চলতে চলতে আমরা এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম, যেখানে সারি সারি ছোটো ছোটো পাহাড়। পাহাড়গুলো সবক’টাই প্রায় চৌকো আকৃতির, যার ঢাল একেবারে খাড়া। পাহাড়ের নীচে চারদিক ঘিরে মানুষ গ্রাম বানিয়েছে, শস্য ফলিয়েছে, গাছপালা দিয়ে ঘিরে রেখেছে তাদের বসতি। পাহাড়ের মাথায় এরা শস্যভাণ্ডার তৈরি করে রেখেছে। অত উঁচুতেও সেখানে এরা একটা করে গোরু বেঁধে রাখে। এই ফসলের গোলা তখন ব্যবহার হয়, যখন এখানে লড়াই বাধে। গোরুটা নাকি লড়াইয়ের পূর্বাভাস দেয়! কী বিচিত্র সংস্কার!

অক্টোবরের মাঝামাঝি। আমরা একটা নদী পেরলাম, যার নাম লেভিঙ্গে। এই নদীটা উত্তরের দিকে গিয়ে বাঁক নিয়ে লেক নয়াসায় গিয়ে পড়েছে। পাহাড় পেরিয়ে এবার এবড়োখেবড়ো সমতলভূমিতে এদিক-ওদিক কয়েকটা টিলা দেখা যাচ্ছে। মিষ্টি হাওয়ায় মনে হচ্ছে যেন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছি। হঠাৎ স্থানীয় একটা লোক এসে বলল তার গ্রামের অনেক লোক নাকি বাবিসায় গিয়েছে হাতির দাঁত কিনতে। তাকে একটা কম্বল দিলে সে কিছু লোক দিতে পারে আমাদের গাইড হিসাবে।

প্রস্তাবটা মন্দ ছিল না, কিন্তু আমরা তাকে কম্বল দিতে অস্বীকার করলে লোকটা বেঁকে বসল। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, সে কোনোদিন কোনও আরব দেশের মানুষ দেখেনি। আমি বললাম, “তোমাদের উচিত ওদের থেকে দূরে থাকা। নচেৎ তারা অবাধে মানুষ বিক্রির ব্যাবসা চালাতে থাকবে।”

তার মতে, ছোটো ছোটো গ্রামে যেসব মাতব্বর আছে, তাদের কারও মধ্যে একতা নেই, কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। তাই আরবদের দাস-ব্যাবসা থেকে দূরে থাকা প্রায় অসম্ভব।

এই এলাকায় দু-রকম লোক থাকে—এক, যারা পাহাড়ে থাকে, তাদের বলা হয় কান্ঠুন্ডা, দুই, যারা সমতলে থাকে, তাদের বলে চিপেটা। এরা মাঙ্গাঞ্জা উপজাতির থেকে বেরিয়ে এসে পৃথক হয়েছে, তাই এদের ভাষার তারতম্য সামান্য। পথ চলতে গিয়ে বহু মানুষের সঙ্গে আমাদের দেখা হচ্ছে। সবাই আমাদের দেখামাত্র বসে পড়ছে। আমরা হাতে দু-বার বুকে আঘাত করে বলছি, ‘রি পেটা, রি পেটা’, যার অর্থ হল, আমাদের যেতে দাও। তারা এর প্রত্যুত্তর দিচ্ছে হাতে তালি দিয়ে।

স্থানীয় কিছু লোক আমাদের সঙ্গী হল। তাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, উত্তরের দিকে মাজিটুদের খপ্পরে পড়ে যাওয়ার ভয় আছে। পশ্চিমদিকে পাহাড়ের ও-পারে একটা জায়গা আছে যার নাম চিন্ডান্ডো। সেখানে পর্তুগিজরা যেত সোনার খোঁজে। সোনা তো দূরের কথা, তারা হাতির দাঁত পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারেনি সেখান থেকে। আমরা ছোট্ট একটা নদী পেরিয়ে গেলাম, যার নাম চিকুয়ো। এটাও উত্তরমুখী বয়ে গিয়ে লেক নয়াসায় মিশেছে।

