জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- এভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়) অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)
এই অভিযানের আগের পর্ব- পর্ব ১, পর্ব ২ পর্ব ৩
(ডেভিড লিভিংস্টোন ছিলেন পেশায় ডাক্তার। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন খ্রিস্ট ধর্মযাজকও। লিভিংস্টোন প্রথম আফ্রিকা পাড়ি দেন ১৮৪১ সালে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। আফ্রিকার অবাধ দাস ব্যাবসার বিরোধী ছিলেন তিনি। বেশ কয়েক দশক ধরে আফ্রিকায় অভিযানে যান ডক্টর লিভিংস্টোন। প্রতিটি অভিযানে আফ্রিকার জনজাতি, ভূতত্ত্ব, পরিবেশ খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য লিখে রাখেন নিজের ডায়েরিতে। এই ধারাবাহিকে তাঁর নীলনদের উৎসের খোঁজে যাত্রার গল্প শুনছি আমরা।)
১০ ডিসেম্বর, ১৮৬৬
জাঞ্জিবরের ব্রিটিশ রেসিডেন্ট ডক্টর জি. এডওয়ার্ড স্টুয়ার্ড, লন্ডনে সেক্রেটারি অফ স্টেটস ফর ফরেন অ্যাফেয়ারসকে একটা চাঞ্চল্যকর তথ্যবহুল চিঠি লিখলেন।—
‘মহামহিম, আপনাকে একটি দুঃসংবাদ দিচ্ছি আমার এই চিঠিতে। ডক্টর লিভিংস্টোনের অভিযান থেকে পলাতক কিছু মালবাহক জাঞ্জিবর ফিরে এসে জানিয়েছে যে, ডক্টর লিভিংস্টোন আফ্রিকার অনাবিষ্কৃত জায়গায় অভিযানের একেবারে শেষভাগে এসে জুলু উপজাতির হঠাৎ আক্রমণের শিকার হয়ে মারা গিয়েছেন। লোয়েন্ডে আর রোভুমা নদীর সংযোগস্থলে তাঁর এই মৃত্যু ঘটে। অভিযানে তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে মাত্র কুড়ি জন সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে ছিল। লেক নয়াসার পশ্চিম পাড়ে মাপুন্ডা নামের এক গ্রামে এই ঘটনা ঘটেছে, এমনটাই জানিয়েছে ফিরে আসা লোকগুলো। তাদের কথা অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় না। আক্রমণকারী জুলুদের সঙ্গে অন্য এক উপজাতিও ছিল, যারা তির-ধনুক ব্যবহার করে লড়াই চালায়। একই সঙ্গে জুলুরা তাদের শক্ত ঢাল, তলোয়ার আর কুঠার নিয়ে আক্রমণ করে। ডক্টর লিভিংস্টোনের কাছে নয়-দশজন বন্দুকবাজ ছিল। কিন্তু যখন তারা বিশ্রাম নিচ্ছিল, তখনই আচমকা আক্রমণ হওয়ার ফলে বন্দুকবাজেরা কিছুই করে উঠতে পারেনি। ডক্টর লিভিংস্টোন গুলি চালান আত্মরক্ষা করতে। তাঁর গুলিতে দুজন জুলু মারা যায়। কিন্তু বন্দুকে টোটা ভরার সময় পিছন দিক থেকে জুলুদের অতর্কিত কুঠার আক্রমণে লিভিংস্টোনের শরীর দু-টুকরো হয়ে যায়। মারা যায় আরও চারজন মালবাহক। হিন্দুস্তানের সেপাইদের অনেক আগেই লিভিংস্টোন বরখাস্ত করেন, তাই আক্রমণের সময় তারা তাঁর কোনোরকম সাহায্যে আসেনি।
মালবাহকদের প্রধান আলি মুসা কোনোরকমে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে ঘটনাস্থল থেকে পালায় এবং জাঞ্জিবর ফিরে আসে এক আরব দাস ব্যবসায়ী দলের সঙ্গে। ডক্টর লিভিংস্টোনকে বাঁচাতে না পারার জন্য সে খুব মর্মাহত।’
ডক্টর জি. এডওয়ার্ড স্টুয়ার্ডের লেখা চিঠিতে লিভিংস্টোনের মৃত্যুর সম্ভাব্য সময় ছিল সেপ্টেম্বর, ১৮৬৬। এই খবর লন্ডনের বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হলে সভ্যসমাজের মানুষ হাহাকার করে ওঠে। একজন নির্বিবাদী অনুসন্ধানকারী মানুষের অকস্মাৎ মৃত্যু লন্ডনের উপরমহলকেও নাড়া দেয়। লিভিংস্টোনের একদা আফ্রিকান অভিযানের সঙ্গী ডক্টর ক্রিক আলি মুসাকে বহু জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং তিনি তাঁর রিপোর্টে লিভিংস্টোনের মৃত্যুর ঘটনা যে সন্দেহের অতীত, এমনটাই জানান। কিন্তু আলি মুসার বক্তব্যকে অনেকেই সত্য বলে মেনে নিতে পারেননি, যার মধ্যে ছিলেন আরেক আফ্রিকা বিশেষজ্ঞ স্যার রডেরিক মার্চিসন। তিনি মুসার মিথ্যেবাদী চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তাঁর অনুমানে সায় দেন আফ্রিকার জঙ্গলে পূর্ব অভিযানকারী এক দক্ষ নাবিক ই. ডি. ইয়ং। আরও অনুসন্ধান চালানোর পর বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী বয়ানের ফলে আলি মুসার বর্ণিত কাহিনিকে নেহাত কল্পিত গল্প বলে মনে করতে থাকেন অন্যান্য ব্রিটিশ অফিসাররাও। রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটি এরপর ইয়ংকে দায়িত্ব দেয় আফ্রিকার জঙ্গলে গিয়ে লিভিংস্টোনকে খুঁজে আনতে।
১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে ই. ডি. ইয়ং এক অভিযাত্রী দল নিয়ে জাম্বেসি নদীতে আফ্রিকার অভ্যন্তরে যাত্রা করেন। লেক নয়াসার দক্ষিণে পৌঁছে ইয়ং স্থানীয় লোকের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, কিছুদিন আগেই তারা লেক নয়াসার আশেপাশে এক ইংরেজের ঘোরাঘুরি করার খবর পেয়েছে। আরও অনুসন্ধান করে ইয়ং লিভিংস্টোনের লেখা কিছু চিঠিপত্র হাতে পান বিভিন্ন জায়গা থেকে, যার অনেক চিঠিই মুসার জানানো লিভিংস্টোনের মৃত্যুর সম্ভাব্য তারিখের অনেক পরে লেখা।
কোনও পূর্ব নির্দিষ্ট পথ দিয়ে আফ্রিকা অভিযানে যাননি লিভিংস্টোন। তাই শুধুমাত্র অনুমান আর স্থানীয় উপজাতিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেই ইয়ংকে এগোতে হয়েছিল আফ্রিকার জঙ্গলে লিভিংস্টোনকে খুঁজে বার করতে। কিন্তু ইয়ং ছিলেন জলের মানুষ, এক অভিজ্ঞ নাবিক। তাই প্রবল সাহস নিয়েও ঘন জঙ্গলে আর বেশিদূর অগ্রসর হয়ে লিভিংস্টোনকে খুঁজে বার করতে পারেননি। অভিযান থামিয়ে জাঞ্জিবর ফিরে এসে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ তিনি ব্রিটিশ অধিকর্তাদের হাতে তুলে দিয়ে জোরালো যুক্তি রাখেন যে, ডক্টর লিভিংস্টোন জীবিত এবং আলি মুসার বলা কাহিনি সম্পূর্ণ মিথ্যে।
ইয়ংয়ের অনুসন্ধানের অব্যবহিত পরেই রয়াল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটির কাছে লিভিংস্টোনের লেখা এক চিঠি এসে পৌঁছায়, যার তারিখ ছিল ফেব্রুয়ারি ১৮৬৭। অর্থাৎ মুসার বর্ণিত মৃত্যুর ঘটনার ছয় মাস পর লিভিংস্টোন তাঁর চিঠি লেখেন সোসাইটিকে। এই ঘটনায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় লন্ডনে এবং লিভিংস্টোন বেঁচে আছেন এই খবরে উৎসাহিত হয়ে অনেকেই তাঁকে খুঁজে বার করতে এগিয়ে আসে।
১৮৬৭ সালের শেষভাগে লিভিংস্টোনের একদা পরম বন্ধু রডেরিক মার্চিসন লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় একটি চিঠি লিখে দাবি করেন যে, সেই বছরের শেষেই লিভিংস্টোন তাঁর অভিযান শেষ করে লন্ডন ফিরে আসবেন। তাঁর এই চিঠি মানুষের মনে আশা জাগালেও, ১৮৬৮-র বেশ কয়েক মাস গড়িয়ে গেলেও লিভিংস্টোনের ফিরে আসার কোনও সম্ভাবনা দেখা যায় না।
এর মধ্যে অনেক জল গড়িয়ে যায়, কিন্তু লিভিংস্টোনের কোনও হদিস পাওয়া যায় না। ১৮৬৯ সালের অক্টোবর মাসে টাইমস পত্রিকায় আরও একটি চিঠি ছাপা হয়, যাতে বলা হয়েছিল আরব দাস ব্যবসায়ীর একটি দল উজিজির কাছে ডক্টর লিভিংস্টোনকে দেখেছে। এই খবরে আমেরিকাতেও সংবাদ মাধ্যম নড়েচড়ে বসে। আমেরিকার নিউইয়র্ক হেরাল্ড সংবাদপত্রের সম্পাদক ও মালিক বেনেট হেনরি, সাংবাদিক এম. স্ট্যানলিকে আফ্রিকায় অভিযান চালিয়ে ডক্টর লিভিংস্টোনকে খুঁজে বার করার দায়িত্ব দেন। স্ট্যানলি এর আগে নিউ ইয়র্ক হেরল্ডে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় সাংবাদিকতার কাজ করেছিলেন খুব দক্ষতার সঙ্গে। স্ট্যানলি লিভিংস্টোনকে খুঁজে বার করার দায়িত্ব পেয়ে খুব খুশি হন। কিন্তু এই অভিযানে যেতে স্ট্যানলির দেরি হয়। বেনেটের আদেশে স্ট্যানলি সুয়েজ ক্যানাল ভ্রমণ করতে যান এই প্রজেক্টের যৌক্তিকতা খুঁটিয়ে দেখবার জন্য। এরপর তাঁকে জেরুজালেম পাঠানো হয়। এসবই ছিল আমেরিকা ও ব্রিটেনের রাজনৈতিক রেষারেষির কারণে। বেনেট খুব সম্ভবত ব্রিটেনের সরকারের কানে সুড়সুড়ি দেবার উদ্দেশ্যে স্ট্যানলিকে প্রচুর খরচ দিয়ে আফ্রিকায় পাঠানো স্থির করেন। সে যাই হোক, স্ট্যানলির আফ্রিকা অভিযান শুরু করে এক নতুন অধ্যায়।
স্ট্যানলি যখন আফ্রিকা অভিযানের জন্য জাঞ্জিবর রওনা দিয়েছেন, তখুনি জাঞ্জিবর থেকে স্যার রডেরিক মার্চিসন ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক সহায়তায় লিভিংস্টোনের জন্য এক বিশাল রসদ ভাণ্ডার এবং সাতজন কুলি জোগাড় করে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন উজিজিতে। রসদের মধ্যে ছিল খাবারদাবার, ওষুধ, কাপড় ও পুঁতি। উদ্দেশ্য ছিল, যদি লিভিংস্টোন বেঁচে থাকেন, তবে এই রসদ হাতে পেলে তাঁর লন্ডন ফিরে আসা সহজ হবে।
হেনরি এম. স্ট্যানলির খাতা (১৮৭১ সালের জানুয়ারি মাস)
জাঞ্জিবর একটা নোংরা শহর। পূতিগন্ধময় এই শহরে নিশ্বাস নেওয়া কষ্টসাধ্য। বেনেটের দেওয়া হাজার পাউন্ড অগ্রিম টাকা প্রায় নিঃশেষ। দুনিয়ার এত জায়গা চষে ফেললেও অন্ধকার আফ্রিকা মহাদেশ আমার একেবারে অচেনা। কাজের দায়িত্ব তো নিয়ে ফেলেছি, এখন ভালোয় ভালোয় এই অভিযান শেষ হলে বাঁচি। লিভিংস্টোন লোকটাকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। পাঁচ বছর আগে এই মহাদেশে এসে তারপর তাঁর বেপাত্তা হয়ে দুনিয়া থেকে হারিয়ে যাওয়া একেবারেই মেনে নিতে পারছি না। সবচাইতে ভয়, আফ্রিকার জঙ্গলে ঘনঘন ম্যালেরিয়া আর অন্য কীটপতঙ্গের আক্রমণে জ্বর আসা। সামনে খুব দুর্দিন, কিন্তু অভিযানটা বেশ রোমাঞ্চকর।
আফ্রিকায় ঢুকে পড়ার আগে অনেক প্রস্তুতি নিতে হবে। জিনিসপত্র কেনা, লোকজন জোগাড় করা, নৌকো ভাড়া করা—আরও কত কাজ বাকি।
জাঞ্জিবরে এসেই জ্বরে পড়লাম, এখনও তো আফ্রিকার জঙ্গলে ঢোকা বাকি আছে। অসুস্থ শরীরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে লিভিংস্টোনের জার্নাল, স্পেক আর বার্টনের লেখা বই থেকে শুরু করে ই. ডি. ইয়ংয়ের আফ্রিকা অভিযানের অভিজ্ঞতা, সব শেষ করে ফেললাম।
উদ্দেশ্যহীনভাবে জাঞ্জিবরের রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটাচ্ছি। এখানে হাতির দাঁতের বিশাল কারবার, বিকিকিনির হাট। এছাড়া গাম কোপাল, চামড়া, কাঠ আর ক্রীতদাসও কেনাবেচা হয়। আমেরিকান, ফ্রেঞ্চ, ব্রিটিশ, পর্তুগিজ, আরব—সবরকমের মানুষ চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আফ্রিকান দাসও নানা কাজে লেগে আছে। আর আছে দো-আঁশলা আরবেরা—এরা না ফর্সা, না কালো। ওরা বড়োলোক আরবদের তাঁবেদার। যত রাজ্যের নিষ্ঠুর উপায়ে প্রভুত্ব ফলায় আফ্রিকার কালো মানুষদের উপর।
হিন্দুস্তানি ব্যাবসাদারদের এখানে খুব রমরমা। তাদের পকেটে হাতির দাঁত কেনাবেচার টাকা সবসময় ঝমঝম করে বাজে। মানুষের বসতিগুলোতে সরু সরু গলি, হাওয়া বাতাস খেলে না বলে খুব অস্বাস্থ্যকর। বেশিরভাগ সময় মানুষ বাড়ির রোয়াকগুলোতে ঠাট্টা-তামাশা করে সময় কাটায়।
সমুদ্রের ধারে গেলে নানাধরনের পালতোলা নৌকা আর জাহাজ নজরে আসে। জাহাজগুলোর মাথায় লাগানো নিশান দেখে তাদের দেশ চেনা যায়। সবচাইতে বেশি আমেরিকান জাহাজ, তারপর আছে জার্মান আর ব্রিটিশ। এরা কাপড়, মদ, বারুদ, বন্দুক, তামার তার আর পুঁতি নিয়ে আসে; ফিরে যায় হাতির দাঁত, গাম কোপাল, চামড়া আর ক্রীতদাস নিয়ে। ব্রিটেনে অবশ্য দাসপ্রথা বিলুপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য দেশে এখনও আফ্রিকান কালো মানুষের দর খুব বেশি।
বেনেটের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আরও হাজার পাউন্ড আগাম নিয়ে নিলাম হেরাল্ড থেকে। এবার রসদ জোগাড় করা। আফ্রিকায় পণ্য বিনিময়ের জন্য যে মুদ্রা চলে তা হল পুঁতি, নানা রঙের বিভিন্ন আকারের পুঁতি। এক-এক উপজাতির এক-এক রঙের পুঁতির চাহিদা। কার কী পছন্দ সেইসব খবর নিতে হল আফ্রিকা থেকে সদ্য ফেরত আরব শেখেদের কাছ থেকে। যারা সাদা পুঁতি পছন্দ করে, তাদের লাল বা সবুজ পুঁতি দিলে ছুড়ে ফেলে দেবে।
পুঁতি ছাড়া আরেক মুদ্রার কাজ করে কাপড়। হিসাব কষে তিরিশ হাজার গজ নানাধরনের কাপড় কিনলাম। জানতে পারলাম লেক টাঙ্গানাইকার আশেপাশে শুধু তামার তার বিনিময় মুদ্রা বলে গণ্য হয়। তাই ৩৫০ পাউন্ড তামার তার কিনে ফেললাম। এসবই হল বছর দুয়েক আফ্রিকার পেটে ঘুরে বেড়াবার রসদ।
রসদের পর জড়ো করলাম নৌকো, বন্দুক আর টোটা, শুকনো খাবারদাবার, দড়ি, মাল বইবার জন্য বেশ কয়েকটা গাধা। এরপর কাজ হল বিশ্বাসী লোকজন জোগাড় করা। ক্যাপ্টেন স্পেকের এক বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিল সিডি মুবারক মম্বে। লোকটাকে খুঁজে বার করলাম। পঞ্চাশের কাছাকাছি মম্বে, যাকে লোকে আদর করে বম্বে বলে ডাকে, সে তার কুমিরের মতো সাদা দাঁত বার করে আমার কাছে হাজির।
এককথায় অভিজ্ঞ লোকটা আফ্রিকা অভিযানে আমার সঙ্গী হতে চাইল। লোকটা কাজ চালানোর মতো ইংরেজি জানে দেখলাম। অভিযানে যাবার শর্ত দিল, তাকে জুতসই ইউনিফর্ম আর একটা বন্দুক দিতে হবে। লোকটা নিজেই আরও উনিশটা লোক নিয়ে এল, যাদের সবারই অভিযানে যাবার মতো বেশ শক্তপোক্ত চেহারা। প্রত্যেককে যথেষ্ট গুলি, একটা করে বন্দুক, একটা ধারালো ছুরি দেওয়া হল।
শুরু হল আফ্রিকা অভিযান (ফেব্রুয়ারি, ১৮৭১)
জাঞ্জিবর পৌঁছানোর আঠারো দিন পর লোকলশকর নিয়ে আফ্রিকা অভিযানে রওনা দিলাম বড়ো নৌকোয় চেপে। জাঞ্জিবরের সুলতান বার্ঘাস-এর সঙ্গে দেখা করে খুব ভালো লেগেছিল। তিনি বাগামোয়োতে তাঁর এজেন্টের কাছে আমাদের আফ্রিকা অভিযানের উদ্দেশ্য জানিয়ে সবরকম সাহায্য করার জন্য একটা চিঠি করে দিয়েছেন। বাগামোয়ো থেকে মালবাহক নিতে হবে হেঁটে যাত্রা করার জন্য। আমেরিকান কনসুলেট থেকে বিদায় নিয়ে যাত্রা শুরু হল।
জাঞ্জিবর থেকে বাগামোয়ো মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার সমুদ্রপথ। কিন্তু আমাদের নৌকা পালে হাওয়া না পেয়ে দশ ঘণ্টা লাগিয়ে দিল এই সামান্য পথ পেরোতে। বাগামোয়োতে সমুদ্রসৈকত বড়ো সুন্দর, শৈবাল ঘেরা। এখানে নানা দেশ থেকে আসা মানুষের বাস। অনেক লোক আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে পাড়ে এসে হাজির। সেই দেখে আমার সাথীদের উত্তেজনা একেবারে চরমে।
শহরের পশ্চিম কোনায় একটা বড়োসড়ো বাড়ি ভাড়া নিলাম। তার সামনে তাঁবু খাটানো হল। পিছন দিকে পশুদের জন্য আস্তাবল বানানো হল। রাতের খাবারের জন্য এখানকার পাদ্রি সাহেব তাঁর বাড়িতে নেমন্তন্ন করলেন।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের দুটো গাধা আর একটা বিরাট তারের বান্ডিল হাওয়া হয়ে গিয়েছে। অনেক খোঁজ করে একটা গাধাকে খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু দু-নম্বর গাধা আর তারের বান্ডিলটা পাওয়া গেল না। বোঝা গেল সমুদ্রের পারেই কেউ সেগুলো চুরি করেছে।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উজিজি রওনা দিতে হবে। কারণ, যদি ডক্টর লিভিংস্টোন জানতে পারেন যে আমি তাকে খুঁজে বার করতে ধাওয়া করেছি, তবে হয়তো আমাকে এড়িয়ে যাবার জন্য অন্য কোথাও চলে যেতে পারেন। লোকটার স্বভাবের এমন হদিস অনেকের কাছ থেকেই পেয়েছি। কিন্তু পায়ে হেঁটে আফ্রিকা ভ্রমণ করতে গেলে মাল বইবার জন্য লোক জোগাড় করতে হবে এখান থেকে।