রাস্তায় একটা কামারশালা দেখতে পেলাম। একটা লোক খুব মন দিয়ে হাপরের নীচ থেকে লম্বা একটা ডান্ডা দিয়ে খুঁচিয়ে স্ল্যাগ বার করছে। এরা ছোট্ট মাটির ঢিপির উপর কামারশালা বানায়। উপর থেকে ধাতুর আকর আর চারকোলের মিশ্রণ ঢেলে দিয়ে নীচ থেকে আগুন লাগিয়ে দেয়। হাপর দিয়ে আগুনের তাত বাড়াতে হয়। এইভাবেই মানুষ কয়েক হাজার বছর আগে লোহা বানাত।

এবার মাটি উত্তপ্ত হয়ে উঠল দিনের বেলাতে। সূর্য যত উপরে উঠতে লাগল, তত মাটিতে পা রেখে চলা দায় হয়ে উঠল। এখানে গ্রামগুলোতে মানুষ খুব গরিব। তাদের গায়ে গাছের ছাল দিয়ে তৈরি একধরনের পোশাক, তাও নামমাত্র। সবার গায়ে গয়না মানে গায়ের উপর ছুরি দিয়ে কেটে তৈরি করা আঁকাবাঁকা উল্কি।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা কামারদের গ্রামে পৌঁছলাম। এখানে মোড়লের নাম চিসুম্পি। সে নামেই মোড়ল। নিজের ছেলের পিটুনি খেয়ে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে বলে আমার কাছে সাহায্য চাইল। এখানে ক্যাম্প পাতার কোনও ইচ্ছেই আমার হল না। দুটো ছোটো ছোটো নদী পার হয়ে একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম, যেখানে চারদিকে গাছের সারি। এখানে প্রচুর জংলি জানোয়ার আছে, কারণ আমার নজরে এল জানোয়ার ধরার ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে অনেক জায়গায়।

এই গায়ের নাম পারিতালা। মোড়লের নাম ওহিতিকোলা। সে গেছে পাশের গায়ে সালিশি সভায়। একটা চোর নাকি সেখানে ভুট্টা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। তার বিচার হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই সালিশি সভা চারপাশের গুটিকতক গ্রামের মোড়লদের নিয়ে হয়ে থাকে। একে এরা বলে মিলান্ডো। গাঁয়ের মেয়েকে ইলোপ করার চেষ্টাই হোক, বা চুরি, ধরা পড়লে দোষীকে নিয়ে আসা হবে মিলান্ডোর সামনে। তাকে বিষ খেতে দেওয়া হবে। যদি সে দোষী হয়, তবে মরে যাবে, নয়তো বিষ বমি করে বেঁচে গেলে প্রমাণিত হবে নির্দোষ। সারাদিন কাটিয়ে সন্ধের দিকে ওহিতিকোলা ফিরে এল। শুনলাম ধরা পড়া চোর বিষ বমি করে বেঁচে গিয়েছে।

মোড়ল না থাকায় গ্রামবাসীরা আমাদের কিছুই খাওয়ার জন্য দেয়নি। সে আসতে ছাগলের মাংস আর পরিজ পাওয়া গেল। খিদের জ্বালা মিটল আমাদের।

দু-একদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার চলা শুরু। ওহিতিকোলা আমাদের সঙ্গী হল। লিলঙ্গে নদীর ধার দিয়ে পশ্চিমের দিকে এগোতে লাগলাম। মাসুম্বা গ্রামের মোড়ল আমাদের সঙ্গে দেখা হতেই ওষুধ ছাড়া আর যাবতীয় জিনিস চেয়ে বসল। খানিকটা কাপড় তাকে দেওয়া হল, কারণ এই রসদও আমাদের ফুরিয়ে আসছে।

পাহাড়ের কোলে এই এলাকায় বেশ গাছপালা আছে। তবে পথে আকাশিয়া গাছের কাঁটাতে পথ চলা বেশ অস্বস্তিকর হচ্ছিল। আমাদের গাইড মোপান্ডা নদীর ধার ছেড়ে ভিতরের দিকে হাঁটতে বলল। এইভাবে এগোলে নাকি সব চাইতে কাছের নিরাপদ এক গ্রামে আমরা পৌঁছে যাব।