স্থানীয়রা মাল বাহকদের বলে পাগাজি। এক ব্যাটা আরবকে ধরলাম লোক খুঁজে দিতে। কিন্তু সে বেজায় ধূর্ত। শুধু আমার কাছ থেকে বেশি কমিশন নেবার তালে আছে। আমায় একশো চল্লিশটা পাগাজি দেবে প্রতিশ্রুতি দিয়েও নানা কথায় ঘোরাতে থাকল। এদিকে তুমুল বৃষ্টি নামল বাগামোয়োতে। দিন পনেরো নষ্ট করে আরেকজনকে ধরে-করে কিছু পাগাজি জোগাড় হল।
আমার লোকলশকর থেকে পাঁচটা দল তৈরি হল। একসঙ্গে আফ্রিকায় ঢুকলে ডাকাতিতে লোক আর রসদ, দুইই লোকসান হয়ে যেতে পারে। শেষ দলটার দায়িত্বে থাকলাম আমি নিজে। এই পাঁচটা দলে আমি ছাড়া আরও দুজন শ্বেতাঙ্গ আছে—ফারকুহার আর শ। এরা দুজনেই অতীতে দুর্ধর্ষ নাবিক ছিল।
বাগামোয়োর সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ, সমুদ্রতটের আরামদায়ক স্নান—সব ছেড়ে এগিয়ে চললাম জঙ্গলে। আমার দলে আছে আটাশ জন পাগাজি বা কুলি, দশজন বন্দুকধারী সেপাই, আমার দোভাষী সেলিম। আমাদের দলের সামনে আমেরিকান পতাকা বহন করে নেতৃত্ব দিল ক্যাপ্টেন বম্বে।
একটা গ্রামে আমরা তাঁবু ফেললাম, তার নাম শাম্বা গনেরা, মানে হচ্ছে গনেরার মাঠ। গনেরা হচ্ছেন এখানকার মালকিন—ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তাঁর স্বামী মারা গিয়েছেন। বিশাল এক বাড়িতে থাকেন। চারদিকে যত্ন করা চাষের জমি, সেখানে নানা ফসল ফলেছে। পুঁতি আর কাপড়ের বিনিময়ে গনেরা হাতির দাঁত কেনাবেচা করে প্রচুর টাকাপয়সা করেছেন। তাঁর বাড়ির পিছনে জলাজমিতে হিপোপটেমাসরা জলে গা ডুবোতে আসে। আর আসে নানা জাতের পাখি। বড়ো সুন্দর পরিবেশ।
পরদিন সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। এখানে জমি খুব উর্বর। যেদিকে দু-চোখ যায়, কুমড়ো আর তরমুজ ফলে আছে চারদিকে। স্থানীয় অধিবাসীদের একটা বিশাল দল কাছ থেকে বেজায় কৌতূহল নিয়ে আমাদের দেখতে লাগল। তাদের গায়ে নামমাত্র পোশাক, বোধহয় আদম আর ইভের সম্বিৎ ফেরার পর এর চাইতে বেশি পোশাক ছিল। ওরা আমাদের পোশাক ছুঁয়ে দেখে নিজেদের মধ্যে খুব হাসাহাসি করতে লাগল। এত পোশাক পরে ওদের চোখে আমরা হয়ে গিয়েছি সার্কাসের জোকার।
আর একটু এগোতে বুঝলাম এবার আমরা আসল আফ্রিকাতে ঢুকে পড়েছি। চারদিকে ঘন জঙ্গল। দিনের আলোতেও যেন রাতের অন্ধকার। আমাদের চারপাশ দিয়ে লাল হরিণেরা ছুটে পালাতে লাগল। বড়ো বড়ো বুনো ব্যাঙ লাফিয়ে লাফিয়ে রাস্তা ছেড়ে দিল আমাদের। তারপর এল এক জলাজমি, যাকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। একটু দূরে শক্ত জমি দেখা যাচ্ছে বলে মনে হল, কিন্তু জলাজমিতে এক বুক সমান পাঁকে মানুষ পার হলেও পশুদের পার করানো যাবে না বলেই মনে হয়। তাই ঠিক করলাম গাছ কেটে সাঁকো তৈরি করতে হবে। অস্বাভাবিক দক্ষতায় আমার লোকেরা বড়ো বড়ো গাছ কেটে নামিয়ে সাঁকো তৈরি করল। তার উপর বিছিয়ে দিল ঘাসের আস্তর। নির্বিঘ্নে আমরা জলাজমি পার হলাম একটুও জামাকাপড় নোংরা না করে।
একটা নদী, দুটো জলাভূমি পেরিয়ে, এগারো মাইল পাড়ি দিয়ে যে গ্রামটায় পৌঁছলাম, তার নাম কিকোকা। এখানে সব বাড়িগুলো খড়ের তৈরি। খাল কেটে জল এনে সেচের কাজ হয়, পানীয় জলের জন্য অনেকগুলো কুয়ো দেখতে পেলাম। এই গ্রামের মোড়ল মাগংগা প্রচুর কাপড় হাতানোর তালে ছিল। তাকে শুধু সামনের রাস্তা দেখিয়ে দিতে বলে সামান্য কিছু কাপড় দেওয়া হল।
পরদিন সকাল সকাল আবার পথ চলা শুরু। উঁচুনীচু জমি আর জলা পার হয়ে বিকেল নাগাদ পৌঁছে গেলাম রোসাকো গ্রামে। এখানকার ওয়াগোগো উপজাতির লোকে খুব ধূর্ত হয় শুনেছি। আরবেরা বলেছিল, নানা আছিলায় জিনিসপত্র হাতানোর ফিকিরে থাকে তারা। একেবারে গ্রামের মাঝখানে তাঁবু গাড়া হল। আমার কুকুরগুলো বেঁধে রাখলাম যাতে অনাহূত কেউ আমার তাঁবুতে হঠাৎ ঢুকে পড়তে না পারে। বাইরে সেপাই পাহারা বসালাম। পশুগুলোকে ঘাস খেতে ছেড়ে দেওয়া হল সামনের মাঠে।
চার নম্বর কাফিলাতে তিনজন পাগাজি অসুস্থ হয়ে পড়েছে খবর পেয়ে ছুটতে হল ওষুধের বাক্স নিয়ে। যদিও আমি ডাক্তার নই, তবে আফ্রিকার জঙ্গলে হাতুড়ে ডাক্তার হয়ে যে দায়িত্ব পালন করতে হবে, তা আমার জানা ছিল। ওদের তিনজনেরই ফুসফুসে সংক্রমণ। কিছু ওষুধ দিয়ে ফিরে এলাম তাঁবুতে। মনে হয় কাল থেকে এরা পিছিয়ে পড়বে।
আমরা চললাম যেদিকে, সেই দেশটাকে বলে উনিয়ানইয়েম্বে। যেদিকে দু-চোখ যায়, শুধু সবুজ আর সবুজ, ঘাস আর নানা লতাপাতায় ঢাকা উপত্যকা। সবদিকেই একই দৃশ্য হওয়ার ফলে পথ হারানো বিচিত্র নয়। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে তাঁবু ফেললাম। এখানে চারদিকে কাঁটা ঝোপ। আরেক উৎপাত হল নানারকম পোকামাকড়ের উপদ্রব। একটা মাছি আমার পায়জামার নীচে দিয়ে কখন যে ঢুকে পড়েছে, টের পাইনি। তার সুড়সুড়ি পায়ে টের পেয়ে পাজামা যেই গুটিয়েছি, অমনি সে তার ছুঁচের মতো শুঁড় ঢুকিয়ে আমার শরীর থেকে অনেকটা রক্ত চুষে নিল। ব্যথায় ককিয়ে উঠে মাছিটাকে চেপে ধরলাম। কামড় বসানোর পর আর ব্যথা নেই। এই মাছিটাই কি সেটসি মাছি? ডক্টর লিভিংস্টোন তাঁর জার্নালে সেটসির বিবরণ দিয়েছিলেন। আমি সেই জার্নাল খুলে মিলিয়ে দেখলাম, এই মাছিটা সেটসি হতে পারে না। আমার দলের আফ্রিকান একটা লোক বলল, এই দেশে ওরা মাছিটাকে বলে মাবুঙ্গা। এই মাছিটার কামড় খেলে ঘোড়াও অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাই এর নাম রাখলাম হর্স ফ্লাই।
আমাদের চার নম্বর কাফিলা পিছিয়ে পড়েছে, আর তাদের মধ্যে বেশ কিছু লোক অসুস্থ, তাই এই ক্যাম্পেই ওদের জন্য অপেক্ষা করা ঠিক মনে করলাম। সময় কাটানোর জন্য ঠিক হল, আমি একাই শিকারে যাব। এদিকে শিকার-টিকার আমার খুব বেশি আসে না। পার্সিয়াতে অনেক শিকারে গিয়েছি ঠিকই, কিন্তু এবার শিকারে গেলে খালি হাতেই ক্যাম্পে ফিরে আসতে হতে পারে মনে হল। ভাগ্যপরীক্ষার জন্য রওনা দিলাম।
লম্বা লম্বা ঘাসের জঙ্গল পেরিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পৌঁছলাম। সামনে গভীর জঙ্গল, জঙ্গল চিরে একটা জলাশয়। কতক্ষণ যে ঘোরাঘুরি করেছি জানি না, হঠাৎ জলাশয়ের ধারে একটা হরিণ দেখতে পেয়ে তার পিছু নিলাম চুপিচুপি। জঙ্গলের ভিতর কখনও তাকে দেখা যাচ্ছে, কখনও আবার সে হারিয়ে যাচ্ছে। বন্দুক তাক করে রেখে কতদূর চলে এসেছি জানি না, ঝুপ করে যেন অন্ধকার নেমে এল। সর্বনাশ! সন্ধে হয়ে এসেছে কখন টের পাইনি। হরিণটাকে শুধু যে হারিয়ে ফেললাম তাই নয়, এবার ক্যাম্পে ফেরার পথটাও হারাল।
জঙ্গলের মধ্যে দিশাহারা হয়ে পকেট কম্পাস বার করে দিকনির্ণয় করে ফেরার চেষ্টা করতে লাগলাম। হঠাৎ কাঁটাঝোপে আটকে আমার ফ্লানেলের পাজামার একদিকটা গেল ছিঁড়ে। উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম; টুপিটা কোথায় ছিটকে গেল দেখতেও পাওয়া গেল না। কাঁটাঝোপে পড়ে গিয়ে মুখ আর হাত-পা কেটে রক্ত বেরোতে লাগল গলগল করে। সঙ্গে কাঁটার বিষের জ্বালা। একটু পরে মাথা স্থির করে কম্পাস দিয়ে পথ খুঁজে হাঁটতে হাঁটতে দেখি কখন যেন ক্যাম্পের সামনে এসে গিয়েছি। লোকজন ততক্ষণে আমাকে খুঁজতে বেরিয়েছে, সবাই উদ্বিগ্ন। ঠিক করলাম, এরপর থেকে আর কখনও আফ্রিকার জঙ্গলে একা শিকার করতে যাবার দুঃসাহস দেখাব না।
দু-দিন পরও চার নম্বর কাফিলার দেখা নেই। কাফিলার অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন বম্বে বলল, এখানে বসে না থেকে বরং ক্যাম্প গুটিয়ে নিয়ে কিঙ্গারু গ্রামে চলে যাওয়া ভালো। সেটা মাত্র পাঁচ মাইল দূরেই। এই জায়গাটা ছেড়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করলাম। এবড়ো-খেবড়ো রুক্ষ জমি পেরিয়ে হঠাৎ নজরে এল একটা জঙ্গলে ঢাকা উপত্যকা, ঠিক যেন চারদিকে উঁচু জমির মাঝে একটা বাটি বসিয়ে দিয়েছে কেউ। নীচে নামতে নামতে লক্ষ করলাম জায়গায় জায়গায় জল জমে আছে, ছোটোবড়ো জলাশয় চারদিকে।
বম্বে জানাল, এখানে মশার অত্যাচার খুব। ম্যালেরিয়ার প্রবল প্রকোপ। ক্যাম্প পাতা হয়ে গেলেই শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। জিনিসপত্র ভিজে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে রাতের ঘুমের বারোটা বেজে গেল সবার। ভোররাতে বৃষ্টি ধরে আসতে দলে দলে আফ্রিকার কালো মানুষেরা পিলপিল করে আমাদের ঘিরে ধরল। তাদের দলনেতা এসে কাপড় দাবি করে বসল। আবার কাপড়ের বিনিময়ে সে কোনও খাদ্য দিতে পারবে না বলে জানাল। লোকটা সাংঘাতিক ধূর্ত। আমার কাছ থেকে কাপড় হাতাবে বলে চাটুকারিতা শুরু করে দিল। বিরক্ত হয়ে ওকে বিদেয় করার জন্য এক গজ কাপড় দিলাম।
সকালের দিকে একটা খারাপ খবর শোনাল বম্বে। জাঞ্জিবরের সুলতান বার্ঘাস আমাকে একটা আরবি ঘোড়া উপহার দিয়েছিলেন। সেটি আজ সকালেই দেহ রেখেছে। ঘোড়াটার শব ব্যবচ্ছেদ করে তার পেটে প্রচুর অজানা পোকার সংক্রমণ দেখা গেল। তাকে সসম্মানে কবর দিল আমার লোকেরা।
ঘোড়াকে কবর দেওয়া হয়েছে শুনে গ্রামের সেই দলনেতা ছুটে এসে আমার কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসল। আমরা নাকি মৃত ঘোড়াকে কবর দিয়ে এই দেশের মাটি কলুষিত করেছি। দুই গজ কাপড় দিয়ে দিলে নাকি আমাদের পাপস্খালন হতে পারে। শুনেই আমি রেগে গিয়ে ওর সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিলাম। চাপের মুখে হেরে গিয়ে সে বন্ধুত্ব স্বীকার করে নিল। এই বচসার মধ্যেই একজন কুলি এসে জানাল, আমার দ্বিতীয় ঘোড়াটাও দেহ রেখেছে। মনখারাপ হয়ে গেল। দু-দুটো ঘোড়া হারিয়ে দীর্ঘ পথ চলা আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর হবে। বুঝলাম, আফ্রিকার মাটি ঘোড়াদের স্বীকার করে না।
এই বিশ্রী গ্রামের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তিনদিন বসে থেকেও চার নম্বর কাফিলার আসবার লক্ষণ পর্যন্ত দেখা না যেতে খুব অসহিষ্ণু হয়ে পড়লাম। এর মধ্যে একরাতে এক পাগাজি আমাদের আমাদের এক বহু মূল্যবান সরঞ্জাম নিয়ে চম্পট দিল। এর মধ্যে ছিল নৌকার ধাতব যন্ত্রাংশ, যা জুড়ে চটজলদি একটা আস্ত নৌকা বানিয়ে ফেলা যায়। গোদের উপর বিষফোঁড়া হল, যখন আমার কাফিলার একের পর এক লোক ম্যালেরিয়ার জ্বরে কাবু হতে লাগল। পঁচিশ জনের মধ্যে দশজন বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছে না। এই জলা জায়গায় ক্যাম্প পেতে যে কী মারাত্মক ভুল করেছি, এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। আমার সবচাইতে বড়ো ভরসা বম্বে আবার বাতের ব্যথায় কাবু হয়ে পড়ল।
চারদিনের মাথায় চার নম্বর কাফিলা এসে পৌঁছল। আমাদের ক্যাম্প দেখতে পেয়ে তারা শূন্যে গুলি ছুড়ে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকায় রাগে আমার গা জ্বালা করতে লাগল। এসেই তারা দাবি করে বসল, আরও একদিন কিঙ্গারু গ্রামে তাদের বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। ইতিমধ্যে অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গেছে। তাই কঠোর গলায় বললাম, আগামীকাল সকালের মধ্যেই যেন তারা উনিয়ানইয়েম্বেতে রওনা দেয়। আমার কথায় কাজ হল। তারা আমাদের আগেই এগিয়ে গেল উনিয়ানইয়েম্বের দিকে।
পনেরো মাইল দূরে পরবর্তী ক্যাম্প হবে ইম্বিকিতে। সন্ধের মধ্যে সেখানে পৌঁছতেই হবে। কিন্তু বেশ কিছু অসুস্থ পাগাজি আমাদের দল থেকে পিছিয়ে পড়ল। ইম্বিকিতে ক্যাম্প পেতে জানতে পেলাম, পিছিয়ে পড়া এক পাগাজি বিরাট এক কাপড় আর পুঁতির বান্ডিল নিয়ে সরে পড়েছে। তাকে খুঁজে বার করতে দুজন সেপাইকে পাঠালাম।
পরবর্তী যাত্রা এক ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। পথ চলার শুঁড়ি পথ এক ফুট মাত্র চওড়া। একটু এদিক-ওদিক নড়লেই কাঁটাঝোপের আঘাতে সারা শরীর ছড়ে গিয়ে রক্তারক্তি হচ্ছি। মাল বওয়া গাধাগুলো খুব কষ্ট পাচ্ছে। পচা লতাপাতার গন্ধে শ্বাসরোধ হওয়ার উপক্রম। তবে প্রায় নির্বিঘ্নেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলাম আমরা।
গ্রামের নাম মসুয়া। এখানে যে মোড়ল থাকে সে হাবেভাবে একেবারে সাদা চামড়ার ইউরোপিয়ান, শুধু গায়ের রঙটাই যা কালো। সে একটা মোটাসোটা ভেড়া আর এক ধামা জোয়ার আমাদের খাওয়ার জন্য দিয়ে গেল। খাবারের বিনিময়ে তাকে ছয় গজ কাপড় দিলাম। সে খুব উৎসাহ নিয়ে আমাদের রাইফেল আর আমার নিজস্ব রিভলভারের খুঁটিনাটি মনোযোগ সহকারে দেখল।
মোড়ল মশাই তাঁর গ্রামের লোকদের সাদা চামড়ার মানুষদের বুদ্ধি সম্পর্কে একটা সুদীর্ঘ ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, ওয়াসাঙ্গুরা (সাদা চামড়ার মানুষ) যে ওয়াসেনশিদের (কালো মানুষ) চাইতে অনেক বুদ্ধিমান, আমি বলতাম… এবার প্রমাণ পেলে তো! ওদের এই আগুন ছোড়া হাতিয়ারগুলো আমাদের তির-ধনুক আর কুড়ুলের চাইতে অনেক-অনেকগুণ বেশি শক্তি রাখে। বসবাস করার জন্য ওরা যে কাপড়ের বাড়ি বানায়, সেগুলো এত মজবুত আর উৎকৃষ্ট যে, বৃষ্টিতেও ওদের ঘরে জল পড়ে না। ওদের হাতের কব্জিতে বাঁধা ওই যন্ত্রগুলো দিনের সময় বলে দেয়। ওদের গাড়িগুলো দেখো, চার-পাঁচটা মানুষ বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় অনায়াসে।
পরদিন পুরো গ্রামের লোক আমাদের বিদায় জানাতে হাজির হল। হাতে তালি বাজিয়ে তারা আমাদের সম্মান জানাল। এই গ্রাম থেকে ইম্বিকি যাওয়ার রাস্তাটা খুব মসৃণ। সুন্দর উপত্যকার মধ্যে দিয়ে মনোরম যাত্রায় গতদিনের ক্লান্তি উধাও হয়ে গেল। রাস্তায় এক বিশাল ক্রীতদাসের দলের সঙ্গে দেখা হল। কাঠের শৃঙ্খল দিয়ে দাসেরা একত্রে বাঁধা অবস্থায় পথ চলছে। কিন্তু দাস ও দাস ব্যবসায়ী—দুই ধরনের মানুষই আমাদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করল।
সবাই কালো মানুষ—শৃঙ্খল না থাকলে দাসেদের থেকে তাদের মালিকদের আলাদা করে চেনা যেত না। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই ক্রীতদাসেরা সহজভাবে পথ চলছে, যেন তাদের কোনও অভিযোগ নেই কারও প্রতি। আসলে তারা এতটাই সরল সহজ যে, ক্রীতদাস জীবনটা ভাগ্য বলে মনে করে আনন্দে থাকার চেষ্টা।
লিভিংস্টোনের প্রথম খবর (এপ্রিল ১৮৭১)
অনেক পথ পেরিয়ে এবার আমরা যে গ্রামে এসে পৌঁছলাম, তার নাম কিসেমো। এই গ্রামে অনেক মানুষের বাস। পাশাপাশি আরও পাঁচটা গ্রাম আছে। এই গ্রামের তরুণী মেয়েরা সাজতে-গুজতে খুব ভালোবাসে। দেখলাম তারা ভারী ভারী গয়না পরে। গয়নাগুলো তামার তারে পুঁতি গেঁথে বনানো হয়। হাতে-পায়ে তামার তারের প্যাঁচানো রিং পরার চলন আছে। তাদের পোশাকও বেশ জমকালো, রঙিন। কিন্তু মেয়েরা যতই চাকচিক্য বজায় রাখুক, এই গ্রামের পুরুষেরা কিন্তু একেবারে অলংকার-বিহীন এবং তাদের পোশাক নামমাত্র ও মলিন। এর একটা কারণ হতে পারে, সমাজটা এখানে মেয়েরাই পরিচালনা করে।