পথে একদল বুনো হাতির দেখা পেলাম। জঙ্গলে গাম কোপাল গাছ উপড়ে গাছের শিকড়ের নরম অংশ চিবিয়ে খেতেই ব্যস্ত তারা। তাদের এড়িয়ে অন্য রাস্তা ধরলাম। অনেক বুনো মোষ দেখা গেল জঙ্গলে। দেখতে পেলাম একপাল কৃষ্ণসার হরিণ, একেবারে তির ছোড়া দূরত্বে। দলের একজন তির চালিয়ে একটা হরিণ বধ করল। তারপর আমরা সেই সুস্বাদু হরিণের মাংস খাব ভেবে আনন্দে প্রায় নৃত্য করছি, এমন সময়ে শুনি পাশের এক গ্রাম থেকে মাজিটুদের আক্রমণে প্রাণ হারানোর ভয়ে মানুষ পালাচ্ছে। আমি মোপান্ডাকে নিয়ে সেই গ্রামে গিয়ে প্রকাণ্ড মরা হরিণটা বয়ে নিয়ে যাবার জন্য লোক খুঁজতে যেতে চাইলাম। একটু এগিয়েই ফিরে আসতে হল। দেখি একদল ভয়ার্ত মানুষ আমাদের দিকে প্রাণভয়ে ছুটে আসছে। তারা মাজিটুদের তাড়া খেয়ে ঘরদোর ছেড়ে জঙ্গলে পালিয়ে এসেছে।

সব মানুষকে জড়ো করে আমি আশ্বস্ত করলাম। এদিকে আমার নিজের দলের ভারবাহীরা দল ছেড়ে চলে যেতে চাইল মাজিটুদের হাত থেকে বাঁচতে। তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে জঙ্গল ছেড়ে জালানিয়ামা পাহাড়ের উপরে চড়ে গ্রামের দিকে এগোতে লাগলাম। পাহাড়ের উপরে থাকলে আমাদের সম্পত্তি সুরক্ষিত থাকবে আর মাজিটুদের অতর্কিত হানা থেকে নিজেদের আমরা বাঁচাতে পারব।

পরদিন সকালে শুনি মাজিটুরা সব গ্রাম ছেড়ে দক্ষিণের দিকে চলে গেছে। এ-যাত্রা প্রাণে বেঁচে গিয়ে আমার সঙ্গীরা খুব খুশি। সমতলে নামতে নামতে চোখে পড়ল, অনেক গ্রাম চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এরাও নিজেদের বলে ‘চিপেটা’। জঙ্গলের রাস্তা ধরে গ্রামের কাছে এসে দেখি মানুষ উদ্বিগ্ন মুখে মাজিটুদের ভয়ে সতর্ক হয়ে অস্ত্র হাতে গ্রাম পাহারা দিচ্ছে। দূরে ধোঁয়া দেখে বোঝা গেল কয়েকটা গ্রামে মাজিটুরা সব জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। মহিলা আর বাচ্চারা তখনও পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে, রয়ে গেছে শুধু সমর্থ পুরুষেরা। এখানে পুরুষরা মাথায় পালক সেঁটে রাখে।

আমাদের দেখে গ্রামবাসীরা খুব খুশি হল। আমাদের আসবার খবর পাঠাল মোড়লের কাছে। সে নাকি মাজিটুর হাত থেকে বাঁচার জন্য পাহাড়ে রাত কাটিয়ে সেখানেই বসে আছে। সন্ধের আগে সে এল না। কিন্তু তার অবর্তমানেই গ্রামের লোকে আমাদের জন্য খুব মজবুত কয়েকটা ঘর বাস করার জন্য দিয়ে দিল।

এই গ্রামের নাম পামালোআ। মোড়ল চিমুনা এসে আমাকে পীড়াপীড়ি করতে লাগল এই গাঁয়ে ক’টা দিন থেকে যেতে। সে নাকি চিপেটাদের মধ্যে সবচাইতে প্রভাবশালী নেতা। আমি বললাম, এইভাবে সব মোড়লদের আতিথেয়তা নিতে গিয়ে যদি বেশি করে বিশ্রাম নিই, তাহলে আমার এই দেশে আসার আসল উদ্দেশ্য আর কোনোদিনই সফল হবে না।

এরপর লাইন দিয়ে পিলপিল করে লোক আসতে থাকল আমাদের দেখতে। এরা কোনোদিন বাইরের জগতে পা রাখেনি, আমার মতো বিচিত্র প্রাণী তাদের কৌতূহল জাগাবে বৈকি? সবচাইতে প্রবীণ মানুষটি যখন আমাকে দেখতে এল, তার ফোকলা দাঁতের হাসি দেখে মন ভালো হয়ে গেল। একমাত্র সে-ই বইয়ের কথা জানে, আর জানে ছাতা বলে একটা জিনিস হয়। জন্মের পর এই চৌহদ্দির বাইরে পা না রাখলে কী হয়, তার বিভিন্ন ব্যবহারিক জ্ঞান দেখার মতো! লোকটা যেমন চাষের কায়দাকানুনের খুঁটিনাটি সব জানে, আবার জানে কীভাবে ঝুড়ি, মাটির পাত্র, গাছের ছালের পোশাক বানাতে হয়। আবার শুনি, মাছ ধরার জাল তৈরি থেকে পশু ধরার ফাঁদ বানানো—সবেতেই সে বেজায় পটু। এমন মানুষের জন্য সম্ভ্রম ছাড়া আর কী দেখানো যেতে পারে?

চিমুনা বাতের ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছিল। আমি তাকে মলম দিতে, সেই মলম লাগিয়ে তার ব্যথা কমে যেতে খুশি হয়ে সে আমাদের একটা বড়ো মুরগি আর এক বিরাট পাত্র বোঝাই পরিজ দিয়ে গেল। যাবার সময় বলে গেল, “সাহেব, একটু তোমার বন্দুকটা কয়েকবার দেগে দাও দেখি। আমাদের শত্রু মাজিটুরা বুঝুক যে আমরা দুর্বল নই।”

পরদিন চিমুনাকে কিছু কাপড় দিয়ে বিদায় দিলাম। এরা কিন্তু খাবার আর আতিথেয়তার বিনিময়ে আমার কাছে কিছুই চায়নি। তবু এদের দারিদ্র দেখে বড়ো কষ্ট পাই। হয়তো কোনোদিনই এদের সঙ্গে আর দেখা হবে না, কিন্তু তাদের সারল্য চিরকাল মনে থাকবে, যতদিন বাঁচব। এরা সত্যিই বড়ো ভালো।

নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি। আমরা বুয়া নামের একটা ছোট্ট নদী পার হলাম। চওড়ায় এই নদী আট ফুটের কাছাকাছি, সেখানে হাঁটুজল। উত্তরের এক সুন্দর গাছগাছালি ঢাকা পর্বত থেকে বেরিয়ে এসে পাক খেতে খেতে সমতলে নেমে এসেছে একটা গ্রামকে বেড় দিয়ে। পার হতেই পৌঁছে গেলাম কানিয়েঞ্জে গ্রামে। রাস্তায় অনেক লোহা বানানোর চিহ্ন। কোথাও পরিত্যক্ত কামারশালা, কোথাও ভাঙা মাটির পাত্র, ধাতু গলানোর লম্বা নল, আবার কোথাও ভাঙা হাপর আর লোহার ধাতুমল পড়ে থাকতে দেখা গেল। এই মাটির নীচে যে আকরিকের খনি, তাও বুঝলাম।