গ্রামের পিছন দিয়ে একটা নদী বয়ে গিয়েছে, যার জল খুব মিষ্টি। এদিকে একটা কাণ্ড ঘটল। যে পাগাজিটা জিনিসপত্র নিয়ে কেটে পড়েছিল, তাকে বেঁধে নিয়ে এল দুই সেপাই। একেবারে নির্ঘাত মৃত্যু থেকে ফিরে এসেছে ব্যাটা। সেপাইরা জানাল, চুরির মাল নিয়ে সে নাকি এক গ্রামে ঢুকে পড়েছিল আশ্রয়ের জন্য। সেখানে লোকেদের পেশাই হল ডাকাতি। অন্য গ্রামের লোকদের সব লুট করে নিয়ে তাদের মেরে ফেলা ওদের চিরাচরিত প্রথা। মালপত্র কেড়ে নিয়ে পাগাজিটাকে তারা একটা বড়ো গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল মেরে ফেলার জন্য। ঠিক তখুনি দুই সেপাই পাগাজির খোঁজে সেই গ্রামে ঢুকে পড়ে। বন্দুকের ভয়ে ডাকাতেরা পাগাজিটাকে ছেড়ে দেয়। জিনিসপত্র সব ফেরত পাওয়া যায়, কিন্তু পাগাজিটাকে ধরিয়ে দেবার জন্য ওরা পুরস্কার দাবি করে বসে। কাপড়ের বান্ডিল থেকে মাত্র দুই গজ কাপড় দিলেই ওরা তাকে ছেড়ে দেয়।
পাগাজিটা আমার পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চায়। সে বুঝে গেছে আমাদের দল ছেড়ে মালপত্র নিয়ে চম্পট দিলে এই গভীর জঙ্গলে ওর পক্ষে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে উঠবে। কিন্তু আমি বিনা বিচারে ওকে তো কাজে পুনর্বহাল করতে পারি না। তাই কুলি আর সেপাইদের নিয়ে আদালত গঠন করলাম। তারা নিজেদের মধ্যে অনেক পরামর্শ করে রায় দিল, সাহেবের গাধা পেটানোর চাবুকের কয়েক ঘা বসিয়ে তবেই ওকে কাজে বহাল করা হোক। এই শাস্তি দেওয়ার ভার দিলাম আমার দলের ক্যাপ্টেন বম্বের হাতে। চাবুকের ঘা খেয়ে পাগাজিটা খুব একচোট কাঁদল। তারপর কাজে যোগ দিল।
ক্যাম্প গুটিয়ে ফেলা হল একদিন বিশ্রাম নিয়ে। এবারের যাত্রা বড়ো সুখকর। চারদিকে জঙ্গলে ঢাকা নানা উঁচুনীচু পাহাড়। পাহাড়ের মাথা কখনও মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, আবার কখনও সরে গিয়ে নীল আকাশ উঁকি দিচ্ছে। পাহাড় চিরে বেরিয়ে এসেছে উঙ্গেরিগেরি নদী। সেই নদী পার হলাম আমরা হেঁটেই, কারণ জলের গভীরতা খুব কম। কিন্তু নদীর দুই ধারের উর্বর পলিমাটিতে নানা ফল আর শস্য ফলে। শসা আর আখের ক্ষেত পেরিয়ে এগোতে লাগলাম। কলাগাছও এখানে প্রচুর।
হাতির দাঁতের ব্যবসায়ীদের এক দলের সঙ্গে একদিন দেখা। প্রায় তিনশো ভারী ভারী হাতির দাঁত নিয়ে তারা পূর্ব অভিমুখে সমুদ্রের দিকে ফিরছে। দলপতির নাম সালিম বিন রসিদ। আমাকে দেখে সে মহাখুশি। আফ্রিকায় প্রথমবার এসেছি জেনে সে অনেক খাবারদাবার দিল আমার দলের জন্য। সবচাইতে রোমহর্ষক ব্যাপার হল, সে লিভিংস্টোনকে স্বচক্ষে উজিজির আশেপাশে দেখেছে। শুধু যে দেখেছে তাই নয়, তাঁর সান্নিধ্যে দিন পনেরো কাটিয়েওছে। তার কথা অনুযায়ী—লিভিংস্টোন খুব বুড়ো এক মানুষ, যাঁর পাকা দাড়িগোঁফ বেশ লম্বা। কিছুদিন আগেই তিনি দীর্ঘ অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভ করে মারুঙ্গু হয়ে মানিয়েমা যাবার পরিকল্পনা করছিলেন।
উঙ্গেরিগেরি নদীর অববাহিকায় চলতে চলতে হঠাৎই যেন একদিন এক স্বর্গরাজ্যের প্রবেশ করলাম আমরা। পাহাড় থেকে নদীতে বহতা দুই খরস্রোতা জলধারা এক মনোরম উপত্যকা শস্যশ্যামলা করে তুলেছে। সেই উপত্যকায় প্রাচীরে ঘেরা এক অপূর্ব নগরী। আফ্রিকায় এমন নগরীর দেখা পাব, তা কল্পনাতেও আসেনি। এমন নগরী দেখেছি পার্সিয়ায়। এই জায়গার নাম সিম্বামওয়েনি। হাজার খানেক পাথরে তৈরি বাড়ি। অন্তত হাজার পাঁচেক মানুষ এই নগরীতে বাস করে। আফ্রিকান ধাঁচ আছে বাড়ি তৈরির শৈলীতে, যদিও আরব বা পার্সিয়ার শিল্পকলার ছাপ পড়েছে কোথাও কোথাও। সুরক্ষা প্রাচীরও মজবুত পাথরে তৈরি। সেই প্রাচীরের মাঝে বন্দুক চালিয়ে বহিরাগত আক্রমণকারীদের প্রতিহত করার ব্যবস্থাও আছে। চৌকোনা নগরীর চারটে কোনাতেই নজরদারি চালানোর জন্য ওয়াচ টাওয়ার। চারটি প্রবেশ পথে আফ্রিকান সেগুন কাঠের পোক্ত দরজা লাগানো।
এই নগরীর সুলতান এক নারী। তার বাবা কিসাবেংগো কুখ্যাত এক দস্যু ছিল। হত্যা, লুঠপাট আর অপহরণ করে সে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে যায় এই তল্লাটে। জাঞ্জিবরের সুলতানেরও সে বিরাগভাজন হয়ে যায়। নিজেকে ও নিজের দলকে সুরক্ষিত রাখতে সে নগরীকে প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলে। মারা যাওয়ার আগে কিসাবেংগো নিজের একমাত্র মেয়েকে উত্তরাধিকার দিয়ে সুলতান ঘোষণা করে দিয়ে যায়।
নগরীর বাইরে আমরা তাঁবু ফেললাম। কাতারে কাতারে মানুষ আমাদের দেখতে এল, চিৎকার করল, কিন্তু দূর থেকে। তারা আক্রমণ করতে এল না। আমরা প্রাচীরের ধার দিয়ে যখন এগচ্ছিলাম, তারা আমাদের অনুসরণ করে পিছু পিছু এল। আমার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় গালাগালি দিল, নাকি প্রশংসা করল বোঝা গেল না। সুলতান স্বয়ং দেহরক্ষীসহ তির-ধনুক আর ঢাল নিয়ে উদ্ধত মডেলের মতো দাঁড়িয়ে আমাদের দেখতে লাগল।
দু-দিন পর হঠাৎ সারা শরীরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল। আমরা এই অসুখকে ম্যালেরিয়া বললেও আফ্রিকায় এর নাম মুকুঙ্গুরু। প্রথমে ঘুমঘুম ভাব, তারপর শিরদাঁড়া চমকানো ব্যথা। আস্তে আস্তে সেই ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল পাঁজর আর কাঁধে। তারপর সারা শরীর জুড়ে শৈত্যপ্রবাহ, মাথাব্যথা। গাদা গাদা কুইনাইন গিলে মুকুঙ্গুরুর হাত থেকে পরিত্রাণ পেলাম তিনদিনের মাথায়।
জ্বর ছেড়ে গেল, কিন্তু সেদিনই মাদাম সিম্বামওয়েনির দূত এসে হাজির আমার তাঁবুতে। সুলতানা বলে পাঠিয়েছেন, এই দেশে কোনও মুসুঙ্গু এলে সুলতানাকে নজরানা পাঠানো নাকি রীতি। আগেই খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম আমাদের আগের কাফিলার দায়িত্বে থাকা ফারকুহার সুলতানাকে একটা দামি উপঢৌকন দিয়েছে। তাই আমি বললাম, আমাদের রীতি হল, একই দলের একজন মাত্র মুসুঙ্গা উপঢৌকন দেবে। শুনে অসন্তুষ্ট হয়ে লোকটা চলে গেল।
উঙ্গেরিগেরি নদীর অববাহিকায় উগোগোর দিকে এগোনো মুশকিল হয়ে গেল। বর্ষা শেষে নদী এখন প্রবল বেগে বয়ে চলেছে। নৌকা তৈরি করে মালপত্র আর গাধাদের নিয়ে পার হওয়া সম্ভব নয় বলেই মনে হল। এখানেই নদীর ধারে ক্যাম্প ফেলা হল। এত চওড়া নদীতে বর্ষার সময় সেতু তৈরি করাও সম্ভব নয়। আশেপাশের সমস্ত পাহাড় ধুয়ে জলরাশি নেমে এসে বয়ে চলেছে নদী দিয়ে। বিপদ একসঙ্গে আসে না—প্রবল বর্ষণ শুরু হল, সঙ্গে কুয়াশা। পাগাজিরা জানাল, এই বৃষ্টি শেষ হতে হপ্তা তিনেক লেগে যেতে পারে। আমার আত্মবিশ্বাস একেবারে তলানিতে ঠেকল। নানাধরনের পিঁপড়ের উৎপাতে তাঁবুর ভিতরে টেকা দায়। ম্যালেরিয়ার মশার আতঙ্ক তো আছেই, সঙ্গে জুটল মৌমাছির আক্রমণ—কাটলে একেবারে বিছের কামড়ের মতো জ্বালা ধরে।
বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই দেখে এ-পাড় থেকে ও-পাড়ে গাছে দড়ি বেঁধে ঝোলায় মালপত্র পাঠানো হল। অনেকটা সার্কাসে ট্রাপিজের খেলা দেখানোর মতো। তবে আমার পাগাজিরা বেশ দক্ষতার সঙ্গে কাজটা করে ফেলল। জামাকাপড় আর মালপত্র ভিজে একশা। সেইসব শুকিয়ে নিয়ে আবার রওনা দিতে অনেক সময় লেগে গেল। বৃষ্টি থামল দু-চারদিন পর। আবার শুরু হল যাত্রা।