কানিয়েঞ্জে গ্রামে যখন আমরা পৌঁছলাম, তখন সেখানকার মোড়লমশাই গেছেন চারকোল কুড়োতে। গাছ পুড়িয়ে চারকোল তৈরির চিহ্ন যত্রতত্র। তাই ফলের গাছ বাদ দিয়ে অন্যসব গাছ কাটা পড়েছে মানুষের হাতে। গ্রামের লোকেরা মাজিটুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। গতবছরের যত শস্য মজুদ ছিল গোলায়, সব তারা কেড়ে নিয়ে গিয়েছে। লোকে তাই খেতে না পেয়ে খুব কষ্টে আছে। গ্রামের এক দরিদ্র বুড়ো এসে খানিকটা খাবার দিয়ে গেল তবু। এদের মন খুব বড়ো। সন্ধের দিকে মোড়ল এল। খুব ফুর্তিবাজ লোক, মিশুকে। জানা গেল, এই গ্রামের বেশিরভাগ লোক হয় ঢালাইকর, নয়তো কর্মকার। তারা নাকি লোহা গড়ার দেবতা চিসুম্পির কাছ থেকে এই বিদ্যে বহুযুগ আগে শিখে এখন পেশা করে নিয়েছে। আসলে নাকি তারা লেক নয়াসার বাসিন্দা। এই এলাকায় একটা দারুণ সুস্বাদু ফল পাওয়া যায়, যাকে ওরা বলে বিউ। অনেকটা তালগাছের মতো দেখতে এই ফলের গাছগুলো।

এই গ্রাম ছেড়ে পরদিন সকালে চার মাইল হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম কানিয়েঞ্জেরি মপন্ডা গ্রামে। এখানে আসতেই প্রবল ঝড়বৃষ্টি আর বজ্রপাত শুরু হল। গ্রামের লোকেরা একটা কুঁড়েঘরে আমাদের আশ্রয় দিল। এখানে প্রাকৃতিক দৃশ্য বড়ো মনোরম। শুনলাম উত্তর দিশায় গেলে নাকি অনেক খাবার পাওয়া যাবে।

একের পর এক নদী পার হতে হতে একটা গ্রাম এল, সেখানেও খাবার পাওয়া দায়। মাজিটুরা সব কেড়ে নিয়ে গেছে। কিছু ফল পাওয়া গেল শুধু খাওয়ার জন্য। আবার চলা শুরু করে জঙ্গলে ঢাকা এক গ্রাম দেখতে পেলাম। সেই গ্রামের তিনদিক গভীর ঝিল, আর একটা দিক শক্তপোক্ত কাঠের তৈরি বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত। কাজেই শত্রুর আক্রমণ আগলানো যায়। গ্রামের মোড়ল জিউরে জানাল, মাজিটুরা এখানে উৎপাত করতে এসে সুবিধা না করতে পেরে চলে গেছে। খাবারদাবার লুট হয়নি। এখানে লোকে আমাদের কাপড়ের বিনিময়ে খাবার দিল নিঃসংকোচে। ওরা নিজেদের অচেওয়া উপজাতির মানুষ বলে মনে করে। এখানে পুরুষদের চুল এমন করে বেঁধে রাখা, দেখে মনে হয় বুঝি হাতির লেজ। মেয়েরা ঠোঁট ফুটো করে ধাতুর চাকতি আর কাঠের টুকরো লাগায়। এই গয়নাগুলো ঝুলে থাকে চিবুক পর্যন্ত। এখানে কুঁড়েঘরগুলো গা ঘেঁষাঘেঁষি করা। মাঝে বাচ্চাদের খেলার জন্য ছোটো ছোটো জায়গা ছাড়া।

আমার দুই মালবাহক জ্বরে পড়ল। দু-একদিন এখানে থেকে না গিয়ে উপায় নেই। এদিকে এখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি। তাই গাঁয়ের লোকেরা আমাকে প্রার্থনা করে বৃষ্টি আনতে বলল। আমি ওদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে প্রার্থনা করে বৃষ্টি ডেকে আনা যায় না। কিছুই ওদের মাথায় ঢুকল না বলেই মনে হল; শুধু মোড়ল আমার কথায় সায় দিল।

এই এলাকায় প্রচুর নীল রঙের মটর চাষ হয়। তাই গাঁয়ের লোকের কাছে এই মটরের বেশ কদর আছে। তারা এই ফসলকে বলে চিলোবে। এখন এই মটরগাছ থেকে মটর তোলা হচ্ছে। সেদ্ধ করে খাচ্ছে লোকে। আমার আগ্রহ দেখে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমার দেশে এই অনবদ্য ফসল পাওয়া যায় কি না। আমি মাথা নাড়াতে সে বড়ো দুঃখ পেয়ে বলল, কী গরিব দেশে আমি থাকি, যেখানে চিলোবে পাওয়া যায় না।