প্রথম প্রথম যাত্রা সুখকর হলেও ক্রমশ আমাদের চলার পথ কর্দমাক্ত হতে থাকল। নদীর অববাহিকায় পলিমাটি নরম হয়ে কোথাও কোথাও বুক সমান পাঁক, এড়ানোর উপায় নেই। ঘণ্টায় মাত্র এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া যাচ্ছে। পশুদের টেনে নিয়ে যাওয়া আরও দুষ্কর হয়ে উঠল। বম্বে তার দলবল নিয়ে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিল। সে আর আসে না। একজায়গায় আমরা কোনোমতে ক্যাম্প পাতার মতো জায়গা পেলাম। গভীর রাতে বম্বে গাড়ি নিয়ে ফিরে এল। কিন্তু সে নাকি বিরাট এক পুঁটুলি হারিয়ে ফেলেছে, তাই একবারে হাউহাউ করে কান্না জুড়ে দিল। সেই পুঁটুলিতে কাপড় আর পুঁতিই নয়, আমেরিকান কুঠার, জামাকাপড়, পিস্তল আর বারুদও ছিল। ভীষণ রেগে গিয়ে ক্যাপ্টেন পদ থেকে বম্বেকে সরিয়ে দিলাম।
পরদিন বম্বে আর দুটো কুলিকে পাঠালাম হারানো মাল খুঁজে আনবার জন্য। কাপড় বা পুঁতির শোক সামলানো গেলেও হারিয়ে যাওয়া আমেরিকান হাতুড়িটা যেন আমার বুকেই বাজতে লাগল। ওটা ছাড়া যন্ত্রাংশ লাগিয়ে নৌকো বানানো বেশ মুশকিল হবে।
এদিকে খাবারে টান পড়ল। কাছের এক গ্রাম থেকে একগজ কাপড় দিয়ে এক ধামা বাজরা জোগাড় করতে পারল আমার লোকেরা। শিকার করার মতো কোনও পশু ধারেকাছে নেই। কয়েকটা বুনো পাখি ধরার চেষ্টা করলাম। দু-দিন অনেক গুলি খরচ করে মাত্র গুটিকতক পায়রা আর কোয়েল মারা গেল। সেই মাংস এতগুলো মানুষের জন্য খুবই কম।
কয়েকজন পাগাজি বেঁকে বসল, তারা নাকি আর এগোতে পারবে না। কাদা-জল পার হতে হতে তারা মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে। রাত কেটে গেলেও বম্বের আর তার দলের ফেরার নামগন্ধ নেই দেখে আবার আমরা ক্যাম্প গুটিয়ে এগোতে লাগলাম। পাথুরে জমিতে মাইল খানেক হাঁটার পর দেখি সামনে লম্বা লম্বা ঘাস আর বাঁশবন। আবার সেই বিস্তীর্ণ জলাভূমি। পাগাজিরা অনেকেই নেই বলে নিজেই ছোটো দল নিয়ে মালপত্র টানতে শুরু করলাম। গাধাগুলো আর এগোতেই চায় না, যেন ওদের পায়ে শিকড় গজিয়েছে। আবার বুক সমান জল আর কাদা ঠেলে এগোনো। ভাগ্য ভালো, অনেকের জ্বর এলেও আমার গা ঠান্ডা। কিন্তু ছ’ঘণ্টা জল-কাদা ঠেলে একেবারে আধমরা হয়ে গেলাম।
এরপর এল কুখ্যাত মাকাতা নদী আর তার অববাহিকা। নদী পার হতে পাঁচ ঘণ্টা লেগে গেল। একের পর এক ছোটো ছোটো নালা আর নদী পার হতে গিয়ে প্রতিবার মাল নামানো আর মাল তোলা, এতেই সব শক্তি আর সময় ফুরিয়ে যায়। আবার আকাশ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে; ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল।
বৃষ্টি থেমে গেল হঠাৎ, কিন্তু জলাভূমির যেন আর শেষ নেই। একের পর এক গাধা মারা যেতে লাগল। মাত্র পাঁচটা গাধা একেবারে রুগ্ন অবস্থায় ধুঁকছে। একদল পাগাজি একদিন একটা উঁচু জমিতে জড়ো হয়ে চেঁচিয়ে প্রতিবাদ জানাতে লাগল, তারা আর জল ঠেলে এগোতে পারছে না, তাদের বিদায় দিতে হবে। এর মধ্যে আমি নিজেই আমাশার শিকার হলাম। ক্লোরোডাইনের শিশি উপুড় করে গলায় ঢালা শুরু করলাম।
তিনদিনের মাথায় একটু সুস্থ বোধ করে আবার চলতে লাগলাম। সামনে পাহাড়ি উঁচু জমি শুরু হতে দেখে ভরসা হল। অনেকদিন পর শক্ত জমি পেয়ে আমার সাথীরাও একটু হালে পানি পেল বলে মনে হল। কিছু দূর এগোতে নজরে এল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে একটা ছোট্ট গ্রাম।
গ্রামের নাম রেহেনেকো। শক্ত মাটির দেওয়াল ঘেরা শান্ত গ্রামটিতে কুঁড়েঘরগুলো শঙ্কু আকৃতির। গোল করে বাঁশের খাঁচা বানিয়ে তার উপর খড় দিয়ে বানানো ছাদ। গ্রামের ধার ঘেঁষে বয়ে গিয়েছে একটা ছোট্ট নদী—কী পরিষ্কার তার জল! এখানে পাহাড়ের গায়ে সুন্দর সুন্দর সব গাছ, যার কাঠ দিয়ে দুর্দান্ত সব আসবাব তৈরি হতে পারে। গ্রামের চারদিকে বাঁশের জঙ্গল, অনেক বাড়িঘর বানাবার কাঁচামাল জোগান দিতে পারে।
দু-দিন বিশ্রামের পর পাহাড়ে চড়া শুরু হল। পাহাড়ের গায়ে পাথর চিরে সুন্দর সব ঝরনা প্রবল বেগে নীচে মাতাকা উপত্যকার দিকে ছুটে যাচ্ছে। উঁচু থেকে পুরো উপত্যকা দেখতে দেখতে আমি জলাভূমি পার হওয়ার বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা মনে করে শিউরে উঠছি। এখনও যে বেঁচে আছি, সেটাই বিস্ময়।
হিসাবমতো বাগামোয়ো থেকে এখানে পৌঁছতে যা সময় লাগার কথা ছিল, তার চাইতে অনেক বেশি সময় লেগেছে। এর কারণ, বর্ষা আর আমার চতুর্থ কাফিলার গড়িমসি চাল। হপ্তা খানেক মার্চ করে, অনেক পাহাড় পর্বত, উপত্যকা, নদীনালা পেরিয়ে একটা ছোট্ট পাহাড়ঘেরা উপত্যকায় এসে পৌঁছলাম। এর মাঝ দিয়ে ছোট্ট একটা নদী বয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন স্পেক আগেই এই উপত্যকার এসেছিলেন, নদীটির নাম মুকুন্ডকোয়া।
নদী পার হয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম কিওরা গ্রামে। বড়ো নোংরা সেই গ্রাম। ভ্যাপসা গরমে এখানে জমিতে পচে উঠেছে লতাপাতা আর ছাগলের নাদি। চারদিকে মাছি উড়ে বেড়াচ্ছে। আপাতত এখানেই তাঁবু গাড়তে হবে।
হঠাৎ শুনতে পেলাম, এখানে আমার তিন নম্বর কাফিলা অনেক আগে থেকেই আস্তানা গেড়ে বসে আছে। কাফিলার দলনেতা ফারকুহার নাকি খুব অসুস্থ। তাদের এতদিনে উজিজি পৌঁছে যাবার কথা ছিল। খুব বিরক্ত হলাম। চারজনের কাঁধে চেপে ফারকুহার আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। তার পায়ে গোদ হয়েছে। সামনে এগোনো তো দূরের কথা, হাঁটাচলা করাও তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এই রোগের কোনও ওষুধ আমার জানা নেই। সামনের অজানা পথে গাধায় টানা গাড়িতে বসিয়ে একে নিয়ে চলা আরেক বিপদ টেনে আনা, কারণ আদৌ সেই পথে চার চাকা লাগানো গাড়ি চালানো যাবে কি না সন্দেহ। এই গ্রামেই তাই ফারকুহারকে ফেলে যেতে হল। হয়তো লোকটা বিনা চিকিৎসায় এখানেই মারা যাবে।
উগোগোর পথে (মে, ১৮৭১)
তিন নম্বর কাফিলার সঙ্গে আমার পাঁচ নম্বর কফিলা জুড়ে দিয়ে ফারকুহারকে কিওরা গ্রামে ফেলে রেখে আমরা উগোগোর দিকে রওনা দিলাম। আমাদের সঙ্গে আরও দুটো আরব ব্যবসায়ী দল জুড়ে গেল। দল যত ভারী হবে এই রাস্তায় তত সুবিধে, কারণ সামনের গ্রামগুলোর বাসিন্দারা নাকি খুব হিংস্র প্রকৃতির আর ডাকাতি করাই তাদের পেশা।
মপোয়া পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে চুনিও নদী। আমরা সেই নদীর ধার ঘেঁষে এগোতে লাগলাম। চুনিও নদীর জল ভয়ংকর দুষিত। এই জল খেয়ে আমার গাধারা অসুস্থ হয়ে পড়ল। অথচ আরব আর স্থানীয় লোকেরা এই নদীর জল খেতে ভয় পায় না। জলের গন্ধ শুঁকে মনে হল নাইট্রাস লবণ এই জলে মিশেছে। দেখি শুকনো পাথুরে পাহাড় থেকে ধ্বস নেমে নদীর জল দূষিত হয়ে চলেছে।
ন’টার মধ্যে পাঁচটা গাধা মারা গেল। এ যে কত বড়ো ক্ষতি, বলে বোঝানো যাবে না। আগামী দিনে মাল বয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।
চুনিও নদী ছাড়িয়ে চললাম উগোগোর দিকে। এক ফোঁটা খাওয়ার জল পাওয়া গেল না পথে। প্রায় দুশো লোকের বিরাট এক কাফিলার জন্য এটা খুব দুঃসময়। জলতেষ্টায় আমাদের ছাতি ফেটে যাবার জোগাড়। এদিকে শরীর জুড়ে জ্বর আসবার লক্ষণ টের পাচ্ছি। একটাও গ্রাম চোখে পড়ছে না যেখানে বিশ্রাম নেওয়া যাবে বা পাওয়া যাবে সবার জন্য খাবার।
আচ্ছন্ন শরীর নিয়ে গাধার পিঠে বসে যাত্রা করা আর সম্ভব হল না। গাধার পিঠ থেকে গড়িয়ে পড়ে গিয়ে শেষে কী একটা কাণ্ড ঘটাব। তাই দুজন কুলির কাঁধে চড়ে বসতে হল উপায়ন্তর না দেখে। তৃণভূমি থেকে হঠাৎ ফসলি জমি নজরে পড়ল। জোয়ারের ক্ষেত দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম, একটা গ্রাম নিশ্চয়ই এবার পেয়ে যাব।
উগোগো পৌঁছে গেলাম। এক বৃদ্ধ ওয়াগোগো আমাকে দেখে ‘ইয়াম্বো, মুসুঙ্গু… মুসুঙ্গু’ বলে বিস্ফারিত চোখে আমায় দেখতে দেখতে চেঁচিয়ে উঠে হইচই ফেলে দিল। মাথায় টুপি, সাদা ফ্লানেলের পোশাক পরা এই জোকারটাকে দেখতে দলে দলে লোক জুটে গেল, যাদের শরীরে একটুকরো কাপড় নেই।
ওয়াগোগোদের লাফালাফি আর চিৎকার বেশ ভীতিপ্রদ। আমার সাথী দুই আরবের একজন শেখ থানি আমার কানে কানে বলল, “এরা খুব হিংস্র, কাছে এলে কামড়েও দিতে পারে।”
আমার দলের পাগাজিরা ওদের ভাগানোর জন্য চিৎকার করতে লাগল। সেই শুনে ওরা আরও ক্ষেপে গেল। জানলাম ওরা বলছে, “তোরা চুপ কর। আমরা এই প্রথম একটা মুসুঙ্গু দেখছি। আমাদের বুঝে নিতে দে। তোরা তোদের কাজ কর।”
লোকগুলো আমাদের বন্দুক দেখে ঘাবড়ে গেল। বন্দুকের দুই-একটা ফাঁকা আওয়াজ করতেই তারা পালিয়ে গিয়ে দূর থেকে আমাদের দেখতে লাগল। শেখ থানি বলল, “এখানকার সুলতান বড়ো লোভী। ওই উঁচু পাহাড়টাতে ঘর বেঁধে থাকে। লোকটার শুধু কাপড়ের খাঁই।”
উগোগোতে খুব ফসল ফলে। নানাধরনের শস্য আর ফলই নয়, এখানে পাওয়া গেল মধু, মিষ্টি, টক, বাদাম, ঘি, আরও কত কী! অবশ্য খাবারের বিনিময়ে অনেক কাপড় আর পুঁতি খসাতে হল। তবে সওদা মন্দ হল না। এখানে চাষাবাদ বাগামোয়ো থেকেও উৎকৃষ্ট।
উগোগোর সুলতান আমার কাছে চল্লিশ গজ কাপড় চেয়ে বসল আর দুই আরবের কাছে বারো গজ করে। আমাদের দলের দিকে ইশারা করে বলল, “এত পতাকা, তাঁবু, লোকলশকর নিয়ে যে মুসুঙ্গু মিছিল করে চলেছে, সে তো বেজায় বড়োলোক। তার কাছে এটুকু দাবি করতে পারব না? এর চাইতে কম কাপড়ে কাজ হবে না।”
ভয়ংকর রেগে গিয়ে ভাবলাম বলে দিই, একটুকরো কাপড়ও দেব না। থানি আমাকে সাবধান করে বলল, তার চাইতে দরাদরি করে কাপড়ের পরিমাণ কমিয়ে আনাই শ্রেয়, কারণ এদের কোপে পড়লে সব সম্পদ লুঠ হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। অনেক দূত চালাচালি করে প্রায় অর্ধেক পরিমাণে রফা হল।
উয়াঞ্জির পথে (জুন, ১৮৭১)
উগোগো থেকে একঘেয়ে চড়াই উতরাই পথ বেয়ে, নানা গাঁয়ে মোড়লদের খুশি করে সেখানে আশ্রয় নিয়ে আমরা জুন মাসের মাঝামাঝি পৌঁছলাম মুকোন্ডোকু। এখান থেকে যাত্রা শুরু হবে উয়াঞ্জির দিকে। দুই আরব সাথীর আমাদের কাছ থেকে এখানেই বিদায় নেবার কথা ছিল। কিন্তু এতদিন ধরে একসঙ্গে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তারা বোধহয় আমাদের মায়ায় পড়ে গিয়েছিল। তাই ঠিক হল উয়াঞ্জি পর্যন্ত একসঙ্গেই যাওয়া হবে। পথের দিশা ওদের পাগাজিদের হাতের পাতার মতো চেনা। কিন্তু তাদের মধ্যে মতের মিল আর হয় না। তিনটে রাস্তার মধ্যে একটা বাছতে গিয়ে প্রবল বচসা শুরু হল নিজেদের মধ্যে। আমি নীরব শ্রোতা। অবশেষে স্থির হল, কিটি গ্রাম হয়ে যাওয়াটাই ঠিক হবে, সেটাই নাকি সবাচাইতে নিরাপদ রাস্তা।
আমাদের চলা শুরু হল একটা ছোটো টিলা পার করে। আকাসিয়া কাঁটাঝোপের মধ্যে দিয়ে চলা কষ্টকর ও শ্লথ হতে লাগল। পায়ের নীচের মাটিও রুক্ষ, এবড়ো-খেবড়ো। সরু পথ চলে গেছে টিলার উপর। তার মাথা পর্যন্ত পৌঁছতে দু-ঘণ্টার বেশি সময় লেগে গেল। টিলা থেকে নামার পথটা তুলনামূলকভাবে মসৃণ। জঙ্গল আর কতগুলো ঝোরা পার হয়ে নীচে এসে পৌঁছে গেলাম একটা ছোট্ট গ্রামে, তার নাম মুনেইকা। এই গ্রামে একটা গভীর ডোবা থেকে পানীয় জল পাওয়া গেল। আহা, এমন বরফ ঠান্ডা পরিষ্কার জল বহুদিন খাইনি। জল খেয়ে আমাদের দলের লোকদের মুডই বদলে গেল, পথশ্রমের ক্লান্তি দূর হল এক লহমায়।
জানতে পারলাম এই গ্রাম উয়াঞ্জির একেবারে সীমান্তে। উয়াঞ্জিকে স্থানীয় লোকেরা বলে মাগুন্ডা মালি, যার অর্থ হল গরম ভূমি। জায়গাটা সত্যিই একটু বেশি গরম, কিন্তু দলের সবাই বেশ খুশি মনে পথ পার হতে লাগল। আফ্রিকাতে অনেক জায়গাতেই মানুষ খুব ভালো, অচেনা হলেও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। অনেক দেশের জনাকীর্ণ এলাকার মানুষদের থেকে এরা ঢের ভালো। পিছনে ফেলে আসা উগোগো মোটেই ভালো জায়গা নয়, ভালো নয় সেখানকার মানুষজনও। যে-দেশে অমন লোভী সুলতান বাস করে সেখানে মানুষ খারাপ হলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না।
মুনেইকা ছেড়ে আরও এগোতে দৃশ্যপট বদলে গেল। যেন ছবির মতো সব সাজানো। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, মধ্যযুগের ইল্যান্ডের কোনও শহরতলির মধ্যে দিয়ে চলেছি। বাগামায়ো ছেড়ে আসার পর এমন দৃশ্য চোখে পড়েনি।
বিকেল পর্যন্ত হাঁটা না থামিয়ে তাঁবু ফেলা হল। কিন্তু রাত একটা বাজতেই আমার আরব সঙ্গী শেখ হামেদ শিঙা ফুঁকে দিল পথচলা শুরু করার জন্য। মনে হল লোকটা পাগল হয়ে গেছে, নইলে শিশির ঝরা এক মনোরম রাতে সবার ঘুম ভাঙাতে গেল কেন লোকটা? সবাই চূড়ান্ত ক্ষেপে গেল। কিন্তু পদযাত্রা শুরু হল অখণ্ড নীরবতার মধ্যে দিয়ে। ভোর তিনটেয় আমরা পৌঁছে গেলাম উনিয়াম্বোগি গ্রামে। সবাই আবার মালপত্র নামিয়ে গ্রামের পাশেই ঘুমিয়ে পড়ল বিশ্রাম নিতে। সকালের আলো ফুটলে না জানি কী লেখা আছে কপালে।
আমার ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। চোখ খুলেই খবর পেলাম, শেখ হামেদ আমাদের জন্য অপেক্ষা না করে তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে কিটি গ্রামের দিকে হাঁটা দিয়েছে। বেজায় চটে গেলাম। শেখ থানিও তার বন্ধুর ব্যবহারে অখুশি। আমাকে জানাল, উনিয়াম্বোগি গ্রামে খাবারের অভাব নেই, আর সে-সব বেজায় সস্তা। মনে আশা জোটালাম, তাহলে অবশেষে এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছি, যেখানে খাবারের অভাবে অভুক্ত অবস্থায় মরতে হবে না।
জুন মাসের ১০ তারিখে সাড়ে চার ঘণ্টা মার্চ করে আমরা কিটি গ্রামে এসে পৌঁছলাম। কিন্তু সেখানে এসে শুনলাম শেখ হামেদের অবস্থা শোচনীয়। আগেভাগে এসে পৌঁছতে না পৌঁছতেই তার প্রিয় এক ক্রীতদাসী মারা গেলে সে যায় তার শেষকৃত্য করতে। সেই ফাঁকে তিনটে পাগাজি ওর অত্যন্ত প্রিয় রুপোর কাজ করা একটা জ্যাকেট, তামার প্লেট আর তিন বান্ডিল কাপড় নিয়ে চম্পট দিয়েছে। যাবার সময় ভালোমন্দ খাবারগুলোও সঙ্গে নিয়ে যেতে ছাড়েনি।
কিটি গ্রামে সত্যিই খাবারদাবারের অভাব নেই। মাংস আর শস্য অনেক সস্তায় পাওয়া যায়। এখানে বাস করে ওয়াকিম্বু উপজাতির মানুষেরা। এরা প্রধানত চাষাবাদ আর পশুপালন করে। বেশি যুদ্ধবিগ্রহ বা ডাকাতি করা পছন্দ করে না। ছোটো ছোটো দলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে, কিন্তু নিজেদের মধ্যে তাদের খুব একটা ঐক্য নেই বলেই মনে হল। হঠাৎ বাইরের শত্রু হানা দিলে এরা নাকি লড়াই না করে অন্য জায়গায় গিয়ে আবার নতুন জীবনযাপন করে। অথচ এদের অস্ত্রশস্ত্রের কোনও অভাব নেই, দলবদ্ধ হলে যে-কোনো শত্রুর মোকাবেলা করা খুবই সহজ।