এবার যাব লোয়াঙ্গার দিকে। লখুজয়া নদীর উপর দিয়ে হেঁটে চললাম আমরা। হেঁটে চললাম, কারণ সেই নদীতে এখন শুধুই ধু-ধু বালি। কোথাও কোথাও অবশ্য নদীর বুকে জমা জলও দেখতে পেলাম। ক্রমশ জঙ্গল এখানে বেঁটে হয়ে আসছে। গাছগুলো লম্বা নয়। মানুষ নদীর ধারে গ্রাম বানিয়ে বাস করে। তাদের গ্রামগুলো সব মজবুত কাঠ আর মাটির তৈরি দেওয়াল দিয়ে সুরক্ষিত করা। উত্তর-দক্ষিণে উঁচু পাহাড়।

গ্রামের প্রধান এল আমার সঙ্গে দেখা করতে। তাকে দেখতে মাঙ্গাঞ্জা উপজাতির মন হল। কিন্তু সে-ব্যাটা নিজেকে ইছেওয়া উপজাতির মানুষ বলে দাবি করে বসল। তার মতে শুধু এখানে নয়, যেদিকে চলেছি আমরা, সেখানে সবাই ইছেওয়া উপজাতির, মাঙ্গাঞ্জা নয়। তার কাছেই জানতে পারলাম, এখানে বেশিরভাগ মানুষ লোহা বানানো আর লোহার জিনিস তৈরির সঙ্গে জড়িত। লোহার খোন্তা বানিয়ে ওরা লোয়াঙ্গায় বিক্রি করে কাপড়ের বিনিময়ে। চুল্লি থেকে একখণ্ড লোহা আর তাদের বানানো খোন্তার নমুনা দেখিয়ে গেল মোড়লমশাই।

এই গ্রামে দুইজন ওয়াইইউ উপজাতির লোকের দেখা মিলল। তারা নাকি আগে দাস ছিল। কিন্তু ওদের দুজনের মালিক মাজিটুদের হাতে প্রাণ দিয়েছে বলে লোক দুটোর কোনও কাজ নেই। ওরা কুলি হিসাবে তাদের আমার দলে নিতে পীড়াপীড়ি করতে লাগল। অগত্যা ওদের নিলাম দলে, যদিও জানি পালিয়ে আসা দাসেরা খুব ধূর্ত হয়। তবে লোকগুলোকে দেখে আমার ভালো মানুষ বলেই মনে হল।

এখানে সারাদিন ধরে ‘ট্যাপ ট্যাপ, টুপ টুপ’ শব্দ শোনা যাচ্ছে চারদিকে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, গাছের বাকল দিয়ে কাপড় তৈরি হচ্ছে। প্রথমে এরা গাছের বাকল কাদাজলে ডুবিয়ে রাখে একটা গর্তে। যখন উপরের খোলসটা আলাদা হয়ে যায়, তখন পাতলা ছাল কাঠের গুঁড়ির উপর রেখে কাঠের হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হয়। এতে ছাল নরম হয়ে কাপড়ের মতো হয়ে যায়।

পাহাড়ি এলাকা দিয়ে পশ্চিমের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। এখানে জন-মনুষ্যির বাস নেই। এই এলাকার নাম কেটেটে। রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হল। এদিকে পানীয় জল ফুরিয়ে গেছে। সকালেও বৃষ্টি থামার নামগন্ধ নেই। বাধ্য হয়ে আবার লখুজোয়া নদীর দিকে চললাম পানীয় জলের সন্ধানে। পথশ্রমে আর চলার মতো ক্ষমতা নেই শরীরে। তবু এগোতে হবে।

দু-দিন পর একটা গ্রামে এলাম যেখানে বাঁশ দিয়ে চারদিক ঘেরা। মাজিটুদের দেখাদেখি বাবিসা উপজাতির লোকেরাও মাঙ্গাঞ্জাদের ধরে বেচে দেয় সুযোগ পেলেই। অবাক লাগল, যখন দেখি গাঁয়ের ঠিক মাঝে একটা দু-ফুট উঁচু কুঁড়েঘর। শুনলাম এই এলাকার সব গাঁয়ে মানুষ এমন একটা করে ছোটো কুঁড়েঘর বানায়। যে-সমস্ত বাচ্চারা অকালে মারা যায়, তাদের জন্য ওরা খাবার রেখে আসে রান্না করে। ওদের বিশ্বাস, মৃত আত্মারা এসে সেইসব খাবার মহা আনন্দে খায়।