কিটি গ্রাম ছেড়ে আমরা রওনা দিলাম মালালোর দিকে। শেখ হামেদ অনেক চেষ্টা করেও তারা হারানো জিনিসপত্র পেল না। মনখারাপ করে আমাদের সঙ্গেই চলতে লাগল তার দলবল নিয়ে। পথে যা খাবারদাবার পাওয়া গেল অনেক কম দামে সেসব গ্রামবাসীদের কাছ থেকে পাওয়ায় আমার দলের কুলি আর সেনারা বেজায় খুশি। তাছাড়া উনিয়ানিয়েম্বের কাছে এসে গিয়েছি আমরা, যার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি, তাই প্রফুল্ল হবার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি। এবার আমরা আবার চলতে লাগলাম কুসুরি নামের এক জায়গার দিকে, সেখান থেকে যাওয়া হবে উনিয়ানিয়েম্বে। পথে অনেকগুলো গ্রাম গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ছড়িয়ে আছে। অনেক মানুষের বসবাস। ‘মুসুঙ্গু’র (সাদা চামড়ার বিদেশি) আসবার খবর পেয়ে গ্রামবাসীরা দলে দলে এল তাকে চোখের দেখা দেখতে। এমন সাদা চামড়ার আজব মানুষ তারা আগে কোনোদিন দেখেনি।
একটু এগোতে এক বিরাট তাঁবু নজরে এল। শুনলাম, এই তাঁবু গেড়েছে ওমানের এক ব্যবসায়ী সুলতান বিন মহম্মদ। সে আমার আগমনবার্তা পেয়ে আগেই তাঁবুর সামনে কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে আমাকে স্বাগত জানাবে বলে। লোকটি বড়োই মিষ্টভাষী। আমার সঙ্গে দেখা হতেই হেসে অভ্যর্থনা করল। আমার কুশল জিজ্ঞেস করবার পর জাঞ্জিবর আর ওমানের হালহকিকত জেনে নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করে বসল আমার কাছে যথেষ্ট কাপড় আছে কি না জানতে। আরবদের এমন প্রশ্নের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে গেছে এতদিনে। আসলে আফ্রিকা বাস করতে গিয়ে বিন মহম্মদের সংগ্রহে কাপড় কম পড়েছে, এবার ফেরার সময় খাবারদাবার কিনতে কাপড় কম পড়তে পারে। আমিও সোজাসাপটা জবাব দিলাম, “মাত্র এক বেল কাপড় পড়ে আছে আমার কাছে। আপনাকে দেবার মতো যথেষ্ট নেই।”
কুসুরিতে এসে একদিনের বিশ্রাম। সামনে যে পথ যাত্রা করতে হবে, তা জঙ্গলে ঢাকা, আর যথেষ্ট পরিশ্রমসাধ্য সেই পথচলা। এই জঙ্গল আলাদা করেছে উয়াঞ্জি আর উনিয়ানিয়েম্বেকে। এখানে এসে জানতে পারলাম, শেখ থানির যেসব লোকেরা কুসুরিতে বসবাস করছে, তাদের অনেকেই বসন্ত রোগে কাবু। এদিকে আমার দলের পাগাজিরা আরও বিশ্রাম চায় এখানে। কিন্তু মনে হল ছোঁয়াচে বসন্ত রোগের হাত থেকে বাঁচতে হলে কুসুরি যত তাড়াতাড়ি ছেড়ে যাব ততই মঙ্গল।
মঙ্গ টেম্বো নামের একটা পোড়ো জনপদ পড়ল পথে। স্পেক আর বার্টনের বইতে এই জায়গার কথা পড়েছি। একসময়ে খুব বর্ধিষ্ণু ছিল এই জনপদ। এখন শ্মশানভূমি। আরবদের কাফিলা লুট করত বলে তারা গ্রামবাসীদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়, শেষ হয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। এখন যেদিকে তাকাই, শুধু বাড়ি-ঘরদোরের ধ্বংসস্তূপ, তার মাঝে জঙ্গল অবাধে প্রবেশ করেছে।
গরমে চারদিক ঝলসে যাচ্ছে। সূর্য মাথার উপর আগুন ঢালছে। গলা দিয়ে যে জল নামছে, তাতে তৃষ্ণা মিটছে না। ইতিমধ্যে দলের এক পাগাজি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে পথেই বসে রইল। সে মরল নাকি বাঁচল, দেখার সময় কই আমাদের? এগোতে হবে। পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য থেমে গেলে থেমে যাবে আমাদের জীবনও। আমাদের কাফিলা যেন ঝড়ে পড়া কোনও জাহাজ—কে ডেক থেকে পড়ে সমুদ্রে ডুবে গেল সেদিকে দৃকপাত না করে ঝড় এড়াতে জাহাজ শুধু এগিয়ে চলে, চলতেই থাকে।
আমরা উনিয়ামওয়েজি পৌঁছে গেলাম। দূর থেকে দেখা গেল গ্রামবাসীদের চাষের ক্ষেত। তারপর দৃশ্যমান হল একটি দুটি করে কুঁড়েঘর। একেবারে প্রথম গ্রামটাতে এসে একটা লোকের দেখা পেলাম। সে মিস্টার স্পেকের দলে ছিল। বম্বের সঙ্গে ঝগড়া করে দল ছেড়ে দিয়েছিল। এখন এগিয়ে এসে পুরোনো সাথীকে কীভাবে যত্ন করবে ভেবে পায় না। কখনও বম্বেকে শরবত খাওয়ায়, আবার কখনও মধুর বিরাট পাত্র এনে হাতে ধরিয়ে দেয়। বম্বেকে খাইয়ে-দাইয়ে, তার দেখাশুনো করে তবে বাকি পাগাজিদের প্রসাদ জুটল। শত হলেও পাগাজিরা তার দেশোয়ালি ভাইয়া বলে কথা।
আফ্রিকার এই প্রান্তকে ইস্টার্ন তুরাও বলা হয়। এখানে খুব ভালো চাষাবাদ হয়। ভুট্টা, বাজরা, মিষ্টি আলু, শসা, তরমুজ, মটর—কী নেই! এরা পাহাড়ের পাদদেশে পরিখা খুঁড়ে সেখানেই সব ফসল ফলায়। এদের গ্রামগুলো বর্গাকারে বেড়া দিয়ে ঘেরা, এক-একটা এমন গ্রাম আবার অনেকগুলো ভাগে ভাগ করা বেড়া বেঁধে।
সেন্ট্রাল তুরাতে এসে তাঁবু গাড়লাম। এখানে একদিন রাতে আমার তাঁবুতে দুটো চোর ঢুকল। কিন্তু বন্দুকের ভয় দেখিয়ে তাদের তাড়ানো গেল সহজেই। তবে আরেক আরবের তাঁবুতে চোর ঢুকেছিল কাপড়ের লোভে। একজন পাগাজি সতর্ক ছিল। সে রাইফেল তুলে দেগে দিল চোরের বুকে। খুবই খারাপ ব্যাপার হল, লোকটা সেখানেই মরে গেল।
পরদিন যাত্রা শুরু করে পশ্চিম তুরা পার হতেই আবার জঙ্গল শুরু। জঙ্গল পার হতে এসে গেল কাওয়ালা গ্রাম। এখানে বড়ো বড়ো পুকুর কেটে লোকে পাঁকাল মাছ চাষ করে। আমার কপালেও জুটে গেল একটা। পাঁকাল মাছ দিয়ে মধ্যাহ্নভোজটা মন্দ হল না। জায়গাটা আফ্রিকা না হয়ে লন্ডন হলে বোধহয় এমন মাছ ছুঁয়েই দেখতাম না। এখান থেকে বিশ মাইল হেঁটে পৌঁছে গেলাম রুবেকায়। বার্টনের বইতে পড়েছিলাম, এ-জায়গাটা নাকি খুব বর্ধিষ্ণু ছিল। এখন এখানে সার সার পুড়ে যাওয়া গ্রাম। চারদিকে পোড়া কাঠ আর পোড়া মাটি। একসময়ে যে এই জনপদ বেশ ধনী ছিল, একটু লক্ষ করলেই তা বোঝা যায়। এদের ক্ষেতের ফসল পেকে গেছে, কিন্তু কাটবার লোক নেই। ফসলের ক্ষেত জঙ্গলে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। তিন-চারদিন ধরে নাকি এখানে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে আরবেরা। যেসব গ্রামবাসীরা বেঁচে ছিল, তারা পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে।
একটু এগোতে একটা ছোটো গ্রাম পাওয়া গেল, যেখানে কয়েক ঘর ওয়াঙ্গয়ানা উপজাতির বাস। এরা হাতির দাঁত কেনাবেচা করে। এক আরব শেখ এখান থেকে জাঞ্জিবর ফিরছে হাতির দাঁতের বোঝা নিয়ে। সে আমাকে ভালোবেসে এক বস্তা চাল আর আস্ত একটা ভেড়া উপহার দিল। এই উপহার বড়ো মূল্যবান, কারণ অন্তত ছ’গজ কাপড় দিলে তবেই কেনা যেত একটা ভেড়া। মাংস-ভাত খেয়ে, বিশ্রাম নিয়ে আবার চলা।
এবার পৌঁছলাম শিজা শহরে। শহর একে বলা যায়, কারণ আরবদের জিনিসপত্রের বিশাল গুদাম এখানে। খাবারদাবারের অভাব নেই। দলপতি সুলতান আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে ছয় গ্যালন মদ আনিয়ে রেখেছিল। আমার দলের লোকেরা খুব খুশি। সুলতান আমাকে একটা মোটাসোটা ষাঁড় উপহার দিল। সঙ্গে-সঙ্গেই পশুটাকে কেটে বনভোজন শুরু করে দিল পাগাজিরা।
আমরা উনিয়ানিয়াম্বে পৌঁছে গিয়েছি। এইখান থেকে পাগাজিদের বিদায় দেওয়া হবে। তারা তাদের সবচাইতে প্রিয় পরিষ্কার পোশাক পরে বিদায়ী উৎসবে মাতল। আমার বন্দুকধারী সৈনিকরা আকাশের দিকে গুলি ছুড়ে পাগাজিদের বিদায় জানাল। বন্দুক দাগতে দাগতে আমার কাফিলা কুইকুরুতে পৌঁছল। দূর থেকে সার বেঁধে দাঁড়ানো মানুষ দেখতে পেলাম। পতাকা উঁচিয়ে, কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে, শিঙ্গা ফুঁকে, বন্দুক থেকে ঘনঘন গুলি ছুড়তে লাগল আমার সিপাইরা। আজ আনন্দের দিন তো বটেই। বন্দর ছাড়ার পর একশো আটাত্তর মাইল পথ পেরলাম ষোলো দিনে, আমাদের অগ্রগতি মন্দ নয়। আরব শেখ সইদ বিন সালিম আমাকে দুই হাত বাড়িয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল। আমিও আমার বন্ধুত্বপূর্ণ হাত বাড়িয়ে দিলাম শেখের দিকে। আমার দল মিশে গেল শেখের দলের সঙ্গে। আফ্রিকা অভিযানের একটা পর্ব শেষ হল।