পরদিন সব গ্রামবাসী মাজিটুদের ভয়ে পাহাড়ে দৌড় দিল। আসলে মাজিটুরা নয়, বাবিসারা ওদের তাড়া করেছিল, ঠিক যেমনভাবে হায়না শিকার তাড়া করে বেড়ায়। এদিকে উত্তরদিকে রওনা দেবার জন্য একটা গাইড দরকার। কপালে তাও জুটল না। গাইড ছাড়াই আবার উত্তরমুখে রওনা দিলাম।

চন্ডে জঙ্গলে এসে আটকে গেলাম বৃষ্টিতে। বেলার দিকে বৃষ্টি নামে, আর রাতের দিকে বন্ধ হয়ে যায়। ফুটিফাটা মাটি দেখা যাচ্ছে এখনও, তাই বোঝা যায় বহুদিন এখানে বৃষ্টি হয়নি। সকালের দিকে দেখি পাখিরা দল বেঁধে গাছের মাথায় বাসা বানাবার জন্য হট্টগোল বাধিয়ে দিয়েছে। বৃষ্টি আসাতে ওরাও খুশি।

স্থানীয় এক লোকের দেখা মিলল জঙ্গলে। সে আমাদের রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যেতে রাজি হল। গাইড না নিলে এই জঙ্গলেই সারাজীবন ঘুরে মরতে হবে। জঙ্গলের পথ বলতে বোঝায় স্থানীয় লোকদের শিকার করতে যাওয়ার চেনা পথ। সেই পথ ধরে চলতে চলতে একটা বিরাট বাওবাব গাছের তলায় এসে আমরা বিশ্রাম নিলাম। গাছের মাথায় তখন এক ঝাঁক আফ্রিকান সারস পাখি মারাবো তাদের বাসা বাঁধছে। পায়ের চিহ্ন দেখে বুঝলাম এই জঙ্গলে নানাজাতের হরিণ, মোষ, জেব্রা সব আছে। যা নেই, তা হল আমাদের কাছে খাওয়ার জন্য শস্য। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হল, এরপর যে গ্রামে এলাম, সেখানে কেউ আমাদের খাবারদাবার দিতে চাইল না। আমাদের দেখে তারা পালিয়ে গেল। আসলে মাজিটুদের আক্রমণ ওদের ভিতু বানিয়ে দিয়েছে।

অভুক্ত অবস্থায় পৌঁছে গেলাম টকোসুসি নদীতে। নম্বোরুমে পাহাড় থেকে এই নদী বেরিয়ে এসেছে। এখন বর্ষার জল পেয়ে ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে। ভাগ্যিস এখানে আমি একটা হরিণ মারতে পারলাম। সামনের পথ বর্ষায় পাঁক তৈরি করেছে। তাঁর মধ্যে দিয়েই এগিয়ে চললাম আমরা। আমার দলের তিনজন পিছিয়ে পড়েছে বর্ষায় আর পথশ্রমে। এদিকে গাইডটাও আর আগে যেতে চাইছে না। নিজের দেশের বাইরের জগৎ তার কাছে একেবারে অচেনা।

খাবার না পেয়ে লোয়াঙ্গা নদী পেরলাম বাধ্য হয়ে। সে বড়ো গভীর নদী। বৃষ্টিতে আরও উত্তাল হয়ে উঠেছে। গভীর নদীর তলদেশ বালুকাময়। দুই পাড়েও বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি। ঝোপঝাড়ে ভরা জঙ্গল দিয়ে পথ চলতে লাগলাম। সঙ্গে কোনও পথপ্রদর্শক নেই। শুধু যন্ত্রনির্ভর করে পথ চলা। পামাজি নদীতে পৌঁছে গেলাম চলতে চলতে। নদীতে জলহস্তীর আওয়াজ শোনা গেল। এখানে বুনো জন্তুর অভাব নেই, কিন্তু তারা খুবই হিংস্র প্রকৃতির। অতিকষ্টে একটা হরিণ মারলাম, এই হরিণকে এরা বলে সেবুলাস। হরিণ মারার সঙ্গে সঙ্গে একটা স্থানীয় লোক এসে দাবি করল, সে নিজেও একজন শিকারি। ওকে কিছু মাংস দিতে সে আমাদের একটা ঝোরা পার হবার রাস্তা দেখাবে বলল। দূরের এক পাহাড় দেখিয়ে বলল, পামাজি নদী ওখান থেকেই বেরিয়ে এসেছে।

বুকজলে পামাজি নদী পার হয়ে একটা গ্রামে পৌঁছে দেখি কেউ একটা কুঁড়েঘরও আমাদের থাকার জন্য দিল না। এরা সব খুব অসভ্য প্রকৃতির। এখানে তাঁবু খাটানো হল। রাত কাটিয়ে আবার পরদিন হাঁটা শুরু করে পৌঁছলাম মালেঙ্গা গ্রামে। এখানে লোকে যখন দেখল যে আমরা না তো কোনও ক্রীতদাস নিয়ে এসেছি, না কোনও হাতির দাঁতের বোঝা, তখন তারা আমাদের কোনও সাহায্য করতে রাজি হল না। আমাদের তাড়ানোর জন্য ওরা একটা গাইড দিল, যে আমাদের কাসেম্বে গ্রামে যাবার রাস্তা দেখিয়ে দেবে।

এখানে জঙ্গল বেশ ঘন, কিন্তু লম্বা লম্বা গাছের পাতাগুলো একেবারে সোজা, মাটির সঙ্গে সমকোণে সাজানো। তাই গাছের ছায়া ঘন নয়। আবহাওয়া বেশ মনোরম। সেইজন্য নানাধরনের পাখির মেলা গাছে গাছে। বুনো মোরগ, তিতির পাখিই সংখ্যায় বেশি। তবে আরও নানা নাম না জানা পাখির মেলা দেখে বোঝা যায়, এটা এক প্রাকৃতিক পাখিরালয়।

এখানে খাওয়ার জন্য একদানা শস্য না পাওয়া গেলেও মাংসের অভাব নেই। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা একটা শিংওয়ালা কুডু হরিণ মারলাম। পরদিন কাসাম্বে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু আদিবাসীরা আমাদের নিরাশ করল। খাবার দেওয়া তো দূরের কথা, তাড়াতে পারলে বাঁচে। এত সন্দেহের চোখে আমাদের দেখতে লাগল যে স্থানীয় লতাপাতা পর্যন্ত খাওয়ার জন্য তুলতে দিল না। আবার চলা শুরু। দেখা মিলল নিয়ামাজি নদীর সঙ্গে, সে সোজা গিয়ে লয়াঙ্গা নদীতে গিয়ে মিশেছে।

পাহাড়ি পথে উঠে আবার নীচে নামা শুরু হল। তবে পাহাড়ের উচ্চতা খুব কম। নীচে নেমে ঘাসে ঢাকা উপত্যকা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। এখানে ঢালু উপত্যকায় এদিক ওদিক গোল গোল পাথর আর গাছের জীবাশ্ম দেখে বুঝলাম, এখানে কোনও এক সময় এক প্রাচীন হ্রদ ছিল। এরকম পাথর দেখা যায় ভিক্টোরিয়া ফলসের ঠিক নীচে।

খিদেয় সবারই অবস্থা বেশ শোচনীয়। শুধু মাংস খেয়ে আর কত পেট ভরানো যায়! পৌঁছে গেলাম কাভিম্বা। গাছের আড়াল আবডাল থেকে মানুষ আমাদের দিকে নজর রাখছে, বেশ টের পাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর দেখি তারা তির-ধনুক নিয়ে আমাদের মারতে চলে এসেছে। জুলুদের হাতে যেরকম ঢাল দেখা যায়, সেই ঢাল এদের হাতে।

(ক্রমশ)

খেলার পাতায় সমস্ত ধারাবাহিক অভিযান একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s